আমি মুজিব বলছি – ৬

একটি কয়েদীর সন্দেহজনক মৃত্যু

৮ই অক্টোবর তিনি সংবাদ পাইলেন যে জেলের cell-এর একটি কয়েদী মারা গিয়াছে। এই কয়েদীকেই পূর্বদিন বেলা ১১/১২ টার সময় বড় জমাদার, জমাদার সিপাহী ও কতিপয় কয়েদী দ্বারা জুলুম সহ উক্ত cell–এর দিকে লইয়া, যাইতে তিনি দেখিতে পান। উত্ত কয়েদী cell- এ না ঢুকিবার জন্য দরজা ধরিয়া বাধা দিতেছিল। অবশেষে প্রবল শক্তির নিকট পরাভূত হয়।

মৃত্যুর দিন সকালে দেখা গেল যে সে অচেতন অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে।

এই মৃত্যুর ঘটনা সতীন্দ্রনাথের অন্তরে এক তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করিল। সহায় সম্বলহীন, দরিদ্র এবং আবদ্ধ একটি নিরস্ত্র লোককে এমন নিষ্ঠুর ভাবেই পুনঃ পুনঃ প্রহার করা হইল–যাহার পরিণতিতে হইল তাহার মৃত্যু, অথচ এজন্য দেখা দিল না কোন আলোড়ন, কোন প্রতিকার ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের একটা প্রধানতম কেন্দ্রে যদি সংঘটিত হইতে পারে এমন সব ঘটনা, তবে সে রাষ্ট্রের কাছে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায়! এই কয়েদীর মৃত্যু এবং সতীন্দ্রনাথের মৃত্যু এই দুইটির মধ্যেই যেন রহিয়াছে এক মহা রহস্য’ সে রহস্যজনক মৃত্যুর কাহিনী রহিয়াছে উভয় মৃত্যুর অন্তর্বর্তী দীর্ঘ অবসরের মধ্যে উদ্ঘাটনের প্রতীক্ষায়– ভাবীকালের অন্তরালে।

সংবাদপত্রে বড় বড় শিরোনামায় প্রকাশিত হইতে পারে এমন সব দুঃসাহসিকতাপূর্ণ কার্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া হয়তো অনেকের পক্ষেই বিচিত্র নহে, কিন্তু অজ্ঞাত, অখ্যাত ভাবে সকলের অলক্ষ্যে বিপদকে উপেক্ষা করিয়া নিজেকে লিপ্ত করিবার মধ্যে যে মানসিক বীরত্বের প্রয়োজন হয় সতীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল তাহা পূর্ণ মাত্রায়। এই কয়েদীর মৃত্যুর ব্যাপার লইয়া এত ঘাঁটাঘাঁটি না করিয়া আর দশজনের ন্যায় তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানাইয়া শান্ত থাকাই তো বিশেষ বুদ্ধিমানের কার্য হইত। কিন্তু তাহা না করিয়া তাঁহার এই ৬০ বৎসর বয়সের কারাভ্যন্তরের মধ্যে সত্যের প্রতিষ্ঠার মানসে তিনি দৃঢ়ভাবে দণ্ডায়মান হইলেন। সতীন্দ্রনাথ দাবী করলেন মৃতের শবব্যবচ্ছেদ সহ পুলিশ কর্তৃক মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটন করা হউক। ইহারই স্বাভাবিক পরিণতি ছিল জেলারের সহিত সতীন্দ্রনাথের তিক্ততা বৃদ্ধি। উক্ত মৃত্যু ব্যাপারে উপরে যবনিকা টানিবার মানসে জেল কর্তৃপক্ষ জানাইলেন যে তাহাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে তাহারা সন্তুষ্ট, তদতিরিক্ত কিছু করিবার নাই। উত্তরে সতীন্দ্রনাথ আবেদন করিয়া বলিলেন- “justice not only to be done but all must feel that justice been done.”-কিন্তু বিশেষ কিছুই হইল না।

সতীন্দ্রনাথ নিশ্চেষ্ট রহিলেন না। যত প্রকার আইনসঙ্গত উপায়ে সম্ভব এই নিষ্ঠুর ও বেদনাদায়ক মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য ক্রমাগত দাবী উত্থাপন করিতে থাকেন। শুধু ইহাই নহে, জেলের অভ্যন্তরস্থ অসহায় কয়েদীদের প্রতি নানাপ্রাকার জুলুম অত্যাচারের প্রতিবাদও সতীন্দ্রনাথ করতেন। জেলারকে তিনি জানাইলেন, সর্ববিধ আইনসম্মত উপায় অবলম্বনের দ্বারাও যদি ইহার প্রতিকার না হয় তবে নিজে লাঞ্ছনা ভোগ করিবেন। ইহারই ফলে শুরু হইল সতীন্দ্রনাথের কারাজীবন দুর্বিসহ করিয়া তুলিবার নানা আয়োজন।

রোগের পূর্বাভাষ

[মৃতুঞ্জয়ী সতীন সেন]

১৯৫৪ সনের নভেম্বরের শেষের দিক হইতেই সতীন্দ্রনাথের শরীর বিশেষভাবে খারাপ হইয়া পড়িল। তাহার উপর চলিত নানাপ্রকার হট্টগোল চিৎকার। ঐ সব কারণে বহু বিনিদ্ৰ রজনী যাপন করিতে হইল।

নভেম্বরের অর্ধমাস অতিবাহিত হইল–পুষ্টিকর আহারের অভাব, নিদ্রাহীন রজনী যাপন, বহিভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অনাদর, তাহাদের সর্বপ্রকার অনিষ্টাচরণের প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি টি বি রোগের বিভীষিকাময় বিস্তৃতির আশঙ্কা–ইহারই পরিণতিতে সতীন্দ্রনাথের শরীর ক্রমশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। স্থানীয় জেলের বিশৃঙ্খলা এবং তাঁহার শারীরিক অবস্থার কথা উল্লেখ করিয়া ন্যূনকল্পে ৬/৭ খানা পত্র তিনি ঢাকার স্বরাষ্ট্র দপ্তরেও পাঠাইয়াছেন, কিন্তু কোন উত্তর তিনি পান নাই। তন্মধ্যে শেষ পত্র তিনি পাঠাইয়াছিলেন, রংপুর জেল হইতে ১৯৫৪ সনের ১০ই ডিসেম্বর। ইহা ব্যতীত জেলের সুপারকেও অসংখ্যবার মৌখিক ও পত্রযোগে তিনি সে কথা জানাইয়াছেন। কিন্তু সবই নিস্ফল!

পাবনা জেল

অনেক লেখালেখি, অনেক হাঙ্গামারা পর অবশেষে সতীন্দ্রনাথকে রংপুর জেল থেকে পাবনা জেলে বদলীর হুকুম আসে। যে সমস্ত নিরাপত্তা বন্দী ছিলেন তাহাদেরও অন্যত্র বদলী করা হইল। ২১শে ডিসেম্বর রংপুর ত্যাগ করিয়া ২৩শে ডিসেম্বর সকাল ৯টায় তিনি পাবনা জেলে পৌঁছাইলেন। এর পরই আসিল সতীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ অধ্যায়। সে অধ্যায় নিরন্তর প্রতি দেশবাসীর মনে এই প্রশ্নই জাগাইয়া তুলিবে–কি হইল বড় এক মহান আদর্শবাদীর– তাঁহার আদর্শ উদযজাপনের পরিণতিই বা কি?

তাঁহার ডায়েরী বা রোজনামচার পাতায় পাতায় যেন ইহার ইঙ্গিত পাই। তাহাতে লেখা আছে-

“রংপুর জেলে শেষের দিক দিয়া এই যে ঝাঁকানি–বেশই লাগিল। এই বয়সে, এই স্বাস্থ্যে, একেবারে একাকী এই সব issue লইয়া যে struggle টা করিলাম, তাহাতে এই বয়সে আমার অতিরিক্ত মানসিক স্বাস্থ্য, শক্তি technique ইত্যাদির পরিচয় পাইতেও বেশ সাহায্য করিয়াছে। আমার সবলতা, দুর্বলতা, আদর্শ ইত্যাদির পরিচয় আমি অনেকটা পাইয়াছি।

কোন্ আদর্শ সতীন্দ্রনাথের ছিল, কোন্ প্রেরণায় তিনি সর্ব বিপদ লাঞ্ছনা বরণ করিবার জন্য সদা প্রস্তুত ছিলেন?

“আমরা আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য যে মনোবল, সংকল্প, অধ্যবসায়, সাহস প্রভৃতির প্রয়োজন (সত্য ও অহিংসার দরকার), organisation আয়োজনের যে প্রস্তুতির প্রয়োজন, তাহার capacity আছে কি? Moslem majority যেখানে পাকিস্তানে তাঁহাদের চেনা, বোঝা তাঁহাদের ধর্ম, কৃষ্টি, ইতিহাস প্রভৃতি–সবলতা, দুর্বলতা, খুব ভাল করিয়া হৃদয় দিয়া, বুদ্ধি দিয়া, বুঝিয়া তাহাদের ভালবাসিতে হইবে।” “এদের কল্যাণ চাই–এরা আমার অকল্যাণ চায় ভুলে, এতে এদেরই লোকসান। গান্ধীজীকে, Jessus Christ কে তাহাদের স্বদেশবাসী হত্যা করিল। এই tragedy তো জীবনে আছে–একে boldly face করিতে হইবে। সুতরাং মানুষের এই পথ–এতেই দেশের এবং বিশ্বের কল্যাণ।”

এই তো ছিল মানুষের মত মানুষের উক্তি।

মহানির্বাণ

১২ই মার্চ সতীন্দ্রনাথকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আনয়ন করা হইল। এবং ১৩ই মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করান হইল। ১১ই মার্চ ঢাকা জেল হইতে লিখিত তাঁহার শেষ পত্র শ্রীযুক্ত বসন্তকুমার দাশ মহাশয় ১৮ই মার্চ পান। তাহাতে লিখিত ছিল সতীন্দ্রনাথের সহিত অবিলম্বে সাক্ষাৎ করিবার কথা। অবশ্য তিনি সতীন্দ্রনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান ২৫শে মার্চ রাত্রি ১১টার সময়–যখন সতীন্দ্রনাথ ছিলেন মরণের প্রতীক্ষায় অচৈতন্য। একজন আই বি-র লোক তাঁহাকে সংবাদ দিল যে সতীন্দ্রনাথকে মুক্ত করা হইয়াছে, এখন হাসপাতালে দেখিতে যাইতে পারেন। অচৈতন্য সতীন্দ্রনাথকে তখন oxygen দেওয়া হইতেছিল। তাঁহার বুকের উপর একটুকরা কাগজে তাঁহার মুক্তি-সংবাদ লিখা ছিল। যখন এই তথাকথিত মুক্তি দেওয়া হয় যখন তিনি ছিলেন জ্ঞানহীন–শেষ নিঃশ্বাসের প্রতীক্ষায়।

রাত্রি প্রায় দেড় ঘটিকার সময় তাঁহার শেষ নিঃশ্বাস মহাঅনন্তে মিলাইয়া গেল। শেষ মুহূর্তে শয্যাপার্শ্বে কেহ ছিল না, কেহ দেখিল না–কেহ চোখের দুই ফোঁটা অশ্রু পর্যন্ত বিসর্জন করিতে পারিল না।

সংবাদ পাইয়া পর দিবস প্রাতে তাঁহার ঢাকার বন্ধু-বান্ধবগণ মৃতদেহ আনয়ন করিবার জন্য কলেজ হাসপাতালে আসিলেন। মৃতদেহ তখন পাঠানো হইয়াছে মর্গে। সত্যাগ্রহীর crucification পরিপূর্ণ হইল। চির বিদ্রোহী বিপ্লবী বীর সতীন্দ্রনাথ দেশের পুঞ্জীভূত হলাহল পান করিয়া মৃতুঞ্জয়ী হইলেন। একটি অগ্নিশিখা নিজে জ্বালিয়া পার্শ্ববর্তী অন্ধকার দূর করিয়া সুদূরপ্রসারী দীপ্তি ছড়াইয়া মহাকালের কোলে আবার নিভিয়া গেল।

অবশেষে

[মৃতুঞ্জয়ী সতীন সেন]

আজ শুধু এ প্রশ্নই রহিল উদগ্র হইয়া–কেন এ মৃত্যু, কার বা কাহাদের উপেক্ষায় এ দুর্দৈব, কি সে হেতু যাহাদের জন্য বাংলার মুক্তি সাধক সর্বত্যাগী বিপ্লবী অসহায় বন্দীরূপে তিলে তিলে কারাগারের মধ্যে আপনাকে ক্ষয় করিয়া হীনতর ব্যবস্থা ও উপেক্ষার মধ্য দিয়া লোকলোচনের অন্তরালে নিঃশব্দে ঝরিয়া গেল।

একটি আত্মীয় রহিল না শয্যাপার্শ্বে, আকুল আর্তি উঠিল না কোন স্বজনের বিহ্বল কণ্ঠে, কাহারও এক ফোঁটা অশ্রুজল সেই গতাসু মানবকে শেষ তর্পণে তৃপ্ত করিল না।

প্রদীপ নিভিয়া গেল।

সেদিন মৃত্যুশয্যার পাশে ছিলেন কয়েকটি ছাত্র ও কয়েকটি সেবক–নিতান্ত অপরিচিত ও অজ্ঞাত। সেদিন তাঁহাদেরই একজন কৌতূহলী কণ্ঠে প্রশ্ন করিয়াছিলেন বিদায়ী বীরকে-

“আপনার কি কেউ নেই?”

রোগকাতর দেহে প্রসন্ন হাস্যে উত্তর দিয়াছিলেন এই মুক্তি-পূজারী—”আমার সবাই আছে–মৃত্যুর পর জানতে পারবে।”

সত্যই সেদিন তাঁহার কেহ ছিল না–যাঁহার সবাই ছিল।

মৃত্যুর পরও সে এক নির্মম পরিহাস–অভিনব প্ৰহসন।

২৬শে মার্চ একটি প্রেসনোটে পূর্ববঙ্গ সরকার প্রচার করলেন–”অসুস্থতার জন্য শ্রীসতীন্দ্রনাথ সেনকে গতকল্য (২৫শে মার্চ) মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির অব্যবহিত পরেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া শ্রীযুক্ত সেনের মৃত্যু হয়–ইহা খুবই দুঃখের সংবাদ এবং গভর্নমেন্ট এজন্য দুঃখ প্রকাশ করিতেছেন।”

অথচ মৃতদেহ আনয়ন করিবার সময়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যে death certificate দেওয়া হয় উহাতে উল্লেখ থাকে–”Satindra Nath Sen, Security Prisoner, C/o Supdt. Dacca Central Jail. “

অর্থাৎ সতীন্দ্রনাথের তথাকথিত মুক্তি সংবাদ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের নিকট পর্যন্ত ছিল অজ্ঞাত। মৃত্যুর পর তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীদিলীপ সেন বিভিন্ন সূত্রে সংবাদ সংগ্রহ করিয়া যে বিবৃতি দিয়াছেন তাহাতে বলিয়াছেন–”ইচ্ছাকৃত অবহেলার জন্যই এই মৃত্যু হইয়াছে। সময় থাকিতে বাহিরে কাহাকেও–কোন আত্মীয় পরিজনকেও কোন সংবাদ দেওয়া হয় নাই।”-

সতীন্দ্রনাথের উপর নিষ্ঠুর অবহেলা, তাচ্ছিল্য ও হৃদয়হীন ব্যবহার তাঁহার জীবনের শেষক্ষণ পর্যন্ত করা হইল।

অসহায় বন্দীকে আত্মীয় পরিত্যক্ত অবস্থায়, নিতান্ত মনুষ্যোচিত করুণায় সাধারণে যাহা করে–সেদিনকার অসাধারণ সেই শাসকের শাসন নীতি কি সেটুকুও করিতে পারে নাই? কেন?

এ হৃদয়হীন ব্যবহারের বিবরণ আছে শয্যাপার্শ্বে উপবিষ্ট এক ছাত্রের বর্ণনায় ও এক নার্সের ভাষায়। ছাত্রটি বলিল–”একদিন সতীনবাবুকে শয্যায় মলমূত্রসহ অসহায় ভাবে শায়িত দেখা গিয়াছিল–ঐ অবস্থায় তিনি ৩/৪ ঘন্টা ছিলেন–কেহ দেখাশুনা করিবার দরকার বোধ করে নাই।” একটি পুরুষ নার্স বলিল–”একদিন সতীনবাবুকে ভাল করিয়া খাওয়াইয়াছিলাম, খাইবার পর তিনি বলিলেন, ২/৩ দিন এরকম ভাল খাইতে পারিলে তিনি সুস্থ হইয়া উঠিতেন।”

(মৃতুঞ্জয়ী সতীন সেন)

১৯৫৪ সালের পর থেকে যুক্তফ্রন্টের ইতিহাস শরিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও কলহের কালিমায় কলঙ্কিত। আওয়ামী লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টি উভয়েই কাগজে কলমে একই কর্মসূচিতে বিশ্বাসী হলেও ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির সাথে দেশের স্বার্থ বা আদর্শবাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের স্বার্থে যুক্তফ্রন্টের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে এবং যুক্তফ্রন্টের অনেক নেতাই কেন্দ্রীয় সরকারের সেই ফাঁদে পতিত হন। মুজিবুর রহমান এই ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতির সাথে কোন সম্পর্ক না রেখে দৃঢ় ভিত্তির উপর আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজেই আত্মনিয়োগ করেন। পাকিস্তানের সে যুগের রাজনীতিতে বহু মন্ত্রিসভার রদবদল হয় এবং সোহরাওয়ার্দীও প্রধানমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশগুলোকে একত্র করে ‘এক ইউনিট’ প্রবর্তন করা হয় এবং তখন স্থির হয় যে পাকিস্তানের জাতীয় পার্লামেন্ট পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে সমান সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হবে। ইহাই Parity নীতি বলে পরিচিত। জনসংখ্যার অনুপাতে যদি প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় তবে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অবশ্যম্ভাবী। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা গণতন্ত্রের এই প্রথম নীতিটি মেনে নিতে অস্বীকার করলেন। তাই পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশগুলোকে একত্র করে ‘এক ইউনিট’ গঠন করা হল এবং পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে Parity নীতি গৃহীত হল! পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থবিরোধী এবং সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এই নীতির সাথে সোহরাওয়ার্দী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকলেও শেখ মুজিবুর রহমানকে এর জন্য দায়ী করা ভুল হবে। মুজিবুর প্রথমে এই নীতি মেনে নিতে রাজী হননি। তাঁর দলের নেতা সোহরাওয়ার্দী যখন প্রতিশ্রুতি দিলেন যে Parity নীতি কেবল মাত্র প্রতিনিধির সংখ্যাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, চাকরী ব্যবসা-বাণিজ্য, মূলধন বিনিয়োগ প্রভৃতি সমস্ত ক্ষেত্রেই এই Parity নীতি গৃহীত হবে, তখন শেখ মুজিবুর দ্বিধাগ্রস্থচিত্তে তাঁর মত দিতে বাধ্য হন। দলগত রাজনীতির খাতিরে এই Parity নীতির জন্য মুজিবুরকে দায়ী করা হয়তো যেতে পারে, এবং পূর্ব বাংলার অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল আজও আওয়ামী লীগকে এর জন্য কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। কিন্তু নিরপেক্ষ ইতিহাসের বিচারে মুজিবুর রহমান এই Parity নীতির জন্য দায়ী নন। তাছাড়া তিনি একথা বারবার বলে আসছেন যে Parity নীতি সমস্ত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার কথা ছিল, কিন্তু প্রতিনিধির সংখ্যা ব্যতীত আর কোন ক্ষেত্রেই এই নীতি প্রয়োগ করা হয়নি।

এই সব প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা আরও পরে হবে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৪ সালে মে মাসের পর থেকে পাকিস্তান রাজনীতিতে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়। এই ঝড়ে কে কখন উড়ছেন আর কে কখন পড়ছেন এর হিসাব রাখা দুঃসাধ্য ছিল।

এই কলমের খোঁচায় নাজিমুদ্দিনকে সরিয়ে কেন্দ্রে মহম্মদ আলিকে প্রধানমন্ত্রী করা হল। প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলি প্রধান সেনাপতি আয়ুব খাঁকে নিয়ে গেলেন ওয়াশিংটন, ঢাকা থেকে ইস্কান্দার মীর্জা ছুটি নিয়ে গেলেন লণ্ডনে।

“Mr. Ghulam Mohammed set spies to watch what was happening at karachi when he was convalescing at abbottabad. Many of the spies were holding key posts in the administration. From them, he obtained a clear picture of the conspiracy against him, hatched and executed by the constituent assembly as a whole and by prime minister Mohammed Ali. He was furious over the ammendmant of the Government of India Act. He came down to karachi immediately but Mr. Mohammed Ali had already left for the United States.

While enjoying American hopitality during his stay in the United States, Mr. Mohammed Ali got a jolt. He got summons from the Governor General of his country to return at once. Mr. Ali cancelled his scheduled visit to Ottawa within few hours of the receiving the summons, Mr. Ali was flying over the Atlantic on his way back to karachi. At London airport Mr. Ali and general Ayub Khan were joined by General Iskandar Mirza and Mr. M. A. H. Ispahani, Pakistani High Comissioner in the U. K. They all flew to Karachi togethers. The Mauripur airport wrs heavily guarded by troops when they landed there at midnight on 23 October.

Emissaries of the Governor-General surrounded Mr. Mohammed Ali as soon as he came down the gangway of the aircraft. Mr. Ali asked his Begum Saheba who also accompanied him to go home. Like a prisoner Mr. Ali was escorted to the car and driven to the residence of the Governor-General.

What passed between Mr. Ghulam Mohammed and Mr. Mohammed Ali came to be known to the public through whispers from men who were eyewitness to their meeting. Pressmen had been to the Governor-General’s residence. They saw how Mr. Mohammed Ali went in and how he came out at 2 in the morning. They saw him weeping when he came out. Mr. Ghulam Mohammed gave him an ultimatum; “Do as I order or go to Prison.”

Reports appeared in foreign press of Mr. Mohammed Ali’s surrender to Mr. Ghulam Mohammed in preference to detention in jail as a prisoner within a few hours of his surrender, early on the morning of 24 October. “

[ Eclips of East Pakistan ]

এর পরেই গোলাম মহম্মদ মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করলেন, যে মন্ত্রিসভাকে তিনি বললেন “Ministry of talents’, যে মন্ত্রিসভায় স্থান পেলেন আয়ুব খান ও জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা। সোহরাওয়ার্দী এ সময় জুরিখে ছিলেন, তাঁকেও এই মন্ত্রিসভায় যোগদানের অনুরোধ জানানো হল। সোহরাওয়ার্দী খুব অরাজী ছিলেন না কিন্তু বাদ সাধলেন মৌলানা ভাসানী। ভাসানী বললেন যে, মহম্মদ আলী একদা অবিভক্ত বাংলায় নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার P A ছিলেন এবং যে মন্ত্রিসভায় সোহরাওয়ার্দী একজন মন্ত্রী ছিলেন তার অধীন মন্ত্রিসভায় যোগদান করা সোহরাওয়ার্দীর শোভন নয়। ভাসানী বললেন, ‘গোলাম মহম্মদ তোমাকে আইনমন্ত্রী করতে চায় কিন্তু প্রধানমন্ত্রী করবে না কেন? কিন্তু সোহরাওয়ার্দী দেশে ফিরে আইনমন্ত্রী রূপেই কেন্দ্রে যোগ দিলেন। মহম্মদ আলি তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, “The chair of the primeminister has been waiting for you, Sir.’ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী হয়ে পূর্ববাংলায় আবার পার্লামেন্টারী শাসন প্রবর্তনের উদ্যেগ নিলেন কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর উচ্চাশা যথা কেন্দ্ৰ ও পূর্ববঙ্গে ক্ষমতা দখল ১৯৫৪ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্টকে ভেঙ্গে দিল।

অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১১ই সেপ্টম্বর ১৯৫৬ মিঃ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন। মৌলানা ভাসানী নতুন মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন, দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হয়ে দলের কর্মসূচি মেনে চলছেন না।

১৩ই সেপ্টেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে সুবিশাল সভা অনুষ্ঠিত হল–যে সভার সভাপতি মৌলানা ভাসানী এবং প্রধান বক্তা ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। মৌলানা ভাসানী বললেন, কেন্দ্ৰীয় সরকার যদি পূর্ব পাকিস্তানে উপযুক্ত খাদ্য না দেয় এবং স্বাধীন গণতান্ত্রিক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে না পারে তাহলে সরকারকে পুনরায় পদত্যাগ করতে হবে। ভাসানীর সমালোচনার সোহরাওয়ার্দী সেদিন খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কিন্তু খুব বেশী জবাব সেদিন দিতে পারেন নি। প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকে ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর বিরোধ দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে। এই দুই নেতার বিরোধের মাঝে দাঁড়িয়ে একজন মাত্র নেতা প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন যাতে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীকে এক মঞ্চে রাখা যায়, দুই প্রতিভাবানকে বাংলাদেশের তথা পুর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে নিয়োগ করা যায়।

এই সময় বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সরকারকে উত্যক্ত করে তুলেছিল কিন্তু সেখানেও মুজিবুরের দৃঢ়তায় সেই দাঙ্গা দমন হয়েছিল খুবই তাড়াতাড়ি। ১৯৫৬ সালের ১লা অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান বিধান সভায় যুক্ত নির্বাচনী বিল আনা হয়। এই বিলকে সমর্থন করে মুজিবুরের বক্তৃতা আজ আবার নতুন করে স্মরণ করা দরকার।

“Saikh Mujibur Rahman supporting the joint electorate motion said that the opposition move to press for separate electorates on the basis at the two nation theory would drive the minorities to a position from where they could justifiably demand a separate homeland within pakistan. He also regretted that the post of the head of the state in pakistan should be reserved for Muslims only. He said such a communal provision in the constitution might have repercussions in India were parties like the Hindu Mahasabha might start a movement to demand reservation of the post of president of India for Hindus only. Such a movement would not be a happy one for the forty millions of Indian Muslims.

(Eclipse of East Pakistan)

সেদিন বিধান সভায় দর্শক গ্যালারী পূর্ণ ছিল আর বিধান সভার বাইরে ছিল হাজার হাজার মানুষ। মুজিবুর রহমানের বক্তৃতার পর অ্যাসেম্বলির গ্যালারী থেকে ধ্বনি উঠল, হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, আতাউর-মুজিবুর জিন্দাবাদ। পূর্ব পাকিস্তান বিধান সভায় এই যুক্তিনির্বাচনী গৃহীত হবার পর প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান রাজনীতিতে যে নূতন ভাবধারা প্রবর্তিত হল তাই থেকেই মৃত্যু ঘনিয়ে এল পাকিস্তান সৃষ্টির দ্বি-জাতি তত্ত্ব ফর্মুলার। এই ভাবধারা প্রাণবন্যা সৃষ্টির মূল ঋত্বিক ছিলেন মুজিবুর রহমান। ফজলুল হক গভর্নর ও আবুল হোসেন সরকার মুখ্যমন্ত্ৰী থাকাকালে যে শাসন-ব্যবস্থা চলছিল সেটা মূলত ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম লীগেরই নীতিবাহী। তখনই মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন সরকার গঠনের চেষ্টায় ব্রতী হন। এবং মুজিবুরের চেষ্টাতেই কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মুজিবুর এই চেষ্টা চালিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর সাহায্য ব্যতিরেকে। শুধু সরকার দখলের চেষ্টাই নয়, রাজ্যব্যাপী অনাহারী মানুষদের সংগঠিত করে বিক্ষোভ মিছিল পরিচালনা মুজিবুরের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হয়ে রয়েছে। ১৯৫৬ সালে ৪ঠা আগস্ট ভুখা মিছিল এগিয়ে এল ঢাকার পথে। দূর গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে মানুষ পায়ে হেঁটে নৌকায় করে এসে উপস্থিত হল বুড়িগঙ্গার অপর পারে। পুলিশ আগেই ১৪৪ ধারা জারী করেছিল। জিনজিরা থেকে জনতা চকবাজার পৌঁছলেই পুলিশ মিছিলের গতিরোধ করল। ক্ষুধার্ত জনতা পুলিশের বাধা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলল। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের গুলী। আহত হল অনেকে, নিহত হল ৩ জন। মুজিবুর একটি যুবকের মৃতদেহ বুকে তুলে নিয়ে পুলিশের আক্রমণে বিধ্বস্ত সেই শোভাযাত্রাকে আবার সংগঠিত করে এগিয়ে চললেন। বুলেট বিদ্ধ যুবকের দেহ থেকে রক্ত ঝরে মুজিবুরের খদ্দরের পাজামা ও শার্ট লাল হয়ে গেল।

এই খাদ্য আন্দোলনই পতন ঘটালো সরকারের। গভর্নর হক সাহেব আতাউর রহমানকে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানালেন ৪ঠা সেপ্টেম্বর। কিন্তু সেই দিনই আবার গুলী চলল ভুখ্ মিছিলের উপর। হক সাহেব জরুরী বার্তা পাঠালেন ইস্কান্দার মীর্জাকে ঢাকা চলে আসবার জন্যে। ইতিমধ্যে মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আর একটা শোভাযাত্রা বেরুলো দীর্ঘ ২ মাইল লম্বা। ছাত্ররা হরতাল আহ্বান করেছে এবং পর দিবস ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শোভাযাত্রা বের করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সোহরাওয়ার্দী সার্কিট হাউসে বসে বিভিন্ন দলনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলেন আই জি পুলিশ এ এইচ এম এস দোহাকে ১৪৪ ধারা তুলে নিতে অনুরোধ জানালেন, কিন্তু মিঃ দোহা সে অনুরোধ রক্ষা করলেন না। মিঃ দোহা মিঃ সোহরাওয়ার্দীর এককালের অতি অনুগত পুলিশ অফিসার ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৬ সালে গ্রেট ক্যালকাতা কিলিং-এর দক্ষিণ হস্ত ছিলেন দোহা। অবশ্য পরে মিঃ হামিদ আলী সহ মিঃ দোহা নতিস্বীকার করেছিলেন সোহরাওয়ার্দীর কাছে। শহর থেকে ১৪৪ ধারা তুলে নিতে হয়েছিল। ১৪৪ ধারা মুক্ত শহরে সুবিশাল শোভাযাত্রা বেরুলো। শোভাযাত্রার পুরোভাগে ছিলেন মৌলানা ভাসানী ও মুজিবুর রহমান।

৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হল। ৬ জন মন্ত্রী শপথ নিলেন। মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হলেন। ৭ই সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মহম্মদ আলী যখন পদত্যাগ করেন তখন ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনারের প্রথম সেক্রেটারী মিঃ বলদেব প্রসাদের বাড়ীতে সোহরাওয়ার্দী এক নৈশ মজলিসে ছিলেন। সংবাদ শুনে মুজিবুর রহমান বললেন “The opportunity has come when Allah could save the country form bureaucracy. রাত্র ৯টায় সোহরাওয়ার্দী ইস্কান্দার মীর্জার পাশে বসে তেজগাঁও বিমান–বন্দর থেকে করাচীর পথে রওনা হলেন কিন্তু যাবার আগে ভুলে গেলেন মৌলানা ভাসানীর কথা। বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী তাঁর দলের নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন একথা খবরের কাগজ পড়ে জেনেছিলেন। ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সাল আওয়ামী লীগের সুবর্ণযুগ, কারণ এই সময় থেকেই কেন্দ্র ও পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তভাবে ক্ষমতায় আসীন হল তারা।

১৭ই জানুয়ারী মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান ও শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী মুজিবুর রহমান দিল্লী এলেন। মুজিব দিল্লী এসে দেখা করলেন প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে। মুজিবুর ১ শিশি সুন্দরবনের মধু উপহার দিলেন রাজেন্দ্রপ্রসাদকে। মুজিবুর মধু উপহার দিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতিকে, করাচীর ‘ডন’ পত্রিকা চিৎকার করে উঠল, কঠোর শান্তি দিতে হবে মুজিবুরকে উনি মধু দিয়ে ভারতের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক স্থাপন করতে চান। আতাউর রহমান দিল্লী থেকে ফিরে এসে হতাশ করে দিলেন পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনৈতিক নেতা ও সংবাদপত্রগুলিকে। “On return from New Delhi, the chief minister, Mr. Ataur Rahman khan, disappointed the reactionary politicians and press by declaring on 24 January that he saw no evidence of any tension prevailing anywhere in India on the Indo-Pakistan dispute over Kashmir. He said, “in fact we felt that there was considerable goodwill for Pakistan among the common people of India. In many places we were greeted with slogans like “Hindi – Pak Bhai Bhai” and Pak- Bharat Moitaee Amar Houk”

[ Eclipse of East Pakistan ]

ইতিমধ্যে ২৬শে জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রাদায়িক দলগুলি কাশ্মীর দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান জানতে পারলেন এইদিন শোভাযাত্রা করে ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশনার অফিস আক্রমণ করা হতে পারে। মুজিবুর তখন মন্ত্রী যেমন তেমনি দলেরও সম্পাদক। অত্যধিক সংকটপূর্ণ মুহূর্তে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হল। তাঁর দলের মধ্যেই ভাসানী অনুগামীরা ভারতীয় হাই কমিশনারের অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখাবার পক্ষে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে শোভাযাত্রা বেরুলো। শোভাযাত্রার পুরোভাগে ছিল নেহরুর কুশপুত্তলিকা আর সেই কুশপুত্তলিকা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল ঢাকার নামকরা কিছু গুণ্ডা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন থেকে পল্টন ময়াদনে যাবার পথে শোভাযাত্রা যখন আমেরিকান দূতাবাসের সামনে এল তখন শোভাযাত্রার ধ্বনি উঠল পণ্ডিত নেহরুমুর্দাবাদ, মুর্দাবাদ। আমেরিকান দূতাবাসের কর্মচারীরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সহর্ষ বদনে শোভাযাত্রাকে অভিনন্দন জানালো, কিন্তু সমগ্র পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মুজিবুর অবস্থা আয়ত্তে রাখলেন। সাম্প্রদায়িকতা থেকে সেই মুহূর্তে দেশকে রক্ষা করতে পারলেও মুজিবুর শেষরক্ষা করতে পারলেন না। সেই ইতিহাস পরে বলছি। তার আগে আবার একবার পিছিয়ে যেতে হবে সেই ১৯৫৪ সালের পরের ইতিহাসের গতিপথে।

.

মীরজাফরের বংশধর বলে পরিচিত জনাব ইস্কান্দার মীর্জার কোনদিনই গণতান্ত্রিক রাজনীতি বা দলের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। কৃষক–শ্রমিক দলকে পূর্ববঙ্গে মন্ত্রিসভা গঠন করার সুযোগ দিয়েও কেন্দ্রে এই দলের প্রতিনিধিদের মন্ত্রিত্বে বসিয়ে (যেমন জনাব ফজলুল হক সাহেবকে) এই দলের নেতাদের রাজনৈতিক চরিত্র হননের ব্যবস্থা ইস্কান্দার মীর্জা গভর্নর জেনারেল হিসাবে করেছিলেন। এবার প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণের পর তাঁর দৃষ্টি পড়ল আওয়ামী লীগের উপর। পূর্ববঙ্গের আওয়ামী লীগ ছিল বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিভীষিকা।

ইস্কান্দার মীর্জা তাঁর আওয়ামী লীগ তোষণের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে এই দলের নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী করে দিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানেও কৃষক-শ্রমিক দলের আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভাকে খারিজ করে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আতাউর রহমানকে দিয়ে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যবস্থা করলেন। ১৯৫৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর জনাব আতাউর রহমান শপথ গ্রহণ করলেন। তাঁর মন্ত্রিসভায় যাঁরা যোগ দিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান–এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মীর্জা জানতেন যে তাঁর প্রধান শক্তি অবাঙালী আমলাতন্ত্র ও পাঞ্জাবী ফৌজ। তাই আওয়ামী লীগের অটোনমির দাবীতে তিনি মোটেই ভীত হননি। প্রেসিডেন্ট মীর্জার ধারণা ও কুটনীতি ছিল এই যে আওয়ামী লীগকে একবার ক্ষমতার আসনে টেনে আনতে পারলেই প্রথমে কৃষক-প্রজা পার্টি এবং যুক্তফ্রন্টের অন্যান্য শরিক দলগুলির সঙ্গে তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাবে এবং ক্রমে এই বিষ ছড়িয়ে পড়বে আওয়মী লীগের নিজের নেতৃত্ব ও সংগঠনেও। ইন্দান্তার মীর্জার ট্র্যাটেজি আশ্চর্যজনভাবে সফল হলো। তাঁর মোক্ষম চালে আওয়ামী লীগ কিছুদিনের মধ্যেই দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল।

প্রেসিডেন্ট মীর্জা যা চেয়েছিলেন যা ভেবেছিলেন তাই হলো। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কৃষক-শ্রমিক দলের মধ্যে চরম বিবাদ বেঁধে গেল। যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গে যে গণ-ঐক্য গড়ে উঠেছিল কলুষিত তা ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেল। গৃহবিবাদ পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক জীবনকে কুলষিকা করে তুলল। শুধু তাই নয়–আওয়ামী লীগের মধ্যেই অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল।

আওয়ামী লীগ জনসাধারণকে বারবার এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে এই দল পাক-মার্কিন চুক্তির বিরোধিতা করবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকমার্কিন চুক্তিকে ধিক্কার জানিয়ে পূর্ববঙ্গে বহু সভা, শোভাযাত্রা এবং সম্মেলন হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়েই শহীদ সোহরাওয়ার্দী দলের এই নীতিকে অগ্রহ করে পাক-মার্কিন চুক্তিকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেন। এর ফলে শুরু হল ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী দ্বন্দ্ব। আওয়ামী লীগের দুই প্রধান মৌলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর কলহ এক সময় এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছাল যে তাঁদের কথা বলা এমনকি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে গেল। চতুর সোহরাওয়ার্দী গদীআটা নেতাদের বেশীর ভাগকে হাত করলেও জনতা ছিল মৌলানা ভাসানীর পক্ষে।

১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে মৌলানা ভাসানী স্থির করলেন যে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি তাঁর স্বগ্রাম ময়মনসিংহের কাগমারীতে একটি সম্মেলন আহ্বান করবেন। মূলত এই একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন হলেও এখানেই হবে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী নায়ক সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে তাঁর চূড়ান্ত বোঝাপড়া।

১৯৫৭ সালের জানুয়ারী মাসে একটি ঘোষণায় মৌলানা ভাসানী কাগমারীর পথের ইঙ্গিত দিলেন। একটি ঘোষণায় তিনি বলেন যে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে অসংখ্য পূর্ববঙ্গবাসী তাঁর কাছে চিঠি পাঠাচ্ছেন। তাঁদের অভিযোগগুলির মধ্যে প্রধানত ছিলঃ

(ক) যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক একুশ দফার অন্যতম দাবী পূর্ব-বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের জন্য আওয়ামী সরকার চেষ্টা করছে না কেন?

(খ) বাঙালীদের উপেক্ষা করে কেন শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিদেশে দূত করে পাঠানো হচ্ছে।

(গ) সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালীদের সংখ্যা শতকরা মাত্র চারজন।

পূর্ব পরিকল্পনামত মৌলানা ভাসানী কাগমারীতে জনাব সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে শেষ পাঞ্জা কষবার আয়োজন করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনার সংবাদ যাতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তার জন্য সারা পৃথিবীর সাংবাদিকদের সঙ্গে বিদেশী দূতাবাসগুলিকেও মৌলানা ভাসানী এই সম্মেলনে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আর এই সম্মেলনের তিনি নামকরণ করেছিলেন আফ্রো-এশিয়ান সাংস্কৃতিক সম্মেলন। সামাগ্রিকভাবে এশিয়া ও আফ্রিকার স্বাধীন দেশগুলি যে কোন রকমের যুদ্ধ-জোটের বিরোধী। অথচ পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দী যুদ্ধ-জোটের পক্ষে ওকালতির একজন কৌসুলী। রাজনীতির ক্ষেত্রে সোহরাওয়ার্দীকে নাস্তানাবুদ করতে হলে তাঁকে এ রকমই একটি আসরে এনে নামিয়ে দিতে হয়। কাগমারী সম্মেলনের নাম আফ্রো-এশিয়ান সাংস্কৃতিক সম্মেলন করার পিছনে মৌলানা ভাসানীর তেমনি একটা উদ্দেশ্য হয়ত ছিল।

তবে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে মৌলানা ভাসানীর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল একেবারে স্পষ্ট। তিনি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবিদ্বেষ, ঘৃণার ঊর্ধ্বে দাঁড়ানো মানবতাবাদী নায়ক। যে সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, কাগমারীতে ভাসানী যেন সেই ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।

এই মানবতাবাদী, এই অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যই টাঙ্গাইল থেকে কাগমারী পর্যন্ত শহরের উপর যে সব তোরণ নির্মিত হয়েছিল তার সঙ্গে তিনি কায়েদে আজম মহম্মদ আলি জিন্নাহ, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লেলিন, শেক্সপিয়ার, আব্রাহাম লিঙ্কন প্রভৃতির নাম যুক্ত করেছিলেন। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। শোনা গেল যে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমুন্ত্রী হিসাবে নয়, অখণ্ড বাংলার একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক হিসাবে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নামেও তিনি একটি তোরণের নাম করণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর উপদেষ্টাদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত মৌলানা ভাসানী এ সংকল্প ত্যাগ করেন।

মৌলানা ভাসানী নিজেই এই সম্মেলনকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন–কাগমারীর সড়ক, –বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতার সড়ক।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে পশ্চিম বাংলা থেকেও একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল কাগমারী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শ্রীতারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। পশ্চিম বাংলার অন্যতম অন্যান্য প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন শ্রীপ্রবোধকুমার সন্যাল, শ্রীহুমায়ুন কবীর প্রমুখ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনের দিকপালরা।

১৯৫৭ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী কাগমারীতে স্থানীয় এক হিন্দু মহারাজার নাটমন্দিরে আওয়ামী সদস্যদের বৈঠক বসল। মৌলানা ভাসানী অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘আমি আমার জান দিয়ে যুদ্ধ-জোটের বিরোধিতা করব। কেউ যদি আমাকে দিয়ে জোর করে এ চুক্তি মানিয়ে নিতে চান তবে আমি কবর থেকেও চেঁচিয়ে উঠবঃ না-না-না, ওই সর্বনেশে যুদ্ধ- জোটের পক্ষে আমি নই।’ মৌলানা ভাসানী যখন বক্তৃতা করছিলেন তখন বিদেশী পোষাকে সজ্জিত প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাশে বসেছিলেন–মুখ চিন্তামগ্ন, ভ্রুকুঞ্চিত। মৌলানা ভাসানী এবার সোহরাওয়ার্দীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আওয়ামী লীগের সমবেত প্রতিনিধিদের বললেন, ‘আপনারা যাঁরা দলের মেরুদণ্ড, গরীবের রক্ত জল করে যাঁরা দল গড়েছেন, তাঁরা বড় না বড় এই ভদ্রলোকটি? আপনারা শহীদকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করেছেন– তাই তিনি আজ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আপনারা তাঁর পিছন থেকে সরে গেলে এ ভদ্রলোককেও সরে যেতে হবে। তাই আপনাদের নির্দেশ পার্টির সদস্য হিসাবে এঁকে মানতেই হবে।’ মৌলানা ভাসানী বললেনঃ পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগ যুদ্ধ-জোটের বিরোধিতা করে ১৯৫৩ সালে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। তারপর প্রতি বছর প্রতি অধিবেশনে সে প্রস্তাবের প্রতি জানিয়েছেন গভীর শ্রদ্ধা। আওয়ামী লীগ আজ তাই সে প্রস্তাব থেকে সরে দাঁড়াতে পারে না।’

জনাব সোহরাওয়ার্দীর প্রতি একবার বক্র দৃষ্টি হেনে বৃদ্ধ মৌলানা আবার বললেনঃ ‘এই ভদ্রলোক প্রচার করছেন যে তাঁর হাতে পড়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি নাকি অনেকখানি সফল হয়েছে। কাশ্মীর প্রশ্ন তিনি নাকি আবার নতুন করে তুলছেন। কথার উপর ট্যাক্স নেই। অনেক লোকে কথা বলতে পারেন, তার জন্য ট্যাক্সকড়ি লাগে না। এই ভদ্রলোকও তেমনি বাক্য ব্যয় করছেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজ শক্তিগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আফ্রো-এশিয়ান জাতি গোষ্ঠীর বিশ্বাস হারানোর নাম কি পররাষ্ট্র-নীতির সাফল্য? নিজের ভাবনা নিজের চিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে পরের ডিকটেশনে চলার নাম কি প্রগতি? এই ভদ্রলোক কি নিজের বুকে হাত দিয়ে সেকথা বলতে পারেন? ভদ্রলোক বলেছেন, কাশ্মীর প্রশ্নটিকে তিনি আবার খুঁচিয়ে তুলেছেন তার উত্তরে আমি যদি বলি যে এদেশের এক শ্রেণীর রাজনৈতিক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে কাশ্মীর-সমস্যার নাম করে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছেন–আমার পাশে বসা ভদ্রলোক তার কি জবাব দেবেন? সে জবাব তাঁর কাছ থেকে আপনারা দাবী করুন।’

মৌলানা ভাসানীর তীব্র কষাঘাতে বিপর্যস্ত জনাব সোহরাওয়ার্দী তাঁর তুণের মোক্ষম অস্ত্র ছাড়লেন। বললেন : পদত্যাগ করব।’ একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান লাফিয়ে উঠে বললেন, “স্যার, আপনাকে আমরা ছাড়ব না, ছাড়তে পারি না।’

যা হোক–ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাকিস্তান সরকারের বৈদেশিক নীতি ও সামরিক চুক্তির নিন্দা করে পূর্বে কাগমারী অধিবেশনে গৃহীত এবং সংসদের অধিবেশনে সমর্থিত প্রস্তাব গ্রহণ করেন। উক্ত বৈদেশিক নীতি ও সামরিক চুক্তি লঙ্ঘনকারী যে কোন সদস্যের প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বনে সম্পূর্ণ ক্ষমতা দলের সভাপতি মৌলানা ভাসনীর উপর অর্পণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ও সভাপতির শক্তিদানের ক্ষমতা সম্বন্ধে মৌলানা ভাসানী স্বয়ং এবং অন্যান্য সংসদ সদস্যরা আন্দোলন শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর পাকিস্তান সরকারের নীতি সমর্থক খসড়া প্রস্তাবটি সদস্যরা নাকচ করে দেন।

কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এই নির্দেশ দেওয়া হয় যে শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প -খনিজ-শ্রম দপ্তরের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তাঁকে যে কোন একটি পদ ত্যাগ করতে হবে ১৯৫৭ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে। সংগঠনের কিছু কিছু সংশোধনের জন্য ৭ জুন আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহক সমিতির নির্বাচন স্থির করা হয়। কাউন্সিল দাবী করল যে কেন্দ্রীয় কোয়ালিশন সরকারের পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দানের দ্বারা পূর্ব ও পশ্চিমের পার্থক্য দূর করা উচিত।

কাগমারীর দুই দিবসব্যাপী সম্মেলনের পর অবস্থার ব্যাখ্যা করার জন্য মৌলানা ভাসানী সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন। এই বিবৃতিতে যথেষ্ট তাৎপর্য ছিল, কারণ আওয়ামী লীগের সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ভাসানীর বিরুদ্ধে সোহরাওয়াদীর পক্ষপাতী। মৌলানা বললেন, “১৯৫৬ সালের মে মাসের সিদ্ধান্ত বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। পার্টি কাউন্সিল আমাকে ক্ষমতা প্রদান করেছে যে, যে কোন সদস্য, মন্ত্রী, এম পি অথবা এন পি এ যাই হোক না কেন তিনি যদি পার্টির সিদ্ধান্ত অমান্য করেন তবে আমি যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ কতে পারব।”

মিঃ সোহরাওয়ার্দী কাগমারী থেকে ঢাকায় এসে সোজা করাচী চলে গেলেন। পরদিন সকালে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের সময়’ লবিতে সাংবাদিকদের কাছে তিনি বললেন,

“শতকরা ৯৮ জন সদস্যই আমাদের সরকারের বৈদেশিক নীতি অনুমোদন করে।” এছাড়াও তিনি দাবী করেন যে সদস্যরা তাঁর প্রতি আহ্বান এবং বৈদেশিক নীতি সম্বন্ধে কাউন্সিলে কোন প্রস্তাবই ওঠে নি। এ ছাড়া তিনি আরও বলেন যে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের অর্থই হল পূর্ব পাকিস্তানের ৯২ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন লাভ।

মৌলানা ভাসানীর চল্লিশ বৎসরের রাজনৈতিক জীবনে এই সময়টা খুব সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে। ভারতীয় কবি লেখকদের পাকিস্তানে নিমন্ত্রণ এবং কিছু কিছু স্তম্ভ ইত্যাদির ভারতীয় নেতাদের নামে নামকরণ করা ইত্যাদি ভাসানীর বিপক্ষীয়দের কাছে বেশ বড় একটা অজুহাত হয়ে ওঠে।

মৌলানা ভাসানী বলেন, নিপীড়িত জনগণের দাবী আদায়ের সংগ্রাম যদি ষড়যন্ত্র হয় তবে কাগমারী সম্মেলনে তো প্রধানমন্ত্রী এবং উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সেখানেই একথা উত্থাপন করেন নি কেন? তিনি জনসাধারণকে সতর্ক করেন প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে।

কাগমারী বিতর্ক যখন চুড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে তখন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মিঃ হোরেস এ হিন্ড্রেথ ১৮ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা প্রেসক্লাবে বলেন যে, ‘সিটো’ চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা কোন সদস্য রাষ্ট্র–সে পাকিস্তান হলেও কমিউনিষ্ট আক্রমণ ছাড়া অন্য কোন আক্রমণেই সাহায্য করতে বাধ্য নয়। মিঃ সোহরাওয়ার্দীর কাছে এটা একটা আঘাত হানল।

কাগমারী সম্মেলনের পর করাচীর জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সরকারের বৈদেশিক নীতি অনুমোদিত হল। এই বৈদেশিক নীতি আওয়ামী লীগের সমর্থন পায়নি আগেই বলা হয়েছে। গণতন্ত্রী এম পি মিঃ মহম্মদ আলি একাই সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধতা করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা করলেন। তিনি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারী গ্রুপের নির্দেশ নাকচ করে দিলেন। তিনি জাতীয় পরিষদে কোনপ্রকারে তাঁর বক্তব্য রাখার সুযোগ না পেয়ে অধিবেশনে যোগদানে থেকে বিরত হয়ে ঢাকায় ফিরে গেলেন। অধিবেশনে ভোট গ্রহণের আগেই আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান করাচী ত্যাগ করেন। কেন্দ্রের কোয়ালিশনে ভাসানীর সমর্থক নামেমাত্র থাকেন। আতাউর রহমান বা মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতি খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, কারণ, কোয়ালিশনের সংখ্যাগুরু শরিক রিপাবলিকান দল। এবং বিরোধী পক্ষের মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক দল ও নেজাম-ই-ইসলাম দল সকলেই ছিল মিঃ সোহরাওয়ার্দীর বৈদেশিক নীতির সমর্থক। ঢাকায় ফিরে আতাউর রহমান ও মুজিবুর রহমান বললেন যে তাঁরা মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য ঢাকায় এসেছেন–পরিষদে ভোট দেওয়ার অনিচ্ছার জন্য নয়। তাঁরা বললেন, তাঁরা মিঃ সোহরাওয়ার্দীর বৈদেশিক নীতির সমৰ্থক।

৩রা এপ্রিল এক বেসরকারী অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিকাংশ সদস্য পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সমর্থন করায় মৌলানার এক বিরাট রাজনীতিক জয়ের সূচনা হয়। শেষ মুহূর্তে শেখ মুজিবুর এই সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন জানালেন। বিরোধীপক্ষের দলপতি মিঃ আবু হোসেন সরকার পর্যন্ত এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন।

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এল তীব্র বিরোধিতা। আভ্যন্তরীণ মন্ত্রী মিঃ গোলাম আলী খান তালপুর জানলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা এবং পশ্চিবঙ্গের সঙ্গে সংযুক্তির কোন আন্দোলনকে বজ্রকঠোর হস্তে দমন করবে। প্রধানমন্ত্রী মিঃ সোহরাওয়ার্দী বললেন, পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের এটা একটা চাল। প্রকৃতপক্ষে জনসাধারণ এর অর্থ ও বোঝে না এবং এ জাতীয় কোন আন্দোলনের বিরোধিতা করার জন্যও তিনি তাঁদের আহ্বান জানালেন।

কাগমারী সম্মেলনের পর মৌলানা ভাসানী বগুড়াতে এক কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন। তিনি বললেন, দেশে কৃষকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের ৮৫ শতাংশ ভোটেই সরকার নির্বাচিত হয়েছে। অথচ শোষণের ফলে তাদের অবস্থা অত্যন্ত হীন, জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্ন। অতএব যদি খাদ্যসামগ্রীর মূল্য বাড়তে থাকে তবে ১লা জুন তারিখ থেকে তিনি অনশন করবেন। সম্মেলন শুরু হলে মৌলানা আসন গ্রহণ করবার সময় তখন একটা সংঘর্ষ হয় সমবেত জনতার মধ্যে। কিছু সোহরাওয়ার্দী-পন্থী লোক সম্মেলন পণ্ড করবার জন্য প্রশ্ন করতে শুরু করে। ইঁটপাটকেল ছোঁড়া শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত ৯ জন আহত হয়। মৌলানা ভাসানী স্থির ও অবিচল থাকেন–বলেন, মিঃ সোহরাওয়ার্দী আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকে ‘স্টান্ট’ বলাতে তিনি মর্মাহত হয়েছেন।

পূর্বে স্থিরীকৃত ১লা জুন থেকে মৌলানা ভাসানী দেশের দুর্ভিক্ষ ও অভাবের জন্য আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে অনশন শুরু করেন। ইতিমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের মধ্যের বিভিন্ন পদ অধিকারের দ্বারা আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে ভাসানী-পন্থী সোহরাওয়ার্দী- বিরোধী ব্যক্তিদের বিতাড়িত করার অভিযান চালাচ্ছিলেন। ৩রা জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী সমিতির সভায় পার্টির অরগ্যানাইজিং সেক্রেটারী মিঃ ওলি আহাদ, যিনি গত ৩১শে মার্চ থেকে মুজিবুরের সমালোচনা করার জন্য সাসপেনডেড ছিলেন, তাঁকে তিন বছরের জন্য পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হল।

মৌলানা ভাসানী মার্চ মাস শেষ হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ ত্যাগের জন্য জানিয়েছিলেন–কারণস্বরূপ তাঁর বার্ধক্যের উল্লেখ করেন। শেখ মুজিবুর কিছুদিন গোপন রাখলেও ওলি আহাদকে বহিষ্কারের পরই দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এই বহিষ্কার আদেশের প্রতিবাদে উপস্থিত ২১ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জন পদত্যাগ করেন।

দলের অভ্যন্তরে এই মতভেদের কারণ প্রকৃতপক্ষে তার মূলভিত্তিতে ছিল। নেতারা পার্টির আদর্শই বিস্মৃত হচ্ছিলেন। ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং মিঃ সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের মূল আদর্শের কিছু পরিবর্তন করাতে চাইছিলেন। সুতরাং বিরোধ অনিবার্য হয়ে উঠল।

শেখ মুজিবুর রহমানের ওয়ার্কিং কমিটির ৫ই জুনের সভায় ঘোষণা করা হল ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকাতে আওয়ামী লীগের পরবর্তী বৈঠক হবে। এখানে সভাপতির ক্ষমতা হ্রাস ও ২৫ জন সদস্যকে ওয়াকিং কমিটিতে নেওয়ার প্রস্তাব করে দলের সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে। এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে শেখ মুজিবুর ও মৌলানা ভাসানীর বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। ঘোষণায় আরো বলা হল কাউন্সিল মিটিংয়ের শেষে মৌলানা ভাসানীর পদত্যাগপত্র বিবেচনা করা হবে।

৫ই এপ্রিল মৌলানা ভাসানী সাংবাদিকদের বলেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবীকে ‘স্টান্ট’ বলার জন্য তিনি মর্মাহত। সাংবাদিকদের তিনি কিছু কাগজ দেখান যা তিনি গত কয়েক বছর বহন করে বেড়াচ্ছেন। ঐ কাগজে ১৯৫৫ সালের ২৬শে এপ্রিল মিঃ সোহরাওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী ছিলেন তখনকার ২১ দফা কর্মসূচীর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের খসড়ায় স্বাক্ষর করেছিলেন। তাঁর স্বাক্ষরিত লেখার বয়ানটি এইরূপঃ “I hereby declare that I shall try my utmost to get the 21 – point of the united front programme and joint electorate by the constituent convention, so far as the proposal affects the constitution. On failure to do so, I shall resign from the ministry.”

মৌলানা ভাসানী একদা অধৈর্য হয়ে পার্টির সম্পাদক শেখ মুজিবুরকে জানালেন যে কেন্দ্রে ও পূর্ববঙ্গে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী দলের নেতারা বিশেষ করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী দলের আদর্শ ও একুশ দফার কার্যসূচি বার বার লঙ্ঘন করে চলেছেন, বিদেশী শক্তির সঙ্গে দেশের গাঁটছড়া বেঁধে দিচ্ছেন। কাজেই তিনি এবার নিজের পথে চলবেন তাতে ফল যাই হোক।

১৯৫৭ সালের ২৫শে জুলাই ঢাকার সদরঘাটে সিনেমা হলে মৌলানা ভাসানীর উদ্যোগে পাকিস্তান গণতন্ত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হোল। এতে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের দুই অংশের প্রায় বারশো প্রতিনিধি যাঁর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফুর খান। এই সম্মেলনেই আওয়ামী লীগ দু-খণ্ডে ভাগ হয়ে গেল। মৌলানা ভাসানীর অনুগামীরা গঠন করলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। পূর্ববঙ্গের তরুণ ও আদর্শবান কর্মীরা আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এই দুটি দলের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেল।

প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার দল ভাঙ্গার রাজনীতি আশাতীতভাবে সফল হল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি যে শুধু বিভিন্ন দলের পরস্পরের বিবাদে কলঙ্কিত হল তাই নয়, আওয়ামী ও ন্যাশলান আওয়ামী পার্টির দ্বন্দ্বেও পূর্ববঙ্গের মানুষ ক্ষুব্ধ, বিভ্রান্ত ও অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ল। অবশ্য এই দুঃসময়ের মধ্যেও আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অন্তত একটি মূল বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বৈপ্লবিক লক্ষ্যকে সুনির্দিষ্ট রাখার চেষ্টায় তৎপর থাকে। এই দুটি বামপন্থী দল অবিরত বলতে থাকে যে ১৯৫৬ সালের পাক শাসনতন্ত্রে পূর্ববঙ্গের গণতান্ত্রিক অধিকার বিলুপ্ত হয়েছে, পুর্বাঞ্চলকে পশ্চিম-পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত করা হয়েছে এবং পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবী অস্বীকৃত হয়েছে।

পুর্ববঙ্গের গণ-আন্দোলন ও গণ-সংগঠনের মেরুদণ্ড এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বিরোধী প্রবল বিক্ষোভকে সম্পূর্ণ চূর্ণ করে দিতে কৃতসংকল্প ইস্কান্দার মীর্জা একটির পর আরেকটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে বহাল ও বরখাস্ত করতে শুরু করলেন। ১৯৫৭ সালের ১১ই অক্টোবর তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে বিতাড়িত করে জনাব চুন্দ্রীগড়কে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসালেন। তের মাস গদীতে থাকার পর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পতন ঘটল। সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট মীর্জা একটি অভিযোগ খাড়া করলেন যে তিনি নাকি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিরোধী আন্দোলন ক্রমশই জোরদার হয়ে উঠেছিল এবং পশ্চিম পাকিস্তান আইসভার অধিকাংশ সদস্য এক ইউনিট ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনের ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়ার দাবী জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ গণতন্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে গৃহীত এই প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে দিলেন প্রেসিডেন্ট মীর্জা। এইভাবে পাকিস্তানের উভয় অংশেই রাজনৈতিক সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেশে সামরিক একনায়কত্ব আসন্ন হয়ে এসেছে, এই কানাঘুষো ক্রমশ প্রবল হতে থাকে। পাকিস্তানের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক দল ও রাজনৈতিক নেতাদের জনসাধারণের অনাস্থাভাজন এবং হেয় প্রতিপন্ন করে নিজের ডিকটেটরি শাসন কায়েম করবার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট মীর্জা। পূর্ববঙ্গে কৃষক শ্রমিক দলের জনাব আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিত্বকালে একবার এবং পরে আওয়ামী লীগের জনাব আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিত্বের সময় আরেকবার খাদ্য সরবরাহ ও সীমান্তের চোরাকারবার রোধের নামে পূর্ববঙ্গের শাসনব্যবস্থা সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে জনসাধারণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে প্রাদেশিক মন্ত্রীরা সর্বশক্তিমান নন, প্রেসিডেন্টের হাতের পুতুল মাত্র।

প্রেসিডেন্ট মীর্জার এই ধরনের স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচারিতা দেখে মুসলিম লীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব আবদুল কাইয়ুম খান ক্ষুব্ধকন্ঠে বললেনঃ “আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট যে দেখছি সব ব্যাপারেই মাথা গলান।’ পূর্ব পাকিস্তান থেকে সমস্বরে জনপ্রিয় আওয়ামী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান খানও তীব্র শ্লেষের সঙ্গে মন্তব্য করলেনঃ ‘আজকের দিনে পাকিস্তানের সর্বপ্রধান সমস্যা হলেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা।’

ইতিমধ্যে জনাব চূন্দ্রীগড় প্রধানমন্ত্রীর গদী থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন পাঞ্জাবী জমিদার নন্দন এবং প্রবীন রাজনীতিবিদ মালিক ফিরোজ খাঁ নুন। ১৯৫৮ সালের মার্চ এপ্রিল মাসে পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটির পর আরেকটি নাটকীয় ঘটনা ঘটতে লাগল। এ ধরনের রাজনৈতিক উথাল পাথালের নজির সারা পৃথিবীর পরিষদীয় রাজনীতির ইতিহাসে মেলা দুষ্কর।

৩১শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন রাজ্যপাল জনাব ফজলুল হক সাহেব মুখ্যমুন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও তাঁর মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে কৃষক প্রজাদলের নেতা আবু হোসেন সরকারকে (ইনি ইতিপূর্বেও কিছুদিন পূর্ববঙ্গের মুখমন্ত্রী ছিলেন) মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করলেন। আওয়ামী মন্ত্রিসভার আকস্মিক পদচ্যুতিতে ক্ষুব্ধ শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেদিনই গভীর রাত্রে করাচীতে প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনকে টেলিফোন করে ভয় দেখালেন যে আধঘন্টার মধ্যে তিনি যদি ফজলুল হক সাহেবকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের পদ থেকে না সরান তবে তিনি কেন্দ্রে আওয়ামী দলের সদস্যদের নির্দেশ দেবেন যে তাঁরা যেন নুন মন্ত্রিসভাকে আর সমর্থন না করেন। মালিক নুন জনাব সোহরাওয়ার্দীর ভীতির প্রদর্শনকে উপেক্ষা করতে পারলেন না, কারণ তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে আওয়ামী সদস্যদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবার অর্থ হোল তাঁর পতন। তাই মালিক নুন উপায়ন্তর না দেখে জনাব সোহরাওয়ার্দীর দাবীর কাছে আত্মসমৰ্পণ করতে বাধ্য হলেন। তিনি শহীদ সাহেবের টেলিফোন পাবার চার ঘন্টার মধ্যে জনাব ফজলুল হককে পদচ্যুত করলেন। চীফ সেক্রেটারী জনাব হামিদ আলী অস্থায়ী গভর্নর নিযুক্ত হলেন।

পররদিনই অর্থাৎ ১লা এপ্রিল জনাব হামিদ আলী মুখ্যমন্ত্রী জনাব আবু হোসেন সরকারকে বরখাস্ত করলেন। আবু হোসেন সরকারের ১২ ঘন্টার মন্ত্রিসভার পতন ঘটলো–শুধু ৩১শে মার্চ রাত্রিটুকু তিনি মুখমন্ত্রী ছিলেন। এতক্ষণ স্থায়ী মন্ত্রিসভার কথা ইতিপূর্বে আর কেউ শুনেছেন কিনা জানি না।

এর পরই অস্থায়ী রাজ্যপাল হামিদ আলি পুনরায় জনাব আতাউর রহমান খানকে মুখমন্ত্রী নিযুক্ত করে তাঁকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আহবান জানালেন। অর্থাৎ চব্বিশ ঘন্টার চেয়েও কম সময়ের মধ্যে জনাব আতাউর রহমান খান তাঁর হাতে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ফিরে পেলেন। ঠিক যেন আরব্যরজনীর একটি কাহিনী! কিন্তু ১৮ই জুন আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার আবার সংকট ঘনিয়ে এলো। পূর্ববঙ্গ বিধান সভায় সরকার পক্ষের আনা একটি প্রস্তাব ভোটে পরাজিত হোল। পরদিন ১৯শে জুন আতাউর রহমান মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলেন। নয়া গভর্নর জনাব সুলতানউদ্দিন আহমেদ (ইনি ইতিমধ্যে অস্থায়ী রাজ্যপাল জনাব হামিদ আলির জায়গায় স্থায়ী গভর্নর নিযুক্ত হয়েছেন)–কৃষক প্রজাদলের জনাব আবুল হোসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আহবান জানালেন। রংপুরের কংগ্রেসী নেতা শ্রীপ্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী ও সিলেটের জনাব আবদুল হামিদকে নিয়ে জনাব সরকার তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। কিন্তু এই নতুন মন্ত্রিসভার তিন দিনও অতিবাহিত হয়নি–২২শে জুন শেখ মুজিবুর রহমান জনাব আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধেই একটি অনাস্থা আনলেন। ১৫৬–১৪২ ভোটে অনাস্থা প্রস্তাবটি পাস হয়ে গেল। ভোটাভুটির সময় বিধান সভায় বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হল। হাতাহাতি, পচা ডিম ছেঁড়াছুঁড়ি অবাধে চলল।

পরদিন ২৩শে জুন জনাব আবু হোসেন সরকার পদত্যাগ করলেন। ১৫ জুন প্রেসিডেন্ট মীর্জা পূর্ব পাকিস্তান বিধান সভাকে সাময়িকভাবে বাতিল করে পূর্ববঙ্গে গভর্নরের শাসন চালু করলেন।

পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্টের শাসন চালু হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দাবী উত্থাপন করলেন যে পরিষদীয় গণতন্ত্র অবিলম্বে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হোক এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।

মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান প্রেসিডেন্ট মীর্জাকে সতর্ক করে বলেছিলেন, শীঘ্র যদি সাধারণ নির্বাচন না হয় তবে তাঁরা রক্তাক্ত বিপ্লব ঘটাবেন।

জনাব সোহরাওয়ার্দী ৬ই জুলাই ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের একটি সভায় বলেছিলেন, স্বাধীনতা লাভের পর ১১ বছরের মধ্যে ভারতে দুটি সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেছে কিন্তু পাকিস্তানে নির্বাচনের কোন চিহ্নই নেই।

কিছুদিন পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাষ্ট্রপতি–শাসন তুলে নেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন বললেন, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করবে। এই ঘোষণা অনুযায়ী আওয়ামী নেতা জনাব আতাউর রহমান তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান বিধান সভায় এমন একটি লজ্জাকর ঘটনা ঘটল যা পরিষদীয় গণতন্ত্র নষ্ট করে দিল।

পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী দল বিধান-সভার স্পীকার জনাব আবদুল হাকিমকে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করতে বদ্ধপরিকর হলেন। আওয়ামী নেতারা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন যে স্পীকার নিরপেক্ষ পদে অধিষ্ঠিত থেকেও বিরোধী দল ‘কৃষক প্রজা পার্টির’ প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে যাচ্ছেন। বিরোধী দলও কৃতসংকল্প হলেন যে তাঁরা বিধান সভায় এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন যাতে অ্যাসেম্বলি চালানো অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং পূর্ববঙ্গে প্রেসিডেন্টের শাসন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।

২০শে সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিধান-সভার অধিবেশন হল। কোরান পাঠ করার পর সভার কাজ শুরু হল। স্পীকার আবদুল হাকিম যখন সভাগৃহে প্রবেশ করলেন তখন সকলে তাঁকে উঠে দাঁড়িয়ে যথারীতি সম্মান প্রদর্শনও করলেন। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই সভাকক্ষের হাওয়া গরম হয়ে উঠল। মুসলিম লীগ দলের জনাব হাশেমুদ্দীন আহমদ ৬ জন আওয়ামী সদস্যের প্রতি স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, এঁদের সভাগৃহে থাকার কোন অধিকার নেই। তাই স্পীকারের অবিলম্বে তাঁদের বহিষ্কার করে দেওয়া উচিত। কারণ এই ৬ জন সদস্য হলেন উকিল বা পাবলিক প্রসিকিউটার, নির্বাচনী কমিশন এঁদের নির্বাচন বাতিল করে দিয়েছিলেন কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পীড়াপীড়িতে প্রধানমন্ত্রী জনাব নুন একটি অর্ডিন্যান্স জারী করে নির্বাচনী কমিশনের সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেন এবং ঐ ছয়জন আওয়ামী নেতাকে পূর্ব পাকিস্তানে বিধান সভায় তাঁদের সদস্য পদে পুনর্বহাল করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথা না মেনে জনাব নুনের কোন উপায়ান্তর ছিল না, কারণ কেন্দ্রীয় পরিষদে সোহরাওয়ার্দীর প্রভাবাধীন আওয়ামী সদস্যরা যদি তাঁদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতেন তবে নুন মন্ত্রিসভার তৎক্ষণাৎ পতন ঘটত। যাই হোক স্পীকার জনাব আবদুল হাকিম বললেন যে, জনাব হাশেমুদ্দীন আহমদ যে আপত্তি উত্থাপন করেছেন সে বিষয়ে তিনি ২৩শে সেপ্টেম্বর তাঁর রুলিং দেবেন। কিন্তু স্পীকার যখন এই ঘোষণা করছিলেন তখন বিধান সভায় প্রচণ্ড হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। স্পীকার কয়েকজন সদস্যকে সভাকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তাঁরা এই নির্দেশ অমান্য করে সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে লাগলেন। এই উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সদস্য জনাব দেওয়ান মাহবুব আলী অকস্মাৎ স্পীকারের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন কিন্তু স্পীকার আবদুল হাকিম এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একদল সদস্য ক্রুদ্ধভাবে স্পীকারের আসনের দিকে ধাবিত হলেন। তাঁরা উত্তেজিতভাবে বলতে লাগলেন যে স্পীকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে। সুতরাং জনাব হাকিমকে সভাকক্ষ ছেড়ে চলে যেতে হবে। বিধান সভার সদস্যরা স্পীকারকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন। তাদের সঙ্গে সদস্যদের হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। বিধান সভার মধ্যে দাঙ্গা বেঁধে গেল। হাতের সামনে যে যা পেলেন পরস্পরের প্রতি নিক্ষেপ করতে লাগলেন– চেয়ার, টেবিল, কালির দোয়াত ইত্যাদি। মাইকগুলোকে বিধান সভার সদস্যরা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে লাগলেন। মুজিবুর রহমান এই সংঘর্ষে আহত হলেন। পরে দেখা গেল বিধান সভার ভিতরে এই দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বহু বহিরাগত অংশ নিয়েছে। কেউ কেউ দর্শকদের গ্যালারী থেকে আর বাকীরা বাইরে থেকে এসে সদস্যদের সঙ্গে মিশে গেছে। বিশৃঙ্খল অবস্থা আয়ত্তের মধ্যে আনতে ব্যর্থ হয়ে স্পীকার আবদুল হাকিম সভাকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ডেপুটি স্পীকার জনাব শাহেদ আলী স্পীকারের আসনের দিকে এগিয়ে এলেন কিন্তু পরে কি ভেবে তিনি আর’ অগ্রসর হলেন না। তিনি মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানের পাশে দাঁড়িয়ে সভার কাজ চালাতে লাগলেন। কংগ্রেস সদস্য শ্রীপিটার পল গোমেজ স্পীকার আবদুল হাকিমকে বদ্ধ উন্মদ ঘোষণা করে একটি প্রস্তাব আনলেন। অধিকাংশ সদস্যের ভোটে এ প্রস্তাবটি গৃহীত হল। এর পরই ডেপুটি স্পীকার যখন ঘোষণা করলেন বিধান সভা পরদিন বেলা চারটার সময় আবার বসবে তখন প্রচণ্ড কোলাহলে সভাকক্ষ ফেটে পড়ল। ফরিদপুরের স্বনামখ্যাত জননেতা কৃষক-প্রজা দলের জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী জনাব শাহেদ আলীর দিকে উত্তেজিত ভাবে এগিয়ে এলেন। সঙ্গে সঙ্গেই সরকার পক্ষের সদস্যরা জনাব ইউসুফ আলি চৌধুরীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি তাল সমলাতে না পেরে ভূলুণ্ঠিত হলেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার স্পীকার আবদুল হাকিমের বিরুদ্ধে চার্জসীট দাখিল করলেন–এতে জনাব হাকিম সম্পর্কে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো।

২১শে সেপ্টেম্বর স্পীকারের প্যানেলভুক্ত সৈয়দ আজিজুল হক সভার কাজ পরিচালনা করলেন। সেদিন স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার দুজনেই অনুপস্থিত ছিলেন। বিধানসভার সদস্যদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়েছিল যতদিন না নতুন স্পীকার নির্বাচনে সফল হন ততদিন স্পীকার কেউই অ্যাসেম্বলিতে আসবেন না। সরকারী দল, আওয়ামী লীগ ও বিরোধী পক্ষ কৃষক প্রজাপার্টি নতুন স্পীকার নির্বাচনে মতৈক্যে আসতে পারলেন না। কৃষক-প্রজা পার্টি বুঝতে পারল বিধান সভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার কোন আশা নেই তাই তারা স্থির করল বিধান সভায় এমন অবস্থা সৃষ্টি করবে যাতে প্রেসিডেন্টের শাসন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে আওয়ামী বিদ্বেষ এতো প্রবল হয়েছিল যে তারা গভর্নমেন্টের চেয়ে প্রেসিডেন্টের শাসন শ্রেয়তর মনে করেছিল।

২৩শে সেপ্টেম্বর ঢাকা শহরের পরিস্থিতি থমথমে হয়ে উঠল। শহরের সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে উদ্বেগের চিহ্ন সুস্পষ্ট। বিধান সভার প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের পঞ্চাশ জন সৈনিক ও তাদের অফিসারদের তৈরী রাখা, হল। এছাড়া ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ইসমাইল সাহেবকে সতর্ক করে দেওয়া হল প্রয়োজন হলে পুলিশ বাহিনী যেন এগিয়ে আসে।

বেলা তিনটার সময় বিধান সভার অধিবেশন বসল। নিদারুণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি। রাজনৈতিক দলগুলি সাংবাদিকদের এমন ভীতি প্রদর্শন করেছিলেন যে তাঁরা তাঁদের নিরাপত্তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী খানের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে কোন আলোচনা করার অক্ষমতা প্রকাশ করেছিলেন। তাই সেদিন ঢাকা বিধান সভার প্রেস গ্যালারী শূন্য ছিল। বেলা চারটের সময় ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী সভাকক্ষে প্রবেশ করে স্পীকারের আসনে উপবেশন করলেন। সরকার পক্ষ তাঁকে সেদিনের অধিবেশনের সভাপতি হিসাবে স্বীকৃতি জানালেন, কিন্তু বিরোধীপক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। তাঁরা সমস্বরে দাবী জানালেন শাহেদ আলী যেন কালবিলম্ব না করে স্পীকারের আসন ত্যাগ করেন। প্রাক্তন কৃষক প্রজা সরকারের মুখমন্ত্রী জনাব আবু হোসেন সরকার এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি ভদ্রতা বোধ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আপনি যদি এই মুহূর্তে বেরিয়ে না যান তবে আপনাকে আমরা খুন করে ফেলব। আপনার বিবি ও বাচ্চারা, আপনার সারা পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে।’

কিন্তু শাহেদ আলী বিচলিত হলেন না। তিনি স্পীকারের আসনে অনড় হয়ে বসে রইলেন। এদিকে সভাকক্ষে ব্যাপক হাঙ্গামা বেঁধে গেল। সদস্যরা চেয়ার, পেপার ওয়েট, এক কথায় হাতের সামনে যা পেলেন তাই ছোঁড়া-ছুঁড়ি শুরু করলেন। বিরোধী কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী। সভাকক্ষের অবস্থা দেখে তিনি শঙ্কিত হয়ে উঠলেন কিন্তু ঠিক কি যে ঘটছে তো উপলব্ধি করার আগেই সবেগে নিক্ষিপ্ত কোন কঠিন বস্তু তাঁকে সরাসরি আঘাত করল। শাহেদ আলী গুরুতর আহত হলেন। তাঁর ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি সংজ্ঞাহারা হয়ে স্পীকারের আসনে লুটিয়ে পড়লেন।

শাহেদ আলীকে সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। ইতিমধ্যে ইনসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ জনাব ইসমাইল একদল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে বিধান সভা ঘেরাও করে ফেললেন–তাঁরা সভাকক্ষেও প্রবেশ করলেন। ডেপুটি স্পীকারকে হাসপাতলে নিয়ে যাওয়ার পর সরকার পক্ষ প্যানেলভুক্ত জনাব জিয়াউল হাসানকে স্পীকারের চেয়ারে বসিয়ে সভার কাজ চালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সভাকক্ষের হাঙ্গামা বেড়েই চলল। পুলিশ সভাকক্ষে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সদস্যদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বেঁধে গেল। পুলিশের আই. জি, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকার পুলিশ সুপারেনটেনডেন্ট প্রভৃতি উচ্চপদস্থ অফিসাররা ও মোহন মিয়া, নান্না মিয়া, আবদুল লতিফ বিশ্বাস প্রভৃতি অতি উত্তেজিত সদস্যদের হাত ধরে– প্রায় বল প্রয়োগ করে তাঁদের সভাকক্ষের বাইরে নিয়ে গেলেন। তাঁদের গ্রেপ্তার করা হল যদিও কিছু পরেই জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এই অভাবনীয় ও শোচনীয় ঘটনায় আর কারও সন্দেহ রইল না যে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের দিন ঘনিয়ে এসেছে।

হোলও তাই। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এল এক বিরাট পরিবর্তন।

২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৮। পূর্ব পাকিস্তান বিধান সভা মুলতবী রইল বলে গভর্নর ঘোষণা করলেন।

২৬শে সেপ্টেম্বর ডেপুটি স্পীকার জনাব শাহেদ আলীর মৃত্যু হল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা গেল যে নাকে, চোখে ও তাঁর বুকে আঘাত ছাড়াও কয়েকটি পাঁজর চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

জনাব শাহেদ আলী সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে শহীদ হলেন।

৭ই অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নুন দুবার তাঁর মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে নতুন মন্ত্রিসভা গড়ে তুললেন– সেদিন তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের এক নিদারুণ সঙ্কটাকীর্ণ মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছিল। একটা সত্যিকারের ক্রাইসিস।

একই দিনে-দু-দুবার মন্ত্রিসভা রদবদল করে জনাব নুন সাময়িক ভাবে বিপদকে আটকে রাখলেন। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেন নি।

৭ই অক্টোবর কয়েকজন আওয়ামী সদস্যকে মন্ত্রিসভায় নেবার জন্যে জনাব নুনকে প্রথমে তাঁর ক্যাবিনেট রি-শাফল করতে হোল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নুন সেদিন কয়েকঘন্টার মধ্যে যে মন্ত্রীসভা গঠন করলেন তাতে আওয়ামী সদস্যরা বাদ পড়লেন। আওয়ামী লীগ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কিন্তু তারা নুন মন্ত্রীসভা থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলো না, কারণ তাদের গভীর আশঙ্কা হল যে নুন মন্ত্রীসভার যদি পতন ঘটে তবে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রেরও অবসান ঘটবে।

প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ৭ই অক্টোবর সন্ধ্যায় নুন মন্ত্রীসভার নবনিযুক্ত সদস্যদের আপ্যায়নের জন্য তাঁর করাচী বাসভবনে একটি পার্টির আয়োজন করছিলেন। পার্টি বেশ জমে উঠেছিল–নানা রকম তরল পানীয়ের মদিরায় সমবেত অতিথিরা বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। রাত ক্রমশ গভীর হয়ে উঠেছিল। রাজধানী করাচীর জনকোলাহল স্তিমিত হয়ে এসেছিল। পথে শুধু নিশাচরীদের আনাগোনা। কিন্তু অতিথিদের ঘরে ফেরবার কোন তাড়াই যেন নেই। তাঁরা তখন নতুন করে তাঁদের পানপাত্র পূর্ণ করতে ব্যস্ত। প্রেসিডেন্ট মীর্জা কিন্তু ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন–ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। অতিথিদের মধ্যে যাঁরা তার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরা অন্যদের, যাঁদের মধ্যে অনেকে ছিলেন একদিন-কা-উজির, এরকম টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেলেন।

সেই দিনই মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক যানবাহন ও মিলিটারী বুটের আওয়াজ ঢাকা ও করাচীর সুপ্তিমগ্ন রজনীর নিস্তব্ধতাকে অকস্মাৎ খান খান করে ভেঙ্গে দিল। বিভিন্ন সংবাদপত্রের দপ্তরের রাতজাগা কর্মচারীরা সবিস্ময়ে দেখলেন যে তাঁদের সামনে সামরিক অফিসাররা দাঁড়িয়ে পরদিন প্রভাতী সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করবার জন্য এক বিশেষ বিষয়বস্তু তাঁদের দিচ্ছেন। মুসলিম লীগ এবং ওই একই গোষ্ঠীর কয়েকটি দল ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক সংস্থার নেতাদের নিদ্রাভঙ্গ করলেন মিলিটারী অফিসাররা। তাঁদের বাড়ীতে চলল তন্ন তন্ন করে খানাতল্লাসী। কিন্তু কেন এই তল্লাসী তা তাঁদের কাছে খুলে বলা হল না, এমন কি এঁদের টেলিফোনও ব্যবহার করতে দেওয়া হোল না। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর তাঁদের কেউ কেউ ভাবলেন যে বোধহয় প্রেসিডেন্টের শাসন চালু হয়েছে–তাই পুলিশ ও মিলিটারী কর্তৃপক্ষের এত তৎপরতা।

কিন্তু ৭ই অক্টোবরের নিশাবসানের পর যখন ৮ই অক্টোবরের প্রভাতী সূর্যের উদয় হ’ল, তখন চমকিত হয়ে স্তম্ভিত হয়ে দেশবাসী দেখল সেই দিনের সবচেয়ে বড় চাঞ্চল্যকর সংবাদঃ ‘MARTIAL LAW PROCLAIMED THROUGHOUT PAKISTAN’ –সারা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করা হয়েছে।

অর্থাৎ দেশের ব্যক্তি-স্বাধীনতা আর নেই, গণতন্ত্র আর নেই। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা শুধু সামরিক আইন দেশের উপর চাপিয়ে দিলেন না, তিনি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বিধানসভাগুলিকে ভেঙ্গে দিলেন, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রকে মৃত বলে ঘোষণা করলেন এবং রাজনৈতিক দলগুলিকে নিষিদ্ধ করে দিলেন। তিনি প্রধান সেনাপতি জেনারেল মহম্মদ আইয়ুব খানকে চীফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটার নিযুক্ত করলেন। প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন ও তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যদের গৃহবন্দী করে রাখা হলো এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের অধিকাংশই হলেন কারারুদ্ধ।

সামরিক শাসনের দাপট শুরু হয়ে গেছে। ৮ই অক্টোবর খুব ভোরে একটি ছোট নৌকা ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার মীর্জাপুর গ্রামে পাশ দিয়ে প্রবাহিত একটি খালের ধারে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। নৌকার ভিতরে লুঙ্গি ও খদ্দরের জামা পরিহিত ৭৫ বছরের এক বৃদ্ধ পশ্চিমাভিমুখী ‘হয়ে নামাজ পড়ছিলেন। ইনি পূর্ববঙ্গের কৃষক আন্দোলনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক নেতা মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বেলা বাড়লে মীর্জাপুরের রায় বাহাদুর রণদা প্রসাদ সাহার অতিথি-ভবন থেকে কয়েকজন ভদ্রলোক সন্তর্পনে নৌকায় এসে উঠলেন। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন শওকত আলী খান। ইনি মৌলানা ভাসানীকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ও শ্রদ্ধা করতেন। এই সময় ভাসানীর শরীর ভাল যাচ্ছিল না। তাই তিনি নৌকাবিহার করে খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করার প্রয়াস পেতেন। এর পরে আরো কয়েকজন ব্যক্তি এলেন। তাঁরা দেশের সামরিক শাসনের সংবাদ মৌলানার গোচরীভূত করলেন। তাঁদের গভীর আশঙ্কা হলো যে ইস্কান্দার মীর্জার মিলিটারী সরকার হয়তো অচিরেই ভাসানীকে গ্রেপ্তার করবে–তাই তাঁরা মৌলানাকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু এই নির্ভীক বৃদ্ধ গণনেতা অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন যে মিলিটারীর ভয়ে ভীত নন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে যে কোন বিপদের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। মৌলানার কথা শেষ হয়নি এমন সময় একদল পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করল। ভাসানীকে প্রথমে কিছু দিন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাখা হলো। তারপরে ধানমণ্ডিতে একটি বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে পুলিশ প্রহরার মধ্যে তিনি গৃহবন্দী হলেন।

পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি সুপার কনস্টেলেশন বিমান ৭ই অক্টোবর রাতে করাচী ছেড়ে সারা রাত ধরে উড়ে ৮ই অক্টোবর ভোরে ঢাকার তেজগাঁ ও বন্দরে এসে নামল। এই বিমানটির যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আগের দিন সন্ধ্যায় করাচীতে প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খাঁ নুনের নৈশ পার্টিতে যোগ দিয়ে ঢাকায় ফিরলেন।

PIA -এর সুপার কনস্টেলেশনটির যাত্রীরা ৭ই অক্টোবর মধ্য রাত্রিতে যখন করাচী বিমান-বন্দর থেকে যাত্রা করেছিলেন তখন তাঁরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে যে বিরাট বিপ্লব ঘটে গেল তার বিন্দুবিসর্গও আঁচ করতে পারেন নি। প্লেনটি যখন তেজগাঁও-এ অবতরণ করল তখন যাত্রীরা লক্ষ্য করলেন যে বিমানঘাঁটি সেনা পরিবেষ্টিত। শেখ মুজিবুরের কয়েকজন সহকর্মী তাঁর এয়ারপোর্টে দেখা করতে এসেছিলেন–তাঁরা বিমর্ষ বদনে শেখ সাহেবকে সেদিনের প্রভাতী সংবাদপত্র দেখালেন। শেখ মুজিবুর সামরিক আইনের খবর পেয়ে হতবাক হয়ে পড়লেন–কিছুক্ষণ তাঁর বাক্য সরল না। বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠবার পর শেখ মুজিবুরের আশঙ্কা হলো তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু আবার অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারারুদ্ধ হবার আগে তিনি তাঁর মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার অভিলাষী হলেন–তিনি কালবিলম্ব না করে ফরিদপুর জেলায় তাঁর স্বগ্রাম গোপালগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা করলেন।

গোপালগঞ্জে মায়ের সঙ্গে মুজিবের দেখা হয়েছিল কিনা সে কথা জানা নেই, কিন্তু ১২ই অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান নিরাপত্তা অর্ডিনান্স অনুসারে গ্রেপ্তার করা হল মুজিবকে। আটক অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে ৬টি ফৌজদারী মামলা রুজু করা হোল। গ্রেপ্তার হলেন আরও অনেকে। সারাদেশে ফৌজী শাসন চালু হল। ২৪শে অক্টোবর ইস্কান্দার মীর্জার ১২ জন সদস্য নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন যে মন্ত্রিসভার প্রধান নিযুক্ত হলেন মহম্মদ আইয়ুব খান। সেনাবাহিনীর প্রধানও থাকলেন আইয়ুব খান। ২৭শে অক্টোবর সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট মীর্জার কাছে শপথ গ্রহণ করলেন। কিন্তু তার ২ ঘন্টা পরে আইয়ুবের প্রেরিত একটি বিবৃতি নিয়ে হাজির হলো আইয়ুবের দূত। তারপর বিদায় নিলেন মীর্জা। সপরিবারে ত্যাগ করে গেলেন পাকিস্তান! আইয়ুব খাঁ ক্ষমতা দখল করে নিজেকেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষণা করলেন। আইয়ুব খান ক্ষমতার এসে প্রথম দিনই পাকিস্তানের সমস্ত রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে দিলেন। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সভা সমিতি শোভাযাত্রা সমস্ত রকম রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ হয়ে গেল। গ্রেপ্তার হলেন সোহরাওয়ার্দী (৩০শে জানুয়ারী ১৯৬২)। গ্রেপ্তার হলেন আবদুল গফুর খান। গ্রেপ্তার হলেন আদুস সামাদ খান। দেড় বছর পরে মুজিবুর জেল থেকে বেরুলেন। আবার দানা বেঁধে উঠল আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সোহরাওয়ার্দী সহ অন্যান্য বন্দীদের মুক্তির দাবীতে ৬ই ও ৭ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায় সহস্র সহস্র ছাত্র যুবক বিক্ষোভ মিছিল বের করল। আইয়ুব খানের ফটো সংগ্রহ করে পদদলিত করা হলো। তাতে থুথু দেওয়া হলো। এগিয়ে এল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। আবার রণাঙ্গণে পরিণত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ববাংলায় যে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সূতিকাগৃহে পরিণত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে

জিন্নাকে শুনতে হয়েছিল ‘না’ ‘না’ ধ্বনি, লিয়াকত আলী খানের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের কন্ঠের মাঝে,–সেখানে আয়ুব খান একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন। ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর কার্জন হলে ভাষণ দিতে এলেন আইয়ুব খান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বাইরে বেয়নেটধারী পুলিশ। বুকে রিভলবার গুঁজে অজস্র সাদা পোশাকের পুলিশ। কিন্তু যেইমাত্র আয়ুব খান ভাষণ দিতে উঠলেন অমনি ছাত্রদের স্লোগানে ডুবে গেল আয়ুবের কণ্ঠস্বর। ক্ষুব্ধ ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান বহু যুদ্ধ মোকাবিলা করেছেন, কিন্তু তাঁকে হল ছেড়ে যেতে হল ভাষণ না দিয়েই। আয়ুব খান হল ছেড়ে যেতেই পুলিশ বাহিনী ক্ষিপ্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছাত্রদের ওপর চলল নির্মম ভাবে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ। মুহূর্তের মধ্যে সারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ রণক্ষেত্রে পরিণত হল। তিনজন ছাত্র নিহত হল পুলিশের গুলীতে। ১৭ই সেপ্টেম্বর পূর্ববঙ্গের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন হয়ে রইল।

১৭ই সেপ্টেম্বর ছাত্রদমনের প্রতিবাদে ২৯শে সেপ্টেম্বর সারা পূর্ববাংলায় সাধারণ ধর্মঘট ও দমননীতি বিরোধী দিবস পালিত হল। এইদিন পল্টন ময়দানে যে সমাবেশ হয় সে সমাবেশ ছিল অবিস্মরণীয়। এই সমাবেশের সামনে ভাষণ দিলেন মৌলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, জনাব আবুল কাসেম।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঘোষণা করেছিলেন মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ১৯৬৫ সালের জানুয়ারী মাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিভ্রান্ত হল না। মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠল। আবার সমবেত হল ঢাকার পল্টন ময়দানে। পল্টন ময়দানের সভা থেকে মুজিবুর রহমান, মৌলানা ভাসানী আওয়াজ তুললেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র নয়, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার চাই।’ অবস্থা বুঝে আইয়ুব খান নতুন পথ ধরলেন। আইয়ুব খানের বিশ্বস্ত অনুচর আবদুস সবুর খান দাঙ্গা লাগিয়ে দিলেন পূর্ববঙ্গে। খুলনার দাঙ্গায় হিন্দু নিধনের পরিণতিতে পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। পূর্ববঙ্গের এই দাঙ্গা অনেক ক্ষতি করেছিল, কিন্তু একটি অমূল্য সম্পদ সৃষ্টি হয়েছিল এই দাঙ্গা। ঢাকায় দাঙ্গার মধ্যেই বেরুল একটা শান্তি মিছিল। সেই শান্তি মিছিলও দাঙ্গাকারীদের আক্রমণ থেকে রেহাই পেল না। প্রাণ দিলেন কাজী রউফ ও এমদাদ খান। এর আগেই দাঙ্গাকারীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন আমির হোসেন চৌধুরী। আমির হোসেন চৌধুরী দাঙ্গা থামাতে গিয়েছিলেন, তাঁর হাতে একটা পিস্তলও ছিল। কিন্তু তিনি নিজে মুসলমান এই পরিচয় দিয়েও সেদিন রেহাই পান নি। ‘বেগতিক দেখে তুমি মুসলমান সেজেছ’–এই বলে আর একজন মুসলমান বল্লম দিয়ে বিদীর্ণ করল আমির হোসেনের বুক।

পাকিস্তানে আইয়ুব খাঁর রাজত্ব যখন নখদন্তে গণতান্ত্রিক জীবনকে বিদীর্ণ করছে, আইনের নামে স্বৈরশাসনে জনজীবন স্তব্ধ করে দেবার ষড়যন্ত্র রূপায়িত হচ্ছে, তখন পাকিস্তানের অনেক নেতাই রাজনীতি থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে নিরাপদ জীবন যাপন করছিলেন। কেউ ব্যবসা করতে নামলেন, কেউ চলে গেলেন ওকালতি করতে, কেউ চলে গেলেন অধ্যাপনা করতে, কিন্তু মুজিবুর বোধহয় ব্যতিক্রম। বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, বারবার জেলে গেছেন, কিন্তু রাজনীতির পথ ত্যাগ করেন নি একদিনের জন্য। সংগ্রামের পথ পরিত্যাগ করে আসেননি এক মুহূর্তের জন্য।

আয়ুব খাঁর বেসিক ডেমোক্রেসির ফরমুলায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হ’ল। নির্বাচনে প্রার্থী হলেন আইয়ুব খাঁ আর তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন ফাতেমা জিন্না। মুজিবুর আইয়ুবের বিরুদ্ধে শ্রীমতী জিন্নাকে সমর্থনের উদ্দেশ্যে CO P গঠন করলেন। মুজিবুর হলেন শ্রীমতী জিন্নার নির্বাচনের প্রধান সংগঠক। আইয়ুব খাঁ নির্বাচনে জয়ী হন বটে তবে এই নির্বাচনে যে আইয়ুব বিরোধী মোর্চা গড়ে ওঠে সেটা ভবিষ্যতে আইয়ুবের পতনের প্রধান কারণ হয়। আর এই মোর্চা গঠিত হয় মুজিবুরের চেষ্টাতেই।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হবার পরই আয়ুব খাঁ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকী দিতে শুরু করেন। এই হুমকীর দুটো কারণ দেওয়া হয়। এক হল কচ্ছের রান, অপরটি হল কশ্মীর। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কিন্ত এই দুটো সমস্যা নিয়ে মোটেই মাথাব্যথা করতে রাজী ছিলেন না। ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় মিঠে কড়া কলমে বিখ্যাত সাংবাদিক ভীমরুল লিখলেন–”বিগত ছয় বৎসরে আমরা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গের অনেক লম্বা লম্বা কথা শুনিয়াছি, বহু লম্ফ ঝম্ফ প্রত্যক্ষ করিয়াছি। যথা নিয়মেই কাশ্মীর লইয়া লম্ফ ঝম্ফ করা হইতে লাগিল।মনে হইতে লাগিল যে ভারতের বিরুদ্ধে একটা কিছু কাণ্ড বাধাইয়া ফেলিতেই ক্ষমতাসীনরা মনস্থ করিয়া

ফেলিয়াছেন। বর্তমানে এই লম্ফ ঝম্ফ চরমে উঠিয়াছে এবং এমন সব কথাবার্তা বলা হইতেছে যেন বিরোধী দলগুলির জন্যই কাশ্মীরকে হাতের মুঠায় আনা যাইতেছে না। আমাদের কথা বলিতে গেলে আমরা মনে করি, সকল প্রতিবেশীর সঙ্গেই পকিস্তানের সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়িয়া তোলা উচিত। আমরা জানি ইতিহাসে কোন যুদ্ধই কোন সমস্যার সমাধান করে নাই। বরং প্রতিটি যুদ্ধই নূতন সমস্যার জন্ম দিয়াছে। এমতাবস্থায় আমাদের নিকটতম প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের চিন্তাকে আমরা অবাস্তব বলিয়া গণ্য করিয়াছি।” পুর্ব পাকিস্তানের মানুষ যাকে অবাস্তব বলে মনে করলো সেই কাজই আয়ূব করলেন অতি নিপুণ ভাবে। কাশ্মীরে হানাদার পঠিয়ে কাশ্মীর দখলের প্রচেষ্টার মাধ্যমেই যুদ্ধ শুরু করলেন ভারতের বিরুদ্ধে। কাশ্মীর নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে মাথাব্যথা অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধ করেও আয়ুব তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পারলেন না। পূর্ববঙ্গের মানুষ দেখলো জরুরী অবস্থায় তারা কত অসহায়। না আছে পূর্ব বঙ্গে নিজেদের রক্ষার কোন শক্তি না আছে যুদ্ধ ও যুদ্ধ-উত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সম্পদ ও রসদ। স্বাধীনতার বহু বৎসর পার হবার পরও পুর্ব পাকিস্তানকে রক্ষার কোন ব্যবস্থাই পাকিস্তান করে নাই। এই চিত্র প্রকট হয়ে উঠলো এবং মুজিবুর যুদ্ধের মধ্যে পুর্ববঙ্গকে বঞ্চনার আরেকটি চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরলেন। মুজিবুর বললেন, যুদ্ধ লাগলে চীন এসে তাদের রক্ষা করবে এই যুক্তি মেনে নিতে তিনি রাজী নন। ১৯৬৬ সালের ১০ই জানুয়ারী তাসখন্দ চুক্তি হয়ে যুদ্ধ বন্ধ হল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিল–কেন এই অবান্তর যুদ্ধ, কেন এই ভারত-বিদ্বেষ। আয়ুব খাঁ কিন্তু তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষর করেও যুদ্ধের জিগির ছাড়লেন না। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারী মাসের শেষ দিকে লাহোরে তাসখন্দ চুক্তি বিরোধী এক সম্মেলন আহ্বান করা হয়। সম্মেলনে মুজিবুরও আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেন। কিন্ত মুজিবুর তাসখন্দ বিরেধী কোন আন্দোলনে অংশ নিতে অস্বীকার করেন এবং সম্মেলন ত্যাগ করে আসেন। মুজিবুর সম্মেলন ত্যাগ করে আসবার সময় জানিয়ে আসেন তিনি ভারত ও পাকিস্তানের সম্প্রীতি নীতিতে বিশ্বাস করেন। এই সম্মেলনেই মুজিব তাঁর বিখ্যাত ছয় দফা দাবী প্রথম প্রকাশ করেন। ছয় দফা দাবীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক জীবন ও কর ব্যবস্থার উপর পুর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ কর্তৃত্ব দাবি করেন। এবং পুর্ববঙ্গের জন্য রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও পুর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবী করেন।

মুজিবুরের ছয় দফা দাবী প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে, কিন্ত গাত্রদাহ শুরু হয় আয়ুব খাঁর। ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ ঢাকায় আয়ুব খাঁ ঘোষণা করেন দেশের অখণ্ডতা-বিরোধী কোন প্রচেষ্টা সমর্থন করা হবে না, দরকার হলে অস্ত্রের মুখে এর জবাব দেওয়া হবে।

কিন্তু এই একই দিনে (২০শে মার্চ ১৯৬৬) পল্টন ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর ঘোষণা করলেন,”কোন হুমকিই জনসাধারণকে ছয় দফা দাবী থেকে নিবৃত্ত করতে পারবে না।” তিনি বলেন,” কেবলমাত্র শক্তিশালী কেন্দ্র নয়, দেশের উভয় অংশকে সমান শক্তিশালী করতে হবে। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেখা গেছে শক্তিশালি কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অসহায় হয়ে পড়েছিল। কেন সংকটের সময় পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায় নাই, কেন জাতীয় পরিষদে তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে হয় চীনের জন্যই পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে? কেন আমরা অন্যের অনুগ্রহে বেঁচে থাকবো?”

দিনে দিনে স্বায়ত্তশাসন দাবীর আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। আর আয়ুব খাঁও বেসামাল হয়ে দমন নীতির প্রয়োগ শুরু করেন। মুজিবুর ছয় দফা দাবী নিয়ে রাজ্যব্যাপী প্রচার অভিযানে বের হলেন। সর্বত্র জনতা মুজিবুরের সমর্থনে এগিয়ে এল। ২১শে এপ্রিল মুজিবকে ঢাকার পথে যশোহরে গ্রেপ্তার করা হল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সিলেটে একটা আপত্তিকর বক্তৃতা দিয়েছেন। তাই গ্রেপ্তার করে সিলেটে পাঠানো হল মুজিবকে। সিলেটে কোর্ট থেকে মুক্তি পাবার পরই সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহ পাঠানো হল। ময়মনসিংহে দায়রা জজ তাঁকে জামিনে মুক্তি দেন।

১৯৬৬ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জে এক সভায় ভাষণ দিয়ে মুজিবুর বাসায় ফেরেন। রাত্রি ১ টার সময় এসে পুলিশ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হলেন শুধু মুজিব নয় আরো অনেকে। এইখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য যে মৌলানা ভাসানীকে সামনে রেখে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কিন্তু শুরু থেকে ছয় দফা দাবীর বিরোধিতা করে। সেইদিন মৌলানা ভাসানী যদি শেখ মুজিবুরের পাশে এসে দাঁড়াতেন, যদি মুজিব আটক হবার পর ভাসানী নেতৃত্ব দিতেন তবে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস অন্য রকম হত। সেই ভাসানী মুজিবের পাশে এসেছিলেন, মুজিবের দাবীর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন, কিন্ত সে অনেক পরে, ১৯৭১ সালে, যখন আর কোন নেতার দরকার ছিল না,জনতাই নেতৃত্বের আসন দখল করেছে। ১৯৬৬ সালে ভাসানী কিন্তু পরোক্ষে ছয় দফা দাবীর বিরোধিতা করে অত্যাচারিতের পাশে না দাঁড়িয়ে স্বৈতরতন্ত্রকেই সমর্থন করেছিলেন। ৭ই এপ্রিল ১৯৬১ সালে মৌলনা ভাসানী বললেন–”ছয় দফা দাবীর মধ্যে অর্থনৈতিক মুক্তির ঘোষণা নেই তাই তাঁরা ছয় দফা দাবী সমর্থন করবেন না।” পরে মৌলানা ভাসানী স্পষ্ট কথায় বললেন,”ছয় দফা দাবীর মাধ্যমে মার্কিনীদের কাজ হাসিলের চেষ্টা করা হচ্ছে–ছয় দফা। করা মধ্যে সমাজতন্ত্রের কথা নাই, তাই ওটা সমর্থনের অযোগ্য।” অবশ্য পরে ভাসানীর আওয়ামী পার্টি তার দলের নীতি পরিবর্তন করে ছয় দফা দাবীকে অগ্রাধিকার দেবার প্রস্তাব গ্রহণ করে–কিন্তু তখন ভাসানীর নিজের দলেও ভাঙ্গন প্রকট হয়ে উঠেছে। যা হোক, সেকথা পরে হবে।

শেখ মুজিবুরের ছ’দফা প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরে অসাধারণ সমাদর লাভ করল, কিন্তু তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হল পশ্চিম পাকিস্তানের চরম প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্র ও রাজনীতিবিদদের কাছে। তাঁরা ‘সব গেল’ ‘সব গেল’ রব তুলে ৬ দফা প্রস্তাবকে বললেন– পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা। সরকার পরিচালিত বা সরকার সমর্থক সংবাদপত্রগুলি শেখ মুজিবুর ও তাঁর সহকর্মীদের ‘stooge’ বা তাঁবেদার বলে আখ্যা দিলেন। প্রেসিডেন্ট আয়ুব হুঙ্কার দিলেন এই ৬ দফা প্রস্তাব ‘সার্বভৌম যুক্ত বাংলা গঠনের পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ আয়ুব আরও বললেন, ‘যারা ৬ দফা দাবী আদায়ের বা প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন কায়েম করার চেষ্টা করেছে তারা মূর্খের রাজ্যে বিচরণ করেছে–কারণ কিছুতেই এটা হতে দেওয়া হবেনা। স্বায়ত্তশাসনের দাবী যুক্তবাংলার পুরোনো ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই নয়।’ এখানেই শেষ নয়, ভারত সরকারের জন্য সহসা অপরিসীম উদ্বেগে আকুল হয়ে তাদের পক্ষেও অযাচিত ওকালতি করে প্রেসিডেন্ট আয়ুব বলে বসলেন, “ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েই এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করত সক্ষম।”

পরিশেষে যথারীতি সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে আয়ুব বললেন, “স্বায়ত্তশাসনের দাবী পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের হিন্দুদের হাতে তুলে দেবার একটি দুরভিসদ্ধিমূলক পরিকল্পনা।’

যেদিন প্রেসিডেন্ট আয়ুব গৃহযুদ্ধের শাসানী দিচ্ছিলেন সেদিনই ঢাকা স্টেডিয়ামে বিশাল এক জনসভায় সুদীর্ঘ এক বক্তৃতায় শেখ মুজিবুর তাঁর ৬ দফা প্রস্তাবের প্রতিটি ধারার তাৎপর্য বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, এ প্রস্তাবগুলিই পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি এবং তাঁদের ‘মুক্তির সনদ’। প্রস্তাবটি পশ্চিমবঙ্গ দ্বারা অনুপ্রাণিত এ অভিযোগ তিনি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করলেন।

পূর্ববঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের অবাধ শোষণের কথা উল্লেখ করে শেখ মুজিবুর বললেন, পুর্ব-পাকিস্তান সারা দেশের ৭৫% বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে, কিন্ত নিজ উন্নয়নের জন্য তা থেকে পায় মাত্র ৩০%। ফলে প্রকৃত অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, পুর্ব পাকিস্তান আজ পশ্চিমা পুঁজিপতিদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপনিবেশে ও অবাধ শোষনের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি ও জঙ্গী শাসকেরা যে শুধু নিরন্তর পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদকে শোষণ ও লুণ্ঠন করছে তাই নয়, তারা এই শোষণজাত সমস্ত মুনাফা পশ্চিমে সরিয়ে ফেলছে। শেখ সাহেব বললেন, এই কারণে তাঁর ৬ দফার অন্যতম দাবী হচ্ছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পৃথক মুদ্রার প্রচলন।

শেখ মুজিবুর তাঁর ৬ দফার ৬ষ্ঠ ধারা অর্থাৎ পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য আধা সামরিক বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, দেশরক্ষার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে যে কতটা অসহায় করে রাখা হয়েছে তা অত্যন্ত প্রকটভাবে বোঝা গিয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়।

শেখ মুজিবুর প্রশ্ন করেন যে, প্রেসিডেন্ট আয়ুব যদি পুর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাকে এতই দুর্ভেদ্য বলে মনে করে থাকেন তবে তিনি এই উদ্বেগসঙ্কুল একশটা দিনের মধ্যে এক দিনের জন্যও তাঁর দেশের বৃহত্তম অংশ পূর্বাঞ্চলের মাটিতে পা দিলেন না কেন?

আয়ুব সরকার এত বড় বড় বুলি আউড়েছিলেন যে, ভারত পূর্ব-পাকিস্তান আক্রমণ করলে তাঁরা দিল্লীতে মার্চ করবেন। তা যে নেহাতই শুন্যগর্ভ বাগাড়ম্বরতা সেটা বুঝতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের বাকি নেই–রণাঙ্গণে সত্যি যে কি ঘটেছিল তা সবাই জানে।

শেখ মুজিবুর আরও বলেন যে, জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতে চীনের হস্তক্ষেপের ভয়েই ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে সাহস পায় নি। কিন্ত ভুট্টো সাহেবের কথাই যদি সত্যি হয় তবে কি এ কথাই মেনে নিতে হবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাকে একটি বিদেশী রাষ্ট্রের খেয়াল-খুশীর উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। জনাব ভুট্টো এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেননি। কথা ছিল যে ১৯৬৬ সালের ১৭ই এপ্রিল ঢাকায় ভুট্টো সাহেব প্রকাশ্যে এক জনসভায় শেখ মুজিবুরের মুখোমুখি হয়ে তাঁর ৬ দফা প্রস্তাবের মোকাবিলা করবেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে জনাব ভুট্টো পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলেন,–তিনি জানালেন জরুরী কাজের জন্য তিনি আসতে পারছেন না। শেখ মুজিবুর বললেন যে, এ মোকাবিলা-সভায় যোগ দিতে ভুট্টো সাহেবের অক্ষমতা তাঁদের আন্দোলনের পক্ষে নৈতিক বিজয়েরই সূচনা করেছে এবং জনগণ যে ৬ দফার পক্ষে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ দাখিল করেছে।

আয়ুব শাহীর শত সহস্র হুমকী সত্ত্বেও পূর্ব-পাকিস্তানে ছয় দফা দাবী সহ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠতে লাগল। নির্ভীক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট আয়ুবকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানালেন যে, হিম্মৎ থাকলে তিনি অবিলম্বে একটি গণভোটের অনুষ্ঠান করে দেখুন যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন চায় কি না। শেখ মুজিবুর আরও বললেন যে, পূর্ব পকিস্তানে শতকরা ৩০ জন লোকও যদি প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের বিরোধিতা করে তবে তিনি কসম খাচ্ছেন যে, তিনি চিরদিনের মতো রাজনীতি থেকে বিদায় নেবেন।

শঙ্কিত আয়ুব পূর্ব-পকিস্তানের এই গণ-আন্দোলনের মোকাবিলা রাজনৈতিক পর্যায়ে না করে দমননীতির পথ বেছে নিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম চৌধুরী, সহ-সভাপতি জনাব মুজিবুর রহমান (রাজশাহী), শ্ৰম- সম্পাদক জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী; চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ, আওয়ামী নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ প্রমুখ বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মীদের দেশরক্ষা বিধি অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হলো।

কিন্তু গণ আন্দোলন পূর্ণোদ্যমে ও অব্যাহতগতিতে চলতেই লাগল। খাদ্যের দাবীতে ২২শে মে সারা পূর্ব পাকিস্তানে ‘খাদ্য দাবী দিবস’ পালিত হলো। ৭ই জুন সারা প্রদেশব্যপী সর্বাত্মক হরতাল। সে সময় পুর্ব-পাকিস্তানে খাদ্য সমস্যা যে কত তীব্র রূপ ধারণ করেছিল তার কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে ঢাকার সাপ্তাহিক‘জনতা পত্রিকা’র এক মন্তব্য থেকেঃ”দেশময় আজ হা-অন্ন হা-অন্ন রব উঠিয়াছে, আজ হাহাকার উঠিয়াছে পূর্ব-বাংলার সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের ঘরে।’ খাদ্য দাবী দিবসে ঢাকার পল্টন ময়দানে বিশাল এক জনসভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে অবিলম্বে খাদ্য সমস্যার সমাধান ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিরোধ না করা হলে শোষিত নির্যাতিত ও নিরন্ন দেশবাসীর রুটি, রুজির দাবীতে দেশব্যাপী এক প্রচণ্ড গণ আন্দোলন গড়ে তোলবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই প্রস্তাবে আরও বলা হয়, দেশবাসীর অন্ন-বস্ত্ৰ, শিক্ষা স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের দায়িত্ব এড়াইয়া শুধুমাত্র শূন্যগর্ভ আশ্বাসের মাধ্যমে ক্ষুধার্ত জনগণের ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যায় না এবং অস্ত্র প্রয়োগের হুমকি দিয়া কোন সরকার–সে যতই শক্তিশালী হউক না কেন–অধিক দিন ক্ষমতায় টিকিয়া থাকিতে পারে না।’ ৭ই জুনের হরতালের সমর্থনে সারা পূর্ববঙ্গ জুড়ে ব্যাপক প্রস্তুতি চলতে থাকে–অপরদিকে একে বানচাল করবার জন্য সাড়ম্বর পুলিশী তোড়জোড়, নির্বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার ও নানা নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা শুরু হয়।

নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ কর্মী কারারুদ্ধ থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকারী কমিটি ১০ই ও ১১ই জুন অন্যতম সহ-সভাপতিত্বে এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হয়ে ১৭ই, ১৮ই ও ১৯ই জুন প্রদেশব্যাপী জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন এবং ১৬ই আগস্ট থেকে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করবার আহ্বান জানালেন।

নিপীড়নমূলক সম্ভাব্য সব পন্থায় এ আন্দোলনের প্রসার রোধ করতে ব্যর্থ হয়ে আয়ুব সরকার সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নেবার শেষ চেষ্টাও করেছিলেন বাঙালী-অবাঙালী সংঘর্ষের উসকানি সৃষ্টি করে, কিন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী জনতা এ অপচেষ্টা বিষয়ে পূর্বাহ্নেই সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। ৭ই জুন দৈনিক সংবাদ মন্তব্য করেছিলেন,”হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষ বা দাঙ্গার উসকানি দিয়ে যেভাবে প্রতিক্রিয়াশীল গণ-দুশমনেরা জনগণের ঐক্যে বারে বারে ফাটল সৃষ্টি করেছে–জনতার রুটি-রুজির আন্দোলনকে বানচাল করে দিয়েছে, তেমনি বাঙালী-অবাঙালী বিদ্বেষ বা উত্তেজনা সৃষ্টি করেও তারা একই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার প্রয়াস পাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই ধরনের উসকানি ও প্ররোচনা-দাতারা দেশের দুশমন ও জনতার দুশমন।”

পূর্ববঙ্গের প্রগতিবাদী সংবাদপত্রগুলিও স্বৈরাচারী সরকারের রুদ্র-রোষের বলি হয়েছিল। সংবাদ বা মতামত প্রকাশে তাদের অত্যন্ত সীমিত স্বাধিনতাও হরণ করে তেসরা এপ্রিল (১৯৬৬) প্রাদেশিক গভর্নর এক নিষেধাজ্ঞা জারী করে ফতোয়া দেন যে, তাঁরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উপর কোন সংবাদ, মন্তব্য, অভিযোগ বা মতামত প্রকাশ করতে পারবেন না।

১। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে হানিকর কোন প্রসঙ্গ।

২। দেশের এক অংশের বা শ্রেণী বিশেষের অপর অংশকে শোষণের ও উভয় অংশের মধ্যে বৈষম্যের অভিযোগ।

৩। ছাত্র ধর্মঘট, ছাত্র বিক্ষোভ, ছাত্র অসন্তোষ, ছাত্র সভা ও ছাত্রদের বিভিন্নমুখী অভিযোগ ও সে সংক্রান্ত ব্যবস্থা।

এমনকি এই নিষেধাজ্ঞার সরকারী আদেশটির খবরও কোন সংবাদপত্রে প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

আগস্ট মাসের প্রথমে আয়ুব পূর্ব পাকিস্তান সফরে গেলেন। গেলেন বললে সত্যের অপলাপ হবে–সেখানকার ঘটনা প্রবাহ তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক গণ-বিক্ষোভের ভিত্তিতে বিরোধী দলগুলির যৌথ প্রচেষ্টায় একটি যুক্ত সংগ্রাম ফ্রন্ট গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে, উদ্বিগ্ন আয়ূব পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি ছাড়াই সপ্তাহব্যাপী এক সফরে ৬ই আগস্ট ঢাকায় এসে উপস্থিত হন। মুখে তিনি যাই বলুন না কেন, পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে তাঁর মনে আশঙ্কার সীমা ছিল না।

ঢাকায় পৌঁছেই প্রেসিডেন্ট আয়ুব স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকারীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে তাঁদের যেমন করে হোক শায়েস্তা করবার হুমকী দিয়ে বলেন–তাঁদের বেয়াদবির ফল হতে পারে মারাত্মক।

পাকিস্তানের উভয় অংশ সমধর্মী বলে আবার সেই বস্তাপচা ধর্মের জিগীর তুলে বলেন যে ইসলামই দুই পাকিস্তানের মধ্যে সেতু রচনা করেছে এ মন কি তাঁর জিগিরকে জোরদার করবার জন্য পয়গম্বরের নামকেও টেনে আনতে আয়ুব দ্বিধা করেন নি। এর মাত্র ৫ দিন আগে ১লা আগষ্ট তাঁর মাস পয়লা বেতার ভাষণে তিনি বলেন যে, দেশের দুই অংশকে যুক্ত করার শক্তি ও সুত্র পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ-এর মহান ব্যক্তিত্বের প্রভাবেই তাঁরা লাভ করেছেন– যতদিন এই যোগসূত্রের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন জাতীয় একতা অক্ষুন্ন থাকবে।

শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমাদের বাঁচার দাবী ও ৬ দফা কর্মসূচি’ এই নাম দিয়ে একটি ঐতিহাসিক পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। এই পুস্তিকাটি ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। শেখ মুজিবুর তাঁর এই পুস্তিকায় বলেছিলেন ‘আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবীতে যে পূর্ব পাকিস্তানে সাড়ে ৫ কোটি শোষিত ব্যথিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই।

তাঁর ৬ দফা দাবীগুলির বিশ্লেষণ করে শেখ মুজিবুর পশ্চিম পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে বলেছেনঃ ‘আপনারা ঐ সব দাবী করিলে আমরা পূর্ব’ পাকস্তানীরা কি করিতাম জানেন? আপনাদের সব দাবী মানিয়া লইতাম। আপনাদিগকে প্রাদেশিক বলিয়া গাল দিতাম না। কারণ আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, ও সব আপনাদের হক পাওনা। নিজের হক পাওনা দাবী করা অন্যায় নয়, কর্তব্য। আমরা শুধু নিজেদের হকটাই চাই। আপনাদের হটা অত্মসাৎ করিতে চাই না।’

উপসংহারে মুজিবুর বলেছেন, কায়েমী স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছেন। এটা নতুনও নয় বিস্ময়ের কথাও নয়। পূর্ব পাকিস্তানের মজলুম জনগণের পক্ষে কথা বলিতে গিয়া আমার বাপ, দাদার মত মরুব্বিরাই এদের কাছে গাল খাইয়াছেন, এদের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করিয়াছেন, আর আমি তো কোন্ ছার? দেশবাসীর মনে আছে, আমাদের নয়ন–মণি শেরে-বাংলা ফজলুল হককে এঁরা দেশদ্রোহী বলেছিলেন। দেশবাসী এ-ও দেখিয়াছেন যে, পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা শহীদ সোহারাওয়ার্দীকেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবরণ করিতে হইয়াছিল এদের হাতে। এতএব দেখা গেল পূর্বপাকিস্তানের ন্যায্য দাবীর কথা বলিতে গেলে দেশদ্রেহিতার বদনাম ও জেল জুলুমের ঝুঁকি লইয়াই সে কাজ করিতে হইবে। অতীতে এমন অনেক জেল-জুলুম ভুগিবার তদির আমার হইয়াছে। সাড়ে ৫ কোটি পূর্বপাকিস্তানীর ভালবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যে কোনও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মত নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতটুকু?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *