আম্রপালী – ১

০১.

ট্যাক্সির সিটে সেদিন যদি ঐ বিচিত্র পত্রিকাখানা আবিষ্কার না করতেন, তাহলে ওঁর জীবনে এ দুর্ঘটনা আদৌ ঘটত না। সেক্ষেত্রে চরিত্রবান বিজ্ঞানসাধকের মাথায় এতবড় কলঙ্কের বোঝাটা চাপত না। আর আমাকেও এই ‘অশ্লীল’ গল্পটা লেখার যন্ত্রণা ভোগ করতে হত না। কিংবা ধরা যাক, সেদিন সকালে ওঁর গাড়িতে যদি স্টার্টিং-ট্রাবল না দেখা দিত, নিজের গাড়ি নিয়ে নিত্যদিনের মতো যদি কলেজে আসতেন, তাহলেও কি এই অঘটনটা ঘটত? আদৌ না!

তো বাস্তবে সেসব যে ঘটেনি। সকালে গাড়িটা কিছুতেই স্টার্ট নিল না। গ্যারেজ আর গাড়ির চাবির থোকা ছট্টুলালের হাতে ধরিয়ে দিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে কলেজে চলে এসেছেন। যোধপুর পার্ক থেকে কলেজ স্ট্রিটে। ছট্টুলাল চেনা লোক, ওঁর বাড়ির সামনে তার রিপেয়ার গ্যারেজ। সারাদিনে সে গাড়িটা সারিয়ে রাখবে।

আসলে ঘটনাটা তো কলেজে আসবার সময় ঘটেনি, সেটা ঘটল ফেরার পথে। নিতান্ত আকস্মিকভাবে। অন্তত সে সময় তাই মনে হয়েছিল। একটা কাকতালীয় যোগাযোগ–কার্যকারণসম্পর্ক-বিরহিত।

কলেজ থেকে যখন বের হলেন তখনো সন্ধ্যা নামেনি, কিন্তু অফিসফেরত যাত্রীর ভিড়ে বাসের পাদানি উপচীয়মান। প্রফেসর রঞ্জন তালুকদারের বয়স হয়েছে। শিক্ষাবিভাগ না হলে এতদিনে পেনসন-ফাইল তৈরিতে মন দিতে হত। সরকারি চাকুরি থেকে রিটায়ারমেন্টের অনেক বাকি, কিন্তু মনুর বিধান মেনে পঞ্চাশোর্ধ্বের পূর্বেই বানপ্রস্থ নিয়েছেন। মানসিকভাবে। তা কেন? শারীরিকভাবেও। বন কি এই কলকাতা-শহর চৌহদ্দির বাইরে? বন এখন ঘরে ঘরে, বন এখন মন-এ মন-এ। এমনিতে শরীরে জরার আক্রমণ অনুভব করেন না। নিত্যপ্রাতে যোগাভ্যাস করেন। ইদানীং। আগে সকালে জগিঙে যেতেন। পাশের বাড়ির সমবয়সী পরেশবাবুর সঙ্গে। পরেশবাবু মারা যাবার পর জগিঙটা বন্ধ হয়েছে। তবু শরীর অটুট। এখনও সকালে আর সন্ধ্যায়–দিনে দুবার–প্রণতিকে পাঁজাকোলা করে বাথরুমে নিয়ে যেতে পারেন। যানও। হুইলচেয়ারটা বাথরুম-দরজার চেয়ে মাপে বড়। প্রণতি অবশ্য কঙ্কালসার–দশ বছর শয্যাশায়ী–কতই বা ওজন ওর? আর্থারাইটিস ছাড়াও নানান স্ত্রীরোগে একনাগাড়ে ভুগেই চলেছে।

পাবলিক-বাস ধরবার চেষ্টা করা অহেতুক। নাকের সামনে দিয়ে একটা ডবল-ডেকার বাদুড়ঝোলা অবস্থায় ‘কাকে-খাই কাকে-খাই’ করতে করতে বেরিয়ে গেল। মনস্থির করলেন : ট্যাক্সিই নিতে হবে। কিন্তু ট্যাক্সি ধরা কি অতই সোজা, এই পড়ন্ত বেলায়? যখন এই এত-ভঙ্গ বঙ্গ দেশটার রঙ্গভরা কেরানিকুল ঘরে ফেরার তাগাদায় জানকবুল। লাখ-লাখ বিল্বমঙ্গল ঠাকুর চলেছে ঘরমুখো। লোডশেডিং-এর আঁধারে চিন্তাকুল চিন্তামণির দল অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষমাণা। তাই ওরা টের পায় না–কী চেপে ধরে ঝুলতে ঝুলতে বাড়ি ফিরছে বাসের হ্যান্ডেল না অজগর সাপ! আর এই মওকায় ট্যাক্সিওয়ালারা সাময়িক ‘আবু হোসেন’–আড়াই ঘণ্টার ‘হঠাৎ নবাব’।–’কোথায় যাবেন স্যার?’ অর্থাৎ যদি তুমি ওর গন্তব্যস্থলের দিকে দু-কদম এগিয়ে যেতে চাও শুধু তাহলেই কিঞ্চিৎ অর্থমূল্যের বিনিময়ে সে তোমাকে একটা লিফট দিলেও দিতে পারে। কেউ কেউ আবার সাঁঝের ঝোঁকে রূপান্তরিত হয়ে যায় শেয়ারের ট্যাক্সিতে। আবার বেশ কিছু ড্রাইভার হাওড়া স্টেশান বা এয়ারপোর্ট ছাড়া অন্যত্র পাদমেকং নগচ্ছামঃ।

হঠাৎ একটি সুদর্শন ছেলে এগিয়ে এসে বলে, আজ গাড়ি আনেননি স্যার?

নির্ঘাৎ কলেজের। কোন ইয়ার? মুখটা চেনা-চেনা। বললেন, না, আজ গাড়ি আনিনি। একটা ট্যাক্সি ধরব ভাবছি; কিন্তু…

–আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন। আমি ধরে দিচ্ছি। বাড়িই ফিরবেন তো? যোধপুর পার্ক?

ওরে বাবা! শুধু নাম নয়, এ যে ধামও চিনে বসে আছে। বলেন, না, না, তুমি ব্যস্ত হয়ো না। অপেক্ষা করতে করতে নিশ্চয় পেয়ে যাব একসময়।

–বিলক্ষণ! তা আর বলতে! আর তর্কের খাতিরে ধরুন যদি না-ই পান, ক্ষতি কী? কাল সকালে তো আবার ফিরেফিত্তি এই আমড়াতলার মোড়েই আসতে হবে। ফার্স্ট পিরিয়ডেই ক্লাস। রাতটা কেটে গেলে সোজা ক্লাসে ঢুকে যাবেন। যাতায়াতের ট্যাক্সিফেয়ারটা বাঁচবে।

ওর চোখে-মুখে কথা বলার ধরনে হেসে ফেলেন প্রফেসর তালুকদার। বলেন, কোন ইয়ার?

ছেলেটি ট্যাক্সির সন্ধানে চলতে শুরু করেছিল। এ-কথায় থমকে থেমে পড়ে। ফিরে ঘনিয়ে আসে আবার। হেসে বলে, সে-কথা যে বলা বারণ, স্যার! আমি চেয়েছিলাম শুধু ‘পজেটিভ ক্যাটালিস্ট’-এর পার্টটুকু প্লে করতে। এনজাইমের মতো। আপনার সঙ্গে ট্যাক্সির সংযোগ ঘটিয়ে দিয়ে আমি থাকতে চেয়েছিলাম, ঐ যাকে বলে ‘আডিস্টার্বড ইন ম্যাস্ অ্যান্ড কেমিক্যাল কম্পোজিশান’।

রসায়নবিদ রসিক মানুষটি খুশি হলেন ওর বাকচাতুর্যে। প্রতিপ্রশ্ন করেন, আমি তোমার রোল-লাম্বারটা জেনে ফেললে তোমার ‘পজেটিভ ক্যাটালিস্ট’-এর ভূমিকাটুকু অব্যাহত থাকবে না?

ঘাড় চুলকে লাজুক লাজুক মুখে বললে, কেমন করে থাকবে স্যার? আমার ‘প্রক্সিলাভ’ বন্ধ হয়ে যাবে না?

উচ্চকণ্ঠে হেসে ওঠেন অধ্যাপক তালুকদার।

ঠিক তখনই একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায় রাস্তার ‘কার্ব’ ঘেঁষে।

ট্যাক্সিতে একজনমাত্র যাত্রী। নিঃসন্দেহে মুসলমান। দাড়ি, কাজ-করা সফেদ টুপি আর রসুনের গন্ধেই তা আন্দাজ করা যায়। মুখে বসন্তের দাগ। বছর সাতাশ-আঠাশ বয়স। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল। তালুকদার-সাহেব তার বয়সের অনুপাতে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন : যানা হ্যায়? যোধপুর পার্ক?

–ক্যেঁউ নেহি? উঠিয়ে…

অধ্যাপকমশাই পিছনের সীটে উঠে বসলেন। ড্রাইভার পুনরায় মিটার ডাউন করল। ছেলেটি রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল তখনো। হাত তুলে নমস্কার করল। প্রফেসর ওকে ইঙ্গিতে কাছে আসতে বললেন। ছেলেটি এগিয়ে এলে জনান্তিকে বললেন, কৃষ্ণা অনেকক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে!

ছেলেটি অবাক হল। ম্যাগাজিন-স্টলের কাছে থার্ড ইয়ারের কৃষ্ণা সেনকে অপেক্ষা করতে বলে ও যে এগিয়ে এসেছিল তা উনি জানলেন কেমন করে? ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল। কৃষ্ণা একমনে মাসিক পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছে। যেন এদিকে ওর নজরই নেই।

–আরও একটা কথা।

প্রফেসর তালুকদারের কণ্ঠস্বরে আবার এদিকে ফেরে। উনি বলেন, একটা কথা ভুলো না, ‘এনজাইম’! প্রক্সিতে ম্যাটিনী-শোর ফার্স্ট ক্লাস টিকিট পাওয়া সহজ, অনার্সের ফার্স্ট ক্লাস টিকিট নয় কিন্তু!

ছেলেটি সত্যিই লজ্জিত। বললে, আয়াম সরি, স্যার! দেবু রায়। ফোর্থ ইয়ার।

–কেমিস্ট্রি?

–না, স্যার। কেমিস্ট্রিতে অনার্স থাকলে কি আর চিনতে পারতেন না? ফিজিওলজি।

সর্দারজি তাগাদা দেয়, অব চলুঁ?

–চল।

অপরাহ্নের আলো কলকাতার সৌধশ্রেণীর মায়া কাটাতে পারছে না। রাস্তা ছায়া ছায়া। পথের বাঁ-দিকে সারি সারি বাড়ির মাথায়-মাথায় লেগে আছে সোনা-গলানো রোদের ছোপ–জলের ট্যাঙ্কিতে, চিলেকোঠায়, পারাবত-কূজিত কার্নিশে। নজর হল দেবু এগিয়ে এসে কৃষ্ণার কর্ণমূলে কিছু বলছে। কৃষ্ণা আড়চোখে অপসৃয়মাণ ট্যাক্সিটাকে দেখে নিয়ে জিব কাটল। থার্ড ইয়ারের কৃষ্ণা সেন ভেবেছিল ‘আর. কে. টি.’ ওকে দেখলেও চিনতে পারবেন না। কিন্তু প্রফেসর তালুকদারের স্মরণশক্তি অতি প্রখর। যে-কারণে জীবনে কখনো সেকেন্ড হতে পারেননি, বরাবর ফার্স্ট-ক্লাস ফার্স্ট! ঐ মেয়েটি একবার সোস্যালে গান গেয়েছিল। দুর্দান্ত গেয়েছিল–তখন তার নাম ঘোষিত হয়েছিল। উনি ভোলেননি।

হাতের ফোলিও ব্যাগটা পাশের সীটে রাখতে গেলেন। নজরে পড়ে, সেখানে ভাজকরা একখানা খবরের কাগজ। উর্দু দৈনিক। খুব সম্ভবত ঐ পূর্ববর্তী মুসলমান যাত্রীটি অনবধানে ফেলে গেছে। অথবা কৌতূহল অবসানের উচ্ছিষ্ট। বোধহয় ‘ইত্তেফাক’। কাগজটা সরিয়ে ফোলিও ব্যাগটা ওখানে রাখতে যাবেন ঠিক তখনই কাগজের তলা থেকে কী একটা মাসিক পত্রিকা পিছলে পড়ে গেল ট্যাক্সির চাতালে। অন্যমনস্কভাবে সেটা তুলে নিতে গিয়েই যেন একটা শক্ খেলেন। দ্রুতহস্তে পত্রিকাখানা চাপা দিলেন দৈনিকপত্রের নিচে। মনে মনে যেন বললেন : সরি।

মেয়েটি যে ইত্তেফাক-পর্দা ফাঁক রেখেই বসন পরিবর্তন করছিল তা আন্দাজ করতে পারেননি।

কিন্তু এ কী?

এমনটা তো কখনো হয় না। হবার কথাও নয়! চিত্রপ্রদর্শনীতে অথবা ছবির বইতে ন্যূড কি দেখেননি, দেখেন না? এখানে অবশ্য কিছুটা প্রভেদ আছে। মাসিক পত্রিকার মলাটে ওটা হাতে আঁকা ছবি নয়, রঙিন আলোকচিত্র। ফটোগ্রাফিকে যতই জাতে তুলবার চেষ্টা কর, হাতে-আঁকা ছবির আবেদনই আলাদা। সেটা পুরোপুরি আর্ট; আলোকচিত্রের মতো আধা-আর্ট আধা-ক্রাফট নয়। তাই চিত্রে, এমনকি ভাস্কর্যেও ন্যুড যতটা শিল্পমণ্ডিত, আলোকচিত্র ততটা নয়। বিদ্যুৎঝলকের মতো এক নজর দেখেছেন মাত্র; কিন্তু তার মধ্যেই ওঁর মনে হয়েছে প্রচ্ছদপটের মেয়েটি–নাকি মহিলাটি–বিবস্ত্রা ঠিক নয়, সযত্ন-সচেতনতায় অর্ধাবৃতা। লুটিয়ে পড়া আঁচলটাকে সে যখন নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই অসতর্ক মুহূর্তেই অসভ্য ফটোগ্রাফারটা….

কিন্তু একটা কথা!

দোষটা তো পুরোপুরি ক্যামেরাম্যানের ঘাড়ে চাপানো যাবে না সোনামণি! ষড়যন্ত্রের অংশীদার তুমি নিজেও। না হলে শাড়ি পরার পূর্ববর্তী পর্যায়ে তোমার পরিধান করার কথা নয় কি–পেটিকোট-ব্রা-ব্লাউস? আর তাছাড়া লুটিয়ে-পড়া আঁচলটাকে তুলে নেবার ভঙ্গিমার আড়ালে কেমন যেন একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়ে গেল না–কেমন যেন একটা তির্যক প্রয়াস : আবৃত হওয়ার অপেক্ষা সযত্নে অনাবৃত হওয়ার?

অধ্যাপক তালুকদারের কান দুটো একটু গরম হয়ে উঠেছে। স্বপিণ্ডের স্পন্দন ছন্দ তেহাইয়ের বোল না তুললেও বেশ কিছুটা দ্রুত লয়ে….

‘যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ….’

জানেন, জানা আছে ওঁর। বহির্জগতে কোনও চাঞ্চল্যের লক্ষণ অনুভব করলে। কূর্ম তার হাত-পা-মাথা দেহবর্মের ভিতরে লুকিয়ে ফেলে। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতও তেমনি তাঁর ইন্দ্রিয়সম্মুখে উপস্থিত চিত্তচাঞ্চল্যের প্রত্যক্ষ হেতুটিকে উপেক্ষা করেন। পঞ্চেন্দ্রিয়কে স্বীয় বশে এনে রাশটানা ঘোড়ার মতো…

তাকিয়ে দেখলেন একবার সামনের দিকে। সর্দারজি একমনে ড্রাইভ করছে। নজর করে দেখলেন ওর ভিয়ু-ফাইভারটিকেও। না, কেউ কোনভাবেই ওঁকে লক্ষ্য করছে না।

চলন্ত ট্যাক্সির গর্ভে তিনি মাতৃগর্ভস্থিত ভ্রূণের মতো একান্ত।

অস্বীকার করার উপায় নেই অধ্যাপক তালুকদারের দ্বৈত সত্তার। তিনি কলেজে ইনঅর্গানিক কেমিস্ট্রির ক্লাস নেন, খাতা দেখেন, রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্টদের ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার দিকে গলফের বলের মতো ঠেলে ঠেলে দেন, ‘ছাত্র-অধ্যাপক কল্যাণ সমিতি’র সেক্রেটারি, কিন্তু সেখানেই তাঁর পরিচয় শেষ হয় না। তিনি লেখক, তিনি ঔপন্যাসিক, তিনি কবি।

অবশ্য ছদ্মনামে। ওঁর মনে হল, ইত্তেফাকের দমবন্ধকরা অন্ধকূপে এতক্ষণে মেয়েটি মুমূর্ষু।

কাগজের তলা থেকে দ্বিতীয়বার উদ্ধার করে আনলেন ওকে। দেখলেন। এবার আর বিদ্যুঝলকে নয়। কত বয়স হবে মেয়েটির? সাতাশ-আঠাশ? বিয়ের সময় প্রণতির যে বয়স ছিল আর কি! প্রায় বিশ-ত্রিশ বছর আগে। তখন তো সে এমন শয্যাশায়ী পঙ্গু ছিল না।

পঁচিশ বছর! উফ্‌! শতাব্দীর একপাদ!

কিন্তু এ-কথাও তো বিস্মৃত হওয়া চলে না যে, প্রণতি যদি বন্ধ্যা না হত, তাহলে ওঁর নিজেরও এতদিনে ঐ বয়সের একটি কন্যাসন্তান থাকতে পারত!

কথাটা মনে হতেই পাতাটা উল্টে দিলেন।

ত্রৈমাসিক পত্রিকা। নাম ‘পত্রমিতালী’। এটি প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যা। পার্ক সার্কাসের একটি ঠিকানা থেকে প্রকাশিত। পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে : পত্রবন্ধুত্বে আগ্রহী পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়াই এ পত্রিকার মূল লক্ষ্য। বিদেশে নাকি এই জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপন করে অনেকে জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীর সন্ধান পেয়েছে। অন্তত সম্পাদক তো তাই দাবী করেছেন। তা বলে এখানে শুধু পাত্রপাত্রীর সন্ধানই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। এই জটিল দুনিয়ায় একই চিন্তাধারার দুটি মানুষ তারা নর ও নারী নাও হতে পারে হয়তো দুটি রমণী অথবা দুটি পুরুষ, পরস্পরের কাছে হৃদয়ের ভার নামিয়ে দিয়ে শান্তি পেতে চেয়েছে, সান্ত্বনা খুঁজেছে। মাত্র তৃতীয় সংখ্যার ভিতরেই প্রায় সত্তরটি পত্ৰবন্ধুত্ব প্রার্থী ছেলে ও মেয়ের সন্ধান সম্পাদক-মশাই পেয়েছেন। তাদের, নামের ক্রমানুসারে তালিকাকারে শেষ ফর্মায় সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। পত্রিকায় এ জাতীয় বিজ্ঞপ্তি দিতে গেলে একটা মেম্বারশিপ-ফি দিতে হয়; কিন্তু যারা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে কোনো সাধারণ পাঠক বা পাঠিকা যোগাযোগ করতে চাইলে ফি দিতে হবে না। পত্রমিতালী যারা চেয়েছে তারা শুধুমাত্র এক-একটি ক্রমিক সংখ্যা দ্বারা সূচিত। ‘নাম’ কোনক্ষেত্রেই জানানো হয়নি। তাদের সম্বন্ধে ভাসা-ভাসা কিছু খবর আছে–কত বয়স, পড়াশুনা কত দূর, কী কী হবি, পুরুষ অথবা স্ত্রী। বিবাহিত-অবিবাহিত অথবা বিধবা/বিপত্নীক। ছাত্র, চাকুরে, ব্যবসায়ী অথবা অবসরপ্রাপ্ত। সংসারে তিক্ত-বিরক্ত তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সংসার কর্তৃক পরিত্যক্ত অথবা উপেক্ষিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবরকমই আছে।

কোনো পাঠক বা পাঠিকা যদি কাউকে চিঠি লিখতে চায়, তাহলে বিশেষ সংখ্যাকে সম্বোধন করে চিঠিখানি লিখতে হবে। খামে ভরতে হবে। বন্ধ খামে ডাকটিকিট সেঁটে খামের পিছনে পেনসিলে ক্রমিক সংখ্যাটি লিখতে হবে। এবার একটি বৃহত্তর খামের গর্ভে তাকে ভরে দিতে হবে। ঐ সঙ্গে বড় খামে দিতে হবে স-টিকিট একটি ‘সেলফ অ্যাড্রেস্‌ড্‌’ খালি লেফাফা। তারপর বড় খামে সম্পাদকের নাম-ঠিকানা লিখে ডাকে দিতে হবে।

পাকা ব্যবস্থা। সম্পাদক যথাযথ ব্যবস্থা করবেন। অবাঞ্ছিত সমাজবিরোধী মানুষ যাতে পত্রমিতালী-প্রার্থীকে বিড়ম্বিত, বরং বলা উচিত বিড়ম্বিতা করতে না পারে তাই এত সাবধানতা। তবে হ্যাঁ, ‘পত্রমিতালী’ প্রতিষ্ঠার পর সম্পাদকের আর কোনো দায়দায়িত্ব থাকবে না– এ বিজ্ঞপ্তিও স্পষ্ট ভাষায় ঘোষিত।

সূচীপত্রে পরিচিত নাম একটাও খুঁজে পেলেন না। একটি ছোট গল্প, কবিতা গুটি তিনেক–নিতান্ত মামুলী। প্রবন্ধ একটি, পতিতাবৃত্তির উপর। সচিত্ৰ, সোনাগাছি, হাড়কাটা গলির। মামুলী। একটু যৌনতা ঘেঁষা। অশ্লীল নয় তা বলে।

প্রফেসর-সাহেব মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিলেন–যোধপুর পার্ক দূর অস্ত্‌। সর্দারজি স্টিয়ারিং হুইলে নিমগ্ন। কলকাতার রাস্তার ধারে সারি সারি বাড়ি পিছনে ছুটছে। উনি পত্রমিতালীর তালিকা ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন। সাহিত্যসেবী হলেও বিজ্ঞানীর মন। উনি মনে মনে পত্রবন্ধুত্বকামেচ্ছুদের বেশ কয়েকটি বিভাগে শ্রেণীবদ্ধ করে ফেলতে পারলেন। প্রথম দল অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে। তারা প্রায়শই ছাত্রছাত্রী। যৌবনের সিংহদ্বারে সদ্য উপনীত। ওঁর বাল্যকালে ছেলে-মেয়েদের পৃথক স্কুলে পড়তে হত। মাত্র কয়েকটি কলেজে ছিল কো-এডুকেশন। একই ক্লাসের ছেলে মেয়েরা বিপরীত লিঙ্গের ক্ষেত্রে ‘আপনি’ বলে কথা বলত। ওঁর নিজের কৈশোরে, যে বয়সে উনি একটা অজানা জগতের ইশারা পেয়ে চঞ্চল হতেন, আজকালকার দিনে সেটা ওদের কাছে আর ‘অজানা’ নয়। ওঁদের ছাত্রকালে যে-তথ্যটা পাঠ্যসূচি থেকে সযত্নে পরিহার করা হত, সেই জীবনসত্যটা আজকে জীববিজ্ঞানের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। হয়তো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, এই যা। এরা সকলেই বন্ধু বা বান্ধবীর সন্ধান করছে। স্পষ্ট বলা নেই, কিন্তু লক্ষ্য:ভিন্ন লিঙ্গের পত্রবন্ধুত্ব। ওরা বিপরীত প্রান্ত থেকে একটু সমমর্মিতা চায়। একটু সহানুভূতি, সান্ত্বনা, পরস্পরের কাছ থেকে উৎসাহ আশার বাণী শুনতে চায়। কেউ জানিয়েছে তার সঙ্গীতে আসক্তি, কেউ ক্রিকেটে, কেউ বা টি. ভি. সিরিয়ালে। দু একজন জানিয়েছে টি, ভি, সিনেমা, নিতান্ত না হলে গ্রুপ-থিয়েটারে নামতে চায়, অথচ বাড়িতে আপত্তি। এ নিয়ে অশান্তি। এই হচ্ছে প্রথম গ্রুপ।

দ্বিতীয় একটি গ্রুপের আভাস পেলেন যারা ‘নাল্পেসুখমস্তি’ মন্ত্রে বিশ্বাসী। দেখাই যাক না, ঘটনা কতদূর গড়ায়’–ভাবখানা ওদের। এরা বিবাহিত কিনা বোঝা যায় না, কিন্তু বৈচিত্র্যসন্ধানী। এক্ষেত্রে xx সন্ধান করছে XY-এর। এবং কনভার্সলি। অর্থাৎ ক্রমোজমের হিসাবে।

তৃতীয় একটি গোষ্ঠী–তারা উত্তর-চল্লিশ–যেন গুনগুন করে গাইছে : ‘ঘরের কোণে ভরা পাত্র, দুই বেলা তা পাই/ঝরনাতলার উছলপাত্র নাই।’

এরা যৌবনের হারিয়ে যাওয়া রোমাঞ্চটিকে ফিরে পাওয়া যায় কিনা তাই পরখ করে দেখতে চায়–ঘরণী বা গৃহস্বামীর দৃষ্টির আড়ালে।

এ-ছাড়া আরও একটি গ্রুপে আছেন কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। পড়ন্ত বিকালের বৈঠকের সভ্য-সভ্যা। এঁরা অবসরপ্রাপ্ত। সংসারে তাদের আকর্ষণ কম, বন্ধন ক্ষীয়মাণ। সময় কাটতে চায় না। সবারই বাড়িতে কিছু টি, ভি, বা ভি. সি. পি. থাকে না। সঙ্গী একমাত্র লাইব্রেরি। তাও যাদের চোখের দৃষ্টি অক্ষুণ্ণ। ছেলেমেয়ে, ছেলের বউ, জামাই, নাতি-নাতনি হয়তো ভগবান অকৃপণ হাতেই দিয়েছেন, কিন্তু তাদের কাছে ওঁরা বোঝা মাত্র। তাদের আলোচনার মাঝখানে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হলে তারা সংযত হয়ে পড়ে, আড়ষ্ট হয়ে পড়ে-ভাবখানা, যেন মনে মনে বলে –এই এলেন সর্বঘটের কাঁঠালিকলা।’ প্রকাশ্যে : ‘ও ঠাম্মা! তুমি আবার এখানে উঠে এলে কেন?’

দিনযাপনের গ্লানি কাটাতে তাঁরা কিছু সমমর্মী মানুষ খুঁজছেন। পত্রমিতালীর মাধ্যমে।

এই তিন-চার শ্রেণীর নরনারীর ভিড়ে গুটিকতক চিঠি নিতান্ত বিভ্রান্তিকর। বলা যায় ‘অড-উয়োম্যান আউট’। বিজাতীয়া। এমন পাঁচখানা চিঠি অন্তত নজরে পড়ল ওঁর, ঐ অল্প সময়ে।

এরা কী? এরা কে? এরা কী চায়?

পাঁচটি চিঠিই এক বিশেষ এজ-গ্রুপের : পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। অব্যক্রিম মহিলা। নিজ নিজ স্বীকৃতি-মোতাবেক পাঁচজনেই চাকুরে, একান্তচারিণী। দুইজন ডিভোর্সি, দুজন বিধবা, একটি আজন্মকুমারী।

কেন এরা ব্যতিক্রম? শোন, বুঝিয়ে বলি, লক্ষ্য করে দেখবয়স, শিক্ষাগত মান, হবির তালিকা জানিয়েই এরা থামেনি, জানিয়েছে উচ্চতা, গাত্রবর্ণ, সৌন্দর্যের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এবং ওজন। পত্রমিতালীর পক্ষে এ-জাতীয় সংবাদ কি প্রাসঙ্গিক? সবচেয়ে বিস্ময়কর : একটি ডিভোর্সি মেয়ে জানিয়েছে তার উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন, বয়স ত্রিশ, সে চাকরিরতা এবং তার হবি : ‘স্ট্যাটিসটিক্স’।

অপিচ, তার নিজস্ব ‘ভাইটাল’ : 36-24-37।

ট্যাক্সিটা ফ্লাইওভারের উপর উঠছে। বাঁয়ে : অবনমহল। ওঁর বাড়ি আর মিনিট পাঁচ-সাত। হঠাৎ কল্যাণের কথা মনে পড়ে গেল ওঁর। কল্যাণ সেনগুপ্ত। ওঁর ছাত্র। দিল্লীতে পোস্টেড। আই. পি. এস.। পুলিসের এক বড়কর্তা। পত্রিকাটা কল্যাণকে পাঠিয়ে দিতে হবে। এটা তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার আবশ্যিক অঙ্গ। প্রতিটি মানুষের কর্তব্য এ জাতীয় অনাচার বন্ধ করা। এ তো নলচের আড়াল দিয়ে পতিতাবৃত্তির বিজ্ঞপ্তি। কল্যাণ যা ভাল বোঝে করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *