আমেরিকার অর্থব্যবস্থায় ইহুদি দৌরাত্ম্য

আমেরিকার অর্থব্যবস্থায় ইহুদি দৌরাত্ম্য

ইহুদিদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল শক্তিঘর প্রতিষ্ঠিত হয় রথসচাইল্ড পরিবারের হাত ধরে, সপ্তদশ শতাব্দীতে। এটি জার্মানির ফ্রাঙ্কফ্রুট শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও পরবর্তী সময়ে তা ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এর সাথে যুক্ত হয় আরও কিছু পরিবার। তাদের আধিপত্যও কোনো অংশে কম নয়।

মূলত অর্থ-সম্পদের ভিত্তিতে গড়ে উঠে অর্থনীতি। আর তারই প্রাচুর্যতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে একটি দেশের রাজনৈতিক দল। তাই অর্থনীতির সাথে রাজনীতির সম্পর্ক খুবই গভীর। ইহুদি ব্যাংকাররা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন শাখা খোলার পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর অদৃশ্য আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। এর ফলে তারা প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে কলকাঠি নাড়ার অনুমতি পেয়ে যায়। রথসচাইল্ড ছাড়া আরও যে চারটি পরিবার এই শিল্পে একচ্ছত্র ক্ষমতাবান, তাদের নাম হলো : Belmont (বেল্টমন্ট), Schiff (স্কিফ), Warburg (ওয়াবার্গ) এবং Kahn (খান)।

১৮৩৭ সালে আমেরিকায় রথসচাইল্ড পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করতে হাজির হন August Belmont। তার জন্ম জার্মানির ফ্রাঙ্কফ্রুট শহরে। পরবর্তী সময়ে তার হাত ধরে জন্ম নেয় বেল্টমন্ট ব্যাংকিং পরিবার। ১৮৬০ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেট কমিটির প্রধান সভাপতি।

দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হলেন Jacob Schiff। তার জন্মও ফ্রাঙ্কফ্রুট শহরে। জার্মানিতে বাবার ব্যাংকে দীর্ঘকাল শিক্ষানবিশ হয়ে কাজ করার পর ১৮৬৫ সালে তিনি আমেরিকায় প্রবেশ করেন। তার বাবাও ছিলেন রথসচাইল্ড পরিবারের বিশেষ একটি শাখার প্রতিনিধি। তার সংগঠনের হাত ধরে প্রচুর জার্মান মূলধন আমেরিকায় প্রবেশ করে। তার অর্থে তৈরি হয় অনেক নতুন নতুন রাস্তাঘাট, সেতু, মহাসড়ক, রেলপথ, উঁচু ভবন, বিমা প্রতিষ্ঠান ও টেলিগ্রাফ প্রতিষ্ঠান।

১৮৭৫ সালে Theresa Loeb-কে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে তিনি Kuhn, Loeb & Company-এর প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। জাপান-রাশিয়া যুদ্ধেও তিনি প্রচুর অর্থ জাপানের পক্ষে বিনিয়োগ করেন। ভেবেছিলেন এই বিনিয়োগের ছুতোতে হয়তো জাপানের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবেন, কিন্তু জাপান রাজা সতর্ক ব্যক্তি হওয়ায় ইহুদিদের ভাবগতি ভালো করেই জানতেন। তাই নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলিতে অন্যদের হস্তক্ষেপের ন্যূনতম সুযোগ দেননি।

Kuhn, Loeb & Company-এর সঙ্গে জড়িত আরেকজন ব্যক্তি হলেন Otto Herman Kahn। অন্যদের মতো তারও জন্ম ফ্রাঙ্কফুট শহরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম’ তৈরির পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে তিনি আমেরিকায় আগমন করেন। তখন থেকেই আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাকে আমেরিকায় নিয়ে আসার পেছনে গোপনে কাজ করেন Paul Warburg ।

এরপর চলে আসে ওয়াবার্গ পরিবারের নাম। ১৯০২ সালে পরিবারটির অন্যতম সদস্য Paul Warburg আমেরিকায় আগমন করেন।

তিনি ১৮৬৮ সালে জার্মানির হাম্বার্গ শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কিশোর বয়সেই রপ্ত করেন ‘কীভাবে অর্থ (Money) তৈরি করতে হয়।’ একটু চিন্তা করে দেখুন, যেখানে প্রাপ্ত বয়সেও অনেকে জানে না কীভাবে অর্থ উপার্জন করতে হয়, সেখানে তিনি কিশোর বয়সেই শিখে ফেলেছেন কীভাবে অর্থ তৈরি করতে হয়!

The Banking House of Warburg ১৭৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই ছিল তার কিশোরকালীন বিদ্যালয়।

ব্যাংকিং শিল্পে তিনি যেভাবে পারদর্শী হয়ে উঠেন, তা ৫ আগস্ট, ১৯১৪ সালে Banking and Currency Committee-তে নিজ মুখে স্বীকার করেন। তার পুরো বক্তব্য একজন শর্টহ্যান্ড লেখক লিপিবদ্ধ করেন। ১২ আগস্ট, ১৯১৪ তার পুরো বক্তব্য জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়। তার বক্তব্যেরে গুরত্বপূর্ণ অংশ নিচে উপস্থাপন করা হলো—

‘হাম্বার্গ থেকে আমি ইংল্যান্ড চলে আসি। সেখানে Samuel Montague & Co-তে দুই বছর কাজ করি। এরপর দুই মাসের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানে শেয়ার অবলেখকের কাজ করি। শেখার চেষ্টা করি, কীভাবে শেয়ারবাজারকে পুরো দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা যায় এবং তার সাথে ব্যাংকিং কার্যক্রম সংযুক্ত করা যায়।

এরপর যাই ফ্রান্সে। সেখানে একটি রাশিয়ান ব্যাংকের শাখায় কিছুদিন কাজ করি। কীভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যের সাথে ব্যাংকিং কার্যক্রমকে সংযুক্ত করা যায়, তা শিখি।

এরপর হাম্বার্গে ফিরে স্থানীয় একটি ব্যাংকে কিছুদিন কাজ করি। পাশাপাশি ভারত, চীন ও জাপানের একাধিক ব্যাংক পরিদর্শন করি।

১৮৯৩ সালে প্রথমবারের মতো আমেরিকায় আসি। কিছুদিন থেকে হাম্বার্গে ফিরে যাই এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি। ১৯০২ সালে পুনরায় আমেরিকায় আসি এবং Kuhn, Loeb & Co-এর শেয়ারহোল্ডার হই।

এই হলো আমার পুরো ব্যাংকিং শিক্ষাজীবনের ইতিহাস। ১৮৯৫ সালে Solomon Loeb-এর কন্যা Nina Loeb-কে বিয়ে করে তাদের সাথে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হই। এর মাধ্যমে আমি তাদের পরিবারিক প্রতিষ্ঠান Kuhn, Loeb & Co.-এর শেয়ারহোল্ডার হই।

Mr. Loeb-এর অপর কন্যাকে বিয়ে করেন Jacob H. Schiff। এটা ইহুদিদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য যে, ব্যবসায় জোট মজবুত করতে তারা পারিবারিক সম্পর্ককে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এরপর Mr. Schiff তার কন্যা Frieda Schiff-কে বিয়ে দেন Felix Warburg-এর সাথে, যিনি Paul Warburg-এর আপন ভাই।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ট্রাস্ট কোম্পানি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল—মানুষের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নিজেদের নিকট জমা রাখা এবং ওয়ারিশবিধি অনুযায়ী তা উত্তরাধিকারীদের নিকট বণ্টন করা। পরবর্তী সময়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও মানুষকে ঋণ দেওয়ার কাজ শুরু করে। কিন্তু ১৯০৬ সালে ট্রাষ্ট কোম্পানিগুলো জনগণের আস্থা একেবারে হারিয়ে ফেলে। প্রচুর মানুষ জমাকৃত সম্পদ হারিয়ে পথে বসে। ঘটনা শুরু হয় যখন Knickerbocker Trust Co. তাদের ‘রিজার্ভ হারিয়ে ফেলে। এ থেকে পুরো আমেরিকায় শুরু হয় অর্থনৈতিক বিক্ষোভ।

এই বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে মি. ওয়ারবার্গ Defects and Needs of Our Banking System শিরোনামে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন। তিনি আর্টিকেলটি আরও আগেই লিখেছিলেন, কিন্তু প্রকাশ করেন ১৯০৭ সালে, যখন পুরো আমেরিকায় অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জানতেন, ট্রাস্ট কোম্পানিগুলো খুব দ্রুত পথে বসবে। মূলত তারাই এই প্রতিষ্ঠানটির পতন ঘটিয়েছে, পুরো বিষয়টাই ছিল সাজানো নাটক!

তার আর্টিকেলটি Senator Aldrich-এর চোখে পড়ে। তিনি তখন আমেরিকান সরকাররের অর্থ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। পেশাদার জীবনে ছিলেন খুবই কর্মঠ। বিশ্বাস করতেন আমেরিকান জাতির উন্নয়নে। তবে তিনি ভাবতেন, এই উন্নয়ন কেবল ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমেই করা সম্ভব। তার সাথে রকেফেলার পরিবারেরও বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। তার মেয়ে Abby Aldrich-কে সেই রকেফেলার পরিবারের সদস্য John D. Rockefeller এর সঙ্গে বিয়ে দেন।

১৯০৬ সালে অর্থনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছালে Nelson Aldrich-কে এর সমাধান খোঁজার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি পরামর্শের জন্য Mr. Warburg-এর স্মরণাপন্ন হন। উভয়ে একটি গুপ্ত আলোচনার আয়োজন করেন, যার জন্য জর্জিয়ার নিকটবর্তী নির্জন দ্বীপ জ্যাকল আইল্যান্ডকে (Jekyl Island) বাছাই করা হয়। দ্বীপটি ছিল সম্পদশালী ইহুদিদের অবসর সময় কাটানোর জায়গা। এই গুপ্ত আলোচনার বিষয়বস্তু কী ছিল, তা আজ অবধি জানা সম্ভব হয়নি। ১৯১৬ সালে Forbes Magazine-এর লেখক B.C. Forbes এই গুপ্ত আলোচনাটি নিয়ে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন, যার অংশবিশেষ নিচে উপস্থাপন করা হলো—

‘কল্পনা করুন আমেরিকার প্রতাপশালী ব্যাংকারদের কথা, যারা বিশ্বস্ত কিছু সহকর্মীকে সাথে নিয়ে রাতের অন্ধকারে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রেনে করে নিউইয়র্ক থেকে ১০০ মাইল দক্ষিণে কোনো একটি স্থানে নেমে যায় এবং সেখান থেকে এক সপ্তাহের জন্য একটি রহস্যেঘেরা দ্বীপে গমন করে। প্রথমবার মিলিত হয়ে তারা কেবল একবারের জন্য নিজেদের পরিচয় বিনিময় করেছে। পাছে ভয় হয়, যদি সাথে থাকা চাকরগুলো সবার পরিচয় জেনে যায়!

সবাই শপথ করে, জ্যাকল আইল্যান্ডে তাদের মাঝে যে আলোচনা হবে, তার উচ্ছিষ্ট অংশটুকু পর্যন্ত সাধারণ মানুষ জানতে পারবে না। Nelson Aldrich-এর নির্দেশে সবাই আলাদা আলাদা গাড়িতে উঠে যায়। তাদের জন্য আগে থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করা ছিল। গাড়িগুলো এমন একটি নির্জন প্লাটফরমে রাখা হয়েছিল, যেন সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা সাউদার্ন কান্ট্রিতে হাজির হয়। অন্ধকার থাকাতে সেই দৃশ্য নিউইয়র্কের কোনো সাংবাদিকের চোখে পড়েনি।

গাড়ি থেকে বের হয়ে তারা ছোটো ছোটো কিছু নৌকায় উঠে পড়ে। তাদের আচরণ এমন ছিল, যেন নৌকার মাঝিরা পর্যন্ত বুঝতে না পারে-তারা আমেরিকার বিশিষ্ট ব্যক্তিভাজন!

সঠিক সময়ে তারা জ্যাকল আইল্যান্ডে এসে পৌঁছায়। দ্বীপটি ছিল জনশূন্য, সেখানে অর্ধডজন চাকর-বাকর ছাড়া আর কেউ-ই ছিল না।

একে অপরকে জিজ্ঞেস করে, কীভাবে চাকরদের কাছ হতে নিজেদের পরিচয় গোপন রাখা সম্ভব? একজন বলল—”চলুন, আমরা সবাই আমাদের নামের প্রথম শব্দটি দ্বারা একে অপরকে সম্বোধন করি।” সবাই এতে রাজি হলো।

ফলে আমেরিকার অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সৈনিকের নাম হয়ে যায় Nelson; আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার গুরু এবং Kuhn, Loeb & Co.-এর অন্যতম শেয়ার হোল্ডারের নাম হয়ে যায় Paul।

Nelson গোপনীয়তা রক্ষা করতে Harry, Frank, Paul ও Piatt-কে বলেন, যতদিন না তারা এমন একটি নকশা তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে—যা দ্বারা পুরো আমেরিকাকে একত্রিত করা সম্ভব, ততদিন এই দ্বীপে অবস্থান করবে। তিনি এমন একটি অর্থব্যবস্থার কথা জানতে চান, যা শুধু আমেরিকায় নয়; পুরো ইউরোপে গ্রহণ যোগ্যতা পাবে।’

সাত দিনে এই আলোচনা অনেক দূর গড়ায়। তবে যেসব বিষয়ের ওপর আলোচনা ও চুক্তি হয়, তার কোনো কিছুই আজ পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

গুপ্ত আলোচনায় বিশেষ চারটি পরিবারের সদস্যগণ ছাড়া আরও যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা হলেন : Bernard Baruch, Eugene Meyer, Felix Frankfurter, Benjamin Strong, Julius Rosenwald, Henry Davison, Arthur Shelton Frank Vanderlip । কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর E.R.A. Seligman নতুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর ১৯১৯ সালে একটি কলাম প্রকাশ করেন। নিচে এর অংশবিশেষ উপস্থাপন করা হলো—

‘আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক গঠনে Mr. Warburg-এর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। শুরুতে যদিও তার পরিকল্পনা কিছুটা দৃষ্টিকটু ছিল, তারপরও সময়ের সাথে সাথে তা আমেরিকার অর্থনীতির মূল গঠনতন্ত্রে পরিণত হয়। খুব দ্রুত তা প্রতিটি প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন অর্থব্যবস্থাকে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এর দরুন দীর্ঘকালীন অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও বাণিজ্যিক জটিলতা থেকে আমেরিকার মানুষ মুক্তি পায়।

১৮৪০ সালে Mr. Samuel Jones কর্তৃক উপস্থাপিত Peel’s Bank Act-এর কল্যাণে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড যেমন নোট ইস্যুর অনুমতি পায়, তেমনি Mr. Warburg কর্তৃক উপস্থাপিত Federal Reserve Act আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নোট ইস্যুর অনুমতি প্রদান করে।

Senator Aldrich চেয়েছিলেন—১২টি আঞ্চলিক শাখা অফিস নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গঠিত হবে এবং তা সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে, কিন্তু Warburg চেয়েছেন—ব্যাংকটি সম্পূর্ণ বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত হবে। তিনি বলেন—”সরকারি বা রাজনৈতিক থাবার ভেতর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কখনো প্রত্যাশিত ফলাফল উপহার দিতে পারে না। তাই এই ব্যাংক পরিচালনায় যে দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে, তা সরকারি আজ্ঞার বাহিরে থাকবে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদের বিনিময়ে ব্যাংক তার সকল অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে।” যেহেতু Aldrich-এর নিকট অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা ছিল না, তাই তিনি উপস্থাপিত দাবি দুটি মেনে নেন।

এটাই হয়তো শেষ প্রজন্ম, যারা বার্টার ট্রেডকে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে। এরপর এই সংস্কৃতি বাজার থেকে হারিয়ে যাবে। এর স্থলাভিষিক্ত হবে কাগজি নোটভিত্তিক বিনিময়ব্যবস্থা।’ (pp. 387-390, Vol. 4, No. 4, Proceedings of the Academy of Political Science, Columbia University)

এটাই প্রথম ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়; ইউরোপে এমন আরও অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক আছে, যেগুলো ইহুদিদের ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। এ নিয়ে Mr. Warburg একটি প্রবন্ধ লিখেন- American and European Banking Methods and Bank Legislation Compared। সেখানে উল্লেখ করেন—

‘শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও ইউরোপের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো শেয়ার নেই। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তো পুরোটাই ব্যক্তি মালিকানাধীন। ফ্রান্স ও জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুটিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সামান্য অধিকার চর্চার সুযোগ পেলেও এর পুরো লভ্যাংশ বণ্টিত হয় ব্যক্তি মালিকদের মাঝেই।’

সেখানে তিনি বেশ কিছু ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাধারণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে, তা Federal Reserve Act-এ অন্তর্ভুক্তির জন্য জোর দাবি তোলেন। বৈশিষ্ট্যগুলো পয়েন্ট আকারে দেখানো হলো—

• কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না।

• রাষ্ট্রীয় নোট ছাপানোর অধিকার কেবল তাদের হাতেই থাকবে।

• জাতীয় সম্পদ (স্বর্ণ-রৌপ্য) সংরক্ষণের অধিকার থাকবে।

• অর্থ বাজারের পরিচালনায় সরকার-প্রশাসন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করবে।

বলে রাখা ভালো, ১৮৩৩ হতে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ইতিহাসে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল না। ১০ জুলাই, ১৮৩২ প্রেসিডেন্ট Andrew Jackson একটি দীর্ঘ বক্তৃতা প্রদান করেন। তিনি বলেন—

‘সাধারণ মানুষ যদি ব্যাংকিং ও অর্থব্যবস্থার কারচুপি সামান্য হলেও বুঝতে পারত, তাহলে পরদিন ভোরেই মহাবিপ্লবের জন্ম হতো। ব্যাংক নামক বিষধর সাপটি যতই বিষাক্ত হোক না কেন, মহান ঈশ্বরকে সাথে নিয়ে আমি তার বিষদাঁত তুলে ছাড়ব। আমি জানি, তারা আমাকে দংশনের অপেক্ষায় ওত পেতে আছে, কিন্তু আমিই তাদের দংশন করব।’

১০ সেপ্টেম্বর, ১৮৩৩ তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক অব আমেরিকাকে বন্ধ ঘোষণা করেন। ব্যাংকটির আরও একটি নাম ছিল ‘ফার্স্ট ব্যাংক অব আমেরিকা’। এরপর দীর্ঘ ৮০ বছর আমেরিকায় কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল না; তবে ইহুদিদের পরিকল্পনার অন্ত ছিল না।

আশা করি, Mr. Taft-এর কথা আপনাদের মনে আছে। তিনি শুধু রাশিয়ানদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাই নয়; অবান্তর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠারও অনুমোদন দেননি।

তাই পরবর্তী নির্বাচনকাল পর্যন্ত ইহুদিদের অপেক্ষা করতে হয়। ১৯১২ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে লড়াই করেন Roosevelt, Taft ও Wilson। যেহেতু এক ঝুড়িতে তারা সব ডিম রাখে না, তাই সকল প্রার্থীর পেছনেই তারা বিনিয়োগ করে। Wilson সাহেবের পেছনে বিনিয়োগ করে Schiff; Taft সাহেবের পেছনে Felix Warburg; Roosevelt- এর পেছনে Mr. Kahn। সবশেষে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন Woodrow Wilson।

ক্ষমতায় এসে Wilson সরকার ইহুদিদের বিনিয়োগ ও প্রচারণা কাজের পুরস্কারস্বরূপ ফেডারেল রিজার্ভ অ্যাক্টকে অনুমোদন করে এবং উত্থাপিত সকল শর্ত মঞ্জুর করে। ব্যাংকটি যেহেতু ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালত হবে, তাই এর প্রারম্ভিক রিজার্ভ যে শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগকৃত সম্পদেই গঠিত হবে, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই রিজার্ভ কী দিয়ে তৈরি হবে? এ সম্পর্কে সিনেটের একটি আলোচনায় Pomerene ও Bristow যৌথভাবে Mr. Warburg-কে প্রশ্ন করেন।

প্রশ্ন : ফেডারেল ব্যাংকের রিজার্ভ কী দিয়ে তৈরি হবে?

উত্তর : এই ব্যাংকের রিজার্ভ স্বর্ণ-রৌপ্য দ্বারা তৈরি হবে।

কিন্তু যে স্বর্ণ-রৌপ্যের কথা এখানে বলা হয়েছে, তা তো ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংকগুলোতে পড়ে আছে। সেখান থেকে সেগুলোকে জাহাজে করে আমেরিকায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য প্রয়োজন একটি যুদ্ধ। কয়েক মাস পর ১ আগস্ট, ১৯১৪। Senator Owen ঘোষণা করেন—’আমরা একটি বড়ো ইউরোপিয়ান যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি।’ বহিঃরাষ্ট্রের সম্পদ গ্রাসের নিমিত্তে এটা ছিল প্রথম যুদ্ধের ইঙ্গিত।

শুরুতে তিনি চেয়েছিলেন—ব্যাংকটির একটিমাত্র অফিস থাকবে এবং তা নিউইয়র্কে। প্রফেসর Seligman তাকে পরামর্শ দেন—

‘নিউইয়র্কের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাধারণ জনগণ এমনিতেই ক্ষেপে আছে। তার ওপর এখানে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পায়, তবে তা রাজনৈতিক জনরোষে রূপ নিতে পারে। এমতাবস্থায় ব্যাংকটির শাখা বৃদ্ধি করা উচিত।’

তার পরামর্শ অনুযায়ী ব্যাংকটিকে ২টি, ৪টি ও ৮টি করে মোট ১২টি শাখায় বৃদ্ধি করা হয়।

সিনেট সদস্যদের আলোচনায় তিনি বলেন—’ব্যাংকটির এতগুলো শাখা থাকায় ব্যবস্থাপনা কাজ জটিল হয়ে পড়বে। তাই এর একটি ব্যবস্থাপনা পর্ষদ থাকা উচিত, যা নিউইয়র্কে স্থাপিত হবে এবং সেখান থেকেই সকল শাখা পরিচালিত হবে।’ Nelson Aldrich পুরো দেশকে একই অর্থ ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার প্রস্তাব করেন, যেন সর্বত্র সুদের হার সমান হয়। কিন্তু Mr. Warbur বলেন—’অবস্থান ও প্রয়োজনের আলোকে ব্যাংকের প্রতিটি শাখা পৃথক পৃথক সুদ-কাঠামো অনুসরণ করতে পারে।’

এ কারণে দেখা যায়—থিয়েটার, সিনেমা হল ও সংগীত বিপণি তৈরিতে প্রডিউসাররা স্বল্প সুদে ঋণ পেলেও কৃষক-রাখলদের উচ্চসুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। যেখানে সমাজের সংখ্যালঘু একটি দল অর্থের পাহাড় বানিয়েই যাচ্ছে, সেখানে জনসংখ্যার বৃহৎ একটি অংশ নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছে। ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখবেন, কেবল উৎপাদনমুখী খাতগুলোর ওপর উচ্চ সুদের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর যেগুলো অনুৎপাদনশীল এবং নোংরা সংস্কৃতির জন্ম দেয়, সেগুলোতেই সুদের হার নগণ্য। কেন এই বৈষম্য? এই বৈষম্যের পেছনে কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে? আশা করি, Protocol of the Learned Elder Zion-এর একটি ধারা আপনাদের মনে আছে? ‘জ্যান্টাইলদের ভূমিশূন্য করতে হবে; নতুবা তাদের ওপর চির দারিদ্র্যতা চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।’

আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ে ইহুদিদের পরিকল্পনা

‘ইহুদিরা ব্যাংকিং শিল্পে খুবই দক্ষ। তাদের মতো আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং জোট গোটা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এই জোট এতটা ভয়ংকর যে, ইহুদিরা একদিন গোটা বিশ্ব অর্থনীতির লাগাম টেনে ধরবে।’—Aurther Brisbane

ইহুদিদের সবচেয়ে বড়ো শক্তি হলো আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক। এর মাধ্যমে তারা পুরো পৃথিবীর অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে। বর্তমানে তাদের পুরো ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের কেন্দ্রবিন্দু জার্মানির ফ্রাঙ্কফ্রুটে অবস্থিত, তবে তা খুব দ্রুতই অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে।

যে স্বর্ণ (Gold) ইহুদিদের কাছে ঈশ্বরের সমতুল্য, যাকে তারা God of the living বলে সংজ্ঞায়িত করে থাকে, আজ তারা সেই স্বর্ণ জাহাজে বোঝাই করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আমেরিকায় নিয়ে আসছে। ইহুদিরা এটা ভেবে খুব ভীত যে, ইউরোপে হয়তো খুব দ্রুতই আরও একটি ভয়ংকর রক্তাক্ত যুদ্ধ সংগঠিত হবে। তাই সময় থাকতে ইহুদিরা অন্যত্র সরে পড়তে শুরু করেছে এবং নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে আমেরিকাকে বেছে নিয়েছে।

প্রতিটি দেশেই ইহুদিদের একটি করে ব্যাংক থাকতেই হবে, এ ধরনের কোনো বাধ্যবোধকতা নেই। এর বিপরীতে ইহুদিরা এমন একটি প্রক্রিয়া তারা চালু করবে, যার মাধ্যমে পুরো পৃথিবীকে একটি মাত্র কেন্দ্রবিন্দু থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। সেই প্রক্রিয়ার নাম হবে ‘World Banking Chain’।

যদি আপনি Warburg, Furstenbergs, Sonnenscheins, Sassoons, Samuels ও Belichroeders-এর মতো ইহুদিদের জীবন ইতিহাস ভালো করে অধ্যয়ন করেন, তবে এই বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। যুদ্ধপূর্ববর্তী সময়ে অর্থ জালিয়াতি নিয়ে তাদের আধিপত্যের কোনো কমতি ছিল না। এ সকল কর্মকাণ্ড নিয়ে এই মস্তিষ্ক বিকৃত পাগলদের আবার গর্বেরও কোনো শেষ নেই। তারা বলে—’আমাদের শক্তি- সামর্থ্যের পরিধি কতটা ব্যাপক, আশা করি তা আজ পুরো পৃথিবী উপলব্ধি করতে পেরেছে। তারা এটাও বুঝতে সক্ষম হয়েছে, আমাদের বাদ দিয়ে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।’

Protocols of the Learned Elder Zion-এর ষষ্ঠ তম প্রটোকলে বলা আছে—

‘খুব দ্রুতই আমরা বিশ্ব অর্থনীতির ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করব। সেখান থেকে তৈরি করব বিশাল সম্পদের আধার। জ্যান্টাইলদের প্রতিটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মূল ভিত্তি হবে আমাদের অর্থ-সম্পদ। প্রতিটি রাষ্ট্র ও তার রাজনৈতিক দলগুলোকে আমরা ঋণের বেড়াজালে বেঁধে ফেলব। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো পতনের সাথে সাথে পুরো ঋণের বোঝা দেশের সাধারণ জনগণের কাঁধে গিয়ে পড়বে, সেখান থেকে নেমে আসবে এক ভয়ংকর অর্থনৈতিক বিপর্যয়।

একই প্রটোকলের অপর একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—

‘একই সময়ে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণে আমরা জ্যান্টাইলদের আগ্রহী করে তুলব। তবে সবকিছুর পেছনে থাকবে আমাদের ফটকা পরিকল্পনা, যেন তারা ইচ্ছেমতো উৎপাদন করতে না পারে। আমরা তাদের ঋণের পৃথক পৃথক খাত এবং ফসল উৎপাদনের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেবো। ফলে তারা চাইলেও অধিক উৎপাদন করতে পারবে না এবং ঋণের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না…। এভাবে একটা সময় তাদের ভূমিগুলো আমাদের মালিকানায় চলে আসবে।

সমাজে ক্ষুধা-দরিদ্রতা ছড়িয়ে দিতে জ্যান্টাইলদের অপ্রয়োজনীয় বিলাসবহুল জীবনব্যবস্থায় উৎসাহী করে তুলব, যা তাদের মস্তিষ্ক থেকে বুদ্ধিবৃত্তি নামক বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে মুছে দেবে।

আমরা শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন-মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে উৎসাহিত করব, কিন্তু এতে শ্রমিকদের ন্যূনতম কোনো উপকার হবে না। কারণ, একই সময়ে আমরা বাজারে পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দেবো এবং বলব—এ বছর ফসল কম উৎপাদন হয়েছে। আমরা উৎপাদনমুখী কৃষকদের দক্ষতা ধ্বংস করার জন্য তাদের অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন শিল্প কার্যক্রমের প্রতি উৎসাহিত করব এবং অ্যালকোহলের প্রতি নেশাগ্রস্ত করে রাখব।’

২০ নম্বর প্রটোকলে বলা হয়েছে—

‘আজ তোমাদের এমন এক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা বলতে যাচ্ছি, যা প্রতারণা ছাড়া অন্য কিছু নয়, আর এটাই আমরা জ্যান্টাইলদের ওপর চাপিয়ে দেবো। তোমরা সবাই জানো, স্বর্ণ-রৌপ্যই পৃথিবীর প্রকৃত অর্থ, যা হাজার হাজার বছর পৃথিবীর বিভিন্ন রাজ্যে একমাত্র বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। যখনই কেউ এই অর্থব্যবস্থার বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছে, ধীরে ধীরে তাদের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা বাজার হতে স্বর্ণ-রৌপ্য সরিয়ে দিয়ে মানুষের হাতে নকল অর্থ ধরিয়ে দেবো।’

‘প্রতিটি ঋণ একজন সরকারের অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে, যা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। এমতাবস্থায় সরকার জাতীয় দায় থেকে বেরিয়ে আসতে জনগণের ওপর একের পর এক করের বোঝা চাপিয়ে দিতে শুরু করবে। বৈদেশিক ঋণ হলো রক্তচোষা জোঁকের মতো। এটা একবার যদি কোনো রাষ্ট্রের ওপর আঁকড়ে বসে, তবে সমস্ত রক্ত খেয়ে তবেই ছাড়বে। তারপরও জ্যান্টাইল রাষ্ট্রগুলো বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করবে এবং একে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় বলে বিবেচনা করবে।

২০ নম্বর প্রটোকলে আরও বলা আছে—

‘বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরবর্তী প্রভাব কী? বন্ডের বিনিময়ে ঋণ গ্রহণ করলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর তা সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে। যদি পাঁচ শতাংশ সুদের বিনিময়ে কোনো রাষ্ট্র ঋণ নেয়, তবে বিশ বছরে সুদের পরিমাণ হবে আসল অর্থের সমান; চল্লিশ বছরে হবে আসল অঙ্কের দ্বিগুণ, আর ষাট বছরে হবে তিনগুণ! ফলে ক্রমবর্ধমান সুদের দায় থেকে কোনোদিনই বেরিয়ে আসতে পারবে না।’

আফসোসের বিষয় হলো—অধিকাংশ মানুষ এই নিগূঢ় সত্যগুলো একেবারেই জানে না। প্রতিবছর এত এত কর পরিশোধের পরও জাতীয় দায় থেকে আমরা মুক্তি পাই না। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত ডলার ছাপানো হয়েছে, তার সব যদি ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তারপরও পুরো পৃথিবীর দায় মেটানো সম্ভব নয়।

Protocols of the Learned Elder Zion মূলত রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যকে উপড়ে ফেলার জন্য তৈরি করা হয়। কিন্তু তাদের এই নীলনকশা কেবল রাশিয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি; ছড়িয়ে পড়েছে পুরো পৃথিবীতে। করব্যবস্থাকে (Tax) কেন্দ্র করে ইহুদিদের যে পরিকল্পনা, তা সংক্ষেপে নিচে উপস্থাপন করা হলো :

১. ‘শাসকশ্রেণিতে পরিণত হওয়ার পর আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে সাধারণ জনগণের ওপর আমরা করের বোঝা চাপিয়ে দেবো। এতে সীমিত আয়ের মানুষ প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ে তুলতে পারবে না। আর এই কাজটা আমাদের করতে হবে না; বরং প্রতিটি দেশের সরকারই নিজ দায়িত্বে এই কাজ করে দেবে। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও প্রশাসনিক খরচ বহনের নামে তারা নিয়মিত জনগণের থেকে কর আদায় করবে, যার দরুন সাধারণ মানুষ চিরকাল গরিব থেকে যাবে।

২. বিভিন্ন উপায়ে কর আরোপ করা যেতে পারে। যেমন :

ক. Progressive Tax : এ প্রক্রিয়ায় আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে করের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

খ. পৈতৃক সম্পদের ওপর কর : পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পদ ব্যবহার করে কেউ যদি উপার্জন করে, তবে তার ওপর কর আরোপ করা হবে। যেমন : মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে বাড়ির মালিকগণ বাসা ভাড়ার ওপর কর প্রদান করবে।

গ. মালিকানাস্বত্ব হস্তান্তরের ওপর কর : সম্পদ হস্তান্তরের সময় খরচ (Fee) প্রদান করতে হবে।

ঘ. Luxury Tax : সৌখিন পণ্যসামগ্রী ক্রয়ের সময় শুল্ক প্রদান করতে হবে।

যেমন : গাড়ি, বিমান, জাহাজ ইত্যাদি।’

আপনাদের প্রশ্ন জাগতে পারে, এত সব তথ্য আমরা কেন জানি না? কেন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থব্যবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তিকর সব বিষয় শেখানো হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে Elder Zion-এর ৮ নম্বর প্রটোকল দিয়ে এই অধ্যায়টি শেষ করছি—

‘আমরা বিশ্বজুড়ে একগাদা অর্থনীতিবিদের জন্ম দেবো, যারা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে সরকার প্রধানের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবে। অর্থবিজ্ঞান আমাদের প্রধানতম অস্ত্র।

আদর্শ অর্থের বৈশিষ্ট্য

মানুষ আমৃত্যু যে জিনিসটির পেছনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করে, তা হলো অর্থ। অর্থ থেকে জন্ম নেয় অর্থনীতি। কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, অর্থের সংজ্ঞা কী? দেখা যাবে অনেকে এর সঠিক উত্তর দিতে পারছে না। ডলার, টাকা, রুপি, রিয়াল ইত্যাদি বহুকাল আমাদের চোখে অর্থ বলে পরিচিত হয়ে আসছে; যদিও এগুলো হলো ‘কারেন্সি’, যা তৈরি হয় বাতাস থেকে।

আমাদের অবচেতন মন ‘অর্থ ও কারেন্সি’–এ বিষয় দুটি এক করে ফেলেছে; কিন্তু তা এক নয়। এমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত, যা দ্বারা বিষয় দুটির মাঝে পার্থক্য গড়ে তোলা সম্ভব। ইতিহাস অধ্যয়ন করলে তিন ধরনের উপকরণ পাওয়া যাবে, যেগুলো বিভিন্ন যুগে অর্থ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যথা : স্বর্ণ-রৌপ্য, কাগজি নোট এবং ভোগ্য পণ্য।

সম্প্রতি অর্থব্যবস্থার ওপর Michael Maloney-এর লেখা Gold & Silver বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ইতোমধ্যে তা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অতিরিক্ত অংশটুকু এই জনপ্রিয় বইয়ের সারাংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হলো।

তিনি বইটিতে আদর্শ অর্থের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করেছেন :

১. গ্রহণযোগ্য বিনিময়মাধ্যম : বিনিময় মাধ্যম বলতে একটি তৃতীয় মাধ্যমকে বোঝানো হয়, যা দ্বারা ক্রেতা-বিক্রেতারা তাদের লেনদেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে। একসময় মানুষ বার্টার ট্রেড পদ্ধতিতে পণ্যের বিপরীতে পণ্য বিনিময় করত। যেমন : দুধের বিপরীতে ডিম, আটার বিপরীতে চাল ইত্যাদি। সেখানে তৃতীয় কোনো মাধ্যম ছিল না। এরপর এক যুগ আসে যখন মানুষ স্বর্ণ-রৌপ্য ও মূল্যবান ধাতব পদার্থকে তৃতীয় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা ব্যবহার করছি কাগজি নোট ও মুদ্রা। এভাবে গড়ে উঠে গ্রহণযোগ্য বিনিময় মাধ্যম এবং অবসান ঘটে বার্টার ট্রেড পদ্ধতির।

২. মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা : বার্টার ট্রেডের একটি বড়ো সমস্যা হলো মূল্য নির্ধারণে অপারগতা। এ কারণে সে যুগের বাণিজ্য একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর আসে স্বর্ণ-রৌপ্যভিত্তিক বিনিময় ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় স্বর্ণ-রৌপ্যকে ওজনের মানদণ্ডে হিসাব করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা হতো। তবে প্রতিবারের লেনদেনে স্বর্ণ-রৌপ্য ওজন করা ছিল এক বিরক্তিকর বিষয়। তাই খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে লিডিয়ার রাজা আলিয়াত (Alyatte) প্রথমবারের মতো ধাতব কয়েন (Coin) তৈরি করেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ, রৌপ্য এবং আরও কিছু ধাতব পদার্থের সংমিশ্রণে তৈরি হতো সে মুদ্রা। বলা হয়, এ মুদ্রাই ছিল ইতিহাসে প্রথম জন্ম নেওয়া অর্থ (Money)। বর্তমানে আমরা বিনিময় মাধ্যম হিসেবে কাগজি নোট ব্যবহার করছি। এগুলো দিয়েও পণ্যের মূল্য সহজে নির্ধারণ করা সম্ভব।

৩. হিসাবের একক : হিসাবের একক দ্বারা পরিমাপককে বোঝানো হয়। যেমন : দূরত্ব পরিমাপের একক মিটার, কিলোমিটার, ইঞ্চি বা মাইল। ওজন পরিমাপের একক আউন্স, গ্রাম বা কিলোগ্রাম। পৃথিবীর সর্বত্র এই পরিমাপকগুলো সর্বজনীন স্বীকৃত। কিন্তু টাকা, ডলার, রুপির ক্ষেত্রে সর্বজনীন স্বীকৃত কোনো পরিমাপক নেই। যেমন : এক টাকা বা এক রুপি কখনো এক ডলারের সমান হতে পারে না। কারণ, এগুলোর মূল্য সর্বদা পরিবর্তনশীল। তবে স্বর্ণ-রৌপ্য পরিমাপে এ জাতীয় কোনো সমস্যা হয় না। কারণ, ১০০ গ্রাম স্বর্ণ বা রৌপ্যের ওজন পৃথিবীর সর্বত্রই সমান। ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও বিষয়টা এমন। যেমন : এক কেজি আটার ওজন পৃথিবীর সব স্থানে একই হবে। এ ক্ষেত্রে ভোগ্য পণ্যকেও অর্থের সংজ্ঞা নির্ধারণে বিবেচনা করা যেতে পারে।

৪. বিভাজনযোগ্য (খুচরা যোগ্যতা) : ১,০০০ টাকার একটি নোটকে ৫০০, ৩০০, ২৫০, ৫০ ইত্যাদি আকারে খুচরা করা সম্ভব। একইভাবে এক কেজি স্বর্ণ বা রৌপ্যকে ৫০০, ১০০, ৫০ বা ২০ গ্রামে বিভক্ত করা সম্ভব। ভোগ্যপণ্যের বেলাও ওজন দ্বারা বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা সম্ভব। বিভাজ যোগ্যতার বড়ো সুবিধা হলো—এর মাধ্যমে পণ্যের মূল্য সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব। এটি লেনদেন ও বিনিময় কাজে দারুণ গতিশীলতা নিয়ে আসে।

৫. মূল্যের স্থিতিশীলতা : এটি দ্বারা বোঝানো হয়, অর্থের ক্রয় ক্ষমতা সহজে পরিবর্তিত হবে না। উদাহরণস্বরূপ : আপনি ৪০ হাজার টাকা দিয়ে আজ যে পরিমাণ চাল ক্রয় করতে পারছেন, আগামী ১০ বছর পর সে পরিমাণ চাল আর ক্রয় করতে পারবেন না। কারণ, নিয়মিত মুদ্রাস্ফীতির দরুন বাজারের প্রতিটি মুদ্রা হারাচ্ছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা। আধুনিক অর্থব্যবস্থায় পৃথিবীর প্রতিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর এবং বিশেষ সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাজারে বড়ো পরিমাণে নতুন নোট ইস্যু করে থাকে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় Quantitative Easing (QE)। এটি বাজারে নতুন মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি করে চলমান মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও পণ্যমূল্য স্থিতিশীল বা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।

অপরদিকে, স্বর্ণ-রৌপ্য যেহেতু চাইলেই উৎপাদন করা যায় না, সেহেতু এ বাজারে স্বর্ণস্ফীতি বা রৌপ্যস্ফীতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তা ছাড়া বিভিন্ন খনি থেকে প্রতিবছর নতুন যে পরিমাণ স্বর্ণ ও রৌপ্য অর্থ বাজারে যুক্ত হয়, তার পরিমাণে এতটাই নগণ্য যে, তা বিশ্ব অর্থনীতিতে বড়ো রকমের কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। বলে রাখা উচিত বর্তমান বাজারে স্বণ-রৌপ্য মূল্যের প্রতিনিয়ত যে উঠানামা, এর মূল কারণ তাদের কাগজি নোটের বিপরীতে মূল্যায়িত করা হচ্ছে। যেহেতু কাগজি নোটগুলো প্রতিনিয়ত তাদের ক্রয় ক্ষমতা হারাচ্ছে, সেহেতু ভোগ্যপণ্যের ন্যায় স্বর্ণ-রৌপ্যের মূল্যও উঠানামা করছে।

পচনশীল বৈশিষ্ট্যের দরুন অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যকে দীর্ঘকাল সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। তবে কিছু পণ্য আছে যাদের তুলনামূলক বেশি দিন সংরক্ষণ করা সম্ভব। যেমন : লবণ, চিনি, মধু ইত্যাদি। এ কারণে রোমান ও গ্রিক সাম্রাজ্যের সামরিক বাহিনীতে প্রতি মাসের বেতনের সাথে কিছু পরিমাণ ভোগ্যপণ্যও প্রদান করা হতো, যা রেশন নামে পারিচিত; বিষয়টি আজও অনেক রাষ্ট্রে চলমান।

৬. স্থিতিশীল বিনিময় হার : বিনিময় হারের উঠানামা মুদ্রা বাজারের একটি নিয়মিত চিত্র। বিনিময় হারের এই উঠানামা কতটা হুমকিস্বরূপ, তা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় খুব ভালো করে জানে। ১৯৭১ সালে ব্রিটন উড্স চুক্তিনামা রহিত হলে বিনিময় হার নির্ধারণের স্থিতিশীল প্রক্রিয়া একেবারে ভেঙে পড়ে। কিন্তু স্বর্ণ-রৌপ্যভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় এমনটা ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। লিডিয়ার পর গ্রিক, রোমান, জেরুজালেমসহ আরও অনেক অঞ্চলে ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। সে সকল মুদ্রায় স্বর্ণ ও রৌপ্যের পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকত বলে তাদের বিনিময় নির্ধারণে কোনো জটিলতা হতো না। যেমন ধরুন, গ্রিকরা তাদের ধাতব মুদ্রায় ব্যবহার করছে ৫০% স্বর্ণ এবং রোমানরা সেখানে ব্যবহার করছে ৭৫% স্বর্ণ। এমতাবস্থায় ৩টি গ্রিক মুদ্রার সমান হবে ২টি রোমান মুদ্রা। বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ছিল বলে আজকের মতো অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা না থাকলেও সে যুগের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্বময় পরিব্যাপ্তি লাভ করেছিল।

৭. নিজস্ব উপযোগ : যেকোনো ভোগ্যপণ্যের প্রধান উপযোগ হলো ক্ষুধা মেটানোর ক্ষমতা। এমন নয় যে এই উপযোগিতা কৃত্রিম বা সরকারি অধ্যাদেশে তৈরি হয়েছে। কিন্তু কাগজি নোটভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় প্রতিটি মুদ্রার উপযোগ সরকারি অধ্যাদেশে তৈরি হয়। যতদিন এগুলো একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধীনে থাকবে, ততদিন কাগজি নোটগুলোর জীবন থাকবে।

মনে করুন, আপনার অ্যাকাউন্টে পাঁচ লাখ রুপি আছে। কিছুদিন পর চীন এসে ভারত দখল করল এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে রুপিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। যদি না নতুন সরকার পুরাতন রুপিগুলোকে নতুন ইস্যু করা মুদ্রার সাথে পালটে নেওয়ার সুযোগ দেয়, তবে সে রুপির আর কোনো মূল্য থাকবে না। যেমন : সাদ্দাম সরকার পতনের সেখানে নতুন দিনারের নোট প্রিন্ট করা শুরু হয়। ফলে পূর্বের বিপুল পরিমাণ ইরাকি দিনারের আর কোনো মূল্য ছিল না। সাধারণ মানুষ কিছু পরিমাণ পুরোনো নোট ব্যাংকে গিয়ে পালটে আনার সুযোগ পেলেও বড়ো একটি অংশ রাস্তায় ফেলে দেয়। আরেকটি উদাহরণ হলো—মোদি সরকার যখন ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট মাসখানেকের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে, তখন নোট দুটিও সাময়িক সময়ের জন্য তাদের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কেউ আধিপত্য বিস্তার করুক বা সরকারি অধ্যাদেশে যে পরিবর্তনই আসুক না কেন, স্বর্ণ-রৌপ্য এবং ভোগ্যপণ্যের উপযোগিতায় কোনো পরিবর্তন আসবে না।

৮. সহজ পরিবহনযোগ্যতা : কাগজি নোট বা স্বর্ণ-রৌপ্যকে আপনি চাইলে এক স্থান থেকে অন্যত্র বহন করতে পারেন। যেহেতু স্বর্ণ-রৌপ্য কাগজি নোটের চেয়ে অধিক মূল্য ধরে রাখতে পারে, সেহেতু স্বর্ণ-রৌপ্যই বেশি কার্যকর। তবে ইলেক্ট্রনিক কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে আজ অনেকেই কাগজি নোট পরিবহনের ঝামেলা কাটিয়ে উঠেছে। এ পদ্ধতি স্বর্ণ-রৌপ্যভিত্তিক অর্থব্যবস্থায়ও প্রয়োগ করা সম্ভব।

এই হলো আদর্শ অর্থের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। এখানে অর্থ হিসেবে তিনটি উপকরণকে বিবেচনায় আনা হয়েছ : স্বর্ণ-রৌপ্য, কাগজি নোট ও ভোগ্যপণ্য। লক্ষ করুন, এমন কোনো উপকরণটি আছে, যার মধ্যে আদর্শ অর্থের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান? অবশ্যই তা স্বর্ণ-রৌপ্য। ঠিক এ কারণে হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন সম্রাজ্যে এটিই ছিল একমাত্র গ্রহণযোগ্য বিনিময়ের মাধ্যম। আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সূচনালগ্নেও স্বর্ণ- রৌপ্যকে কাগজি নোট ছাপানোর মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের আধিপত্য বিস্তারের গল্প

মাত্র ১০০ বছর আগেও পৃথিবীর বৃহৎ অংশ জুড়ে ছিল স্বর্ণ-রৌপ্যভিত্তিক বিনিময় ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলন। যেমন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সম্রাজ্যের পতন হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা বিনিময় মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ব্যবহার করত। তা ছাড়া ১৮৮০-১৯১৪ এবং ১৯৪৬-১৯৭১ সাল পর্যন্ত ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশ স্বর্ণ- রৌপ্যকে বাণিজ্যিক কাজে অর্থের মূল্য নির্ধারণের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করত। অর্থাৎ প্রতিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পরিমাণ ধাতব মুদ্রা বা কাগজি নোট ছাপাক না কেন, তার বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য মজুত করত এবং তা দ্বারা আন্তর্জাতিক বিনিময় হার নির্ধারণ করত। যেমন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ব্রিটেন ও আমেরিকা যথাক্রমে প্রতি ৪.২৫ পাউন্ড এবং ২০.৬৭ ডলার ইস্যুর বিপরীতে মজুত রাখত ১ আউন্স পরিমাণ স্বর্ণ। ফলে ১ পাউন্ড সমপরিমাণ ছিল ৪.৮৬ ডলার। এই পুরো সময়টিকে বল হতো ক্লাসিকেল গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের (Classical Gold Standard) যুগ এ সময় মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল খুবই সামান্য

প্রকৃতির প্রতিটি গঠন উপাদানের যেমন নিজস্ব একটি চক্র রয়েছে, অর্থব্যবস্থাও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই চক্রের মূল নিয়ামক হলো স্বর্ণ-রৌপ্য। শুনে বিস্মিত হবেন, বতর্মান কাগজি নোটভিত্তিক অর্থব্যবস্থা তার জীবনের শেষ যুগে এসে পৌঁছেছে। খুব দ্রুত শুরু হতে যাচ্ছে ইলেক্ট্রনিক কারেন্সির যুগ। এই চক্র শেষ হলে পুনরায় ফিরে আসবে স্বর্ণ-রৌপ্যের যুগ

কিছু বিষয় ছোটোকাল থেকে আমাদের মনে গেঁথে আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের পক্ষে কাজ করে, তাই এটি সরকারি ব্যাংক। এই ব্যাংক নিজ ইচ্ছায় নোট ছাপাতে পারে না। এজন্য তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য মজুদ করতে হয় এবং বিশ্বব্যাংক থেকে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু আগের দুটি অধ্যায় উপস্থাপন করা হয়েছে, পৃথিবীতে বহু কেন্দ্রীয় ব্যাংক রয়েছে, যা ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে সরকার বা সাধারণ মানুষের অধিকার চর্চার কোনো সুযোগ নেই।

২৩ ডিসেম্বার ১৯১৩, প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মন্ত্রীসভা ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমকে (সংক্ষেপে ফেড) আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে অনুমোদন দেয়। সেইসঙ্গে ব্যাংকটিকে ডলার ছাপানো এবং আমেরিকার অর্থনীতি পরিচালনার একচ্ছত্র অধিকারও প্রদান করা হয়। কিছুদিন পর সরকারি অধ্যাদেশে ডলার ব্যতীত অন্য সব বিনিময়মাধ্যম নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু নতুন এই কারেন্সির ওপর আমেরিকার সাধারণ মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছিল না। কারণ, মাত্র কয়েক বছর আগে ট্রাস্ট কোম্পানি কেলেঙ্কারির দরুন হাজারো মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছিল। ফলে শুরু থেকেই সবাই ডলারকে এড়িয়ে চলতে লাগল এবং স্বর্ণ-রৌপ্যকে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে অধিক প্রাধান্য দিতে থাকল।

বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে ফেড ডলারের মূল্য ঘোষণা করে—১ আউন্স স্বর্ণ = ২০ ডলার। অর্থাৎ প্রতি ১ আউন্স স্বর্ণের বিপরীতে ফেড ২০ ডলার ইস্যু করবে। সাধারণ মানুষকে আহ্বান করা হয়, তারা যেন নিজেদের স্বর্ণগুলো ফেডের নিকট জমা রেখে সমপরিমাণ ডলার নিয়ে আসে।

ফেড মানুষকে বোঝায়, প্রতিটি ডলার হলো একেকটি চেক নোট। মানুষ যদি ২০ ডলারের প্রতিটি নোট পুনরায় ফেডকে জমা দেয়, তবে সে তার জমাকৃত সম্পদ ফেরত পাবে। JM 043829043-এ ধরনের যে সংখ্যাটি নোটগুলোর ওপর ছাপানো থাকে, তা দ্বারা বোঝায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই হিসাবটিতে ইস্যুকৃত নোটটির বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ (স্বর্ণ/রৌপ্য) মজুদ করা আছে। চেক নোট (ডলার) ফেরত আসা মাত্রই ব্যাংক গ্রাহককে সে পরিমাণ সম্পদ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। তা ছাড়া ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংক নোটের দরুন ইতঃপূর্বে আন্তঃপ্রাদেশিক লেনদেনগুলোতে যে জটিলতা তৈরি হতো, তা এখন ডলার ব্যবহারের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব হবে। কারণ, এখন থেকে পুরো দেশে একটিমাত্র কারেন্সি ব্যবহৃত হবে। কিন্তু ফেড তার কথা রাখেনি। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ডলারের বিপরীতে সাধারণ মানুষের যে সম্পদগুলো সে আত্মসাৎ করেছে, তা আর কখনো ফিরিয়ে দেয়নি।

ইতিহাসের অন্যতম এক গোপন আলোচনার মধ্য দিয়ে ফেড প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯১০ সালে জর্জিয়ার উপকূলবর্তী জ্যাকল দ্বীপে এই আলোচনার আয়োজন করা হয়। তবে সেই আলোচনার বিষয়বস্তু কী ছিল এবং উপস্থিত সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কী কী চুক্তি করেছিল, তার কোনো তথ্যই আজ পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ পায়নি। The Federal Reserve System: Its Origin and Growth বইয়ের লেখক Paul Warbug হলেন সেই গোপন সম্মেলনে উপস্থিত সদস্যদের একজন। তিনি বইটিতে উল্লেখ করেন—

‘আমাদের প্রত্যেক সদস্য এতটাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, আজ পর্যন্ত সে আলোচনার চুক্তিপত্রে লিপিবদ্ধ তথ্যও জনসম্মুখে প্রকাশ পায়নি।’ তবে ব্যাংকটির পরবর্তী কার্যক্রম দেখে সাধারণ মানুষ অনুমান করে নিয়েছে, গোপন আলোচনায় নির্ধারিত হয়েছে ব্যাংকটির শেয়ারহোল্ডারদের সংখ্যা, গঠনতন্ত্র ও লভ্যাংশ বণ্টন প্রক্রিয়া।

কী পরিমাণ স্বর্ণের মজুদ নিয়ে ফেড তার প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করে, সে তথ্য জানা সম্ভব না হলেও কিছু কাল্পনিক তথ্যকে পুঁজি করে এগোনো যাক। ধরে যাক, গোপন আলোচনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফেডের শেয়ারহোল্ডারগণ সে সময় ২ হাজার টন স্বর্ণ মজুত করল এবং এর বিপরীতে ১০ বিলিয়ন ডলার প্রিন্ট করল। এখন তা বাজারে সরবরাহ হওয়ার অপেক্ষায় আছে।

১৯১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রশাসনিক ও বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি খরচ মেটাতে প্রেসিডেন্ট উইলসন প্রশাসনের ১০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু তার রাজস্ব ভান্ডারে এত পরিমাণ অর্থ ছিল না। ফলে তিনি ফেডের নিকট এই পরিমাণ ডলারের জন্য আবেদন করলেন। ফেড ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক হওয়ায় প্রেসিডেন্ট প্রশাসনকে ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবে প্রদান করল।

ধরুন, তারা প্রেসিডেন্ট প্রশাসনকে ২% সুদে ১০ বছর মেয়াদে ১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিলো। তাহলে ১০ বছর পর সুদে-আসলে কী পরিমাণ ডলার পরিশোধ করতে হবে? কম করে হলেও ১২ বিলিয়ন ডলার! সমস্যা হলো তিনি এত ডলার পাবেন কোথায়? বাজারে তো মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলারের অস্তিত্ব আছে। সুদের দরুন যে অতিরিক্ত দায়ের জন্ম হয়েছে, তার বাহ্যিক অস্তিত্ব নেই। তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট সাহেবের নিজেরও কোনো প্রিন্টার নেই। সুতরাং, তিনি সর্বোচ্চ ১০ বিলিয়ন ডলারই পরিশোধ করতে পারবেন। বাকিগুলো পরিশোধ করতে পারবেন না। কারণ, পকেটে ৫০ ডলার থাকলে ৫১ ডলার সমমূল্যের পণ্য ক্রয় করা সম্ভব নয়।

সুদের কাছে এখানে সবাই আটকে যায়। কারণ, সুদ থেকে যে অদৃশ্য দায়ের জন্ম হয়, তা সামষ্টিক উপায়ে কখনো পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এরপর শুরু হলো যুদ্ধ। প্রেসিডেন্ট সাহেবের খরচ বেড়ে গেল কয়েকগুণ। তিনি আবারও ঋণ নিলেন এবং নিতেই থাকলেন। একই সঙ্গে আমেরিকায় আরও অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক গড়ে উঠল। তারাও ফেড থেকে ঋণ নিয়ে তহবিল তৈরি করল। তাদের কাছ থেকে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ঋণ নিল। চারদিক ঋণে ঋণে সয়লাব হয়ে উঠল। প্রতিটি ঋণের ওপর সুদ চেপে বসল। এই সুদ থেকে তৈরি হলো জাতীয় দায়, যার পরিমাণ দিনে দিনে বাড়তেই থাকল। আদৌ কি এই জাতীয় দায় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব?

ফেডের দিকে তাকানো যাক। ১৯১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বার ফেডের নিকট ২ হাজার টন স্বর্ণ ছিল। এর বিপরীতে জানুয়ারি মাসে তারা ১০ বিলিয়ন ডলার প্রিন্ট করে প্রেসিডেন্ট সাহেবকে ঋণ দেয়। প্রথম ঋণের পর প্রেসিডেন্ট সাহেব যখন পুনরায় ঋণের আবেদন করলেন, তখন ফেডের সিন্দুক ফাঁকা! অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তারা আবারও ডলার প্রিন্ট করল এবং তা প্রেসিডেন্ট সাহেবের নিকট পৌঁছে দিলো। এই যে দ্বিতীয়বার ডলার প্রিন্ট করল, তার বিপরীতে কি সমপরিমাণ স্বর্ণ মজুত করেছে? তা ছাড়া প্রতিটি ঋণের ওপর যে সুদ চাপিয়ে দিচ্ছে, তারও বিপরীতে কি স্বর্ণ মজুত করছে?

আবার লক্ষ করুন, সাধারণ মানুষ সরকারের হুকুম মানতে নিজেদের স্বর্ণগুলো ফেডের নিকট জমা দিচ্ছে, আর ফেড প্রিন্টিং মেশিনে ডলার ছাপিয়ে তা সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে। তারা ডলার তৈরি করছে বাতাস থেকে, আবার তার ওপর সুদ চাপিয়ে ঋণ দিচ্ছে! যখন কেউ সুদ-সমেত ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না, তখন তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কেড়ে নিচ্ছে। এভাবে বিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেয় আধুনিক মহাজন বৃত্তি।

১৯৩৩ সালে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় ঘোষণা জারি করে, সবাই যেন এ বছরের মধ্যে তাদের সকল স্বর্ণ ফেডের নিকট জমা রেখে সমপরিমাণ ডলার সংগ্রহ করে; নতুবা তাদের সম্পদ জব্দ করা হবে। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষ ফেডের কাছে স্বর্ণ জমা রাখতে বাধ্য হয় এবং এর বিনিময়ে সমপরিমাণ ডলার নিয়ে আসে।

৩১ জানুয়ারি, ১৯৩৪, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছ হতে নতুন ঘোষণা আসে। এখন থেকে ১ আউন্স স্বর্ণ সমান ৩৫ ডলার। অর্থাৎ ডলারের মূল্য রাতারাতি ৪০% হ্রাস পেল! কেনই-বা এমনটা হলো! ১৯১৩ সালের পর থেকে ফেড নতুন স্বর্ণ মজুত না করে প্রচুর নোট ইস্যু করেছে। এই মূল্যহীন নোটগুলোকে বলা হয় ‘Fiat Money’। তাই নতুন ইস্যুকৃত নোটের সাথে রিজার্ভে থাকা স্বর্ণগুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে ডলারের মূল্য হ্রাস করা হয়েছে এবং স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঠিক এ কারণে মুদ্রাস্ফীতি বাজারের একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন অর্থের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং বাজারে এর সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, তখনই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। এর নেতিবাচক প্রভাবগুলোর সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। যেমন : দ্রব্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া, জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়া, সঞ্চয় হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নিয়মিত নতুন নতুন নোট ইস্যু করা এবং বাজারে এর সরবরাহ বৃদ্ধি করা মুদ্রাস্ফীতির প্রধানতম কারণ।

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত। যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র ছয় মাস আগে আয়োজন করা হয় Bretton Woods সম্মেলন। বলার অপেক্ষা রাখে না ইহুদিরা ছিল এই সম্মেলনের মধ্যমণি। এতদিন পর্যন্ত ডলার ছিল কেবল আমেরিকার কারেন্সি। এই সম্মেলনে তারা প্রস্তাব করে, ডলার হবে পুরো পৃথিবীর একমাত্র বিনিময়যোগ্য কারেন্সি। বেশিরভাগ রাষ্ট্র এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। সবার এক কথা : ফেড তো চাইলেই ইচ্ছেমতো ডলার প্রিন্ট করতে পারে, সেখানে মনিটরিং-এর কোনো সুযোগ নেই।

বিতর্ক চলতে থাকল। ইহুদি প্রতিনিধিরা বলল—প্রতিটি দেশের পৃথক পৃথক কারেন্সি থাকার দরুন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্থবির হয়ে আছে। সবাই যদি একই কারেন্সি ব্যবহারে সম্মত হয়, তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গতিশীল হয়ে উঠবে। তা ছাড়া যুদ্ধের আঘাত পুরো ইউরোপকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এমতাবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে যে সম্পদ প্ৰয়োজন, তা তাদের নেই।

হিটলারের সাবমেরিনের আঘাতে ইউরোপীয় অনেক স্বর্ণবাহী জাহাজ মেডিটেরিয়ান ও আটলান্টিকে হারিয়ে গেছে। সবাই এখন অর্থ সংকটে। এমতাবস্থায় ডলার হতে পারে সকল সমস্যার সমাধান। ফেড ডলার প্রিন্ট করে ঠিক, তবে নতুন কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরি করা হবে, যেখানে সকল দেশের অংশ গ্রহণের সুযোগ থাকবে। স্বর্ণের বিপরীতে ডলারের মান হবে ১ আউন্স স্বর্ণ = ৩৫ ডলার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অধিকাংশ রাষ্ট্র এই প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হয়।

আলোচনায় বলা হয়, যেহেতু এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্রগুলোর নিকট প্রয়োজনীয় পরিমাণ ডলার নেই, তাই উচিত হবে রাষ্ট্রীয় রিজার্ভে থাকা নিজেদের স্বর্ণগুলো ফেডের নিকট জমা রেখে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার নিয়ে যাওয়া। আর যাদের স্বর্ণ নেই, তারা বন্ড জমা রেখে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ নিতে পারবে। প্রতিটি রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ লেনদেনে নিজস্ব কারেন্সি ব্যবহার করতে পারবে। তবে অবশ্যই স্বর্ণ-রৌপ্য বা ডলারে পরিমাপযোগ্য মূল্য থাকতে হবে। অর্থাৎ কোন দেশ চাইলে স্বর্ণ-রৌপ্যের পরিবর্তে ডলারকে রিজার্ভ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। প্রতিটি দেশের বিনিময় হার নিরূপণ ও মনিটরিং-এর দায়িত্বে থাকবে আই.এম.এফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক।

যদি কোনো দেশ ডলারগুলো ফেডের নিকট ফিরিয়ে দেয়, তবে প্রতি ৩৫ ডলার অনুপাতে সমপরিমাণ স্বর্ণ ফেরত দেওয়া হবে। এরপর থেকে অনেক রাষ্ট্র তাদের রিজার্ভে থাকা স্বর্ণগুলোর একটি নির্দিষ্ট অংশ ফেডের নিকট জমা রেখে ডলার নিতে শুরু করে। Tinmothy Green রচিত Central Bank Gold Reserves An Historical Perspective Since 1945 অনুযায়ী—ব্রেটন উডস সম্মেলনের পর ১৯৪৫ সালে ফেডের রিজার্ভে থাকা স্বর্ণের পরিমাণ ছিল ১৭৮৪৮ মেট্রিক টন। ১৯৫০ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২০২৭৯ মেট্রিক টন। কিন্তু আমেরিকানদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা এই যে শুরু হলো, আর থামল না।

এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় নিমজ্জিত থাকার দরুন তাদের ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। নতুন নতুন অস্ত্র নির্মাণ, সৈনিকদের বেতন প্রদান, বিভিন্ন রসদ আমদানি ইত্যাদি নানা কাজেও তাদের প্রচুর ডলার অন্যান্য দেশগুলোতে চলে যেতে শুরু করে। ফলে সে সকল ডলারের বিপরীতে যখন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো স্বর্ণ দাবি করে বসছিল, তখন আমেরিকা হারাতে শুরু করে তাদের স্বর্ণের মজুদ। কারণ, নতুন ডলার প্রিন্ট করলেও ১ আউন্স স্বর্ণ = ৩৫ ডলার হারে তখনও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

৬০’র দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পরা আমেরিকার জন্য ছিল অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বড়ো কারণ। তারা ভাবতেও পারেনি, এই যুদ্ধ এতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে। তাদের ঘাটতি বাজেট বাড়তে শুরু করলে নতুন ডলার প্রিন্ট প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। ১৯৬৩ সালে জন এফ কেনেডি নিহত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পদে আসেন লিন্ডন বি. জনসন। তিনি স্বর্ণের বিপরীতে ডলারকে পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

কিন্তু ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো তাদের বিরুদ্ধে বৈরী আচরণ শুরু করে দেয় কি না, তা নিয়ে তার মনে ছিল যথেষ্ট সংশয়। তাই তিনি কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালাতে শুরু করেন, যেন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো আপাতত তাদের নিকট স্বর্ণ দাবি না করে।

১৯৬৮ সালের দিকে তাদের রিজার্ভে স্বর্ণের পরিমাণ ৯৬৭৯ মেট্রিকটনে নেমে আসে। এমতাবস্থায় ডলার পুনর্মূল্যায়ন না করলে বাকি স্বর্ণগুলো আটকে রাখা যাবে না। ১৯৭১ সালে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন রিচার্ড নিক্সন। ততদিনে তাদের রিজার্ভে স্বর্ণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৯০৭০ মেট্রিক টন। ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের অব্যাহত স্বর্ণের দাবিকে কূটকৌশলের মাধ্যমে কয়েক বছর দমিয়ে রাখলেও এ বছর আর সম্ভব হচ্ছিল না। বিশেষ করে ফ্রান্সে চাপ ছিল অন্য সবার চেয়ে বেশি।

ফলে ১৫ আগস্ট, ১৯৭১, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ব্রেটন উডস অঙ্গি কারনামা রহিত করেন। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ পরিশোধের প্রক্রিয়া রহিত করেন। এরপর কয়েক দফা ডলারকে পুনর্মূল্যায়িত করা হয়, ১ আউন্স স্বর্ণ = ৩৮/৪০/৪২। কিন্তু ডলারের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা পুনস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৩ সালে চূড়ান্তভাবে ব্রেটন উডস অঙ্গীকারনামাকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। এরপর হতে স্বর্ণের বিপরীতে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এখন যে প্রক্রিয়ায় বিনিময় হার নির্ধারিত । হয়, তা হলো—Floating Exchange Rate System।

পেট্রোডলার

William Clark-Petrodollar Warfare: Oil, Iraq and the Future of the Dollar বইটি হতে :

ফেড বুঝতে পারে, আন্তর্জাতিক মহল ডলারের ওপর পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তারা যদি নতুন কোনো অর্থব্যবস্থার ফন্দি করে, তবে তা ডলারের শেষকৃত্যের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকা জ্বালানি তেলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, যার জন্য ডলার আজও টিকে আছে।

৭০ দশকের প্রথম থেকে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। আমেরিকা সৈন্যবাহিনী নিয়ে আরব দেশের তেলক্ষেত্রগুলো একে একে দখল করতে শুরু করে। যাদের সাথে সমঝোতা হয়েছে, তাদের সাথে যুদ্ধ হয়নি। আর যারা বেঁকে বসেছে, তাদের ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ১৯৬৭ সালের পর হতে ঘটে যাওয়া আরব- ইজরাইল যুদ্ধগুলোতে আমেরিকা ইজরাইলিদের পক্ষ নেওয়ায় আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে মার্কিনিদের সম্পর্ক তিক্ততায় পৌঁছে। এরই রেশ ধরে ১৯৭৩ সালে ওপেকভুক্ত ১২টি রাষ্ট্র আমেরিকার ওপর তেল অবরোধ জারি করে, যা সে বছরের (৭৩) অক্টোবর হতে শুরু করে পরবর্তী বছরের (৭৪) মার্চ মাস পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। মাত্র ছয় মাসে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের মূল্য $২৫.৯৭ থেকে বেড়ে $৪৬.৬৩-এ গিয়ে পৌঁছায়।

মার্কিন প্রশাসন এ পর্যায়ে মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক চাল চালতে শুরু করে। পারিবারিক দ্বন্দ্বে বাদশাহ ফয়সাল নিহত হলে মার্কিনিদের জন্য পথ আরও সহজ হয়ে যায়। তখন সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইজরাইলের জুজু কাজ করছিল। ইজরাইল তার আশেপাশের ভূখণ্ডগুলোতে যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ চালাতে পারে—এমন একটি আতঙ্ক তাদের মধ্যে কাজ করছিল। ১৯৭৫-৭৬ সালে সৌদি-আমেরিকা অস্ত্রচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মূল বিষয় ছিল, সৌদি রাজপরিবার রক্ষায় আমেরিকা তাদের সামরিক নিরাপত্তা প্রদান করবে। বিনিময়ে সৌদি আরব তাদের নিকট তেল রপ্তানি করবে। এই তেল পরিশোধন করে আমেরিকা বিশ্ব বাজারে বিক্রি করবে।

ধীরে ধীরে অন্যান্য আরব দেশগুলোও আমেরিকার সাথে বিভিন্ন চুক্তি করে। একপক্ষ দেবে অস্ত্র ও সামরিক নিরাপত্তা, অপরপক্ষ দেবে তেল। এবার ইউরোপীয় বা অন্য কোনো দেশ যদি পরিশোধিত তেল ক্রয় করতে চায়, তবে তা ডলার দিয়েই ক্রয় করতে হবে। অন্য কোনো কারেন্সির বিনিময়ে আমেরিকা তা বিক্রি করবে না। বাধ্য হয়ে প্রতিটি রাষ্ট্র এই নীতি মেনে নেয়। তখন থেকে আমেরিকান ডলারের ভিত্তিমূল্যে স্বর্ণের পরিবর্তে তেল স্থলাভিষিক্ত হয়। এ কারণে ডলারের অপর নাম আজ পেট্রোডলার।

৭০-এর দশকে আমেরিকা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে শুরু করে, যাতে করে পেট্রোডলারের যুগ শেষ হয়ে গেলেও বিনিয়োগকৃত অর্থের বদৌলতে ডলারকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ব্যবহার করে চীনের অভ্যন্তরে বিনিয়োগের অনুমতি পাওয়া আমেরিকার জন্য ছিল বড়ো অর্জন।

আমেরিকার সাথে রাজনৈতিক দ্বৈরথের দরুন ২০০০ সালে সাদ্দাম হোসেন ডলার বর্জনের ঘোষণা দেন। তিনি পুনরায় স্বর্ণভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কথা ব্যক্ত করেন। অর্থাৎ আমেরিকাকে এখন থেকে ডলার নয়; স্বর্ণ দিয়ে তেল কিনে নিতে হবে। এ কারণে আমেরিকান প্রশাসন ২০০১ সালে অর্থনৈতিক হোঁচট খায়। এরপর কী হলো! ডলারকে বাঁচাতে আমেরিকা পুরো ইরাক দখল করে নেয়; একই সঙ্গে তেলক্ষেত্রগুলোও। একই ভাগ্য বরণ করতে হয় সিরিয়া ও লিবিয়াকে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য ভূ-রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *