আমি মুজিব বলছি – ৩

চট্টগ্রামে মৌলানা ভাসানী

জনগণ রাজনৈতিক দলগুলির চাইতে এগিয়ে আছে

চট্টগ্রাম ২০শে মার্চ-ন্যাপ প্রধান মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, স্বীয় দাবীর জন্য ত্যাগ স্বীকার বোধের ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলের চাইতে জনসাধারণ অনেক বেশী এগিয়ে আছে। তাই সবগুলি রাজনৈতিক দলের উচিত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরা।

মৌলানা ভাসানী শনিবার রাত্রে পাঁচলাইশে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাধায়ক সরকার গঠন করার জন্যে আবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে পরামর্শ দিয়েছেন। স্ব- স্বাধীন পূর্ব বাংলার দাবী জানিয়ে মৌলানা বলেন যে, এই তত্ত্বাধায়ক সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে যে পাওনা তা নিষ্পত্তি করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য চালু রাখার প্রচেষ্টা করবে।

মৌলানা বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যদি এই দাবী মেনে না নেন তবে তিনি পূর্ব বাংলায় ভিয়েতনামের চাইতেও বেশী জোরদার আন্দোলন শুরু করবেন।

তিনি আরও বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ এতে জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তিই সৃষ্টি করবে।

মৌলানা বলেন যে, শেখ মুজিব যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তাহলে বিশ্বের সকল স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি স্বাধীন পূর্ব বাংলাকে স্বীকৃতি দেবে।

গ্রামে গ্রামে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং একসের খাদ্য শস্যও যাতে দেশের বাইরে পাচার হতে না পারে সেই ব্যবস্থা করার জন্য জনগণের প্রতি মৌলানা আবেদন জানিয়েছেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার জন্য আহ্বান জানিয়ে মৌলানা কঠোর পরিশ্রম, অধিক খাদ্য উৎপাদন এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে কৃচ্ছতা সাধন, খাদ্য উদ্ধৃত্ত এলাকা থেকে ঘাটতি এলাকায় খাদ্য-শস্য চলাচলের ব্যবস্থা করার জন্যে আবেদন জানিয়েছেন।

জয়দেবপুরে অসামরিক লোকদের গুলী করে হত্যা করার কথা উল্লেখ করে মৌলানা বলেন যে, নিরস্ত্র লোকেদের হত্যা করা কোরাণের শিক্ষার পরিপন্থী। পূর্ব বাংলার জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহার না করার জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেন যে, আমাদের জনগণের উপর ফের হামলা চালানো হলে তার চ্যালেঞ্জ করা হবেই। শাসকচক্র যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে তাহলে মুক্তিসংগ্রামরত জাতিগুলোর পথই তারা বেছে নিতে বাধ্য হবে।

মার্শাল ল তুলে নিতে হবে।

পশ্চিম পাকিস্তানের তিনজন নেতা এখন ঢাকায় আছেন। আগে থেকেই আছেন সীমান্তের খান ওয়ালী খান। এখন এসেছেন মিয়া মমতাজ দওলতানা আর মুফতী মাহমুদ। মুফতী মাহমুদ সাহেব সম্প্রতি লাহোরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলোর এক যুক্ত বৈঠক করে এসেছেন। সে বৈঠকে ভুট্টো সাহেবের দল ও কাইয়ুম খানের দল যোগ দেন নি। অন্য যাঁরা দিয়েছিলেন তাঁরা বহু শলা-পরামর্শ করে এসেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় এখন তাঁরা যুক্তভাবে বসবাসের শেষ চেষ্টা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর ফর্মূলা প্রয়োজন হলে পুরোপুরি মেনে নেওয়ার মানসিক প্রস্তুতিই গ্রহণ করেছেন।

এদিকে ওয়ালী খান সাহেব চার-পাঁচ দিন এখানে সরেজমিনে অবস্থাদি পর্যালোচনা করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তিনি অবশ্য চান যে সবাই মিলে সোজা হেঁটে জাতীয় পরিষদে হাজির হবেন, সেখানেই যা হয় ফয়সালা করা যাবে। এই গণহত্যা ও ষড়যন্ত্রের পর বাংলাদেশে যে প্রচণ্ড অসহযোগ চলছে তাতে যেখানে বাংলার অধিনায়ক সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীকে পূর্ব শর্ত দিয়েছেন সেখানে সোজা পথে জাতীয় পরিষদে হেঁটে যাওয়া আর সহজ নয়। তাই এখন পশ্চিম পাকিস্তানের এই তিন দলের মধ্যে গুরুত্ব সহকারে গোপন মত বিনিময় শুরু হয়েছে।

মিয়া দওলতানা শনিবার সকালে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দেশের ঐক্য রক্ষা আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার-এ দুটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে সকলকে চলতে হবে’ তিনি শেখ সাহেবকে প্রিয় বন্ধু, ভাই ও নেতা বলেও অভিহিত করেছেন। তিনি শেখ সাহেব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনার আগে শনিবার সকালে পশ্চিম পাকিস্তানী অন্যান্য নেতাদের নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দীর্ঘক্ষণ ধরে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে ওয়ালী খান, জনাব গওস বখশ বেজেঞ্জো, মুফতী মাহমুদ এবং কাউন্সিল লীগের সর্দার শওকত হায়াত খান ও ক্যাম্বেলপুরের এম এন এ পীর সাইফুদ্দিন অংশ গ্রহণ করেন।

এ তিন দল যদি একমত হয়ে অবশেষে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রে আপন আপন সত্তা নিয়ে এক সাথে থাকার স্বার্থে বাংলাদেশের একক বক্তব্যে শরীক হন তবে কাইয়ুম খান ভিন্ন পথ ধরতে পারবেন না বলে এঁদের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা গেছে। সীমান্তে ওয়ালী ন্যাপ ও মুফতী মাহমুদের দলের মধ্যে ঐক্যফ্রন্ট আপাতত নেই। ফলে কাইয়ুম খান সীমান্তে ক্ষমতাশীন হওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকতে পারছেন। কিন্তু এখানে এই পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায় ওয়ালী ন্যাপ ও হাজারভী জমিয়তে সমঝোতা হলে কাইয়ুম খান সে সুযোগও হারাবেন। তাই বাধ্য হয়েই হয়ত তিনি দলে ভিড়তে পারেন।

রাষ্ট্রীয় নীতির সব আলোচনার শেষ কথা হচ্ছে সামরিক আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নে অর্থাৎ অন্য কথায় প্রধান সামরিক প্রশাসকের এল-এফ-ও। তাই সমাধানের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়াজন হবে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় শাসনতান্ত্রিক কাঠামে নিরূপণ।

পশ্চিম পাকিস্তানের এই তিন নেতার ভূমিকাও তাই লক্ষ্যণীয় ব্যাপার।

শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যান

—বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি

আওয়ামী লীগ প্রধান জনাব শেখ মুজিবুর রহমান শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শনিবার এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, এবারের সংগ্রামে প্রতিটি শহর, নগর, বন্দর ও গ্রামে আবাল বৃদ্ধবণিতা বাংলাদেশের দাবীর পিছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছে। তারা যে ঐক্যবদ্ধভাবে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে বিশ্বের সামনে বাংলার মানুষ আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি আওয়ামী লীগের নির্দেশের আওতায় থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার কাজে নিরলস পরিশ্রম করার জন্যে সর্বস্তরের জনগণকে-ক্ষেতের চাষী, কারখানার শ্রমিক, অফিসের কর্মচারী সবাইকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নির্দেশসমূহ যথাযথভাবে প্রয়োগ করার জন্যে যাঁরা অতন্দ্র প্রহরীর মত কাজ করেছেন সেইসব ছাত্র, শ্রমিক এবং কর্মচারী সংগঠনগুলোর সদস্যদের আমি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমাদের জনগণ প্রমাণ করেছেন তাঁরা সুচারুভাবেই তাঁদের নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।

তিনি উসকানিমূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার জন্য ধ্বংসাত্মক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, জনসাধারণের নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানো অব্যাহত রাখার স্বার্থেই অর্থনৈতিক তৎপরতা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জনগণকে কঠোর শৃঙ্খলা পালন করতে হবে।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিবৃতি

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, জনাব শাজাহান সিরাজ, জনাব আ. স. ম. আবদুর রব ও জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখন শনিবার সংবাদপত্রে একটি যুক্ত বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, আমরা বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারলাম ঢাকায় বিভিন্ন বাণিজ্য- কেন্দ্রে ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিক ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চারজন সদস্যের যে কোন একজনের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। আমরা বহুবার পত্রিকার মাধ্যমে, বিবৃতিতে বলেছি যে সংগ্রাম পরিষদের নামে যেন কোন চাঁদা দেওয়া না হয়। আমাদের কোন চাঁদার প্রয়োজন হলে সংগ্রাম পরিষদের চার সদস্য একত্রে চাঁদা সংগ্রহ করতে যাবো। একজনের নামে চাঁদা আদায় করতে গেলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট লোক প্রতারক এবং তাকে পুলিশে সোপর্দ করবেন।

অসহযোগ আন্দোলন

মুক্তি আন্দোলন লক্ষ্যে পৌঁছবেই

বীর বাঙালীর দৃপ্ত পদচারণায় রাজধানী ঢাকা টলমল হয়ে কাঁপছে। প্রতিদিন চলেছে অসংখ্য মানুষের দৃপ্ত মিছিল। সকলের মুখে একই ধ্বনি “শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। স্বাধীন কর স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। আপোস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম।” দ্রুত পায়ে মিছিলের পর মিছিল এগিয়ে চলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে, সেখান হতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে। বাংলার মুক্তি সংগ্রাম ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচণ্ড অসহযোগ আন্দোলনের উনবিংশতিতম দিবসে শনিবার হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল। মিছিলের প্রতিটি মুখই ছিল সংগ্রামী চেতনায় ভাস্বর। তাদের চোখ থেকে আগুণের কনা ঠিকরে পড়ছে। মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তারা রাস্তায় নেমেছে। প্রতিটি মানুষ আজ সংগ্রামের এক একজন বীর সেনানী আর প্রতিটি গৃহ এক একটি দুর্ভোদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছে। যারা দুর্জয় শপথ নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কর্মচারী, সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের কর্মচারী, ঔষধ শিল্প কর্মচারী, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীবৃন্দ। সকলেই এই গণ-আন্দোলনকে সফল করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে এবং এজন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারের শপথ নেয়।

আওয়ামী লীগ প্রধানের বাসভবনের সামনে গতকাল বহু মিছিল যায়। এসব মিছিলের উদ্দেশ্যে ভাষণ দান কালে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশকে উপনিবেশ ও বাজার হিসাবে রাখার দিন শেষ হয়ে গেছে।

তিনি দৃঢ় আশা প্রকাশ করেন যে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালী বর্তমানে যে মুক্তি-আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তারা ঈন্সিত লক্ষ্যে পৌঁছবেই।

তিনি বলেন, যে জাতি রক্ত দিতে জানে তাদের কোন বাহিনীই দাবিয়ে রাখতে পারে না- সেনাবাহিনী যতই শক্তিশালী হোক না কেন।

সংগ্রাম চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গে থাকব। তিনি বলেন, আমাদের পেশ করা দাবী যদি গৃহীত না হয় তাহলে সংগ্রামের জন্য আমাদের তৈরী থাকতে হবে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এক–জয় তাদের অনিবাৰ্য।

২৩শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশে ছুটি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শনিবার ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, ইতিমধ্যে ঘোষিত ব্যাখ্যাসহ সমস্ত নির্দেশ এবং নতুন কোন নির্দেশ সাপেক্ষে ১৪ই মার্চ ঘোষিত কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে এবং ২৩শে মার্চ (লাহোর প্রস্তাব দিবস উপলক্ষে) সারা বাংলাদেশে ছুটি পালিত হবে।

স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগামী ২৩শে মার্চ প্রতিরোধ দিবসে সকাল ছয়টায় বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারী বেসরকারী অফিস আদালত ও বাসভবনের স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করার আহ্বান জানিয়েছেন।

ভাসানী ন্যাপ

মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কর্তৃক আহূত ২৩শে মার্চ স্বাধীন ‘পূর্ব বাংলা দিবস’ পালনের প্রস্তুতি হিসাবে শনিবার নর্থ সাউথ রোড, বায়তুল মোকাররম, গুলিস্তান, নওয়াবপুর, রেলগেট, ঠাটারী বাজার রাস্তায় পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সকল পথসভায় জনাব আবদুল হামিদ সিরাজুল হক, আবদুল খালেক এডভোকেট, শেখ মনিরুজ্জামান, শাখাওয়াত মতিন, আবদুস সামাদ এবং নাজির আহমদ প্রমুখ ন্যাপ নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন।

জাতীয় শ্রমিক লীগ

জাতীয় শ্রমিক লীগের স্বাধীন বাংলাদেশ শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ ২৩শে মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য বর্জনের সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন।

[দৈনিক পাকিস্তান-২১ শে মার্চ, ১৯৭১]

শনিবার ২০শে মার্চ-প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুজিবুরের চতুর্থ দফা আলোচনা হল। আলোচনা চলল দু ঘণ্টা ধরে। এই আলোচনায় মুজিবুরের সঙ্গে ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ, কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খোন্দকার মুস্তাক আহমদ, মনসুর আলী ও ডঃ কামাল হোসেন, ইয়াহিয়া খাঁর পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এ আর করনেলিয়াস। এদিকে আওয়ামী লীগের উগ্রপন্থীরা মঙ্গলবার দেশের সর্বত্র প্রতিরোধ দিবস পালনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রতি বাড়ীতে নূতন বাংলাদেশের পতাকা তুলতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত ছাত্র নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না কারার জন্য সমস্ত বিদেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে আবেদন জানিয়েছে। তাঁরা বলেছেন, অস্ত্র বিদেশী রাষ্ট্রের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য, আভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ দমনের জন্য নয়।

জয়দেবপুরের গুলী চালনায় ৪০ জন নিরস্ত্র বাঙালীকে হত্যা করায় শেখ মুজিবুর রহমান এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, সরকার যদি মনে করে থাকেন যে এইভাবে গুলী করে মানুষ হত্যা করে জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করতে পারবেন তবে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। তিনি বলেন, দেশ বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন তার সমাধান শান্তিপূর্ণভাবে হতে পারে। কিন্তু ধৈর্য ও সহিষ্ণুতারও একটা সীমা আছে। জয়দেবপুরের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঘটনার ঠিক পরেই কারফিউ জারী করে মৃত ও আহতদের সরিয়ে আনবার কাজে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। যখন সামরিক প্রশাসকেরা ঘোষণা করেছেন যে সৈন্যদের ব্যারাকে পাঠানো হয়েছে তখন সৈন্যরা কি করে বাজার ও অন্যান্য অঞ্চলে থাকতে পারে তা বোধের অগম্য। এই রকম পাশবিক শক্তির প্রয়োগে বাংলার জনগণকে দাবিয়ে রাখার দিন ফুরিয়ে গেছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ জীবন উৎসর্গ করতে শিখেছে। তারা তাদের অভীষ্ট সাধনের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।

একদিন করাচীর খবর-জনাব ভুট্টো ঢাকায় রওনা হচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে থাকবেন ২০ জনের একটি প্রতিনিধি দল।

রবিবার ২১শে মার্চ-ভুট্টো ঢাকায় এলেন। কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার মধ্যে ভুট্টোকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ভুট্টো ঢাকা পৌঁছানো মাত্র হাজার হাজার যুবক ও ছাত্র ভুট্টোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান। কয়েক হাজার ছাত্র ছোরা ও তরোয়াল নিয়ে রাস্তায় ঘুরতে থাকে। তাদের মুখে ধ্বনি, ‘ব্রেকফাস্টের জন্য ভুট্টোকে চাই।’ ভুট্টো ঢাকা পৌঁছেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং উভয়ের মধ্যে নিভৃতে বৈঠক হয়। এইদিন শেখ মুজিবুরের সঙ্গেও প্রেসিডেন্টের এক বৈঠক হয়। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার পর শেখ মুজিবুর সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলবে। বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছেন। আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাঁচতে চাই। এদেশ আর কারও উপনিবেশ হিসাবে গণ্য হতে নারাজ।

ভুট্টোর ঢাকায় আগমন

২১শে মার্চ বিকেল ৫টায় দলের অন্য ১২ জন নেতা সহ ভুট্টো ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ভুট্টোর ঢাকা আসার গোপন সংবাদ জানতে পেরে তেজগাঁ বিমান-বন্দরের আশেপাশে অসংখ্য মানুষের ভিড় হয়। এদের অনেকেরই হাতে ভুট্টোবিরোধী ফেস্টুন ছিল। জনসাধারণকে বিমান বন্দরের ধারে কাছেও আসতে দেওয়া হয়নি। কারণ এর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই সারা বিমান-বন্দর এলাকা সশস্ত্র সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছিল। কোন সংবাদদাতাকেও বিমান-বন্দর এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হয় নি। বিশেষত গণহত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যে কালো ব্যাজ ধারণ করেছিলেন তাঁদের কাউকেই বিমান-বন্দরের সীমানায় এক কদমও আসতে দেওয়া হয়নি। বিমান থেকে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই সৈন্যবাহিনীর কঠোর পাহারায় একটি কালো মার্সিডিজ বেন্‌জ গাড়ীতে ভুট্টোকে ওঠানো হয়। পিছনের সিটে ভুট্টোকে মাঝখানে বসিয়ে তাঁর দুইপাশে দুইজন দেহরক্ষী ২টি ষ্টেনগানের নল গাড়ীর জানালার দিকে তাক্ করে রেখে দ্রুতগতিতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে চলে যায়।

ওইসময় আশেপাশে অপেক্ষমান মানুষ ভুট্টোবিরোধী বিভিন্ন শ্লোগান দেন। হোটেলে পৌঁছনোর পর কঠোর পাহারায় ভুট্টোকে হোটেলের করিডোর দিয়ে লিফটের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। লিফটে তোলার পর বেশ কিছু সময় লিফটের দরজা বন্ধ না হবার দরুন সবাই বিশেষ শঙ্কিত হয়ে পড়েন ঐ সময় ভুট্টোবিরোধী শ্লোগান চরমে ওঠে। ক্ষিপ্ত জনতা চার পাশ হতে জুতো, স্যাণ্ডেল ভুট্টোর মাথায় মারে। ঐ সময় ভুট্টোকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। তাঁর মুখ কপাল বেয়ে টপ টপ করে ঘাম পড়ছিল। পাঁচ মিনিটের পর লিফটের দরজা বন্ধ হলে ভুট্টো উপরে চলে যান। এর পরও অনেকক্ষণ বিভিন্ন স্থান হতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী হোটেলের আশেপাশে দাঁড়িয়ে ভুট্টোবিরোধী শ্লোগান দেয়। ওই দিন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সমস্ত বাঙালী কর্মচারী স্বাধীন বাংলার প্রতীক ব্যবহার করেন। সামরিক কর্মচারীরা তা খুলে ফেলার জন্য পীড়াপীড়ি করলে সমস্ত কর্মচারী কাজ বয়কটের হুমকি দেন এবং ওই সব সামরিক কর্মচারী প্রতীক খুলে ফেলার প্রচেষ্টা ত্যাগ করে।

পরদিন শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হলে জনগণের মধ্যে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। ঐ বৈঠক সম্বন্ধে শেখ মুজিবুর বলেন, ‘আমিও ঢাকায় এবং প্রেসিডেন্টও ঢাকায়, কাজেই আমরা যে কোন সময়েই একসঙ্গে মিলিত হতে পারি। এতে সন্দেহের কিছু নেই ‘

ইতিমধ্যেই অন্য সব দলের নেতারাও প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসে প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবুরের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে ২৭ মাইল উত্তরে জয়দেবপুরে সামরিক বাহিনীর গুলীতে ৫ জন নিহত হওয়ার ফলে আলোচনায় কিছুটা গরম হাওয়ার সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট এই ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দেন।

২৪ তারিখের মধ্যে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নেতারা (কেবল ভুট্টোর দলের পাঁচ জন ব্যতীত) করাচী চলে যান। ২৪ তারিখে ভুট্টো জানান, তিনি ও তাঁর দলের অন্যান্য নেতারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনার বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করেছেন। ওই দিনই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়। বাংলার জনগণের তখনও ধারণা ছিল যে, ২৫শে মার্চেই ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন। কিন্তু জনগণ এবারও প্রতারিত হন। ওই দিনই গভীর রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে হঠাৎ ঢাকার দিকে দিকে শোনা যেতে লাগল গুলী, বোমার আওয়াজ। জানা গেল ইয়াহিয়া আর ভুট্টো গভীর রাতে ঢাকা ছেড়ে পালিয়েছেন নতুন নির্দেশ দিয়ে।

[গণশক্তি- ৫ই এপ্রিল]

সোমবার ২২শে মার্চ ভুট্টোর উপস্থিতিতে মুজিবুর ও ইয়াহিয়া খাঁর বৈঠক অনুষ্ঠিত হল। এই বৈঠকের পর সকলেই আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে বলে মন্তব্য করলেন। ফলে সব মহলে বেশ কিছু খুশীর ভাব দেখা গেল। প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খাঁর জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত ষোঘণা করে দিলেন। ২৫শে মার্চ এই বৈঠক হবার কথা ছিল।

‘ইত্তেফাক’ সম্পাদকীয় লিখল : “সংকট নিরসনের পথে”।

সোমবার ঢাকায় এই মর্মে আভাস পাওয়া গিয়াছে যে, রাজনৈতিক সংকট নিরসনের পন্থা চূড়ান্ত করার পদক্ষেপ হিসাবে প্রেসিডেন্ট দুই একদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের এক যৌথ বৈঠকে মিলিত করার চেষ্টা করিতে পারেন। সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যেই তিনি কাইয়ুম খানকে তলব করিয়া আনেন। অন্য পশ্চিমাঞ্চলীয় গণপ্রতিনিধিত্বশীল নেতারা বর্তমানে ঢাকায় রহিয়াছেন। এদিকে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর এবং জনাব ভুট্টো আলোচনায় অগ্রগতি হইতেছে বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। চারি দফা পূর্ব শর্ত পূরণ করা না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিবে না বলিয়া ঘোষণা করিয়া এ ব্যাপারে শেখ সাহেব যে আপোসহীন ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন, ইয়াহিয়া ও ভুট্টো উহার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইয়াছেন বলিয়া অনুমতি হইতেছে। সম্ভবত সেই কারণেই অর্থাৎ সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর সহ বঙ্গবন্ধুর দাবী পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তই ভুট্টোর উপস্থিতিতে শেখ সাহেবের সঙ্গে বৈঠক চলাকালেই সোমবার প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবার স্থগিত ঘোষণা করিয়াছেন। যদি শেষ মুহূর্তে ব্যক্তিবিশেষের কারণে অতিনাটকীয় কিছু না ঘটে তবে অচিরেই সামরিক আইন প্রত্যাহৃত এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর ব্যবস্থা গৃহীত হইতে যাইতেছে। আরও জানা গিয়াছে যে শেখ মুজিবের দাবী অনুসারে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পরই নয়া সরকারের রূপরেখা নির্দিষ্ট হইবে। ইতিমধ্যে শেখ সাহেব সোমবার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলিয়াছেন যে, ‘আমাদের আন্দোলন চলিতেছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত থাকিবে।’ তিনি আরও বলিয়াছেন, ‘বাংলার মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান চায়। কিন্তু উহা না হইলে সংগ্রামের মাধ্যমেই তারা লক্ষ্যে গিয়া পৌঁছিবে।’

বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে আলোচনাকল্পে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সোমবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর সঙ্গে ৭০ মিনিট স্থায়ী ষষ্ঠ দফা বৈঠকে মিলিত হন। এই সময় জনাব ভুট্টোও উপস্থিত ছিলেন। বিগত সাধারণ নির্বাচনের পর তিন জনের একই টেবিলে উপবেশন ও আলোচনা এই প্রথম। এই আলোচনাকালে আর কেহ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। এই সময় প্রেসিডেন্ট ভবনের আশেপাশে পূর্ববর্তী যে কোন দিনের তুলনায় সামরিক বাহিনীর কড়া প্রহরা মোতায়েন ছিল। শেখ মুজিবুরের সমর্থনে ও ভুট্টোর বিরুদ্ধে স্লোগানরত জনতার কলেবর ছিল সর্ববৃহৎ শেখ সাহেব প্রেসিডেণ্ট ভবনে পৌঁছাইবার পাঁচ মিনিট আগে ভুট্টো সেখানে প্রবেশ করেন; বঙ্গবন্ধুর প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগের পরে এক ঘণ্টা ভুট্টো সেখানে অবস্থান করেন।

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার পর স্বীয় বাসভবনে ফিরিয়া শেখ সাহেব সাংবাদিকদের আভাস দেন যে, আলোচনার আরও অগ্রগতি হইয়াছে। তিনি বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হইয়াছি। সেখানে ভুট্টো সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে প্রেসিডেণ্ট আমাকে জানান যে তাঁহার সঙ্গে আমার যে সব আলোচনা হইয়াছে তাহা তিনি জনাব ভুট্টোকে অবহিত করিয়াছেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিবুর বলেন, ‘আমাদের দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করিতে পারি না। আর সেই অনুসারেই প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করিয়াছেন।’ আর এক প্রশ্নের উত্তরে শেখ সাহেব বলেন, ‘অগ্রগতি না হইলে আমি আলোচনা অব্যাহত রাখিয়াছি কিসের জন্য।’

প্রেসিডেন্ট ভবন হইতে আলোচনা-শেষে বাহির হইয়া আসিলে সামরিক বেষ্টনীর বাহিরে বিপুল জনতা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির সাহায্য তাঁহাকে স্বাগত জানান। শেখ সাহেবের প্রস্থানের পর জনতা আবার পূর্বস্থান দখল করে। ঘণ্টাখানেক পরে জনাব ভুট্টো বাহির হইয়া আসিলে জনতা তাঁহার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। জনতা চরম ভুট্টো-বিরোধী স্লোগান দেয়। অগ্রপশ্চাতে ষ্টেনগান সজ্জিত সামরিক বাহিনীর মধ্যস্থলে থাকিয়া ভুট্টো হোটেল ও প্রেসিডেন্ট ভবনে যাতায়াত করেন। জনাব ভুট্টোর দু’পাশে বন্দুকের নল উঁচাইয়া দু’জন রক্ষী উপবিষ্ট ছিল। হোটেল প্রাঙ্গণে আসিয়া পৌঁছিবার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকরা ভুট্টোর নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু কেহই তাঁহার নিকটে যাইতে পারেন নাই। একজন সাংবাদিক ছুটিয়া গিয়া প্রশ্ন করিলে জনাব ভুট্টো সংক্ষেপে জবাব দেন– “প্রগ্রেসিং”।

[ইত্তেফাক- ২৩শে মার্চ, ১৯৭১]

সোমবার ঢাকায় সর্বাধিক সংখ্যক মিছিল বাহির হয়। বিশেষ করিয়া ‘বায়তুল মোকাররম’, শহীদ মিনার, নিউমার্কেট এলাকা, মীরপুর রোড মিছিলে মিছিলে ছাইয়া যায়। বস্তুত নিউমার্কেট এলাকা হইতে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডীস্থ বাসভবন পর্যন্ত দীর্ঘ ও সুপ্রশস্ত সমগ্র রাস্তা যেন উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। চৈত্রে নিদাঘ আকাশে জ্বলন্ত সূর্যের দাবাগ্নির তীব্র দাহনে রাস্তার গলিত উত্তপ্ত পীচকে উপেক্ষা করিয়া অগ্নিশপথের হুঙ্কার দিয়া চলে অগনিত মানুষের অন্তহীন মিছিলের স্রোত। সকালের দিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এই সময় হোটেলের আঙ্গিনায় মেশিনগান ষ্টেনগানধারী সশস্ত্র সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল। মিছিলকারীগণ ভুট্টো ও সামরিক বাহিনীর গণহত্যা বিরোধী স্লোগানে ফাটিয়া পড়ে। মিছিলকারীদের মধ্যে অনেককে পায়ের জুতো ও স্যাণ্ডেল উপরে তুলিতে দেখা যায়। একটি দীর্ঘ মিছিলে ভুট্টোর ‘কুশপুত্তলিকা’ বহন করে আনা হয়। কুশপুত্তলিকাটি বিক্ষুব্ধ মিছিলকারীগণ বর্শার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন করিয়া ফেলে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এইদিন এক বাণীতে বলেন, ‘জাতিকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে পাকিস্তান এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। যখন আমাদের মূল জাতীয় অস্তিত্বই বিপদাপন্ন তখন আসুন আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার দরবারে প্রার্থনা জানাই- তিনি যেন আমাদের সঠিক পথে পরিচালনা করেন।’

মঙ্গলবার ২৩শে মার্চ ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়– “এবারের ২৩শে মার্চ”–

সারা দেশে এবারও ২৩ মার্চ উদযাপিত হইতেছে। কিন্তু এ এক নবতর ২৩শে মার্চ নতুন ইহার সাজ। নতুন ইহার সুর। নতুন ইহার ধ্বনি। ২৩শে মার্চ বলিতে মানুষ এতদিন যাহা বুঝিত তাহা আর নাই, মানুষের সেই ধ্যান-ধারণা আমূল বদলাইয়া গিয়াছে। তদস্থলে ২৩শে মার্চ নতুন আঙ্গিকে পরিগ্রহ করিয়াছে সম্পূর্ণ নতুন এক রূপ, নতুন এক অর্থ। কেন্দ্ৰীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ইহাকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ রূপে পালনের ডাক দিয়াছেন। শেখ সাহেব ইহাকে সাধারণ সরকারী ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করিয়া ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন দিবস’ হিসাবে উদ্যাপনের আহ্বান জানাইয়াছেন। তাই ২৩ বছর ধরিয়া যে ২৩শে মার্চ লাহোর প্রস্তাব দিবস’ বা ‘পাকিস্তান দিবস’ রূপে প্রতিপালিত হইয়া আসিয়াছে তাহা আজ উদ্‌যাপিত হইতেছে প্রতিরোধ দিবস রূপে তথা লাহোর প্রস্তাবায়ন দিবস রূপে। বাংলাদেশে সাত কোটি মানুষ অভিন্ন সুরে আজ যে আওয়াজ তুলিতেছে, সে আওয়াজ হইল সকল অত্যাচারের উদ্ধত শিরে বজ্র হানিয়া স্বরাজ ও স্বাধিকার ছিনাইয়া আনার আওয়াজ, সঙীন ও বুলেট প্রতিরোধের আওয়াজ।

শেখ সাহেব এই দিনটিকে লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের দিন হিসাবে পালনের যে কথা বলিয়াছেন তাহা অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা লাহোর প্রস্তাব কেবল ভৌগলিক স্বাধীনতারই ছক ছিল না, ছক ছিল জনগণের স্বাধীনতারও। কিন্তু কালক্রমে দেখা গেল স্বাধীনতার নামে আমরা যা পাইলাম, তা কেবল ভৌগলিক অর্থেই সত্য হইল, দেশের আপামর মানুষের জীবনের কোথাও তার কোন স্পর্শ লাগিল না। স্বাধীনতার নামে মানুষের স্বাধিকার হরণ যেমন লাহোর প্রস্তাবের প্রতিপাদ্য ছিল না, তেমনি সে প্রস্তাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে কলোনী বানাইবার ও তার কোটি কোটি মানুষকে ক্রীতদাসে পর্যবসিত করারও কোন প্রস্তাবনা ছিল না। কিন্তু ক্ষমতা হাতে পাইবার পর হইতে শাসকগোষ্ঠী ২৩টি বৎসর যাবৎ তাহাই করিয়াছে এবং সংহতির নামে দুই যুগ ধরিয়া গণ-শোষণ, নিপীড়ন ও স্বাধীনতা হরণ কার্যই চালাইয়াছে। একটা ভৌগোলিক অঞ্চল হিসাবে এদেশের মানুষ স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথা ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট শুনিয়াছিল বটে, কিন্তু বাংলার হতভাগ্য মানুষ সে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করিতে পারে নাই। জনসংখ্যাগরিষ্ঠ এই অঞ্চলের মানুষেরা স্বাধীনতার যে ‘অমৃত’ ভোগ করিয়াছে তাহা হইল নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষন ও বঞ্চনা। ‘ঝুটা আজাদীর এমনি মহিমা যে বাংলার বঞ্চিত বিশীর্ণ মানুষের প্রতিবাদ জানানোর অধিকারটুকুও উহার কল্যাণে হৃত লুণ্ঠিত হইয়াছে। বস্তুত বাক স্বাধীনতাই হইয়াছে নব্য ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর হস্তে ফাষ্ট ক্যাজুয়ালটি এবং স্বাধীনতার মূল সনদ লাহোর প্রস্তাব হইয়াছে উহাদের মেশিনগানের মুখ্য শিকার। তাই রাস্ট্র পত্তনের পর ২৪টা বৎসরও যাইতে পারিল না। সবকিছু তছনছ হইয়া গেল, এমন কি মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, ধ্যান ধারণার রাজ্যেও সমস্ত কিছু লন্ডভন্ড হইয়া পড়িল। অতীতের নাম নিশানা পর্যন্ত বিলুপ্তির যোগাড়। মূলে ভুল না থাকিলেও থুলে ভুল হইয়াছে এবং সেই ভুলেরই খেসারত দিতে দিতে মানুষকে আজ প্রাণান্ত হইতে হইতেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের স্রোতে যে স্বাধীনতার আগমন, সেই স্বাধীনতার মূল অঙ্গীকারের সঙ্গেই করা হইয়াছে নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা। যাহারা যত বেশী ‘ সংহতির’ দোহাই পাড়িয়াছে তাহারা তত বেশী ‘সংহতির’ গোড়া কাটিয়াছে। সংহতির নাম শুনিলে মানুষের প্রাণে জাগে ভয়, বুঝি বা উহা নতুন কোন নিপীড়নের কলাকৌশল। অতএব বাঙালী মানসের আজিকার এই বিস্ফোরণ অকারণ নয়। শাসক শোষকরাই বাঙালীকে এই পর্যায়ে লইয়া আসিয়াছে এবং এই তুলনাহীন বিস্ফোরণ সংঘটন ও অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছে। এবারের ২৩শে মার্চের ভিন্ন সাজ ও ভিন্ন সুরের জন্য সর্বাংশে তাহারাই দায়ী। এবারের ২৩ শে মার্চ যে সকল প্রশ্ন আনিয়া উপস্থিত করিয়াছে, তাহার প্রত্যেকটির মোকাবিলা করিতে হইবে, বাস্তবের পটভুমিতে বিচার করিয়া তার সময়োপযোগী সুষ্ঠু স্থায়ী সমাধান দিতে হইবে। পাশ কাটাইয়া যাইবার উপায় নাই।

সাত কোটি মানুষ যখন ঐক্যবদ্ধ হইয়াছে
তখন দাবী আদায় করিয়া ছাড়িব
–শেখ মুজিব

সোমবার স্বীয় বাসভবনের সন্মুখে জমায়েত বিপুল জনতার উদ্দেশে ভাষণ দানকালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেনঃ সাত কোটি মানুষের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবে। আমরা নিশ্চয়ই জয় লাভ করিব। বন্দুক,কামান,মেসিনগান, কিছুই জনসাধারণের মুক্তি রোধ করিতে পারিবে না। শেখ মুজিব সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকিতে জনসাধারণের প্রতি আহবান জানান।

গতকাল সকাল হইতেই অসংখ্য মিছিল শেখ মুজিবের বাসভবনে একের পর এক আসিতে থাকে এবং বার বারই শেখ মুজিব-শোভা যাত্রীর উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দান করেন। প্রতিটি মিছিলই জনতার অধিকার আদায়ের দৃপ্ত শপথে মুখর ছিল।

বক্তৃতা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশে আন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়া বলেন যে, শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগ্রাম ব্যতিরেকে চুড়ান্ত বিজয় সম্ভব নয়। তিনি বলেন, যাহারা বাড়ী বাড়ী জোর করিয়া চাঁদা আদায় করিয়া বেড়ায় তাহাদের এই কাজকে গুন্ডামী ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

শেখ মুজিব বলেন, ৭ কোটি মানুষ যখন ঐক্যবদ্ধ হইয়াছে তখন আমি অবশ্যই দাবী আদায় করিয়া ছাড়িব। ২৩ বছর মার খাইয়াছি, আর মার খাইতে রাজী নই। শহীদদের রক্ত বৃথা যাইতে দিব না। প্রয়োজন হইলে আরও রক্ত দিব। কিন্তু এবার সুদে আসলে বাংলার দাবী আদায় করিয়া আনিব। বাংলাদেশকে আর কলোনী ও বাজার করিয়া রাখা যাইবে না। সত্যের জন্য সংগ্রাম করিতেছি। জয় আমাদের অবশ্যই হইবে।

শেখ মুজিব দাবী আদায়ের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার আহবান জানান। তিনি বলেন যে, দেশে জনগণের সরকার কায়েম হইলে অন্যায়ভাবে কাহাকেও আটক রাখা হইবে না।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব ভুট্টো সোমবার ঢাকায় বলেন, রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন করিয়া সমঝোতা ও ঐক্যমত্যে পৌঁছার জন্য সংশ্লিষ্ট শিবিরসমূহ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করিতেছেন এবং এই প্রয়াস ভন্ডুল করিয়া দেওয়ার জন্য কোন পক্ষই ‘ভেটো’ প্ৰয়োগ করিবে না।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব ভুট্টো সোমবার ঢাকায় বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবুর রহমান সমসাময়িক সঙ্কট নিরসনের জন্য একটি সাধারণ ঐক্যমত্যে পৌঁছিয়াছেন। এই ঐক্যমতকে জনাব ভুট্টো আরও আলাপ আলোচনার জন্য ‘উৎসাহজনক একটি ভিত্তি’ বলিয়া বর্ণনা করেন।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাত সোয়া নয়টায় সাত তাড়াতাড়ি আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব ভুট্টো বক্তৃতা করিতেছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য তিনি নিজে কোন ‘ফর্মুলা’ পেশ করেন নাই। তবে ইয়াহিয়া- মুজিব ‘সাধারণ ঐক্যমত্যে তাঁহার পিপলস পার্টির অনুমোদন বা সমর্থন সাপেক্ষ। সর্বজনগ্রাহ্য একটি সমঝোতা ও ঐক্যমতে পৌঁছার জন্য তাঁহার দল সর্বপ্রকারের প্রয়াস পাইবে বলিয়া তিনি পুনরায় ঘোষণা করেন।

জনাব ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদান সম্পর্কিত শেখ মুজিবুর রহমানের চার দফা পূর্বশর্ত এবং সম্ভবত তার চাইতে বেশী কিছু আমরা বিবেচনা করিতেছি। দেশের জন্য একটা স্থায়ী ব্যবস্থার কথা মনে রাখিয়া অন্তর্বর্তীকালীন একটা ব্যবস্থার কথা আমরা চিন্তা করিতেছি। তাঁহারা দুইটি শাসনতন্ত্রের কথা ভাবিয়াছেন কিনা জানিতে চাহিলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে চিন্তা করিতেছি।’

জনাব ভুট্টো পুনরায় উল্লেখ করেন যে, জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে বসার আগে আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘ত্রিপক্ষীয় চুক্তি’ প্রয়োজন রহিয়াছে। তিনি মনে করেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীও একটা ‘পক্ষ’। কারণ, সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা আছে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে তাদের ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে হইবে। তিনি বলেন, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব আমি স্বীকার করি, তবে রাজনৈতিক বাস্তবতা হইতেছে এই যে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত দেশের দুইটি সংখ্যাগুরু দল আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টিতে সমঝোতা ও ঐক্যমতে অবশ্যই পৌঁছিতে হইবে।

জনাব ভুট্টো জানান যে, সোমবার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁহার ফলপ্রসূ আলোচনা হইয়াছে। তাঁহারা পূর্বাহ্নে প্রেসিডেন্ট ভবনে বৈঠকে মিলিত হন বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। শেখ সাহেবের সঙ্গে তাঁহার পৃথক কোন বৈঠক হইয়াছে কিনা জানিতে চাহিলে তিনি বলেন যে, শেখ সাহেব যে ধারণা দিয়াছেন সে ধারণার বিপরীত কোন ধারণা আমি দিতে চাহি না।

জনাব ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন যে, ‘সাধারণ ঐক্যমতটি সম্পর্কে তাঁহার দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি পশ্চিম- পাকিস্তানে যাইতে পারেন। তবে সে অবস্থায় তিনি খুব তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরিবেন এবং এখানে কিছুকাল থাকিবেন।

বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক ও মর্মান্তিক’ বলিয়া বর্ণনা করিয়া সঙ্কট নিরসনের জন্য সমঝোতায় পৌঁছার উদ্দেশ্য জনাব ভুট্টো নতুন করিয়া দৃঢ় বাসনা প্রকাশ করেন। শেখ সাহেবের দাবী-দাওয়া তিনি ও প্রেসিডেন্ট আলোচনা করিয়াছেন কিনা জানিতে চাহিলে তিনি ‘হ্যাঁ’ বাচক জবাব দিয়া বলেন, আমরা এর বেশীও আলোচনা করিয়াছি।

আজ ২৩ শে মার্চ ১৯৭১ সাল

২৩শে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবস। ১৯৪০ সালে লাহোরে ২৩শে মার্চ তারিখে নিখিল ভারত কাউন্সিল মুসলিম লীগের অধিবেশনে ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে খ্যাত ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এই লাহোর প্রস্তাবটি বিশ্বের মানচিত্রে পাকিস্তানের আবির্ভাব ঘটিয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর এই দিনটিকে ‘পাকিস্তান দিবস’ বা ‘জাতীয় দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়।

১৯৭০ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানের ‘যুগবাণী’ পত্রিকায় এই ২৩শে মার্চ দিনটির উল্লেখ করে লেখা হয়েছিল : “ভুলের মাশুল”।

“বছরে বছরে বিশেষ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান দিবস উদযাপন করতে গিয়ে যে আত্মপ্রঞ্চনার অপরাধে আমরা নিজেদের অপরাধী করে চলেছি তাতে করে লাহোর প্রস্তাব দিবসের কার্যত অমর্যাদাই করা হচ্ছে। লাহোর প্রস্তাবের প্রতিটি ছত্র আদ্যন্ত অস্বীকার করেই আমরা প্রতি বছর লাহোর প্রস্তাবে দিবস উদযাপন করে চলেছি। ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল : নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এ অধিবেশন এই মর্মে সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করছে যে নিম্নোক্ত মৌলিক আদর্শসমূহকে ভিত্তি হিসাবে না ধরে, অপর যে কোন নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে প্রণীত শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকরী এবং মুসলমানদের জন্য গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না।

যে সব এলাকা একান্তভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকা ভারতের-পূর্বাঞ্চল,প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানার রদ বদল করে ঐ সকল এলাকাকে ভৌগোলিক দিক দিয়ে এরূপভাবে পুনর্গঠিত করা হোক যাতে করে তাহারা দুটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলি সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌমের মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়।

১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চের নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের প্রকাশ্য অধিবেশনে উত্থাপনের পূর্বে প্রস্তাবটি ঐ দিন সকালে বিষয় নির্বাচনী কমিটির বেঠকে কায়েদে আজম স্বয়ং পাঠ করে কমিটির সভ্যদের শোনান,এবং প্রস্তাবটির তাৎপর্যও বিশদভাবে বর্ণনা করেন। তখন তাঁকে এ প্রশ্নও করা হয়েছিল দুটি স্টেটের পারস্পরিক সম্পর্ক কি হবে? এর জবাবে তিনি বলেন, সংবিধান রচনার সময় বিষয়টি স্থিরীকৃত হবে।

১৯৪৫ সনের শেষভাগে কেন্দ্রীয় পরিষদের এবং ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ আইন পরিষদের মুসলিম আসনগুলিতে একটি মাত্র ইস্যুতে প্রার্থী দাঁড় করান এবং সেই ইস্যুটি ছিলঃ পাকিস্তান ইস্যু (লাহোর প্রস্তাবের ইস্যু)।

উক্ত নির্বাচনে কেন্দ্রীয় পরিষদের ৩০টি মুসলিম আসনের সব কয়টিই লীগ মনোনীত প্রার্থীগণ পান।

আর প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলির মধ্যে বাংলার আইন পরিষদের ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১২টি আসন মুসলিম লীগ অধিকার করে। নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীদের সাফল্যে, বিশেষ করে বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রশংসনীয় সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, ‘লাহোর প্রস্তাব থেকে সঞ্চারিত আশা উদ্দীপনা ও প্রেরণা।’ ভারতের মুসলিম জনগণের কাছে লাহোর প্রস্তাব যেন একটি প্রত্যাদিষ্ট প্রস্তাব বলে প্রতিভাত হয়েছিল। এতে ভারতের দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূখন্ডের সাধারণ মানুষ তাদের স্বাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং মহামুক্তির প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট দেখেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় তাদের সেই লাহোর প্রস্তাবকে পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। কেন্দ্রের ও প্রাদেশিক নির্বাচনগুলির আইন পরিষদ সমাপ্তির পর ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে কায়েদে আজম দিল্লীতে কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক আইন সভা সমূহের নব নির্বাচিত লীগ সদস্যগণের এক কনভেনশান আহবান করেন।

১৯৪৬ সালের ৯ই এপ্রিল তারিখে উক্ত কনভেনশানে সর্বসম্মতিক্রমে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। তাতে পরিস্কার বলা হয় যে, পাকিস্তান একটি মাত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। লাহোর প্রস্তাব ইস্যুতে যাঁরা জয়লাভ করেন আইন পরিষদের সেই সদস্যরা কোন অধিকারে সেই লাহোর প্রস্তাবকে সরাসরি অস্বীকার করে একটি নতুন প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই। রাজনীতির অ আ ক খ যাঁরা জানেন তাঁদের কাছে একথা বিদিত যে ১৯৪০ সালের লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত লাহোর প্রস্তাব নাকচ করেছিলেন কারা। পাকিস্তানকে গত ২৩ বৎসর যাবৎ লাহোর প্রস্তাবকে বেআইনী ভাবে অস্বীকার করার খেসারত দিতে হচ্ছে। একটানা ২৩ বৎসর যাবৎ ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে হতভাগ্য প্রদেশ আজ ভিখারীতে পরিণত হতে চলেছে।

.

দ্বি-জাতি থিয়োরীর ওপরে ভিত্তি করে যে পাকিস্তান-সৌধ নির্মাণ করা হল তার বাস্তবরূপ দেখে কায়েদে আজমের মত অন্যান্য নেতারাও চমকিত হন নি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নাটকের পঞ্চম অঙ্কে অভিনয় করতে গিয়ে দেখলেন– সাজানো বাগান শুকিয়ে গেছে। তিনি তাঁর আত্মীয় ও লীগ সেক্রেটারী আবুল হাশিম,ক্যাবিনেট সহযোগী মুহম্মদ আলী (বগুড়া), ফজলুর রহমান (ঢাকা ইউনিভার্সিটি) এবং ডাঃ আবদুল খালেককে (নদীয়া) সঙ্গে করে শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায়ের সঙ্গে ‘সভারেন বেঙ্গল গঠনে তখন ব্যস্ত। গান্ধীজী সে প্রস্তাব বিবেচ্য মনে করেছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক তাপমাত্রা এমন পয়েন্টে তখন পৌঁছেছে যে বাঙালীরা বা গান্ধীজী যথাসাধ্য চেষ্টা করেও যা অবশ্যম্ভাবী তা রোধ করতে পারেন নি। কিরণশঙ্কর সেই মুহূর্তে একবার বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে যা শুনেছিলেন তাই সঠিকভাবে সেদিনকার ভারতবর্ষের বিকার দশার অবস্থা নির্ণয় করে। মাউন্টব্যাটেন নাকি কিরণশঙ্করকে বলেছিলেন যে, গোটা দেশের মধ্যে কেবল দুটি প্রাণীই দেশ বিভাগ চায় না– এক তিনি (মাউন্টব্যাটেন) এবং অপর জন হলেন মোহনদাস কমরচাঁদ গান্ধী। বাঙালীদের সেই শেষ যুক্ত চেষ্টা’ সভারেন বেঙ্গল’ কল্পনা কতদুর গড়িয়েছিল তা গান্ধীজীর সেক্রেটারী পিয়ারীলাল গান্ধীজীবনীতে লিপিবদ্ধ করেছেন। গান্ধীজী বলেছিলেন যে, ‘সভারেন বেঙ্গল’ অথবা পরে যদি বাংলাদেশ পাকিস্তান অথবা ভারতবর্ষের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় তবে সে সিদ্ধান্ত গ্রাহ্য হবে কেবল মাইনরিটি হিন্দুদের তিনভাগের দুইভাগ সমর্থন করলে। “It Seems that till Sarat Bose could not get either Suhrawardy or Moslem League to agree to Gandhiji’s stipulation that every act of the Government–including the decision about Sovereign Bengal are its subsequent joining India or Pakistan–must carry with it the co- operation of at least two thirds of the Hindu minority in the execution and in the legislature what appeared in its place in the amended clauses (of the draft) was on overall two thirds majority. সাতচল্লিশ সালের ৬ই জুন দিল্লীতে শরৎবসু ‘সভারেন বেঙ্গলের’ শেষ খসড়া রদবদল করে গান্ধীজীর কাছে পেশ করলেন, কিন্তু তার পূর্বেই লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবর্গ মাউন্টব্যাটেনের দেশ বিভাগ প্রস্তাব গ্রহণ করে ফেলেছেন। ‘সভারেন বেঙ্গল’ কল্পনা আপনা থেকেই বাতিল হয়ে গেল। শরতের সঙ্গে গান্ধীজী এই বিষয়ে যে পত্রালাপ করেছিলেন তা সার্থক হয়নি। তাঁদের মতে ‘ সভারেন বেঙ্গল’কল্পনা চাল মাত্র, হিন্দু ও সিডিউল্ড কাস্টের সদস্যদের ধোঁকা দেবার চেষ্টা। এমনকি তাঁদের মতে তখন টাকার থলে অবাধে চালনা করা হচ্ছিল সিডিউল্ড কাস্টের ভোট গড়বড় করবার উদ্দেশ্যে। অতএব গান্ধীজীর মতে এ প্রস্তাব নিয়ে অগ্রসর হওয়া সমীচীন নয়। বিধান-সভায় দেশ বিভাগ প্রস্তাব পেশ করবার পূর্বে কারেন্সি নোট থলে ভর্তি করে নবাবজাদা লিয়াকত আলী যে কলকাতায় উপস্থিত হয়েছিলেন সে সংবাদ কলিকাতার তদানীন্তন মুসলমান চালিত ইংরেজ দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল। পিয়ারীলালের মতে গান্ধীজী ‘সভারেন বেঙ্গল’ কল্পনা রূপায়ণে আগ্রহী হলেও সোহরাওয়ার্দী যে সে কাজে সত্যি সত্যি সাহায্য করতে পারেন,এ ভরসা আর করতে পারছিলেন না। “He (Suhrawardy) was playing for high tricks but lacked the courage or the will or perhaps both to face up to Quaid-I-Azam who suffered on nonsense in the Moslem League camp and was trying to tread on a thin wire. And Sarat Bose and his friends, with more zeal than prudence, were permitting them-selves unwillingly to be drawn into Saheed’s desperate gamble.”

‘সভারেন বেঙ্গল’ কল্পনা বানচাল হলেও সোহরাওয়ার্দীকে নানা কারণে ভারতবর্ষে কিছুকাল থাকতে হয়েছিল। দ্বি-জাতি তত্ত্বের মহিমায় কি অবস্থান্তর হতে চলেছে সে সম্পর্কে তখন তাঁর দৃষ্টি সুপ্রসারিত। করাচীতে এগারোই সেপ্টেম্বর তারিখে পাকিস্তান কনষ্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লি উদ্বোধনে কায়েদে আজম যেমন স্বয়ং আবিষ্কৃত দ্বি-জাতি থিয়োরী নিয়ে তোবা তোবা করলেন, তেমনি তাঁর কলিকাতাস্থ ৪০ নং থিয়েটার রোডের বাড়ী থেকে লেখা পত্রে সমগোত্রের চৌধুরী খলিকুজ্জামানকে একই বিষয় নিয়ে আপন মতামত সুষ্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন।

সেই পত্রে সোহরাওয়ার্দী জানালেন : হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে লঘিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের কি ভবিষ্যত? এ বিষয়টি নিয়ে তো পূর্বে কোন আলোচনাই আমরা করিনি! আমরা কোন দিনই আশা করতে পারিনি যে বাংলাদেশ বিভক্ত হবে এবং এখানেও অঞ্চল বিশেষে মুসলমানেরা সংখ্যায় লঘিষ্ঠ হবে। (We are now all thinking every hard as to what should be the position of the minorities, particularly of the minority Moslems in the Hindu majority provinces. We had not thought about it earlier, as we did not expect Bengal to be partitioned and Moslems being reduced to a minority in part of Bengal.)

সেই দীর্ঘ পত্রে সোহরাওয়ার্দ্দী মুসলমানদের ভবিষ্যত আলোচনা করে জানালেন যদি আমরা ভারতবর্ষে ইসলামিক ঐতিহ্য নিয়ে মোসলেম লীগ নিয়ন্ত্রিত দ্বি-জাতি থিয়োরী নিয়ে বসে থাকি তবে পাকিস্তানের কাছ থেকে সমর্থন পেতে পারি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের হিন্দুদের বিষ নজরে পড়তে হবে। আমি নিজে মুসলমান সম্প্রদায়কে দেশের অন্যান্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবার পক্ষপাতী নই অথবা দ্বি-জাতি থিয়োরী যে ধরণের সমাজ গঠন চায় তাও সমর্থন করি না। (continue to live as Moslems in the best Islamic traditions connected with Moslem League and holding fast to the two nation theory.

I am, therefore, not in favour of adopting an attitude of aloofness dependent upon two nation theory.)

চৌধুরী খালিকুজ্জমান সে চিঠির কোন উত্তর দেন নি। কিন্তু তাঁর গ্রন্থে দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর মন্তব্য করেছেন। সে মন্তব্যে কোনই আবছায়া নেই। তবে সে মন্তব্যের কোন সার্থকতা ও ছিল না। দ্বি-জাতি থিয়োরী যা ক্ষতি করবার তা করে ফেলেছে তখন। যখন আগুন জ্বলে উঠেছিল তখন তো প্রধান ইন্ধনদাতা ছিলেন এই দ্বি-জাতি তত্ত্বের আবিষ্কারক মহম্মদ আলী জিন্না এবং তাঁর সমর্থকেরা–যথা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও চৌধুরী খালিকুজ্জামান! চৌধুরী সাহেবের মন্তব্য হল : “He (Suhrawardy) doubted the utility of the two nation theory which to my mind also had not paid any dividends to us. But after the partition it proved positively injurious to the Moslems of India and on a long view basis of Moslems everywhere. Many of the quaries in Suhrawardy’s letter also offshoots of the first question concerning the two nation theory. I would have replied to him in detail but certain events intervened”

দ্বি-জাতি থিয়োরী সম্পর্কে ইতিহাসের দৃষ্টি নিয়ে বিচার করলে অতীতের অনেক বিষয়ের আলোচনা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যে দিন থেকে বাঙালী মধ্যবিত্ত হিন্দু ইংরেজের সমালোচক হ’ল সেদিন থেকেই এই থিয়োরী জন্মলাভ করেছিল, কেবল এর সুদূরপ্রসারী কর্মক্ষমতা সেদিন অজ্ঞাত ছিল। যখন মধ্যবিত্ত বাঙালী হিন্দু পরিচালিত আন্দোলন –বিশেষ করে ইলবার্ট বিল পর্বের পরে দানা বাঁধতে শুরু করল এবং কংগ্রেস জন্মলাভ করল তখন থেকেই প্রথমে আমির আলী এবং তিনি বিলেতে চলে গেলে (১৮৮৫-৮৬) আলিগড়ের সৈয়দ আহমদকে ক্রীড়নক স্বরূপ ব্যবহার করে এ ভাবধারা সিঞ্চিত করা হয়েছে। ধাপে ধাপে যতই পোলিটিক্যাল আন্দোলন জোরদার হতে লাগল ততই শাসককুল পরিচালিত ভেদবুদ্ধি মুসলমান মনকে অন্যদিকে চালিত করেছে। সিপাহী বিদ্রোহে যে মোটামুটি হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বজায় ছিল এমনকি সেকথা ঘুণাক্ষরেও স্মরণে রাখবার প্রয়োজন বোধ হয়নি। মর্লে-মিন্টো শাসনসংস্কার কালে অতি গোপন ব্যবস্থায় বিভেদের বীজ অঙ্কুরিত হল। অবস্থান্তর আনতে গিয়ে লক্ষ্ণৌয়ে আপোস ব্যবস্থাপত্রে (১৯১৬ সাল) বিভেদটাই বড় করে দেখান হল। পরিণামে দেশ বিভাগের দাবী রূপায়নে দ্বি-জাতি থিয়োরী একান্ত প্রয়োজন ছিল। সে দাবী মিটলে যখন দৃষ্টি স্বচ্ছ হল তখন প্রথম ধরা পড়ল সর্বনাশের পরিমাণ।

এ সর্বনেশে পরিণতির জন্যে কেবল মুসলমান নেতৃত্বের সমালোচনা নিরর্থক। কারণ যে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল দেশ বিভাগের পূর্ব মুহূর্তে তখন তা মহীরুহ। বিশের বা ত্রিশের এমনকি চল্লিশের কোঠাতেও সমস্ত মুসলমান দাবী মেনে নিলেও এ পরিনাম এড়ান যেত কিনা সন্দেহ। কারণ সমস্ত দাবীদাওয়ার ভিত্তিই ছিল সাম্প্রদায়িক বিভেদের ওপর। মুখে স্বীকৃতি না পেলেও কাজকর্মে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে যে হিন্দু ও মুসলমান বিভিন্ন গোষ্ঠী। সাতচল্লিশ সালের ৩রা জুন তারিখে কংগ্রেস ও লীগ পার্টিশন ব্যবস্থা স্বীকার করে নিয়ে অতীতের সেই ইংরেজের উসকানীতে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক ভোদধারা সরাসরি এবং সরকারীভাবে গ্রহণ করল মাত্র। কংগ্রেস নেতৃত্ব এই পরিণতিতে কোন প্রকারে প্রতিরোধ করতে পারতেন কি?

আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে পারতেন না এবং সে চেষ্টা অতীতের মতন কেবল ভেদবুদ্ধিই অধিকতর তীব্র করে তুলত। কিন্তু নানা ধরনের অভিজ্ঞতায় লব্ধ মোহনদাস কমরচাঁদ গান্ধীর বক্তব্য সঠিকভাবে (সেই মুহূর্তে দেশের সামনে নানা কারণে ধরা না পড়লেও) অনুধাবন করলে মনে হয় তাঁর নির্দিষ্ট পথে দেশকে এগুতে সহায়তা করলে ভবিষ্যতে হয়ত দেশ বিভাগ ছাড়া অন্য কোন গন্তব্যে পৌঁছতে পারা যেতওবা।

পিয়ারীলাল তাঁর গ্রন্থে এক দিকে যেমন শরৎ-সোহরাওয়ার্দীর ‘সভারেন বেঙ্গল’ কল্পনা নিয়ে যে আলোচনা গান্ধীজীর সঙ্গে চলেছিল তা বর্ণনা করেছেন, অপরদিকে সে কল্পনা-বিরোধী ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর বক্তব্যও উদ্ধার করেছেন। সেদিন প্যাটেল-নেহেরুর এই বিষয়ের অন্যতম মন্ত্রদাতা ছিলেন তিনি। গান্ধীজীর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ পরিস্কারভাবে মন্তব্য করেছিলেন যে ‘সভারেন বেঙ্গল’ কল্পনা, তাঁর মতে, সাহেবদের মাথায় প্রথম গজিয়ে থাকবে। (Sovereign Bengal move was inspried by European vested interests for reasons their own)

উত্তরে গান্ধীজী জানালেন,কিন্তু সোহরাওয়ার্দী তো দুই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সম্মতি নিয়ে সে কল্পনা রূপায়ন করতে ইচ্ছুক? শ্যামপ্রসাদ প্রতিপ্রশ্ন করলেনঃ ‘সভারেন বেঙ্গল’ হয়ে যাবার পর যদি হিন্দুরা ভারতবর্ষে এবং মুসলমানেরা পাকিস্তানে যোগদান করতে চায় তখন কি হবে?

সে প্রশ্নের উত্তরে গান্ধীজী যা বলেছিলেন তাতেই সেই অজানা সম্ভাবনার কথা স্বতই মনে উদয় হয়। গান্ধীজী জানালেন : সে অবস্থা এলে অন্তত ইংরাজের কোন কিছু করবার থাকবে না। দ্বিতীয়ত তাতে জিন্নার দ্বি-জাতি থিয়োরীর কোন স্থান থাকবে না। (It would not be participated by a third party on the basis of Zinnh’as two nations)

সেদিন এ আলোচনার মথার্থ সাধারণের কাছে ধরা পড়েনি। কিন্তু পাকিস্তান কল্পনা বাস্তব রূপ নেবার পরই এবং ইংরেজের রাজদন্ড অন্তর্হিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই কায়েদে আজম ও তাঁর শিষ্য-উপশিষ্যদের সেই দ্বি-জাতি তত্ত্বের ওপর নতুন ধরণের মতামত যে ভাবে তড়িত গতিতে এসেছিল তাতে মনে হয় তৃতীয় পক্ষের যুগ যুগ ধরে উসকানি দেবার দরুন যে দ্বি-জাতি থিয়োরীর ওপর ভিত্তি করে দেশ বিভাগ ঘটল তা যদি ঠেকান যেত তবে হয়ত অন্য কোন দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা সম্ভবপর হত এবং অন্য কোন সমাধান খুঁজে বের করবার অবকাশ মিলতওবা।

ইতিহাস এত সহজে অতীতকে ভুলতে অথবা নতুন সুযোগ গ্রহণ করতে দেয় না। এবং সেদিনও দেয়নি। গান্ধীজী তাঁর মর্মকথা চিরকালের জন্য ইতিহাসের পাতায় জুড়ে রাখলেন : “I find myself all alone even the Sardar (Patel ) and Jawaharlal ( Nehru ) think that my reading if partition is agreed upon……. they did not like my telling the Viceroy that if there was to be partition it should not be through British intervention or under British rule….. We may not feel the full effect immediately but I can clearly say that the future of independence gained at this price is going to be dark. I pray that god may keep me alive to Wittness it. “

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের কাহিনী শুনবার পর তাঁর বাকরুদ্ধ স্বদেশবাসীর পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ যে পত্র ভাইসরয়কে লেখেন সে পত্র যেমন অন্য কোন ভাষায়, এমনকি মাতৃভাষাতেও রূপান্তর করা অসম্ভব–কবি নিজেও সে চেষ্টা করেছিলেন–তেমনি গান্ধীজীর এই মর্মস্পর্শী শেষ প্রার্থনা ভাষান্তরিত করা অসম্ভব। অশোকের শিলালেখের মতন চিরকাল ভারতবর্ষের ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ের শেষ পাতা জুড়ে গান্ধীজীর এই শেষ প্রার্থনা ভাবীকালের বাঙালীর মনে প্রশ্ন জাগাবে।

ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে বাঙালীত্বের ওপর চরম আঘাত হেনে এবং পশ্চিম প্রান্তে পাঠান- ভূমি নিশ্চিহ্ন করবার ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে ইংরেজ বিদায় নিল। [যুক্ত বাংলার শেষ অধ্যায়– কালীপদ বিশ্বাস,পৃঃ৪০১]

সংযুক্ত স্বাধীন বাংলা [শরৎ বসু ফর্মূলা ]

১৯৪৭ সালের ১২ই মে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব ইন্ডিয়ার বিশ্বস্ত সুত্রে প্রাপ্ত একটি খবরে জানান হয় যে, ১৯৪৭ সালের জানুয়ারী মাসে শ্রীশরৎচন্দ্র বসু সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি, বাংলায় নতুন মন্ত্রিসভা গঠন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। মুসলিম লীগের প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য একটি সাব -কমিটি নিয়োগের পরই শরৎবাবু বাংলার মুসলিম নেতাদের কারুর কারুর সঙ্গে কথা বলেছিলেন বলে যে রিপোর্ট বেরিয়েছিল ওই খবরে তা ভ্রান্ত বলে উল্লেখ করা হয়।

শরৎবাবু নাকি মূলত চেয়েছিলেন যেঃ

(১) বাংলা হবে একটি সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র।

(২) ঐ সাধারণতন্ত্রের জন্যে যে সংবিধান রচিত হবে সেই অনুসারে প্রাপ্তবয়স্কের সার্বজনীন ভোটাধিকার ও যুক্ত-নির্বাচকমন্ডলীর ভিত্তিতে বাংলার আইনসভা গঠিত হবে।

(৩) এইভাবে গঠিত বাংলার আইনসভা ভারতের বাকী অংশের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক কী হবে তা স্থির করবে।

(৪) বর্তমান মুসলীম লীগ মন্ত্রিসভা বাতিল করে অবিলম্বে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে।

(৫) বাংলায় সরকারী পদগুলিতে বাঙ্গালীরাই থাকবে এবং সেগুলি হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সমভাবে বন্টন করা হবে।

(৬) বাংলায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে ৩০ বা ৩১ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি সংবিধান রচনাকারী সংস্থা গঠন করতে হবে। ওই সংস্থা দ্রুত বাংলা সাধারণতন্ত্রের সংবিধান রচনা করবে।

খবরে আরও বলা হয়েছিল যে শরৎবাবু, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় আরও কোন কোন কথাবার্তা হয় এবং অন্যান্য কয়েকটি বিষয় তখনও বিবেচনাধীন ছিল। অবশ্য সেগুলি সম্বন্ধে বিশদ তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে একথা দৃঢ়তার সঙ্গে জানানো হয় যে কোন কোন মুসলিম লীগ নেতার সঙ্গে শরৎবাবুর গোপনে চুক্তি করা সম্পর্কে প্রকাশিত রিপোর্ট সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

১৯৪৭ সালের ২০শে মে শরৎবাবু একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেনঃ

ভারত এবং তার অন্তর্গত প্রদেশগুলির ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র কী হবে সে সম্বন্ধে আমি গত কয়েক বছর ধরে যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। ১৯৪৪ সালের ২৯শে জানুয়ারী জেলে বসে আমি আমার ধারণাগুলোকে যেভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলাম তা হলঃ

“আমি কল্পনা করি আমার এই দেশ কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের ইউনিয়ন হিসাবে গড়ে উঠবে–এক প্রকান্ড মিলন ভূমি রূপে এর অন্তর্গত সকল জাতি ও উপজাতির বৈশিষ্টগুলি তার মধ্যে এমনভাবে মিশে যাবে যার মধ্যে জন্ম নেবে এক নতুন বিশ্ব- যার মধ্যে জাতি, শ্ৰেণী অথবা ভৌগোলিক সীমানার কোন আড়াল থাকবে না।”

গত কয়েক মাসে বাংলা এবং অন্যান্য প্রদেশের যে সব ঘটনা ঘটেছে তা সত্ত্বেও আমি আমার ধারনায় অটুট আছি। গত জানুয়ারিতে আমি কি ভাবে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের মীমাংসা করা যায়,বাংলায় একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে ঐক্যমত হতে পারে এবং বাংলার ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র কি হবে সে সম্বন্ধে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক (এখন ছুটিতে) মিঃ আবুল হাশিম-এর সঙ্গে আলোচনা করতে উদ্যোগী হয়েছিলাম। তার কয়েকদিন পরেই গত ২৬শে জানুয়ারী বেলগাছিয়া ভিলায় আহুত এক অভ্যর্থনা সভায় আজাদ হিন্দ ফৌজের মফিসারবৃন্দ ও অন্যান্যদের কাছে এক ভাষণে আমি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে একথা বলেছি যে, স্বায়ত্তশাসিত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রসমুহের একটি ইউনিয়ন হিসাবে ভারত গড়ে উঠবে মামি বরাবরই এই মত পোষণ করেছি। আমার বিশ্বাস বিভিন্ন প্রদেশগুলিকে যদি ভাষার ভত্তিতে পুনর্বিন্যস্ত করে সেই অধুনা কথিত প্রদেশগুলিকে স্বয়ংশাসিত সমাজতান্ত্রিক াধারণতন্ত্রে পরিণত করা হয়, সেই সমাজতান্ত্রিক সাধারনতন্ত্রগুলি সানন্দে পারস্পরিক হযোগিতার মাধ্যমে ভারতীয় ইউনিয়ন গড়ে তুলবে।

এই ভারতীয় ইউনিয়নে ভারতীয় চিন্তাধারায় ভারতীয়েরা নিজেরা গড়ে উঠবে। আমি সেই ইউনিয়নের দিকে মুখ চেয়ে আছি, বৃটিশ ধারণাশ্রয়ী বৃটিশ তৎপরতায় সৃষ্ট ইউনিয়নের দিকে নয়।

তখন থেকে বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে আমার ধারনাগুলি নিয়ে আলোচনার সুযোগ হয় এবং তার কাছ থেকে কিছু বাস্তব প্রস্তাবের উদ্ভব হয়েছে। এই সময়েই বাংলায় এবং দেশের অন্যান্য স্থানে যে সব ঘটনা ঘটে তার ফলে দেশবাসীর এক বিরাট অংশে হতাশার সঞ্চার হয়েছে এবং রাজনেতিক জগতে নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে যাঁরা একদা পাকিস্তান ও দেশবিভাগের বিরোধী ছিলেন তাঁরাও আজ এই উভয়েরই সমর্থক হয়ে উঠেছেন। এসব, সত্বেও আমি আগেও যা বলেছি দৃঢ়তার সঙ্গে এখনও তাই বলবো যে,পাকিস্তান মেনে নেওয়া ও দেশবিভাগকে সমর্থন করার অর্থ ভারতের স্বাধীনতা ও সামাজিক প্রগতির পক্ষে আত্মঘাতী হওয়া। এর ফলে বিভক্ত প্রদেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী,সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের অবাধ মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হবে। এখন যে ভাষার বন্ধন রয়েছে তা হবে ছিন্ন এবং সাম্প্রদায়িক বিরোধের সমাধানের পরিবর্তে আরও তীব্র ও ব্যাপক আকার নেবে। পাকিস্তান বা দেশবিভাগের কথা না বলে বা চিন্তা করে এবং তার দ্বারা সশস্ত্র সাম্প্রদায়িক শিবিরের জন্ম না দিয়ে আমাদের সম্মিলিতভাবে বাঁচার ও কাজ করার পথ ও উপায় খুঁজতে হবে। এক জনগণের সরকার গঠনের চেষ্টা করতে হবে। সেই সরকার সাম্প্রদায়িক স্বার্থের পরিবর্তে জনসাধারণের সাধারণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মঙ্গলের জন্য সচেষ্ট হবে। আমার মতে ভাষার ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক সাধারনতন্ত্রগুলির একটি কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন গড়ে তোলার মধ্যেই বর্তমান সাম্প্রদায়িক বিরোধের প্রকৃত মীমাংসার সূত্র নিহিত রয়েছে।

আমাদের নীতি নির্ধারনের ব্যাপারে আমরা যেন কিছুতেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী এবং ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতা বাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা চালিত না হই। সাধারণ মানুষের সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতেই আমরা নতুন সমাজতান্ত্রিক ঐক্য গড়ে তুলবো, সাম্প্রদায়িক বৈরিতার অবসান ঘটাবো। আমি দেশের যুবকদের আহবান করছি–তারা যেন আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রচন্ড বিশ্বাস ও আশা নিয়ে এই বিরাট কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করেন। তাঁরা আলো দেখান, সাধারণ মানুষরা সেই রাস্তায় হাঁটবে।

গভীর পরিতাপের বিষয়, গত ডিসেম্বর থেকে ক্রমাগত অসুস্থ থাকায় আমি আগের মতো রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থাকতে পারি নি। তবু গত দু সপ্তাহের মতো কিছুটা সুস্থ বোধ করায় আমি অদূর ভবিষ্যতে কাজে নামতে চাই, দেশবাসীকে বোঝাতে চাই যে, যে সমাধানের ইঙ্গিত আমি দিয়েছি সেটাই সঠিক সমাধান।

.

১৯৪৭ সালের ২২শে মে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব ইন্ডিয়ার তরফে খুব বিশ্বস্ত সূত্রে অবগত একটি সংবাদ উদ্ধৃত করে জানানো হয় যে, বাংলার ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র এবং নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট শর্তাবলী শরৎবাবু এবং কংগ্রেস মুসলিম লীগের কোন কোন

প্রখ্যাত নেতার মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে রূপগ্রহণ করেছে।

সেই শর্তগুলি হল :

১। বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। ভারতের বাকী অংশের সঙ্গে কী সম্পর্ক হবে বাংলার স্বাধীন রাষ্ট্র সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেবে।

২। স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে যৌথ-নির্বাচকমণ্ডলী, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার এবং হিন্দু ও মুসলিম জনসংখ্যার সমানুপাতিক আসন সংরক্ষণের বন্দোবস্ত সমন্বিত আইনসভা গঠনের ব্যবস্থা থাকবে। হিন্দু ও তফসিলীভুক্ত হিন্দুদের আপেক্ষিক জনসংখ্যা অনুযায়ী অথবা তাদের মধ্যে যেমন ঐক্যমত হতে পারে সেই মতো আসন বন্টন করা হবে। নির্বাচনমণ্ডলী ও ভোট হবে বন্টনাত্মক, পৌনঃপুনিক নয়। নির্বাচনে যে প্রার্থী নিজের সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের শতকরা ২৫ভাগ পাবেন তিনি নির্বাচিত হয়েছেন বলে ঘোষণা করা হবে। যদি কোনও প্রার্থী এই শর্ত পূরণ করতে না পারেন তাহলে যিনি নিজ সম্প্রদায়ের সর্বাধিক ভোট পাবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন।

৩। বৃটিশ সরকারের ঘোষণায় স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র মেনে নেওয়ার এবং বাংলাদেশ বিভক্ত হবে না এটা স্বীকার করায়, বাংলার বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গড়তে হবে। সেই সরকারে মুখ্যমন্ত্রী বাদে সমসংখ্যক হিন্দু (তফসিলীভুক্ত হিন্দুদের ধরে) ও মুসলিম মন্ত্রি থাকবে। ঐ মন্ত্রিসভায় মুখ্যমন্ত্রী হবেন একজন মুসলিম এবং স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ভার আসবে একজন হিন্দুর হাতে।

৪। নতুন শাসনতন্ত্র অনুসারে একটি আইনসভা ও মন্ত্রিপরিষদ চূড়ান্তভাবে গঠিত হওয়ার আগে সামরিক বাহিনী ও পুলিশ সমেত সকল বিভাগের পদগুলি সমসংখ্যক মুসলিম ও হিন্দুদের (তফসিলীভুক্ত হিন্দু সমেত) দ্বারা পূর্ণ করা হবে সকল পদেই বাঙ্গালী নিয়োগ করা হবে।

৫। সংবিধান বিধায়ক পরিষদে ইউরোপীয় বাদে ১৫ জন মুসলিম ও ১৪ জন অমুসলিম সদস্য থাকবেন। মোট সদস্য সংখ্যা হবে ৩০। এরা আইন সভায় নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন।

১৯৪৭ সালের ২৩শে মে শ্রীশরৎচন্দ্র বসু এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেন :

বাংলায় স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হলে সেটি একটি সাধারণতন্ত্র হবে। সেই সাধারনতন্ত্রের প্রকৃতি এবং বিশেষত্ব হবে সমাজতান্ত্রিক। বাংলায় যদি কখনো একটি নিজস্ব সংবিধান বিধায়ক পরিষদ গঠিত হয় তবে তখন সেখানেই সমাজতান্ত্রিক সাধারনতন্ত্রের বিস্তারিত রূপ স্থির করা হবে। গত পাঁচ মাস ধরে আমি যাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি তাঁদের সঙ্গে মূল ব্যাপারগুলির বিষয়ে আমার কোন মতপার্থক্য নেই।

আমি বাংলাদেশ ও ভারতের অন্যত্র সকলকে বোঝাতে চাই যে, সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার নিরসন করা যায় না। একটা সম্পুর্ণ ভিন্ন ও বলিষ্ঠতর দৃষ্টিভঙ্গী–অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে সমস্যাটির মোকাবিলা করতে হবে।

আমার চেয়ে কেউ বেশী জানে না যে সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কি গভীর পারস্পরিক অবিশ্বাস রয়েছে। গত আগষ্ট মাস থেকে এটা বেড়েই চলেছে। যদি এটা দূর করা না যায় তাহলে বাংলা তথা ভারত ধ্বংস হয়ে যাবে–এটা দূর করতেই হবে।

এই সমস্যার সমাধান হিসাবে আমি সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র সৃষ্টি করার প্রস্তাব করেছি (এগুলিকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলেও আখ্যা দেওয়া যেতে পারে)আজ সকালে সমঝোতার শর্তগুলি প্রকাশিত হয়েছে তাতে ঐ কথাগুলিই ব্যবহার করা হয়েছে। আমার কাছে ‘স্বাধীন’–এই কথাটার অর্থ শুধু রাজনৈতিক দাসত্বের বন্ধন মোচন।

জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে গেলে বাংলায় প্রথমেই দরকার এক নতুন সরকার গঠন করা। বর্তমান সাম্প্রদায়িক মন্ত্রিসভা সরিয়ে জনগণের আস্থাভাজন এক মন্ত্রিসভা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অবিলম্বে এটা প্রয়োজন। জনগণের মধ্যে যে অবিশ্বাস রয়েছে, শুধু এর ফলেই তা বহুলাংশে দূর হবে। যে মুহূর্তে সকল শ্রেণীর মানুষের আস্থাভাজন একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হবে সেই মুহূর্ত থেকে প্রশাসন ব্যবস্থার চরিত্রও দ্রুত বদলাতে শুরু করবে। আইন রচনার প্রস্তাবগুলি তখন সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করে দেখা হবে। জনসাধারণের একাংশের সুবিধার বদলে সমগ্র জনগনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থে আইন প্রণীত হবে।

লর্ড মিন্টোর আমল থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী প্রচলিত রয়েছে। তারপর কয়েক দশক কেটে গেছে, এই প্রথম ভারতের কোনও প্রদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতারা যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী ও প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারে রাজী হয়েছেন। অবশ্য এটা ঠিক যে কিছু কিছু রক্ষাকবচ রাখা হয়েছে। কিন্তু সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবেই তা করা হয়েছে এবং আমি আশা করি বছর দশেক পরে কিংবা তার আগেই এগুলি উঠিয়ে দেওয়া হবে।

ভোট পৌনঃপুনিক হবে না বন্টনমূলক হবে একথা আমরা বলেছি। এর অর্থ হলো, কোন ভোটদানকারী তার সকল ভোট একজন প্রার্থীকেই দিতে পারবেন না। এই শর্তগুলি কংগ্রেস ও লীগ সংগঠনগুলিকে বিবেচনা করে দেখতে হবে।

আমার চিন্তাধারা এখন কোন্ খাতে প্রবাহিত হচ্ছে তা আপনাদের জানিয়েছি–এই মুহূর্তে বিশদভাবে বলার প্রয়োজন নেই।

এই মুহূর্তে আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী স্বচ্ছতা হারিয়েছে সত্য কিন্তু আমার সর্ব্বৈ আশা আমাদের হিন্দু-মুসলিম সকল রাজনৈতিক কর্মী এই সুযোগ গ্রহণ করবেন এবং সমবেতভাবে বাংলার ইতিহাসে এক নতুন পরিচ্ছেদ যোজনা করবেন এবং কালক্রমে ভারতের ইতিহাসেও তা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

আমি যা খবর পেয়েছি এবং বেশ নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া সেই খবর–তাতে জানা যায় যে, বাংলাদেশ বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে বর্ধমান বিভাগ, ২৪ পরগণা জেলা, খুলনা জেলা এবং সম্ভবত কলকাতা পশ্চিম বাংলায় যাবে এবং বাকী বিভাগ ও জেলাগুলি পূর্ববঙ্গের ভাগে পড়বে। এই ধরণের বিভাগে সম্মত হওয়া সম্ভব কিনা তা আমি বাংলাদেশের জনগণকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।

আমার নিজের কথা বলতে গেলে, আমি সব সময়ই চেয়েছি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যেন আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা না হয়, আমরা যেন আমাদের ঘর নিজেরাই গুছিয়ে নিতে পারি।

২২শে মে ১৯৪৭ সালে মহাত্মা গান্ধীকে লেখা শরৎচন্দ্র বসুর একটি শিলমোহর করা খাম নিয়ে জনৈক পত্রবাহক পাটনায় যায়। গান্ধীজী তখন পাটনায়। এই প্রসঙ্গেই শ্রী বসুর কাগজপত্রের মধ্যে পাওয়া শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা মহাত্মা গান্ধীর নিম্নলিখিত চিঠিটি বিশেষ আকর্ষণীয়।

পাটনা
২৪।৫।৪৭

প্রিয় শরৎ

তোমার চিঠি পেয়েছি। শুধুমাত্র সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কিছু করা যাবে না এমন কোন কথা তোমার খসড়ায় দেখলাম না। আইনসভা এবং শাসন বিভাগের সকল সরকারী কাজে হিন্দুদের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশের সহযোগিতা থাকা দরকার। বাংলার সংস্কৃতি অভিন্ন এবং মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষাও অভিন্ন এই স্বীকৃতিটুকু থাকা দরকার। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ প্রস্তাবের বিরোধী এমন ধরণের খবর রয়েছে,তবু তাঁদের সম্মতি আছে- এটা নিশ্চিতভাবে জানা প্রয়োজন। যদি দিল্লীতে তোমার উপস্থিতি প্রয়োজন থাকে তাহলে আমি টেলিফোনে বা টেলিগ্রাম করে জানাব। ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে আমি প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই।

–তোমার বাপু

.

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব ইণ্ডিয়ার তরফে বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া নিম্নোক্ত সংবাদটি ১৯৪৭ সালের ২৬শে মে প্রকাশিত হয় :

শ্রীশরৎচন্দ্র বসু উদ্যোগী হয়ে কোন কোন লীগ ও কংগ্রেস নেতার সঙ্গে বাংলার ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে যে আলোচনা করেন তা থেকে উদ্ভূত সূত্রগুলির কিছুটা পরিবর্তন সম্পর্কে কথাবার্তা চলেছে বলে জানা গেছে।

সূত্রগুলির উদ্ভাবকেরা তাঁদের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন : লক্ষ্য, সূত্রগুলির আরও উৎকর্ষ বিধান। প্রধানত (১) ভারতের অবশিষ্টাংশের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের কি সম্পর্ক থাকবে, এবং (২) আইনসভার নির্বাচন–এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে কথাবার্তা চলেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে যে ঐ অনুচ্ছেদ দুটির খসড়া প্রস্তাব রচনাকারীদের কারুর কারুর হাতে নতুন করে লিখিত হয়েছে। সংশোধিত অনুচ্ছেদ–১। বাংলা হবে স্বাধীন রাষ্ট্র। স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নির্ধারণ করবে। কোন একটি রাষ্ট্র সমবায়ে যোগ দেওয়ার বিষয়টি স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের আইন সভায় দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে স্থির করা হবে।

সংশোধিত অনুচ্ছেদ–২। স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে যৌথ-নির্বাচকমণ্ডলী ও প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটে আইনসভা গঠন করার ব্যবস্থা থাকবে। আইনসভায় হিন্দু ও মুসলিম জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে আসন সংরক্ষণের বন্দোবস্ত থাকবে।

হিন্দু ও তফসিলীভুক্ত হিন্দুদের আপেক্ষিক জনসংখ্যার অনুপাতে অথবা উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে আসন বন্টন করা হবে। একাধিক আসনবিশিষ্ট নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করা হবে। ভোট পৌনঃপুনিক হবে না, বন্টনমূলক হবে।

যে প্রার্থী নির্বাচনে আপন সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের সর্বাধিক ভোট ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভোটারদের দেওয়া ভোটের শতকরা ২৫ ভাগ পাবেন, তাঁকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এই শর্তগুলি যদি কোন প্রার্থীই পূরণ করতে না পারেন তাহলে যাঁর পক্ষে আপন সম্প্রদায়ের সর্বাধিক সংখ্যাক ভোট ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অন্তত শতকরা ২৫ ভাগ ভোট পড়বে তাকেই নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এই শর্তও যদি কোনও প্রার্থী পূরণ করতে না পারেন তাহলে যত ভোট গৃহীত হবে তার মধ্যে যিনি সর্বাধিক ভোট পাবেন, তিনি নির্বাচিত হবেন।

আরও জানা গেছে যে বর্তমান আইনসভায় এবং যখন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে তখনকার আইনসভায় নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতা,না বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সিদ্ধান্ত গৃহীত তবে তাও আলোচনাকারীদের বিবেচনাধীন।

১৯৪৭ সালের ৩১শে মে নয়াদিল্লীতে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের কাছে শ্রী শরৎচন্দ্র বসু বলেন যে বাংলার অবস্থা, বিশেষ করে বাংলাকে দ্বিধাবিভক্ত করার কল্পনা হিসাবে তাঁর স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

শ্রীবসু আশা প্রকাশ করেন যে কংগ্রেস হাইকমাণ্ড যদি তাঁর পরিকল্পনা মেনে নেন তাহলে কার্যত তাঁর পরিকল্পনারই অনুরূপ সোহরাওয়ার্দী পরিকল্পনা স্বীকার করে নিতে লীগ হাই কমান্ডকে রাজী করানো সহজ হবে। শ্রীবসু বলেনঃ আমার পরিকল্পনায় আমার আস্থা আছে এবং শেষ পর্যন্ত আমি এতে অনড় থাকবো। আমি অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে দেখা করব এবং বাংলা বিভাগের সম্ভাবনা রোধ করার সকল উপায় চেষ্টা করে দেখবো।

বাংলাদেশ ইউনিয়নের বাইরে থাকবে একথা আমি বলি না। আমার বক্তব্য কেবলমাত্র স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রই ভারতের অবশিষ্টাংশের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ১৯৪৭-এর ৯ই জুন শরৎচন্দ্র বসু এম এ জিন্নাকে নিম্নলিখিত চিঠিটি লেখেন :

উডবার্ন পার্ক
কলিকাতা
৯ই জুন, ১৯৪৭

প্রিয় জিন্না,

আপনি আমাকে যে শিষ্টাচার ও হৃদ্যতা এবং আমার প্রস্তাবগুলি সম্পর্কে যে বিবেচনা দেখিয়েছেন তার জন্য আমার একান্ত আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন। বাংলা তার ইতিহাসের বৃহত্তম সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলেছে, কিন্তু তাকে বাঁচানো যেতে পারে। যদি আপনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় নিম্নলিখিত নির্দেশগুলি পাঠান তবেই তা সম্ভব :

(১) ব্যবস্থাপক সভার (ইউরোপীয়দের বাদ দিয়ে) সকল সদস্যের যে বৈঠক স্থির করা হবে যে ভবিষ্যতে যদি বাংলার উভয় অংশ অবিভক্ত থাকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন কোন সংবিধান রচনাকারী পরিষদে সমগ্রভাবে বাংলা যোগ দেবে এই প্রশ্নে তাঁরা যেন হিন্দুস্থান সংবিধান রচনাকারী পরিষদ কিংবা পাকিস্তান সংবিধান রচনাকারী পরিষদ–এর কোনটিতেই যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত না করেন এবং তাঁরা ব্যবস্থাপক সভায় অথবা সংবাদপত্রে অথবা অন্য যে কোন উপায়ে এক বিবৃতি প্রকাশ করে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তাঁরা বাংলাদেশের জন্য একটি নিজস্ব শাসনতন্ত্র রচনাকারী পরিষদ গঠনের ব্যাপারে দৃঢ়মত।

(২) ব্যবস্থাপক সভার দুই ভাগের সদস্যরা যখন স্বতন্ত্রভাবে মিলিত বেঠকে প্রদেশ ভাগ করার পক্ষে অথবা বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা পাবেন তখন যেন তাঁরা দৃঢ়ভাবে বিভক্তিকরণের বিরুদ্ধে ভোট দেন।

আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের সময় আপনি যে মত প্রকাশ করেছিলেন সেই অনুসারেই আপনাকে এই অনুরোধ জানাচ্ছি।কিন্তু আমার মনে হয় আপনি যদি শুধুমাত্র আপনার মতটুকু প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকেন এবং ভোটদান সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট নির্দেশ না দেন তাহলে পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব হবে না। আশা করি বাংলাদেশ যাতে অবিভক্ত থাকে এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয় তার জন্য আপনি সাধ্যমত সব কিছুই করবেন।

যদি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার মুসলিম সদস্যেরা উপরোক্ত অনুচ্ছেদ (১) এবং (২) অনুসারে সকলে ভোটদান করেন তাহলে আমার ধারণা লর্ড মাউন্টব্যাটেন ব্যবস্থাপক সভার (ইউরোপীয় বাদে) সকল সদস্যকে আর একটি বেঠক ডাকতে বাধ্য হবেন এবং সেই বৈঠকে সমগ্রভাবে এই প্রদেশ একটি নিজস্ব শাসনতন্ত্র রচনাকারী পরিষদ গঠন করতে চায় কিনা সে বাবদে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

১৩ই অথবা ১৪ই আমি আবার দিল্লী যাচ্ছি এবং ১৪ই বা ১৫ই আপনার সঙ্গে দেখা করবো।

ধন্যবাদ রইল। আমার শ্রদ্ধা জানবেন।

—-শরৎচন্দ্র বসু

কায়েদে আজম এম এ জিন্না
ব্যারিস্টার অ্যাট-ল
১০ আওরঙ্গজেব রোড, নয়াদিল্লী

বিমানে বিশেষ দূত মারফৎ এই চিঠিটি মিঃ জিন্নার হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু কংগ্রেস হাইকমাণ্ড শরৎচন্দ্র বসুর সংযুক্ত স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এ বিষয়ে আলোচনা আর চালানো সম্ভব হয়নি। পরে গান্ধীজী তাঁর প্রার্থনা সভার ভাষণে বলেন যে, “শরৎবাবুর প্রস্তাব সমর্থন করায় তাঁকে তিরস্কৃত করা হয়েছে।”

১৯৪৭-এর ২১শে জুন মহাত্মা গান্ধী শরৎচন্দ্র বসুকে নিম্নোক্ত পত্রটি লেখেন :

হরিদ্বার
১২-৬-৪৭

প্রিয় শরৎ,

এখানে কিছুটা সময় নিজের মতো ক’রে কাটাবার অবকাশ পেয়েছি। সেই অবসরে অনেক আগে লেখা উচিত ছিল। এখন দু একটা চিঠির উত্তর দিচ্ছি। এ মাসের ১৪ তারিখে লেখা তোমার চিঠিটা আমি পেয়েছিলাম।

ভৌগোলিক ঐক্য ক্ষুণ্ন হলে ঐক্যের জন্য কী ভাবে কাজ করতে হয় তা আমি জানিয়েছি।

তোমার সর্বাঙ্গীন কুশল আশা করি। ভালবাসা রইলো।

—বাপু

পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী ভায়েদের প্রতি

[১৯৫৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী কলকাতায় প্রকাশিত শরৎচন্দ্র বসুর একটি প্রেস বিবৃতির পুর্ণাঙ্গ বিবরণ।]

গতকাল”দি নেশন” পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভ “এটা পথ নয়” শীর্ষক লেখাটিতে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার বক্তব্য প্রতিফলিত হয়েছে। তবু পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মুসলিম ও হিন্দু ভায়েদের কাছে আবেদনক্রমে ইউ এস ও এর সভাপতি হিসাবে আমার কিছু বলা কৰ্তব্য এবং বলার অধিকার আছে বলে মনে করি। আমি তাঁদের কাছে শান্তি, মর্যাদাজনক শান্তির জন্য আবেদন করি, আবেদন করি তাঁরা যেন সুবিবেচন, ধীরতা এবং সুস্থতাকে মর্যাদা দেন।

পূর্ববঙ্গের কোন কোন জায়গায় সাম্প্রদায়িক ধরনের গণ্ডগোল বেঁধে ওঠায় এবং তার সুত্র ধরে কলকতা ও শহরতলীতে গোলমাল শুরু হওয়ায় আমি সত্যই ব্যথিত। আমার আরও দুঃখ এই যে যদি উভয় বঙ্গে শাসকবৃন্দ কিছুটা করুণা, বুদ্ধি, চাতুর্য এবং দৃঢ়তার পরিচয় দিতেন– যদি তাঁরা অবিবেচনা প্রসূত বিবৃতি দেওয়া থেকে কিছুটা সংযত থাকতেন তাহলে এই সব বিশৃঙ্খলা এড়ানো যেত। যাঁরা সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগের স্রোতে ভেসে গেছেন কিংবা ওই মনোভাবের উসকানি দিচ্ছেন তাঁদের আমি এইটুকুই বলবো যে প্রতিশোধ কোন সদ্‌গুণ নয়, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তা নূতন এক হিংসার ও অপকার্যের পারস্পর্য্যের জন্ম দেয় এবং শেষ পর্যন্ত তার সমর্থকদের গ্রাস করে। সীমান্তের ওপারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার নামে যাঁরা প্রতিশোধ প্রবৃত্তিকে উসকানি দিচ্ছেন, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মানুষ যেন তাঁদের হাতে খেলার পুতুল না হন–এই আমার আবেদন। যারা প্রলোভন দেখাচ্ছে তারা সমাজের ছদ্মবেশী শত্রু। আমার আবেদন–তাদের কথায় কান দেবেন না।

পূর্ববঙ্গের কোন কোন অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার করা হচ্ছে বলে কিছুদিন থেকে আমি খবর পাচ্ছি। তার ফলে রোগশয্যা থেকে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের কাছে আমি আবেদন জানাতে বাধ্য হয়েছি যে তিনি যেন ঘটনাবলী সম্পর্কে অনুসন্ধান করে সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি এবং স্বাধীনতার নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। অনেক আগেই অর্থাৎ গত ২রা জানুয়ারীতেই আমি এই আবেদন করেছি।

আমি এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারি না যে কলকাতার কোন কোন গণ্ডগোলের জন্য কয়েকজন সাংবাদিকেরও দায়িত্ব কিছু কম নয়। কেননা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মতে যখন “পুর্ববঙ্গের প্রকৃত পরিস্থিতি কী তা জানা ছিল না” তখন এঁদের দায়িত্ববোধহীন জ্বালাময়ী লেখা ও প্রচার এবং সংবাদ পরিবেশনাকে এর জন্য কিছুটা দায়ী না করে উপায় নেই। সৌভাগ্যক্রমে সংখ্যায় এঁরা খুবই অল্প। এঁরাই বাংলা বিভাগের জন্য প্রচণ্ডভাবে দারুণ আন্দোলন চালিয়েছিলেন। যোগাযোগটা লক্ষ্য করার মতো। অবশ্য আজ দেশবিভাগ এক অনস্বীকার্য ঘটনা। আমি আশা করেছিলাম, তাঁরা এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁদের পরিবর্তিত কর্তব্যের কথা উপলব্ধি করবেন এবং উভয় বঙ্গে সংখ্যালঘুদের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি তাঁদের লেখার মাধ্যমে বিপন্ন হতে দেবেন না। যদি এতই তাঁরা পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে বা তাদের হয়ে লড়তে চাইতেন তাহলে কলকাতায় সম্পাদকীয়ের পবিত্র কোটরে আবদ্ধ না থেকে পূর্ববঙ্গে গিয়ে সংখ্যালঘুদের জন্য লড়াই করাই তাঁদের উচিত ছিল।অবশ্য সেখানে সংগ্রামের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে বীরত্ব দেখানো সহজ।

এই প্রসঙ্গে আমি আরও উল্লেখ করতে চাই যে, গোলমালের সুযোগ নিয়ে কোন কোন জমি ও বস্তিমালিক আপন আপন স্বার্থ সিদ্ধ করতে তৎপর হয়েছেন এরকম খবরও ক্রমাগত আমার কাছে আসছে। খবরগুলি কতদুর সত্য তা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুসন্ধান করে দেখা কর্তব্য। ক্রমাগত আরও খবর পাওয়া গেছে যে গুণ্ডা প্রকৃতির লোকেরা শুধুমাত্র লুট এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে নির্বিবাদে অসহায় মানুষের ওপর অত্যাচার করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। এই সন্ত্রাস বন্ধ করার দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকার, তার পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর।

দেশবিভাগের ফলে যে সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোন সমাধান হবে না বরং নতুন আকারে এই সমস্যা জিয়ানো থাকবে এটা তৎকালীন কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার নেতাদের মনে যেদিন দেশ ব্যবচ্ছেদের ধারণা সৃষ্টি হয় তখন থেকেই আমি আশঙ্কা করেছিলাম। অনেক আগে ১৯৪৭ সালের ১৫ই মার্চ আমি বলেছিলাম : “ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশগুলির বিভক্তিকরণ সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান নয়। প্রদেশগুলি ওইভাবে ভাগ করা হলেও সেখানে হিন্দু ও মুসলমানদের পাশাপাশি বাস করতে হবে এবং সাম্প্রদায়িক বিরোধের ঝুঁকি সেখানেও থাকবে……। এর ফলে সাম্প্রদায়িক সমস্যা বৃদ্ধি পাবে এবং তার সমাধান একান্ত জটিল হয়ে উঠবে,হয়তো অসম্ভব হবে। ভারতের সর্বত্র এই রকম মিশ্রিত জনবসতি থাকার দরুন সাম্প্রদায়িক পার্থক্যকরণ কিংবা ধর্মভিত্তিক বিচ্ছিন্নকরণ বাঞ্ছনীয় নয়, সম্ভবও নয়……..। আমরা হিন্দু বা মুসলিম, শিখ বা খৃষ্টান হই আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ও স্বার্থ অভিন্ন।”

সাম্প্রদায়িক সমস্যা সম্বন্ধে আমার এই রাজনৈতিক মতামতের জন্য আমি জীবনে কোনদিন কখনই অবিভক্ত বাংলায় অথবা তার পরে বিভক্ত বাংলায় হিন্দু মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য করিনি। বাংলা বিভাগের পরেও উভয় বঙ্গেই জনসংখ্যার মিশ্রিত বৈশিষ্ট্য তেমনই থেকে গেছে, পার্থক্য ঘটেছে শুধু পরিমাণগত। কাজেই উভয় রাষ্ট্রে উদার সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সাম্যের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সংখ্যালঘুদের প্রশ্নটি বিবেচনা করতে হবে। সেই পথেই সমস্যার সমাধান, অন্য কোন পথে নয় এবং আশা করি উভয় রাষ্ট্রের সরকার এই দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থ উপলব্ধি করতে পারবেন। রাষ্ট্র দুটি,কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রে হিন্দু হোক,মুসলিম হোক জনগণ অভিন্ন। উভয় সম্প্রদায় পরস্পরের প্রতি বন্ধনে বাঁধা। সীমান্তের এপারে কিংবা ওপারে হোক একে অপরের সঙ্গে অস্থিমজ্জার মতো মিশে আছে।

পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার বাঙালী ভায়েরা, পবিত্র সব কিছুর নামে,বাংলার অতীত ইতিহাসের নামে, বিগত এবং বর্তমান বন্ধুত্বের নামে আমি আপনাদের কাছে হিংসার পথ পরিহার করে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার এবং সাম্প্রদায়িক শান্তি ও মিল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার আবেদন করছি। দিল্লী বা করাচীর পথ চেয়ে বসে থাকবেননা, সেখান থেকে আলো আসবে না। আপনাদের অন্তরের আলোয় যে নির্দেশ রয়েছে তাকেই অনুসরণ করুন। যে সব প্রস্তাব বিভিন্ন মহল থেকে করা হয়েছে সেগুলি নিয়েও আমি বিবেচনা করে দেখেছি। গভীর চিন্তা ও পরিণত বিবেচনার শেষে আমি এই সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য হয়েছি যে এর কোনটাই কোন সমাধান নয়। আমি ভারত ও পাকিস্তানের জনগণকে শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই যে পাঞ্জাবে এবং পাঞ্জাব থেকে ব্যাপক বাধ্যতামূলক দেশত্যাগে যে অসংখ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে আজ পর্যন্ত তার সমাধান হয়নি।

ভারত ও পাকিস্তানের জনগণকে আমার এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানাই যে পূর্ববাংলা একটি নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দিক এবং ভারত ও পাকিস্তানের জনগণ যেন তাঁদের নিজ নিজ সরকারকে এটা যতদূর সম্ভব দ্রুত কার্যকরী করার জন্য চাপ দেন। গত তিন বছর ধরে আমি বারবার বলে আসছি যে ধর্মের ভিত্তিতে এই প্রদেশ ভাগ সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোন সমাধান নয় এবং ওইভাবে প্রদেশগুলি বিভক্ত হলেও সেখানে হিন্দু ও মুসলিমদের পাশাপাশি বাস করতে হবে এবং সাম্প্রদায়িক পৃথকীকরণ বা ধর্মভিত্তিক বিচ্ছিন্নকরণ–বাঞ্ছনীয় নয়, সম্ভবও নয়। আমার এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আমি জীবনে কোনদিন বিভক্ত বাংলায় হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে কোন ভেদ করিনি। উভয় বাংলাতে আগের মতোই জনসংখ্যার মিশ্রিত চরিত্র অব্যহত রয়েছে।

ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহবান

[মৃত্যুর আধঘন্টা আগে “দি নেশন” শরৎচন্দ্র বসুর স্বাক্ষরিত সম্পাদকীয় হিসাবে লিখিত এবং ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫০-এ প্রকাশিত–পুর্ণাঙ্গ পুনর্মুদ্রণ।]

এক বিরাট ব্যক্তিগত শোকের অন্ধকারে মগ্ন থেকে গত শনিবারের আগের শনিবার অর্থাৎ এ মাসের ১১ই লিখতে বসে আমি পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ভায়েদের কাছে শান্তির জন্যে– মর্যাদাজনক শান্তির জন্য আবেদন করেছিলাম। আবেদন করেছিলাম তাঁরা যেন সুবিবেচনা, ধীরতা ও সুস্থতাকে মর্যাদা দেন।

পবিত্র সব কিছুর নামে, বাংলার অতীত ইতিহাসের নামে, বর্তমান ও অতীতের বন্ধুত্বের নামে, পবিত্রতার নামে আবেদন জানিয়ে আমি তাঁদের হিংসার পথ পরিহার করে ধীরতা ও সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে এবং সাম্প্রদায়িক শান্তি ও মিল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে অনুরোধ করেছিলাম। আমি তাঁদের দিল্লী বা করাচীর পথ চেয়ে বসে থাকতে বারণ করেছিলাম,কেননা সেখান থেকে আলো আসবে না। আমি তাঁদের অন্তরের আলোর নির্দেশ অনুসরণ করতে অনুরোধ জানিয়েছিলাম।

বর্তমান অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তার প্রকৃত সমাধান কী হতে পারে এ নিয়ে আমি গত এগার দিন ধরে গভীরভাবে চিন্তা করেছি। পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুদের ব্যাপক দেশত্যাগ কিংবা উভয় বাংলার মধ্যে জনসংখ্যা বিনিময়ের ব্যাপারেও। বঙ্গবিভাগ যখন ঘটেই গেছে তখন এর আমি পরিবর্তন করতে চাইনে। দেশবিভাগের দাবীর পিছনে যে ব্যর্থতাবোধ ছিল, সম্প্রতি কিছুকাল আগে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এটা আমি ভালভাবেই জানি। আমি সমাধানের যে প্রস্তাব করেছি তাতে বর্তমান ব্যবস্থার ন্যূনতম পরিবর্তন ঘটবে। একটি সুনির্দিষ্ট ও পৃথক রাজ্য হিসেবে পূর্ব বাংলা বাঁচুক এবং উন্নতি করুক, কিন্তু আমার আগেকার কথামতো দুই বাংলায় বসবাসকারী যে সম্প্রদায়গুলির পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ, যারা একে অপরের সঙ্গে অস্থিমজ্জার মতো মিশে আছে তাদের ভবিষ্যৎ স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে বলি, পূর্ববাংলা যেন ভারতীয় ইউনিয়নের ছত্রছায়ার আশ্রয়ে বেঁচে ওঠে এবং উন্নতির পথে অগ্রসর হয়।

“দি নেশনে” আমার সহকর্মীদের নামে ও তাঁদের পক্ষ থেকে এবং আমার নিজের তরফ থেকে আমি ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের বিবেচনার জন্য এই প্রস্তাব উত্থাপন করছি। “দি নেশন” বিশ্বাস করে, এই সমাধান শুধু যে দুই বাংলার শান্তি ও সমৃদ্ধির সহায়ক হবে তাই নয়, এতে ভারত ও পাকিস্তানেও শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে। সকল শান্তিপূর্ণ এবং আইনসম্মত উপায়ে এই সমাধানকে ত্বরান্বিত করার কাজে “দি নেশন” আপনাকে উৎসর্গ করছে।

স্বাঃ- শরৎচন্দ্র বসু

দুধ কলা দিয়া সাপ পুষিলে যাহা হয়, বাংলার ভাগ্যে আজ তাহাই জুটিতেছে। ধিকৃত বৃটিশের ইউনিয়ন জ্যাক উপড়াইয়া ফেলিয়া অর্ধচন্দ্র তারকা খচিত পতাকা সদর্পে প্রোথিত করার অব্যবহিত পর যাহারা সাবেক দিনের জগৎশেঠ রায়দুর্লভদের মত নিছক ভাগ্যান্বেষণে এদেশে আগমন করিয়াছিল তাহাদের কণ্ঠ আজ বাংলা-বিরোধী ‘অর্থনৈতিক অবরোধ; সৃষ্টির জয়ধ্বনিতে মুখরিত। অবশ্য ইহাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। চিত্তে সুখের কারণ ঘটিলে কত কি করিতে ইচ্ছা জাগে। তাহাদের চিত্তে আজ সুখের কারণ ঘটিয়ছে। লোটা ঘটি সম্বল করিয়া যাহারা এদেশে আসিয়াছিল, তাহারা এখন অচিন্ত্যনীয় জৌলুসের অধিকারী। যাহারা একদিন ঢাকায় হাজার টাকা লইয়া আসিয়াছিল কিনা সন্দেহ, তাহারাই এখন বিপুল বিত্ত-বৈভবের অধিকারী বনিয়া যায়, তখন এমন পাঁয়তারা না করিলে চলেই বা কেমন করিয়া। সুতরাং আমরা আশ্চর্য হইতেছি না, শুধু বিস্ময় বিমূঢ় চিত্তে ভাবিতেছি, ইহার পরিণতি তাহাদের নিজেদের জীবনে আশীর্বাদ না অভিশাপ বহন করিয়া আনিবে, সেইটিও ইহারা ভাবিতে পরাঙমুখ কিনা সে ইহাদের ভাল জানা থাকার কথা। তবে যে সুপারিশ জ্ঞাপন করা হইতেছে তাহার নির্গলিতার্থ এইযে বাংলাদেশ হইতে শেখ সাহেবের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা যদি প্রত্যাহৃত না হয়, তাহা হইলে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে পণ্য রপ্তানী বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে। বলা বাহুল্য, সম্প্রতি করাচী শিল্প-বণিক সমিতি একটি পুরাদস্তুর সভা ডাকিয়া এই অবরোধ সৃষ্টির হুমকী প্রদর্শন করে। সে হুমকী প্রদর্শনের উদ্দেশ্য যে ভীতি প্রদর্শন করিয়া কার্যোদ্ধার করা–সে কথা বলাই নিরর্থক।

কিন্তু আমরা বলি, ‘ও’ভয়ে কম্পিত নহে বীরের হৃদয়। পীচঢালা কালো রাজপথ রক্তরঞ্জিত হওয়া সত্ত্বেও যাহারা ভয় পায় নাই, সান্ধ্য আইনের বিভীষিকা যাহাদের কাছে পরাভব স্বীকার করিয়াছে, তাহারা করাচী শিল্প-বণিক সমিতির ভয় ভীতির প্রদর্শনে লেজ গুটাইয়া ভিজা বিড়ালের মত আত্ম-সমর্পণ করিবে, ইহা নিছক গোবর্ধন ছাড়া আর কেহ কল্পনাও করিতে পারে না। তাই ও ভয়ে আমরা ভীত নই। আমরা ভাবিতেছি, রাজনৈতিক অবরোধ সৃষ্টির যে ভীতি প্রদর্শন করা হইতেছে তাহা কি করিতে এখনও কিছু বাকী আছে?পশ্চিম পাকিস্তান হইতে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করিয়া করাচী বন্দরে লইয়া যাওয়া হইতেছে, উহার পর অবরোধ সৃষ্টির আর বাকী আছে কি? করাচী শিল্প ও বণিক সমিতি যদি আরও ব্যাপকতর ও বিস্তৃততর অবরোধ সৃষ্টির সম্ভাব্যতার প্রতি ইঙ্গিত করিয়া থাকেন, তাহা হইলেই বা কি হইবে? তেমন অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষকে কি প্রাগৈতিহাসিক কালের মানুষের ন্যায় দিগম্বর ভাবে বা বাকল পরিধান করিতে হইবে? না কি অপরাপর পণ্য- সামগ্রীর অভাবে বাংলাদেশ অনতিক্রমে সঙ্কটের সম্মুখীন হইয়া পড়িবে? অনন্তত আমরা তা মনে করি না। পশ্চিম পাকিস্তান হইতে পণ্যদ্রব্য রপ্তানী বন্ধ করিয়া দেওয়া হইলে সাময়িকভাবে বাংলা দেশে কোন কোন পণ্য-দ্রব্যের কিছুটা সংকট দেখা দিতে পারে বটে, তবে তাহা কোন সুদূরপ্রসারী সংকট সৃষ্টি করিতে সক্ষম হইবে না। সাময়িক অভাব দেখা দিতে পারে এইজন্য যে, বিগত চব্বিশ বৎসরের ক্রুর বঞ্চনা আর শোষণের অপরিহার্য পরিণতি স্বরূপ বাংলার সোনা-দানা যেমন শতদ্রুঝিলামের তীরবর্তী সিন্দুকে গিয়া সঞ্চিত হইয়াছে, তেমনি বাংলার সম্পদে ওইসব উষর মরুময় অঞ্চল শস্য-শ্যামলা এবং শিল্প-সম্ভার সমৃদ্ধ হইয়া উঠিলেও বাংলাদেশে প্রয়োজনানুগ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া উঠিতে পারে নাই। উপরন্তু ঔপনিবেশিক মানসিকতার বেদীমূলে তখনকার যা কিছু ছিল তাহাকেও বিনষ্ট করা হইয়াছে। ঔপনিবেশিক বৃটিশের মানদণ্ড যখন রাজদণ্ডে পরিণত হয়, তখন এই বাংলার বুকে অপরাপর কুটির-শিল্প ছাড়াও বিশ্ববিশ্রুত মসলিন উৎপন্ন হইত। বৃটেনের শিল্প-বিপ্লবের স্বার্থে সেই সব কিছুর নির্মম বিনাশ সাধন করা হয়। শুধু তাই নয়–মসলিন তৈরীর কলাকৌশল যাহাতে ধরাপৃষ্ঠ হইতে চিরতরে বিলুপ্ত হইয়া যায়, তজ্জন্য তাঁতীদের বৃদ্ধাঙ্গষ্ঠ কাটিয়া দেওয়া হয়। সেই অমানুষিক বর্বরোচিত নীতির অভিশাপ বর্ণনা প্রসঙ্গে জনৈক বৃটিশ নাগরিকই বৃটিশরাজের নিকট প্রেরিত এক পত্রে লিখিয়াছেন, “বাংলার মাটি তাঁতীদের হাড়ে সাদা হইয়া যাইতেছে।” উত্তর-স্বাধীনতাকালে বাংলার মানুষ শাসকচক্রের নিকট হইতে যে নির্মম আচরণ লাভ করিয়াছে, তাহাও তদপেক্ষা তেমন কিছু উন্নত নয়। পার্থক্য শুধু এই, তখন তাঁতীদের হাড়ে বাংলার মাটি সাদা হইয়াছিল আর এখন তাঁতী, কামার-কুমার, শ্রমিকমজুর, ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে সকলের রক্তে বাংলার মাটি লাল হইতেছে। উত্তর-স্বাধীনতাকালে পশ্চিমাশিল্পের স্বার্থে এখানকার কুটিরশিল্পকে বিচিত্র কৌশলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলিয়া আনা হইয়াছে। পশ্চিমা চাউল-মরিচ পেঁয়াজ মায় বাংলার সুস্বাদু কমলালেবুর স্থলে রসকষহীন মাল্টা বিক্রয়ের স্বার্থে এখানকার উন্নয়নকে নির্মমভাবে অবহেলা করা হইয়াছে। স্বাধীনভাবে বাংলাকে ব্যবহার করা হইয়াছে পশ্চিমা পণ্যদ্রব্যের ‘সংরক্ষিত বাজার’ হিসাবে। আর তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা আজও পরনির্ভরশীল। ইহার সর্বাঙ্গ দারিদ্রক্লিষ্ট। কিন্তু তবু আমরা ইহা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, পণ্য রপ্তানী সর্বতোভাবে বন্ধকরণেও বাংলার মানুষের সুদূরপ্রসারী কিছু ক্ষতি সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা নাই। বরং রহিয়াছে তাহাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান লাটে উঠার সম্ভাবনা, যাহারা বর্গীর লুঠতরাজ অপেক্ষাও নিষ্ঠুরতম পন্থায় বাংলাদেশকে লুণ্ঠন করিয়া শিল্প-সম্ভার গড়িয়া তুলিয়াছে।

কেননা, পূর্বাহ্নেই বলা হইয়াছে যে বাংলাদেশেই পশ্চিমা শিল্পদ্রব্যের প্রধানতম বাজার। যদি এই বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করা বন্ধ হইয়া যায়, আজ যদি বাংলার মানুষ একজোট হইয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, শোষকের উৎপাদিত পণ্য আমরা ব্যবহার করিব না, তাহা হইলে পাঁচ আঙ্গুল ঘি খাওয়ার কথা বিস্মৃত হইয়া যাওয়া ছাড়া কোন গতি থাকিবে না। তাহাদের কপাল ভাল যে, বঙ্গবন্ধু এখনও তেমন ডাক দেন নাই। পক্ষান্তরে তেমন অবস্থার অর্থাৎ পশ্চিমা পণ্যদ্রব্য রপ্তানী যদি বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে উহা বাংলার মানুষের জন্য সুদূরপ্রসারী সুফল সৃষ্টি করিতে এই জন্য যে, তেমন অবস্থায় বাংলাদেশ আবার স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে অগ্রসর হইবে। তখন বাংলার অবহেলিত তাঁতশিল্প, খদ্দরশিল্প প্রভৃতি আবার নব প্রাণস্পন্দনে স্পন্দিত হইয়া উঠবে। রসকষহীন মাল্টার দৌরাত্ম্যমুক্ত পরিবেশে আবার জাগিবে সুস্বাদু কমলালেবুর চাষের প্রেরণা। আমরা জানি, অন্ধকার বিদূরিত হওয়ার পূর্বক্ষণেই অন্ধকার সর্বাধিক ঘনীভূত হয়। সঙ্কট যত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, সঙ্কট উত্তরণের স্পৃহাও তত বাড়ে। পশ্চিমা পণ্যদ্রব্য যখন এ শ্যামল মাটির ধরাতলে আসিত না, তখন এখানকার মানুষ কদলীপত্র পরিধান করে নাই এবং তাহাদের পেটেও কাপড় বাঁধিতে হয় নাই। সুতরাং সে রকম ভয়- ভীতি প্রদর্শন অর্থহীন। বাংলায় অর্জিত অর্থসম্পদ বাংলা দেশে বিনিয়োগ করিতে হইবে এবং ইহাই বাংলার মানুষের দাবী। এই দাবীতে অস্পষ্টতা নাই, অযৌক্তিকতা নাই। অতএব, হুমকি ধমকির অবাঞ্ছিত স্বভাবধর্ম বর্জন করিয়া যুক্তির পথে অগ্রসর হওয়াই তাহাদের পক্ষে সর্বাধিক মঙ্গলজনক।

[দৈনিক ইত্তেফাক–২৩শে মার্চ]

আমরা শুনেছি ঐ, মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ–
‘৭১-এর তেইশে মার্চের সুর

দৈনিক ইত্তেফাক –২৪শে মার্চ, ১৯৭১ঃ বিক্ষুদ্ধ বাংলার বুকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে আঘাতে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের স্মারক দিবস ২৩ মার্চ গতকাল (মঙ্গলবার) চিরাচরিত আনুষ্ঠানিকতায় আর পালিত হয় নাই। বাংলার মুক্তি ও স্বাধিকার আন্দোলনের রক্তঝরা পটভূমিকায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ও ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের’ ডাকে গত কালের দিনটি বাংলাদেশব্যাপী ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসাবে পালিত হইয়াছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সরকারী বেসরকারী ভবনসমূহে, বাড়ী-ঘরে, যানবাহনে কালো পতাকার পাশাপাশি গতকাল সংগ্রাম পরিষদ পরিকল্পিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন করা হয়। ঢাকা শহরে সামরিক কড়া বেষ্টনীর ছত্রছায়ায় বিমান-বন্দর ভবনটিতে পাকিস্তানের পতাকা উড়িতে দেখা যায়। সংরক্ষিত এলাকা প্রেসিডেন্ট ভবন ও লাটভবনে পাকিস্তানের পতাকা ছিল। এছাড়া রাজধানীর সকল সরকারী ভবন–বাংলা পরিষদ ভবন, সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট সেক্রেটারিয়েট, শেখ সাহেবের বাসভবন, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল, ঢাকা বেতার কেন্দ্র, টেলিভিশন কেন্দ্র প্রভৃতি স্থানে কালো পতাকার পাশাপাশি ‘স্বাধীন বাংলার’ পতাকা উড্ডীন করা হয়। গতকাল প্রতিরোধ দিবস পালন উপলক্ষে রাজধানী ঢাকার গণজীবনে গণ-আন্দোলনের সাগরে ভরা কোটালের জোয়ার দেখা দেয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যবস্থাপনায় আউটার স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছাত্রছাত্রীরা যে বীরোচিত কুচকাওয়াজ পরিবেশ করেন, স্বাধিকার পিপাসু হাজার হাজার নরনারী আনন্দ উজ্জ্বল কিন্তু বজ্রকঠোর দ্যুতিতে দীপ্ত এক অপূর্ব পরিবেশে তাহা অবলোকন করেন। বাংলার তরুণদের এই কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়া গতকাল আকাশে-বাতাসে বাঙালীরা মানুষের মত মরিবার ও বাঁচিবার আত্মপ্রত্যয়ের যে অনির্বাণ স্বাক্ষর রচনা করিয়াছে তাহা অতুলনীয় অদৃষ্টপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব। সকাল হইতে রাত পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় বীর বাঙালীর অগণিত মিছিল শুধু কামনা বাসনা ও আকাঙ্ক্ষার ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করিয়া গিয়াছে অবিশ্রান্ত জলধারার মত। মিছিলে মিছিলে সভা-সমিতিতে জনতার কন্ঠ যেন কেবলি বলিতে চাহিয়াছেঃ

“শুকনো গাঙে আসুক
জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক
ভাঙ্গনের জয়গান গাও–
জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক
আমরা শুনেছি ঐ, মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ–”

গতকাল ছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারী ছুটির দিন।

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক এই দিবস উপলক্ষে গৃহীত কর্মসূচী অনুযায়ী গতকাল ভোরে প্রভাতফেরী, শহীদানের মাজার জেয়ারত, বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী বাসভবনে এবং প্রতিষ্ঠানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন। আউটার স্টেডিয়ামে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে জনসভা অনুষ্ঠান করা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *