2 of 2

আমি ভালো নেই, তুমি? – কিন্নর রায়

আমি ভালো নেই, তুমি? – কিন্নর রায়

মন ভালো নেই

এক আকাশ মেঘ, তবু গলে বিষ্টি পড়ে না। হাওয়ায় ঠান্ডা মিশে আছে। সস্তা মেসের চৌকিতে পাশ ফিরতে-ফিরতে রবি এসব দেখল। ঘরের ভেতর ঝুলঝাঁপ্পি অন্ধকার। কোথাও-কোথাও মিয়োনো আলো লেগে। বালিশের তলা থেকে হাতঘড়ি টেনে দেখল আটটা কুড়ি। তার মানে অনেকটাই বেলা। আর তখনই কোথা থেকে যেন ভেসে এল, ‘তুমি একলা ঘরে বসে-বসে কী সুর বাজালে।’ প্রায় সকালেই কোনও-না-কোনও গানের লাইন এভাবে মাথায় ঢুকে সারাদিন বেজে যায়। বেজে যায়।

দক্ষিণ কলকাতার এই প্রাচীন দোতলা মেসের দোতলার বাঁ-দিকের ঘরে রবি ছাড়া আরও দুজন থাকে। ডাইনের ঘরে লাদাই করা পুরোনো ভাঙাচোরা চেয়ার, চৌকি, ট্রাঙ্ক। সেখানে অন্ধকার অনেক গাঢ়। রবির এ-ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় আকাশ, সি. এম. ডি. এ.-র ঘটঘটাং। বাস-ট্রাম, মানুষজন। এ-ঘরে রবি প্রায় বছর-পাঁচেক। সিট-রেন্ট পঁচাত্তর। খাওয়া-দাওয়া বাইরে। এত সস্তায় সিট পাওয়ার পিছনে রবি যে-কাগজের করেসপনডেন্ট, তার চিফ রিপোর্টারের কৃতিত্ব। পাকা চাকরির ব্যবস্থা না করলেও তুতিয়ে-পাতিয়ে একটা সিট—।

গানের দুটো লাইন রবির মাথার ভেতর। বিছানা ছাড়তে-ছাড়তে দেখতে পায় বোসদা আর ভটচায্যিবাবু আগেই উঠে পড়েছেন। একজন সরকারি আপিসের কেরানি। অন্যজন বিমা কোম্পানির এজেন্ট। সাইড ইনকাম লটারির টিকিট বিক্রি।

বোসদার সরকারি আপিস, সময়ের বালাই নেই। এগারোটার আগে বেরোন। ভদ্রলোকের ধারণা তিনি পলিটিকসের সবটা বোঝেন। খান তিন/চার ইংরেজি, বাংলা কাগজ পড়েন খুঁটিয়ে। রবি যে-বাংলা দৈনিকের করেসপনডেন্ট, তাকে উঠতে-বসতে গালাগালি। এসব গায়ে মাখলে চলবে না, এ ভেবে রবি হাসে। মাঝে-মাঝে মদ্যপান করেন বোসদা। মাসের প্রথম দশ দিনের দু-দিন কাগজে মুড়ে পাঁইট আনেন। বিলিতি। সাধারণত রাম। তারপর চান করে কাচা-কাপড় পরে চুলটুল আঁচড়ে গেলাস-বোতল নিয়ে বসেন। সিগারেট পোড়ে। নীচের দোকান থেকে আনান কাটলেট। পঁয়তাল্লিশ পেরুনো বোসদাকে কখনও বাড়ি যেতে দেখেনি রবি।

ভটচায্যিবাবু বিমার লোক। চল্লিশের মধ্যে বয়েস। বয়েসের তুলনায় অনেকটা গম্ভীর। দিনরাত হিসেব কষেন। ঘন-ঘন সিগারেট খান। এন্টারটেইনমেন্ট বলতে সিনেমা দেখা—তাও উত্তম-সুচিত্রার পুরোনো বাংলা ছবি হলেই ভালো। মন ভালো থাকলে দরাজ-গলায় সেইসব ছবির গান গেয়ে যান। বর্ধমানে বাড়ি। এখনও বিয়ে করেননি।

রবি জানে, ভটচায্যিবাবুর পাইলস আছে। বাথরুম সারতে দেরি হয়। তাই এখনই চেষ্টা না করে একবার মোড়ের মাথা ঘুরে আসার কথা ভাবল।

রোজ সকালে এই এক টেনশন। নিজের কাগজ আর অন্য সব কাগজ মিলিয়ে দেখা। কোনও খবর বাদ গেল কি না। বিশেষ করে ওর এলাকার। কাগজে-কলমে রবি সাউথ সুবারবন করেসপনডেন্ট। মাস গেলে রোজগার সাকুল্যে চারশো। এক কলম ছাপা হলে দশ টাকা। রিটেনারশিপ দেড়শো। তাও ভাউচার পেতে-পেতে প্রতি মাসেই সাত/আট হয়ে যায়।

আকাশের মেঘ এখন একটু ফিকে। দরজা টেনে রবি রাস্তায়। মুখে পেস্ট লাগানো ব্রাশ। তার খবর করার এলাকা বলতে রবীন্দ্রসদনের পর থেকে সুন্দরবন, সাগরদ্বীপ। চিড়িয়াখানার লিটিগনের বাচ্চা থেকে শুরু করে ক্যানিংয়ে নৌকোডুবি—যে-কোনও একটা ফসকালেই গেল। চিফ রিপোর্টার সুজয় সেনের গালাগালি।

এসপ্লানেড ইস্টের মিটিং-সমাবেশ, মিউজিয়ামে এ-মাসের প্রদর্শনী—এসবও কখনও-সখনও লিখতে হয় রবিকে। তখন খবরের আগে লেখা হয় নিজস্ব প্রতিনিধি। দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা লিখলে বাকি স্টাফ রিপোর্টাররা চেঁচিয়ে ডেস্ক ফাটায়।

রবি রাসবিহারীর মোড়ে প্লাস্টিক চাপা সরিয়ে সব কটা কাগজ একে-একে নাড়ল। নাহ, খবর মিস হয়নি। নিজের কাগজে চিফ মিনিস্টারের মিটিং-এর স্টোরি প্রথম পাতায় ডবল কলম। ভালো লাগল। মনে-মনে খবরের লম্বাই মাপে। প্রায় কলম-দেড়েক, তার মানে টাকা-পনেরো। ফুল নিশ্চয়ই দেখবে। ওর মা-ও। রবি জানে, ফুলদের বাড়ি এ-কাগজ কেনে। আর তখনই কোনও না-জানা কারণে তার মন খারাপ হয়ে যায়।

ঝুপ-ঝুপ বিষ্টি এল।

তাড়াতাড়ি প্লাস্টিক দিয়ে সব কাগজ ঢাকল রবি। হকারটি ওকে চেনে। তার ফলে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলে না। বিষ্টি তেমন জোরে নয়, তবু হাঁটতে ভালো লাগছে না। একটু এগিয়ে সিগারেটের দোকান। এক প্যাকেট চার্মস নিল। একটা দেশলাই। দশ টাকার নোট, তবু ভাঙানো গেল না। কী যে খুচরোর আকাল এখন! এ নিয়ে অন্য কাগজে স্টোরিও বেরিয়েছে। দশ পয়সা দু-পয়সা গালিয়ে তৈরি হচ্ছে সব চেন। বাসে-বাসে দু-টাকা করে বিক্রি। রবির কাগজ ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। স্টোরিটা নিজের কাগজে দিতে পারলে কদর বাড়ত।

সিগারেট নেওয়া হল না। বিষ্টি এখন সহস্রমুখী ধারা। শব্দ ওঠে ঝমর ঝম। আজ জুনের বারো। আটই জুন বর্ষা আসার কথা। তার মানে ঠিক সময়েই মৌসুমী বাতাস। রবির মাথায় সকালের সেই সুর—’তুমি একলা ঘরে বসে-বসে’…। দ্রুত মেঘমল্লারে আলাপ জমায় কোনও ওস্তাদ, এমনই বিষ্টির পতনধ্বনি। তারপরই রোদ হাসে। আষাঢ়ের আকাশে রোদের কদম ফুল। রবি বুঝতে পারে না এই প্রকৃতি, এই নারী। দুজনকেই বসায় এক আসনে। এই আলো, এই অন্ধকার। এই হাসি, এই বিষাদ। মনখারাপ গাঢ় হয়।

কাদামাখা রাস্তা, গাড়ির চাকা ছেটকানো নোংরা জল-কাদা বাঁচিয়ে পা টিপে-টিপে মেসে আসে। সিঁড়ির কোণে, বাঁকে তখন আঁধার ঝুলে আছে। ঘরের দরজা হাঁ। ভটচায্যিবাবু গুন-গুন করছেন, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন/ কবে যাব / কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।’ রবি বুঝতে পারে, আজ ওঁর বাথরুম ক্লিয়ার। একটু আগে চান সেরেছেন। জুলফির নীচে, ঘাড়ে স্নানজলের বেয়ে আসা স্মারক। বোসদা নিজের চৌকিতে আধশোয়া। খালি গায়ে ‘টেলিগ্রাফ’ পড়ছেন। আড়চোখে রবিকে দেখে মুখ তুললেন। তারপর বললেন, আরে দ্যাখো, দ্যাখো। পেজ লে আউট কাকে বলে! কী ছাপা! রবি চুপ। কথার মোড় ফেরায়—একটা সিগারেট দিন তো, বোসদা। মিত্যুন বোস নড়েন। ওঠেন। দেওয়ালে ঝোলানো জামার পকেট থেকে প্যাকেট এনে ছুড়ে দেন রবির দিকে। রবি সিগারেট নেয়। দেশলাইও জ্বালে। ঘরের বাতাস ধোঁয়ার গন্ধে একটু অন্যরকম। নিজের কোঁচকানো ময়লা বিছানার চাদর, তেলচিটে তোশক, বালিশ গুটিয়ে চৌকির ওপর ডাঁই করতে-করতে রবি বলে, বোসদার কি আজ রেইনি ডে?

বাইরে আবার বিষ্টি নামে। রবির মাথায় সেই পাগল-করা গানের সুরের পাক। প্রায় তিরিশ ছোঁয়া তার শরীর চৌকির ওপর থেবড়ে বসে। অনুকূল ভটচায্যি তখন গলা ছেড়ে গাইছে রিমঝিম বিষ্টি / মাটির কানে কানে কী আশা নিয়ে যায় ঝরে…।’ ঘনায়মান অন্ধকার তিনটি বয়েস একসঙ্গে ঢাকে।

সাজানো বাগান

পুলক একসময় নকশাল করত। এখন বাগান করে। কলকাতার ইদানীং এ এক উটকো ফ্যাশান। ‘গাছ লাগান শহর বাঁচান’—এই স্লোগান দেওয়ালে লেখা হয় ক (ই)-র রাইটার্স অভিযান বা সিটুর কলিকাতা জেলা সম্মেলনের পাশাপাশি।

রাসবিহারী মোড় ছাড়িয়ে ক্যাওড়াতলার দিকে যেতে ডান-হাতের ফুটপাতের লাগোয়া শিখ গুরুদ্বার। পাশের গুরুদ্বার পার্কে এখন পাতাল রেলের দৌলতে দিন-রাত্তির ঘট-ঘটাং। ঘটাং-ঘট। হুড়ুম-দুড়ুম। বক্সিং-রিং, বিকেলে বসা, বেড়ানো, মিষ্টি-মিষ্টি প্রেম করা—সব এখন চৌপাট। এর গা-লাগোয়া বড়সড় বাঁধানো ডাস্টবিন। তারপরই পুলকদের ফুটপাত-বাগান ‘সবুজ-স্বপ্ন’। নাম রবির দেওয়া।

পুলক জানে, এই প্রথম বর্ষা মাটি তৈরির সময়। এখন জিনিয়া-কোচিয়া-গ্যালাডিয়া-গমফরেনার চারা তৈরি হচ্ছে। আর দোপাটির চারাও। জুলাইতে তৈরি হবে ছোট চন্দ্রমল্লিকার কাটিংস। অগাস্টে বড় চন্দ্রমল্লিকার। ছোট চন্দ্রমল্লিকা বলতে পমপম। বড় জাত—স্নোবল, সিমসন, কিউ কি বেরি, আর সি প্রিন্স।

আকাশে ঝুড়ি-ঝুড়ি মেঘ। পুলক নজর দিল বাঁদরের খাঁচায়। তিনটে বাঁদর। রড ধরে কিচিকিচি। পাশে পাখি আর ভাল্লুকের থাকার জায়গা। বাঁদরের খাঁচার পাশে দু-চারজন। বেলা বাড়লে ভিড় আরও বাড়বে। মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম দ্যাখে মদন। ভাল্লুক-বাঁদরের খাঁচা পুতান। পাখির দেখাশুনো বাচ্চু।

পুলক গাছে ডুবে থাকে। ফুটপাতের এ-বাগানে বড়সড় কৃষ্ণচূড়ার ডালে নানারকম মশলা আর নারকেলের ছোবড়া দিয়ে অর্কিড বাঁধে। পুলক জানে, বড় চন্দ্রমল্লিকায় লাগে রেড়ির খোল। মাটি তৈরি তিন+এক+এক—এই ভাগে। তিন ভাগ মাটি, এক ভাগ গোবর, এক ভাগ পাতা, কিছুটা চুন। টবে চারা দিতে গেলে লাগে ওই ভাগের সঙ্গে দু-চামচ হাড়ের গুঁড়ো।

তিনটে ময়ূর আছে পাখির খাঁচায়। একটা ময়ূর, দুটো ময়ূরী। পুলক দেখল, আকাশে মেঘের ডিজাইন দেখে পাখা খুলেছে ময়ূর। আবছা আলো লেপটে আছে রংচঙে পাখনার গায়ে। টানা লম্বা তারের জাল ঘেরা জায়গায় ওড়া-উড়ি প্র্যাকটিস করে কয়েকটা পাখি। তাদের উড়ুক্কু ডানায় আঁধার-মাখা আলো বিঁধে যায়। মোটা লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে নাক বের করে ভাল্লুক। নাম শর্মিলা। কয়েকদিন আগেও পুলক ওকে ঘাড়ে-কাঁধে করে পাড়ায় ঘুরেছে। তার ঘাড়ে চড়া ভালুক দেখে তেড়ে এসেছে একপাল কুকুর। নেড়িদের কী ডাকাডাকি! বইতে লেখা ‘ভালুক জানে বাসতে ভালো’ কথাটা কতটা সত্যি জানা নেই, তবে পুলকের সঙ্গে তার অন্য সম্পর্ক। ইদানীং শর্মিলার—যার ডাকনাম শর্মি—নখ অনেক তীক্ষ্ন ও বড়, মুখ দিয়ে লালা ঝরে, তাকে কাঁধে তুলে ঘোরা যায় না। বর্ষার মেঘ, বিষ্টির জল শর্মিকে অস্বস্তিতে ফেলে। বারবার খাঁচার কোণে সিমেন্টের গুহায় ঢুকে যায়। হাওয়ায় বনের গন্ধ ভাসে।

পুলক বাগানের মাটি তৈরি করে। ঘাস তুলে ফ্যালে। রবার গাছের ডালে কলম বাঁধে। গাছের ডালের ছাল গোল করে তুলে সারিডেক্স পাউডার ছড়িয়ে পাতা-মাটি-গোবর সারের মিলমিশ দিয়ে-দিয়ে বেঁধে ফেলা। তার ওপর পাতলা প্লাস্টিকের মোড়ক। ক’দিনের মধ্যেই কলম তৈরি হবে। এখান থেকে হাত-দশেকের ভেতর অন্য ফুটপাত বাগান ‘স্বর্গোদ্যান’-এ রাজহাঁস ডাকছে। এখানে আর জায়গা নেই। না হলে একজোড়া রাজহাঁসও রাখা যেত।

খুব দ্রুত নাচতে-নাচতে একদল মড়া নিয়ে গেল। ভিজে রাস্তায় খই খুঁটে খাওয়ার কাক নেই। বর্ষার জল-বাতাস মুহূর্তে খইদের সাদা চন্দন মাখা শ্বেত পুষ্প বানিয়ে ছাড়ল। হরিবোলের শব্দ সোজা যেতে-যেতে ঢুকে গেল বাঁয়ে। বিষ্টি জোরে নেমেছে, বড় কৃষ্ণচূড়ার তলায় দাঁড়িয়ে পুলক তার পড়ে যাওয়া দেখছে। বিষ্টির ফোঁটায়, হাওয়ায়, মানিপ্ল্যান্টের বড়সড় পাতা কাঁপছে। সাড়ে দশটার এস সতেরো ডিগডিগ করে চেতলা ব্রিজ পেরিয়ে ‘সবুজ-স্বপ্ন’র একটু আগে থামল। কোনও প্যাসেঞ্জার হাত দেখিয়েছে। আর বাসের পিছন থেকে ছাতা মাথায় বেরিয়ে এল পুতান।

বর্ষায় চেক-কাটা পাজামা বাঁ-হাতে মুঠো করে একটু ওপরে তুলে রেখেছে। আধময়লা হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি, হাওয়াই চপ্পল। পাজামার পিছনে পাঞ্জাবির একেবারে পায়ের কাছে অজস্র চপ্পল ছেটকানো কাদার ফোঁটা। গাছের পাতা-ঝরা জলে পুলকের দু-কাঁধ ভেজে। বিষ্টি বোধহয় আরও জোরে এল। পুতানের সামনে ছাতার চারপাশে বিষ্টির জরি, যেমনটি সরস্বতী ঠাকুরের সামনে। সিগারেটের ফালি দোকানের সামনে দাঁড়াল পুতান। সিগারেট নিল, ধরাল। বিষ্টি-ভেজা কলকাতার হাওয়ায় ধোঁয়া মিশিয়ে হেঁটে এল ‘সবুজ-স্বপ্ন’-এ। গেট খুলে ভেতরে।

শর্মিকে সকালে কোনওরকমভাবে একবার খাবার দেওয়া হয়েছে। তবু পুতানের এসে দাঁড়ানো, গলার শব্দ, ছাতা দিয়ে গরাদে আওয়াজ করা—সব মিলিয়ে শর্মি চঞ্চল। ঘরের ভেতরে চারপায়ে পায়চারি চলে। কখনও গরাদ ধরে দু-পায়ে দাঁড়িয়ে ওঠা। গলায় আদর-শব্দ। পুতান শর্মির গলার তলায় হাত রাখে। তার আঙুল লোমের ভেতর খেলে। কৃষ্ণচূড়ার ছায়া থেকে পুলক বলে, সিগারেটের কাউন্টারটা দিস। পুতান একহাতে ছাতা ও সিগারেট সামলায়। শর্মির শরীর থেকে আঙুল সরিয়ে এনে সিগারেটের হাত-বদল করে। টানে। তারপর এগিয়ে এসে পুলককে বাড়ায়।

তুই কি জানিস, ‘স্বর্গোদ্যান’-এর ছেলেরা লটারি করছে! ফার্স্ট প্রাইজ ভারত টি. ভি., সেকেন্ড প্রাইজ বি. এস. এ. রানিং সাইকেল, থার্ড প্রাইজ টাইমপিস। এ ছাড়া একশোটা সান্ত্বনা পুরস্কার। একটা টিকিট তিরিশ পয়সা। আমাকেও একটা একশো পাতার বই গছাবে।

পুতানের কথায় পুলকের উত্তর নেই। সিগারেটে টান দিতে-দিতে বলে, ওসবে অনেক ফ্যাচাং। পাবলিক মানি মানেই বিলা কেস। এর থেকে ভালো একটা সিনেমা শো করা। নগদা-নগদি লাভ। পুরোনো ভালো হিট বই আনলে কথাই নেই। ধর না ‘পথের পাঁচালি’ বা ‘জলসাঘর’। রবিকে ধরলে ও তাড়াতাড়ি করিয়ে দিতে পারবে। রিপোর্টার বলে কথা।

‘পথের পাঁচালি’ বা ‘জলসাঘর’ দারুণ ফিল্ম। কিন্তু কোনওদিনই হিট করেনি। এখন তবু ভিড় হয়। তারচেয়ে আনতে হলে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘লালপাথর’, ‘শাপমোচন’—এরকম বই আনলে পাবলিক অনেক বেশি নেবে। দ্যাখ সেটা ভেবে!

সত্তর/একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রামের পর দীর্ঘ জেলজীবন, পঁচাত্তরের এমারজেন্সি আর সাতাত্তরে হঠাৎ বেরিয়ে আসার পর গাঢ়ভাবে কিছু ভাবনা পুলকের মাথায় ধারাবাহিকভাবে খেলে না। তবুও এই বাগান—’সবুজ-স্বপ্ন’, গাছেদের বেড়ে ওঠা, অ্যাকোয়ারিয়ামে পোষা মাছেদের প্রাত্যহিক জীবন পুলককে ভুলিয়ে রাখে। লুকিয়ে রাখে। কিছু করছি না—এ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সে আত্মগোপন করতে চায় বৃক্ষের বেড়ে-ওঠা, বাঁদরের কিচিকিচি, পাখিদের ওড়া-উড়িতে। তবুও কয়েকদিন আগে স্থানীয় একটি বড় বাড়ির ঝি-র হত্যা না আত্মহত্যার ব্যাপার নিয়ে লোকাল থানা অফিসারের সঙ্গে তার গলাবাজি হয়।—যান, যান, লিডারি মারবেন না। আপনার মতো অনেক পাতি নকশালের পোঁদে হাত ভরে এখানে এসেছি—এ-কথা শোনার পর পুলক সামান্য দমে। থানার ঝুঁঝকো অন্ধকার, অফিসারের জন্তুময় মুখ, ধাড়ি কোনও কনস্টেবলের গোঁফ-পাকানো তাকে সেই নিহত স্মৃতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। যখন যুবকদের দেওয়ালে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হচ্ছে। লক-আপে, জেলখানায় নরকের উল্লাস।

বাস্তব থেকে এই পালিয়ে-থাকার ফাঁকে পুলক কলকাতা ফিল্মোৎসবের ‘তান্নির তান্নির’ ও সথ্যুর ‘বারা’—ছবি দুটি দ্যাখে। ‘তান্নির তান্নির’ দেখার পর এক আশ্চর্য বিপ্লবী শিহরন বয়ে যায়। সে বাড়িতে এসে লেনিনের ‘কী করতে হবে’ ঝাড়পোঁছ করে পড়তে বসে। তিনদিন পর আবার তার আশ্রয় হয় ‘সবুজ-স্বপ্ন’-র বৃক্ষরা। গাছের নড়াচড়া, বাড়বাড়ন্ত, পাতা-পড়া ও গজিয়ে-ওঠা দেখতে-দেখতে সে রহস্যে ডোবে। মাটিতে চারা লাগায়।

বৃষ্টির লাগাম কেউ টেনে ধরেছে। আকাশ মেঘে মাখামাখি। পুতান ও পুলক বাগানের বাইরে ফুটপাত-লাগোয়া কাঠের বেঞ্চিতে বসে। পুতান এ পর্যায়ে দু-নম্বর সিগারেট ধরায়। বলে, প্রূডেনশিয়াল কাপে ইন্ডিয়া ভালোই খেলছে। মনে হয়, আরও ভালো খেলবে। জিতবেও।

ভারত জিতুক চায় নাই জিতুক, সদ্য তিরিশ পেরুনো পুলকের কাছে ব্যাপারটা তেমন কিছু জরুরি মনে হয় না। আসামে ব্যাপক গণহত্যা ও বামপন্থীদের ন্যাকড়াবাজি, পাঞ্জাবে আকালিদের যাবতীয় কাজকর্ম তাকে উদ্বুদ্ধ করে না। সংকটের গভীরে টানে। পুলক বুঝতে পারে না, কী করা দরকার। স্বর্গোদ্যানের মতো লটারি না সিনেমা শো—কোনটাতে ‘সবুজ-স্বপ্ন’ কিছু পয়সার মুখ দেখতে পারে তা ভেবে ভোম মেরে বসে থাকে।

বেলা বাড়ে। বর্ষা-দিনের সময় বোঝা যায় না। দু-একটা এটা-সেটা কথা বলে পুতান বলে, চলি রে!

পুলকের ফেরার ইচ্ছে জাগে না। বাড়িতে বিধবা মাকে দেখে তার কোনও প্রাচীন বৃক্ষের কথাই মনে হয়। যার শেকড় জড়িয়ে-টড়িয়ে রেখেছে সংসার-পাট। ঘর-গেরস্থালি। পুলক আবার বাগানে ফেরে। পুরোনো ঢোলা প্যান্ট গুটিয়ে কৃষ্ণচূড়ার আশপাশে মাটির ওপর দু-চোখ রাখে। মায়া বাড়ে।

খবর এসেছে

সাবেককালের কাঠের সিঁড়ি। বেয়ে-বেয়ে উঠলেই বিজ্ঞাপনের লোকজন। লম্বা করিডর। ম্যানেজিং ডিরেক্টর, এডিটরের ঘর ছাড়ালেই সাব-এডিটর, রিপোর্টারদের ঘর। সিঁড়িতে ছাতা বন্ধ করতে-করতে রবি দেখল, সিঁড়ি-লাগোয়া দেওয়ালে এ-কাগজের প্রাচীন কত্তা-ব্যক্তির অয়েল পেন্টিংয়ে পায়রার গু। সিঁড়ির কোণেও পায়রাদের অপকম্ম।

হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে নন্দ বেয়ারা। রবিকে দেখেই বলল, আপনার ছাতাটা দেবেন? মোড়ের মাথায় যাচ্ছি দুধ-চা আনতে। ক্যান্টিনে শুধু লিকার।

শীতের কাঁথা আর বর্ষার ছাতা দিতে মানা। জেনেও প্রায় নতুন ফোল্ডিং ছাতা নন্দকে দিয়ে বলল, আমার জন্যে এককাপ।

বেলা দেড়টা প্রায়। চিফ রিপোর্টার সুজয় সেন এখনও আসেননি। বদ্যিনাথদা টেলিফোন ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে পুলিশের খবর জোগাড় করছেন। সভা-সমিতি তৈরি করছে প্রদীপ। ডুমের আলোয় বর্ষার অন্ধকার মিশে কেমন ফ্যাকাশে ভাব। সাব-এডিটর টেবিলে চিফ সাব মাখন চৌধুরী টেলিপ্রিন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কপি ছিঁড়ছে। পি. টি. আই., ইউ. এন. আই. অনবরত খবর পাঠাচ্ছে—টক্কর-টক। টক্কর-টক।

দুপুরে খাওয়াটা ভালোই হয়েছে। শেষ পাতে আবার একটাকার দই। দু-চোখে ঘুমের আলতো সুড়সুড়ি। রবি নড়ে বসল চেয়ারে। অনেকদিন আগে অপরেশ লাহিড়ীর একটা গান শুনেছিল—’খবর এসেছে ঘর ভেঙেছে / দারুণ ঝড়ে তারের ভাষায় সংকেতে টক্কা টক্কা টরে। টক্কা টরে।’ বহুদিন পর গানটা আবার মনে পড়ে গেল। আর সঙ্গে-সঙ্গেই আচমকা মাথার ভেতর বেজে উঠল সকালে শোনা সেই সুর : ‘তুমি একলা ঘরে বসে-বসে কী সুর বাজালে’। আর অকারণেই তখন তার চোখে জল এল।

ঘুম আর হঠাৎ-কান্না তাড়াতে রবি টেলিফোন টানল। রিং করার চেষ্টা করল চিড়িয়াখানা, আলিপুর পুলিশ কট্রোল। খবর নেই। খবর নেই।

নন্দ চা এনেছে। সুজয় সেন এসে গেছেন চেয়ারে। গরম চায়ে চুমুক দিতে-দিতে সুজয় সেন বললেন, রবি, আজ কী স্টোরি দিচ্ছ?

এখনও কিছু হয়নি, সুজয়দা।

১০ তারিখ অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’ রিলিজ করেছে। গ্লোবে ইংরেজি। বাকি সব হলে হিন্দি। ছবিটা দেখেছ?

সুজয় সেনের মুখে মেঘলা আলোর উঁকি। একটা সিগারেট জ্বেলে চেয়ারে আয়েশি হেলে বসা। শেষের চা-টুকু চোঁ করে মেরে দিয়ে রবি বলল, নাহ।

ছবিটা দেখো। ওটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত নাও। সমস্ত পলিটিক্যাল পার্টি, ইয়াং আর বয়স্ক ফিল্ম-মেকার, সাধারণ পাবলিক, ছাত্র থেকে শুরু করে সিনেমার ব্ল্যাকাররা পর্যন্ত তোমার স্টোরিতে আসবে। দরকার হলে দুটো-তিনটে ইনস্টলমেন্টে বের করব। রোদ্যাঁ নিয়ে যেমন দাঁড় করিয়েছিলে, ‘গান্ধী’ নিয়েও সেরকম…।

রবির মনে পড়ে গেল বিড়লা একাডেমিতে রোদ্যাঁ-প্রদর্শনীর কথা। সুজয়দা দিন-তিনেক ধরে তাকে গাড়ি অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছিলেন। দু-দিন রবির রিপোর্ট ফার্স্ট পেজে গেছল, নামে। একদিন ছয়ের পাতায়, নিজস্ব প্রতিনিধি। কলকাতা তখন রোদ্যাঁ জ্বরে ভুগছে। অসামান্য সব মূর্তি। থিংকার, বার্ঘেস অফ কালে, আদম, ইভ, অরফিউস, ক্যাথিড্রাল, বালজাক। দেখা আর মুগ্ধ হওয়া।

কী, পারবে তো?—সুজয় সেন আবার প্রশ্ন ছোড়েন। রবি ঘাড় নাড়ে।

কই হে বদ্যিনাথ, কিছু আছে নাকি?

বদ্যিনাথ বলে, এখনও করতে পারিনি।

প্রদীপ, সভা-সমিতি প্রেসে দিয়ে দাও। ভারত সেবাশ্রম সংঘের ব্যাপারটা যেন যায়। মহারাজরা বারবার বলেছেন।—এসব বলা শেষ করে সুজয় সেন টেলিফোন ঘোরান। রবি নন্দকে গত বছরের এসময়কার পুরোনো ফাইল আনতে বলে। বর্ষার একটা কিছু যদি দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়।

দুটো বেজে গেল, এখনও কোনও খবর নেই। লোক্যাল স্টোরি কিছু দাও, সুজয়। এখন থেকে কম্পোজ না হলে পরে বিপদ হবে।—অচ্যুত সরকারের গলা শুনে রবি মুখ তোলে।

অ্যাকটিং নিউজ এডিটর। লম্বা সিড়িঙ্গে চেহারা। মুখের প্যাটার্নে আয়াতোল্লা খোমেইনি। ধুতি-পাঞ্জাবি-চটি। বিয়ে-থা করেননি। পঞ্চাশ পেরোনো অচ্যুত ঠিকুজির বয়েস অনুযায়ী এখনও সাতচল্লিশ। নিজেকে ‘বিপ্লবী’ বলে আনন্দ পান। মাঝে-মাঝে ‘এরিয়ানে খেলতুম’ বলেও। পুজোর সময় বেয়ারাদের বকশিস দেওয়ার ব্যাপারটা ‘আমি বিপ্লবী’ বলে এড়িয়ে যান। ওরা পিছনে ‘অমুকের বিপ্লবী’—এই মন্তব্য সহযোগে খিস্তি ঝাড়ে।

সাব-এডিটর আর রিপোর্টারদের টেবিলের মাঝে একটি বড় টেবিল। ভারত-চিন সীমান্তের ম্যাকমোহন লাইন। ওখানেই বসেন অচ্যুত সরকার। গোটা-দুয়েক বড়সড় বেড়াল এখন টেবিলের ওপর শোওয়া। একটি পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। সবই অচ্যুতের পোষ্য। একটু বাদে ওদের জন্যে পাঁউরুটি আর সন্দেশ আসবে। বেড়াল-কুকুরের প্রতি আশ্চর্য মমত্ব এ-মানুষটির।

অচ্যুত আশ্চর্য সব গল্প বলেন। তাঁর শ-স-ষ-এর উচ্চারণ চ-এর মতো। তার ফলে সুভাষচন্দ্র হন সুবাচচন্দ্র। সুভাষচন্দ্র বসু নাকি নিজে অচ্যুতের নাম দিয়েছিলেন সাকুরাই। অবিশ্যি চিফ সাব বীরেনদা বলেন, আমরা ওকে আড়ালে শকুনি বলি। ও তার থেকেই ‘সাকুরাই’-এর সান্ত্বনা বানিয়ে নিয়েছে। নাইট ডিউটি থাকলে সাব-এডিটররা শুনতে পায় অচ্যুত সরকারের সেই আশ্চর্য গল্প—দু-হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে একমন ওজনের স্টেনগান নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের শেষ করে দেওয়া, আই-এন-এ-র হয়ে সাপ খেতে-খেতে বহু রাস্তা মার্চ করে পেরুনো। জুনিয়ার কোলিগরা এসব শুনে পিছনে হাসে। অনেকেই জানে, শনিবার অচ্যুত রেস খেলেন। মাঠে যাওয়ার সঙ্গতি নেই। পয়সা ধরেন বুকির কাছে।

মানুষের এইসব জীবনযাপনের মজা রবিকে ভাবিয়ে তোলে। পুরোনো ফাইল হাতড়াতে-হাতড়াতে তার মাথায় ঘুরপাক খায় কোন লাইন দিয়ে বর্ষার স্টোরি শুরু করবে। আর-এক রাউন্ড চা আসে। সুজয় সেন হাঁক মারেন, কই হে, তাড়াতাড়ি কপি ছাড়ো।

ফুলের কাছাকাছি

মেঘমাখা দুপুরে গ্লোবের সামনে ফুলের জন্য দাঁড়িয়ে রবি। ফুল স্কুল সেরে আসবে। নর্থেরই একটা স্কুলে পড়ায়। বাড়ির কাছে। শো শুরুর তিনমিনিট আগে ফুল এল। হালকা পিংক শাড়ি। ওই রঙের ব্লাউজ। কপালে উজ্জ্বল খয়েরি টিপ। এক হাতে বালা। অন্য হাতে ঘড়ি। সব মিলিয়ে কী যে লাবণ্য! টান করে বাঁধা দীর্ঘ বেণিতে দু-এক কুচি বিষ্টির ফোঁটা পোখরাজ হয়ে আছে। কানের ওপর একগোছা আলগা চুল বাতাসে নড়ল।

রবি দাড়ি কামায়নি। এই এক বিটকেল অভ্যেস। কিছুতেই কামাতে ইচ্ছে করে না। কুঁড়েমি—ফুল ঠিকই বলে। শিশির ধোওয়া তাজা ফুল দেখতে-দেখতে রবি তার ময়লা মতো গালে হাত রাখল।

কী, দাড়ি কামাওনি তো!—ফুলের নাকের পাটা আলতো ফুলে ওঠে। কপালের ডানদিকে একটা শিরা সামান্য উঁচু হয়েই মিশে যায় চামড়ায়। কপাল একটু কুঁচকে গেল। রবি বুঝতে পারে ফুল রাগ করছে।

একদম সময় পাইনি, জানো। সকালেও একটা অ্যাসাইনমেন্ট—।—মিথ্যে কথা শেষ হয় না। ফুলের ঠান্ডা-ঠান্ডা দীর্ঘ আঁখি রবির চোখ থামিয়ে দেয়।—চলো তো, ভেতরে ঢুকি। এরপর অন্ধকার হয়ে যাবে—, বলতে-বলতে রবি আগে হাঁটে।

দাড়ি কাটতে তোমার কী যে আলসেমি! আসলে আমি যা ভালোবাসি, তা তুমি কখনওই—।

নিভু আলোয় কোনার দামি সিটে বসতে-বসতে রবি আর-একবার ফুলকে দেখে নেয়।—তোমাকে যা দেখতে লাগছে না!

থাক, খুব হয়েছে।—কপট গাম্ভীর্যে ফুল আলতো ঘাড় ঝাঁকায়। রবির বুকের ভেতর তারসানাই বেজে ওঠে।

সিনেমা হলে বসে ইদানীং এ এক আশ্চর্য খেলা। রবির পা ফুলের পা-কে নানাভাবে ছোঁয়। লেহন করে। ফুল আপত্তি করে না। রবি তার পা দিয়ে অনুভব করতে চায় কত সুন্দর গড়ন ওই পায়ের। রবির হাতের ওপর হাত রেখে ফুল বলে, তুমি না ভীষণ দুষ্টু।

রবি শব্দহীন হাসি হাসে।

‘গান্ধী’ দেখানোর জন্য ছুটি দিয়েছেন সুজয় সেন। অবিশ্যি সে-অর্থে অফিস না গেলেই রবির ছুটি। সমস্ত ছবি জুড়ে কিংসলের অসামান্য অভিনয়ে রবি মুগ্ধ। গান্ধী ক্রমশই মিথ হয়ে দাঁড়ান। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখানো হয়। রবীন্দ্রনাথ নেই। জওহরলাল, জিন্না, প্যাটেল, আবুল-কালাম-আজাদ আসেন। সুভাষচন্দ্রকে দেখা যায় না। বাংলা, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের বিপ্লবীরা অ্যাটেনবরোর ছবিতে ঢুকতে পারেননি।

ফুলের পাড়ে সুড়সুড়ি থেমে যায়। কস্তুরবা মারা যাচ্ছেন। শয্যার পাশে গান্ধী। অসামান্য প্রকৃতি চারপাশে। আলোছায়ার নিখুঁত খেলা। চোখ দিয়ে জল গড়ায় মোহনদাস করমচাঁদের, রবি কেঁদে ফেলে। তার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সেই ‘পথের পাঁচালি’র দুর্গার মৃত্যুদৃশ্য, ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যু, ঘটি গড়িয়ে জলে পড়ে যাওয়া। দিদির চুরি করা হার আবিষ্কার করে অপুর পুকুরে ছুড়ে ফেলা, তারপর পাশ সরে গিয়ে আবার যে-কে সেই—এসব দৃশ্য রবিকে কাঁদিয়েছে বারবার। কেন যেন তার মনে হল, কস্তুরবার এই চলে যাওয়া—এ-ছবির সেরা শট।

গান্ধীর মৃত্যু দিয়ে ছবি শেষ এবং শুরু। হলের বাইরে বেরিয়ে ফুল বলল, খুব খিদে পেয়েছে। রবি তখনও গান্ধীর কাছে ওমপুরির আর্মস সারেন্ডারের দৃশ্য ভাবছিল। শেষবেলার আকাশে আশ্চর্য রং। লাল রং করা মনুমেন্টের মাথায় আলো পড়ে আছে। ঝিরঝির বিষ্টি হয়েছে কিছু আগে। রাস্তা ভিজে। আলগোছে শাড়ি একটু তুলে ফুল হাঁটে। তার ফরসা গোড়ালির ওপর সাদা সায়ার কুচি লুটোয়। ম্যাড্রাস টিফিনের দোতলায় উঠে আসে। কফি আর আলুবড়া খেতে-খেতে ফুল বলে, ছবিটা একটুও ভালো লাগেনি। স্রেফ তোমার জন্যে—। এর চেয়ে ‘আন্ধা কানুন’ ঢের ভালো ছিল।—গরম কফি চলকে ওঠে। রবি আশ্চর্য মুখে ফুলকে দ্যাখে। প্রকৃতি আর নারীর রহস্য কিছুতেই ধরা পড়ে না। ফুল চোখ টান-টান করে বলে ওঠে, কী এত দেখছ বলো তো?

এসপ্লানেড থেকে মিনিবাসে উঠতে-উঠতে রবি দ্যাখে কলকাতার আকাশে অন্ধকারের প্যারাশুট আস্তে-আস্তে খুলছে। সাদা আর হলুদ আলো বিঁধে যাচ্ছে তার গায়ে। ফুলকে উত্তর কলকাতায় ওর পাড়াতে নামিয়ে রবি ফেরে। আকাশ ভেঙে বিষ্টি নামে। বাস থেকে নেমে অফিসের দিকে হেঁটে আসতে-আসতে রবি টের পায়, রাস্তায় জল জমেছে। প্যান্ট গোটাতে হয়।

দোতলায় সাব এডিটর, রিপোর্টার রুমে থিকথিক ভিড়। অনবরত ছাপা খবর উগরে যাচ্ছে টেলিপ্রিন্টার। সুজয় সেন রবিকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, এই তো রবি! কী খবর ‘গান্ধী’র? দেখেছ?

রবি ঘাড় নাড়ে—হ্যাঁ।

ওপিনিয়ন ফর্ম করাও। নানা অ্যাঙ্গেলে ইন্টারভিউ করো। ব্যাপারটা নিয়ে লাগিয়ে দাও তো। আর শোনো, মিউজিয়ামের এডুকেশন অফিসার শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী ফোন করেছিলেন। এ-মাসের এগজিবিট অফ দি মান্থ নিয়ে বলতে চান। তুমি কাল অবশ্য যাবে বা ফোন করবে।

জোরে বিষ্টি এল। ঘড়িতে প্রায় রাত আটটা। রবি জিগ্যেস করল, সুজয়দা, অফিসের কোনও গাড়ি কি সাউথে ফিরবে?

এখনই নয়। ন’টা নাগাদ।

তাহলে আমায় যদি একটু নামিয়ে দেয়।

কোনও ব্যাপারই নয়। তুমি বরঞ্চ একটু ফোন ঘুরিয়ে লালবাজার, ফায়ার বিগ্রেডটা দ্যাখো। রিভার ট্রাফিকটাও একবার দেখে নিয়ো।

জল পড়লেই কলকাতার ফোনের তেরোটা বেজে যায়। কুঁ-কোঁ-কোঁ—অদ্ভুত সব শব্দ বেরিয়ে আসে। যন্ত্রণাবিশেষ। ধরা পড়ে না কোনও লাইনই। এদিকে লোডশেডিংয়ের জন্য বন্ধ মেশিন। পি. টি. আই., ইউ. এন. আই. কপি আনতে লোক পাঠাতে হয়। রবি ঢিল দিয়ে চেয়ারে বসে থাকে। আনমনে সিগারেট টানে। হাতের কাজ একটু ফাঁকা হলেই সুজয় সেন গলা তুলে বলেন, শোনো, ‘গান্ধী’র ওপর প্রথম লেখাটা কালকেই চাই।

রবি কাঁচুমাচু হয় পরশু করুন : কাল সারা দিনটা একটু ঘুরি।

সুজয় সেন ঘাড় নাড়েন—ঠিক আছে।

অফিসের গাড়িতে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট দিয়ে যেতে-যেতে রবি দেখতে পায়, রাস্তার দু-পাশের যাবতীয় ঝকঝকে সাদা আলো আকাশের গলায় হিরের হার হয়ে ঝুলে আছে। গাড়ি বড় দ্রুত দৌড়য়। এসপ্লানেড পেরিয়ে যাওয়ার পর বিষ্টির চিহ্নমাত্র চোখে পড়ে না।

মেসে ঢোকার আগে মোড়ের পাঞ্জাবি দোকান থেকে দই আর রুটি খায় রবি। রোজ-রোজ তড়কা-রুটি সহ্য হয় না বর্ষায়।

মেসে লোডশেডিং। পুরোনো দিনের সিঁড়ির কোণে-কোণে বর্ষার গুমো গন্ধ। সিঁড়ির কাঠের রেলিংয়ে একটা প্রায় নিভে-আসা মোমবাতি। নীলচে আলো ক্ষয়ে যাওয়ার মুখে লালচে হয়ে এসেছে। অন্ধকারে সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে দোতলায় ভেজানো দরজা খুলল। ঘরের ভেতর ভটচায্যিবাবু আর বোসদা অন্ধকারে মুখোমুখি। বোসদা আস্তে-আস্তে মদ ঢালছেন। বাইরে বাজের চিকুর হানা। বিদ্যুৎ-আলোয় রবি একঝলক দেখল, বোসদার মধ্যিখানে সিঁথি-কাটা পাট-করা চুল মুখের একফালি, ভটচায্যিদার গলা, কানের পাশ। বাতাসে হালকা রামের গন্ধ।

নিজেকে বিছানা চৌকিতে ঢেলে দিয়ে রবি বলল, বোসদা, কেমন জমেছে!

গেলাস বোধহয় ঠোঁটের আগায় লাগানো। জবাব দিতে তাই একটু দেরি।—জমল আর কোথায়, ভাই! ভটচাজ তো ‘মুক্তি’র গান জানে না। আর ‘দেবদাস’-এ সায়গলের গান—’কাহারে যে জড়াতে চায় দুটি বাহুর লতা’—তাও ওর জানা নেই। কী করে জমে! কই রিপোর্টার, একটা সিগারেট দাও তো।

প্যান্টের পকেটে দোমড়ানো প্যাকেট বের করে একটা দিল মিত্যুন বোসকে। আর দুটো আছে। অনুকূল ভটচায্যিকে একটা দিয়ে নিজেও ধরাল। বাথরুমের সিগারেট কাল সকালে ভটচায্যিদার কাছে পাওয়া যাবে, এই ভরসায়। বাইরে আবার ঝেঁপে বিষ্টি এল। ফুলের কথা ভেবে তখনই মন খারাপ। মনে পড়ল, কতদিন দেখা নেই কাকিমার সঙ্গে। বাবা, ছোটভাই—। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতে-দিতে রবি শুনতে পেল ভটচায্যিদা গাইছেন, ‘তুমি আসবে বলে সারা বেলায় দুয়ার খুলে আছি’। কত দিনের যে পুরোনো গান! রেডিয়োতে রবির কিশোর বয়েসে একটা নাটক হত। নাম—’কাচের খেলনা’। তাতেই ছিল এ-গান। একটি খোঁড়া মেয়ে, তার বিধবা মা, রাগী দাদা আর শিংওলা কাচের খেলনা ঘোড়া নিয়ে এ-নাটক।

মন আরও খারাপ হয়। বালিশে মুখ চেপে রবি ঘুম ডাকে।

উই আর ইন দি সেম বোট, ব্রাদার

শিস দিয়ে পুতানের মতো গান তোলার ক্ষমতা খুব কম ছেলেরই। আজ সকালে আকাশ আশ্চর্য নীল। রোদের সোনালি ডানা চারপাশে। ‘সবুজ-স্বপ্ন’-এ বসে রবি, পুলক, পুতান, বাচ্চু সময় কাটায়। এখন সকাল আটটা। ভোরবেলা রবিকে ডেকে এনেছে পুলক। ‘স্বর্গোদ্যান’-এর ছেলেরা লটারি করে টাকা তুলছে। ‘সবুজ-স্বপ্ন’ তাহলে কীভাবে এগোবে? রবি চার্মস ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। তারপর বলে, দরকার হলে আমরা কৌটো নিয়ে বেরোব।—পুতান একমনে শিস দিয়ে যায়—’উই আর ইন দি সেম বোট, ব্রাদার। উই আর ইন দি সেম বোট, ব্রাদার…।’ ভূপেন হাজারিকার গাওয়া এই অসাধারণ গানের সুর রবির মাথায় ঢুকব-ঢুকব করে, আর তখনই ওর মনে পড়ে যায় আজ ‘গান্ধী’ সিরিজের প্রথম ইনস্টলমেন্ট দিতে হবে। ভাবনা মাথার একপাশে সরিয়ে রবি বলে, ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা দরকার। পুতানের পয়েন্টও ফেলে দেওয়ার নয়। একটা সিনেমা শো—।

সবটাই কিন্তু তুই ওপর-ওপর নিচ্ছিস।—বলতে-বলতে পুলক ততক্ষণে বাগানে নেমে পড়েছে। রবি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পুলক পাতাবাহারের ডাল বেঁধে দিচ্ছে। মানিপ্ল্যান্টের নতুন ডাল জড়িয়ে দিচ্ছে গাছের কাণ্ডে। পুতান তার শিস অব্যাহত রেখে এগিয়ে আসে শর্মির খাঁচার পাশে। পায়চারি করা ভালুক রডের ফাঁক দিয়ে নাক বের করে। কিছুটা মুখও। আদরের লালা ঝরে। পুতানের আঙুল শর্মির নাকের ওপরে সুড়সুড়ি দেয়।

তিনটে বাঁদরের ভেতর দুটো ছেলে। একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম বেগম। একটা ছেলের নাম বাদশা। অন্যটা শাহজাদা। খাঁচার গরাদে অদ্ভুত কিচিমিচি। পুতানের শিস ওদের তুলে ধরে। গরাদ বায়। ঘুরে-ফিরে ‘উই আর ইন দি সেম বোট, ব্রাদার’ চালাতে-চালাতে পুতান খাঁচার কাছ থেকে সরে এসে অ্যাকোয়ারিয়ামের সামনে দাঁড়ায়। নতুন বাচ্চা দিয়েছে ব্ল্যাক মলি, সোর্ড টেল। হাতঘড়িতে ন’টা পনেরো। রবি উঠে পড়ে।—রবিবার বসব। একটা কংক্রিট ডিসিশান নিতে হবে। এভাবে হবে না।

পুলক পুরোনো দিনের কৃষক হয়ে ভিজে মাটির ওপর উবু হয়ে বসে থাকে। মনে পড়ে, গোপীবল্লবভপুরের এবং খেতমজুরের সঙ্গে কোনও ভূমির ঘ্রাণ নেওয়ার এক আশ্চর্য স্বপ্ন। তখন মুক্তির দশকের ভাবনা। এখন পলাতক সৈনিক।

কয়েকদিন একটা গোলমাল কোত্থেকে যেন ঢুকে পড়েছে। নানান ভাবনার মধ্যেও পুলক টের পায়। সি. এম. ডি. এ.-র লোহা সিমেন্ট বালির টোপ। টালিগঞ্জের কিছু ছেলে বাচ্চুকে টার্গেট করে। কাঁচা পয়সার টান এমনই জিনিস। অচেনা মুখ যখন-তখন ঘুরে বেড়ায়। সে-মুখে হিংস্রতার আবরণ। একদিন বাগানের পাশে বোমা পড়ে। কেওড়াতলায় মদের ঠেক। নানান মূর্তি, স্মৃতিস্তম্ভে ছেঁড়া কাঁথা-কানির ভেতর লুকনো ব্লাডারের মদ, মহীশূর রাজার বাগানে উটকো বাসিন্দা, গোয়ালঘর, তারপরও সি. এম. ডি. এ.-র সিমেন্ট-বালি-লোহা পয়সার হাতছানি হয়ে সবাইকে ডাকে। যদি কিছু কামিয়ে নেওয়া যায়।

পুলক লক্ষ করে, তার বাগানের পাশে বোমা পড়ল। বাচ্চুকে অচেনা মুখ খোঁজে। হাওয়া সুবিধের নয়।

বাচ্চু ইদানীং কেমন আনমনা। পাখির দেখাশুনোয় ভাটা। সকাল-বিকেল বাগানে আসা অনিয়মিত। পুলক লক্ষ করে। নতুন করে কিছু বলতে তার ভালো লাগে না। পাছে কেউ ‘জ্ঞানদা’ বলে সেই ভয়েই সর্বদা সিঁটিয়ে থাকে। তবু দিনে-দিনে বিপদ বেড়ে যায়। বহু ঘা-খাওয়া পুলক কেন যেন বুঝতে পারে। কথায়-কথায় রবিকে জানালে তেমন আমল পাওয়া যায় না। রবির ‘গান্ধী’ নিয়ে লেখা তিনটে ইনস্টলমেন্টের দুটো দারুণ হাততালি পায়।

সুজয় সেন পার্সোনালি কংগ্র্যাচুলেট করলেন রবিকে। রবি মাথা নিচু করে থাকে। তারপর হঠাৎই বলে ওঠে, চাকরিটা পার্মানেন্ট করে দিন। না হলে বিয়ে করতে পারছি না। সুজয় সেন হাসতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে যান।

মুখোমুখি

আজ রবিবার। ‘স্বর্গোদ্যান’-এর লটারি হল। রেজাল্ট বেরোবে একটু পরে। বহুদিন পর ফুল এসেছিল রাসবিহারীতে। রবি তখন কাঠের চেতলা ব্রিজের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে। একটু পরেই চেতলা বয়েজ স্কুল। সঙ্গে পুতান। এমনিই হাঁটতে-হাঁটতে চলে আসা। কেন যেন বাচ্চু আজকাল চট করে কোথাও যেতে চায় না। আকাশে মেঘের হুড়োহুড়ি। সিমেন্টের পাকা ব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে ফুল আসছে। এখন ঠিক আকাশের ক্যানভাসে একটা রঙিন ম্যাগাজিন থেকে কাটা ছবি। বিজ্ঞাপনের মেয়েরা যেমন হয়। সানসিল্কের বিজ্ঞাপনে যেমনটি দেখায়, তেমনি একপিঠ খোলা চুল। ফুরফুরে, অথচ বেহিসেবি ওড়ে না। হালকা চাঁপা রঙের সিনথিটিক শাড়ি ঘুরিয়ে পরা। কনুই অব্দি ওই রঙের ব্লাউজ। চোখে আবছা কাজল। লিপস্টিক নেই। ফুল নামছে। পায়ের শব্দ রবির বুকের স্পন্দনের সঙ্গে একসুরে বাজে।

কী ব্যাপার, খবর না দিয়েই…।

দেখতে এলাম কী রাজকার্য করো। সবার জন্যে সময় আছে—নেই কেবল আমার জন্যে।

রাস্তার ময়লা জমা জলে ফুলের নিটোল ছায়া। আকাশের পাখি ছায়া হয়ে জলবন্দি ফুলকে ছুঁয়ে গেল।

রবি বলল, চল পুতান, ওপারে যাই।

তোমার আজ অফিস নেই! সেই যে একসঙ্গে ‘গান্ধী’ দেখলুম, তারপর একটা খবরও নেই।

আমার খবর তো রোজই পাও।

ফুল বুঝতে না পেরে দাঁড়ায়।

রবি বলে, কেন, কাগজে পড়ো না আমার স্টোরি? ভালো না থাকলে আর খবর ছাপা হয় কীভাবে?

আকাশের মেঘ উঠে আসে ফুলের মুখে। পুতান বলে, আমি এগোই। তোরা আয়।

সিমলাই কাফেতে কিছু সময় কাটে। ফিশ রোল দাঁতে কাটতে-কাটতে ফুল হাসে। রবির দাড়ি-না-কামানো গালের জন্য বকুনি দেয়। ফুলকে বাসে তুলে দেয় রবি। যাওয়ার আগে ফুল বলে, ‘গান্ধী’ নিয়ে লেখাটা খুব জমেছে।

‘সবুজ-স্বপ্ন’র দিকে আসতে-আসতে বোমার শব্দ শুনতে পায়। পরপর তিনটে। কোন অজানা মন্ত্রে নিভে যায় রাস্তার আলো। আশপাশের বাড়ির দোতলা থেকে আসা আলোয় রবি রণক্ষেত্র আবিষ্কার করে। দুদ্দাড় পায়ের শব্দ, এলোমেলো ছুটে যাওয়া পায়ের ছবি, হই-চিৎকার। রবি দেওয়ালে পিঠ রেখে সাবধানে এগোয়। আবার বোমা পড়ে। বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী।

হঠাৎ হইহই চিৎকার, খিস্তি ছুটে আসে কালীঘাটের দিক থেকে কেওড়াতলায়। পরপর বোমা ফাটে। গুলির আওয়াজ শোনা যায়। একটা ভিড় চেতলার পাকা ব্রিজের ওপর ওঠে। ওখানে কোনও আলো নেই। সাত-আটটা টর্চ জ্বলে ওঠে। বাচ্চু আর নকার নাম ধরে ছোটে খিস্তির ফোয়ারা।

শুধু সি. এম. ডি. এ.-র বালি, সিমেন্ট, রড, শ্মশানের চোলাইয়ের হিস্যা নিয়ে নয়। এ-যুদ্ধ নকাকে নিয়েও। বেহালা থেকে দু-দুটো মার্ডার কেসের আসামি নকা এখন এখানে ওয়ান্টেড হয়ে আছে। অ্যাকশান করছে। কালীঘাটের এদিকের ছেলেরা নকাকে পেয়ে টালিগঞ্জ চেতলার ক্যাওড়াদের চমকাচ্ছে। গোটা ছবি রবির সামনে পরিষ্কার। এর ওপর একটা স্টোরি করলে কেমন হয়, ভেবে নিয়ে রবি এগোয়।

অজস্র মানুষ গোল করে কালীঘাটের দিকে চেতলা যাওয়ার পাকা ব্রিজের সীমানা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে। তাদের আশেপাশে এদিককার দাদা-ভাইয়ারা। নকা অবিশ্যি স্পটে নেই। লুঙ্গি গুটিয়ে খালি পায়ে হাতে পেটো নিয়ে ঘুরছে বাচ্চু। রবির মন খারাপ হয়ে গেল। শেষমেশ এ-লড়াইয়ে বাচ্চুও!

পাকা পোলের পেটের ওপর থেকে টর্চ জ্বালানো-নেভানো আর মা-মাসি উদ্ধার চলেছে। হঠাৎ ভিড় একটু যেন ছিটকে গেল। চনমনে ভাব। সবাই প্রায় দৌড়চ্ছে। রবি দেখল, একটা ঢাউস পুলিশ ভ্যান গুরগুর করে আসছে। ব্রিজে উঠতে যা সময়। দমাদম দুটো মাল পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে চারগুণ স্পিডে ব্যাক করল গাড়ি। পাবলিক আবার তামাশা দেখতে জোটে। ব্রিজের পেটের ওপর সেই টর্চের ঝলকানি। পায়ের কাছে পাবলিকের চক্রব্যূহ। মিনিট-পঁয়তাল্লিশ পর একটা ভ্যান, দুটো জিপে পুলিশ হাজির। ও-ব্রিজের মুখে নেমেই পাবলিককে তাড়ায় পুলিশ। হুড়মাড় দৌড়। রবি একপাশে দাঁড়িয়ে লক্ষ করে। একটা ক্যামেরা থাকলে দারুণ স্পট স্টোরি হত। এই ভেবে আপশোস। পুলিশ তখন ব্রিজের ওপর উঠে পড়েছে। টর্চের ঝলকানি আর নেই। রবি তাড়াতাড়ি রাসবিহারী এসে বাস ধরে ধর্মতলা যায়। তারপর সেখান থেকে অফিস। সাড়ে আটটার ভেতর একটা ডবল কলম নামে। স্টোরির ভেতর নকার নাম থাকে। রবি জানে, এ-স্টোরি ফার্স্ট পেজেই যাবে। একেবারে এক্সক্লুসিভ স্পট রিপোটিং।

‘স্বর্গোদ্যান’-এর লটারির রেজাল্ট শিকেয় তোলা যাবে।

ঘটনা-ঘটনা

সোমবার প্রথম পাতায় ডবল কলমে মারামারির খবর বেরোয়। সকাল আটটার ভেতরই রাসবিহারী, কালীঘাট, হাজরা অঞ্চলে রবির কাগজ আর পাওয়া যায় না। আর কোথায় যেন বিপদ ঘনিয়ে আসে। সোমবার সকালে ‘সবুজ-স্বপ্ন’-এ একবার হাজিরা দেয় রবি। পুতান, পুলককে দেখে যায়। পুলক অনেক চুপচাপ। কোথায় যেন আসন্ন ত্রাসের ছায়া। বাগানের মাটি তৈরি করতে-করতে বলে, কাজটা ভালো করলি না, রবি। এ-রিপোটিং তুই না করলেও পারতিস।

কেমন যেন রাগ হয়ে যায়। রবি একটু গলা তুলেই বলে, গাছের সঙ্গে থেকে-থেকে তুইও একেবারে গাছ হয়ে যাচ্ছিস। এত বড় একটা অন্যায়, তাতে রি-অ্যাকট করব না!

কার কাছে রি-অ্যাকট করবি! পুলিশ, প্রশাসন, সাধারণ মানুষ—সবাইকেই তো দেখতে পাচ্ছিস! এতে নিজেরই বিপদ বাড়ানো। তখন ম্যাও কে ধরে!

শোন পুলক, জার্নালিজম করতে এসে আমরা শিখেছি পাবলিক আর অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের মধ্যে ব্রিজ হল নিউজ পেপার। সমস্ত সমস্যা—যতটা পারা যায়—কাগজে তুলে ধরার একটা নৈতিক দায়িত্ব আমার আছে।—রবির গলায় হালকা ঝাঁজ।

পুলক আরও আস্তে বলে, অ্যান্টিসোশ্যালদের সম্বন্ধে তোর কোনও ধারণা নেই। যা খুশি লিখব মনে করলেই লেখা যায় না। এ-এলাকায় তোকে থাকতে হবে। ওদের চটিয়ে—।

তুই না এক সময় রাজনীতি করতিস! আদর্শের জন্যে যে-কোনও সময় গুলি খেতে তৈরি ছিলি! তোর মুখে এ-কথা মানায় না, পুলক।

আশ্চর্য বিষণ্ণ হয়ে যায় পুলকের মুখ। এই এক গোপন ঘা, যেখানে রবি খোঁচা দিল। সত্তর দশকে সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি করে এখনও বেঁচে থাকাটাই যেন অপরাধ। হয়তো রবি একেবারেই সে-অর্থে এ-কথা বলেনি। তবুও পুলকের গভীরে বাজে। সত্যিই তো, রাজনীতি করা পুলক এখন ওয়ার্থলেস। ডেড। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। আসলে এই স্পন্দনহীন বেঁচে থাকার প্রতি কী এক মায়ায় সে জড়িয়েছে। পাকে-পাকে আরও জড়িয়ে যাচ্ছে। জীবনের প্রতি এ কী অন্ধ মোহ!

এই তো সেদিন এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড করিয়ে আনল পুলক। মেরুন রঙের পাতলা কার্ড তার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার সময় কাউন্টারের ভদ্রমহিলা জিগ্যেস করছিলেন, সে কি, আপনি এতদিন কার্ড করাননি! ঊনসত্তরে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছেন।

রবি উঠে পড়ে। পুলকের চাপা দীর্ঘনিশ্বাস বৃক্ষেরা শুষে নেয়। গাছ-ঘাস-লতাপাতার মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চায় পুলক। লজ্জায়।

অফিসে আসতে-আসতে রবির প্রায় তিনটে বাজে। চিফ রিপোর্টার হইহই করে তাকে কংগ্র্যাচুলেট করেন।—দারুণ খেয়ে গেছে তোমার স্টোরি। একেবারে এক্সক্লুসিভ। এর ফলো আপ দেবে। ব্যাপারটা নিয়ে একটু লড়ে যাব। দেখা যাক, কী হয়!

রবির বুক ফুলে ওঠে। ডেস্কে বসতে-বসতে জল চায়।

রাসবিহারী মোড়ের সন্ধে ছটা। একটু আগে বিষ্টিতে থকথকে কাদা মোড়ের মাথায়। সি. এম. ডি. এ.-র গর্তে হাঁ-করা অন্ধকার। একটু এগোলেই ডান ফুটপাতে ফলের দোকান। ল্যাংড়া আম ক’দিন আগে উঠে গেছে। এখন ফজলির সময়। পাশাপাশি কলা, মুসাম্বি। তার গায়েই বোবাদের সান্ধ্যকালীন নিত্য মেলামেশা। হাত-পা নেড়ে মাইম-আড্ডা। জনা সাত-আট। সবই স্বাভাবিক।

তারপরই হঠাৎ কেওড়াতলার আশপাশে আলো নেভে। কয়েক জোড়া পা দ্রুত দৌড়ে এসে ‘সবুজ-স্বপ্ন’-এর রেলিং টপকায়। পরপর বোমা ফাটে। ত্রাহি চিৎকার দিয়ে ওঠে বাঁদর, ময়ূর। খোলা নেপালার কোপ পড়ে ময়ূরের গায়ে। কেকা-ধ্বনি আর্তনাদে হারিয়ে যায়। ভালুকের খাঁচার ভেতর বোমা পড়ে। একটা…দুটো…তিনটে। ভীরু জানোয়ার কোনওরকমে সিমেন্টের ছোট গুহায় মুখ লুকোয়। তবু আগুনের ঝলকে পিঠের লোম পোড়ে।

লম্বা ভারী রড নেমে আসে অ্যাকোয়ারিয়ামের কাচে। জলভরতি কাচ ভাঙার অন্যরকম শব্দ শোনা যায়। আবার বোমা ফাটে। চিৎকার, গালাগালি। ওরা বাচ্চুকে চায়। সন্ধেবেলা একটু দূরে চা খাচ্ছিল পুলক ও পুতান। দৌড়ে আসে। ওদের জাপটে ধরে অন্ধকার। পুতান কোনওরকমে ছাড়ান পায়। তার জামা ছেঁড়ে। পুলককে চ্যাংদোলা করে তুলে বাগানের ভিজে মাটির ওপর শোয়ায়। তারপর একটার পর একটা ভোজালির কোপ। মাংস কাটা চপারের কোপ। রডের বাড়ি। পাইপগানের গুলি।

বিশাল কৃষ্ণচূড়ার পায়ের কাছে মুখ থুবড়ে থাকে পুলক। এলোমেলো ভোজালির কোপে কেটে যাওয়া দুটি হালকা পাতাবাহারের ডাল তার পিঠের ওপর, গলার পাশে, শুয়ে থাকে। অজস্র রক্তের নদী-নালা বয়। পুলকের শরীর বিষ্টি-ভেজা মাটির মতোই ঠান্ডা মেরে আসে।

সাতটা নাগাদ অফিসে ফোন পায় রবি। সুজয় সেন তখন তাকে চেম্বার অফ কমার্সের হ্যান্ড-আউট ধরিয়েছেন। প্রেস কনফারেন্সে কেউ যায়নি। এর থেকেই খবর করে দিতে হবে। নিউজ হলের চেহারা মোটামুটি একইরকম। সুজয়দা হঠাৎ বললেন, রবি, তোমার ফোন!

শোন, আমি পুতান বলছি। থানা থেকে ফোন করছি। তুই শিগগির চলে আয়। পারলে একটা ফটোগ্রাফার আনিস। বাগান লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।

পুতানের স্বরে আতঙ্ক টের পায় রবি। ও কোনও উত্তর দেয় না।

ও-প্রান্ত থেকে টানা কথা ভেসেই আসে!—হ্যালো, শোন, পুলক সিরিয়াসলি ইনজিয়োর্ড। বোধহয় বাঁচবে না। ওকে পি. জি.-তে নিয়ে গেছে।

রবির শিরদাঁড়ায় কীসের যেন কাঁপুনি। সকালে এত তর্ক। কথা-কাটাকাটি। এর মধ্যেই…।

তুই শিগগির চলে আয়।—পুতান কথার সঙ্গে-সঙ্গে ফোন নামিয়ে রাখে। তখনও রবির হাতে ধরা রিসিভার। রবি গোটা হলঘর দেখে নেয়। তারপর তার হাতের কালো দূরভাষটিকে দ্যাখে। আস্তে নামিয়ে সুজয় সেনের কাছে আসে। বলে, সুজয়দা, এখনই গাড়ি চাই। একটা মার্ডার হয়েছে আমার এলাকায়। সঙ্গে মারামারি। স্পটে যাব।

সুজয় সেন নির্বিকারভাবে ফোন তোলেন। নীচে গাড়ি দেওয়ার নির্দেশ দেন কেয়ারটেকারকে। ফোটোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের সুজিতকে ডাকেন। গোটা ব্যাপারটা ঠিক করতে মিনিট-দশেক। রবি তখন কাঁপছে উত্তেজনায়, অনুশোচনায়। কিছু রাগেও।

যাওয়ার আগে সুজয় সেন বলেন, শোনো, যতটা পারবে পুলিশকে কোট করার চেষ্টা করবে। কেন হঠাৎ এই ভায়োলেন্স এ-ব্যাপারে ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি চাই। বি কুইক। আমি নাইটের চিফ সাবকে বলে রাখছি। এক স্লিপ, এক স্লিপ করে স্টোরি দেবে। কম্পোজ হবে। যাও।

গাড়িতে সুজিত ক্যামেরার ব্যাগ সমেত বসে। পিছনের সিটে নিজেকে ছেড়ে দিতে-দিতে রবি বলল, বানারসি, পি. জি. হয়ে যাব।

হাসপাতালের এমারজেন্সি মানেই নৈনিত্তর। ভাঙাচোরা, মৃত্যু, অ্যাক্সিডেন্ট, খুন-জখম।

বাইরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সুজিতকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে। একটা ছোট্ট ভিড়। তার মাঝখানে আবছা নীল লোহার খাটে পুলক। রক্ত, স্যালাইন, অক্সিজেন একসঙ্গে। মাথা থেকে মুখের একটা চোখ ঢেকে সাদা ব্যান্ডেজ। সারা ঘরে ওষুধ, রক্ত, মৃত্যুর ঘ্রাণ। পুলকের চোখ বোজা। মাথার কাছে একজন সিস্টার, আপনমনে খাতায় কী লিখছেন। ঘড়ি দেখছেন। দ্রুতপায়ে চলে যাওয়া হাউস-স্টাফ, ডাক্তারবাবুরা। পুলকের মাথার কাছে একজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর। পায়ের কাছে একজন কনস্টেবল। একটু দূরে ওর বিধবা মা, ভাই।

পুলকের কোনও সাড়া নেই। রবি চুপ করে মিনিট-দুই দাঁড়িয়ে রইল। সাব-ইনস্পেক্টরটিকে জিগ্যেস করল, কোনও নাম বলেছে পুলক? স্টেটমেন্ট দিয়েছে?

সাদা ইউনিফর্ম ভুরু কোঁচকাল।

রবি নির্দ্বিধায় বুকপকেট থেকে নিজের কার্ড বের করে দেখায়। কোঁচকানো ভুরুতে তখন বিস্ময় মাখানো খাতির।—নাহ। খাতা-পেনসিল নিয়ে তো রেডি হয়ে আছি। যদি কোনও স্টেটমেন্ট—।

সিস্টারকে একটু দূরে ডেকে এনে রবি জিগ্যেস করল, কী বুঝছেন?

ভালো না। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। তা ছাড়া ইনজুরিও ভাইটাল সমস্ত জায়গায়। মাথায়, ঘাড়ে, লোয়ার অ্যাবডোমেনে সিরিয়াস স্ট্যাবিং। পালস পাওয়া যাচ্ছিল না একটু আগে। এখন ভগবান ভরসা।

ভালোমানুষ চেহারার মোটাসোটা সিস্টারটি আবার নিজের জায়গায়। ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত স্যালাইন পুলকে মিশে যাচ্ছে।

কে যেন বলল, আরও রক্ত লাগবে। রবি প্রায় দৌড়ে এসে একজন হাউস-স্টাফের হাত ধরে বলল, যেভাবেই হোক পুলককে বাঁচান।

এরপর গাড়ি থানায়। সারা রাস্তা সুজিতের সঙ্গে কোনও কথা হয় না। একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যায় রবি।

পুতান ও. সি.-র ঘরে বসা। পাশে এই মামলার আই. ও.। লম্বা করিডর পেরিয়ে রবি ও. সি.-র ঘরে। টেবিলের ওপর দুটো টেবল ল্যাম্প। কাচের নীচে অনেকগুলো কালীর ফটো। রামকৃষ্ণ। মাথার পিছনে দেওয়ালে কালীঘাটের কালীর বিশাল ছবি। একটু মোটার দিকে চেহারার মানুষটি প্রবল ঘামছেন। রবি ওর পরিচয় দিয়ে ব্যাপারটা জানতে চাইল।

আই. ও. তার পান-খাওয়া দাঁতে ক্লাস সিক্সের ছেলের ভূগোল প্রশ্ন মুখস্থ বলার মতো গড়গড়িয়ে সবটা বলে গেল : ওর কথা অনুযায়ী পুলকদের সঙ্গে পুরোনো ঝগড়ার পরিণতি এ-ঘটনা। পুলক আগে নকশাল করত। ইদানীং বাগান-ক্লাব ইত্যাদিতে মন দিলেও যারা সি. এম. ডি. এ.-র মাল চুরি করে কেওড়াতলা চেতলা ব্রিজের নীচে চোলাই বেচে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। বখরা নিয়ে ঝামেলা। ব্যস। তবুও পুলিশ চেষ্টা করছে অপরাধীকে ধরতে। পুতানের স্টেটমেন্ট পুলিশ নোট করেছে। যাদের নাম পুতান বলেছে এফ. আই. আর.-এ সেসব নামও নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন তো পাকা ক্রিমিনাল। তবে পুতানকে পুলিশ আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। বড়বাবু নিজে ওকে প্রশ্ন করবেন।

ও. সি.-র ঘরে অল্প আলোয় রবি পুতানকে আর-একবার দেখল। বিপন্ন মুখ, ছেঁড়া জামা। মাথার চুল এলোমেলো। পুলিশের সামনে কেমন যেন নার্ভাস হয় সবাই। কিছু পয়েন্টস নোট ডাউন করল রবি। পুলককে মারার ব্যাপারে পুলিশের অতি সরলীকরণ ব্যাখ্যা রবিকে খুশি করেনি। ব্যাপারটার পিছনে আরও কিছু। অন্য কিছু। থানা থেকে বেরিয়ে আসতে-আসতে রবি আর-একবার অসহায় পুতানকে দেখে নিল।

ঘড়িতে আটটা কুড়ি। গাড়ি ঘুরিয়ে নিল বানারসি। পিছনে পাতাল রেলের হাঁ। আলো। ঘটঘটাং-ঘট শব্দতান। প্রতাপাদিত্য রোড হয়ে গাড়ি রাসবিহারীতে। তারপর জ্যামে মিনিটখানেক। জীবন এখানে একই তরঙ্গে বাঁধা। গৌড়ীয় মঠের বারান্দার নীচে মানুষ। রেডিয়োর গান। অথচ এর সিকি মাইলের ভেতর একটা দাঙ্গা। একজন মানুষের জীবন-মৃত্যু সরু সুতোয় ঝুলে আছে।

গাড়ি কেওড়াতলার দিকে, বাঁ-দিকে ঘুরল। গুরুদ্বার, গুরুদ্বার পার্ক, ডাস্টবিন তারপরই ‘সবুজ-স্বপ্ন’। এখনও একটা আলগা ভিড়। পুলিশের ভ্যান উলটো ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। সমস্ত বাগানের আশপাশ জুড়ে ত্রাস। শর্মি, বাঁদরেরা, পাখি, ময়ূর সব চুপ। চারপাশে লোডশেডিং। রবি এগোলো, ছত্রাখান অ্যাকোয়ারিয়াম। ভাঙা কাচ বর্শা-ফলক হয়ে মাথা উঁচু করে আছে। একদম তলায় জল। তার মধ্যে দু-একটা কেতরানো মাছ। মাথার মেরুন ঢাকনা উপড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে দূরে।

রবি ভেতরে ঢুকল রেলিংয়ের দরজা ঠেলে। ও-ফুট থেকে দৌড়ে এল একজন পুলিশ অফিসার—কী করতে চান, মশাই! ভেতরে যাচ্ছেন কেন?

রবির পিছন-পিছন সুজিতও। ক্যামেরার শাটার টিপছে।

বাইরে চলে আসুন।—পুলিশ অফিসারের কথা অগ্রাহ্য করে রবি প্রায় কৃষ্ণচূড়ার কাছাকাছি।

অন্ধকারে দোমড়ানো ঘাস, ঘাড়-মাজা ভাঙা দোপাটি চারা, কাটা পাতাবাহার, ভিজে মাটিতে ঘষ্টানির চিহ্ন। বুক হু-হু করে উঠল। নোট ডাউন করবে কী!

পুলিশ অফিসার বাগানের গেটের কাছে : কী ব্যাপার, বলুন তো!

রবি গম্ভীর গলায় তার কাগজের নাম বলল। সুজিতকে ডেকে আবার বলল, গোটা বাগানটার একটা ছবি নে।—পুলিশ অফিসারকে ধন্যবাদ দিল। তারপর প্রেস লাগানো গাড়িতে উঠে বানারসিকে বলল, পি. জি. হয়ে অফিস।

এমারজেন্সির সামনে থমকে থাকা কান্না রবিকে দেখে ভেঙে পড়ল। ঢেউ-ঢেউ। অক্সিজেনের নল, স্যালাইন, রক্তের ছুঁচ খোলা। সামান্য হাঁ-করা পুলক। ছুটি হয়ে গেছে।

অফিসে এসে ঠিক গোনা এগারো স্লিপের স্টোরি নামাল রবি। প্রথম পাতার অ্যাঙ্কার হবে। সঙ্গে একটা ডবল কলম ছবি।

পরদিন হইহই। রাসবিহারীতে, হাজরায়, কালীঘাটে রবির দৈনিক মারকাটারি। প্রায় সারাদিন একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে মর্গ, শ্মশান। পুতানকে সকালেই পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। এখন রবির মাথায় কেবল চিন্তা ইনভেস্টিগেশন।

সন্ধের দিকে ‘সবুজ-স্বপ্ন’-এ হালকা ভিড়। শর্মির পিঠে ওষুধের পুলটিশ। ডানাকাটা ময়ূর এখনও ঝিমোয়। বাঁদরের কিচিকিচি বন্ধ। ওরা আজ প্রায় কেউই খাবার ছোঁয়নি। ফাঁকা বেঞ্চিতে একলা রবি। বৃক্ষেরা হাওয়ায় দোলে। লোহার রেলিঙের গায়ে পুলকের ফটো-ফ্রেমে সাদা মালা। রবির ভেতরটা কেঁদে ওঠে। উঠে আসে। এলোমেলো হাঁটতে-হাঁটতে ওষুধের দোকান থেকে সুজয়দাকে ফোন করে।—ফলো আপ পাঠাও। কী হল?

রবি চট করে জবাব দিতে পারল না। আস্তে বলল, তেমন কিছু নেই। তবে রাতের দিকে একবার যেতে পারি। সারাদিন খুব টানাপোড়েন গেছে। মর্গ, শ্মশান।

পারলে চলে এসো। আমি আছি ন’টা, সাড়ে ন’টা অব্দি।

ফোন নামিয়ে রাখলেন সুজয় সেন। শব্দ পাওয়া গেল।

আলগা পায়ে হেঁটে এল রবি। তারপর মেসে ফিরে এসে নিরুপদ্রব অন্ধকারে নিজেকে ডুবিয়ে দিল।

একদিন হঠাৎ

দু-দিন হয়ে গেছে পুলকের খুনিরা কেউ অ্যারেস্টেড হয়নি। রবির কাগজের স্টোরি পড়ে পুরমন্ত্রী স্বয়ং এসেছিলেন। সঙ্গে পুলিশ কমিশনার। পূর্তমন্ত্রী। নতুন করে বাগান সাজিয়ে দেওয়ার কথা দিয়ে গেছেন মন্ত্রীরা। বলেছেন, পুলকের খুনিদের ধরে শাস্তি দেওয়া হবে।

রবি তখন পাড়ায় ছিল না। পরে খবর পেয়েছে। পাশে থাকলে মন্ত্রীদের ছবি দিয়ে একটা খবর হতে পারত। ভারত প্রূডেনশিয়াল কাপ জিতে নিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ একেবারে ল্যাজে-গোবরে। মোহনবাগান যেভাবে এগোচ্ছে তাতে লিগ পাওয়ার চান্স অনেকটাই—এসব ভাবনার কোনওটাই রবিকে সেভাবে চাঙ্গা করতে পারে না। পুলকের মৃত্যু, একটা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোটিংয়ের পোকা, পয়সার লোভ, সুজয়দার পিঠ চাপড়ানি, আর ভবিষ্যতে যদি চাকরি হয়, এই আশা তাকে তাড়িয়ে ফেরে।

কেওড়াতলা শ্মশান, আদি গঙ্গার ধারে মদের ঠেক, মহীশূর রাজার বাগানের আনাচ-কানাচ, এ-মুড়ো সে-মুড়ো রবি নতুন খবরের সন্ধানে ঘোরে। পুলকের হত্যাকারীদের নাম সে জানে। অথচ লেখার উপায় থাকে না। সুজয়দা বলেন, কেচ্ছা হয়ে যাবে। যদি ওরা কাগজের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে!

খুঁজতে-খুঁজতে রবি আবিষ্কার করে বেহালা থেকে আসা পলাতক নকাই শুধু নয়, তিন-চারজন আরও আছে—যারা পুলককে মেরেছে। ওরা নিয়মিত বুক ফুলিয়ে ঘোরে। সি. এম. ডি. এ.-র মালপত্র নিয়ে চোরাই ব্যবসা চালায়। চোলাই বিক্রি করে। নেশায় ভাসে। এদের মধ্যে দুজন একটি খুনের মামলায় সেশান ট্রায়ালে আছে। হাকিম এদের এলাকায় ঢুকতে মানা করেছেন। তবু ওরা ঘোরে।

লোকাল থানায় বলে কোনও ফল হয় না। একটা পলিটিক্যাল পার্টির ছোট অংশ এদের মদত করে।

পুলকের খুনিরা কেন ধরা পড়ে না, সে নিয়ে থানার ও. সি.-র সঙ্গে রবি দু-দিন কথা কাটাকাটি করে আসে। এ মামলার আই. ও.—ইনভেস্টিগেটিং অফিসার—দেশলাই কাঠি দিয়ে পানের কষ ছোবানো দাঁতের কোণ থেকে একটি ছোট সুপুরির কুচি অনেক কষ্টে বের করে বলে, কী করব, দাদা! রোজই যদি একটা না একটা ঝামেলা থাকে, তা হলে কী হবে, বলুন তো। জায়গাটা যে একেবারে ছোটখাটো চম্বল হয়ে উঠল! সি. এম. ডি. এ.-র সিমেন্ট, বালি, লোহা রোজ চুরি। হিস্যা নিয়ে মাঝে-মধ্যেই বঁটি, ক্ষুর, পাইপগানবাজি। এই তো সেদিন বাজারের সামনে ধুনকিকে বঁটি দিয়ে এক কোপ ঝাড়লে। দুটো ছেলে ছিল। পড়ল ধরা! রোজই হচ্ছে, মশাই। কত বলব! জঙ্গল, জঙ্গল হয়ে গেছে। থাকত ব্রিটিশ, পেঁদিয়ে বাবার নাম খগেন করে দিত।

আই. ও.-র কথায় রবির মেজাজের চিঁড়ে ভেজে না। বলে, আমি নাম বলেছি তো! আপনি ওদের ধরুন। না হলে লালবাজারে যাব।

নাম তো, মশাই, আমিও জানি। কিন্তু ধরব কাকে? এই তো পরশু খবর পেয়ে কালীঘাট বাজারের মাগিপাড়ায় রেড করলাম। এ-কেসের দু-মক্কেল নাকি ওখানে ছুপে আছে! কোথায় কী? মাঝখান থেকে মাঝরাতে মেয়েমানুষগুলোকে তোলার জন্যে আমার মা-মাসির নামে অজস্র খিস্তি শুনলাম। পুলিশের সমস্যা তো আপনারা দেখেন না, শুধু দোষই ধরেন! আমিও তো পুলকের খুনিদের ধরে মামলা তৈরি করতে চাই।

ভদ্রলোক কাঠি দিয়ে আবার সুপুরির কুচি খোঁজে।

মনে-মনে ‘ধুত্তোর’ বলে বেরিয়ে আসে রবি। ঠিক করে, অন্য অ্যাঙ্গেলে রিপোর্ট করে এলাকায় পুলিশি তল্লাশির ব্যবস্থা করবে।

সুজয় সেনকে ব্যাপারটা খুলে বলে রবি। কেওড়াতলা, টালিগঞ্জ রোড, চেতলার একটা অংশে যেসব কুকর্ম হয়, তার ওপর ডিটেলে কভারেজ করতে চাই, সুজয়দা।

সুজয় সেন কী যেন ভাবেন। তারপর ঘাড় ঝুঁকিয়ে বলেন, ডান।

খুব ভালো করে মিশে, খবর নিয়ে, একটার পর একটা রিপোর্ট জমা দেয় রবি। ডিটেলে নাম দিয়ে-দিয়ে লেখে কারা এ-সমস্ত অসামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে। কোথায়-কোথায়, কখন চোলাই বিক্রি হয়। কীভাবে হিস্যা নিয়ে যায় লোকাল থানা। কোথায় তৈরি হয় চোলাই মদ। সি. এম. ডি. এ.-র বালি-সিমেন্ট-রড রাতের অন্ধকারে কোথায় সরে, কারা সরায়, কী দরে বেচা হয়, সমস্ত বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায় তার রিপোর্টে।

এ-সিরিজের চারটে রিপোর্টই প্রথম পাতায় অ্যাঙ্কার হয়। রবির দৈনিক কাগজ সাউথে সকাল আটটার পর আর পাওয়া যায় না। মানুষজনের হাতে-হাতে ঘোরে। কাগজের দারুণ কাটতি।

এরই মধ্যে এক মেঘলা দুপুরে অফিসে ফোন পায় রবি। ফুল।

কী ব্যাপার? তুমি কি এখন পুলিশে কাজ নিয়েছ?

রবি শব্দহীন।—নাহ। মানে—।

উঁ? রেগুলার কী সব লিখছ? এরপর বিপদ হলে—।

কতদিন তোমাকে দেখি না!

থাক।

একদিন এসো না। আমি ভালো নেই। তুমি?

খুবই ভালো। খাচ্ছি-দাচ্ছি, ইস্কুল করাচ্ছি। ভাবনা কী?

দেখতে ইচ্ছে করছে।

অনেক হয়েছে। ছাড়ছি, ক্লাস আছে।

কবে আসবে?

তুমি এসো আমার স্কুলে।

ফুল ফোন ছাড়ে। রিসিভার হাতে রাখে রবি। এই কাজ, ব্যস্ততায় ডুবে থাকা। ফুলকে ফাঁকি দেওয়া, সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকেও—সবটাই মনে হয় আশ্চর্য। রিসিভার রেখে দেয়।

বহুদিন পর বাড়ি ফিরে বোসদাকে রামের পাঁইট নিয়ে দেখতে পায়। গেলাসে ঢালতে-ঢালতে বোসদা বলেন, বেড়ে চালাচ্ছ, রিপোর্টার। সাউথে তোমার কাগজই তো হট কেক। যা ছাড়ছ না! আজই তো ভোররাতে শ্মশানের আশেপাশে গোটা এলাকা রেইড হয়েছে। লালবাজার থেকে লোকজন এসেছিল। লোকাল থানা খবর অব্দি পায়নি। ভোর না হতেই তোমার কাগজ খুঁজতে বাস্তুহারা বাজারে গেছলুম। ওখানেই শুনলুম। তুমি তো, বাওয়া, রাত্তিরে একখানি কাগজ হাতে পাকিয়ে ফেরো। ততক্ষণ কে ধৈর্য করে থাকবে, বাওয়া। আর এ-খবর তো আর অন্য কাগজে থাকবে না!

আজ অনেক সকালে রবি বেরিয়েছিল। রবীন্দ্রসদনে গাইনোকলজিস্টদের এক কনফারেন্সে। সি. এম. ওপেন করবেন ঠিক ন’টায়। সময়ের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী একেবারে স্ট্যান্ডার্ড টাইম। এক সেকেন্ড এদিক-ওদিক হওয়ার উপায় নেই। সাড়ে আটটার মধ্যে পৌঁছতে হয়েছিল। তারপর স্টোরি জমা দিয়ে ফুলের স্কুলে। ফুল নেই। তাই ওর বাড়ি। সারাটা দিন আড্ডা। আড্ডা। ফুলের মায়ের যত্ন। গোটা দিনটা স্বপ্ন-স্বপ্ন। তারপর সকাল-সকাল মেসে ফিরে আসা।

কী খবর দিলেন, বোসদা!—রবির তো প্রায় দু-হাত তুলে নাচতে ইচ্ছে করছে। রিপোটিং-এ তাহলে এখনও কাজ হয়! বদ্যিনাথদা পুলিশ অ্যারেস্টের খবর নিশ্চয়ই করে দেবেন।

সকালে উঠেই রবি ভোররাতের রেইডের খবর নেয়। পাকা মাল অনেকেই ধরা পড়েছে। ফসকে গেছে নকা। একবার ঘুরতে-ঘুরতে ‘সবুজ-স্বপ্ন’-এ আসে রবি। বাচ্চু ফেরার। পুতান কোনওরকমে বাঁদর-পাখি-মাছ-ভালুককে সকাল-বিকেল খাবার দিয়ে যাচ্ছে। সে-খবর পাওয়া গেল সিগারেটের দোকান থেকে। ‘সবুজ-স্বপ্ন’র চারপাশ কেমন যেন থম মেরে আছে। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে মেসে ফিরে এল। তারপর অফিস। রেইড আর গ্রেপ্তারের খবরটা বদ্যিনাথদা করে দিয়েছেন। আছে প্রথম পাতাতেই।

ঢোকামাত্রই সুজয়দা বললেন, কংগ্র্যাচুলেশনস, রবি। হোল ম্যাটারকে তুমি নিউজ আইটেম করলে। গ্রেপ্তার আর ওই এলাকার গোলমাল নিয়ে অন্য একটা বাংলা আর দুটো ইংরেজি ফ্রন্টপেজ কভারেজ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এডিটর নিজে তোমার কলাম মাপের টাকা বাড়িয়ে দেবেন বলেছেন।

রবির মাথা নিচু। বুকের গভীরে বেজে ওঠে জয়জয়ন্তী।

একটা ফলো আপ স্টোরি পারলে দাও।

কলম নিয়ে রবি বসে। গ্রেপ্তার এবং তারপর এলাকার ছবি তুলতে চায় রিপোর্টাজে। ঝমঝমিয়ে বিষ্টি নামে।

তারপর আকাশের কত না অশ্রুজল! বকাবকি। বৃষ্টি থামল এগারোটা দশে। কলকাতার কোনও-কোনও অঞ্চল তখন জলবন্দি।

গাড়ি যখন হাজরায় রবিকে নামাল, তখন প্রায় বারোটা। অফিস ক্যানটিনে নাইট স্টাফদের সঙ্গে রুটি-তরকারি খেয়ে নিয়েছিল। কালিকা সিনেমার সামনে জল প্রায় হাঁটু ছুঁই-ছুঁই। রবি প্যান্ট গুটিয়ে জুতো খুলে নামল। একটু শীত-শীত করে উঠল সমস্ত শরীর। মিনিট-আড়াই এগোনোর পর জল নেই। তারপর সমস্ত সদানন্দ রোড জল—ন্যাকড়া মোছা স্লেট, রাস্তার নিয়ন আলোয় নকল জ্যোৎস্না। রবি জানে আরও পরে, তপন থিয়েটারের সামনে, এখনও পাতা ডোবা জলের আবরণ। তারপর তার বাড়িতে যাওয়ার গলির মুখে কে যেন তার নাম ধরে ডাকে। একবার, দুবার। প্রথমটা ভুল মনে হলেও দ্বিতীয়বার পিছন ফেরে রবি। থমকায়। এত রাতে কে ডাকে? মাল পেয়ে গেছি রে—, বলে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ওত-পাতা যুবক-মৃত্যু এগিয়ে আসে। তার হাতে খোলা ছুরি। পিছনেও মৃত্যুরা, তিনজন। ওদের একজনের হাতের ভারী লোহার রড আকাশে উঠেই রবির মাথায় নামে।

রবি পড়ে। তারপর তার শরীর কর্ষিত হয় ভোজালি, চপার এবং ক্ষুরে। ঘাতকেরা পালায় রাস্তার ওপারে রকের গা ঘেঁষে শোয়ানো চারটি সাইকেলে। তাদের চাকা-ছোঁয়া রাস্তার জমা জল এক ডিজাইন হয়ে মাথা তুলেই যায় মিলিয়ে। রবির রক্ত রাস্তার জল-কাদায় মেশে। পাড়া গার্ড-দেওয়া একটা কুকুর হঠাৎ রবিকে শুঁকে ভয়-মাখা ডাক ওঠে ডেকে।

ঘন বৃষ্টির পর লোডশেডিং। মন অকারণেই খারাপ হয়ে থাকে। মোমের কাঁপা আলোয় ফুল রবিকে লেখা চিঠির শেষ লাইনে লেখে—আমি ভালো নেই। তুমি?

অপরাধ

পুজো সংখ্যা, ১৯৮৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *