ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

আমেরিকার সিংহ

আমেরিকার সিংহ (ছোট গল্প)

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরা যে বিড়াল-জাতীয় জীবটিকে পার্বত্য-সংহ নামে অভিহিত করে সেই জন্তুটি কিন্তু সিংহ নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন জানোয়ার।

পার্বত্য-সিংহ নামক জন্তুটির আরও কয়েকটি প্রচলিত নাম আছে, যেমন- পুমা, কুগার, প্যান্থার প্রভৃতি। এই নামগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত দুটি নাম হচ্ছে পুমা এবং কুগার।

সিংহের সঙ্গে পুমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কিছুটা সাদৃশ্য আছে, পুমার গায়ের রংও অনেকটা সিংহের মতো। তবে স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে বিচার করলে সিংহের সঙ্গে পুমার বিশেষ মিল নেই। নিতান্ত বিপদে না পড়লে পুমা লড়াই করতে চায় না, বরং পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে; কিন্তু পশুরাজ সিংহের রাজকীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হলে সে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দীর বিরুদ্ধে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

সিংহ, বাঘ, লেপার্ড প্রভৃতি বিড়াল-জাতীয় বড়ো বড়ো জানোয়ারের মতো হিংস্র নয় পুমা, তাকে দস্তুরমতো নিরীহ বলা যায়। মানুষকে সে পারতপক্ষে আক্রমণ করে না। তবু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশুপালকরা পুমার সম্বন্ধে অত্যন্ত বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। তার কারণ মানুষকে ভয় করলেও গৃহপালিত পশুর মাংস পুমার প্রিয় খাদ্য। প্রতি বৎসর বহু সংখ্যক গোরু, বাছুর, ভেড়া প্রভৃতি গৃহপালিত পশু পুমার আক্রমণে প্রাণ হারায়। এমনকি ঘোড়ার মতো বলিষ্ঠ জানোয়ারও পুমার কবল থেকে নিষ্কৃতি পায় না। সেইজন্য পশুপালকদের কাছে পুমা হচ্ছে। চোখের বালির মতোই দুঃসহ।

পুমাকে হত্যা করার জন্য শিকারিরা শিক্ষিত কুকুরের সাহায্য গ্রহণ করে। এই হাইল্ড বা শিকারি ককর দলবদ্ধ হয়ে পমাকে অনুসরণ করে এবং পলাতক পমার গায়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে তারা গ্রেপ্তার করে ফেলে, বেচারা পুমা কুকুরের প্রখর ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়কে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারে না। কোণঠাসা হলে পুমা সাধারণত গাছে উঠে সারমেয়-বাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে কুকুরের চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে অকুস্থলে উপস্থিত হয় বন্দুকধারী শিকারি এবং তারপরই গুলিবিদ্ধ পুমার প্রাণহীন দেহ আছড়ে পড়ে মাটির উপর। অনেক সময় শিকারিকে আসতে দেখলে পুমা গাছের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে সারমেয়-বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে ছুটে পালাতে চায়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার চেষ্টা সফল হয় না– দলবদ্ধ শিকারি কুকুরের আক্রমণে পুমার সর্বাঙ্গ হয়ে যায় ছিন্নভিন্ন।

তবে সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম আছে। ফ্ল্যাটহেড নামক যুক্তরাষ্ট্রের এক অঞ্চলে হঠাৎ একবার আবির্ভূত হল একটি পুমা এবং কিছুদিনের মধ্যে সে এমন ভয়ংকর স্বভাবের পরিচয় দিল যে শিকারিরা হয়ে গেল স্তম্ভিত, স্থানীয় মানুষ হয়ে পড়ল সন্ত্রস্ত। এই সৃষ্টিছাড়া পুমাটা সারমেয়ে-বাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকার করত না, আক্রান্ত হলেই সে অদ্ভুত সাহস ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রতি-আক্রমণ করে কুকুরের দলকে বিধ্বস্ত করে ফেলত এবং শিকারি অকুস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই চটপট পা চার্লিয়ে নিরাপদ স্থানে প্রস্থান করত। শিকারি এসে দেখত তার প্রিয় কুকুরদের মধ্যে অধিকাংশের দেহের উপরই রয়েছে পুমার ধারালো নখের রক্তাক্ত স্বাক্ষর, দটি বা একটি কুকুরের প্রাণহীন দেহ হয়েছে ধরাশয্যায় লম্বমান এবং বাকি কুকুরগুলো আতঙ্কে এমন বিহ্বল হয়ে পড়েছে যে তারা আর ওই বিপদজনক বিড়ালের পিছু নিতে রাজি নয়।

বারংবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার ফলে কুকুরের দল ঘাবড়ে গেল, ওই পুমাটার গায়ের গন্ধ পেলে তারা আর শিকারকে অনুসরণ করতে রাজি হত না কিছুতেই।

অনেক চেষ্টা করেও এই জন্তুটাকে কোনো শিকারি হত্যা করতে পারেনি, অবশেষে হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনায় পুমাটার মৃত্যু হয়।

পুমার সম্বন্ধে বিভিন্ন ধরনের পরস্পরবিরোধী মতামত শোনা যায়। অধিকাংশ শিকারি ও প্রাণিতত্ত্ববিদের অভিমত হচ্ছে পুমা নিতান্তই ভীরু জানোয়ার, মানুষকে সে কখনোই আক্রমণ করতে চায় না। কিন্তু দু-একজন শিকারি ভিন্নমত পোষণ করেন; তাঁরা বলেন, সুযোগ পেলে পুমা মানুষকে আক্রমণ করে, এমনকি নরমাংসের আস্বাদ গ্রহণ করতেও নাকি তাদের আপত্তি নেই!

এ বিষয়ে জোর করে কিছু বলা মুশকিল, তবে দু-একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণী পাঠ করে মনে হয় মাংসাশী বন্যপশুর স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।

উত্তর আমেরিকার এক গভীর অরণ্য থেকে ফিরে এসে জনৈক শিকারি ঘোষণা করল, যে সব বইতে পুমাকে নিরীহ বলে উল্লেখ করা হয় সেই সব বই অবিলম্বে অগ্নিতে সমর্পণ করা উচিত এবং যে-সব বিশেষজ্ঞ ওই জন্তুটিকে হিংস্র নয় বলেছেন, তাঁদের কথাও আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। উক্ত শিকারির বিবরণী থেকে যে ঘটনা জানা যায় তাতে অবশ্য পুমাকে নিরীহ আখ্যা দেওয়া অসম্ভব। ঘটনাটি নিম্নে বর্ণিত হল :

উত্তর আমেরিকার এক অরণ্য-আবৃত পর্বত-সঙ্কুল অঞ্চলে জনৈক শিকারি হরিণ শিকার করতে যায়। শিকারির নাম হল অ্যান্ড্র এস ফুলার। ছোটোখাটো হরিণের দিকে তার নজর ছিল না, তার প্রার্থিত জীব ছিল এ নামক মহাকায় হরিণ।

ডেভ রোজার্স নামক আর একটি শিকারি ছিল ফুলারের সঙ্গী, তাদের পথ-প্রদর্শক হল এড কেনেডি নামধারী একজন স্থানীয় অধিবাসী। শিকারিরা প্রত্যেকেই ঘোড়ার পিঠে যাত্রা শুরু করেছিল, তা ছাড়া প্রয়োজনীয় মালপত্র বহন করার জন্য তারা আরও তিনটি অতিরিক্ত ঘোড়া সঙ্গে নিয়েছিল।

শিকারিরা প্রথম দিন তাবু ফেলল একটা পাহাড়ের নীচে। জায়গাটা অত্যন্ত নির্জন। একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে একটা মস্ত বড়ো পাথরের মধ্যস্থলে অবস্থিত জমিটার উপর দাঁড়িয়ে শিকারিরা দেখল, পূর্বোক্ত পাথরের ঢালু দেয়াল নেমে গেছে একটা গভীর খাদের মধ্যে এবং সেই সুগভীর খাদের বক্ষ ভেদ করে ছুটে চলেছে এক পার্বত্য-নদীর তীব্র জলস্রোত। উপরে পাহাড়ের মাথায় দেখা যাচ্ছে তুষারের শুভ্র আস্তরণ, নীচের দিকেও যতদূর দেখা যায় চোখে পড়ে শুধু বরফ আর বরফ।

ওইখানেই শিকারিরা আস্তানা পাতল। সন্ধ্যার সময়ে ডেভকে তাবুর পাহারায় রেখে ফুলার ও এড হানা দিল নিকটবর্তী অরণ্যে। একটু পরেই তাদের গুলিতে মারা পড়ল একটা হরিণ। এই জন্তুটা অবশ্য এ হরিণ নয়, তবে মাংসের জন্যই তারা জন্তুটাকে বধ করতে বাধ্য হয়েছিল। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার জন্য তাদের টাটকা খাদ্য অর্থাৎ টাটকা মাংসের প্রয়োজন ছিল।

এল রাত্রি। শিকারিরা মৃত হরিণটাকে একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে তাঁবুর ভিতর শয্যাগ্রহণ করল। হরিণের দেহটা তারা তাঁবুর মধ্যে রাখেনি, কারণ মাংসের লোভে হয়তো কোনো বুনো জানোয়ার তাবুতে হানা দিতে পারে, কিন্তু গাছের উপর ঝোলানো মৃগ-মাংসকে শিকারিরা বন্যপশুর নাগালের বাইরে নিরাপদ বলে বিবেচনা করেছিল। পরের দিন সকালে উঠেই শিকারিদের আক্কেলগুড়ুম! গাছের উপর হরিণটা স্বস্থানে আছে বটে কিন্তু সম্পূর্ণ নেই। হরিণের দেহ থেকে বেশ কিছু মাংস হয়েছে অদৃশ্য!

গাছের নীচে জমি পরীক্ষা করে শিকারিরা পুমার পায়ের ছাপ দেখতে পেল। পদচিহ্ন পরীক্ষা করে তারা বুঝল, জন্তুটার ওজন হবে দেড়শো থেকে দুশো পাউন্ড!

হানাদার পুমাটা নেহাত ছোটোখাটো জীব নয়!

ফুলার লক্ষ করল পথ-প্রদর্শক এড কেনেডির মুখে ফুটে উঠেছে দারুণ বিস্ময়ের চিহ্ন, সে যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছে।

ফুলার প্রশ্ন করল, কি ভাবছ তুমি?

এড বলল, আমি ভাবছি জন্তুটা গাছে উঠে মাংস নিয়ে গেল অথচ এত কাছে দাঁড়িয়েও ঘোড়াগুলো পুমার উপস্থিতি টের পেল না!

সত্যি কথা। পুমাকে দেখতে পেলে বা তার গায়ের গন্ধ পেলে নিশ্চয়ই ঘোড়াগুলো চিৎকার করে শিকারিদের ঘুম ভাঙিয়ে দিত; কিন্তু এমন নিঃশব্দে, এমন ক্ষিপ্রগতিতে জন্তুটা গাছে উঠে মাংস নিয়ে গেছে যে নিকটবর্তী ঘোড়গুলির সম্মিলিত দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তি শ্বাপদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারেনি।

পুমাটা অসাধারণ চটপটে আর ধূর্ত ছিল সন্দেহ নেই, তবে ঘোড়ার মতো প্রখর অনুভূতি। সম্পন্ন জানোয়ারকে বার বার ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়দ্বিতীয় রাত্রে তীব্র হ্রেষাধ্বনিতে শিকারিদের ঘুম ভেঙে গেল।

এড এবং ডেভ শয্যাত্যাগ করার আগেই ফুলার রাইফেল হাতে তাবুর বাইরে পদার্পণ করল। অগ্নিকুণ্ডের আলোতে অস্পষ্টভাবে পুমার দেহটা ফুলারের চোখে পড়ল, চকিতে রাইফেল তুলে সে গুলি চার্লিয়ে দিল। রাইফেলের যান্ত্রিক গর্জনধ্বনিকে ডুবিয়ে দিয়ে জেগে উঠল জান্তব কণ্ঠের তীব্র ও তীক্ষ্ণ চিৎকার- পরক্ষণেই অন্ধকারের চেয়েও কালো এক চতুস্পদ ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল অন্ধকার অরণ্যের অন্তঃপুরে!

এড আর ডেভ এসে দাঁড়াল ফুলারের পাশে। এড বলল, জন্তুটার চিৎকার শুনে বোঝা যায় সে আহত হয়েছে। তার ধারণা, অবশিষ্ট মৃগ-মাংসের সন্ধানেই পুমাটা আবার তাঁবুর কাছে এসেছিল।

ফুলার কিন্তু সঙ্গীর মন্তব্যে সায় দিল না। তার ধারণা জন্তুটা শিকারির দলকে অনুসরণ করছে।

এড হেসে জানিয়ে দিল ফুলারের সন্দেহ অমূলক, একেবারে কোণঠাসা না হলে পুমা কখনও মানুষকে আক্রমণ করতে চায় না।

ফুলারের গুলিতে পুমাটা আহত হয়েছিল। সকালে উঠে ফুলার জন্তুটার পায়ের ছাপ ধরে সেটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল। পুমার একটা থাবা মাটির উপর দিয়ে ঘষে ঘষে গেছে দেখে শিকারিরা বুঝতে পারল ফুলারের গুলি জন্তুটার একটা থাবা জখম করে দিয়েছে।

একটু পরেই ফুলার আবিষ্কার করল এক ভয়াবহ তথ্য! শিকারিরা ঘুরছে পুমার পিছনে, কিন্তু পুমার পায়ের ছাপ দেখে বোঝা যায় বৃত্তাকারে ঘুরে এসে সে শিকারিদের পিছু নিয়েছে।

ফুলার সন্ত্রস্ত্র হয়ে উঠল। তার সঙ্গীরা অবশ্য ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। এড বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, বিড়াল-জাতীয় জানোয়ারের মধ্যে কৌতূহল খুব প্রবল, তাই কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্যই পুমা শিকারিদের অনুসরণ করতে উদ্যত হয়েছে।

ফুলারের অস্বস্তি দূর হল না। তার কেবলই মনে হতে লাগল পুমা জানে কে তাকে আঘাত করেছে। তাই প্রতিশোধ নেবার জন্যই জন্তুটা তাকে অনুসরণ করছে।

একটু পরেই তার সন্দেহ আরও দৃঢ় হল। ডান দিকে একটা মস্ত পাথরের উপর পুমার মাথাটা। তার নজরে পড়েছে।

পাথরটার উপর থেকে পুমা নীচের দিকে তাকিয়ে অশ্বারোহী শিকারিদের লক্ষ্য করছিল– জটার ঈষৎ হাঁ করা মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ধারালো দাঁতগুলো দেখে শিউরে উঠল ফুলার।

এড এবং ডেভ জন্তুটাকে দেখতে পায়নি। ঘোড়ার পিঠ থেকেই পুমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুডল ফুলার। পমার মুখের কাছেই একটা পাথরের উপর তীব্র সংঘাতের শব্দ তুলে গুলিটা ঠিকরে পড়ল, ভয়ার্তকণ্ঠে চিৎকার করে পুমাও গা-ঢাকা দিল তৎক্ষণাৎ!

পুমা যে তাদের অনুসরণ করছে এবং তার উদ্দেশ্য যে ভালো নয় এ বিষয়ে ফুলারের আর সন্দেহ ছিল না। ডেভ ও এড অবশ্য ফুলারের সন্দেহ অমূলক বলে উড়িয়ে দিল। এড আরও বলল যে, কয়েক মাইল দূরে যে কাঠের ঘরটা আছে শীঘ্রই তারা সেখানে পৌঁছে যাবে, কাজেই এ যাত্রায় আর মি, কুগারের সঙ্গে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ফুলারের ধারণা অবশ্য অন্যরকম, তবে সে তর্ক না করে ঘোড়া চার্লিয়ে দিল গন্তব্য পথের দিকে…

যে কাঠের ঘরটার কথা এড কেনেডি তার সঙ্গীদের কাছে বলেছিল, সেই ঘরটার সামনে তারা যখন এসে পৌঁছল তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমেরিকার বনে-জঙ্গলে এই ধরনের কাঠের ঘর দেখা যায়; ঘরগুলি কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়। ভবঘুরে শিকারিরা এগুলো তৈরি করে ভবঘুরে শিকারিদের জন্যই। এই সব ঘরের দরজা-জানালাও অনেক সময় থাকে না। এই ঘরটা অবশ্য দরজা থেকে তখনও বঞ্চিত হয়নি, তবে দু-দুটো জনালার মধ্যে একটারও পাল্লার বালাই ছিল না! খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর ছুটে আসছিল ঠান্ডা হাওয়া। হরিণের চামড়া দিয়ে জানালা দুটির ফাঁক বন্ধ করে শিকারিরা কনকনে ঠান্ডা বাতাসের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করল। এড আগুন জ্বালিয়ে খাদ্য প্রস্তুত করতে লাগল। শিকারিদের সঙ্গে কিছুটা মৃগমাংস ছিল, সেই মাংসের টুকরোটা তারা ছাদের বরগার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘরের তিনটি কোণে শয্যা প্রস্তুত করে তিন সঙ্গী যখন নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মনোনিবেশ করল, বাইরে তখন নেমে এসছে রাত্রির অন্ধকার…

গভীর রাতে হঠাৎ ডেভ-এর ডাকাডাকিতে ফুলারের ঘুম ভেঙে গেল। ডেভ ফুলারকে জানাল বাইরে তাদের ঘোড়াগুলিকে সে বেঁধে রেখেছিল বটে, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে উত্তেজিত হয়ে দুটি ঘোড়া অন্ধকার অরণ্যের গর্ভে আত্মগোপন করেছে। অতএব এডকে নিয়ে সে এখনই পলাতক অশ্ব দুটিকে গ্রেপ্তার করতে বাইরে যাচ্ছে, ফুলার যেন সাবধানে থাকে।

আচ্ছা, বলেই ফুলার আবার ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও সে কৃতকার্য হল না, তার শ্রান্ত ক্লান্ত দেহ তখন বিশ্রাম চাইছে নিদ্রাদেবীর ক্রোড়ে..

আচম্বিতে ঘুম ভেঙে ফুলার সচমকে উঠে বসল, তার শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেছে একটা ঘর্ষণ-শব্দ।

প্রথমে সে ভাবল ঘোড়াগুলো হয়তো পা ঠুকছে, কিন্তু ভালো করে কান পেতে শুনে সে বুঝতে পারল, পাহাড়ের দিকে যে জানালাটা আছে সেই জানালার সঙ্গে ঝোলানো হরিণের চামড়াটার উপর কেউ যেন নখ দিয়ে আঁচড় কাটছে।

নখের আঁচড় কাটার শব্দ!

 মোটেই ভালো কথা নয়।

মুহূর্তের মধ্যে ফুলারের ঘুমের ঘোর কেটে গেল, সে শয্যাত্যাগ করার উপক্রম করল।

কিন্তু ফুলার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই হরিণের চামড়াটা কোনো অদৃশ্য হাতের ধাক্কা খেয়ে ঘরের ভিতর দিকে সরে এল এবং মুক্ত বাতায়ন-পথে মেঝের উপর সশব্দে অবতীর্ণ হল এক অতিকায় মাজারের দেহ পুমা।

দারুণ আতঙ্কে ফুলারের দেহের রক্ত যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। পুমা তার দিকে চাইল না, শ্বাপদের জ্বলন্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে সেই দিকে যেখানে ছাদের বরগা থেকে ঝুলছে একখণ্ড মৃগ-মাংস।

পুমা এইবার দৃষ্টি সঞ্চালিত করল ফুলারের দিকে সঙ্গে সঙ্গে তার কণ্ঠে জাগল অবরুদ্ধ গর্জনধ্বনি এবং উন্মুক্ত মুখগহ্বরের ভিতর থেকে উঁকি দিল ভয়ংকর দাঁতের সারি!

ফুলার ঘরের কোণে অবস্থিত রাইফেলটার দিকে সতৃষ্ণনয়নে দৃষ্টিপাত করলে এবং অস্ত্রটাকে হাতের কাছে না রাখার জন্য নিজেকে অভিসম্পাত দিল বারংবার।

পুমা ঘরের মেঝের উপর নীচু হয়ে বসে পড়ল, তার কান দুটো চ্যাপ্টা হয়ে মাথার খুলির সঙ্গে মিশে গেল বিড়াল-জাতীয় পশুর আক্রমণের নিশ্চিন্ত সংকেত। ফুলার একবার ভাবল লাফ মেরে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করবে, কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝল, পিছন থেকে আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টাই সে করতে পারবে না, অতএব পলায়নের কথা ভুলে গিয়ে সে বিছানার পাশে হাত বাড়িয়ে লম্বা ছুরিটা তুলে নিয়ে প্রস্তুত হল যুদ্ধের জন্য…

হিংস্র দন্তবিকাশ করে সগর্জনে লাফ দিল পুমা, বিদ্যুৎবেগে নীচু হয়ে ফুলার শ্বাপদের আক্রমণ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। পুমার ধারালো নখগুলি শত্রুর কাঁধের উপর এঁকে দিল সুগভীর ক্ষতচিহ্ন, তৎক্ষণাৎ শাপদের পাঁজর ভেদ করে বসে গেল শিকারির হাতের শাণিত ছুরিকা!

তীব্র আর্তনাদ করে পুমা ছিটকে পড়ল দেয়ালের উপর এবং সেখান থেকে ঠিকরে এসে মেঝের উপর গড়িয়ে পড়ল। এক লাফে ঘরের অপর প্রান্ত থেকে রাইফেলটা হস্তগত করে ফুলার প্রস্তুত হল চরম মুহূর্তের জন্য।

আহত পুমা আবার তেড়ে এল। ফুলার গুলি চার্লিয়ে দিল জন্তুটার মুখ লক্ষ্য করে। ভীষণ চিৎকারে ঘর কাঁপিয়ে পুমা পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপরই মেঝের উপর ছিটকে পড়ে ছটফট করতে লাগল। ফুলার আরও তিনবার গুলি ছুড়ল, পুমার দেহটা একবার টান হয়েই স্থির হয়ে গেল। ফুলার যখন বুঝল, জন্তুটার দেহে প্রাণ নেই, তখন রাইফেল নামিয়ে সে দেয়ালে পিঠ রেখে বসে পড়ল– দারুণ আতঙ্ক ও উত্তেজনায় তার সর্বশরীর হয়ে পড়েছে।

প্রায় এক ঘণ্টা পরে ডেভ আর এড যখন ঘরে ঢুকল তখন ফুলার কাঁধের ক্ষতটার উপর একটা ব্যান্ডেজ বাঁধার চেষ্টা করছে। ঘরের মধ্যে পুমার মৃতদেহ এবং ফুলারের রক্তাক্ত কাঁধের দিকে তাকিয়ে এড আর ডেভ সহজেই অনুমান করে নিল ব্যাপারটা কি হয়েছে।

দারুণ বিস্ময়ে এড যে শপথ বাক্যাটি উচ্চারণ করল সিধে বাংলায় তার অর্থ হচ্ছে, এ কি দেখছি! পুমা এগিয়ে এসে মানুষকে আক্রমণ করে।

হঠাৎ ফুলারের দৃষ্টি পড়ল ছাদের বরগার সঙ্গে ঝোলানো মৃগ-মাংসের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ফুলারের মনে হল হয়তো ওই মাংসের লোভেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছিল পুমা, প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা তার ছিল না–

মাংস-লোপ ক্ষুধার্ত পুমাকে হয়তো ফুলার প্রতিশোধ পরায়ণ শ্বাপদ বলে ভুল করছে, হয়তো যে সব বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিতত্ত্ববিদ পুমার নিরীহ স্বভাবের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের কথাই ঠিক, কিন্তু–

হ্যাঁ, তবু একটা কিন্তু থেকে যায়। যে কোনো কারণেই হোক এই পুমাটা মানুষের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছিল এবং জানলার খোলা পথে পালানোর উপায় থাকা সত্ত্বেও সে মানুষকে আক্রমণ করতে একটুও ইতস্তত করে নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *