আয়নামহল – ৯

নয়

তুমি কী মিষ্টি দেখতে গো মাসি! তোমার মতো সুন্দর আমি আর একটাও দেখিনি।

মিমলির পাকা পাকা কথায় খিলখিল হেসে উঠল কৃত্তিকা, মাসিকে তুই আজ এই প্রথম দেখলি নাকি?

হঠাৎ কথাটা বলে ফেলে মিমলি লজ্জা পেয়েছে খুব। চোখের পাতা কাঁপিয়ে বলল, কী করব, বলতে ইচ্ছে হল যে!

এখন? এই খাবার টেবিলে বসে? কৃত্তিকার হাসি থামছে না। উচ্ছল স্বরে বলল, তোর দেখছি আরও একটা ভক্ত বেড়ে গেল রে, দিদি!

রোহিণীর মুখোমুখি বসেছে বিভাস। ঠোঁটে তার পরিমিত হাসি। ফিশফ্রাইতে কামড় দিয়ে বলল, আমিও তো দিদির অ্যাডমায়ারার। এই দুনিয়ায় সুন্দরের অনুরাগী কে নয়!

রোহিণী চোখ তুলেছে। আলগা ধমক দিয়ে বলল, আহ্ বিভাস, তুমিও এই আধবুড়িটাকে নিয়ে মজাক শুরু করলে!

আপনি আধবুড়ি! এখনও স্বচ্ছন্দে আপনাকে কৃত্তিকার ছোট বোন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

পলকের জন্য কৃত্তিকার দৃষ্টি চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল বিভাসের মুখে। পরক্ষণে স্বাভাবিক উচ্ছ্বাসে ফিরিয়েছে নিজেকে। হালকাভাবে বলল, বাপ মেয়েতে মিলে আমার দিদির রূপ গিললেই চলবে? হোস্টের ডিউটিটাও একটু পালন করো। ভাল করে খেতে বলো দিদিকে।

সঙ্গে সঙ্গে দম দেওয়া পুতুলের মতো বিভাস বলে উঠেছে, হ্যাঁ দিদি, আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না, খালি খুঁটছেন। কৃত্তিকা আজ নিজের হাতে আপনার জন্য কত কী বানাল…

না-চাইতেও একটা গর্বিত স্বর এসে গেল কৃত্তিকার গলায়, আমি আজ সাবিত্রীকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দিইনি।… দ্যাখ দিদি, সব ক’টা তোর ফেভারিট আইটেম। মিষ্টি মিষ্টি পোলাও, দইমাছ, মটন কষা…

দেখছি তো। রোহিণী ঠোঁট টিপে হাসল, দেখেই লোভ হচ্ছে।

তো ঠিক করে খা। শুধু জিভে ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে ছেড়ে দিচ্ছিস কেন?

আজকাল আর বেশি রিচ রান্না হজম হয় না রে, ঝুনি। মা’র সঙ্গে থেকে থেকে এক ধরনের অভ্যেস হয়ে গেছে। দেখেছিসই তো তুই, আমরা ঝালমশলা কত কম খাই!

মনে মনে আহত হল কৃত্তিকা। এমনিই তো কত সাধ্যসাধনা করে আজ আনা গেছে দিদিকে, এ-কাজ, সে-কাজের অছিলায় নেমন্তন্নটা কায়দা করে এড়িয়ে যাচ্ছিল। সোনামাটি যাওয়ার সময় হয়, কিন্তু চেতলা থেকে তিন কিলোমিটার পথ আসতে যত রাজ্যের বাহানা! এসেও না-ছুঁই, না-ছুঁই ন্যাকামো! বোনের আন্তরিকতা আর পরিশ্রমকে মূল্যহীন করে দিয়ে দিদি কি মজা পাচ্ছে?

গলা সহজ রেখেই কৃত্তিকা বলল, শরীর যতটুকু চায়, ততটুকুই খা মাকে নয় ফোনে বলব, তোমাদের ঢেপসির যত্নআত্তি তোমার বড় মেয়ের পছন্দ হয়নি।

মিথ্যে নালিশ করবি? রোহিণী হেসে ফেলল, তুই আর বদলালি না রে, ঝুনি। একই রকম পাগলামি করিস।

হ্যাঁ, পৃথিবীতে একমাত্র আমিই তো পাগল।

মাংসের টুকরো মুখে তুলতে গিয়েও থমকেছে বিভাস। একবার রেহিণীকে দেখছে, একবার কৃত্তিকাকে। সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে বলল, তোমরা কি মক ফাইট করছ? নাকি সিরিয়াস?

না না, এটা আমাদের খেলা। রোহিণী হাসতে হাসতেই এক চামচ পোলাও তুলল পাতে। ভুরু বেঁকিয়ে বোনকে বলল, হ্যাঁরে ঝুনি, এখন রান্নাবান্নাকেই জীবনের মোক্ষ বলে ধরে নিলি নাকি? এক সময়ে চাকরি চাকরি করে অত খেপে উঠেছিলি, সেই চাকরি ছেড়ে এখন ঘরে বসে আছিস?

দিদি কি প্রসঙ্গ ঘোরাচ্ছে? নাকি চাকরির কথাটা স্মরণ করিয়ে একটু ঠুকে নিল? কিন্তু কৃত্তিকা আজ একদমই চটবে না। তার সামান্যতম বিরক্তিকেও দিদি নিজের জয় বলে ভেবে নিতে পারে।

মুচকি হেসে বলল, মিমলি বড্ড বায়না ধরেছিল রে। ছোটতে সাবিত্রীর কাছে থাকত, তখন ঝামেলা করেনি, যেই না স্কুলে যাওয়া শুরু হল, ওমনি ব্যস…। তাও ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। আস্তে আস্তে দেখি আমাদের মিমলিরানি খুব জিদ্দি হয়ে যাচ্ছে। তাই ডিসিশনটা নিয়েই ফেললাম। চুলোয় যাক চাকরি, আমার এখন ঘর-সংসার আগে। সত্যি বলতে কী, আমাদের সংসারে আমার চাকরির তো দরকারও নেই। বিভাস যা ইনকাম করছে, তাতে তো দিব্যি চলে যায়। এই তো দ্যাখ না, দুম করে একটা সাড়ে ষোলোশো স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট কিনে ফেলল।

বিভাস বলল, লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। এমন চমৎকার পজিশন, পাড়াটাও নতুন… তিনতলার ওপর দক্ষিণ খোলা… লিফট্, বড় বড় দু’খানা ব্যালকনি…

রোহিণী ঘাড় ঘুরিয়ে আর একবার অতিকায় লিভিংরুমটাকে দেখল। তারিফ করার সুরে বলল, সুন্দর হয়েছে। খুব বড় ফ্ল্যাট।

আমার একটু হাত পা ছড়িয়ে থাকাই পছন্দ রে, দিদি। তাও তো এটাতে টেরেস নেই। আমি বিভাসকে বলে দিয়েছি, পাঁচ বছর পরে আমরা কিন্তু একটা টেরেসওয়ালা ফ্ল্যাট কিনব, হ্যাঁ। সেখানে মাটি ফেলে, ঘাস লাগিয়ে, একটা লন বানাব।

বিভাস সংকুচিতভাবে বলল, অনেক টাকার ধাক্কা। পারব কিনা কে জানে!

কৃত্তিকা ধমক দিয়ে বলল, খুব পারবে। পারতেই হবে। জেদ না-থাকলে মানুষের ইচ্ছাপূরণ হয় নাকি?

বলেই তেরচা চোখে রোহিণীকে দেখল কৃত্তিকা। দিদির কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি? মুখটা কি একটুও শুকনো লাগে না? উঁহু, বোঝা দায়। মুখে একই হাসি ধরে রেখেছে। হাসিটা বাড়ছেও না, কমছেও না। পাকা অভিনেত্রীর মতো মনের ভাব লুকিয়ে রাখতে পারে দিদি। দিব্যদাকে নিয়ে তার সঙ্গে লড়তে গিয়ে গোহারান হেরে যখন কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছিল, তখনও তো কোনও তাপ-উত্তাপ দেখায়নি।

কথাটা মনে হতেই কৃত্তিকা খানিকটা চনমন বোধ করল। একটা প্লেট নিয়ে বসে পড়ল টেবিলে। বহুমূল্য বিদেশি ডিনার সেটখানা বের করেছে আজ, সুদৃশ্য চিনামাটির পাত্র থেকে, পোলাও নয়, ভাত নিল অল্প। তার ডায়েটিং চার্টে রাত্তিরে ভাত নেই, তবুও। সামান্য দইমাছের কাই দিয়ে ভাতটা মাখতে মাখতে বলল, কাল সোনামাটি থেকে তুই কখন ফিরলি রে?

রোহিণী এক ঢোক জল খেল, প্রায় সাড়ে দশটা। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল।

অনেকটা রাস্তা, তাই না?

দু’ঘণ্টা-সওয়া দু’ঘণ্টা মতো লাগে। পথে বম্বে রোডে জ্যাম ছিল… তুই যাসনি সুবর্ণলতায়?

আমি গিয়ে কী করব? আমাকে কোন কাজে লাগবে?

সে কী? দেখতেও যাসনি?

বিভাস গেছে এক-আধবার। আমার অত সময় নেই।… স্পৃহাও নেই। দিব্যদাদের বাড়ির ঝিয়ের মেয়েটা ওখানে রাজত্ব করছে… ওই খরখরিটাকে দেখলেই আমার গা জ্বালা করে।

কেন রে? কল্পনা তো বেশ ভালই চালাচ্ছে।

চালাক না, মোচ্ছব করুক।… জানিস, মেয়েটার ওপর সব ছেড়ে দেওয়ার জন্য বড়মাসি কতটা দুঃখ পেয়েছে? বড়মাসি সেখানে যায় না পর্যন্ত। কৃত্তিকা বেছে বেছে ছোট্ট একটা মাংসের টুকরো তুলল হাতায়। চোখে বিচিত্র ভঙ্গি করে বলল, অশান্তি হবে বলে চুপচাপ থাকি। তবে

বলতে গেলে তো অনেক কথা বলতে হয়।

কী কথা?

মাকে তো দিল্লিতে আমি বলেওছি। মা তোকে বলেছে কি না জানি না।

কী ব্যাপারে বল তো? দিদার টাকা?

হ্যাঁ। সুবর্ণলতা তো তৈরিই হয়েছে আমাদের দিদার টাকায়। দিদা যেমন বড়মাসির মা, আমাদের মায়েরও তো মা। তিনি তাঁর বড় মেয়েকে সম্পত্তিটা কিছু একটা করার জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন। তার মানে তো এই নয়, বেচে আট-দশ লাখ যা পাওয়া গেছে সব দিব্যদার হয়ে গেল? আরও দুঃখের কথা কী জানিস? কত টাকা পাওয়া গেছে, কেউ নাকি জানে না! বড়মাসিও নয়! জিজ্ঞেস করলেই বড়মাসি হাত উলটে দেয়। বেচাবেচির পর্বটা দিব্যদা পুরো নিজের কন্ট্রোলে রেখেছিল। তোকে আমাকেও কি বলেছে কিছু? অন্তত মাকে তো একবার জানিয়ে দিতে পারত।

বিভাসের আহার শেষ, এখন মিমলিকে খাওয়াচ্ছে। টেবিল ম্যানারস মেনে। আলগোছে কথা ভাসাল, ছাড়ো না কৃত্তিকা। দিব্যদা তো একটা ভাল কাজেই টাকাটা লাগিয়েছে।

তুমি চুপ করো। এটা আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার।… ভাল কাজ হোক, কি খারাপ, ওই টাকায় আমাদেরও শেয়ার আছে। এবং সেই কারণে, ওই প্রতিষ্ঠানেও। আমাদের বাদ দিয়ে দিব্যদা একা একা সুবর্ণলতা খোলে কোন রাইটে?

রোহিণীর হাত থেমে গেছে। ভুরুর মাঝে একটা দুটো রেখা ফুটে ও যেন মিলিয়ে গেল। দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু সুবর্ণলতা স্টার্ট হওয়ার পরেও তো দিব্যদার সঙ্গে মা’র বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। কই, মা তো দিব্যদাকে এ নিয়ে কিছু বলেনি!

লজ্জায় বলেনি। বোনপোর ওপর স্নেহবশত বলেনি। বোনপোর স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই বলে বলেনি। কৃত্তিকা চোখের পাতা কাঁপতে দিল না, তা ছাড়া কৃতজ্ঞতা ব্যাপারটাও বোধহয় মা’র মাথায় ঘোরে। এককালে ওরা আমাদের সাহায্য করেছে। অবশ্য…

কৃত্তিকার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, বিনিময়ে দিব্যদাও নিয়েছে অনেক। কোনওক্রমে শব্দগুলো গিলে নিয়ে কৃত্তিকা বলল, অবশ্য দিব্যদা যে তার জন্য টাকাটা আত্মসাৎ করে নেবে, আর সেই টাকায় নাম কিনে দুনিয়ার লোকের বাহবা কুড়োবে… আরও বেশি খ্যাতিমান হবে… এটা কেই বা কল্পনা করতে পেরেছে!

রোহিণীর চোখে তবুও যেন একটা হাসি খেলা করছে। এঁটো হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই দেখছি দিব্যদার একদম অ্যান্টি হয়ে গেছিস? কৃত্তিকা গোমড়া হল, আমি কারও পক্ষেও নই, বিপক্ষেও নই। যেটা উচিত কথা, সেটা আমি বলবই।

দিব্যদাকে বলেছিস কখনও?

বলব। দিন আসুক। সময় আসুক। কৃত্তিকা একবার মিমলিকে দেখে নিল। অনেকক্ষণ পর হাসছে মিটিমিটি। হাসতে হাসতে বলল, উঠে পড়, উঠে পড়, হাতটাত ধুয়ে নে। … সাবিত্রী এসো, এবার খাবার টাবারগুলো তোলো। মাংসটা বেশি ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে, ফ্রিজে ঢোকানোর আগে একবার গরম করে নিয়ো।

মাঝবয়সি সাবিত্রী টেবিল সাফ করছে। মিমলি রোহিণীকে টানতে টানতে নিয়ে গেল বেসিনে, সেখান থেকে আধুনিক কেতায় সাজানো বসার জায়গাটায়। মেয়েটা মাসির মধ্যে কী মধু পেয়েছে কে জানে, গায়ে গায়ে লেগে থাকছে! বিভাসও গিয়ে বসেছে সোফায়, টুকটাক কথা চলছে রূপসি শ্যালিকার সঙ্গে। মিমলি মাসির গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়ল, মাসি তাকে চুমু খাচ্ছে।

সাবিত্রীকে খাবার দিতে কৃত্তিকা রান্নাঘরে ঢুকেছিল, বেরিয়ে কয়েক পল দেখল দৃশ্যটা। ঠোঁট চেপে হাসল একটু। কেন যে হাসল? শোওয়ার ঘরে গিয়ে মশলার কৌটোটা নিয়ে এসেছে। রোহিণীর সামনে ধরে বলল, হাত পাত।

কী ওটা? মৌরি?

উহুঁ, জোয়ান। সঙ্গে বিটনুন লেবু…। নে, রিচ খানা হজম হয়ে যাবে।

মিমলি বায়না জুড়ল, আমাকেও দাও।

মেয়ের হাতেও দু’-চার দানা জোয়ান দিল কৃত্তিকা, ব্যস, আর নয়। সন্ধে থেকে প্রচুর দৌড়ঝাঁপ হয়েছে, সোজা গিয়ে শুয়ে পড়।

আর একটু থাকি না, মা। যতক্ষণ মাসি আছে।

আবার অকারণে চপল হল কৃত্তিকা, ঠিক হ্যায়। এবার যখন দিল্লি যাব, তোকে মাসির কাছেই রেখে আসব। খুশি?

হু^উউ।

তোর দৌড় জানা আছে। আগেরবারই তো দিদা বলেছিল, মিমুসোনা আমার কাছে থাক… ওমনি তো ভ্যাঁ ভ্যাঁ কান্না জুড়ে দিয়েছিলি।

আহা, ও তখন কতটুকু! ফস করে কথার মাঝে নাক গলিয়েছে বিভাস, সবে তো সাড়ে তিন কি চার।

বিভাসের মনে করিয়ে দেওয়াটা মোটেই পছন্দ হল না কৃত্তিকার। সে যে প্রায় তিন বছর মা’র কাছে যায়নি, চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে দেওয়া কি একান্তই জরুরি? তবে ছদ্ম বিস্ময়ের ছটার আড়ালে লুকিয়েও ফেলল অসন্তোষটা। চোখ কপালে তুলে বলল, এমা যাহ্, আমি এত দিন দিল্লি যাইনি? ইস, এবার তো তা হলে পুজোয় যেতেই হয়। কী বলিস, দিদি?

আসতেই পারিস। মা খুশি হবে।

এবার কিন্তু মাকে আমি কলকাতায় নিয়ে আসব। আগে থাকতে বলে রাখলাম। কত বছর ধরে মা ওখানেই পড়ে… আমার সংসার করাটাও তো মা দেখল না।

মা কি পারবে আসতে? শরীরের যা হাল। এদিকে বাতে ধরেছে, ওদিকে প্রেশার, হাঁপানির টান….

ওগুলো সমস্যাই নয়। তেমন বুঝলে প্লেনে উড়িয়ে আনব। কলকাতায় ডাক্তারেরও কোনও অভাব নেই।

কথাটা বলে বেশ আত্মপ্রসাদ অনুভব করল কৃত্তিকা। যেন দিদির ডাক্তার হওয়ার গুমোরটাকেও সে খানিকটা খাটো করতে পেরেছে। তা ছাড়া দিদি মাকে কাছে রেখেছে, একা সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে চলেছে— এইসব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কাঁটাগুলো উপড়ে ফেলার সুযোগও তো সেভাবে আসে না। আজ যখন পেয়েছে, ছাড়বে কেন।

রোহিণী কবজি উলটে ঘড়ি দেখছে। বিভাসকে বলল, এবার তো উঠতে হয়, ভাই।

বিভাস বলল, বসুন না আর একটু। সবে তো দশটা।

রোজ রোজ রাত করাটা ঠিক নয়। বাড়িতে একটা রোগী আছে…। তোমাদের কম্পাউন্ডের সামনে থেকে কি ট্যাক্সি পাব?

গাড়ি তো আছে, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

মিছিমিছি কষ্ট করবে কেন?

কষ্ট কীসের। ইটস মাই প্লেজার।

বিভাস কি একটু বেশি গদগদ ভাব দেখাচ্ছে না? কৃত্তিকা কটাক্ষ হানতে গিয়েও সংযত করল নিজেকে। রোহিণীকে দরজা অবধি এগিয়ে দিতে দিতে বলল, তোর মুখ থেকে একটা খবর কিন্তু খুব আশা করেছিলাম রে দিদি।

রোহিণী ঘুরে দাঁড়াল, কী বল তো?

বড়মাসি বলছিল, তুই নাকি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করছিস?

রোহিণী অস্পষ্ট হাসল, এখনও ঠিক নেই।

সেই ডাক্তার বন্ধু? মা যার কথা টেলিফোনে বলে?

হুঁ।

তোর সঙ্গেই নাকি এসেছে কলকাতায়? একবার দেখালি না?

বিভাস গাড়ি বার করতে গেছে। মিমলি কৃত্তিকার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে। ঝুঁকে বোনঝির চুল ঘেঁটে দিল রোহিণী। সোজা হয়ে বলল, দেখে কী করবি? বর মেয়ে নিয়ে দিব্যি তো সুখে আছিস, থাক না নিজের মতো।

কৃত্তিকার কানে ঠং করে বাজল ইঙ্গিতটা। মাথা জ্বালা করে উঠল সহসা। লিফট্ নেমে যাওয়ার পরও ঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। হঠাৎই নজর গেছে মিমলির ওপর। কড়া গলায় মেয়েকে বলল, এখনও দরজায় কেন? যাও, শুতে যাও।

মিমলি গা মোচড়াল, যাচ্ছি তো।

যাচ্ছি নয়, এক্ষুনি যাও। এক্ষুনি।

সশব্দে দরজা বন্ধ করল কৃত্তিকা। ভেতরে এসে সাবিত্রীকে বলল, মিমলিকে নাইটড্রেসটা পরিয়ে দাও।…রান্নাঘরের কাজ শেষ? মাংস ঠান্ডা করে ফ্রিজে তুলেছ তো?

হ্যাঁ।

তুমিও বিছানা করে শুয়ে পড়ো।

আচ্ছা।

বিভাস ফিরল প্রায় এগারোটায়। নিজেকে রাতপোশাকে বদলে নিয়ে ব্যালকনিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল কৃত্তিকা। মিষ্টি একটা মলয় বইছে আজ, হাওয়াটা তাকে যেন ছুঁতে পারছিল না। উৎকট এক তাপ বেরোচ্ছে শরীর থেকে। চিন্তা তো শুধু নিজেকে পোড়ায় না, চারপাশেও বুঝি আগুন ধরিয়ে দেয়।

বিভাস ঘরে ঢোকামাত্র কৃত্তিকা গিয়ে হিসহিস করে উঠেছে, যাক, ফিরেছ তা হলে!

সরল মনে বিভাস বলল, একটু দেরি হয়ে গেল, না? ভাবলাম, গেছি যখন, দোতলায় একবার উঁকি দিয়ে আসি।

সে তো আমি জানি। দিদির পিছু ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না, তাই তো?

বিভাস যেন মজা পেয়েছে। ফিচেল হেসে বলল, এমন কী খারাপ বাসনা? শি ইজ সো চার্মিং! এখনও কী দারুণ ফিগারটা রেখেছেন!

আমার ফিগার বুঝি ধসে গেছে? কৃত্তিকা দুপদাপিয়ে এগিয়ে গেল, কোনটা আমার দিদির চেয়ে খারাপ? বুক? পেট? হিপ?

তুলনা তো করিনি! বিভাস অবাক তুমি হঠাৎ হিস্টিরিক হয়ে যাচ্ছ কেন? তুমি তোমার মতো, দিদি দিদির মতো।

থাক। কথা ঘোরাতে হবে না। তোমাদের, পুরুষদের আমি খুব চিনি।

বিভাস পাঞ্জাবি খুলে ওয়াড্রোবে রাখছিল। ঘুরে বলল, তুমি তোমার দিদিকে একটুও সহ্য করতে পারো না। কেন বলো তো?

বাজে কথা। দিদি আমায় সহ্য করতে পারে না। দেখলে না, কত সাধাসাধি করলাম, তবু আমাদের বাড়িতে এসে উঠল না!

বিভাস খাটে বসল। ঠোঁট ছুঁচোলো করে বলল, বেশ, তাই নয় হল। কিন্তু দিদিই বা কেন তোমায় সহ্য করতে পারেন না?

আমায় হিংসে করে।

তোমার নিজের দিদি… তোমাকে… হিংসে! বিভাসের গলা থেকে প্রশ্ন ঠিকরে এল, কেন?

এক একজনের নেচার থাকে। আপনজনের ভাল দেখতে পারে না। এই যে আমি চমৎকার সেটল করে গেছি, আর ও এখনও…

সেই জন্যই উনি কলকাতায় আসেন না? বিভাস যেন এতক্ষণে রহস্যের সমাধান খুঁজে পেয়েছে। বিজ্ঞ গোয়েন্দার ভঙ্গিতে বলল, তাই তুমি বেশি বেশি করে বলছিলে? টেরেসওয়ালা বাড়ি…?

কৃত্তিকা বহুক্ষণ পরে অকৃত্রিম হাসল, খারাপ কিছু বলেছি।

বিভাস হাসতে হাসতে বলল, তুমি কিন্তু বেশ দুষ্টু আছ। দিদি অত দূর থেকে ছুটতে ছুটতে দিব্যদাকে দেখতে এসেছেন, আর তুমি দিব্যদার সম্পর্কে তার কাছে ঝুরি ঝুরি অভিযোগ জানিয়ে গেলে।… দিদি মনে হল খুব হার্ট হয়েছেন।

তাতে আমার বয়েই গেল। কৃত্তিকা বিভাসের পাশে এসে বসল। আলগাভাবে বিভাসকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমায় গাড়িতে কিছু বলছিল নাকি?

না। চুপচাপই ছিলেন। বিভাস কৃত্তিকার নাকে নাক ঘসল, আচ্ছা, তুমি মাঝে মাঝেই গজগজ করো বটে, কিন্তু দিব্যদা কি সত্যিই অত মতলবি লোক?

কৃত্তিকা ধীরে ধীরে সরে গেল। ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে বসেছে। চুলে ব্রাশ চালাতে চালাতে বলল, আমি যা যা বলি, তার একটাও কি মিথ্যে?

তবু…। বিভাস একটা হাই তুলল, দিব্যদাকে দেখে তো ওরকম মনে হয় না। অন্যকে ঠকিয়ে খুব রইসি চালে থাকেন, তাও তো দেখি না। বরং সোশাল ওয়ার্ক করছেন…। ছবির মার্কেটেরও খবর আমি একটু- আধটু রাখি, সেখান থেকেও ওঁর ইনকাম নেহাত কম নয়। বছর কুড়ি চাকরি করে ভি-আর নিলেন, কলেজ থেকেও না-হোক ছ’-সাত লাখ তো মিলেছেই। সব টাকাই তো শুনি উনি সুবর্ণলতায় লাগাচ্ছেন।

যদি লাগায়ও, নিশ্চয়ই কোনও উদ্দেশ্য আছে। অকারণে কিছু করার লোক দিব্যদা নয়।

কী করে বলছ? আমি তো গিয়ে দেখেছি, কত বড় একটা কাজ হচ্ছে সেখানে। ইনটিরিয়ার ভিলেজের গরিব মেয়েরা রোজগারের সুযোগ পাচ্ছে…

থামো তো। রাতদুপুরে আর কচকচানি ভাল লাগছে না। ঘুমোও।

কী জানি বাবা, তোমায় আমি বুঝি না। বিভাস শুয়ে পড়ল। আবার একটা হাই তুলে বলল, এই দেখি পড়িমরি করে মেয়ে নিয়ে দিব্যদার কাছে ছুটছ, এই দেখি দিব্যদার নিন্দায় পঞ্চমুখ! দিব্যদা অসুস্থ বলে টেনশনও তো কম করো না!

কৃত্তিকা আর কিছু না বলে বাথরুমে চলে গেল। বেরিয়ে দেখল বিভাস যথা নিয়মে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিদ্রায় তলিয়ে যেতে বিভাসের এক মিনিটও সময় লাগে না। কী পুরুষ! তার যখন দেহ জেগে ওঠে, বিভাসের তখন নাক ডাকে, কৃত্তিকা চাইলেও কিছুতেই চোখ খোলে না। সেভাবে শরীরের চাহিদা নেই, মাতামাতি নেই, অবরে-সবরে একটুখানি দানাপানি পেলেই বর্তে যায় যেন। এই মানুষটা দিব্যদার চেহারা আন্দাজ করবে কী করে!

নিথর মুখে চুল বাঁধল কৃত্তিকা, নিঃশব্দে ক্রিম ঘষল গালে, নিঃসাড়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়, আলো নিবিয়ে দিল। চকিত অন্ধকারে ভেসে উঠেছে দিব্যদার মুখখানা। সেই মুখ… সেই নিষ্ঠুর মুখ

মস্তিষ্কে চলতে শুরু করেছে ভিডিও ক্যাসেট।… দিব্যদা এসেছে গাইঘাটায়, দিদির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করছে, দিদিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল হাঁটতে, পিছন পিছন যাচ্ছিল কৃত্তিকা, হাত নেড়ে দিব্যদা তাকে টা টা করে দিল! ঝুনি যেন নিতান্তই এলেবেলে! ঝুনিকে যেন সঙ্গে নেওয়া যায় না! বেচারা ঝুনির কপালটাই তো এরকম, জন্ম থেকেই। তাকে কালো হতে হবে, অঙ্কে কাঁচা হতে হবে, বাড়িতে কেউ এলে তাকে লুকিয়ে পড়তে হবে, পাছে দিদির সঙ্গে তুলনা শুরু হয়। দিব্যদাও কিনা দিদির খাতাতে দিদির স্কেচ বানিয়ে দিল, আর তার খাতায় আঁকল শুধু হিজিবিজি। আবার ঠাট্টা করে বলল, তোরটা অনেক মহৎ আর্ট রে, বড় হলে বুঝবি! হুঁহু, ঝুনি যেন তখন বাচ্চা আছে! দিদির চেয়ে সে কত ছোট? পুরো তিন বছরও তো নয়!

…দিদি ডাক্তারি পড়তে চলে গেল কলকাতায়। ছুটিছাটায় যখন গাইগাটায় আসত, কীরকম একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরোত দিদির গা থেকে। মিষ্টিও নয়, কড়াও নয়, কেমন যেন বুনো বুনো ঘ্রাণ। মা কোনওদিন গন্ধটা পায়নি, শুধু ঝুনিই…। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিত, ওই গন্ধের উৎস ভীষণ চেনা কেউ। ওই গন্ধটার নেশায় কলকাতায় আসার জন্য ছটফট করত ঝুনি। কিন্তু হায়ার সেকেন্ডারিতে সে গড়িয়ে মড়িয়ে সেকেন্ড ডিভিশন, হাবড়া কলেজ ছাড়া তখন তার আর গতি কী!

…একদিন দিদির ব্যাগে একটা চাবি আবিষ্কার করেছিল ঝুনি। হস্টেলের চাবির রিংয়ে নয়, আলাদা করে রাখা ছিল খাঁজে। সাদা মনে দিদিকে জিজ্ঞেস করতেই দিদির সে কী চোটপাট! কোন সাহসে তুই আমার ব্যাগ ঘাঁটিস! এরকম কুচ্ছিত হ্যাবিটগুলো কোত্থেকে হল! বাজে বা নোংরা নয়, ঝগড়ার সময়ে কুচ্ছিত শব্দটাই ব্যবহার করত দিদি। ঝুনি যে তার তুলনায় অসুন্দর, সেটাই শুনিয়ে দিত বোধহয়। অনেক পরে অবশ্য চাবি রহস্য বুঝেছিল ঝুনি, দিব্যদার কাছেই জেনেছে। চাবিটা ছিল চেতলার বাড়ির। দিব্যদারই বানিয়ে দেওয়া ডুপ্লিকেট।

…তারপর তো দিদি ডাক্তারি পাশ করল, চাকরিও পেল নার্সিংহোমে। ভাড়া নিল ছোট্ট টু-রুম ফ্ল্যাট। এম.এ পড়ার বাসনায় ঝুনিও অমনি নাচতে নাচতে কলকাতায়। অনার্স একটা ছিল বটে, তবে মার্কস সুবিধের নয়, সুতরাং চান্সও জুটল না। দিদি বলল, কী আর করবি, ফিরে যা গাইঘাটায়। মা’র দেখভাল কর, আর পারলে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা টরিক্ষার জন্য তৈরি হ। কেমন যেন একটা সুর ছিল দিদির গলায়! করুণা? নাকি বিদ্রূপ? না তাচ্ছিল্য? কিংবা হয়তো তাকে সরিয়ে দিয়ে স্বস্তি পেতে চাইছিল দিদি! কিন্তু ঝুনির তো তখন, মাত্র ক’দিনেই, চোখে একটা ঘোর লেগে গেছে। কলকাতা যেন চুম্বকের মতো ধরে রাখতে চাইছে তাকে। দিদিকেও তো দেখছে সে, কেমন পাখির মতো উড়ছে দিদি। কোনওভাবেই কি সে এখানে থেকে যেতে পারে না? দিদির গলগ্রহ না হয়ে? একটা চাকরি বাকরি জুটিয়ে?

…তখনই দিব্যদার শরণাপন্ন হল। চেতলায় গিয়ে ধরল এক-দু’দিন, দিব্যদা সেভাবে পাত্তা দিল না। ওখানে যেতে খুব একটা ভালও লাগত না ঝুনির। পৃথাবউদি কেমন যেন বাঁকা চোখে তাকায়, আভাসইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় ঝুনির উপস্থিতি সে আদৌ পছন্দ করছে না। ঝুনি প্ৰথমে ভাবত, দিব্যদা, বড়মাসি তাদের জন্য এত করে বলেই বুঝি বউদির রাগ! কী করে মাথায় আসবে, পৃথাবউদি তখন এক ঘরপোড়া গোরু!

…ঝুনি একদিন মরিয়া হয়ে হানা দিল দিব্যদার কলেজে। সেদিন ও এড়িয়ে যাচ্ছিল দিব্যদা, ঝুনি ঝুপ করে বলে ফেলল, আমার জন্য কেন গো কিছু করতে চাও না তুমি? দিদি কিছু বললে তো ঝাঁপিয়ে পড়ে করে দিতে!

দিব্যদা স্থির চোখে তাকে দেখল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, রুনি আর তুই কি এক?

তোমার চোখে তো তাই হওয়া উচিত। দিদির জন্য যদি উইকনেস থাকে, আমার জন্যও থাকবে।

খুব ভেবেচিন্তে কথাটা বলেনি ঝুনি, কিন্তু দিব্যদার চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল। গমগমে স্বরে বলেছিল, ঠিক আছে, দেখছি।

আমি তা হলে তোমার ভরসাতেই থাকছি ক’দিন? থাক।

তবে রুনিকে কিছু বলার দরকার নেই।

দিন পনেরো পর দিব্যদা হঠাৎ দুপুরবেলা যাদবপুরের ফ্ল্যাটে হাজির, তোর একটা ব্যবস্থা বোধহয় হয়ে গেল। কাজ একটা তোর জুটে যাবে।

ঝুনি লাফিয়ে উঠল, কোথায়?

আমার দুই পরিচিত আর্টিস্ট একটা অ্যাড এজেন্সি খুলেছে। ইন্টিরিয়র ডেকরেশনও করে। তাদের অফিসের ডে-টু-ডে কাজকর্ম সামলাতে হবে। পারবি?

পারব।

এখন তিন হাজারের বেশি দেবে না। চলবে?

দৌড়োবে।… তোমায় যে কী বলে ধন্যবাদ দেব দিব্যদা…!

ধন্যবাদ ধুয়ে কি জল খাব? দিব্যদার গলা আচমকা অন্য রকম, আমি ওই সব ধোঁয়া ধোঁয়া কথায় বিশ্বাস করি না।

মানে?

দিদির সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেছিলি না? তোর দিদি যা দিতে পারে, সেটা তো তোর নেই। যা তোর আছে, সেটাই দে।

কী দেব?

শরীরটা। বলেই আঙুল নাচাল, নাইটিটা খুলে ফ্যাল।

ঝুনি স্তম্ভিত, কী বলছ তুমি দিব্যদা?

ন্যাকামি করিস না। খোল চটপট।

আমি তোমার ছোট বোন, দিব্যদা!

সঙ্গে সঙ্গে সপাটে গালে চড়, চোপ। বোন বলে মাগ্‌ায় সুবিধে নিবি? সব কিছুর একটা দাম আছে, পে কর।

তারপরে তো হয়েই গেল। প্রায় জন্তুর মতো তার শরীরটাকে আঁচড়াল, কামড়াল দিব্যদা। কিন্তু কী আশ্চর্য, যেই শুনল দিদির সঙ্গেও দিব্যদার একটা দৈহিক সম্পর্ক আছে, অমনি এক অদ্ভুত পুলকে ভরে গেল মন। পুলক, না সুখ? পুলক, না তৃপ্তি? নাকি শুধুই দিদির পারফিউম পাউডার ক্রিম লুকিয়ে মেখে নেওয়ার শিহরন?

তা একবার রক্তের স্বাদ পেলে বাঘিনী আর কি শান্ত থাকে! রক্তে তখন কল্লোল বাজছে, দিব্যদাকে চাই, দিব্যদাকে চাই। দিদি না-থাকলে সন্ধেবেলা চলে আসে দিব্যদা, খ্যাপা পশুর মতো দু’জনে দু’জনকে ছিন্নভিন্ন করে তখন। হ্যাঁ, পশুই। লজ্জা, হায়া, শরম, সবই তখন উবে গেছে ঝুনির। এর মধ্যে হঠাৎ দিদি মাকে নিয়ে এল কলকাতায়। কী বিপদ, এবার ঝুনি কী করে! দিব্যদাই সমাধান খুঁজে দিল। মিডলটন স্ট্রিটে দিব্যদার এক বন্ধুর ফ্ল্যাট ছিল, বন্ধু বিদেশে, সেখানে শুরু হল অভিসার। দিদির কাছ থেকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে আনছে দিব্যদাকে, এতে যে কী অপার আনন্দ!

একটা মাত্র ভুলের জন্য জানাজানি হয়ে গেল। দিব্যদার জ্বর, পাঁচ- সাত দিন দেখা হচ্ছে না, অফিস ছুটির পর চেতলায় চলেই গেল ঝুনি। পৃথাবউদি ছিল না সেদিন তবে বড়মাসি ছিল। ওপাশের ঘরে বড়মাসি থাকা সত্ত্বেও দুঃসাহসী হওয়ার ভূত চাপল ঝুনির মাথায়। জ্বর থেকে সবে উঠেছে, দিব্যদা বেশ দুর্বল, তাও অবসন্ন মানুষটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগাতে চাইছিল ঝুনি। আর সেই মুহূর্তে, যাকে সে হিসেবে ধরেনি, সেই হতচ্ছাড়ি কল্পনাই কিনা তাকে দেখে ফেলল! এবং চুকলি করল পৃথাবউদির কাছে!

অবশ্য ধরা পড়ার জন্যে ঝুনির একটুও অনুতাপ নেই। কিল খেয়ে কিল হজম করা দিদির কলকাতা ত্যাগের জন্যও নয়। একটাই যা দুঃখ, দিব্যদার সঙ্গে খেলাটা ছানা কেটে গেল। দিব্যদা তার শরীরের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলল হঠাৎ। পৃথাবউদি মারফত বড়মাসিও তখন জেনে গেছে, ঝুনির বিয়ের জন্য উঠতে বসতে চাপ দিচ্ছে মাকে। ঝুনি ও বা কেন আপত্তি করবে! দিদিই যখন ফ্রেম থেকে আউট, বিয়ে করে থিতু হওয়াটা মন্দ কী!

…এক শুভলগ্নে সম্বন্ধ করা পাত্রের সঙ্গে ছাদনাতলায় বসে পড়ল ঝুনি। কিন্তু বিয়ের পরেই টের পেল, দিব্যদা তার কত বড় ক্ষতি করে দিয়েছে। বিভাস কেজো মানুষ, বিভাস দায়িত্বশীল মানুষ, কিন্তু ঝুনির বিছানায় সে অচল। ঝুনির চনচনে খিদে মেটাতে একমাত্র দিব্যদাই পারে। শুধু দিব্যদা।

…মিমলিকে দিব্যদাই আনল পৃথিবীতে। মিমলি জন্মানোর পর বিভাসের উৎফুল্ল মুখখানা দেখে ভারী মায়া হয়েছিল ঝুনির, বেচারা!

অন্ধকারে কৃত্তিকার চোখ দুটো জ্বলে উঠল সহসা। দিব্যদা ভেগে গেছে। যেদিনই ঝুনির মুখ থেকে শুনল মিমলির ব্যাপারটা, সেদিন থেকেই এড়িয়ে চলে সুকৌশলে। মহা হারামি লোক, নিজের বাচ্চার ওপরও কণামাত্র টান নেই। মেয়েটার দিকে ভাল করে তাকায় না পর্যন্ত। ইচ্ছে করলেই হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতে পারে কৃত্তিকা। আজকাল যা সব টেস্ট বেরিয়েছে, অস্বীকার করে পার পাবে না। ভাগ্যিস সোনামাটিতে সেদিন দুম করে মরে যায়নি, তা হলে বিস্তর মুশকিল হত। বোধহয় কৃত্তিকার কথা ভেবেই দিব্যদাকে এবার প্রাণভিক্ষা দিল ভগবান।

উঠে বসল কৃত্তিকা। হাতড়ে হাতড়ে টেবিল থেকে টানল জলের জগটা। দু’ঢোক ঢালল গলায়। দিব্যদা আর একটু সুস্থ হলে, এবার একটা হিসেবে বসতে হবে। ত্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করলে কৃত্তিকা ছাড়বে না। মুখোশটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিব্যদার আসল রূপ দেখিয়ে দেবে সকলকে। কৃত্তিকার গায়েও কালি লাগবে? লাগুক। সুবর্ণলতা থেকে শুরু করে দিব্যজ্যোতি সিংহের যাবতীয় সম্পত্তি মিমলির নামে হয়ে যাবে, এটা বোঝার পরে বিভাসের মতো হিসেবি মানুষ নিশ্চয়ই কৃত্তিকাকে পরিত্যাগ করার মতো মূর্খামি করবে না! করেও যদি, তারই লোকসান।

কী অনবদ্য পরিস্থিতি! হেড আই উইন, টেল ইউ লুজ!

আচমকা একটা শ্বাস পড়ল কৃত্তিকার। জয়ের ভাবনাতে তৃপ্তি নেই কেন? কোথায় যেন সে হেরে আছে, হেরেই আছে। দিদির কাছে। দিব্যদার কাছে। মা’র কাছে। বড়মাসির কাছে। এমনকী পাশে শুয়ে থাকা এই বোকাসোকা নিরীহ মানুষটার কাছেও।

কৃত্তিকার কান্না পাচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *