আয়নামহল – ৭

সাত

ঘুলঘুলিতে এক জোড়া চড়ুইপাখি বাসা বেঁধেছে ইদানীং। ভোরবেলা খানিক কিচির মিচির করে দুটিতে কোথায় যেন বেরিয়ে পড়ে। ফেরে সেই দুপুরে, বাড়ি যখন প্রায় নিঝুম, ওপাশে মীরার ঘর থেকে ভেসে আসা টেলিভিশনের আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যখন থমকে থাকে দিব্যজ্যোতির চৌকাঠের ওপারে কিংবা ঢোকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে, শব্দের রেণু হয়ে। চড়ুইদম্পতির তখন মহা আনন্দের সময়। অনন্ত খুনসুটি চলে তাদের। ঝাপটাঝাপটি করছে, এ ওকে তাড়া করছে, ও তাকে ধাওয়া করছে, হঠাৎই যুগলে চলে গেল বাসায়, প্রেমালাপ সারতে সারতে দিব্যজ্যোতির ঘরময় ছড়িয়ে দিচ্ছে কাঠিকুঠি। গৃহস্বামীর উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে কখনও বা ঝুপঝুপ নেমে পড়ে লাল মেঝেতে। চলে তুডুক তুডুক লাফ, যেন এক্কা-দোক্কা খেলছে।

পুচকে পাখি দুটোকে নিয়ে দুপুরটা বেশ কাটে দিব্যজ্যোতির। এই সময়টায় ঘরে সে একাই। সেন্টারের নার্স মেয়েটা দুপুরে মা’র ঘরে থাকে, বিছানায় কলিংবেলের বন্দোবস্ত করা হয়েছে, বাজালেই সে চলে আসে ঝটপট। তবে দিব্যজ্যোতি তাকে ডাকে না বড় একটা, দ্বিপ্রাহরিক নির্জনতা একা একা উপভোগ করে তারিয়ে তারিয়ে। ঘুমোয় না, ভাতঘুমে চোখ জড়িয়ে এলে জোর করে ছিঁড়ে ফেলে তন্দ্রা, একদৃষ্টে দেখতে থাকে দুই চড়ুইয়ের কার্যকলাপ। মজা পায় খুব, আপন মনে হাসে মিটিমিটি। মাঝে মাঝে কথাও বলে তাদের সঙ্গে। কী রে, কী খেলি আজ তোরা? দানাটানা কিছু জুটল, নাকি শুধুই এঁটোকাঁটা? আজ গেছিলি কদ্দূর? একসঙ্গেই ছিলি। নাকি আলাদা আলাদা? চড়ুই দুটো তখন চোখের পাতা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে দেখে তাকে, তারপর মৃদু হুইল বাজিয়ে পিড়িং উড়ে যায়।

আজ দুই চড়ুইয়ের দর্শন নেই এখনও। বুকের ওপর একখানা কবিতার বই খুলে ঘুলঘুলিটার দিকে ঘনঘন তাকাচ্ছিল দিব্যজ্যোতি। বুঝি-বা একটু অসহিষ্ণু বোধ করছিল। গেল কোথায়? বেশি দূরে পাড়ি দিল কি?

দরজায় মীরা, এ কী, বলে দিলাম তাও অঞ্জলি জানালগুলো বন্ধ করেনি!

দিব্যজ্যোতি বই বুকের ওপর রাখল, করছিল, আমিই বারণ করেছি।

আজ বাইরে এত তাত, হাওয়াটাও গরম গরম…

আমার খারাপ লাগছে না।

তবু…

তোমার গরমের বাতিক আছে। ফাল্গুনের সমীরণে নাকি তাত! ফুঃ। জানলা বন্ধ রাখলে আমার দম আটকে আসে। দিব্যজ্যোতি ঠোঁট ছুঁচোল করল, তা তুমি হঠাৎ টিভি ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ যে বড়?

আমার টিভি দেখা তো সময় কাটানো। জানিসই তো, আমার কোনও সিরিয়াল টিরিয়ালের নেশা নেই।

এবারে হয়ে যাবে। যা একখানা নার্স আমদানি করেছ, নেশা ধরিয়ে তবে ছাড়বে।

মীরা আলগা হাসলেন। তাঁর চেহারায় এক ধরনের ব্যক্তিত্ব আছে, হাসিতেও। সত্তরে পৌঁছেও তাঁর দেহযষ্টি এখনও টানটান, সাধারণ বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তিনি অনেকটাই লম্বা, স্বাস্থ্যটিও তারিফ করার মতো, চোখমুখও বলে দেয় এককালে মীরা মোটামুটি সুন্দরীই ছিলেন। কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার অভ্যেসটিও তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়।

ঘরে ঢুকে বেতের আরামকেদারাটায় বসেছেন মীরা। নরম গলায় বললেন, না রে। আমি তো ভাবছি তোর আর একটু উন্নতি হলেই আবার বিকেলে বেরোনো শুরু করব।

সেই মিশনে গিয়ে দল বেঁধে কথামৃত শোনা?

কতরকম লেকচারও তো হয়। জ্ঞান বাড়ে, মনটা ভাল থাকে…

ফালতু সময় নষ্ট করা। তোমাকে তো বারবার বলেছি, এখনও শক্তপোক্ত আছ, স্ট্রেট সোনামাটি চলে যাও। দিব্যি ওখানে সবার মাথার ওপরে থাকবে, কল্পনাদেরও গাইড টাইড করবে… ওদের কাজকর্মের ওপর ডে টু ডে ওয়াচ রাখাও তো দরকার।

আমি তোর হয়ে ওখানে পাহারাদারি করতে যাব?

বাঁকাভাবে নাও কেন? প্রতিষ্ঠানটা তো তোমারই মা’র নামে, তুমিই না হয় তার দায়িত্ব নিলে!

সুবর্ণলতা তৈরির জন্য যখন মা’র টাকাটা আমার কাছ থেকে নিয়ে নিলি, তখন তো এই প্রস্তাবটা দিসনি! কল্পনার ওপরই তো তোর তখন বেশি আস্থা ছিল। এখন কি ভরসা টলে গেছে?

দিব্যজ্যোতি চুপ করে গেল। এই মহিলার সঙ্গে সে কোনও কালেই কথায় পেরে ওঠে না। মা কঠোর, না কোমল, তাই সে আজও বুঝে উঠতে পারল না।

মীরা ফের হেসে বললেন, কেন আমায় আর ওসবে জড়াবি? তোর কাজ তুই কর। আমি এখানে বেশ আছি।

দিব্যজ্যোতি আস্তে আস্তে উঠে বসল। সময় নিয়ে। চড়ুই দম্পতি ফিরেছে আস্তানায়, শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। একটুক্ষণ স্থির থেকে শুনল তাদের কিচিরমিচির। তারপর হঠাৎই জিজ্ঞেস করল, রুনি কোথায়? ঘুমোচ্ছে?

নাহ্, বেরোল এইমাত্র। দরজা লাগিয়েই তো আসছি।

কোথায় গেল?

বলল তো কীসব কেনাকাটা আছে।

রুনি কি এখানে শপিং করতে এসেছে নাকি? আসার পর থেকেই তো শুনছি বেরিয়ে যাচ্ছে, আর বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে একটু বসার সময়ই হয় না!

তুই কী এক্সপেক্ট করেছিলি? মীরার ভুরুতে ভাঁজ, এসেই তোর সেবাশুশ্রূষা আরম্ভ করে দেবে?

দিব্যজ্যোতি সিংহ কারও সেবার প্রত্যাশী নয়, মা। তবে আমায় দেখতে কলকাতায় এল, দু’-চার মিনিট বসে গল্পও তো করতে পারে!

আসে তো। বসেও তো। আজ সকালেই তো তোর প্রেশার চেক করল।

দিব্যজ্যোতি একটা অদ্ভুত মুখভঙ্গি করল। কৌতুক আর তাচ্ছিল্য মেশানো। হালকা গলায় বলল, মহারানিকে বোলো ফিরে যেন আমার সঙ্গে একবার দেখা করে। ওকে একটা কাজ দেব।

কী কাজ?

আছে।

ওর কিন্তু আজ ফিরতে রাত হবে। সল্টলেকে নেমন্তন্ন আছে।

নেমন্তন্ন খেয়ে বেড়াচ্ছে কলকাতায়? কার বাড়ি যাবে আজ?

ওই যে ডাক্তার ছেলেটা… রুনির সঙ্গে এসেছে।

দিব্যজ্যোতি ঝটকা খেল একটু। চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, সোহম?

হ্যাঁ। রুনি তো সোহমই বলল।

সোহম… রুনির সঙ্গে কলকাতায় এসেছে? রুনি আমায় বলেনি তো?

মীরা প্রশ্নটার জবাব দিলেন না। ছেলের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, সোহম রুনিকে বিয়ে করতে চায়। ধীরা বলছিল।

অ।

আবার একটু সময় নিয়ে মীরা বললেন, রুনিরও বোধহয় অমত নেই। দিব্যজ্যোতি জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেরি গুড। ওয়াইজ ডিসিশন।

ভাল তো বটেই। কী-ই যে বিয়ে করবে না বলে ধনুর্ভাঙা পণ করে বসে ছিল! কত সুন্দর সুন্দর সম্বন্ধ এসেছে, সব নাকচ। … এতদিনে তাও মতি ফিরছে।

হুম।

তুমি আর ওর মাথার পোকা নাড়িও না। এবার ওকে শান্তিতে ঘরকন্না করতে দাও।

আমি কবে কার হাত পা বেঁধে রাখলাম? দিব্যজ্যোতি বেশ জোরেই হেসে উঠল। তার মুখ এখনও একশো ভাগ স্বাভাবিক হয়নি, হাসিটা তাই ঈষৎ বিকৃত দেখাল যেন। বাঁ হাতখানা দুলিয়ে বলল, সব কিছু তো বহুকাল আগেই চুকেবুকে গেছে মা। রুনি যদি এখনও বিয়ে না-করে থাকে সেটা রুনির প্রবলেম, আমার নয়।

থাক। কাদা ঘাঁটতে আমার আর ভাল লাগে না। মীরা একটুখানি দম নিয়ে বললেন, একটাই শুধু আফশোস, পৃথার মতো মেয়েকে এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। একটা দিনের জন্যও সে এখানে সুখ পায়নি।

দ্যাখো, নিজেই কিন্তু কাদা ঘাঁটা শুরু করলে। ছাড়ো না পুরনো কথা ভুলে যাও। দিব্যজ্যোতি খাটের বাজুতে হেলান দিল। পাশবালিশটা কোলে টেনে নিয়ে বলল, সুখ জিনিসটা তো যার যার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, মা। কেউ ভাবে, যেমন আছি তাতেই সুখ। কেউ জীবনভর কোথায় সুখ, কোথায় সুখ বলে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। আবার কেউ-বা মনে করে, সুখ মানুষের জন্য নয়, ওটা একটা সাবহিউম্যান অনুভূতি। যাদের বোধটোধ কম, আই মিন যারা ভোঁতা টাইপ, তারাই শুধু সুখ সুখ করে কাতর হয়। পৃথা এর মধ্যে একটা ক্লাসে বিলং করে, আমি আর একটা ক্লাসে। এই নিয়ে হা-হুতাশ করার কোনও মানেই হয় না।… আর একটা কথাও মাথায় রেখো, মানুষ বেঁচে থাকে তার কাজে। সুখ কোনও কাজের মধ্যে পড়ে না।

মীরা গম্ভীর মুখে বললেন, এটা তো তোমার ব্যাখ্যা।

আমি তো আমার ব্যাখ্যাই দেব। দিব্যজ্যোতি ফের হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, বাব্বা, বকতে বকতে গলা শুকিয়ে গেল, একটু চা খাওয়াবে? অঞ্জলিকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও না।

অপ্রসন্ন স্বরে মীরা বললেন, আমি এখন চলে গেলেই বুঝি তুই খুশি হোস?

ঠিক ধরেছ। আমি এখন একটু একা থাকাই প্রেফার করব।

কিন্তু একা থাকা আজ দিব্যজ্যোতির কপালে নেই, মীরা উঠে যাওয়ার পরে পরেই কলিংবেল বেজে উঠেছে। দুই আগন্তুক দেখতে এসেছে দিব্যজ্যোতিকে। সোনামাটির শ্যামল গুছাইত আর প্রবীর মান্না।

.

সন্ধে নেমেছে। ঘুলঘুলিতে ঘুমিয়ে পড়েছে চড়ুই দম্পতি। দিব্যজ্যোতি ও চোখ বুজে শুয়ে ছিল। শ্যামল গুছাইত আর প্রবীর মান্না থাকতে থাকতেই এসে পড়ল ফিজিওথেরাপিস্ট। শারীরিক কসরত সেরে দিব্যজ্যোতি এখন রীতিমতো ক্লান্ত। তবে শ্যামলরা খানিক উজ্জীবিতও করে গেছে তাকে। নলকূপ নাকি সামনের সপ্তাহেই বসে যাবে। আর একটি সুসংবাদ, জেলা সভাধিপতির নির্দেশক্রমে আশপাশের আরও বেশ কয়েকটি গ্রামে সুবর্ণলতার জন্য প্রচার চালাবে পঞ্চায়েত। কথায় কথায় প্রবীর এও জানাল, পার্টির রাজ্য সম্পাদকও নাকি দিব্যজ্যোতির শরীরস্বাস্থ্যের ব্যাপারে যথেষ্ট উদবিগ্ন। প্রবীররা আজ যখন পার্টির রাজ্য দপ্তরে গিয়েছিল, তিনি নিজে নাকি বেরিয়ে এসে খবরাখবর নিয়েছেন, দিব্যজ্যোতির।

এ ধরনের সংবাদে প্রাণিত হওয়ারই তো কথা। শুয়ে শুয়েই দিব্যজ্যোতি ভাবছিল, কবে নাগাদ সে আবার সোনামাটিতে যেতে পারবে। ডান হাত এখন অনেকটাই নাড়াচাড়া করতে পারে, লাঠি ধরে ধরে বাথরুমেও যায়। তবু সাহায্য একটা লাগে এখনও। যতই শান্তি আসুক, ফিজিওথেরাপিটা চালিয়ে তাড়াতাড়ি সেরে উঠতেই হবে। বাঁ হাতে লেখার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে, চেক ফেকও তো সই করা দরকার, মা নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে আর কত তুলে যাবে? আজকালের মধ্যে সুখেন আসবে মাল নিয়ে, তার হাত দিয়ে নগদ কিছু পাঠাতে হবে সুবর্ণলতায়। ওখানে সকলের মাইনেকড়ির ব্যাপার আছে, তা ছাড়া প্রাত্যহিক খরচখরচা… দিব্যজ্যোতি অসুস্থ বলে ওরা হয়তো মুখ ফুটে চাইছে না, কিন্তু অসুবিধে তো হচ্ছেই। চিত্রমালা আর্ট গ্যালারি থেকে একটা পেমেন্ট পাওয়ার কথা ছিল, তাড়া লাগাবে টেলিফোনে? চেক না হয় পরেই হবে, আপাতত ক্যাশটা তো দিয়ে যাক। ধুস, এভাবে চলে নাকি? ব্যাঙ্কে কথা বলতেই হবে। সাময়িকভাবে অক্ষম বা অসুস্থ মানুষদের জন্য তাদের কি কোনও ব্যবস্থা নেই? টিপসইতে টাকা তোলা? পেনশনও তো ওঠানো হয়নি! সিঙ্গল অ্যাকাউন্টটা যদি মা’র সঙ্গে জয়েন্ট করে ফেলা যায়…? তিন সপ্তাহ ধরে মা যে খরচটা টেনে যাচ্ছে, সেটাও তো ফেরত দেওয়া উচিত।

অঞ্জলি ডাকছে, দাদা, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

চোখ খুলল দিব্যজ্যোতি। কালোপানা দাঁতউঁচু অঞ্জলির দিকে তাকিয়েই ফের বুজে ফেলেছে।

বিকেলের ছানাটা তো খাওয়া হয়নি, এখন দিই?

থাক। তুমি বরং একটা কাজ করো। টেবিল থেকে বোর্ডটা এনে দাও।

সবে একটা ব্যায়াম হল, এখনই ছবি আঁকবেন?

আহ্, যা বলছি করো। সঙ্গে স্কেচ পেনসিলগুলোও আনবে।

দিব্যজ্যোতির কড়া গলাকে ভয়ই পায় অঞ্জলি। ঝটপট বোর্ড আর পেনসিল এগিয়ে দিয়েছে। বিছানায় বোর্ডটাকে শুইয়ে কাগজে রেখা টানছে দিব্যজ্যোতি। হচ্ছে না, হচ্ছে না। দাঁড়িয়ে আঁকা অভ্যেস, সামনে খাড়া থাকে ক্যানভাস, চলে ডান হাত— একসঙ্গে এতগুলো কি বদলানো সম্ভব? একটা টানও নিয়ন্ত্রণে থাকছে না দিব্যজ্যোতির, এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। যা চাইছে, কিছুতেই হচ্ছে না। তবু পারতে তো হবেই। পারতেই হবে। ডান হাত কবে চলবে, তার আশায় তো বসে থাকা যায় না!

মিনিট পাঁচেক আঁকিবুকি টেনে দিব্যজ্যোতির গলদঘর্ম দশা। মাথা টিপটিপ করছে। পাশে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করছিল অঞ্জলি, বলল, এবার থাক না, দাদা। আবার নয় কাল সকালে…

হুম। লাঠিটা দাও, বাথরুমে যাব।

শরীর কিন্তু কাঁপছে। পারবেন তো?

দেখি চেষ্টা করে। নইলে তুমি তো আছ।

লাঠি শক্ত করে ধরে বিছানা থেকে নামল দিব্যজ্যোতি। জোর কম, তবু বাঁ হাতে ভর দিতে হচ্ছে, টাল খেয়ে যাচ্ছে দেহ। তবে কয়েক দিনে মোটামুটি রপ্ত হয়ে এসেছে। ডান পা টেনে টেনে পৌঁছোল বাথরুমে ওফ্, এইটুকু রাস্তাও যে কখনও কখনও এত লম্বা মনে হয়!

দিব্যজ্যোতি বেরিয়ে দেখল বিভাস এসেছে। রোজকার মতোই পরিপাটি পোশাকআশাক, নিখুঁত কামানো গাল, সযত্নচর্চিত চুল। সাজসজ্জায় কখনই বিশৃঙ্খল থাকে না ঝুমির বর। ঈষৎ ঝুঁকে খাটে পড়ে থাকা ড্রয়িংবোর্ডটা নিরীক্ষণ করছিল বিভাস, দিব্যজ্যোতিকে দেখামাত্র সসম্ভ্রমে সরে গেল দু’ পা। দিব্যজ্যোতি বিছানায় ফের থিতু না-হওয়া পর্যন্ত সে কথা বলবে না। তার সহবতে বাধে।

টানা তিন মিনিট সতেরো সেকেন্ড অপেক্ষা করে বিভাস গলা ঝাড়ল, আপনার ওয়াকিংটা কিন্তু মারজিনালি বেটার হয়েছে দিব্যদা।

একটু একটু হাঁপাচ্ছিল দিব্যজ্যোতি। ফুসফুসে খানিকটা বাতাস ভরে বলল, তুমি কি সোজা অফিস থেকে?

হ্যাঁ। তিন দিন থাকব না। অফিসট্যুর। ভাইজ্যাগ। তাই দেখা করতে এলাম।

ডিউটি পালন করে যাচ্ছ, অ্যাঁ?

ডিউটিটা হেলাফেলার জিনিস নয়, দিব্যদা। আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজেদের কর্তব্য ঠিকঠাক করি, তা হলেই তো পৃথিবীর অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

তোমার অফিস স্টাফদের জন্য তৈরি করা লেকচার তুমি আমার ওপর ঝাড়ছ?… ভারী ভারী কথা না বলে বসো।

থ্যাঙ্কস।

টেবিলের সামনে থেকে চেয়ারটা টেনে বসেছে বিভাস। টানটান হয়ে। দিব্যজ্যোতি জিজ্ঞেস করল, ঝুনি কি আসবে আজ?

কাল আসবে। মিমলিকে নিয়ে। কৃত্তিকার আজ স্লিমিং সেন্টারে যাওয়ার দিন।

ঝুনিটা পারেও বটে। দিব্যজ্যোতি মৃদু হাসল, গায়ে একটু চর্বি লেগেছে, কি লাগেনি, ওমনি ছুটল রোগা হতে!

এক্সসেস ফ্যাট ঝরিয়ে ফেলাই ভাল। অযথা কমপ্লিকেশনস ডেভেলাপ করে না।

বিভাসের উপযুক্ত সংলাপই বটে। জীবনে নির্মেদ থাকাটাই বুঝি বিভাসের মূল লক্ষ্য। আচারআচরণ, আলাপচারিতা, সবই তার মাপাজোপা। বিভাসের সঙ্গে আড্ডা চালিয়ে যাওয়া দিব্যজ্যোতির মতো মানষের পক্ষে বেশ কঠিন। তবে এই নীরস রক্তশূন্য ব্যবহার দিব্যজ্যোতি যতই অপছন্দ করুক, এই গুণটিকে সম্বল করেই তো অফিসে তরতর সিঁড়ি ভাঙছে বিভাস! এবং ঝুনির মতো চপলমতি মেয়েও দিব্যি তার সঙ্গে ঘর করে যাচ্ছে!

দিব্যজ্যোতি বালিশে হেলান দিল। অঞ্জলিকে বলল, মাকে গিয়ে খবর দাও, বিভাস সাহেব এসেছেন।

শ্লেষটা বুঝল না বিভাস। ব্যস্ত গলায় বলল, যেতে হবে না। আমার বড়মাসির সঙ্গে দেখা হয়েছে।

দিদি শুনলাম বেরিয়েছেন….

কে দিদি?

রোহিণীদি।

অ।

দিদি তো রবিবার চলে যাচ্ছেন… কৃত্তিকা বলছিল, শনিবার রাতে ওঁকে খেতে ডাকবে… আমিও শুক্রবার ফিরে আসছি…

অ।

দিদির সঙ্গে তো এখনও আমার দেখাই হল না!

আবার একটা অ উচ্চারণ করার আগেই ঘরে মীরা। জামাইয়ের জন্য চা-জলখাবার এনেছেন। উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর হাত থেকে ট্রে-খানা নিল বিভাস, টেবিলে রাখল। খাবারের পরিমাণ দেখে হাঁ হাঁ করল যথারীতি, তারপর খেতেও লাগল টুকটুক। গোটা চারেক ফ্রেঞ্চটোস্ট, সন্দেশ, চানাচুর…। প্লেটটাকেও বুঝি সে নির্মেদ রাখতে চায়!

টুকটাক কথা বলে মীরা বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরে হঠাৎই অখণ্ড নীরবতা। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বিভাস, কথা খুঁজছে বোধহয়। আচমকা দেওয়ালে টাঙানো দিব্যজ্যোতির আঁকা একটা ছবি দেখিয়ে বলল, আপনার এই পেন্টিংটা কিন্তু ক্লাসিক।

দিব্যজ্যোতি খুব একটা আমল দিল না। এ-দেওয়ালে, ও-দেওয়ালে, বেশ কয়েকটা শিল্পকর্ম ঝুলছে তার। মাঝে মাঝেই যে-কোনও একটাকে তারিফ করার জন্য বেছে নেয় বিভাস। ছবির কিস্যু বোঝে না, তবু শিষ্টাচারের অঙ্গ হিসেবে মন্তব্য সে করবেই।

হেলাফেলার সুরে দিব্যজ্যোতি বলল, গণেশটার কথা বলছ? ওটা তো ছেলেমানুষি কাজ। সেই কলেজ পাশ করার পর পরই আঁকা। দ্যাখো না কাছে গিয়ে, সালটা লেখা আছে।

দেখেছি আগে। জানি তো… আমার কিন্তু ছবিটাকে বেশ ম্যাচিওরই লাগে। বোঝা যায়, তখন থেকেই আপনি অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্টের দিকে ঝুঁকছেন।

তাই নাকি? তোমার বেশ দূরদৃষ্টি আছে তো! দিব্যজ্যোতি এবার যেন মজা পেয়েছে, তা এই গণেশটার মধ্যে কী বিমূর্ততা দেখলে?

শুঁড়। নরমাল শেপের নয়। ওয়াটার কালারে এঁকেছিলেন, তাই না?

সরি। ঢিলটা লাগল না। ওটা তেলরঙের কাজ।

বিদ্রূপটা গায়েই মাখল না বিভাস। মুচকি হেসে বলল, আপনি তো আবার আঁকা স্টার্ট করে দিয়েছেন দেখছি।

কোথায়! জাস্ট হাতটাকে একটু চালু করার চেষ্টা করছি। ডান হাতে তো পারছি না, তাই বাঁ হাত চালিয়ে চালিয়ে… বলতে পারো, এক ধরনের এক্সারসাইজ।

বাঁ হাতেই এখন কিছুদিন আঁকুন না, নতুন এক্সপেরিমেন্ট হবে।

তুত্, তা হয় নাকি? আঁকতে গেলে রেখার ওপর, তুলির ওপর এবং আঙুলের ওপর পুরো কন্ট্রোল দরকার। শুধু আঙুল কেন, গোটা হাতের ওপরই। প্লাস, মস্তিষ্কের সঙ্গে হাতের একটা মেলবন্ধনেরও ব্যাপার থাকে।

অতশত কে বোঝে, দিব্যদা? আপনার নাম থাকাই তো যথেষ্ট।

মানে?

আপনি একজন বড় শিল্পী। এমনি এমনি তো বড় হননি, প্রচুর খাটতে হয়েছে। সেই পরিশ্রমের ফলেই আজ আপনার নাম, মার্কেট, গুডউইল। আমার তো মনে হয়, আপনার যে-কোনও প্রোডাক্টই এখন বিক্রি হয়ে যাবে।

কী বললে তুমি? কী বললে? প্রোডাক্ট? মার্কেট? গুডউইল? দুম করে গলা চড়ে গেল দিব্যজ্যোতির, আর্টিস্টদের সৃষ্টি শুধুই কমোডিটি? উত্তেজিত হচ্ছেন কেন, দিব্যদা? ছবি তো বিক্রি হয়। লাখ লাখ টাকায়… কোটি কোটি টাকায়…

বটেই তো। তুমি আর এ ছাড়া কী বলবে? তোমাদের হিসেবে তো মানুষ মানে বিশ তিরিশ কেজি মাংস, দু’-তিন কেজি রক্ত, আর কয়েকটা হাড়, নাড়িভুঁড়ি। কিন্তু মানুষ মানে কি তাই? দিব্যজ্যোতি মাথা নাড়ল। গলা নামিয়ে বলল, শোনো বিভাস, শিল্প বিক্রি হয় ঠিকই, কিন্তু বিক্রি হওয়ার জন্যই শিল্প সৃষ্টি হয় না। এনি ফর্ম অফ আর্ট, সে পেন্টিংই হোক, কি গান নাচ সাহিত্য, ক্রিয়েট হয় মনের তাগিদ থেকে। প্যাশনই এর জন্ম দেয়। কত শিল্পী ছবি এঁকেও অন্ধকারে তলিয়ে গেছেন, খবর রাখো? কত শিল্পী নিজের জীবদ্দশায় ছবির কানাকড়িও মূল্য পাননি। অথবা যা পেয়েছেন, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি তাঁদের প্রাপ্য ছিল। বেঁচে থাকতে ভ্যান গখের তো একটা ছবিও বিক্রি হয়নি, তবু কিন্তু তিনি এঁকে গেছেন। কেন? ভবিষ্যতে কোনও একদিন তাঁর নামের গুডউইলে ছবি মার্কেটে কমোডিটি হিসেবে একশো-দুশো কোটি টাকায় বিক্রি হবে, এই আশায়? দিব্যজ্যোতির ঠোঁটের কোণে আস্তে আস্তে একটা হাসি ফুটে উঠল। গলা আরও নামিয়ে বলল, দ্যাখো, আমি ভ্যান গখ নই, পিকাসো নই। অবন ঠাকুর, রামকিঙ্করও নই। আমার লিমিটেশন আমি জানি। আমি একদমই এক মাঝারি মাপের পেন্টার। ছবি বিক্রি হয়ে কিছু টাকা পেলে আমার খুব ভালও লাগে। তবু আমি একজন শিল্পীও তো বটে। যে-ছবি আমার হৃদয় থেকে আসবে না, যে-ছবি আমার ভেতরের অনুভূতিগুলোকে আমার মতো করে ফোটাতে পারবে না, সেই ছবির জন্য আমি তুলি ধরি না বিভাস। নিজেকে ক্রমাগত ভাঙছি, নতুন নতুন ফর্ম খুঁজছি, তা কি শুধুই কিছু টাকা রোজগারের জন্য?

কিন্তু আপনারা তো ছবি মার্কেটিংয়ের জন্য দিচ্ছেন, দিব্যদা। এ-কথাটা তো আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না।

দিচ্ছি। তবে আঁকাটায় আমার কোনও ফাঁকি নেই। হাত চলে না, তবু যা হোক একটা কিছু বানিয়ে দিলাম… সরি, দিব্যজ্যোতি সিংহ তা পারে না।

তর্কের অভিঘাতে দিব্যজ্যোতি ঘেমে গেছে। শ্বাস টানছে জোরে জোরে। বিভাস আরও কিছু বলতে গিয়েও যেন বলল না। কাছে এসে দিব্যজ্যোতির কাঁধে হাত রেখেছে, আমি কিন্তু আপনাকে হার্ট করতে চাইনি, দিব্যদা।

জানি। দিব্যজ্যোতির হাসি মলিন দেখাল, তুমি তোমার ধ্যানধারণা মতো চলেছ। ইটস ও কে। হয়তো আজকালকার হিসেবে খুব একটা ভুলও বলোনি।

আজ তবে আসি?

এসো।

বিভাস চলে যাওয়ার পর দিব্যজ্যোতি শুয়ে পড়ল। নিজে নিজে পারল না, শরীরটা কাঁপছিল, অঞ্জলি শুইয়ে দিল তাকে। মাথাটাও কেমন যেন বিবশ হয়ে আসছে। রাতের নার্স এসে খেতে না-ডাকা পর্যন্ত পাতলা তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল দিব্যজ্যোতি।

রোহিণী ফিরল দশটা নাগাদ। তার খানিক আগে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে দিব্যজ্যোতি, স্নায়ু তখনও শিথিল হয়নি। শুয়ে শুয়ে শুনতে পাচ্ছিল মা’র সঙ্গে কথা বলছে রুনি। হঠাৎ রুনি হেসে উঠল। দিব্যজ্যোতির ঠাকুরদার আমলে তৈরি দোতলা বাড়িখানা গলির ভেতরে, পাড়াটা তাড়াতাড়িই নিস্তব্ধ হয়ে যায়, হাসিটা তাই একটু জোরেই কানে বাজল দিব্যজ্যোতির।

ক্ষণ পরে হালকা পদশব্দ। অচেনা সুগন্ধীর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। রাতবাতির আলোয় রুনিকে দেখতে পেল দিব্যজ্যোতি। বিছানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

কী ব্যাপার? এখনও চোখ খোলা কেন?

ঘুম আসতে একটু সময় লাগে।… আজ মাথাটাও কেমন টিপটিপ করছে।

প্রেশার বাড়ল নাকি?

বুঝতে পারছি না।

রোহিণীকে যেন সামান্য উৎকণ্ঠিত মনে হল। লাগোয়া ঘর থেকে ডাকল রাতের নার্সকে। টিউবলাইট জ্বেলে, প্রেশার মাপার যন্ত্র নিয়ে, টুল টেনে বসেছে। স্টেথো লাগাল কানে।

পারদের ওঠানামা পরীক্ষা করে রোহিণীর ভুরুতে ভাঁজ, সিস্টোলিকটা বেশ বাড়িয়েছ দেখছি!

যাচ্ছে বেড়ে মাঝে মাঝে, কথা শুনছে না। দিব্যজ্যোতি ঈষৎ লঘু স্বরে বলল, তুই তো ডাক্তার, বল কীভাবে শায়েস্তা করা যায়। আলুনি আলুনি খাবার খাচ্ছি, সিগারেট বন্ধ, অ্যালকোহলের প্রশ্নই নেই… আর কী করতে পারি?

তর্ক করাটা কমাও। মিছিমিছি ব্রেনকে এক্সসাইট করছ কেন?

মা বুঝি বিভাসের রিপোর্টটা দিল?

ভালমানুষ পেয়ে বেচারাকে খুব দাবড়াও, অ্যাঁ?

বেচারা? ভালমানুষ?

নয়? ঝুনিকে যে বিয়ে করেছে, সে তো বেচারাই।

আর সোহম? সে কীরকম?

মুহূর্তের জন্য তীব্র দৃষ্টি হানল রোহিণী। বুঝি-বা বিভাস সোহমকে এক পঙ্ক্তিতে বসানো তার পছন্দ হয়নি। পরক্ষণে নির্লিপ্ত মুখে প্রেশার মাপার যন্ত্র গোছাচ্ছে।

দিব্যজ্যোতি জিজ্ঞেস করল, সোহমের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে আলাপ হল?

হুঁ। … বড়মাসি বলছিল তোমার নাকি আমার সঙ্গে কী কাজ আছে? আমার কাজের জন্য তোর সময় হবে? রোববার তো চলে যাচ্ছিস! কাজটা কী?

একবার সোনামাটি ঘুরে আসতিস। সুবর্ণলতায়। জায়গাটা দেখাও হত, ওখানকার মেয়েদের একটু হাইজিন টাইজিন নিয়ে বুঝিয়েও আসতে পারতিস। একে ডাক্তার, তায় মেয়ে, তুই ওদের সঙ্গে ভাল কমিউনিকেট করতে পারবি।

বলছ যখন, যাব। ঘুরে আসব তোমার নতুন খেলাঘর থেকে

দিব্যজ্যোতি যেন নিবে গেল সহসা। রোহিণী লক্ষ করল না, বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে।

প্রকাণ্ড কক্ষে আবার সেই রাতবাতি। আবার সেই আবছায়া। আবার সেই নিজের মুখোমুখি হওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *