আয়নার বায়না
ঘটনাটা আসলেই ঘটেছে!
আমি নিজেকে যতোই প্রবোধ দিচ্ছি এটা নিছক আমার মনের ভুল, অবচেতন মনের কোনো পাগলামি কিংবা পুরোটাই আমার কল্পনা, মন ঠিক সায় দিতে পারছে না। কারণ এটা কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার নয়, স্ফুলিঙ্গের মতো চোখের নিমেষে উধাও হয়েও যাচ্ছে না। ব্যাপারটা ঘটেই চলছে!
শেভ করার জন্য বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলাম, গতরাতের বাজে ঘুমের প্রভাবে চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেছে, চেহারাটাও কেমন ফ্যাকাশে। এসব বাদ দিলেও আয়নার সামনে দাঁড়ালে অন্য অনেকের মতো নিজের চেহারা দেখে আক্ষেপ জাগে আমার। নাকটা যদি আরেকটু চিকন আর খাড়া হতো! চোয়ালটা যদি একটু ভারি হতো, কপালটা অতো বড় না হলেও চলতো। এরকম অনেক ভাবনা, কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়ালে কার না এসব হয়? এ পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর মানুষটিও এরকম ভাবনার শিকার হতে বাধ্য। তার মানে এই নয়, আমার চেহারা খুবই বদখত। দেখতে আমি আট-দশজন মানুষের মতোই স্বাভাবিক। আর স্বাভাবিকভাবেই সব মানুষের যেমন কিছু খামতি থাকে, আমারও আছে। হয়তো একটু বেশিই আছে। এরকম আক্ষেপ শেষে মুচকি হেসে শেভিং ক্রিমটা হাতে তুলে নিতে যাবো ঠিক তখনই ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম। পরিস্কার একটি কণ্ঠস্বর, দৃঢ়তার সাথে বলা একটি বাক্য আমাকে যারপরনাই ভড়কে দিলো।
“তুমি চাইলে আমি তোমকে বদলে দিতে পারি!”
আমি বলতে পারতাম কে-কিংবা কে বলছো-সেটা হতো বোকার মতো একটি প্রশ্ন। এই ছোট্ট পরিসরের বাথরুমে আমি ছাড়া যে অন্য কেউ নেই সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে! কার উদ্দেশ্যে আমি এই প্রশ্নটা করবো? তাই কোনো প্রশ্ন না করে সামনের আয়নার দিকে তাকালাম ভুরু কুঁচকে। নিজের চেহারাটা ভালো করে দেখে নিলাম আরেকবার। এটা কি আমার অবচেতন মনের কণ্ঠস্বর? হতে পারে। মাত্র ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করেছি। গতরাতের বাজে ঘুমের কারণে এখনও চোখে ঘুম লেগে রয়েছে। হতে পারে নিজের ভেতর থেকে আমার মস্তিষ্ক কথা বলে উঠেছে।
“তুমি চাইলে আমি তোমাকে বদলে দিতে পারি!”
আবারও বলে উঠল কণ্ঠস্বরটি, এবার আগের চেয়েও স্পষ্ট। আমি নিশ্চিত কণ্ঠটা অন্য কারোর, অন্তত আমার যে নয় তা আমি বাজি ধরে বলতে পারি। বাথরুমের আশেপাশে ভালো করে খুঁজে দেখলাম। ভুতে বিশ্বাসী হলে এক দৌড়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে যেতে পারতাম খুব সহজেই, কণ্ঠটা কার এ নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু আমি আমার মাথা ঠিকই ঘামাতে শুরু করলাম।
“কে?”
“আমি!” পরিস্কার কণ্ঠে জবাব দেয়া হলো।
“আ-আমিটা কে?” একটু তোতলালাম। এটা খুবই স্বাভাবিক। আয়নার দিকে ভুরু কুঁচকে ভয়ের সাথে তাকিয়ে রইলাম।
“যার দিকে তাকিয়ে আছো তুমি!”
“আয়না?!” বিস্ময় আর অবিশ্বাস একসাথে আমার গলায় জড়ো হলো।
“হ্যাঁ। আমি তোমার আয়না।”
এবার আমি নিশ্চিত, কণ্ঠটা আসলে আমার নিজের! গতরাতে ভালো ঘুম না হবার কারণ হ্যাংওভার। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে শরীর বিগড়ে গেছিল। সারারাত মাথা ব্যাথা আর এপাশ ওপাশ করে নিঘুম ছিলাম, শেষরাতের দিকে ক্লান্তিতে ঘুম এলেও অফিসে যাবার তাড়া আছে বলে সকাল আটটার মধ্যে বিছানা ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। মদের নেশা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। দু-চোখের পাতায় ঘুম লেগে আছে। বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়বো আবার।
উপুড় হয়ে আয়নার নিচে বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে মুখে আবারও পানির ঝাঁপটা দিলাম। মাথাটা সজোরে ঝাঁকিয়ে হেলুসিনেশন দূর করার চেষ্টা করলাম। আমি নিশ্চিত, অডিও-হেলুসিনেশানের শিকার হচ্ছি। মুখ তুলে যে-ই না আয়নার দিকে তাকালাম অমনি আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। শক্তপোক্ত মসৃণ আয়নাটি যেন স্বচ্ছ পানির মতো টলটল করছে! পুকুরের পানিতে ঢিল ছুঁড়ে মারলে যেমন তরঙ্গের সৃষ্টি হয় তেমন! পানির ট্যাপটা বন্ধ করতে ভুলে গেলাম। চোখ কুঁচকে মাত্র একহাত দূরে থাকা আয়নার দিকে ভালো করে দেখলাম। তরঙ্গে তরঙ্গায়িত আয়নাটি আসলে হাসছে!
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অদ্ভুত আর অচেনা একটি মুখাবয়ব ফুটে উঠেছে। আয়নার পৃষ্ঠে! যেন টলটলে পানি ব্যবহার করে কোনো ভাস্কর একটি মুখ খোদাই করেছে, আর সেই মুখটি জীবন্ত হয়ে হাসছে!
“ভয় পেও না, আমি তোমারই আয়না, তোমার বন্ধু!” সেই কণ্ঠটা গমগম করে উঠল।
“বন্ধু?” আমি জানি না কীভাবে কথাটা আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল।
“হ্যাঁ। তোমার পরমবন্ধু।”
“এসব কী হচ্ছে!” এবারও আমি বলতে পারবো না কিভাবে শব্দগুলো মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল।
“বললাম তো, আমি তোমার বন্ধু। আমাকে ভয় পাবার কোনো কারণই নেই। তোমার উপকার করার জন্যই তোমার ভাষায় কথা বলছি।”
“উপকার?”
“হ্যাঁ। আমার সাধ্যে যেটুকু কুলায় আমি তোমার উপকার করবো।”
“একটা আয়না কীভাবে জ্বলজ্যান্ত মানুষের উপকার করতে পারে?” আমার যুক্তিবাদি মস্তিষ্ক মোক্ষম প্রশ্নটাই করলো।
হেসে উঠল আয়না। “ভালো বলেছে। সত্যি বলতে আমার উপকার করার ক্ষমতা একদমই কম। বলতে পারো প্রায় নেই বললেই চলে। আসলে আমি একটামাত্র উপকারই করতে পারি। আমার ক্ষমতা ওটুকুই।”
“সেটা কী?” মনের অজান্তেই আমি কৌতূহলি হয়ে উঠলাম।
“ঐযে বললাম, আমি তোমাকে বদলে দিতে পারি!”
এবার আমি মনের অজান্তেই সন্দেহগ্রস্ত হয়ে উঠলাম, “আমার কী বদলে দিতে পারো?”
“তোমার চেহারাটা!!”
“আমার চেহারা?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু তুমি কীভাবে এটা করতে পারবে? কেন করবে?”
ঐযে বললাম আমি তোমার বন্ধু, তাই।”
“আয়নার কাজ তো চেহারা বদলে দেয়া নয়।” আবারও মোক্ষম প্রশ্ন আমার। “তুমি যদি সেটা করো তাহলে তুমি আর আয়না থাকবে না! অন্যকিছু হয়ে যাবে।”
“কী হয়ে যাবো?”
এবার আয়না প্রশ্ন করলো। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম আয়নার মুখাবয়বে প্রশ্নের অভিব্যক্তি!
“অন্যকিছু…মানে, আর যাইহোক আয়না থাকবে না।”
“কেন? আয়না থাকবো না কেন?”
“কারণ আয়নার কাজ যার চেহারা যেরকম সেরকমভাবেই দেখানো, চেহারা পাল্টে দেখানো নয়!”
“কিন্তু আমি যদি তোমার চেহারাটা আরও ভালো করে দেখাই, তোমার যে খামতিগুলো আছে সেগুলো দূর করে দেই তাহলে ক্ষতি কী?”
“আমার চেহারায় খামতি আছে মানে?” প্রতিবাদ করে উঠলাম। “তোমাকে কে বলেছে এসব? কোত্থেকে শুনেছো এ কথা?”
“আশ্চর্য, তুমি তো একটু আগেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে এটা ভাবলে।”
আমি চুপ মেরে গেলাম। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মাত্র কয়েক মিনিট আগের ব্যাপার অস্বীকার করা খুব কঠিন। গতকালের ঘটনা হলেও না-হয় একটা চেষ্টা করে দেখা যেতো।
“তোমার আক্ষেপ শুনেই তো আমি ঠিক করলাম তোমাকে বদলে দেই। মানে, আমার পক্ষে এটা সম্ভব, বুঝতেই পারছো।”
“মোটেও বুঝতে পারছি না। এটা কী করে সম্ভব? আশ্চর্য!”
“তুমি তাহলে বিশ্বাস করতে পারছো না?”
“অবশ্যই না।” যতোটা জোর দিয়ে বলা সম্ভব ততোটা জোর দিয়েই বললাম।
“তুমি কি একটু নমুনা দেখতে চাও?”
“নমুনা?” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলাম আমি।
“মানে, তুমি কি প্রমাণ চাইছো আমি সত্যি সত্যি বদলে দিতে পারি কিনা?”
আনমনেই মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দিলাম।
“ঠিক আছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করো। আমি বললে চোখ খুলবে।”
“ঠিক আছে।” আমি চোখ বন্ধ করলাম কিন্তু আমার মন বলছে এটা করা ঠিক হচ্ছে না। আয়নার কথায় এভাবে চোখ বন্ধ করে ফেলাটা বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু আমার কৌতূহলি মন কিংবা লোভ আমাকে আয়নার কথামতো কাজ করতে প্রলুব্ধ করেছে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি ঘন অন্ধকারে ডুবে থাকলাম। ঠিক করে বলতে পারবো না কতোক্ষণ ওভাবে ছিলাম। সম্ভবত পাঁচ-ছয় সেকেন্ডের বেশি হবে না।
“বদলে যাও!”
আমি চোখ বন্ধ করেই আয়নার গমগমে কণ্ঠটা শুনতে পেলাম কিন্তু চোখ খুললাম না।
“এবার চোখ খোলো।”
পরক্ষণেই আয়নার হুকুমে আস্তে করে, অনেকটা ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে তাকালাম।
আহ্! বিস্ময়ের চেয়ে বেশি খুশি হয়ে উঠলাম। নিজের চেহারাটা চিনতে বেগ পেতে হলো একটুখানি। এটা কি আমি? অবশ্যই আমি। তাহলে এরকম দেখাচ্ছে কেন? এরকম মানে, অবশ্যই ভালো কিছু। চোখের নিচে কালচে দাগ নেই! একেবারে তরতাজা একটি মুখ। যেন দশদিন ধরে পরিপূর্ণভাবে ঘুমিয়ে সতেজ হয়ে উঠেছি!
“এবার বিশ্বাস হচ্ছে?”
অবিশ্বাস করার কোনো কারণই নেই। আনমনেই আমি সায় দিয়ে দিলাম। আয়না থেকে চোখ ফেরাতেই ইচ্ছে করছে না। আমার দৃষ্টি যেন
পেরেকের মতো বিদ্ধ হয়ে আছে আয়নায়!
“একটু আগে তুমি আক্ষেপ করেছিলে তোমার নাকটা যদি আরেকটু লম্বা হতো তাহলে ভালো লাগতো দেখতে…তুমি চাইলে আমি সেটাও করে দেখাতে পারি!”
“তুমি আমার নাকও পাল্টে দিতে পারবে?” আয়নার ক্ষমতা দেখার পরও আমার সন্দেহ পুরোপুরি কাটেনি।
আয়না হেসে উঠল। সেই হাসিতে আশ্বস্ত করার ভঙ্গি আছে। আবার চোখ বন্ধ করো!”
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সময়টা পাঁচ সেকেন্ডের বেশি প্রলম্বিত হলো না।
“বদলে যাও!” আয়না তার জাদুমন্ত্র উচ্চারণ করলো।
আমি আয়নার কাছ থেকে হুকুম পাবার জন্য অপেক্ষা করলাম আরেকবার।
“চোখ খুলে দেখো!”
আয়নায় যে মুখাবয়বটি দেখলাম সেটা অনেকটা আমার মতোই কিন্তু আমার নাক আর আগের মতো নেই। যেরকমটি সব সময় কামনা করতাম তেমন লম্বা আর খাড়া হয়ে গেছে! অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য কিন্তু…
“কিন্তু কী?”
আয়না আমার মনের কথা বুঝে গেল।
একটু দ্বিধা ভর করলো আমার মধ্যে। নাকটা আমার দারুণ পছন্দের হলেও আমার বংশগতভাবে পাওয়া প্রশ্বস্ত কপালের সাথে ঠিক মানাচ্ছে না, কেমনজানি বেখাপ্পা লাগছে। ভালো করে নিজের চেহারাটা দেখে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, সদ্য পাওয়া লম্বা নাকটি কপালের সাথে একটু বেমানান।
“ওটাও ঠিক করে দিতে পারি!”
একটু চমকে উঠলাম আমি। “কোনটা?”
“তোমার ঐ প্রশস্ত কপাল!”
আমি নির্বাক। এই আয়না শুধু চেহারাই পাল্টে দিতে পারে না, মনের কথাও বুঝে ফেলে!
“তুমি একদম ঠিক ধরতে পেরেছো, সুন্দর নাকটার সাথে ওটা মানাচ্ছে না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলাম আমি। এক মুহূর্তের জন্যেও আয়না থেকে চোখ সরাতে পারছি না। নার্সিসাস হয়ে উঠেছি যেন।
“তুমি যেমন চাও কপালটা ঠিক তেমন করে দিতে পারি।” আমি আয়নার এ প্রস্তাবে রাজি না-হয়ে পারলাম না।
আবারও চোখ বন্ধ করে চোখ মেলে তাকালাম। অবিশ্বাস্য ঘটনাটি আবারও প্রত্যক্ষ করলাম। আমার প্রশস্ত কপাল চমৎকারভাবেই বদলে গেছে! লম্বা, খাড়া নাকের সাথে একদম মানিয়ে গেছে ওটা। আমার প্রিয় এক অভিনেতার চেহারার সাথে অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে এখন। আমার চেহারার মধ্যে তাহলে ওর চেহারাটা লুকিয়ে ছিল! শুধু থুতনি আর চোয়ালটা একটু ছোটো হলেই হয়ে গেছিল!
“ঠিক। থুতনিটা একটু ছোটো হওয়া দরকার। তাহলে পুরোপুরি মানিয়ে যাবে তোমার প্রিয় নায়কের সাথে!”
“আমার প্রিয় নায়ক!?” আমি বিস্মিত হবার ভান করলাম। আয়নাটি যে মনের কথা বুঝতে পারে এ ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই আমার।
মুচকি হাসলো আয়না। “বদলে যাও!”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম চোখ বন্ধ করার আগেই আমার চোখের সামনে আমার মুখাবয়ব আবারও বদলে গেল। তরল আয়নার পক্ষে এভাবে বদলে দেয়াটা যেন মামুলি কোনো ঘটনা! একটু তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল টলটলে আয়না, তারপর আমার চোয়াল আর আগের মতো রইলো না।
“কি বন্ধু, খুশি?”
“বন্ধু?”
“হ্যাঁ। আমি তোমার বন্ধু।”
আমি নির্বাক হয়ে আয়নায় আমাকে দেখছি। আমার প্রিয় নায়কের সাথে আমার চেহারার এতোটা সাদৃশ্য ভাবাই যায় না। শুধু চোখ দুটো একটু নীলাভ হলে কারো বোঝার ক্ষমতা নেই আয়নার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে।
“চোখ দুটো?”
অন্তর্যামি আয়নার প্রশ্নে আমি মুচকি হাসলাম। যেন মেহমানদারির সময় বিনয় দেখিয়ে বলার মতো : থাক, আর লাগবে না!
“তুমি নিশ্চিত নীলাভ রঙটাই চাইছো?”
এবার সলজ্জ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। নীল চোখ কে না চায়? কতো কবিতা-গান আছে এই নীল চোখ নিয়ে!
“তাহলে তা-ই হবে।”
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমার কালো কুচকুচে চোখ দুটো নীলাভ হয়ে উঠল। “হা-হা-হা।” আমি আমার খুশি আটকে রাখতে ব্যর্থ হলাম। “তুমি কী শুরু করেছো!” কথাটা বড্ড বেশি ন্যাকা শোনালো।
“যখন ভালো কিছু ঘটতে থাকবে তখন প্রশ্ন করবে না, বন্ধু। সন্দেহভরা মন নিয়ে সেটাকে বিচারও করবে না। ভালো তো ভালোই। সেটাকে শর্তহীনভাবে গ্রহণ করতে হয়। এই যেমন এখন তোমার সাথে ঘটছে।”
এ কথার সাথে কী করে ভিন্নমত পোষণ করি? হাজার হলেও আমি একজন যুক্তিবাদি মানুষ।
“তোমার চুলটা কিন্তু ওর চেয়ে একটু বেশি বড়…”
“ওর মানে?”
“তোমার প্রিয় নায়ক! যাকে তুমি ভীষণ পছন্দ করো।”
“ওহ্,” আবারও সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটে।
আয়না আর আমাকে জিজ্ঞেসও করলো না আমি কী চাই। তার অবশ্য কোনো দরকারও নেই। সে তো আমার মনের কথা বুঝতেই পারে। মুহূর্তে আমার চুলগুলো ছোটো হয়ে চমৎকার একটি স্টাইলে রূপান্তরিত হয়ে গেল ঠিক আমার প্রিয় নায়কের মতোই!
আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখছি আয়নার সমানে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রিয় অভিনেতা! কিন্তু আমি কই? পরক্ষণেই এই প্রশ্নটা আমাকে ভৌতিক শূন্যতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরলো।
“এই যে তুমি।” আমাকে আশ্বস্ত করলো আয়না।
আমি একটুও আশ্বস্ত হতে পারলাম না। নিজের ঘরের ছোট্ট বাথরুমের দেড়ফুট বাই দুই ফুটের আয়নার মধ্যে যে প্রতিচ্ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। সেখানে আমি নেই। আমার কিছু নেই!
“কী সব আবোল তাবোল ভাবছো!” আয়না যেন বিরক্ত হলো। “যা হয়েছে দারুণ হয়েছে। তোমার প্রিয় অভিনেতার মতো মুখ বানিয়ে দিলাম…এখন আবার এসব কী ভাবনা মাথায় ঘুরছে?”
“কিন্তু এখানে তো আমি নেই! এই চেহারা তো আমার না!”
“এটাই তোমার চেহারা।”
“না!” আমার প্রতিবাদ দুর্বল শোনালো।
“পাগলামি কোরো না। এটাই তুমি।”
“না!”
“হ্যাঁ!” ধমেকের সুরে বলল আয়না।
আমি ঢোক গিলোম। আমার আগের চেহারাটা কেমন ছিল কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া যে চেহারাটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে সেটার সামনে আমার কল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ল। কেউ বুঝতে পারবে না কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিজের চেহারা হারিয়ে অন্য চেহারার মালিক বনে গেলে কেমন অনুভূতি হয়। খুবই বাজে আর জঘন্য একটা অনুভূতি। তারচেয়েও বড় কথা, এক ধরণের ফাঁকা আর শূন্যতা গ্রাস করে।
আমার এখন মনে হচ্ছে আমি অশরীরি একজন! যে কেবল ভাবতে পারছে কিন্তু তার অস্তিত্ব নেই। নিজের মুখ ছাড়া নিজের অস্তিত্ব চিন্তা করাও যারপরনাই কষ্টের। জন্মান্ধ হলেও এরকম হয় না। সে মনে মনে একটা ছবি এঁকে নেয় হয়তো। কিন্তু আমি সেটাও করতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমি নেই! আমার কোনো অস্তিত্ব নেই…পরিচয় দেবার মতো মুখও নেই!
“খামোখা এসব ভাবছো…এটাই তুমি।”
গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে মিনমিনে গলায় বললাম, “ঠিক আছে, এটাই আমি…”
আয়না চওড়া হাসি দিলো।
“কিন্তু আমি আমার আগের চেহারাটা ফিরে পেতে চাই। অন্যের চেহারা নিয়ে থাকতে চাই না।”
আয়নার চওড়া হাসি নিমেষে উবে গেল।
“অন্যের সুশ্রীমুখ কামনা করা যায় কিন্তু সেই মুখ নিজের মুখে লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় না। এটা খুব কষ্টের। খুবই যন্ত্রণার। এই কয়েক মুহূর্তেই আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।”
“ভীতু কোথাকার!” ভর্ৎসনার সুরে বলল আয়না। “একটু ধৈর্য ধরো…এই চেহারার সাথে চমৎকারভাবেই মানিয়ে নিতে পারবে তুমি নতুন বলে একটু সমস্যা হচ্ছে হয়তো।”
“না। আমি এখনই আমার আগের মুখটা ফেরত চাই। আমার নিজেকে খুবই অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে আয়নার মধ্যে আমি অন্য একজনকে দেখছি। এটা আমার মুখ নয়!
“পাগলামি কোরো না। একটু সময় নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“না। আমি আমার আগের মুখ ফেরত পেতে চাই!” বেশ জোর দিয়েই বললাম।
“বাচ্চাছেলেদের মতো বায়না ধরো না! সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমি বায়না ধরছি?” রেগে গেলাম। “বায়না আমি ধরছি!”
আয়না নির্বিকার রইলো।
“বায়না যদি কেউ ধরে থাকে সেটা তুমি!”
“তাই নাকি?” বাঁকা হাসি হাসলো আয়না।
“হ্যাঁ। তুমি আয়না। তুমি ভুলে যাচ্ছো তোমার কাজ কী!”
“আমার কাজ কী?”
“তোমার কাজ হলো যার যেমন চেহারা তাকে সেভাবেই দেখানো। একদম ঠিকঠিকভাবে দেখানো।”
“অনেক আয়নায় কিন্তু চেহারা বিকৃত দেখায়।”
“হ্যাঁ। ওগুলো বাজে আয়না। ভালো আয়না কখনও চেহারা বিকৃত করে দেখায় না।”
“আর যে আয়না চেহারার খামতিগুলো দূর করে দিয়ে আরও ভালো করে দেখায়…কারোর মনের গহীনে থাকা গোপন আক্ষেপ দূর করে দেয় তাকে কী বলবে?”
আমি গভীর করে দম নিয়ে বললাম, “যার যেটা কাজ তার সেটাই করাই ভালো। তোমার কাজ যে চেহারা যেরকম সেটাকে ঠিক সেরকম প্রতিফলিত করা।”
“আয়নার কাজ কি সেটা তুমি ঠিক করে দিতে চাইছো?”
“না। আমি ঠিক করে দিতে চাইছি না। এটা আগে থেকেই ঠিক করে দেয়া আছে। আয়নার জন্ম থেকেই এটা হয়ে আসছে। এটাই নিয়ম।”
“কিন্তু আমি সেই নিয়ম পাল্টে দিতে চাই। আমার দিকে যারা আক্ষেপ নিয়ে তাকায় তাদের আক্ষেপ দূর করে দিতে চাই। সাধারণ মুখগুলো বদলে দিতে চাই অসাধারণ মুখে । আমার এই ভালো চাওয়াটাকে তুমি কেন দোষ দিচ্ছো?”
আমি একটু চুপ করে ভেবে নিলাম। “আচ্ছা, তুমি কেন এটা করতে চাইছো? এতে তোমার কী লাভ?”
“লাভ? এসব কী বলছো? আমি কোনো লাভের চিন্তা থেকে এটা করছি না। যারা আমার সামনে এসে দাঁড়ায় তারা অবশ্যই আমার বন্ধু। আর বন্ধুর জন্য ভালো কিছু চাইতেই পারি।”
মুচকি হাসি দিলাম আমি। “যদি তুমি ভালো কিছু করতে চাও তাহলে যাকে যেরকম দেখায় তাকে সেরকমই দেখাও। পরিস্কার…ঝকঝকে…কিন্তু কোনোভাবেই অন্যরকম চেহারায় নয়…অন্য কোনো অবয়বেও নয়।”
“আমার কাজ কি তুমি ঠিক করে দেবে?”
“হ্যাঁ!” বেশ জোরেই বললাম। “আমিই তো ঠিক করে দেবো। কারণ আমি তোমাকে আমার প্রয়োজনে ব্যবহার করছি…টাকা দিয়ে কিনে এনেছি…আমি ঠিক করে দেবো না তো কে দেবে?”
“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি একজন স্বৈরাচার।”
“আর তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি অসম্ভব কিছু বায়না ধরে বসে থাকা একজন গোঁয়ার!” কথাটা বলেই রেগেমেগে বেসিনে থুতু ফেললাম। “নিজের গণ্ডির মধ্যে থাকো। বুঝতে পেরেছো?!” মনের অজান্তেই হাতের তর্জনি উঁচিয়ে বলে ফেললাম শেষ কথাটি।
“তুমি খুব বিশ্রিভাবে রেগে রেগে কথা বলছো! তোমাকে দেখতে জঘন্য লাগছে!”
আমি বিস্ময়ের সাথে দেখতে পেলাম আয়নায় একটি কুৎসিত-কদাকার মুখ ভেসে উঠেছে! এমন জঘন্য মুখ আমি জীবনেও দেখিনি। এটা আমি!?
“হ্যাঁ। এটাই তুমি!”
আয়নার মুখটা আরও ভয়াবহ রকমের কদর্য হয়ে উঠতে শুরু করলো। যেন মানুষের চেহারা ঠেলে কোনো ভয়ালদর্শনের দানব বেরিয়ে আসছে!
“বন্ধ করো! বন্ধ করো এই খেলা!”
হা-হা-হা করে অট্টহাসি শোনা গেল কেবল।
আয়নার মুখটা জঘন্য থেকে আরও জঘন্য হয়ে উঠছে! আমি আমার মুখ সরিয়ে ফেললাম। এই দৃশ্য দেখা যায় না।
“কাপুরুষের মতো মুখ সরিয়ে রেখেছো কেন?”
আমি দ্রুত ঘরের আশেপাশে তাকালাম।
“অ্যাই!” ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল আয়না। “এসব কী ভাবছো!”
আমি বেসিনের উপরে রাখা প্রায় নতুন একটি শেভিং ফোমের ক্যান হাতে তুলে নিলাম হাতে।
“না!”
কোনো কথা না বলে দু-পা পিছিয়ে ক্যানটা সজোরে ছুঁড়ে মারলাম আয়নার দিকে। ঝনঝন শব্দে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ল অসহ্য আর অযাচিত আয়নাটি। দেরি না করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
“কিরে, কী হয়েছে?” আমার মা অন্য ঘর থেকে দৌড়ে এসে ভয়ার্ত মুখে জিজ্ঞেস করলেন।
“কিছু না। বাথরুমের আয়নাটা ভেঙে গেছে।”
“আয়না ভেঙে গেছে? কীভাবে?”
“আমি ভেঙে ফেলেছি।”
“কী!”
“আয়নাটা নষ্ট হয়ে গেছে। চেহারা খুব বাজে দেখায়।”
মা আমার দিকে ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলেন। “তোর চেহারা তো এমনিতেই বাজে দেখাচ্ছে।”
আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। আমার চেহারা বাজে দেখাচ্ছে মানে? ঐ বদমাশ আয়না কি আমার চেহারাটা সারাজীবনের জন্য সত্যি সত্যি বদলে দিলো নাকি?
“কে-কেমন দে-দেখাচ্ছে?” ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললাম। কণ্ঠে যেন কোনো শক্তিই নেই।
“চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে…গাল বসে গেছে…মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। রাতে ভালো ঘুম হয়নি?”
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। যাক, আমি তাহলে আমিই আছি! বাজে ঘুমের কারণে একটু বিপর্যস্ত, ক্লান্ত আর রোগা দেখাচ্ছে।
“ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে,” মলিন হাসি দিয়ে বললাম।
“ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস। ঘুমাস। রাত জাগিস না।” মায়ের উপদেশ। “যা, নাস্তা খেয়ে নে। অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
মা চলে যাবার পরও আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ঘরে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলাম। জানি এই মুখটা আমার, অন্য কারোর নয়। একেবারেই আমার। আর আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমি এই মুখটাই দেখতে চাইবো সব সময়!