আমি মাধবী

আমি মাধবী

আমি পুণ্যশ্লোক রাজা যযাতির মেয়ে মাধবী৷ মাতৃপরিচয়? কী হবে জেনে? মা তো শুধুই গর্ভধারণের আধার, তাঁর পরিচয় কোন কাজে লাগে? আমি জন্মেছি অমিতবীর্য রাজা যযাতির ঔরসে, এই আমার একমাত্র পরিচয়৷ ‘কুমারী’ মেয়ের এ ছাড়া আর কোনো পরিচয় থাকতে নেই যে৷

পরিচয় কেন, আমার কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্বও আছে কি? মনে পড়ে এক বসন্তের সকালে, আমি তখন সদ্য যুবতী, রাজপুরীর বাগানে প্রিয় সখীদের সঙ্গে ফুল কুড়োচ্ছি, রাজসভায় ডাক পড়ল আমার৷ গিয়ে দেখি ভারি গম্ভীর মুখে সিংহাসনে বসে আছেন বাবা, কিছুটা বুঝিবা চিন্তিতও৷ সামনে ঋষির বেশে এক দিব্যকান্তি যুবক, পাশে তাঁর এক মহাবলশালী পুরুষ৷ দ্বিতীয় পুরুষটিকে আমি চিনি৷ ইনি আমার পিতৃসখা গরুড়৷ নত হয়ে প্রণাম করলাম তাঁকে৷ ঋষিকেও৷

আমার আগমনে সভায় ঈষৎ চাঞ্চল্য দেখা দিল৷ রাজার ভুরুর কুঞ্চন যেন শিথিল সামান্য৷ মন্দ্রস্বরে বললেন— শোনো মাধবী, সখা গরুড় ঋষি গালবকে আমার কাছে নিয়ে এসেছেন৷ ঋষি গালব আমার কাছ থেকে এমন কিছু চান যা এঁরা দেশে দেশে ঘুরেও পাননি৷

আমি বিস্মিত হলাম৷ এ জন্য আমাকে ডেকে আনার কী দরকার?

বাবা আর আমার দিকে তাকালেনও না৷ অকম্পিত স্বরে ঋষিকে বললেন— মুনিবর, এই মূহুর্তে আপনার প্রার্থনা পূরণ করার সঙ্গতি আমার নেই৷ কিন্তু বিষ্ণুসখা কিংবা আপনার মতো ব্রহ্মর্ষিকে নিরাশ করা আমার অন্যায় হবে৷ আপনি এক কাজ করুন, আপনার প্রার্থিত আটশো অশ্বের বদলে আমার কন্যা মাধবীকে নিয়ে যান৷ আমার কন্যাটি অতি সুশীলা, রূপবতী৷ আশা করি একে পেলে আপনার অভিষ্ট পূর্ণ হবে৷

ঘোড়ার বদলে আমি? বাবার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই মাথায় ঢুকছিল না৷ প্রশ্ন করাও যাবে না কিছু, সে অধিকারও আমার নেই৷ বিহ্বল চোখ জন্মদাতার মুখ থেকে ঘুরে ঋষি গালবের দিকে পড়ল৷ আজ থেকে আমি এঁরই অধীনা? ভাবতে অবশ্য মন্দ লাগছে না৷ ক্ষত্রিয় বীর নয় নাই হল, এমন বিদ্বান সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ পাওয়া তো ভাগ্যের কথা৷ আমার মতো মেয়েরা তো মনে মনে এমন একজনকেই স্বপ্ন দেখে থাকে৷

অন্দর মহলে খানিক কান্নাকাটি হল৷ দাসীরা কাঁদল, সখীরা কাঁদল, মা কাঁদলেন, বিমাতা কাঁদলেন৷ সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এক বস্ত্রে ঋষি গালবের সঙ্গে রাজপ্রাসাদ ছাড়লাম আমি৷

পিতৃসখা গরুড় অন্য পথে চলে গেলেন৷ নীরবে হাঁটছেন গালব, পিছনে দুরু দুরু বুকে আমি৷ মনে মনে প্রস্তুত করছি নিজেকে৷ বিলাস বৈভব সব ভুলে এবার থেকে তপোবনে কাটাতে হবে বাকি জীবন, নিজেকে এই মানুষটার যোগ্য করে তুলতে হবে৷ পারব তো? নিশ্চয়ই পারব৷ আমি গালবের প্রেমে পড়েছি, মেয়েরা কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে পেলে তার জন্য সব করতে পারে৷

হাঁটছি তো হাঁটছি৷ রাজধানী পার হয়ে লোকালয় এল৷ তারপর ছোট্ট অগভীর বন৷ বনের শেষে কুলকুল এক নদী৷ পথশ্রমে ক্লান্ত ঋষি নদীর কিনারে এক শিংশপা গাছের নীচে বসেছেন৷ একটু দূরত্ব রেখে সসংকোচে আমিও৷

পথের নীরবতা বৃক্ষছায়ায় অসহ্য লাগছিল৷ অথচ নিজে থেকে কথা বলার সাহসও হচ্ছে না৷ এক সময়ে মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম— ঋষিবর, আমি কি আপনার সেবা করব?

গালব হাসলেন সামান্য৷ মাথা নেড়ে বললেন— না, দরকার নেই৷ একটু পরেই উঠব আমরা৷

কী মধুর কণ্ঠস্বর! আমি বিগলিত গলায় বললাম— আমরা কি নদীর ওপারে যাব?

—হ্যাঁ৷

—আপনার আশ্রম কি এখান থেকে বহু দূর?

—হুঁ৷

কথা বলছেন গালব, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি আমার দিকে নেই, বহতা নদীতে স্থির৷

ঈষৎ লাস্য আনলাম গলায়— আপনি এত গম্ভীর কেন ঋষি? আমাকে কি আপনার পছন্দ নয়?

গালব যেন একটু বিরক্ত হলেন৷ ক্ষণেক আমাকে দেখেই আবার তাঁর চোখ নদীতে৷ রুক্ষস্বরে বললেন— শোনো যযাতির মেয়ে, এটা রঙ্গরসিকতার সময় নয়৷ তুমি কি জানো, কী কারণে তোমায় আমি নিয়ে এসেছি?

আরেকটু চপল হলাম, জানি৷ আটশো ঘোড়ার বদলে আপনি আমায় গ্রহণ করেছেন৷

—ভুল৷ আটশো ঘোড়ার বদলে নয়, আটশো ঘোড়ার জন্য তোমাকে আনা হয়েছে৷

—মানে?

—ও, তার মানে রাজা যযাতি তোমায় সব খুলে বলেননি!

পলকের জন্য গালব অন্যমনস্ক৷ উঠে পড়লেন, পায়ে পায়ে গেলেন নদীর ধারে, আঁজলা ভরে মুখে চোখে জল ছেটালেন৷ ফিরে এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে, স্পষ্টকথা স্পষ্টভাবে শুনে নাও যযাতির মেয়ে৷ আমি তোমাকে গ্রহণ করার জন্য আনিনি৷ অন্তত এই মুহূর্তে৷ আমার জন্য তোমায় একটা কাজ করতে হবে৷ কঠিন কাজ৷

আমার বুক থর থর৷ অস্ফুটে বললাম— আজ্ঞা করুন৷

—আমার গুরু বিশ্বামিত্র আমার কাছে আটশোটি দুর্লভ ঘোড়া গুরুদক্ষিণা চেয়েছেন৷ এমন ঘোড়া যাদের গায়ের রং ধবধবে সাদা, কিন্তু একটি কান শ্যামবর্ণ৷ অযোধ্যার রাজা হর্ষশ্বের কাছে এমন ঘোড়া আছে শুনেছি৷ তবে খবর পেয়েছি তিনি তা এমনি দেবেন না৷ বিনিময়ে হর্ষশ্ব এমন এক নারী চান যে তাঁকে রাজচক্রবর্তী পুত্র উপহার দিতে পারে৷…আমি এখন তাঁর কাছেই যাব৷ যদি তিনি তোমাকে পছন্দ করেন, তবে তাঁর হাতে তোমাকে তুলে দিয়ে আমার ঘোড়া সংগ্রহ করব৷

আমি স্তম্ভিত৷ বাকরুদ্ধ৷ এ কী বলছেন গালব? মেয়ে হতে পারি কিন্তু মানুষ তো বটে৷ ইনি আমাকে ভাড়া খাটাতে চান? ছি ছি৷

সম্বিত ফিরতে সোজাসুজি তাকালাম, আমার বাবা সব জানেন?

—অবশ্যই৷ তিনিই তো আমাকে পরামর্শটা দিলেন৷

রাগে দুঃখে অভিমানে চোখে জল এসে গেল৷ আমার জন্মদাতাই জেনেশুনে…!

কোনোক্রমে বললাম—তার মানে এখন আমায় অযোধ্যায় জীবন কাটাতে হবে?

—হুঁ৷ অন্তত যতদিন না তুমি পুত্র প্রসব করো ততদিন৷

—তারপর?

গালবের ঠোঁটে বিচিত্র হাসি ফুটল৷ কোমল স্বরে বললেন— তারপর আমি তোমাকে ফেরত নিয়ে আসতে পারি৷

—সত্যি আনবেন৷

—আনতেই হবে৷ তোমার দায়িত্ব এখন আমার…

আশ্চর্য নারীর মন! কথাটা শুনেই কোত্থেকে যেন দীপ্তি জ্বলে উঠল আমার বুকে৷ কে যেন কুহকিনী কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে বিপদে সাহায্য করা নারীর ধর্ম৷ ঘেন্নাপিত্তি ভুলে, চোখ কান বুজে ক-টা মাস কাটিয়ে দে, তারপর তো গালব তোরই৷

ধন্য আশা কুহকিনী৷ ধন্য পুরুষের প্রতি নারীর আকর্ষণ!

আবার শুরু হল আমাদের যাত্রা৷ নদী পাহাড় অরণ্য জনপদ পার হয়ে পৌঁছলাম অযোধ্যায়৷

রাজা হর্ষশ্বের সভায় আমাকে নিয়ে গেলেন গালব৷ প্রস্তাবটি রাখলেন রাজার কাছে৷

হর্ষশ্ব আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন৷ যেমন ভাবে কোনো বিক্রয়যোগ্য পশুকে দেখে কোনো বণিক, অনেকটা তেমন ভাবেই৷ মুখে হাসি ফুটল— নাঃ, বলতেই হয় এ মেয়ে ভারি সুলক্ষণা৷ মনে হচ্ছে আমি যা চাই, এ তা আমায় দিতে পারবে৷…কিন্তু আপনার শুল্ক তো আমি পুরোপুরি মেটাতে পারব না মুনিবর৷ ওরকম ঘোড়া আমার কাছে আছে বটে, তবে মাত্র দু-শো৷ এতে কি আপনার চলবে?

এ যে রীতিমতো দরাদরি! আমার গা ঘিনঘিন করে উঠল৷ দাঁতে দাঁত চেপে তবু দাঁড়িয়ে আছি৷ শুধু গালবের মুখ চেয়ে৷

গালবের মুখ পাংশু হয়ে গেছে৷ আমার কথা ভেবে নয়, অন্য চিন্তায়৷ একান্তে ডাকলেন আমাকে৷ অস্থির হয়ে বলে উঠলেন— এখন আমার কী হবে যযাতির মেয়ে? গুরুদক্ষিণা মেটাতে না পারলে আমি যে পাতকী হব! ইহলোকেও সুখ পাব না, মরার পরেও স্বর্গলাভের কোনো আশা থাকবে না! নাঃ, তোমাকে দিয়ে আমার কোনো কাজই হল না৷ আমার সারা জীবনের শ্রম তপস্যা সব নিস্ফল হয়ে গেল৷

কথাকটি তিরের মতো আমার মর্মমূল ভেদ করল৷ ক্ষণিকের জন্য পাথর হয়ে যাওয়া হূদয়ে বিন্দু বিন্দু মায়া জমছিল৷ ওই মানুষটার জন্য৷ হাতের কাছে রমনীরত্ন থাকা সত্ত্বেও কী অসহায়! ইহলোক আর পরলোকের ভাবনায় কী কাতর!

মনোকষ্ট চেপে রেখে বলেই ফেললাম— এর তো সহজ সমাধান আছে ঋষি৷ আপনি দু-শো ঘোড়ার বদলেই এঁর কাছে আমাকে রেখে যান৷ ছেলে হতে তো বছর খানেক সময় লাগবেই, এর মধ্যে আপনি খোঁজ খবর করুন আর কোন কোন রাজার কাছে এমন ঘোড়া পাওয়া যায়৷ ভাড়া খাটাই যখন আমার মতো মেয়েমানুষের নিয়তি, তখন নয় আরও ক-টা রাজার সঙ্গে শোব৷ আপনারও প্রাপ্য ঘোড়া মিলে যাবে৷

প্রস্তাবটায় শ্লেষ ছিল আমার৷ ভেবেছিলাম বিদ্রূপের অভিঘাতে আহত হবেন ঋষি, হাঁ হাঁ করে উঠবেন৷ শুনেছিলাম সাত পা একসঙ্গে হাঁটলে সঙ্গী নাকি বন্ধু হয়৷ সে যদি জঙ্গলের পশু হয়, তবুও৷ ঋষি গালবের সঙ্গে এই ক-দিন লক্ষ পা হেঁটেছি আমি, এক কণা দুর্বলতাও কি আমার জন্য জমেনি তাঁর মনে? বন্ধুর মনোবেদনা বুঝতে পারবেন না, ঋষি কি এতই প্রজ্ঞাহীন?

নাঃ, গালবের মুখে যন্ত্রণার চিহ্নমাত্র নেই৷ বরং উদ্ভাষিত হয়েছেন৷ পরক্ষণেই ম্লান আবার৷ কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন— উপায়টা মন্দ বলোনি৷ তবে এতেও সমস্যা আছে৷

—আছে বুঝি?

—নেই? গালবের বিস্ময় যেন বাঁধ মানল না— তুমি তো রাজবংশের মেয়ে, জানো না, রাজারা কুমারী মেয়ে পছন্দ করেন? এক রাজার সঙ্গে বছরভর কাটানোর পর অন্য কোনো রাজা তোমায় নেবেন?

ধন্য পুরুষ৷ ভাড়া খাটার মেয়েছেলেও চাই, টাটকা কুমারীও চাই! একই সঙ্গে!

সামান্য ছলনার আশ্রয় নিলাম এবার৷ হেসে বললাম— এই কথা? এ তো কোনো সমস্যাই নয়৷ অতি শৈশবে এক ব্রাহ্মবাদী ঋষিকে আমি সেবায় তুষ্ট করেছিলাম৷ তিনি আমাকে একটা অদ্ভুত বর দিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন, প্রতিবার সন্তান প্রসবের পর তুমি আবার কুমারী হয়ে যাবে৷

—যাহ, এমন আবার হয় নাকি?

—হয়৷ আপনাদের মতো পুরুষরা বর দিলে সবই হয়৷ সবই তো আপনাদেরই ইচ্ছানির্ভর৷ চাওয়া নির্ভর৷

মনে মনে বললাম, শত শাস্ত্র অধ্যয়ন করেও আপনি কী অজ্ঞ ঋষি! এত জানেন আর এটুকু বোঝেন না, শরীর তো দূরের কথা, হূদয়ে একজনের জন্য প্রণয় জাগলেই নারী আর কুমারী থাকে না!

ঋষি গালব আনন্দের আতিশয্যে আমার হাত জড়িয়ে ধরেছেন— তুমি আমায় বাঁচালে যযাতির মেয়ে৷ কী বলে যে তোমায় কৃতজ্ঞতা জানাব?

—থাক৷ শুধু কথা দিন আপনার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়ে গেলে আমাকে আপনি…

—সে আর বলতে৷ আমি কি বুঝি না এমন ভাবে জীবন কাটাতে মেয়েদের কত কষ্ট হয়!

গালব চলে গেলেন৷ আমার ঠাঁই হল রাজা হর্ষশ্বের অন্তঃপুরে৷

শুরু হল আমার নদীর জীবন৷ বয়ে চলেছি, বয়েই চলেছি৷

দিন যায়৷ কীভাবে যে যায় সে শুধু আমিই জানি৷ একে একে তিন রাজার শয্যাসঙ্গিনী হলাম আমি৷ হর্ষশ্বের পর কাশীরাজ দিবোদাস, তারপর ভোজরাজ উশীনর৷ এঁরা প্রত্যেকেই মহৎ, কিন্তু পৃথক ধরনের মানুষ৷ হর্ষশ্বের দানধ্যানের সুনাম আছে, দিবোদাস বীর, উশীনর সত্যের পূজারী৷ শুধু একটি বিষয়েই তিনজনের ভীষণ মিল৷ মাত্র দুশোটি ঘোড়ার বিনিময়ে একটি নারীকে ভোগ করতে কারও মনে এতটুকু দ্বিধা নেই৷ কে জানে, হয়তো এর মধ্যে ধর্মের কোনো গূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে!

সে যাই হোক, এঁদের কার্যসিদ্ধি হয়েছে৷ প্রকৃতির নিয়মে এঁদের প্রত্যেকের গৃহেই আমি গর্ভবতী হয়েছি, তিনজনকেই উপহার দিয়েছি একটি করে পুত্র৷ হর্ষশ্বের ঘরে বসুমনা, দিবোদাসের প্রাসাদে প্রতর্দন, উশীনরের রাজপুরীতে শিবি৷ প্রতিটি জন্মের সংবাদই যথাসময়ে পৌঁছেছে আমার বাবার কানে৷ আশ্চর্য, তিনিও দৌহিত্র লাভ করে নাকি মোহিত!

তিন সন্তানকেই দুধ-মা-র কাছে ছেড়ে রেখে এসেছি আমি৷ প্রথম বার যখন অযোধ্যা থেকে গালব আমায় নিতে এলেন, বসুমনার জন্য আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল৷ অতটুকু দুধের শিশু ফেলে কোন প্রাণে যাই! হর্ষশ্বকে বললাম, ছেলে এখন আমার কাছে থাক৷ একটু বড়ো হলে ফিরিয়ে দিয়ে যাব৷ তিনি সম্মত হলেন না৷ তাঁর ছেলে অন্যের ঘরে প্রতিপালিত হবে? অসম্ভব৷ পশুপাখির জগতে শিশু মা-র, মানুষের জগতে নয়৷

আমার বুকের দুধ যন্ত্রণার পুঁজ হয়ে জমে গেল৷ শুকিয়ে মরে গেল৷ তিন তিন বার৷

উশীনরের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গালবকে বললাম— এখনও তো আপনার দু-শো ঘোড়া সংগ্রহ বাকি৷ এবার কোথায়?

গালবকে সেদিন একটু যেন বিমর্ষ দেখাচ্ছিল৷ হতাশ স্বরে বললেন— আমার চেষ্টা বোধ হয় সফল হল না৷ সমস্ত শ্রম আমার ব্যর্থ হয়ে গেল৷

গালবের শ্রম! হাসি পেল৷ তবু প্রশ্ন— কেন? কী হল?

—মহা সমস্যায় পড়ে গেছি৷ কালই গরুড় আমার কাছে এসেছিলেন৷ তিনি এক নতুন সংবাদ দিয়ে গেলেন৷…এই যে সব দুর্লভ অশ্ব, এই সবই নাকি আগে মহর্ষি ঋচিকের ছিল৷ তিনি এদের পেয়েছিলেন বরুণালয়ে৷ তাঁর কন্যা সত্যবতীর বিয়ের সময়ে মহর্ষি ঋচিক কান্যকুব্জরাজ গাধিকে এরকম এক হাজারটি ঘোড়া যৌতুক দিয়েছিলেন৷ মহারাজ গাধি ঘোড়াগুলোকে নিজের কাছে রাখেননি, সবই তিনি ব্রাহ্মণদের দান করে দেন৷ সেই ব্রাহ্মণরা যখন ঘোড়া নিয়ে ফিরছিলেন তখন হর্ষশ্ব দিবোদাস আর উশীনর তাঁদের কাছ থেকে দুশোটি করে ঘোড়া কিনে নিয়েছিলেন৷ বাকি চারশো পথে চুরি হয়ে যায়৷ অর্থাৎ এরকম ঘোড়া আর আমার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ গরুড় অবশ্য বলেছিলেন তুমি এই ছশো ঘোড়াই গুরুদেব বিশ্বামিত্রকে দক্ষিণা দিয়ে দাও৷ তোমার অসুবিধার কথা খুলে বললে তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন৷

পলকের জন্য অন্তরে যেন মুক্তির স্বাদ পেলাম৷ উজ্জ্বল মুখে বললাম— বিষ্ণু সখা গরুড় যা বলছেন তাই করুন তবে৷

—তা কি হয় যযাতির মেয়ে? গুরুদক্ষিণা পুরো না দিলে আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় কী করে? বলতে বলতে অপাঙ্গে আমার দিকে তাকালেন— একটা বুদ্ধি অবশ্য মাথায় এসেছে, জানি না তাতে লাভ হবে কিনা৷

—কী? আমার গলা কেঁপে গেল৷

—যদি অবশিষ্ট ঘোড়ার বদলে গুরুদেব তোমায় রাখেন…না না, এ বোধ হয় হয় না৷ গুরুদেব হয়তো এতে আহত হতে পারেন৷ তিনি তো ঘোড়াই চেয়েছেন, স্ত্রীলোকে কি তিনি সন্তুষ্ট হবেন?

তিন রাজর্ষির শয্যা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে৷ মনে মনে বললাম, খুব হবে৷ ঋষি হলেও তিনি পুরুষ তো বটে৷

গালব আমার হাত ধরলেন— আরেক বার আমার জন্য কষ্ট করবে যযাতির মেয়ে? এই শেষ বার?

চোখে জল এসে গেল৷ সামলে নিয়ে বললাম— চলুন৷

—তবে তাই চলো৷ যদি তিনি করুণাপরবশ হয়ে…

নির্দয় পুরুষ অপরের করুণা চায়! সে করুণার প্রকৃতিই বা কীরকম? না ঘোড়ার বদলে সুন্দরী ভোগ করে অপর জনটি তৃপ্ত হবেন কি হবেন না!

আমার ধারণাই মিলে গেল৷ এক ঝলক আমাকে দেখামাত্রই ঋষি বিশ্বামিত্রের কামজ্বর এসে গেল৷ গদগদ গলায় বললেন— তুই কী আহাম্মক রে গালব! এমন একটা মেয়েছেলে তোর হাতে আছে, অথচ তাকে আগে আমার কাছে আনিসনি! থাকি তো বনে বাদাড়ে, ঘোড়া আমার কী কম্মে লাগবে? নেহাত ‘গুরুদক্ষিণা দেব, গুরুদক্ষিণা দেব’ বলে বায়না জুড়েছিলি, তাই তোকে পরীক্ষা করার জন্য…৷ এহেহেহে, এই ক-টা বছর মেয়েটাকে পেলে… যাক গে যাক, এখনই বা মন্দ কী!

ব্যস৷ এবার আর রাজপ্রাসাদ নয়, মুনির তপোবন৷ এবারও সেই একই পরিণতি৷ তিন রাজার মতো আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে একসা করলেন ঋষিবর৷ ফলত আরেকটি ছেলে৷ অষ্টক৷ ছেলে জন্মাতেই ঋষির কামজ্বর উধাও৷ বুঝি বা পরমব্রহ্মের কথা মনে পড়ে গেল৷ তুচ্ছ মানবীতে কতদিন আর আটকে থাকতে পারেন সাধুসন্ন্যাসীরা!

আবার গালবের কাছে প্রত্যাবর্তন৷ এতদিনে সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে এসেছে আমার৷ মনেরও, শরীরেরও৷ বড়ো ক্লান্ত বোধ করি, বড়ো অবসন্ন৷ নাঃ, গালবকে দেখে হূদয়ে এখন আর এতটুকু চাঞ্চল্য জাগে না৷ প্রণয়ের ক্ষুধা মরে গেছে, প্রথম প্রেম এখন দূরের স্মৃতি৷ তবু মনে একটা ক্ষীণ স্বস্তি, যাক আর ভেসে বেড়াতে হবে না৷ রাজকন্যা হই আর যাই হই, মেয়েদের যে কোনো আলাদা সত্তা থাকতে নেই এ আমি হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি৷ আমাদের আবার ইচ্ছে অনিচ্ছে কী? এখন বাকি জীবনটা গালবের সঙ্গে চোখ কান বুজে কাটিয়ে দিতে পারলে বাঁচি৷

গালবের পিছু পিছু হাঁটছি আবার৷ নদী-গিরি-প্রান্তর-অরণ্য- লোকালয় পার হয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি৷ এক দুপুরে এক স্রোতস্বিনী পার হলাম আমরা৷ তিলের বিশ্রামের জন্য বসেছি এক শিংশপা গাছের নীচে৷ জায়গাটা ভারি চেনা চেনা৷ এখানেই প্রথম দিন আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম না? হ্যাঁ তো৷

গালবও বুঝি চিনেছেন জায়গাটাকে৷ ঘুরে ঘুরে দেখছেন চারদিক৷ নদীকেও৷ চৈত্রবাতাসে ঘূর্ণি উঠছে ছোটো ছোটো৷ কোত্থেকে একটা কোকিল ডেকে উঠল৷ ডাকছে, ডেকেই চলেছে৷

নির্বাক মানুষটা হঠাৎ সবাক হলেন— কি ভাবো যযাতির মেয়ে?

ঘাড় নাড়লাম— কিছু না৷

গাম্ভীর্য স্বরে মৃদু হাসি উঁকি দিল— ক-টা বছর তোমার ওপর দিয়ে খুব ঝড় বয়ে গেল, তাই না?

অর্থহীন কথা৷ উত্তর দিলাম না৷

—তোমার এই আত্মত্যাগ বিফলে যাবে না, দেখো৷ তোমার চার সন্তানেরই নাম ত্রিভুবনে ছড়িয়ে পড়বে৷ বসুমনা হবে দাতা, প্রতর্দন হবে বীর, শিবি ধার্মিক হবে, আর আমার গুরুর সন্তান অষ্টক হবে যজ্ঞকারী৷ কি, খুশি?

পলকের জন্য চারটে কচি কচি মুখ ভেসে উঠেছে৷ কেমন আছে ছেলেগুলো? কী করছে? মাকে কি খোঁজে তারা? মার জন্য কাঁদে? নাকি ভুলেই গেছে এই অভাগিনী মাকে? বুকফাটা কষ্টের মধ্যে হাসি পেল সহসা৷ গালব আশীর্বাদ করছেন আমার ছেলেদের, আমাকে নয়৷ মেয়েদের এতটুকু গৌরব দিতেও এত কার্পণ্য? হায় রে পুরুষ!

নীরস স্বরে বললাম— আমার খুশিতে কী দরকার? আপনার কার্যসিদ্ধি হয়েছে, সেটাই যথেষ্ট৷

কোকিলের ডাক আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে৷ গালব কাছে সরে এলেন, একদম পাশটিতে৷ কাঁধে হাত রেখেছেন, পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে৷ এক সময়ে ওই স্পর্শের জন্য উন্মুখ ছিল হূদয়, কিন্তু সেই মুহূর্তে কোনো রোমাঞ্চ অনুভব করলাম না৷ অথচ ওই দৃষ্টি আমার চেনা৷ ওই স্পর্শের ভাষাও৷

শুকনো গলায় বললাম— সংযত হোন ঋষি৷

—কেন?

—এখানে নয়৷ এভাবে নয়৷

—কেন, এই জায়গাটা কী দোষ করল? গালব সবলে আলিঙ্গনে বেঁধে ফেললেন আমাকে৷ কানে কানে ফিসফিস করে বললেন— এ তো অতি মনোরম স্থান৷ নদী গাছ প্রকৃতি…তুমি আর আমি…মনে নেই এখানেই একদিন তুমি আমার সেবা করতে চেয়েছিলে? আজ তোমার জীবনে সেই সৌভাগ্য এসেছে৷ শুভলগ্ন বয়ে যেতে দিও না৷

হঠাৎ কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠল৷ এত বিবমিষা আগে কখনো জাগেনি৷ তিন রাজার সঙ্গে শুয়েও নয়, বিশ্বামিত্রের অঙ্কশায়িনী হয়েও নয়৷

রূঢ় ভাবে বললাম— এত তাড়াহুড়োর কী আছে? আর তো কারও কাছে আমাকে পাঠানোর নেই! চলুন, আপনার আশ্রমে যাই, সেখানে নয় সারা জীবন ধরে আমাকে যত খুশি…

—সারা জীবন ধরে? আমার আশ্রমে? তোমাকে নিয়ে? গালব ছিটকে সরে গেলেন, তুমি কি জানো না, তোমাকে আশ্রমে আর নিয়ে যাওয়া যায় না? আশ্রম অতি পবিত্র স্থান, অন্যপূর্বা নারীকে নিয়ে সেখানে বাস করাটা অধর্ম৷ আমি কোনোভাবেই তোমাকে আমার সহধর্মিণী করতে পারি না৷

বাঃ বাঃ, এই তো যোগ্য উত্তর৷ এরকমটাই তো আশা করা উচিত ছিল৷

তবু কেমন জেদ চেপে গেল৷ বললাম— আমি অন্যপূর্বা নই৷ সন্তান প্রসব করা হয়ে গেছে, এখন আমি আবার কুমারী৷

—তুমি কুমারী৷ গালব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন৷ ওসব গালগল্প তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?

রাগে হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেল৷ চিৎকার করে উঠলাম— যদি জানেনই গালগল্প, একের পর এক পুরুষের কাছে আমায় কুমারী সাজিয়ে পাঠালেন কী করে? এতে অধর্ম হয়নি?

—তুমি নেহাতই বোকা যযাতির মেয়ে৷ এও বোঝ না, মহৎ কারণে ছোটোখাটো ছলনার আশ্রয় নিলে কোনো পাপ হয় না৷ গালব আবার আমায় আলিঙ্গন করলেন, বাজে তর্ক কোরো না৷ এসো আমরা মিলিত হই৷ চিন্তা নেই, তোমার বাবার কাছে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব৷

—কক্ষণো না৷ আপনি ছোঁবেন না আমাকে৷ সরে যান৷

না, এরপর গালব আর আমাকে ছোঁননি৷ বোধ হয় তাঁর মানে লেগেছিল৷ বাবার হাতে নামহীন যযাতির মেয়েকে তুলে দিয়ে চিরতরে বিদায় নিলেন ঋষি গালব৷

এখানেই আমার কাহিনি শেষ হয়ে যেতে পারত৷ বাদবাকি জীবন রাজা যযাতির অন্তঃপুরেই সুখে না হোক শান্তিতে কাটিতে দিতে পারতাম৷ রাজকন্যাদের তো আর পেটের ভাতের অভাব হয় না৷

কিন্তু বিধি বাম৷ মহাপূণ্যবান রাজা যযাতি দু-বেলা কানের কাছে এসে হুসহাস নিশ্বাস ফেলেন, ঘরে অবিবাহিতা মেয়ে রয়েছে বলে তাঁর নাকি রাতে ঘুম হয় না! আরও দুঃখ, মেয়েটা পতিহীন থাকলে মরার পরে স্বর্গে তার নাকি ঠাঁই হবে না! অতএব মেয়েকে পাত্রস্থ করতেই হবে৷ ওদিকে মনে আবার সংকোচও আছে, চারটে বাচচাওলা মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলে অন্য রাজারা হাসাহাসি না করে!

অনেক ভেবেচিন্তে পাঁচ ছেলের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন রাজা৷ শেষ পর্যন্ত নিজেরা নিজেরা একটা উপায়ও বার করে ফেললেন৷ আমাকে ডেকে হুকুম জারি করা হল, প্রস্তুত হও৷ তোমার স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করা হয়েছে৷

আঁতকে উঠে আপত্তি জানাতে গেলাম, কেউ কর্ণপাত করল না৷ গঙ্গা যমুনার সঙ্গমস্থলে প্রয়াগতীর্থে নাকি সভা ডাকা হয়ে গেছে, আমাকে যেতেই হবে৷ তা রাজপ্রাসাদ থাকতে ওখানে কেন? না প্রয়াগতীর্থ অতি পুণ্যস্থান, ওখানে স্বয়ম্বরা হলে আমার দোষ কেটে যাবে৷ বাবা যেটা মুখে বললেন না সেটা হল, দোজবর হোক, তেজবর হোক, একটা বোকাসোকা ভালোমানুষ রাজা কপালে জুটে গেলে এবারকার জীবনটা আমার তরে গেল৷

আজ সেই শুভদিন৷ প্রয়াগতীর্থের এক আশ্রমে আনা হয়েছে আমাকে৷ এখানেই বসেছে স্বয়ম্বর সভা৷ বাবা নিজে আসেননি, রাজকাজে ব্যস্ত৷ হতেও পারে, নাও হতে পারে, সত্যি মিথ্যে আমি জানি না৷ আয়োজনে অবশ্য কোনো ত্রুটি নেই৷ আমার দুই দাদা যদু আর পুরু নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে আশ্রম সাজিয়েছে, রাজকীয় মঞ্চ বানিয়েছে, ফুলে গন্ধে আমোদিত হয়ে আছে দশ দিক৷ লোকলস্কর সেপাই সান্ত্রী ছুটে বেড়াচ্ছে অবিরাম, আগত রাজাদের আপ্যায়নে যেন কোনো ফাঁক না থাকে৷

অবাক কাণ্ড! চার ছেলের মাকে বিয়ে করতে রাজাও কিছু এসেছেন বটে৷ এমনকী নাগযক্ষ গন্ধর্বরাও উপস্থিত৷ এত লোক আমাকে পেতে আগ্রহী? কেন? রাজার মেয়ে বলে? নাকি পুত্রদায়িনী সুলক্ষণা মেয়েমানুষ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছি তাই?

একটু আগে সখীরা আমায় বধূসাজে সাজিয়ে দিল৷ ঋষিকন্যারা বরমালা গেঁথে ধরিয়ে দিয়েছে হাতে, এবার সভায় গিয়ে পছন্দসই কাউকে পরাতে হবে সে মালা৷

কাকে পরাব এই মালা? কোনো হর্ষশ্ব দিবোদাস উশীনর অথবা বিশ্বামিত্রকে? অথবা কোনো গালবকে? এদের একজনকেও না বাছার স্বাধীনতা আজ আমার আছে, কিন্তু তার পর? বাবার কাছে থাকা, সেও তো এক পুরুষের আশ্রয়েই বাস৷ বাবা মারা গেলে ভাইয়ের আশ্রয়, তারাও তো পুরুষ৷ অপেক্ষা করব ছেলেরা কবে বড়ো হয়ে মাকে নিয়ে যাবে? হায়, ততদিনে তারাও তো এক একটা আস্ত পুরুষমানুষ হয়ে যাবে!

কোনো পথ নেই? কোনো পথ নেই?

জঙ্গলে চলে যাব? বাঘ ভাল্লুক শিয়াল কুকুরদের জগৎ কি মানুষের সমাজের চেয়ে হীন কিছু হবে?

ভাবছি আমি৷ ভাবছি, ভাবছি…

মালা আমার হাতেই শুকিয়ে গেল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *