আমি মুজিব বলছি – ১

॥ প্রারম্ভ ॥

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
মুজিব নগর, বাংলাদেশ
তারিখ….১/৫/৭১

শেখ মুজিব একটি দৰ্শন

একটি মহান ব্যক্তিত্ব, যার নির্দেশে আজও আমরা এগিয়ে চলেছি একটি শোষিত বঞ্চিত জাতির সার্বিক মুক্তির দিকে, সেই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমাকে কিছু বলতে হবে–তা কৃত্তিবাস দা’র দেওয়া এ প্রস্তাবের আগে এমন করে কখনও ভাবিনি। তাই এই মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছু বলার আগে এইটুকু বলা দরকার যে শেখ মুজিব একটি নাম নয়; শেখ মুজিব একটি দর্শন। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে . জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের যে সংগ্রাম, যা আজ বিশ্বের ইতিহাসে এক নূতন দিগন্তের উন্মোচন করতে চলেছে–তা শুধু শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করেই নয় বরং শেখ মুজিবের দর্শন ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে। অসহযোগ ও প্রত্যক্ষ সংগ্রাম; সংসদীয় পদ্ধতি ও সশস্ত্র বিপ্লব–এদুয়ের সংমিশ্রণে গড়ে উঠা মুক্তি-সংগ্রামের এক নুতন পথ। এক নতুন দর্শন,মুক্তিকামী মানুষের কাছে এক নূতন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, কিভাবে সংসদীয় পদ্ধতি ব্যর্থ হলে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু হয় এবং সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য যে জনসমর্থনের প্রয়োজন তা অসহযোগ ও সংসদীয় পদ্ধতিতে সৃস্টি করে বিপ্লবী সংগঠনের মাধ্যমে শত্রুকে চরম রূপে আঘাত হানা যায়; সে আন্দোলনে শেখ মুজিব এক নূতন অধ্যায়। তাই পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের কাছে এই মহান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একজন মুক্তির দিশারী হয়ে নতুন করে নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছেন।

শেখ মুজিবের সাথে আমার পরিচয় সংগঠনের মাধ্যমে। অর্থাৎ আমি যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সে সংগঠন ‘ছাত্র লীগ’ করতে এসে। কেউ কেউ এ সংগঠনকে আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে ভুলও করে থাকেন! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা হলো যুবধর্মে সংগঠিত পাকিস্তান উপনিবেশবাদের উপর চরমভাবে আঘাত হানার জন্য, অস্ত্রের জবাব অস্ত্রের মাধ্যমে দেওয়ার জন্য গড়ে ওঠা এক ছাত্র সংগঠন–যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ভারত বিভক্তির সময় বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খা “বাংলাদেশ” সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা পদদলিত হয়ে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে হস্তান্তরিত হয়েছিল বৃটিশ ঔপনিবেশবাদের হাতে এবং এই পাকিস্তান উপনিবেশবাদের শৃঙ্খলমুক্ত এক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে জন্ম ছাত্র লীগ সংগঠনের। তাই আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের মধ্যে যে সম্পর্ক তা বঙ্গবন্ধুর ভাষায় খুব সহজ হয়ে ধরা পড়ে-“আমি আওয়ামী লীগ প্রধান আর ছাত্র লীগের আজীবন সভাপতি”। অর্থাৎ সংসদীয় রাজনীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠা গণসংগঠন আওয়ামী লীগ আর যুবধর্মে বলীয়ান বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত ছাত্র লীগ–এ দুই দর্শনের মিলনসেতু বঙ্গবন্ধু। তেমনি বাংলাদেশের মানুষকে শ্রেণীশোষণমুক্ত শোষণহীন সমাজে গড়ে উঠার সহায়তায় বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে শ্রেণী সংগ্রামের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে শ্রমিক সংগঠন–শ্রমিক লীগ। কেননা তিনি বলেন-”কৃষক শ্রমিকের রাজত্ব কায়েম না হওয়া পর্যন্ত শোষিত মানুষের মুক্তি আসে না।” তাই এই সংগঠনগুলোর মধ্যেই ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের যথার্থতা।

ছাত্র লীগের হয়ে প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর কাছে আমাদের এই সংগঠনের কাজে পরামর্শ নিতে যেতে হয়। এবং যতবারই তাঁর সম্মুখে যেতে হয় ততবারই বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয় তাঁর অপূর্ব সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখে। গণসংগঠনের সাথে অধিক জড়িত হলেও ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের প্রতি জায়গার কার্যকলাপ যেন তাঁর নখদর্পণে। কোথায় কোন ইউনিয়নে কোন ছাত্র লীগ কর্মী কতটুকু কাজ করেছে তা যেন তাঁর সম্পূর্ণ মুখস্ত। মাঝে মাঝে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন, “সারা বাংলাদেশের লোকই তো আমার। তাই কোথায় কি হচ্ছে তা কি আমার অজানা থাকতে পারে।” তখন ভাবতাম সত্যিই তো, সারা বাংলাদেশের লোক যে তাঁর লোক। তাই তো উনসত্তরের ২৩শে ফেব্রুয়ারীতে রেসকোর্সের সম্বর্ধনার জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন– “এই বলে মোর পরিচয় হোক, আমি তোমাদেরই লোক।” সত্যি করে বলতে কি একথা তাঁরই বলা সাজে; যার হাতের ইশারাতে লক্ষ লক্ষ জনতা ওঠে বসে, এ কথা তো তিনিই বলতে পারেন। মাঝে মাঝে গণ-সংগঠনের কর্মীদের চেয়ে ছাত্র-সংগঠনের বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত কর্মীদের প্রগতিমনার সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি এমনিভাবে সশস্ত্র বিপ্লবের দর্শন, কার্যপদ্ধতি ব্যাখ্যা করতেন যে আমরা অবাক হয়ে যেতাম আর ভাবতাম বঙ্গবন্ধু এখনও যেন আমাদের সভাপতি। আমরা এমন এক বিপ্লবী মহানায়কের সাথে আলোচনা করছি, সে মহানায়ক শুধু পারেন একটি জাতিকে উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল হতে মুক্ত করে বলিষ্ঠ জাতি হিসাবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে।

মুক্তি-আন্দোলনের মহানায়ক শেখ মুজিব তাই তাঁর সিদ্ধান্তে অটল বিশ্বাসী এবং বিনা যুক্তিতে কারও পক্ষেই সম্ভব নয় তাঁর সামনে কোন বিষয়ের অবতারণা করে কিংবা তাঁর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। মৃত্যুর সম্মুখেও তিনি দৃঢ়তার সাথে সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেন। ‘৬৯-এর ফেব্রুয়ারীর চতুর্থ সপ্তাহের শেষের দিকে যখন তিনি ষড়যন্ত্র মামলায় ‘অন্তরীণ’ তখন তৎকালীন দেশরক্ষামন্ত্রী এ আর খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুকে ‘প্যারালে’ গোলটেবিলে যেতে অনুরোধ করলো, এমন কি বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুভয়ও দেখালো, তখন কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকে সেদিন এ আর খানকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, “You are general in war but child in politics.” তাঁর এই আত্মবিশ্বাস ও মনের দৃঢ়তাই তাঁকে আজ জাতির পিতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা গণমানুষের মনে এনে দিয়েছে আলোর হাতছানি।

বাংলাদেশের এই শ্যামল মাটিতে তিনি যেমন জন্ম নিয়ে এর শ্যামল মায়ায় বর্ধিত হয়েছেন তেমনি এই মাটিকে ঘিরেই তাঁর দর্শন গড়ে উঠেছে। আর এই মাটিকে যে তিনি কত ভালবাসেন তাঁর নিদর্শন পাই কয়েকটি ঘটনা থেকে। ‘৬৭-এর শেষের দিকে বাংলার শোষিত মানুষের পক্ষ থেকে ৬ দফা দাবী পেশের অভিযোগে তিনি তখন দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকা জেলে আবদ্ধ। হঠাৎ একদিন মধ্যরাত্রে তাঁকে মুক্ত বলে জেল থেকে বাইরে নিয়ে আসা হলো। তিনি জেল গেটের বাইরে এসে বুঝলেন যে এটা তাঁর মুক্তি নয়, কেননা তাঁকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবার জন্য বিরাট সামরিক সাঁজোয়া গাড়ীর দল প্রস্তুত। তিনি এই ষড়যন্ত্রের আভাস বুঝতে পেরে সামরিক অফিসারটিকে একটু দাঁড়াতে বলে একটু দূরে গিয়ে হাঁটু গেড়ে হাতে মাটি নিয়ে কপালে ঠেকালেন। পরে তাঁর কাছ হতে শুনেছি তিনি নাকি সেদিন একথাই বলেছিলেন–”এ মাটিতে আমার জন্ম, এ মাটিতেই যেন মরতে পারি।” শুধু এই নয়, যখন এই সেদিনও ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী বাংলাদেশ হতে সমস্ত অর্থ ও স্বর্ণ পাচার করছিল এবং তা যখন আমরা তাঁর দৃষ্টিতে এনে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কি হবে বলে প্রশ্ন করলাম, তখন অতি সহজে হাসতে হাসতে তিনি বললেন—”এতদিন ওরা আমাদের সব নিয়েছে, কিন্তু বাংলার মাটি তো নিতে পারে নাই! মাটিই যে আমার সোনা, একে রক্ষা করলেই সব হবে।”

এমনি শত শত ঘটনা তাঁর মাটির প্রেমের স্বাক্ষর হয়ে রয়েছে। তিনি যেমনি দেশের মাটিকে ভালবাসেন তেমনি ভালবাসেন সাধারণ মানুষকে। শতপরিশ্রান্ত হয়ে এসেও যদি দেখেন তাঁর জন্য একজন সামান্য মজুরও বসে আছেন তবে তিনি তাঁর অন্য কাজে বিলম্ব করে হলেও তার সাথে খোলাখুলি আলোচনায় মেতে যান। তিনি যখন যেখানেই থাকুন না কেন জনগণের জন্য তাঁর সাথে দেখা করার ব্যাপারে তিনি কোন বাঁধার সৃষ্টি হতে দেন না। তাইতো তাঁর বাসভবনের সামনে সর্বক্ষণের জন্য যেন একটা মেলা লেগেই থাকে। জনগণের প্রতি তাঁর এই অক্ষত ভালবাসাই তাকে উদ্ধুদ্ধ করেছে পুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার করে শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত হতে। তাই তিনি শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত অনাহারক্লিষ্ট সাড়ে সাত কোটি জনগণের অতি আপনজন, তাদের অতি প্রিয় নেতা–বঙ্গবন্ধু–যার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে শত বছরের পরাধীন এক জাতি এক নূতন সূর্যের সন্ধান। এবং যার প্রত্যাশায় এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ শত বুলেট, বেয়নেট, ট্যাংক, কামান আর মেশিনগানকে উপেক্ষা করে।

এমনি এক মহান নেতার আশীর্বাদ ও পরিচর্যায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ তার জন্মলগ্ন হতে পাকিস্তান উপনিবেশবাদের কবলমুক্ত শোষণহীন বাংলাদেশ গঠনের সংগ্রাম করে আসছে। বহু ঘাত-প্রতিঘাত তুচ্ছ করে বাংলাদেশের জনগণের বিজয় নিশানকে ঊর্ধে তুলে ধরে বেরিয়ে এসেছে ‘৫২, ‘৬২, ‘৬৬ ও ‘৬৯-এর রক্তঝরা ইতিহাসকে। শত শহীদের রক্তে পবিত্র হয়ে মুক্তির শপথে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে এসেছে প্রতিটি কর্মী, যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বাংলাদেশের মাটিতে গড়ে উঠছে এক একটি গণজোয়ার। তারাই তো জয় বাংলার দর্শনকে সামনে রেখে অর্জন করেছে ‘৭০-এর ঐতিহাসিক গণবিজয়। ‘৭০-এর নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাদের রায় স্পষ্ট করে জানালেও গত ২৩ বছরের পাকিস্তানী শাসনের ইতিহাসের একটা যোগফল বার বার একথাই বলে গিয়েছে যে পাকিস্তানের বর্বর শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের জনগণের এ রায়কে অত সহজে মেনে নেবে না। পৃথিবীতে কোথাও কোন ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী তার বিষদাঁত ভাঙ্গার আগে পর্যন্ত মেনে নেয় নি, বা নিতে পারে না। এই ঐতিহাসিক সত্যকে সামনে রেখেই বাংলার যুবসমাজ এগিয়ে চলেছিলো স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রামের দিকে। যুবসমাজের এই সংগ্রামে এক একটি স্তর অতিক্রম করে তার বিস্ফোরণের উপযুক্ত সময় ১লা মার্চে এসে উপনীত হয়। এই এগিয়ে চলার পথে ছাত্র লীগকে শুধু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বাঁধাই অতিক্রম করতে হয়নি, অতিক্রম করতে হয়েছে এদেশের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে

এমনি করে ১লা মার্চ পাকিস্তান কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশনকে স্থগিত করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র। জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল স্বাধীনতার ধ্বনি দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্র লীগ পল্টনে ঘোষণা করে দিল বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতাকে। শুরু হয়ে গেল প্রত্যক্ষ স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু আহবান জানালেন অসহযোগের, সাড়া দিল লক্ষ কোটি জনতা সে ডাকে। ২রা মার্চ ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সর্ববৃহৎ ছাত্র সমাবেশে ছাত্র সমাজ পুড়িয়ে দিল পাকিস্তানের পতাকা। সেখানে উত্তোলন করা হলো বহু আশা-আকাঙ্খার নূতন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা।

৩রা মার্চ পল্টনের ছাত্র লীগের জনসভা। বিকেলে ৩টায় সভা শুরু হলো সংঘঠনের সভাপতি নুরে আলম সিদ্ধিকীর সভাপতিত্বে। বঙ্গবন্ধু সেই সভায় অনির্ধারিতভাবে এসে উপস্থিত ছিলেন। আমাকেই পড়তে হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এক নং ইস্তাহার। সে ইস্তাহারে ঘোষণা করা হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও নির্ভেজাল গণতন্ত্রের ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা। এরপর বাংলাদেশ চলতে শুরু করল আমাদের প্রিয় নেতার নির্দেশে। সরকারী বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠান মেনে চলছে সেই নির্দেশকে, বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর সরকার। ৬ তারিখে ইয়াহিয়ার ভাষণের জবাবে ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমুদ্রের সামনে বঙ্গবন্ধু উপস্থাপিত করলেন তাঁর ঐতিহাসিক ঘোষণা–”এ সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

এরপর একদিকে আলোচনা অপরদিকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে মুক্তির সংগ্রাম। এগিয়ে এল ২৫শে মার্চ। দু’পক্ষের রাইফেল হতে বেরিয়ে এল বুলেট। বাংলাদেশের আকাশ ভরে গেল কাল ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধে। পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যরা স্থাপন করল বর্বরতার এক নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত। পুড়িয়ে দিল গ্রামের পর গ্রাম আর হত্যা করলো নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণকে। কিন্তু মুক্তিকামী জনসাধারণ বীভৎস সামরিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে এগিয়ে চললো তাদের স্বাধীনতার পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে। জনগণ সামরিক বাহিনীর হত্যা ও নারীধর্ষণ, আগুন জ্বালানো প্রভৃতির মাঝে পরিবার পরিজনদের হারিয়ে নতুন মনোবল নিয়ে এগিয়ে চলেছে মুক্তির পথে। পাকিস্তানী সৈন্যের এই বর্বরতা কোন এক জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়, এটা ঘটেছে সেখানে যেখানে এই বর্বর সৈন্যেরা প্রাধান্য পেয়েছে। তাই ভাবতে বিস্ময় লাগে যে একজন নেতার প্রতি কতটা শ্রদ্ধা থাকলে বা নেতা কত মহৎ হলে মানুষ পারে তাঁর নির্দেশে এমনি করে এগিয়ে যেতে। তাই স্থির করা যায় না কোনটা সত্য যে -মুজিব বাংলাদেশের, না বাংলাদেশ মুজিবের।

বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় অনেক কথাই বলে ফেলেছি, কিন্তু নেতার সত্যিকারের একটা ছবি যে আঁকতে পারিনি সেটা সত্য। কেননা শেখ মুজিবকে কোন একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা উক্তির মধ্যে বোঝা বড়ই কঠিন। তাঁকে বুঝতে হলে তাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে বাংলাদেশের এই মুক্তি আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে স্তরে। কিন্তু আমাদের অনেক বন্ধুই সেটা না করে তাঁর একটা বিচ্ছিন্ন উক্তিকে নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মেতে প্রকৃত মানুষটিকে না দেখে একটি বিকৃত মানুষের সন্ধান করে ফেরেন। সেখানেই বন্ধুরা ভুল করে বসেন। তাঁকে বুঝতে হলে দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শোষণে আবদ্ধ এমন একটি জাতীয় ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে যেখানে তাঁকে দেখতে পাওয়া যাবে মুক্তি-আন্দোলনের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার মাঝে। কেননা মুক্তি-আন্দোলনের ইতিহাসে শেখ মুজিব একটি নূতন দিগন্ত। তাই সবশেষে আমি আবার সেই কথাই বলব,- শেখ মুজিব একটি নাম নয়, শেখ মুজিব একটি দর্শন।

বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা আন্দোলনে আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ বিনা দ্বিধায় বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিচ্ছে। দেশ স্বাধীন হবে। পৃথিবীর কোন শক্তিই বাংলার স্বাধীনতাকে রোধ করতে পারবে না। আমাদেরকে আরও অনেক রক্ত দিতে হবে। এ রক্তের বিনিময়েই আমাদের উত্তরসূরীরা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি বলে পরিচয় দেবে। কিন্তু ফিরে পাবে না তারা বাংলার এই স্বাধীনতা আন্দোলনের পাদপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের পবিত্র শহীদ মিনারকে যা আজ পাঞ্জাবী হানাদারদের বুলেট, মেশিনগান আর ট্যাংকের আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (পরবর্তীকালে তার নাম হয়েছে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্ররা সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর করেছিলেন। তখন সন্ধ্যা সাতটা। তারিখ ২৫ মার্চ। ছাত্র লীগের নেতারা পরপর কয়েকটি সংবাদ পেলেন টেলিফোনে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অবিলম্বে আক্রমণ করবে বলে গোপন সূত্র থেকে জানা গেছে।

ছাত্র নেতারা ছুটলেন শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে, স্থানঃ ঢাকার ধানমণ্ডী। শেখ সাহেব নানা নেতা ও কর্মীকে নির্দেশ দিলেন। বললেন,–“কেউ যেন অযথা সময় নষ্ট না করি।”

শেখ সাহেবের নিজের নিরাপত্তার প্রশ্ন উঠল। কিন্তু তিনি বললেন, বাসস্থান ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না। তাঁর কথা : “আমার লাশ পড়ে যায় তো যাক।” তবু তিনি নড়বেন না; কেননা তাঁকে না পেলে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা ঢাকায় কাউকে বাঁচতে দেবে না; গোটা শহরটাকেই ধ্বংস করে দেবে।

“মানুষ কারে কয় দেখলেন! মহত্বটা একবার দেখেন। কিন্তু আমরাও ছাড়লাম না।” বহু অনুনয় বিনয় করে আমি এবং আমার মতো আরো অনেকে শেখ মুজিবকে রাজী করিয়েছিলাম। রাত্রি এগারোটা নাগাদ বিশ্বস্ত কয়েকজন সহযোদ্ধার পাহারায় তাঁকে বাসস্থান থেকে নিরাপদে সরিয়ে দেওয়া হয়।

রাত্রি সাড়ে এগারোটায় গুলীবর্ষণ শুরু হল। সারা শহর জুড়ে। প্রথমে চারিদিক থেকে কাতর আর্তনাদ শোনা গিয়েছিল। তারপর শুধু ফৌজী চীৎকার, গাড়ির আনাগোনা এবং গুলী আর গুলীর শব্দ।

কিন্তু তা সাময়িক। পাকিস্তানী বাহিনী অতঃপর ট্যাংক নিয়ে রাজারবাগ আক্রমণ করে। সে-ও আমেরিকান আর চীনা ট্যাংক। পুলিশ লাইন এবং পুলিশ সেই হামলার সামনে দাঁড়াতে পারেনি। বাড়ীটা গেছে গুঁড়িয়ে; এবং পুলিশদের অনেকেই মরেছে, সামান্য কয়েকজন পালাতে পেরেছিল।

এখন মনে হয় রাজারবাগে ওরকম প্রতিরোধ গড়ে তোলা ভুল হয়েছিল। ওখানে প্রতিকূল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন না হলে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা বোধহয় ঢাকার থানাগুলিকে একের পর এক শেষ করে দিত না।

রাজারবাগের ঘটনার পর সৈন্যবাহিনী শহরের থানাগুলিতে আক্রমণ চালায়। একমাত্র লালবাগ থানাটি এই হামলা থেকে রক্ষা পায়, কারণ সেখানে ইয়াহিয়ার দালালরা ঘাঁটি করেছিল। ঢাকা শহরে অতঃপর আর একটি থানাও অক্ষত ছিল না। ইউনিফর্ম পরা পুলিশ কত যে নিহত হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই।

শহরের প্রত্যেকটি দমকল-কেন্দ্রে হানা দিয়ে ইয়াহিয়া বাহিনী সেগুলিকে ধ্বংস করে দিল। যত দমকলের কর্মী ছিলেন তাঁদের একজনও বাদ যান নি, প্রত্যেককে গুলী করে মেরে ফেলা হয়েছে। ২৬শে মার্চ সকালে ইউনিফর্ম-পরা ১০০ পুলিশ এবং তার দ্বিগুণ দমকল- -কর্মীর মৃতদেহ এক জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

রাত্রি প্রায় দুটোর সময় আক্রমণ চলল সদরঘাট ষ্টেশনে। পুরো চার ঘন্টা গুলী বৃষ্টির পর ষ্টেশনে উপস্থিত যাত্রী, পোর্টার এবং অন্যান্য নানা শ্রেণীর লোকের অবস্থাটা কি দাঁড়াতে পারে সেকথা কাউকে বলে দিতে হয় না। আশ্চর্য হবার নয় যে, পরদিন বুড়িগঙ্গা নদীতে শত শত মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে। ২৬শে মার্চ ভোরবেলা গুলীবৃষ্টি হঠাৎ থেমে গেল। ভয়ে সন্তর্পণে কিছু কিছু লোক বেরিয়েছে রাস্তায়। চারিদিকে মৃতদেহ। পরিচিত এবং অপরিচিত মুখগুলি। সবাই হাত লাগায়। এক মর্মান্তিক কর্তব্য। অল্পক্ষণের মধ্যে দেখা গেল, মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে হাজার খানেক লাশ জমা হয়েছে।

ততক্ষণে সৈন্যরা এসে গেছে। তাদের ককরে। যেখানে যেমন আছে সেখানেই লাশ পড়ে থাকবে। তবু কেউ কেউ মৃতদেহ সরাবার চেষ্টা করেছিল কোথাও কোথাও। যারা তা করতে গেছে মিলিটারীর গুলী তাদেরও লাশ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।

এ দিনকার ঘটনাবলী থেকে বোঝা গেল, ইয়াহিয়া বাহিনী আক্রমণের ছক বহু পূর্ব হতেই তৈরি করে রেখেছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রদের হোষ্টেলগুলি এবং তার চারদিকের বাড়ী-ঘরে পাকিস্তানী ফৌজ যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। নামজাদা অধ্যাপক, মেধাবী ছাত্র, সাধারণ কর্মচারী–সবাইকে পরিকল্পনা অনুযায়ী খতম করা হয়েছে। ঢাকার বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এইসব পরিবারবর্গকে–মা শিশুদের পর্যন্ত– একেবারে নির্মূল করে দেওয়া হয়েছে।

ইয়াহিয়ার ঔপনিবেশিক যুদ্ধ সুস্পষ্টভাবে তার শ্রেণীযুদ্ধও। ২৬শে মার্চ ঢাকা শহরে এই কথাটির নির্ভুল প্রমাণ পাওয়া গেল।

শাজাহান সিরাজ
১/৫/৭১ মুজিবনগর। বাংলাদেশ

.

আমি মুজিবর বলছি,–”বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম।” শুক্রবার ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ সাল সকাল ৯টা ৮ মিনিটে অজ্ঞাত রেডিও থেকে কন্ঠস্বর ভেসে এল–”আমি মুজিবর রহমান বলছি, সঙ্গে পাক-বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য জনগণ শত্রুর সঙ্গে বীরের মত লড়াই করছে। বাংলাদেশ-এর কোণায় কোণায় শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আল্লাহ আপনাদের সহায় হউন, শত্রুর বিরুদ্ধে আপনাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করুন। আমরা বিড়াল কুকুরের মত মরব না, যদি মরতে হয় তবে বাংলা মায়ের সুযোগ্য সন্তান হিসাবেই প্রাণ দেব। ‘বাংলাদেশের’ পতাকা বাংলাদেশের সমস্ত গ্রামে উড়ছে। ‘জয় বাংলা’।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এই যুদ্ধের নেতা-নায়ক-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। সংগ্রাম শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের বিপ্লবী জনতা ফৌজী চলাচল বন্ধ করতে উড়িয়ে দিচ্ছে পুল, ভেঙ্গে দিচ্ছে রেললাইন। ঢাকা বেতার-কেন্দ্র মিলিটারীর দখলে গিয়েছে ৭টা ১৫ মিনিটে, কিন্ত স্বাধীন বাংলার বেতার-কেন্দ্র ঘোষণা করেছে যে তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও দিনাজপুরের বিরাট অংশ দখল করে নিয়েছে। দখল করেছে চট্টগ্রাম বেতার-কেন্দ্র।

এদিকে লড়াই চলছে সর্বত্র। চলছে ঢাকায়, সিলেটে, কুমিল্লায়, চট্টগ্রামে। গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, বন্দরে। সারাদিন সারারাত ধরে চলছে যুদ্ধ। দুই পক্ষে-হতাহত অনেক। মুজিবর তাঁর গোপন বেতার-কেন্দ্র থেকে বলেছেন, “শত্রুর শেষ না দেখা পর্যন্ত লড়াই চলবে। জঙ্গীশাসন উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত সর্বস্ব পণ করে এগিয়ে যেতে হবে। জয় বাংলাদেশের হবেই।” শুধু তাই নয় আজ শবৃহস্পতিবার মধ্যরাত্রে পাক সশস্ত্ৰ-বাহিনী ঢাকায় পিলখানা ও রাজারবাগে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশবাহিনীর উপর হঠাৎ আক্রমণ চালায়। বহু নিরস্ত্র লোক নিহত। ঢাকা শহরে ও ঢাকার অন্যান্য অঞ্চলে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস, ও পুলিশেরনিবার সারা বাংলাদেশে হরতাল পালন করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার-কেন্দ্র জানিয়ে দিয়েছে যে, টিক্কা খানের কোন ফতোয়াই বাংলাদেশ মানবে না, মানবে না, মানবে না।

এগারদিন ধরে ঢাকায় সাংবিধানিক সংকট নিরসনের আলোচনা চালিয়ে মুজিবের ৪ দফা দাবী নীতিগতভাবে মেনে নেওয়ার পর ২৫শে মার্চ মধ্যরাত্রে ইয়াহিয়া খাঁ চুপিসাড়ে সরে পড়েন। পালিয়েছেন ভুট্টোও! তাঁরই নির্দেশে সামরিক কর্তৃত্ব পুনরায় কার্যকর করার উদ্দেশ্যে পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ৬ দফার এক নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশে আছে : সর্বত্র কারফিউ, দেখামাত্র গুলি, ব্যাঙ্ক, বেতার বন্ধ, রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ, সরকারী কর্মচারীদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে কাজে যোগদানের আদেশ, ইত্যাদি।

ঢাকা এবং আর কয়েকটি স্থানে ২৫শে মার্চ মধ্যরাত্রির পর সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। ঢাকায় সংঘর্ষ মারাত্মক। ঢাকায় ও চট্টগ্রামের পথে লড়াই চলছে। এবং জনগণ সামরিক প্রশাসনের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বন্ধপরিকর। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং পুলিশ ‘বাংলাদেশের’ স্বাধিকার রক্ষার জন্য প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জনগণ। গত ২৪ ঘন্টায় অন্তত দশ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য চট্টগ্রাম ও খুলনার চালনা বন্দরে নেমেছে বলে জানা গিয়েছে। তাদের ঢাকা, কুমিল্লা ও যশোহর সেনানিবাসে পাঠানো হয়। তার ফলে পূর্ববঙ্গে পাক সেনার সংখ্যা দাঁড়ালো ৭০ হাজার। এই নতুন সৈন্য আসার পরই সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়াও কুমিল্লাতে সংঘর্ষ হয়েছে। কুমিল্লায় কয়েক ব্যক্তিকে গুলী করা হয়। সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থানে কয়েকশ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। সৈন্য, আধা-সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালীদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে। লাঠি হাতে পুলিশদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্তব্যরত রাখা হয়েছে।

কিন্তু বন্ধ হলনা কিছুই। ইতিহাসের চাকা বলদর্পীরা স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল-কিন্তু শুরু হল শেকল ছেঁড়ার যুদ্ধ। আহবান এল–‘সকাল হয়েছে, বন্ধু শেকল ছেঁড়ো, শেকল ছেঁড়ো।’ ‘শত্রু সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে।’ সামরিক শক্তি উন্মত্ত ব্যভিচারে বিদ্রোহ দমন করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই ভয়ঙ্কর রাতের ঘটনা ঢাকার এক হোটেলের জানলা থেকে দেখেছিলেন বিদেশী সাংবাদিকরা। তাঁরা বলেছেন, “বৃহস্পতিবার রাত্রে দেখেছি সৈন্যরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসছে। অটোমেটিক অস্ত্র হাতে নিয়ে তারা ছুটছে। ট্যাঙ্কের উপর কামান ও রকেট নিয়ে তারা ছুটছে শহরের প্রতিটি রাস্তায়, অলি-গলিতে। রাত সাড়ে দশটায় সামরিক বাহিনীর এই অভিযান শুরু হল। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হল, যে-কেউ বাইরে পা দেবে তাকে গুলী করা হবে। ইন্টারকনটিনেন্টাল হোটেলে আমরা পৃথিবীর নানা দেশের ত্রিশজন সাংবাদিক, ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার নামজাদা সংবাদসংস্থা, পত্র ও বেতার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এবং সোভিয়েট, যুগোশ্লাভ ও জাপানী সাংবাদিকরাও রয়েছেন। সৈন্যরা হোটেলটি ঘিরে রাখল। আমরা বন্দী হলাম। শুক্রবার (২৬শে মার্চ) সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিটে সামরিক ভ্যানে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ঢাকা বিমান-বন্দরে। সেখান থেকে করাচী। করাচী থেকে বিমানে করে নিজ নিজ দেশে।

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১ টায় ঢাকা ইন্টারকনটিনেন্টাল হোটেলে আমরা জন ত্রিশেক বিদেশী সাংবাদিক বন্দী। জানলা পথে দেখলাম বন্যার মত সৈন্যরা রাস্তায় নেমে পড়েছে, যেখানে পাচ্ছে সেখানেই বাংলাদেশের পতাকা ছিঁড়ে ফেলছে-সেগুলিতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। সারারাত গুলী-গোলার শব্দ। তারই মধ্যে নিরস্ত্র জনতা তাড়া-হুড়া করে রাস্তায় অবরোধ সৃষ্টি করছে। বুলডোজার চালিয়ে সেগুলি ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। আবার ব্যারিকেড, আবার অবরোধ। সারারাত এভাবে চলল। বাইরের পৃথিবীতে তাদের এ সকল কাজের কথাবার্তা যাতে না পৌঁছতে পারে সেজন্য সামরিক কর্তাদের চেষ্টার অন্ত ছিল না।

ঢাকায় বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে প্যারিসে ফিরে গিয়ে এএফপি-র সংবাদদাতা ব্রিয়ামে বলেছেন : দেখলাম সৈন্যরা একটি একটি করে বাড়ী-ঘর বেছে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে এবং এও দেখেছি, প্রকাশ্য দিবালোকে কোন কোন বাড়ীর জানালা লক্ষ্য করে সৈন্যরা সাব- মেশিনগান থেকে গুলী চালাচ্ছে। প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় আমাদের বিমান-বন্দরে নিয়ে আসা হল। পথে যা দেখলাম তাতে এই বিশ্বাস নিয়ে ফিরে এসেছি, বাঙালীরা প্রচণ্ড ভাবে বাঁধা দিয়েছে। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড়াতে গিয়ে তাদের হাতে কি-ই বা ছিল? হয়তো ছোরা বা ছুরি। ক্যান্টনমেন্টের ভিতর দিয়ে বিমান-বন্দর আসার পথ। সেই এক মাইল পথের মধ্যেও সংঘর্ষের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে হোটেলে বন্দীজীবন। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই, কোথায় কি ঘটছে জানি না। শুধু মুহুর্মুহু মেশিনগানের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাইনি। বৃহস্পতিবার বিকালের দিকে ইন্টারকনটিনেন্টালের কর্মীরা হোটেলের শীর্ষে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। জানালা-পথে দেখলাম মশাল হাতে সৈন্যরা এগিয়ে এল এবং পতাকাটি নামিয়ে নিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে সেটাকে পুড়িয়ে দিল। সেই গভীর রাত্রে মশালের অগ্নিআভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাকে আলোকিত করে তুলেছে। ওখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গত দুই সপ্তাহ ধরে আগ্নেয় অস্ত্রের ব্যবহার করে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা থেকে মেশিনগানের শব্দ শুনতে পেলাম। অনুমান করে নিলাম ছাত্র স্বেচ্ছা- সৈন্যবাহিনীর হেড কোয়ার্টারস দখলের জন্যই সেনাবাহিনীর এই নৈশ অভিযান। মুহুর্মুহু মেশিনগানের শব্দ আসতে লাগল। বুঝলাম হেড কোয়াটার্স রক্ষার জন্য ছাত্ররা সর্বস্ব পণ করে লড়ছে, নিজেদের সামান্য শক্তি দিয়ে তারা সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। বুঝতে পারলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা যে প্রতিরোধ ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার নানা শাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশ লালে লাল। বাড়ীর পর বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে সৈন্যরা প্রেতনৃত্য করতে করতে চলে গেল। পথে যেতে যেতে ইংরেজী পত্রিকা পীপল্-এর অফিসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ঢাকার পুরনো মহল্লায়। সাংবাদিকরা সে অগ্নিকাণ্ড দেখেন নি। শুধু দেখেছেন তার বিরাট ধুম্রপুঞ্জ। পাকিস্তানী সেনারা ঢাকা শহরটিকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চলেছে। বৃহস্পতিবার রাত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তারা যে আগুন দিয়েছিল তার আভা আমরা একমাইল দূরে হোটেল থেকে দেখেছি। এও দেখেছি বাজার এলাকায় একটি তিনতলা বাড়ীর বারান্দা থেকে “বাঙ্গালী একহও” আওয়াজ হওয়া মাত্র রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক জীপ থেকে মেশিনগান সেদিকে আগুন ছিটিয়ে দিল। এসময়েই সেই ভয়ঙ্কর রাত্রিতে একদল ছেলে কি একটা ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। সামনে একদল জঙ্গী সেনা। হালকা মেশিনগানের গুলী ও ধোঁয়া-আর কিছু দেখা গেল না। ওদের কি হল বুঝতে পারলাম না। রয়টারের প্রতিনিধি হুইটেন জানাচ্ছেন, “কিছুক্ষণ পরে এক ভয়াবহ নিস্তব্ধতার প্রাচীর ভেদ করে বহু দূর থেকে আর্তনাদের সুর ভেসে এল।”

ইন্টারকনটিনেন্টাল হোটেলের ১৬ তলা ছাদ থেকে দেখলাম, দিগন্ত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। বুঝতে দেরী হল না, গভীর রাত্রে এটা সেনা-দলেরই কীর্তি। আমরা পৃথিবীর নানা দেশের সাংবাদিক গোষ্ঠী ওদের প্রহরাধীনে সামরিক বন্দীগাড়ী করে বিমান-বন্দরে পৌঁছুলাম। একজন পাঞ্জাবী সেনা তার রাইফেল দিয়ে ইঙ্গিত করে মজাদার গলায় বলল, – ‘দেখলে তো, ওদের সখের বাংলাদেশ কেমন খতম করে দিলাম।” না, বাংলাদেশকে খতম করা যায়নি। বাংলাদেশকে খতম করা যায় না। বাঙালী জাতিকে খতম করা যায় না। ইতিহাস বার বার একথা প্রমাণ করেছে। সপ্তদশ অশ্বারোহী নিয়ে দ্বাদশ শতকে নবদ্বীপ বিজয়ে এসেছিলেন বখতিয়ার খিলজী। কিন্তু ফিরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। বখতিয়ার খিলজী কোন স্মরণচিহ্ন রেখে যেতে পারেন নি নবদ্বীপের বুকে। সেখানে স্মরণচিহ্ন রয়েছে বাংলার স্বাধীন সুলতান মুনীষ-উদ্দীন রজুফের। লক্ষণাবতীতে রাজত্বকালে দিল্লীর মসনদকে মাত্র একজন সুলতানই সালাম জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ বার বার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বার বার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে লক্ষণাবতী তথা বাংলাদেশ। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। তারপর এলেন হোসেন শাহ। সেই পূর্ব বাংলা, সেই বাংলাদেশ, যেখানে সুবর্ণগ্রামের রাজধানীর প্রতিরক্ষা দুর্গ একডালায় শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে ফিরোজ শাহের অভিযান। সেই একডালা দুর্গ কেন্দ্র করে যে লড়াই–আজ যেন সেই একই লড়াই। আজ যেন শামসুদ্দীন ইলিয়াস মুজিবর-তাজউদ্দিনের মধ্যে বেঁচে উঠেছেন, আর ইয়াহিয়া খাঁ বেঁচে উঠেছেন ফিরোজ শাহের মধ্যে। একডালা দুর্গ সেদিন দখল করতে পারেননি ফিরোজ শাহ। এ সেই পূর্ব বাংলা যেখানে বার বার এসে মোঘলরা ফিরে গেছে। এ সেই বারভূঁইয়ার দেশ-বাংলাদেশ। ঈশা খাঁ বশ্যতা মানে নি মোঘল দরবারের কাছে। আইন-ই- আকবরীতে লেখা আছে–বাংলার আসল বাদশা ঈশা খাঁ। দিল্লীর মুদ্রা ছাড়া সেখানে আর বাদশাহী কোন কিছু চলে না। সেই ঈশা খাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন আজ ইয়াহিয়া খাঁ। ঈশা খাঁ বার বার জন্মগ্রহণ করেছে বাংলাদেশে। ঈশা খাঁই আজ ‘মুজিবর’। বাংলাদেশের চির বিদ্রোহে ‘মুজিবর’ চিরবিদ্রোহী। ‘মুজিবর’ বার বার বিদ্রোহ করেছেন।

শুক্রবার ২৬শে মার্চ ঢাকা থেকে গোপনে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আত্মরক্ষা করলেন ইয়াহিয়া খাঁ। নিরাপদ দূরত্ব করাচী থেকে বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া বললেন, মুজিবর রহমান ও তাঁর অনুগামীরা পাকিস্তানের শত্রু। ইয়াহিয়া বললেন, মুজিবুর পাকিস্থানকে ভাঙ্গতে চায়, তার শাস্তি মুজিবরকে পেতেই হবে। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হল। ইয়াহিয়া বলেন, আজ দেশে যে গুরুতর পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি সারা দেশে সর্বপ্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হল। সংবাদপত্রের উপর কড়া সেন্সর ব্যবস্থা কায়েম করা হল। এই সমস্ত ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শীঘ্রই সামরিক শাসন জারী করা হবে। দেশের সর্বত্র রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হবে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা, সরকারের কর্তৃত্ব পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইয়াহিয়া খাঁর নির্দেশের রূপ দিলেন টিক্কা খাঁ। অবশ্য বৃহস্পতিবার রাত থেকেই পুরোদস্তুর লড়াই শুরু হয়ে যায়। তবে সে লড়াই প্রথম কয়েক ঘন্টা সীমাবদ্ধ ছিল শহরের বিভিন্ন পুলিশ ব্যারাকে। সেনাবাহিনী ব্যারাকগুলি ঘিরে ধরে। পুলিশ ও ইপি আ-রের লোকদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দিতে বলে। তাঁরা জবাব দেন যে, তাঁদের আই জি-র নির্দেশ ছাড়া তাঁরা তা কখনও করবেন না। সেনাবাহিনী তখন জোর করে অস্ত্র ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে। এবং সঙ্গে সঙ্গে লড়াই শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখনও কিন্তু গ্রাম ও ছোট ছোট শহরগুলির দিকে এগোবার চেষ্টা করেনি। তারা প্রধানত বড় বড় শহরেই ব্যস্ত। কলকারখানা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে সেনাবাহিনী রয়েছে।

শুক্রবার সীমান্তের কতকগুলি এলাকায় ওপারের কিছু বাঙালী যুবক এসে এপারের লোকজনদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র চায়, চায় গ্রেনেড ও বোমা। কিন্তু তাদের বিফল হয়েই ফিরতে হয়েছে। কারণ আঞ্চলিক অধিবাসীরা কেউই গ্রেনেড ও বোমা দিতে পারেন নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে দিন তিন-চার আগে থেকেই এই ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল তারও খবর পাওয়া যায়। তিন-দিন আগে টিক্কা খাঁ পূর্ব পাকিস্তানের আই জি-কে ডেকে বলেন, “আপনি সব এস-পি-কে নিদের্শ দিন তাঁরা যেন সেনাবাহিনীর লোকদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দেয়।” বাঙালী আই জি সেই নির্দেশ মানতে নারাজ হন। তখন তাঁকে বলা হয়, “আপনি পদত্যাগ করুন।” তাতেও অরাজী হন। আই জি এই খবর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে দেন। ফলে পুলিশ এবং ই পি আরের কিছু লোক আগে থেকেই অস্ত্র নিয়ে ব্যারাক থেকে সরে যায়। ফরমান দিলেন টিক্কা খাঁ-১৬ দফা আদেশ জারী করে। বাংলাদেশকে তাবে রাখতে, পদ্মা মেঘনা-বুড়ীগঙ্গার উত্তাল তরঙ্গকে বাঁধতে ১৬ দফা বিধিনিষেধ আরোপ করলেন টিক্কা খাঁ। সেই দফাগুলির মধ্যে আছে :–

এক :-পূর্ব পাকিস্তানের সব রকম রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা। ঘরে বাইরে বক্তৃতা, সমাবেশ, সভা, ধ্বনি, মিছিল বিলকুল বন্ধ রাখতে হবে। কেউ এসবে যোগ দিতে পারবে না।

দুই :-ফৌজী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া খবরের কাগজে, বেতারে, টিভিতে, প্রাচারপত্রে, পুস্তিকায় বা ভাষণে-কোন কিছু প্রকাশ করা চলবে না।

তিন :-পূর্ব পাকিস্তানের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে কিছুমাত্র সম্পর্ক আছে এমন কোন খবর বা মন্তব্য কোনভাবে প্রকাশ, প্রচার বা পাচার করা চলবে না। টেলিপ্রিন্টার ও বেতারবার্তা এই আওতার মধ্যে আসবে। সামরিক আইন প্রশাসক বা তাঁর অধস্তন অফিসার সেন্সর ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবেন। কোন কিছু প্রকাশে তাঁদের অনুমোদন অবশ্যই চাই।

চার :-সরকারী, বেসরকরী সব ক্ষেত্রের সব পর্যায়ের কর্মচারীদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিজ নিজ কর্মস্থলে হাজিরা দিতে হবে। এ আদেশ অমান্য করলে চাকরী যাবে এবং ফৌজী আদালতের সম্মুখীন হতে হবে। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনস এর কর্মীরা এই আদেশের আওতায় পড়বেন না।

পাঁচ :-পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

ছয় :-পূর্ব পাকিস্তানের কোন বাসিন্দা আগ্নেয়াস্ত্র, গুলী বা বিস্ফোরক রাখতে পারবে না। যাদের কাছে এসব আছে সেগুলি ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিকটতম থানায় জমা দিয়ে রসিদ নিতে হবে। কুটনীতিকরা ও ফৌজের লোকেরা এই হুকুমের আওতায় পড়বেন না।

সাত :-পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত ব্যাংক বন্ধ থাকবে। কেউ টাকা তুলতে বা লকার থেকে কিছু বার করতে পারবে না।

আট :-সশস্ত্র, আধা-সামরিক স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী সংগঠন ইত্যাদি ধরনের কোন তৎপরতা চলবে না।

নয় :-লাঠি, লোহার রড, রাম-দা বা অন্যকে আঘাত করা যায় এমন কোন কিছু কেউ রাখতে পারবে না।

দশ :-আগামী ৭২ ঘন্টায় কোন পাঁচজন লোক একসঙ্গে জমায়েত হতে পারবে না। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য ফৌজী শাসকদের হুকুম নিতে হবে।

এগারো :-সরকারী শিল্প ও অত্যাবশ্যক সংস্থাগুলিতে ধর্মঘট, লকআউট বা কোনরকম আন্দোলন চলবে না। পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্কেও এই আদেশ প্রযোজ্য।

বার :-পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত কোন বিদেশী কাউকে কোন ভাবে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারে না।

তেরো :-লুঠ, ঘেরাও,অগ্নিসংযোগ বা নাশকতা বরদাস্ত করা হবে না। আইনরক্ষা ও প্রয়োগের দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত আছে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারও সহ্য করা হবে না।

চৌদ্দ :-ফৌজী লোকেরা যে কোন বাড়ী, যে কোন জায়গা, দোকান তল্লাসী চালাতে পারবে।

পনের :-সমস্ত সাইক্লোস্টাইল বা রিপ্রোডাকসান মেসিন সামরিক শাসকদের হাতে জমা দিতে হবে।

ইয়াহিয়া খাঁ আর টিক্কা খাঁর বেতার ভাষণ ও সামরিক শাসন জারীর আদেশের জবাব দিল স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্র। ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বময়।

বেতার কেন্দ্রের ঘোষক বললেন-”স্বাধীন বাংলার ভাই বোনেরা, আসসালামু আলাইকুম। মহান জননায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সারা বাংলাদেশে আজ যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। চিরাচরিত প্রথায় বাংলার ধনসম্পদ লুণ্ঠন করবার ঘৃণ্য মানসিকতা বর্জন করতে না পেরে ওরা এখনও শোষণ অব্যাহত রাখতে চায়। ওরা তাই সকল ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে পৈশাচিকভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে সর্বপ্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে বদ্ধপরিকর। সমগ্র বাংলাদেশ সহ সমগ্র পৃথিবী আজ স্তম্ভিত। সামরিক শক্তির এহেন জঘন্য প্রয়োগের নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয় নেই। আজ সারা দেশ সামরিক শক্তির দাপটে এবং নারকীয় হত্যাকাণ্ডে ক্ষত-বিক্ষত। স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী জনসাধারণ তাদের উপর আঘাত হেনে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।….ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় স্বাধীন বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে হানাদার শত্রুদের দল প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় শত্রুবাহিনী শক্তি বাড়াবার উদ্দেশ্য অনবরত হেলিকপটার ব্যবহার করছে। কুমিল্লা থেকে সৈন্য এনে তারা তাদের শক্তিকে মজবুত করতে চাইছে। ই পি আর ও অন্যান্য শক্তি তাদের মোকাবিলা করার জন্য প্রচণ্ড ভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

তাই আজ মুক্তিপাগল কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র জনতার নিকট আহবান জানাই, শত্রুসেনাদের মোকাবিলায় তুমুল যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। হানাদারদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দিন। শত্রুসেনা শহরে প্রবেশ করতে চাইলে সুবিধামত স্থানে অবস্থান করে মরিচের গুঁড়া, সোডা এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ছুঁড়ে দিন। হাতবোমা নিক্ষেপ করুন। গ্রামের ভাইদের কাছে আমাদের আবেদন-দলে দলে শহর অভিমুখে অগ্রসর হোন এবং ক্যান্টনমেন্ট দখল করার কাজে লিপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করুন। শহরের ভাইদের কাছে আবেদন, আপনারা দলে দলে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে মুক্তি সেনাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সর্ব প্রকারে সাহায্য চালিয়ে আমাদের এই দুর্বার আন্দোলনকে সফলকাম করে তুলুন।

বন্ধুগণ, আজকে সারা দেশের মানুষ উৎকণ্ঠায় পাগলের মত হয়ে উঠেছে। আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি নিরপরাধ, নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের উপর ওরা অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। দেখামাত্র গুলী করছে, হাজার হাজার মানুষ আজ মৃত্যুবরণ করছে। এর নজির বিশ্বের ইতিহাসে নেই। তাই আমি সারা বিশ্ববাসীর কাছে আহবান জানাব, বিশেষভাবে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিকট আহবান জানাব, আপনারা এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখেও চুপ থাকবেন না। এগিয়ে আসুন এই সাড়ে সাত কোটি পূর্ব পাকিস্তানী ভাইদের বাঁচাবার জন্য। আপনারা আমাদের সাহায্য করার জন্য অগ্রসর হোন। বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানাই, আপনারা মানবতার খাতিরে, মানুষকে বাঁচাবার তাগিদে, বাংলার জনগণের মুক্তির জন্য অগ্রসর হোন। হে বিশ্বের অধিবাসী তোমরা দেখো, তোমরা শোন, কী ভাবে এই গণবিরোধী শক্তি, এই শোষক শ্রেণীর প্রতিভু, এই সাম্রাজ্যবাদীদের দালালরা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করবার উদ্দেশ্যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছে আহবান জানাই, আপনারা চুপ করে থাকবেন না, আসুন, আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করুন। বন্ধুগণ, আমি সারা বাংলার, স্বাধীন বাংলার জনগণের কাছে আহবান জানাব, বাঙালী ভাইয়েরা, আপনারা তুমুল সংগ্রামে নিজেদের শরিক করুন এবং হানাদার দুশমনদের খতম করুন। যে যেখানে যে অবস্থায় আছেন, যাঁর হাতে যে অস্ত্র আছে সেই অস্ত্র তুলে নিন। মা, বোন, বাপ, ভাইয়েরা বসে থাকবেন না। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ন এবং সুবিধামত স্থানে অবস্থান করে শত্রু-সেনাদের ঘায়েল করুন। মরাত্মকভাবে আঘাত হানুন, আঘাতের পর আঘাত হেনে বাংলাকে মুক্ত করুন। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়বে-সে দিন আর সুদূরপরাহত নয়। পরিশেষে আমি জনগণকে আহবান জানাব-এই দেশ, এই দেশের মহামান্য জননেতা, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের চোখে দেবতুল্য, বাংলার নয়নের মণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের নির্দেশে পরিচালিত হতে। অন্য কারো নির্দেশ বাঙালী কোনদিন বরদাস্ত করবে না এবং কোন ‘মার্শাল ল’ বাঙালীরা মানে না। আমি আহবান জানাব বাংলার প্রতিটি নরনারী সকলের কাছে, আপনারা ‘মার্শাল ল’ মানবেন না। মার্শালের কোন আইনই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা স্বাধীন বাংলার নাগরিক, স্বাধীন বাংলার মহান জননায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের নির্দেশ আমাদের শিরোধার্য। জয় বাংলা। স্বাধীন বাংলা। জয় বাংলা।”

৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০। প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানে আজ সাধারণ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হয়। ভোটাররা জাতীয় পরিষদের ৩০০ জন সদস্য নির্বাচন করবেন। এক নতুন সংবিধান রচনা করাই হবে পরিষদের প্রধান কাজ। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের কাছ থেকে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া খাঁ ক্ষমতাগ্রহণের পর আগের জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন। সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান একটামাত্র ইউনিট হিসেবে গণ্য হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে তার আসন সংখ্যা ছিল সমান। বরাবরের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে পদানত রাখবার জন্যে আইয়ুব খাঁর এই এক-ইউনিট পরিকল্পনা চালু হয়েছিল। এই এক-ইউনিট পরিকল্পনার ফলে পূর্ব পাকিস্তান পাঞ্জাবীদের প্রভুত্বাধীন হয়ে পড়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের এক অবাধ শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বায়ত্তশাসন ও পৃথক রাষ্ট্রগঠনের দাবী সোচ্চার হয়ে উঠেছিল এই শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে-যার মুখ্য প্রবক্তা হলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান। পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘুর্ণিঝড়ের বিপর্যয়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের ত্রাণকার্যে অবহেলাও পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক হবার দাবীকে জোরদার করে তোলে। শেখ মুজিবর রহমান বন্যাবিধবস্ত এলাকাগুলি পরিদর্শন করে এসে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বলেন, “স্বায়ত্তশাসনের জন্য বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্খাকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দশ লাখেরও বেশী লোক মারা গেছেন। শাসকদের মধ্যে যাঁরা ভাবছেন জনগণের দাবীকে অবহেলা করা চলে-তাঁদের সাবধান হবার সময় এসেছে। বাংলাদেশ জেগে উঠেছে। নির্বাচন যদি বানচাল করে না দেওয়া হয়-তবে বাংলাদেশ নির্বাচনে তার যোগ্য রায় দেবে। আর নির্বাচন যদি বানচাল করে দেওয়া হয়-তবে স্বাধীনভাবে বসবাস করবার জন্য বাংলাদেশ যাতে নিজের ভাগ্য নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে-তার জন্য দরকার হলে আরো দশ লাখ লোক প্রাণ দেবে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভূত গম উৎপন্ন হয়েছে ও ভাগ্যের পরিহাসে পূর্ব পাকিস্তানকে এই প্রথম বিদেশীদের কাছ থেকে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়েছে।” মুজিবর প্রশ্ন করেন-”ইসলাম ও জাতীয় সংহতির স্বয়ম্ভু প্রভুর দল-মৌলানা মাসুদী খান, কাইয়ুম খান, মিঞা মমতাজ দৌলতানা, নবাবজাদা নসরুল্লা খান এবং অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা আজ কোথায়? তাঁরা কি একটা দিনের জন্য এসে যারা বেঁচে রয়েছে তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারতেন না? আমাদের বর্তমান অভিজ্ঞতা একটা কথাই হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিচ্ছে। কথাটা হল, বাংলাদেশকে উপনিবেশ ও বাজার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিকের জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত। কেন্দ্রীয় সরকারের এবং তার আমলাদের হাতেই সব ক্ষমতা একচেটিয়া করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে চরম অবহেলা ও বিমাতৃসুলভ আচরণের জন্য আমি তাদেরই দায়ী করছি। বালাখানা গড়বার জন্য দুশো কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। অথচ দশ বছরেও সাইক্লোন নিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ কোটি টাকাও জোটেনা। তাই আমরা স্থিরনিশ্চিত, বাংলাদেশকে যদি রক্ষা করতে হয় তবে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে আর্থিক উন্নয়ন, বন্যানিয়ন্ত্রণ, গ্রামীণ পুনর্গঠন করা সম্ভব হবে। আমাদের আমরাই শাসন করব। যেসব সিদ্ধান্ত আমাদের প্রভাবিত করে, সে সব সিদ্ধান্ত আমরাই নেব। আমাদের টাকা আমরাই খরচ করব। আমরা আর পশ্চিম পাকিস্তানের আমলা, পুঁজিপতি ও সামন্ত প্রভুদের স্বার্থে কষ্টস্বীকার করব না। শক্তিশালী কেন্দ্র ঢের দেখলাম। জাতীয় সংহতির নামে আমরা অনেক অপরাধ করেছি।”

মুজিবর তাঁর এই বক্তৃতায় একবারও নিজের দেশকে পূর্ব পাকিস্তান বলে উল্লেখ করেননি, উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ বলে। মুজিবরের ছ’দফা দাবীর ভিত্তিতে নির্বাচন শেষ হল। নির্বাচনে জয়জয়কার হল মুজিবরের। ঢাকায় শতকরা পঁচানব্বই জন ভোট দিলেন। একত্রিশ হাজারের বেশী কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হল। মুজিবর রহমান নিজে দুটি কেন্দ্র থেকে জয়ী হলেন।

পাক জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে দলীয় অবস্থা দাঁড়ায় নিম্নরূপ :– আওয়ামী লীগ-১৫১, পিপলস পার্টি-৮১, মুসলিম লীগ (কাইয়ুম গোষ্ঠী)-৯, মুসলিম লীগ(কাউন্সিল)-৭, জমিয়ত- উল-উলেমা-ই-পাকিস্তান-৭, জমিয়ত-উল-উলেমা-ই-ইসলাম (হাজরভি গোষ্ঠী) -৭, জাতীয় আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি খাঁ গোষ্ঠী)-৫, জমাতে ইসলামী-৪, মুসলিম লীগ (কনভেনশন) -২, ডেমোক্রেটিক পার্টি-১ নির্দল-১৬। মোট ঘোষিত আসন-২৯০। বন্যাবিধবস্ত এলাকার ৯টি আসনের নির্বাচন পরে অনুষ্ঠিত হয় এবং সবকটি আসনেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।

৯ই ডিসেম্বর নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর মুজিবর রহমান এক সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেন, তাঁর দলের নির্বাচনী ইস্তাহারের উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানের নূতন জাতীয় পরিষদের সংবিধান তৈরী করতে হবে। তাঁর দলের বিরাট সাফল্যের অর্থ ছয় দফা কর্মসূচীর প্রতি জনসাধারণের প্রবল সমর্থন। মুজিবর রহমান বলেন দেশবাসীর কাছে তাঁর বাণী হল-

“একদিন না একদিন যাতে আমরা সত্যিকারের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারি তার জন্যে সমস্ত বাধাবিপত্তি কাটিয়ে দৃঢ়সংকল্প হয়ে এগিয়ে যেতে হবে।”

মুজিবর রহমানের বিখ্যাত ছয়দফা কর্মসূচী হল :-

(১) সংবিধানে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা করতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্র হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ভিত্তি। প্রাপ্তবয়স্কর ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত আইনসভাই হবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।

(২) যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অধীনে ২টি বিষয় থাকবে। প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র। অঙ্গরাজ্যগুলি অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।

(৩) আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সংবিধান রক্ষার জন্য অঙ্গরাজ্যগুলিকে আধা-সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাদল গঠন ও নিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে হবে।

আওয়ামী লীগ মনে করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন মেটাবার জন্য মূল ও ভারী শিল্প, ব্যাঙ্ক, বীমা কোম্পানী,সকল প্রকার পরিবহন এবং বৈদেশিক বানিজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত করা দরকার।

(৪) সকল দেশের প্রতি মৈত্রীর মনোভাব নিয়ে পাকিস্তানকে জোট-নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে।

(৫) পাকিস্তানের হয় অবাধে বিনিময়যোগ্য ২টি মুদ্রা প্রচলন করতে হবে না হয় সমগ্ৰ দেশের জন্য একটি মুদ্রা চালু হলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের মূলধন পাচার বন্ধ করার জন্য কার্যকরী সাংবিধানিক ব্যবস্থা রাখতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাঙ্ক রিজার্ভ রাখতে হবে।

সকল প্রকার কর ধার্যের একমাত্র অধিকার থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলির হাতে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কোন প্রকার কর ধার্য করতে পারবেন না যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের খরচ মেটাবার জন্য রাজ্যের সংগৃহীত করের একটা অংশ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। রাজ্যের সকল করের উপর একটা নির্দিষ্ট শতাংশ ধার্য করে ঐ টাকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মজুত তহবিল গড়ে তোলা হবে।

(৬) যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্যের বৈদেশিক বানিজ্যর একটি করে পৃথক হিসাব রাখতে হবে। বৈদেশিক বানিজ্য থেকে যে বিদেশী মুদ্রা অর্জিত হবে রাজ্যগুলি তার মালিক হবে। রাজ্যগুলি সমান হারে বা একটা নির্দিষ্ট হারে বিদেশী মুদ্রার একটা অংশ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বিদেশী মুদ্রার প্রয়োজন মেটাবে। কোনরূপ কর ছাড়াই দেশে উৎপন্ন দ্রব্যাদি বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে চলাচল করবে। অঙ্গরাজ্যগুলি যাতে বিদেশে বানিজ্য প্রতিনিধি নিয়োগ করে অঙ্গরাজ্যের স্বার্থে বানিজ্য সংক্রান্ত আলোচনা চালাতে পারে সংবিধানে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখতে হবে।

৯ই ডিসেম্বর। অনেকদিন পরে মুখ খুললেন ৮৯ বৎসর বয়স্ক বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী। মৌলানা ভাসানী নির্বাচনকে তামাসা মনে করেন। মৌলানা ভাসানী বললেন, “নির্বাচনে শেখ মুজিবরের আওয়ামী লীগ দলের এই প্রচণ্ড জয়লাভ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূলেই রায়।” মৌলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অথবা রাজ্যগুলির সার্বভৌম অধিকার সহ শিথিল ফেডারেশনের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, “স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ইরাণ, তুরস্ক ও আরবের ন্যায় পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবেন। পশ্চিমবঙ্গ যদি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে যোগ দিতে চায় তবে তাকেও স্বাগত জানানো হবে।”

মুজিবর রহমান দাবী জানালেন, ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসাতে হবে। ২৯শে ডিসেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁ সে দাবিই মেনে নিলেন। ইয়াহিয়া খাঁ বসলেন মুজিবরের সঙ্গে বৈঠকে। ঘোষনা করলেন, “মুজিবুর রহমানই পাকিস্তানের ভাবী প্রধান মন্ত্রী। ঢাকায় এলেন ভুট্টো সাহেবও। মুজিবুরকে ছয় দফা দাবী থেকে টলাবার অনেক চেষ্টা করলেন। হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন ভুট্টো সাহেব।

শুরু হল চক্র চক্রান্ত। কাশ্মীরে ধরা পড়ল ‘আলফাতা’ নামে গুপ্ত সংস্থা। সেই গুপ্ত সংস্থার কার্য পরিচালনার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে ভারত সরকার পাকিস্তান হাই-কমিশনের প্রথম সচিব জনাব ইকবাল রাঠোরকে ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেন। ‘আলফাতা’-যার অর্থ হল জয়। এই সংস্থা কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী জি এম সাদেক ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কাশ্মীর পুলিশ বেশ কিছুদিন আগেই এই ‘আলফাতা’র সন্ধান পায়। ৮ই জানুয়ারী এই সূত্রে গণফ্রন্ট নেতা আফজল বেগের এবং ৯ই জানুয়ারী শেখ আবদুল্লার জম্মু ও কাশ্মীরে প্রবেশ নিষেধ জারী করে আদেশ দেওয়া হয়। গণভোট ফ্রন্টের চারশত কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১২ই জানুয়ারী গণভোট ফ্রন্টকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। ১৮ই জানুয়ারী ‘আলফাতা’র ২২ জন গুপ্তচরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপরই ২৪শে জানুয়ারী এই ‘আলফাতা’ সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে জাফর ইকবাল রাঠোরকে বহিষ্কার করা হয়।

২৫শে জানুয়ারী। পশ্চিমে যখন ‘আলফাতা’ চক্র ধরা পড়েছে, পশ্চিমে যখন ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের দু’জন দূতাবাসের প্রধানকে বহিষ্কার করা হয়েছে-সেইদিন ২৫শে জানুয়ারী যশোরের কপোতাক্ষ নদী তীরে সাগরদাঁড়ী গ্রামে বসল ‘মধুমেলা’। সাড়ম্বরে পালিত হল মাইকেল মধূসুদন দত্তের ১৪৭তম জন্মোৎসব। পঞ্চাশ হাজার মানুষ এসেছিল সেই উৎসবে। সাগরদাঁড়িতে এসে সাহিত্যসাগর মধুসূদনের জন্মভূমিকে প্রণাম জানালেন ঢাকা- রাজশাহী-রংপুর-পাবনা-কুষ্টিয়া-খুলনা থেকে মানুষের দল। পূর্ব বাংলার মানুষ নব-ঈদ পালন করল সেদিন সাগরদাঁড়িতে। ভাষণ দিলেন ডক্টর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। সভাপতিত্ব করলেন কবি জসীমউদ্দীন। সকলের শ্রদ্ধা নিবেদনের ভাষা এক- “মধুসূদন বঙ্গসাহিত্যের দিক্‌পাল–মধুসূদন বাঙালীর মধুসূদন, পূর্ব বাংলার এক আদরের নাম। রবীন্দ্রনাথ–নজরুলের মত মধুসূদন বাংলার জাতীয় কবি।”

ভূট্টো সাহেব এসেছেন ঢাকায়। তিনদিন শেখ মুজিবুরের সঙ্গে আলোচনা করে ফিরে গেলেন ভূট্টো সাহেব। সেদিন ৩০শে জানুয়ারী। আর সেইদিন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমানকে দু’জন বিমান-দস্যু পিস্তলের মুখে বিমানের গতি পরিবর্তন করিয়ে জম্মু থেকে লাহোর নিয়ে যায়। বিমানে ছিল আটাশ জন যাত্রী, চারজন বিমানকর্মী। পাকিস্তান সরকার বিমান-দস্যুদ্বয়কে পাকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। বিমান-দস্যুদ্বয় হুমকি দেয়, “কাশ্মীরে আটক ৩৭ জন মুক্তিফ্রন্টের সদস্যকে মুক্তি দিতে হবে, অন্যথায় লাহোর বিমান ঘাটিতে তারা বিমানটি বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেবে।” জুলফিকার আলী ভুট্টো এখানেও হাজির! ১লা ফেব্রুয়ারী মিঃ ভুট্টো বিমান বন্দর গিয়ে একজন বিমান-দস্যু হাশিম কোরেশীর সঙ্গে কথা বললেন। হাশিম কোরেশী ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলে সাংবাদিকদের বললেন, “আমরা যা করার পরিকল্পনামত করেছি এবং এটি তার অতি অল্পই।” বিমান-বন্দরে এক বিরাট জনতা ধ্বনি তোলে, “বিমান-দস্যুদ্বয় দীর্ঘজীবী হোক, কাশ্মীর আমাদের, বিমানটি ভারতকে ফেরত দেওয়া হবে না।” এইদিন আলাদা একটি বিমানে বিমানযাত্রী ও বিমানকর্মীদের ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়। ভুট্টো সাহেব এই লাহোরেই ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর ভিত্তিতে রচিত কোন সংবিধান তিনি গ্রহণ করতে পারেন না। এই রকম সংবিধানের অর্থ হবে বাঙালী জাতীর জন্য স্বায়ত্তশাসিত একটা অঞ্চল।

২রা ফেব্রুয়ারী ভারতের ছিনতাই বিমানখানি লাহোর বিমান-বন্দরে বোমা ফাটিয়ে ধ্বংস করে দিল বিমান-দস্যুদুজন! বোমা দিয়ে বিমানটি ধ্বংস করে আরও দুটি বোমা হাতে করে দাঁড়িয়ে থাকে -যারা আগুন নেভাতে আসবে তাদেরও তারা বোমা মারবে।

ভারত সরকার যখন ছিনতাই বিমানখানি ফেরত দেবার জন্য এবং বিমান-দস্যুদ্বয়কে ভারতে ফেরত পাঠাবার জন্য দাবী জানালেন এবং পাকিস্তান সরকার যখন বিমানখানি ফেরত দেবার প্রশ্নে টালবাহানা করছিল, তখন দস্যুরা ভারতের বিমানখানা পুড়িয়ে দিয়ে ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যে অনভিপ্রেত তিক্ততার সৃষ্টি করল। ভারত সরকার ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমানের জন্য পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবী করলেন এবং এক আদেশে ভারতের উপর দিয়ে পাকিস্তানী বিমান চলাচল বন্ধ করে দিলেন। বিমান-দস্যুদের অন্যতম মোহাম্মদ হাশেম কোরেশীর বাবা মোহাম্মদ খালির কোরেশী শ্রীনগরে বলেন, “আমার ছেলেকে আমার সামনে এনে হত্যা করা হোক। মাতৃভূমির প্রতি তার এই বিশ্বাসঘাতকতার এটাই হল একমাত্র শাস্তি।” কিন্তু ওদিকে পাকিস্তানে বিমান -দস্যুদ্বয়কে ভারতে ফেরত পাঠানো নয়, ক্ষতিগ্রস্ত ভারতকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া নয়, বিমান-দস্যুদের নিয়ে পাল্টাবিজয় মিছিল বেরোলো লাহোরে। এক বিধ্বস্ত ভারতীয় বিমানের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরিবর্তে পাল্টা ভারতের কাছেই ক্ষতিপূরণ দাবী করা হল।

লাহোরে যখন পাকিস্তানী রাজনীতির এই ন্যক্কারজনক অভিনয় চলছে তখন ৫ই ফেব্রুয়ারী পূর্ববাংলার জননায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় বিমান ধ্বংসের তীব্র নিন্দা করে বললেন, “এই ঘটনার পশ্চাতে রয়েছে পাকিস্তানের শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরকে সাবোটাজ করার বিশেষ মতলব।”

‘ইত্তেফাক’ পত্রিকা এক দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে বিমান ধ্বংসের ঘটনাকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করল। ‘ইত্তেফাক’ বলল, এই অপরিণামদর্শী হঠকারিতার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপনের ভাষা আমাদের নেই। আমাদের বিশ্বাস কোন সুস্থবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষই ইহার নিন্দা না করিয়া পারিবে না।

শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে ছিনতাই করা বিমানটি উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। মুজিবুর বলেন, “শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরকে সাবোটাজ করার মতলব নিয়ে কায়েমী স্বার্থবাদীরা চক্রান্ত করছে। এই ঘটনা প্রতিরোধের জন্য কর্তৃপক্ষ ত্বরিত ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন। জাতীয় জীবনের এই সংকট-সন্ধিক্ষণে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির দ্বারা ষড়যন্ত্রকারী ও অন্তর্ঘাতীদের স্বার্থ সিদ্ধি হতে পারে।”

ভুট্টো কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত ফরমান দিলেন। ভুট্টো বললেন, “এ ব্যাপারে পাকিস্তানের কোন দায়িত্বই নেই, কারণ ছিনতাইকারীরা কাশ্মীরের লোক, তারা ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। কাশ্মীরীরা আশ্রয়ের জন্য আবেদন না জানিয়েও পাকিস্তানে থাকতে পারে।”

১০ই ফেব্রুয়ারী ইসলামাবাদে একদল পাকিস্তানী দুষ্কৃতকারী ভারতীয় দূতাবাসের বাইরে পুলিশ পাহারা এড়িয়ে দূতাবাসের ভিতরে ঢুকে পড়ে। দূতাবাসের জানালা দরজা ভেঙে ফেলে আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেয়। বিমান ধ্বংসের ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা একটু থিতিয়ে আসতেই জনাব ভুট্টো তাঁর তুণ থেকে নতুন শর নিক্ষেপ করলেন- “১৩ই ফেব্রুয়ারী ইয়াহিয়া খাঁ ঘোষণা করলেন ৩রা মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে।” ১৪ই ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসল। এই বৈঠকে ঘোষণা করা হয় যে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতেই পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করতে হবে।

পাকিস্তানের ৭ কোটি মানুষ এই দাবীর পিছনে আছে। মুজিবুর রহমান বলেন, তাঁরা ইতিমধ্যে একটা খসড়া সংবিধান রচনা করেছেন, ২৭শে ফেব্রুয়ারী এই খসড়ার চুড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে। তিনি কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেন, “অসামরিক প্রশাসন চালুকরার পথে বাধা দানের চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা আগুন নিয়ে খেলা করার সামিল।”

সেই আগুন নিয়ে খেলাই শুরু করলেন জনাব ভুট্টো। পেশোয়ারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মুজিবের দাবীর জবাব দিয়ে ভুট্টো বললেন, মুজিবুর ৬ দফা দাবীর ব্যাপারে আপোস না করলে, জনাব ভুট্টো জাতীয় পরিষদের বৈঠকে বসবেন না। ভুট্টো সাহেবকে জাতীয় পরিষদের বৈঠকের মূল্য হিসাবে আওয়ামী লীগকে ৬ দফা দাবী ছাড়তে হবে। ১৬ই ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের এক সভায় জনাব মুজিবুর রহমানকে দলের নেতা নির্বাচন করা হয়। আড়াই ঘন্টার বৈঠকে জনাব নজরুল ইসলাম আইন সভায় দলের সহকারী নেতা, জনাব কামরুজ্জামান সম্পাদক এবং জনাব ইউনুস খাঁ মুখ্য সচেতক নির্বাচিত হন।

৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। তার জোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ১৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করে পাকিস্তান আইন সভা ভবন নবরূপায়ণের কাজ চলছে। তিনশত লোক দিবারাত্র খাটছে। ৩রা মার্চ ইয়াহিয়া খাঁ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধন করবেন। ২৫শে ফেব্রুয়ারী আবার এক বিবৃতি দিলেন মুজিবুর রহমান। মুজিবুর রহমান বললেন, “পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষের উপর ঔপনিবেশিক শোষণ চালাচ্ছে। কেন্দ্রের হাতে বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিদেশী মুদ্রা বন্টনের ক্ষমতা থাকায় এখানকার সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের সেবায় লাগানো হচ্ছে। এর ফলে ওখানে পুঁজিপতি গড়ে তুলছেন মুনাফার পাহাড় আর বাঙালীরা ভিখারীতে পরিণত হচ্ছেন।” ২০শে ফেব্রুয়ারী মুজিবুরের নেতৃত্বে একটা মিছিল বেরুলো ঢাকা শহরে। জিন্ন এভেনিউতে মিছিল থেমে গেল। মিছিল থেকে দাবী উঠল– জিন্না এভেনিউ নয়, ‘সূর্য সেন’ এভেনিউ চাই।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার মাত্র ৩ দিন বাকী। ১লা মার্চ ভুট্টোর কাছে নতিস্বীকার করলেন ইয়াহিয়া খাঁ। করাচী থেকে এক বিবৃতিতে ইয়াহিয়া খাঁ বললেন, পাকিস্তানের দুই অংশের নেতাদের মধ্যে রাজনীতিগত বিরোধ দেখা দিয়েছে। এই বিরোধ অবসানের অবকাশ সৃষ্টির জন্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হল। এইদিন আর একটি ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অ্যাডমিরাল এস এম আহসানকে গদীচ্যূত করা হয়। অ্যাডমিরাল আহসান কয়েক দিন আগে মুজিবুরের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন।

১লা মার্চ সোমবার ইয়াহিয়া খাঁর ঘোষণা ঢাকায় পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা শহর, সারা পূর্ববঙ্গ। ৩রা মার্চ দেওয়া হয় বাংলা বন্ধের ডাক। মুজিবুর রহমান সংগ্রামে প্রস্তুত হবার আহবান জানিয়ে বলেন, “আগামী রবিবার এক জনসভায় ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।” প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজার হাজার ছাত্র হাতে লাঠি সোঁটা অস্ত্র নিয়ে রাজপথে বেরিয়ে আসে। বিক্ষোভকারীদের দমন করতে পুলিশ কয়েক বার লাঠি চালনা করে। পূর্ববাংলার পথে পথে ধবনি উঠল–জয় বাংলার জয়। ২রা মার্চ মঙ্গলবার ঢাকায় সর্বাত্মক ধর্মঘট। ঢাকা শহরে বিক্ষোভ মিছিলে দশ হাজার ছাত্র রাজপথে বেরিয়ে পড়ল। রাজপথে বেরিয়ে পড়েছে শ্রমিক, আইনজীবী, সরকারী কর্মচারীরা। বিক্ষোভকারীদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা “জয় বাংলা” “স্বাধীন বাংলা”। ঢাকা বিমান-বন্দরের কাছে জনতার উপর পুলিশ গুলী বর্ষণ করে। ঘটনাস্থলে ১জন নিহত হয়।

সোমবার ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবী করার ঘোষণার আগেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনী আসতে শুরু করে। মুজিবুর ঘোষণা করলেন,

“ষড়যন্ত্রকারীরা যদি মনে করেন তাঁরা আবার তাঁদের ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করতে পারেন তা হলে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।” ঢাকা শহরের ছাত্ররা রাস্তার উপর বালি দিয়ে একটা স্তুপ তৈরী করে সেই স্তূপের উপর সাদা খড়ি দিয়ে লিখে দেয় এই হল ভুট্টোর কবর। ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক গোলটেবিল বৈঠক আহবান করেছিলেন। মুজিবুর রহমান সেই গোলটেবিলে যোগদানের আহবান প্রত্যাখ্যান করলেন। কারফিউ জারী করা হয়েছে ঢাকা, রংপুর, সিলেটে। হাজার হাজার মানুষ কারফিউর নির্দেশ অমান্য করে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। বিক্ষোভকারীরা ফৌজী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ফৌজী শাসন। তাদের হাতে বন্দুক। ক্রদ্ধ বিক্ষোভকারীদের দমনের নামে নির্মম হত্যা শুরু হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়। মুজিবুর রহমান রবিবার ৭ই মার্চ ঢাকায় রাজনৈতিক নেতাদের গোলটেবিল বৈঠক বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বলেছেন–বন্দুক উঁচিয়ে এই গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানান হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য স্থানে নিরস্ত্র মানুষকে নির্মম ও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এই হত্যাকারীদের সঙ্গে কোন বৈঠক হতে পারে না।

৪ঠা মার্চ বৃহস্পতিবার ঢাকা শহরে দুটি বৃহৎ জনসভা অনুষ্ঠিত হল–একটি শহীদ মিনারে, অপরটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে। কারফিউর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। খুলনা, রংপুর এবং অন্যান্য শহরেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নিহতদের সংখ্যা কয়েক শতে পৌঁছেছে। বি বি সি খবর দিচ্ছেন, সাধারণ ধর্মঘটে পূর্ব পাকিস্তান অচল। মুজিবুর জানিয়েছেন–গণ বিক্ষোভে উদ্বেলিত ঢাকা ও তার আশেপাশে মিলিটারীর গুলীতে মারা গেছেন ৩০০ জন। আর একটি খবরে বলা হয়েছে, পাক বর্বর সেনাবাহিনী মেশিনগান চালিয়ে দু হাজার মানুষকে খুন করেছে। মুজিবুর রহমান বুধবার বললেন, সেনাবাহিনী দখলকারী সৈন্যদের মত নিরস্ত্র মানুষের উপর মেশিনগানের গুলী চালাচ্ছে। বুধবার বিক্ষোভ প্রদর্শন কালে বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তানের একটি জাতীয় পতাকা ও জিন্নার একটি প্রতিকৃতি পুড়িয়ে দেয়। বুধবার প্রথমেই পাকিস্তানী জাতীয় পাতাকার পরিবর্তে ‘জয়বাংলা’ পতাকা উড়ে। সেনা চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে ঢাকার রাজপথে ব্যারিকেড রচনা শুরু হয়। ২০০ গজ অন্তর রাবিশ ও ইটপাটকেল ফেলে রাজপথ অবরোধ করা হয়।

পূর্ব বাংলায় নতুন ধ্বনি উঠেছে–‘জয় বাংলা’। কভারে মুজিবুরের ছবি দিয়ে জয় বাংলা গান বেরিয়েছে। গানটি পরিচালনা করেছেন আজাদ রহমান। এক বৃহত্তর সংগ্রামে বাঙালীকে উজ্জীবিত করা, দেশাত্মবোধের মন্ত্রে জাতিকে দীক্ষিত করাই এই গানের উদ্দেশ্য।

“পুবের আকাশে সূর্য উঠেছে
আলোকে আলোকময়
জয় জয় জয় জয়–জয়বাংলা।
ঘুম পাড়ানী মাসী পিসী
বেরিয়ে এস বলে
বর্গী যদি আসে তাদের
তাড়িয়ে দিতে হবেই।
তাড়িয়ে দেব, তাড়িয়ে দেব–
বুলবুলিকে ধান দেব
আদর সোহাগ করে
সেই তো আমার খাজনা দেওয়া
ভালবাসায় ভরে।
দস্যুগুলো পালিয়ে গেছে
আঁধার হয়েছে ক্ষয়
জয় বাংলা, জয় জয় জয় জয়।”

জয় বাংলা! জয় বাংলা! গত ২৩শে মার্চ মুজিবুর রহমান নিজের বাড়িতে জয় বাংলা পতাকা তুলেছেন। সেই পতাকা ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। জয় বাংলার নাম বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মুখে।

মুজিবুরের ঐতিহাসিক ঘোষণার মাত্র একদিন বাকী। পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁ এক পা পিছু হটলেন। ইয়াহিয়া খাঁ ঘোষণা করলেন, ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের বৈঠক বসবে। ইয়াহিয়া খাঁ তাঁর ঘোষণায় সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে ৫টি মৌলিক নীতির উল্লেখ করলেন। তার মধ্যে ১টি হল পাকিস্তানের আঞ্চলিক সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুরের উদ্দেশ্যে হুমকি দিয়ে বলেন, মুজিবুর তাঁর আচরণ সংযত’ না করলে পরিণাম খারাপ হবে। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার জন্য তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকে দায়ী করেন। তিনি স্থির করেছেন, রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসাবে তিনি দেশের সংহতি বিপর্যস্থ হতে দেবেন না।

১৩ মিনিট বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খাঁ যখন পাক জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহবান করলেন, সেই সঙ্গে অনেক হুমকি, ধমক ও সতর্কবাণী শোনালেন মুজিবুরকে, তখন বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত দল ও নেতারা এসে সমবেত হয়েছেন মুজিবের পিছনে। গত ৬ দিনের ফৌজীবাহিনীর নির্মম অত্যাচার ও হত্যালীলা এক করে দিয়েছে সকলকে। মৌলানা ভাসানী এসে দাঁড়িয়েছেন মুজিবের পাশে। পি ডি পি নেতা নূরুল আমীন–যিনি নির্বাচনের আগে মুজিবের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন–তিনিও মুজিবের পাশে। সারা পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষ আজ এককাট্টা। পূর্ব পাকিস্তানের রেডিওর সুর ও আওয়াজ বদলে গেছে। পাকিস্তান রেডিওতে ভারতকে আর হিন্দুস্থান বলে উল্লেখ করা হচ্ছে না–ভারতকে ভারত বলেই উল্লেখ করা হচ্ছে। বেতার কেন্দ্রগুলিতে আর তত বেশী ধর্মীয় ও ইসলামী সঙ্গীত শোনা যাচ্ছে না। এখন আর রেডিও পাকিস্তান ঢাকা নয়, এখন “ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি”। গতানুগতিক অনুষ্ঠানসূচী নয়; বেতারে শোনা গেল দেশাত্মবোধক ও সামরিক সঙ্গীত। শেষ গান সমবেত কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”

গান আরও গান।

“সাত আকাশের আলো দিয়ে মোর
সূর্যতোরণ গড়েছি।”

অথবা “স্বপ্ন রঙিন ভোরের আকাশে
নবীন সূর্য জেগেছে
দীপ্ত প্রাণের দখিণ দুয়ারে
তোমার তূর্য বেজেছে।”

কখনও—”নব জীবনের দীপ্ত আকাশ তলে।”

কখনও–”আঁধার যখন আকাশ ছেয়ে এল
বাজল গুরু গুরু……
তখন আমার যাত্রা হল শুরু।”

কখনও—”আঁধারের পথ পার হয়ে
আমরা এলেম নতুন দিনের প্রান্তে”

কখনও—”চল সম্মুখে হব আগুয়ান
হাতে আছে হাতিয়ার
আজ মানবোনা কোন বাধা
সংশয় সব গুরুভার।”

কখনও—”এক রাশ নীলাকাশ দিগন্তে ঘূর্ণি
একটি কপোত সেথা উড়ছে?”

কখনও—”ভেঙ্গে গেছে, ভেঙ্গে দাও আঁধারের কারা”

মুজিবুর বৈঠকে বসলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও সংগ্রাম সাথীদের নিয়ে। মাত্র একদিন পরে (৭ই মার্চ) মুজিবুর তাঁর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন। বৈঠক বসল মুজিবুর রহমানের বাড়ীতে। বৈঠকে বসলেন খোন্দকার মুস্তাক আহমদ, তাজউদ্দিন আহমদ; সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলি, আলহাজ্ব জহিরউদ্দিন। বৈঠক চলাকালেই খবর এল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের নূতন গভর্ণর নিযুক্ত করেছেন।

টিক্কা খান। ১৯৬৩ সাল। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিরা আর একবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। জোয়ারের রুটি আর দেশী বন্দুক সম্বল করে রুখে দাঁড়ালো আয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে। আয়ূব খাঁ বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ৭ হাজার বর্গমাইল জুড়ে ‘সারভনদ্ রোড’ তৈরী করতে ‘সারভনদ্ রোড’ তৈরী না হলে দুর্ধর্ষ বেলুচদের আয়ুব খান কোনক্রমেই বাগে আনতে পার- ছিলেন না। গ্রামে যদি মিলিটারী ঢুকতে না পারে তাহলে মিলিটারী শাসন কায়েম হবে কি করে? তাই ‘সারভনদ্ রোড’ তৈরীতে আয়ুব খাঁর বড্ড বেশী গরজ়। কিন্তু বাধা দিল বেলুচরা। তারপর বেলুচিস্তানের গেরুয়া রঙের পাহাড়ী মাটি বেলুচদের রক্তে লাল হয়ে গেল। আর এই রক্তের বন্যা যিনি বইয়েছিলেন তিনি হলেন টিক্কা খান। বিদ্রোহী বেলুচরা ঘোষণা করল- “আমাদের বুকের এক ফোঁটা রক্ত থাকতে ‘সারভনদ্ রোড’ তৈরী করতে দেব না।’

সেদিন নভেম্বর মাস ১৯৬৩ সাল। যে সরকারী ইঞ্জিনিয়াররা ‘সারভনদ্ রোড’ তৈরী করতে এসেছিল তাদের ছাউনি আক্রমণ করল বিক্ষুদ্ধ বেলুচরা। বেলুচদের নেতা গ্রাম্য যুবক ‘সানঝের খেল’। যন্ত্রপাতি ফেলে ইঞ্জিনিয়াররা পালিয়ে গেল ছাউনি থেকে। আয়ুব সরকার অনেক আগেই বেলুচ নেতা আতাউল্লাহ খান মোঙ্গল, আবদুল বার্কি, আবদুস সামাদ খাঁকে কারাগারে আটক করেছিল। ইঞ্জিনিয়ারদের তাঁবু আক্রান্ত হবার পরদিন পুলিশ শুরু করল অত্যাচার। নিরীহ গ্রামবাসীদের ধরে নিয়ে গেল; মেয়েদের চুলের ঝুঁটি ধরে মাটিতে আছড়ে ফেলল, ঘর দরজা ভেঙ্গে তছনছ করে দিল। কিন্তু সেইদিন রাত্রেই পালটা আক্রমণ শুরু হল গ্রামবাসীর। এবার আক্রমণের লক্ষ্য হল থানা পুলিশ ফাঁড়ি।

থানা পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে দখল করে নিল বন্দুক গোলা বারুদ। শুরু হয়ে গেল গ্রামে গ্রামে লড়াই। ক্ষিপ্ত আয়ুব বেলুচদের ঠান্ডা করতে সৈন্য বাহিনী পাঠাতে শুরু করলেন।

১৯৬৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঈদের দিন ‘কারান’ উপত্যকায় ঈদের জমায়েতে হাজার হাজার ছেলে মেয়ে বুড়ো উৎসবের পোশাকে এসেছে। নামাজ শুরু হয়েছে। হঠাৎ আকাশে শোনা গেল বিমানের গর্জন। তারপর প্লেনগুলো ডাইভ দিয়ে নেমে এল সেখানে যেখানে নামাজ পড়ছিল ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। তারপরেই বুম বুম্ আওয়াজ, আর্ত চিৎকার, মৃতদেহ আর মৃতদেহ। কতজনের হাত, পা, মাথা উড়ে গেছে। রক্তের স্রোত বইছে। সেই উৎসব শেষ হল না; উৎসব শেষে যে আহারের আয়োজন করা হয়েছিল সে সব খাদ্য রক্তে ভেসে গেছে। মৃতদেহ সামনে নিয়ে বেলুচরা প্রতিজ্ঞা নিল–এর বদলা তারা নেবেই।

আবার বোমা বর্ষণ ২৩শে ফেব্রুয়ারী ‘সারুনায়’ একটা কাফেলার উপর। নিরীহ নিরস্ত্র কাফেলার মানুষগুলোকে বোমা ফেলে মারা হল। ২৬শে ফেব্রুয়ারী একই ঘটনা ঘটল দারামুলাতে। কিন্তু আর নয়, বন্দুক হাতে রুখে দাঁড়ালো। পাহাড়ের আড়ালে আড়ালে স্বেচ্ছাযোদ্ধাদের ঘাঁটি তৈরী হল। হালজিতে বোমা ফেলতে এসেছিল দুটো স্যাবার জেট। সানঝের খেল পাহাড়ের আড়াল থেকে গুলী করল সেই বিমান লক্ষ্য করে, আগুন ধরে গেল বিমানে। তারপর মাটিতে পড়ে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস হয়ে গেল বিমানখানি।

পরদিন আরও একখানা বিমান ও হেলিকপটার গুলীবিদ্ধ হয়ে ধ্বংস হল। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল আয়ুবশাহী। ১৫ লক্ষ বেলুচকে শায়েস্তা করতে এগিয়ে এল পাকিস্তান সেনা বাহিনীর অষ্টম ডিভিশনের সৈন্যরা। তাদের হাতে আমেরিকান স্টেনগান, রাইফেল, এম এন গান, লাইট মেশিন গান। রেশন বন্ধ করে দেওয়া হল। বেলুচদের উপর আক্রমণ শুরু হল আকাশ পথে। আক্রমণ শুরু হল পথে পথে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই অষ্টম ডিভিশনের পরিচালনা ভার নিয়ে যিনি বেলুচ নিধনে নেতৃত্ব করলেন তিনি হলেন মেজর জেনারেল টিক্কা খান। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত টিক্কা খান চলল। বেলুচ স্বাধীনতা সংগ্রামী–অগণিত বালক, যুবক, শত শহীদের রক্তে লাল হল বেলুচিস্তানের ভূমি। এই অত্যাচারের বর্ণনা রয়েছে কল্হন লিখিত “বিক্ষুব্ধ পাকিস্তান” গ্রন্থে। জনৈক বেলুচ সাংবাদিকের বিবরণ তুলে ধরছি।

ওয়াদ-এ বৃদ্ধ সানাউল্লাহ খান সৈন্যদের বাধা দিতে গিয়েছিলেন বলে চোখের সামনে তার ১৩ বছরের মেয়ে গুলনারের উপর ৫ জন সৈন্য একের পর এক পাশবিক অত্যাচার করেছে। একজন দাঁত দিয়ে কেটে দিয়েছে গালের মাংস, নখের আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত করেছে বুক। আর বুকে পিঠে বেয়নেট ধরে সানাউল্লাহ খান মোঙ্গলকে তাই দেখতে বাধ্য করেছে তারা। বাপ হয়ে মেয়ের উপর সেই পাশবিক অত্যাচারের দৃশ্য আর সে দেখতে পারেনি। মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেছে। জ্ঞান হয়ে দেখেছে তাঁরই পাশে পড়ে আছে তাঁর প্রাণপুত্তলি গুলনারের রক্তাক্ত নিষ্প্রাণ দেহ।

আমাদের গ্রামের মোহাম্মদ খানের নববিবাহিতা তরুণী বধু সুফিয়ার উপর সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বলাৎকার করেছে। স্তন থেকে মাংস খুবলে নিয়েছে হিংস্র কামাবেগে। এতেও বর্বর সৈনিকদের তৃপ্তি হয়নি, যাবার সময় পৈশাচিক হাসি হাসতে হাসতে বেয়নেট দিয়ে নারীদেহের গুহ্যস্থান খুঁচিয়ে দিয়ে গেছে–পাশবিক উল্লাসে রক্তাক্ত করেছে সেই দেহ। অভাগী মরে বেঁচেছে

অজ্ঞাতেই আমার মুখ দিয়ে বেরুলো, হরিবল্! উঃ! এ রকম নির্যাতন যে এ যুগের কোন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের হতে পারে ভাবতেই পারি না

দেখলাম, রাগে উত্তেজনায় আহম্মদ জাই এর চোখ থেকে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। দৃঢ় আঙ্গুলের চাপে গুড়িয়ে ফেলল হাতের সিগারেট। বলল, এ আর কি হরিবল্? আরও কত রোমহর্ষক পৈশাচিক নির্যাতন হয়েছে। বলে চুপ করল একটু, তাকালো বাইরে। মাথার উপর ট্রাইডেন্ট্ ১-ই ঘুরপাক খাচ্ছে ল্যানডিং-এর জন্য। বোধ হয় কনট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পেয়ে গেছে। নামবে এক্ষুণি। আহম্মদ জাই সম্ভবত কিছু বলতে চেষ্টা করল। ট্রাইডেটের প্রচন্ড গর্জনে ভালো শুনতে পেলাম না।

মুহূর্তে বিমানটি চলে গেল রানওয়ের উত্তর সীমার শেষ প্রান্তে। ক্রমশ নিচু হতে হতে ল্যান্ড করল সেটি। দ্রুত এগিয়ে আসছে টারমিনাল বিল্ডিং এর দিকে। নিচে সিঁড়ি নিয়ে তৈরী হয়েছে বিমানঘাঁটির কর্মীরা। চেকিং-এর পর এটাই আবার পাড়ি দেবে করাচী। এ প্লেনেই আহমদ জাই যাবে। কী বিস্ময়কর উন্নতি। কতো দ্রুত কনভেয়ার আর ডাকোটার যুগ ছেড়ে পাকিস্তান ট্রাইডেনট আর বোয়িং এর যুগে পৌঁছে গেছে। অথচ পাখতুন, বেলুচ ও বাংলার অবস্থার কোন উন্নতিই হয় নি। বরং স্বাধীনতা লাভের পূর্ব অবস্থা থেকে আরও খারাপ হয়েছে, হচ্ছে। দিন দিন কোটি কোটি দেশবাসীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

আহামদ জাই আবার শুরু করল, গ্রাম ছেঁকে সব যুবকদের এনে হাজির করল সৈন্যরা। ছেলে, বুড়ো, মেয়েদের ভিড় থেকে গায়ে গতরে বাড়ন্ত কয়েকজন কিশোরকেও রাইফেলের কুঁদোর ঘা মেরে আমাদের সামনে এনে দাঁড় করাল, বুড়োদেরও অধিকাংশবাদ গেল না। ভেড়ার পালের মত গায়ে গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে খোলা প্রান্তরে। মাথার উপর সূর্যটা আগুন ছড়াচ্ছে। আমাদের একজন পানি চাইতে গেল, পেল রাইফেলের কুঁদোর ঘা।

সানঝের খেলকে যখন নিয়ে এল, পরীবানুও উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসছিল পিছু পিছু। একজন মিলিটারী অফিসার তার চুলের গোছা মুঠিতে ধরে টেনে হেঁচড়ে ফেলে দিয়ে এল বাড়ীর দরজায়। অফিসারটি ফিরে এল জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে একমুখ থুথু ছিটিয়ে দিল সনঝের খেল তার গায়ে। পর মুহূর্তে রাইফেলের ঘায়ে মুখ থুবড়ে পড়ল সে মাটিতে। মিলিটারী অফিসারটি থুথু মুছে বুটসুদ্ধ পা দিয়ে সানঝের খেলকে দাঁড় করালো আমাদের সঙ্গে- -ফাইলে।

তার পর নিয়ে চলল কুইলি ক্যাম্পে। দীর্ঘ ফাইল। হেঁটে চলেছি উত্তপ্ত পাহাড়ী পথে, সূর্যের প্রচন্ড তাপে পাহাড়গুলো পর্যন্ত ঝলসে গেছে। পানি পিপাসায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু বলার উপায় নেই। ‘কুইলি’তে হাজার হাজার ছেলে বুড়ো যুবককে গোরু বাছুরের মতো গাদাগাদি করে অভুক্ত রেখে দিল। বেছে বেছে শ খানেক যুবককে সেখান থেকে নিয়ে গেল মিলিটারী কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।

কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালাবার জন্য কতকগুলো ঘর তৈরী করা হয়েছিল। সেই অমানুষিক নির্যাতনের কথা শুনলে তোমরা শিউরে উঠবে, শিউরে উঠবে সারা বিশ্বের মানুষ। সে নৃশংস নির্যাতন আলজেরিয়ার ঘটনাকেও বুঝি হার মানায়।

আহমদ জাই একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগল, শত্রু দেশের সঙ্গে আমাদের যোগসাজস রয়েছে–এই মিথ্যা স্টেটমেন্ট আদায়ের জন্য দিনের পর দিন আমাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে সেখানে। হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে পায়ের নীচে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। যন্ত্রণায় চিৎকার টুকু পর্যন্ত করবার উপায় ছিলনা। মুখে কাপড় ঠাসা

একদিন একজন মিলিটারী অফিসার এসে আমার সামনেই সানঝের খেলের গালে একটা প্রচন্ড চড় কষিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বল তোরা কোথা থেকে অস্ত্র পেয়েছিস।’ সানঝের খেলের জবাব : ‘কোনখান থেকেই অস্ত্র পাইনি। কতো আর অত্যাচার করবে আমাদের উপর। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন থামবে না’, থামবে না। “সানঝের খেলের হাত পা বাঁধা ছিল, বসে ছিল সে। একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে অফিসারটি বুটের লাথিতে তাকে শুইয়ে দিল মাটিতে। তারপর বলল, ‘দেখি শায়েস্তা হয় কিনা।’ একজন সৈনিককে ডেকে নির্দেশ দিল, একে হট্ ওয়াটারে চাপাও। আমার সামনে দিয়ে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে অদূরের টর্চার চেম্বার এর দিকে নিয়ে গেল তাকে। আমাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে সানঝের খেলকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে সানঝের খেলকে ঝুলানো হলো। একটু বাদেই একটা বড়ো বালতি করে গরম জল নিয়ে এল দুজন সৈনিক। বালতির ভিতর লাঠি ঢুকিয়ে দুজনে ধরাধরি করে নিয়ে এসেছে বালতিটা। ধোঁয়া উঠছে বালতি থেকে। সানঝের খেলের মাথার ঠিক নিচেই বালতিটা রাখল। ইঞ্চি চার পাঁচ নিচেই রয়েছে বালতিটা। সেই অফিসারটি ক্রুর স্বরে ফের বলল, এখনো বল্ তোরা কোন দেশ থেকে অস্ত্র পেয়েছিস্? আফগানিস্থান? ভারত?’

সানঝের খেল চুপ করে রইল। অফিসারটি ক্ষিপ্ত হয়ে এক মগ গরম জল ছিটিয়ে দিল তার মুখে। একটা বিকট আর্ত চিৎকার দিয়ে উঠল সানঝের খেল অসহ্য যন্ত্রণায়। সারা মুখ তার ঝলসে গেছে। ‘এখনো বলবি না!’ অফিসারটির দাঁতে দাঁত চাপা ক্রুদ্ধ স্বর শোনা গেল। উত্তরে সানঝের খেলের মুখ থেকে কোন মতে বেরুলো : ‘কোথাও থেকে নয়।’

“তবে রে। মজা দেখাচ্ছি, দ্যাখ।’ বলে অফিসারটি একটি সৈন্যকে কী নির্দেশ দিল। সৈন্যটি উপরে উঠে পায়ের বাঁধা দড়িটা ছেড়ে দিল অনেকখানি। প্রচন্ড তপ্ত জলে সানঝের খেলের মাথাটা ডুবে গেল। চোখের মণি দুটো গলে এসেছে। জ্ঞান হারালাম আমি।

পরদিন আর সানঝের খেলকে দেখতে পেলাম না। দেখতে পাব না জানি। তার মৃতদেহটি কোথাও টেনে নিয়ে ফেলে দিয়েছে হয়তো। সানঝের খেলের মতো এমনি কত দেশ প্রেমিক যুবক যে প্রাণ হারিয়েছে তারও সংখ্যা পরিসংখ্যা নেই। কতো সুফিয়া, গুলনার যে ইজ্জত হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সানঝের খেলের জায়গাটা আজ ফাঁকা। কালও ছিল সে। আজ নেই। পরীবানু কি জানে সে কথা? ওদের বিয়ে হল না। এ জীবনে ওরা আর ঘর বাঁধতে পারল না। এমনি কত পরীবানুর ঘর বাঁধার স্বপ্ন যে ভেঙেছে জালিম আয়ুব, তোমরা তার কতটুকুইবা জানো? রোজ রোজ যে নির্যাতনের আরো কত নৃশংস উপায় বের করত! বেয়নেট দিয়ে উপড়ে নিয়েছে কারও চোখ, খুবলে নিয়েছে কারও শরীরের মাংস। দিনের পর দিন সেই সব হতভাগ্যদের আর্ত চীৎকারে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটা থরথরিয়ে কেঁপে উঠত। রাতের নৈঃশব্দ সেই চিৎকারে খান খান হয়ে যেত। সানাউল্লাহ খান মোঙ্গল নামে এক যুবকের অন্ডকোষ দুই রাইফেলের মাঝে চেপে পিষে দিল একদিন। পরে শুনেছি, গাঁয়ে ফিরে সে বেচারী আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া তার যে আর কোন উপায় ছিল না। সানঝের খেল-পরীবানুর মতো ওরও বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ভাবী পত্নী রওশনের কাছে সে কোন লজ্জায় মুখ দেখাবে। কী বলবে তাকে। তাই আত্মহত্যা করে সেই দুঃসহ লজ্জা আর গ্লানির হাত থেকে মুক্তি নিয়েছে সে।

কিন্তু এই বর্বরদের কাহিনী শুধুই কি মাত্র বেলুচিস্থানের দেওয়ালে পাহাড়ের গায়ে রক্ততে রক্ততে লেখা আছে। না, এর চেয়ে অনেক মর্মান্তিক করুণ কাহিনী লেখা রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের শহরে গ্রামে, নগরে। অগণিত মানুষের উপর বর্বর অত্যাচারের কাহিনী। সে কাহিনী ম্লান করে দেয় বিশ্বের যে কোন নৃশংস অত্যাচারের কাহিনীকে। এই অত্যাচার শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই। ১৯৫০ সালে ২৪শে এপ্রিল রাজশাহী জেলে পুলিশের নির্মম গুলী বর্ষণে যাঁদের বুক বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তাঁরা ছিলেন কৃষক নেতা কম্পরাঙ সিং, তরুণ ছাত্র আনোয়ার হোসেন, শ্রমিক নেতা দেলওয়ার হোসেন, প্রখ্যাত দেশভক্ত সুধীন ধর, সুখেন ভট্টাচার্য, হানিফ শেখ ও বিজন সেন। কিন্তু পরীবানু–সে কি শুধু বেলুচিস্তানে? বাংলাদেশের অনেক মা বোন পরীবানুর চেয়ে মর্মান্তিক নির্যাতন অত্যাচারের স্বাক্ষর রেখেছেন।

১৯৫০ সালের শুরুতেই ময়মনসিং জেলার হাজং এলাকায় “টঙ্ক’ প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল কৃষকরা। জনপ্রিয় জননেতা মণি সিং এর নেতৃত্বে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল হাজং এর কৃষকরা। মণি সিং এর পাশে এসে দাঁড়ালেন সিলেটের খোকা রায়, অনিল মুখার্জি, চিত্ত দাশগুপ্ত, খুলনার বিষ্ণু চ্যাটার্জি, বরিশালের অমিয় দাসগুপ্ত, রংপুরের মণি বিষ্ণু সেন, দিনাজপুরের হাজি মোহাম্মদ দানেশ। মুসলিম লীগ সরকার নিষ্ঠুর নির্মম অত্যাচারে দমন করল এই কৃষক বিদ্ৰোহকে।

একই বিদ্রোহ দেখা দিল রাজশাহী জেলায়। সাঁওতালদের নিয়ে কৃষক সংগঠন করেছিলেন শ্রীমতী ইলা মিত্র। ১৯৫০ সালের ৭ই জানুয়ারী রাজশাহী জেলার রাহানপুরের কাছে পুলিশ গ্রেপ্তার করল শ্রীমতী মিত্রকে। সাঁওতালী রমণীর পোশাকে আত্মগোপন করেছিলেন শ্রীমতী মিত্র। পুলিশ শ্রীমতী মিত্রকে গ্রেপ্তার করে চাঁপাই নবাবগঞ্জ থানায় নিয়ে যায়। তারপর সেই থানার অভ্যন্তরে শ্রীমতী মিত্রের উপর কি ভাবে অত্যাচার করা হয়েছিল তার বর্ণনা আছে অমিতা গুপ্তের ‘পাকিস্তান’ নামক গ্রন্থে। গ্রন্থের লেখককে ডি আই জি বলেছিলেন, নাচোলের নিকটবর্তী চাঁপাই নবাবগঞ্জ থানায় গিয়ে এক সন্ধ্যায় থানার হাজত কক্ষে রক্তাপ্লুত অবস্থায় নগ্ন দেহে শ্রীমতী ইলা মিত্রের যে হাল তিনি দেখেছিলেন তাতে তিনি শিউরে উঠেছিলেন। শোণিত স্রোতের মধ্যে শায়িত শ্রীমতী ইলা মিত্রকে দেখে তাঁর আশস্কা হয়েছিল হয় তিনি মৃত না হয় মৃত্যু আসন্ন। ডি আই জি সাহেব তাঁকে হাসপাতালে পাঠাবার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নাচোলের গ্রামে যখন জীপ নিয়ে ঢুকলেন তখন নাকি গাছের নীচে স্তুপীকৃত যন্ত্রণাকাতর গুরুতর আহত সঁওতালদের রক্তাক্ত দেহগুলি দেখে আঁতকে উঠেছিলেন তিনি।

এরপর শ্রীমতী ইলা মিত্র নিজের বর্ণনা নিজে দিয়েছেন কোর্টে। সেই বর্ণনা একদা লিফলেট আকারে ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল পূর্ববঙ্গে। কারণ শ্রীমতী মিত্রের সেই বিবৃতি কোন সংবাদপত্র ছাপেনি। ছাপতে পারেনি। শ্রীমতী মিত্র বলেন, “কেসটির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। গত ৭.১.৫০ তারিখে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়, পরদিন নাচোলে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধোর করে, তারপর আমাকে একটা সেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাকান্ড সম্পর্কে সবকিছু স্বীকার না করলে আমাকে উলঙ্গ করে দেওয়া হবে, এই বলে এস আই আমাকে হুমকি দেখায়। আমার যেহেতু বলার মত কিছু ছিল না কাজেই তারা আমার সমস্ত কাপড় চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ ভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দী রাখে। আমাকে কোন খাবার দাবার দেওয়া হয়নি, একবিন্দু জল পর্যন্ত না। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় এসআই এর উপস্থিতিতে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময় আমার কপড় চোপড় আমাকে ফেরত দেওয়া হয় এবং রাত্রি ১২টার সময় সেল থেকে আমাকে বের করে সম্ভবত এস আই এর কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। যে কামরাটিতে আমায় নিয়ে যাওয়া হল সেখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তারা নানারকম অমানুসিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালাল। দুটো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটো ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। সে সময় চারিধারে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা বলছিল যে, আমাকে পাকিস্তানী ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। এই নির্যাতন চলার সময়ে তারা আমার মুখ রুমাল দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল। জোর করে আমায় কিছু বলাতে না পেরে তারা আমার চুল উপড়ে ফেলছিল। সিপাইরা আমায় ধরাধরি করে সেলে নিয়ে গেল। কারণ সেই নির্যাতনের পর আমার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব ছিল না। সেলের মধ্যে আবার এস আই ৪টি গরম গরম সিদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিল এবং বলল এবার সে কথা বলবে। তারপর ৪-৫ জন সিপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিৎকরে শুইয়ে রাখল এবং ১জন আমার যৌন অঙ্গের মধ্যে একটা গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন আগুণে পুড়ে যাচ্ছি। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।

৯.১.৫০ তারিখে সকালে যখন আমার জ্ঞান হল তখন উপরোক্ত এস আই এবং কয়েকজন সিপাই আমার সেলে এসে তাদের বুট দিয়ে আমার পেটে লাথি মারতে থাকে। এরপর আমার ডান পায়ের গোড়ালীতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেওয়া হল। সে সময় আধা অচেতন অবস্থায় পড়ে থেকে আমি এস আই কে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম, আমরা আবার রাত্রিতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না কর তাহলে সিপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাত্রিতে এস আই এবং তার সিপাইরা ফিরে এল এবং তারা আবার সেই হুমকী দিল। যেহেতু তখনও আমি কিছু বলতে রাজী হলাম না, তিন চারজন আমাকে ধরে রাখল এবং ১নং সিপাই সত্যি আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করল। এর অল্প কিছুক্ষণ পরে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম।

পরদিন ১০.১.৫০ তারিখে যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন আমি দেখলাম যে আমার দেহ থেকে দারুনভাবে রক্ত ঝরছে আর আমার কাপড় চোপড় রক্তে সম্পূর্ণ ভাবে ভিজে গেছে। সেই অবস্থাতেই আমাকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হলো। নবাবগঞ্জ গেটে জেলের সিপাইরা জোরে ঘুসি মেরে অভ্যর্থনা জানালো। সে সময় আমি একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলাম। কাজেই কোর্ট ইনসপেক্টার এবং কয়েকজন সিপাই আমাকে একটি সেলের মধ্যে বহন করে নিয়ে গেলো। তখনও আমার রক্তপাত হচ্ছিল এবং খুব বেশী জ্বর ছিলো। সম্ভবত নবাবগঞ্জ সরকারী হাসপাতালের একজন ডাক্তার সেই সময় আমার জ্বর দেখেছিলেন ১০৫ ডিগ্রি। যখন তিনি আমার দারুণ রক্তপাতের খবর শুনলেন তখন তিনি আমাদের আশ্বাস দিলেন যে একজন মহিলা নার্সের সাহায্যে আমার চিকিৎসা করা হবে। আমাকে কিছু ওষুধ এবং কয়েক টুকরো কম্বলও দেওয়া হলো।

১১.১.৫০ তারিখে সরকারী হাসপাতালের নার্স আমাকে পরীক্ষা করলেন তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে কি রিপোর্ট দিয়েছিলেন সেটা আমি জানি না। তিনি আসার পর আমার পরনে যে রক্তমাখা কাপড় ছিল সেটা পরিবর্তন করে একটা পরিস্কার কাপড় দেওয়া হল। এই পুরো সময় আমি নবাবগঞ্জের জেলের একটি সেলে একজন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার শরীরে খুব বেশী জ্বর ছিল, তখনো আমার দারুণ রক্তপাত হচ্ছিল এবং মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম।

১৬.১.৫০ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় আমার সেলে একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসা হল এবং আমাকে বলা হল যে পরীক্ষার জন্য আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। খুব বেশী শরীর খারাপ থাকার জন্যে আমার পক্ষে নড়াচড়া সম্ভব নয়–একথা বলায় লাঠি দিয়ে আমাকে একটা বাড়ি মারা হল এবং স্ট্রেচারে উঠতে আমি বাধ্য হলাম। এর পর আমাকে অন্য এক বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হল। আমি সেখানে কিছুই বলিনি কিন্তু সেপাইরা জোর করে একটা সাদা কাগজে সই আদায় করল। তখন আমি আধা অচেতন অবস্থায় খুব বেশী জ্বরের মধ্যে ছিলাম। যেহেতু মার অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিল সেজন্য পরদিন আমাকে নবাবগঞ্জের সরকারী হাসপাতালে পাঠানো হল। এর পর যখন আমার শরীরের অবস্থা আরও সঙ্কটাপন্ন হল তখন আমাকে ২১.১.৫০ তারিখে নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে এসে সেখানে জেলের হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হলো। কোন অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলিনি এবং উপরে যা বলেছি তার বেশী আমার আর বলার কিছু নেই।

এই ইলা মিত্র। এর পরেই কবি গোলাম কুদ্দুস তাঁর বিখ্যাত কবিতায় লিখলেন-”ইলা মিত্র, ইলা মিত্র ফুচিকের বোন, তুমি স্টালীন নন্দিনী।” বেলুচিস্তানের পরীবানু আর রাজশাহীর ইলা মিত্র এক হয়ে গেলেন পাকিস্তানী শাসনের নির্মম নিষ্ঠুর অত্যাচারে। রাজনীতি এবং ভৌগোলিক দিক দিয়ে পাকিস্তান কোনদিনই ঐক্যবদ্ধ নয়, কিন্তু ঐক্য ছিল এবং আছে একটি ক্ষেত্রে–সে হল নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচারের মধ্যে।

বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যখন অধীর আগ্রহে নিজেদের অধিকার কায়েম করার প্রত্যাশায় জাতির স্মরণীয় দিন ৩রা মার্চ প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা ভাবছিলেন সেই সময় অর্থাৎ ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা সারা বাংলাদেশে এক অভাবনীয় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্রেসিডেন্টের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ ধিক্কারে ফেটে পড়ে। মিছিলে মিছিলে, স্লোগানে স্লোগানে বাংলার অলিগলি ভরে যায়। শুরু হয় দমননীতি– সেই দুর্বার আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য। শুরু হয় গুলী, বেয়নেট চালনা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী সহ বিভিন্ন স্থানে সরকার মানুষের বজ্রকঠিন আওয়াজকে স্তব্ধ করার জন্য হত্যা করে হাজার হাজার শান্তিকামী ছাত্র জনতা মজুর কৃষককে।

ছাত্র-ছাত্রীদের উপর অত্যাচার

চট্টগ্রামের সিটি কলেজ সহ ঢাকা,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে সেনাবাহিনী ছাত্র- ছাত্রীদের নির্মমভাবে মারধর করে। বিভিন্ন স্থানে সান্ধ্য আইন জারী করে। জনসাধারণ সান্ধ্য আইন ভেঙ্গে রাস্তায় নেমে এল। শুরু হল বিভিন্ন স্থানে খন্ডযুদ্ধ। সরকারী কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ছাত্রাবাসের ছাত্র-ছাত্রীদের জোর করে ছাত্রাবাস ত্যাগ করতে বাধ্য করে। রাজশাহীতে ৩রা মার্চেই সান্ধ্য আইন জারী করা হয়েছিল, কিন্তু রেডিও পাকিস্তান তা প্রচার করে ৫ই মার্চ। ঐ দিন রাজশাহীর সঙ্গে যোগাযোগে অসুবিধার জন্য রাজশাহীর আসল ঘটনা বেশ কিছুদিন চাপা ছিল। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে পরে জানা গিয়েছে, সৈন্যরা ঐদিনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র প্রাঙ্গণ কলঙ্কিত করে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাঃ জোহা হলের’ ছাত্রদের ১২ ঘন্টার ভিতর হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে ওই হলেই সৈন্যরা ক্যাম্প করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ওই সৈন্যবাহিনীর অফিসারকে এ ব্যাপারে আপত্তি জানালে উপাচার্য অপসারিত হন। উপাচার্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা আবাসিক হল মনু জান হলের ব্যাপারে অনুরোধ করেন–সৈন্যরা যেন ওদিকে না যায়, কিন্তু সেই অফিসার তাও প্রত্যাখ্যান করলে তিনি মেয়েদের সাম্ভাব্য নিরাপত্তার জন্য নিজেদেরকেই ব্যবস্থা নিতে বলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন বেশ কয়েক মাইল দূরের রেল স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠে এক- এক-দিকে চলে যায়। বিভিন্ন স্টেশনের লোকজন ঐসব অনাহারী ছাত্রছাত্রীদের স্টেশনে স্টেশনে খাবার দেয়। মেয়েরা মালগাড়ীতে গাদাগাদি করে বাড়ী ফিরে যায়। রাজশাহীতে এই সময় এক প্রতিবাদ সভায় বর্বর সৈন্যরা অহেতুক গুলীবর্ষণ করে ২৮ জনকে হত্যা করে।

ফৌজি বাহিনীর তান্ডব

ঠিক সেই সময়ে রংপুরে ফৌজি বাহিনীর অহেতুক গুলীবর্ষণে নিহত হয় বেশ কিছু ছাত্র। জানা গিয়েছে, ১৪৪ ধারা থাকায় আওয়ামী লীগের একদল স্বেচ্ছাসেবক ২-৩ জন করে যখন রাস্তা পার হচ্ছিল তখন হঠাৎ সশস্ত্র বাহিনীর হামলায় ১জন স্বেচ্ছাসেবক নিহত হলে জঙ্গী বাহিনীর সাথে জনগণের দারুণ লড়াই শুরু হয়। সেই লড়াইয়ে নিহতের সঠিক সংখ্যা কেউই নিতে পারেন নি। অনেকের মতে শতাধিক নিরস্ত্র ছাত্র জনতা রংপুরে নিহত হয়েছেন। ঢাকার রাজপথ মজুর, শ্রমিক, ছাত্র, জনতার রক্তে রাঙা হয়েছে। বহু দোকান পাট লুট করেছে পাক সৈন্যরা। ঘর থেকে বের করে রাস্তায় এনে যাকে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। প্রতিবাদে সারা বাংলায় হরতাল পালিত হয়েছে। রাস্তায় সৈন্যদের চলাচল বন্ধ করার জন্য জনতা বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *