আয়রন ডোম
‘নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অব ইনভেনশন’- আমরা সবাই এই কথাটা জানি। কিন্তু যদি এখন বলা হয় যে, যুদ্ধই আবিষ্কারের চাবিকাঠি! তাহলে হয়তো কেউ মানবে না। কেই বা যুদ্ধবাজ তকমা নিজের কপালে লাগাতে চাইবে?
যদি একজন ইসরায়েলি নাগরিককে জিজ্ঞেস করা হয় যে, এখনও অবধি আপনার দেশের বিগত দশকের সেরা আবিষ্কার কোনটা, তাহলে সবচেয়ে বেশি যে উত্তরটা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে তা হল— আয়রন ডোম।
আয়রন ডোম কী? কেনই বা তা দরকার?
এ কথা জানতে হলে আমাদের উঁকি দিতে হবে ইতিহাসের পাতায়।
১৯৭৩ সাল। আরব-ইসরায়েলের যুদ্ধ চলল। ‘য়ম কিপ্পুর ওয়র’। ওই বারেই প্রথম ব্যালিস্টিক মিসাইলের ব্যবহার হল ওই অঞ্চলে। প্রথমে মিশর তিনটে স্কুড মিসাইল দাগল ইসরায়েলের দিকে। সিরিয়া যুদ্ধ চলাকালীন ফ্রগ-সেভেন নামে আর্টিলারি রকেট ছোড়া শুরু করে উত্তর ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে। আর ইসরায়েল সিরিয়াকে এর জবাব দিয়েছিল বায়ুসেনা পাঠিয়ে। সিরিয়ার কয়েকটা টার্গেটকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছিল ইসরায়েল। এরপর সিরিয়া আর রকেট ছোড়ার পথে যায়নি। কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল যে, ইসরায়েল প্রত্যেক আঘাতের উত্তরে প্রত্যাঘাত করবেই। চোখের বদলে চোখই হয়ে উঠেছিল ইসরায়েলের নীতি। আর এই আক্রমণ-নীতি প্রয়োগ করে তারা এই যুদ্ধে সফলও হয়েছিল। তাই পরবর্তীকালে মিসাইল ও রকেটের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগিদ তাদের মনে জন্মায়নি।
১৯৮০ সালে শুরু হয় ইরাক ও ইরানের যুদ্ধ, যা প্রায় আট বছর ধরে চলেছিল। এতে দুই দেশের সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ এই যুদ্ধ কেবল দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দুটো দেশই একে অপরের শহরগুলোকে লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুঁড়ছিল। ১৯৮৮ সালে যুদ্ধ যখন শেষের দিকে, তখন ইরাক ইরানকে লক্ষ্য করে ২০০ টা ব্যালিস্টিক মিসাইল ফায়ার করে। প্রায় ২,০০০ জন মানুষের মৃত্যু হল এবং এই ঘটনার ফলে ইরান একপ্রকার বাধ্য হয়েই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব স্বীকার করে নেয়।
ইরাক-ইরান কনফ্লিক্ট থেকেই কিন্তু শিক্ষা নিতে শুরু করল ইসরায়েল। কারণ এই রাষ্ট্র সবার আগে ভাবে। নিজের মাটি এবং নিজের মানুষদের সুরক্ষিত করে তোলাই ইসরায়েল রাষ্ট্রের এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য। ব্যালিস্টিক মিসাইলের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা শুরু করল ইসরায়েল।
প্রতিপক্ষ একবার ব্যালিস্টিক মিসাইল ফায়ার করার পর তাকে ঠেকানোর কোনো উপায় জানা থাকে না। ফলে যা ক্ষতি হওয়ার, তা হবেই। ইরাক- ইরানের যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর মিছিল ইসরায়েলকে ভাবতে বাধ্য করল। আটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগান ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স নিয়ে উঠে-পড়ে লাগেন। তিনি মিত্র রাষ্ট্রগুলিকে আহ্বান করেন স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভে (যার আরেক নাম স্টার ওয়র্স) অংশগ্রহণ করার জন্য। আমেরিকার লক্ষ্য তখন সোভিয়েত ইন্টারকন্টিনেন্টাল নিউক্লিয়ার ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিহত করার মতো একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা। বলা বাহুল্য, ইসরায়েলের কাছে এর উপযুক্ত কোনো পরিকল্পনা বা জ্ঞান কিছুই ছিল না। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী তখন য়িত্জাক রাবিন। তিনি আমেরিকার এই প্রকল্পে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঘনিষ্ঠ মহলে এই ব্যাপারে একটাই কথা বলেছিলেন, ‘এই সুযোগে আমরা আমেরিকার নেকনজরে আসতে পারব। কারণ আরব দুনিয়ার সঙ্গে লড়াইতে আমেরিকাকে পাশে পেলে একটা বিরাট ব্যাপার হবে।’ আর আরেকটা ব্যাপারও এর মধ্যে ছিল। ইসরায়েলের শত্রু আরব দেশগুলোর প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ ছিল ইউএসএসআর বা সোভিয়েত ইউনিয়ন।
তবে এক্ষেত্রে একটা ক্যালকুলেটিভ রিস্ক নিয়েছিল ইসরায়েল। কারণ ইসরায়েলের এই পদক্ষেপকে বাহানা করে সোভিয়েতের পক্ষে আরব দেশগুলোকে আরও বেশি অস্ত্র সরবরাহ করার পথ প্রশস্ত হল এবং সোভিয়েত ভূখণ্ডে বসবাসকারী ইহুদিদের পক্ষে ইসরায়েলে ইমিগ্রেট করা আরও কঠিন হয়ে উঠতেই পারত।
রাবিন তার রিসার্চ টিমকে আদেশ করলেন, ‘প্ল্যান রেডি করো!’ উজি রুবিন নামে এক প্রতিভাবান এঞ্জিনিয়ারকে এই প্রোজেক্ট দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত করা হল। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে কয়েকটি পরিকল্পনার খসড়া তৈরি হয়ে গেল। এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের নাম ছিল ‘অ্যারো’। এই প্রকল্পে এমন একটা ইন্টারসেপ্টর তৈরির কথা বলা হয় যেটা ব্যালিস্টিক মিসাইলকে গুলি করে ধ্বংস করতে পারবে। ঠিক যেভাবে ফাইটার জেটকে ফায়ার করে নীচে নামানো হয়, সেভাবেই ভেবে নিয়ে এগোনো হচ্ছিল। তবে হ্যাঁ, বোঝা যাচ্ছিল যে, মিসাইলটাকে ধ্বংস করতে হবে ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেকটাই উঁচুতে, যাতে নীচে থাকা কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর ক্ষতি না হয়।
প্রোজেক্ট ‘অ্যারো’-এর ডেভেলপার ছিলেন ডভ রাভিভ। তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, ‘আয়তনের দিক থেকে ইসরায়েল এমনিতেই ছোট একটা দেশ। এর ফলে শত্রুর পক্ষে ঘরে বসেই ইসরায়েলের যে কোনো প্রান্তে মিসাইল দিয়ে আঘাত হানা সম্ভব। তাই যে প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে, তা যেন নার্ভ রিফ্লেক্সের গতিতে কাজ করতে পারে।’
রুবিনের নেতৃত্বে একটা টিম ওয়াশিংটনে গিয়ে আমেরিকানদের টেবিলে নিজেদের প্রস্তাব রাখল। প্রোজেক্ট ‘অ্যারো’-এর কথা শুনে আমেরিকানরা বিস্মিত হয়ে যায়। তাদের বিস্ময় আরো বেড়ে যায় এর খরচের কথা জানতে পেরে। কারণ মার্কিনদের ধারণা ছিল যে, এ ধরনের প্রোজেক্টে খরচ হতে পারে কম করে ৫০০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু রাভিভ যখন বললেন, ‘গোটা প্রোজেক্টের খরচ পড়বে মাত্র ১৫৮ মিলিয়ন ডলার’, তখন আমেরিকার পক্ষ থেকে বলা হল, ‘এই প্রোজেক্টে আমরা টাকা ঢালব।’
ওদিকে ওয়াশিংটনের এই অতি উৎসাহকে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ কিন্তু ভালো চোখে দেখছিল না। আইডিএফ-এর চিফ অব স্টাফ য়হুদ বারাক সরাসরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করেন। তাঁর মত ছিল, ‘ইসরায়েলের উচিত ট্যাঙ্ক, ফাইটার জেট আর যুদ্ধজাহাজ কেনা। মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম দিয়ে তো আর যুদ্ধ জেতা যাবে না।’
অপর দিকে ইসরায়েলি এয়ারফোর্সের এর কমান্ডার ডেভিড ইভরি আবার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের পক্ষে ছিলেন। যদিও ইসরায়েলের যুদ্ধ জয়ের নীতি ছিল একটাই, আক্রমণের জবাবে পালটা আক্রমণ করে শত্রুকে বিধ্বস্ত করা, কিন্তু তাঁর মতে ডিফেন্স করাটাও সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সফল ডিফেন্সের দ্বারাও যুদ্ধজয় সম্ভব।
এভাবেই টানাপোড়েন চলতে থাকল। এর মধ্যেই ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাকি সেনা কুয়েত আক্রমণ করে। আমেরিকা এবং অন্যান্য ৩৩টি দেশের সম্মিলিত সেনা ইরাককে কুয়েত থেকে হটাবার জন্য ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় কোয়ালিশন আর কখনো গঠন হয়নি। ইসরায়েল কিন্তু এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি এবং তারা তা করেনি আমেরিকার ইশারাতেই। কারণ একটাই, আরব দুনিয়া ইসরায়েলের অংশগ্রহণ কোনোভাবেই মেনে নিত না।
ইসরায়েলের সঙ্গে ইরাকের সম্পর্কটা চিরকালই অহি-নকুলের। তাই ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেন আগে থেকেই ইসরায়েলকে হুমকি দিয়ে রেখেছিল— ‘যদি ইসরায়েল নাক গলাতে আসে, তবে ইসরায়েলের অর্ধেকটা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হবে।’
আসলে ইরাক ইসরায়েলকে উসকাতে চাইছিল। সাদ্দাম চাইছিলেন, ইসরায়েল ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামুক। কারণ আরব দেশগুলো কখনোই ইসরায়েলের সাহায্য নিয়ে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না। হয় তারা যুদ্ধ থেকে সরে যাবে অথবা ইরাকেরই পক্ষে যোগ দেবে। তাই ইরাক যে কোনো মূল্যে ইসরায়েলকে যুদ্ধে জড়াতে চাইছিল। কী অদ্ভুত যুদ্ধনীতি!
যুদ্ধ শুরুর পরের দিনই ইরাক ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে আট আটটা আল- হুসেইন মিসাইল নিক্ষেপ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইজরায়েল এই প্ররোচনায় পা দিল না। যে ইসরায়েল তার আগের ৪০টা বছরে মারের বদলে পালটা মার দেওয়ার নীতিতে চলেছে, সেই ইসরায়েল এই প্রথম বার কাউকে পালটা আক্রমণ করল না।
কিন্তু থামল না ইরাকও। তারা ৩৯টা স্কুড মিসাইল ইসরায়েলের জনবসতিপূর্ণ এলাকাকে টার্গেট করে নিক্ষেপ করল। ইসরায়েলের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্য আমেরিকা প্যাট্রিয়ট মিসাইল এয়ার ডিফেন্স ব্যাটেলিয়ন পাঠাল, আর তার সঙ্গে পাঠাল দুই ব্যাটারি প্যাট্রিয়ট মিসাইল। স্কুড মিসাইল হানায় তেল আভিভ ও হাইফাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় ৩,৩০০ অ্যাপার্টমেন্ট ও বেশ কিছু বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ১,১৫০ জন নাগরিককে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরিত করে হোটেলে রাখার ব্যবস্থা করে ইসরায়েলি গভর্নমেন্ট। প্রতি রাতে হোটেলের খরচই ছিল প্রায় ২০,০০০ মার্কিন ডলার। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি ছিল ৭৪ জন মানুষের প্রাণহানি।
এই যুদ্ধের পর ‘প্রোজেক্ট অ্যারো’কে ইসরায়েল খুব গুরুত্ব সহকারে দেখতে শুরু করে। এই প্রোজেক্টে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আমেরিকাও তার বরাদ্দ বাড়িয়ে দেয়। আরও কয়েক বছর পর ইসরায়েলি বায়ুসেনা নিজেদের প্রথম অ্যারো মিসাইল ব্যাটারি পেল। ইসরায়েলই এমন প্রথম দেশ যারা একটি কার্যকরী ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করে। য়হুদ বারাক একটা সময় অবধি এর তীব্র বিরোধী ছিলেন, তিনি অবধি নিজের ভুল স্বীকার করে নেন। এই প্রথম বার ইসরায়েলের কাছে ইরাক ও সিরিয়ার মিসাইলকে আটকানোর উপায় হাতে এসে গেল। কিন্তু ইসরায়েলের কপালে ঈশ্বর হয়তো শান্তি শব্দটিই রাখেননি, কারণ এবার ইরাক কিংবা সিরিয়া নয়, আক্রমণটা এল সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে। ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে।
স্ট্রেট শহরের মেয়র এলি ময়াল। এই ছোট্ট শহরটি ইসরায়েলের দক্ষিণে অবস্থিত এবং গাজা ভূখণ্ড থেকে এর দূরত্ব মাত্র এক কিমি। নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে মরুভূমির উষ্ণ বাতাস উপভোগ করছিলেন মেয়র সাহেব। হঠাৎই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে জানালার কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল! এরপর আরেকবার! খানিক দূরে ধোঁয়া বেরোতে দেখেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মেয়র সাহেব ছুটলেন ধোঁয়ার উৎস খুঁজতে। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখলেন একটা গর্ত তৈরি হয়েছে, আর গর্তটা থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে একটা ধাতব নলের মতো অংশ। ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের একজন আধিকারিকও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তিনি ময়ালকে বললেন, ‘মনে হচ্ছে গাজা স্ট্রিপ থেকে দুটো রকেট ছোড়া হয়েছে। আপনি এখুনি কাউকে কিছু বলবেন না, প্লিজ!’
এর অর্থ খুব পরিষ্কার ছিল। হামাস জঙ্গিদের হাতে রকেট পৌঁছে গিয়েছিল! বিগত শতাব্দীর অন্তিম দশক থেকে হামাস আত্মঘাতী হামলা চালানো শুরু করেছিল গোটা ইসরায়েল জুড়ে। সেটাকে নানা ভাবে প্রতিহত করছিল ইসরায়েল। অনেকাংশে ঠেকানো যাচ্ছিল ওই ধরনের আক্রমণ। ইসরায়েলের বিশ্বাস ছিল যে, হামাস জঙ্গিদের হাতে রকেটের মতো বিপজ্জনক অস্ত্র নেই এবং উল্লেখিত রকেট-হামলার আগে পর্যন্ত ডেরট খুব শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ শহর হিসাবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু নতুন দান চেলে দিয়েছিল হামাস। যেহেতু ইসরায়েলের বায়ুসেনা ও স্থলসেনার সঙ্গে পেরে ওঠা হামাসের পক্ষে সম্ভব ছিল না। রকেট আক্রমণ হামাসের পক্ষে অনেক বেশি কার্যকরী।
হামাস এই রকেটের নাম দিয়েছিল ‘কাসাম’। প্রথম দিকে কাসামের রেঞ্জ ছিল মাত্র এক মাইল। ২০০৮ সাল নাগাদ এর রেঞ্জ বেড়ে হয় ২৬ মাইল। ২০১২ সালে হামাসের হাতে আসে ইরানের তৈরি অত্যাধুনিক রকেট, যা গাজাপট্টি থেকে ৪০ মাইল দূরে অবস্থিত তেল আভিভে আঘাত হানতে সক্ষম। ২০১৪ সাল পর্যন্ত গাজা ভূখণ্ড থেকে ১২,০০০-এরও বেশি রকেট ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করেছে হামাস। এদিকে দক্ষিণে লেবানন থেকে রকেট ফায়ার করছে হিজবুল্লাহ জঙ্গিরা।
এর আগে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী সিমন পেরেস মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টনের সঙ্গে ১৯৯৬ সালে মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরির জন্য একটা চুক্তি সাক্ষর করেন। ‘নটিলাস’ নামের লেসার নির্ভর এই সিস্টেম তেমন কার্যকরী না হওয়ায় এর ব্যবহারও বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৪ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড্যানি গোল্ডকে ইসরায়েলের রক্ষা মন্ত্রকের রিসার্চ ও ডেভলপমেন্ট বিভাগের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করা হয়। তাঁর মূল ধ্যানজ্ঞান ছিল একটাই— গাজাপট্টি থেকে ইসরায়েলের উদ্দেশে রকেট আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা। ২০০৪- এর আগস্ট মাসে তিনি ইসরায়েলি ডিফেন্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের প্রত্যেককে বলেন, ‘একটা করে আইডিয়া উদ্ভাবন করুন।’ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ২৪টা পরিকল্পনা জমা পড়ল। গোল্ড ও তাঁর টিম প্রত্যেকটা পরিকল্পনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন।
এদের মধ্যে একটা প্রোজেক্ট ছিল আমেরিকানদের আদলে, যেটা তারা ইরাকে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে রকেট ও মর্টারের আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য ব্যবহার করত। এর ক্যানন একটা মিসাইলকে লক্ষ্য করে মিনিটে ৪,০০০ রাউন্ড ফায়ার করতে পারত।
‘কিন্তু একটা রকেটের পিছনে ৪,০০০ রাউন্ড ফায়ার করাটা কি যুক্তিযুক্ত?’ এই কথাই বলেছিলেন গোল্ড।
প্রথমত, এটা মশা মারতে কামান দাগার মতো ব্যাপার। দ্বিতীয়ত, এভাবে ফায়ার করলে গাজায় বসবাসকারী সাধারণ মানুষের ক্ষতি হতে পারত। তাই এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিলেন গোল্ড।
আরেকটা প্রোজেক্ট ছিল নটিলাসেরই একটু উন্নততর সংস্করণ, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘স্কাইগার্ড’। কিন্তু এটাও গোল্ডের মনে ধরল না।
সমস্যা কী ছিল?
এর একটা বড় অসুবিধা ছিল যে, এর লেসার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে কাজ করে না, আর গোটা জিনিসটা এত বড় যে একে প্রয়োজন অনুসারে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়াটা একটা বড় হ্যাপা।
গোল্ডের টিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি চষে ফেলল। কিন্তু তেমন কোনো লাভ হল না। তার ওপরে আবার গোল্ডের কঠোর নির্দেশ ছিল— -জিনিসটা হতে হবে সস্তা।’ অনুসন্ধান জারি রইল। শেষমেষ ২০০৫ সালে এসে গোল্ডের মনে হল যে, এবার তিনি মনের মতো জিনিসটি খুঁজে পেয়েছেন।
‘রাফায়েল’। ইসরায়েল সরকারের একটি অন্যতম সংস্থা। পাঠকবন্ধুরা, চিন্তিত হবেন না, ইসরায়েলের রাফায়েলের সঙ্গে ফরাসি ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট র্যাফেলের কোনো সম্পর্ক নেই। ‘সারফেস টু সারফেস’ মিসাইলের জন্য গোটা বিশ্ব একে এক ডাকে চেনে।
এদের পরিকল্পনা কী ছিল?
একটু অন্যরকম। দ্য নেম ইজ ‘আয়রন ডোম’। আয়রন ডোমের তিনটি অংশ। প্রথম অংশটি হল একটা ইন্টারসেপ্টর মিসাইল, যা শত্রুপক্ষের মিসাইলকে ধ্বংস করতে সক্ষম। দ্বিতীয় অংশটি হল একটি শক্তিশালী রাডার, যেটা শত্রুপক্ষ রকেট নিক্ষেপ করা মাত্রই তা ডিটেক্ট করে ফেলবে এবং তৃতীয় অংশটি হল ব্যাটেল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, যার কাজ শত্রুর ছোড়া রকেটের গতিপথ আগে থেকেই অনুমান করা এবং রকেট কোথায় আঘাত হানবে তারও প্রায় সঠিক অনুমান করে ফেলা। এর ফলে জনবহুল এলাকায় যখন কোনো রকেট আঘাত হানতে যাচ্ছে, তখন সাইরেন বাজিয়ে সেখানকার লোকজনকে সতর্ক করে দেওয়া সম্ভব হবে, আর ইন্টারসেপ্টর মিসাইল নিক্ষেপ করে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে শত্রুর শক্তিশেল। আবার অপর দিকে, যে মিসাইলগুলো ফাঁকা জায়গাতে আছড়ে পড়বে, তাদের জন্য কোনো ইন্টারসেপ্টর মিসাইলও অপচয় করতে হবে না।
গোল্ড এই সিস্টেম পাওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন। তবে তিনি নিজের শর্ত থেকে সরে আসেননি— প্রতিটা ইন্টারসেপ্টর হতে হবে সস্তা। তিনি বললেন, ‘যদি এটা সস্তা না হয়, তাহলে শত্রুরা রকেট ছুড়ে ছুড়েই আমাদেরকে ভিখারী বানিয়ে দেবে।’ দামি কথা! তাই নয় কি?
এবার একটা দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিয়ে বসলেন গোল্ড। তিনি রাফায়েলকে পুরোদমে আয়রন ডোম তৈরির জন্য আদেশ দিয়ে দিলেন। আসলে তিনি যে পদে আসীন ছিলেন, তাতে এই আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা বা অধিকার তাঁর মোটেই ছিল না।
কারা দিতে পারতেন এই আদেশ?
আদেশ দেওয়ার অধিকার ছিল শুধুমাত্র আইডিএফ প্রধান এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর হাতে। স্বাভাবিক ভাবেই অডিটে ধরা পড়ল গোল্ডের এই কীর্তিকলাপ। সেই রিপোর্টে বেশ চাঁছাছোলা ভাষায় গোল্ডকে আক্রমণ করা হল। কিন্তু বিধাতাপুরুষ যার সঙ্গে আছেন, তাঁকে আর কে মাত করবে? কারণ যত দিনে অডিট রিপোর্ট বেরিয়েছিল, তত দিনে আয়রন ডোম নিজের কামাল দেখাতে শুরু করে দিয়েছিল!
এবারে আসা যাক আয়রন ডোম নির্মাণের পর্বে। ২০০৫ সালে রাফায়েলের চেয়ারম্যান ছিলেন ইলান বিরান। তিনি গোল্ডের মতোই কাউকে খুঁজছিলেন, যিনি অনায়াসে এই প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দ নিশ্চিত করবেন। গোল্ডের সঙ্গে মিটিংয়ের পর তিনি তাঁর এঞ্জিনিয়ার ও মিসাইল এক্সপার্টদের নিয়ে বসলেন। একটাই প্রশ্ন সকলের সামনে রেখেছিলেন— ‘স্বল্প মূল্যে এটা করা কি সম্ভব?’
সবার নজর গিয়ে পড়েছিল একজনেরই দিকে। গ্লোসি ড্রাকার, রাফায়েলের মিসাইল বিভাগের প্রধান। পঁয়ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি রাফায়েলে কাজ করছিলেন। রাফায়েল ‘পাইথন’ নামে এমন একটা মিসাইল আবিষ্কার করেছিল যেটা একবার টার্গেট নিশ্চিত করে দিলে তাকে আঘাত হানবেই। এই পাইথন মিসাইল ছুড়ে ইসরায়েলি এয়ারফোর্সের পাইলটরা শত্রুপক্ষের বিমান দেখতে না পেলেও তাকে ধ্বংস করে দিতে পারত।
ড্রাকার বললেন, ‘মিসাইল ছুড়ে যদি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করা যায়, তাহলে মিসাইল ছুড়ে মিসাইল ধ্বংস করাই বা যাবে না কেন?’
ড্রাকারের কথায় অবশ্য সেদিন অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। কারণ টার্গেট হিসাবে যুদ্ধবিমান ও মিসাইলকে কোনো ভাবেই তুলনা করা যায় না। যুদ্ধবিমান আকারে অনেক বড় হয়ে থাকে। একটা ১৭০ মিমির রকেটকে যদি ধ্বংস করতে হয়, তাহলে কাজটা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং
আবার প্রশ্ন তুললেন ড্রাকার, ‘কাজটা দুঃসাধ্য হতে পারে, কিন্তু অসাধ্য নয়!’
বিরান ড্রাকারকে খুব ভরসা করতেন। তিনি ড্রাকারকে একটা টিম তৈরি করে কাজ শুরু করতে বলে দিলেন।
কাজ আরম্ভ হল। খরচ কম রাখার জন্য সস্তায় কাঁচামালের খোঁজ শুরু করল টিম। সরকারি সাহায্য পুরোপুরি না পাওয়ার জন্য কাজ চলছিল ঢিমে তালে। ২০০৬ সালের ১২ জুলাই, হিজবুল্লাহ জঙ্গিরা ইসরায়েলে প্রবেশ করে দুজন আইডিএফ-এর সেনাকে অপহরণ করে। এর জবাবে ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক সীমানা পার করার সঙ্গে সঙ্গেই নীচে রাখা অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইনের বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী অলমার্ট হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং ঠিক এই সময়েই ইসরায়েল উপলব্ধি করল যে, রকেট হামলা কী মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ৩৪ দিনের মধ্যে হিজবুল্লাহ দেগে বসল ৪,৩০০ টা রকেট। প্রায় ১০ হাজার মানুষ ঘরছাড়া হল। যুদ্ধ শেষের কয়েক দিন পর রক্ষামন্ত্রী আমির পেরেট্জ তেল আভিভে জরুরি বৈঠক ডাকলেন। জিজ্ঞাসা করলেন মিসাইল ডিফেন্সের খবরাখবর। পেরেট্জ দীর্ঘ দিন স্ট্রেটে বসবাস করেছেন এবং তিনি সেখানকার প্রাক্তন মেয়র। স্পেরটে আগেই তিনি রকেট হামলার অভিজ্ঞতার সম্মুখীনও হয়েছেন। বৈঠকে তিনি বললেন, ‘আয়রন ডোমই হবে এখনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্ট। যত দ্রুত সম্ভব এই প্রোজেক্ট সম্পূর্ণ করতে হবে!’
এই যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী অলমার্টকে প্রথম বার আয়রন ডোমের প্রোজেক্টের কথা জানানো হল। আইডিএফ-এর প্রথম সারির কর্তারা সবাই ছিলেন এই প্রোজেক্টের বিরুদ্ধে। তাই অলমার্ট চাপে পড়ে গেলেন। ব্যাকফুটে চলে গিয়ে তিনি তখন এই প্রোজেক্টে টাকা ঢালতে অস্বীকার করলেন।
সরকারি সাহায্য না পাওয়া সত্ত্বেও রাফায়েল কিন্তু আয়রন ডোম তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। ড্রাকার এই প্রোজেক্টের ম্যানেজার হিসাবে উজিকে চাইছিলেন। কিন্ত উজি তখন সস্ত্রীক চিলিতে ছুটি কাটাতে ব্যস্ত। ড্রাকার ফোন ধরলেন উজিকে, ‘তোমাকে আমাদের দরকার। এখুনি ফিরে এসো!’ উজি নিজের স্ত্রীকে কোনোরকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছুটির প্ল্যান কাটছাঁট করে দেশে ফিরলেন।
কয়েক দিনের মধ্যেই উজি প্রোজেক্টের ব্যাপারটা বুঝে নিলেন। ‘এই প্রোজেক্টে অসম্ভব বলে কোনো শব্দ নেই,’ উজি তাঁর সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বললেন। এদিকে শত বিরোধ সত্ত্বেও গোল্ড নিজের মতো চেষ্টা চালাতে লাগলেন। আবার তিনি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ২০০৬ সালের নভেম্বরে রাফায়েলকে পুরোদমে প্রোডাকশন চালানোর কন্ট্রাক্ট দিলেন।
২০০৭ সালের গোড়ার দিকে পেরেন্জ রাফায়েলের মিসাইল কারখানায় হাজির হলেন ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। আয়রন ডোমের জন্য ওকালতি করার আগে তিনি দেখে নিতে চাইছিলেন যে, বাস্তবে ঠিক কী হচ্ছে কারখানায়। ড্রাকার তাঁকে সমস্ত খুঁটিনাটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন।
পেরেট্জ বললেন, ‘আমার মনে হয় দিনে তিনটে শিফট চালালে ভালো হয়।’ ড্রাকারের উত্তরটা ছিল, ‘আমরা এখানে একটাই শিফটে কাজ করি, আর সেটা ২৪ ঘণ্টার শিফট।’
বলাই বাহুল্য যে, পেরেট্জ খানিকক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেছিলেন। তাঁকে অবাক করার জন্য অবশ্য আরও বিষয় বাকি ছিল। তিনি তো জানতেনই না যে, শনিবার, যেদিন সমস্ত ইহুদিরা ছুটি কাটায়, সেদিনও রাফায়েলে কাজ চলে। এর জন্য তাঁরা রাব্বিদের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি অবধি নিয়েছে। গোটা দেশ তখন এমন একটা বিপদের মধ্যে, যে একমাত্র আয়রন ডোমই পারত ওই বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে। সুতরাং, ওই পরিস্থিতিতে আরাম করার কোনো প্রশ্নই ছিল না।
ওদিকে গোটা দেশে আয়রন ডোম প্রকল্পের বিরোধীরা প্রচার চালাতে লাগল যে, এক একটা ইন্টারসেপ্টর বানাতে খরচ পড়বে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মার্কিন ডলার এবং এই বিপুল খরচের ফলে দেশটা দেউলিয়া হয়ে যেতে বসেছে। এসবের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটল। ২০০৭ সালের জুন মাসে পেরেকে সরিয়ে য়হুদ বারাককে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হল। বারাক কিন্তু গোড়া থেকেই আয়রন ডোমের বিপক্ষে ছিলেন। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি গোল্ড ও তাঁর টিমকে নির্দেশ দিলেন আয়রন ডোমের পাশাপাশি স্কাইগার্ড লেসার সিস্টেম তৈরি করা যায় কিনা সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে।
গোল্ড রীতিমতো বিরক্ত হলেন। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম বিশ্বের সব দেশেই করতে হয়। তাই গোল্ডও বারাকের মতে সায় দিলেন। আখের বস্ বলে কথা! রাফায়েলের কর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল, কারণ হাওয়ায় একটা খবর ভাসছিল- স্কাইগার্ড প্রোজেক্টে যদি সরকার টাকা ঢালে, তাহলে আয়রন ডোমের সমস্ত প্রোজেক্টটা মাঠে মারা যাবে।
‘ওরকম কিছু ঘটবে না! চিন্তার কোন কারণ নেই। ওসব স্কাইগার্ড ফার্ড দিয়ে কিস্যু হবে না। এই মুহূর্তে আয়রন ডোমের কোনো বিকল্প নেই,’ গোল্ড তাদের আশ্বাস দিলেন।
প্রোজেক্টের কাজ এগোচ্ছিল। আরেকটা নতুন সমস্যার উদয় হল। যদি আয়রন ডোম সফলভাবে বানিয়ে ফেলাও হয়, পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যাটারি আর ইন্টারসেপ্টর মোতায়েন করার জন্য চাই প্রচুর অর্থ।
উপায় কী?
ওয়াশিংটনে যোগাযোগ করা হল। প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। এর কয়েক সপ্তাহ পরে আমোস গিলাডের নেতৃত্বে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একটি প্রতিনিধি দল পেন্টাগন পৌঁছল। ডিফেন্স সেক্রেটারির অধীনে মেরি বেথ লং তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট সিক্যুরিটি অফ ডিফেন্স ফর ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন। লং কোনোমতেই আর কোনো বাড়তি অর্থ ইসরায়েলের হাতে দিতে রাজি ছিলেন না। কারণ মাত্র কয়েক মাস আগেই ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে চুক্তি করেছিল, তাতে ইসরায়েল প্রতি বছর তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাবে বলে ঠিক হয়েছিল এবং এই অনুদান চলার কথা ছিল আগামী ১০ বছরের জন্য। লং সাফ জানালেন যে, যদি আয়রন ডোমের জন্য ইসরায়েলের অর্থের দরকার হয়, তাহলে যে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার তারা বছরে পাচ্ছে সেখান থেকেই ব্যবহার করুক। কিন্তু সেখানেও বাধা। কারণ সরকার তো আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছে যে ওই অর্থ দিয়ে কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট ও মিসাইল কেনা হবে। আরেকটা ব্যাপার হল যে, লং-এর ডিপার্টমেন্ট কেবল এমন অস্ত্রেই ফান্ড দিতে পারে যেটা পরীক্ষিতভাবে সফল। আর আয়রন ডোম তো তখনও পুরোপুরি তৈরিই হয়নি। তবুও একটা সুযোগ মিলল। ইসরায়েলের আয়রন ডোমের প্রোজেক্টটাকে যাচাই করার জন্য তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রবিন র্যান্ডকে দায়িত্ব দিলেন।
একটা ট্রাকে করে একটি আয়রন ডোম লঞ্চার ইসরায়েলের দক্ষিণে মিশর সীমান্তে পরীক্ষার জন্য আনা হল। ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘তামির’। এত দিনের পরিশ্রমের ফসল যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা কার্যকরী হবে তারই পরীক্ষা। ইন্টারসেপ্টর লঞ্চ করার জন্য তৈরি হল। অপারেটর কাউন্টডাউন শুরু করল: ৫… ৪… ৩… ২… ১। রাফায়েলের টিম, আইডিএফ আধিকারিক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কর্তা— সবার নজর তখন টিভির পর্দার দিকে। অপারেটর লঞ্চ বাটন টেপার পরও কিছু হল না। আবার প্রেস করা হল লঞ্চ বাটন। এবার আরো জোরে। নাহ্, মিসাইল কোনো সাড়া দিল না! ড্রাকারের তো তখন মাথায় হাত। মিডিয়াতে সব জানাজানি হয়ে গেছে ততক্ষণে। প্রোজেক্টটা কি ব্যর্থ হয়ে গেল? এত দিনের সব পরিশ্রম কি জলে গেল?
সবকিছু গুটিয়ে আবার রাফায়েলের কারখানায় নিয়ে আসা হল। কয়েক দিনের ভেতরই সমস্যাটা শনাক্ত করা গেল। একটা তার কোনো ভাবে খুলে গিয়েছিল। তাতেই এই গড়বড়। নতুন করে আশার আলো জাগলো। দু’ সপ্তাহ পরে। আবার সেই টেস্ট রেঞ্জে নিয়ে আসা হল ‘তামির’কে। অপারেটর লঞ্চ বাটন প্রেস করল। না, এবার আর কোনো গন্ডগোল নয়। তামির আকাশে উঠল ঠিক যেমনটা চাওয়া হচ্ছিল।
এবার আসল পরীক্ষা বাকি। একটা মিসাইলকে ইন্টারসেপ্ট করে ধ্বংস করে দেখাতে হবে। তবে তো সবাই মানবে এর ক্ষমতা।
২০০৯ সালের কোনো এক দিন। সকাল ১১টা বাজতে একটু বাকি। একটা ডামি কাত্যুসা রকেট লঞ্চ করা হল। জঙ্গিরা এই রকেটই ব্যবহার করে বেশিরভাগ সময় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। সবার চোখ তখন অপারেটরের স্ক্রিনের ওপর। স্ক্রিনে সঙ্গে সঙ্গে ‘এনিমি রকেট লঞ্চ’ ডিটেক্ট হল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তামিরকে লঞ্চ করা হল। এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি! একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল। তামির কাত্যুসা মিসাইলকে ধ্বংস করে দেখাল!
একাধিক বার চলল এই টেস্ট। জেনারেল রবিন র্যান্ড সবকিছুর ওপরেই নজর রেখেছিলেন। তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। আয়রন ডোম প্রায় ৮০% রকেটকেই ইন্টারসেপ্ট করতে পারল, যা তার কাছে একদম অপ্রত্যাশিত ছিল।
২০০৮ সালে বারাক ওবামা ইজরায়েল আসেন। তখনও অবশ্য তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হননি। তিনি তখন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী। তিনি স্ট্রেট গিয়ে দেখলেন ‘রকেট মর্গ’, যেখানে জঙ্গিদের ছোড়া রকেটের অবশেষ সংরক্ষণ করে রাখা আছে। ‘আমার ঘরে যদি কেউ এভাবে আক্রমণ করে, তাহলে আমার সর্বশক্তি দিয়ে আমি তা প্রতিহত করব,’ স্ট্রেটের রকেট মর্গে দাঁড়িয়ে এটাই ছিল ওবামার উক্তি। স্পেরটে যাওয়ার পর তাঁর ধারণাই বদলে গিয়েছিল। রকেট হামলার ফলে ইসরায়েল যে কতটা জেরবার তার সম্যক ধারণা ওবামার ছিল না। তিনি ঠিক করেন যে, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রূপে নির্বাচিত হলে তিনি ইসরায়েলকে রকেটের বিরুদ্ধে একটা সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অবশ্যই সাহায্য করবেন।
আমেরিকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ইসরায়েলের পক্ষে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০০৯ সালে বারাক ওবামা আমেরিকার ৪৪তম রাষ্ট্রপতি রূপে নির্বাচিত হলেন। সেই বছরই এপ্রিলে প্রফেসর কলিন কালকে মিডল ইস্টের ডেপুটি অ্যাসিস্টেন্ট ডিফেন্স সেক্রেটারি পদে বসানো হয়। তিনি ছিলেন বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞ। যুদ্ধরত এলাকাগুলোতে শান্তি ফেরানোর দায়িত্ব দেওয়া হল কালের কাঁধে। আর ওবামা বিশেষ ভাবে চাইছিলেন শান্তি স্থাপনের জন্য ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনকে এক টেবিলে বসাতে। ইসরায়েল ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে তখনই সেনা সরাতে চায়নি। কয়েক বছর আগে গাজা থেকে সেনা সরিয়ে যে ভুল তারা করেছিল, তারা তার পুনরাবৃত্তি চাইবে না এটাই স্বাভাবিক ছিল। তাই আয়রন ডোম একটা সমাধানের পথ হতে পারত। কাল আয়রন ডোমের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিলেন। তিনি ন্যাশনাল সিক্যুরিটি কাউন্সিলের মিডল ইস্ট পলিসির প্রধান ড্যান শাপিরোর কাছে এই ব্যাপারটা উত্থাপন করলেন। এই ড্যান শাপিরো খুব শীঘ্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসাবে ইসরায়েলে যাচ্ছেন। দুজনে আলোচনা করে আয়রন ডোম প্রোজেক্টকে যাচাই করার জন্য একটা টিম পাঠালেন ইসরায়েলে। এই টিম ফিরে এসে আয়রন ডোমের ভূয়সী প্রশংসা করে। কাল দেখলেন যে, এবার কিছু একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে।
২০০৯-এর জুন মাসে তিনি নিজেই ইসরায়েল গেলেন। লেবাননের সীমানা ও গাজা ভূখণ্ডের সীমানা এলাকায় গেলেন। সেখানে তিনি দেখলেন কীভাবে রকেট হামলার ফলে সাধারণ ইসরায়েলি নাগরিকদের জীবন বিপন্ন। তিনি আমেরিকা ফিরেই সঙ্গে সঙ্গেই আয়রন ডোমের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার আয়রন ডোম ফান্ডিংয়ের জন্য সুপারিশ করলেন। তাঁর যুক্তি ছিল সোজাসাপটা। আয়রন ডোম মোতায়েন হলে ইসরায়েলের নাগরিকরা সুরক্ষিত থাকবে। ফলে ইসরায়েলেরও পালটা আক্রমণে যাওয়ার দরকার পড়বে না। শান্তি স্থাপনের জন্য এটা একটা বড় পদক্ষেপ হতে পারে।
অবশেষে সমস্ত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ২০১১ সালের মার্চ মাসে আইডিএফ-এর বীরসেবা নামক জায়গার বাইরে প্রথম আয়রন ডোম মোতায়েন করে। বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না। ৭ এপ্রিল আয়রন ডোম তার প্রথম শিকার করল এবং কয়েক দিনের মধ্যেই ধ্বংস করল আরও ৮টা রকেট। আয়রন ডোম আসার পর পুরো খেলাটাই ঘুরে গেল। গাজা থেকে ফায়ার করা রকেটগুলোর মধ্যে প্রায় ৯০% রকেটই আয়রন ডোম বিধ্বস্ত করে দেখাল। আর এর ফলে আইডিএফ-এর গাজাতে সেনা অভিযানের মাত্রাও কমতে থাকল। ২০১২তে আইডিএফ গাজাতে কোনো সেনা অভিযানই করেনি। ২০১৪তে করেছিল একটা ছোট অপারেশন। আমেরিকা ও ইসরায়েল সম্মিলিতভাবে আয়রন ডোম তৈরি করছে এখন। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত আমেরিকা ইসরায়েলের আয়রন ডোমের জন্য খরচ করেছে ১.৩৯৭ বিলিয়ন ডলার। আয়রন ডোমের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। ইসরায়েল প্রথম বাইরের দেশ হিসাবে আজারবাইজানকে আয়রন ডোম বিক্রি করে ২০১৬ সালে। রোমানিয়া এবং ভারত আয়রন ডোম কেনার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কাতার, বাহরিন এবং সৌদি আরব আয়রন ডোম কেনার জন্য আগ্রহী।
একটা আয়রন ডোম ব্যাটারি ১৫০ বর্গ কিমি এলাকা সুরক্ষিত করতে পারে। ইসরায়েলে ২০১৯ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত ১০টা ব্যাটারি সক্রিয় ছিল। আরও ৫টা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ইসরায়েলের। এই ৫টা হাতে এলে মোটামুটি পুরো দেশটাই মিসাইল হামলার হাত থেকে সুরক্ষিত করা যাবে।
আয়রন ডোম যখন প্রথম মোতায়েন করা হয়, তখন ইসরায়েলের তরফে ভাবা হয়েছিল যে, রকেট হামলা করে ইসরায়েলের ক্ষতি করতে না পেরে হামাস হয়তো রকেট হামলা বন্ধ করে দেবে।কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ইসরায়েলের শত্রুরা তাদের রকেট ও মিসাইলের ভাণ্ডার বাড়িয়েই চলেছে। ইসরায়েলের ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী হিজবুল্লাহ জঙ্গিদের কাছে মজুদ আছে ১,০০,০০০-এরও বেশি মিসাইল ও রকেট। হামাসের কাছে আছে প্রায় ১০,০০০। হিজবুল্লাহর কাছে আজ আরও লং রেঞ্জের মিসাইল রয়েছে, যা টার্গেটকে একেবারে নির্ভুলভাবে আঘাত করতে পারে।
ইসরায়েলে এখন মাঝারি রেঞ্জের মিসাইল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তৈরি হচ্ছে ‘ডেভিড’স্ স্লিং সিস্টেম’ আর লং রেঞ্জের মিসাইলের জন্য ডেভলপ হচ্ছে ‘অ্যারো ইন্টারসেপ্টর সিস্টেম’।
২০১১ সালের পর আয়রন ডোম ৮৫% রকেট আক্রমণ সফলভাবে প্রতিহত করেছে। আয়রন ডোমেরও রকেট হামলা প্রতিরোধ করার একটা সীমাবদ্ধতা আছে।
সেটা কেমন ব্যাপার?
মানেটা এরকম, একটা আয়রন ডোম এক ঘণ্টায় যতগুলো মিসাইল বা রকেট ইন্টারসেপ্ট করতে পারে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক রকেট ছুড়লেই কিছু রকেট টার্গেটে আঘাত হানবেই। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আর তার সুযোগ নিয়েই জঙ্গিরা ইসরায়েলে ধ্বংসলীলা চালাতে চাইছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০১৯ সালের মে মাসের ৫ তারিখ, সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে আসদদকে টার্গেট করে ১১৭টা রকেট ফায়ার করে জঙ্গিরা। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, কারণ আয়রণ ডোমের ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিল ব্যাপারটা।
তাহলে প্রশ্ন হল, এর শেষ কোথায়? শান্তির পরিবেশ কি কোনো দিন বাস্তব হবে না ইসরায়েলের জন্য?
উত্তর এখনও অজানা। তবে একটা জিনিস ইসরায়েল শিখে গেছে। সেটা হল বিপদে পড়লে নতুন কিছু আবিষ্কার করে বিপদ থেকে নিজেকে টেনে তোলা। প্রাক্তন মিসাইল ডিফেন্স এজেন্সির প্রধান যে কথাটি বলেছিলেন, সেটাই আজ সবথেকে বেশি প্রাসঙ্গিক— আমরা হয় আবিষ্কার করব, না হয় নিশ্চিহ্ন হব!