আরশিনগরের অসভ্য লোকটা
এক
বলব না বলব না করেও শেষ পর্যন্ত লোকটার কথা নন্দিনীকে বলে ফেললাম।
লোকটাকে আমি গত তিনদিন ধরে লক্ষ্য করছি। সবসময় চোরের মতো আড়চোখে তাকিয়ে রয়েছে। প্রথম-প্রথম ভাবতাম, লোকটা বুঝি লুকিয়ে-চুরিয়ে আমাকে দ্যাখে। কিন্তু এই তিনদিনেই বুঝেছি, তা, আমাকে না—লোকটা লুকিয়ে-লুকিয়ে নন্দিনীকেই দেখার চেষ্টা করে।
অবশ্য সবসময় যে দ্যাখে তা নয়। লুকিয়ে দেখার জন্যে ও ঠিক মোক্ষম মুহুর্তগুলোই বেছে নেয়। যেমন, নন্দিনী বাথরুম থেকে স্নান সেরে ঘরে এলেই লোকটা তৈরি হয়ে যায়। ওর চোখের মণি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। গলার শিরা ফুলে ওঠে। ফরসা মুখে রক্তের ফোয়ারা ছোটে। সব মিলিয়ে লালসা মাখানো কামুকনজরে ও চোখ বড়-বড় করে নন্দিনীকে দেখতে থাকে। কারণ ও জানে, এক্ষুনি নন্দিনী কাপড় ছাড়বে। তারপর…ওঃ, অসহ্য!
আর নন্দিনীকেও বলিহারি যাই! জানি, সুন্দর করে সাজানো অ্যাটাচড বাথওয়ালা এই মাঝারি ফ্ল্যাট একেবারে আমাদের নিজের। বাথরুম থেকে স্নান সেরে নন্দিনী খালি গায়ে বেরোলেই-বা কে দেখতে পাবে—আমি ছাড়া! তখন ওর ফরসা গায়ে, বুকে, চুলে জলের ফোঁটা আটকে থাকে। এমনকী নাকের ডগায়, চোখের পাতায়, অথবা ঠোঁটেও ছুঁয়ে থাকে জলবিন্দু। তখন আমার তো আর মাথার ঠিক থাকে না, তাই ওকে জাপটে ধরে ঠোঁট দিয়ে সারা শরীরের জলের ফোঁটা মুছে নিই। আর স্পষ্ট বুঝতে পারি, কেন জলের আর-এক নাম জীবন। কারণ, ওই সময়ে নন্দিনীকে আদর করতে না-পারলে আমি মরে যেতাম।
বিয়ের পর তিনটে বছর দারুণ কেটে গিয়েছিল। দিনে বা রাতে আমাদের ভালোবাসায় কোনও হেরফের হত না। মনে হত, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমাদের ভালোবাসা যেমন ছিল, এখন তারই অ্যাকশান রিপ্লে চলছে। তা-ই চলত—যদি না মাঝখান থেকে ওই অসভ্য লোকটা এসে দেখা দিত।
ভোরবেলা নন্দিনী যখন বিছানা ছেড়ে ওঠে তখন সে এক দেখার মতোই দৃশ্য! যাকে বলে টপ। মানে টপলেস। ব্লাউজ-এর বালাই নেই। আর শাড়ি-সায়াটা বায়না-করা বাচ্চার মতো কোনওরকমে ওর কোমর আঁকড়ে ধরে ঝুলছে। তখন ঘুম জড়ানো চোখে যেই আমি নন্দিনীকে দেখি অমনি আমার ঘুম ছুটে যায়। হ্যাংলার মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। অথচ, কিছুক্ষণ আগেই, সারারাত ধরে ওকে নিয়ে কত-না হামলা-হামলি করেছি। শরীর-মন-বিছানা সব উথালপাথাল। তবুও সকালের আলোয় ওর ওই ফরসা ইয়েগুলো দেখলে আমি কেমন ইয়ে হয়ে যাই। এইজন্যেই বোধহয় মুনি-ঋষিরা বলেছেন: লোভ অতি বিষম বস্তু।
তা এই লোভের টানেই বোধহয় ওই অসভ্য লোকটা তাক বুঝে উঁকিঝুঁকি মারে। ভোরবেলা নন্দিনীর ঘুমভাঙা থেকে শুরু হয় লোকটার নজরদারি কাজ। তারপর স্নান করতে যাওয়ার আগে-পরে। কাপড় ছাড়ার সময়। রাতে শুতে যাওয়ার সময়। এমনকী আধো-আঁধারি বিছানার দিকেও ওর নজর থাকে। অবশেষে সকালবেলার ব্যাপারটা তো আছেই।
লোকটার অসভ্যতার এত খুঁটিনাটি আমি টেরও পেতাম না, যদি-না অফিস থেকে দশদিনের ছুটি নিতাম। অফিসে কাজের টেনশান দিনকে-দিন বেড়েই চলেছিল। তাই ডাক্তারি পরামর্শে দশদিন ছুটি নিয়েছি—বিশ্রামের জন্যে। কিন্তু ওই লোকটা আমাকে বিশ্রাম দিল কই!
তিন-তিনটে দিন লোকটাকে ভালো করে লক্ষ করার পর আজ সকালে নন্দিনীকে ডেকে বললাম, অ্যাই শোনো—।
কী?
জানো, একটা অসভ্য লোক সবসময় লুকিয়ে-লুকিয়ে তোমাকে দ্যাখে!
নন্দিনী হেসে বলল, সে আর জানি না, সেই লোকটা তো এখনও আমাকে হ্যাংলার মতো দেখছে।—বলে আমার বুকে আঙুল দিয়ে টোকা মারল দু-বার।
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, আমি না, আমি না—একটা অন্য লোক।
নন্দিনী তখন বেশ ঘাবড়ে গেল। এক-পা পিছিয়ে গিয়ে চারপাশে তাকাল। তারপর অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, কে? কোথা থেকে দ্যাখে?
আমি দেখলাম, আর লুকিয়ে লাভ নেই। সুতরাং ওকে বলেই ফেললাম, লোকটাকে চিনি না। তবে লোকটা দ্যাখে ওই আয়নার ভেতর থেকে। —বলে আমি আঙুল তুলে ড্রেসিং-টেবিলের আয়নাটার দিকে দেখালাম।
এই ড্রেসিং-টেবিলটা বিয়ের সময় নন্দিনীর মা আমাদের দিয়েছিলেন। এটা তিনি আবার পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। অর্থাৎ অ্যান্টিক। আর চেহারা দেখেই তার আভিজাত্য দিব্যি বোঝা যায়। যেমন, মেহগনি কাঠ। সূক্ষ্ম কারুকাজ—যার মধ্যে রয়েছে শিল্পীর ধৈর্য ও দক্ষতার প্রমাণ। এ ছাড়া আয়নাটাও মাপে বেশ বড়। প্রায় ছ-ফুট উঁচু, আর চওড়ায় প্রায় দু-ফুট। তার ওপর আবার দু-পাশে দুটো ভাঁজ করা আয়নার ফালি জোড়া রয়েছে—পাখির ডানার মতো।
বিয়ের পর সময় করে আমি ড্রেসিং-টেবিলটাকে ভালো করে পালিশ করিয়ে নিয়েছিলাম। আর সুন্দর ঝালর দেওয়া সরু লেসের কাজ-করা পরদা ঝুলিয়ে দিয়েছি ওটার ওপরে। আমাদের ফ্ল্যাটে যে-ই আসুক, ড্রেসিং-টেবিলটা দেখে তারিফ না করে পারে না। বলে, দামি কাঠ, বেলজিয়ামের কাচ, ব্রিটিশ আমলের জিনিস, এর দাম কম করে দশ-পনেরো হাজার টাকা হবে।
এখন সেই অভিজাত ড্রেসিং-টেবিলের আয়নার আড়ালেই আশ্রয় নিয়েছে নির্লজ্জ বেহায়া অসভ্য লোকটা।
নন্দিনীকে আয়নাটা আঙুল দিয়ে দেখাতেই ওর মুখ পলকে খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চট করে আমাকে টেনে নিয়ে গেল বিছানার কাছে। নরম গদির ওপরে ঠেলে বসিয়ে দিল আমাকে। গায়ে, মুখে, কপালে হাত বোলাতে-বোলাতে জিজ্যেস করল, সকালে ওষুধ খেয়েছিস?
বিয়ের আগে আমাদের ‘তুই-তুই’ প্রেম ছিল। বিয়ের পরেও আদুরে ভালোবাসা জানাতে আমরা দুজনে-দুজনকে ‘তুই’ বলে ডাকি। কিন্তু ওর মুখে ‘ওষুধ’ শব্দটা শুনেই আমার আদুরে ভালোবাসা বিগড়ে গেল।
অফিসের কাজের চাপে আমার টেনশান হয় বলে নন্দিনী একরকম জোর করেই আমাকে একদিন ডক্টর সোমেন বাসুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে মাসে একবার করে ডক্টর বাসুকে দেখাতে যাই। ইনি কী দেখেন ভগবান জানেন! তবে কী একটা বিচ্ছিরি ট্যাবলেট আর সিরাপ খেতে দিয়েছেন। নন্দিনীর খেয়াল আর যত্নে একটিবেলাও সে-ওষুধ বাদ দেওয়ার জো নেই। আর সাম্প্রতিক ছুটি নেওয়ার পরামর্শটাও ওই মহা-চিকিৎসকের।
নন্দিনীকে আমি রাগাতে চাই না। তাই ওর বুকে মুখ গুঁজে বললাম, হ্যাঁ, ওষুধ খেয়েছি।
নন্দিনী কোনও কথা না-বলে আমার মাথাটা বুকে চেপে রেখে আমার চুলে বিলি কাটতে লাগল।
আমার বেশ ভালো লাগছিল। কিছুক্ষণের জন্যে বেমালুম ভুলে গেলাম অসভ্য লোকটার কথা।
পদ্ম নামে একটি বউ আমাদের ঠিকে কাজ করে দেয়। ওর আসার কথা সকাল আটটায়, কিন্তু প্রায় রোজই আসে সাড়ে ন’টা-দশটায়। ওর দেরি দেখে আমি রেগে যাই, অথচ নন্দিনী ওকে কিছু বলে না। কী করে পদ্ম ওর বউদিমণিকে ম্যানেজ করে রেখেছে কে জানে!
আজও পদ্ম আসতে দেরি করছে। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। নিশ্চিন্তে নন্দিনীর আদর খেতে পারছি। পদ্মর মেয়ে সুখী আসে বেলা বারোটা নাগাদ। এসে সারাটা দিন নন্দিনীর কাছেই থাকে, আর দরকার হলে ফাইফরমাশ খাটে। রাত ন’টা বাজলে খেয়েদেয়ে মেয়েটা মায়ের ডেরায় চলে যায়।
তোর কী হয়েছে বল তো!—নন্দিনী আমাকে আলতো করে জিগ্যেস করল।
আমি ওর বুকের মধ্যেই আড়ষ্টভাবে সামান্য মাথা নেড়ে বললাম, কিচ্ছু না। শুধু ওই অসভ্য লোকটাকে আমি সহ্য করতে পারছি না। লোকটা সবসময় ওই আয়নার আড়াল থেকে তোকে দ্যাখে।
কথাটা বলেই আমি ঘাড় সামান্য ঘুরিয়ে আড়চোখে তাকালাম আয়নাটার দিকে। ওটার ওপরে লেসের পরদা টানা ছিল। কিন্তু তবু যেন আমি একটা অস্পষ্ট ছায়াকে চট করে সরে যেতে দেখলাম। চোখগুলো বড়-বড়। ঠোঁটের কোণে লোভাতুর হাসি।
নন্দিনীকে কিছু বলার আগেই ও বলে উঠল, সন্দীপ, এসব নিয়ে তুই একদম ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
নন্দিনী সান্ত্বনা দিলে কী হবে, আমি জানি, এত সহজে সব ঠিক হবে না। ওই লোকটার নিশ্চয়ই কোনও বদ মতলব আছে।
এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। আমাকে সঙ্গে-সঙ্গে আলতো ঠেলায় সরিয়ে দিয়ে নন্দিনী এগিয়ে গেল টেলিফোনের দিকে। ওর পেছনটা বেশ ভারী। বিয়ের আগে এতটা ভারী ছিল না।
নন্দিনী টেলিফোনে মিষ্টি করে ‘হ্যালো’ বলল।
এটা কি সেই টেলিফোন?
মানে, কিছুদিন ধরে একটা ফোন আসছে, সেটা আমি ধরলেই সব চুপচাপ—কেউ কথা বলে না। শুধু দম নেওয়ার ‘ফোঁস-ফোঁস’ শব্দ শোনা যায় কয়েক লহমা। আর তারপরই লাইন কেটে যায়।
অথচ নন্দিনী যদি ফোন ধরে তা হলে আর লাইন কাটে না। কখনও সেই ফোনে কথা বলে নন্দিনীর মা, অথবা আমার ছোটপিসি, বা আমেরিকা থেকে নন্দিনীর বড়দা, আর নয়তো দীপেশ।
নন্দিনী টেলিফোনে কথা বলছিল। আমি হাঁ করে ওর কথাগুলো শুনছিলাম। কে ফোন করেছে এখন?
আমার মুখ দেখে নন্দিনী বোধহয় নীরব প্রশ্নটা টের পেল। রিসিভারের মুখে হাত চাপা দিয়ে ফিসফিসে গলায় বলল, দীপেশ—।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দীপেশ আমাদের দুজনেরই বন্ধু। ইউনিভার্সিটিতে আমরা তিনজনে একসঙ্গে পড়েছি। দীপেশটা যাচ্ছেতাই নম্বর পেয়ে প্রত্যেক ইয়ারে ফার্স্ট হত। তার ওপর কী দারুণ চেহারা! আমার সঙ্গে তো একেবারে গলায়-গলায় ছিল। একসঙ্গে কত সিনেমা দেখেছি আমরা। তখন নন্দিনীর সঙ্গে আমার অতটা মাখামাখি ছিল না।
পাশ-টাশ করে একটা দারুণ ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরি নিয়ে দীপেশ স্টেটস-এ চলে গেল। আমিও চাকরি পেলাম। তার কিছুদিন পর নন্দিনীও চাকরিতে ঢুকল। চাকরি করা অবস্থায় আমাদের প্রেম চলেছিল বছরখানেক। কিন্তু তারপর আর পারা যাচ্ছিল না। নন্দিনীর বাবা একটা ফ্ল্যাট গিফট করতেই সব প্রবলেম সলভ হয়ে গেল। নন্দিনী চাকরি ছেড়ে দিল। বলল, সন্দীপ, চাকরির চেয়ে বিয়ে অনেক বেটার। তুই একা চালাতে পারবি না?
আমি ‘খুব পারব’ বলে ওকে জাপটে ধরে কোলে তুলে নিয়েছিলাম। আর তারপরই দু-গালে প্রচণ্ড ‘চকাৎ-চকাৎ’ শব্দে দুটো চুমু। নন্দিনী আচমকা বিব্রত হয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল, কী হচ্ছে! কী হচ্ছে!
আমি হেসে বলেছিলাম, সোনা, চুমুতে যখন বিকট শব্দ হয় তখন তাকে বলে হামি।
করিডর ধরে কে যেন এগিয়ে আসছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে নন্দিনীকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়েছিলাম।
আমাদের বিয়ের মাসতিনেক পর দীপেশ কলকাতায় ফিরল। তারপর থেকে মাঝে-মাঝেই আসে আমাদের আস্তানায়। ওকে দেখলেই আমার ইউনিভার্সিটির দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। নন্দিনীর সঙ্গে পিরিত করার জন্যে ও আমাকে কম ওসকায়নি। বন্ধুবান্ধব সকলের মাঝে লুকিয়ে আমার পেছনে চিমটি কেটে বলেছিল, জাগো বাঙালি, লড়ে যাও।
নন্দিনী টেলিফোনে খুব হাসছিল। তারপরই খেয়াল করলাম ও দীপেশকে আমার কথা বলছে।
আমি আয়নার দিকে একবার আড়চোখে তাকালাম। না, সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু দীপেশকে এখুনি ওই লোকটার কথা বলার দরকার নেই। ও কী মনে করবে কে জানে!
নন্দিনীকে ইশারা করে বারণ করলাম, দীপেশকে এখন যেন কিছু না বলে।
নন্দিনী আমাকে আশ্বস্ত করে হাসল। তারপর রিসিভার নামিয়ে রাখল। রাখার সময় স্পষ্ট দেখলাম, রিসিভারটা ওর বাঁ-দিকের বুকে ঘষে গেল। রিসিভারটাকে হিংসে হল আমার।
নন্দিনীকে কাছে ডাকতে যাব, অমনি কলিংবেল বেজে উঠল। ও আমাকে লক্ষ করে জিভ ভেঙাল। বলল, পদ্ম না-এলে আমার কপালে বোধহয় একটি ফোঁটাও বিশ্রাম জুটত না। দীপেশ এলে বলব, তুমি একটুও কথা শোনো না।
নন্দিনী দরজা খুলতে গেল।
আর ঠিক তখনই একটা আবছা ছায়া আয়নার ওপরে আড়াআড়ি সরে গেল যেন।
দুই
নন্দিনী অলস ভঙ্গিতে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল বিছানায়। ঘরের নাইট-ল্যাম্প জ্বলছে। তার নীল আলোয় নন্দিনীর শাড়ির রং ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। তবে বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা চারজন লোককে দিব্যি দেখা যাচ্ছে। ওদের মুখ অস্পষ্ট হলেও উদ্দেশ্য মোটেই অস্পষ্ট নয়। ওদের মধ্যে একজন ক্ষিপ্র হাতে খপ করে চেপে ধরল নন্দিনীর শাড়ি। তারপর একটা উল্লাসের হেঁচকি তুলে শাড়িটা টানতে শুরু করল। বিছানায় নন্দিনীর দেহটা সাপের মতো মোচড় খাচ্ছে, আর শাড়িটা একটু-একটু করে খুলে আসছে ওর শরীর থেকে। বাকি তিনজন লোক নন্দিনীর বস্ত্রহরণ চুপচাপ দেখছে। আবছা আলোতেও ওদের চোখে ফুটে ওঠা তৃপ্তি বেশ বোঝা যাচ্ছে।
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। ক্ষিপ্তের মতো চিৎকার করে উঠলাম। সঙ্গে-সঙ্গে ওই চারজন দস্যু চমকে উঠে এপাশ-ওপাশ তাকাল। তারপর এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় চারজন গায়ে-গায়ে মিশে একজন মানুষ হয়ে গেল। এবং সেই লোকটা একছুটে চলে গেল ড্রেসিং-টেবিলের আয়নার কাছে। আয়নার পরদা সরিয়ে চোখের পলকে ঢুকে গেল আয়নার ভেতরে।
আমার ঘুম ভেঙে গেল।
স্বপ্নের মধ্যেই বোধহয় চিৎকার করে উঠেছিলাম। কারণ, দেখি, নন্দিনী আলুথালু বেশে উঠে বসে আমার বুকে হাত বোলাচ্ছে, মাথায় হাত বোলাচ্ছে, কপালে-গালে ভয়-ভাঙানো চুমু খাচ্ছে।
কী হয়েছে রে? বাজে স্বপ্ন দেখেছিস?—নন্দিনীর গলায় উৎকণ্ঠা।
হ্যাঁ, খুব বাজে স্বপ্ন।—বড় বড় শ্বাস নিতে-নিতে আমি বললাম, আয়নার ওই লোকটা তোর শাড়ি ধরে…শাড়ি ধরে…।
থাক, থাক। এখন ঘুমো।
আমাকে একগ্লাস জল দিল ও। ঢকঢক করে জল খেয়ে ওর নরম বুকে মুখ গুঁজে আমি শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল থেকে লোকটাকে আর দেখতে পেলাম না। আমি নানা অছিলায় আয়নার কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে লাগলাম। নন্দিনী ঘরকন্নার কাজের ফাঁকে-ফাঁকে আমাকে লক্ষ করছিল। ওর নজর দেখেই বুঝলাম আমার মতলব ও ধরে ফেলেছে, কিন্তু আমাকে কিছু বলল না।
বেলার দিকে একবার ফোন বেজে উঠতেই আমি ফোন ধরলাম। নন্দিনী রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে ছুটে আসছিল ফোন ধরতে। কিন্তু আমাকে রিসিভার তুলতে দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অপেক্ষা করতে লাগল।
আমি টেলিফোনে কথা বললাম।
হ্যালা—
কোনও উত্তর নেই। তবে টের পেলাম, ও-প্রাপ্ত শোনা যাচ্ছে ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।
আমি আরও বেশ কয়েকবার ‘হ্যালো-হ্যালো’ বললাম, কিন্তু কোনও লাভ হল না।
আমি আয়নার দিকে একবার তাকালাম। নাঃ, সেখানে কেউ নেই।
রিসিভার নামিয়ে রাখতে যাচ্ছি, নন্দিনী সাত-তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমাকে দাও, আমি একবার চেষ্টা করে দেখি।
আমি রিসিভারটা ওকে বাড়িয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। আয়নার দিকে না-দেখার ভান করে আড়চোখে নজর রাখলাম—যদি শয়তানটা উঁকিঝুঁকি মারে।
হঠাৎই খেয়াল করলাম, টেলিফোনে দিব্যি কথা চলছে। নন্দিনী কথা বলছে আর হাসছে।
একটু পরেই কথা শেষ করে ও রান্নাঘরে চলে গেল। যাওয়ার আগে আমাকে মিষ্টি করে বলে গেল, বারোটার সময় ওষুধটা খেতে ভুলো না।
রান্নাঘর থেকে পদ্মর মশলা বাটার শব্দ আসছিল। আর নন্দিনী সেখানে ঢুকেই কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলে বোধহয় কিছু ছাড়ল। কারণ ‘ছ্যাঁক’ করে এমন শব্দ হল যে, মনে হল আমার কপালে ছ্যাঁকা লেগেছে।
বিছানায় চুপচাপ বসে বিশ্রাম নিতে লাগলাম। টেনশান কাটাতে ডাক্তারবাবু আমাকে বিশ্রাম নিতে বলেছেন! কিন্তু ডক্টর বাসু তো আর আয়নার ওই লোকটার কথা জানেন না!
লোকটার কথা ভাবতে-ভাবতেই অলস চোখে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলাম। আমার মাথার ভেতরে কোথাও একটা টেলিফোন ক্রমাগত বেজে যাচ্ছিল।
জানলার বাইরে চড়া রোদ্দুর। উলটোদিকের ফ্ল্যাটের কার্নিশে একটা মেয়ে-চড়ুই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। একটা কাম-জর্জর পুরুষ-চড়ুই দু-পাশে ডানা নামিয়ে মুখটা উদাসীনভাবে ওপরে তুলে মেয়ে-চড়ুইটিকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে একটা থিয়োরি মাথায় এল। মানে, ওই অসভ্য লোকটার ব্যাপারে। যতই ভাবতে লাগলাম, থিয়োরিটা ততই কম অবাস্তব ঠেকতে লাগল। কিন্তু না, নন্দিনীকে এখন বলব না। শুনলে ও হয়তো খিলখিল করে হেসে উঠবে। তারপর বলবে, না রে, তোর টেনশান এখনও কাটেনি।
নন্দিনী মনে হয় আমার কথায় খুব একটা আমল দিচ্ছে না। দীপেশ বললে ব্যাপারটাকে ও কিন্তু এরকম হালকাভাবে উড়িয়ে দিতে পারত না। আজ সন্ধেবেলা দীপেশ যদি আসে তা হলে সবকিছু ওকে বলব। বলা দরকার। তা না-হলে আয়নার ওই লোকটা দিন-দিন আমার মাথায় চড়ে বসবে।
ঘোর দুপুরে নন্দিনীকে বিছানায় কাছে পেয়ে আমি কয়েকঘণ্টা আগে দেখা কার্নিশের চড়ুই পাখিটার মতো হয়ে গেলাম। সুখী পাশের ছোট ঘরটার মেঝেতে শুয়ে পড়েছে। আর আমাদের ঘরে ঢোকার সব দরজাই বন্ধ। সুতরাং আমরা দুজনে এখন দুজনের।
আমার ভালোবাসায় বাধা দেওয়ার ছল করে নন্দিনী বলল, একটু ঘুমোও না, তা হলে টেনশানটা একটু কমবে।
আমি হাসলাম, বললাম, টেনশান কমানোর এটাই সবচেয়ে ভালো ওষুধ—ট্যাবলেট বা সিরাপ নয়।
জানলাগুলোয় পরদা টানা ছিল। তাই ঘরে হালকা ছায়ায় একটা আস্তরণ ছিল। কিন্তু তাতে নন্দিনীকে আগাপাস্তলা দেখতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না আমার। ওর শরীর নিয়ে পাগলামি করতে-করতেই কী যে হল, হঠাৎ করে চোখ গেল আয়নার দিকে।
আবছা আঁধার এবং লেসের কাজ করা পরদা থাকা সত্ত্বেও লোভী ছায়াটাকে আমি দেখতে পেলাম। আমি ঝটকা মেরে উঠে বসতেই ছায়াটা সড়াৎ করে সরে গেল।
নন্দিনী অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, কী হল?
ওই লোকটা।—আয়নার দিকে দেখালাম আমি, বললাম, ওঃ, অসহ্য হয়ে উঠেছে।
নন্দিনী কোনও কথা না বলে চুপচাপ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর ছোট্ট করে বলল, এবার শুয়ে পড়ো। সন্ধেবেলা দীপেশ এলে ওকে বলে দেখি কী বলে—।
ওর কথামতো চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে নানান কথা ভাবতে লাগলাম। নাঃ, সন্ধেবেলা দীপেশকে ব্যাপারটা বলতেই হবে।
সন্ধেবেলা দীপেশ এল। ওর কলিংবেল বাজানোর নিজস্ব একটা ঢং আছে। শুধু কলিংবেল কেন, সব ব্যাপারেই ওর নিজস্ব কতকগুলো ঢং আছে। মনে পড়ে, ইউনিভার্সিটির দিনগুলোয় আমি লুকিয়ে-লুকিয়ে ওকে নকল করার চেষ্টা করতাম। ওকে আমার মাঝে-মাঝে হিংসে হত। এখনও যে হয় না তা নয়।
ডাইনিং স্পেসে টিভি চালিয়ে চায়ের আসর বসিয়েছিলাম আমরা তিনজনে। এ-কথা সে-কথার মাঝে নন্দিনীই ফস করে বলে বসল লোকটার কথা। আমি ভেবেছিলাম দীপেশ হো-হো করে হেসে উঠবে, কিন্তু ও হাসল না। সিরিয়াস মুখ করে লোকটার সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতে লাগল আমাকে কেমন দেখতে, কখন-কখন উঁকি মেরে নন্দিনীকে দ্যাখে, আমাকে দেখিয়ে নন্দিনীকে কোনওরকম কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে কি না, ইত্যাদি-ইত্যাদি।
আমি তখন একটু ভরসা পেয়ে সামান্য ইতস্তত করে নতুন থিয়োরিটার কথা দীপেশকে বলে ফেললাম।
আমার কী মনে হয় জানিস? ড্রেসিং-টেবিলের ওই আয়নাটা আসলে একটা দরজা—।
দরজা!—অবাক হয়ে নন্দিনী বলল।
আর-একটু বুঝিয়ে বল তো।—দীপেশ চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। হাতের সিগারেটে টান দিতে ভুলে গেল।
আমি হয়তো বিব্রত হয়ে পড়তাম, কিন্তু দীপেশের আগ্রহ আমাকে ভরসা দিল।
একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে আমি বললাম, হ্যাঁ, দরজা। দরজার একপাশে হচ্ছে আমাদের জগৎ—মানে, আমাদের এই ফ্ল্যাট, শোওয়ার ঘর, রান্নাঘর, এইসব। আর অন্যদিকে ওই লোকটার দুনিয়া। আয়নাটা হচ্ছে এই দুটো জগতের মাঝের দরজা। আমরা সেই দরজা দিয়ে যাতায়াত করতে পারি না, কিন্তু লোকটা হয়তো পারে—কে জানে!
আমি ভাবছিলাম, আমার কথায় দীপেশ আর নন্দিনী হয়তো হো-হো করে হেসে উঠবে। কিন্তু না, ওরা কেউই হাসল না আমার থিয়োরি শুনে। নন্দিনী একবার চিন্তিত মুখে তাকাল দীপেশের দিকে। দীপেশ গম্ভীরভাবে আমাকে কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখল। তারপর জিগ্যেস করল, আর কী-কী মনে হয় তোর?
এইজন্যেই দীপেশের জবাব নেই। ও আর-একজনের মনের অবস্থা সবসময় ঠিক-ঠিক বুঝতে পারে। এইজন্যেই কারও কাছের মানুষ হয়ে উঠতে ওর এতটুকু দেরি হয় না।
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম, আমার আরও কী মনে হয় জানিস! ওই লোকটা নির্ঘাত কোনও বদ মতলবে ঘুরঘুর করছে।
কী মতলব?
সেটাই তো এখনও বুঝতে পারছি না।
তারপর কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।
একসময় দীপেশ বলল, সন্দীপ, তুই লোকটাকে যেমন লক্ষ রাখছিস সেরকম লক্ষ রাখ। এটা নিয়ে এক্ষুনি থানা-পুলিশ করা ঠিক হবে না। ব্যাপারটা নিজেদের মধ্যে থাকাই ভালো। আমি আজ চলি, নন্দিনী, তোরা একটু সাবধানে থাকিস।
দীপেশ চলে যাওয়ার পর সুখীকে একপ্যাকেট সিগারেট কিনতে পাঠালাম। নন্দিনীকে একা পেয়ে জাপটে ধরে দুটো চুমু খেয়ে বললাম, শুনলি তো, এখন থেকে তোকে সাবধানে থাকতে হবে।
নন্দিনী অদ্ভুত হেসে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এখন না, রাতে।—তারপর চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।
আমি টিভিটা অফ করে দিয়ে চলে এলাম শোওয়ার ঘরে। প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে ড্রেসিং-টেবিলের আয়নার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালাম। আয়নার পরদা সরিয়ে দিয়ে ঠান্ডা কাচে হাত দিলাম। এটা আসলে দরজা! ভাবা যায়! ওই লোকটা কোথায় গেল?
আয়না লক্ষ করে কয়েকবার সিগারেটের ধোঁয়া ছুড়ে দিলাম। তারপর আয়নার খুব কাছে ঝুঁকে পড়ে চাপা গলায় জিগ্যেস করলাম, আয়না, তুই সত্যি করে বল, কাকে তুই লুকিয়ে রেখেছিস—।
আয়না কোনও উত্তর দিল না।
শুধু আমার প্রতিবিম্ব আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
তিন
আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। তবে আমি সেটা জানতে পেরেছি এটা নন্দিনী বা দীপেশ—কাউকে বুঝতে দিইনি।
সন্ধের পর একটা ফোন এল। আমিই ফোনটা ধরলাম। তারপর ‘হ্যালো’ বলা সত্ত্বেও ও-প্রান্ত থেকে কোনও উত্তর নেই। তবে মনোযোগ দিয়ে কান পেতে শুনতে পেলাম ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।
নন্দিনী বাথরুমে গা ধুতে ঢুকেছে। সুতরাং আরও কয়েকবার চেঁচিয়ে ‘হ্যালো’ বলে ফোন রেখে দিতে যাচ্ছি, শুনতে পেলাম ‘খটাস’ করে বাথরুমের দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দ। তাকিয়ে দেখি, ভেজা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নন্দিনী এগিয়ে আসছে।
দাও তো, আমি একবার দেখি।
নন্দিনীকে রিসিভারটা দিয়ে শোওয়ার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর জলে ভেজা নন্দিনীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলাম। ও ছোট-ছোট আদুরে শব্দের ফাঁকে-ফাঁকে ফোনে কথা বলতে লাগল। আমি আদর করতে-করতে ওর কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম।
হ্যালো, নন্দিনী বলছি। হ্যাঁ, বলো। এই তো, ঘরেই রয়েছে। না, ডক্টর বাসুকে ফোন করিনি। পরশুদিন একেবারে ওকে নিয়ে যাব। তুমি কী করছ এখন? আমি? আমি এই তো গা ধুয়ে বেরোলাম। ইয়ারকি কোরো না। তুমি কবে আসছ? আচ্ছা। রেখে দিই তা হলে—।
ফোন রেখে দিল নন্দিনী। ওর ‘উঁ’, ‘আঃ—’ শব্দগুলো এবার জোরে হতে লাগল। ও আমাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যেসব আলগা আপত্তি করছিল সেগুলো যে আসলে কোনও আপত্তিই নয় তা এই তিন বছরে আমি ভালো করে জেনে গেছি।
সুতরাং ভিজে শাড়িটা ওর গা থেকে খসিয়ে দিলাম। তারপর ওকে নিয়ে গেলাম বিছানার কাছে। ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ, আর পরদা ঢাকা আয়নায় আবছাভাবেও কাউকে নজরে পড়ছে না। তা হলে ফুলশয্যা হতে আর বাধা কী!
আদর-ভালোবাসার দমকে আয়নার দিকে তাকানোর কথা খেয়াল ছিল না। কিন্তু সবকিছুর শেষে ক্লান্ত দেহে যখন শুয়ে আছি, তখনই লোকটাকে দেখতে পেলাম। আয়নার বাঁ-দিকের এককোণে ওর বাঁ-চোখ আর চুলের খানিকটা দেখা যাচ্ছে।
আমি বিছানায় উঠে বসতেই লোকটা সরে গেল।
নন্দিনী অবাক চোখে আমাকে একবার দেখল, তারপর বলল, কী হল!
সেই লোকটা।—আমি আয়নার দিকে চোখ রেখেই জবাব দিলাম।
ও—।
নন্দিনী বিছানা ছেড়ে উঠে মেঝেতে পড়ে থাকা ভিজে শাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল।
আমি কিছুক্ষণ অলসভাবে শুয়ে রইলাম। ভাবতে লাগলাম আমার থিয়োরিটার কথা। লোকটার নিশ্চয়ই কোনও খারাপ মতলব আছে। হয়তো সুযোগ বুঝে ও ওই দরজা পেরিয়ে চলে আসবে আমাদের জগতে। ঢুকে পড়বে আমাদের ফ্ল্যাটে। তারপর সাংঘাতিক কিছু একটা কাণ্ড করে…।
আমার মাথাটা কেমন দপদপ করছিল। বোধহয় টেনশানটা বাড়ছে। নাঃ, একটু রাস্তায় বেরোই, পায়চারি করে মাথাটা হালকা করে আসি।
নন্দিনীকে বলে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। কাছেই একটা মাঠ আছে, সেখানে বসে একটু জিরিয়ে নেব।
ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় গাড়ির হেডলাইটের আলোয় একটা লোককে হঠাৎই দীপেশ বলে মনে হল। আমি চেঁচিয়ে ওকে ডাকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু গাড়িটা চলে যেতেই রাস্তাটা এমন অন্ধকার হয়ে গেল যে, ধন্দে পড়ে গেলাম। বোধহয় দীপেশ না, অন্য লোক। দীপেশকে কাছে পেলে আমি খুব ভরসা পেতাম। তাই কখনও ওকে কাছছাড়া করতে চাইতাম না। কিন্তু সেসব দিন এখন কোথায়!
খোলা মাঠে ঠান্ডা বাতাসে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে ফিরে চললাম বাড়ির দিকে।
ফ্ল্যাটের দরজায় এসেই ভেতর থেকে হাসি আর কথাবার্তার শব্দ শুনতে পেলাম। কী ভেবে কান পাতলাম দরজায়।
ওঃ, সন্দীপের নতুন থিয়োরির জবাব নেই!—কোনও পুরুষের ভারি গলা। তারপর আমার গলা নকল করে ব্যঙ্গের সুরে সে বলল, আমার কী মনে হয় জানিস? ড্রেসিং-টেবিলের ওই আয়নাটা আসলে একটা দরজা।—তারপরই দরাজ গলায় অট্টহাসি।
এবার নন্দিনীর গলা শুনলাম: ওর আজগুবি ফ্যানটাসি নিয়ে ওকে থাকতে দাও। ওষুধপত্র খাচ্ছে—কদিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ডক্টর বাসু বলেছেন, ওকে কখনও কনট্রাডিক্ট না-করতে। বলেছেন, ওর সব গল্পে সায় দিয়ে যেতে।
তাই তো দিচ্ছি। ও কোথায় গেছে এখন?
এই আশেপাশে একটু পায়চারি করতে গেছে। এখুনি এসে পড়বে।
আমি কলিংবেলের বোতামে চাপ দিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে ঘরের ভেতরে কথাবার্তা থেমে গেল।
নন্দিনী দরজা খুলল। আমাকে দেখেই মিষ্টি করে হাসল, বলল, কী, বেড়ানো হল?
আমি অল্প হেসে ‘হুঁ’ বলে জবাব দিলাম। ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দীপেশকে দেখতে পেলাম। ও সহজভাবে হাসতে চেষ্টা করল, বলল, কী রে, কেমন আছিস?
না, কিছুতেই ওদের বুঝতে দেব না যে, ওদের কথাবার্তা আমি শুনে ফেলেছি। তাই বললাম, ভালো।—তারপর শোওয়ার ঘরের দিকে যেতে-যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে যোগ করলাম: ওষুধ তো খাচ্ছি—কদিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
লক্ষ করলাম, পলকের জন্যে নন্দিনী আর দীপেশের মধ্যে চোখাচোখি হল।
আমি শোওয়ার ঘরে ঢুকে গায়ের জামাটা খুলে সটান বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম, সাংঘাতিক একটা কিছু না-হওয়া পর্যন্ত ওই লোকটার কথা ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আগের দিন আমার থিরোরির কথা শুনে দীপেশ তো একটুও ঠাট্টা করেনি! আর নন্দিনীও তো কখনও আমার কথায় প্রতিবাদ করেনি! এ-সবই কি ওদের অভিনয়? নাকি ডক্টর বাসু ওদের যেরকম শিখিয়ে দিয়েছেন ওরা সেরকমই ব্যবহার করছে আমার সঙ্গে।
একটু পরেই ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম, দীপেশ চলে গেল।
আমি চোখ বুজে শুয়ে রইলাম। নন্দিনীর সঙ্গেও এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ওরা ওদের বিশ্বাসে নিয়ে থাক। দীপেশ যত পারে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করুক আমাকে। কিন্তু আমার বিশ্বাস ওরা চিড় ধরাতে পারবে না কিছুতেই।
আমার মন বলছে, আয়নার ওই লোকটার মতলব মোটেই ভালো নয়।
শেষ
যা ভয় করছিলাম শেষ পর্যন্ত তাই হল। লোকটাই জিতে গেল শেষ পর্যন্ত। ওকে কিছুতেই আটকাতে পারলাম না।
রাত্র তখন কটা হবে? বড়জোর সাড়ে এগারোটা। আমি বাথরুমে গিয়েছিলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকেই দেখি নন্দিনী কেমন অদ্ভুতভাবে বিছানায় শুয়ে আছে। একটা হাত বুকের ওপরে, আর একটা হাত ছড়ানো। শাড়িটা উঠে গেছে হাঁটু পর্যন্ত। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
আমি ছুটে গেলাম ওর কাছে। দেখি ঠোঁট ফাঁক হয়ে আছে, দাঁত দেখা যাচ্ছে, ঠোঁটের কোণে একফোঁটা রক্ত, আর ওর নরম গলায় কালশিটের দাগ।
আমি ভয়ে পাথর হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি ওর পালস দেখলাম। কোনও সাড় নেই। ওর নাকের কাছে হাত রাখলাম। না, নিশ্বাস পড়ছে না। তখন ঝুঁকে পড়লাম ওর শরীরের ওপর। বুকে কান চেপে ধরলাম। না, কোনও শব্দ নেই।
আমি ঘামতে শুরু করলাম। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। ভয়ে-ভয়ে তাকালাম আয়নার দিকে। কোথায় গেল লোকটা? নিশ্চয়ই অপকর্মটি সেরে লুকিয়ে পড়েছে।
আমি দৌড়ে গেলাম ফ্ল্যাটের দরজার কাছে। যা ভেবেছি তাই! দরজার লক, ছিটকিনি সব ঠিকঠাক রয়েছে। বাইরের কেউ ফ্ল্যাটে ঢোকেনি। সুতরাং আর কাউকে সন্দেহ করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি যখন বাথরুমে ঢুকেছি তখনই সুযোগ বুঝে ওই লোকটা বেরিয়ে এসেছে আয়নার ভেতর থেকে। ঘুমিয়ে থাকা নন্দিনীকে নিয়ে নিজের সাধ মিটিয়েছে। তারপর ওকে খুন করে আয়না দিয়ে চম্পট দিয়েছে।
আমি যে এখন কী করি! দরজা খুলে বাইরে গিয়ে কাউকে ডাকাডাকি করতে যাব সে-উপায় নেই। কারণ সেই ফাঁকে লোকটা হয়তো টুক করে বেরিয়ে আসবে আয়না থেকে, তারপর কায়দা করে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে সোজা হাওয়া হয়ে যাবে, তখন তাকে আর কে খুঁজে পাবে!
আমি নন্দিনীকে জাপটে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করলাম।
কাঁদতে-কাঁদতেই বললাম, তুই আমাকে চেঁচিয়ে একবার ডাকতে পারলি না!
নন্দিনী ফ্যাকাসে মুখে শূন্য চোখে চুপচাপ তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
হঠাৎই আমার দীপেশের কথা খেয়াল হল। ওকে ফোন করে ব্যাপারটা বলি। তারপর বাকি যা ব্যবস্থা করার ও করবে।
দীপেশকে ফোন করতেই ও-প্রান্ত থেকে ওর ঘুম জড়ানো গলা পেলাম।
হ্যালো।
সন্দীপ বলছি।
দীপেশ চমকে উঠল। উৎকণ্ঠার সুরে বলল, কী ব্যাপারে রে, এত রাতে?
আমি ওকে সব বললাম।
দীপেশ স্তম্ভিত হয়ে গেল। অস্পষ্ট গলায় নন্দিনীর নামটা দু-বার বিড়বিড় করল। তারপর বলল, তুই এ কী করলি, সন্দীপ?
আমি?—দীপেশ বোধহয় আমার কথা ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। তাই ওকে বুঝিয়ে বললাম, আমি কিছু করিনি। আয়নার ওই লোকটা গলা টিপে নন্দিনীকে খতম করেছে। আমি এখন ফ্ল্যাটে বসে পাহারা দিচ্ছি যাতে শয়তানটা পালাতে না-পারে। তুই তো আমার থিয়োরিটাকে আমল দিলি না—এবার দেখ, আমার কথা ঠিক হল কি না!
দীপেশ আমার কথা বুঝতে চাইল না। ও শুধু বলেই যেতে লাগল, ছি, ছি, সন্দীপ, তুই এটা কী কাজ করলি! তুই কেন এসব করলি? নন্দিনীকে তুই…।
দীপেশের গলা বুজে এল। আমি শুধু ওর ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
অনেকক্ষণ পর দীপেশ বলল, তুই ফ্ল্যাট ছেড়ে কোথাও যাস না যেন। আমি আধঘণ্টার মধ্যেই লোকজন নিয়ে যাচ্ছি।
না, না, আমি এখানেই আছি—নন্দিনীকে ফেলে আর কোথায় যাব!
ফোন রেখে দিলাম।
তারপর শুধু অপেক্ষা। আয়নার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা আর পাহারা। ওই শয়তান অসভ্য লোকটাকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।
অনেকক্ষণ পর সিঁড়িতে যেন বেশ কয়েকজোড়া ভারী বুটের শব্দ পেলাম। তারপরই কলিংবেল বেজে উঠল। আর একইসঙ্গে ফ্ল্যাটের দরজায় অধৈর্যভাবে ‘দুমদুম’ করে ধাক্কা মারল কেউ।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দীপেশ লোকজন নিয়ে এসে গেছে। আমার দায়িত্ব শেষ। সব দায়িত্ব শেষ।
ঘুমে দু-চোখ জড়িয়ে আসছে আমার।