আম্রপালী – ১০

১০.

ও. সি. জয়ন্ত চৌধুরী ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমাকে ‘তুমিই’ বলবেন স্যার, আমিও ঐ কলেজের ছাত্র। দশ বছর আগে পাশ করে বেরিয়েছি। তবে আমি ছিলাম আর্টস্ বিভাগে, তাই আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না।

তালুকদার বললেন, তাহলে তো ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। আমরা সবাই একই কলেজের। আমার সঙ্গে যে দুজন এসেছে এরা দুই ছাত্রনেতা।

–বলুন, স্যার, কী করতে পারি আমি?

–কলেজের তিনটি ছাত্রকে তোমার পুলিস তুলে এনে হাজতে পুরেছে…

বাধা দিয়ে ও.সি. বলে, কলেজের ভিতর থেকে?

–না। কলেজ স্ট্রিটের ট্রাম-রাস্তা থেকে। গেটের সামনে থেকে। তাদের কী অপরাধ? কেন তাদের অ্যারেস্ট করা হল?

–রাউডিজম। সরকারী সড়কের উপর দাঁড়িয়ে মারামারি করা।

–আমরা এসেছি তাদের জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে।

–নিয়ে যান। আপনি যদি তাদের সনাক্ত করেন এবং পার্সোনাল বন্ড দিতে রাজি থাকেন। তবে একটা কথা : পার্সোনাল বন্ডে তাদের মাত্র চব্বিশ ঘন্টার জন্য হাজতের বাইরে রাখতে পারবেন। কাল সকাল দশটার সময় একজন ফার্স্টক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পুনরায় ওদের জামিন নিতে হবে। সেখানে আমি নিজে উপস্থিত থাকব। জামিন নেবার জন্য কোথায় যেতে হবে তাও আমি বলে দেব।

তালুকদার বলেন, জয়ন্ত, একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে বল তো? এটাই কি তোমার কাছে কলকাতা শহর প্রত্যাশা করে? কলেজের একটি মেয়েকে সর্বসমক্ষে কয়েকজন অ্যান্টিস্যোশাল অপহরণ করে নিয়ে গেল। আর তুমি তোমার কর্তব্য শেষ করলে কলেজের কয়েকটি নিরীহ ছেলেকে গ্রেপ্তার করে, যারা নিরুপায় হয়ে মাঝসড়কে আর্তনাদ করছিল অথবা পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করা হল?

জয়ন্ত নড়ে-চড়ে বসল। বলল, অ্যাবডাকশনের কথাটা আমিও শুনেছি, স্যার। বাট ইটস্ জাস্ট হেয়ার-সে। শোনা কথা। কেউ থানায় এসে লিখিত এজাহার দেয়নি যে, কলেজের একটি মেয়েকে সর্বসমক্ষে অ্যাবডাকট করা হয়েছে।

তালুকদার রুখে ওঠেন, অ্যাজ ইফ কোন একজন এসে থানায় লিখিত এজাহার দিয়ে গেছিল যে, পটল, বাবু আর রহিম রাস্তায় মারামারি করছিল অথবা পুলিসের নিষ্ক্রিয়তায় আর্তনাদ করছিল।

জয়ন্ত নীরব রইল। একটু পরে বলল, ইজ দ্যাট অল, স্যার? আপনি ঐ তিনজনকে জামিনে খালাস করিয়ে নিয়ে যেতে চান, পার্সোনাল বন্ডে। তাই তো?

–হ্যাঁ, সেটা তো বটেই। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। ঐ সঙ্গে আমি এফ. আই. আর. লিখে যেতে চাই ঐ অ্যাবডাকশান কেসটার। কলেজের গেট থেকে কলেজের একটি ছাত্রীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে একটা অ্যামবাসাডার গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে কয়েকজন অ্যান্টিসোশাল।

–আপনি কি প্রত্যক্ষদর্শী?

–না, তবে তিন-তিনটি প্রত্যক্ষদশী আমার কাছে স্বীকার করেছে।

–তাদের সঙ্গে করে আনলেন না কেন, স্যার?

–প্রয়োজন বোধ করিনি। আমি তো এসেছি শুধু এফ. আই. আর. লজ করতে। যারা প্রত্যক্ষদর্শী তাদের নাম-ঠিকানা জানাব আমি। যদি তুমি মনে কর ট্যাক্স পেয়ারদের স্বার্থে তোমার এনকোয়ারি করা উচিত, তাহলে তুমি গিয়ে তাদের এজাহার নেবে।

–যে মেয়েটি অ্যাবডাক্টেড হয়েছে তার নাম কী?

–কৃষ্ণা সেন। থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। হাতিবাগানের কাছে থাকে। পুরো অ্যাড্রেস এফ. আই. আর.-এ জানাব।

–যারা অ্যাবডাক্ট করেছে তাদের কারও নাম কি আপনি প্রত্যক্ষজ্ঞানে জানেন?

–না, পরোক্ষজ্ঞানে জানি। আমার কাছে প্রত্যক্ষদর্শীরা স্বীকার করেছে, তাই জানি।

–কী নাম?

–লালটু অথবা লাল্লু ওস্তাদ!

জয়ন্ত টেবিলের উপর একটা কাগজচাপা নিয়ে অহেতুক কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল। তারপর বলল, এক্সকিউজ মি, স্যার! এটা কি একটা পজিটিভ অ্যাকিউজেশন হল? গোটা নামটা বলতে পারছেন না, উপাধিটা জানেন না, এমনকি নামটাও জানেন না ভাল করে।

তালুকদার-সাহেব সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, কোনও মফঃস্বল কলেজের পাস-কোর্সে পাশ করা গ্র্যাজুয়েট হলে তোমার অভিযোগটা ধোপে টিকত, জয়ন্ত। কিন্তু তুমি যে-কলেজের ছাত্র তাতে আমি আশা করেছিলাম –এটাই যথেষ্ট ক্লু। আমি আশা করেছিলাম, তুমি তোমার এলাকার অ্যান্টিসোশালদের চেন। এনি ওয়ে, তুমি যদি সন্দেহজনক এ-পাড়ার কয়েকটি অ্যান্টিসোশালকে অ্যারেস্ট করতে পার তাহলে আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে আমার দুটি ছাত্রী এবং একটি ছাত্র অপরাধীকে চিহ্নিত করে দেবে। তখন জানা যাবে তার প্রকৃত নামটা কী! আমি তো এখানে কোন লোকের নামে ‘পজিটিভ অ্যাকিউজেশন’ করতে আসিনি। এসেছি, একটা অভিযোগ জানাতে। একটা অপরাধ সংগঠিত হয়েছে সেই তথ্য লিপিবদ্ধ করতে। বাকি কাজ তোমার।

জয়ন্ত তবুও ইতস্তত করে বললে, আপনি কি এফ. আই. আর. এ ঐ লালটু বিশ্বাসের নামটা উল্লেখ করতে চান?

–বিশ্বাস? লালটু বিশ্বাস?

ও. সি. মনে মনে জিহ্বা দংশন করল কি না তা দেখতে পেলেন না, কিন্তু তার সামলে নেবার ব্যর্থ প্রয়াসটা অনুভব করলেন। ও. সি. বললে, আপনিই তো বললেন, লালটু না কী যেন বিশ্বাস!

–না, ‘বিশ্বাস’ উপাধিটা আমি বলিনি, তবে এফ, আই, আর এ লিখব। আমার বিশ্বাস, ওর উপাধিটা এতক্ষণে জানা গেছে।

ঠিক ঐ সময় টেলিফোনটা বেজে ওঠায় বিড়ম্বনার হাত থেকে রেহাই পেল জয়ন্ত। তুলে নিয়ে আত্মঘোষণা করল। তারপর একতরফা অনেকগুলি কথা বলে গেল।

তালুকদার-সাহেব প্রথমদিকে খেয়াল করেননি, ওঁর মনে হয়েছিল জয়ন্তর কোনও উপরওয়ালা পুলিস-অফিসার কথা বলছেন; কারণ প্রায় প্রতি বাক্যের শেষেই জয়ন্ত ‘স্যার’ বলছিল। হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলেন যখন জয়ন্ত টেলিফোনে বললে, না স্যার, ঠিক এখনি যেতে পারছি না। আমি একটা এফ. আই. আর. লেখাচ্ছি…আজ্ঞে হ্যাঁ, ঐ কলেজের কেসটা নিয়েই…ইয়েস, স্যার! কলেজের একজন প্রফেসার এসেছেন ওদের জামিনে ছাড়িয়ে নিতে….

তারপর অনেকক্ষণ কী যেন শুনে গেল। শেষে টেলিফোনের মাউথপিস-এ হাতচাপা দিয়ে প্রফেসার তালুকদারকে প্রশ্ন করে, মহিমবাবু লাইনে আছেন, আপনি কি, স্যার, ওঁর সঙ্গে এই কেস নিয়ে কথা বলতে চান?

তালুকদার জানতে চান, মহিমবাবুটি কে?

তাপস ওঁর কর্ণমূলে বললে, মহিম হালদার! স্ট্যান্ডিং এম. এল. এ….

তালুকদার হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।

জয়ন্ত টেলিফোনে ও-প্রান্তবাসীকে বললে, নিন, স্যার, এবার প্রফেসার তালুকদারের সঙ্গে কথা বলুন।

ওর হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে তালুকদার বলেন, নমস্কার! তালুকদার বলছি…

–নমস্কার, নমস্কার। কিন্তু এ-সব কী হচ্ছে প্রফেসার তালুকদার? আপনাদের কলেজটা যে অ্যান্টিসোশালদের একটা আড্ডা হয়ে উঠছে।

তালুকদার হেসে বললেন, বলছেন? কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে কলেজ-ক্যাম্পাসের বাইরে; এবং অপরাধী কলেজের ছাত্র নয়।

–না, না, অপরাধটা কে করেছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু জয়ন্ত যে বলল তিন-তিনটে ছেলেকে রাউডিজম-এর জন্য ধরে এনেছে?

–আজ্ঞে না, আমি সে-কেসটার কথা বলছি না। আমি বলছিলাম অ্যাবডাকশন কেসটার কথা।

–অ্যাবডাকশন! গুড হেভেন্স! অ্যাবডাকশন হল কখন? কে? কোথায়?

–আপনি বরং ও. সির সঙ্গে কথা বলুন।

যন্ত্রটা উনি হস্তান্তরিত করেন।

জয়ন্ত সংক্ষেপে ওঁকে ব্যাপারটা জানাল। অপহৃতা মেয়েটির নাম জানালো। তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর কথাও; কিন্তু তালুকদার-সাহেব এজাহারে যে নামটা লিখবেন বলে কথা দিয়েছেন তার নামোল্লেখ করল না। ও-প্রান্তবাসীর কথা শোনা গেল না। জয়ন্ত শুনে নিয়ে কথা-মুখে হাত চাপা দিয়ে পুনরায় বললে, উনি আপনার সঙ্গে আবার কথা বলতে চান।

–অলরাইট, দাও।

যন্ত্রটা আবার হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করলেন।

মহিম হালদার ওঁকে অনুরোধ করলেন একবার তার বাসায় আসতে। ব্যাপারটা গুরুতর। এখনি ব্যবস্থা করা দরকার।

তালুকদার বললেন, আমি একবার মেডিকেল কলেজে যাব এখান থেকে। আই মীন, এখানে যারা আটক আছে তাদের জামিনের ব্যবস্থা হয়ে গেলেই…

বাধা দিয়ে মহিম হালদার বললেন, না, না, জামিন-টামিন নয়। আমি জয়ন্তকে বলে দিচ্ছি, ওদের পার্মানেন্টলি ছেড়ে দিতে। পুলিস ওসব পেটি-কেস চালাবেই না। তাহলে কখন আপনি আসতে পারবেন?

–অ্যাবাউট সাড়ে চারটে।

–দ্যাট সুটস্ মি ফাইন, থ্যাঙ্ক য়ু।

তালুকদার জয়ন্ত চৌধুরীকে বললেন, ওঁর ঠিকানাটা…

তাপস আর সতীশ প্রায় একসঙ্গে বলে ওঠে, আমরা চিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *