“আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
চৈত্রবংশীয় রাজা সুরথ তাঁর প্রজাদের সন্তানস্নেহে পালন করছিলেন। রাজা হিসাবে অতুলনীয়। বিরল এক উদাহরণ। সহসা কোলাবিধ্বংসী যবনরা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে সব ছারখার করে দিল। রাজা এলেন বনে। সেই নির্জন অরণ্যে তিনি এক সঙ্গী পেলেন।
কে আপনি?
আমার নাম সমাধি। আমি একজন ধনী ব্যবসায়ী। স্ত্রী, পুত্র, পরিজন সবই আছে।
তাহলে এই অরণ্যে কেন? বৈরাগ্য?
না, আমার সব কেড়ে নিয়ে স্ত্রী-পুত্ররা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। মনের দুঃখে চলে এসেছি বনে।
কিন্তু! এই ‘কিন্তু’তেই আছে ‘দেবীমাহাত্ম্য’। রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি দুজনেই অবাক, রাজ্যচ্যুত রাজা বনে এসেও প্রজাদের কথাই ভাবছেন, আর বিতাড়িত সমাধি ভাবছেন স্ত্রী-পুত্র, পরিজনের কথা। রাজার মন থেকে রাজত্ব যাচ্ছে না, বৈশ্যের মন থেকে যাচ্ছে না পরিবার-পরিজন! এ কী জ্বালা!
অরণ্যের এক প্রান্তে মেধস মুনির তপোবন। রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি সেই মুনিকেই প্রশ্ন করলেন, বিতাড়িত হয়ে বনবাসী, কেউই আমাদের চায় না। আমি রাজা, রাজত্ব গেছে, রাজ-অমাত্যগণ সুযোগ বুঝে আমাকে পরিত্যাগ করেছেন, তবু আমি তাঁদের চিন্তায় অধীর; আর এই বৈশ্য, স্ত্রী-পুত্র বিশ্বাসঘাতকতা করে সব কেড়ে নিয়েছে, কপর্দকশূন্য, বনবাসী, তবু স্ত্রী-পুত্রের চিন্তায় কাতর। আমাদের দুজনের এই অবস্থা কেন?
মুনি সব শুনে কিঞ্চিৎ হাসলেন! বললেন : “তথাপি!” তথা অপি–তবুও কি সেটা? চিত্তের এবম্বিধ বৈকল্যের আদি কথাটি কি? মুনি বসে আছেন তাঁর প্রশান্ত কুটিরে, সামনে দুই শ্রোতা। মুনি বলছেন, শুনুন রাজা, সব প্রাণীরই বিষয়জ্ঞান আছে। শুধুমাত্র মানুষই বিষয়কাতর নয়। পাখিকে দেখুন, শাবককে খাওয়াচ্ছে, তাতে তার নিজের খিদে যাচ্ছে না কিন্তু। মোহের বশে শাবকের ঠোঁটে শস্যকণা গুঁজে দিচ্ছে। পাখি জানে, ডানায় ওড়ার শক্তি এলেই উড়ে যাবে। পাখির কোন প্রত্যাশা নেই, একমাত্র মানুষই প্রত্যুপকারের লোভে পুত্রাদির প্রতি অনুরক্ত হয়। মানুষ তো শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, তথাপি—
“তথাপি মমতাবর্তে মোহগর্তে নিপাতিতাঃ।
মহামায়াপ্রভাবেণ সংসারস্থিতিকারিণা।।” (চণ্ডী, ১।৫৩)
সংসারের স্থিতিকারিণী কে? মহামায়া। মহামায়ার প্রভাবে সমস্ত জীব মোহরূপ গর্তে, মমতারূপ আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়। সংসারের ‘ব্ল্যাক হোল’। টেনে নেয়। কোথা দিয়ে কেমন করে জীবন কেটে গেল, বোঝার আগেই মৃত্যু এসে কেশ ধরে। চল ভাই, বাড়ি যাই। খেল খতম পয়সা হজম।
ঠাকুর একটি গান গেয়ে এটি বোঝাতেন—
“এমনি মহামায়ার মায়া রেখেছে কি কুহক করে।
ব্ৰহ্মা বিষ্ণু অচৈতন্য জীবে কি জানিতে পারে।।” [কথামৃত, উদ্বোধন সং, ১৯৮৬, পৃঃ ১২০]
মেধা মুনি বলছেন, রাজা জ্ঞান-বিজ্ঞানে কিছুই করতে পারবে না—
“জ্ঞানিনামপি চেতাংসি দেবী ভগবতী হি সা।
বলাদাকৃষ্য মোহায় মহামায়া প্রযচ্ছতি।।” (চণ্ডী, ১।৫৫)
—বিবেক কি করবে? মহামায়া বিবেকিগণের চিত্তকেও ‘বলাদাকৃষ্য’ বা বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহাবৃত করেন। ঠাকুরের গাওয়া ঐ গানের রচয়িতা কুমার নরচন্দ্র।
“বিল করে ঘুনি পাতে মীন প্রবেশ করে তাতে।
গতায়াতের পথ আছে তবু মীন পালাতে নারে।।
গুটিপোকায় গুটি করে পালালেও পালাতে পারে।
মহামায়ায় বদ্ধ গুটি, আপনার নালে আপনি মরে।।”
ঠাকুর ব্যাখ্যা করেছেন ভক্তদের কাছে, সে-ব্যাখ্যা আরো মনোগ্রাহী। সংসারে বদ্ধজীবের কথা বলছেন। “তারা যেন গুটিপোকা, মনে করলে কেটে বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু অনেক যত্ন করে গুটি তৈয়ার করেছে, ছেড়ে আসতে পারে না, তাতেই মৃত্যু হয়। আবার যেন ঘুনির মধ্যে মাছ। যে-পথে ঢুকেছে, সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু জলের মিষ্ট শব্দ আর অন্য অন্য মাছের সঙ্গে ক্রীড়া, তাই ভুলে থাকে, বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করে না। ছেলে-মেয়ের আধ আধ কথাবার্তা যেন জলকল্লোলের মধুর শব্দ। মাছ অর্থাৎ জীব, পরিবারবর্গ। তবে দু-একটা দৌড়ে পালায়, তাদের বলে মুক্তজীব।”[কথামৃত, উদ্বোধন সং, ১৯৮৬, পৃঃ ১২০]
রাজা সুরথ মেধস মুনিকে প্রশ্ন করছেন, কে সেই দেবী, যাকে আপনি মহামায়া বলছেন? আমরা যে তাঁর বৃত্তান্ত শুনতে চাই। মুনি বললেন :
“নিত্যৈব সা জগন্মূর্তিস্তয়া সর্বমিদং ততম্।
তথাপি তৎ সমুৎপত্তিবহুধা ক্রয়তাং মম।।” (চণ্ডী, ১।৬৪)
তিনি নিত্যা, তাঁর জন্ম বা মৃত্যু নেই, তিনি বিশ্বচরাচরে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন। তবু দেবতাদের কার্যসিদ্ধিতে তিনি কখনো কখনো আবির্ভূত হন। মুনিবর অতঃপর মধুকৈটভ, মহিষাসুর ও শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের উপাখ্যান সবিস্তারে বললেন। হে রাজন! এই সেই দেবী মহামায়া, জগৎ পরিপালন করছেন— “তয়ৈতন্মোহ্যতে বিশ্বং”। তোমাদের তিনিই মোহিত করেছেন—”তামুপৈহি মহারাজ শরণং”। তাঁর আরাধনা করুন। ভোগ, স্বর্গ, অপবর্গ সবই তিনি দিতে পারেন।
ঠাকুরও একই কথা আমাদের জীবনের মতো করে বলেছেন—যুদ্ধ করে মায়াকে জয় করা যায় না। প্রার্থনা করতে হয়, কৃপা করে পথ ছাড়ুন, আরেকটু সত্যদর্শন হোক। “এ-সংসার তাঁর মায়া। মায়াতে সৎ বা নিত্য অসৎ বা অনিত্য বলে মনে হয়। মায়ার কাজের ভেতর অনেক গোলমাল, কিছু বোঝা যায় না।
ঠাকুর আরো কাছে আসছেন, ভবরোগের ডায়াগনোসিস প্রায় সম্পূর্ণ। বলছেন : কাম-কাঞ্চনই মায়া। “মায়াকে যদি চিনতে পার আপনি লজ্জায় পালাবে। হরিদাস বাঘের ছাল পরে একটা ছেলেকে ভয় দেখাচ্ছিল। যাকে ভয় দেখাচ্ছিল সে বললে, ‘আমি চিনেছি, তুই আমাদের হরে।’ তখন সে হাসতে হাসতে চলে গেল।”
ঠাকুর আমাদের ‘পজিটিভ’ চিকিৎসার কথা বলে গেলেন, যা হয়তো অন্যে বলেননি। পলায়নের পরামর্শ নয়, জলেই থাক তবে জালে পড়ো না। মায়ার ‘ক্লাসিফিকেশন’ করলেন—”মায়া দুই প্রকার—বিদ্যা এবং অবিদ্যা। তার মধ্যে বিদ্যামায়া দুই প্রকার-বিবেক এবং বৈরাগ্য। এই বিদ্যামায়া আশ্রয় করে জীব ভগবানের শরণাপন্ন হয়। আর অবিদ্যা মায়া ছয় প্রকার—কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ এবং মাৎসর্য। অবিদ্যা মায়া ‘আমি’ ও ‘আমার’ জ্ঞানে মনুষ্যদিগকে বদ্ধ করে রাখে। কিন্তু বিদ্যা মায়ার প্রকাশে জীবের অবিদ্যা একেবারে নাশ হয়ে যায়।” যে মারতে আসছে তাকেই বলা, বাবা তোমার সঙ্গে পারব না। তেলো- ভেলোর মাঠে মা বললেন : “বাবা, আমি তোমার মেয়ে সারদা। দক্ষিণেশ্বরে তোমাদের জামাই থাকে। সঙ্গীসাথীরা ফেলে চলে গেছে।” সংহারক শুধু রক্ষক নয় তখন, সেবক। পথপ্রদর্শক। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীমাকে ঠাকুরের সুপ্রসিদ্ধ প্রশ্ন : “তুমি কি আমাকে সংসারপথে টেনে নিয়ে যেতে এসেছ?” সুস্পষ্ট প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর—তা কেন? আমি তোমার ধর্মপথের সহায় হতে এসেছি—আমি তোমার সহধর্মিণী।
তাহলে বস এই আসনে, তিন মাকে এক করি। নাও আমার সব সাধনা, জপের মালা। আমি শিব। শব। তুমি শিবা। মায়া—মহামায়া থেকে মহামায়ী।
নদীর ধারে মৃন্ময় মূর্তির সামনে রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি। তিন বছরের একাগ্র সাধনায় তুষ্ট হলেন দেবী।
কি চাও?
রাজা চাইলেন হৃতরাজ্য। আর সবচেয়ে সেরা জিনিস চাইলেন সমাধি বৈশ্য—
“সোঽপি বৈশ্যস্ততো জ্ঞানং বরে নির্বিঘ্নমানসঃ।
মমেত্যহমিতি প্রাজ্ঞঃ সঙ্গবিচ্যুতিকারকম্।।” (চণ্ডী, ১৩।১৮)
‘আমি’ এবং ‘আমার’–এই অজ্ঞান নাশ করে দাও দেবী।
ঠাকুর বলতেন : “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল।” কাশীপুরে অসুস্থ শরীরে দোতলা থেকে নিচের উদ্যানে নেমে এলেন ঠাকুর, হাতে তাঁর অকৃপণ সম্ভারের ডালি, যে যেখানে আছ, নাও, নাও–চৈতন্য হও।