আয়োজন
পশুপতি অফিস থেকে ফিরতেই মনোবীণা জিজ্ঞেস করল, “টিকিট পেয়েছ?”
পশুপতি গায়ের জামাটা খুলে মনোবীণার দিকে এগিয়ে দিল। দেষার সময় বউয়ের থুতনি ধরে আদর করে নেড়ে দিয়ে বলল, “পেয়েছি।”
মনোবীণা স্বামীর হাত থেকে পাঞ্জাবিটা নিয়ে কাঠের হ্যাঙারে ঝোলাল। আলনায় টাঙিয়ে টাঙিয়ে রাখবে। টিকিট পাওয়া গেছে শুনে যেন মনোবীণার কত দুর্ভাবনা কেটে গেল।
পশুপতি খানিকটা পুরনো ধরনের মানুষ। এখনও ধুতি-পাঞ্জাবি পরে; পায়ে ভোট চড়িয়ে অফিস যায়। তার পোশাক ছিমছাম; তাঁতের সাধারণ ধুতি, মাঝারি আদ্দির পাঞ্জাবি। বয়েস আটচল্লিশ হতে চলল। এখনও চুল পাকেনি; পাকব পাকব করছে। দোহারা চেহারা, আধ-ফরসা গায়ের রঙ, মুখচোখ সামান্য চৌকোনা।
মনোবীণা পাঞ্জাবি রেখে বলল, “আর ওইটে আননি?”
পশুপতি ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় গায়ে পাখার বাতাস লাগাতে সরে গেল, বলল, “না, আজ আর হল না।”
“টাকা ফরিয়ে গেল? আমি তোমায় গুনে গুনে পঞ্চাশ দিলাম…।”
“উহু, টাকা ছিল”, পশুপতি তার সাদা মাদ্রাজি লুঙ্গিটার জন্যে হাত বাড়াল। তারপর ইতস্তত করে বলল, “তুমি কি সত্যি সত্যি বাড়িতে ও-সব ঢোকাবে?”
মনোবীণা স্বামীর সাদা লুঙ্গিটা আলনা থেকে তুলে নিয়ে এবার ঝেড়ে নিল। “তার মানে! আমি কি শখ করতে তোমার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছিলাম। দিন দিন খিদে কমে যাচ্ছে, বাড়ি ফিরেই বললা—আর পারছি না, ক্লান্তি লাগে; মাঝে মাঝে শুনি, ঘুম হচ্ছে না ভাল। তুমিই বলছিলে ওষুধ-বিষুধ টনিক-ফনিকে কাজ হয় না; তার চেয়ে রোজ একটু ওই খেলে ভাল হয়—।”
স্ত্রীর হাত থেকে লুঙ্গিটা নিল পশুপতি। “এখন তো বলছ ভাই, তারপর দু-দিন পরে বলবে, আমি বাড়িতে মদ ঢুকিয়েছি।”
“আহা রে, সোনার চাঁদ কিনা তুমি। বাইরে আর ও-জিনিস খাও না!”
“সে ন-মাসে ছ-মাসে এক-আধ দিন; তাও বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে।”
“থাক, আর বন্ধু-বান্ধব দেখিও না। …এবার না হয় বউয়ের পাল্লায় পড়ে খাও।”
“আমার আর কি, খেতেই পারি। পরে তোমায় কাঁদতে হবে।”
“কাঁদার বয়েস পেরিয়ে গেছে গো! কচি বউ হতাম, বয়স কম হত, বর বাড়ি ফিরে মাতলামি করত, পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতাম। চল্লিশ বছরের বুড়ি আমি, আমার আর কাঁদার কিছু নেই। তোমাকে বাপু সুস্থ রেখে যেতে পারলেই বাঁচি।”
লুঙ্গিটা পরে ফেলেছিল পশুপতি। ধুতি মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে স্ত্রীর হাতে দিল। ঠাট্টা করে বলল, “রেখে তো যাবে বলছ, কিন্তু কার কাছে রাখবে? বকুলের মার কাছে?”
মনোবীণা কাপড় গোছাতে গোছাতে বলল, “তোমার কি মুখ! বাড়ির ঝি নিয়ে ঠাট্টা! ঘেন্না হয়।”
পশুপতি জোর হেসে ফেলল। “শোনো ভাই মনো, আমি যদি হুইস্কি খাই—দেশি হুইস্কি, তা হলে কিন্তু মুখে বেশ গন্ধ হবে।”
আলনার কাছে সরে গেল মনোবীণা; বলল, “থিয়েটারের কত টাকার টিকিট পেলে?”
পশুপতি বলল, “দশ টাকার। পাঁচ-সাতখানাই আর ছিল।”
মনোবীণা আর দাঁড়াল না; বলল, “মুখেচোখে একটু জল দিয়ে এসো, চা আনছি।”
পশুপতি পাখার তলায় আরও একটু দাঁড়িয়ে থাকল। ঘাম শুকিয়ে এসেছে। দেরাজর দিকে তাকাতেই পুরো্ন চৌকোনো টাইমপিস ঘড়িটা চোখে পড়ল পৌনে সাত। কাল এতোক্ষণ থিয়েটারে।
পশুপতি থিয়েটারের ভক্ত। আজ তিরিশ বছর সে থিয়েটার দেখছে। বেশিও হতে পারে। শিশির ভাদুড়ি, দুর্গাদাস, ছবি বিশ্বাস—কিছুই তা বাদ যায়নি। আজকালকার থিয়েটার, তার তেমন ভাল লাগে না। তবু নেশা। মন ভরে না, তবু যায়। আর পশুপতি নানারকম অভিজ্ঞতা থেকে ধরে নিয়েছে, শনিবারের দিনটাই থিয়েটার দেখার ভাল দিন। বৃহস্পতিবারে থিয়েটারঅলারা বাড়ির লক্ষ্মী পুজোর মতন নমো নমো করে ‘প্লে’ সারে; আর রবিবার ডবল খেপ। আজকালকার সিনেমা-করা থিয়েটারের ছেলেগুলোর দমই থাকে না তো ডবল খেপ মারবে! শনিবারটাই ভাল।
বউয়ের কাছে এই সব গল্প বলে পশুপতি: শিশির ভাদুড়ির গল্প, দুর্গাদাসের গল্প, শান্তি গুপ্তা আর রানীবালার গল্প। গল্প শুনিয়ে বলে, “তুমি তো আর এ-সব দেখলে না ভাই মনো, কী সব অ্যাক্টর অ্যাকট্রেস ছিল তখন। …এখন তেমন অ্যাক্টর কই!”
পশুপতি তার বউকে সোহাগ করে ‘মনো বলে ‘ভাই’ বলে, আরও অনেক কিছু বলে।
মনোবীণা কলকাতার মেয়ে নয়। আসানসোলের দিকে কোলিয়ারিতে তার বাবা ম্যানেজারির চাকরি করত। পাঁচ ঘাটের জল খেয়ে সে মানুষ। বেচারি আর কোথ্থেকে কলকাতার থিয়েটারের খোঁজ রাখবে। বিয়ের পর পাকাপাকিভাবে সে কলকাতায়, এই হরি মিত্তির লেনের বাড়িতে। নয় নয় করেও আজ সতেরো আঠারো বছর কেটে গেল এই বাড়িতে। এই আঠারো বছরে শ্বশুর গিয়েছেন, শাশুড়ি গিয়েছেন গ্রহণের স্নান সারতে গিয়ে বাগবাজারের গঙ্গায়। এক ননদ ছিল, বিয়ের পর নাগপুর ছাড়িয়ে আরও দেড়-শো দু-শো মাইল দূরে চলে গেছে। বাপের বাড়ির তরফেও যে যার মতন মায়া কাটিয়ে চলে গেছে, যারা আছে তারাও নিজেদের সামলাতে অতিষ্ঠ। আঠারো বছর বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের আর বাপের বাড়ির কী থাকে। কিছুই নয়! কাছাকাছি থাকলে তবু হয়তো মুখ দেখাদেখি চলত, দূর পড়ে যাওয়ায় সেও বছরে এক-আধবার হয় কি হয় না।
শ্বশুরবাড়িতে মনোবীণার এখন স্বামী ছাড়া কেউ নেই, কিছু নেই। বাইশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল মনোবীণার। পঁচিশ বছরে একবার সন্তান-সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল; মাস-সাতেকের মাথায় সেটা নষ্ট হয়ে যায়। এই হরি মিত্তির লেনের বাড়িতে, ওই দোতলার সিঁড়ির মুখে সে পা পিছলে পড়ে যায়। তিন-চার ধাপ শুধু গড়িয়ে গিয়েছিল। তাতেই যা যাবার গেল। তারপর থেকে মনোবীণার আর কিছু হয়নি। ডাক্তার বদ্যি অনেক করেছে, ওষুধ খেয়েছে কতরকম, কিউরেট করিয়েছে, কিছু হয়নি। মাদুলি আংটিও পরেছে মনোবীণা, সাধু-সন্ন্যাসীর পায়ে পুজো দিয়ে এসেছে। কই কিছুই হল না।
মনোবীণার বয়েস এখন চল্লিশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে বেশ জানে, ছেলেপুলে হবার স্বাভাবিক বয়েস এটা নয়; এখন কিছু ঘটা মানে যমে-মানুষে টানাটানি। মনে মনে আর নিশ্চিত কোনো আশাও রাখে না। তবু এখনও সে কোনো কোনো মাসে হঠাৎ কেমন সচেতন হয়ে ক্যালেণ্ডারে তারিখ দেখে। দেখে আর দেখে। অপেক্ষা করে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়, রাত্রে ঘুমন্ত স্বামীর পাশে শুয়ে কতরকম কি ভাবে, সারা দিন সতর্ক হয়ে শরীর বাঁচায়। তারপর যখন তার পক্ষে যেটা স্বাভাবিক সেই ঘটনাটা ঘটে
—তখন তার দু-চোখ ভরে জল আসে, নিজের ওপর আক্রোশ হয়, ঘৃণা জাগে। পশুপতির সঙ্গে তার সেদিন তুমুল হয়ে যায়। অথচ মনোবীণা জানে, তার স্বামীর কোনো দোষ নেই। দোষ তার নিজের শরীরে। তবু, মনোবীণা ভাবে, একবার যখন হয়েছিল, আচমকাই হোক বা আকস্মিক হোক, তখন তো আবার হতে পারে। কেন। হয় না?
এক-এক দিন মন যখন এই সব কারণে উতলা থাকে মনোবীণা তখন ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকিয়ে তার প্রত্যাশিত দিনের পরও প্রতিটি বাড়তি দিনকে রত্নের মতন মুঠোয়. ধরে থাকে—দিন যায় দিন যায়, আর তারপর আচমকা সেই জিনিস ঘটে যায়—তখন মনোবীণার মনে হয়, তার হাত থেকে সব রত্ন জলে পড়ে গেল। হাত ফাঁকা, অসাড় নিঃস্ব। তখন সে কী যেন প্রচণ্ড আক্রোশে দোতলার সেই সিঁড়ির মুখ—যেখান থেকে পা পিছলে একদিন পড়ে গিয়েছিল সেই জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিরাগে, ঘৃণায়, প্রচণ্ড জ্বালায়। কত বছর আগে সে ঘটনা ঘটে গেছে—বছর পনরো, তবু মনোবীণার কেন যে এই অদ্ভুত রাগ।
পশুপতি বসে ছিল, মনোবীণা চা জলখাবার নিয়ে ঘরে এল।
“তুমি কাল অফিস থেকে ফিরবে কখন?” মনোবীণা জিজ্ঞেস করল।
“তিনটে নাগাদ, শনিবার তো!”
“তাসে বসবে না?”
“মাথা খারাপ। তোমার থিয়েটার।”
“এর বেলায় আমার! যখন নিজে টেনে নিয়ে বেরোও তখন দোষ থাকে না।”
পশুপতি পরোটার সঙ্গে অলুভাজা তুলে মুখে দিল, চিবোতে লাগল। তারপর বলল, “দোষ দিচ্ছি না, ভাই। বলছি হুকুম। তোমার হুকুম মানবো না এমন ক্ষমতা আমার নেই।”
“আহা, কি আমার বাধ্য?”
“তোমার বাধ্য না হলে কার হব! তুমি আমার বউ, বোন, ভাই, মা, বাবা সব সর্বস্ব। অলমাইটি।”
মনোবীণা হেসে ফেলে চোখের কটাক্ষ করল, বলল, “তোমার ইয়েটি—” বলে বুড়ো আঙুল দেখাল।
পশুপতি হাসিমুখে স্ত্রীকে দেখছিল।
মনোবীণা আর পশুপতির একটা যুগল ছবি আছে এ ঘরে। দেওয়ালে ঝুলছে। বিয়ের ঠিক পর পর ভোলা না হলেও কিছু পরে তোলা। ওই ছবির মনোবীণা ছিল রোগা-রোগা, টল্টলে চোখ ছাড়া মুখের আর কোথাও ভরা-ভারত ভাব ছিল না। আজকের মনোবীণা অন্যরকম; চেহারা ভারিক্কি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তেমন বিসদৃশ ভারি নয়, গড়নের মধ্যে ভোঁতা ভাব আসেনি, মোটামোটি গড়ন ঠিকই আছে। মুখ সামান্য গোল ধরনের, নাকটি মাঝারি, চোখ টানা টানা—; কিন্তু চোখের পাতা আর গালের কোল ফুলে থাকার জন্যে কম বয়েসের টল্টলানি নেই। মনোবীণার মাথার চুল কোনো কালেই খুব কালো ছিল না, আজ আরও কটা ধরনের কালচে। তবে চল্লিশ বছরের অনুপাতে তার মাথায় এখনও যথেষ্ট চুল, খোঁপা বাঁধতে অসুবিধে হয় না। কানের পাশে, কপালে মাথার চাঁদির দিকে দু-দশটা রুপোলি চুল চোখে পড়ে হয়তো। তা পড়ুক। তবু এই যে মনোবীণার চেহারা, তাতে বয়েস থাকলেও তার ভার কিংবা ভাঙন এখনও স্পষ্ট করে চোখে পড়ে না। হাত-পায়ের মাংস কেমন শক্ত রয়েছে, গলা কিংবা ঘাড়ের চামড়া কুঁচকে যায়নি। এখনও বুক নেমে আসেনি, ভারি এবং পূর্ণ হয়েও সবল, কোমরে পেটে বেয়াড়া চর্বি তার জমলল না, পেছনের দিক থেকেও তাকে শক্ত দেখায়, মনে হয় না চল্লিশ বছরের গেরস্থ বাঙালি বাড়ির বউ। কাদার মতন গলে না গিয়ে মনোবীণা এখনও শরীরটাকে মজবুত শক্ত রাখতে পেরেছে।
পশুপতির ধারণা, ছেলেপুলে না হবার জন্যেই তার বউয়ের শরীর বা গড়ন এখনও টিকে আছে। বাচ্চাকাচ্চার ধকলে মেয়েদের শরীর ভেঙে যায়, বুক-টুক নষ্ট হয়ে যায়, পেছন-টেছন থপথপ হয়ে পড়ে। মনোবীণার সে সব ঝাট এল না জীবনে। তা ছাড়া তার বউ বড় কাজের, শুয়ে-বসে গড়িয়ে সময় কাটাতে পারে না। বকুলের মা বাসনমাজা ঘর-মোজার কাজটুকুই যা করে, বাকি সব মনো নিজের হাতে, রান্না-বান্না থেকে যাবতীয় যা কিছু। হাতের কাজও কম জানে না, শীত পড়লেই কত যে আলতু-ফালতু বুনে দেয় পাড়ার লোকের, মেয়েরা এসে জামার ছাঁটকটি করিয়ে নিয়ে যায় হরদম। দুপুরে ঘন্টা দেড়-দুই শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়া ছাড়া মনোকে আলস্য করতে পশুপতি দেখেনি।
অবশ্য তাদের সংসার আর কতটুকু ! দু-জন মানুষ। এই দু-জন মানুষই তো এতোটা কাল পরস্পরের ওপর নির্ভর করে, পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে এল। এইভাবেই তারা এক জন অন্য জনের বিদায় পর্যন্ত কাটাবে। তারপর কী হবে—কেউ জানে না। ভাবতে গেলে মন এত মুষড়ে পড়ে যে পশুপতি ও সব ভবিষ্যতের কথা ভাবতে চায় না।
চায়ের কাপ মুখে তুলে পশুপতি স্ত্রীর দিকে কেমন মমতার চোখে তাকাল, বলল, “তুমি চা খাবে না?”
“আনছি।”
“যাও নিয়ে এসো, আমার ভাই তোমাকে ফেলে কিছু করতে ইচ্ছে করে না।”
“আহা, ঢঙ…! যখন বন্ধুদের সঙ্গে তাস নিয়ে বসো তখন মনোর কথা কত মনে পড়ে ভাই!”
“এই দেখো, কী মিথ্যে অপবাদটাই দিচ্ছ ! শনিবার দিনটাই যা অফিসে একটু কল্যাণদের সঙ্গে বসি। তাও তোমার পোষা ইয়ের মতন সন্ধ্যের আগেই গোয়ালে ফিরে আসি।”
মনোবীণা এই বয়সেও স্বামীকে বঙ্কিম কটাক্ষ হেনে জিব বের করে ভেঙাল।
পশুপতি একলা। মনোবীণা চা আনতে গেছে। নিজের চায়ের স্বাদটাও চমৎকার লাগছিল পশুপতির। মনো জানে, পশুপতি একটু শৌখিন ধাতের মানুষ। ভাল চা, মোটামুটি ভাল সিগারেট, অল্প কিন্তু পাঁচ রকম ব্যঞ্জন খেতে ভালবাসে। স্বামী যা ভালবাসে মনো সমস্ত করে। স্বামী কাপড়-জামা নিজের হাতে ধোয়া থেকে শুরু করে পায়ের জুতোটি পর্যন্ত রোজ ঝেড়ে মুছে কালি লাগিয়ে রাখে। আর পশুপতিও জানে, সে অফিস বেরোনোর পর থেকে যতক্ষণ না বাড়ি ফিরছে মনো হাঁ করে বসে থাকে। সারা দিনের মধ্যে এই আট-দশ ঘন্টা যা বিচ্ছেদ, নয়তো তাদের মধ্যে আর কোনো ছেদ নেই। সকালের দিকটায় তাড়া থাকে মনোবীণার, পশুপতিরও অফিস যাবার তাড়া, দু-জনের মধ্যে হাসি-তামাশা, রগড়, পেছনে লাগা তেমন হয় না। তাদের যা কিছ এই সন্ধের পর। কোন দিন ঘরে বসে শুধুই গাল-গল্প, কোনদিন দাবা নিয়ে বসে পড়ল স্বামী-স্ত্রী, কোনদিন চলল সিনেমায়, কোনদিন থিয়েটারে। আবার কখনও। দক্ষিণেশ্বরের দিকে চলে যায় বেড়াতে।
মনোবীণার সাধু-সন্ন্যাসীর বাতিকটা আগে তেমন ছিল না; সেটা মাঝে বেশ বেড়ে গিয়েছিল। আবার কমে যায়। তবে হালে আবার বাড়ছিল।
পশুপতি এসব পছন্দ করে না। সে দেব-দ্বিজ নিয়ে মাথা ঘামায় না। হিন্দুর ছেলে, ঠাকুর-দেবতা প্রণাম করতে তার আপত্তি নেই। দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে দুদণ্ড বসতেও তার অনিচ্ছা দেখা যায় না। কিন্তু গেরুয়া দেখলেই ছোট, আর মাদুলি তাবিজ পরো—এতে তার আপত্তি। স্ত্রীকে পশুপতি বুঝিয়েছে; বলেছে—’তোমার এখনও এত আফসোস কেন মনো, যা হয়নি তা মেনে নাও; সংসারে সকলের সব কিছু হয় না। আমাদের অফিসের একটি মেয়ের স্বামী মারা গেল বিয়ের দু-বছরের মাথায়, বাচ্চাকাচ্চাও নেই। আরও তো বছর তিন কেটে গেল, কই মেয়েটি আবার বিয়ে বিয়ে করে কেঁদে মরছে না তো। বিধবা হয়ে থাকার দুঃখ ছেলেপেলে না হবার চেয়ে কি বেশি নয়? …তা ছাড়া, তোমার বয়স হয়েছে, আমি বুড়ো হতে চললাম, এখন কিছু না হওয়াই মঙ্গলের। আমি ভাই স্পষ্ট বলছি, আমি বউ হারাতে রাজি নই, ছেলেপুলে শালা চুলোয় যাক, আই ডোন্ট কেয়ার।’
মনোবীণা বোঝে, আবার বোঝেও না। মাঝে মাঝে হঠাৎ তার মাথার পোকা নড়ে ওঠে।
ততক্ষণে মনোবীণা চা নিয়ে ফিরে এসেছে।
পশুপতি হঠাৎ বলল, “হাঁ ভাই মনো, তোমার সেই ইচ্ছাময়ী মা’র কি হল? সিঁথি ছেড়ে পালিয়েছেন? না এখনও আছেন?”
মনোবীণা বিছানার দিকে সরে গিয়ে বসল। স্বামীকে দেখল। বলল, কেন?
“জিজ্ঞেস করছি।”
“হঠাৎ?”
“বাঃ তুমি না যাও সেখানে?”
“বাজে কথা বলো না”, মনোবীণা রাগ করে বলল, “বার দুই-তিন গিয়েছি। প্রথমবার তোমার প্রাণের বড়দি নিয়ে গিয়েছিল।”
বড়দি মানে এই পাড়ার মাধুরীদি। পশুপতি ছেলেবেলা থেকেই বড়দি বলে। আসছে। সবাই বলে পাড়ার। তিনি প্রবীণা। বড়ই ধর্মপ্রাণ, অলৌকিক ক্রিয়াকর্মে বিশ্বাসী। হাঁপানিতে ভুগে ভুগে মরছেন, এখন তাকতুক করে শারীরিক কষ্টটা বাঁচাতে চান।
পশুপতি বলল, “আহা, রাগ করছ কেন? ইচ্ছাময়ী মা তোত ভালোই, বাবারা হলে আমার আপত্তি থাকতো।”
“তোমার সব তাতেই অবিশ্বাস।”
“মোটেই নয়। তোমার ওপর আমার যে কী বিশ্বাস তা যদি দেখাতে হয় ভাই তা হলে হনুমানের মতন বুক চিরতে হয়। বুক চিরলে দেখবে সেখানে শুধু মনো মনো লেখা।” বলতে বলতে পশুপতি প্রাণ খুলে হেসে উঠল।
দুই
থিয়েটারে তখন নাচ চলছিল। টানা এক ঘণ্টা বসে থাকার পর তবে নাচ এল। চারপাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, এই যে একটা ঘণ্টা সময়—এ যেন স্টেশনে গাড়ির অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে বসে থাকার মতন, যেই গাড়ি এল সকলেই চঞ্চল হয়ে পড়ল, পড়িমরি করে ছুটল জায়গা দখল করতে। অবশ্য এটা গাড়ি নয়, থিয়েটার; কাজেই হুড়োহুড়ি করে ছোটার উপায় নেই। কিন্তু অনেকটা সেই রকম চাঞ্চল্য। বিলাতি ঢঙের প্রবল বাজনার সঙ্গে বিলাস-নৃত্য। আলোর ঢেউ খেলে যাচ্ছে, স্থির থাকছে, আবার সরাসরি নৃত্যময়ীকে প্রখর, স্পষ্ট উজ্জ্বল করে তুলছে।
পশুপতি লক্ষ করে দেখল, নাচ শুরু হবার পর—পেছন থেকে কিছু কিছু অস্পষ্ট ধ্বনি ও গুঞ্জন ভেসে এল, কদাচিৎ দু-একবার ছোকরা বকাটে গলার উল্লাস। তার আশপাশে কেউ কেউ, স্বামী-স্ত্রী হোক অথবা না হোক, ফিসফিস করে কানে কানে কিছু বলাবলি করল, পরস্পরের চোখের দিকে তাকাল, দৃষ্টি সরাল, আবার নাচের দিকে চোখ রাখল। এ সব যে কি হয়’ বলার পরও চৰ্চকে চেহারায় এক ভদ্রলোক পাশের মহিলার কোলের ওপর হাত রাখল।
মনোবীণা স্বামীর মুখের দিকে তাকাল, যেন লক্ষ করল পশুপতি কী নজরে নাচটা দেখছে। সামান্য হেলে গেল স্বামীর কাঁধের দিকে, কাঁধে কাঁধ স্পর্শ করল, পায়ের চটি থেকে আস্তে আস্তে করে পা বের করল, করে স্বামীর পায়ের ওপর আলতো করে পা রাখল।
পশুপতি নস্যির গন্ধ পেল। কেউ হয়তো ঝাঁঝালো অবস্থায় নস্যি টেনে নিচ্ছে। একটি মেয়েলি গলা বেফসকা বলে ফেলল, ‘কোমরে চর্বি লেগেছে।’ বলেই চুপ করে গেল।
মনোবীণা সামান্য উসখুস করে কানে কানে কথা বলার মতন কী যেন বলল।
পশুপতি স্ত্রীর দিকে তাকাল।
“তা হলে?” পশুপতি নিচু গলায় শুধলো।
“চলো চলে যাই।”
“এখন কেমন করে বেরুবো। এটা শেষ হোক।”
নাচ শেষ হবার পর বিরতি। পশুপতি স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এল।
বাইরের ভিড় কাটিয়ে এসে পশুপতি বলল, “তুমি মাইরি কী ! শেষের দিকে আরও নাকি দুটো জবর নাচ আছে।”
“আহা, খুব যে…।”
“আমায় বলছ কেন, এই থিয়েটার তুমিই দেখতে চেয়েছিলে। রেগুলার তাগাদা মেরেছ।”
মনোবীণা সে কথার কোনো জবাব দিল না। “কটা বেজেছে?”
ঘড়ি দেখল পশুপতি। “আটটা বাজতে পাঁচ।”
“রিকশা নাও।”
কয়েক পা এগিয়ে পশুপতি রিকশা নিল। রিকশায় চেপে বউকে বলল, কলকাতায় কিছু স্পেশ্যাল রিকশা থাকা দরকার কি বললো, আমাদের মতন দু-জনের। সাইজের জন্যে…।”
মনোবীণা স্বামীকে কনুই দিয়ে ছোট করে গুতো মারল, “নাচ দেখে বুঝি ওইরকম ছিপছিপে চাইছ?”
“না ভাই, এ বয়সে ছপছপেই চাইছি।”
রিকশাঅলা এগুতেই মনোবীণা বলল, “বাজারের দিক দিয়ে যেতে বলো ওকে।”
“বাজার দিয়ে? দেরি হয়ে যাবে তো!”
“হোক।”
“না—মানে তুমি সামলাতে পারবে?”
“পারব।”
পশুপতি রিকশাকে বাজার দিয়ে যেতে বলল।
আকাশে মেঘ করেছে যেন। যদিও এটা বর্ষার শেষ, শরৎ চলছে, তবু কটা দিন খটখটে যাচ্ছিল। গরমও পড়েছিল। আজ সকাল থেকেই ঘোলাটে, মেঘলা-মেঘলা গিয়েছে। বাদলার গন্ধ এখন ভেসে আসছে আস্তে আস্তে; হয়তো এক পশলা নামবে। হাওয়াও দিয়েছে।
পশুপতি যেন আচমকা বাদলার গন্ধ নাকে টানতে টানতে গিয়ে স্ত্রীর কাঁধের কাছ থেকে কোনো সুঘ্রাণ পেল। বার দুই নাক টানল।
“কী মেখেছ গো?”
“কিছু না। সেই সেন্টটা…।”
“খসের গন্ধ না? বেশ লাগে।”
পশুপতি হঠাৎ কেমন সচেতন হয়ে স্ত্রীকে লক্ষ করল। কখনো কখনো এমন হয়—আগে যা নজরে আসেনি আচমকা তা নজরে এসে যায়। পশুপতির সেই রকম হল; দেখল: মনোরমা আজ সিল্ক পরেছে, সচরাচর পরে না; তার তাঁত পছন্দ—বলে, এ বয়সে আমাদের কি আর অত ছোপ-ছোপ রঙ ভাল লাগে—বুড়ি হয়ে গেলাম। সেই বুড়ি আজ ফিরোজা রঙের সিল্ক পরেছে, পাড়টা কী সুন্দর—অথচ একেবারে ঢালা, কোনো কারুকার্য নেই। গায়ের জামাটা শাড়ির রঙের। মনোবীণা যেভাবে শাড়ির আঁচল কাঁধের কাছে বার বার টেনে হাত ঢাকছিল—তাতে এবার পশুপতির নজরে পড়ল, তার বউ বগল-কাটা জামা পরেছে। সর্বনাশ, মনোবীণা। করেছে কি? এ ধরনের জামা দু-একটা করিয়েও সে পারেনি।
পশুপতি ঠাট্টা করে বলল, “ভাই মনো, তুমি আজ সারপ্রাইজ দিচ্ছ?”
“কেন?”
“এই ড্রেস। ওই ব্লাউজ।”
“নিজের হাতে তৈরি করেছি মশাই, তোমরা তো এসব দেখতে ভালবাস।”
“তোমায় আমি এত ভালবাসি যে তুমি যাই পরো, না-পারো আমার কিছু এসে যায় না।”
মনোবীণা স্বামীর হাঁটুর কাছে চিমটি কেটে দিল।
পশুপতি হাসতে লাগল। মনোবীণার গায়ের রঙ মন্দ নয়। আজ তার মুখ আরও ঝকঝকে অথচ মোলায়েম দেখাচ্ছিল। চোখ টান টান। মাথার খোঁপাটা বেশ বড়।
না, বৃষ্টি বোধ হয় এসেই যাবে। বাদলার গন্ধ বেশ নাকে লাগছে। সামান্য ধুলো, কাগজ-টাগজ, পাকা উড়ছে, লোকজন আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তায় শনিবারের সেই ভিড়।
বাজারের মুখে এসে মনোবীণা বলল, “এই, ওই দেখো ফুল।”
“ফুল ! ও, নেবে?”
“নিতে পার।”
“তা হলে নামি।”
“নামবার কি আছে? ফুলঅলাকে ডাকো। রিকশাটা একটু পাশ করে থামাক।”
রিকশা থামিয়ে ফুল কিনল মনোবীণা, বেলের মালা, খোঁপায় পরবে। রজনী গন্ধার ঝাড় নিল ডজন দুই।
আবার রিকশা চলতে লাগল।
“কটা বাজল গো?”
ঘড়ি দেখল না পশুপতি। বলল, “আটট দশ-পনেরো হবে।” বলে একটা সিগারেট ধরাল। স্ত্রীর গায়ের গন্ধ, বাদলার গন্ধ, ফুলের গন্ধ সব যেন মিলে-মিশে বিচিত্র এক গন্ধ তৈরি করছিল।
রিকশা চলেছে—চলছে, ট্যাক্সি গেল, একটা বাস কান কালা করে চলে গেল পাশ দিয়ে, বাতি নিবছে দোকানের, শেষ বেলায় হকাররা বাক্স গুছোচ্ছে, যেতে যেতে মনোবীণা স্বামীর হাঁটুর কাছে হাত রেখে চাপ দিল। “এই?”
“কী?”
“তুমি তো কষা মাংস খেতে ভালবাস!”
“বাসতাম। কেন?”
মনোবীণা একটু চুপ করে থেকে বলল, “রাগ করবে না?”
“রাগের কী আছে! ব্যাপারটা কী?”
“তুমি তো আজ ওইটে খাবে। আমি বলছিলাম—একটু কষা মাংস ওই পাঞ্জাবীর দোকান থেকে নিয়ে নাও না। বাড়িতে মাংস-টাংস নেই। তুমিই বললা—ওই সবের সঙ্গে একটু মাংস খাওয়া ভাল।”
ও! আচ্ছা! …তুমি খাবে মাংস?”
“খাবোখন একটু।”
“কিন্তু মাংস নিতে হলে দেরি হবে একটু। তোমার আবার অতক্ষণ…। ফ্যাসাদে পড়ে যাবে।”
“কিছু হবে না। তুমি যাও।”
রিকশাঅলাকে পশুপতি রসিকতা করে বলল, “তোকে বাবা বেশি পয়সা দেব আবার একটু পাশ করে দাঁড়া। আমার বউয়ের কষা খেতে সাধ হয়েছে। লক্ষ্মী বাবা আমার, বউ কি জিনিস, জানিস তো।”
রিকশাঅলা আবার রিকশা দাঁড় করাল এগিয়ে, একপাশে। পশুপতি নেমে গেল। মিঠে পানও আনতে বলল মনোবীণা।
মনোবীণা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বসে থাকল। তারপর আকাশের দিকে তাকাল। একটাও তারা চোখে পড়ছে না। মেঘ হয়েছে। দূরে কোথাও মেঘ ডাকল। এই জায়গাটা সামান্য ঝাপসা। দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে আশে-পাশের।
এখন কটা বাজল? আটটা কুড়ি না পঁচিশ? সাড়ে আটটা কী? অনেক সময় রয়েছে হাতে, অনেক।
থিয়েটারের নাচ মনে পড়ল মনোবীণার। ওই পোশাক, ওই নাচ! অত সব আলো। কত বয়েস হবে মেয়েটার? তিরিশের কাছকাছি হতে পারে। বোঝা যায় না। শরীর রেখেছে কত যত্ন করে। পেট চালাবার জন্যে না রেখে উপায় কি! যতই বলল, উরু ভারী লাগছিল, পায়ের গোছ কিন্তু বেশ। কোমর বাপু এমন কিছু সরু নয়। পেছনটা টনটনে। হাত-টাত কিন্তু তেমন একটা খেলানো নয়।
পশুপতির কেমন লাগছিল? মনোবীণা চোরা চোখে যতবার স্বামীর দিকে তাকিয়েছে, দেখেছে—পশুপতি কৌতুহলী ও সামান্য লোভী-লোভী চোখে নাচের মেয়েটাকে দেখেছে।
মনোবীণা মনে মনে হাসল। দেখুক না, দেখুক। দেখার জন্যেই তো।
তিন
বাড়ি ফেরার পর পরই বৃষ্টি নেমে গেল।
বাতি জ্বালিয়ে পাখা চালিয়ে দিল মনোবীণা, বলল, ‘জানলা খুলো না—ওদিকে ছাট রয়েছে।’ বলে ফুলগুলো দেরাজের মাথায় রাখল। বেলের মালা ড্রেসিং টেবিলে।
পশুপতি হাতের কষা মাংসর ভাঁড়টা মাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বলল, “দারুণ গন্ধ দিচ্ছে মাইরি।”
মনোবীণা এগিয়ে এসে ভাঁড়টা নিল। বলল, “তা তো দেবেই, এখন বাবুর কত গন্ধই দেবে। যাকগে, জামা-কাপড় ছেড়ে ওটা খোল। আমি বাথরুম থেকে আসছি।”
মনোবীণা চলে গেল।
পশুপতি সামান্য দাঁড়িয়ে থেকে জামাটা খুলতে লাগল। খোলার সময় বুক পকেট থেকে খুচরো টাকার সঙ্গে থিয়েটারের টিকিট দুটো মাটিতে পড়ল। মেঝে থেকে টাকা কুড়োবার সময় টিকিট দুটোর ছেড়া অংশ কুড়িয়ে নিল। একেবারে জলে গেল টাকাটা। মনোর যা কাণ্ড! হবার হ’—এই সময়ে হুস করে হয়ে গেল। মেয়েদের ব্যাপারই আলাদা।
জামা খুলে আলনার পাশে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রেখে পশুপতি কাপড়-টাপড় পালটে নিয়েছে এমন সময় মনোবীণা ঘরে এল।
মনোবীণা বলল, “না গো, কিছু নয়।”
পশুপতি স্ত্রীর দিকে তাকাল। সামান্য যেন অবাক। “কিছু নয়?”
মাথা নাড়ল মনোবীণা।
“যাঃ, কুড়িটা টাকা একেবারে জলে চলে গেল। তুমি মাইরি যা কাণ্ড করো, তোমার জন্যে অমন সব লাচ-ফাচও দেখতে পেলাম না।”
“বাঃ, তা আমি কি করব! মনে হল—তাই বলেছিলাম।”
“মনে হল—! তুমি ভাই মেয়ে হয়েছিলে কেন? ইয়ের ব্যাপারটাতেই এ রকম মনে হয় কেন?” রঙ্গ করে পশুপতি বলল।
মনোবীণা নকল ধমক দিয়ে বলল, “নিজে একবার মেয়ে হয়ে দেখলে পার, কি মনে হয় আর না হয়! যাও, বাথরুম থেকে ঘুরে এস! …ওটা বের করে দেব?
“দাও।”
পশুপতি ঘর ছেড়ে চলে গেল।
মনোবীণা বেশ হালকাভাবে একবার জানলার দিকে গেল। এই বৃষ্টিতে সত্যি সত্যি তেমন কিছু ছাট আসার কথা নয়। তবু জানালা বন্ধ থাকাই ভাল। খোলা থাকলেই তুলসীদের বাড়ি থেকে এই ঘরের কিছু না কিছু চোখে পড়ে, পরদা থাকা সত্ত্বেও। বাদলা বাতাস আর পাখার হাওয়ায় ঘর এখন ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। মনোবীণা প্রথমে দেরাজের মাথা থেকে রজনীগন্ধার ডাঁটিগুলো নিয়ে সাজাল। দেরাজের মাথায় রাখল। কটা, পুরনো ফুলদানিতে। বাকি কটা কাচের গ্লাসে করে ড্রেসিং টেবিলে রাখল। কাঠের ভারী আলমারি খুলল। আলমারির মাথার ওপরই চাবির গোছা পড়ে ছিল। বোতলটা বার করল। চ্যাপটা ছোট বোতল। বড়োয় দরকার কি! বেশি ভাল না। বোতলের মধ্যে হালকা সোনালি রঙের জলো জিনিসটা দেখল। লেবেল পড়ল। সীল করা বোতলের ওপরই নাক রেখে বার দুই টানল।
তারপর আলমারির মধ্যে আবার তাকিয়ে থাকল। শাড়িগুলো দেখতে লাগল। তাঁতের শাড়িই বেশি, হালকা রঙেরই যত শাড়ি। সিল্ক অল্প; নাইলন গোটা তিন। তার মধ্যে ছাপ-ছোপঅলা দুটো। একটাই মাত্র একেবারে প্লেন, ঘন নীল রঙের। কী মনে করে মনোবীণা ওই শাড়িটাই বার করে নিল। নিয়ে আলমারির অন্য তাক ঘাঁটতে লাগল, জামাটা যেখানে থাকে। ঘেঁটে ঘেঁটে গোটা চারেক নিচের জামা বার করল। দুটো মামুলি ছাঁটের অবশ্য ভাল কাপড়ের ভাল ইলাস্টিকের। অন্য দুটোর মধ্যে একটা কালো, সিল্কের। অন্যটার বুকের কাছে লেসের কাজ, তলায় নেট, কাপড়টুকু নাইলন। মনোবীণা লেসের কাজ করাটাই পছন্দ করে নিল।
আলমারি বন্ধ করে মনোবীণা ড্রেসিং টেবিলের দিকে সরে আসতেই পশুপতি ঘরে এল।
“বাইরে খুব বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, রাত্রে কলকাতা ভাসাবে, পশুপতি বলল, একটু থেমে মুখ মুছতে মুছতে সরে এল “ভাসাক। কাল রবিবার। শালা খিচুড়ি আর ইলিশ-মাছ লাগিয়ে কর্তাগিন্নী ঘুম মারব। দাও, চিরুনিটা দাও একবার।”
চিরুনি দিল মনোবীণা। “হ্যাঁ গো তোমায় কী কী দেব?”
“কিসের?”
মনোবীণা হুইস্কির বোতলটা দেখাল।
“সেরেফ জল দাও, সোড়া-টোডা তো নেই। জল দাও আর কাচের গ্লাস। …তুমি একটু টেস্ট করবে নাকি? তাহলে দুটো গ্লাস এনো।”
“আমার টেস্ট করে দরকার নেই; তুমি করো।”
“আমি তো করবোই; রক্তের গন্ধ পেলে বাঘ কখনো ছাড়ে ভাই!”
“বাঘ না শেয়াল?” মনোবীণা মুখের ভঙ্গি করে হাসল।
চিরুনি রেখে দিল পশুপতি। “তুমি কি বলছ! আমি বাঘের বাবা সিংহ। একটা জাত-সিংহকে শেয়াল বলছ! জানো, আমরা সিংহী—পশুপতি সিংহ…”
“খুব হয়েছে সিংহমশাই, কাজের সময় দেখব। এখন দয়া করে বলুন, এর সঙ্গে কী খাবেন?”
“কী আবার খাব! আছে কি তোমার? পাঞ্জাবীর দোকান থেকে দুটো কাটলেট নিয়ে এলে হত। পাঁপর-টাঁপরও চলতে পারত, পট্যাটো চিপস…। যাক যে, শুধুই দাও তুমি!”
মাথা নাড়ল মনোবীণা। “না, শুধু শুধু খেতে দেব না। শুনেছি লিভার নষ্ট হয়।”
“দূর বাব্বা! একদিন একরত্তি হুইস্কিতে লিভার নষ্ট হবে কি? তুমি পাগল নাকি?”
মাথা নাড়তে নাড়তে মনোবীণা বলল, “না, আমি শুধু পেটে খেতে দেব না। …বেশ তো, কষা মাংস খাও…।”
“রাত্রে খাব রুটির সঙ্গে।”
“খেয়ো। এখন দু-এক টুকরো খাও।”
পশুপতি খুঁতখুঁত করে বলল, “দাও তবে।”
হাতের সেই শাড়ি আর নিচের জামাটা আলনায় সরিয়ে রেখেছিল আগেই মনোবীণা। হুইস্কির বোতলটা হাতেই ছিল। স্বামীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “খোলো, আমি সব আনছি।”
পশুপতি হাত বাড়াল।
মনোবীণা পাশের ঘর থেকে একে-একে সব এনে গুছিয়ে দিল। তাদের হরি মিত্তির লেনের এই বাড়িটা সাবেকী। পশুপতির বাবা চন্দ্রনাথ শীলের কাছ থেকে কিনেছিলেন। পার্টিশান করা বাড়ি। ওপরে মাঝারি ধরনের দুটো ঘর—আর রাতের কাজ চালাবার জন্যে ছোট বাথরুম। নিচে রান্নাঘর, ভাঁড়ার, কল-টল, বাথরুম। দু-জন মানুষের সংসার বলে মনোবীণা বিকেলের দিকে আর রান্নাঘরে নামে না। দোতলায় পাশের ঘরে খাবার-টাবার এনে রেখে দেয়। রাত্রে খাবার আগে জনতা স্টোভ জ্বালিয়ে গরম করে। কিংবা টুক্টাক কিছু করে নেয়। ওই ঘরে তাদের খাওয়া-দাওয়া।
পশুপতিকে সব সাজিয়ে দিয়ে মনোবীণা আবার একবার ঘড়িটা দেখল। ঘড়ি সে বার বারই দেখছে। নটা বেজে গেছে।
মনোবীণা বলল, “তুমি যাও; আমি বাথরুম থেকে আসছি।”
“আবার বাথরুম! এই তো এসেই ঢুকেছিলে।”
“সে তো ইয়ের জন্যে। মুখটা একটু ধুয়ে আসি।”
পশুপতি কিছু বলল না। বড় মাপের হুইস্কি ঢেলে নিয়ে মাপ মতন জল মেশাতে লাগল।
মনোবীণা বাথরুমে চলে গেল।
ফিরতে মনোবীণার খানিকটা দেরিই হল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ও যে পাশের ঘরে গিয়েছে পশুপতি বুঝতে পারছিল। সাড়া পেয়েছে দু-চার বার। তারপর চুপচাপ। বৃষ্টির সেই পাতলা ঝিরঝিরে ভাব অল্পের জন্যে থেমে গিয়ে আবার জোর বৃষ্টি নেমেছে। মেঘ ডাকছে মাথার ওপর। ভাদ্রের শেষে এই বৃষ্টি হয়তো সারা রাত চলবে। চলুক। কাল রবিবার। পশুপতি থোড়াই কেয়ার করে।
মনোবীণা ঘরে এল।
পশুপতি অবাক হয়ে স্ত্রীকে দেখল। ঘরের শাড়ি জামা পরনে নেই, তার বদলে সস্তা তসরের শাড়ি। কোনোরকমে গায়ে জড়ানো, গায়ে জামা নেই, পরনে সায়া নেই।
“কী ব্যাপার?” পশুপতি বলল।
মনোবীণা হেসে বলল, “কিছু না। তখন থিয়েটারে যাবার সময় সন্ধে দিতে ভুলে গিয়েছিলুম। মার নারায়ণের কাছে ধূপ-ধুনো দিইনি।’
“ও!”
পশুপতির মা বেঁচে থাকতে নারায়ণ-টারায়ণ রেখেছিলেন, জল বাতাসা দিতেন সকালে, সন্ধে বেলায় ধূপ-ধুনো। ছেলের বউ-শাশুড়ি মারা যাবার পর থেকে নিয়মটা মেনে যায়। পশুপতির খেয়ালও থাকে না। সকাল সন্ধে কখন মনো জল বাতাসা। দিচ্ছে—কে তার খোঁজ রাখে। তবু মনোবীণাকে তসর-টসর পরতে সে বড় দেখেনি।
মনোবীণা স্বামীকে আবার খানিকটা মদ ঢেলে নিতে দেখল।
“কত খাচ্ছ?”
“এই তো, দু নম্বর নিচ্ছি।”
“বেশি খেও না।”
“না, তিন পর্যন্ত চালাব।”
“তারপর মাতাল হবে।”
“আরে না, আমি অত পাতি মালখোর নয়।”
মনোবীণা স্বামীর দিকে এগিয়ে এল। “দেখি, তোমার মুখের গন্ধ দেখি!”।
পশুপতি হাঁ করল, মনোবীণা একেবারে স্বামীর গায়ে ঝুঁকে পড়ে মুখ নামিয়ে গন্ধ নিতে লাগল।
পশুপতি হাত বাড়াল।
“আঃ, লাগে—!” মনোবীণা স্বামীর হাত বুকের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে চোখে কটাক্ষ করে হাসল। “বুড়ি হয়ে গিয়েছি না?”
“কোন শালা তোমায় বুড়ি বলে?”
মনোবীণা সরে গেল, যাবার সময় যেন তার হাঁটার ভঙ্গিটা এমন লঘু করল যে পিছন দুলে উঠল।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল মনোবীণা। আয়নার দিকে তার মুখ, কাচের তলার দিকে পশুপতির মুখ দেখা যাচ্ছে। স্বামীর দিকে পিছন করে দাঁড়িয়েই মনোবীণা রঙ্গের গলায় বলল, “থিয়েটারের ওই নাচিয়ে মেয়েটাকে তোমার খুব ভাল লাগছিল।”
“ধুৎ—!”
“বাজে কথা বলো না, চোখ বড় বড় করে গিলছিলে।”
“গিলতে আর দিলে কই, কান ধরে উঠিয়ে নিয়ে এলে।”
মনোবীণা পাশ ফিরে দাঁড়াল। “সত্যি। একেই পুরুষমানুষ বলে।”
পশুপতি খেতে খেতে হসির গলায় বলল, “সে তো ভাই কবে—সেই মনি-ঋষিদের টাইম থেকেই চলে আসছে। তোমরা নাচো, আমরা ধ্যান-ফ্যান ভেঙে লাফিয়ে উঠি।”
মনোবীণা আলনার দিকে সরে গেল, হাত বাড়াল! “তুমি যতই বলো, সাজগোজ করলে আমরাও এমন কিছু ফেলনা নয়।”
“কে বলল তুমি ফেলনা।”
“নই-ই তো” বলতে বলতে মনোবীণা আলনা থেকে সিলোনিজ সায়াটা তুলে নিল। নরম; সুতির সায়ার মতন বড় ঘেরও নয়। বড় নরম, শরীরের সঙ্গে আঁটসাঁট হয়ে থাকে, সিরসির করে গা। গায়ের ওপর থেকে তসরের শাড়িটা আলগা করে মাথা গলিয়ে সায়াটা কোমরের কাছে ফেলে দিল মনোবীণা : দিতে সায়াটা পায়ের কাছে নেমে গেল, তলার শাড়িটা টেনে টেনে বার করে নিতে লাগল।
পশুপতি একটা সিগারেট ধরাল। একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া হচ্ছে। হোক।
স্বামীর দিকে পিঠ। মনোবীণা তসরের শাড়ি আলগোছা তুলে নিয়ে আলনায় রাখল। কাঁধ পিঠ আবরণহীন। অল্প বয়সের, কচি বউয়ের লজ্জা তার নেই। কারই বা থাকে! যে দেখার লোক সে তো স্বামী।
লেসের কাজ করা জালি বসানো নিচের জামাটা নিয়ে বুক ঢাকতে ঢাকতে বলল, “ওই মেয়েটার মুখ কিন্তু বাপু ভাল না। অত রঙচঙ করেছে মুখে, চোখের টান তো কান পর্যন্ত ছড়িয়েছে, অথচ মুখের কোনো ছিরি নেই। মোটা মোটা ঠোঁট, নাকও মোটা। গাল কত বসা দেখেছ?”
পশুপতি কষা মাংসের প্লেট থেকে আরও একটু নিল। তেমন বানাতে পারেনি। মাংসটা বোধ হয় তেমন ভাল না।
নাইলনের সেই গভীর নীল শাড়িটা পরতে পরতে মনোবীণা বলল, “তোমার খুব আফসোস হচ্ছে, না।’
“কেন?”
“শেষের নাচগুলো দেখতে পেলে না?’
“দেখতে দিলে না—”
“রাখো ওই নাচ দেখতে হয় না। কাপড় জামা খুলে মাথার ওপর হাত তুলে কোমর দোলালে অমন নাচ আমরাও নাচতে পারি।” বলতে বলতে মনোবীণা একবার কোমরের কাছে শাড়ি আর সায়ার তলায় কি যেন দেখে নিল।
পশুপতির এবার অল্প-অল্প নেশার টান লাগছিল। জিব সামান্য মোটা হচ্ছিল।
শাড়ি পরে মনোবীণা আবার ড্রেসিং টেবিলের কাছে এল। মাথার খোঁপাটা আলগা হয়ে গিয়েছিল। ঠিক করল। বেল ফুলের মালা খোঁপায় জড়াল বাহারী করে।
“কি গো সিংহীমশাই কথা বলছ না যে?”
“বলতে পারছি না।”
“কেন?”
যা দিচ্ছ! আজ যেন টপ ফর্ম তোমার?”
“শাড়িটার জন্যে বলছ! এ তো পুরোনো, গত বছরের আগে তুমি কিনে দিয়েছিলে। পাড় নেই বলে পরি না। খুব কম পরেছি। আজ ভেবেছিলাম পরব থিয়েটারে যাবার সময়। লজ্জা করল। আলনায় রেখে গিয়েছিলাম। খুলে ফেলব?”
পশুপতি হাসতে লাগল। “খুলবে কেন! শাড়িটা তোমায় বেশ মানায়। পরলে মাইরি দশ বছর বয়েস কমে যায় তোমার।”
“ইয়ার্কি”, মনোবীণা টেবিলের পাশে রাখা রজনীগন্ধার ডাঁটি থেকে ফুল ছিড়ে নিয়ে স্বামীর দিকে ছুঁড়ে মারল।
পশুপতি মজার গলায় বলল, “তোমায় ভাল বললেও বিশ্বাস করবে না, এ তো মহা ফ্যাসাদ—?”
মনোবীণা মুখের শোভা বাড়াতে লাগল হালকা করে, দেবে কি দেবে না করে চোখে সুর্মা দিল।
পশুপতি দু-বারই বেশি বেশি নিয়েছিল। ফুরিয়ে যাচ্ছে দেখে গ্লাসেরটুকু শেষ করে আবার হুইস্কি নিল।
মনোবীণা এবার দেরাজের কাছে গিয়ে মিঠে পানের খিলি নিয়ে একটা পান খেল, তারপর হেলে দাঁড়িয়ে থাকল। “আবার ঢালছ কিন্তু।”
“তিন নম্বর ঢালছি।”
“এরপর নেশায় গড়াগড়ি দেবে।”
“না ভাই, দেব না। যদি দিই তা হলেও নিজের ঘরে বিছানায় দেব, রাস্তার নালায় দেব না। তবে তুমি ভেব না ভাই, মনো; আমি পরিষ্কার তোমায় দেখতে পাচ্ছি।
“পাচ্ছ?”
“আলবাত পাচ্ছি।”
মনোবীণা এবার হালকা চালে স্বামীর কাছে এল।
পশুপতি অল্প জল মিশিয়ে নিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে কাছে টানল।
“তোমার হাত গরম গরম লাগছে”, মনোবীণা বলল।
“এসব খাবার পর একটু লাগে”, পশুপতি স্ত্রীকে আরও কাছে টানল।
“বেশি গরম মশাই, একটু নয়।”
“সে তোমার জন্যে।”
মনোবীণা স্বামীর কাছে বসল। “এখন কী করবে?”
“তোমায় দেখব।”
“রাখো। আমায় দেখার কিছু নেই। আঠারো বছর ধরে দেখছ। তাও যদি কচি থাকতাম—।”
“কচিতে গুলি মার। আমি কচি-ফচি চাই না। তুমি এখনও কেমন শেপে আছ ভাই, নো টোল-টাল।”
“আহা—!”
‘মাইরি বলছি ! তোমার ওভার ওয়েট নেই, কোথাও লুজনেস নেই। এই বয়সে এমন টাইট নরম্যাল ফিগার কে রাখে গো ! বয়েসে যা মানায় তোমার ঠিক সেই রকম! আই লাভ ইউ মাই ডিয়ার, বেজী।”
মনোবীণা স্বামীর কাঁধের কাছটায় কামড়ে দিল ছেলেমানুষীর ভঙ্গিতে। পশুপতি বউকে কখনো কখনো আদরে গলে গিয়ে ‘বেজী’ বলে। বাঁজা-র অপভ্রংশ। মনোবীণা রাগ করে না, পশুপাত এমন সময় বলে যখন তার আদর আর সোহাগের ভরা ভাব মনোবীণারও টলটলে মনের অবস্থা, কাজেই তখন রাগের আর কিছু থাকে না।
পশুপতি বউকে মুখের কাছে নিয়ে ঘাড়ের কাছে মুখ ঘষতে লাগল। খোঁপায় তার নাক লাগছে। বেলফুলের গন্ধ। বৃষ্টির শব্দটাও কানে এল।
“মনো !”
‘উঁ!’
“তুমি আমার কে?”
“বউ।”
“ধৎ, শুধু বউ কেন হবে! জায়া, জননী, কন্যা, ভ্রাতা, ভগিনী—সব—অলমাইটি।”
‘থিয়েটার হচ্ছে?”
“না ভাই, দিব্যি করে বলছি—থিয়েটার নয়। সে এককালে করতাম। কলেজে পড়ার সময়। তখন তুমি ছিলে না।”
পশুপতি স্ত্রীকে আদর করতে লাগল। মনোবীণা স্বামীর গেঞ্জির বুকের কাছটা আঙুল দিয়ে সরিয়ে মাথা ঘষতে লাগল। সিঁদুরের দাগ লাগল বুকে গেঞ্জিতে।
পশুপতি মুখ সরিয়ে এবার অনেকটা খেয়ে নিল একসঙ্গে।
মনোবীণা পানের ঠোঁট পশুপতির গালে ঘষে দিয়ে কানের লতি কামড়ে দিল।
“পশুপতি স্ত্রীর শাড়ির আঁচল খুলে দিল। তার নেশা হয়েছে। চোখ টানছিল। নিঃশ্বাস গরম। মাথা ঝুঁকে যাচ্ছে।
“মনো।”
“বলো।”
“আমরা খুব হ্যাপি। আজকাল স্বামী-স্ত্রীরা খুব কম হ্যাপি হয়। শুনি তো বন্ধু-বান্ধবের কাছে। সব সময় গজগজ করছে। আমরা কিন্তু সুখী। কল্যাণরা বলে, পশুপতিদা তুমি স্ত্রৈণ। আমি বলি; ইডিয়েট, তোরা তো বউকে শুধু ইউটিলাইজ করিস ভালবাসিস না। আমি ভালবাসি। বউ ছাড়া আমার কেউ নেই। ঠিক কি না বলো?”
মনোবীণা দূর থেকেই ঘড়িটা দেখল। টাইমপিস ঘড়ি। নটা চল্লিশ মতন।
সময়টা দেখার পর মনোবীণার বুক যেন কেঁপে উঠল। আর সাত মিনিট। তারপর সেই যোগ। শুভ সময় পড়ে যাবে। প্রায় সোয়া-ঘণ্টা থাকবে। মনোবীণা এতই চঞ্চল ও অধৈর্য হল যে তার হাত কাঁপতে লাগল। সামান্য ঘাম লাগল বুকে।
পশুপতি স্ত্রীর শাড়ি সরিয়ে দিচ্ছিল। বুকে-পিঠে কাপড় নেই; কোমর থেকে আঁচলটা ঝুলে মাটিতে গড়াচ্ছে। সেই চমৎকার লেসের কাজ করা, জালি দেওয়া নিচের জামাটা পশুপতি দেখতে লাগল। ভরাট, গোল অথচ শক্ত হাত, ডুবে থাকা কণ্ঠা, খাটো গলা—পশুপতি স্ত্রীর কোনো খুঁত দেখতে পেল না। পিঠের দিকে হাত বাড়াল। মেদ এমন করে মাখানো যাতে সমস্ত পিঠ মোলায়েম হয়ে আছে। পশুপতি স্ত্রীর বুক এবং ওপর পেটের দিকে নেশা এবং কামনার চোখে তাকিয়ে বলল, “বেজী, কে বলবে তোমার বয়েস চল্লিশ! চল্লিশে এই চেহারা। কাশীর পাকা পেয়ারার মতন। মাইরি”, বলতে বলতে পশুপতি স্ত্রীকে মুখের কাছে টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে চেপে থাকল।
মনোবীণা ওই অবস্থাতেই ঘাড় ঘুরিয়ে আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর স্বামীর মাথার চুল নিয়ে খেলা করতে লাগল। পশুপতি ঠিক বুকের ওপর লেসে মুখ রেখে ঠোঁট দিয়ে কামড়াচ্ছে।
“আর খাবে না?” মনোবীণা গাঢ় গলায় বলল।
পশুপতি আবেগের দু-চারটে শব্দ করল, ছেলেমানুষের ঢঙে আদর করতে লাগল বুকে মুখ গুঁজে, তারপর মুখ সরিয়ে নিল। এখনও গ্লাসে খানিকটা রয়েছে। ঝোঁকের মাথায় পুরোটাই এক চুমুকে খেয়ে ফেলল।
“তুমি ভাই, পাগল করে দিচ্ছ” পশুপতি কামের গলায় বলল। বলে স্ত্রীর পিঠের দিকে হাত বাড়াল। বেশ ঘাম হচ্ছিল তার। চোখ লালচে, পাতা ভারী হয়ে এসেছে। জড়ানো জিবে পশুপতি বলল, “বাঁজা বউয়ের একটা আলাদা-চার্ম আছে ভাই মনো, সে তুমি যাই বলল। ভেরি সলিড !”
মনোবীণা স্বামীর হাত সরিয়ে দেবার জন্যে সামান্য হেলে গেল পাশে। “টেনো না, ছিঁড়ে যাবে। চলো, বিছানায় চলো।”
পশুপতিই উঠে দাঁড়াল, না মনোবীণাই স্বামীর হাত ধরে টেনে নিচ্ছিল বোঝা গেল না; পশুপতি উঠে দাঁড়াল। সামান্য হেলে পড়ছিল।
মনোবীণা স্বামীকে নিয়ে বিছানায় আসার সময় পশুপতি যেন খেলাচ্ছলে স্ত্রীর শাড়ি টেনে টেনে খুলে দিতে লাগল। মনোবীণা খুশি হচ্ছিল, তবু চাপা গলায় বলল— “কি করছ? কাপড়-চোপড় সব খুলে দিচ্ছ।”
“দেব, আলবাত দেব। নিজের বউয়ের কাপড় খুলছি কোন শালা বলবে—” বলেই পশুপতির মাথায় বিদ্যে জাহিরের ঝোঁক চাপল, বলল, “তোমরা ভাই শুধু দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণটাই জান? ডু ইউ নো দি বিউটিফুল চ্যাপটার? শিভা ওয়াজ মেকিং লাভ উইথ উমা? মাইরি মনো, শিবেবেটা উমারাণীর গায়ে এক টুকরো আঁশও থাকতে দেয়নি। কুমারসম্ভব পড়ো। সংস্কৃত ভুলে মেরে দিয়েছি—নয়তো শ্লোকটা শুনিয়ে দিতাম।”
পশুপতি বিছানায় বসে পড়ল। মনোবীণা সামনে দাঁড়িয়ে। পশুপতি দু-হাতে কোমর জড়িয়ে ধরেছে মনোবীণার। নেশা আর কামের ঘোলাটে চোখে দেখছে স্ত্রীকে। দেখতে দেখতে কাছে—নিজের মুখের কাছে টেনে নিল। স্ত্রীর বুক পেটে কোমরে মুখ ঘষতে লাগল জোরে জোরে, চুমু খেতে লাগল। মনোবীণা নিচের জামার পিঠের দিকে হুক খুলে ফেলল। পশুপতি ছেলেমানুষের মতন বলতে লাগল, “তোমায় আমার এতো ভাল লাগে মনো—এতো ভাল লাগে…তোমায় আমি কেন এত ভালবাসি, কেন, কেন?” পশুপতির কথাগুলো যেন ভাঙা রেকর্ডের একই জায়গায় পড়ে বার বার বাজতে লাগল।
মনোবীণা আর ঘড়ির দিকে তাকাল না। দরকার নেই। সময় হয়ে গেছে।
“তোমার সবটাই কী নরম মনো, বিশ্রী নরম নয়: ভেতরে শক্ত…বাইরে নরম। …এমন বউ লাখে একটা জোটে”, বলতে বলতে পশুপতি স্ত্রীকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আড়াআড়ি।
মনোবীণার মনে হল, সেই শুভ সময় শুরু হয়ে গেছে। পশুপতি তার বুক থেকে কাপড়ের শেষ আবরণটুকু খুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল। পাগলের মত চুমু খাচ্ছে। খাক। একটু জোরে দাঁত দিল, দিক। মনোবীণা কিছুই গ্রাহ্য করতে চায় না। অশ্বিনী নক্ষত্রের সেই শুভ যোগ চলছে এখন। আজ ত্রয়োদশী। মনোবীণার আজ বারো দিন চলছে। সারাদিন সে শুদ্ধ, একমন, একই ধ্যান নিয়ে থেকেছে। আর থাকার কথা নয়।
যেটুকু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল মনোবীণা তার মধেই তার মাথার খোঁপা আলগা হয়ে গেছে, ফুলের মালা ছিঁড়ে পড়েছে, পশুপতি যেন দস্যুর মতম তার সমস্ত কিছু লুঠে নিচ্ছে। নিক। মনোবীণার এই ইচ্ছা ছিল। সাধ ছিল। ন’টা বাহান্নোর পর এই যে যোগ পড়েছে এই শুভ যোগের মধ্যেই মনোবীণাকে যা কিছু পূরণ করে নিতে হবে। মনস্কাম-সিদ্ধ যোগ তার। কৃষ্ণপক্ষ। ত্রয়োদশী তিথি। অশ্বিনী নক্ষত্র।
পশুপতি যে সিলোনিজ সায়া নিয়ে খেলা করছে মনোবীণার, সেটা বুঝতে পারল।
“আঃ!”
“কী?”
“কি যে করছ! এটুকু থাকতে দাও।”
“না, না, না—” পশুপতি কিছুই থাকতে দেবে না।
গিঁট আলগা হচ্ছে মনোবীণা বুঝতে পারল। কোমরের বাঁধন ঢিলে হল। মসৃণ স্পর্শ যা তা কোমর ও তলপেট থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত জড়ানো ছিল তার খানিকটা আর থাকল না। মনোবীণা মনে মনে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগল। মনে মনে ইচ্ছাময়ীকে স্মরণ করল।
আর ঠিক এই সময়ে পশুপতি হঠাৎ মনোবীণার কোমরের তলায় হাত রেখে কী যেন টানল। “এটা কী?”
জবাব দিল না মনোবীণা।
পশুপতি আঙ্গুল দিয়ে টেনে টেনে দেখতে লাগল জিনিসটা। তারপর বউকে সামান্য কাত করে দিল। “লাল সুতোয় বাঁধা কী পরেছ এটা?”
মনোবীণা তবু জবাব দিল না। ইচ্ছাময়ী মা বলেছিলেন, তোর মনস্কামনা পূর্ণ হবে। দিন নক্ষত্র সময় যোগ সব বলে দিয়েছিলেন, লিখে দিয়েছিলেন কাগজে। আর কি যেন এক ওষধি লাল সুতোয় জড়িয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, শুদ্ধ হয়ে ঠাকুরের নাম করে পরে নিবি সহবাসের আগে। স্বামীকে কিছু বলবি না, জানতে দিবি না। তোর কাজ হল, স্বামীকে কিছু না জানিয়ে প্রবৃত্ত করানো। দেখিস, স্বামী যেন যোলো আনা মন দিয়ে তোর পাশে শোয়।
পশুপতি আবার বলল, “এটা কী, বলছ না?”
মনোবীণা স্বামীর হাত সরিয়ে দিতে গেল, পারল না।
পশুপতি সুতো ধরে টান মারল, যেন ছিঁড়ে দেবে।
মনোবীণা সায়াটা পেট পর্যন্ত তুলে নেবার চেষ্টা করল। সুতোটা ঢাকতে চায়।
“কী এটা? বলবে না?”
মনোবীণা ডান হাত বাড়িয়ে স্বামীকে নিজের কাছে টানতে গেল। পারল না। বিছানায় উঠে বসল।
পশুপতি সন্দেহ করেছিল। মনোবীণা তাকে জড়িয়ে কাছে টেনে নেবার ভীষণ রুক্ষ গলায় বলল, “কী পরেছ ওটা?”
“যাই পরি, তুমি এসো না গো—”
“এই শালার লাল সুতো কী? কোমরে সুতোর সঙ্গে কী ওটা গাছের ছাল-ফাল বাঁধা আছে?”
“যা আছে থাক—; তোমার মনোর এত বড় চেহারা, কি একটু বাঁধা থাকল…”।
পশুপতি বুঝতে পারল। মাথায় দপ্ করে যেন আগুন জ্বলে উঠল। ও শালা এই জন্যে এত ঘটা? এত ফন্দি?…এত আদিখ্যেতা?
পশুপতি যেন অনুভব করল, সে কিছু নয়; তার আঠারো বছরের স্ত্রী, জীবনের একমাত্র সঙ্গীর কাছেও প্রধানতম নয়। মনোবীণা তার সঙ্গে ছলনা করছিল, এত আয়োজনের উদ্দেশ্য পশুপতি নয়, সে নিমিত্তমাত্র; মনোবীণা নিজের প্রয়োজনে স্বামীকে যন্ত্রের মতন ব্যবহার করতে চাইছিল। কিন্তু পশুপতি এই বয়সে তার বিগত-যৌবনা স্ত্রীর দেহ-মনের প্রতি যে আসক্ত, অনুরক্ত, আবেগপূর্ণ হয়ে উঠতে পেরেছিল তার কোনো মূল্য মনোবীণার কাছে নেই। আশ্চর্য ! পশুপতির মনে হচ্ছিল, মনোবীণা তাকে জীবনের একমাত্র অবলম্বন মনে করে না, সে তার স্ত্রীর কাছে যথেষ্ট নয়, পশুপতি তার এই অকৃত্রিম প্রেম, অনুরাগ ও আসক্তি নিয়েও স্ত্রীকে পরিপূর্ণ সুখী করতে পারল না। পারবে না।।
নিজের এই আকস্মিক মূল্যহীনতা ও ব্যর্থতা পশুপতিকে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ করে তুলছিল। মুখ লাল হয়ে উঠছিল। রাগে কাঁপছিল পশুপতি। ঘৃণা, আক্রোশ ও তিক্ততার সঙ্গে স্ত্রীকে দেখছিল। পাগলের মতন দৃষ্টি। খেপাটে আচমকা স্ত্রীর গালে প্রচণ্ড জোরে এক চড় মারল। এত জোরে মারল যে, ঘরের মধ্যে শব্দটা যেন ছড়িয়ে পড়ল, মনোবীণা বিছানায় পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল। লাল হয়ে আঙ্গুলের দাগ ফুটতে লাগল।
পশুপতি স্ত্রীকে হ্যাঁচকা টান মেরে বিছানা থেকে যেন ছুঁড়ে ফেলে দিতে দিতে বলল, “শালা, আমি তোমার কেউ নয়—! আমার সঙ্গে ভাঁওতা, খেলা? বাঁজা মেয়েছেলে কোথাকার, বেশ্যার মতন ঢঙ মারছ? এখনও বাচ্চা বাচ্চা? তুকতাক? কোমরে শেকড় বাঁধছ? চলে যাও আমার চোখের সামনে থেকে, চলে যাও, নয়তো খুন করে ফেলব তোমায়…।” পশুপতির মদ খাওয়া ভাঙা গলা, তার জড়ানো স্বর কর্কশ, ক্লান্ত অদ্ভুত এক বিলাপের মতন শোনাল।
ঠেলে, লাথি মেরে স্ত্রীকে যেন মাটিতে ফেলেই দিচ্ছিল পশুপতি। মনোবীণার পড়তে পড়তে সামলে নিল।
ঘরে আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হল না মনোবীণার, বাইরে পালিয়ে এল।
বাইরে অন্ধকার। কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। মনোবীণার শোবার ঘরের হালকা আলো দরজার বাইরে বারান্দায় পড়ে আছে ফ্যাকাশে ভাবে। এই ঘন বাদলার বাতাসে শীত করছিল মনোবীণার। তার গায়ে কোনো আবরণ নেই। সায়াটা কোনোরকমে কোমরে জড়ানো। মাথার খোঁপা ঘারে ভেঙে পড়েছে চড় খাওয়া গাল ফুলে যাচ্ছিল, টন্টন করছিল ভীষণ! কোমরে, পিছনে লাথি লেগেছে। কোমরের তলাতেও ব্যাথা।
স্তব্ধ অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন বুকের কোন অভ্যন্তর থেকে সীসের মতন ভারী এক কান্না কণ্ঠনালীকে প্রচণ্ড কাতর করে গলায় এসে উঠল। শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল মনোবীণার। ফাঁস-লাগা গলার মতন তার গলা ফুলে উঠল। তারপর মুখ হাঁ করে কেঁদে ফেলল।
ভেতরে কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই। বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টির গুঁড়ো উড়ে এসে-এসে বার বার গায়ে মাথায় লাগছিল মনোবীণার।
হঠাৎ কী যেন হল মনোবীণার, দৃষ্টি তার দোতলার সিঁড়ির মুখে স্থির হয়ে থাকল। কিছু যেন ওই সিঁড়ির কাছটায় ধীরে ধীরে ঘটে যাচ্ছিল। কী, তা মনোবীণা বুঝতে পারল না। ক্রমেই তার ঘোর এল। আস্তে আস্তে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। তাকিয়ে থাকল। স্থির, অপলক দৃষ্টি। আচ্ছন্ন। প্রথমে যেন কী এক ঘৃণা ও জ্বালার টুকরো চোখে জ্বলে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত আর জ্বলল না। বরং কেমন কাতরতা এল, মায়া জাগল। পনেরো বছর আগে একদিন এইখানে মনোবীণার পা পিছলে গিয়েছিল। এই সিঁড়িতেই সে পড়েছিল প্রথম, প্রথম আঘাত ও যন্ত্রণা এইখানে পেয়েছিল। সেদিন মনোবীণার মধ্যে তার প্রার্থিত প্রাণটি ছিল। কেমন তার আকার, সে শুধুই একটা রক্তমাংসের তাল ছিল, নাকি তার অবয়ব হয়েছিল, হাত পা মুখ চোখ, কেমন গড়ন হয়েছিল তার, সে পশুপতির দিকে হেলে যাচ্ছিল নাকি মনোবীণার—কিছুই জানা নেই। মনোবীণা কিছু জানে না। কখনো কখনো যখন মনোবীণার দিন ক্যালেণ্ডারের পাতার দিকে তাকিয়ে বড় উতলা হয়ে ওঠে—তখন যেন তার দিনের এবং রাত্রের অলস মুহূর্তে অতি অস্পষ্ট, অবোধ, অসহায় কেউ মনের মধ্যে ভেসে আসে আবার চলে যায়।
মনোবীণা সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল। বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরঝির করে। বাতাস দিচ্ছে এলোমেলো; অন্ধকার জলভরা আকাশের কোনো কোনো প্রান্তে বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছে। মনোবীণা বসে থাকল। সম্পূর্ণই আচ্ছন্ন। সর্বাঙ্গ সিক্ত, রোমকূপ শীতে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। বসে থাকতে থাকতে মনোবীণা অনুভব করার চেষ্টা করছিল, এই অচেতন প্রাণহীন সিঁড়িই সেই রক্তসদৃশ অবয়বটিকে স্পর্শ করতে পেরেছিল কিনা! যদি পেরে থাকে তবে কি কোনোদিন তাকে সেই অনুভব জানিয়ে দিতে পারে না। কোনো রকমেই কি সম্ভব নয়?
অনুভূতির এই গভীরতম রহস্যময় অন্ধকারে মনোবীণা যেন অনুভব করল, তার গর্ভের মধ্যে যা নেই তাও যেন কেমন এক সৃষ্টির মায়া দিয়ে ঘেরা। পশুপতি তার মধ্যেকার মানুষ নয়, সে তার সৃষ্টি নয়, পশুপতিকে সে বাইরে থেকে পেয়েছিল। এমন করে গোপনে অন্ধকারে প্রতি মুহুর্তে সৃষ্টি করার জন্যে কাতর হয়নি।
ভোরবেলা মনোবীণার ঘুম ভাঙল। ঘুমের চোখে তার পরনের শুকনো শাড়ি এবং এলো করা চুলের ওপর হাত রাখল। তারপরই গা কেমন শিউরে উঠল। তাকাল। সে পাশ ফিরে শুয়ে। ঘুমের মধ্যে স্বামীর দিকে পাশ ফিরে গেছে। মনোবীণার বুকের কাপড় আলগা। গায়ে জামা নেই। ওপরের বুক উন্মুক্ত। পাশ ফিরে শুয়ে থাকার দরুন বুক ভার হয়ে নত হয়ে রয়েছে।
মনোবীণার বুকের তলায় পশুপতির মুখ। উপুর হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে সে শুয়ে আছে। অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
আটচল্লিশ বছরের এই স্বামীর ঘুমন্ত, কিছুটা যেন ক্লান্ত, ম্লান অথচ সরল মুখ দেখতে দেখতে মনোবীণার সর্বাঙ্গ শীতের বাতাস লাগার মতন কেঁপে উঠল।
অনাবৃত আনত স্তনের বৃন্তটি ক্রমশই কাঁটা লেগে শক্ত ও স্ফীত হয়ে উঠছে অনুভব করল মনোবীণা। পশুপতির ঘুমন্ত মুখের ওপর সেই বৃন্ত আরও স্ফীত হয়ে উঠতে পারে ভেবে মনোবীণা তার খোলা বুক ঢেকে নিল।