আম্রপালী – ৯

০৯.

সোমবার সকালে ঘটল একটা বিশ্রী দুর্ঘটনা।

কলেজ গেট-এর শ-দুই গজ দূর থেকেই গাড়ির গতি কমিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। সামনে কী একটা হৈ-চৈ বিক্ষোভ হচ্ছে। পথ-চলতি কে-একজন আগবাড়িয়ে বললে, ওদিকে যাবেন না দাদু, বোম্ ফাটছে।

কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে সেটা নতুন কিছু নয়। এ-পথে বৃষ্টির জলে যেমন জ্যাম হয়, বেহুদ্দো গাড়িতে-গাড়িতে জট পাকিয়ে যেমন জ্যাম হয়, তেমনি বোমা পড়ার কারণেও রাস্তা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যায়। মানুষজন তখন বড় রাস্তা এড়িয়ে গলি ঘুঁজি ধরে চলে। এদিক-সেদিক অসংখ্য গলিপথ।

কলেজ স্ট্রিট এই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত।

তালুকদার লোকটির পরামর্শ মেনে নিলেন। গোলদিঘি পাক মেরে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটুট ‘হল’ ঘুরে এসে পড়লেন বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রিটে। হিন্দু স্কুলের বিপরীতে ওঁর জানা এক প্রকাশকের দোকানের সামনে গাড়িটা পার্ক করে নেমে এলেন।

দোকানের মালিক ওঁকে আপ্যায়ন করে বসালো। উনি জানতে চাইলেন, কলেজের সামনে গণ্ডগোলটা কিসের?

প্রকাশক অমায়িক হেসে বললেন, আদার ব্যাপারি স্যার, জাহাজের খোঁজ রাখিনা। কিছু একটা ‘আমাদের দাবী’ নিশ্চয় আছে, যা বোধ করি কেউ মানছে না, তাই তার ‘কালো হাত ভেঙে দেওয়ার’, অথবা ‘গুঁড়িয়ে দেওয়ার’ আয়োজন। তবে এটুকু খবর পেয়েছি যে, পুলিসভ্যান এসে গেছে। একটু পরেই রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। ট্রামবাস চলবে আবার।

–কিন্তু আমার যে বারোটা দশে ক্লাস।

–ভুলে যান, স্যার। আপনি প্রেজেন্ট স্যার হলেও আপনার ছাত্রছাত্রীরা সবাই ‘অ্যাবসেন্ট স্যার’! কী খাবেন বলুন, গরম না ঠাণ্ডা?

–আরে না, না, আগে দেখে আসি ব্যাপারটা কী। শোন, আমার গাড়িটা রইল তোমার দোকানের সামনে। কেউ না চাকা খুলে নিয়ে যায়। একটু নজর রেখ।

–ঠিক আছে স্যার, যান। পুলিস ভ্যান এসেছে প্রায় ঘন্টাখানেক আগে। এতক্ষণে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

গাড়িটা দোকানের সামনে লক করে পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলেন কলেজ গেট এর দিকে। এখনো সেখানে চাপ ভিড়। উত্তেজিত ছাত্রদের চিৎকার চেঁচামেচি, স্লোগান, কাউন্টার-স্লোগান। পুলিস ভ্যানের পাত্তা নেই। ট্রাম এখনো চালু হয়নি। গেটে ঢুকবার মুখে বাধা পেলেন। ভিড়ের ভিতর রাস্তা করে এগিয়ে যাওয়াই মুশকিল। হঠাৎ ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল একটি ছাত্র, ফোর্থ ইয়ার-এর তাপস মিত্র। ভিড় সরিয়ে রাস্তা করে দিয়ে বললে, আসুন, আসুন স্যার, গাড়ি কোথায় রাখলেন?

–হিন্দু স্কুলের সামনে। আজ আবার কী নিয়ে গণ্ডগোল?

–অনেক কাণ্ড হয়ে গেছে, স্যার। বলছি….না, না, ওদিকে যাবেন না। প্রিন্সিপাল-সাহেব ঘেরাও হয়ে আছেন। ওদিকে গেলে আপনিও ফেঁসে যাবেন। সোজা কেমিস্ট্রি ল্যাবে চলে যান।

–প্রিন্সিপ্যাল-সাহেব ঘেরাও হয়ে আছেন? কেন? কী ব্যাপার?

–তাহলে এদিকে সরে আসুন। একটু আড়ালে না হলে…

এত উত্তেজনাতেও ডেভিড হেয়ার নির্বিকার। বোমাই ফাটুক আর গুলিই ছুটুক জোব্বা গায়ে একইভাবে বই-বগলে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ বলে নয়। দশকের পর দশক। তাঁরই পায়ের কাছে সরে এলেন ওঁরা দুজন।

তাপস মিত্র ছাত্র য়ুনিয়ানের পাণ্ডা। তবে এবার ওদের পার্টি ইলেকশান জিততে পারেনি। বিধানসভার নজির দিয়ে বলা যায় তাপস এখন বিরোধী দলপতি। সে সংক্ষেপে যা জানালো তা এই রকম :

সকাল পৌনে-দশটায় কলেজের সামনে একটা দুঃসাহসিক ‘অ্যাবডাকশন-কেস’ হয়ে গেছে। কলেজের একটি ছাত্রী ট্রাম থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে কলেজে আসছিল, মাঝ-সড়কে তিন-চারজন গুণ্ডা তাকে চেপে ধরে। ওরা এসেছিল কালো রঙের একটা অ্যাম্বাসাডারে। সেটা রাস্তার ধারেই স্টার্টে রাখা ছিল, চালকের আসনে ড্রাইভার রেডি হয়ে বসে প্রতীক্ষা করছিল। মেয়েটি আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তিন-চারজন ষণ্ডা-মার্কার সঙ্গে সে পারবে কেন? প্রকাশ্য দিনের আলোয় কয়েক শ দর্শকের। চোখের সামনে ওরা জোর করে মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে ফেলে। চার-পাঁচটি ছেলে ছুটে গিয়েছিল বাধা দিতে। তখন ওরা পরপর দুটো বোমা ফাটায়। তার সপ্লিন্টারে একজন আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আর একটি ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে গাড়ির উপর। গুণ্ডাদলের একজন ছেলেটির তলপেটে ছোরা বসিয়ে দেয়।

তিন-চার মিনিটের মধ্যেই সমস্ত ঘটনাটা ঘটে যায়। ঠিক তারপরেই কলেজ গেটের সামনে মারামারি বেধে যায়। দুই রাজনৈতিক দলের সহানুভূতিশীল ছাত্রদের মধ্যে। একটু পরেই পুলিস ভ্যান এসে যায়। তাপসদের পার্টির তিনটি ছেলেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। অতি সংক্ষেপে এই হল ঘটনার বিবরণ।

–তাহলে প্রিন্সিপাল-সাহেব ঘেরাও হলেন কেন?

–উনি ছেলেদের জামিনের ব্যবস্থা করছেন না বলে। বলছেন, পুলিসে যাদের অ্যারেস্ট করেছে তারা রাস্তায় ছিল, কলেজ-ক্যাম্পাসের ভিতরে নয়। ফলে তারা ছাত্র না, সাধারণ নাগরিক….

–অলরাইট! এস আমার সঙ্গে–

–না, স্যার। আপনি ওদিকে যাবেন না। তাহলে আপনিও ঘেরাও হয়ে যাবেন। আমি ঠেকাতে পারব না।

–তুমি ভুলে গেছ তাপস, ‘ছাত্র-শিক্ষক কল্যাণ সমিতি’ বলে একটা সংস্থান আমরা এই কলেজে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, আর আমি তার প্রেসিডেন্ট। তুমিও আছ সেই কমিটিতে। এস, আর কথা বাড়িও না।

প্রিন্সিপাল-সাহেবের ঘরে তিল-ধারণের ঠাঁই নেই। সবাই এক সঙ্গে কথা বলতে চায়, ফলে কারও কথাই শোনা যাচ্ছে না। তদুপরি মাঝে মাঝে ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। প্রিন্সিপাল হাত নেড়ে ছেলেদের কিছু বোঝাতে চাইছেন, তার একটা শব্দও শোনা যাচ্ছে না। অন্তত এতদূর থেকে।

তালুকদার-সাহেব চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাপস ওঁর ভিতরে ঢোকার পথ করে দেবার চেষ্টা করে। কেউ কেউ তাঁকে দেখে নিজে থেকেই সরে যায়। দু-একজন এদিকে ফেরে।

তালুকদার ছাত্রবয়সে অভিনয় করতেন নাটকে। ‘টপ-ভয়েস’ কীভাবে নিক্ষেপ করতে হয় সে কায়দাটা ভুলে যাননি। সেই উচ্চগ্রাম কণ্ঠস্বরে তিনি বজ্রনির্ঘোষে হাঁকাড় পারেন, কমরেডস্! প্লীজ লেন্ড মি দাইন ইয়ারস্!

মন্ত্রের মতো কাজ হল তাতে। চিৎকার চেঁচামেচি একদম থেমে গেল। ঘরশুদ্ধ সবাই দ্বারপথে দৃকপাত করে এই নতুন অভিনেতার দিকে। অপেক্ষাকৃত নিম্ন স্বরে কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে তালুকদার-সাহেব ইংরেজিতেই বলে চলেন, আশা করি তোমরা সবাই আমাকে চেন… না, না রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক পরিচয়ের কথা বলছি না আমি… তোমরা জান যে, দুঃসময়ে যৌথব্যবস্থা নেবার সুবিধা হবে বলে আমরা এ বছর একটি ‘ছাত্র-শিক্ষক কল্যাণ সমিতি’র প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি সে কথাই বলছি। তোমরা জান, আমি সেই সমিতির সভাপতি!… কমরেডস! আমি এইমাত্র কলেজে এসে জানতে পেয়েছি যে, ঘণ্টা-কতক আগে কলেজ গেট-এর কাছে-কলেজ ক্যাম্পাসের ভৌগোলিক সীমানার ভিতরেই হোক, অথবা বাইরে–পরপর কয়েকটি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। যার ফলে কলেজের একটি ছাত্রীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও যেতে হয়েছে, তিনজন ছাত্র আহত হয়ে হাসপাতালে এবং তিনজন ছাত্রকে পুলিসে গ্রেপ্তার করেছে। এর প্রতিবিধানের জন্য আমি এই মুহূর্তেই আমাদের সমিতির একটি কার্যকরী সভার আহবান জানাচ্ছি। সবাইকে খবর দেবার সময় নেই। ঐ কমিটির যে কয়জন সভ্য-সভ্যা এখানে উপস্থিত আছ তারা আমার সঙ্গে রসায়ন বিভাগে লেকচার থিয়েটারে চলে এস। আর যারা ঐ দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী তারাও চলে এস। …. একটা কথা, কমরেডস্। আমাদের এই কলেজ এশিয়ার মধ্যে একটি সুবিখ্যাত ঐতিহ্যময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান… এর মর্যাদা রক্ষা করার দায় তোমাদের, দায় আমাদের! …যারা সত্যিই এ অন্যায়ের প্রতিকার করতে চাও, তারা আমার সঙ্গে চলে এস, আর যারা শুধু খ্যাপা কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ করতে চাও তারা প্রিন্সিপাল-সাহেবকে ঘিরে ‘হাউল’ করতে পার।

একতরফা বক্তব্যটা পেশ করে মুহূর্তমধ্যে উনি চলতে শুরু করলেন।

যেন, হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। গোটা দলটা তার পিছু নিল। কিছুদূর এগিয়ে উনি আবার থেমে পড়েন। পিছন ফেরেন। পশ্চাতে অনুসরণকারী ছাত্রছাত্রীদের সম্বোধন করে বললেন, সবাই এসে ভিড় করলে কোন কাজ করা শক্ত হবে। শোন, যারা ঐ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং যারা ঐ ছাত্র-শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সভ্য-সভ্যা তারাই শুধু আমার সঙ্গে এস। বাদবাকি ছাত্রছাত্রীদের আমি ক্লাসে যেতে বলছি না, এই মানসিক অবস্থায় সেটা সম্ভবপর নয়। তোমরা মাঠে অপেক্ষা কর। আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এসে আমরা আমাদের কার্যকরী সিদ্ধান্ত জানাব। তোমরা তাতে সন্তুষ্ট না হলে আমাকে ঘেরাও করতে পার, পুনরায় প্রিন্সিপাল-সাহেবকে ঘেরাও করতে পার, অথবা আমাকে ‘ফিজিক্যালি অ্যাসল্ট’ করতে পার। কিন্তু প্লীজ কমরেডস, ডোন্ট স্টার্ট হাউলিং এগেন!

গটগট করে এগিয়ে গেলেন এরপর কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের দিকে। ওঁর অনুসরণকারী দলের অধিকাংশই মাঠের দিকে চলে গেল। জনা আট-দশ ওঁর অনুগমন করল।

লেকচার থিয়েটারে ডায়াসের উপর উঠে ওঁর নজর হল সামনের বেঞ্চিতে জনা দশেক উপস্থিত। চারজন ছাত্রী ছয়জন ছাত্র। তার ভিতর তাপস মিত্র আছে, আছে। সতীশ সামন্তও। সতীশ এখন ইউনিয়ানের অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি। ওদের পার্টিই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরা দুজনেই ছাত্র-শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সদস্য। কিন্তু দেবাশীষ জোয়াদ্দারকে দেখতে পেলেন না ইউনিয়ন-ইন-পাওয়ার এর সেক্রেটারি। তাই সতীশকে প্রশ্ন করলেন, দেবাশীষকে দেখছি না। আসেনি?

সতীশ উঠে দাঁড়ায়। বলে, না স্যার। কী জানি কেন আজ সে অ্যাবসেন্ট। আমি ওকে বাড়িতে খবর পাঠিয়েছি।

তালুকদার বলেন, আমি কিছু ক্লাস নিচ্ছি না। তোমাদের যা জিজ্ঞাসা করব, তার জবাব বসে বসেই দিও। নাউ ফার্স্ট কোশ্চেন : সকালবেলার ঘটনার–আমি অ্যাবডাকশান কেসটার কথা বলছি–প্রত্যক্ষদর্শী কে কে? স্বচক্ষে মেয়েটিকে অপহরণ হতে দেখেছ কে কে? প্লীজ রেজ য়োর হ্যান্ডস্।

সামনের বেঞ্চি থেকে দুটি মেয়ে এবং একটি ছেলে হাত তুলল।

অধ্যাপক তালুকদার তাদের নাম বা রোল নম্বর জানতে চাইলেন না। বরং পেশ করলেন তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন : যে ছাত্রীটিকে ওরা তুলে নিয়ে গেছে তাকে তোমরা কেউ চেন?

প্রথম সারির যে দুটি মেয়ে ইতিপূর্বে হাত তুলেছিল তাদের মধ্যে একজন উঠে দাঁড়ায়। শ্যামলা রঙ, সালোয়ার-পাঞ্জাবি পরে এসেছে। বললে, আমি চিনি, স্যার। আমরা এক পাড়াতেই থাকি। হাতিবাগানের কাছাকাছি। একই ট্রামে আসছিলাম। রুবি উঠেছিল হেদোর কাছে…

–রুবি কে?

ঐ শ্যামলা রঙের মেয়েটির ঠিক পাশেই বসেছিল আর একটি মেয়ে। সেও প্রথম প্রশ্নে হাত তুলেছিল, এবারও তুলে আত্মঘোষণা করল।

–বুঝলাম। তোমরা তিনজনে একই ট্রামে আসছিলে। কিন্তু আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম অ্যাবডাক্টেড মেয়েটির নাম….

–কৃষ্ণা সেন, থার্ড-ইয়ার, ফিলজফি অনার্স।

ভ্রূকুঞ্চন হল অধ্যাপক তালুকদারের। বললেন, কৃষ্ণা সেন? ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়? গতবছর স্যোসালে….

–ইয়েস স্যার! সেই কৃষ্ণাই।

–বলে যাও….

মেয়েটি বর্ণনা করে–

ট্রাম থেকে নেমে ওরা কীভাবে ট্রাম রাস্তা অতিক্রম করতে থাকে। তিনজনই একসঙ্গে। হঠাৎ উল্টোদিক থেকে একটা ট্রাম এগিয়ে আসে। কৃষ্ণা চট করে পার হয়ে যায়। ওরা দুজন এপারে থেকে যায়। কিন্তু ট্রামটা ওদের দৃষ্টিপথ অক্রিম করার আগেই ওপাশে কী একটা গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। ট্রামের প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় মাঝখানে যেটুকু ফাঁক আছে তার মধ্যে দিয়ে ওরা দেখতে পায় দুজন গুণ্ডা কৃষ্ণার দুই হাত ধরে টানছে ফুটপাতের দিকে। ব্যাপারটা কী হয়েছে। জানবার জন্য ওরা দুজন ট্রামটার পিছন দিয়ে ছুটে ওপারে যায়। ততক্ষণে গুণ্ডারা জোর করে কৃষ্ণাকে গাড়িতে তুলছে। তিন-চারজন ছাত্র বাধা দিতে ছুটে আসে। তখন ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে-থাকা একজন গুণ্ডা তাদের লক্ষ্য করে পরপর দুটি বোমা ছোড়ে। একটা ফাটেনি, দ্বিতীয়টাও কারও গায়ে লাগেনি, কিন্তু ট্রামরাস্তায় পড়ে সশব্দে ফেটে যায়। দুজন ছাত্র রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। তখন ধোঁয়ার প্রাবল্যে সামনে কী ঘটছে দেখা যাচ্ছিল না। ধূম্রজাল অপসারিত হবার পর ওরা দেখতে পায় রাস্তায় দুজন ছেলে পড়ে কারাচ্ছে। কৃষ্ণার কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে পড়ে আছে। আর রাস্তার ওদিকে যে কালো রঙের অ্যামবাসাডার গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল সেটা নেই। মেয়েটি কৃষ্ণার ব্যাগটা তুলে নেয়। লক্ষ্য করে দেখে, দশ-পনেরজন ছাত্র ছুটে যাচ্ছে আহত দুজনকে পাঁজাকোলা করে সরিয়ে আনতে। রাস্তায় জন ও যান চলাচল থমকে গেছে। মুহূর্তমধ্যে বহু মানুষের ভিড়ে রাস্তাটা ভরে যায়। ও আর কিছু জানে না। কৃষ্ণার ব্যাগটা এখনো ওর জিম্মায়। তুলে দেখায়।

তালুকদার এবার রুবির দিকে ফিরে বলেন, ও যা বলল তা তুমি কি সব করবোরেট করছ, না ও কিছু ভুল বলেছে?

–না, স্যার। আমিও ঠিক তাই দেখেছি।

তালুকদার এবার ছেলেটির দিকে ফিরে বলেন, আর তুমি?

সে কিছু বলার আগেই সতীশ সামন্ত বলে ওঠে, ওর পরিচয়টা জানি না, স্যার। তোমার নাম? কোন ইয়ার?

তালুকদার নজর করে দেখলেন, সতীশ একটা খাতায় কী সব নোট নিচ্ছে। তিনি বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, সতীশ, প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব মি! এখানে আমিই এনকোয়ারিটা কনডাক্ট করছি। তোমাদের ইউনিয়নের তরফে যদি পৃথক কোন তদন্ত তোমরা করতে চাও তাহলে দেবাশীষ এসে পড়লে তা তোমরা পৃথকভাবে করতে পার।

প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে যে ছেলেটি দাবী করেছিল তার দিকে ফিরে তালুকদার পুনরায় একই প্রশ্ন করেন, আর তুমি?

–আমি স্যার রাস্তার এপাড়ে ছিলাম। ফলে স্মোকস্কৃনে আমার দৃষ্টিপথ আড়াল হয়নি। আমি দেখেছিলাম গাড়ির ভিতর দুজন ছিল। দুজনেই ড্রাইভারের সীটে। পিছনের সীটটা খালি। তা থেকেই ঐ তিনজন অ্যান্টিসোশাল নেমে এসে কৃষ্ণাকে চেপে ধরে। টানাটানি করে পিছনের সিটে তোলে। কৃষ্ণার ব্যাগটা হাত থেকে পড়ে যায়। সে আপ্রাণ লড়াই করে। ইনফ্যাক্ট, লাল… আই মীন যে ছেলেটি ওর ডান হাত ধরে টানছিল তার কবজিতে এক কামড় বসিয়ে দেয়। লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে। ঠিক তখনই দেবু ঐ গুণ্ডাটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার চোয়ালে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুষি মারে….

তালুকদার সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়েন। বলেন, কী নাম বললে? দেবু?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, দেবব্রত বসু।

–ফোর্থ ইয়ার? ফিজিওলজি?

সতীশ জানতে চায়, চেনেন স্যার ছেলেটিকে?

তালুকদার জবাব দেন না। সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন।

যে ছেলেটি জবানবন্দি দিচ্ছিল সে আবার শুরু করে, দেবু ওর চোয়ালে ঘুষিটা কষানোর সঙ্গে সঙ্গে ঐ লোকটার পাশ থেকে আর একজন অ্যান্টিসোশাল দেবুর তলপেটে ছোরা বসিয়ে দেয়। দেবু রাস্তায় পড়ে যায়। ঠিক তখনি অ্যামবাসাডারটা চলতে থাকে। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সে সামনের দিকে বেরিয়ে যায়। একটা রিকশাকে ধাক্কা মেরে উল্টে দিয়ে।

তালুকদার প্রশ্ন করে জানতে পারেন, রিকশাওয়ালার আঘাত সামান্যই। ফার্স্ট এইড নিয়ে ছাড়া পায়। কিন্তু দেবু, রতন ও জলিল–অর্থাৎ যে ছেলেদুটি বোমার আঘাতে ধরাশায়ী হয়েছিল তাদের সবাইকেই মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে।

–পুলিস কখন আসে? কে পুলিশে খবর দেয়? আর অ্যারেস্ট হয়েছে যে তিনজন তাদের নামগুলো কী?

এবার অনেকেই ওঁকে সাহায্যে করতে পারে। কারণ এসব ঘটনা ঘটেছে আধঘণ্টা পরে। তখন বহু ছাত্রছাত্রী উপস্থিত হয়েছিল।

সতীশ তার নোটবুকে সব কিছু লিখে নিল। তালুকদার কিছুই লিখলেন না।

সব প্রশ্ন-উত্তরের পর তালুকদার বললেন, এবার তোমাদের যে প্রশ্নটা করছি তার জবাব ভেবেচিন্তে দিও। আমি বিশেষ করে তোমাদের তিনজনকে বলছি, যে তিনজন অ্যাবডাকশান কেস-এর প্রত্যক্ষদর্শী। যে কয়জন গুণ্ডা কৃষ্ণাকে অপহরণ করে নিয়ে গেল সেই অ্যান্টিসোশালদের মধ্যে কাউকে কি তোমরা চিনতে পেরেছিলে? থিংক বিফোর য়ু আনসার।

একটা অস্বস্তিকর নীরবতা। তিনজনই পরস্পরের দিকে তাকায়। যেন চোখে চোখে কথা হয়ে যায়।

অবশেষে ছেলেটি বলে ওঠে, আমি একজনকে চিনি, স্যার!

হঠাৎ রবি উঠে দাঁড়ালো। যদিও বসে-বসেই এতক্ষণ জবাব দিচ্ছিল, কথা বলছিল। বোধ করি এবার উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে। বললে, আমিও একজনকে চিনতে পেরেছি–ঐ যার কবজি কামড়ে দিয়েছিল কৃষ্ণা।

–আর তুমি? নিবেদিতা?

হাতিবাগানের মোড়ের বাসিন্দার মাথাটা এতক্ষণ ছিল বুকের উপত্যকায়। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, তালুকদার-সাহেব তাকে নামে চেনেন। ধীরে-ধীরে এবার সেও উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমিও তাকে চিনতে পেরেছিলাম, স্যার। তাছাড়া যে গাড়ি চালাচ্ছিল তাকেও।

আবার একটা অস্বাভাবিক নীরবতা।

সতীশ জানতে চায়, হোয়াটস্ য়োর নেকস্ট কোশ্চেন, স্যার?

তালুকদার তাকে বলেন, তুমি অত উতলা হয়ে উঠেছ কেন, সতীশ? এনকোয়ারিটা আমিই তো কনডাক্ট করছি, নাকি? আমাকে ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ করতে দেবে না? তুমি কি এতই নির্বোধ যে, বুঝতে পার না এদের নিরাপত্তার কথাও আমাকে ভাবতে হচ্ছে?

সতীশ অধোবদনে নীরবে অপেক্ষা করে।

তালুকদার বলেন, তোমরা তিন জনে তিনটে কাগজে সেই অ্যান্টিসোশালের নাম ব্লক ক্যাপিটালে লিখে আমার হাতে দাও।

আবার ওদের চোখে-চোখে কথা হল। মনে হল, ওরা নির্দেশটা মেনে নিতে রাজি হল। তিনজনে তিনটি কাগজে কী লিখে ওঁকে দিয়ে এল। তালুকদার তিনটি কাগজের টুকরোকে একইভাবে ভাঁজ করলেন। তারপর কড়িখেলার সময় যেমন মুঠোয় করে কড়িগুলোকে ঝাঁকাতে হয় সেইভাবে ঝাঁকিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। হেসে বললেন, কে কোন নাম লিখেছ তা আর জানবার উপায় নেই, তাই না? ঠিক আছে, এবার দেখি কাগজগুলোয় কী লেখা আছে!

ভাঁজ খুলে তিনটি কাগজের লেখা পড়লেন। তারপর তাঁর লেকচার টেবলের প্রান্তে বুনসেন বার্নাটা জ্বেলে কাগজ তিনটি তার নীল শিখায়–যাকে বলে উত্তপ্ততম অংশ–মেলে ধরলেন।

সতীশ উঠে দাঁড়ায়। উত্তেজিত ভাবে বলে, এ কী করছেন, স্যার? য়ু কান্ট ডেস্ট্রয় এভিডেন্স!

–এভিডেন্স! কীসের এভিডেন্স? কোন কাগজটা কার লেখা তাই তো আমি জানি না। চল, আমার তদন্তের কাজ শেষ হয়েছে। আমরা এখান থেকে প্রথমে যাব থানায়। তিনটি ছাত্রের জামিনের ব্যবস্থা করতে। এবং অ্যাবডাকশান কেসটা ডায়েরি করতে। তারপর একদল যাবে কৃষ্ণার বাড়ি। সে দলে নিবেদিতা তুমি থাকবে। আর একদল যাবে মেডিকেল কলেজে জলিল, রতন আর দেবু কেমন আছে। খবর নিতে। তাপস তুমি এস বরং আমার সঙ্গে। আর সতীশ তুমি অফিসে যাও, দেবু, রতন আর জলিলের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের বাড়িতে খবর দাও…

–আমি আপনার সঙ্গে থানায় যাব না?

–কী দরকার? দেবু বোস রতন মুখুজ্জে আর জলিল হুসেন এর বাড়িতে খবর দেওয়াটাও তো জরুরী।

–না, স্যার। আমি আপনার সঙ্গে থানাতেই যাব। ওদের তিনজনের বাড়িতে খবর দেবার ব্যবস্থা আমি নিশ্চয় করব। এখনই! কিন্তু জোয়াদ্দারদা নেই, ইউনিয়ানের তরফে আমার থানায় যাওয়াটা কর্তব্য।

–অল রাইট। তাই যদি তুমি মনে কর, তাহলে তুমিও এস।

তাপস জানতে চায়, একটা ট্যাক্সি ধরব, স্যার?

–না, আমার গাড়িটা হিন্দু স্কুলের সামনে পার্ক করা আছে। আমরা তাতেই যাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *