আমি সিরাজের বেগম – ৭

যুদ্ধে শওকজঙের নবাব হওয়ার সাধ ঘুচল। মিরজাফরের অপূর্ব রণকৌশলে তার সৈন্য দাঁড়াতে পারেনি শুনলাম। তার পক্ষে শুধু অপূর্ব বীরত্ব দেখিয়েছে কোন এক শ্যামসুন্দর, কেউ চেনে না তাকে। সে নাকি জীবনে প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিল। কিন্তু অনেক অভিজ্ঞ সৈন্য আর সেনাপতি অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছে তার যুদ্ধ। মিরজাফরও দেখেছে। হয়তো পানাসক্ত আর ভীরু প্রভুর নির্বিকার আচরণ তার মনে প্রেরণা যুগিয়েছিল। নইলে এমন নাকি কখনও হতে পারে না। তবে তার বীরত্ব নিষ্ফল হল। প্রভুকে বাঁচাতে পারল না, নিজেও বাঁচল না।

শ্যামসুন্দরের কথা শুনে মোহনলালের কথা মনে হল। শ্যামসুন্দর যুদ্ধ জানত না, কিন্তু মোহনলাল যুদ্ধে পারদর্শী। সিরাজের দুর্দিন যদি তেমন আসে, তাহলে মোহনলালও এমনিভাবে লড়বে। সে থাকায় বুকে অনেক বল পাই। ফৈজী হত্যায় তাই আমি অতটা বিচলিত হয়েছিলাম। কিন্তু ভুল ভেঙেছে আমার। আদর্শকে অনুসরণ করার বেলায় এই যুবক বজ্রকঠিন। ফৈজী হত্যায় এটুকু প্রমাণিত হয়েছে যে, শত-সহস্র আঘাতেও আদর্শচ্যুত হবে না এই বীরপুরুষ।.

ঘসেটি এসে বলে, ‘রাজবল্লভ আর জগৎশেঠের মুখ ভার হয়েছে নিশ্চয়ই?’

‘কেন?’

‘এতবড় একটা সুযোগ নষ্ট হল।’

‘কীসের সুযোগ?’

শওকতকে নবাব করার।’

তারা এর পেছনে ছিল নাকি?’

‘হয়তো ছিল না। তবু শওকৎ নবাব হলে তাদের কপাল খুলত। নিজেদের ইচ্ছেমতো নবাবকে চালাতে পারত। সিরাজ বড় শক্ত ঠাঁই। তাকে বাগে আনা অসম্ভব। আমিই পারলাম না। সিরাজ হাতছাড়া হওয়াতেই তো ওদের এত রাগ।

‘ও!’ আপন মনে ভাবি ঘসেটির কথা। তার চরিত্রের বোধহয় এতদিনে সত্যিই পরিবর্তন হয়েছে। নইলে এমনভাবে বলতে পারত না সে।

‘জাফরানগঞ্জের খবর জান?’ ঘসেটি হঠাৎ বলে।

‘না তো।’

‘সে কী! বাংলার বেগম হয়ে আসল খবরটা রাখো না, বেগমাসায়েবা। সেখানে এখন যে জোর মজলিস চলেছে।

‘কীসের মজলিস?’

‘মিরজাফর যুদ্ধ থেকে ফিরে খুব তৎপর হয়ে উঠেছে। রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ এখন ওখানে দু’বেলাই যাতায়াত করছে।’

‘কারণ?’

ঘসেটির মুখে বিচিত্র হাসি খেলে যায়, ‘তাও কি বলে দিতে হবে? দেশের ভবিষ্যৎ নির্ণয় করতে ব্যস্ত ওরা।’

‘ষড়যন্ত্র করছে?’

‘সাদা কথায় অর্থ তাই দাঁড়ায় বটে।’

‘নবাব জানেন?’

‘সিরাজ জানে না এমন কিছুই নেই। কিন্তু এখানে সে অনেকটা অসহায়।‘

‘তবে কী হবে?’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘসেটির সামনে উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেলি।

‘অমন ব্যাকুল হয়ে আমাকে প্রশ্ন করা কি তোমার মানায়, বেগমসায়েবা? সিরাজকে বলো, আমি তো তোমাদের শত্রুপক্ষ। এতদিন তোমাদের বিরুদ্ধে ছিলাম বলেই না এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে আমাকে।’

‘নিজের লোকের কাছে থাকা বন্দিত্ব নয়, ঘসেটি বেগম।

‘তাই নাকি? তাহলে হীরাঝিলের জারিয়াদের মতো নিজের ইচ্ছেমতো বাইরে যাবার স্বাধীনতা আমার আছে?’

‘সেটা নবাবকেই জিজ্ঞেস করবেন।’

‘সে কী বলবে আমি জানি। বলবে, দেশের স্বার্থের খাতিরে খানিকটা বন্দিত্ব স্বীকার করতেই হবে।’

‘মিথ্যে বলবে না তাহলে।’

‘তা ঠিক। নিজেকে আমিও বিশ্বাস করি না। বিশেষ করে রাজবল্লভের সামনে দাঁড়িয়ে বিবেক ঠিক রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ‘

এমন স্পষ্ট আর উলঙ্গ স্বীকৃতি আমি কল্পনাও করিনি। ঘসেটি বেগম বলেই এ সম্ভব। পুরুষালী নারী!

.

ঘসেটি চলে যায়। তার অপস্রিয়মাণ দেহখানার দিকে চেয়ে থাকি। রাজবল্লভ আর নজরালির দোষ কী? অমন সুন্দর চলার ভঙ্গি বেগম মহলে কয়জনের রয়েছে? ফৈজী সুন্দরী ছিল, কিন্তু এমন লীলায়িত ছন্দ তার ছিল না। ঘসেটির যৌবন ওই দেহখানাকে ছেড়ে যেতে চায় না। তাই যতদিন পারে আঁকড়ে ধরে বসে রয়েছে। হয়তো তার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সে অমনিই থাকবে—চিরযৌবনা নারী।

ঘসেটির কথায় আমার মন আশঙ্কায় ভরে ওঠে। শওকৎ-এর মৃত্যুতে ভেবেছিলাম বুঝি চিরকালের মতো নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, কিন্তু তা নয়। হয়তো কোনো নবাবই কখনও মসনদ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না। সব বেগমই চিরকাল এমনিভাবেই দুর্ভাবনা আর দুশ্চিন্তায় দিন কাটায়। না, সব বেগম নয়। শুনেছি, নতুন নবাব অনেক ক্ষেত্রে মসনদের সঙ্গে সঙ্গে পুরানো নবাবের বেগমদেরও পায়। নারীও তো আসবাব, মন বলে কিছু নেই। তাই কিছুতেই তাদের ভাবনা নেই। নবাব পরিবর্তনে কিছু এসে যায় না, হারেমে থাকতে পারলেই তারা তুষ্ট।

মেয়েটা কাঁদছে। হামিদা নিয়ে গিয়েছে। কাঁদুক, যত পারে কাঁদুক। বড় হলে কান্নার ঝুলি নিঃশেষিত হয়ে কেবল হাসিটুকুই থাকবে। ওকে আমি ইচ্ছে করে কাঁদাই। সব সময় হাসে বলে বড় ভয় হয়। এখনই এত হাসি কিসের? জীবনের কিছুই শুরু হয়নি।

মেয়েটা ছেলে না হয়ে ভালোই হয়েছে। ছেলে হলে নিশ্চয়ই নবাব হত। আর নবাব হলে সারা জীবন অশান্তি। সিরাজের মতো অল্প বয়সেই চিন্তার রেখা পড়ত তারও কপালে। নবাব আলিবর্দির তো সবে সেদিন মৃত্যু হল—এক বছর হয়েছে মাত্র। এর মধ্যেই সিরাজের কপালে কুঞ্চন দেখা দিয়েছে। কিশোরের কপালে সেই মসৃণতা আর নেই।

.

সোফিয়া এসে প্রবেশ করে। সেদিন তাকে ভর্ৎসনা করেছিলাম। তার পরে আর আসেনি। ওকে দেখলে আজকাল আমি বিরক্ত হই—বিরক্ত হই মহম্মদের স্ত্রী বলে। নইলে এককালে সব জারিয়াদের মধ্যে শুধু ওর ওপরই আমার মায়া ছিল। কিন্তু মহম্মদের সঙ্গে থেকে ওর চরিত্রেরও পরিবর্তন হয়েছে। সেদিনের কথাবার্তায় সেটা বেশি প্রকট হয়ে উঠেছিল। আজ আরও রাগ হল ওকে দেখে। কারণ মহম্মদের সর্বশেষ কার্যকলাপের বিবরণ হামিদার মুখে শুনলাম সেদিন।

জাফরাগঞ্জে সে নাকি বড় বেশি যাতায়াত করে আজকাল। মিরজাফরের পুত্র মিরনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছে সে। অনুগৃহীত মহম্মদের পক্ষে এটা কম সৌভাগ্যের কথা নয়। আমারই চেষ্টায় সিরাজ তার খোশামোদের জাল থেকে যেদিন মুক্ত হল, তারপরই মহম্মদ ওদিকে ঢলেছে। তার মনে বড় হবার জ্বালা। কিন্তু বড় হতে হলে যে বীরত্ব, সাহস আর বুদ্ধির প্রয়োজন, সে সবের কিছুই নেই মহম্মদের মধ্যে। তাই সহজ পথ বেছে নিয়েছে—কুটিল পথ। খোশামোদে সব হয়, যদি বিবেককে বর্জন করা যায়। মহম্মদের বিবেকের বালাই নেই।

সোফিয়া কুর্নিশ করে দাঁড়ায়।

জাফরাগঞ্জের কোনো নতুন খবর আছে নাকি, সোফিয়া? দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করি। ঘসেটির কাছ থেকে খবরটা পাওয়ার পর ভেতরে ভেতরে জ্বলছিলাম।

‘সে কী বেগমসায়েবা? জাফরাগঞ্জের খবর আমি কি করে পাব?’

‘মহম্মদ তো সেখানে রোজই যায়।’

‘হ্যাঁ যায়।’ একটু সামলে নেয় যেন সে।

‘মিরবক্‌সিকুল যুদ্ধে জিতে ফিরেছেন। উৎসব হচ্ছে না?’

‘মিরবক্‌সিকুল নবাবেরই অধীন। তিনি জিতলে নবাবের জয়। উৎসব হীরাঝিলেই তো হওয়া উচিত।’

সোফিয়া আগের চেয়ে অনেক চতুর হয়েছে। মহম্মদ তাকে ভালোভাবেই শিক্ষা দিয়েছে সর্পিল পথে। প্রচণ্ড রাগে আমার মাথা গরম হয়ে ওঠে। সোফিয়ার কথায় কোনো রকম অমর্যাদা প্রকাশ না পেলেও খোঁচা ছিল।

‘আচ্ছা, তুমি এখন যাও সোফিয়া, আমি ব্যস্ত আছি।’

সোফিয়া নড়ে না।

‘দাঁড়িয়ে আছ কেন?’

‘বেগমসায়েবা কি আমাকে একটা অনুমতি দেবেন?’

‘কীসের অনুমতি?’

‘কতদিন ঘসেটি বেগমকে দেখিনি, একবার দেখতে ইচ্ছে হয়। তিনি তো এখানেই রয়েছেন।’

সোফিয়ার হীরাঝিলে আগমনের উদ্দেশ্য এতক্ষণে আমার কাছে স্পষ্ট হয়। সে আমাকে নিতান্ত অজ্ঞ ভেবেই কথাটা বলেছে। নইলে ঘসেটির নাম সোজাসুজি উচ্চারণ করতে সাহস পেত না। বুঝলাম, হীরাঝিলের সঙ্গে জাফরাগঞ্জের একটা নতুন যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা চলছে। ওদিকে রাজবল্লভ রয়েছে, এদিকে ঘসেটি। কিন্তু রাজবল্লভ জানে না যে, ঘসেটির তার প্রতি দুর্বলতা না কমলেও সে আর আগের ঘসেটি নেই।

হাসি পায়। অজ্ঞতার মুখোশ পড়ে বলি, ‘কিন্তু তাকে দেখলে তোমরা কাঁপতে এককালে। এখন দেখা করতে চাও কোন সাহসে?’

সোফিয়া বিগলিত হয়ে বলে, ‘যখন কাঁপতাম তখন নবাব আলিবর্দি জীবিত ছিলেন। তাঁর কন্যার প্রতাপের মূল্য ছিল।’

‘এখন নেই?’

‘থাকলেও বাংলার বেগম স্বয়ং অনুমতি দিলে ভয় কী?’

‘কেন দেখা করতে চাও?’

‘এককালে তাঁর কত সেবা করেছি, তাই দেখতে ইচ্ছে হয়।’

‘তাকে দেখতে হলে কি অনুমতির প্রয়োজন?

‘বেগমসায়েবা কি তা জানেন না?’

‘না, নতুন শুনলাম। ‘

‘নবাব বাইরের কারও সঙ্গে ঘসেটি বেগমের সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করেছেন।’

‘কবে থেকে নবাবের এই হুকুম বহাল হয়েছে?’

‘শওকত্জঙ নিহত হবার পর।’

তীক্ষ্ণবুদ্ধি সিরাজের। ঘসেটি ঠিকই বলেছে, কোনো কিছুই সিরাজের অজানা নেই। সে সব জানে, সব বোঝে, অথচ মুখে কিছুই বলে না। এমন সংযম সত্যিই অসাধারণ। সিরাজের কপালের কুঞ্চিত রেখার কারণ এবার খুঁজে পাই। প্রতি পদে যদি এতখানি ভেবে কাজ করা: হয়, তাহলে এমন হবেই। নবাব আলিবর্দির বেগমেরও তাই অমন হয়েছিল।

নিজের মসৃণ কপালের ওপর একবার হাত বুলিয়ে নিই। মনে মনে দুঃখ হয় সিরাজের জন্য। আমি কিছুই ভাবি না। তার দুশ্চিন্তায় অংশ গ্রহণ করে তাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করার ক্ষমতাও আমার নেই। সব বোঝা তারই ঘাড়ে।

সোফিয়াকে বলি, তুমি নবাবের আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করতে বলো আমাকে?’

‘সে কী বেগমসায়েবা! তা কি বলতে পারি? আপনিও যা, নবাবও তাই। আপনার আদেশে নবাবের আদেশের কড়াকড়ি কিছুটা কমাতে পারেন। বাংলার বেগমের ক্ষমতা নিশ্চয়ই রয়েছে।

‘শোনো সোফিয়া, ঘসেটির সঙ্গে তোমার দেখা হবে না। নবাবের আদেশ থাকলেও আমি তোমাকে দেখা করতে দিতাম না। তুমি এখনই হীরাঝিল ছেড়ে চলে যাও। আর কখনও আসবে না এখানে।’ বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে, কোনো কিছু প্রকাশ না করে, আমি সোফিয়াকে দরজা দেখিয়ে দিই।

সে আমাকে দায়সারা কুর্নিশ করে দুপদাপ পা ফেলে চলে যায়। তার উদ্ধত গতি দেখে মনে হয়, কোনো খোজা ডেকে গর্দান নিতে হুকুম দিই। জানি, সোফিয়াকে ফিরিয়ে দিয়ে যে তরঙ্গ তুললাম, তার গতি অনেকদূর পৌঁছবে।

.

সৈন্যসামন্ত নিয়ে সিরাজ নিজেই কাশিমবাজারের দিকে রওনা হল। খুব গুরুতর কিছু না হলে সে নিজে যুদ্ধে যায় না। কারণ সে মুর্শিদাবাদে না থাকলে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে আজকাল। ইংরেজরা একটু বাড়াবাড়ি শুরু করেছে একথা সত্যি। কিন্তু নবাবের এতটা বিচলিত হবার কারণ কী?

রওনা হবার আগে বলেছিলাম, ‘এবারেও মিরবক্‌সিকুলকে পাঠিয়ে পেছনে মোহনলালকে রাখলে হত না?’

‘না।’

ইংরেজরা শওকৎ-এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী নয়।’

তা ঠিক। কিন্তু তাদের কৌশল সম্বন্ধে তুমিই তো একদিন বলেছিলে।’

মিরবক্‌সিকুলের বিরাট সৈন্যের কাছে কাশিমবাজারের কয়েকজন মাত্র ইংরেজ কী করতে পারে?’

‘একটু ভাবো বুঝতে পারবে।’

‘আমি আর ভাবতে পারি না। তুমি মুর্শিদাবাদ ছাড়লে আমার ভয় করে।’

‘ভয় আমারই কি কম? যতবার মুর্শিদাবাদ ছাড়ি ততবারই মনে হয়, এসে দেখব মসনদে অন্য কেউ বসেছে।’

‘তবে যাচ্ছ কেন?

ইংরেজরা নিজে যে নবাব হবে না।’

‘বুঝলাম না।’

‘আবার একটু ভাবো।’

‘আমি সত্যিই আর কিছু ভাবতে পারি না, নবাব।’

সিরাজ আমার মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে বলে, ‘এটুকু বুঝলে না বেগমসায়েবা? শওক‍ নিজে নবাব হতে আসছিল। মিরজাফর তা হতে দেবে কেন? তার নিজেরই যে সেই সাধ। কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে পাঠালে সে ইংরেজদের হাত করে নেবে।

‘এখন তাহলে ওদের আক্রমণ কোরো না। ওরা তো যুদ্ধ করছে না।’

‘তার চেয়েও বেশি করেছে। ওরা আমাকে অপমান করেছে। নবাবি আইন-কানুন মানছে না একটুও।’ রাগে সিরাজের মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে।

‘তবু…’

সিরাজ আমার মুখ চেপে ধরে বলে, ‘আর কিছু বোলো না, লুৎফা। তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, তোমার অমতে কিছু করব না। এ ব্যাপারে আর কিছু বললে নবাবি করা যাবে না।’

‘কিন্তু তোমার অনুপস্থিতিতে এরা যদি মাথা তুলে দাঁড়ায়?’

‘এদের দাবিয়ে রাখার মতো বুদ্ধি তোমার রয়েছে, সে ভার তোমাকে দিয়ে গেলাম। তাছাড়া রইল মোহনলাল।’

‘তাকেও তো পাঠাতে পারতে।’

‘এই সামান্য ব্যাপারে তাকে পাঠাতে ইচ্ছে হল না। তাকে রেখে দিয়েছি আমার ঘোর দুর্দিনের জন্যে। কাশিমবাজারে গিয়ে তার যদি ভালো-মন্দ কিছু ঘটে যায়, তখন কে থাকবে আমার পক্ষে?’

চিৎকার করে উঠলাম, ‘আর তোমার বুঝি ভালো-মন্দ কিছু ঘটতে পারে না?’

‘তবু মোহনলাল থাকবে। ইংরেজরা রাজ্যভোগ করতে পারবে না। নেমকহারামির দেউড়ির কেউ মসনদ কলঙ্কিত করবে না।’

‘নেমক হারামির দেউড়ি! সেটা কী নবাব?’

‘জাফরাগঞ্জ। আমি চলি, লুৎফা।’ আমার গালে আলগোছে চুমু খেয়ে সিরাজ বিদায় নেয়।

নেমক-হারামির দেউড়ি। কথাটা মাথায় মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।

সিরাজ নিরাপদেই ফিরল। সঙ্গে নিয়ে এল দুই সায়েবকে। কাশিমবাজার কুঠির দুই মাতব্বর—ওয়াট্‌স্‌ আর চেম্বারস্। এমন অদ্ভুত নাম অনেক কষ্টে রপ্ত করেছি।

সায়েব দু’জন নবাবের আদেশে মুর্শিদাবাদেই থাকবে নবাবের চোখের ওপর। বাংলার সমস্ত ইংরেজদের জামিন তারা। মন্দ বুদ্ধি বার করেনি সিরাজ। ইংরেজদের সমস্ত তৎপরতার চাবিকাঠি নবাবের হাতের মুঠোর মধ্যে। সায়েবদের মেমরাও এসেছে সঙ্গে।

মিষ্টি হাসি হেসে মেমরা নবাব-পরিবারের অনেকের সঙ্গেই আলাপ জমিয়ে ফেলল। হীরাঝিলে এসে আমার সঙ্গেও দেখা করতে চেয়েছিল তারা। আমি রাজি হইনি। ফুটফুটে সুন্দরী হলেই যে বাংলার বেগমের সঙ্গে দেখা করা সহজ হবে, এ ধারণা না থাকাই উচিত তাদের।

সিরাজ খুশি হল। বেগমের মর্যাদা রাখতে জানি দেখে সে সেই রাত্রে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। তার এমন উচ্ছ্বসিত ভাব আমি এর আগে মাত্র পাঁচ-ছয়বার দেখেছি। বুঝলাম, বেগমের মর্যাদা রাখাই এর একমাত্র কারণ নয়। তার সঙ্গে অন্য কিছু যুক্ত হয়েছে। সেটা জানার ইচ্ছা থাকলেও জানতে চাইলাম না। প্রেমের মধ্যে বাস্তবতা এনে ফেললে সিরাজের উচ্ছ্বাস কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ে, বড় মনমরা হয়ে পড়ে সে। নিজে যেমন অবুঝ হয়, আমাকেও তেমন অবুঝ দেখতে চায় সেই মুহূর্তে।

.

পরদিন আমিনা বেগমকে আমার ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বিস্মিত হলাম। তিনি এসে কোনোরকম ভূমিকা না করেই প্রশ্ন করলেন, ‘কথাটা কি সত্যি?’

‘কোন্ কথা?’

‘মেমদের সঙ্গে তুমি নাকি দেখা করোনি?’

‘হ্যাঁ সত্যি। কেন বলুন তো?’

‘তাতে আমাকে অপমান করা হয়েছে, এটুকু বোঝো?’

‘কেমন করে?’ মনে মনে বিরক্ত হই।

‘নবাবের মা হয়ে আমি দেখা করতে পারলাম, অথচ তুমি ওভাবে ওদের তাড়িয়ে দিলে?’

‘আপনি চটেছেন। শান্ত হোন্, দেখবেন আমি ঠিকই করেছি।’

‘ঠিক করেছ?’ আমিনাবিবি অহেতুক ধমক দেন।’

‘হ্যাঁ। নবাবকে আপনি কতদিন দেখেননি?’

দু’মাস হবে। সিরাজ আজকাল ব্যস্ত থাকে বলে আমার সঙ্গে দেখা করার সময় পায় না।’

‘আমার সঙ্গে তার রোজই দেখা হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই দেশের অনেক বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়। ইংরেজদের কথাও ওঠে। ওরা আমাদের ঠিক বন্ধু নয়, একথা আপনি নিশ্চয়ই মানবেন। মেমদের হারেমে পাঠিয়ে গুপ্ত কথা জেনে নেওয়া অসম্ভব নয় ওদের পক্ষে। সেইজন্যেই দেখা করিনি।’

‘ওয়াটসের মেমের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আছে জান?’

‘শুনেছি। কিন্তু কাজটা ভালো করেননি। আর সেইজন্যেই বোধহয় নবাব আপনার সঙ্গে দেখা করা ছেড়ে দিয়েছেন।’

‘লুৎফা’!

‘আমাকে ভুল বুঝবেন না।’

‘না, ঠিকই বুঝেছি। নিচু ঘরের মেয়ে বেগম হলে তার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা অন্যায়।’

এই মুহূর্তে আমিনা বেগমকে গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে পারি। আমার মনের অবস্থা সেই রকমই। কিন্তু সামলে নিলাম, হাজার হলেও সিরাজের মা।

‘আপনি এখন যেতে পারেন। আপনি যখন নবাবের মা, তখন ছেলেকে বলুন না কেন, আমাকে আবার জারিয়া করে দিতে।’

আমিনা বেগম একটু সময় থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গা ঝাড়া দিয়ে বলেন, ‘তবে শোনো, বেগমসায়েবা, সায়েবদের ছেড়ে দেবার জন্যে সিরাজকে রাজি করিয়েছি। এর জন্যে তার সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন হয়নি। শুধু একটা চিঠিতেই কাজ হয়েছে।

‘ভালোই করেছেন। নবাবের মাতৃভক্তি তাহলে ভালোভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এর জন্যে আপনাকে ভবিষ্যতে কাঁদতে না হয়।’

‘চিঠিতে যখন সেটা সম্ভব হয়েছে, তখন তোমার বেগমত্ব ঘুচিয়ে দিতে সিরাজের সামনে একটু দাঁড়ালেই যথেষ্ট হবে মনে রেখো।’

আমিনা বেগম ছুটে বার হয়ে যান। আমি বসে দাঁতে দাঁত ঘষি।

.

আমার মেয়ের ভালো একটা নাম রাখা হল না। যখন যা মনে আসে তাই বলে ডাকি। সেও সাড়া দেয়। নাম শুনে নয়, আমার গলার স্বর শুনে সাড়া দেয়। সে জানে, তাকে ডাকার সময় আমার স্বরে বিশেষ এক টান থাকে, যা অন্য সময়ে থাকে না। অন্য সবাইকে ডাকতে হলে আজকাল একটু গুরুগম্ভীর স্বরেই ডাকতে চেষ্টা করি, কিন্তু মেয়ের বেলায় আমি ‘মা’

সে আধো-আধো ‘মা’ ডাকতে শিখেছে। কী মিষ্টি যে লাগে সে-ডাক। এক-একসময় ইচ্ছে হয়, তাকে পুরানো বেগম মহলে সেই গবাক্ষের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াই। দেখাই তার মা ছোটবেলায় কীভাবে দিন কাটিয়েছে, কিন্তু ওর কি বোঝবার বয়স হয়েছে? বড় হলে নিশ্চয়ই একদিন নিয়ে যাব।

সেই গবাক্ষের স্বপ্ন এখনও দেখি। চোখের জলে ধুয়ে যাওয়া দেওয়ালের বিবর্ণতা এখনও অটুট আছে নিশ্চয়। নবাব আলিবর্দির সময়েও যে-দেওয়ালে রং পড়েনি, এখন পরিত্যক্ত হয়ে মহলের সেই নির্জনতম স্থান কি আর কারও চোখে পড়ে? সারা মহলেই আর কখনও রং লাগানো হবে কি না কে জানে? সিরাজের এত সাধের এই নতুন হীরাঝিলের বাগিচাও যেন আগের মতো শ্যামল নেই। এর মধ্যেই একটা রুক্ষতা এর শ্যামলতা শুষে নিয়েছে যেন।

মুহূর্তের জন্যেও যে-নবাবের শান্তি নেই, যার পেছনে ষড়যন্ত্র সবসময়ে হাত বাড়িয়ে রয়েছে সামান্য অসাবধান হলে টুটি চেপে ধরবার জন্যে, তার বাগিচার এই দশাই তো হয়, আর তার বেগমদের হয় আমার দশা। আরশির সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি, আমার ভেতরেও একটু রুক্ষতা এসেছে। চেহারায় এবং মনেও—যে-মুখে জারিয়াদের হুকুম করি, সোফিয়াকে গালাগালি দিই, সে-মুখের কথা কি নবাবের কাছে প্রথম দিনের মতো মিষ্টি লাগে?

এইজন্যই বোধহয় নবাবদের হাজার বেগম—নানা বয়সের নানা স্বভাবের। মনের অবস্থানুযায়ী নিত্যনতুন বেগমের ঘরে সময় কাটায় তারা—মনের সঙ্গে যখন যে-বেগম খাপ খায়। এইজন্যই বেগমদের বাইরের ঘটনা সম্বন্ধে অন্ধকারে রাখা হয়—নিশ্চিন্ত মনে তারা শুধু নবাবদের মনোরঞ্জনই করে। এ নিয়ম একদিকে অনেক ভালো। এমন হলে আমার মনে এত তাড়াতাড়ি এ কাঠিন্য হয়তো আসত না—প্রথম দিনের লুৎফাই থেকে যেতাম।

বাইরে নবাবের আগমনবার্তা ঘোষিত হল। চেহেল-সেতুন থেকে সিরাজ ফিরল। আজকাল ফিরে সে আমারই কাছে আগে আসে। তাড়াতাড়ি পোশাক পরিবর্তন করে নিজেকে সাজিয়ে নিই। সম্প্রতি বুঝতে শিখেছি যে, শত ভালোবাসা থাকলেও পুরুষমানুষ মেয়েদের সজ্জিত রূপটাই দেখতে চায়, বিশেষ করে সে যখন পরিশ্রান্ত হয়ে দিনান্তে ফেরে। নিজেকে অগোছাল করে রেখে দেখেছি, মুখে কিছু না বললেও আমার ওপর সিরাজের আকর্ষণ ততটা দুনির্বার হয়ে ওঠে না। অথচ খুব সেজেগুজে বসে থাকলে সে এসেই প্রথমে আমাকে আদর করে। সাজানো রূপ যখন অত ভালোবাসে সিরাজ, তখন সেইভাবে থাকাই ভালো। আমি যে তারই।

কিন্তু সেজেগুজে লাভ হল না কিছু। ঘরে ঢুকে আমার সঙ্গে কোনো কথা বলল না সে। দু’বার ঘরময় পায়চারি করে গবাক্ষের সামনে গিয়ে বাইরের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। সে বড় গম্ভীর। গভীর চিন্তান্বিত সে। কথা বলে তাকে বিরক্ত না করে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পেয়ে না ডেকে থাকতে পারি না।

‘নবাব।’

জবাব নেই।

‘সিরাজ।’

হঠাৎ সে তার সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলে, ‘জানো লুৎফা, এইযে আমি এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি, এখনি একটা তির কিংবা গোলা বাইরে থেকে ছুটে এসে আমাকে শেষ করে দিতে পারে। তাড়াতাড়ি তাকে গবাক্ষের সামনে থেকে টেনে সরিয়ে এনে বলি, ‘তাহলে ওখানে তুমি দাঁড়িও না।’

‘শুধু এটুকু সময়ে আমাকে রক্ষা করে কী হবে?’ সিরাজের স্বরে বিমর্ষভাব।

‘এসব কথা আজ বলছ কেন? আমার কি শুনতে সাধ হয়েছে?’

‘না, তা নয়। বাংলার নবাবের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, সে বিষয়ে তোমাকে একটু ওয়াকিবহাল করে রাখলাম।’

‘নবাবির পথে যে ফুল বিছিয়ে থাকে না, সে-কথা আমি জানি, নবাব।’

‘কিন্তু আমার নবাবির পথে শুধু কাঁটাই বিছিয়ে দেওয়া নেই, প্রতিটি কাঁটার ডগায় মাখানো রয়েছে তীব্র বিষ।’

‘সেই বিষকে ডিঙিয়ে যাবার মতো বুদ্ধিও তোমার রয়েছে।’

শত বুদ্ধি থাকলেও মানুষ মানুষই, লুৎফা। সব সময়ে সব বিষয়ে লক্ষ রাখা একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। কার ওপর আস্থা রাখব?’

‘তোমার মোহনলাল রয়েছে।’

‘মোহনলাল একা কী করবে? তাছাড়া সে বুদ্ধিমান হলেও কুট নয়। সে সরল, সে বিশ্বাসী, সে বলিষ্ঠ। এসব নোংরা ঘাঁটা তার পক্ষে সম্ভব নয়।’

কী সেই নোংরামি, নবাব? ‘

‘সে-কথা আমার মুখে নাই বা শুনলে। মুর্শিদাবাদে এখনও হাওয়া বয়। সে-হাওয়া ভেসে ভেসে একসময় তোমার কানেও এসে পৌঁছবে। হীরাঝিলের লৌহদ্বার আর প্রাচীরে তা বাধা পাবে না।’

‘তবু তুমিই বলো।’

‘না।’

‘সেই ইংরেজ দুটোর সম্বন্ধে কি?’

‘না।’

‘তাদের ছাড়লে কেন?’

‘মায়ের অনুরোধে।’

‘নিজের বিপদের আশঙ্কা জেনেও?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেন?’

‘দুটো ইংরেজকে আটকে রেখে যেটুকু লাভ, তার মেয়াদ ফুরিয়েছে। সাধারণ লোকে যদি আমাকে না চায়, তাহলে তাদের আটকে রেখে লাভ কী? ‘

‘নবাব সিরাজদ্দৌলাকে জনসাধারণ চায় না?’

‘এখনও হয়তো চায়, কিন্তু দু’দিন পরে আর চাইবে না। আমার পায়ের নিচের মাটি ধসে পড়েছে, লুৎফা। আমি বুঝতে পারছি, অথচ উপায় নেই।’

‘আমাকে বলতেই হবে, কী হয়েছে?’

‘না। শুধু শুনে রাখো, বিরাট ষড়যন্ত্র।’

‘সে তো আজ প্রথম নয়।’

‘এতদিন মানুষের মন ভাঙেনি, তাই আমার বুকে বল ছিল।’ সে একটু থেমে বলে, ‘ওসব কথা থাক, মায়ের দ্বিতীয় অনুরোধের কথা তোমাকে বলা হয়নি।

‘বলো।’

‘তোমাকে বেগম থেকে আবার জারিয়া করে দিতে বলেছেন তিনি।’ আজই কি আমাকে ঘর ছাড়তে হবে?’

‘না।’

‘আমার মেয়েটা কি জারিয়ার মেয়ে বলেই পরিচিত হবে?’

‘না।’

‘আমাকে কি পুরানো মহলে আমিনা বেগমের সেবার জন্যে রাখা হবে?’

‘না।’ সিরাজ হেসে আমার হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলে, ‘বেগমসায়েবা দেখছি জারিয়া হবার জন্যে প্রস্তুত। সিরাজের জন্যে কষ্ট হবে না?’

কথা না বলে তার বুকের ওপর মাথা রাখি।

.

হাওয়ায় সেই নিদারুণ খবরই ভেসে এলো। সিরাজ সত্যি কথাই বলেছিল। মুর্শিদাবাদে হাওয়া এখনও বয়ে চলেছে—সাংঘাতিক ভাবে বয়ে চলেছে।

হামিদার মুখে গুজবটা শুনে দু’হাত দিয়ে নিজের কান চেপে ধরেছিলাম।

‘বিশ্বাস হয়, হামিদা?’ যেন তার জবাবের ওপর আমার জীবন-মরণ নির্ভর করছে।

.

‘না, বেগমসায়েবা। নবাবকে আমি ভালোভাবে চিনে ফেলেছি। মসনদে বসার পর কিছুদিন তিনি শুধু নবাব আলিবর্দির আদরের নাতির মনোভাব নিয়ে ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি প্রকৃত নবাব। তিনি এ কাজ করতে পারেন না।’

তার কথায় সত্যিই সান্ত্বনা পেলাম।

জাফরাগঞ্জ দেউড়ি থেকে যার সূত্রপাত, এখন তা দেশের প্রতিজনের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। সিরাজের ওপর তাদের বিশ্বাসের মূলে কঠিন আঘাত হেনেছে।

সিরাজ যখন কাশিমবাজার থেকে ফিরছিল, তখন নাকি ঘটনাটা ঘটেছে। গঙ্গার বুকের ওপর দিয়ে ভেসে আসছিল বজরা। সেই বজরা থেকে সে দেখতে পেয়েছিল বড়নগরের ছাদের ওপর এক অপ্সরীকে। প্রথমে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল, তারপর নাকি সৈন্যসামন্ত নিয়ে রানি ভবানীর প্রাসাদ অবরোধ করে।

পাগল না হলে এমন কথা কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি লোকই যে গুজব-পাগলা। তাই সবাই বিশ্বাস করে বসে রয়েছে নিশ্চয়

ছাদের সুন্দরী ছিল রানি ভবানীর বিধবা মেয়ে তারা। হিন্দুসমাজে বড়নগরের রানির আসন কত উঁচুতে সিরাজ সে-কথা ভালোভাবেই জানে। রানির পালিত পুত্র একজন মহাপুরুষ, একথাও হিন্দুদের মতো মুসলমানদেরও অজানা নয়। তাঁরই মেয়ের দিকে কটাক্ষপাত যে সিরাজের পক্ষে কখনও সম্ভব নয়, একথা আমার চাইতে ভালো কে বুঝবে? আর বুঝবে ঘসেটি বেগম, যে নবাবকে হাড়েহাড়ে চেনে।

.

‘সিরাজ এলে বলি, বাইরের বাতাস হীরাঝিলেও ঢুকেছে নবাব।’

‘জানতাম।’

‘বিশ্বাস করি কি না জিজ্ঞাসা করলে না?’

‘আমি মূৰ্খ নই।’

‘দেশের সবাই সত্যি বলে ভেবেছে।’

‘তাদের পক্ষে সেটাই সম্ভব।’

‘আমার পক্ষে?’

‘তোমাকে বজরায় করে নিয়ে গিয়ে দেখাতে পারি যে, বড়নগরের রাজবাড়ি গঙ্গা থেকে দেখাই যায় না। তাতে তুমি বিশ্বাস করবে। কিন্তু দেশের প্রতিটি লোককে তো সেভাবে দেখানো সম্ভব নয়।’

‘কে রটাল এসব?’

‘তা বলতে পারি না। তবে নেমক-হারামির দেউড়ি থেকেই রটেছে কথাটা।

‘আমি জানি কে রটিয়েছে।’ দরজায় ঘসেটি বেগমের কণ্ঠস্বরে আমরা উভয়েই চমকে উঠি। খবর না পাঠিয়ে এমন অকস্মাৎ সে কখনও আসে না।’ সেরকম হুকুমও নেই। বুঝলাম, সব শুনে সে আর স্থির থাকতে পারেনি।

ঘসেটির কথায় সিরাজ উদ্‌গ্রীব হয়ে বলে, ‘কে রটিয়েছে?’

‘এত বুদ্ধি থাকতেও সহজ জিনিসটা বোঝনি, নবাব। সমস্ত হিন্দুকে তোমার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে হলে হিন্দুদের নাড়ির খবর জানা দরকার। মুসলমানের পক্ষে তা সম্ভব নয়। রাজবল্লভ শেষ চাল চেলেছে, আর সেই চালে বাজিমাত। পারলে না তুমি সিরাজ, হেরে গেলে। বাইরের লোক এখন তোমাকে পশু বলে জেনে নিয়েছে।’

ঘসেটির কথায় বিদ্রূপ ছিল কি না জানি না, কিন্তু ধৈর্য ধরে থাকতে না পেরে আমার চুলের বিনুনিটা নিজের বাঁ হাতের ওপর সজোরে আঘাত করে বলি, ‘আপনার খুব আনন্দ হচ্ছে, তাই না ঘসেটি বেগম? সে-আনন্দ চাপতে না পেরে বিনা হুকুমে ছুটতে ছুটতে এসে এ ঘরে ঢুকেছেন।

ঘসেটির মুখ সাদা হয়ে যায়, কিন্তু মুহূর্তের জন্যে। গম্ভীর স্বরে সে বলে, ‘তোমার বাঁ হাতকে আমার মুখ বলে ভুল করে লাভ নেই, বেগমসায়েবা। দেখছ না, তুলতুলে মাংস কেমন ফুলে উঠেছে?’ সে সিরাজের দিকে চেয়ে বলে, ‘তোমারও কি একই ধারণা, সিরাজ?’

‘না। লুৎফা এখনও ছেলেমানুষ, ঘসেটি বেগম।’

‘ছেলেমানুষের মতো থাকাই উচিত তবে।

ঘসেটির কথায় বিনুনির চাবুকের জ্বালা প্রথম অনুভব করলাম। কিন্তু কিছুই করার ছিল না বলে ছটফট করতে লাগলাম।

ঘসেটি বলে, ‘রাজবল্লভকে একবার আমার কাছে ডেকে আনতে পারো, সিরাজ?’

‘কেন, কী হবে?’

কী হবে এখনও বুঝছ না?’ ঘসেটির চোখ জ্বলতে থাকে—পুরোনো মহলের সেই বিজন কোণে হোসেন কুলিখাঁ চলে গেলে আমাকে দেখে যেমন জ্বলে উঠেছিল। সেদিনের মতো আজও আমার বুক কেঁপে উঠল, যদিও আজ আর আমি জারিয়া নই, আমি বেগম লুৎফউন্নেসা।

‘স্পষ্ট করে বলো।’ সিরাজ বলে।

‘আলিবর্দির মসনদ আরব দেশের ওই কাপুরুষটিকে দিতে পারি না।’ ঘসেটির কণ্ঠস্বরে শ্লেষ।

‘যদি সেরকম দিন আসে তুমি কী করবে?’

‘প্রতিহিংসা! আমাকে তুমি বন্দি করে রেখেছ, কিন্তু প্রতিহিংসা নিতে দেবে তো?’

‘রাজবল্লভের সামনে গেলে তুমি বড় দুর্বল হয়ে পড়ো।’

‘হ্যাঁ, তাই তো তাকে এই হীরাঝিলে আমার সামনে এনে দিতে বলছি।’

‘কী করবে তাকে নিয়ে?’ সিরাজের চোখে সপ্রশ্ন কৌতূহল।

‘তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। নিজে পাগল হব, তাকে পাগল করব। তারপর তার মুখে একপাত্র বিষ ঢেলে দেব।’ কাঁপতে থাকে পুরুষালী নারী।

‘তাতে বাংলার মসনদ সুরক্ষিত হবে না, শুধু প্রতিহিংসাই নেওয়া হবে। রাজবল্লভের মৃত্যু হলে আমার পশুত্ব সত্যি বলে প্রতিষ্ঠিত হবে।’

‘সেটা প্রতিষ্ঠিত হবার অপেক্ষায় নেই সিরাজ। রাস্তা দিয়ে যখন যাবে, প্রজাদের মুখের দিকে চেয়ে দেখো তো, সে-মুখে কী লেখা রয়েছে। রাজবল্লভের মৃত্যু না হলেও তোমার মসনদ আর কখনও সুরক্ষিত হবে না। সময় নেই সিরাজ, প্রস্তুত হও। বিশ্বাসী লোকদের একজোট করে সৈন্য ভাগ করে দাও।’ ঘসেটি যেমন অকস্মাৎ এসেছিল, তেমনি চলে গেল।

কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর সিরাজ মুখ খোলে, ‘ঘসেটি বেগম যদি মসনদে বসত, তাহলে এত তাড়াতাড়ি বাংলার বিপদ আসত না।’

‘কেন নবাব?’

‘সে আমার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরে।’

‘সে কিন্তু বলে, তুমিই বেশি বুদ্ধিমান।’

‘সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু ঘসেটি যা বলে গেল তা সম্ভব নয়। মিরজাফরের সৈন্য অপরের মধ্যে ভাগ করে দেবার সাহস আমার নেই।’

‘তুমি না নবাব?’

‘হুঁ, আইনত। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে অনেক ব্যাপারেই বাধা আছে। তার সৈন্যরা আমার চেয়ে তারই বেশি অনুগত। আমার সঙ্গে তাদের আর কতটুকু সংযোগ? ঘসেটির কথামতো কাজ করতে গেলে অনর্থক একটা আলোড়নের সৃষ্টি হবে, যা আমি আপাতত চাই না।’ চিন্তান্বিত হয়ে সিরাজ চলে যায়।

মেয়েটাকে নিয়ে হামিদা প্রবেশ করে। আমাকে অনেকক্ষণ না দেখে সে কাঁদছিল। কাঁদুক, যত পারে কাঁদুক।

.

মোহনলালকে ব্যস্তভাবে হীরাঝিলের বাগিচা অতিক্রম করে আসতে দেখে কেন যেন অমঙ্গলের আভাস পেলাম। এই লোকটিকে সিরাজের নবাবি- শাসনের স্তম্ভ বলে আমি মনে করি। স্তম্ভে সম্ভবত নাড়া লেগেছে। সম্ভবতই বা বলি কেন, নিশ্চয়ই তাই। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে বিচলিতভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সামান্যে বিচলিত হবার মতো পুরুষ মোহনলাল নন। নিজের বোন ফৈজীর সম্মুখে তুলে দেওয়া দেওয়ালের সামনে তাঁকে নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি বলেই একথা এমনভাবে আমি বলতে পারছি।

একবার মনে হল, নিজেই ছুটে যাই তাঁর কাছে। জিজ্ঞাসা করি, তাঁর বিচলিত হবার কারণ কী। কিন্তু আমি যে বেগম, আমি তা পারি না।

সিরাজ আমার অনুরোধে চেহেল-সেতুনে আর যায় না। হীরাঝিলেই দরবার বসে। তবে এ ব্যাপারে তাকে সম্মত করতে যথেষ্ট বেগ হতে হয়েছে। প্রথমে সে হেসে উঠেছিল এই অবাস্তব অনুরোধে। দুর্গের মধ্যে বসে থেকে রাজ্যশাসনের পরামর্শ দেওয়া অবাস্তব তো বটেই। প্রজাদের সঙ্গে সংযোগ না রেখে নবাবি করা যায় না। কিন্তু যখন তাকে বুঝিয়েছিলাম যে, জাফরাগঞ্জ থেকে রটনা করা বড়নগরের ঘটনাটির প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে কিছুদিন অন্তত তার বাইরে না যাওয়াই উচিত, তখন সে বুঝেছিল। তবু একটু প্রতিবাদ না করে ছাড়েনি। বলেছিল, এভাবে হীরাঝিলের মধ্যে বসে থাকলে প্রজারা গুজবটিকে বিশ্বাস করে নেবে। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। তাই বলেছিলাম, সে-বিশ্বাস ভেঙে দেবার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু এই উত্তেজনাময় মুহূর্তে বাইরে গেলে কোনো প্রজা মরিয়া হয়ে কিছু করে বসলে আর কোনো উপায়ই থাকবে না।

আমার কথার সম্মান রেখেছিল সিরাজ।

.

মোহনলালকে আসতে দেখে ভাবলাম, নবাব ইতিমধ্যে বাইরে চলে যায়নি তো? আমাকে না জানিয়ে গোপনে হয়তো মুর্শিদাবাদ পরিদর্শনে গিয়েছে প্রজাদের মন জানতে। কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। মনে হয়, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না, এখনি বুঝি পড়ে যাব। মোহনলাল চরম দুর্ঘটনার খবর নিয়েই যেন ছুটতে ছুটতে আসছেন। বিশ্বাসঘাতকেরা তৎপর হয়ে উঠেছে বলেই বন্ধুপত্নীকে রক্ষা করতে আসছেন তিনি।

মেঝের ওপর বসে পড়ি। হামিদা ছুটে এসে হাত ধরে টেনে তুলে বলে, ‘কী হয়েছে, বেগমসায়েবা?’

‘নবাব বোধহয় আর বেঁচে নেই, হামিদা।’

‘সে কী! এইমাত্র এ-ধার দিয়ে গেলেন তো।’

‘নিজের চোখে দেখেছিস্? ভুল দেখিনি?’

‘না-না, ওই দেখুন।’

হামিদার আঙুল বরাবর চেয়ে দেখি, সত্যই সিরাজ এগিয়ে গিয়ে মোহনলালের সঙ্গে কথা বলছে। শরীরে আবার রক্ত চলাচল শুরু হল।

দু’জনাই খুব নিশ্চিন্ত হলেও স্বস্তি অনুভব করতে পারলাম না। মোহনলাল কী বলল শোনার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলাম।

.

সিরাজ গিয়েছে, মোহনলাল গিয়েছে—সবাই গিয়েছে। পলাশীর প্রান্তরে জমায়েত হয়েছে সবাই ইংরেজদের বিতাড়িত করতে। এখানে এখন আছে শুধু রাজবল্লভ, জগৎশেঠ—রয়েছে উমিচাঁদ, আর রয়েছে মিরজাফরের আদরের ছেলে মিরন, যাকে সোফিয়ার স্বামী মহম্মদ ছায়ার মতো সবসময় অনুসরণ করছে। মিরনের ছায়া মহম্মদ, ভালোই হয়েছে।

এসব কথা হামিদা বলেছে আমাকে। আর হামিদাকে বলেছে সোফিয়া নিজে। তার নাকি বরাত খুলেছে। এখন সে পায়ে হেঁটে কোথাও যায় না, গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ায়। গাড়িতে করে এসেছিল সেদিন হীরাঝিলে। ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে চেঁচামেচি করে এক দৃশ্যের অবতারণা করেছিল। খোজারা ছুটে এসে আমাকে জানাতে আমি হামিদাকে পাঠিয়েছিলাম।

হামিদা যেতেই সে চিৎকার করে বলেছিল, ‘এই যে বিশ্বস্ত জারিয়া, বেগমসায়েবার কাছে নিয়ে চল। এরা আমাকে যেতে দিচ্ছে না। চেনে না কিনা।

হামিদা মাঝে মাঝে বড় বেয়াড়া কথা বলে। সোফিয়া অহঙ্কারে ফুলে উঠেছে দেখে সে খোঁচা দেবার লোভ সামলাতে পারেনি, যদিও আমি বার বার করে বলে দিয়েছিলাম যে, শান্তভাবে বুঝিয়ে যেন তাকে বিদায় করা হয়।

হামিদা বলেছিল, ‘এতবড় গাড়ি করে এসেছ, ঢুকতে দেওয়া ওদের উচিত ছিল। বেগম বলে ভাবাও স্বাভাবিক। কিন্তু চেনে বলেই ঢুকতে দিচ্ছে না।’

‘চেনে কী রকম?’ সোফিয়া রেগে উঠেছিল।’

‘তুমিই ওদের জিজ্ঞাসা করো, সোফিয়া।’

‘বোরখার মধ্যে থেকে কি মুখ দেখা যাচ্ছে আমার?’

‘আমারও তো মুখ বোরখায় ঢাকা, তাই বলে কি আমাকে চেনে না এরা? সব চেনে। এদের যে চিনতে হয়। নইলে পাহারা দেওয়া চাকরি থাকবে না।’

সোফিয়া বলেছিল, তুমি হীরাঝিলে থাকো, ওরা তোমার স্বর চেনে, চলনও চেনে। তুমি পুরোনো মহলে থাকতে, তোমারও গলার স্বর ওদের চেনা। তবে তোমার চলন বদলেছে।’

‘সব বাজে কথা।’

‘বাজে কথা নয়, দেখবে?’ হামিদা দ্বারের একজনকে বলেছিল, ‘তোমরা এই বোরখার বিবিকে চেনো না?’

‘হ্যাঁ, ভালোভাবেই চিনি। সোফিয়া জারিয়া।’ একজন দ্বাররক্ষী নির্বিকার ভাবে বলেছিল। ‘দেখলে তো জারিয়া, এরা বড়ই সাংঘাতিক।’ হামিদা হেসে উঠেছিল।

সোফিয়া রেগে বোরখা খুলে অগ্নিদৃষ্টিতে দ্বাররক্ষীর দিকে চেয়ে বলেছিল, ‘এখন আমি কে জান?’

‘হ্যাঁ জানি। মহম্মদের সঙ্গে শাদি হয়েছে। মহম্মদ যে আমার দোস্ত ছিল বিবি। তবে এলেম্‌ আছে তার, বেশ ওপরে উঠে গেল।’

সোফিয়া চোখ-মুখ লাল করে বলেছিল, ‘সব তোমার শেখানো, হামিদা। আজ চলে যাচ্ছি বটে, কিন্তু পরে যখন আসব, তখন আর কেউ বাধা দিতে সাহস পাবে না। কুর্নিশ করে পথ ছেড়ে দিতে হবে।’

‘তাই নাকি! মহম্মদ কি নবাব হবে?’ হামিদা রীতিমতো হিংস্র হয়ে উঠেছিল।

‘তা হবে কেন?’

‘তবে কি মিরন তোমাকে বেগম করতে চেয়েছে?’ হামিদা হা-হা করে হেসে উঠেছিল।

‘যতই হাসো, তোমাদের দিন ফুরিয়েছে।’

‘পলাশীর খবর কি তোমার কাছে এসে গিয়েছে?’

‘খবর আগে থেকেই জানা আছে।’

‘তাই নাকি!’ হামিদা বিস্মিত হবার ভান করেছিল।

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, পলাশীতে যুদ্ধ হবে না, মশকরা হবে।’

‘তাহলে তো গেলে হত, মজা দেখতাম।’

সোফিয়া চলে গেলে হামিদা এসে আমাকে সবিস্তারে সব জানায়। সোফিয়ার একটা কথাই আমার কানে বার বার বাজতে থাকে—পলাশীতে যুদ্ধ হবে না, মশকরা হবে। কেন সে ওকথা বলল? তবে কি জাফরাগঞ্জের চক্রান্তের খবর সে কিছু রাখে? এর মধ্যে কি কোনো সত্যতা রয়েছে?

সিরাজও ওই রকম একটা কিছু বলেছিল। বলেছিল যে, মাত্র কয়েক শ’ ইংরেজ সৈন্যের কাছে যুদ্ধ বলে কিছুই হবে না। বিশাল ফৌজ নিয়ে গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ালেই নাকি ওদের কর্তা ক্লাইভ সায়েব এসে পা চেপে ধরবে।

কিন্তু কই, এখনও তো কোনো খবর এল না। মুর্শিদাবাদ থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে পলাশীর প্রান্তর হতে খবর আসতে এত দেরি হবে কেন? আমি তো সিরাজকে বার বার করে বলে দিয়েছিলাম যে, প্রতিদিনের খবর জানিয়ে সে যেন একজন করে অশ্বারোহী পাঠায় আমার কাছে। অশ্বারোহীর পক্ষে সেখান থেকে মুর্শিদাবাদ আসতে একদিনের বেশি দেরি হতে পারে না। অথচ এ পর্যন্ত কেউ এল না।

‘বেগমসাহেবা এত মন-মরা কেন?’ মেয়ে কোলে নিয়ে হামিদা এসে দাঁড়ায়।

‘পলাশীর কোনো খবর এল না, হামিদা?’

‘সে খবর নবাব নিজে এসেই দেবেন। ব্যাপারটা এত তুচ্ছ যে, শুধু শুধু অশ্বারোহী পাঠানো প্রয়োজন বোধ করেন না তিনি।’

তুচ্ছ হলেও সেটুকু জানানো উচিত ছিল। তাহলে নিশ্চিন্ত হতাম।’ হামিদা কিছু বলার আগে আর একজন জারিয়া এসে কুর্নিশ করে।

‘কী চাও?’

‘ঘসেটি বেগম একবার এখানে আসতে চান।’

‘আসতে বলো।’

ঘসেটি এলে তার দিকে চেয়ে থাকি অনেকক্ষণ। তার মুখের দিকে নয়, পরিচ্ছদের দিকে। খুব সাধারণ ঘরের মেয়েরাও বোধহয় এর চেয়ে দামি পোশাক পরে। পাশে হামিদার পোশাকের দিকে চেয়ে আমার নিজেরই লজ্জা হল। শেষে রাগ হল। এটাও ঘসেটি বেগমের চাল? সে কি প্রমাণ করতে চায় যে নবাব তাকে বন্দি করে রাখায় তার এ দুর্দশা হয়েছে। তার শরীরের কোথাও অলঙ্কার বা মণিমুক্তোর ছিটেফোঁটাও দেখলাম না। শুধু অলঙ্কারের শূন্য জায়গায় শরীরের ত্বকের ওপর সাদা সাদা দাগ উৎকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।

‘ঘসেটি বেগমের এ বেশের অর্থ?’

‘রাগ কোরো না, লুৎফা। সাধারণভাবে থাকা অভ্যাস করছি।’ তার মুখে ম্লান হাসি খেলে যায়।

‘কেন, নিজের ভবিষ্যৎ কি এর-মধ্যেই দেখে ফেলেছেন।’

‘হ্যাঁ।’ দৃঢ় জবাব।

‘আর তার মূলে নবাব সিরাজদ্দৌলা নিশ্চয়ই?’

‘না-না, ও ভুল কোরো না লুৎফা, ও ভুল কোরো না। যদি পারতাম প্রায়শ্চিত্ত করতাম। চিরদিন সিরাজের শত্রুতা করে আজ আমার অনুতাপ হচ্ছে। প্রথম থেকে তার পাশে দাঁড়ালে বোধহয় বাংলায় এ দুর্দশা হত না। সিরাজ আরও শক্তিশালী হতে পারত।’

‘আপনি এসব কী বলছেন?’

‘প্রস্তুত হও লুৎফা, ভীষণ দুর্দিনের জন্য প্রস্তুত হও।’

‘আপনি কি পাগল হলেন? সিরাজ বলেছে, ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ বলতে কিছুই হবে না। নবাব সৈন্যের সংখ্যা দেখেই তারা আত্মসমর্পণ করবে।’

ঘসেটি কিছু বলে না। সে দৃঢ়ভাবে ঠোঁট দুটো পরস্পর চেপে ধরে। ঠিক আলিবর্দির বেগমের মতো দেখায় তার মুখ। কপালেও তেমনি রেখা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বুঝতে পারি সিরাজের চিন্তায়ও এ রেখা ফুটেছে। ঘরময় পায়চারি করে বেড়ায়। নবাব আলিবর্দিকেও এমনি অবস্থায় কতবার দেখেছি। হাত দুটো পেছন দিকে, একটার ওপর আর একটা পড়ে রয়েছে।

কিছুক্ষণ এইভাবে ঘুরে সে সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপরই হামিদার কোলে আমার মেয়ের কাছে যায়। তার মাথাটা নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে। জীবনে এই প্রথম তার মুখে একটা মাতৃত্বভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু মেয়েটা কাঁদতে শুরু করে। তাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে অল্প হেসে ঘসেটি আবার আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার মুখের দিকে বহুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। একসময় দেখি তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে, তার দুটো চোখের কোণে জল চিকচিক করছে।

তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি আমি।

‘কেঁদো না, লুৎফা। কাঁদার দিন গিয়েছে। কাঁদার দিন পরেও আসতে পারে। কিন্তু এখন তোমাকে শক্ত হতে হবে। তুমি বাংলার বেগম। বাংলার নবাবের মনোবল ফিরিয়ে আনতে শুধু তুমিই পারবে। যদি সে সুযোগ আসে—’ ঘসেটি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, আমি যেমন করে আমার মেয়ের মাথায় দিই।

হামিদা স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। এবারে সে ধীরে ধীরে বলে, ‘তবে কি সোফিয়ার কথাই ঠিক? সে বলেছিল, পলাশীর যুদ্ধের খবর আগে থেকেই জানা আছে।’

ঘসেটি বেগম বলে, ‘সোফিয়া ঠিক কথাই বলেছে। আজ সকাল থেকে হীরাঝিলের সামনে গঙ্গার বুকে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ আর মিরনের বজরার ঘনঘন আবির্ভাবে আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি।’

‘তারা ওভাবে আসছে কেন?’ আমি বলে উঠি।

‘হয়তো সিরাজের খোঁজে। একা সিরাজ কখন ফিরে আসে তাই দেখতে। কিংবা হয়তো হীরাঝিলকে দরবার বানালে কেমন হবে, এখন থেকেই তার ছক কাটছে।’

‘পলাশীর যুদ্ধে কি তবে সত্যিই সিরাজের পরাজয় হবে?’ মাথাটা আমার সহসা ফাঁকা হয়ে যায়, যেন স্বপ্ন দেখছি।

‘পলাশীতে তো যুদ্ধ হবে না। যুদ্ধের নামে হবে বিরাট পরিহাস। এতক্ষণে হয়তো হয়েও গিয়েছে। সিরাজ জানত বোধহয়।

‘তবে কেন গেল সে? কেন গেল?’

‘মোহনলালের ভরসায়।’

‘সে ভরসা কি আর নেই?’

‘বোধহয় নেই। তাহলে সে এর মধ্যে আসত। মিরজাফর নিশ্চয়ই শেষ পর্যন্ত নির্লজ্জের মতো মোহনলালের বিরুদ্ধে তার সৈন্য লেলিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এ সমস্তই আমার অনুমান।’

‘আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। সবকিছু চিন্তার ক্ষমতা লোপ পায়।

ঘসেটি আমার চিবুক উঁচু করে ধরে আমার গালে চুমু খেয়ে বলে, ‘বাংলার বেগমসায়েবা, তুমি শুধু হারেমের পুতুল নও, তুমি নবাবের সুখ-দুঃখের অংশের ভাগীদার। তৈরি থেকো। তোমার সাধের হীরাঝিল ত্যাগের জন্যেও মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করো।’

‘আপনি তো আমার সঙ্গেই থাকবেন? ‘

‘না, আমি দেখতে চাই, আমাকে নিয়ে ওরা কী করে?’

‘যদি ওরা রাজবল্লভের হাতে তুলে দেয়?’

‘আমি তো তাই চাই। রাজবল্লভের মরা-মুখ আমাকে দেখতেই হবে। কিন্তু তা কী করে

আর হবে? সে চতুর লোক। আমার ধারে-কাছেও আর ঘেঁষবে না বোধহয়।’

‘কিন্তু নবাব কি সত্যিই পরাজিত?’

‘আমার কথা যেন মিথ্যে হয়। যদি কেউ বলে যে আমি প্রাণ বিসর্জন দিলে এ সমস্ত মিথ্যে হবে, আমি তাতেও রাজি।’

‘সিরাজের কী হবে?’

‘পরাজিত নবাবের যা-যা হয় তারই একটা হবে। শোনো লুৎফা, যদি তোমাকে একলা কিংবা কারও সঙ্গে হীরাঝিল ছেড়ে পালাতে হয়, তাহলে কখনও জলপথে যেও না।’

‘কেন?’

‘জলপথে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। নদীর ধারে সৈন্যদের ঘাঁটি আছে। তাছাড়া নদীতেই যত ব্যবসা, যত কিছু। স্থলপথে গেলে নিজেকে লুকিয়ে রাখার সুবিধে অনেক বেশি।’

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *