আমেরিকা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

আমেরিকা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

আমেরিকায় নামবার আগে ভাল করে দাঁত মেজে নিও। কারণ তোমার দাঁতে প্রাচ্যদেশীয় জীবাণু থাকতে পারে। হাতঘড়ির সময়টাও মিলিয়ে নিও। কারণ আমেরিকায় সবকিছু ঘড়ি ধরে চলে। তোমার জুতোর তলায় রয়েছে প্রাচ্যদেশীয় ধুলো ময়লা। রুমালে সেগুলো সাবধানে মুছে নাও। আমেরিকাকে নোংরা কোরো না। এবার প্রস্তুত হও। সিট বেল্ট বাঁধে। সিগারেট নিভিয়ে ফেল। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা কেনেডি এয়ারপোর্টে নামছি।

এসব আমার জানাই ছিল। অনেক আগেই আমি দাঁত মেজে, হাতঘড়ি মিলিয়ে এবং জুতো পরিষ্কার করে বসে আছি। আমার পাশে বসা একটা খুনখুনে তিব্বতি বুড়ি ভাঙা হিন্দিতে বিড়বিড় করে আমাকে বলল, আমার দাঁত নেই, হাতঘড়ি নেই, রুমাল নেই। বাঁচলাম। নীচে ওই যে জঙ্গলের মতো দেখা যাচ্ছে, মস্ত মস্ত উঁচু গাছ অথচ ডালপালা নেই, ওটা কী জায়গা বলো তো?

চুপ চুপ। আমি চাপা গলায় বলি, ওটাই নিউ ইয়র্ক।

নিউ ইয়র্ক! বুড়ি চোখ কপালে তুলে বলল, কিন্তু কার্পেটটা দেখতে পাচ্ছি না কেন বলো তো! আমার ছেলে নিউ ইয়র্ক থেকে লিখেছিল গোটা আমেরিকাই একটা মস্ত কার্পেট দিয়ে মোড়া।

আমিও শুনেছি।

শুনেছ! যাক বাঁচালে। বলে বুড়ি বিড়বিড় করতে করতে তার পোঁটলাপুঁটলি গোছাতে লাগল।

প্লেন নামল। থামল। দরজা খুলে হোসটেস বলল, প্রাচ্যবাসীগণ, তোমাদের সামনে স্বর্গের দরজা খোলা। এখানে সবকিছুই অফুরন্ত। ডলার, মেয়ে, ফরেন গুডস, যাও কয়েকদিন লুটেপুটে খাওগে। ইউরোপীয়গণ, আমেরিকা তোমাদের কাছে স্বর্গ না হলেও চমৎকার এক চারণভূমি। যাও দ্বিতীয় এই স্বদেশকে বারবার আবিষ্কার করো। আমেরিকানগণ, তোমাদের কাছে আমেরিকা সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। এই সেই নরক যেখানে মরতে তোমাদের ফিরে আসতে হয়।

আমি নামলাম। এবং নেমেই তাজ্জব হয়ে গেলাম। আমেরিকায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই যেন আমেরিকা আমাকে তার কোলে তুলে নিল। আদর করে কানে কানে বলল, বাছা রে, গরিবের ঘরে পথে ধুলো কাদা ঘেঁটে বড় হয়েছিস। ভাল জিনিস চোখে দেখিসনি, জিবে ঠেকাসনি, ভোগ করিসনি। আয় বাছা ক’দিন সুখ ভোগ করে যা। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে জল এল। আমি গোপনে রুমালে চোখের জল মুছে নিলাম। আমেরিকায় কাঁদা বারণ। তবে আমেরিকা সম্পর্কে আমি যা যা শুনেছিলাম তা সবই সত্যি। দেশটা আগাগোড়া মহার্ঘ কার্পেটে মোড়া। সেই কার্পেটের ওপর কোথাও ঘাস এবং কোথাও কংক্রিট বসানো। এক অতি উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে এখানকার আকাশকে আরও একটু বেশি নীল করা হয়েছে। প্রাচ্যের সংবাদপত্রগুলো ঠিকই বলে, আমেরিকায় মাধ্যাকর্ষণে বল কিছু কম। ফুরফুর করে হাঁটা যায়, কষ্ট হয় না। এখানকার বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণও বেশি। পানীয় জল জীবাণুমুক্ত এবং ভিটামিনযুক্ত।

একশো আশি তলা উঁচু একটা হোটেলের একশো সত্তর তলার একটা ঘরে ঢুকে আমি দেখলাম, একটা লোক একটা হেলিকপ্টারে বসে বাইরে থেকে আমার ঘরের জানালার শার্শি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করছে। ঘরের মধ্যেও চমৎকার ব্যবস্থা। রঙিন টি ভি, ফ্রিজ, রাজকীয় বিছানা ও সুন্দরী রমণী সবই প্রস্তুত। ব্যবহারের অপেক্ষা মাত্র। টেলিফোন তুলে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম।

একটু বাদেই টেলিফোনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের গমগমে এবং আহ্লাদিত গলা পাওয়া গেল, বলো বন্ধু, বলো।

আমি এক ভারতীয় পর্যটক মাননীয় প্রেসিডেন্ট।

ভারতীয়! ভারতীয়! প্রেসিডেন্ট একটু স্মরণ করতে সময় নিলেন। তারপর উচ্চকিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ওঃ! ভারত! হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি। ভারত হল পৃথিবীর দ্বিতীয় বা তৃতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্র। সেখানে তাজমহল আছে। তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ মাননীয় প্রেসিডেন্ট।

স্বাগতম ভারতীয় পর্যটক। আমাদের দেশ সর্বদাই ভারতীয় পর্যটকদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে। প্রকৃতপক্ষে আমরা সব দেশের লোককেই শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকি যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই প্রকৃত শ্রদ্ধার যোগ্য নয়।

আমেরিকা অতীব মহান দেশ মাননীয় প্রেসিডেন্ট।

ধন্যবাদ ভারতীয় পর্যটক, তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো!

না মাননীয় প্রেসিডেন্ট। এই হোটেলের ঘরে রঙিন টি ভি থেকে সুন্দরী রমণী সবই আছে।

চমৎকার। তুমি নিশ্চয়ই ওসব জিনিসের ব্যবহার জানো। আমি তো শুনেছি, ভারতে ট্রেন চলে এবং কোথাও কোথাও এরোপ্লেনও নামা ওঠা করে। দিল্লিতে টেলিফোনও আছে, আমি জানি। ভারত যে গত কয়েক বছরে দুর্দান্ত অগ্রগতি করেছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

ধন্যবাদ মাননীয় প্রেসিডেন্ট। আমি শুনেছি গোটা আমেরিকাই কার্পেটে মোড়া। মাননীয় প্রেসিডেন্ট, এরকম মহান কীর্তি আর কোনও দেশের নেই।

ধন্যবাদ ভারতীয় পর্যটক। আমরা যথাসাধ্য দেশটাকে সুন্দর করার চেষ্টা করেছি মাত্র। তোমার ভাল লাগলেই খুশি হব।

মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আমি শুধু পর্যটন করতেই আসিনি। আমি দু’জন মৃত আমেরিকান নাগরিক সম্পর্কে কিছু খোঁজখবরও করতে এসেছি। একজন সোনি লিস্টন, আর একজন উইলিয়াম হোলডেন।

তারা কারা?

দু’জনেই বিশ্ববিখ্যাত লোক।

প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, অধিকাংশ আমেরিকান নাগরিকই বিশ্ববিখ্যাত মানুষ। তাদের সকলকে মনে রাখা মুশকিল। তবে তুমি যে কোনও জীবিত বা মৃত আমেরিকান সম্পর্কেই খোঁজ খবর নিতে পার। কোনও বাধা নেই।

ধন্যবাদ মাননীয় প্রেসিডেন্ট।

তোমার সফর আনন্দময় হোক ভারতীয় পর্যটক।

টেলিফোন রেখে আমি জানালার কাছে যাই। হেলিকপটারে বসা লোকটা অখণ্ড মনোযোগে শার্শি পরিষ্কার করে যাচ্ছে। ঠোঁট থেকে ঝুলছে আধপোড়া সিগারেট।

আমি জানালার একটা শার্শি ফাঁক করে বললাম, শুভ সন্ধ্যা।

শুভ সন্ধ্যা।

আমি একজন ভারতীয় পর্যটক।

ইন্ডিয়ান? ইন্ডিয়ানদের তো আমরা তাড়িয়ে দিয়েছি।

আমি রেড ইন্ডিয়ান নই।

খুব ভাল। রেড ইন্ডিয়ান হওয়াটা কাজের কথা নয়।

তোমার দেশ খুব ভাল লাগছে।

লাগারই কথা। আমিও শুনেছি আমেরিকা খুব ভাল দেশ।

এই দেশটার বৈশিষ্ট্য কী বলতে পারো?

পারি। এখানে মেলা কাচের শার্শি। এত শার্শি তুমি অন্য কোনও দেশে পাবে না। আমি দিনে প্রায় দু’তিন হাজার শার্শি পরিষ্কার করি।

তাহলে তোমার রোজগার ভালই?

কী যে বলো। এদেশে এখন মিলিয়নেয়ারদেরই গরিব বলে ধরা হয়। এই জানালা থেকে তুমি যদি নীচের রাস্তায় এলোপাথারি গুলি চালাও তাহলে যে ক’টা লোক মারা পড়বে তাদের অধিকাংশই মিলিয়নেয়ার, বিলিয়নেয়ার বা ট্রিলিয়নেয়ার। আমার আয় তো দিনে মোটে দু’তিন শো ডলার। তাও সকাল থেকে সন্ধে অবধি খাটতে হয়। পুরনো হেলিকপ্টারটা বেচে নতুন একটা মডেল কেনার ইচ্ছে বহুদিনের, পেরে উঠছি না। তবে সুখের কথা এখানে শার্শি বাড়ছে। আরও বাড়বে।

আমেরিকায় কাচের শার্শি ছাড়া আর কী আছে?

অনেক কিছুই আছে। নায়েগ্রা প্রপাত, ডিজনিল্যান্ড, স্ট্যাচু অব লিবার্টি।

দেখেছ?

দেখেছি। তবে ওসব হল ট্যুরিস্টদের জন্য। আসল আমেরিকাকে আবিষ্কার করতে চাও তো আমার মতো হেলিকপ্টার কিনে তাতে উঠে পড়ো। কাচের শার্শি পরিষ্কার করার কাজ নাও। তখন দেখবে তোমার সামনে আসল আমেরিকার বুক ও নিতম্ব অনাবৃত হয়ে পড়ছে।

সেটা কী করে সম্ভব?

কাচ স্বচ্ছ জিনিস এবং সব ঘরেই তো পর্দা টানা থাকে না। শার্শিতে চোখ রাখলে ঘরে ঘরে আমেরিকার বিচিত্র রূপ দেখতে পাবে।

ধন্যবাদ। বলে আমি জানালা বন্ধ করে দিই।

ঘরের মেয়েটি আপনমনে আয়নার সামনে বসে সাজছিল। খুবই সুন্দরী সে। লম্বা, স্বাস্থ্যবতী। ফর্সা রঙের কথা আর কী বলব!

আমি জানালা বন্ধ করার পর সে আমার দিকে চেয়ে বলল, ভারতীয় পর্যটক, মহিলাদের সম্বন্ধে তোমার পূর্ব ধারণা কীরকম?

খুব পরিষ্কার নয়। আচ্ছা তোমাদের দেশের নিগ্রোদের সম্পর্কে তোমার ধারণা কীরকম?

খুব পরিষ্কার নয়। তবে শুনেছি ওরা ভীষণ দুষ্টু। মারপিট করে, রেপ করে।

করে? আমি চোখ কপালে তুলি।

হ্যাঁ, আমি রেপ জিনিসটা একদম পছন্দ করি না। সেক্স খুব ভাল। কিন্তু রেপ ভীষণ খারাপ।

আমি শুনেছি গোটা আমেরিকাই একটা চমৎকার কার্পেটে ঢাকা। কথাটা কি সত্যি?

নিশ্চয়ই।

তাহলে তোমাদের চাষবাস কোথায় হয়?

কেন? কার্পেটটা ভীষণ উর্বর। খুব গভীরও। আমরা কার্পেটের ওপরেই চাষ করি।

বাঃ বাঃ, আমেরিকা প্রযুক্তিবিদ্যায় তো বহুদূর এগিয়ে গেছে।

বহুদূর।

কার্পেটের তলায় কী আছে জানো?

না। আমরা জন্ম থেকেই কার্পেটটা দেখেছি। সম্ভবত কার্পেটটার তলায় আছে প্রিমিটিভ আমেরিকা। কিন্তু কথা অনেক হয়েছে। এবার এসো খানিকটা সেক্সের চর্চা করা যাক।

হবে হবে। কিন্তু আমেরিকার বৈশিষ্ট্য কী তা বলতে পারো?

পারি। আমেরিকা মানেই হচ্ছে বিছানা। এত সুন্দর নকশাদার ও নরম বিছানা তুমি কোথাও পাবে না। সুখে বা দুঃখে তুমি কেবল বিছানায় ডুবে থাকতে পারো। তুলো, ফোম, রবার এবং পালকের এমন বিচিত্র ও সমানুপাতিক সংমিশ্রণ আজও পৃথিবীর কোথাও কেউ ঘটাতে পারেনি। এসো, শুয়ে দেখ।

আমি এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলি, হবে হবে। আমার আরও কিছু জানার আছে।

মদির চোখে আমার দিকে চেয়ে মেয়েটি বলে, প্রাচ্যের ভীরু পুরুষ, কেন সংকোচ? কেন দ্বিধা? দেখ ওই যে উঁচু সটান সব স্কাইস্ক্র্যাপার, এগুলো কীসের প্রতীক জানো?

না তো।

আমেরিকানরা সেক্সকে কত মর্যাদা দেয় তা ভাল করে বুঝতে পারবে যদি ভাল করে ওগুলো প্রত্যক্ষ কর। তোমাদের দেশের শিবলিঙ্গ যেমন সৃষ্টির প্রতীক, আমেরিকান স্কাইস্ক্র্যাপারও তেমনই এক প্রতীক। এদেশে লজ্জার স্থান নেই। এসো এসো…

আমি আর্তনাদ করে বলি, দাঁড়াও। আমার কয়েকটা কথা জানবার আছে।

মেয়েটা হাই তুলে বলল, কিন্তু এখন আমার একটু গরম বিছানা দরকার। আমি বরং অন্য ঘরে যাই। মেয়েটা চলে গেলে আমি লিফটে নীচে নেমে আসি। সামনেই একটা চমৎকার পার্ক। একটি নিরিবিলি বেঞ্চিতে ভবঘুরে চেহারার একজন লোক বসে ঢুলছে। টুপিটা চোখের ওপর নামানো।

আমি তার কানে কানে বললাম, কার্পেটটা একটু তুলে দেখাতে পারো?

সে কিছুমাত্র নড়ল না। শুধু ডান হাতটা বাড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল, পাঁচ ডলার।

আমি পাঁচটা ডলার তার হাতে দিতেই বুড়ো লোকটা টুপি সরিয়ে আমার দিকে চাইল। একটা শ্বাস ফেলে উঠতে উঠতে বলল, এসো। পার্কের ওই কোনায় কার্পেটটা সবচেয়ে পাতলা। খুব বেশি মেহনত করতে হল না। পার্কের নির্দিষ্ট কোণে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে লোকটা একটা পকেট-ছুরি বের করে কুচ কুচ করে ঘাস মাটির একটা অংশ কেটে চাড় দিয়ে কার্পেটটা তুলে ফেলল, বলল, যাও।

নীচে একটা গর্ভগৃহ। ভয়ের কিছু নেই। নামবার সিঁড়িও আছে। আমি নেমে গেলাম। এত বড় গর্ভগৃহ আমি জীবনে দেখিনি। এ মুড়ো ও মুড়ো দেখা যায় না। একটু ঝুঁঝকো অন্ধকার ভাব। বহু টেবিল পাতা। এক একটায় এক একজন লোক বিমর্ষভাবে বসে আছে। শব্দহীন। শুধু একটা চাপা ‘হায় হায়’ ধ্বনি সেখানকার বদ্ধ বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাস যেন একযোগে বলছিল, একা, বড় একা।

খুব বেশি খুঁজতে হল না। একটা টেবিলে সোনি লিস্টন বসে ছিল। মড়ার মতো ফ্যাকাসে মুখ। চোখের দৃষ্টি দীপ্তিহীন। সেই বিশাল শরীরটা যেন কোনও ক্রমে টেবিল ধরে নিজেকে সামলে রেখেছে।

মিস্টার লিস্টন, কিছু বলুন।

কী বলব? একা, বড় একা।

মৃত্যুর সময়টা আপনার কেমন লেগেছিল?

ওঃ বোলো না। বাড়িতে কেউ ছিল না। একা। বড় একা।

একা?

একদম একা।

কেন?

তা তো জানি না। স্ত্রী বাইরে কোথায় যেন গিয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। ছেলেপুলেরা কাছে থাকত না। আমি ছিলাম। আর বাড়িটা আমাকে গ্রাস করতে আসছিল। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। কত ডেকেছি, চেঁচিয়েছি। কেউ শুনতে পায়নি।

তারপর?

আমি ঢলে পড়ে গেলাম। মেঝেয়। দমের জন্য আঁকুপাঁকু করছিলাম আর মানুষের মুখ দেখতে চাইছিলাম।

আপনি খুব ভাল মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কত টাকা ছিল আপনার। কত গুণমুগ্ধ। তবু একা?

তবু একা, ওঃ বোলো না।

তারপর কী হল?

একটা প্রেত হঠাৎ আমেরিকার বিখ্যাত কার্পেটটা তুলে আমাকে বলল, ঢুকে পড়ো, ঢুকে পড়ো। আমি ঢুকে পড়লাম। এইখানে।

আমি উঠে ধীরে ধীরে খুঁজে খুঁজে উইলিয়াম হোলডেনকেও পেয়ে যাই। এই সেই চিত্তচাঞ্চল্যকর চলচ্চিত্রাভিনেতা। বিশ্বাস হয় না। হাড়গোড় বেরিয়ে পড়েছে। মুখের হনু দুটো উঁচু হয়ে আছে।

মিস্টার হোলডেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমি শুধু জানতে চাই, মৃত্যুর সময় আপনি কেন একা ছিলেন?

আমিও পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই, মৃত্যুর সময় অধিকাংশ আমেরিকানই কেন একা থাকে?

আমি বোকার মতো তাঁর দিকে চেয়ে আছি দেখে তিনি মৃদু একটু হেসে বললেন, প্রতিটি আমেরিকানই একা। সঙ্গী বা আত্মীয়হীন। আমেরিকানদের কেউ থাকে না কেন বলো তো!

আপনার কেউ ছিল না? অত টাকা! অত খ্যাতি! অত মেয়েছেলে!

হোলডেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, তবু কেন উইলিয়াম হোলডেন একা মরে? কেন তার মৃত্যুর পাঁচ দিন পর তার লাশ বাড়ি থেকে বের করে পুলিশ?

সেটাই আমার প্রশ্ন।

আমারও প্রশ্ন। এখন যাও, বিরক্ত কোরো না।

আমি আবার ওপরে ফিরে আসি।

আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে আবার ফোনে পেয়ে যাই আমি।

মাননীয় প্রেসিডেন্ট।

বলো ভারতীয় পর্যটক।

আমি এক জায়গায় কার্পেটটা তুলে আমেরিকার ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলাম।

অভিনন্দন ভারতীয় পর্যটক। কী দেখলে?

অনেক কিছু। আমি জানতে চাই মাননীয় প্রেসিডেন্ট, কেন সোনি লিস্টন এবং উইলিয়ম হোলডেন ফাঁকা ঘরে মারা গিয়েছিল?

গিয়েছিল নাকি?

হ্যাঁ, মাননীয় প্রেসিডেন্ট। সংবাদপত্রে তার অকাট্য প্রমাণ আছে।

ভারতীয় পর্যটক, আমি এইমাত্র খবর পেলাম ভারত প্রযুক্তিবিদ্যায় আরও এগিয়ে গেছে। সে মোটরগাড়ি এবং লরি তৈরি করতে পারে। তুমি একথাটা আমাকে জানাওনি।

কিন্তু মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আপনি কি দেখেছেন, অধিকাংশ আমেরিকানই বুড়ো বয়সে খুব একা হয়ে পড়ে! তাদের স্ত্রী কাছে থাকে না বা ছেড়ে চলে যায়। ছেলেমেয়েরা ভিন্ন হয়ে যায়। মৃত্যুর সময় হলে…

ভারতীয় পর্যটক, তুমি এখনও হিউস্টন দেখনি, এম্পায়ার স্টেট বিলডিংসে ওঠোনি, লাস ভেগাসে জুয়ার আড্ডায় যাওনি, এমনকী এখনও একটিও মার্কিন মেয়েকে চুমু খাওনি! এটা কেমন কথা?

কিন্তু মাননীয় প্রেসিডেন্ট, একাকিত্বের কথাটা আমাকে শেষ করতে দিন। আমি আমেরিকার অভ্যন্তরে ঢুকে…

কার্পেটটা আবার আমরা নতুন করে পাতব ভারতীয় পর্যটক। এবার সেটা এত সুন্দর হবে যে তার তলায় কী আছে তা আর কারও দেখতে ইচ্ছেও করবে না।

২৭.০৬.১৯৮২

লেখক পরিচিতি

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: ২ নভেম্বর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলায় জন্ম। স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ এবং ১৯৮৭-তে আনন্দ পুরস্কার। ঘুণপোকা, যাও পাখি, মানব জমিন ইত্যাদি বহু উপন্যাসের রচয়িতা। ১৯৮৯ সালে ‘মানব জমিন’ গ্রন্থের জন্য অকাদেমি পুরস্কার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *