আরব সাগরের রসিকতা

আরব সাগরের রসিকতা

আরব দেশের হাস্যরসের সহিত পরিচয় নাই; কিন্তু একবার আরব সাগরের রসিকতার পরিচয় পাইয়াছিলাম।

অনেক দিন ধরিয়া আরব সাগরের তীরে বাস করিতেছি, কিন্তু এক দিনও সমুদ্র-স্নান হয় নাই। বন্ধুরা খোঁচা দিয়া প্রশ্ন করিতেছিলেন। গৃহিণীর আধুনিকা বান্ধবীরাও যেভাবে কথা কহিতেছিলেন, তাহা তাঁহার শ্রুতিমধুর লাগিতেছিল না,—‘এত দিন বম্বে-তে আছেন, সী-বেদিং করেননি?…ভয় করে বুঝি? তা করবারই কথা—যারা আগে কখনও সমুদ্র দেখেনি, তাদের ভয় করবে বৈ কি।’

একদিন গৃহিণী বলিলেন, ‘ওগো, সমুদ্রে স্নান না করলে আর তো মান থাকে না। চলো এক দিন।’

আমি বলিলাম, ‘বেশ তো, চলো। কিন্তু বেদিং কস্ট্যুম্ কিন্‌তে হবে যে।’

গৃহিণী উত্তপ্ত কণ্ঠে বলিলেন, ‘ঐ বেহায়া পোশাক পরে আমি নাইবো? কেটে ফেললেও না।’

‘কিন্তু—’

গৃহিণী কিন্তু সতেজে ঐ বিলাতী বর্বরতা প্রত্যাখ্যান করিলেন। তিনি গঙ্গায় স্নান করিয়াছেন, পদ্মায় স্নান করিয়াছেন—সমুদ্রে তাঁহার ভয় কি? তিনি বাঙালীর কুলবধূ, নিজের চিরাভ্যস্ত সাজ-পোশাকেই স্নান করিবেন। যে যা খুশি বলুক।

ভালই হইল। বেদিং কস্ট্যুমের আজকাল দাম কম নয়। একটা দম্‌কা খরচ বাঁচিয়া গেল।

সমুদ্র আমার বাড়ি হইতে পোয়াটাক মাইল দূরে। ইতিপূর্বে কয়েক বার বীচে বেড়াইতে গিয়াছি; স্থানটা দেখাশুনা আছে। বেশ নির্জন স্থান; তবে সকালে-সন্ধ্যায় স্নানার্থীর ভিড় হয়। আমরা পরামর্শ করিয়া পরদিন ঠিক দুপুরবেলা বাহির হইলাম। এই সময়টায় ভিড় থাকে না। সমুদ্রের সহিত প্রথম ঘনিষ্ঠতা একটু নিভৃতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তখন জানিতাম না যে, সেদিন ঠিক দুপুরবেলাই জোয়ার আসিবার সময়।

বীচে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, দিঙ্‌মণ্ডল পর্যন্ত সমুদ্র যেন মাতাল হইয়া টলমল করিতেছে! বড়-বড় ঢেউ বেলাভূমিকে আক্রমণ করিতেছে, বালুর উপর শুভ্র ফেনের একটা সীমা-রেখা আঁকিয়া দিয়া ফিরিয়া যাইতেছে, আবার তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে। ঢেউয়ের পর ঢেউ।

বীচে কেহ নাই। এপাশে ওপাশে অনেক দূরে জলের মধ্যে দু’-একটা মুণ্ড উঠিতেছে নামিতেছে দেখিলাম। বীচের পিছনে নারিকেল-কুঞ্জের মধ্যে একসারি ছোট ছোট কেবিন; যাহারা নিয়মিত সমুদ্র-স্নান করিতে যায়, তাহারা ঐ কেবিন ভাড়া লয়।

এক শ্বেতাঙ্গী যুবতী শিস দিতে দিতে একটি কেবিন হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। পরনে গোলাপী রঙের বেদিং কস্ট্যুম্, মাথায় রবারের টুপি, কোমরে একটি বড় টার্কিশ তোয়ালে জড়ানো। আমাদের দিকে ঘাড় বাঁকাইয়া ফিক্‌ করিয়া একটু হাসিয়া নৃত্যচঞ্চল চরণে তিনি সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হইলেন।

গৃহিণী চাপা তর্জনে বলিলেন, ‘মরণ নেই বেহায়া ছুঁড়ির! খবরদার বল্‌ছি, ওদিকে তাকাবে না!’

হেঁটমুণ্ডে জলের দিকে চলিলাম। গৃহিণী শাড়ির আঁচল কোমরে জড়াইয়া লইলেন। ভাগ্যক্রমে আমি হাফ্-প্যান্ট পরিয়া আসিয়াছিলাম।

জলের কিনারা পর্যন্ত আসিয়া গৃহিণী কিন্তু আর অগ্রসর হইতে চান না। আমারও সুবিধা বোধ হইতেছিল না। কিন্তু এত দূর আসিয়া ফিরিয়া যাওয়া অসম্ভব। ওদিকে শ্বেতাঙ্গী তরঙ্গের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে! ঢেউয়ের নাগর-দোলায় দোল খাইতেছে—যেন গোলাপী রঙের একটি মৎস্যনারী।

গৃহিণীকে বলিলাম, ‘এসো, ডাঙায় দাঁড়িয়ে কি সী-বেদিং হয়?

জলের পানে সশঙ্ক দৃষ্টিপাত করিয়া গৃহিণী বলিলেন, ‘ঢেউগুলো বড্ড বড় বড়?’

‘তা হোক্ না—সমুদ্রের ঢেউ বড়ই হয়। ঐ দেখ না, ও মেয়েটা কেমন ঢেউ খাচ্ছে।’

‘আবার ওদিকে তাকাচ্ছ!’

‘না না, ও অনেক দূরে আছে। এখান থেকে বিশেষ কিছু দেখা যায় না— এসো।’

হাত ধরিয়া টানিয়া তাঁহাকে জলে লইয়া গেলাম। বেশি নয়, হাঁটু জল পর্যন্ত গিয়াছি কি, বিভ্রাট বাধিয়া গেল! প্রকাণ্ড একটা ঢেউ আসিয়া আমাদের ঘাড়ের উপর ভাঙিয়া পড়িল। গৃহিণী পড়িয়া গেলেন; ঢেউ তাঁহার মাথার উপর দিয়া চলিয়া গেল। ঢেউ ফিরিয়া গেলে তিনি হাঁচোড়-পাঁচোড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেই আর একটা ঢেউ আসিয়া আবার তাঁহাকে আছাড় মারিয়া ফেলিল। তিনি চিৎকার করিতে লাগিলেন, ‘ওগো, আমাকে ধরো—আমি যে খালি পড়ে যাচ্ছি! কোথায় গেলে তুমি—আমাকে ফেলে পালালে?’

তাঁহাকে ধরিবার মতো অবস্থা আমার ছিল না। প্রথম গোটা দুই ঢেউ অতি কষ্টে সামলাইয়া গিয়াছিলাম বটে, কিন্তু তৃতীয় ঢেউটা সমস্ত লণ্ডভণ্ড করিয়া দিল। ঢেউয়ের তলায় গড়াইতে গড়াইতে আমি প্রায় ডাঙায় গিয়া উঠিলাম। দু’-এক ঢোক লোণা জলও পেটে গিয়াছিল। কোনমতে উঠিয়া বসিয়া চক্ষু খুলিয়া দেখি, গৃহিণী তখনও এক হাঁটু জলে আছাড় খাইতেছেন! ঢেউগুলো এত দ্রুত পরস্পরায় আসিতেছে যে, তিনি পলাইয়া আসিতে পারিতেছেন না! তাহার কণ্ঠ হইতে অনর্গল চিৎকার নিঃসৃত হইতেছে, ‘ওগো কেমন মানুষ তুমি! আমাকে ফেলে পালালে! আমার যে কাপড় খুলে যাচ্ছে—’

শঙ্কায় কণ্টকিত হইয়া দেখি, জলের মধ্যে লোমহর্ষণ কাণ্ড ঘটিতেছে। সত্যিই গৃহিণী বিবসনা হইতেছেন! ঢেউগুলা দুঃশাসনের মতো ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার বসন ধরিয়া টানিতেছে। আঁচল শিথিল হইয়া গেল। আর একটা ঢেউ—তিনি প্রাণপণে শাড়ির প্রান্ত আঁক্‌ড়াইয়া আছেন। আর একটা ঢেউ—ব্যস্! নারীর লজ্জা-নিবারণকারী শ্রীমধুসূদন বোধ হয় কাছাকাছি ছিলেন না; দুঃশাসনরূপী আরব সাগর গৃহিণীর শাড়ি কাড়িয়া লইয়া প্রস্থান করিল।

মরীয়া হইয়া জলে লাফাইয়া পড়িলাম। অনেক নাকানি-চোবানি খাইয়া শেষ পর্যন্ত গৃহিণীকে একান্ত নিরাবরণ অবস্থায় ডাঙায় টানিয়া তুলিলাম। তিনি নেহাৎ তন্বী নন— কিন্তু যাক্!

চারিদিক ফাঁকা, কোথাও এতটুকু আড়াল-আবডাল নাই। উপরন্তু ভোজবাজির মতো ঠিক এই সময় কোথা হইতে কতকগুলা লোক জুটিয়া গেল! তাহারা কাতার দিয়া দাঁড়াইয়া তামাসা দেখিতে দেখিতে নিজেদের ভাষায় (সম্ভবত আরবী) মন্তব্য প্রকাশ করিতে লাগিল। কৌরব-সভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ-কালে পঞ্চপাণ্ডবের মনের অবস্থা কিরূপ হইয়াছিল তাহা অনুমান করা কঠিন হইল না। ব্যাকুলভাবে চারিদিকে তাকাইলাম— হে মধুসূদন, তুমি কত দূরে!

হঠাৎ দেখি, দূর হইতে শ্বেতাঙ্গী মেয়েটি ছুটিয়া আসিতেছে। খিল্ খিল্ করিয়া হাসিতে হাসিতে সে তাহার বড় তোয়ালেখানা গৃহিণীর গায়ের উপর ফেলিয়া দিল।…

সেদিন তোয়ালে-পরিহিতা গৃহিণীকে সঙ্গে লইয়া পদব্রজে কি করিয়া গৃহে ফিরিয়াছিলাম, সে প্রশ্ন করিয়া পাঠক-পাঠিকা আর আমাকে লজ্জা দিবেন না। তাঁহাদের প্রতি অনুরোধ, তাঁহারা যেন মনে মনে চোখ বুজিয়া থাকেন।

১৮ আষাঢ় ১৩৫১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *