1 of 2

আয়ি সাবন – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

আয়ি সাবন – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

পাঞ্জাব থেকে ঘুরতে ঘুরতে রোহিলখণ্ডের এক শহরে এসে পড়লুম। শহরটি বেশ বিস্তৃত—খোলামেলা। লোকজনের বসতি আছে অনেক—মনে হল আমার কাজের বেশ সুবিধে হবে এখানে! দেখলুম—সেখানে গম ও ডালের বড় বড় পাইকার দোকান ফেঁদে বসেছে। উঠলুম গিয়ে সরাইখানায়—সেই পুরনো চালের সরাই—লম্বায় ও চওড়ায় প্রায় দু’শ গজ জমি—উঁচু ইঁটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের গায়ে পাশাপাশি অসংখ্য ঘর, তার একটি মাত্র দরজা; ঘরের ভাড়া লাগে না, এক পয়সা খাটিয়ার ভাড়া লাগে। রাত্রিবেলা এই খাটিয়া প্রাঙ্গণে টেনে নিয়ে এসে লোকে ঘুমোয়—শীতকালে বোধ হয় ঘরের মধ্যেই শোয়।

রাতের এক অপূর্ব দৃশ্য, অসংখ্য লোক প্রাঙ্গণে খাটিয়ায় শুয়ে আছে, কেউ বা বসে আছে। কেউই কারুকে চেনে না। কোনো কোনো পরিবার ওরই মধ্যে রান্নাবাড়া করছে—চলেছে সংসার। আমার রান্নার হ্যাঙ্গামা নেই—চারখানা বড় কচুরি চার পয়সার ও আধপো রাবড়ি পাঁচ পয়সার—দুবেলা এই চলেছে।

যাঁরা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ঘুরেছেন তাঁরাই জানেন, সেখানে কি রকম বড় বড় আকাশচুম্বী বাত্তেল্লার প্রচলন আছে। এই রোহিলখণ্ডের রোহিলাদের সম্বন্ধেও নানান প্রবাদ শুনতে পাওয়া যেত। শুনেছিলুম, তারা খুব বীর আর তলোয়ার চালাতে খুবই মজবুত। নমুনাস্বরূপ একটি উদাহরণ দেবার প্রলোভন সামলাতে পারছি না।

এদের একজন সর্দার—বাহাদুর খান তাঁর নাম ছিল। তিনি আকবর বাদশার সময় একটি অন্যতম রত্ন ছিলেন। বাহাদুর খাঁর সম্বন্ধে বীরত্বের নানা কথা প্রচলিত আছে; কিন্তু সে সব ছেড়ে দিয়ে তার সম্বন্ধে একটি প্রচলিত কাহিনী এইখানে বলি।

একবার আফগানিস্থানের সঙ্গে এক যুদ্ধে বাহাদুর খাঁ গিয়েছিলেন সেনানীরূপে। কিছুদিন পরে তাঁর মার কাছে খবর পৌঁছলো যে, যুদ্ধে বাহাদুর খাঁর মৃত্যু হয়েছে। মা শোক করলেন না—বললেন, বীরপুত্রের তো এইরকম মৃত্যুই লোকে কামনা করে থাকে। কিন্তু কিছুদিন বাদে খবর পাওয়া গেল, বাহাদুর খাঁ জীবিত আছেন এবং তাঁকে শুশ্রূষার উপর রাখা হয়েছে।

আরো খবর পাওয়া গেল, আহত সৈনিকদের ওপর দিয়ে যখন বিপক্ষ পক্ষের লোকেরা তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য হাতি চালাচ্ছিল—সেই সময় একটা হাতির পায়ের তলা থেকে একজন আহত ব্যক্তি হাত সরিয়ে নেওয়ায় দেখতে পাওয়া গেল যে সে বাহাদুর খাঁ।

এই খবরটা যখন বাহাদুর খাঁর মার কাছে গিয়ে পৌঁছলো তখন তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কি ব্যাপার!—আমার ছেলের এমন দুর্বলতা হল যে হাতির পায়ের তলা থেকে হাত সরিয়ে নিলে! পঞ্চাশটা হাতি তার গায়ের ওপর দিয়ে গেলে সে গ্রাহ্য করে না!—ইত্যাদি।

বাহাদুরের মায়ের মড়াকান্না শুনে পল্লীর অন্যান্য সর্দারদের বাড়ির মেয়েরা ছুটে এল। তারা ব্যাপারটা শুনে আফসোস করতে লাগল—তাই তো বাহাদুরের মা, রোহিলার ছেলের এমন দুর্বলতা!

বাহাদুরের মা বললেন—আমি শুনে অবধি ভাবছি, কোথা থেকে কী কারণে তার এই দুর্বলতা এল! ভাবতে ভাবতে মনে হল।—ও, এবার কারণটা খুঁজে পেয়েছি।

অন্যান্য মহিলারা উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন—কি কারণ—কি কারণ?

বাহাদুরের মা বলতে লাগলেন—বাহাদুর যখন শিশু তখন একদিন বিকেলবেলায় তাকে ঘুম পাড়িয়ে আমি নেমাজ পড়ছিলুম। কিছুক্ষণ বাদেই ছেলে কেঁদে উঠল, কিন্তু সেদিকে কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে আমি নেমাজ পড়ে যেতে লাগলুম। কয়েক সেকেণ্ড পরেই ছেলের কান্না থেমে গেল। নেমাজ শেষ করে আমি ফিরে দেখি—আমাদের ধোপানী এসেছে, তারই কোলে শুয়ে সে খেলা করছে। আমি ধোপানীকে জিজ্ঞাসা করলুম—ও কান্না থামাল কেন?

ধোপানী বললে—ওর মুখে দুধ দেওয়াতে একটুক্ষণ চুষেই থেমে গেল।

আমি তো শুনে আঁতকে উঠলুম। বললুম—কী সর্বনাশ! তুই ওকে দুধ দিতে গেলি কেন?

তারপর ছেলের পেটে মাথা দিয়ে তাকে খুব ঘুরোলুম—সে বমি করতে লাগল। বমি করতে করতে হাত-পা যখন প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে তখন শুইয়ে দিলুম। সব দুধই উঠে গিয়েছিল—বোধ হয় এক ফোঁটা পেটের কোথাও ছিল—তার ফলেই এই দুর্বলতা।

অন্যান্য সর্দারনীরা হাতির পায়ের তলা থেকে হাত সরিয়ে নেওয়ার একটা সদুত্তর পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যে যার বাড়ি ফিরে গেল।

বাহাদুর খাঁ-র বংশধরেরা বাহাদুরি দেখাতে দেখাতে আজ ধরাপৃষ্ঠ থেকে অবলুপ্ত। এখন সেখানে এসেছে যত ব্যবসাদার-আড়তদার, উকিল-মোক্তার-মুহুরির দল। এদের মধ্যে কাজ করে কোনোরকমে দৈনিক খরচটা আমার উঠে যাচ্ছিল; কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি—কাজে আমার আর মন ছিল না। এই ভবঘুরের জীবন ইতি করে দিয়ে আবার কলকাতায় ফেরবার জন্যে মন হু-হু করছিল—কিন্তু পাথেয় অভাবে ফিরতে পারছিলুম না।

সমস্ত দিন কাজ করে বিকেল নাগাদ আমি ইস্টিশানে গিয়ে বসতুম। গাড়ি আসছে যাচ্ছে—কত লোক উঠছে নামছে—দেখতে বেশ ভালো লাগত। রোজ সেখানে যাওয়ার ফলে ইস্টিশানের কর্মচারিদের সঙ্গে আমার বেশ ভাব জমে উঠেছিল।

একদিন একটি লোক—একে এর আগেও স্টেশনে দেখেছি তবে আলাপ-পরিচয় হয়নি—লোকটি একরকম গায়ে পড়েই আমার সঙ্গে আলাপ করলে। নাম বললে—দীপচাঁদ ভার্গব।

আরো বললে, সে স্টেশনেই কাজ করে।

দীপচাঁদ বললে, আমি তোমার বড় ভাই, আমাকে লাল্লা বলে ডাকবে।

দু’দিনেই দীপচাঁদের সঙ্গে বেশ আলাপ জমে উঠল। একদিন সে আমাকে বললে, ভাইয়া, তোমার কাছে আট আনার পয়সা হবে?

আমি তখুনি তাকে পকেট থেকে একটা আধুলি বার করে দিলুম। সামনেই একটা রেউড়িওলা বসেছিল—তাকে ডেকে সে আট আনার রেউড়ি কিনলে।

মনে করলুম—রেউড়ির কিছু অংশ আমি পাব। কিন্তু দেখলুম—ঠোঙাটি বেশ করে মুড়ে-ঝুড়ে সে পকেটস্থ করে বললে—পয়সাটা তোমায় কাল ফেরত দেব।

পরের দিন যথারীতি স্টেশনে দীপচাঁদের সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু পয়সার কথাটা সে তুললেই না। আমিও চক্ষুলজ্জায় তার কাছ থেকে চাইতে পারলুম না।

দীপচাঁদ এ-কথা সে-কথার পর জিজ্ঞাসা করলে, ভাইয়া, তোমার খাওয়া-দাওয়া কোথায় হচ্ছে?

দু’বেলা কচুরি আর রাবড়ি খাচ্ছি শুনে সে আঁতকে উঠে বললে, সব্বনাশ! ঐ খাবার আরো চালালে ব্যারামে পড়ে যাবে। সে ব্যারাম সারানো মুশকিল হবে।

আমি ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করলুম—ভালো খাবার কোথায় পাওয়া যাবে?

সে একটু ভেবে বললে, আচ্ছা দাঁড়াও।—আমিই ব্যবস্থা করছি।

সরাইখানায় বাস করছি শুনে সে এমন ভাব দেখালে যেন শ্মশানে বাস করাও তার চেয়ে নিরাপদ। তার কথা শুনে এমন ভয় পেয়ে গেলুম যে, আট আনা ফিরে পাবার আশাও যে কোথায় উবে গেল তা বুঝতেই পারলুম না।

পরের দিন দেখা হতেই বললে, চলো ভাই, তোমার খাবার বন্দোবস্ত করেছি।

আমি বললুম, কোথায়?

সে জিজ্ঞাসা করলে, আমাদের বাড়িতে থাকতে, আমাদের খাবার খেতে তোমার তো কোনো আপত্তি হবে না?

—তাহলে এখুনই চল।

এই কথা বলে সে আমায় নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়ল।

পথে চলতে চলতে সে আমাকে বললে—আমাদের বাড়িতে থাকতে কিছু অসুবিধা আছে। আমাদের বাড়িই, আদ্ধেকটা আমার মাউসি থাকেন, তাঁর ওখানে তোমার থাকবার সমস্ত ব্যবস্থা করেছি।

মাসির বাড়ি গিয়ে পৌঁছলুম। তাঁকে নমস্কার করতেই তিনি বলতে লাগলেন, শুনেছি, শুনেছি—আমি সব শুনেছি। এই বয়সে বাপ-মা’কে কাঁদিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোয় কী লাভ আছে?

আমি বললুম, মা’কে ছেড়ে না এলে কি মাসিকে পেতুম?

কথা শুনে মাসি খুবই খুশি। বললেন, বেটা, আমার দীপচাঁদও যেমন, তুমিও তেমন। যতদিন ইচ্ছা, এখানে থাকো।

এখানে মাসি সম্বন্ধে কিছু বলি। মাসির দেহের রঙ অত্যুজ্জ্বল গৌর, দেহটি যেন “অমিঞা ছানিয়া” তৈরি করা হয়েছে। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। সামান্য স্থূলভাব—মুখখানি দেখলেই ভক্তি হয়। সমস্ত দিন তিনি পূজার্চনায় কাটান, সন্ধেবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে ছাতে গিয়ে শুয়ে পড়েন। বহুদিন আগেই বিধবা হয়েছেন। ছেলেপুলে নেই, একলার সংসার।

মাসি আমাকে নিয়ে গিয়ে একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললেন—দিনের বেলা এইখানেই থাকবে, রাত্রিবেলা তো খাটিয়া ছাতে উঠছে।

একটা নেয়ারের খাট দেখিয়ে বললেন, তোমার বিছানা এইখানেই রাখো।

তারপর হাঁক দিলেন, পরমেশ্বর—এ পরমেশ্বর—

প্রথমটা বুঝতেই পারিনি, সমস্ত দিন পূজার্চনা করে এত চিৎকার করে ‘পরমেশ্বর’ বলে ডাকবার প্রয়োজন কি!

খানিক বাদে পরমেশ্বর সশরীরে এসে উপস্থিত হল। কালো, বেঁটেসেঁটে গুলে-ভাঁটার মতন চেহারা। মনে হয় যেন কষ্টিপাথর কুঁদে তাকে তৈরি করা হয়েছে। তাকে মাউসি খাট আর বিছানা দেখিয়ে দিয়ে বললেন—এই বাবুজীর বিছানা আর খাট ছাতে নিয়ে যাও।

পরমেশ্বর বিজবিজ করে কি বললে, বুঝতে পারলুম না। কিন্তু মাউসি বললেন—মনে করে নিয়ে যেও।

বাড়িতে এই একমাত্র চাকর পরমেশ্বর। সেই রাঁধে। বাড়ির অন্যান্য কাজ—সবই করে।

—একটু ঘুরে আসছি বলে আমি তখনকার মতন বেরিয়ে পড়লুম। মাসি বলে দিলেন, সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরবে। আমরা সন্ধ্যা লাগতেই খেয়ে-দেয়ে সংসারের কাজ মিটিয়ে ফেলি।

মাসির গলাটি ছিল একেবারে খনখনে। বোধ হয় সেই জন্যেই তিনি কথাবার্তা বলতেন অত্যন্ত কম আর আস্তে। তবে বিকেলবেলায় প্রতিদিন দেখতুম পরমেশ্বর ও তিনি এক এক তাল সিদ্ধির গোলা এক এক গেলাস ঘন দুধের সঙ্গে দু’জনেই সেবন করতেন। এর পরেই দেখতুম—মাসির আওয়াজটা যেত একটু চড়ে। এই সময় তিনি পরমেশ্বরের সঙ্গে সংসার সম্বন্ধে কোনো বিষয়ে আলোচনা করলে আড়াল থেকে মনে হত তিনি বোধ হয় আর্তনাদ করছেন।

পরমেশ্বরের চেহারাটি যাই হোক না কেন—সে রাঁধত অতি পরিপাটি, যদিও রান্না ছিল অতি সামান্য। মোটা হাতে-গড়া রুটি—মোটা হলেও অত্যন্ত নরম হত সে রুটি আর খেতে দস্তুরমত মিষ্টি লাগত। আমার মনে হত বোধ হয় সে গুড় মিশিয়ে দেয়। এই রুটির সঙ্গে থাকত একটি ডাল আর একটুখানি চাটনি। এই সামান্য খাবার আমার কাছে কচুরি রাবড়ির চেয়েও ঢের ভালো লাগত।

পরমেশ্বর বিকেলবেলাই ছাতে খাটিয়া তুলে বিছানা পেতে রাখত। সন্ধ্যায় খাওয়া-দাওয়া সেরে ছাতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়তুম।

পশ্চিমে এঁদের বাড়ি যাঁরা দেখেছেন তাঁরাই জানেন যে, এসব বাড়িতে ছাদের উপরে একটি করে ছাদবিহীন ঘর থাকে। চারদিকে দেয়াল—দেয়ালে ঝরোখা, কুলুঙ্গি সবই আছে—খালি ঘরের ছাদ নেই। এই ঘরে মেয়েরা শোয়। আমি ওপরে উঠবার কিছু পরেই মাসি আসতেন। আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে প্রতিদিন নিয়মমত আশীর্বাদ করে তিনি সেই ছাদবিহীন ঘরে ঢুকে পড়তেন। এর কিছু পরে পরমেশ্বর উঠত ছাতে—সে মাটিতেই নিজের বিছানা করে সেই ছাদবিহীন ঘরেই থাকত। পশ্চিমে অনেক জায়গায় দেখেছি বাড়ির বয়স্থা মহিলারা পুরুষ চাকরকে দিয়ে গা-হাত-পা টেপায়। পরমেশ্বর খানিকক্ষণ হাত-পা দাবিয়ে নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়ত।

একদিন, সেদিন বোধ হয় পূর্ণিমা, ধরণীতল জ্যোৎস্নায় প্লাবিত—বাতাস একটু জোরে বইছিল, ছোটো ছোটো সাদা মেঘ চাঁদের তলা দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল—এইসব দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম—হঠাৎ একটু ঠাণ্ডা বোধ হওয়ায় ঘুমটা ভেঙে গেল। পায়ের কাছ থেকে চাদরটা তুলে নিতে গিয়ে দেখি পরমেশ্বর তার বিছানায় নেই। ক্নোথাও গিয়েছে মনে করে ঘুমুতে চেষ্টা করতে লাগলুম কিন্তু ঘুম আসে না। বিছানা থেকে উঠে ছাতে পায়চারি করতে করতে একবার মাসির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলুম—মাসির সেই স্বল্প-পরিসর খাটখানিতে তাঁর অর্ধনগ্ন শুভ্র দেহলতাকে ময়াল সাপের মতো পাকে পাকে জড়িয়ে নিয়ে পরমেশ্বর ঘুমুচ্ছে। দেবদুর্লভ সে দৃশ্য! সাদায়-কালোয়—আত্মায়-পরমাত্মায় এমন গ্রন্থনা ইতিপূর্বে আর চোখে পড়েনি। আমি তো দূরের কথা—মাথার ওপরে অতন্দ্র চাঁদা-ব্যাটাও বিস্ফারিত লোচনে সে দৃশ্য দেখছিল। দরজার কাছ থেকে সরে এসে বার বার ফিরে গিয়ে উঁকি মেরে মেরে আমি সেই অপূর্ব ছবি দেখতে লাগলুম।

হঠাৎ একটুখানি কাসির আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ওপাশের দোতলার ছাদের দিকে চেয়ে দেখলুম—দীপচাঁদ সরে গেল।

পরের দিন সকালবেলা খেতে বসেছি, দীপচাঁদ এসে হাজির। দীপচাঁদকে দেখলেই আমার সেই আধুলির কথা মনে পড়ে এবং মনে হয় এইবার বুঝি সে সেইটে ফেরত দেবে। সেদিন একথা-সেকথার পর সে বললে—ভাইয়া, এখানে দেখছি তোমার খাওয়া-দাওয়ার বড় অসুবিধে হচ্ছে। তোমাদের খাবারের মাছ-মাংস হবার উপায় নেই এখানে। যদিও আমিষ খেতে আমাদের কোনো বাধা নেই, তবুও আমার বাড়িতে ওসব ঢোকে না, কারণ আমার স্ত্রী ওসব খান না। আমার মেসোমশাই কামতাপ্রসাদ শ্রীবাস্তব এখানকার সব চেয়ে বড় উকিল। তাঁর বাড়িতে রোজ মাংস হয়। আমি সেইখানেই তোমার থাকার ব্যবস্থা করছি। অবিশ্যি আমার ছোটোমাসি ওসব স্পর্শ করে না, তবে মেসোমশাইয়ের একবেলা মাংস না হলে চলে না; আর রবিবার দিন সকালবেলা মাছও হয়।

বুঝলুম দীপচাঁদ আমাকে এখান থেকে সরাতে চায়। যাই হোক মেসোমশাই যখন বড়লোক—তাঁর কাছ থেকে কোনোক্রমে যদি কলকাতায় যাবার গাড়িভাড়াটা যোগাড় করতে পারি, সেই মতলবে বললুম, আমার কোনো আপত্তি নেই, তুমি ব্যবস্থা কর।

দীপচাঁদ তার মাসিকেও জপালে। মাসি বললেন, বেশ তো, দিনকতক সেখানে থেকে আসুক না! সেও তো আর-এক মাসি বটেক!

পরের দিন সকালবেলা মোটঘাট নিয়ে দীপচাঁদের সঙ্গে কামতাপ্রসাদের বাড়িতে গিয়ে উঠলুম। তিনি তখন কাচারি বেরুবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলেন। আমাকে দেখে ভারি খুশি হয়ে অভ্যর্থনা করলেন। বললেন—কলেজে আমাদের এক বাঙালী প্রফেসর ছিলেন।

আরো বললেন, তুমি যখন দীপচাঁদের বন্ধু, তখন তুমি আমার ছেলের মত।

দীপচাঁদকে বললেন, একে এর ঘরে নিয়ে যাও, সব ব্যবস্থা করো, কোনোরকম তকলিফ যেন না হয়।

কথাবার্তায় মনে হল কামতাপ্রসাদ অতি সদাশয় ও অমায়িক ব্যক্তি। যেমন তাঁর দশাসই চেহারা—ব্যবহারটিও তেমনি উদার ও মিষ্টি।

তিনি বেরোবার মুখে দীপচাঁদকে আবার বললেন, ওকে ওর ঘরে নিয়ে যাও।

দীপচাঁদের সঙ্গে আমার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে এলুম। দোতলায় বেশ খোলামেলা পরিষ্কার ঘরখানি। একদিকে ছোট্ট নেয়ারের খাট, ঘরের আর একদিকে চেয়ার-টেবিল। সেখানে আমার ভাঙা প্যাঁটরা ও ছেঁড়া বিছানা নিতান্তই বেমানান হল। মনের মধ্যে চিন্তার চক্র ঘুরছিল। নিরামিষ থেকে মাংসের হাটে এলুম বটে, কিন্তু এ রকম করে আর কতদিন চলবে। দীপচাঁদকে বললুম, আমাকে কলকাতায় ফিরে যাবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারো? আমার কাছে কিন্তু পয়সাকড়ি কিছু নেই। আর এ কাজও আমার আর পোষাচ্ছে না!

দীপচাঁদ মিনিটখানেক চুপ করে থেকে বললে—দুর দুর—এ কাজ কি ভদ্রলোক করে! তিরিশ টাকা মাইনে দেয়—তা থেকে ট্রেনভাড়া যায়। তবে আর থাকে কি! তার ওপর খাবার ঠিক নেই, থাকবার জায়গা নেই। তুমি এইখানেই থাকো। আমি জোর করে বলছি মেসোমশাইকে বলে তোমার একটা চাকরি এইখানেই ঠিক করে দেব। রেলে ও আদালতে প্রায়ই তো লোক নেয়। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।

দীপচাঁদ একটা চাকরকে ডেকে বললে, তুমি বাবুজীর খিদমতে থাকবে। ইনি আমাদের মেহমান, দেখো যেন তাঁর কোনো অসুবিধা না হয়।

দীপচাঁদ তাকে আবার জিজ্ঞাসা করলে, বাবুজী কোথায়?

চাকরটা বললে, তিনি কাচারি চলে গেছেন।

দীপচাঁদ বললে, এবার ছোটোমাসির সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই।

চললুম ছোটোমাসির ঘরের উদ্দেশে। বাড়িখানি বেশ বড়। আমরা গোটাকয়েক উঁচু উঁচু ছাদ ও ঘর পেরিয়ে ছোটোমাসির ঘরের কাছাকাছি এসে পৌঁছলুম। দীপচাঁদ সেইখান থেকেই তাঁকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে চলল।

ঘরের দরজায় একটি মহিলা এসে দাঁড়ালেন। বয়স তাঁর খুব বেশি নয়—তেইশ-চব্বিশের বেশি হবে না। মাসির বোন—দেখলেই বুঝতে পারা যায়। কিন্তু মুখখানা দেখলে মনে হয় বুঝি তাঁর ভয়ানক পেটকামড়ানি ধরেছে। আমাদের বললেন, এসো এসো।

বেশ বড়। ঘর। তাকে হলঘরই বলা চলে। সাজানো-গুজোনো, মনে হয় যেন স্টেজে এসে ঢুকলুম। মেজেতে শতরঞ্জি পাতা। তিনি আমাদের বসতে বলে নিজে বসলেন। তারপরে দীপচাঁদের কাছ থেকে আমার কথা শুনতে লাগলেন। অবিশ্যি দীপচাঁদ আগেই তাঁকে আমার কথা বলে রেখেছিল। অনেকক্ষণ গল্প করার পর তিনি বললেন, এবার নাওয়া-খাওয়ার ব্যবস্থা কর।

ওঠবার সময় আমার দিকে ফিরে হঠাৎ বললেন—তুমি আমাকে মাসি বোলো না। আমি তোমার মা।

আমি বললুম, আমার অনেকগুলি মা আছে, আপনাকে আমি নতুন-মা বলে ডাকব।

দেখলুম, নামকরণ শুনে তিনি প্রসন্নই হলেন। দীপচাঁদকে বললেন, একে চানের ঘরটরগুলো দেখিয়ে দাও। আমি এদিকে খাবার ব্যবস্থা করছি।

আমার ঘরেই খাবার এল। খেয়েদেয়ে একটু শুয়েছি, চাকর এসে খবর দিলে মায়িজী ডাকছেন।

মায়িজীর ঘরে গিয়ে দেখলুম, তাঁর খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে। নানারকম গল্প শুরু করেছেন। তাঁর হালচাল দেখে মনে হলো মুখখানা অমন করে থাকলেও তিনি একটি গল্পবাজ লোক। একথা-সেকথার পর তিনি বললেন—দেখ, এ বাড়ির কোনো কথা তোর মাউসিকে বলবি নি।

গল্প করতে করতে বেলা পড়ে এল। আমি বললুম, এবার আপনি একটু বিশ্রাম করুন, আমিও শুইগে।

ঘরে এসে ভাবতে লাগলুম—এখন কী করি! কী করে কিছু অর্থের যোগাড় করে কলকাতায় পালাই! সেবার পুনাতেও এইরকম বিপদে পড়েছিলুম, কিন্তু অভাবিতরূপে উদ্ধার পেয়ে গিয়েছিলুম। আমার সৃষ্টিকর্তা সারা জীবন ধরে আমাকে এইরকম অভাবিতভাবে উদ্ধার করতে করতে আর কিছু করে উঠতে পারলেন না।

সমস্ত দিন বাড়ি নীরব নিস্তব্ধ ছিল। সন্ধ্যা নাগাদ কর্তা বাড়ি ফিরতেই দেখলুম চাকরবাকরেরা সব সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল—তারা ধোপদস্ত ধুতি আর তার ওপরে একটা করে সাদা আচকান চড়িয়ে নিলে। তারপর সবাই মিলে নিচে কর্তার বৈঠকখানার দিকে চলে গেল।

একটু বাদেই বৈঠকখানায় অনেক লোকজনের আওয়াজ পাওয়া যেতে লাগল। তিনটে চাকর চারদিকে ছুটোছুটি করে তাদের ফরমাস খাটতে থাকল। আমি একবার বেরুবার অছিলা করে বৈঠকখানার দরজার পাশ দিয়ে চলে গেলুম। দেখলুম গোটা তিনেক লোক বসে খুব উচ্চৈঃস্বরে আলাপচারি করছে। তাদের সামনে একটা বোতল, আর হাতে একটা করে গেলাস। কামতাপ্রসাদবাবু তাদের মধ্যে বসে আছেন—তাঁরও হাতে একটা গেলাস। ফিরে এসে আমি আমার ঘরে বসে রইলুম। হুল্লোড় ক্রমেই বাড়তে লাগল। তিনটে লোক মিলে দশ জনের হল্লা করতে লাগল। চাকর তিনটের দম ফেলবার সময় নেই—তারা তাদের ফরমাস খাটতে ইতস্তত ছোটাছুটি করছে।

সময় কাটতে লাগল। খানিকক্ষণ বাদে যে লোকটা রাঁধত, সে আমার জন্যে খাবার নিয়ে এল—রুটি আর একটি বড় বাটির এক বাটি মাংস। সকালবেলা কিন্তু একজন চাকরই আমার খাবার এনেছিল। বুঝলুম এবেলা তার ফুরসত নেই। যে আমার খাবার এনেছিল তাকে জিজ্ঞাসা করে জানলুম—নিচের বাবুরা সকলেই খেয়ে বাড়ি যাবে। তারা রোজই এইখানেই খায়।

গোলমাল উত্তরোত্তর বাড়তেই লাগল। রাত্রি দশটা নাগাদ খুব চেঁচামেচি হচ্ছে শুনে নিচে গিয়ে দেখলুম, বাবুদের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে—এবার বাড়ি যাওয়ার পালা।

বাবুদের মধ্যে একটা রোগামতন লোক ছিল। দেখলুম, সে কেবলই শুয়ে পড়ছে, আর একটা চাকর ক্রমাগত তাকে সিধে করবার চেষ্টা করছে। এমনি করে কিছুক্ষণ কাটবার পর বাবুদের তিনজনকেই এক একজন করে চাকর বাড়ি পৌঁছে দিতে গেল। এটি তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ।

পরের দিন নতুন-মা আমাকে বললেন, আমাদের বাবুজী বেশ ভালো লোক। ঐ তিন ব্যাটাই অতি বদমাইস। এখানে এসে মদ খাবে, রুটি-মাংস খাবে আর বাবুজীকে চাকর-বাকরদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করবে।

আমি বললুম, ঐ রোগামতন লোকটা সব থেকে বেশি গোলমাল করছিল।

নতুন-মা বললেন, ঐ হচ্ছে রামলগন। ঐ ব্যাটাই শয়তানের ধাড়ি। ওর বুকে একটা ছ্যাঁদা আছে।

আমি বললুম, সে কি? কোথায়?

তিনি বললেন, শুনেছি ঐ যেখানে পাঁজর দুটো মিশেছে, সেইখানে ছ্যাঁদা আছে, ভেতরের সব দেখা যায়।

এরকম যে হতে পারে তা আমি আগে জানতুম না। নতুন-মা বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু সমস্তক্ষণ ঐ জায়গাটা আঠা-দেওয়া ফিতে দিয়ে ঢেকে রাখে। তার ওপর কখ্খনো জামা খোলে না। আমার এসব মোটেই ভালো লাগে না।

যাই হোক, দিন কয়েক এইরকম কেটে গেল। গোলমাল রোজই হয়। একদিন এক রাত্রে খুব একটা গোলমাল শুনে ঘুম ভেঙে গেল। বাবুজীর গলা ও সেই সঙ্গে চাকরদের কান্না ও দৌড়ঝাঁপ শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলুম। দেখি বাবুজী এক একটা চাকরের পেছনে দৌড়চ্ছেন আর ধড়াদ্ধড় লাঠি মারছেন। এইরকম একতলা থেকে দোতলায়, অন্দর থেকে বাইরে চলতে লাগল। আমি তো দেখেশুনে অবাক!

এইরকম ছুটোছুটি করতে করতে হঠাৎ একবার বাবুজী উঠোনের নর্দমার কাছে পা পিছলে মুখ থুবড়ে পড়লেন, তারপরেই নড়নচড়ন বন্ধ। ওপর থেকে নতুন-মা কাঁদতে কাঁদতে নিচে নেমে এলেন। বাবুজীর মুখে-চোখে জলের ছিটে দেওয়া হতে লাগল। এর পর যে চাকরদের তিনি এতক্ষণ ধরে ঠেঙাচ্ছিলেন, তারাই এসে সেই বিরাট দেহ চ্যাংদোলা করে তুলে নিল। আমি নতুন-মা আর ওরা, আমরা সবাই মিলে তাঁকে ঘরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলুম। তখনও তাঁর জ্ঞান হয়নি; আমরা তাঁর মুখচোখে জলের ঝাপটা দিতে লাগলুম। নতুন-মা মাথার কাছে বসে পাখা করতে লাগলেন। সময় বুঝে আমি সেখান থেকে সরে এসে নিজের ঘরে ঢুকলুম।

এর পর থেকে নিত্যই এই হাঙ্গামা চলতে লাগল। একদিন, বেলা প্রায় দশটা, এমন সময় নতুন-মা আমাকে ডেকে বললেন—আমাকে তীর্থে নিয়ে যেতে পারবি?

বললুম, হ্যাঁ, পারব। কোন তীর্থে যাবেন?

তিনি বললেন, মথুরা-বৃন্দাবন। আগ্রা-দিল্লিও দেখব। তারপর কাশী-গয়া। সেখান থেকে দ্বারকা। প্রথমবারে এই কটা ঘুরে আসব।

আমি বললুম, তা বেশ, কিন্তু অনেক টাকা লেগে যাবে।

তিনি বললেন, ওঃ, টাকা আমার ঢের আছে। তুই কি আমায় গরিব লোক বলে মনে করিস?

এই বলে উঠে গিয়ে আলমারির ভেতর থেকে একটা আধহাতটাক লম্বা চাবি বার করে সিন্দুকটা খুলে ফেলে আমাকে বললেন, এই ডালাটা তোল। দিশি ছোট সিন্দুক হলে হবে কি—জিনিসটা খুবই ভারী।

ডালাটা তুলতেই আমার চোখের সামনে রূপের ফোয়ারা খুলে গেল। দেখি, সিন্দুকের কানায় কানায় ভর্তি টাকা আর মোহরে জড়াজড়ি করে রয়েছে। এমন রূপ এর আগে কখনো দেখিনি।

মাসির ওখানে সাদায়-কালোয় জড়াজড়ি রূপ দেখেছিলুম—এখানে রুপো আর সোনায় জড়াজড়ি দেখলুম।

আমি অবাক হয়ে দেখছি দেখে নতুন-মা বললেন—কি রে, নিবি? তোর যা দরকার তুলে নে।

আমি বললুম, না, আপনি আমায় পঁচিশটে টাকা তুলে দিন।

এই বলে আমি দুই হাত অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালুম। নতুন-মা গুনে গুনে পঁচিশটি টাকায় আমার অঞ্জলি পূরণ করে দিলেন। তারপর একখানি মোহর তুলে নিয়ে বললেন, এটাকেও রাখ।

আমি বললুম, না, না—এখন ওটা ওখানেই থাক। দরকার হলে আমি চেয়ে নেব। তিনি অবহেলাভরে মোহরখানা সিন্দুকে ফেলে দিলেন। আমি কোঁচার খুঁটে টাকাগুলো বেঁধে সিন্দুকের ডালাটা বন্ধ করে দিলুম। তারপর নিজের ঘরে এসে ভাঙা প্যাঁটরায় একখানা ধোপদস্ত ধুতির খুঁটে টাকাগুলো বেঁধে রাখলুম।

টাকাটা পাবার পর আর আমার মন সেখানে টিঁকছিল না। কিন্তু ওদিকে নতুন-মা আবার তীর্থে যাবার ঢেউ তুলেছেন, এদিকে আমার মহাতীর্থ কলকাতা আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে আরম্ভ করেছে। সেই কবে কৈশোরের প্রান্তে এসে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলুম, এখন আমার বয়স উনিশ বছর। এই দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অনাহার, অনিদ্রা, অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগে আমার দিন কেটেছে। এর থেকে মুক্তি পাবার জন্যে মনের মধ্যে হাহাকার উঠেছিল। কবির ভাষায় বলতে গেলে “চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা”। এবার কিছু পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে। দেহমন আমার ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, কিছু বিশ্রাম চাই। কিন্তু পথের নেশা আমার কাটে নি, তাই সারা জীবন কখনো পথ কখনো পাথেয়—এরই সাধনা করেছি। পথের নেশা আজও কাটল না, ওদিকে পাথেয়ও কিছু সংগ্রহ হল না।

যাই হোক, ঘরে বসে বসে ভাবতে লাগলুম—এখন এখান থেকে মুক্তি পাই কি করে? নতুন-মায়ের সঙ্গে যদি তীর্থদর্শনে বেরুতে হয়, তাহলে ফিরতে সে তো ছ’ মাসের ধাক্কা! কিন্তু যিনি অযাচিতভাবে আমার পাথেয় জুটিয়ে দিয়েছেন, তিনিই অভাবিত রূপে অচিরে আমাকে মুক্তি দিলেন।

আগেই বলেছি, বাক্সের মধ্যে টাকা রেখে আমি শান্তি পাচ্ছিলুম না—যখের মতো দিনরাত ঘরেই থাকবার ইচ্ছে করছিল। কিন্তু থেকে থেকে নতুন-মা ডেকে পাঠান আর তীর্থযাত্রা সম্বন্ধে আমি কি করছি, তার খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু আমার কীই বা করবার ছিল? আমি একদিন বললুম—খরচের টাকার ব্যবস্থা করেছেন?

নতুন-মা জিজ্ঞাসা করলেন—কত টাকা লাগবে?

বললুম, তা হাজার দুয়েক টাকা লাগতে পারে। পুরো না লাগলেও কিছু টাকা কাছে থাকা দরকার।

—তা হলে সিন্দুক থেকে দু’জনে গুনে হাজার দুয়েক টাকা বাইরে বার করতে হয়।

তাঁকে একথাও জানালুম, নগদ হলে চলবে না। নোট নিতে হবে।

নতুন-মা বললেন—বেশ, নোটও আছে আমার কাছে। বাবুজীর সমস্ত টাকা আমার কাছে থাকে।

বললুম, তবে আর কি! দশ টাকার নোটে দু হাজার টাকা গুনে আলাদা করে রেখে দেবেন

নতুন-মা বললেন, আচ্ছা দেখ, দীপচাঁদ আমার সঙ্গে যেতে চাইছে।

বললুম, বেশ তো, ভালোই হয় তাহলে!

—আর পাৰ্বতীয়ার ইচ্ছা সেও আমাদের সঙ্গে যায়! ওকে আমি নেব না—ভারি বজ্জাত মাগী।

বললুম, আপনাকে কিছু বলেছিল নাকি?

—না বলেনি, তবে আমি লোকের মনের কথা টের পাই কিনা! আর বাবুজীকেও এখনো বলা হয় নি।

নতুন-মার কথাগুলো কী রকম অসংলগ্ন মনে হতে লাগল। তবুও তাঁকে বললুম, বাবুজীকে বলে তাঁর অনুমতিটা নিয়ে রাখবেন। আমাদের তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হবে।

পরদিন নতুন-মাকে জিজ্ঞাসা করলুম, বাবুজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন?

তিনি কোনো জবাব দিলেন না। দেখলুম তাঁর মাথার চুলগুলি রুক্ষ, বোধ হয় তিন চার দিন স্নান করেন নি। আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে এলুম।

ঠিক তার পরের দিনই দুপুরবেলা নতুন-মার ঘরের দিকে খুব একটা গোলমাল শুনে চমকে উঠলুম। শুনলুম পার্বতীয়া চিৎকার করে কাঁদছে, সেই সঙ্গে নতুন-মার চিৎকারও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। চাকরবাকর ছুটোছুটি করছে। আমি একরকম দৌড়তে দৌড়তে নতুন-মার ঘরে গিয়ে দেখি, সে এক বীভৎস কাণ্ড। ঘরময় রুটি, তরকারি, থালা ছড়ানো। পার্বতীয়ার কপাল কেটে দরদর করে রক্ত পড়ছে। নতুন-মার দুই চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে, আর তিনি চিৎকার করছেন—হারামজাদী আমাকে বিষ দিয়েছিস!

পার্বতীয়া প্রাণপণে প্রতিবাদ জানাচ্ছে আর কাঁদছে। চাকরেরা তাকে ধরে নিয়ে গেল। নতুন-মা আমাকে বলতে লাগলেন—ওকে তীর্থে নিয়ে যাব না জেনে কতদিন থেকে আমাকে বিষ খাওয়াবার চেষ্টা করছে—

আমি দেখলুম, দস্তুরমত ক্ষিপ্তাবস্থা। তখুনি মাসিকে খবর দেবার জন্যে একটি চাকর পাঠালুম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দীপচাঁদের মাসি এসে হাজির। নতুন-মা এতক্ষণ নিরবচ্ছিন্ন চিৎকার করছিলেন, মাসিকে দেখেই একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন।

মাসি ঘরে ঢুকেই বোনকে জড়িয়ে ধরলেন। নতুন-মাও দিদিকে জড়িয়ে নীরবে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। প্রথমে নিঃশব্দ কান্না—তারপর একটু একটু করে কণ্ঠস্বর বাড়তে লাগল, শেষে চিৎকার করে মড়াকান্না জুড়ে দিলেন।

ইতিমধ্যে দীপচাঁদ ছুটেছিল আদালতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবুজী এসে হাজির। বাবুজী এসেই ডাক্তারের কাছে লোক পাঠালেন। ডাক্তার এসে রুগী দেখেই বললেন—এঁকে পাগলা-গারদে পাঠাতে হবে। চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই ভালো হয়ে যাবে।

বাবুজী তখুনি আগ্রায় গারদের কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিলেন।

মাসি নতুন-মাকে চান করিয়ে খাইয়ে সন্ধেবেলায় চলে গেলেন। সেই দিনই কামতাপ্রসাদবাবুকে বললুম, এবার আমাকে বিদায় দিন।

তিনি বললেন—না, না—তুমি যেও না। তোমাকে বিশেষ দরকার। তুমি আর দীপচাঁদ ওঁকে গারদে দিয়ে আসবে। তীর্থে যাবার নাম করে ওঁকে গাড়ি চড়াতে হবে। তুমি না থাকলে চলবে না।

এই কার্যটি আমি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছিলুম, কিন্তু ঘুরেফিরে ঠিক আমার ঘাড়েই এসে পড়ল।

ক্রমে তীর্থযাত্রার দিন এগিয়ে এল।

নতুন-মাকে বললুম, আজ সন্ধের গাড়িতে আমরা বেরুব তীর্থযাত্রায়।

শুনে তিনি মহা উৎসাহিত হয়ে গান শুরু করলেন—”আয়ি বদরিয়া সাবন কি—সবন কি মনভাবন কি—”

যাই হোক, সন্ধেবেলায় নতুন-মাকে নিয়ে ট্রেনে চড়লুম। কোনো গোলমাল না করে তিনিও আমাদের সঙ্গে ট্রেনে উঠলেন। সকাল প্রায় সাতটার সময় আমরা আগ্রা সিটি স্টেশনে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করলুম। নতুন-মা অদ্ভুত শান্তভাবে আমাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠলেন আর বৃন্দাবনের কথা বলতে লাগলেন।

গাড়ি গারদে এসে পৌঁছল। গাড়ি থেকে নেমে দীপচাঁদ গারদের লৌহকপাটের কাছে গিয়ে খবর দিতেই একজন নারী সান্ত্রী বেরিয়ে এসে নতুন-মার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামালে। আমিও নেমে পড়লুম।

নতুন-মা কোনো গোলমাল না করে সেই সান্ত্রীর সঙ্গে ভেতরে চলে গেলেন। মোটা মোটা লোহার রঙ দেওয়া লোহার কপাট, তার মধ্যে ছোট্ট আর একটি সেই রকমই কপাট—তার ভিতর দিয়ে শাস্ত্রী নতুন-মাকে ভেতরে নিয়ে গেল।

হঠাৎ কি মনে করে চারদিকে চেয়ে পোঁ করে তিনি সামনের দিকে ফিরে দু হাতে দুটো লোহার রড ধরে তার ফাঁকে মুখ দিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলুম তাঁর দুই চোখ জলে ভরে উঠেছে। ভেতর থেকে সান্ত্রী এসে আকর্ষণ করতেই তিনি ফিরে গুট-গুট করে ভেতরের দিকে চলে গেলেন।

আজও কখনো কখনো কোনো শ্রাবণ দিনের আকাশে পুঞ্জীভূত মেঘের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অকস্মাৎ আমার অজ্ঞাত মানসলোক থেকে দুটি সজল চক্ষু চেতনালোকে ভেসে ওঠে। সে দুটি চোখের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে আমার চক্ষুও অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

১৩৭১ (১৯৬৪)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *