আয়না নয়
ভূতের গল্পের শেষে যদি দেখা যায়, যাকে ভূত বা পেত্নী বলে ভাবা গিয়েছিল, সেটা আসলে একটা বেল গাছ, কলা বা তেঁতুল গাছ, তখন বড্ড রাগ হয়। ভূতের গল্প হবে খাঁটি ভূতের গল্প, নইলে শুধু শুধু ঠকাবার দরকার কি?
মুশকিল হচ্ছে এই যে আমি নিজে ভূত বিশ্বাস করি না, আবার ভূতেরাও আমাকে বিশ্বাস করে না। আমি অনেক পোড়ো বাড়ি কিংবা ভূতুড়ে বাড়িতে রাত্রে থেকেছি কিন্তু সেখানেও কোনোদিন ভূত দেখতে পাইনি, ভূতেরাও আমাকে দেখতে পায়নি।
আমাদের ছেলেবেলায় মাসি—পিসি, ঠাকুরদা—ঠাকুমার কাছ থেকে ভূত সম্পর্কে অনেক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে পেতুম। তাঁদের সকলেরই জীবনে একবার না একবার ভূতের সাক্ষাৎ উপলব্ধি হয়েছে। সে সবই বেশ রোমাঞ্চকর গল্প, কিন্তু এখন সে সব পুরনো হয়ে গেছে।
আজকাল কোনো আড্ডায় ভূতের প্রসঙ্গ উঠলে অন্য রকম ব্যাপার হয়। বৃষ্টি বাদলার দিনে কোনো কোনো সন্ধেবেলা মুড়ি আলুর চপ খেতে খেতে ভূতের গল্প এসেই যায়। বিশ্বাস করুক বা না করুক ভূতের গল্প শুনতে সবাই ভালোবাসে। বিশেষত মেয়েরা। ভূতের গল্প শোনবার পর সেই রাত্রে মেয়েরা একা একা বাথরুমে যেতে ভয় পায়।
কিন্তু এই সব আড্ডায় কেউই নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারে না। প্রায় সবাই ইংরেজি পত্র—পত্রিকা বা বই থেকে কোনো গল্প শোনায়। কিংবা বড়জোর বলে আমাদের অফিসের মনতোষবাবুর একবার হয়েছিল…কিংবা আমার ছোট মাসির দেওর একবার মধুপুরে গিয়ে…। যতই জমাটি হোক, এই সব গল্পের চেয়ে কারুর নিজের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে অনেক বেশি ভালো লাগে। সত্যি ঘটনার স্বাদই আলাদা।
আমার ধারণা, ভূতরা অভিমান করে আজকাল মানুষদের দেখা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
এই সব কথাগুলোই আমি বলছিলুম শনিবারের এক আড্ডায়। শুধু মুড়ি তেলেভাজাই নয়, হুইস্কি—টুইস্কিও চলছিল। আমরা প্রায় দশ বারো জন, এর মধ্যেই তিন চারজন বই—পড়া কিংবা বানানো কয়েকটা রোমহর্ষক গল্প বলেছে।
আমার কথা শুনে শান্তনু গম্ভীরভাবে বললো, আমি কিন্তু একবার নিজের চোখে দেখেছি। কোন রকম ভুল নয়, চোখের ভুল নয়। ঠিক যেমন তোমাদের দেখছি, সেই রকমই দেখেছি।
আমরা সবাই চমকে উঠলুম। এ যে সম্পূর্ণ নতুন কথা। শান্তনুর বয়েস বেশি নয়, ছাব্বিশ—সাতাশ হবে, সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরিতে ঢুকেছে। আমরা কেউ দেখিনি, অথচ এই কম বয়েসে শান্তনু ভূত দেখে ফেলল?
আমি খানিকটা অবিশ্বাসের সঙ্গে বললুম, কী রকম ঘটনাটা শুনি।
মেয়েরা বেশি উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগল, বল, বল।
কিন্তু শান্তনুর মুখখানা একটু বিমর্ষ হয়ে গেল। সে আস্তে আস্তে বললো, নাঃ, সে ঘটনা বলতে চাই না।
এ আবার কী ব্যাপার? ভূত দেখেছে, অথচ সে কথা বলতে চায় না কেন? এখনো ভয় পায় নাকি?
আমার অবশ্য একটু সন্দেহ হল যে শান্তনু বোধহয় এখনো পুরো গল্পটা বানিয়ে উঠতে পারেনি।
অন্যরা সবাই মিলে খুব পেড়াপেড়ি করতে লাগল। তখন শান্তনু ওর বন্ধু সিদ্ধার্থর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী রে, বলব?
সিদ্ধার্থ বললো, হ্যাঁ, বল না। সেই নর্থ পয়েন্টের ব্যাপারটা তো?
শান্তনু মাথাটা বুকের দিকে ঝাঁকালো। দু’হাতের আঙুলের ডগাগুলো ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে অনেকটা আপন মনে বলার মতন গল্পটা শুরু করল।
শান্তনু বললো, এটা আমার কলেজ জীবনের কথা। তখন আমি দার্জিলিংয়ে পড়ি। মাত্র কয়েক মাস হল আমি ওখানে গেছি। একটা বিশেষ কারণে আমায় কলকাতার কলেজ ছাড়িয়ে দার্জিলিংয়ে পাঠানো হয়েছিল।
আমাদের আড্ডার এক মহিলা ঠাট্টা করে প্রশ্ন করলেন, কেন কলকাতার নকশাল হয়ে যাচ্ছিলে বুঝি?
শান্তনু চোখ তুলে মেয়েটির দিকে তাকাল। কোন রসিকতাও করল না, সরাসরি সে প্রশ্নের কোন উত্তরও দিল না। বললো, না, অন্য ব্যাপার। যাই হোক, আমি আসল ঘটনাটা সংক্ষেপে বলি। আমি ফেনিয়ে গল্প বলতে পারি না। তখন পুজোর ছুটির সময়। এই ছুটিতে সবাই হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি চলে যায়। দার্জিলিংয়ের ছাত্রদের জন্য ওই সময় ট্রেনের কামরা রিজার্ভ করা থাকে, প্লেনের টিকিটেও আলাদা কোটা দেওয়া হয়।
কিন্তু আমার সেবার ফেরা হবে না। বাবা চিঠি লিখে জানিয়েছিল যে আমাদের বাড়িশুদ্ধ সবাই দার্জিলিং বেড়াতে আসছেন, সুতরাং আমার কলকাতায় ফিরে কোন লাভ নেই। কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে একটা দারুণ দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, মা এখন তা নিয়ে কান্নাকাটি করেন, দার্জিলিংয়ে এলে তবু যদি তার মন একটু অন্য দিকে ফেরে।
তবে বাবার অফিসের ছুটি হতে আরও কয়েকটা দিন দেরি আছে, সেই কটা দিন বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমি হোস্টেলে থাকবার ব্যবস্থা করলুম।
হোস্টেল একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল এক শনিবার। রইল শুধু আমার মতন আর একজন, তার নাম রামানুজম। দক্ষিণ ভারতীয় ছেলে। ওর বাবা—মা দু’জনেই কিছুদিন আগে আমেরিকা চলে গেছেন, সুতরাং ওর কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমি ঠিক করেছিলুম, আমার বাবা—মা এলে রামানুজমকেও আমাদের সঙ্গে বেড়াতে নিয়ে যাব।
পাশাপাশি তিনখানা ঘরের মধ্যে মাঝখানেরটা বাদ দিয়ে দু’পাশের দুটো ঘরে আমি আর রামানুজম থাকি। আমাদের ঘর দুটো ছাড়া অন্য সব ঘরই তালাবন্ধ। ইচ্ছে করলে আমি আর রামানুজম ওই ক’দিনের জন্য এক ঘরেই থাকতে পারতুম। কিন্তু প্রথম রাত্তিরে সে কথা আমাদের মনে পড়েনি।
প্রথম রাত্তিরে দু’জনে অনেকক্ষণ গল্প করার পর এক সময় শুতে গেলুম নিজেদের ঘরে।
অনেক রাত্তিরে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। কার যেন গলার আওয়াজ পাচ্ছি। তারপরেই বুঝলুম, এ তো রামানুজমের গলা। সে তাই খানিকটা ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করচে, শান্তনু, এই শান্তনু, তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ হয়েছে?
আমি অবাক। আমি ঘুমিয়ে ছিলুম, তবু আমাকে এ রকম প্রশ্ন করার মানে?
তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুললুম। আরও অবাক হয়ে দেখি, আমার ঘরের সামনে নয়, মাঝখানের বন্ধ দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে রামানুজম ওই কথা বলছে।
আমি কাছে গিয়ে বললুম, কী ব্যাপার, রামানুজম?
রামানুজম কী রকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। এমনিতে সে বেশ সাহসী ছেলে, আমাদের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিল। দারুণ খেলত।
আমি ওকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললুম, এই কী হয়েছে? ও বেশ কয়েকবার ঢোঁক গিলল। তারপর শুকনো গলায় বললো, কী হল, বলত? আমি বাথরুম করতে উঠেছিলুম…হঠাৎ দেখি এই ঘরে আলো জ্বলছে…এদিকে এগিয়ে এসে দেখলুম, এ ঘরের দরজা খোলা, খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে একটা ছেলে, মনে হল যেন অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। হোস্টেলে তো আর কেউ নেই, সুতরাং ভাবলুম, তুমিই হবে, হঠাৎ কোনো অসুখ করছে কিংবা পেটব্যথা করছে….আমি যেই ঘরে ঢুকতে গেলুম অমনি দড়াম করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আমি বললুম, এই তো এ ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা ঝুলছে।
রামানুজম কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললো, কিন্তু আমি যে নিজে দেখলুম, স্পষ্ট… নিশ্চয়ই এ ঘরের মধ্যে কেউ আছে।
আমি বললুম, কাল সকালে দেখা যাবে, চল, তুমি আমার ঘরে শুতে চল।
শান্তনুর গল্পে বাধা দিয়ে একজন বললো, নিশ্চয়ই ওই হোস্টেলে কিছুদিন আগে কোন ছেলে আত্মহত্যা করেছিল।
শান্তনু বললো, অধিকাংশ গল্পেতেই এরকম থাকে বটে, কিন্তু আমার এটা গল্পও নয়, আর ওই হোস্টেলে কোনো দিন কোনো ছেলে আত্মহত্যাও করেনি।
আর একজন জিজ্ঞেস করল, তুমি সেদিন ভয় পেয়েছিলে?
শান্তনু বললো, তা পেয়েছিলুম, অস্বীকার করব না। অত রাত্তিরে সব দিক নিঝুম…বিশেষত রামানুজমকে ভয় পেতে দেখেই আমার ভয় ধরে গেল। রামানুজম আজেবাজে কথা বলার ছেলে নয়।
যাই হোক, সে রাত্তিরটা তো কেটে গেল। পরদিন সকালে আমরা মাঝখানের ঘরের দরজাটা ফাঁক করে দেখলুম। ভেতরের দুটো খাট স্পষ্ট দেখা যায়। কোনো মানুষের চিহ্ন নেই।
দিনের বেলা আর এই নিয়ে আমরা কিছু আলোচনা করলুম না। সেদিন সন্ধ্যে বেলা আমরা দুজনে সিনেমা দেখে এলুম। তারপর হোস্টেলে ফেরার পরই রামানুজমের ব্যবহার কী রকম যেন অস্বাভাবিক হয়ে গেল। হঠাৎ হঠাৎ চমকে ওঠে। পিছন ফিরে চায়। আমার হাতটা চেপে ধরে। এক সময় সে নিজেই বললো, শান্তনু, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ আমি খুব ভীতু কিংবা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কাল স্পষ্ট দেখেছি, নিজের চোখকে কী করে অবিশ্বাস করব!
আমি বললুম, নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাখ্যা আছে। থাক ও নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই।
সে রাত্রে শুয়ে শুয়ে গল্প করলুম অনেকক্ষণ। মনে হল সারা রাত ঘুমই আসবে না। কিন্তু রামানুজমই ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়। আমার তবু ঘুম আসছে না। মুখে চোখে জল দিলে ভালো লাগতে পারে ভেবে উঠে পড়লুম। রামানুজম যাতে ভয় না পায়, সেই জন্য আলো জ্বেলে রাখলুম। বাইরে বেরিয়ে পাশের ঘরে উঁকি মেরে দেখলুম একবার। না, আলো—টালো কিছু জ্বলছে না।
বাথরুমে সবে মাত্র ঢুকেছি অমনি শুনতে পেলুম রামানুজমের আর্ত চিৎকার।
এক দৌড়ে ফিরে এলুম নিজের ঘরে। দেখলুম বিছানার ওপর উদভ্রান্তের মতন বসে রামানুজম চিৎকার করছে, শান্তনু, হি ওয়াজ হিয়ার! হি ওয়াজ হিয়ার!
আমি পাশে বসে পড়ে বললুম, কে? কে?
ঠিক কালকের মতন, এই পাশের বিছানায় যন্ত্রণায় ছটফট করছিল কিন্তু শান্তনু, সে যেন অনেকটা তোমার মতন…
তারপরেই সে আঙ্গুল তুলে আবার বললো, ওই যে! ওই!
এবার আমিও দেখতে পেলুম! দরজার পাশেই দেয়ালের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে…তাকে দেখতে অবিকল আমার মতন…রামানুজম দারুণ ভয় পেয়ে একবার তাকে দেখছে, একবার আমায় দেখছে….কিন্তু আমি তাকে দেখে কোন কথা বলতে পারলুম না। কান্নায় আমার গলা বুঁজে এলো—
হঠাৎ কথা থামিয়ে শান্তনু মুখটা নিচু করে রইল। সবাই চুপ। আমি নিরাশভাবে বললুম, যাঃ! এও তো সেই পর্যন্ত কলাগাছ বেলগাছের ব্যাপার। নিশ্চয়ই সে দেওয়ালে কোন বড় আয়না ছিল। নইলে জ্যান্ত অবস্থায় কেউ তো নিজের ভূত দেখে না।
শান্তনু মুখ তুলে তীব্র গলায় বললো, না সেখানে কোনো আয়না ছিল না। আলো ছায়ার খেলাও ছিল না। সত্যিই সে এসেছিল। আমি তখন বিছানায় বসে আর সে দাঁড়িয়ে। তার কপালের ক্ষত দিয়ে রক্ত পড়ছে, মুখে যন্ত্রণার সঙ্গেও মিনতি মাখান, যেন সে বলতে চাইছে, শান্তনু তুই আমায় চিনতে পারছিস না—।
বলতে বলতে সত্যিই কেঁদে ফেলল শান্তনু। এবারে আমরা সবাই অবাক। ভূতের গল্প বলতে গিয়ে কেউ তো কোনোদিন কাঁদে না।
শান্তনুর বন্ধু সিদ্ধার্থ এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ওকে এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। ওর এক যমজ ভাই ছিল, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল সে, পুলিশের গুলিতে মারা যায়। এই ঘটনা শান্তনু কোনোদিন ওর মাকেও বলেনি।