আয়নার মন

আয়নার মন

আজ ঠিক করেছিলাম বাড়ি থেকে বেরোব না। একটা বেকার ছেলে একদিন অন্তরালে থাকলে কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না সমাজের। কাঠ বেকার অবশ্য নয়। গোটাছয়েক টিউশন করি। সাবজেক্ট বাংলা। আজ, মানে মঙ্গলবার দুটো বাড়িতে যাওয়ার কথা আছে। না গেলেও হয়! কারণ আমি গেলেই দুই সায়েন্স স্টুডেন্টের খেয়াল পড়ে, ‘তাই তো আজ কুশল স্যারের আসার কথা!’ ডুব দিতে সেই কারণেই কোনও অপরাধবোধ হবে না। ভেবেছিলাম বেলা করে ঘুম থেকে উঠব। এফএম চালিয়ে একটা থান ইট সাইজের বই নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকব নিজের ঘরে। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল না। বউদি ঘুম থেকে ঠেলে তুলে, হাতে চায়ের কাপ, টাকা আর বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিল। বলল, ‘বাবা ভোরে বেরিয়ে গিয়েছেন, বর্ধমানে বন্ধুর বাড়ি। আজ তুমি বাজার যাও।’

দাদা চিরকালই গুডবয় মার্কা। বাজার, রেশনের ধার মাড়ায় না। কাতরস্বরে বউদিকে বলেছিলাম, ‘ডিমফিম দিয়ে চালিয়ে দাও না। একদম মুড নেই বাজার যাওয়ার।’ অদ্ভুত একটা মিঠে বিদ্রূপ টাইপ হেসে ঘর থেকে চলে গিয়েছিল বউদি। ওই হাসির একটাই মানে হয়, ‘কেন মিছিমিছি অ্যাক্টিং করছ! এরকম দিন তোমার জীবনে আগেও বেশ কয়েকবার এসেছে। তোমার তাতে কিছুই যায় আসেনি!’

হ্যাঁ, আজকের দিনটা আমার জীবনের একটা বিশেষ দিন হতে পারত। অলিভিয়ার বিয়ে আজ। আড়াই বছর ধরে অলিভিয়ার সঙ্গে আমার প্রেম ছিল। ওর বাড়িতে যখন বিয়ের জন্য পাত্র পছন্দ করা হল, আমি অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, বিয়েটা করেই ফেলো অলিভিয়া। আমার চাকরিবাকরি কবে কী হবে, বোঝা যাচ্ছে না। হলেও ভাল কিছু হবে বলে তো মনে হয় না। তুমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। মেয়ের একটা ভাল বিয়ে তাঁরা আশা করতেই পারেন। তা ছাড়া এত ভাল পাত্র যখন পাওয়া গিয়েছে…

আমার বোঝানোর মাঝে লাইব্রেরি মাঠ থেকে রেগেমেগে উঠে গিয়েছিল অলিভিয়া। তখনই আমি মনে মনে ওকে বলেছিলাম, বিরাট ভুল স্ট্র্যাটেজি নিলে অলিভিয়া। অভিমানের এই স্পেসটুকু দিয়েই আমি কেটে যাব।

হয়েও ছিল তাই, টানা দশদিন অপেক্ষা করার পর অলিভিয়া যখন দেখল, আমি কোনও যোগাযোগ করছি না, ফোন করল আমার মোবাইলে, কী ব্যাপার, দেখা করছ না কেন? বললাম, তোমার বিয়ের কথা চলছে, এই সময় কি দেখা করা উচিত হবে!

যেন আকাশ থেকে পড়েছিল অলিভিয়া। বিপুল বিস্ময়ে বলেছিল, তার মানে! তুমি চাও আমার বিয়ে অন্য কারও সঙ্গে হয়ে যাক!

যার-তার সঙ্গে নয়। আমার চেয়ে ভাল কোনও ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে,বাধা দেওয়া ঠিক হবে না। আমি চাই, তুমি সুখী হও।

তুমি খুব ভাল করেই জানো, তোমাকে বিয়ে করেই সবচেয়ে সুখী হব আমি।

তা হয়তো হবে। কিন্তু আমি তো একটা কথা ভেবে কষ্ট পাব, তুমি আরও স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার যোগ্য। যা তোমায় আমি দিতে পারছি না। এই হীনন্মন্যতা আমাকে অসুখী করবে।

আমার ঠাকুরদা নামী উকিল ছিলেন। জিনবাহিত হয়ে তাঁর কিছু গুণ আমার মধ্যে চলে এসেছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া এই শক্তি আমি কাউকে দেখাই না। ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু জানে আমার এই ক্ষমতাটা। কদরও করে। আমার যুক্তিতে বিভ্রান্ত হয়ে অলিভিয়া বলেছিল, আমি তোমার বাড়ি যাব। বউদির সঙ্গে কথা বলব এ ব্যাপারে।

বউদির সঙ্গে আমিই আলাপ করে দিয়েছিলাম অলিভিয়ার। খুচরো প্রেমিকাদের আমার বাড়ি বা পরিবারের ত্রিসীমানায় আসতে দিই না। অলিভিয়ার প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছিল, অবচেতনে স্ত্রী করার বাসনাও হয়েছিল হয়তো, খানিকটা আহ্লাদের বশবর্তী হয়ে পাড়ার পঁচিশে বৈশাখের ফাংশনে বউদির সামনে ওকে এনেছিলাম। দু’জনেই খুব হেসে হেসে গল্প করল। পরে বাড়িতে বউদি আমাকে বলল, এই নিয়ে তো তিনজনের সঙ্গে আলাপ করালে। অলিভিয়াই বেস্ট। দেখতেও যেমন সুন্দর, ব্যবহারটাও মিষ্টি। অত বড়লোকের মেয়ে, বুঝতে দেয় না! এই প্রেমটা তোমার থাকবে তো? নাকি অন্যগুলোর মতো…

বউদির আশঙ্কাটাই মিলে গেল। অলিভিয়াকে নিয়ে আমার তিন প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে ঝড়, সুনামির কোনও চিহ্ন নেই। গত রাতে বেশ ভাল ঘুম হয়েছে। ঘুম ভাঙার পর নিজের মনটার আগাপাশতলা জরিপ করলাম, নির্লজ্জের মতো স্বাভাবিক! আমি যে কী বস্তুতে গড়া, নিজেই বুঝতে পারি না। আমার কি প্রেমবোধ নেই? অথচ হরবখত্ তথাকথিত ‘প্রেমে’ আমি পড়ি। মেয়েরাও পড়ে। প্রেমিকার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসস্টপে অপেক্ষা করতে পারি। মিনিংলেস বকতে বকতে তাদের সঙ্গে হাঁটতে পারি মাইলের পর মাইল। আমি তাদের শরীরের ব্যাপারে খুব উৎসাহী, এই বদনাম দেওয়া যাবে না। ক্ষেত্র বিশেষে অধৈর্য হয়ে তারাই বরং এগিয়ে আসে। আমি তাদের নিরাশ করি না, এই যা।

আমার আগের যে দুটো সিরিয়াস প্রেম, মানে যাদের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়াই ছিল একমাত্র পরিণতি, তারা হচ্ছে শ্রীময়ী আর পারমিতা। শ্রীময়ী কলেজে আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ছিল। ক্যাম্পাসে সন্ধে নেমে যেত, গাছে গাছে বসে যেত পাখিদের পাঠশালা। তারপর আমরা উঠে বাড়ির দিকে হাঁটা দিতাম। কলেজ রাস্তার চা-দোকান থেকে নানা টিটকিরি ভেসে আসত। যার মধ্যে একটা খুব ইন্টারেস্টিং, কী মামা, জমিয়ে প্র্যাকটিকাল ক্লাস হল মনে হচ্ছে!

আমি আর শ্রীময়ী আওয়াজ খেয়ে হাসতাম। হঠাৎই একদিন যেন এখনই ট্রেন মিস হবে, এই ভঙ্গিতে শ্রীময়ী এসে জানাল, যা ভয় পাচ্ছিলাম তাই হল, বুঝলি কুশল!

জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হল আবার?

পাত্রপক্ষ পছন্দ করে গেল আমাকে। এখন তোকেই বা আমি বিয়ের জন্য চাপ দিই কী করে বল! তোর তো এখন কলেজই শেষ হল না। এদিকে চিন্তা হচ্ছে, আমাকে ছাড়া তুই থাকবি কী করে!

উত্তরে আমি বলেছিলাম, তুই চিন্তা করিস না। অসম বয়সের প্রেমে এরকমটাই হয়। আমি এর জন্য তৈরি ছিলাম।

বিশ্বাস করি না। তোর ভীষণ কষ্ট হবে, আমি জানি, বেশ কনফিডেন্টলি বলেছিল শ্রীময়ী। আমি তখন বলি, ঠিক আছে, দেখিস, তোর বিয়েতে কেমন সেজেগুজে খেয়ে আসব।

সত্যিই গিয়েছিলাম। হেভি মাঞ্জা দিয়ে। শ্রীময়ী আমাকে আড়ালে ডেকে বলেছিল, তোকে ঠিক জোকারের মতো লাগছে। যাদের দেখলে হাসিও পায়, করুণাও হয়। হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলাম, তোকে দেখেও আমার কষ্ট হচ্ছে। যতই সাজিস, আসলে ক্রীতদাসীই হতে চলেছিস।

তো যা হয়, ক্রীতদাসী ফোনেও জোকারের আর কোনও খবর নেয়নি। মাঝে দু’-চারটে খুচখাচ প্রেম হওয়ার পর এল পারমিতা। ইউনিভার্সিটির প্রেম। ওর হাত ধরে কলকাতার পার্ক, ময়দান চিনলাম। বেজায়গায় বসতে গিয়ে তাড়া খেলাম পুলিশের। একদিন পারমিতাও নিয়ে এল অনিবার্য সংবাদ, আমার দেখাশোনা চলছে। কথা বেশিদূর এগোতে দিইনি। তোর আমার রিলেশনটা জানিয়ে দিয়েছি বাড়িতে। কবে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করবি বল?

বলেছিলাম, ১৫ অগস্ট তোর বাবার নিশ্চয়ই ছুটি। ওইদিনই যাব।

যাইনি। আমার অপেক্ষায় থেকে থেকে বাড়িতে ফোন করেছিল পারমিতা। তখন আমার মোবাইল সেট হয়নি। বউদি পারমিতাকে জানায়, ও তো সকাল থেকে ফুটবল খেলছে। পাড়ার মাঠে টুর্নামেন্ট আজ।

বউদি মিথ্যে বলেনি। তবে খুব অবাক হয়েছিল, ফোনের ওপারে পারমিতাকে কাঁদতে দেখে। শ্রীময়ী, পারমিতা আমায় যত সহজে রেহাই দিয়েছে, অলিভিয়া দেয়নি। মেয়েটা যুগ বেমানান ইনোসেন্ট। এই তো দিন কুড়ি আগে আমাদের সন্ধের ঠেক, সাধুর ঘাটে বসে আছি। বালিব্রিজের উপর দিয়ে একটা মালগাড়ি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পিছনে এসে বসল অলিভিয়া। থমথমে মুখ। ওই মুখ দেখে বন্ধুরা আমার পাশ থেকে মানে মানে কেটে গেল। মালগাড়ির যাওয়ার শব্দ শেষ হওয়ার পর অলির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কী হয়েছে? পাত্রপক্ষ কি পিছিয়ে গেল? আমাদের রিলেশনটা জানিয়ে নিশ্চয়ই কেউ কান ভাঙিয়েছে।

ছলছল চোখে অলিভিয়া জানাল, বাড়িতে চিঠি লিখে তোমার কাছে চলে এলাম। বসে আছি গঙ্গার পাড়ে, বুকের ভিতর সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল যেন। বাইরের এক্সপ্রেশনে কিছু বুঝতে দিলাম না। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী লিখলে চিঠিতে?

কান্না আগলে অলি বলেছিল, লিখেছি, রাষ্ট্রপতির ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলেও, আমি করব না। যত কষ্টেই থাকি, যাকে ভালবাসি তার সঙ্গেই থাকব। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে…

অলিকে থামিয়ে চিঠির বাকি অংশটা আমিই বলে উঠেছিলাম, তোমরা চিন্তা কোরো না। পারলে আমায় ক্ষমা কোরো। ইতি…

জলভরা চোখেও বিস্ময় ফুটে উঠেছিল ওর। আমি বলেছিলাম, অত্যন্ত হঠকারী ব্যাপার হয়ে গিয়েছে কিন্তু। বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া না পড়লে চলছে না। তুমি বোসো, আমি একটা সিগারেট নিয়ে আসি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্বলন্ত সিগারেট মুখে অলিভিয়ার পাশে এসে বসেছিলাম। অপরাধী গলায় অলিভিয়া বলেছিল, আমি কিন্তু বাড়ি থেকে কিছু নিইনি। টাকাপয়সা, গয়না কিচ্ছু না। এই সালোয়ার-কামিজটা সবচেয়ে প্রিয়, এটা পরেই বেরিয়ে এসেছি।

বেশ করেছ। তুমি বাড়ি থেকে টাকাকড়ি নিয়ে আসার মেয়েই নও। তবে কিনা, বাড়ির লোককে একদম কিছু না জানিয়ে তোমার এভাবে বেরিয়ে আসা ঠিক হয়নি। তাঁরা চিন্তা করছেন।

তুমি যদি বলো, এখনই মোবাইল থেকে ফোন করে জানিয়ে দিই?

আমার বাড়িতেও একটা ইন্টিমেশন দিতে হবে। হঠাৎ তোমাকে নিয়ে গিয়ে উঠলে, তাঁরাও থতমত খেয়ে যাবেন। তার আগে একটা কথা বলো তো, রাষ্ট্রপতির ছেলেকেই তোমার বেস্ট নমুনা মনে হল কেন? পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স করছ বলে?

বড় মিষ্টি করে লজ্জা পাওয়া হাসি হেসেছিল অলিভিয়া। সমস্ত টেনশন তখন ওর চেহারা থেকে উধাও। এইভাবে কথায় কথায় মিনিট পনেরো-কুড়ি কেটেছিল। আমায় আশ্বস্ত করে ঘাটের উপর থেকে ভেসে এসেছিল অলিভিয়ার বাবার গলা, মুন্নি, বাড়ি চল।

চমকে উঠে ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল অলিভিয়া। আমি উঠে দাঁড়াতে, শক্ত করে চেপে ধরেছিল আমার হাত। আমি ওকে বোঝালাম, ‘আপাতত বাড়ি যাও। দেখছ না, তোমার মা পর্যন্ত এসে গিয়েছেন।

অলিভিয়ার মা বাড়ি থেকে বড় একটা বের হন না। অলিদের ফ্যামিলি এলাকার প্রায় লুপ্ত বনেদি পরিবারের একটা। আমার হাত ছেড়ে দিয়ে সিঁড়ি ধরে উঠে গিয়েছিল অলিভিয়া। মা-বাবার সঙ্গে গাড়িতে যেতে যেতে নিশ্চয়ই শুনেছে, আমিই ওঁদের ফোন করে আনিয়েছিলাম। সিগারেট কিনতে গিয়ে ফোন করেছিলাম অলিভিয়ার বাবাকে, আপনার মেয়ে সাধুঘাটে বসে আছে। বাড়ি যেতে বললে শুনছে না। একটু ইমোশনাল টাইপ তো! প্লিজ় এসে নিয়ে যান।

এসব জানার পর খুব স্বাভাবিক কারণে অলিভিয়া আমার সঙ্গে আর দেখা করেনি। ওর প্রতি এই ধরনের আচরণের জন্য আমারও খুব খারাপ লেগেছে। অলিভিয়ার নিদারুণ বেদনা আমি ফিল করছি। কিন্তু ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না। আমার অনুরোধে অলিভিয়া নাক বিঁধিয়েছিল। সেই নাকে আজ নাকছাবি পরে অন্যের বউ সাজবে, এটা কল্পনা করে আমার এতটুকু ঈর্ষা হচ্ছে না। প্রেমিকাকে নাক বেঁধাতে বলা আমার পুরনো আবদার। তখনও সানিয়া মির্জা মার্কেটে আসেনি। শ্রীময়ী, পারমিতা দু’জনেই আমার আবদারের চিহ্নে অন্যের জন্য গয়না পরেছে এবং এটাও অতি বাস্তব, আমার আদর করা জায়গাও তারা তুলে দিয়েছে…

আমি ভেবে পাই না, প্রেমিকার প্রতি অধিকারবোধের ব্যাপারে আমি এত অনুভূতিশূন্য কেন? এটা কি এক ধরনের রোগ? মানসিক প্রতিবন্ধকতা, নাকি পলায়ন মনোবৃত্তি? কিন্তু কার থেকে পালাচ্ছি আমি? একটি মেয়ের দায়িত্ব নিতে হবে বলে? এসব ধারণা আজকের দিনে অচল। আমার সব প্রেমিকাই লেখাপড়ায় ভাল, ছোটখাটো কেরিয়ার করে নেওয়া তাদের পক্ষে কোনও ব্যাপার নয়! আমি পাশে থাকলে সেই চেষ্টা তারা অবশ্যই করত। তার বদলে অপেক্ষায় থাকি, কবে তাদের বিয়ের সম্বন্ধ আসবে… নিজের উপর যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বাজারের রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। দূরে কোথাও সানাই বাজছে। অলিভিয়াদের বাড়িতে নয়। পাড়া ছাপিয়ে সানাই অভিজাত পরিবারে আজকাল বাজে না। এটা নিশ্চয়ই ক্যাম্পের দিকে গরিব কোনও বাড়ির সানাই।

আনাজপাতি কেনা শেষ করে আমি এখন মাছের বাজারে। শীতলদা মাছ কেটে জড়ো করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, বিয়েবাড়ির অর্ডার। হয়তো অলিভিয়াদের বাড়িতেই যাবে। আমাকে দেখে শীতলদা একগাল হেসে বলল, একটু দাঁড়াবে, নাকি যেটা কাটছি, সেটা থেকেই কিছুটা দিয়ে দেব?

আমি বললাম, না।

একটু অভিযান ধরা পড়ল কি এই উচ্চারণে? অভিমান কার প্রতি?

আমি এখন একটা জুয়েলারির দোকানে। সকালে একবার যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েইছি, সন্ধের মুখেও ঠেকে বসার জন্য বেরোলাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টের পেয়েছি, আজকের ডেটে প্রচুর বিয়ে। অনেক বাড়ি থেকেই সানাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। লেডিস পার্লার উপচে গিয়েছে ভিড়ে। ফুলের দোকানগুলো রেডিমেড বোকে সাজিয়ে রেখেছে। অনুষ্ঠানে যে ক’টা বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়, সব বুক্‌ক্ড। গেট সাজানো হয়েছে আসল-নকল ফুল আর আলোয়। চারদিকে কেমন একটা উৎসব আনন্দের ভাব। সব কিছুই যেন আমাকে বাদ দিয়ে। এই যে আমার প্রেমিকার বিয়ে, আমার বন্ধুবান্ধব সকলেই জানে। এক-দু’জনের ও বাড়িতে নেমন্তন্নও আছে। সকালে বউদির ওই ইঙ্গিতময় হাসি ছাড়া, সারাদিনে কেউ আমার কোনও খোঁজ করল না। আমার যেন কোনও অস্তিত্বই নেই। এটা মাথায় ঢোকার পর কেন জানি আমার ইচ্ছে হল, আজ এই আনন্দ উৎসবের দিনে নিজেকে একটু জানান দিই। সেই কারণেই ঢুকেছি গয়নার দোকানে। অলিভিয়াকে একটা গিফ্ট পাঠাব। কিন্তু সামান্য একটা আংটির দাম দেখে মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। একটু চোখে পড়ার মতো নাকছাবিই আমার সারা মাসের টিউশনির রোজগারের সমান। দোকান মালিক সুকুমারদা আমার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা আন্দাজ করে নিল। বলল, দাঁড়াও ভাই, একটা দারুণ জিনিস দেখাচ্ছি।

রুপোর ফ্রেমের ছোট একটা হাত আয়না বের করেছে সুকুমারদা। জিজ্ঞেস করল, কেমন? ফ্রেমে কারুকাজ করা ছোট্ট আয়নাটা মন্দ নয়। যেন পুরনো পেন্টিং-এর গ্রিকদেবীর হাত আয়না। সেখান থেকে খুলে ঘষে মেজে উজ্জ্বল করা হয়েছে। বললাম, এটাই প্যাক করে দাও। গিফ্ট নিয়ে চলে এলাম অরণ্যের বাড়ি। দরজা খুলল অরণ্য। আমাকে দেখে

বেশ অবাক হল। অরণ্যের পরনে দুধসাদা পাজামা আর স্যান্ডোগেঞ্জি। পাঞ্জাবিটা শুধু গলানো বাকি। ঠিক সময়ই এসেছি, আর-একটু হলেই বেরিয়ে যেত। অরণ্যদের নেমন্তন্ন আছে অলির বিয়েতে। ড্রয়িং-এ এসে বসা অবধি অরণ্য আমাকে জিজ্ঞেস করল না, হঠাৎ কেন এলাম। মুখে কেমন একটা অপরাধের ছায়া। বন্ধুর প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হচ্ছে, সেখানে খেতে যাচ্ছে সে!

সোফায় আরাম করে বসে জিজ্ঞেস করলাম, রাংতা কোথায় রে?

আছে। ড্রেস করছে, বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল অরণ্য। অস্বস্তি থেকে যেন বাঁচল। রাংতা অরণ্যর বোন। হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে। খুব হাসিখুশি। স্কুল বয়স থেকে অরণ্যর বাড়িতে আসছি। রাংতা আমার হাঁটুর বয়সি, ওর সঙ্গেও একটা বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। রাংতা এল। শুধু মুখের মেকআপটা নিয়েছে। পরনে নীলচে গাউন। আমাকে দেখে চিরাচরিত উচ্ছ্বাসে বলে উঠল, আরে কুশলদা, তুমি এ সময়ে ! ভালই করেছ অবশ্য এসে। আজ কোন শাড়িটা পরব, তুমি ঠিক করে দেবে।

রাংতার মুখের কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। অন্যরকম লাগছে দেখতে। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শাড়ি আনতে। অলিভিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা রাংতাও জানে। সিচুয়েশন অনুযায়ী ওর একটু গম্ভীর থাকা উচিত, কিন্তু সেটা যে ওর ধাতে নেই!

নিয়ে এল তিনটে শাড়ি। জানতে চাইল, বলো, কোন শাড়িটা?

আমি গোলাপি শাড়িটার দিকে আঙুল তুললাম। শাড়িটাকে আর-একবার জরিপ করার প্রয়োজন বোধ করল না রাংতা। বলল, দারুণ চয়েস! এটাই পরব।

এবার আমি আসল কথায় আসি, চাপা গলায় বলি, রাংতা, আমার একটা কাজ করে দিবি? আমার গলার স্বর শুনে রাংতাও একটু সিরিয়াস হল। জানতে চাইল, কী কাজ? অলিভিয়ার জন্য একটা গিফ্ট এনেছি। লুকিয়ে দিয়ে দিতে পারবি?

কেন পারব না! দেখি কী এনেছ? পকেট থেকে গয়নার দোকানের লাল কাগজের মোড়কটা বের করে ওর হাতে দিলাম। রাংতা অনুমতি চাইল, খুলে দেখি? দেখ, আবার প্যাক করে দিস।

কাগজ খুলে উৎফুল্ল হল রাংতা। বলল, দারুণ গিফ্ট! এ কী, ভিতরে কিছু লেখোনি কেন? এক-দু’লাইন কিছু লিখে দাও। নইলে বুঝবে কী করে, কে দিয়েছে? আমি বললে হয়তো ভাববে, মজা করছি।

গিফ্টটা সেন্টার টেবিলে রেখে, কাগজ পেন আনতে দৌড়োল রাংতা। আমি জানি, রাংতা চুপিসারে কাজটা সারবে। অরণ্য বা ওর বাবা-মা, কেউই জানতে পারবে না। সুন্দর একটা লেটারপ্যাড আর পেন নিয়ে এল রাংতা। আমি বড় বড় করে অলির উদ্দেশে লিখলাম, এটা সামনে রেখে সিঁদুর পোরো। নাম লিখলাম না। অলি আমার হাতের লেখা চেনে। রাংতা আমার লেখাটা আয়নার উপর রেখে লাল কাগজে মুড়ে ফেলল গিফ্টটা। বলল, আমি সেলোটেপ মেরে নেব। তুমি এখন আমাদের বাড়িতেই থাকো। ওখানে কী হল না হল, এসে বলব।

রাংতা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কাকিমা এলেন আমার জন্য চা নিয়ে। কাকিমা

শাড়ি পরে রেডি। বললেন, তোমার কাকাবাবু আর তুমি রইলে বাড়িতে। খুব প্রয়োজন ছাড়া কোনও অনুষ্ঠান বাড়িতে যেতে চান না উনি।

আমি একটা অর্থহীন হেসে চায়ের কাপটা নিলাম। তারপর চালিয়ে দিলাম টিভিটা। এ বাড়িতে তিনজন বেরিয়ে গেল। আমিই দরজা দিলাম। ফ্যানের হাওয়ায় ওলট পালট খাচ্ছে ওদের পারফিউমের গন্ধ। যাওয়ার সময় রাংতা নিজের সাজ দেখিয়ে গেল। শাড়িটা পরে ওকে সত্যিই সুন্দরী লাগছে। রাংতাও লেডি হয়ে গেল! সেই কবে থেকে ওকে দেখছি।

টিভির পরদায় হলুদ বালির উপর হেঁটে যাচ্ছে এক কাঁকড়া। ওর কি কোনও গন্তব্য আছে? অনেকদিন এত মন দিয়ে টিভি দেখিনি। বিভিন্ন চ্যানেল সার্ফ করে, কতক্ষণ কেটে গেল জানি না। হঠাৎই ডোর বেল এবং একই সঙ্গে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেলাম। প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেলেও, উঠে গিয়ে খুললাম দরজা। রাংতা ফিরে এসেছে। চেহারায় ঝড়ে পড়ে যাওয়া ভাব। ধপাস করে সোফায় বসে কপালে হাত দিয়ে বলল, কেস পুরো গুবলেট হয়ে গেছে কুশলদা। গিয়ে দেখলাম অলিভিয়াদি তখনও বিয়েতে বসেনি। বর এসেছে, আছে অন্য ঘরে। দারুণ সেজে চেয়ারে বসে অলিভিয়াদি সবার সঙ্গে হেসে কথা বলছে, গিফ্ট নিচ্ছে। ভাবলাম, মুড বুঝি খুব ভাল। কানের কাছে গিয়ে বললাম, বিশেষ একজন আমার হাত দিয়ে তোমাকে গিফ্ট পাঠিয়েছে। বোধহয় বুঝতে পারল, তোমার গিফ্ট। বলল, দেখি, কী পাঠিয়েছে?

প্যাকেটটা দিলাম। খুলে দেখার পরই কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে কী কান্না, তুমি বিশ্বাস করবে না! আমি কিছুক্ষণ সামলানোর চেষ্টা করে, পিছোতে শুরু করলাম। ততক্ষণে অনেকেই চলে এসেছে। সকলে জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছে? হাত থেকে গিফ্টটা নিয়ে দেখছে বড়রা। কোনও এক মহিলা বলে উঠলেন, মনে হচ্ছে, কুশল পাঠিয়েছে। কে যেন জিজ্ঞেস করল, ওর হাতে এটা দিল কে? কথাটা আমি পালিয়ে আসতে আসতে শুনেছি।

দম নিতে থামল রাংতা। হাত-পা বেয়ে ঠান্ডা উঠে আসছে আমার শরীরে। ঘাবড়ানো গলায় বলি, ওদের আত্মীয় বন্ধুরা নিশ্চয়ই তোর খোঁজে এ বাড়িতে আসবে।

সে তো আসবেই। সেইজন্যেই তো দৌড়ে তোমাকে খবরটা দিতে এলাম। তুমি এখান থেকে পালাও।

পালিয়ে আর কী হবে,ওরা জেনেই গেছে গিফ্টটা আমারই দেওয়া।

মাথা নাড়ছে রাংতা। বলে, প্রমাণ করতে পারবে না। অলিভিয়াদিকে কেঁদে পড়তে দেখেই তোমার হাতের লেখা ওই কাগজটা আমি সরিয়ে নিয়েছি। আয়নাটা আঁকড়ে ছিল। এবার যদি ওদের বাড়ির লোক এসে আমায় জিজ্ঞেস করে, জিনিসটা কে পাঠিয়েছে? বলব, আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম মজা করার জন্য। ও এতটা সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাবে ভাবিনি। কারও নামও তো করিনি আমি।

মুঠোয়-ধরা কোঁচকানো কাগজটা আমার সামনে তুলে ধরল রাংতা। ওটা নিয়ে পকেটে পুরি। ধীরে ধীরে শরীর থেকে ঠান্ডা ভাবটা কাটছে। অনুতাপের গলায় রাংতাকে বলি, আমার জন্য এত কিছু কেন করতে যাচ্ছিস! আমি তো একটা খারাপ ছেলে। এই সময় অলিভিয়াকে গিফ্ট পাঠানোটা একধরনের নিষ্ঠুরতা।

রাংতা উঠে দাঁড়াল। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, তোমাকে যদি অলিভিয়াদি সেরকম ভালবাসত, তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারতে না। এই যেমন দেখো, তুমি দিনপনেরো আগে এ বাড়িতে দাদার সঙ্গে গল্প করতে করতে বলেছিলে, প্রেমিকা হিসেবে নাকছাবি পরা মেয়েই তোমার সবচেয়ে পছন্দের। সেই শুনে ক’দিন আগে নাক বেঁধালাম। আমার ছোটবেলা থেকে মা বলে আসছে, এতদিন নাক ফুটো করিনি। ভীষণ ভয় পেতাম। এবার যখন বেঁধালাম পার্লারে গিয়ে, খুব ভাবছিলাম তোমার কথা। এতটুকু যন্ত্রণা হয়নি।

আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাংতার সামনে। নাক বিঁধিয়েছে বলেই আজ ওর মুখটা অন্যরকম লাগছিল। ওই জায়গাটা এখনও লাল হয়ে আছে, ওতেই পরেছে সোনার রিং। আমি যেন ওর সামনে জাদু-আয়না। যতই নিজেকে খারাপ বলি, মানবে না কিছুতেই। এই আয়নার মোহেই পড়েছিল আমার বাকি প্রেমিকারা। অলিভিয়াকে নকল আয়না পাঠাতেই কান্নায় ভেঙে পড়েছে।

আমি তা হলে যাই, বুঝলি, বলে দরজার দিকে এগোই।

রাংতা বলে, এদিক দিয়ে নয়। ওরা এখনই হয়তো এসে পড়বে। পিছনের দরজায় চলো, খুলে দিচ্ছি।

আলোহীন গলিতে এসে স্বস্তি পাই। অন্ধকারে আয়নার ধর্ম প্রকাশ পায় না। সন্তর্পণে বাড়িগুলোর ছায়া ধরে হাঁটি, চাঁদ-তারাও যেন মুখ না দেখতে পারে আমার শরীরে! আরও অন্ধকার গলি খুঁজি, হয়তো খুঁজে পাব নিজেকে।

উনিশ কুড়ি, অক্টোবর ২০০৮

2 Comments
Collapse Comments

খোঁজ গল্পটি মিসিং, দয়া করে দেখুন।

বাংলা লাইব্রেরি (Administrator) October 2, 2024 at 1:53 pm

ধন্যবাদ। ঠিক করে দেয়া হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *