তিন
তোয়ালেতে মাথা মুছছিল কণাদ। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিনই তার একবার স্নান করা চাই-ই চাই। পৃথা হাসিঠাট্টা করে মাঝে মাঝে। বলে, বাতিক। তবু অভ্যেসটা কণাদ বদলাতে পারেনি।
চায়ওনি বদলাতে। এই স্নানটুকুতে যে স্বস্তিটা মেলে, তাতেই বুঝি একটা ইট-কাঠ-সিমেন্ট-ইস্পাতের খাঁচা পরিপূর্ণ গৃহ হয়ে ওঠে। নিজস্ব ঘরে ফেরার অনুভূতি জাগে যেন।
লাগোয়া ছোট্ট ব্যালকনিতে ভিজে তোয়ালে মেলে দিয়ে কণাদ শোওয়ার ঘরে এল। হালকা একখানা হাফপাঞ্জাবি চড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে ঘাড় হেলিয়ে দেখল, পৃথা টেবিলে খাবারদাবার সাজিয়ে ফেলেছে।
কণাদ গলা তুলল, আজ রুটি, না ভাত?
পৃথার উত্তর উড়ে এল, রুটির ঝামেলায় কে যাবে, ভাতই করছি।
গুড। আমার মনটাও আজ ভাত ভাত করছিল। ক’দিন ধরে চোরা অম্বল হচ্ছে…
নিশ্চয়ই অফিসে উলটোপালটা খাচ্ছ?
না দিদিমণি। আমাদের সংবাদপত্রের অফিসে তো শুধু মুড়ি চলে। নারকোল আর কাঁচালঙ্কা সহযোগে। মজা করার সুরে বলল কণাদ, আজ অবশ্য দুটো শিঙাড়া খেয়ে ফেলেছি।
তা হলে আর অম্বলের দোষ কী!
হুম। চিরুনি রেখে কণাদ ডাইনিং টেবিলে এসে বলল। এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে টুকুস স্বেচ্ছায় আলাদা ঘরে শুচ্ছে। ঘরখানার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে কণাদ আলগাভাবে বলল, সাহেব ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?
আর কতক্ষণ জেগে থাকবে? সওয়া এগারোটা তো বাজে।
আজ একটু দেরি হয়ে গেল, না? সানডের কভার স্টোরির ইলাস্ট্রেশনটা শেখরবাবুর পছন্দ হল না, আবার পুরোটা বদলানো…
পৃথা প্লেটে ভাত দিচ্ছিল। জিজ্ঞেস করল, দ্যাখো, আর দেব?
লাগলে নিয়ে নেব। তুমি শুরু করো না।
মাথা নামিয়ে খাওয়ায় মন দিল কণাদ। গরম ডাল দিয়ে ভাত মাখছে, হঠাৎই পৃথা বলে উঠল, আজ দিব্যজ্যোতির মা ফোন করেছিলেন।
কণাদ চমকে গেল। থেমে গেছে হাত, চোখ তুলেছে।
দিব্যজ্যোতি সিংহ খুব অসুস্থ।
জানি তো। গ্রিন ভিউতে আছে।
জানতে? জানো? আমাকে বলোনি তো?
কণাদ ঈষৎ অস্বস্তি বোধ করল। অপ্রতিভ মুখে বলল, আমি তো ভেবেছিলাম তুমিও… কোন একটা কাগজেই তো বেরিয়েছিল… ছোট করে… রোববার। আমাদের কাগজে নয় অবশ্য।
পৃথার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে, রবিবার তো বাড়িতে এক গুচ্ছ কাগজ আসে। ক’টা আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি?… যখন দেখলে, তখনই তো আমায় বলা উচিত ছিল।
কণাদ সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিতে পারল না। পৃথা ভুল বলেনি, তাকে ডেকে খবরটা দেখানোই তো স্বাভাবিক ছিল। তখন মনে হল, পৃথা যদি খবরটা দেখে যেচে কিছু বলে, তখনই আলোচনা করা যাবে প্রসঙ্গটা? কেনই বা সে ধরে নিয়েছিল ওই সংবাদ পৃথার চোখে পড়বেই? কোন যুক্তিতে তার ধারণা জন্মাল, দিব্যদা গুরুতর অসুস্থ জানা সত্ত্বেও মুখে কুলুপ এঁটে আছে পৃথা?
কণাদ এক ঢোক জল খেল। গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বলল, উচিত ছিল বটে। সরি।
পৃথা যেন একটু নরম হয়েছে। একটুক্ষণ স্থির চোখে কণাদের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, দিব্যর মা একটা ঝামেলায় ফেলে দিয়েছেন। কী করি বলো তো?
কী ঝামেলা?
একবার তাঁর ছেলের কাছে যেতে বলছিলেন।
কণাদ এবার বেশ অবাক, তুমি গিয়ে কী করবে?
আমিও তো ওঁকে তাই বললাম। আমি গিয়ে কী করব! … তবু এমনভাবে অনুরোধ করছিলেন… আমার মরোমরো ছেলেটাকে একবার দেখে যাও…
মরোমরো কেন? দিব্যদা তো এখন বেটার। বলেই কণাদ বুঝতে পারল বেফাঁস কথা বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে। অপ্রস্তুতভাবে বলল, আমাদের আর্টরুমের নব্যেন্দু আজ বলছিল। ও বোধহয় কাল গিয়েছিল নার্সিংহোমে।…
ও।
কণাদ টের পেল, পৃথা তার সাফাই গাওয়াটা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। হয়তো বুঝেই ফেলেছে, তাদের আর্টরুমে নিয়মিত কথা হয় দিব্যদাকে নিয়ে। মাথা নামিয়ে আহারে ফের মনোযোগী হওয়ার ভান করে বলল, তা মাসিমা যখন বলছেন, একবার ঘুরেই এসো না।
তুত্, আমার একদম ইচ্ছে করছে না। ওই লোকটার মুখ আবার দেখতে হবে ভাবলেই আমার কেমন গা কিশকিশ করে।
লোকটা তো এখন আর লোকটা নেই, পৃথা। দিব্যদা তো এখন জড়ভরত।
হতে পারে। কিন্তু ওকে দেখলেই আমার পুরনো কথাগুলো মনে পড়ে যাবে। একটা নোংরা লোক…
তুমি দিব্যদাকে এখনও এত ঘেন্না করো?
সারাজীবন করব। তুমি যদি দশ বছর ওর সঙ্গে থাকতে, তা হলে তুমিও করতে।
কণাদ হেসে ফেলল, ভাগ্যিস আমি দিব্যদার বউ হইনি, ছাত্র ছিলাম!
ইয়ারকি মেরো না। আমার বিরক্ত লাগছে। পৃথা কটমট তাকাল, সবচেয়ে খারাপ লাগছে কী জানো? দিব্যর মা… যিনি ছেলেকে হাড়েমজ্জায় চেনেন… ছেলের নেচার বদলাতে পারেননি বলে আমার কাছে সহস্রবার কপাল চাপড়েছেন… উনিই এক সময়ে বলেছিলেন, তুমি পালাও, দিব্যর সঙ্গে আর কিছুদিন থাকলে তুমি পাগল হয়ে যাবে… তিনিই আজ আমায় সাধছেন!
একটা কথা বলব, পৃথা? কণাদ না-বলে পারল না, মাসিমা অত্যন্ত সেনসেটিভ মহিলা। সেটা তুমিও জানো, আমিও জানি। তোমার অসম্মানগুলো উনি খুব রেলিশ করেছেন, এ অপবাদ তুমি নিশ্চয়ই ওঁকে দিতে পারবে না!
দিইনি তো। বলেছি কখনও, উনি ছেলের অন্যায়কে সাপোর্ট করেছেন?
তা হলে?
কী তা হলে?
বলি কী… উনি যখন সব বুঝেশুনেই ডাকছেন, তোমার একবার ঘুরে আসা উচিত।
পরামর্শটা পৃথার যেন পছন্দ হল না। মাথা নামিয়ে ভাত খুঁটছে, ছোট ছোট গ্রাস তুলছে মুখে, সময় নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। আড়চোখে পৃথাকে দেখছিল কণাদ। দোটানায় পড়ে গেল কি? কী আশা করছিল? কণাদ তার না-যাওয়ার ইচ্ছেটাকে সমর্থন করবে? প্রায় এগারো বছর একসঙ্গে ঘর করার পরেও কণাদকে কি চেনেনি পৃথা?
হঠাৎই কণাদের মনে হল, পৃথার এই দোলাচল, এই অপ্রসন্নতা, কোনওটাই যেন পুরোপুরি অকৃত্রিম নয়। যদি দিব্যদাকে দেখতে না- যাওয়ার ইচ্ছেটা এতই প্রবল হত, মাসিমাকেই তো সরাসরি বলে দিতে পারত। মাসিমার কাছে ভাল বা মন্দ, কোনও কিছু সাজারই তো আর দায় নেই পৃথার! যদি তিনি প্রাক্তন পুত্রবধূকে নিষ্ঠুরও ভাবেন, তাতেই বা পৃথার কী যায় আসে? স্বামী হিসেবে দিব্যদা যেরকম প্রবঞ্চক ছিল, তাতে তো তার প্রতি পৃথার সমবেদনা না-জাগাটাই স্বাভাবিক। মাসিমা আহত হলেও নিশ্চয়ই বুঝতেন পৃথার মনোভাবটা। নয় কী?
আরও একটা কথা মনে হচ্ছিল কণাদের। প্রায় এক যুগ দিব্যদার সঙ্গে পৃথার কোনও সংস্পর্শ নেই, এখনও কি তার ওপর এতখানি রাগ ঘেন্না থাকা সম্ভব? সময় কি তৃষ্ণা, বিতৃষ্ণা, দুটোকেই খইয়ে দেয় না? পৃথা যদি একা থাকত, তা হলে হয়তো স্মৃতিভারে পীড়িত হলেও হতে পারত। নিঃসঙ্গতা প্রেমকে বাড়িয়ে দেয়। অপ্রেমকেও। কিন্তু পৃথা তো দিব্যি ঘরসংসার করছে, ছেলে ছেলে করে পাগল থাকে সারাক্ষণ! শূন্যতাবিহীন হৃদয়ে বিরাগ টিরাগে তো পলি পড়ে যাওয়ার কথা!
নাহ্, নারীচিত্ত অতি অনিত্য, এর তল পাওয়া কণাদের কম্মো নয়। ওস্তাদ ডুবুরি লাগবে।
একটু যেন গা-বাঁচানো চিন্তা। তবু এভাবেই ভাবনাটাতে সাময়িক বিরতি টানল কণাদ। ভাতে ডিমের ঝোল ঢেলে বলল, যাক গে, কাল কী হবে?
পৃথার দৃষ্টি উঠেছে।
যেমন বাজারে যাই তেমনই যাব? নাকি তোমার ময়নারানি আসে কি না দেখে নিয়ে…?
পৃথা বুঝি স্বচ্ছন্দ হল একটু। সামান্য ভেবে নিয়ে বলল, মনে হয় না আসবে। ময়না তো এক দিনের জন্য ডুব মারে না। আমি বরং সকালে উঠে ফ্রিজারে যে মাছটা আছে, রেঁধে ফেলব।
একটু মুরগি এনে রাখতে পারি।
বেশ তো, এনো। কাল শনিবার…হাফ ডে…আমি এসে করে ফেলব।
আমিও করতে পারি। আমার তো বারোটায় বেরোনো। যদি বলো তো চিকেনের একটা নতুন প্রিপারেশান ট্রাই করি।
তোমার মশলাগুলো বড্ড ছ্যাকরা ছ্যাকরা থাকে। ভাল করে কষাও না।
এটা একদম অন্য রকম রান্না। নো কষাকষি বিজনেস। শুধু নুন তেল মশলা দিয়ে দমে বসিয়ে দাও, ব্যস। মাখতেও হয় না।
পৃথা ঠোঁট উলটোল, কী জানি সে কী পদের হবে!
আহা, দ্যাখোই না…
যা খুশি করো। ঝালটা দিয়ো না, টুকুস মুখে তুলতে পারবে না।
কণাদ ঠাট্টার সুরে বলল, আমি কিছু রাঁধতে চাইলে তুমি এত ফ্যাকড়া তোলো কেন বলো তো? রান্নাঘর হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে?
পৃথার খাওয়া শেষ। থালা বাটি তুলে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কন্ট্রোলটা পুরোপুরিই নাও না। আমাকে আর তা হলে ময়নার পেছনে ট্যাকট্যাক করতে হয় না।
রক্ষে করো। কণাদ হেসে উঠল, তোমার ময়নারানির কন্ট্রোল আমি নিতে পারব না।
পৃথাও হেসে ফেলেছে। এঁটো বাসন সিঙ্কে রেখে এসে অবশিষ্ট খাবার ঢোকাল ফ্রিজে। কণাদও উঠল। বেসিনে গিয়ে হাত-মুখ ধুল। তারপর একখানা ঢেকুর তুলে ঢুকেছে টুকুসের ঘরে।
রাতবাতি জ্বলছে। তাদের ঘরের মতো নীলাভ আলো নয়, কম পাওয়ারের সাধারণ বাল্ব। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে পাছে টুকুস ভয়টয় পায়, তাই এ-ঘরটা বেশি অন্ধকার হতে দেয় না পৃথা। সিঙ্গল বেড খাটে যথারীতি টেরাবেঁকা হয়ে ঘুমোচ্ছে টুকুস। বালিশ কোথায়, টুকুসের মাথাই বা কোথায়! চরকি খেতে খেতে ধারেও সরে এসেছে অনেকটা। পাঁজাকোলা করে ছেলেকে তুলল কণাদ, শুইয়ে দিল ঠিক করে, পাশবালিশ দিয়ে আটকে দিল খাটের কিনারা। বেশ ভারী হয়ে গেছে টুকুস, তুলতে হাঁপ ধরে যায়, বিছানার কোণটাতে বসে জিরিয়ে নিচ্ছে একটু। হালকা আলো মাখা ঘরখানাকে নিরীক্ষণ করছে। ফ্ল্যাটটা কেনার সময়ে আমার আলাদা ঘর চাই, আমার আলাদা ঘর চাই বলে কানের পোকা নড়িয়ে দিয়েছিল টুকুস। অগত্যা পৃথাকেও রাজি হতে হল। ঘরটা পৃথা সাজিয়েওছে চমৎকার। ছেলের জামা-কাপড়ের জন্য দেওয়ালজোড়া রঙিন ওয়ার্ডোব, খেলনা রাখার কাচের আলমারি, পড়ার টেবিল, বইয়ের র্যাক, জানলায় মানানসই পরদা…। ঘরটায় ভারী যত্ন পৃথার, একটুও অগোছালো হতে দেয় না।
শুধু এ-ঘর কেন, দু’কামরার এই ফ্ল্যাটে কোথাও কি এলোমেলো ভাব আছে? পৃথা তা হতেই দেবে না। যেমন ঘুরে ঘুরে বাছাই আসবাব কিনেছে, শো-পিস সংগ্রহ করেছে, তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও পৃথার তেমনই প্রাণঢালা উৎসাহ। সারাক্ষণ এটা ঝাড়ছে, ওটা পরিষ্কার করছে…। একটা জিনিস এদিক ওদিক হলেই কণাদ আর টুকুস বকুনি খাচ্ছে এন্তার। কেন আমার দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ দু ইঞ্চি সরল। কে আমার দুর্গামূর্তিতে হাত দিয়েছে! পেন্টিংটা যে বেঁকে আছে, কেউ তাকিয়েও দেখে না! ওই ধমকধামকগুলোই যেন বলে দেয়, সুস্থ একটা সংসার পেয়ে মনটা ভরে গেছে পৃথার।
এই পরিপূর্ণতার মধ্যেও কি অতীত এসে হানা দেয়? না হলে দিব্যদার ওপর এখনও পৃথার এত রাগ কেন? কণাদের ভালবাসা কি এখনও পৃথার জ্বালাটা জুড়োতে পারেনি?
ধুস্, আবার সেই হাবিজাবি চিন্তা! কণাদ উঠে বসার জায়গায় এল। টিভি চালিয়ে দিয়েছে। অন হতেই পরদায় কার্টুন। রিমোট টিপে কণাদ বাংলা চ্যানেলে গেল। একটা অচেনা মেয়ে পুরনো দিনের গান গাইছে, শুনতে মন্দ লাগে না। গানের মাঝেই রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে টুং-টাং আওয়াজ। বাসনকোসনগুলো বোধহয় মেজে রাখছে পৃথা। এর পর চলবে রান্নাঘর সাফাই। স্ল্যাব, তাক, সব ঝকঝকে না-করলে পৃথার ঘুমই আসবে না। দিব্যদার সংসারে পৃথা এতটা নিটিপিটি ছিল না, বরং সবেতেই কেমন যেন আলগা আলগা ভাব, কণাদ দেখেছে। আনমনাও থাকত সারাক্ষণ। প্রথম দিন তো কণাদের চায়ে চিনির বদলে নুন দিয়ে ফেলেছিল। তখন কণাদ আর্ট কলেজের ফাইনাল ইয়ারে। কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীর ব্যাপারে কী একটা যেন কথা বলতে দিব্যদার বাড়িতে গিয়েছিল সে আর চন্দন। নুন-চা খেয়ে চন্দনের মুখ বিকৃত হয়ে গেছে, কণাদের অবস্থাও তথৈবচ।
দেখে দিব্যদার কী হাসি, একে কী বলে জানিস তো? আগুনে দীক্ষা নেওয়া। নোনতা চা দিয়ে তোদের বউদির সঙ্গে পরিচয়টা হল… মনে হচ্ছে এই পরিচয়টা বহুকাল টিকবে।
প্রায় দৈববাণী যেন! অন্তত কণাদের ক্ষেত্রে। কীভাবে যে সেই পৃথাবউদির সঙ্গে সম্পর্কটা পরে বদলে গেল! আর্ট কলেজ ছাড়ার পর বছর দু’-তিন তো দিব্যদার সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না। তখন অন্নচিন্তা চমৎকারা, আঁকার টিউশনি ফিউশনি জুটিয়ে কোনওক্রমে কলকাতায় টিকে আছে কণাদ। আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পরিকল্পনা করছে কীভাবে সবাই মিলে একটা এগজিবিশন করে কলকাতাকে কাঁপিয়ে দেওয়া যায়। গাঁটের কড়ি খসে খসুক, কুছ পরোয়া নেই।
ওই প্রদর্শনীর সূত্রেই সুতোটা জুড়ল আবার। অ্যাকাডেমির সাউথ গ্যালারিতে চার বন্ধুর ছবি আর ভাস্কর্যের প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে। দিব্যদাকে কলেজে না পেয়ে চেতলার বাড়িটায় গিয়েছিল কণাদ। বেল বাজাচ্ছে, বেল বাজাচ্ছে, কোনও সাড়াশব্দ নেই। ফিরে যাবে কিনা ভাবছে, তখনই পৃথা দরজা খুলল। পৃথাই। তার মুখ অসম্ভব ফুলে আছে, দু’চোখ করমচার মতো লাল।
কণাদ থতমত মুখে বলল, স্যারের কাছে এসেছিলাম।
ও।
স্যার বাড়ি নেই?
না তো।
এই কার্ডটা স্যারকে দেওয়ার ছিল। আমাদের এগজিবিশন… একুশ তারিখে ওপেনিং… সাত দিন চলবে। স্যারকে বলবেন যেন অবশ্যই আসেন।
হুঁ।
আপনিও যাবেন কিন্তু
উঁ?
আপনি গেলে আমাদের খুব ভাল লাগবে।
হুঁ।
আপনার কি শরীর খারাপ?
উঁ?
আপনার মুখচোখ যেন কেমন লাগছে! আজ স্কুলে যাননি?
হ্যাঁ। গেছিলাম তো।
পৃথা যেন অনেক দূরে কোথাও চলে যাচ্ছিল বারবার। যাচ্ছে, ফিরছে, যাচ্ছে, ফিরছে…। পরে কণাদ শুনেছে, দিব্যদা নাকি সেদিনই ঘোষণা করেছিল রুনির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা তার পক্ষে কোনওভাবেই সম্ভব নয়।
সেই বিশেষ দিনটাতেই কি পৃথার প্রতি কণাদের মুগ্ধতার জন্ম? নাকি আরও পরে? যখন দিব্যদার বাড়িতে আবার যাতায়াত শুরু হল? পৃথা যে কেন তাকেই বেছে নিয়েছিল দুঃখের ঝাঁপি উজাড় করার জন্য? ওই ফোঁটা ফোঁটা দুঃখই বা কবে দানা দানা মুক্তো হয়ে গেল? বয়সের তফাত, স্যারের বউ, কোনও সংস্কারই আর মাথায় রইল না। এমনকী স্যার থেকে দিব্যদা হয়ে যাওয়া প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের ওপর অন্ধ শ্রদ্ধাভক্তিটাও ক্রমশ উবে গেল।
কণাদ বলত, কেন পড়ে আছ, পৃথা?
পৃথা বলত, কী করব? কোথায় যাব?
বাবা-মা’র কাছে চলে যাও।
উঁহুঁ, তা হয় না। নিজে জেদ করে বিয়ে করেছিলাম….
সো? ভুল তো তোমার হতেই পারে।… তা ছাড়া তোমার একটা চাকরিও আছে…
আমার ভয় করে, কণাদ। ভরসা পাই না।
কীসের ভয়? কাকে ভয়?
জানি না। তোমাদের দিব্যদা এমন একটা পাহাড়ের মতো মানুষ, তার ছায়া থেকে সরে গেছি ভাবলেই আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে।
তার মানে দিব্যদার ওপর তোমার এখনও উইকনেস আছে?
উইকনেস? এত কিছু দেখার পরেও? পৃথা জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাত, না। বিশ্বাস করো, না। তবু…
ওই তবুটুকুর পাঁচিল ডিঙোতে কতবার যে হোঁচট খেয়েছে পৃথা! ধাক্কা মেরে মেরে, ধাক্কা মেরে মেরে, এক জীবন থেকে তাকে অন্য জীবনে প্রবেশ করানো যে কী কঠিন কাজ ছিল! ওই তবুরই এক ক্ষীণ ভগ্নাংশ কি এখনও রয়ে গেছে পৃথার হৃদয়ে? আত্মগ্লানি হয়ে? অসন্তোষের রূপ ধরে যা ঠিকরে বেরোচ্ছে এখন?
কিন্তু দিব্যদার মা’র ব্যাপারটা কী? মাসিমা আবার পৃথাকে ডাকাডাকি শুরু করলেন কেন? হঠাৎ পৃথাকে দেখে দিব্যদার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, না-ভেবে নিশ্চয়ই ডাকেননি? দিব্যদাই কি তবে পৃথার দর্শনের অভিলাষী? পৃথা কি তা জানে? নাকি জানে না?
পৃথা পাশে এসে বসেছে। টিভিটাকে দেখিয়ে বলল, কী ছাতার মাথা একটা ইন্টারভিউ দেখছ?
তাই তো, গান তো শেষ হয়ে গেছে! কণাদ হেসে বলল, আহা, ইন্টারভিউটাও তো চলছিল লোকজনকে দেখানোর জন্যই, না কি?
তুমি মোটেই এসব প্রোগ্রাম লাইক করো না।… কিছু একটা ভাবছ, তাই তো?
হুঁ। রিমোটটা পৃথাকে বাড়িয়ে দিয়ে সোফায় পিঠ ঠেকাল কণাদ, দিব্যদার কথাই মনে পড়ছিল।
কী কথা?
কী মানুষ, তার কী হাল! এত লাইভলি, এত ফুল অফ ফোর্স, তার কিনা সেরিব্রাল? আর কি নরমাল লাইফে ফিরতে পারবে?
তোমার খুব মায়া হচ্ছে মনে হয়?
হওয়ারই তো কথা। আমি তো দিব্যদার সঙ্গে ঘর করিনি। বলেই নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল কণাদ।
পৃথা টিভি অফ্ করে দিল। সরু চোখে বলল, আমায় টিজ করছ?
না গো।… আসলে আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটা তো অন্য রকম ছিল। অ্যাজ এ মাস্টারমশাই, হি ওয়াজ নিয়ার পারফেক্ট। আমরা তো ওর ক্লাসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতাম।
জানি। শয়তানদের একটা মেসমেরাইজিং পাওয়ার থাকে।
ওফ্, তুমি না…! কণাদ মুখভঙ্গি করল, আমাদের সঙ্গে এমনভাবে মিশত… মনে হত বন্ধু। ভেরি নিয়ার অ্যান্ড ডিয়ার। কে কোথায় কার সঙ্গে প্রেম করছে, কিংবা কারও স্ক্যান্ডাল, কীভাবে আর্টিস্টদের ছবির দাম চড়ানো হয়… কোনও কিছুতেই দিব্যদার রাখঢাক ছিল না।
তোমাদের সঙ্গে বয়সের ডিফারেন্সই বা কী ছিল? বড় জোর আট-দশ বছর।
তা কেন? জুনিয়ার ছেলেমেয়েগুলোও তো বলে…
সবটাই ওর অ্যাক্টিং।… আমার সঙ্গে মিউচুয়াল সেপারেশনটা হয়ে যাওয়ার পর ও নাকি কলেজে গিয়ে হাউহাউ করে কেঁদেছিল! রানিদি আমায় বলেছে। কান্নায় নাকি ভিড় জমে গিয়েছিল স্টাফরুমে। অথচ মিউচুয়াল সেপারেশনের প্রস্তাবটা কিন্তু ওরই দেওয়া।… দিব্যর ওই কান্নাটাও যেমন নাটক, স্টুডেন্টদের কাঁধে হাত দিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা ও সেরকমই নাটক।
আই ডাউট। অ্যাট হার্ট, দিব্যদা কিন্তু খুব প্যাঁচোয়া নয়।… আমাদের ব্যাপারটাই ধরো না। দিব্যদা কি বোঝেনি আমাদের মধ্যে একটা রিলেশান গড়ে উঠছে? কতদিন তো ঠাট্টা করে আমায় জিজ্ঞেস করেছে, তুই এ-ঘরে এসেছিস, না ও-ঘরে।
সে তো আমাকেও বলত। যাও না, ঘরে কেন গোঁজ হয়ে বসে আছ, কণাদের সঙ্গে গিয়ে অ্যাকাডেমিতে নাটক ফাটক দেখে এসো, মনটা ফ্রেশ হবে।
কণাদ চোখের কোণ দিয়ে তাকাল, তা হলে?
তা হলে আবার কী! ওটা ছিল ওর ইঁদুর-বেড়াল খেলা। ধরেই নিয়েছিল ওকে ছেড়ে আমি কস্মিনকালে বেরুতে পারব না, তাই সুতো ছেড়ে ছেড়ে দেখত আমার যন্ত্রণাটা বাড়ছে, না কমছে। তুমিও একটু নার্ভাস ফিল করতে…. সেটাও বেশ এনজয় করত। রিমোট কন্ট্রোলে পুতুল নাচানোর আনন্দ!
তুমি কিন্তু দিব্যদাকে বড় ন্যারো অ্যাঙ্গল থেকে দেখেছ, পৃথা। হতে পারে দিব্যদার দোষের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই, তোমার সঙ্গে যে আচরণটা করেছে…
আচরণ নয়, বলো নির্যাতন। পৃথা আটকে দিল কথাটা, মানসিক অত্যাচার। হাসিমুখে আমার সঙ্গে কথা বলছে, ওদিকে নিজের যা-যা নোংরামো করার সবই করে যাচ্ছে। ধরা পড়লেও বিকার নেই, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলছে, ছাড়ো না, কেন ওসব বাইরের ব্যাপারগুলোকে পাত্তা দাও! আমি যেরকম, সেভাবেই আমায় অ্যাকসেপ্ট করতে পারো না?
হ্যাঁ, ওটা অত্যাচার। অত্যাচারই। আমি তো না বলছি না। জানি তো, কাম রিপুটা দিব্যদার একটু বেশিই ছিল। কিন্তু তার জন্য দিব্যদার অন্য গুণগুলো…
থামো। ওই এক রিপুর ঠেলাতেই আমার জীবন…। পৃথা ছোট একটা হাই তুলল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শুতে যাবে তো এবার?
হুঁ। যাই।
পৃথা চলে যাওয়ার পরেও কণাদ বসে রইল কিছুক্ষণ। বসেই আছে। পৃথা যা বলল তা পুরোটা কি মানা যায়? শুধু অভিনয় দিয়ে কি একটা মানুষ নিজের চারপাশে অমন জ্যোতির্বলয় তৈরি করতে পারে? মাত্র সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ বছর বয়সে টুসকি বাজিয়ে চাকরি ছেড়ে দিল, কোন সে গণ্ডগ্রামে গিয়ে বড় একটা কাজ করছে, জুনিয়ার আর্টিস্টদের প্রোমোট করার জন্য হরবখত গলা ফাটায়, যে-কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মিছিলে সবার আগে… সবই কি দিখাওয়া? দিব্যদার খুব বেশি কাছে ছিল বলেই বোধহয় পৃথা সেভাবে পড়তে পারেনি দিব্যদাকে। ক্যামেরা একেবারে গায়ের ওপর গিয়ে পড়লে যা হয় আর কী। বিশাল ক্লোজআপে শরীরের রোমগুলোই প্রকট হয়, সৌন্দর্যটা নয়। রোমকূপগুলো নিশ্চয়ই সত্যি, কিন্তু পুরো সত্যি কি?
কণাদের মনে পড়ল, বছর তিনেক আগে একটা গ্যালারিতে দিব্যদার সঙ্গে হঠাৎ দেখা। আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল কণাদ, দিব্যদাই এগিয়ে এল। পুরনো চেনা ভঙ্গিতে কাঁধে চাপড় মেরে বলল, হাই ইয়াং ম্যান, আছিস কেমন? পৃথা? বাচ্চাটা কত বড় হল? কী যেন নাম রেখেছিস তোরা?
দিব্যজ্যোতি সিংহের ওই আচরণ কি শুধুই অভিনয়? নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু? খুব সাধারণ মাপের মানুষ কি অত সহজ স্বরে কথা বলতে পারে? অন্তত কণাদ তো পারত না। সেদিন দিব্যদার সামনে কেমন যেন ছোট লেগেছিল নিজেকে। বাড়ি এসে পৃথাকে সাক্ষাৎকারটার কথা বলতে পারেনি। না পারাটাই যেন আরও বেশি ক্ষুদ্র করে দিয়েছিল নিজেকে।
আলো পাখা বন্ধ করে ঘরে এল কণাদ। পাঞ্জাবিটা ছাড়ছে। খালি গায়ে শোওয়াটাই তার বেশি আরামের।
আচমকাই পৃথার গলা, হঠাৎ তুমি দিব্যর গুণ আবিষ্কার করা শুরু করলে কেন বলো তো?
কণাদ ঘুরে তাকাল। আড়াআড়ি চোখ ঢেকে শুয়ে আছে পৃথা ঘুমোয়নি!
কণাদ জবাব দেওয়ার আগেই পৃথা ফের বলল, তোমার কি দিব্যকে নিয়ে কোনও কমপ্লেক্স আছে?
ন্ন্না। না তো! কণাদ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তোমার এরকম কেন মনে হল?
এমনিই। পৃথা পাশ ফিরল, আলোটা নিবিয়ে দাও।