১২.
হাসপাতাল সেরে মহিম হালদারের আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছালেন তখন পড়ন্ত বিকাল। সাড়ে চারটে। বাড়ির সামনে অনেকগুলি গাড়ি দাঁড়িয়ে। অ্যামবাসাডার, মারুতি, মায় একটি মার্সেডিজ। মহিমবাবু একাধিকবার চুনাওয়ে জয়ী হয়েছেন। দশবছর আগে ইঁটের পাঁজরা বার করা যে একতলা পৈত্রিক বাসভবনে এই রাজনীতির ব্যবসা শুরু করেন, পর-পর দুবার দেশসেবার অধিকার পেয়ে সে বাড়ি আজ ত্রিতল। একতলায় বেশ বড় একটা হল-কামরা। ব্যারিস্টার বা পশারওয়ালা ডাক্তারদের যেমন থাকে। সামনের দিকে একটি প্রতীক্ষাগারে সোফা সেটি-চেয়ার, বেঞ্চি। আর তার পরে অটোমেটিক ডোর-ক্লোজার লাগানো টীক-প্লাই-এর ফ্লাশ-পাল্লার আড়ালে বাতানুকূল-করা সাহেবের চেম্বার–থুড়ি, এক্ষেত্রে ‘দাদা’র খাশ-কামরা।
গাড়ি পার্ক করে তালুকদার-সাহেব তাপসকে নিয়ে প্রবেশ করলেন বাইরের ঘরে। একাধিক সাক্ষাৎপ্রার্থী অপেক্ষা করছে। বাঙালি এবং অবাঙালি। উনি এক ধারে গিয়ে বসলেন। তাপস একই সোফায় বসতে ইতস্তত করছিল। উনি হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলেন।
একটি লক্কা-পায়রা-মার্কা ছেলে এসে বাড়িয়ে ধরল ছাপানো স্লিপ বুক। তালুকদার মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন।
তাপস হাত বাড়িয়ে সেটা নিল। সাক্ষাৎপ্রার্থীর নাম জানালো : ‘প্রফেসার আর. তালুকদার’। প্রয়োজনের ঘরে : ‘অ্যাজ আপয়েন্টেড’।
ছেলেটি কাগজটা নিয়ে ভিতরে গেল।
পরমূহুর্তেই ফ্লাশ-পাল্লাটা খুলে গেল। দুজন যুবক বার হয়ে এল। ডানে-বাঁয়ে তাকালো না। সোজা বেরিয়ে গেল রাস্তায়। ওদের ভিতর একজনকে চিনতে পারলেন তালুকদার-সাহেব। ঐ ছেলেটির ফটোই আছে তাঁর অ্যাটাচি-কেসে। এখন জিন্স্-এর প্যান্ট নয়, গোল-গলা স্পোর্টস্ গেঞ্জিও নেই গায়ে, কিন্তু মাথার উপর পাখির বাসাটি আছে অবিক্ষত। উনি তাপসের দিকে আড়চোখে তাকালেন। তাপসের ঘাড় সোজাই রইল। শুধু চোখ জোড়া ইঙ্গিতপূর্ণভাবে একবার বন্ধ হয়ে খুলে গেল।
একটু পরে এল সেই লক্কা-পায়রা। তালুকদারের কাছাকাছি এসে বললে, আসুন স্যার, দাদা আপনাকে ভিতরে যেতে বললেন।
সাত-আট জোড়া চোখ–ঐ যারা প্রতীক্ষায় বসে আছেন, খোদায় মালুম কতক্ষণ!–ওঁর উপর পড়ল। তালুকদার ভ্রূক্ষেপ করলেন না। তাপসকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে গেলেন। খাশ-কামরার ভিতর। লঙ্কা-পায়রাও এল পিছন-পিছন।
–আসুন, আসুন, প্রফেসর তালুকদার। ওদের কেমন দেখে এলেন?
–ওদের? মানে কাদের?
–আপনি তো মেডিকেল কলেজ থেকেই আসছেন?
-–ও হ্যাঁ। মোটামুটি ভালই আছে। তবে স্ট্যাব-কেসটা একটু গোলমেলে। জ্ঞান হয়নি এখনো।
–আজ্ঞে না। দেবু স্ট্রং সিডেটিভে আছে। ডাক্তারবাবু তো তাই বললেন টেলিফোনে।
অর্থাৎ মহিম হালদার খোঁজ-খবর ঠিকই রাখছেন।
হঠাৎ তাপসের দিকে তাকিয়ে বলেন, এ ছেলেটি কে? ঠিক চিনতে পারছি না তো?
–আমাদের কলেজেরই। একজন ছাত্রনেতা। তাপস…।
–অ। তা ভাই তাপস, তুমি একটু ও-ঘরে গিয়ে বস। আমি প্রফেসার তালুকদারের সঙ্গে জনান্তিকে কিছু…
–ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি ও-ঘরে অপেক্ষা করছি।
তাপস বেরিয়ে যায় শশব্যস্তে।
মহিম হালদার এবার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, শুনুন প্রফেসর তালুকদার…
প্রফেসর তালুকদার বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, দাঁড়ান শুনছি। এ ছেলেটি কে? ঠিক চিনতে পারছি না তো?
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লঙ্কা-পায়রাটিকে দেখিয়ে দেন।
–ও, মানে আমার ছোট ভাইয়ের মতো। সেক্রেটারি আর কি। অনেকদিন ধরে কাজ করছে। পার্টি-ক্যাডার। তপেন….
–অ। তা ভাই তপেন, তুমি একটু ও-ঘরে গিয়ে বস। আমি ওঁর সঙ্গে জনান্তিকে কিছু বলতে চাই…
মহিম হালদার ঝানু লোক। ঢোক গিললেন তিনি। তাঁর সঙ্গে চোখে-চোখে কথা হল তপেনের। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সে।
এবার তালুকদার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, বলুন?
–প্রথম কথা মেয়েটি এখনো আনট্রেসড। মিনিট-দশেক আগেও আমি টেলিফোনে কথা বলেছি ডঃ সেনের সঙ্গে।
–ডঃ সেন কে?
–ডঃ অপরেশ সেন, প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার। কৃষ্ণার বাবা। কৃষ্ণার মা নেই। বাড়িতে আছেন বাবা, এক ভাই আর ছোট বোন। ডঃ সেন জানাচ্ছেন, মেয়ের কোন হদিসই পাননি। আমি আই. জি. ক্রাইমকে টেলিফোনে ব্যাপারটা জানিয়েছি। সমস্ত পুলিস স্টেশনকে অ্যালার্ট করা হয়েছে… যে কোন মুহূর্তে সেই কালো অ্যামবাসাডারটা ধরা পড়তে পারে…
–তা পারে। আবার নাও পারে। কিন্তু আমাকে আপনি দেখা করতে বলেছিলেন কেন? কী পরামর্শ করতে?
–ঐ মেয়েটির সম্বন্ধে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিতে। কেমন চরিত্রের মেয়ে সে? আপনি কিছু জানেন? শুনেছি, জলসায়-জলসায় গান গেয়ে বেড়াতো?
প্রফেসার তালুকদার সে-কথার জবাব না দিয়ে একটি প্রতিপ্রশ্ন পেশ করেন, জয়ন্ত চৌধুরীর সঙ্গে কি এর মধ্যে আপনার যোগাযোগ হয়েছে, আমি এফ. আই. আর. লজ করার পর?
–হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
–সে কি বলেনি, আমি একজন সন্দেহভাজন অ্যান্টিসোশালের নাম লিখেছি?
–হ্যাঁ, তাও বলেছে। পুরো নামটা জানেন না, আন্দাজে কী দু-তিনটে নাম…
–তাই হয়, মিস্টার হালদার। অ্যান্টিসোশালদের একাধিক নাম থাকে। এক এক এলাকায় এক-একটা। আমি যার কথা বলছি…
হঠাৎ মাঝপথে থেমে গিয়ে উনি অ্যাটাচি-কেসটা খুলে কালীপূজার স্মারক পত্রিকাখানা বার করে আনেন। ছবিটা ওঁর টেবিলে মেলে ধরে বলেন, এই ছেলেটির কথা আমি বলতে চাই– কেউ ওকে জানে লালটু নামে, কেউ লালু, কেউ শুধুই মস্তান। ছেলেটিকে চেনেন?
মহিম হালদার তৈরি ছিলেন। বললেন, আমিও এমনটা আশঙ্কা করছিলাম। এ একটা সাজানো কেস। কৃষ্ণা সেন আদৌ অপহৃতা হয়নি। আমাদের একজন অ্যাকটিভ পার্টি ক্যাডারকে ফাঁসানোর জন্য গোটা কেসটা সাজানো। আপনি যে ছেলেটিকে নির্দেশ করছেন ওর নাম লালটুও নয়, লালুও নয়, লালমোহন বিশ্বাস। ওকে ফাঁসানোর জন্য এর আগেও এভাবে কেস-সাজানো হয়েছিল। ভাড়া-করা প্রত্যক্ষদর্শীরা ভিড় করে এসেছিল থানায় এজাহার দিতে। তবে এবার ওদের চালে একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে, প্রফেসার তালুকদার। শুনুন…
মহিম হালদার জানালেন, তিনি সকালে তাঁর নিজস্ব গাড়ি নিয়ে বারাসত গিয়েছিলেন। সকাল ছয়টার ওঁরা রওনা হন, ফিরে আসেন একটার সময়। গাড়িতে ওঁর সঙ্গে ছিলেন জগৎ বাবু, বিশু মৌলিক, ওঁর পুত্র এবং ঐ লালমোহন বিশ্বাস। অ্যাবডাকশন –তা সে সাজানো-কেস হোক বা সত্যিকারের –ঘটে সকাল দশটায়। সে সময় লালমোহন বিশ্বাস সন্দেহাতীতভাবে বারাসতে একটা স্থানীয় পার্টি-মিটিঙে অংশ নিচ্ছে। এম. এল. এ. মহিমবাবুর চোখের সামনে! আরও সাত-আটজন পার্টি মেম্বারদের চোখের সামনে।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল প্রফেসার তালুকদারের।
তারপর বললেন, ঐ লালমোহন বিশ্বাস-মশাই কি মিনিট পাঁচেক আগে এই ঘরে ছিলেন? আমি এ-ঘরে ঢোকার আগে?
মহিমবাবু হেসে বলেন, ‘বিশ্বাস-মশাই’ বলার দরকার নেই, ও আপনার ছেলের বয়সী। হ্যাঁ, ছিল।
–তা হোক। লালুবাবু আপনাদের পার্টির সম্মানিত কর্মী তো বটেন।
মহিমবাবু গুম খেয়ে যান।
তালুকদার উঠে দাঁড়ান। বলেন, আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী অনেক-অনেকজন বসে আছেন দেখলাম। অযথা আপনার সময় আর নষ্ট করব না। চলি তাহলে, নমস্কার।
মহিমবাবু জবাব দিলেন না। হাত দুটি জোড় করলেন মাত্র।
বাইরে এসে তাপসকে নিয়ে রাস্তায় নেমে এলেন। গাড়িতে উঠে বললেন, কৃষ্ণার বাবা ডাক্তার?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, ডাক্তার অপরেশ সেন।
তালুকদার বলেন, তাপস, আমি বড় ক্লান্ত বোধ করছি। দৈহিক যতটা তার চেয়ে মানসিক। ‘কুয়ো ভাদিস’। কোথায় যাচ্ছি আমরা? শোন, আমার বোধহয় একবার ডক্টর সেনের সঙ্গে দেখা করা, উচিত ছিল…
বাধা দিয়ে তাপস বলে ওঠে, স্যার! আমাদের কলেজে কতজন অধ্যাপক আছেন তা আপনিও জানেন, আমিও জানি। সারাদিন না খেয়ে-দেয়ে পেট্রোল পুড়িয়ে কে আপনার মতো সারাটা শহর চষে বেড়াচ্ছে বলুন? আপনি ফিরে যান। আমি কৃষ্ণার বাবার সঙ্গে দেখা করে যাব।
–তাঁকে আমার ফোন নাম্বারটা দিও। আর বল, কৃষ্ণার কোন খবর পেলেই যেন আমাকে জানান।