আম্রপালী – ৫

০৫.

পরদিন গাড়ি নিয়ে কলেজে এলেন না। উনি চান না, ঐ ‘মেঘচুম্বিত অ্যাপার্টমেন্ট’ হাউসের সামনে রাস্তার উপর গাড়িটা পার্ক করতে। কলেজ থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যখন ওখানে পৌঁছলেন তখনও নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়নি। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে স্বয়ংক্রিয় লিফটে উঠে এলেন আটতলায়। অধিকাংশ ফ্ল্যাটই খালি। বস্তুত, মিস্ত্রিরা এখনও কাজ করছে এখানে-ওখানে। নিচে অবশ্য তমাধারী দারোয়ান বসে ছিল। চোখ তুলেও দেখল না।

এইট/টোয়েন্টি নম্বরচিহ্নিত দরজা। একটা নেমপ্লেট : এস সোন্ধী।

কল-বেল বাজাতে গিয়ে ইতস্তত করলেন কিছুটা। মিনিটতিনেক। তার ভিতর একবার মাত্র লিফটটা উপর থেকে নিচে নামল। একজোড়া চড়ুই পাখি রেলিঙে এসে বসে বিহঙ্গভাষে নিজেদের মধ্যে কী-যেন বলাবলি করল। এ-ছাড়া চরাচর নিস্তব্ধ। মনেই হচ্ছে না, এটা জনাকীর্ণ কলকাতা শহর।

প্রফেসর তালুকদার মরিয়া হয়ে কল-বেলটার গলা টিপে ধরলেন।

তৎক্ষণাৎ ম্যাজিক-আইয়ের ও প্রান্তে এগিয়ে এল একটা কৌতূহলী চোখ।

সে চোখে কাজল-পরা আছে কি না বোঝা গেল না, কিন্তু ভারি পাল্লাটা পাঁচ সেন্টিমিটার আন্দাজ ফাঁক হল। তারপর আটকে গেল সেফটি ক্যাচ-এ।

ও-প্রান্ত থেকে বামাকণ্ঠে প্রশ্ন হল : হুম ডু ঝু ওয়ান্ট প্লিজ?

–মালিনী, মালিনী সোন্ধী! ডাজ শি লিভ হিয়ার?

–ইয়েস অ্যান্ড নো। বাট হুম শ্যুড আই অ্যানাউন্স?

–মিত্র। এস. মিত্র।

দরজাটা খুলে গেল : ‘একী, আর্যপুত্র যে!’

উনি প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর পিছনে বন্ধ হয়ে গেল ইয়েল-লক সদর দরজা। এবং করিডোরে জ্বলে উঠল জোরালো বাতি।

অসতর্ক অধ্যাপকের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল : আপনি?

মেয়েটি–-মহিলাটিই বলা উচিত–চলতে শুরু করেছিল। এ কথায় থমকে থেমে গিয়ে বললে, তুমি কি. ট্রিলজি লিখবে বলে মনস্থির করে ফেলেছ?

–ট্রিলজি! মানে?

–প্রথম খণ্ডে নায়িকা ‘আপনি’, দ্বিতীয় খণ্ডে ‘তুমি’, তৃতীয় ও শেষ খণ্ডে আজকাল তোমাদের কলেজে ছেলে-মেয়েরা যা করে : ‘তুই-তোকারি’!

–আমি কলেজে পড়াই কে বলল?

–কে আবার? তুমি! এস! এখানে দাঁড়িয়ে কথা কইলে বাইরের প্যাসেজে শুনতে পাওয়া যায়। তা হঠাৎ ‘আপনি’ বলে থেমে গেলে যে? তুমি কি আগে আমাকে কোথাও দেখেছ?

চলতে চলতে ওঁরা এসে বসলেন ড্রইংরুমে। প্রকাণ্ড ঘর, কিন্তু ভালভাবে সাজানো নয়। ড্রইংরুমটা বড়, বেশ বড়, কিন্তু সোফা-সেটি কিছু নেই। খানকয় ফোন্ডিং চেয়ার। একটা ক্যানভাসের ইজিচেয়ার। দেওয়ালে ছবি, ক্যালেন্ডার একটাও নেই। মায় সিলিঙে ফ্যান পর্যন্ত নেই। অথচ দেওয়ালে সিন্থেটিক এনামেলের মোলায়েম প্রলেপের কুহক।

–কী দেখছ?

–এমন সুন্দর ফ্ল্যাট, অথচ এমন ন্যাড়া কেন?

–ডির্ভোসের সময় মানি-সেটলমেন্টে ফ্ল্যাটটা পেয়েছি, ফার্নিচার নয়। ধীরে ধীরে কিনতে হবে। কিন্তু তুমি আমার প্রথম প্রশ্নটার জবাব দাওনি। তুমি কি আমাকে আগে কোথাও দেখেছ?

–বাস্তবে নয়। ফটোতে। ‘পত্রমিতালী’র প্রচ্ছদে। থার্ড ইস্যুতে।

–আই সি। হ্যাঁ, ওটা আমারই ছবি। কিছু খাবে?

-–খাব? এই বেলা আড়াইটার সময়? আমার বয়সটা কত তা তো আমি বলেছি, মিসেস সোন্ধী।

–আমি মিসেস সোন্ধী নই। তুমি আমাকে ‘মালিনী’ বলেই ডেক। আর ‘খাবে’ প্রশ্নটা রিডিক্লাস মনে হচ্ছে, যেহেতু হিন্দি বা ইংরেজির মতো ঐ ক্রিয়াপদের চলিত বাঙলা নেই। লাইক টু হ্যাভ আ ড্রিংক? এত গরমে এলে তো, তাই বলছি। জিন অ্যান্ড লাইম? দেব একটা?

–নো, থ্যাংস। আমি মদ্যপান করি না।

–গুড হেভেন্স! ‘জিন’ মদ নয় গো, সাহিত্যিক মশাই। আপনার প্রফেশনাল ছদ্মনামটা কী দয়া করে জানাবেন? ‘জিন’কে যিনি মদ বলেন, তিনি কী জাতের কথাসাহিত্য রচনা করতে সক্ষম, আমি জানতে কৌতূহলী।

–আমার কথা থাক। তোমার কথা শুনতে এসেছি। সন্ধ্যায় তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। ফলে ঘণ্টা-তিনেক তোমার সঙ্গে আলাপচারি করলে কী পরিমাণ সম্মান-দক্ষিণা দিতে হবে সেটা সর্বাগ্রে জেনে নিতে চাই।

–আলাপচারি?

–হাঁ, তাই। তুমি বেণীর সঙ্গে মাথাটাও দিতে প্রস্তুত; কিন্তু আমি শুধু বেণীটুকুই সংগ্রহ করতে এসেছি। আই ওয়ান্ট য়োর স্টোরি, অ্যান্ড নাথিং বাট ইট!

–‘ওনলি-বিমল’-স্টোরি?

এক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, অঙ্কটা ভেরিএবল। বাড়ে কমে। সেটা নির্ভর করে পার্টির স্যাটিসফ্যাকশানের উপর।

–স্যাটিসফ্যাকশান? সন্তুষ্টি?

–তাই বলেছি আমি। তুমি নাকি মাথা বাদ দিয়ে শুধু বেণীটুকু নিতে এসেছ। তা সেই বেণীটা দিয়ে তোমাকে স্যাটিসফাই করতে হবে না? আরও সহজ ভাষায় : তুমি এসেছ একটা প্লটের সন্ধানে–জানতে যে, যৌনপত্রিকায় যে মেয়েটি মডেল হতে রাজি, সে কেন কারও ঘরণী নয়, সে কেন নয় কারো ‘মা’? তাই তো?

–একজ্যাক্টলি। কেন? কেন? কেন?

–সেই কিস্সা শুনিয়ে তোমাকে স্যাটিসফাই করতে হবে প্রথমে। তুমি না পরে বলতে পার–এ তো জানা প্লট, মোপাসা, টুর্গেনিভ বা ব্যালজাকে পড়েছি।

অধ্যাপক তালুকদার একটু ঝুঁকে বসেন সামনের দিকে : জাস্ট আ মিনিট। তোমার পড়শুনাটা কদ্দুর?

–নাউ য়ু আর টকিং, প্রফেসর! পড়াশুনা! অব এ প্রস্টিট্যুট!! হাঃ!

-–ঠিক আছে। পড়াশুনার কথা থাক। তোমাদের বিবাহিত জীবন কতদিনের?

–লেস দ্যান আ ইয়ার। কেন? সে কথা কেন?

–মাত্র এক বছর! প্রেম করে বিয়ে!

মেয়েটি দৃঢ়ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল, ওসব কথা থাক– লেটস গো টু দ্য বেডরুম। ওখানে ফ্যান আছে। ড্রিংস যখন করবেই না।

–কী দরকার? আমার তো গরম লাগছে না?

–আমার লাগছে।

–একটা হাত-পাখাটাখা নিয়ে এস তাহলে।

ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল দেড় মুহূর্ত! তারপর বললে, বাট হোয়াই? প্রস্ কোয়ার্টার্সে আসতে পারলে, আর তার বেডরুমে গেলেই জাত যাবে?

-–’জাত যাবে’ তা তো আমি বলিনি।

–বলনি, বাট য়ু আর বিহেভিং…ওয়েল, আমি গা গেকে ব্লাউজটা খুললে তুমি মূৰ্ছা যাবে না তো? সত্যিই আমার এখানে গরম লাগছে….

প্রফেসর তালুকদার হেসে ফেলেন।

বলেন, না মালিনী! তুমি গা থেকে ব্লাউজটা খুললে আমি মূৰ্ছা যাব না। ইন ফ্যাক্ট, ঐ অবস্থাতেই তো তুমি ফটোটা তুলিয়েছিলে, তাই নয়?…ঐ পত্রিকায়?..দেখে আমি তো মূৰ্ছা যাইনি….

মেয়েটি দুম্‌ দুম্ করে উঠে গেল বেডরুমে। প্রফেসর তালুকদার অন্যমনস্কের মতো পাশের টি-পয়ে রাখা একটা ফটো-অ্যালবাম তুলে নিলেন। পাতা উলটেই বুঝতে পারলেন, সেটা বিশেষ উদ্দেশ্যে ওখানে অবিন্যস্তভাবে সুবিন্যস্ত। ফটো-অ্যালবামে মেয়েটির একাধিক আলোকচিত্র। নানান মাপের। ও নিশ্চয় কোনো ফটোগ্রাফারের মডেল।

পত্রিকায় তবু নচের আড়াল ছিল। এখানে একাধিক ন্যূড-ফটোগ্রাফ। ‘খদ্দের’কে ওয়র্ম-আপ করার অ্যাপিটাইজার।

নিঃশব্দে অ্যালবামটা স্বস্থানে নামিয়ে রাখলেন।

ঘরের ভিতর থেকে প্রশ্ন হল, সরবতে আপত্তি আছে? লিমন্ স্কোয়াশ? নাকি আমার ছোঁওয়া খাওয়া যাবে না?

তালুকদার বেডরুমের দিকে মুখ করে নেপথ্যচারিণীকে বললেন, তুমি অহেতুক আমাকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করছ, মালিনী। নিয়ে এস। লিমন-স্কোয়াশ নয়, ‘জিন-উইথ লাইম স্কোয়াশ’। দু পাত্ৰই এনো। তুমিও খাও নিশ্চয়?

একটু পরে শয়নকক্ষের পর্দা সরিয়ে মালিনী এ ঘরে এল। তার দুহাতে কাঁচের গ্লাস। উপরে বরফের কিউব। শুধু ব্লাউস নয়, অধোবাসটিও সে ঘরের ভিতর খুলে রেখে এসেছে।

একটা গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রেখে সে মুখোমুখি বসে বললে, এই যে বললে ‘মদ্যপান’ কর না।

–গুড হেভেন্স। ‘জিন’ মদ নয় গো, জনপদকল্যাণী। আপনার প্রফেশনাল ছদ্মনামটা কী, দয়া করে জানাবেন? ‘জিন’কে যিনি ‘মদ’ বলেন, তিনি কী-জাতের রতিরঙ্গকুহক রচনা করতে সক্ষম, আমি জানতে কৌতূহলী!

–দ্যাটস্ এ গুড ওয়ান! জিন আগে কখনো পান করেছ?

–করিনি! ইতিপূর্বে কোনো জনপদকল্যাণীর প্রমোদভবনে…বাই দ্য ওয়ে… ‘জনপদকল্যাণী’ কাকে বলে জান তো?

ওর হাতের গ্লাসে গ্লাসটা ঠেকিয়ে বললে, চিয়ার্স! জানি।

একটা চুমুক দিয়ে প্রফেসর তালুকদারের মনে হল, ও গুল মারছে। প্রশ্ন করেন, অজন্তা-গুহায় একটি জনপদকল্যাণীর ছবি আছে, কোথায় তা জান?

–জানি। কেভ সিক্সটিন। সব গাইড বইতে যাকে ভুল করে লেখে ‘দ্য ডাইং প্রিন্সেস’। মেয়েটি রাজনন্দিনী আদৌ নয়। আমারই মতো জনপদকল্যাণী।

রীতিমতো অবাক হলেন অধ্যাপক তালুকদার। মেয়েটির পড়াশুনার রেঞ্জটা জানা নেই। কিন্তু ও সেই জাতের উত্তরাধিকার বহন করছে, প্রাচীন গ্রীসে যাদের বলত ‘হেটেরা’, প্রাচীন ভারতে ‘রাজনৰ্তকী’।

আর এক সিপ পান করলেন। জিন আগে কখনও পান করেননি।

স্বাদটা ভালই লাগছে। একটু কড়া! বোধহয় এক গ্লাসে ডবল-পেগ দিয়েছে।

দুজনেই নিঃশব্দে পান করতে থাকেন।

তারপর মালিনী বললে, এবার তোমাকে তোমারই অস্ত্রে বধ করব অধ্যাপক। বল তো, বৌদ্ধযুগে একজন অযোনিসম্ভবা জনপদকল্যাণী সে-কালীন শ্রেষ্ঠ ভেষগাচার্যকে গর্ভে ধারণ করে….

তালুকদার ওকে কথাটা শেষ করতে দিলেন না। তাঁর বাঁহাতে ধরা ছিল পানপাত্রটা, ডান হাত বাড়িয়ে চেপে ধরলেন ওর গজদন্তশুভ্র বাহুমূল। উত্তেজিতভাবে। বলে ওঠেন, তুমিও কি তা পার না কল্যাণী? সেই অযোনিসম্ভবা জীবমাতা আম্রপালীর মতো? এই তিনশ বছরের বুড়ি কলকাতা-শহরের ট্রামরাস্তার উপর দাঁড়িয়ে সমকালকে ফুকারে উড়িয়ে দিয়ে শাশ্বত আম্রপালীর মতো উদাত্ত নির্ভীককণ্ঠে ঘোষণা করতে : প্রভু বুদ্ধ লাগি, আমি ভিক্ষা মাগি…..

মেয়েটি হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল।

ওর চোখজোড়া আর্দ্র হয়ে উঠল। যে-হাত ওর বাহুমূল ধরে আছে তার উপর একটি হাত আলতো করে চাপা দিয়ে বললে, আমার গর্ভেও এসেছিল জীবক! জানলে? কিন্তু কী করব? তথাগত তো কোনদিনই এসে পদধূলি দিলেন না এই আম্রপালীর সর্বতোভদ্রে! তেমন করে কেউ যে আমার কানে কানে বীজমন্ত্রটা…

ঘরের টেবিল-ল্যাম্পটা বার-দুই দপ্ করে জ্বলে কী-যেন ইঙ্গিত করে নিভল।

তালুকদার বলেন, লোডশেডিং হল নাকি?

মেয়েটি ভ্রূক্ষেপ করল না। বলে, একটা কথার সত্যি জবাব দেবে, অধ্যাপক?

বেশ নেশা হয়েছে। ঘরটা দুলছে।

তালুকদার বললেন, কী জানতে চাও? জিজ্ঞেস করে দেখ…..

গ্লাসের তলানিটুকুও গলায় ঢেলে দিলেন।

মালিনী উঠে গেল বেডরুম-এ। শূন্য পান-পাত্র দুটি নিয়ে।

ফিরে এল একটু পরেই। পূর্ণপাত্র হাতে। নির্দ্বিধায় একটি পাত্র গ্রহণ করলেন তালুকদার। ওঁর মনে পড়ল না, কোথায় বসে আছেন, মনে পড়ল না বাড়ি ফেরার কথা, অথবা ‘অ্যালকোহল’-এর প্রতিক্রিয়া আগে কখনো উপভোগ করেননি। আবার এক চুমুক পান করে বললেন, কী জানতে চাইছিলে, আম্রপালী?

–তুমি লিখেছিলে যে, তুমি বিবাহিত। মিসেস মিত্র কি জানেন যে, তুমি আম্রপালীর প্রমোদভবনে আজ এসেছ স্পর্শ-বাঁচানো পূজা সংখ্যার প্লটের সন্ধানে?

একটু থমকে গেলেন উনি। প্রণতির প্রসঙ্গ উঠে পড়তে পারে এটা বোধহয় আন্দাজ করেননি। একটু গম্ভীর স্বরে বললেন, না! সে হতভাগিনী কিছুই জানে না। আর, স্পর্শ তো বাঁচেনি, আমি তোমার বাহুমূল চেপে ধরেছি কামোন্মত্ত না হলেও উত্তেজিত হয়ে…

–আমি তো তোমার ঠিকানা জানিই। আমি যদি গিয়ে তাঁকে বলে আসি?

ধীরে ধীরে মেয়েটির বাহুমূল ছেড়ে দিলেন। শয্যালীন একটি প্রৌঢ়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওঁর। বললেন, খুব সম্ভবত তুমি তাঁর বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারবে না। এ তাঁর চিন্তার বাইরে। দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছরের দাম্পত্যজীবন আমাদের। কিন্তু যদি কোনভাবে তুমি অকাট্য প্রমাণ দাখিল করতে পার, তাহলে সে মর্মান্তিক আহত হবে। হয়তো মরে যাবে! ইয়েস! মরেই যাবে!

খিলখিল করে হেসে ওঠে প্রগলভা রূপোপজীবিনী। ওরও বেশ নেশা হয়েছে এতক্ষণে।

বলে, মরে যাবে? অ্যাকেরে মরে যাবে? হিংসেয়? বুক ফেটে? যাঃ!

সোজা হয়ে বসলেন প্রফেসর তালুকদার।

পানপাত্রটা নামিয়ে রাখলেন টুলে।

এই প্রথম বিচলিতবোধ করলেন উনি। মনে হল, কাজটা ঠিক হয়নি, ঠিক হচ্ছে না! এ জাতীয় আলোচনা উঠে পড়তে পারে, তা আন্দাজ করেননি।

গম্ভীর হয়ে বললেন, হ্যাঁ, তাই! কথাটার ঠিক বাংলা নেই, তাই তোমার কাছে ‘রিডিক্লাস’ মনে হচ্ছে! কিন্তু লিটারালি ‘বুক ফেটে’ই মরে যাবে সে! আসলে ওর হার্ট খুব দুর্বল। প্রেশার খুব হাই! ও…ও একজন ‘ইনভ্যালিড’… ক্রিপড! চিররুগ্না। বাথরুমে পর্যন্ত যেতে পারে না। আমি পাঁজা-কোলা করে নিয়ে যাই…

বেদনার্দ্র হয়ে উঠল প্রগলভার মুখ।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। জানতে চাইল, কতদিন? কতদিন উনি শয্যাশায়ী?

তালুকদার ওর চোখে-চোখে তাকিয়ে বললেন, এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমার ভাগ্যের অদ্ভুত মিল!

–মানে?

–আমার বিবাহিত জীবনও—’বায়োলজিকাল’ অর্থে বলছি–এক বছর। তারপর একটা অ্যাকসিডেন্টে…

তার মানে বলতে চান বিশ-পঁচিশ বছর ধরে আপনি…

–আঠাশ বছর। কিন্তু হঠাৎ ‘আপনি’ কেন? ট্রিলজি লিখবে নাকি?

ধীরে ধীরে আবার বসে পড়ে।

এবার চেয়ারে নয়। ওঁর সামনে, মেঝেতে। দু-হাতে ওঁর হাটু-জোড়া জড়িয়ে ধরে বলে, আয়াম সরি! রিয়েলি সরি!

–য়ু নিড্‌ন্ট বি! তোমার দুঃখিত হবার কী আছে?

–ওঁর অসুস্থতা নিয়ে আমি রসিকতা করেছি, ব্যঙ্গ করেছি—

–কিন্তু তখন তো তুমি সব কথা জানতে না।

ওঁর কোলে মাথাটা রাখল। বন্ধনীমুক্ত হৃদয়োচ্ছ্বাসের যুগল পেলব স্পর্শ অনুভব করলেন জানুতে। সংযতস্বরে বললেন, চেয়ারে উঠে বস, আম্রপালী!

–বসছি। তার আগে একটা কথা বলুন…আপনি কি, মানে এই দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে…

–হ্যাঁ, তাই! বেণীর সঙ্গে মাথা দিতে চেয়েছিলে তুমি; আমি প্রত্যাখ্যান করেছি, কিন্তু জিন-উইথ-লাইমের মতো সে ‘আনন্দ’ অনাস্বাদিতপূর্ব নয় আমার কাছে! আঠাশ বছর আগে…

ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, কিন্তু কেন? পাপ-পুণ্য মান বলে?

–না, আম্রপালী–আমি বৈজ্ঞানিক! পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক আমাদের মানতে নেই!

–আর ঈশ্বর?

–ঈশ্বর ওয়াজ আউট অব বাউন্ডস্ ঈভন টু দ্য লর্ড বুদ্ধা, জীবকমাতা!

–তাহলে কেন? কেন এই তিন দশকের ব্রহ্মচর্য? পার্সোনাল এথিক্স?

মাথা ঝাঁকি দিয়ে প্রৌঢ় মানুষটি বলে ওঠেন, আমার কথা থাক আম্রপালী। আমি জানতে এসেছি তোমার কথা। সেই কথা বল। লুক হিয়ার! আমি মহামানব তথাগত নই। জনপদবধূ আম্রপালীকে রাতারাতি বৌদ্ধ ভিক্ষুণীতে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা আমার নেই। বাট…বা…আমি সাহিত্যিক…আমি কথাশিল্পী…আমি কবি। সমাজের কাছে আমি দায়বদ্ধ…’দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর, তার পরে ছুটি নিব’! এই কণ্টাকাকীর্ণ সমাজে ঐটুকুই আমার দায়িত্ব। শুধু দু-একটি কাঁটা…আই মাস্ট নো, কেন তোমার মতো একটি রমণীরত্ন….

মেয়েটি কী একটা কথা বলতে চায়। উনি হাত বাড়িয়ে তার মুখটা চাপা দিলেন। বলেন, আমার বলা শেষ হয়নি আম্রপালী! আমি যেমন গৌতম বুদ্ধও নই, তেমনি ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষিও নই। ঠিক জানি না, হয়তো আত্মপ্রতারণা! হয়তো শুধু সত্যের সন্ধানে নয়, সৌন্দর্যের সন্ধানেই আমি ছুটে এসেছিলাম–ঠিক যেমন করে দু’হাজার বছর আগে প্র্যাক্সিটেলেস ছুটে যেতেন ফ্রিনের কাছে…

বাহুবন্ধন মুক্ত করে নিজে থেকেই সরে যায় মেয়েটি।

বলে, ‘ফ্রিনে’ কে, আমি জানি না।

–‘প্র্যাক্সিটেলেস’কে জান?-

-না! কোনো গ্রীক দার্শনিক?

–না! দার্শনিক নন। সমকালের তো বটেই, বোধকরি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর। ‘ভেনাস ডি মিলো’ হয়তো তাঁরই কীর্তি। তিনি ভালবেসেছিলেন ফ্রিনেকে। ফ্রিনে, এথেন্সের সর্বশ্রেষ্ঠা সুন্দরী হেটেরা, জনপদকল্যাণী! অনাবৃতা ফ্রিনেকে মডেল করে একাধিক ভেনাস মূর্তি গড়েছিলেন প্র্যাক্সিটেলেস। তার একটির পাদমূলে আজও খোদাই করা আছে গ্রীক ভাষায় শিল্পীর স্বীকৃতি, যার ইংরাজী অনুবাদ “Praxiteles hath portrayed to perfection the Passion (Eros), drawing his model from the depths of his own heart and dedicated Me to Phryne, as price of Me”

–ইংরেজিতে বলছ কেন? আর কী বিদঘুঁটে ইংরেজি!

–হ্যাঁ, তার কারণ গ্রীকভাষা থেকে অনুবাদক আক্ষরিক অনুবাদ করেছিলেন। তাও দু-তিনশ বছর আগে। চসার আর শেক্সপীয়ারের অন্তর্বর্তীকালে। আমি নিজেই একটা বাংলা অনুবাদের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু নিজেই তার অর্থ বুঝিনি।

মালিনী হাসল।

বলল, শুনি তোমার অনুবাদ?

“–অ্যাক্সিটেলেস তাঁর অন্তরের অন্তস্তল থেকে (দেহজ) কামনার অনিন্দিত ব্যঞ্জনাটি এখানে মূর্ত করেছেন, আর সেজন্যই আমাকে উৎসর্গ করে গেছেন ফ্রিনের উদ্দেশ্যে–সেইতো আমার মূল্য।”

–কিন্তু তা কি সম্ভব? প্র্যাক্সিটেলেস কি ‘ভেনাস’-এর সত্য-শিব-সৌন্দর্যের নাগাল পেয়েছিলেন ফিনেকে অস্বীকার করে? অপমান করে?

–অপমান করে?

–নয়? তুমি আমার নারীত্বকে অস্বীকার করছ, অপমান করছ! তোমায় হৃদয় দিয়ে নয়, মানিব্যাগ থেকে আমার সম্মানমূল্য মেটাতে চাইছ? এভাবে তো হয় না প্র্যাক্সিটেলেস! Pay the price of Phryne! ফ্রিনের নারীত্বের মর্যাদা যে তোমাকে সর্বাগ্রে মিটিয়ে দিতে হবে। অর্থ দিয়ে নয়, সর্বাঙ্গ দিয়ে।

ধীরে ধীরে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন প্রৌঢ় অধ্যাপক তালুকদার।

বললেন, আয়াম সরি।

দুটি হাত বাড়িয়ে দিলেন সামনের দিকে। সবলে বুকে টেনে নিলেন ওকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *