আট
অধ্যক্ষের ঘরে স্থান অকুলান বলে মিটিং আজ কলেজের বড় স্টাফরুমে। স্থির করা হচ্ছে আগামী শিক্ষাবর্ষে ছাত্রছাত্রী ভরতি হওয়ার নীতি। অধ্যক্ষ মৃগাঙ্ক সেন তেমন একটা পরিবর্তনের পক্ষপাতী নয়, তবে অ্যাডমিশন টেস্টের ব্যাপারে তার কয়েকটা পরামর্শ আছে, সেগুলোই বলছিল সাজিয়েগুছিয়ে। লিখিত পরীক্ষার গুরুত্ব খানিকটা কমিয়ে স্বাভাবিক অঙ্কনক্ষমতাকে আরও বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া যায় কি না, কিংবা মৌখিক পরীক্ষায় চিত্রশিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে পরীক্ষার্থীদের জ্ঞান কতটা যাচাই করা উচিত, এইসব।
এমন মিটিং ফি বছরই হয়। কী অশ্বডিম্ব প্রসব হবে তা তো সকলের জানা। বেশির ভাগ শিক্ষক শিক্ষিকাই তাই নীরব শ্রোতা। এক-আধজন ঢুলছে, কেউ কেউ নিয়মমাফিক হুঁ হ্যাঁ করছে। তবে চা বিস্কুট চলছে ঘনঘন। দুধ-চা, লিকার চা, চিনি ছাড়া চা, চিনি সহ চা…। শুধু জনা তিন- চারজন অল্পবয়সি অতি উৎসাহে মতামত জানাচ্ছে টুকটাক। চোখ নাক কুঁচকে শুনছে মৃগাঙ্ক, কাগজে নোটও করে নিচ্ছে। অবশ্য শেষ অবধি বক্তব্যগুলোকে সে বিশেষ আমল দেবে, এমন সম্ভাবনা নিতান্তই কম। তরুণ তুর্কিরাও জানে এ-কথা, তবু তাদের কিছু না-কিছু বলা চাই। এ যেন একটা খেলা।
সভা শেষ করার আগে মিটিংয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো আর একবার পড়ে দিল মৃগাঙ্ক। ছাত্রসংসদের এক প্রতিনিধিও উপস্থিত আছে আজ, তাকে জিজ্ঞেস করল, কী হে সঞ্জয়, তোমাদের কোনও আপত্তি নেই তো?
সঞ্জয় একটু মুখচোরা ধরনের। খ্যাতনামা স্যার ম্যাডামদের ভিড়ে সে আড়ষ্ট বোধ করে। তার মুখ থেকে কথা খসার আগে প্রবীণ অধ্যাপক বিজিতের মন্তব্য, ও কী বলবে? ওরা কি অতশত বোঝে? … সঞ্জয়, যাওয়ার সময়ে ক্যান্টিনে চা বলে দিয়ো তো, শেষবেলায় গলাটা আর একবার ভিজিয়ে নিই।
বেলা সত্যিই শেষ। বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এল। চায়ের অপেক্ষায় না-থেকে অনেকেই বেরিয়ে পড়ছে গুটিগুটি। যেতে যেতেই ছোট ছোট জটলায় চলছে খুচরো গল্প আড্ডা।
ফাইলপত্র গুছিয়ে মৃগাঙ্কও উঠে দাঁড়াল। বিজিতকে বলল, কাল লেট আওয়ারে একবার আমার চেম্বারে আসতে পারবেন, বিজিতদা? আপনার পেনশন পেপারগুলো নিয়ে একটু বসব ভাবছিলাম।
বিজিত মৃদু হেসে বলল, মুক্তির ঘন্টাটা আর এক একবার শুনিয়ে দিলে?
উপায় কী, বিজিতদা। আপনার মতো শিল্পীকে ধরে রাখতে পারলে আমরা তো ধন্য হতাম। আপনার কাছ থেকে স্টুডেন্টদেরও কত কিছু শেখার আছে। কিন্তু..
সংকুচিত বোধ করছ কেন। আমি খুশি মনেই বিদায় নেব। কালের নিয়ম তো মানতেই হবে। বিজিতকে সামান্য উদাস দেখাল, তবে কলেজের কথা খুব মনে পড়বে। এতগুলো বছর… কী সুন্দর কাটল…
সে আর বলতে।… তা হলে কাল তিন-চারটে নাগাদ আসছেন তো চেম্বারে?
ঘড়ি দেখতে দেখতে বেরিয়ে গেল মৃগাঙ্ক। পিছন পিছন আরও কয়েকজন। রমানাথ ব্যাগে একটা বই ঢোকাচ্ছিল। চেন আটকে বলল, আপনি ভাল সময়েই যাচ্ছেন বিজিতদা। কলেজের পরিবেশটা এখন যেন কেমন হয়ে গেছে। লাইফ নেই।… দেখুন না, মিটিংগুলোও একদম ম্যাদামারা বনে গেছে।
মৃগাঙ্করই সুবিধে। পরমেশ দরজার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, এখন মৃগাঙ্ক যা যা ডিসিশন নিচ্ছে, সব পাশ।
বিজিত বলল, আহা, ও অন্যায্য প্রোপোজাল কিছু দিয়েছে নাকি?
ন্যায্য অন্যায্যর কথা ছাড়ুন। চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে কি? মৃগাঙ্ক তো শুধু তাড়া লাগায়, আর ঘড়ি দেখে।
হুম। এসব মিটিংয়ে দিব্যর খুব দরকার ছিল। ও ব্যাটা থাকলে ওরাল এগজামিনেশন আরও স্ট্রিকট করার প্ল্যানটা গুবলেট হয়ে যেত।
বিজিত বলল, কিন্তু মৃগাঙ্কর উদ্দেশ্য তো খারাপ নয়। বেটার কোয়ালিটির ছেলেমেয়ে চাইছে।
কাউন্টার যুক্তিও আছে। দিব্যজ্যোতি থাকলে অবশ্যই বলত, স্টুডেন্টরা তো কলেজে হিস্ট্রি অফ আর্ট পড়বেই। আগে থেকে তাদের সর্বজ্ঞ হয়ে আসার দরকার কী!
বনানী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। বলে উঠল, স্ট্রেঞ্জ! কথাটা তো আপনিও মিটিংয়ে বলতে পারতেন। আপনাদের মতো সিনিয়ার টিচারও যদি চুপ থাকেন….
যাক। মৃগাঙ্ক যেমনটা স্যুটেবল মনে করছে, চালাক। আমাদের কী, ভাল ছাত্র ভরতি হলেও পড়াব, খারাপ ছাত্র এলেও পড়াব। তর্কাতর্কির ঝামেলা আমার পোষায় না।
স্টাফরুম প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। হৈমন্তী জানলার ধারে গিয়ে মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল, বোতাম টিপে ঢাউস ভ্যানিটি ব্যাগে রাখল ফোন। কান বোধহয় এদিকেই খাড়া ছিল, চেঁচিয়ে বলল, এখানেই তো দিব্যজ্যোতি সিংহর সঙ্গে আমাদের তফাত রমাদা। কথা অনেকের গলাতেই বুড়বড় করে, কিন্তু দিব্যদার মতো বেপরোয়াভাবে কেউ বলে দিতে পারে না।
রমানাথ বলল, তোমার আবার একটু বেশি দিব্যপ্রীতি। কী এমন গুণের আকর ছিল দিব্য? তক্কো হুজ্জোত চেঁচামেচিটা ভাল পারত, আর একটা না-একটা পয়েন্ট খুঁজে নিয়ে বিবাদ বাধিয়ে দিত, ব্যস।…
মৃগাঙ্কদাকে সামনে পেলে তো আরও বেশি করে করত। বনানী সায় দিল, বেচারা মৃগাঙ্কদা নিরীহ মানুষ, লড়াই ঝগড়া মোটেই আসে না।
মৃগাঙ্কর ব্যাপারটা আলাদা। ওকে নিয়ে দিব্যজ্যোতির একটা কমপ্লেক্স ছিল। চশমা খুলে টেবিলে রাখল বিজিত। চোখের পাতা ঘষতে ঘষতে বলল, দু’জনে একই সঙ্গে পাশ করেছে… হঠাৎ একদিন মৃগাঙ্ক ওর মাথার ওপর প্রিন্সিপাল হয়ে বসে গেল… দিব্যর খুব ইগোতে লেগেছিল।
বেশ সুগারকোটিং করে দিলেন তো, বিজিতদা। সাফ সাফ বলুন না, দিব্য হিংসেয় জ্বলত। একটা দিনের জন্যও ও মৃগাঙ্ককে স্ট্যান্ড করতে পারেনি। প্রিন্সিপালের চেয়ারটার যে একটা মর্যাদা আছে, সেই বোধটাই ওর ছিল না। আপনারা তো মৃগাঙ্কর ঢের ঢের সিনিয়ার, কই আপনারা তো তার পেছনে কখনও আদাজল খেয়ে লাগেননি!
বনানী মাথা নাড়ল, হানড্রেড পারসেন্ট ঠিক। আমরাও হয়তো অনেক সময়ে দিব্যদাকে সাপোর্ট করেছি, কখনও কখনও হয়তো উসকেওছি। তবে এটাও তো মানতে হবে, দিব্যদার মধ্যে একটা বিশ্রী পরশ্রীকারতা আছে। সমান কেউ দিব্যদার চেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে, দিব্যদা এটা হজম করার বান্দাই নয়। এবং তার জন্য যে-কোনও লেভেলে দিব্যদা নেমে যেতে পারত। আই মিন, পারে।
যাহ্, তুই কিন্তু রংটা একটু চড়া করে দিচ্ছিস। হৈমন্তী চেয়ার টেনে বসল। পাখার হাওয়ায় এলোমেলো চুল উড়ছিল, দু’হাতে ঠিক করতে করতে বলল, ওইরকম জেলাসি কার মধ্যে একটু-আধটু নেই রে ভাই?
দ্যাখো, হিংসে করাটা আলাদা। আর ভিন্ডিক্টিভ হয়ে ওঠাটা আলাদা। রমানাথ আঙুল তুলল, তুমি কি কলেজে সেই অ্যাজিটেশনের ব্যাপারটা ভুলে গেলে? মৃগাঙ্ক প্রিন্সিপাল হয়ে জয়েন করার পর পরই স্টুডেন্ট ইউনিয়ন হঠাৎ খেপে গেল… সারাদিন ঘেরাও করে রেখেছে প্রিন্সিপালকে, জল খেতে দিচ্ছে না, বাথরুমে পর্যন্ত যেতে দিচ্ছে না….
সঙ্গে কী কুচ্ছিত কুচ্ছিত স্লোগান! ছিঃ। … ধান্দাবাজ মৃগাঙ্ক সেন দূর হঠো, দূর হঠো! স্টুডেন্টদের পয়সা মেরে পেটমোটা করা চলবে না, চলবে না! আরে ভাই, ক্যান্টিনের সাবসিডি তোরা বাড়াতে চাস, তার জন্য ওই ভাষা! ক্যান্টিনটার ফাটাফুটো দশা তো চিরকালই। সেই আমরা যখন স্টুডেন্ট, তখন থেকেই। হঠাৎ মৃগাঙ্কদা দায়ী হয়ে গেল কী করে? আর সারাতে হলেও তো দু’-চার-ছ’মাস সময় লাগে। হুট বললেই তো হয় না, গভর্নমেন্টের থেকে গ্রান্ট পাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। বাট নো মার্সি। মৃগাঙ্কদা তখন সবে চার মাস হল জয়েন করেছে…
কিন্তু ওই অ্যাজিটেশনের সঙ্গে দিব্যদার কী সম্পর্ক? হৈমন্তী চোখ ঘোরাল, আমি তো বরং উলটো ছবি দেখেছি। দিব্যদা আমার সামনে মৃগাঙ্কদাকে বলেছিল, স্টুডেন্টদের প্রেশার ট্যাকটিসে একদম মাথা নোওয়াবি না। দিব্যজ্যোতি সিংহ তোর পাশে আছে, দেখি ওরা কী করে!
পরমেশ হঠাৎ হৈমন্তীর পক্ষ নিয়েছে, আমিও কিন্তু দেখেছি দিব্যজ্যোতি প্রিন্সিপালের ফেভারেই বলছিল। ইনফ্যাক্ট প্রিন্সিপাল তো তখনই রিজাইন করতে যাচ্ছিল, দিব্যজ্যোতিই তাকে নিষেধ করে।
ওটাই তো দিব্যর ক্যাচ। রমানাথ ফিক করে হাসল, সাধে কি বলি, ও অনেক উচ্চমার্গের জীব। সাপের গালেও যেভাবে চুমু খাবে, ব্যাঙের গালেও একই স্টাইলে চুমু দেবে। ইয়াগোও ওকে দেখে লজ্জা পেয়ে যাবে রে ভাই।
তার মানে আপনি বলছেন দিব্যদাই ছেলেমেয়েদের খেপিয়েছিল?
অবশ্যই। সেবারের জি. এস তীর্থঙ্কর আমার কাছে কনফেস করেছে। এই তো, মাস তিনেক আগে একটা চাকরির রেকমেন্ডেশনের জন্য এসেছিল। জাস্ট ঠাট্টা করে বলেছিলাম, দেখিস আমার বদনাম করে দিস না, পরে যদি কলেজের মতো হল্লাবাজি করিস, আমার প্রেস্টিজটা পাংচার হয়ে যাবে। তখনই আমায় খুলে বলল সব। কবে কোথায় দিব্য ওদের সঙ্গে মিটিং করেছিল… কী কী পয়েন্টে কীভাবে মৃগাঙ্ককে চেপে ধরতে হবে শিখিয়েছিল…। তীর্থঙ্কর তো পরিষ্কার বলে গেল, ওরা পারসোনাল অ্যাটাক করতে চায়নি, কিন্তু ব্যাপারটা যেন কী করে সেদিকেই গড়িয়ে গেল।
বনানী বলল, আমি কারও মুখ থেকে শুনিনি। তবে আগাগোড়াই আমার কেমন সন্দেহ ছিল। ওদের পেছনে নিশ্চয়ই একটা কেউ আছে! নইলে ওরা অত বাড়াবাড়ি করতে সাহস পায়? পুতুলনাচের সেই কারিগরটি যে দিব্যদাই, এটাও আন্দাজ করেছিলাম। কারণ সে পার্টি করা লোক, কীভাবে একটা আন্দোলনকে চাগিয়ে দিতে হয় ভালমতোই জানে, স্টুডেন্টদের ওপরও তার একটা ম্যাগনেটিক ইনফ্লুয়েন্স আছে।
হৈমন্তী বলল, কী জানি, আমার তো এখনও বিশ্বাস হয় না। স্টুডেন্টদের সঙ্গে দিব্যদার চমৎকার সম্পর্ক। শুধু ইউনিয়ন নয়, সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই। একেবারে বন্ধুর মতো মিশতে পারে দিব্যদা। ওদের প্লেনে নেমে, ওদেরই একজন হয়ে। এই ক্ষমতাটা আমাদের মধ্যে খুব কম টিচারেরই আছে।
রমানাথ বলল, দিব্যর মতো স্যাম্পেলই বা আমাদের মধ্যে ক’টা আছে, হৈমন্তী?
উত্তরে হৈমন্তী কিছু বলতে যাচ্ছিল, থালায় কাপ সাজিয়ে রামখেলাওনকে ঢুকতে দেখে থেমে গেছে। বিজিত হেসে বলল, থাক, চা-টা এসে গেছে। অনেক পরচর্চা হয়েছে, এবার চা খেয়ে যে যার মতো কেটে পড়ি চলো।
হৈমন্তী বলল, এই চায়ের পয়সাটা কিন্তু আমি দেব।… বিজিতদা, বিস্কুট দিতে বলি?
না না, শুধু চায়ের কোনও বিকল্প নেই। যেমন আমাদের দিব্যরও কোনও বিকল্প নেই।
রমানাথ ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছে। চোখে পড়তেই বিজিতের মুখ হাসিতে ভরে গেল। বলল, আহা, চটে যাচ্ছ কেন? দিব্য স্বর্গ থেকে খসে পড়া দেবতা, এ-কথা তো আমি বলছি না। দোষ তো তার ছিলই। চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও আছে।… এই যে হৈমন্তী বলল, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দিব্যর খুব মাখামাখি, এটাও ভুল কথা নয়। ভাল করে পড়াতে পারুক না-পারুক স্টুডেন্টদের সঙ্গে ও জমে যেতে পারে। এক্স স্টুডেন্টরা তো এখনও দিব্যদা দিব্যদা করে পাগল। তার মানে নিশ্চয়ই এর পেছনে দিব্যর কোনও প্লাস পয়েন্ট আছে! সাম পজিটিভ কোয়ালিটি!
তা তো বটেই। স্টুডেন্টদের নিয়ে মালের আসর বসালে পপুলারিটি তো বাড়বেই।
রামখেলাওন বেরিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বিজিত বলল, দ্যাখো রমা, জীবনের সবক্ষেত্রেই দুয়ে দুয়ে চার কোরো না। তোমরা… তোমরা কেন, আমিও… আমাদের স্টুডেন্টদের বোধহয় ঠিক এস্টিমেট করি না। ভাবি, দু’-চারটে চিপ স্টান্ট দিলেই তাদের ওপর কন্ট্রোল নেওয়া যায়। ধারণাটা কিন্তু মোটেই সঠিক নয়। ওদেরও কিন্তু একটা থার্ড আই থাকে। সেই চোখ দিয়ে ওরা বুঝে নেয়, কোন স্যার অ্যাট হার্ট ভাল, কার ভেতরটা ফাঁপা। এখন তো দিব্য পড়ায় না, তবু পুরনো ছেলেমেয়েরা যে দিব্যজ্যোতির কাছে ছুটে ছুটে যায়, এটাকে তুমি কীভাবে এক্সপ্লেন করবে? নিশ্চয়ই তারা দিব্যর মধ্যে কিছু পায়।
কী পায়? ছবি বিক্রির ফন্দিফিকির? নাকি ইন্সপিরেশন?
তা জানি না। তবে কিছু একটা তো পায়ই।… আমাদের কথাই ধরো না। দিব্য তার সহকর্মীদের জন্য চিন্তাভাবনা করত, এটা তো মানবে। শ্যামাপদ এক বছরের ছুটি নিয়ে প্যারিস গেল, সেই লিভটা নিয়ে তো পরে বিস্তর কমপ্লিকেশন হয়েছিল। ডি পি আই অফিসে দৌড়োদৌড়ি করে দিব্যই তো ক্লিয়ার করেছিল কেসটা।… তারপর… দু’সপ্তাহের মধ্যে হিমাংশুর পাসপোর্টটা করিয়ে দিল।
ওর অনেক কানেকশনস, তাই করতে পেরেছে। অসুবিধেয় পড়ে কেউ রিকোয়েস্ট ফিকোয়েস্ট করলে ও ক্ষমতাটা দেখিয়ে দিত। আর যতটা করত, তার চেয়ে ঢের বেশি শোনাত
তবু… করেই বা ক’জন?… তোমরা যে যাই বলো, দিব্যকে আমরা সত্যিই খুব মিস করি। ভাবতে খারাপ লাগে, ওরকম একটা লাইভলি ছেলে… স্টাফরুমটাকে জমিয়ে রাখত… হা হা হাসছে, গলা ছেড়ে গান গাইছে… বেচারার যে কী হল!
এবারটা বোধহয় সামলে গেছে। রমানাথ উঠে দাঁড়াল। ব্যাগ কাঁধে তুলে বলল, আমি ওর অ্যাডমায়ারার নই, তবু আমি বলব থ্যাঙ্ক গড়, তেমন সিরিয়াস কিছু হয়নি।
তুমি গেছিলে দেখতে?
হসপিটালে ভিড় করতে ভাল লাগে না। বাড়ি ফিরেছে, ভাবছি এবার একদিন যাব। তবে মোহিত অনন্তরা তো গেছিল। হৈমন্তীও তো…। দিব্যর স্পিচ এখন নরমাল না?
শুধু নরমাল! খুব বেশি বকবক করছে। হৈমন্তী চোখ ঘোরাল, যত চুপ করতে বলি, তত কথা বেড়ে যায়।… দেখলি তো হৈমন্তী, আমি কেমন যমেরও অরুচি! বিধাতা বলে দিয়েছেন, যদ্দিন না তোমার মর্তের মিশন ফুলফিল হচ্ছে, এদিকে নো এন্ট্রি!
বিজিত বলল, তা হলে আমিও একদিন ঘুরে আসব। নার্সিংহোমে তো হয়ে উঠল না, নিজেই জ্বরে পড়ে গেলাম।
যান না। কলেজের কাউকে দেখলে খুব খুশি হয়। সেদিন তো আপনার কথা জিজ্ঞেসও করছিল। মাথা একদম ক্লিয়ার, আপনার রিটায়ারমেন্টের ডেটটাও মনে আছে।
পরমেশও উঠে পড়েছে। হাতে ফোলিও ব্যাগখানা ঝুলিয়ে বলল, আমি যেদিন নার্সিংহোমে গিয়েছিলাম, সেদিন তো খুব ভিড়। তার মধ্যেও হেসে হেসে…। আমাদের প্রিন্সিপাল সাহেবকে তো রীতিমতো লেগপুল করছিল।
বনানীর চোখ বড় বড়, মৃগাঙ্কদা গিয়েছিলেন?
ইয়েস ম্যাম। রমানাথ ফুট কাটল, দিব্য এমনই চিজ, যাকে সে যাঁতা দেবে, সেও অসুখের সময়ে তাকে দেখতে যাবে।
যাহ্, তুমি না…! পরমেশ হালকা ধমক দিল, আফটার অল ওরা পুরনো বন্ধু…। বলতে বলতে বিজিতকে ডাকছে, কী দাদা, যাবেন তো এবার?
তোমরা এগোও। আমি একটু বাথরুম ঘুরে আসছি।
বনানী বলল, চল হৈমন্তী, আমরাও বেরোই। তুই গাড়ি এনেছিস তো?
হ্যাঁ। কেন?
তুই তো গল্ফ গ্রিনে ফিরবি, আমায় একটু রাসবিহারীতে নামিয়ে দিস, প্লিজ।
নো প্রবলেম।
স্টাফরুমের বাইরে করিডোরটা বেশ অন্ধকার অন্ধকার। পার হয়ে নীচে নামল চার শিক্ষক-শিক্ষিকা। গেটের দিকে এগোতে এগোতে রমানাথ বলল, বিজিতদা তো দিব্যকে একটু বেশিই স্নেহ করেন, তাই মুখের ওপর বলা গেল না। ছেলেমেয়েরা দিব্যর অনুগত একটিই কারণে, তারা কখনও দিব্যর স্বরূপটা দেখতে পায়নি।
তা অবশ্য অনেকটাই টু। পরমেশ একটা সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে বলল, দিব্যজ্যোতি সিংহ সাংঘাতিক ইমেজ কনশাস। এবং ইমেজটাকে ও টিকিয়েও রাখতে জানে। ওর অ্যাপারেন্টলি বোহেমিয়াম চালচলন দেখে স্টুডেন্টদের পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়, তাদের প্রিয় স্যারের কীরকম একটা ক্যালকুলেটিভ মাইন্ডও রয়েছে। একমাত্র যারা ওর সঙ্গে কাজ করেছে, তারাই ওটা হাড়ে হাড়ে জানে। আমার লাইফের সেকেন্ড… না না, থার্ড এগজিবিশন আমরা করেছিলাম তিনজন। দিব্যজ্যোতি, শতরূপা আর আমি। কথা হয়েছিল, দশ থেকে পনেরোর মধ্যে আমাদের ছবির দাম থাকবে। দিব্য স্রেফ আন্ডারকাট করে নিজের সাতখানা ছবি বেচে দিয়েছিল। আট-সাত যে-দামে পেরেছে ঝেড়েছে। সে কী সিন, ওর ছবিতে টুপটুপ লাল টিপ পড়ছে, এদিকে আমি আর শতরূপা বসে বসে আঙুল চুষছি!
রমানাথ হেসে বলল, প্রয়োজনে আন্ডারকাট তো সবাই করে। খুঁজে দ্যাখো, হুসেনও ফার্স্ট লাইফে করেছেন।
সে তো ভাই আমিও করেছি। ঠেকে শিখে। কিন্তু যাদের সঙ্গে এগজিবিশন করছি, তাদের কাছে লুকোছাপা করে নয়। ওই ধরনের ডিজঅনেস্টি করতে একমাত্র দিব্যজ্যোতিই পারে।
হৈমন্তী হাসতে হাসতে বলল, ওই দোষ দিব্যদার এখনও যায়নি। এখন অবশ্য আর একটা ট্যাকটিক্সও খেলে। গ্যালারির সঙ্গে যোগসাজশে দামটা চড়িয়ে রাখে। মিডিয়ার সঙ্গেও ভাল র্যাপো আছে, তাদের দিয়েও একটা হাইপ তুলে দেয়। অবশ্য এ দোষে দিব্যদা একাই দোষী নয়, আরও অনেকেই আছেন। তবে দিব্যদার পাবলিসিটিটা অনেকের চেয়েই বেশি। আই মিন, অতটা বোধহয় দিব্যদা ডিজার্ভও করে না।
অ্যাজ এ পেন্টার, দিব্যদা তত বড় মাপের নয়ও। গত পাঁচ-সাত বছরে কী এমন স্পেশাল কাজ করেছে? সাবজেক্ট তো অলমোস্ট সেম, কালার যা একটু-আধটু বদলাচ্ছে। লাইনগুলোও সব এক ধাঁচে।
তা অবশ্য আমি বলব না। ভ্যারিয়েশনের চেষ্টা দিব্যজ্যোতি কিন্তু করছে। লাস্ট এগজিবিশনটা তো বেশ স্টার্টলিং ছিল। ওপেনিংয়ের দিন ডেকেছিল, গিয়ে দেখেছি। গিমিকটা অনেক কম। বোধহয় ওই সুবর্ণলতা খোলার পর থেকে একটা হিউম্যান পয়েন্ট ওর মধ্যে জেগে উঠছে।
হবে হয়তো। তবে সুবর্ণলতা দেখিয়ে আমাদের কিন্তু খুব টুপি পরিয়েছিল।… তোর মনে আছে হৈমন্তী, দিব্যদা কেমন জোরজার করে আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল?… একটা মহৎ কাজ হবে, হেল্প করাটা তো তোমাদের মরাল ডিউটি…! পরে জানা গেল, দিব্যদা তার দিদিমার রেখে যাওয়া একটা মোটা টাকা পেয়েছিল ওই কাজের জন্য!
এখন তো শুনছি, গর্ভনমেন্ট থেকেও এড পাচ্ছে। ফরেন থেকেও মোটা ফান্ড আসে।
দিব্যজ্যোতি শাহেনশা লোক, ভাই। স্টার্ট যখন করেছে, সুবর্ণলতাকে ঠিক ঘ্যাম কিছু করে ছাড়বে। যত রকম কানেকশন আছে, সব ইউজ করবে। দেখলে না, পার্টির থ্র দিয়ে কতগুলো জায়গায় ম্যুরাল বানাল! রবীন্দ্র ভবন, নজরুল ভবন, সুকান্ত ভবন— ম্যুরাল বাই দিব্যজ্যোতি সিংহ! সেরিব্রালটা হয়ে ব্যাটা একটু দ-এ পড়ে গেল। খাড়া হতে পারলেই আবার ঠিক খেল শুরু করে দেবে।
বিজিত এসে পড়েছে। বিজিতের গাড়িতে উঠে গেল রমানাথ আর পরমেশ, তিনজনই উত্তরে যাবে। বনানী আর হৈমন্তী এগোল কম্পাউন্ডের শেষ প্রান্তে রাখা লাল মারুতিটার দিকে।
পিছনের সিটে বসে হৈমন্তী শরীর ছেড়ে দিয়েছে। বনানীও পাশে চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর ফুরফুরে হাওয়ায় দু’জনেই যেন দিনের ক্লান্তি তাড়াচ্ছে।
হঠাৎই হৈমন্তী বলল, আজ দিব্যদার বড় বেশি কুচ্ছো গাওয়া হল। তাই না?
বনানী উদাস গলায় বলল, যা সত্যি তাই তো বলা হয়েছে। তাও তো দিব্যদার আসল ভাইসটার কথা ওঠেনি।
নারীদোষ?
আর কী! কত মেয়েকে নিয়ে যে শুয়েছে!
তারা শুত কেন? গ্রিন সিগনাল না পেলে দিব্যদা কখনও কোনও মেয়ের দিকে এগোত না, আমি হলফ করে বলতে পারি। আমাদের সঙ্গে তো এত ক্লোজ, একবারও আমাদের কোনও অশালীন ইঙ্গিত দিয়েছে? যা রটেছে, তার অনেকটাই রং চড়ানো। দিব্যদাকে তো কম লোক হিংসে করে না, তারই…। এই রমাদা টমাদারাই তো দিব্যদা সম্পর্কে ভয়ংকর জেলাস।
মানছি। তা বলে দিব্যদাকে এক্কেবারে ক্লিন চিট দিস না। বউ তো এমনি এমনি কণাদ বসুর সঙ্গে ভাগেনি।
পৃথার ওপর কিন্তু দিব্যদার ভয়ংকর উইকনেস ছিল। তুই তখনও জয়েন করিসনি, জানিস না, যেদিন ফাইনাল ডিভোর্সটা হয়ে গেল, কলেজে এসে দিব্যদার সে কী হাউমাউ কান্না! পৃথা আর আমার রইল না… পৃথা আমার জীবন থেকে একেবারে চলে গেল…!
বনানী চোখ টিপল, কুমিরের কান্না নয় তো? আমি কিন্তু আসার পর দেখেছি, পারমিতা বলে মেয়েটাকে নিয়ে খুব লাট খাচ্ছে।
হৈমন্তী হাসল, মন বড় আজব চিজ রে ভাই! হয়তো কান্নাটাও সত্যি, পারমিতাও। কিংবা হয়তো দুটোই মিথ্যে। কে জানে!