দশ
দুপুর যখন বিকেলটাকে ছোঁয়, দক্ষিণের জানলাটায় এসে বসে দিব্যজ্যোতি। বেতের আরামকেদারা এখানেই রাখা থাকে আজকাল। প্রাচীন দীর্ঘ বাতায়নে, মোটা মোটা লোহার শিকের ওপারে, তেমন বিশেষ কিছু দৃশ্যমান নয়। খানিকটা গলি, ঘরবাড়ির টুকরো-টাকরা অংশ, আর গলিশেষে বড় রাস্তার একটা কুচি চোখে পড়ে মাত্র। ওই কুচিটুকুতে হঠাৎ হঠাৎ চলমান গাড়ির ঝলক। কখনও সাদা, কখনও লাল, নীল কিংবা হলুদ। সুঁই-সাঁই চলে যায় তারা, দর্শনেন্দ্রিয়কে ঝাঁকি দেয় ঘনঘন। হর্নের উৎকট আওয়াজ উড়ে আসে, শব্দের রেশ রয়ে যায় কানে। নজরে পড়ে মানুষও। নারী-পুরুষ-বালক-বালিকা…। প্যান্ট-ধুতি-শাড়ি- সালোয়ার কামিজ-স্কুল ইউনিফর্ম… রঙিন ছাতা, কালো ছাতা, ছাতাবিহীন…। মানুষজনকে একটু যেন খাটো দেখায় দোতলা থেকে হাঁটাচলাতেও তাদের কেমন পুতুল পুতুল ভাব। সামনের সরু গলি, বাড়ি ঘরের ভগ্নাংশ, চকিত মানুষ, ঝটিতি যানবাহন, সব মিলিয়ে একটা ছবি তৈরি হয় দৃশ্যপটে। সেই ছবিটাই কি দেখে দিব্যজ্যোতি? হয়তো বা!
গলির মোড়ে আজ এক লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা মোটামতন লোক কার সঙ্গে যেন ঝগড়া করছে। পাড়ার কেউ কি? দিব্যজ্যোতি দূর থেকে ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না। তবে আঙুল নেড়ে নেড়ে লোকটার শাসানোর ভঙ্গি ভারী মজাদার লাগছে এখান থেকে। যাকে শাসাচ্ছে তাকে দেখা যায় না, মনে হয় লোকটা যেন কোনও অদৃশ্য প্রতিপক্ষের উদ্দেশে একা একাই তর্জনী নাচাচ্ছে! দৃশ্যটার যেন একটা মানে আছে! আবার নেইও। ঝুঁকে, গরাদে কপাল ঠেকিয়ে, অন্য লোকটিকে খোঁজার চেষ্টা করল দিব্যজ্যোতি। মুখভঙ্গি করে বলল, দেখি ব্যাটা কোথায় তুই! মুখ দেখা!
গোবিন্দ কখন পিছনে চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। মীরার নতুন পরিচারক, দিন পনেরো হল কাজে ঢুকেছে। বছর ষোলোর ছেলেটা ঘাড় উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কথা বলছ, মামা?
জবাব না-দিয়ে দিব্যজ্যোতি আরও দু’-চার সেকেন্ড খুঁজল লোকটাকে। তারপর আরামকেদারায় শরীর মেলে দিয়ে বলল, ধুস্।
গোবিন্দ পিটপিট তাকাচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার গলিটাকে দেখল, একবার দিব্যজ্যোতিকে।
রগুড়ে গলায় দিব্যজ্যোতি বলল, ব্যাটা ভগবান দেখা দিল না, বুঝলি। … কাপটা রাখ, চা-ই খাই।
হতবাক গোবিন্দ কাপ প্লেট রাখল আরামকেদারার হাতলে। পা টিপে টিপে চলে যাচ্ছে। তার যাওয়ার ভঙ্গিটা দেখে হো হো হেসে উঠল দিব্যজ্যোতি। হাসতে হাসতেই বলল, সুখেনটা কী করছে রে? তাকে একবার পাঠিয়ে দে তো।
তলব পেয়ে সুখেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাজির। পাশে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে। তাকে আলগা নিরীক্ষণ করে দিব্যজ্যোতি বলল, পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিলি বুঝি?
না তো। দিদার সঙ্গে কথা বলছিলাম।
তোর দিদা আজ বেরোবে না বিকেলে?
বোধহয় বেরোবে। শাড়ি বের করছিল।
অ।… তুই মাল ডেলিভারি করে কখন ফিরলি?
দেড়টা। … না না, দুটো।
আমার কাছে এলি না তো!
আপনি তখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন…
হুম।… মিসেস সিংহানিয়ার সঙ্গে দেখা হল?
হ্যাঁ।
ম্যাডামের একটা কমপ্লেন আছে। কী?
বলছিলেন, ডিজাইন নাকি একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে।
হুম। কথাটা আমিও ভাবছিলাম। যাই সুবর্ণলতায়, তারপর দেখি কী করা যায়।… এক কাজ করিস। ডিজাইনের যে হ্যান্ডবুকটা তৈরি করেছিলাম, সেটা সামনের বার নিয়ে আসিস। ভুলবি না। আমার দাবার বোর্ডটা আনতে বলেছিলাম…
এনেছি। দিদার কাছে আছে।
বিছানার পাশের টেবিলটায় রেখে যাস। … খাটের ওপর থেকে রবারের বলটা দে তো।
ঝটিতি রবারের বলখানা এনে দিয়েছে সুখেন। ডান হাতের মুঠোয় বলটা নিয়ে দিব্যজ্যোতি চাপছে, ছাড়ছে। ব্যায়ামটায় ভারী উপকার হয়। ফিজিওথেরাপিস্ট বলেছে, যত বেশি ব্যায়ামটা করবে, তত ভাল ফল হবে। হচ্ছেও। ডান হাতের আঙুলগুলো দিব্যি নড়াচড়া করছে এখন
প্রক্রিয়াটা চালাতে চালাতে দিব্যজ্যোতি বলল, পেমেন্টের ব্যাপারে মিসেস সিংহানিয়া কিছু বলল?
একটা চেক দিয়েছে। দশ হাজার টাকার।
মাত্র দশ? ওর কাছে তো অনেক টাকা পড়ে। লাস্ট কনসাইনমেন্টে বত্রিশ হাজার টাকার মাল নিল, কুড়ি হাজার ঠেকাল। এ তো হু হু করে জমে যাচ্ছে! তুই কিছু বললি না?
বলেছি। আবার সামনের সপ্তাহে দেবে বলেছে।
এবার ফোনে খিস্তি মারতে হবে। দিব্যজ্যোতি ঝেঁঝে উঠল, শালী আমার দাড়ি উপড়ে বোস্টন-নিউ ইয়র্কে ব্যাবসা করবে…! বিছানায় পড়ে গেছি বলে খুব অফচান্স নিচ্ছে!
আমরা সরাসরি বিদেশে মাল পাঠাতে পারি না, মামাবাবু?
ওরকমই কিছু একটা ভাবতে হবে এবার। দালালই যদি পয়সা খেয়ে নেয়, সুবর্ণলতার লাভ কোথায়?… যাক গে, তোদের টাকা-পয়সা কী লাগবে, একটা এস্টিমেট করে এনেছিস?
সমরবাবু বানিয়ে দিয়েছে। কাগজটা নিয়ে আসব?
হুঁ।
সুখেন বেরিয়ে যেতেই দিব্যজ্যোতি ইজিচেয়ারের মোটা হাতল দুটোয় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার ডান অঙ্গে সাড় অনেকটাই ফিরেছে এখন, একা একাই চরে বেড়াতে পারে ঘরময়। তবে লাঠিটা এখনও লাগছে। গত সপ্তাহ থেকে সেবিকাদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাতবিরেতে বাথরুমে যেতেও তার খুব একটা অসুবিধে নেই। তবে মীরার নির্দেশে গোবিন্দ এ-ঘরেই শোয়। যদিও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ছেলেটাকে ডাকাডাকি করে না দিব্যজ্যোতি।
লাঠি ঠুকে ঠুকে দিব্যজ্যোতি বিছানায় গিয়ে বসল। কাগজ নিয়ে ফিরেছে সুখেন, নাকের ডগায় সরু চালশে-চশমা এঁটে হিসেবটা দেখছে মন দিয়ে। চোখ বুজে কী যেন বিড়বিড় করল, ফের নজর কাগজে। দেখা শেষ করে কাগজখানা ভাঁজ করল দিব্যজ্যোতি। সুখেনকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার কম্পিউটার-টেবিলটার ড্রয়ারে রাখ এটা। আর দ্যাখ, ওই ড্রয়ারেই চেকবই আছে, নিয়ে আয়। কলমটাও।
আজ্ঞা পালন করতে পুবের বন্ধ জানলাটায় গিয়েছিল সুখেন, সেখান থেকেই বলে উঠেছে, আজ কি ঘরে ঝাঁট পড়েনি মামাবাবু?
কেন, কী হল?
জানলার নীচে এত কাঠি পড়ে…!
দিব্যজ্যোতি হেসে ফেলল, ও আমার চড়ুইদের কীর্তি। দুপুরে বোধহয় ঘুলঘুলি থেকে ফেলেছে।
চড়ুই বড় ঘর নোংরা করে। বাসাটা ভেঙে দেব?
থাক। উৎসাহী সুখেনকে নিরস্ত করল দিব্যজ্যোতি, বেচারাদের বেঘর করার পাপটা নয় নাই করলাম। গেলে আপনিই চলে যাবে। মনে হচ্ছে চড়ুইগিন্নি ডিম পেড়েছে। বাচ্চাটাচ্চা ফুটুক।… আমার রাইটিং প্যাডটাও আনিস তো।
ড্রয়ার ঘেঁটে প্যাড চেকবই বার করে বিছানায় এনে রাখল সুখেন। গদগদ স্বরে বলল, আমাদের ওখানেও বাবুই এখন বাসা বাঁধছে।
সাইডটেবিল থেকে একটা মোটা বই টানল দিব্যজ্যোতি। রাইটিংপ্যাড তার ওপর রেখে খুশি খুশি মুখে বলল, গুড নিউজ। কোন গাছে?
পশ্চিম কোণের বেঁটে তালগাছটায়। একসঙ্গে ছ’-সাতটা বাসা।
মেয়ে বাবুইরা খুব ঘুরঘুর করছে তো বাসার কাছে?
সুখেনের কথাটা ঠিক বোধগম্য হল না। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছে।
দিব্যজ্যোতি বলল, মাথায় ঢুকল না তো?… ছেলে বাবুইরাই তো বাসা বাঁধে রে। আই মিন, বোনে। তাল, নারকোল … তারপর ধর গিয়ে তোর সুপুরিগাছের কচি কচি পাতার যে লম্বা লম্বা আঁশ থাকে, সেগুলোকে ঠোঁট দিয়ে বুনে বুনে, এক একজন এক একটা বাসা বানায়। পুরোটা কমপ্লিট করে না, তার আগেই মেয়ে বাবুইদের ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। এসো এসো, আমার কেরামতি দেখে যাও! ম্যাডামরা এসে তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাসাগুলোকে পরখ করেন। কোনটা কত টেকসই, কে কত সুন্দর বুনেছে, কার ছাউনি কতটা পোক্ত… যার বাসা মনোমত হবে, ম্যাডাম তার সঙ্গেই জোড় বাঁধবেন। তার পরে বাবুইমশাই ফিনিশিং টাচ দেবে বাসায়। এটাই ওদের কাস্টম।
সুখেন মাথা দুলিয়ে বলল, বাহ্, ভাল রীতি তো! প্রায় মানুষের মতোই। আমাদেরও তো ঘরটর দেখেই ছেলে পছন্দ করা হয়।
অন্যভাবেও তো হয়, সুখেনবাবু! দিব্যজ্যোতি চোখ মটকাল, তোর ঘরদোর কিছু ছিল? আমার দৌলতে দিব্যি তো ফোকটে একটা বউ পেয়ে গেলি!
বোকা বোকা মুখে হাসছে সুখেন। দিব্যজ্যোতি ঘাড় নামিয়ে কাগজে সই মকশো করা শুরু করল। হাত এখনও কাঁপে, তবে হচ্ছে মোটামুটি। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বলেছে, একটু-আধটু ফারাক থাকলেও চেক পাস করে দেবে। প্র্যাক্টিস সেরে চেকবই খুলল। সন্তর্পণে লিখতে লিখতে বলল, ইস, বাবুইপাখির বাসাটা আমার দেখা হল না! আই রিয়েলি লাইক ইট। কী নিপুণ শিল্পকর্ম, আহা।
একটা বাসা তো পেয়েছিলাম। আস্ত। গত রোববার ওখানে কালবোশেখি হল, ঝড়ে পড়ে গিয়েছিল। তুলে রেখেছিলাম ঘরে, ভেবেছিলাম আপনাকে এনে দেখাব… আপনার ভাগনির জন্য হল না। পরদিনই দেখি ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
সে কী রে! দিব্যজ্যোতির হাত থামল, বাসাটাকে নষ্ট করে দিল?
আজকাল কল্পনার রাগ খুব বেড়েছে, মামাবাবু। আমাকে তো সারাক্ষণ গুয়ে বসাচ্ছে, তাই নিয়ে আমি কিছু মনে করি না। তা আমি নয় তার স্বভাবটা জানি, কিন্তু আর পাঁচজন? যা নয় তাই বলছে। মেয়েগুলোকে উঠতে-বসতে দাবড়ানি। সমরবাবুর সঙ্গেও কেমন চোখ পাকিয়ে পাকিয়ে কথা বলে। আর কচিকাচাগুলোর সঙ্গে যে কী ব্যবহারটা করে।… এই তো, রোববারই, ঝড়ে কিছু আম পড়েছিল, গাঁয়ের বাচ্চারা চাট্টি কুড়োতে এসেছে, তাদের বাপ-মা তুলে কী খিস্তি! বাচ্চাদের ওপর ওর যেন জাতরাগ।
দিব্যজ্যোতি সাবধানে চেকটা ছিঁড়ল, হয়তো নিজের বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে না, তাই।
সুখেন ঘাড় নিচু করে বলল, কতবার তো বলছি, ডাক্তারের কাছে চলো, দু’জনেই পরীক্ষা করিয়ে আসি। কিছুতেই যেতে চায় না। উলটে আমায় গাল পাড়ে।
দিব্যজ্যোতি হাসতে হাসতে বলল, কী বলে তোকে? ঢ্যামনা?
সুখেনের ঘাড় আরও ঝুলে গেল।
মুখ তোল। দিব্যজ্যোতি চেকটা এগিয়ে দিল, কাল সকালে চেকটা ভাঙিয়ে নিয়ে যাস।… এবার আমটাম কেমন হয়েছে রে?
সুখেনের গলা দিয়ে ক্ষীণ আওয়াজ বেরোল, ভাল।
আশা করছি, বৈশাখে সুবর্ণলতায় যেতে পারব। তদ্দিনে হিমসাগরে পাক ধরে যাবে, কী বল?
সামনের মাসে পারবেন, মামাবাবু?
দেখে কী মনে হচ্ছে, অ্যাঁ? ডান হাতখানা মন্থর গতিতে তুলতে শুরু করল দিব্যজ্যোতি। গোটা বাহুটাই কাঁপছে অল্প অল্প। মুখে একটা কষ্ট ফুটে উঠল, তবু থামছে না। হাত মাথার ওপর তুলে হাঁপাতে হাঁপাতে হাসল, কী রে, বল?
সুখেনের চোখ উজ্জ্বল, এবার সোনামাটি গেলে এক মাস থেকে আসবেন। আমরা আপনার সেবা করব।
দিব্যজ্যোতি যন্ত্রণাটা মুছে ফেলে হাসিটুকু ধরে রাখল মুখে। বলল, ওপাশের জানলা দুটো খুলে দিয়ে যা তো। ঘরে ভাল করে হাওয়া খেলুক। তোদের দিদার যে কী বন্ধ বন্ধ বাতিক!
আলো একটু বাড়তেই ঘরটা যেন বদলে গেল সহসা। মায়াবী বিকেল ডানা মেলে দিয়েছে অন্দরে। এবার চৈত্র মাস পড়ার পর বেশ কয়েকটা কালবৈশাখী হয়ে গেছে। কালও একটা ঝড় উঠেছিল সন্ধেবেলা। সঙ্গে জোর এক পশলা বৃষ্টি। তাপ আজ বেশি চড়তে পারেনি, দিনভর হাওয়াও দিচ্ছে খুব। খামখেয়ালি বাতাস। হঠাৎ হঠাৎ বইছে দমকা, থেমে যাচ্ছে পরক্ষণে। আবার উঠছে।
দিব্যজ্যোতি জানলায় গিয়ে বাতাসটা মাখল খানিকক্ষণ। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না, শরীর কাঁপতে থাকে, আস্তে আস্তে কম্পিউটারের সামনে এসে বসেছে। ড্রয়ার থেকে সুখেনের আনা হিসেবটা বের করে পুরছে কম্পিউটারে, সুবর্ণলতার অ্যাকাউন্টে। কম্পিউটারে সে খুব সড়গড় নয়, দেখে দেখে টিপছে কি-বোর্ড, ঠিক অক্ষর টিপল কি না চোখ তুলে বারবার দেখছে মনিটারে।
কাজ অর্ধেকও এগোয়নি, পিছনে ফের গোবিন্দ, মামা, একজন
মেয়েছেলে এসেছে।
দিব্যজ্যোতি বিরক্ত মুখে তাকাল, মেয়েছেলে?
গোবিন্দ তাড়াতাড়ি বলল, না না, দিদিমণি।
দিদিমণি?
না না, মাসি। আসতে বলব?
দিব্যজ্যোতি হেসে ফেলল। বেচারা গোবিন্দ এখনও বাবুদের বাড়ির তাল-ছন্দে ঠিক রপ্ত হয়নি। কাকে কী বলতে হয়, কীভাবে বলতে হয়, জ্ঞানটা কম। পরশু না কবে যেন ঝুনি এসেছিল, তাকে কাকিমা বলে ডেকে ফেলে বেচারার কী আতান্তর! কেন কাকিমা মনে হল, কাকাটিকে সে পেল কোত্থেকে… পরের পর প্রশ্ন হেনে চলেছে ঝুনি, আর গোবিন্দ গপগপ ঢোঁক গিলছে। বিজিতদাকেও কাল দাদু বলেছিল না?
দিব্যজ্যোতির সম্মতির অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গিয়েছিল গোবিন্দ। ফিরেছে যে মেয়েছেলে কাম দিদিমণি কাম মাসিটিকে নিয়ে, তাকে দেখে দিব্যজ্যোতি রীতিমতো চমকিত।
হৃষ্ট স্বরে বলল, কী ব্যাপার, অ্যাঁ? প্যারিসের পারমিতা পাতকের প্রকোষ্ঠে?
পারমিতা একটুও হাসল না। জিনস্ টপ পরিহিতা, কোমর অবধি লম্বা চুল, সুগন্ধী মাখা, ফ্যাটফেটে ফরসা পারমিতা কোমরে হাত রেখে স্থির। দুঃখী দুঃখী গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার এ কী হল, দিব্য?
এক কালের ছাত্রী পারমিতার নাম ধরে ডাকা দিব্যজ্যোতির কানসওয়া। বছর আষ্টেক আগে প্যারিসে তারা একত্রে বাস করেছিল মাসখানেক, তখন থেকেই।
দিব্যজ্যোতি বাঁ হাতে চেয়ারটাকে সামান্য ঘোরাল। সপ্রতিভ গলায় বলল, মৃত্যুকে ছুঁয়ে দেখার সাধ হয়েছিল। ফেল করে গেলাম।
ডোন্ট টক শিট্। এখন আছ কেমন?
নেচে দেখাতে পারব না। তবে জাস্ট ফাইন। দাঁড়িয়ে কেন, বসো।
ওপাশের চেয়ার টেনে বসেছে পারমিতা। কেমন যেন অদ্ভুত চোখে দেখছে দিব্যজ্যোতিকে। মুগ্ধতা নয়, বিস্ময় নয়, প্রেম নয়, বিষাদও নয়, তবু সবই যেন ওই দৃষ্টিতে আছে। মিলেমিশে।
দিব্যজ্যোতি ভুরু নাচাল, খবর পেলে কোত্থেকে? কলেজের কেউ…?
সবে তো দেশে এলাম। এখনও কারও সঙ্গে যোগাযোগই হয়নি। পারমিতার ঠোঁটে ছোট্ট একটা হাসি দেখা দিল, কাল সন্ধেবেলা গড়িয়াহাটে হঠাৎ তোমার এক্স ওয়াইফের মুখোমুখি। আমাকে প্রথমটা রেকগনাইজ করতে চায়নি, আমিই আগ বাড়িয়ে কথা বললাম। জাস্ট হাই হ্যালো করতে গিয়েছিলাম, তখনই দুম করে তোমার অসুস্থতার কথাটা বলল। শুনেই মনটা এত খারাপ হয়ে গেল!
দিব্যজ্যোতি মৃদু হাসল, মাঝে মাঝে মন খারাপ হওয়া ভাল। ওতে মনের একটা এক্সারসাইজ হয়।
উফ্, তোমার ওয়ে অফ টকিং একই রকম রয়ে গেল।
আনরোম্যান্টিক?
না। সিউডো রোম্যান্টিক।
গ্রেট কমপ্লিমেন্ট। আমার কোনও প্রেমিকাই আমাকে এই আখ্যা দেয়নি। দিব্যজ্যোতি শব্দ করে হেসে উঠল। হঠাৎই হাসি থামিয়ে বলল, অ্যাজ এ হোস্ট জিজ্ঞেস করছি, চা খাবে? কফি? অর এনি আদার ড্রিঙ্কস?
আজ নো ফরমালিটি, দিব্য। আমি বসবও না বেশিক্ষণ, তাড়া আছে। আজ শুধু তোমায় দেখতে এসেছি।
কেমন দেখছ? দিব্যজ্যোতি চেয়ারে টানটান হল।
সত্যি বলব? কিছু মাইন্ড করবে না?
তুমি তো জানো আমি সত্যি শুনতেই ভালবাসি। মিথ্যে আমার বরদাস্ত হয় না।
লাইনারশোভিত চোখের কুচকুচে কালো মণি দুটো কেঁপে উঠল তিরতির। মাথা নেড়ে নেড়ে পারমিতা বলল, ইউ আর লুকিং সিকলি, দিব্য। ওল্ড।
দিব্যজ্যোতির মুখটা সামান্য শুকনো দেখাল। তবু হাসার চেষ্টা করে বলল, একটা বড় ধাক্কা গেল কাহিল তো লাগবেই। তা ছাড়া বয়সও তো হচ্ছে।
না না, ঠিক সেরকম নয়। দেখে মনে হচ্ছে, তুমি আর আগের তুমি নেই, অনেকটা নিবে গেছ। পারমিতার গলা নেমে গেল হঠাৎই, প্রায় বিড়বিড় করে বলল, এটা ঠিক এক্সটারনাল সিকনেস নয়, তুমি বোধহয় ভেতরে ভেতরে…
তোমার কি অন্তর্দৃষ্টি গজিয়েছে নাকি? ফের শব্দ করে হেসে উঠল দিব্যজ্যোতি। বাঁ হাতে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলল, নো, বকোয়াস, পারমিতা। আমি আগে যা ছিলাম, তার চেয়ে হাজার গুণ ভাল আছি। চাকরি বাকরির ঝুটঝামেলা নেই। প্রাণের খেয়ালে ছবি আঁকছি। মনের চাহিদা মেটাতে মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। লাস্ট তোমার সঙ্গে যখন দেখা… আই মিন, লাস্ট আমরা যখন মিট করেছিলাম…
মিট! ইউ কল ইট মিট? পারমিতা আহত গলায় বলল, সিম্পলি মিট?
ও কে। সেকেন্ড টাইম প্যারিস গিয়ে আমি যখন তোমার সঙ্গে ছিলাম…
এত অবলীলায় তুমি কথাটা বলে দিলে? তোমার গলা কাঁপল না?
আমি ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট মানুষ, পারমিতা। ওয়ার্ল্ড ট্যুর করতে গিয়ে তোমার সঙ্গে প্যারিসে দেখা হল, আমরা কয়েকটা দিন এক সঙ্গে রইলাম…
শুধু থাকা?
ওয়েল… ক্লোজ হয়ে ছিলাম। আমাদের দু’জনেরই সেই সময়টা খুব সুন্দর কেটেছে। আমার অ্যালবামে সেই সময়কার কয়েকটা ছবিও আছে, মাঝে মাঝে ছবিগুলো দেখতে আমার ভালও লাগে… তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, সেই সময়ে আমি বলেছিলাম দেশে ফিরে গিয়ে এবার একটা বড় কাজে হাত দেব?
হ্যাঁ, ওরকমই একটা বাহানা দিয়েছিলে বটে। এতক্ষণ পর পারমিতার স্বরে একটু যেন ব্যঙ্গ, কী একটা ওয়ার্ড যেন খুব ইউজ করতে? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আত্মরতি। বলতে, শুধু আত্মরতিতে জীবনটা অপব্যয় করা কোনও কাজের কথা নয়। বেঁচে থাকতে গেলে লাইফের একটা মিশন চাই।
এখনও বলি। এবং জেনে রাখো, সেই মিশনটা আমি খুঁজেও পেয়েছি। এত বছর পর পোড়া দেশটায় এলে, নিশ্চয়ই কিছুদিন থাকবে… একবার গিয়ে দেখে এসো আমি কী গড়েছি। সুবর্ণলতা। আমার ড্রিম প্রোজেক্ট। আমাদের ট্র্যাডিশনাল আর্টকে প্রোমোট করছি। গ্রামের দরিদ্রতম মেয়েদের কিছু উপার্জন করার একটা রাস্তা খুলে দিয়েছি। এখনও পুরো হয়নি, অনেকটাই বাকি। স্টিল, গিয়ে দেখলে বুঝবে, দিব্যজ্যোতি সিংহ জীবনটাকে কত বড় করে ভাবতে পারে। দিব্যজ্যোতি একগাল হাসল, অ্যান্ড ফর দ্যাট ম্যাটার… সব কিছু মিলিয়ে এত ব্যস্ত থাকি, যে আমার খারাপ থাকার কোনও সুযোগই নেই।
আমি তোমার প্রতিষ্ঠানটার খবর শুনেছি। প্যারিসে থাকলেও এখানকার সঙ্গে আমার টাচ তো আছে। পারমিতা চোখ তেরচা করল, ব্যস্ত থাকো জানি। ইনভলভড্ থাকো কি?
থাকি না? এত সময় ডিভোট করছি… আমার জীবনের সঙ্গে জুড়ে গেছে…
সে তো তোমার এক্স ওয়াইফও তোমার সঙ্গে জুড়ে ছিল। কম দিন নয়, প্রোব্যাবলি দশ-এগারো বছর। আমার সঙ্গেও তো তুমি অন্তত চারটে উইক…। জানি না আর কারও সঙ্গেও এরকম হয়েছে কি না…! এ-সবের মধ্যে কোথাও কি তোমার কখনও ইনভলভমেন্ট ছিল? হয়েছে কখনও? আমার তো ধারণা, তুমি কোনও কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে থাকার মানুষ নও। তোমার সেই ক্ষমতাই নেই।
দিব্যজ্যোতি স্থির চোখে পারমিতাকে দেখল একটুক্ষণ। তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে, জীবনটাকে এত ছোট অ্যাঙ্গেল থেকে দ্যাখো কেন, অ্যাঁ? যে-কোনও সম্পর্ক… এনি ড্যাম রিলেশনশিপ… জীবনের একটা পার্ট মাত্র। গোটা জীবন নয়। আর বেঁচে থাকাটাই তো জীবনের সবচেয়ে বড় ইনভলভমেন্ট। নয় কি? লাইফের প্রত্যেকটা মোমেন্ট ডিফারেন্ট, বেঁচে থাকার ভঙ্গিটাও তাই অলওয়েজ পালটে যায়।
কথার মাঝেই মীরা ঢুকেছেন ঘরে। পারমিতাকে ঝলক দেখে নিয়ে দিব্যজ্যোতিকে বললেন, তোর কি এখন সুখেনকে দরকার?
না। কেন?
আমি একটু সুখেনকে নিয়ে বেরোচ্ছি তা হলে। কয়েকটা জিনিস কিনে ওর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেব।
তুমি ফিরছ কখন?
আটটার মধ্যে চলে আসব। তোর কিছু লাগবে?
একটা ভাল শেভিং ক্রিম…। দিব্যজ্যোতি গালে হাত বোলাল। মুচকি হেসে বলল, এইসব বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো এসে বলছে, আমায় নাকি বুড়ো বুড়ো লাগছে! গালটাকে আরও ঝকঝকে করতে হবে। … তুমি ওকে চিনতে পারছ তো? আগে এক-দু’বার এসেছে। পারমিতা। আমার ছাত্রী ছিল।
মীরা চিনলেন বলে মনে হল না। হেসে বললেন, ও আচ্ছা। … বসো, তোমরা গল্প করো।
বেরিয়ে গেলেন মীরা। পারমিতাও উসখুস করছে। ঘড়ি দেখে বলল, আজ তা হলে উঠি?
দাঁড়াও। তোমার খবর তো এখনও জানা হল না। দিব্যজ্যোতি ভুরু নাচাল, আছ কোথায় এখন? প্যারিসেই?
ওখানেই তো রয়ে গেলাম।
শুনেছিলাম তুমি বিয়ে করেছ? ফরাসি ছেলেকে?
হ্যাঁ। পিয়ের। ঊনত্রিশ মাস আগে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
ইজ ইট? তুমি তা হলে এখন সিঙ্গল?
কিস্যু খবর রাখো না। লাস্ট ইয়ারে আবার বিয়ে করেছি। রিকার্ডোও একজন পেন্টার। স্প্যানিশ। ফার্স্ট ম্যারেজে আমার একটা ইস্যুও আছে। ছেলে। আমাদের সঙ্গেই থাকে।
প্যারিসেই তা হলে সেট করে গেলে?
মনে তো হচ্ছে। ফেরা আর হল কই!
ফিরতে পারোনি বলে আফশোস আছে নাকি?
না। ইনফ্যাচুয়েশান আমি কাটিয়ে ফেলেছি।
দ্যাটস দা স্পিরিট। মোহ জাগবে, ঘুচে যাবে, সম্পর্ক গড়বে, ভাঙবে, আবার নতুন করে তৈরি হবে, কিংবা হবে না… জীবন তো এরকমই হওয়া উচিত।
পারমিতার ঠোঁট সামান্য বেঁকে গেল, নিজেকে দিয়ে অন্যকে অ্যাসেস করো না, দিব্য। কেউ সম্পর্ক ছিঁড়ে গেলে কষ্ট পায়, কেউ সম্পর্ক গড়তেই জানে না।
উম্ম্।… তা দেশের মাটিতে আছ ক’দিন?
দিন কুড়ি। বাবার শরীরটা খারাপ। বাইপাস হবে, দাদারা ডাকাডাকি করছিল… মা চাইছে আরও কিছুদিন থাকি…. ওদিকে বর-ছেলেও রেখে এসেছি…
কখন যেন চলে গেছে পারমিতা। দিব্যজ্যোতি আবার ইজিচেয়ারে। বাইরের মেদুর বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে এখন। গলির আলো জ্বলেনি আজ, আশপাশের বাড়ির আলো মাখা গলিটাকে কেমন যেন মনমরা দেখায়। বড় রাস্তার টুকরোটায় যথারীতি গাড়ির আনাগোনা। হঠাৎ আলোর ঝলকানি, হঠাৎ ছেঁড়া ছেঁড়া আঁধার।
দিব্যজ্যোতির হাতে রবারের বল। চাপছে। ছাড়ছে।
রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল দিব্যজ্যোতি। মাঝসমুদ্রে একটা পুরনো মানোয়ারি জাহাজ। গাদাবোট টেনে নিয়ে যাচ্ছে জাহাজটাকে। অদূরে দেখা যায় বন্দর। প্রকাণ্ড জাহাজখানা চলেছে বন্দরে। পশ্চিমের আকাশে সূর্যাস্ত হচ্ছে তখন। সমুদ্রের বুকে জাফরানি আর সোনালি হলুদ ঝিকমিক করে উঠল।
দা ফাইটিং টেমেরেয়ার!
টার্নারের পেন্টিংটা কেন যে এল দিব্যজ্যোতির স্বপ্নে!