1 of 2

আয়নার ইতিহাস

আয়নার ইতিহাস

বেনারসে বেড়াতে এসেছি। সঙ্গে আছেন মা ও ভাই-বোনেরা।

অগস্ত্য কুণ্ডের সরু একটা গলির ভিতরে একখানা মাঝারি আকারের বাড়িতে আমাদের বাসা। বাড়িখানা তেতলা এবং সেকেলে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ির মতো এরও নীচের তলার সঙ্গে সূর্যালোকের সম্পর্ক নেই বিন্দুমাত্র। তাই একতলার ঘরগুলো আমরা ব্যবহার করতুম না।

আমাদের বেনারসে থাকার কথা মাস-তিনেক। দু-চার দিন যেতে-না-যেতেই এখানকার জনাকয়েক লোকের সঙ্গে আলাপ হল। তাঁরা প্রায়ই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। কাজেই একখানা বাইরের ঘর বা বৈঠকখানার দরকার হল। একদিন সকালে নীচে নেমে দেখলুম, নীচের কোনো ঘর কাজে লাগাতে পারা যায় কিনা। সদর দরজার পাশেই একখানা বড়ো ঘর পছন্দ হল। যদিও এ ঘরে চারটে জানালা ছিল, তবুও ঘরের ভিতরে বিরাজ করছিল প্রায় সন্ধ্যার অন্ধকার। কিন্তু বেনারসের বাসিন্দাদের অন্ধকার সম্বন্ধে বোধ হয় কোনো অভিযোগ নেই, অতএব এই ঘরখানাকেই বৈঠকখানার উপযোগী করবার চেষ্টায় নিযুক্ত হলুম।

ঘরের জানালাগুলো খুলে দিয়ে দেখলুম, মাঝখানে রয়েছে একখানা চৌকি এবং পূর্ব দিকে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করানো রয়েছে প্রকাণ্ড একখানা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি—নিশ্চয় বাড়িওয়ালারই সম্পত্তি।

কিন্তু ছবিখানা ছিল পিছন ফিরানো। আমি তাকে সামনে ফেরাতে গিয়ে দেখলুম—না, এখানা তো ছবি নয়, দামি সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো মস্ত বড়ো এক আয়না—লম্বায় পাঁচ হাত ও চওড়ায় তিন হাত। ফ্রেমের সোনালি রং নানা স্থানে চটে গিয়েছে দেখে বুঝলুম, আয়নাখানার বয়স অল্প নয়।

এ-রকম মূল্যবান আয়না এভাবে পরিত্যক্ত হয়েছে কেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই ভাবছি, এমন সময় আমার শখের কুকুর ঝুমি সেখানে এসে হাজির হল।

আদর করে তাকে ডাকলুম, ‘আয় রে ঝুমি আয়।’

ঝুমি ল্যাজ নেড়ে মনের আনন্দ জানালে, কিন্তু পরমুহূর্তে আয়নার দিকে তাকিয়ে তার কান দুটো হঠাৎ খাড়া হয়ে উঠল এবং ল্যাজটা কুঁকড়ে ঢুকে গেল একেবারে পেটের তলায়।

ব্যাপার কী? ঝুমি কি আয়নার ভিতর তার নিজের চেহারা দেখে ভয় পেয়েছে? একটু অবাক হলুম! কারণ আমি বরাবরই লক্ষ করে দেখেছি কুকুর-বিড়ালরা আরশিতে নিজেদের চেহারা দেখে বিশেষ বিস্মিত হয় না—অনেক সময়ে গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। ঝুমি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে সরে পড়ল। তারপর এ ঘরে সে আর ডাকলেও আসত না। এমনকী এ ঘরের পাশ দিয়ে আনাগোনা করবার সময়েও গরর গরর করে গর্জন করত। তার এ ব্যবহারের কারণ বোঝা গেল না।

দুই

দিন তিনেক পরের কথা।

দোতলায় বসে মায়ের সঙ্গে গল্প করছি, হঠাৎ নীচ থেকে এল বিমলের পরিত্রাহি চিৎকার। বিমল হচ্ছে আমার ছোটো ভাই। বয়স সাত বৎসর।

দ্রুতপদে নীচে নেমে গেলুম। চিৎকার আসছে বাইরের ঘর থেকে।

সেখানে গিয়ে দেখি, আয়নার সামনে জড়সড় হয়ে বসে ভয়ার্ত স্বরে বিমল দুই চক্ষু মুদে চিৎকারের পর চিৎকার করছে।

—কী রে বিমল, কী হয়েছে রে?

—জুজু দাদা, জুজু! আয়নার ভেতরে জুজু।

—কী যা তা বলছিস? কই, আয়নার ভেতরে কেউ তো নেই—খালি তুই আর আমি ছাড়া।

—না দাদা, একটা ভয়ানক জুজু আয়নার ভেতর থেকে কটমট করে আমার পানে তাকিয়ে ছিল!

তার ছেলেমানুষি ভয়ের কথা শুনে আমি হো-হো করে হেসে উঠলুম।

কিন্তু আমার হাসি শুনেও বিমল কিছুমাত্র আশ্বস্ত হল না। দারুণ আতঙ্কে আয়নার দিকে তাকাতে তাকাতে পায়ে পায়ে পিছিয়ে পড়ে ঘর থেকে সে পালিয়ে গেল।

ব্যাপার কী? অবলা পশু ঝুমি, অবোধ শিশু বিমল—এ ঘরে ঢুকে দু-জনেই একরকম ব্যবহার করলে কেন? দু-জনেই ভয় পেলে ওই আয়নাখানা দেখে? আশ্চর্য! একখানা জীর্ণ, ত্যক্ত, সেকেলে সাধারণ আরশি—তার অপরিষ্কার কাচের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কেবল এই ঘরেরই খানিকটা অংশ, এর মধ্যে আবার ভীতির কী থাকতে পারে? তবে কি ওর পিছনে কিছু লুকিয়ে আছে? সাপ-টাপ বা অন্য কোনোরকম জীব!

সাবধানে এগিয়ে হেলিয়ে দাঁড় করানো সেই আয়নার পিছনের ফাঁকে উঁকি মারলুম! কিছুই নেই। আরও ভালো করে দেখবার জন্য দুই হাতে আয়নাখানাকে ধরে টেনে সরাতে গেলুম। কিন্তু পারলুম না—বিষম ভারী! অথচ সেদিন এখানাকে আমি নিজের হাতেই ফিরিয়ে খুব সহজেই সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলুম! হঠাৎ এখানাকে জগদ্দল পাথরের মতন ভারী বলে মনে হচ্ছে কেন?…আরও খানিকক্ষণ প্রাণপণে টানাটানির পর সে ব্যর্থ চেষ্টা ছেড়ে দিলুম।…এ আবার কী রহস্য?

তিন

কয়েকদিন কেটে গেল।

সে-দিন দুপুরে দু-জন বন্ধু এসেছিলেন। বাইরের ঘরে বসে খানিকক্ষণ গল্প করে তাঁরা চলে গেলেন। আমি একলাটি বসে বসে খবরের কাগজ পড়তে লাগলুম।

দুপুর বেলায় এ ঘরটায় খানিকক্ষণের জন্য কিছু আলো আসে।

পড়তে পড়তে প্রাণের ভিতরে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলুম। মনে হল, আমি যেন এ ঘরে আর একলা নেই, কে যেন অপলক চোখে আমার পানে তাকিয়ে আছে!

মুখ তুলে অবশ্য কাউকে দেখতে পেলুম না। দেখতে পাবার কথাও নয়। তবু কিন্তু মনের ভিতর থেকে সেই অদ্ভুত ভাবটা তাড়াতে পারলুম না—সেখানে আমার পাশে অদৃশ্য আর একজনের উপস্থিতি অনুভব করতে লাগলুম বারংবার।

আবার মুখ তুলতেই চোখ পড়ে গেল সেই পুরাতন আয়নার দিকে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল।

আয়নার মধ্যে সবিস্ময়ে দেখলুম, ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ভীষণ এক মূর্তি।

হ্যাঁ, সে মূর্তিকে ভীষণ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না! তার চোখ দুটো কোটর থেকে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তার জিভখানাও ঠোঁটের ভিতর থেকে বেরিয়ে ঝুলে পড়েছে, আর তার গলা জুড়ে রয়েছে একটা কটকটে লাল দাগ।

আমি একবার একটা গলায় দড়ি দিয়ে মরা লোক দেখেছিলুম। এরও চেহারা ঠিক সেই রকম।

কয়েক মুহূর্ত বসে রইলুম আচ্ছন্নের মতো। তারপর ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে তাকালুম। কিন্তু কই আর কেউ তো এখানে নেই!

আবার আয়নার দিকে চোখ গেল। তার মধ্যেও আমি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তির চিহ্ন নেই।

ভূত-টুত মানি না, আর এমন অসম্ভবও কখনো সম্ভব হয় না, কিন্তু আশ্চর্য আমার চোখের ভ্রম!

নিজের মনেই হেসে উঠলুম। এ হচ্ছে শিবের কাশী, আর শাস্ত্র বলে শিব হচ্ছেন ভূতনাথ। তবে কি কোনো শিবানুচরই সময় কাটাবার জন্যে আমার সঙ্গে কিঞ্চিৎ মশকরা করবার ফিকিরে আছেন?

অন্য লোক হলে হয়তো তাই-ই বুঝত। কিন্তু আমি হচ্ছি অবিশ্বাসী আধুনিক বাঙালি, মেডিকেল কলেজে দস্তুরমতো মড়ার পর মড়া কেটে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি— আমার কাছে শাস্ত্রীয় কুসংস্কারের কোনো ধাপ্পাবাজিই খাটবে না। অ্যানাটমির কোনো কেতাবেই ভৌতিক দেহের বর্ণনা নেই—ভূত-পেতনি বাস করে কেবল শিশুদের উপকথায় আর অশিক্ষিত নির্বোধের কল্পনাজগতে।

কিন্তু মনের ভিতরটা কেমন করতে লাগল। এই আবছায়া-মাখা স্যাঁৎসেঁতে ঘরের হাওয়া যেন বিষাক্ত। এ ঘরে কেউ নাই বটে, কিন্তু তবু যেন সন্দেহ হয়, আমি ছাড়া আর একজন কেউ এখানে নিশ্চয়ই আছে! তার নিষ্পলক দৃষ্টি এসে বিঁধছে আমার সর্বাঙ্গেই!

খবরের কাগজ ফেলে উপরে গেলুম। বিমলকে ডেকে প্রশ্ন করে বুঝলুম, আয়নার ভিতর সে যাকে দেখেছিল তারও চেহারা হচ্ছে আজকের আমার দেখা লোকটার মতোই!

গভীর বিস্ময়ে যেন হতভম্ব হয়ে গেলুম। আমাদের দু-জনেরই এমন একরকম চোখের ভ্রম হল কেন? কুকুর ঝুমিই বা ও-ঘরে ঢুকতে চায় না কেন? সে তো শাস্ত্রীয় ভূতনাথের নাম শোনেনি বা উপকথায় উপদেবতার গল্পও পড়েনি, তবে তার ভয় পাবার কারণ কী?

চার

গঙ্গার ধারে ভূষণবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ভূষণবাবু হচ্ছেন এখানকার একজন সবজান্তা লোক—বেনারসের নতুন ও পুরোনো সব খবর তাঁর নখদর্পণে।

আজ সকালে আমার বাসায় ছিল ভূষণবাবুর চায়ের নিমন্ত্রণ।

যথাসময়ে তিনি এলেন কিন্তু বৈঠকখানায় ঢুকে আয়নাখানা দেখেই চমকে উঠলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘শিউপ্রসাদবাবুর আয়নাখানা এখনও এ বাড়িতেই আছে?’

আমি জিজ্ঞাসা করলুম—‘শিউপ্রসাদবাবু কে?’

—কাশীর একজন মহাজন। আগে এ বাড়িখানা ছিল তাঁরই।

—তিনি এখন কোথায়?

—দশ বছর হল মারা গিয়েছেন। তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি।

—কীরকম?

—রাগের মাথায় এক চাকরকে তিনি এমন প্রহার করেন যে, বেচারা মারা পড়ে। শিউপ্রসাদবাবুর নামে ওয়ারেন্ট বেরোয়। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে এসে দেখে এই ঘরের কড়িকাঠে তাঁর মৃতদেহ ঝুলছে। তিনি গলায় দড়ি দিয়েছিলেন।

আমার বুক কেঁপে উঠল! আয়নায় দেখা সেই মূর্তিটাকে আবার মনে পড়ল। সেই ঠিকরে পড়া চোখ, সেই বেরিয়ে পড়া লকলকে জিভ, সেই গলা বেড়ে টকটকে লাল দাগ। রুদ্ধশ্বাসে বললুম, ‘তারপর?’

—তারপর এ বাড়িখানা বিক্রি হয়ে যায়। নতুন মালিক এখানে এসে কিন্তু বেশিদিন বাস করতে পারেনি।

—কেন?

—ওই আয়নাখানার ভয়ে।

—তার মানে?

—আয়নাখানার ভারী দুর্নাম আছে। নানান লোকে নানান কথা বলে। সেসব আজগুবি কথা আমি বিশ্বাস করি না, আপনাকে বলতে চাই না।

—আয়নার যদি এমন দুর্নাম, তবে ওখানা ভেঙে ফেললেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়!

—নতুন মালিককে সে পরামর্শও কেউ কেউ দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর সাহসে কুলোয়নি। যে অভিশাপ আয়নার ভেতরে বন্ধ আছে, ওখানাকে ভেঙে তাকে বাইরে আনতে তিনি ভরসা পাননি।

—তাহলে আপনি বলতে চান এটা হচ্ছে ভূতুড়ে আয়না?

—আমি বলি না লোকে বলে।

একলাফে আমি দাঁড়িয়ে উঠলুম। ঘরের কোণে ছিল একটা জানালা ভাঙা লোহার গরাদ, টপ করে সেটা তুলে নিয়ে আয়নার ওপরে করলুম সজোরে এক আঘাত! প্রকাণ্ড কাচের ওপর অংশ ঝন ঝন করে ভেঙে পড়ল! আবার গরাদ তুললুম এবং পরমুহূর্তেই দেখলুম, আয়নার নীচের অংশে ফুটে উঠেছে আগুন-ভরা দুটো চোখ! কী ক্রুদ্ধ, কী হিংস্র সেই দৃষ্টি! মুখ নেই, দেহ নেই, খালি দুটো জ্বলন্ত, ক্ষুধিত চোখ! এও কি আমার চোখের ভ্রম!

আবার আঘাত করলুম—কাচের বাকি অংশও ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল।

ভূষণবাবু কিছু দেখেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু তিনি কাঁপতে কাঁপতে চৌকির উপরে ধপাস করে বসে পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *