৯০
চাঁদটা ঠিক মাথার উপরে। চারিদিকে ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। জোনাকি পোকা ও রাতের প্যাঁচা কারোর মুখে রা নেই। এমনকি বাতাসের নিজস্ব শব্দও থমকে গিয়েছে। শুধু শোনা যাচ্ছে তাণ্ডবলীলার আহবান। গাছের ডালপালার আড়াল থেকে নিশাচর পাখিরা চেয়ে আছে। তারা তেজস্বী পদ্মজার আগমন দেখছে। পদ্মজার একেকটা কদম নিশাচর পাখিদের মনে বজ্রপাতের মতো আঘাত হানছে। তার সাদা শাড়ি থেকে বিচ্ছুরিত সাদা রঙ নিশাচরদের চোখ ঝলসে দিচ্ছে। পদ্মজার এক হাতে রাম দা অন্যহাতে দঁড়ি। দঁড়ি দিয়ে বাঁধা তিনটে নেড়ি কুকুর! আচমকা কুকুরগুলো চিৎকার করে উঠলো। নিশাচর পাখিরা ভয় পেয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে গেল। গাছের ডালপালা নড়ে উঠাতে পদ্মজাসহ তিনটে কুকুর আড়চোখে উপরে তাকালো। চার জোড়া হিংস্র চোখ
জ্বলজ্বল করছে! কুকুরগুলোর চোখের চেয়ে মানবসন্তান পদ্মজার চোখের দৃষ্টি ভয়ংকর! যেন চোখ নয় আগ্নেয়গিরি! এক্ষুনি আগুন ছড়িয়ে দিয়ে চারপাশ ভস্ম করে দিবে! পদ্মজা পায়ে হেঁটে ঘাস পেরিয়ে একটা পুকুরের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুকুরের জল কুচকুচে কালো। পুকুরের চেয়ে কিছুটা দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় রেইনট্রি গাছ । গাছগুলোর শত বছর বয়স। রেইনট্রি গাছের সাথে বাঁধা অবস্থায় ঘুমাচ্ছে মজিদ,খলিল,আমির,রিদওয়ান ও আসমানি।
পদ্মজা পাশ থেকে ছোট চৌকিখাট টেনে নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বসলো। তার শরীরের রক্ত বুদবুদ করে ফুটছে! ঘুমন্ত অমানুষগুলোকে দেখে তার ঠোঁটে তিরস্কারের মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। যখন চোখ খুলে আমির ও তার দলবল আবিষ্কার করবে, তারা বন্দী! আর সামনে তিনটে কুকুরের সাথে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা! তখন তাদের কেমন অনুভূতি হবে?
.
সাত ঘন্টা পূর্বে, তখন শেষপ্রহরের বিকেল। পদ্মজা লতিফাকে পানি আনতে পাঠিয়েছে। সে রান্নাঘরে রান্না করছে। লতিফা কলপাড়ে এসে আমিরকে দেখতে পেল। আমির আলগ ঘরে প্রবেশ করেছে মাত্র। লতিফা কলসি রেখে আমিরের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিন্তু দুই কদম হেঁটে এসে সে থমকে দাঁড়ায়। দ্রুত উল্টো ঘুরে কলপাড়ে চলে আসে। কলপাড়ে খালি কলসিটা স্থির হয়ে আছে। লতিফা কলসির উপর চোখ নিবদ্ধ রেখে কপাল কুঁচকায়। নূরজাহানের ঘর থেকে তিনদিন আগেই ঘুমের ঔষধ সংগ্রহ করে রেখেছিল পদ্মজা। আজ রাতের খাবার পরিবেশন করার পূর্বে খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়া হবে। যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন পদ্মজা আক্রমণ করবে! এই পরিকল্পনাই লতিফাকে জানানো হয়েছে। লতিফা কলপাড়ে এসে আমিরকে দেখে দূর্বল হয়ে পড়ে। তার বলে দিতে ইচ্ছে হয়,আমির যেন রাতের খাবার না খায়! কিন্তু যখন মনুষ্যত্ব জেগে উঠলো সে থেমে গেল।
আজ লতিফার একখানা বড় কাজ আছে। রিনুকে নিয়ে তার পালাতে হবে! এই বাড়িতে কিশোরী রিনু এসেছে গতবছর। তার আগেও অন্দরমহলে রিনু নামে একজন কাজের মহিলা ছিল। তিনি ডায়রিয়ায় গত হয়েছেন দুই বছর আগে। এতিম লতিফা প্রথম যখন এই বাড়িতে এসেছিল,মজিদ ও খলিলের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল। তারপর লতিফা ফরিনাকে সব জানায়। ফরিনা প্রতিবাদ করায় আমির সব শুনলো। আমির তার বাপ-চাচাকে নিষেধ করে লতিফাকে নির্যাতন করতে। সে চায়,তার মায়ের সেবা করা মানুষগুলো নিরাপদ থাকুক।
এরপর প্রায় দুই-তিনবছর নিরাপদে কেটে গেলেও পনেরো বছর বয়সে রিদওয়ানের মাধ্যমে লতিফা ধর্ষিতা হয়। ধর্ষণের পর লতিফা পালানোর জন্য ছটফট করেছে। দরজা বন্ধ করে দিনের পর দিন লুকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছে। তারপর বেশ কয়েকবার মজিদ ও খলিলের থাবার শিকার হতে হয়েছে। দিনগুলো বিষাক্ত ছিল। পালানোর মতো জায়গা ছিল না। তাই একসময় লতিফা ভাগ্যকে মেনে নিল। সহ্য করে নিল সবকিছু। অন্দরমহলের পাশাপাশি পাতালঘরের বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে উঠলো। তবে গত চার বছর ধরে সে মজিদ,খলিল আর রিদওয়ানের থাবা থেকে মুক্ত। এর পিছনেও কাহিনি রয়েছে। ফরিনার প্রতি লতিফার ভালোবাসা এবং সম্মান দেখে আমির লতিফার ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। তার হুমকিতে থেমে যায় লতিফার কালরাত্রিগুলো। লতিফা বিশ্বস্ততার সাথে আমিরের গোপন আদেশ-নিষেধগুলো মেনে চলে। পদ্মজা, রূম্পা ও হেমলতাকে চোখে চোখে রাখা ছিল লতিফার দায়িত্ব। গত বছর কিশোরী রিনু নতুন এসেছে অন্দরমহলে। সে এ বাড়ি সম্পর্কে কিছুই জানে না। মজিদ হাওলাদার উদারতা দেখিয়ে এতিম রিনুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। যেহেতু রিনুকে উদারতার জন্য আনা তাই রিনুকে দেখেশুনে রাখা হয়। বিয়ের জন্য পাত্রও খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু লতিফা দেখেছে,রিদওয়ানের কু-দৃষ্টি রিনুর উপরে আছে। রিনুর সাথে একই বিছানায় থাকতে থাকতে লতিফা রিনুকে আপন ছোট বোন ভাবা শুরু করেছে। সে রিনুকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসে। রিনুকে অভিশপ্ত নিখুঁত যন্ত্রণাময় কালরাত্রিগুলো থেকে বাঁচাতে লতিফা দ্রুত পালাতে চায়। তাই আমিরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা সত্ত্বেও গোপন পরিকল্পনার কথা বলতে পারলো না। দমে গেল! সে কলসি রেখে দ্রুতপায়ে অন্দরমহলে চলে যায়।
রান্নাঘরে পা রাখতেই পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সে পাথরের মতো স্থির! লতিফার হাত খালি দেখে যান্ত্রিক স্বরে বললো, ‘ পানি কোথায়?’
লতিফা নিজের হাতে নিজের কপাল চাপড়ালো। সে কলসি রেখে চলে এসেছে। লতিফা টান টান করে হেসে বললো, ‘ এহনি আনতাছি। খাড়াও। ‘
লতিফা কলসি আনতে চলে গেল। পদ্মজা এক এক করে পাতিলে মশলা ঢাললো। মুরগি কষানো হবে। পুলিশ ভোরে পূর্ণার লাশ ফেরত দিয়েছে। বাসন্তী নাকি রাতে স্বপ্ন দেখেছেন,পূর্ণা লাহাড়ি ঘরের পাশে কবর খুঁড়ছে। তাই তিনি সবাইকে অনুরোধ করেছেন,পূর্ণার কবর যেন লাহাড়ি ঘরের পাশে গোলাপ গাছটির নিচে হয়। বাসন্তীর কথা রাখা হয়৷ পূর্ণা তার প্রিয় গোলাপ গাছটির নিচে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা আজও কাঁদলো না। সে চুপচাপ কোরান শরীফ পড়েছে। তারপর পূর্ণাকে কবর দেয়া হলে অন্দরমহলে ফিরে এসেছে। এ নিয়ে সমাজে নানান কথা হচ্ছে৷ পদ্মজার ব্যবহারে অবাক হয়েছে প্রেমা,বাসন্তী ও প্রান্ত। মৃদুলের অবস্থা নাজেহাল। তাকে হাজার টেনেও পূর্ণার কবর থেকে সরানো যাচ্ছে না। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। মৃদুলের মা জুলেখা বানু ছেলের পাগলামি দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মোড়ল বাড়ির অবস্থা করুণ! পদ্মজা ভাবনা ছেড়ে কাজে মন দিল। লতিফা কলসি নিয়ে দৌড়ে আসে। তারপর মেঝেতে কলসি রেখে বললো, ‘ লও পানি।’
পদ্মজা পূর্বের স্বরেই বললো, ‘ যা যা আনতে বলেছিলাম,আনা হয়েছে?’
‘হ,আনছি।’
‘রিনু ব্যাগ গুছিয়েছে?’
‘হ,গুছাইছে।’
‘রিনুকে ডাকো।’
লতিফা রান্নাঘর থেকে গলা উঁচু করে ডাকলো, ‘ রিনুরে…ওই রিনু।’
রিনু আশেপাশেই ছিল। লতিফার ডাক শুনে দ্রুত হেঁটে আসে। সে গতকাল থেকে আতঙ্কে আছে। ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেনি। রিনুর সামনের দাঁতগুলো উঁচু। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। কিন্তু মনটা সাদা। সরল-সহজ একটা মেয়ে। রিনু এসে বললো, ‘ হ, আপা?’
পদ্মজা বললো, ‘ রাতে বের হয়ে যাবি লুতু বুবুর সাথে। পথে একদম ভয় পাবি না। আমি লুতু বুবুকে কিছু টাকা দিয়েছি আর একটা ঠিকানা দিয়েছি। আল্লাহ সহায় আছেন। বিসমিল্লাহ বলে বের হবি। পথে আল্লাহকে স্মরণ করবি বেশি বেশি। ইনশাআল্লাহ কোনো ক্ষতি হবে না।’
রিনু বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। লতিফা পদ্মজাকে বললো, ‘ তোমারে ওরা কিচ্ছু যদি করে?’
পদ্মজা উত্তর দিল না। লতিফা উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো। অনেকক্ষণ পর পদ্মজা বললো, ‘ আমার ঘর থেকে কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে পুকুরপাড়ের আশেপাশে কোথাও রেখে আসো। এখন আরেকটু পেঁয়াজ, রসুন বাটো।’
‘রাইখা আইছি। সব কাম শেষ। গোয়ালঘরের পিছনে তিনডা কুত্তা বান্ধা আছে। চিল্লাইছে অনেকক্ষণ, খাওন দিছি এরপরে থামছে। আর ওইযে আলমারিডার পিছনে একটা বৈয়াম আছে। ওইডার ভিতরে রিনু বিষ পিঁপড়া ভরছে। এইডাও একটু পরে রাইখা আমুনে।’
‘মরে যাবে না?’
‘না। বৈয়ামের মুখ কাপড় দিয়া বাইন্ধা রাখছি। ভিত্রে(ভিতরে)মাডিও আছে।’ বললো রিনু।
পদ্মজা,লতিফা ও রিনু তিনজনে মিলে রান্নাবান্না শেষ করলো। আমিনা সদর ঘরে আলোকে নিয়ে খেলছেন। তার জীবন আলোতে সীমাবদ্ধ। আর কিছুতে পরোয়া করেন না। আগে ঘরের ব্যাপারে হলেও কথা বলতেন। এখন তাও করেন না। সারাদিন আলোর সাথে কথা বলেন। মনের ব্যথা আলোকে শোনান। আলো কিছু বুঝে না। শুধু হাসে। আলোর হাসিটাই আমিনার সঙ্গী। রিনু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মিনিট দুয়েকের মাঝে দৌড়ে ফিরে আসে। পদ্মজাকে জানায়, ‘ রিদওয়ান ভাইজানে আইতাছে। লগে একটা ছেড়ি।’
পদ্মজার হাত থেমে যায়! তাহলে সেই নারী? যে পূর্ণাকে হত্যা করতে সাহায্য করেছে! রিনু এক হাত দিয়ে অন্য হাত চুলকাতে থাকলো। সে রিদওয়ানকে আগে ভয় পেত,এখন নাম শুনলেই কাঁপে। লতিফা রিনুর অস্বস্তি,ভয় খেয়াল করে বললো, ‘ রিনু ঘরে যা। দরজাডা লাগায়া দিবি।’
লতিফার বলতে দেরি হয়,রিনুর ঘরে চলে যেতে দেরি হয় না।
রিদওয়ান সদর ঘরে প্রবেশ করে আসমানিকে বললো, ‘ আমার লগে থাকবা না অন্য ঘর লইবা?’
রিদওয়ানকে দেখেই আমিনা আলোকে নিয়ে ঘরে চলে যান। আসমানি নিকাব তুলে চোখ বড় বড় করে বললো, ‘ বাড়ির ভিত্রে(ভিতরে) তোমার লগে থাকুম? আইছি যে এইডাই বেশি। এমনিতে ডর লাগতাছে আমার।’
‘তখন রানি,কাকি এরা ছিল। এখন তো নাই। যারা আছে এরা থাকা আর না থাকা সমান।’
আসমানি চারপাশ দেখে বললো, ‘ পদ্মজা কই?’
আসমানির চোখমুখ দেখে দাত কেলিয়ে হাসলো রিদওয়ান। বললো, ‘ বাবুর বউ পাগল হইছে। মাথা ঠিক নাই। ভয় পেও না।’
আসমানি চারপাশ দেখতে দেখতে বললো, ‘ মাথা ঠিক নাই দেইখাই তো ডর বেশি।’
রিদওয়ান আসমানির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো। বললো, ‘ আজিদ ফিরবে কোনদিন?’
‘মা রে লইয়া শহরে গেছে। আইতে চাইর-পাঁচদিন তো লাগবই।’
‘তাহলে কয়দিন আমার সাথে থাকো।’
আসমানি রিদওয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। আসমানি বললো, ‘পদ্মজা যদি জিগায়,আমি কার কী লাগি?’
‘তোমাকে চিনে না? বাড়ির কাছে থাকো,আজিদের বউ হিসেবে দেখেনি কখনো?’
‘না।’
‘তাইলে কিছু বলার দরকার নাই। প্রশ্ন করলে উত্তর দিও না।’
‘সন্দেহ করলে?’
‘সন্দেহ করলেই কী? না করলেই কী? পদ্মজার দাম আছে আর?’
‘আইচ্ছা ছাড়ো,আমি পদ্মজারে দেইখা আইতাছি।’
আসমানি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সে চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখছে। এই বাড়িতে আসার অনেক ইচ্ছে ছিল তার। কখনো আসতে পারেনি। এই প্রথম আসতে পেরেছে। অন্যবার সোজা পাতালঘরে যেত। লুকোচুরি লুকোচুরি খেলাটা কমেছে বলে ভালো লাগছে। এখন হয়তো প্রতিনিয়ত অন্দরমহলে আসা হবে! লুকিয়ে ভাঙা ফটক দিয়ে পাতালঘরে যেতে হবে না।
আমির ধানের বস্তায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। ঘরের অর্ধেক অংশ জুড়ে ধানের বস্তা রাখা হয়েছে। বস্তাগুলো বাঁশের মাচার উপর। মাটি স্যাঁতসেঁতে। এই ঘরটায় খুব দরকার ছাড়া কেউ আসে না। আবছা অন্ধকারে আমিরের মুখটা অস্পষ্ট। তার হাতে পদ্মজার বেনারসি। বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। আর মাত্র কয়টা ঘণ্টা! ইশ,যদি থেকে যাওয়া যেত! আফসোসে বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো পথ নেই। সব পথ বন্ধ। হয় আগুনে ঝলসে যেতে থাকো নয় মৃত্যু গ্রহণ করো। কী নিষ্ঠুর শর্ত! আমির পদ্মজার বেনারসির দিকে তাকালো। ধূলোর আস্তরণে বন্দী হয়ে গেছে সব স্বপ্ন-আশা! চোখে ছবির মতোন দৃশ্যমান হয়,পদ্মজার লাজুক মুখখানা। তার দুধে আলতা ছিমছিমে গড়নে খয়েরী রঙটা কী ভীষণ মানাতো! বর্ষাকালের শুক্রবার মানেই ছিল, বৃষ্টিতে ভেজা। আমির ঘন্টার পর ঘন্টা পদ্মজাকে একধ্যানে দেখেছে। মুখস্থ করে নিয়েছে তার প্রতিটি পশমের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ। আমির কল্পনা থেকে বেরিয়ে বেনারসিতে চুমু দিল। সীমাহীন যন্ত্রণা থেকে বললো, ‘যখন তোমার কথা ভাবি, তখন আমার শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরা বাজতে থাকে। আমাদের পথটা কি আরেকটু দীর্ঘ হতে পারতো না?’
আমির উত্তরের আশায় বেনারসির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার ঠোঁট দুটো বাচ্চাদের মতো ভেঙে আসে। একটু কথা বলুক না…বেনারসিটি একটু কথা বলুক! আমির ভেজা গলায় আবার বললো, ‘তোমার জন্য বুকটা পুড়ে যাচ্ছে। তোমায় ছোঁয়ার সাধ্যি,দেখার সাধ্যি কেন নেই আমার?’
বেনারসি নিশ্চুপ! সে বোবা,প্রাণহীন। আমির চোখ বুজে বস্তায় হেলান দিল। গত কয়দিনে পদ্মজার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ কানে বাজছে। যখন পদ্মজার বলা, ‘ একবার…একবার নিজের মা-বোনকে মেয়েগুলোর জায়গায় দাঁড় করিয়ে ভাবুন। একবার আমাকে মেয়েগুলোর জায়গায় ভেবে দেখুন।’ কথাগুলো কানে বাজলো তখন চোখের পর্দায় ভেসে উঠে পদ্মজার নগ্ন শরীর। তার সারা শরীরে ছোপ ছোপ দাগ। একটা ছায়া পদ্মজার শরীরে চাবুক মারছে। পদ্মজা আর্তনাদ করার শক্তিটুকু পাচ্ছে না। শুধু গলা কাটা গরুর মতো কাতরাচ্ছে।
আমির ছায়াটির গলা চেপে ধরার জন্য হাত বাড়ায়৷ কিন্তু একি! ছায়াটিকে ছোঁয়া যাচ্ছে না! আমির দ্রুত চোখ খুলে ফেললো। তার মুখ থেকে অস্পষ্ট উচ্চারণ হয়,পদ্মজা! আমির চট করে উঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর আগুন লেগে গেছে৷ ভেতরটা ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। শরীর দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে দূরে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শরীরের শিরা-উপশিরায় তাণ্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে। এই যন্ত্রণা আমির নিতে পারে না। সেই দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরলো। বিগত দিনগুলো তাকে নরকীয় শাস্তি দিয়েই চলেছে। চোখগুলো আজেবাজে দেখছে৷ মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন আজেবাজে ভাবছে। পদ্মজা,পদ্মজা,পদ্মজা…এই পদ্মজাতে কী শক্তি লুকিয়ে আছে? এই একটিমাত্র নাম তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। বিষাক্ত করে তুলেছে প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস। আমির টিনের দেয়ালে এক হাত রেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
মজিদ ক্লান্ত হয়ে আলগ ঘরে বসলেন। এখানে প্রচুর আলো-বাতাস আসে। লতিফা মজিদকে আসতে দেখে,দ্রুত শরবত আর পান-সুপারি নিয়ে আসে। মজিদের সামনে এসে বসে রিদওয়ান ও খলিল। মজিদ শরবত পান করে লতিফাকে প্রশ্ন করলেন, ‘পদ্মজা কথাবার্তা বলছে?’
লতিফা নতজানু অবস্থায় উত্তর দিল, ‘হ,কইছে।’
রিদওয়ান লতিফাকে বললো, ‘যে মেয়েটা আসছে দেখে রাখবি। যত্ন নিবি।’
লতিফা বাধ্যের মতো বললো, ‘আইচ্ছা,ভাইজান।’
খলিল বললেন, ‘ আসিদপুর থাইকা যে বড় পাটিডা আনছিলাম, পুশকুনিপাড়ে ওইডা বিছাবি।’
‘বিছাইছি খালু। এশারের আযানডার পরে সব খাওনদাওন দিয়া আমু।’
‘ভালা করছস।’ খলিল পান মুখ পুরে বললেন।
লতিফা শরবতের খালি গ্লাস নিয়ে চলে গেল। মজিদ আরো দুই গ্লাস পানি পান করলেন। তিনি ভীষণ ক্লান্ত। সারাদিন দৌড়ের উপর ছিলেন। রিদওয়ানের ভুল আপাতত মগার উপর ঘুরে গিয়েছে। মগা গতকাল থেকে বাড়িতে নেই। আবার শেষবার মগার সাথে পূর্ণা ছিল। সবার জবানবন্দির ভিত্তিতে আপাতদৃষ্টিতে মগা খুনি! পুলিশ হাওলাদার বাড়ির দারোয়ানকে খুঁজেছে। মোড়ল বাড়িতে পুলিশ এসেছে শুনেই রিদওয়ান দারোয়ান মুত্তালিবকে হত্যা করেছিল। তাই পুলিশ মুত্তালিবকে পেল না। মজিদ হাওলাদার পুলিশকে বলেছেন,তিনি ধারণা করছেন দারোয়ান ও মগা পরিকল্পনা করে পূর্ণালে ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছে। পুলিশ এখন দারোয়ান মুত্তালিব ও মগাকে খুঁজছে।
রিদওয়ান নিরাপদে আছে। খলিল মজিদকে বললেন, ‘ ভাইজান, কিছু ভাবছেন?’
‘কী নিয়ে?’ মজিদের নির্বিকার স্বর।
রিদওয়ানের ভ্রুকুটি হয়ে গেল। সে চারপাশ দেখে বললো, ‘ আপনি এতো নির্বিকার কেন চাচা? আজ আমিরকে খুন করার কথা ছিল।’
মজিদ এক হাত তুলে রিদওয়ানকে চুপ করতে ইশারা করলেন। তারপর বললেন, ‘বাবু যদি আমাদের কথা না শুনে তখন ব্যবস্থা নেব। তার আগে না।’
রিদওয়ানের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে নাছোড়বান্দা স্বরে বললো, ‘ আমির কখনোই পদ্মজাকে খুন করবে না,শেকল বন্দীও করবে না!’
মজিদ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘দেখা যাবে।’
রিদওয়ান খলিলের দিকে তাকালো। তারপর অধৈর্য্য হয়ে মজিদকে বললো, ‘ আমিরের জন্য আমাদের ক্ষতি না হয়ে যায়!’
মজিদ খলিলকে বললেন, ‘ দেখ তো আশেপাশে কেউ আছে নাকি। ঘরগুলোও দেখবি।’
আমির মাত্র বের হতে যাচ্ছিল। মজিদের শেষ কথাটা কানে আসতেই সে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। খলিল আলগ ঘরের প্রথম দুটো ঘর দেখে এসে বললেন, ‘কেউ নাই।’
তারপর চেয়ারে বসলেন। রিদওয়ান খলিলের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে মজিদকে বুঝাতে। খলিল মজিদের আরেকটু কাছে এসে বসলেন। তারপর বললেন, ‘রিদু কিন্তু হাচা কইতাছে ভাইজান। বাবুরে দিয়া আর ভরসা নাই।’
মজিদ রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই কী বোঝাতে চাচ্ছিস? বাবু আমাদের খুন করে পদ্মজাকে নিয়ে সংসার করতে চাইবে?’
রিদওয়ান তড়িৎ গতিতে বললো, ‘এটা কি সম্ভব না কাকা? আলমগীর ভাই কী করলো?’
মজিদ নির্লিপ্ত কণ্ঠে খলিলকে বললেন, ‘ খলিল,তোর ছেলের বুদ্ধি এখনো হাঁটুতে আছে।’
রিদওয়ান উঠে দাঁড়ায়। তার মাথা চড়ে যাচ্ছে। মজিদ বললেন, ‘তুই আমার পাশে বস। তোর মাথায় কিছু কথা ঢোকাতে হবে।’
রিদওয়ান মনের বিরুদ্ধে আবার বসলো। মজিদ বললেন, ‘চুপ করে আমার কথা শোন। আলমগীর আর বাবুর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পাতালঘরের রীতি পূর্বপুরুষ থেকে পেলেও, নারীপাচার চক্রটার সৃষ্টি বাবুর। এই চক্রে আলমগীর, তুই, আমি আর খলিল বাবুর দলের একটা অংশমাত্র। আমরা সরে গেলে আমাদের উপর রাগ একমাত্র বাবুই ঝাড়তে পারবে। কিন্তু এই চক্রের শুরুটা যে করেছে সে হচ্ছে নেতা। গত সপ্তাহে বাবু ঢাকা থেকে একটা খাম নিয়ে আসছে। খামের চিঠিতে স্পষ্ট লেখা আছে,ছয় মাস পর বাবু নিজ দায়িত্বে ষোলটা মেয়ে সিঙ্গাপুরে পাঠাবে। সার্নার জনের সাথে তিন মাস আগে থেকে চুক্তিবদ্ধ বাবু। বাবুর সাক্ষর আছে চিঠিতে। বাবু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
রিদওয়ান বললো, ‘পড়ছি আমি। কিন্তু টাকা কী করছে? আমাদের তো দেয়নি।’
মজিদ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালেন। তিনি কথার মাঝে কথা বলা একদম পছন্দ করেন না। বললেন ‘হয়তো কাজশেষে দিত। আমার পুরো কথা শোন। কথার মাঝে কথা বলবি না।’
রিদওয়ান মাথা নাড়াল। মজিদ বললেন, ‘এখন বাবু যদি প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করে এর পরিণতি কেমন হবে ধারণা আছে? বিদেশের কত মানুষের সাথে ও কাজ করছে হিসাব আছে? সবার বিরুদ্ধে ছোটখাটো প্রমাণ হলেও বাবুর কাছে আছে। আর এই দেশে কি একমাত্র বাবু মেয়ে পাচার করে? আরো আছে। কম হলেও আট-নয় জন দলনেতার সাথে বাবুর ভালো পরিচয় আছে। যেখানে এই দেশ পরিচালনা করা একজন নেতা এই চক্রের সাথে জড়িত আর বাবুর তার সাথে যোগসূত্র আছে, সেখানে বাবু পালিয়েছে যদি জানতে পারেন তিনি বাবুকে ছেড়ে দিবেন না। সব রকম ব্যবস্থা নিবেন। সম্মানহানির ভয় পাবেন,সব প্রকাশ হওয়ার ভয় পাবেন। বাবুর সাথে পদ্মজার ক্ষতি করবেন। পদ্মজা সুন্দর। বাবুর সামনে পদ্মজার বেইজ্জতি হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ আছে। আরো কত ক্ষমতাশীল লোক বাবুর সাথে এই কাজে জড়িত আছে। যতদিন বাবু এই কাজে নিজেকে রাখবে ততদিন ভালো থাকবে। ছাড়তে চাইলেই সর্বনাশ। বাবুর বুদ্ধি তোর মতো না রিদু। ও আর যাই করুক পালিয়ে যাওয়ার মতো বোকামি করবে না। এতোটা বোকা বাবু না। যদি সত্যি বাবু পদ্মজাকে ভালোবেসে থাকে ও ভুলেও পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে না। এই চক্রের সাথে জড়িত সবাই একজোট! বাবু পালানোর চেষ্টা করলে ও একা হয়ে যাবে। সবাই ঠিক ধরে ফেলবে বাবুকে। আর বাবু ধরা পড়লে পদ্মজাও ধরা পড়বে। পদ্মজা একবার ধরা পড়লে চোখের পলকে ভোগের বস্তু হয়ে যাবে।’
‘পালিয়ে কোথাও না গিয়ে পুলিশকে সব খুলে বললেই তো ও নিরাপত্তা পেয়ে যাবে! আর ফেঁসে যাবো আমরা আর অন্যরা!’
মজিদ বোকা রিদওয়ানের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘ পুলিশ কয়জনকে ধরবে? আমির নিজেও পুলিশের হাতে ধরা পড়বে। ফাঁসিও হবে। নিজের মৃত্যু নিজে টেনে আনবে। তো কী হলো? কিছু কিছু কাজ আছে,যেগুলোতে একবার প্রবেশ করে ঘাঁটি সৃষ্টি করে ফেললে আর সেখান থেকে বের হওয়া যায় না। বাবু তেমনই চিপায় আছে। যদি পালাতে চায় নিজের সাথে পদ্মজার ইজ্জত আর জীবন হারাবে। এই ঝুঁকি নেয়ার সাহস বাবুর হবে না। আমি নিজের চোখে ঢাকায় দেখেছি, পদ্মজা অসুস্থ হয়ে ঘরে ঘুমাচ্ছে আর আমির বাড়ির সব কাজ করছে। পদ্মজার জন্য হলেও বাবু পাতালঘর আর আমাদের আঁকড়ে ধরে রাখবে ।’
‘দেশে কি জায়গার অভাব আছে? কোথাও না কোথাও ঠিক লুকিয়ে থাকতে পারবে।’
‘ওর কাজ করতে হবে না? ঘরে বসে খাবে? তুই নিজ চোখে দেখেছিস, আমির কীভাবে মাত্র দশ দিনে আলীকে রাজশাহী থেকে ধরেছে। আলীর পালিয়ে যাওয়া আমিরের জন্য হুমকি ছিল। তাই চিরুনি অভিযান চালিয়ে ঠিক খুঁজে বের করছে। আমিরের অভিজ্ঞতা আছে। আমির পদ্মজাকে নিয়ে এতো বড় ঝুঁকি নিবে না। আমির চিনে তার পেশার রক্ত কেমন! এতদিন অন্য মেয়েদের পিটিয়েছে। তখন নিজের বউকে পিটাতে দেখবে।’
মজিদ থামলেন,দাঁত বের করে হাসলেন। এতো কথাতেও রিদওয়ানের মনে শান্তি এলো না। সে দুইহাত তুলে বললো, ‘ আচ্ছা ধরলাম,আমির পালাবে না। কিন্তু পদ্মজাকে বেইজ্জতি করার জন্য আমাদের খুন করবে না তার নিশ্চয়তা আছে?’
মজিদ হাওলাদার এবার রেগে গেলেন। বললেন, ‘বাবুর যখন এই কাজের সাথে থাকতেই হবে তখন আমাদের খুন করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে না। খলিল তোর ছেলেরে নিয়ে যা। তারপর গোয়ালঘর থেকে কতোটা গোবর খাইয়ে দে।’
অপমানে রিদওয়ানের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। সে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকলো। আমিরের জায়গাটা সে কিছুতেই দখল করতে পারছে না!ব্যর্থ হচ্ছে বার বার। রিদওয়ান চেয়ারে লাথি দিয়ে, চলে গেল। খলিল বললেন, ‘ ভাইজান,আসমানিরে আনা কি ঠিক কাম হইলো?’
‘একদম না। রিদওয়ান আবার আরেকটা ভুল করলো। বাড়িতে কেউ নাই বলে,ঝুঁকি নিয়ে যা ইচ্ছে করছে। আবার বিপদে পড়লে আমার পা যেন না চাটে বলে দিস।’
খলিল মুখ থেকে পানের পিচকিরি ফেলে বাইরে চোখ নিবদ্ধ করলেন।
ক্রোধে-আক্রোশে আমিরের কপালের রগ ভেসে উঠে। চোখ দুটি রক্তবর্ণ ধারণ করে। সে রাগে এক হাতে দরজা চেপে ধরলো। তার দূর্বলতা ধরতে পেরে মজিদের আনন্দ হচ্ছে! মজিদের হাসি দেখে আমিরের গা জ্বলে যাচ্ছে। সে একবার ভাবলো এক্ষুনি গিয়ে মজিদের গলা চেপে ধরবে। কিন্তু পরক্ষণে কী ভেবে থেমে গেল। চলে এলো ধান রাখার ঘরে। ধানের মাচার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলো,চাপাতি আর রাম দা ঠিকঠাক আছে নাকি। হ্যাঁ,ঠিকঠাক আছে! আমির স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। জানালা খুলে বাইরে তাকাতেই বিকেলের রঙহীন ধূসর কুয়াশা চোখে পড়ে।
পদ্মজা পালঙ্কের উপর গাঁট হয়ে বসে আছে। এশারের নামায আদায় করে মাত্রই উঠেছে। তার পরনে সাদা শাড়ি৷ লতিফা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে পদ্মজাকে জানালো,সে পুকুরপাড়ে খাবার রেখে এসেছে। বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে চারপাশ। মজিদ,খলিল,আমির,রিদওয়ান ও আসমানি এখুনি যাবে৷ পদ্মজা নিস্তেজ গলায় বললো, ‘ওরা ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে ডেকো।’
তার শান্ত স্বর ! কথা শুনে মনে হচ্ছে,পদ্মজা লতিফাকে ঘর ঝাড়ুর জন্য অথবা রান্না করার জন্য ডাকতে বলেছে! লতিফা দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তার বুকের ভেতর দামামা বাজছে। মনে হচ্ছে, যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। এ তো সত্যিই যুদ্ধ! লতিফার ঘাম হচ্ছে।চাপা একটা আনন্দও কাজ করছে! কী অদ্ভুত!
রান্নাঘরে আসমানি গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু পদ্মজাকে কথা বলাতে পারেনি৷ পদ্মজা একটাও জবাব দেয়নি। সে আসমানিকে পুরোদমে এড়িয়ে গিয়েছে। আসমানি নিরাশ হয়ে বেরিয়ে যায়৷ তারপর আর তাদের দেখা হয়নি। পদ্মজা বিছানা থেকে নেমে শক্ত করে হাত খোঁপা করলো। জানালা গলে চাঁদের আলো পদ্মজার পায়ের উপর পড়ে। নিখুঁত কালো রাতকে চাঁদ তার নরম আলোয় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পদ্মজা চাঁদের আলোকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। ছোঁয়া গেল ঠিকই অনুভব করা গেল না। পদ্মজার কানের পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে বাতাস উড়ে যায়। সে বাতাসের শীতলতাকে আগুনের আঁচের মতো অনুভব করছে!
তারা পাঁচ জন গোল হয়ে বসেছে। খাবারের সুন্দর ঘ্রাণে চারপাশ মৌ মৌ করছে। রান্নার ঘ্রাণ শুনেই আমির বুঝে গেল,সব পদ্মজা রান্না করেছে! সে নিজেকে সামলাতে পারলো না। সবার আগে খাওয়া শুরু করলো। আগে তাদের হালকা-পাতলা আলোচনা করার কথা ছিল। তারপর খাওয়া দাওয়া করে ভবিষ্যত পরিকল্পনা করবে। কিন্তু আমির নিয়ম ভঙ্গ করে শুরুতেই খাওয়া শুরু করে। অগত্যা বাকিরাও খাওয়া শুরু করলো। তাদের চেয়ে কয়েক হাত দূরে টলটলে জলের বিশাল পুকুর। জলের রঙ কালো। আশেপাশে কোনো ফুলের গাছ আছে। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে৷ কালো জলের পুকুরটির পঁচিশটি সিঁড়ি। এই পুকুর নিয়ে অনেক গুজব রয়েছে। যদিও সব মিথ্যে৷ বাড়ির মেয়েরা এদিকটায় কখনো আসেনি। মজিদ হাওলাদারের ভীষণ প্রিয় এই জায়গাটা। তার দাদা এই জায়গাটাতে সবসময় ভোজ আসর করতেন। মজিদের ইচ্ছে ছিল চাঁদের রাতে পুকুরের পাশে বসে ভোজ আসর উপভোগ করার। কিন্তু সম্ভব হয়নি! মজিদ হাওলাদারের দাদা নিজের বউকে ভূতে ধরা পাগল প্রমাণ করার জন্য গুজব রটিয়ে দেন। সেই গুজব ধরে রাখতে মজিদ হাওলাদারও এদিকটায় আসেননি কখনো। আজ বাড়ি খালি হওয়াতে সেই সুযোগ মিলেছে৷ তিনি গতকালই দুজন লোক দিয়ে জায়গাটা সুন্দর করে পরিষ্কার করেছেন। চোখ জুড়িয়ে দেয়ার মতো দৃশ্য হয়েছে!
একটু দূরেই ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকা উড়ছে৷ মাথার উপর চাঁদের আলো। চারপাশে চারটি হারিকেন। চমৎকার পরিবেশ। খলিল মুরগির রানে কামড় দিয়ে বললেন, ‘ বাবু,সারাদিন কই থাহছ?’
আমির ছোট করে উত্তর দিল, ‘এখানেই।’
মজিদ আমিরকে আগাগোড়া পরখ করে নিয়ে বললেন, ‘কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছিস?’
‘না,আব্বা।’ বললো আমির।
রিদওয়ান কিছু বলতে আগ্রহী নয়। সে চুপচাপ খাচ্ছে। তার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। আসমানি আমিরের পাশ ঘেঁষে বসলো। বললো, ‘ পরের কামে কয়দিনের সময় দিছে?’
‘অনেকদিন।’
‘এইবার ভৈরবে নিশানা রাইখো। ওইহানে সুযোগ সুবিধা আছে অনেক।’
মজিদ আসমানির সাথে তাল মেলালেন, ‘আমিও ভৈরবের কথা বলতাম।’
আমির রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এই কাজ রিদওয়ান নিক। আজিদ আর হাবুরে নিয়ে কয়দিনের জন্য ট্রলার নিয়ে ভৈরবে চলে যাবে।’
রিদওয়ান না চাইতেও সম্মতি জানালো। আমির আড়চোখে পিছনে তাকালো। তার চেয়ে পাঁচ হাত দূরে একটা রেইনট্রি গাছ। গাছটির পিছনে সে চাপাতি আর রাম দা রেখেছে। আরেকটু রাত বাড়লে যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে যাবে,নেশা করবে তখন সে আক্রমণ করবে। দুই হাতে দুই অস্ত্র নিয়ে রিদওয়ান ও মজিদকে আঘাত করা তার লক্ষ্য। তারপর খলিল ও আসমানি বাঁ হাতের খেল! আমির চুপচাপ প্রহর গুণতে থাকে।
খাওয়া শেষে প্লেটগুলো দূরে রাখা হয়। প্লেটগুলো সরানোর জন্য মজিদ চারপাশে চোখ বুলিয়ে লতিফাকে খুঁজলেন। লতিফা আশেপাশে নেই।
অন্যবার তো থাকে। আজ কোথায়? মজিদ বিরক্ত হলেন। তিনি মনে মনে লতিফাকে একটা নোংরা গালি দিলেন। তারপর পরবর্তী ডিল নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন। কীভাবে এগোতে হবে কোন এলাকায় যেতে হবে,বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক করা যায়। এসব নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। রিদওয়ান চোখমুখ কুঁচকে বসে আছে। মজিদ হাওলাদার আমিরকে কী প্রশ্ন করবেন বলেছিলেন। তাও করছে না। এই বুড়ো আবার গুটি পাল্টে দিয়েছে। আমির কথা কম বলছে। সে মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায়! কিন্তু তার সুযোগ আসার পূর্বেই সে এবং বাকিরা ঘুমের কাছে হেরে যায়। এতোই ঘুম পেয়েছিল যে,তাদের শরীর অন্দরমহলে যাওয়া অবধি ইচ্ছেশক্তি পায়নি।
লতিফা কিছুটা দূরে অন্ধকারে লেবু গাছের আড়ালে বসে ছিল। মশা কামড়ে তার হাত-পা বিষিয়ে দিয়েছে। যখনই দেখলো ভোজ আসরের পাঁচজনই ঘুমিয়ে পড়েছে,তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। সে ছুটে যায় অন্দরমহলে। পদ্মজা সদর ঘরে শান্ত হয়ে বসেছিল। লতিফা হাঁপাতে হাঁপাতে সব জানালো। তারপর তারা লুকিয়ে রাখা দঁড়ি আর ওড়না নিয়ে চলে আসে পুকুরপাড়ে। পদ্মজা, লতিফা ও রিনু মিলে ঠান্ডা মাথায় মজিদ,খলিল,আমির,রিদওয়ান এবং আসমানির হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেললো। তারপর এক এক করে টেনে নিয়ে গেল রেইনট্রি গাছের সামনে। পাঁচজনকে পাঁচটি গাছের সাথে বেঁধে তারা স্থির হয়ে দাঁড়ালো।
লতিফা,রিনু ঘেমে একাকার। রিনু তো ভয়ে তরতর করে কাঁপছে। এমন একটি দুঃসাহসিক কাজে অংশগ্রহণ করে সে হতভম্ব! পদ্মজা বললো, ‘ এবার তোমরা বেরিয়ে যাও।’
লতফা ও রিনু দুজনের গায়েই বোরকা ছিল। তারা ব্যাগ নেয়ার জন্য অন্দরমহলে দৌড়ে যায়। পদ্মজা বিদায় জানাতে অন্দরমহলে আসে। বের হওয়ার পূর্বে রিনু ও লতিফা পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। লতিফা বিষণ্ণ গলায় বললো, ‘ আবার দেখা হইবো তো পদ্ম?’
‘আল্লাহ চাইলে,আবার আমাদের দেখা হবে বুবু।’
‘সামলাইতে পারবা সব?’
‘পারবো। তুমি বেরিয়ে যাও। আর দেরি করো না।’
লতিফা এক হাতে ব্যাগ নিয়ে অন্য হাতে রিনুর হাত ধরলো। তারপর ছলছল চোখে পদ্মজাকে একবার দেখে বেরিয়ে পড়লো অচেনা গন্তব্যে। আমিনা সদর ঘর থেকে সবকিছু দেখেছেন। এতদিনের পুরনো কাজের মেয়ে চলে যাচ্ছে কেন? তিনি প্রবল আগ্রহ থেকে পদ্মজাকে প্রশ্ন করলেন, ‘ লুতু কই যাইতাছে?’
পদ্মজা শান্ত স্বরে বললো, ‘ শহরে যাচ্ছে।’
‘ওমা! কার কাছে?’
‘আপনি ঘরে যান। সকাল হওয়া অবধি বের হবেন না।’
আমিনা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কেরে?’
পদ্মজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো,বললো, ‘ এতদিন যেরকম নির্জীব ছিলেন আজও থাকুন।’
পদ্মজা রান্নাঘর থেকে হাতে রাম দা তুলে নিল। তারপর আমিনাকে জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ করার আগে আমিনার উদ্দেশ্যে বললো, ‘যদি কোনো শব্দ করেন আপনার মাথা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে।’
তারপর পদ্মজা রাম দা নিয়ে গোয়ালঘরে গেল। সেখান থেকে তিনটে নেড়ি কুকুর নিয়ে পুকুরপাড়ের পথ ধরলো।
.
নিশীথে পাঁচজন মানুষ বাঁধা অবস্থায় মাথা ঝুঁকে ঘুমাচ্ছে। আর সামনে রাম দা নিয়ে এক রূপসী বসে আছে। পাশে তিনটে কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটি ভয়ংকর। সুনসান নীরবতায় কেটে যায় ক্ষণ মুহূর্ত। আর সময় নষ্ট করা যাবে না। তারা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মৃত্যু উপভোগ না করে অমানুষগুলো মরে যাক পদ্মজা চায় না। সে দুই জগ পানি পাঁচ জনের মাথার উপর ঢেলে দিল। তাতেও তাদের ঘুম ভাঙলো না। পদ্মজা রাম দার শেষ প্রান্ত দিয়ে পর পর পাঁচজনের পায়ের তালুতে আঘাত করলো। এতে কাজ হয়। তারা সক্রিয় হয়। পাঁচ জনই আধবোজা চোখে তাকায়। তাদের ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি। মাথা ভারী হয়ে আছে। ভনভন করছে। পদ্মজা চৌকিখাটের উপর গিয়ে বসলো। রিদওয়ান পদ্মজাকে ঝাপসা ঝাপসা দেখছে। সে চোখ বুজে আবার তাকালো। পদ্মজার হাসি হাসি মুখটা ভেসে উঠে। তার হাতে রাম দা। জ্বলজ্বল করছে পদ্মজার পাশের তিনটে কুকুরের চোখ! রিদওয়ান চমকে গেল। মজিদ,খলিল এবং আসমানি যখন পরিস্থিতি বুঝতে পারলো তারাও চমকে যায়। তারা কথা বলতে গেলে ‘উউউ’ আওয়াজ বের হয়। উঠতে গেলে টের পায় তাদের হাত-পা বাঁধা। ঘুম উবে যায়। মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। রিদওয়ান অবাক চোখে মজিদের দিকে তাকায়। মজিদও তাকালেন। তারা ছোটার জন্য ছটফট করলো। কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হচ্ছে না। আমির পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটি বার বার বুজে যাচ্ছে। তবে পরিস্থিতি ধরতে পেরেছে। সে সবসময় বলে,পদ্মজার নাকি নিজস্ব আলো আছে! এইযে এখন তার মনে হচ্ছে,অন্ধকারাচ্ছন্ন অতলে যখন সে তলিয়ে যাচ্ছিল তখন পদ্মজা এসে আলোর মিছিলে ভরিয়ে দিয়েছে তার মনের উঠান!
নিশীথে পাঁচজন মানুষ বাঁধা অবস্থায় মাথা ঝুঁকে ঘুমাচ্ছে। আর সামনে রাম দা নিয়ে এক রূপসী বসে আছে। পাশে তিনটে কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটি ভয়ংকর। সুনসান নীরবতায় কেটে যায় ক্ষণ মুহূর্ত। আর সময় নষ্ট করা যাবে না। তারা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মৃত্যু উপভোগ না করে অমানুষগুলো মরে যাক পদ্মজা চায় না। সে দুই জগ পানি পাঁচ জনের মাথার উপর ঢেলে দিল। তাতেও তাদের ঘুম ভাঙলো না। পদ্মজা রাম দার শেষ প্রান্ত দিয়ে পর পর পাঁচজনের পায়ের তালুতে আঘাত করলো। এতে কাজ হয়। তারা সক্রিয় হয়। পাঁচ জনই আধবোজা চোখে তাকায়। তাদের ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি। মাথা ভারী হয়ে আছে। ভনভন করছে। পদ্মজা চৌকিখাটের উপর গিয়ে বসলো। রিদওয়ান পদ্মজাকে ঝাপসা ঝাপসা দেখছে। সে চোখ বুজে আবার তাকালো। পদ্মজার হাসি হাসি মুখটা ভেসে উঠে। তার হাতে রাম দা। জ্বলজ্বল করছে পদ্মজার পাশের তিনটে কুকুরের চোখ! রিদওয়ান চমকে গেল। মজিদ,খলিল এবং আসমানি যখন পরিস্থিতি বুঝতে পারলো তারাও চমকে যায়। তারা কথা বলতে গেলে ‘উউউ’ আওয়াজ বের হয়। উঠতে গেলে টের পায় তাদের হাত-পা বাঁধা। ঘুম উবে যায়। মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। রিদওয়ান অবাক চোখে মজিদের দিকে তাকায়। মজিদও তাকালেন। তারা ছোটার জন্য ছটফট করলো। কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হচ্ছে না। আমির পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটি বার বার বুজে যাচ্ছে। তবে পরিস্থিতি ধরতে পেরেছে। সে সবসময় বলে,পদ্মজার নাকি নিজস্ব আলো আছে! এইযে এখন তার মনে হচ্ছে,অন্ধকারাচ্ছন্ন অতলে যখন সে তলিয়ে যাচ্ছিল তখন পদ্মজা এসে আলোর মিছিলে ভরিয়ে দিয়েছে তার মনের উঠান!
পদ্মজা পাঁচজনকে পরখ করে নিল। তাদের ছটফটানি আর ভয়ার্ত চোখ পদ্মজার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ও তৃপ্তিকর দৃশ্য। আমিরের উপর চোখ পড়তেই আগে চোখে ভাসে আমিরের অযত্নে বেড়ে উঠা মাথার চুল। যা আমিরের কপাল ও চোখ ঢেকে রেখেছে৷ পদ্মজা উঠে দাঁড়ালো। রিদওয়ান ও মজিদের পাশে গিয়ে বসলো। দূরে সন্তানহারা পেঁচা ডাকছে চাপাস্বরে। আশেপাশে নাড়াচাড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। পদ্মজা তাদের উপর ঝুঁকলো। তারপর মৃদু হেসে চাপাস্বরে বললো, ‘ তবে হউক উৎসব। ‘
পদ্মজার কন্ঠ ও হাসি তাদের হৃৎপিণ্ডে জোরেশোরে আঘাত হানে। আসমানি ‘উউ’ শব্দ করই চলেছে। সে ভীতগ্রস্ত। ভয়ে তার শরীরে ঘাম হচ্ছে। ভয় পাচ্ছে উপস্থিত চারজনই। পদ্মজা আনাড়ি নয়৷ সে এর আগে তিনটে খুন করেছে। শেষ খুনটা নিখুঁত ছিল! পদ্মজাকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রিদওয়ান শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। পদ্মজা হিজল গাছটির দিকে এগিয়ে যায়। লতিফা হিজল গাছের পিছনে কাপড়ের ব্যাগটি রেখেছে। পদ্মজা কাপড়ের ব্যাগখানা নিয়ে আসে। ব্যাগ উল্টো করতেই বেরিয়ে আসে তিনটে বৈয়াম, চাপাতি,ছুরি,রাম দা ও তলোয়ার। অস্ত্রগুলো দেখেই বন্দীদের আত্মা কেঁপে উঠে। খলিল হাওলাদার ভয়ে পা দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে গোঙানো শুরু করলেন। পদ্মজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। ছুরি নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসে। পদ্মজার হাতে ছুরি দেখে কুকুরগুলো পালাতে উদ্যত হয়। কিন্তু তারা সুপারি গাছের সাথে বাঁধা! তাই পালাতে পারলো না। ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে উঠলো।
পদ্মজা খলিলের উপর ঝুঁকে তার মাথার চুল শক্ত করে ধরে কিড়মিড় করে বললো, ‘ যে হাত দিয়ে এতদিন হত্যা করে আসা হয়েছে আমি আজ সেই হাত কেটে ফেলবো।’
খলিল চোখ দুটি মারবেলের মতো বড় বড় হয়ে যায়। পদ্মজার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে পূর্ণার মৃত দেহের সোঁদা গন্ধ৷ ভেসে উঠে আঁচড় কাটা মায়াবী মুখটা। সে মনের ক্রোধ প্রকাশ করতে,খলিলের চুলে ধরে রেইনট্রি গাছের সাথে বার কয়েক আঘাত করলো। খলিলের মাথা ফুলে টিলার মতো উঁচু হয়ে যায়। যে চোখে এতদিন হিংস্রতা ছিল সেই চোখে ভয়ের ছাপ।
পদ্মজা ছুরি দিয়ে খলিলের হাত-পায়ের চামড়া ছিঁড়ে দিল। তারপর বৈয়াম থেকে মরিচ নিয়ে সেখানে আহত স্থানে মাখিয়ে দিল। খলিলের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। তিনি কেঁদে কিছু বলছেন,কিন্তু ‘উউ’ ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছে না। যন্ত্রণায় তার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। জ্বলে যাচ্ছে হাত-পা।
খলিলকে ছেড়ে পদ্মজা সরু চোখে রিদওয়ানের দিকে তাকালো। কাছে কোথাও থেকে থেকে পেঁচা ডাকছে। জোনাকি পোকাদের দেখা যাচ্ছে না। কুকুর তিনটে পদ্মজার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
খলিলকে আঘাত করার সময় পদ্মজার চোখেমুখে যে হিংস্রতা ফুটে উঠেছিল, সেই দৃশ্য দেখে তারা অবাক হয়েছে৷ পদ্মজাকে তাকাতে দেখে রিদওয়ান চট করে চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিল। খলিলের অবস্থা দেখার পর থেকে সে পদ্মজাকে ভয় পাচ্ছে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে ছোটার। রিদওয়ানের চোরা চাহনি দেখে পদ্মজা হয়তো হাসলো। মধ্যরাতের বাতাস ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। পদ্মজা দ্বিতীয় বৈয়ামটি নিয়ে রিদওয়ানের দিকে এগিয়ে আসে। পদ্মজার একেকটা কদম রিদওয়ানের আত্মাকে কাঁপিয়ে তুলছে। পদ্মজা রিদওয়ানের পাশে বসলো। রিদওয়ান আড়চোখে পদ্মজার দিকে তাকায়। পদ্মজা রিদওয়ানের মুখের সামনে মুখ নিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। বললো, ‘ রাখে আল্লাহ মারে কে হা?’
রিদওয়ান একটু নড়াচড়া করে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। পদ্মজা এক থাবায় রিদওয়ানের মুখ থেকে ওড়নার বাঁধন খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রিদওয়ান মজিদের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ আমি আগেই বলছিলাম এই মেয়ে আমাদের বিপদের কারণ হবে। শুনেননি।’
পদ্মজা খপ করে রিদওয়ানের তালুর চুল টেনে ধরলো। রিদওয়ান পদ্মজার মুখে থুথু ছুঁড়ে মারে। পদ্মজা তার মুখ দ্রুত সরিয়ে নেয়। রিদওয়ানের থুথু রিদওয়ানের মুখের উপরই পড়লো। রিদওয়ান কটমট করে তাকালো। বললো, ‘ বে** মা* তোরে প্রথম দিনই মেরে ফেলা উচিত ছিল।’
পদ্মজা উঠে দাঁড়ায়। জোরে লাথি মারে রিদওয়ানের মুখে। লাথি খেয়ে রেইনট্রি গাছের সাথে আঘাত পায় রিদওয়ান। তার মাথা ভনভন করে উঠে। রিদওয়ান কিছু বুঝে উঠার আগে পদ্মজা তার প্যান্টের ভেতর বৈয়াম থেকে কিছু ঢেলে দিল। সেকেন্ড কয়েক পার হতেই বিশেষস্থানে জ্বালাপোড়া অনুভুব করে। একসাথে অনেকগুলো জীবের কামড়ে তার মুখ নীল হয়ে যায়। সে চমকে তাকায় পদ্মজার দিকে। প্রশ্ন করে, ‘কী দিছস? খান** ঝি প্যান্টের ভেতর কী দিছস তুই?’
পদ্মজা উত্তর দিল না। রিদওয়ান চিৎকার করতে থাকে। পদ্মজা রয়ে সয়ে রিদওয়ানের চিৎকার করার দৃশ্য দেখতে দেখতে কুকুরগুলোকে মুক্ত করে দেয়। কুকুর তিনটে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে পিছিয়ে যায়। পদ্মজা তৃতীয় বৈয়াম নিয়ে মজিদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। বৈয়াম থেকে দুই টুকরো কাঁচা মাংস বের করলো। ছাগল জবাই করেছিল আজ। সে দেখেশুনে হাড্ডিসহ কয়েক টুকরো মাংস রেখে দিয়েছিল। মাংস দেখে কুকুরগুলোর চোখ চকচক করে উঠলো। পদ্মজা এক টুকরো মাংস নিয়ে মজিদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মজিদের মুখের উপর মাংসের টুকরোটি ধরলো। তিনটে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে মজিদের উপর। কুকুরগুলো লাফ দিতেই পদ্মজা মাংসের টুকরোটা মজিদের উরুর উপর ছেড়ে দেয়।
কুকুরগুলোকে নিজের দিকে তেড়ে আসতে দেখে মজিদ নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যান। চোখের পলকে মজিদের হাত-পা ও মুখের চামড়া ছিঁড়ে যায়। বেরিয়ে আসে রক্ত। এক টুকরো মাংস নিয়ে তিন কুকুরের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়। তাদের বিষদাঁতের কামড় পড়ে মজিদের গোপনাঙ্গে!
তিনি গোঙাতে গোঙাতে চোখের ইশারায় পদ্মজাকে আকুতি করেন এসব যেন থামানো হয়। অন্যদিকে রিদওয়ান ছোটার জন্য ছটফট করছে। পদ্মজাকে বিশ্রী গালিগালাজ করে হুমকিও দিয়েছে। যখন পিপড়ার কামড়ে সর্বাঙ্গ বিষিয়ে উঠে তখন সে পদ্মজাকে অনুরোধ করে তাকে বাঁচাতে। কখনো পদ্মজাকে দেবী বলে আবার কখনো মা বলে ডাকলো। ওয়াদা করলো,সে আর কখনো অন্যায় করবে না। পদ্মজা উত্তরে কিছুই বলেনি। সে নির্বিকার। রিদওয়ান ও কুকুরের চিৎকার শুনে মাথার উপর এক ঝাঁক পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল। আবার ডানা ঝাপটিয়ে ফিরে এলো। পাখিদের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। তাদের অস্থিরতায় দানবের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর কচি ডালপালা ও পাতা বার বার নড়েচড়ে উঠছে। পদ্মজা এবার বৈয়াম নিয়ে খলিলের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। পূর্বের মাংসটি নিয়ে একটি কুকুর দৌড়ে দূরে চলে যায়। তার পিছনে পিছনে বাকি দুটি কুকুরও গেল।
পদ্মজা আরেক টুকরো মাংস খলিলের মুখের উপর ধরলো। তারপর কুকুর তিনটের আকর্ষণ পেতে মুখ দিয়ে শব্দ করলো, ‘হুশশ!’
খলিল হাওলাদার কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে ভয়ে প্রস্রাব করে দিলেন। পদ্মজার ডাকে তিনটে নেড়ি কুকুর সাড়া দিল। তারা ঘেউ ঘেউ করে দৌড়ে আসে। খলিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পদ্মজা আগের মতোই হাতের মাংস খলিলের উরুর উপর ছেড়ে দিল।
তারপর আরেক টুকরো মাংস নিয়ে আসমানির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বৈয়াম রাখলো মাটিতে। একটা কুকুর পদ্মজার পিছনে এসে দাঁড়ায়। ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে,তাকে মাংস দিতে। পদ্মজার এক হাতে ছুঁরি বলে ভয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মাংস কেড়ে নেয়ার সাহস পাচ্ছে না। আসমানি পদ্মজাকে তার সামনে দাঁড়াতে দেখে গোপনে ঢোক গিলল। তার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। সে কিছু একটা বলতে চাইছে। চোখের জলে যেন এক্ষুনি বন্যা বয়ে যাবে! মেয়েরা ভালো হউক,খারাপ হউক, বুড়ো হউক আর যুবতী হউক তারা ভীষণ কাঁদতে পারে! পদ্মজা আসমানির মুখ মুক্ত করে দিল। আসমানি কাঁদো কাঁদো স্বরে অনুরোধ করলো, ‘ আল্লাহর দোহাই লাগে ভাবি,আমারে ছাইড়া দেন। আমি আপনার গোলামি করাম সারাজীবন।’
পদ্মজা আসমানির সামনে বসলো। আসমানির উপর ঝুঁকে তার গাল আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে আদুরে স্বরে বললো, ‘ তুমি ভীষণ সুন্দর।’
পদ্মজার ঠান্ডা স্পর্শ আসমানির যকৃত ছুঁয়ে ফেললো। সে কেঁপে উঠে। চোখেমুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে পদ্মজার চোখের দিকে তাকায়। পদ্মজা হাসলো। আসমানির চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে বললো, ‘ আমি পুরুষ না যে আমাকে আকৃষ্ট করবে। আমার বোনের মৃত্যুকষ্ট তোমাকেও অনুভব করতে হবে।’
পদ্মজা হাতের মাংসের টুকরোটি মজিদের উপর ছুঁড়ে মারলো। তাৎক্ষণিক কুকুর তিনটে মজিদের উপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পদ্মজা আসমানির পায়ের দঁড়ি খুলে সেই দঁড়ি দিয়ে আসমানির গলা পেঁচিয়ে ধরে৷ আসমানির চোখ উল্টে যায়। পদ্মজার চোখেমুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে শান্ত,স্বাভাবিক। যখন আসমানি নিস্তেজ হওয়ার পথে পদ্মজা দঁড়ি ছেড়ে দিল৷ আসমানি কাশতে কাশতে নতজানু হয়। পদ্মজা আবার পেঁচিয়ে ধরলো। আসমানি দুই পা দাপিয়ে দম নেয়ার চেষ্টা করে। তার শাড়ি হাঁটু অবধি চলে এসেছে। যতক্ষণ না আসমানির নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয় পদ্মজা শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে টেনে ধরে রাখে দঁড়ি। ক্ষণমুহূর্ত যুদ্ধে আসমানি নিস্তেজ হয়ে যায়। পদ্মজা দঁড়ি ছেড়ে দিল। আসমানির জিহবা মুখের ভেতর নেই। বাইরে বেরিয়ে এসেছে। চোখ দুটি উল্টে রয়েছে। সারামুখ কালচে ভাব। পদ্মজা তার দুই হাত ঝেড়ে আসমানির মৃত লাশ থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়।
পিঁপড়ার কামড়ে রিদওয়ানের কোমর থেকে পায়ের তালু অবধি অবশ হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ! শরীর ব্যথায় টনটন করছে। তার স্পর্শকাতর স্থান গুরুতর আহত। পদ্মজা ছুরি নিয়ে রিদওয়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়। রিদওয়ানের উরুতে ছুরি প্রবেশ করে আবার বের করে আনে। রিদওয়ান চিৎকার করে উঠলো। অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলো, ‘ আর না। আর না…’
পদ্মজা শূন্যে ছুরি ছুঁড়ে মেরে কৌশল করে ধরলো। তারপর ছুরি দিয়ে
রিদওয়ানের শরীরে অগণিত আঘাত করতে থাকে। তারপর এক চোখ তুলে নিল। রিদওয়ান জোরে আর্তনাদ করে উঠে। আকুতি করে তাকে মৃত্যু দিতে নয়তো বাঁচতে দিতে। পদ্মজা দাঁতে দাঁত চেপে রিদওয়ানের দুই গাল চিপা দিয়ে ধরলো। ফিসফিস আওয়াজের মতো করে বললো, ‘ এই…এই চোখগুলো আর কোনোদিন কোনো মেয়েকে দেখবে না।কোনোদিন না।’
রিদওয়ানের এক চোখ থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে৷ কুকুরগুলো আরো মাংসের জন্য বিরতিহীনভাবে চিৎকার করে যাচ্ছে৷ পদ্মজা তার কথা শেষ করে রিদওয়ানের আরেকটা চোখে ছুরি ঢুকিয়ে দিল। তারপরই মুখের উপর ছুরি দিয়ে তেরছাভাবে টান মারলো। রিদওয়ানের নাক ছিঁড়ে উপরের ঠোঁট দুই ভাগ হয়ে যায়। চিৎকার করার শক্তিটুকুও আর সে পেল না। তার পূর্বেই বেহুশ হয়ে যায়। পদ্মজা ক্রোধে মৃদু কাঁপছে। তার সাদা শাড়ি ইতিমধ্যে রাঙা হয়ে গেছে। সে রাম দা নিয়ে নিঃশ্বাসের গতিতে যেভাবে পারে রিদওয়ানকে কোপাতে থাকলো। তার মুখ দিয়ে ক্রোধ স্বর বের হচ্ছে। রিদওয়ান শরীরের মাংস ছিটকে পড়ে এদিকসেদিক। লুকিয়ে দেখা নিশাচরেরা একস্বরে ডেকে উঠে। তারা পদ্মজাকে তার কাজে সাহস যোগাতে কিছু বলছে? নাকি ভয় পেয়ে ডাকছে? কে জানে!
প্রায় মিনিট দশেক পর পদ্মজা স্থির হয়ে দাঁড়ালো৷ তার মুখ রক্তে অস্পষ্ট। চোখ দুটি ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। শাড়ি তাজা রক্তে জবজবে! সামনের চুলগুলো রক্তে আঠালো হয়ে গেছে। তার বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে। নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন। বাতাস পদ্মজার সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে আলিঙ্গন করার জন্য ধেয়ে আসে। পদ্মজা রাম দা থেকে রক্ত পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে। সে রাম দা রেখে সদ্য কেনা চাপাতি তুলে নেয় হাতে। ঘুরে এসে মজিদের সামনে দাঁড়ায়। কুকুরের আঁচড় আর কামড়ে মজিদের প্রাণ নেতিয়ে পড়েছে! পদ্মজা মজিদের মুখের বাঁধন খুলে দেয় মজিদের শেষ আর্তনাদ শোনার জন্য। মজিদ অস্পষ্ট স্বরে বললো, ‘ মা,মা…আমায়…’
মজিদ কথা শেষ করতে পারলেন না। পদ্মজা চিৎকার করে হাত ঘুরিয়ে এক আঘাতে মজিদের মাথা দ্বিখণ্ডিত করে ফেললো। রক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ে। বুরবুর শব্দ তুলে পেটের নাড়িভুড়ি ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। পদ্মজা এক মুহূর্তও থামলো না। হিংস্র তাণ্ডব চালিয়ে গেল। তার রক্তের তৃষ্ণা মিটেনি! সে খলিলের মুখের বাঁধন খুলে দিল। পদ্মজাকে রক্তমানবী মনে হচ্ছে। তার শরীরে প্রতিটি লোমকূপ রক্তে স্নান করেছে। খলিল হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো, ‘ও মা, ও মা আমারে ছাইড়া দেও। আমি তোমার বাপের মতো। ও মা আমারে ছাইড়া দেও….’
পদ্মজা দাঁত বের করে হাসলো। তার দাঁতেও রক্ত লেগে আছে! ভয়ানক দেখাচ্ছে! কোথায় গেল তার ভুবনমোহিনী রূপ? রক্তের সাগরে ডুব দিয়েছে সে। পদ্মজা চাপাতি দুই হাতে ধরে হাত ঘুরিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো খলিলকে আঘাত করতে থাকে। এক আঘাতেই খলিলের আত্মা দেহ ছেড়ে দেয়। কিন্তু পদ্মজা থামলো না। সে ক্রোধ স্বর মুখে রেখে খলিলকে ইচ্ছেমতো কোপাতে থাকলো। ক্যাচক্যাচ শব্দে চারপাশ কেঁপে কেঁপে উঠে। আঘাতে আঘাতে খলিলের এহ হাত,কান, নাক শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। পদ্মজা ক্লান্ত হয়ে চাপাতি খলিলের মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। বাম হাতে কোমর থেকে আরেকটা ছুরি নিয়ে খলিলের পেটে ঢুকিয়ে দিল। রিদওয়ান, মজিদ আর খলিলের রক্ত মাটি বেয়ে পুকুরের কালো জলের দিকে যাচ্ছে। পদ্মজা মাটিতে বসে পড়ে। নেড়ি কুকুরগুলো ভয় পেয়ে দূরে চলে গিয়েছে। দূর থেকে তারা পদ্মজাকে দেখছে।
হিংস্র ঝড়ের তান্ডব থামতেই চারিদিকে নিস্তব্ধতা ভর করে। পদ্মজা ভীষণ ক্লান্ত। সে দুই চোখ বুজে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিল। তারপর মাথা তুলে আমিরের দিকে তাকালো। আমির এতক্ষণ পদ্মজার দিকে তাকিয়ে ছিল। পদ্মজাকে তার দিকে তাকাতে দেখে সে চোখ সরিয়ে নিল। আমিরের চোখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। সে শান্ত হয়ে বসে আছে। কোনো ছটফটানি নেই,অস্থিরতা নেই,ভয় নেই। সে নির্লিপ্ত। পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকালো। আমিরের দেয়া নতুন তলোয়ারটি ঘাসের উপর পড়ে আছে। পদ্মজা মাটিতে হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তিন কদম এগিয়ে তলোয়ারটি হাতে তুলে নিল। তারপর ফিরে তাকালো আমিরের দিকে। সেদিনের কথা,যেদিন আমির নিজে এই তলোয়ার পদ্মজার হাতে তুলে দিয়েছিল,জীবন নেয়ার অনুমতি দিয়েছিল! এ কথা শুনে পদ্মজার সেকি কান্না! কিন্তু আজ পদ্মজা শুধুই পদ্মজা,প্রিয় স্বামীর পদ্মবতী নয়! পদ্মজা শক্ত করে তলোয়ার ধরে সামনে এগিয়ে যায়। সে যত এগুচ্ছে অনুভব করছে বুকের ভেতরের শক্ত আবরণটা সরে যাচ্ছে। একটা নরম কোমল অনুভূতি জেঁকে বসছে!
পদ্মজা আমিরের সামনে এসে দাঁড়াতেই আমির চোখ তুলে তাকালো। এইযে রাতের বাতাসে পদ্মজার এক দুটো চুল উড়ছে। তাতেও ভালো লাগছে। রক্তের মাখামাখিও পদ্মজার রূপের বাহার নষ্ট করতে পারেনি। অন্তত আমিরের কাছে!
নির্জন,নিরিবিলি পরিবেশে আমিরকে এমন অবস্থায় এতো কাছে দেখে পদ্মজার চোখগুলো শীতল হয়ে উঠে। তার মনে হচ্ছে, আমিরের চোখ,পা,হাত,বুক,বাহু সব কথা বলছে! সেদিনই তো তাদের বিয়ে হলো। আমির তার শক্তপোক্ত দুটি হাত দিয়ে পদ্মজাকে কোলে নিয়ে ঘরে তুলে। উপহার দেয় নতুন সংসার,নতুন পৃথিবী! সে আমিরের সংস্পর্শে এসে আবিষ্কার করে নতুন এক সত্ত্বা। পুরনো কথা ভেবে পদ্মজার কণ্ঠনালিতে একটা যন্ত্রণা ঠেকছে। তার কণ্ঠনালী ব্যথা করছে! সে মাটিতে তলোয়ার রেখে রেইনট্রি গাছের দঁড়ি থেকে আমিরকে মুক্ত করে দেয়। এখন শুধু আমিরের হাত-পা আর মুখ বাঁধা। পদ্মজা আমিরের সামনে বসলো। আমিরের নতজানু মুখটা নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করলো । তারপর আমিরের বুকে সাবধানে এক হাত রাখলো। পদ্মজার একটুখানি ছোঁয়া আমিরের সত্ত্বাকে কাঁপিয়ে তুলে। যেন সমুদ্রের ঢেউ গর্জে উঠে। আকাশ ভেঙে বজ্রপাত পড়ে!
কুকুরগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। পদ্মজার ছলছল চোখ দুটি স্পষ্ট! আমিরের মনে হচ্ছে, আকাশের চাঁদটা ঠিক পদ্মজার মাথার উপরেই। সে সকল অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু পদ্মজাকে কোমল চোখে তাকাতে দেখে তার বুকটা হুহু করে কেঁদে উঠলো। চোখের চাহনীতে মনের সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছে পদ্মজা। বুঝা যাচ্ছে সে আমিরের প্রেমে কতোটা মাতোয়ারা! আমির আশা করেনি,এই মুহূর্তে এতোকিছুর পর পদ্মজার চোখে পুরনো প্রেম দেখতে পাবে! বুকটা আর কত পুড়বে? যখন একসাথে থাকা সম্ভবই নয়।
আমিরের চুপ থাকা,আমিরের নির্লিপ্ততা বলে দিচ্ছে সে পদ্মজার কোনো আঘাতকেই পরোয়া করে না। আমিরের মায়া মায়া চোখ দুটি গ্রাস করে ফেলে পদ্মজাকে। কেনো জানি তার খুব কান্না পাচ্ছে! বুকের ভিতরে কোথায় যেনো লুকানো জায়গা থেকে একদল অভিমান প্রচণ্ড কান্না হয়ে দু’চোখ ফেটে বেরুতে চাইছে। পদ্মজা ধীর কণ্ঠে বললো, ‘কেন আমায় ভালোবাসলেন না?’
তার কণ্ঠে কান্না! আমিরের এক চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। সে কোন শাব্দিক উচ্চারণে বোঝাবে,পদ্মজাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে? কী করে বলবে? সে পদ্মজার জন্য বিষের দাঁনা!
ভালোবাসা এক ভয়ংকর মহামারির নাম। যে মহামারির একমাত্র পথ,বিপরীত মানুষটিকে ছাড়া নিঃস্ব হয়ে যাওয়া। এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে কত মানুষ বৈরাগী হয়েছে! আর আমির বেছে নিয়েছে মৃত্যু! পদ্মজা হুট করে আমিরের কপালে চুমু খেল। আমিরের হৃৎপিণ্ড জ্বলে উঠে! তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। পদ্মজার দুই চোখের জল আটকাতে পারলো না। সে বললো, ‘ আপনার দুটি সত্ত্বার একটি আমার স্বামী। আমি তাকে সম্মান করি। কিন্তু অন্য সত্ত্বার জন্য আপনাকে মরতে হবে।’
পদ্মজা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকাচ্ছে। আমির নিজেকে সামলে চোখের দৃষ্টি নত করলো। পদ্মজা নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে,বুকটা জ্বলে যাচ্ছে কেন? একটু আগের তেজটা কেন নেই বুকের ভেতর? আমিরের ভালোবাসার অভাব তাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ছয়টা বছর মানুষটা এতো কেন ভালোবাসলো? এত নিখুঁত ভালোবাসার অভিনয় হতে পারে? কাঙাল সে,তার স্বামীর ভালোবাসার কাঙাল। কিন্তু সেই ভালোবাসাই প্রতারণা করলো। এই ভালোবাসা ভাগ হয়েছে আরো আগে। কষ্টগুলো বাতাসে উড়ে যায় না কেন?
পদ্মজা খাপ থেকে তলোয়ার বের করলো। তলোয়ারখানা দেখে পদ্মজার বুকের ভেতরে দ্রিমদ্রিম করে কিছু বাজতে থাকে। কেঁপে উঠে তার হাত। পদ্মজা ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করলো। তারপর কাঁপা হাতে আমিরের মুখ থেকে ওড়নার বাঁধন খুলে দিল। আমিরের আর্তনাদ শোনার জন্য নয়! সে চায়,আমির তাকে কিছু বলুক। কিন্তু কী শুনতে চায় সে জানে না। আমিরের বেলা সে কঠোর হওয়া তো দূরে থাক,তলোয়ার চালানোর সাহস পাচ্ছে না। আমির মাথা নত করে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর জন্য। মৃত্যু তার জন্য উপহার! পদ্মজা আঘাত করতে সময় নিচ্ছে। আমিরের নিশ্চুপতা তার মনের ব্যথা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সে বেহায়া হয়ে কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো, ‘কিছু বলার আছে?’
আমির তাকালো। এইতো…এই দৃষ্টি পদ্মজাকে খুন করে ফেলে! তীরের বেগে বুকের ভেতর ছিদ্র করে ফেলে! এই পৃথিবীতে নাকি শ্যামবর্ণ অবহেলিত! অথচ ভুবনমোহিনী রূপসী পদ্মজা শ্যামবর্ণ এক পুরুষকে ভালোবেসে থমকে গিয়েছে! আমির বললো, ‘ গত চারদিনের যন্ত্রণার একাংশ যদি তুমি অনুভব করতে আমাকে খুন না করে বাঁচিয়ে রাখতে। আমার শাস্তি হতো আমার বেঁচে থাকা!’
আমির কথা শেষ করে চোখের পলক ফেলার পূর্বে পদ্মজা তার বুকের মধ্যিখানে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল। তলোয়ার বুক ভেদ করে পিঠে গিয়ে ঠেকে!
আচমকা আক্রমণ করায় আমির অবাক হলো। তার মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। বুকের যন্ত্রণারা শেষবারের মতো দুই চোখ ছাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমিরের মুখ থেকে এতো রক্ত বের হতে দেখে পদ্মজার পায়ের তলা কেঁপে উঠে। সে সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার টেনে বের করলো। আমিরের দেহটা দপ করে শব্দ তুলে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। পদ্মজা বুক ছ্যাঁৎ করে উঠে। বুকের ভেতর পাহাড় ধ্বসে পড়ে। সে দ্রুত আমিরের দুই হাতের বাঁধন খুলে দেয়। বুকের ভেতর থেকে শব্দ তুলে কান্নারা বেরিয়ে আসে। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ‘ যাবেন না…যাবেন না।’
আমিরের শরীর দুই-তিনটে ঝাঁকি দিয়ে নিথর হয়ে যায়। পদ্মজা মাথায় এক হাত দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো এদিকসেদিক তাকায়। তার শরীরটা কেমন যেন করছে। চোখের সামনে তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রেমের রাজপ্রাসাদ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে! সে শব্দ শুনতে পাচ্ছে। শব্দের আঘাতে তার মগজ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পদ্মজা আর্তনাদ করে উঠে। দুই হাতে মাটি চাপড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, ‘আল্লাহ…আল্লাহ।’
তার চিৎকার শুনে সন্তানহারা পেঁচাটির কান্না থেমে যায়। ‘আল্লাহ’ উচ্চারণটি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে যেন বার বার৷ এই একটি ডাকে পদ্মজার সর্বহারার বেদনা ফুটে উঠে। সে আপন মানুষদের মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তার যন্ত্রণার পাহাড় ভেঙে গেছে। পদ্মজা বাচ্চাদের মতো হাঁটুতে ভর দিয়ে একবার ডানে যায় আরেকবার বামে যায়। তারপর আমিরের মাথার কাছে এসে বসে। আমিরের চোখ দুটো খোলা। পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আছে! চোখ জোড়ার কি পদ্মজাকে দেখার তৃষ্ণা মেটেনি?
‘তোমাকে দেখার তৃষ্ণা আমার কখনোই মিটবে না,পদ্মবতী।’ পদ্মজা চমকে পিছনে তাকায়। কেউ নেই। ডান পাশ থেকে আবার শুনতে পায় একই কথা। পদ্মজা ডান পাশে তাকায়। তারপর শুনতে পায় বাম পাশ থেকে। পদ্মজা চরকির মতো ঘুরতে থাকে। সে বাস্তব দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেক আগে। আমিরের বলা পুরনো কথাগুলো সে শুনছে। প্রতিটি কথা তাকে সূচের মতো খোঁচাচ্ছে। পদ্মজা এতো ব্যথা সহ্য করতে না পেরে দুই হাতে খামচে ঘাস টেনে তুললো। তারপর এক হাত দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে করতে চিৎকার করে কাঁদলো।
কাঁদতে কাঁদতে তার গলার স্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। সে শরীরের ভার ছেড়ে দেয়। সেজদার মতো উঁবু হয়। তারপর মাথা তুলে এক হাতে আমিরের চোখ দুটি বন্ধ করে দিল। চোখের জল মুছে চারপাশে চোখ বুলাল। তার চোখের দৃষ্টি অস্থির৷ নিঃশ্বাস এলোমেলো। এই বিশাল পৃথিবীতে এখন সে একা!
আচমকা সে উঠে দাঁড়ায়। যেখানে ভোজ আসর হয়েছিল সেখানে ছুটে যায়। আমিরের প্লেট আলাদা। তার প্লেটে দুটো পদ্মফুল আঁকানো। পদ্মজা খুঁজে খুঁজে আমিরের প্লেটটা বের করলো। সেখানে কিছু খাবার অবশিষ্ট ছিল। পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আমিরের মৃত দেহ দেখলো। তারপর দ্রুত অবশিষ্ট খাবারটুকু খেল। খাবার শেষ হতেই পানি না খেয়েই দৌড়ে আমিরের কাছে আসে। একটা তীক্ষ্ণ ঠান্ডা স্রোত বুকের এদিক থেকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। চাঁদটা অর্ধেক ডুবে গিয়েছে। তবে তার আলো এখনো রয়ে গেছে৷ পদ্মজা আমিরকে টেনে সোজা করলো৷
আমিরের শার্টের বুক পকেট থেকে একটি বিষের শিশি বেরিয়ে আসে। পদ্মজা শিশিখানা হাতে নিয়ে অবাক চোখে আমিরের ফ্যাকাসে মুখটা দেখে। সে কিছু একটা বলে কিন্তু কথাটি ফুটল না। তার কথা হারিয়ে গেছে! তারপর ভাবলো, বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে৷ কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়লো, আত্মহত্যা মহাপাপ! পদ্মজা বিষের শিশি ছুঁড়ে ফেলে পুকুরে।
আমিরের মাথাটা কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ গুনগুন করে কাঁদলো পদ্মজা। বাতাসের বেগ বেড়েছে। রক্ত শুকোনোর পথে। ঠান্ডা কাঁটার মতো বিঁধছে শরীরে। পদ্মজার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। সে রক্তাক্ত আমিরকে টেনে মাঝে নিয়ে এসে সুন্দর করে শুইয়ে দিল। তারপর আমিরের নিথর দেহটিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে তার বুকের উপর শুয়ে পড়লো। মিনিট দুয়েক পর ঘুম ঘুম চোখে মাথা উঁচু করে আমিরের দুই গালে সময় নিয়ে দুটো চুমু দিল পদ্মজা। একটা কুকুর পদ্মজাকে ঘিরে হাঁটছে। আর বাকি দুটো কুকুর মজিদ,খলিল,রিদওয়ান ও আসমানির লাশ শুঁকছে। ক্লান্ত পদ্মজা আমিরের বুকে শুয়ে শান্ত হলো। চোখ বুজলো। যে পৃথিবীর লীলাখেলায় সে বাধ্য হয়েছে স্বামীর বুকে অস্ত্র চালাতে সেই পৃথিবীর উদেশ্যে মনের খাতায় চিঠি লিখলো-
‘ক্ষমা করো পৃথিবী। তাকে আমি ঘৃণা করতে পারিনি। তাকে আমি নিষ্ঠুর মৃত্যু দিতে পারিনি। যার হাতের পাঁচটি আঙুল আমার নির্ভরতা,যার বুকের পাঁজরে লেগে থাকা ঘামের গন্ধ আমার সবচেয়ে প্রিয়,যার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া আমার প্রতিদিনের অভ্যাস, যার এলোমেলো চুলে আমি হারিয়ে যাই বারংবার, যার ভালোবাসার আহবানে সবকিছু তুচ্ছ করে ছুটে যাই,যার মিষ্টি সোহাগে অন্য জগতে হারিয়ে যাই, তার কষ্ট আমি কী করে সহ্য করি? লোকে বলে, স্বামীর বাঁ পাঁজরের হাড়ে স্ত্রী তৈরি। তাহলে যার পাঁজরে আমার সৃষ্টি তার আর্তনাদ কী করে শুনি? এই কঠিন কাজ আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ও পৃথিবী সবাইকে বলে দিও,আমার কবরটা যেন আমার স্বামীর কবরের ঠিক বাঁ পাশেই হয়! আমি তাকে ভালোবাসি। যেমন সত্য চন্দ্র-সূর্য তেমন সত্য আমি তাকে ভালোবাসি!
শেষ রাত্রি। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে রক্ত,একটি জিহবা বের করা নারী দেহ,তিনটি ক্ষত-বিক্ষত পুরুষ দেহ ও একটা মাথা। মাঝখানে শুয়ে আছে আমির হাওলাদার। তার বুকের উপর শুয়ে আছে তারই অর্ধাঙ্গিনী তারই খুনি উম্মে পদ্মজা! খাবারে ঘুমের ঔষধ ছিল বলে, পদ্মজা ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনটে নেড়ি কুকুর এলোমেলো হয়ে এদিক সেদিক হাঁটছে। সাঁইসাঁই করে বাতাস বইছে। অনেকগুলো তারার মাঝে একটা চাঁদ। স্বচ্ছ আকাশ। চাঁদটা তার নরম আলো নিয়ে ঠিক আমির-পদ্মজার উপর স্থির হয়ে আছে।
৯১
প্রচণ্ড গরম পড়েছে। প্রেমা ঘেমে একাকার। তৃষ্ণায় তার গলা শুকিয়ে চৌচির! ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে নদীর পানি দিয়ে গলা ভেজাতে পারে। কিন্তু তার ইচ্ছে করছে না। বুকের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে সাত মাস পূর্বেই৷ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া ভগ্নহৃদয় নিয়েই দিব্যি বেঁচে আছে! মাঝে মাঝে সে নিজেকে প্রশ্ন করে, কেন সে বেঁচে আছে?
তুষার তার হাতের সিগারেটটি নদীতে ফেললো। তারপর সামনে তাকালো। কালো বোরকা পরে বসে আছে প্রেমা। তার মাথার উপর বাঁশের ছাউনি। সে চোখ ছোট ছোট করে উদাসীন হয়ে তাকিয়ে আছে দূরে,বহুদূরে। তুষার চার মাস ধরে প্রেমাকে দেখছে। মেয়েটা সবসময় উদাসীন থাকে। তুষার তার কপালের ঘাম মুছলো। গরম ভালোই পড়েছে। সে তার ব্যাগপ্যাক থেকে পানির বোতল বের করে গলা ভেজালো। তারপর প্রেমাকে ডাকলো, ‘ এই মেয়ে,পানি খাও। গরম পড়েছে খুব।’
প্রেমা তাকালো না। তুষার তার এক ভ্রু উঁচিয়ে ডাকলো, ‘ এই যে খুকী? ‘
প্রেমা ঘাড় ঘুরিয়ে ছোঁ মেরে বোতল নিল। তারপর আবার আগের মতো ঘুরে বসলো। প্রেমার ব্যবহারে তুষার বেকুব বনে যায়। তার মাথা চড়ে যায়। এইটুকু মেয়ে বেয়াদবি করলো কীভাবে? তুষার দূরে গিয়ে বসলো। কিন্তু তার রাগ বেশিক্ষণ রইলো না। দোষটা তো তারই! বয়সের পার্থক্যটা বেশি হওয়াতে প্রেমাকে তার বউ মনে হয় না। তাই গত চার মাসের দাম্পত্য জীবনে একবারও সে প্রেমার হাত ধরেনি। কখনো ভাবেওনি তার একটা বউ আছে! শুধু দুজন এক বাড়িতে থেকেছে,এই যা! এই যুগে একরকম চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সের পার্থক্যে স্বামী-স্ত্রী অহরহ দেখা যায়। তবুও কেন যেন তুষার প্রেমাকে ছোট স্কুলপড়ুয়া একটা মেয়ে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না! সে প্রেমার সাথে সবসময় দূরত্ব রেখেছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া মেয়েটাকে সময় দেয়নি,এতোবার কাঁদতে দেখেও আদর করে কখনো কান্না থামায়নি! সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। তুষার যে রসকষহীন কাঠখোট্টা একটা মানুষ প্রেমা বুঝে নিয়েছে! তুষারও বুঝতে পেরেছে। তাকে বুঝিয়েছে তার মা। গত শুক্রবার জুম্মার পর তুষারের মা আয়তুন বিবি তুষারের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেন। বুঝান, বউকে বউয়ের মতো দেখতে। বিয়ে যখন হয়েছে প্রেমাই তুষারের জীবনের নিখুঁত স্ত্রী। প্রেমা নিঃসঙ্গতায় কামড়ে খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। এক বোন কবরে অন্য বোন জেলে। যে স্বামী হয়েছে সেও দূরত্ব বজায় রেখে চলে। এভাবে মেয়েটা কীভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে? মায়ের কথা শোনার পর তুষার কাজকর্ম রেখে অনেক ভেবেছে। উপলব্ধি করলো,পদ্মজার মুখে প্রেমার যে বর্ণনা সে শুনেছিল,যে প্রাণোচ্ছল, লজ্জাবতী মেয়েটার কথা সে শুনেছিল সে মেয়েটা আর আগের মতো নেই! তুষারের বিবেক জাগ্রত হয়৷ সিদ্ধান্ত নেয় প্রেমাকে সময় দিবে। সম্পর্কটাকে সুযোগ দিবে,সহজ করবে! তাৎক্ষণিক সে প্রেমাকে জানালো,তারা অলন্দপুরে ঘুরতে যাবে। তুষারের সিদ্ধান্ত শুনে প্রেমা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। গত দুইদিন তুষার ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছে। তাও সব কথা পড়া নিয়ে! এতো ছোট মেয়ের সাথে কী বন্ধুত্ব হয়! তুষার কথা বলে সম্পর্ক সহজ করতে গিয়ে আরো কঠিন করে তুলছে। সে কিছুতেই প্রেমার সাথে সহজ হতে পারছে না। তারপর আজই দুজন গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হলো। পথে কেউ কোনো কথা বলেনি। অলন্দপুরে চলে এসেছে তারা। নৌকা ধীরগতিতে আটপাড়ার দিকে এগোচ্ছে। তুষার আড়চোখে প্রেমাকে দেখলো। প্রেমা ঝিম ধরে বসে আছে। তুষার খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে ডাকলো, ‘ প্রেমা?’
প্রেমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সে অবাক হয়েছে। স্বামী নামক কঠিন পাথরটি তাকে সবসময় খুকী বলে অথবা এই মেয়ে ডাকে! হুট করে প্রেমা ডাকটা শুনে অবাক হয়েছে আবার ভালোও লাগলো! তুষার গাম্ভীর্যতা ভেঙে প্রেমার দিকে এগিয়ে আসে। প্রেমার সামনে এসে বসলো। মাঝি বাউল গান গাইছে। গাইতে গাইতে বৈঠা বাইছে। তুষারকে এরকম মুখোমুখি বসতে দেখে প্রেমা উৎসুক হয়ে তাকায়।
তুষার বসেছে তো ঠিকই। কিন্তু কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না৷ আরো দুই-তিনবার খ্যাঁক করে কাশলো। তারপর বললো, ‘ আমাদের সম্পর্কটা আসলে কী?’
এটা কেমন প্রশ্ন! প্রেমা ভ্রুকুটি করলো। তুষার নিজের প্রশ্নে নিজে হতভম্ব হয়ে যায়! হয় সে কঠিন,কঠিন কথা বলে। নয়তো কী বলে নিজেও বুঝে না। প্রেমাও বুঝে না। তুষার দুই দিনের চেষ্টায় বুঝে গিয়েছে মেয়ে মানুষ পটানোর চেয়ে আসামী ধরা সোজা! প্রেমার সাথে তার জমছেই না! আসলে কি পটাতে পারছে না? নাকি কীভাবে পটাতে হয় সেটাই তুষার জানে না? প্রেমা চোখ ফিরিয়ে নিল। তুষারের হাবভাব সে বুঝে না। বুঝার ইচ্ছেও নেই। মেট্রিক পরীক্ষাটা দেয়া হয়নি। আরো এক বছর পড়তে হবে! জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। তার পাশে আপন বলতে কেউ নেই। প্রেমার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তুষার সেই দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়। সে প্রেমার দিকে তাকালো। এইটুকু মেয়ের দীর্ঘশ্বাস এতো ভারী! তুষার নরম কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলো, ‘ তুমি কি আমার উপর বিরক্ত?’
তুষার নরম কণ্ঠে কথা বলার চেষ্টা করলেও, কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্যতা থেকে যায়। প্রশ্ন করে দুই ভ্রু কুঁচকে প্রেমার দিকে তাকায়। তার চাহনি দেখে মনে হচ্ছে,প্রেমা চোর! চুরি করে ধরা পড়েছে। আর তারই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। প্রেমা জবাব দিল না। তুষারের ভ্রু দুটি আরো বেঁকে গেল। সে কাঠ কাঠ স্বরে বললো, ‘প্রশ্ন করেছি তো? উত্তর কোথায়?’
প্রেমা অন্যদিকে চোখ রেখে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, ‘না। বিরক্ত না।’
‘তাহলে আমার সাথে কথা বলো না কেন?’
প্রেমা নির্বিকার চোখে তাকালো। বললো, ‘ আপনিও তো বলেন না।’
তুষার থতমত খেয়ে যায়। প্রথম প্রথম প্রেমা তুষারের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে৷ তখন তুষারই হু,হ্যাঁ এর বেশি কিছু বলেনি। তাই কখনো দীর্ঘ আলাপ হয়নি। প্রেমার কথায় তুষার বিব্রতবোধ করলেও নিজেকে গুটিয়ে নিল না। সে কখনো হারেনি। সবসময় জয়ী হয়েছে। এবারের চ্যালেঞ্জটা মেয়েলি ব্যাপার! যাই হোক,সে হারবে না। হ্যাঁ…কিছুতেই হারবে না। তুষার মাছি তাড়ানো মতো হাত নাড়িয়ে বললো, ‘ পিছনের কথা বাদ। এখন থেকে দুজনই কথা বলবো। ঠিক আছে?’
প্রেমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। তুষার বললো, ‘ বেশি গরম লাগছে?’
‘লাগছে।’
তুষারের দূরে চোখ রেখে বললো, ‘আর কিছুক্ষণ। এসেই পড়েছি।’
আচমকা কালো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ। দখিনা বাতাস ধেয়ে আসে। দস্যি বাতাসে প্রেমার ওড়নার একাংশ ছাউনির বাইরে চলে যায়। তুষার ধরলো। প্রেমা তার অবাধ্য ওড়নাকে সুন্দর করে গায়ে পেঁচিয়ে নিল। তিন-চারদিন ধরে হুটহাট বাতাস বইছে। সেই সাথে ভ্যাপসা গরম তো রয়েছেই। তুষার চোখ ছোট ছোট করে চারপাশ দেখছে। নদীর দুই পাড়ে দুই গ্রাম। বামে হিন্দু পাড়া ডানে আটপাড়া। আটপাড়ার সব মানুষ মুসলমান। তুষার বললো, ‘ হিন্দু পাড়ায় কখনো গিয়েছো?’
‘হু,অনেকবার।’
তুষার প্রেমার মুখের দিকে তাকালো। বললো, ‘আমাদের বিয়েটা কী করে হলো জানো?’
‘জানি।’
, ‘কী জানো?’
প্রেমা নির্বিকার স্বরে বললো, ‘হানি খালামনির কাছে আপনার আম্মা প্রস্তাব নিয়ে যান। তারপর কিছু বুঝে উঠার আগে পরদিনই আমার বিয়ে হয়ে যায়।’
তুষার গুরুতর ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো, ‘অচেনা একজনকে এক কথায় বিয়ে করে নিলে কেন? তোমার অনুমতি নেয়া হয়নি?’
তুষার এসব কেন জিজ্ঞাসা করছে প্রেমা জানে না। জানতে ইচ্ছে হলেও সে প্রশ্ন করবে না। প্রেমা উদাস গলায় বললো, ‘ তখন আমার অভিভাবক আমার নানু আর খালামনি ছিল। আমার ভাবার বা বলার কিছু ছিল না। খালামনি যা চেয়েছেন তাই হয়েছে।
‘তুমি এই বিয়েতে সুখী হতে পারোনি তাই না?’
তুষারের সহজ/সরল প্রশ্ন! প্রেমা তুষারের চোখের দিকে সরাসরি তাকালো। মানুষটা হঠাৎ করে তার সুখ নিয়ে ভাবছে কেন? সে চোখ নামিয়ে ফেললো। কিছু বললো না। তুষার মিনিট দুয়েক সময় পার করে বললো, ‘ আমাদের বিয়ে হউক তোমার বড় আপা চেয়েছিলেন।’
প্রেমা চকিতে তাকালো। তার চোখ দুটি হঠাৎ করেই জীবন্ত হয়ে উঠে। তুষার পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে,প্রেমার মুখটা কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে। প্রেমা বললো, ‘আপা চেয়েছিল?’
তুষার বললো, ‘ তোমার আপা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলেও তিনি তোমাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তখন আমার আম্মা আমার বিয়ে নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। বার বার টেলিফোন করতেন। বিয়ের জন্য চাপাচাপি করতেন। আমি বিয়েতে আগ্রহী ছিলাম না। আমার বেড়ে উঠা অন্য দশজনের মতো ছিল না। বাবা ছাড়া শহরে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়েগুলো জানে জীবন কতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে! তোমার আপা কম কথা বলতেন। কথা বলতে বলতে হুট করে থেমে যেতেন। তার মাঝে আম্মাও কল করতেন অনবরত। তাই একবার আম্মার সাথে চেঁচামেচি করেছিলাম। কিছু কথা তোমার আপার কানে যায়। সেদিনই রাত্রিবেলা হাওলাদার বাড়ি সম্পর্কে বলতে বলতে তোমার আপা থেমে যান। বাকি কথা কিছুতেই বলছিলেন না।
যখন জোর করছিলাম বলার জন্য। আমাকে অনুরোধ করেন, আম্মাকে নিয়ে তোমাকে একবার যেন দেখতে যাই। আর আম্মার পছন্দ হলে যেন বিয়ে করি। ততক্ষণে তোমার সম্পর্কে অনেককিছুই শুনেছি। আমার বিয়ে করাও জরুরি নয়তো আম্মা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিবেন। অন্যদিকে তোমার আপা নিজ ইচ্ছায় কিছু না বললে কিছু জানাও সম্ভব নয়৷ তাই কথা দেই,তোমাকে দেখতে যাব। তোমার আপা হাসিমুখে বাকিটুকু বলেন। তিনি যেন নিশ্চিত ছিলেন, আম্মা তোমাকে দেখলে পছন্দ করবে। ঠিক তাই হলো। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তুমি আর তোমার পরিবার হানি খালামনির বাসায় আছো। আম্মাকেও জানাই,একটা মেয়ে আছে দেখে আসো পছন্দ হয় নাকি। আম্মা তো খুব খুশি। তোমাকে দেখার পর রাত্রে ঘুমাননি। সারারাত তোমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছেন। বাকিটুকু তো তুমি জানো।’
‘আমাকে বিয়ে করাটা অনুগ্রহ ছিল?’ প্রেমার কণ্ঠটা কেমন যেন শোনায়।
তুষার কৈফিয়ত দেয়ার মতো বললো, ‘ মোটেও না। আম্মার পছন্দ না হলে বিয়েটা হতো না। তোমার আপাও কিন্তু আমার উপর চাপিয়ে দেননি। বলেছেন,একবার যেন দেখি। পছন্দ হওয়ার পর বিয়ে। আর আমার আম্মার তোমাকে পছন্দ হয়েছে। বরং তোমার সাথে আমাকে মানায় না।’
‘কেন মানায় না?’ প্রেমা নিজের অজান্তে প্রশ্ন করলো।
তুষার বললো, ‘ আমার বয়স বেশি।’
প্রেমা আর কথা বাড়ালো না। তার ভালো লাগছে! হুট করেই ভীষণ ভালো লাগছে। এমনকি কাঠখোট্টা তুষারকেও এখন তার ভালো লাগছে। সে মৃদু হাসলো। তুষার প্রেমার হাসি খেয়াল করে বললো, ‘ হাসছো যে?’
প্রেমা ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললো, ‘ আপনার গোঁফ জমিদারদের মতো বড় বড়।’
প্রেমার কথা শুনে তুষারও হাসলো। পদ্মজা নামটাতে জাদু আছে। তার কথা উঠতেই প্রেমা হেসেছে। জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তুষার বললো, ‘ তোমার নানাবাড়িতে এখন কে কে আছে?’
‘নানু আর হিমেল মামা।’
‘নানুর কিডনিতে কী না হয়েছিল? অপারেশন হয়েছে শুনেছি। শহরেই মেয়ের কাছে থাকতেন। গ্রামে আসতে গেলেন কেন?’
প্রেমা অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো,’আমি কী এখানে থাকি যে জানব?’
প্রেমা থামলো। তারপর আবার বললো, ‘গত বছর আপা যখন আসছিল গ্রামে। তখন নানু আর মামা খালামনির কাছে ছিল। নানুর অপারেশন তখন হয়েছে। অনেকদিন কেটে গেছে। এখন নানু সুস্থ।গ্রামে সমস্যা হবে না।’
‘তোমার নানাকে দেখার ইচ্ছে ছিল। দেখতে পারিনি।’ আক্ষেপের স্বরে বললো তুষার।
প্রেমা বললো, ‘ নানা তো দুই বছর আগেই চলে গিয়েছেন। দেখবেন কী করে!’
তুষার ছাউনির বাইরে আঙুলে ইশারা করে বললো, ‘তোমাদের বাড়ির ঘাট না?’
প্রেমা বাইরে তাকালো। বললো, ‘ হু,এতো জলদি চলে এসেছি!’
তুষার কাপড়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে বললো, ‘কথা বলতে বলতে সময় কেটে গেছে।’
নৌকা মোড়ল বাড়ির ঘাটে এসে থামলো। তুষার মাঝিকে টাকা দিয়ে প্রেমাকে হাতে ধরে নামায়। প্রেমার হাত ধরার সময় তুষারের মনে হলো, এতো কোমল হাত সে কখনো ধরেনি! তাৎক্ষণিক তার বুকের ভেতর কী যেন হয়!
প্রেমা উঠানে পা রাখতেই বাসন্তীর সাথে দেখা হয়। বাসন্তী প্রেমাকে দেখে চমকে যান। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। প্রেমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। বাসন্তীর কান্না শুনে রুম্পা আর প্রান্ত ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। রুম্পা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রান্ত বাইরে ছুটে আসে। বাসন্তী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ও মা! মা আমার!’
প্রেমার আকস্মিক আগমন তিনি হজম করতে পারছেন না। মোড়ল বাড়ি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। মরুভূমির মাঝে প্রেমা যেন জল হয়ে এসেছে! প্রেমা বাসন্তীর পিঠে হাত বুলিয়ে বললো, ‘শান্ত হও বড় আম্মা। শান্ত হও।’
বাসন্তী প্রেমার কপালে,গালে চুমু দিলেন। তুষার পাশ থেকে সালাম দিল৷ বাসন্তী চোখের জল মুছে তুষারকে বললেন, ‘ভালো আছো আব্বা?’
‘জি আম্মা। আপনি তো অনেক শুকিয়ে গেছেন।’
‘মেয়েগুলো কাছে নাই। তারা ভালো নাই। আমি কেমনে ভালো থাকি বাপ?’
প্রেমা প্রান্তর দিকে তাকাতেই প্রান্ত প্রেমার মাথায় থাপ্পড় দিল। বললো, ‘ এতদিন পর আসলি!’
প্রেমা প্রান্তর চুল টেনে ধরে বললো, ‘একদম মাথায় থাপ্পড় দিবি না। আমার মাথা ব্যথা করে।’
প্রান্ত আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তুষারকে দেখে থেমে যায়। তুষার হাসতে কার্পন্য করলো না। সে প্রান্তর সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো, ‘ দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’
কুশল-বিনিময় শেষে বাসন্তী তুষার আর প্রেমাকে নিয়ে বারান্দায় পা রাখলেন। দেখা হয় রুম্পার সাথে। রুম্পার পেট উঁচু হয়েছে। তার গর্ভাবস্থার সাত মাস চলছে। সে এই বাড়িতেই থাকে। হাওলাদার বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। সাত মাসে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। আমিনা আলোকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছেন। বৃদ্ধা নূরজাহান মারা গিয়েছেন৷ বিদেশ থেকে লাবণ্য ও জাফর তাদের স্বামী-স্ত্রী নিয়ে দেশে এসেছিল। দুই সপ্তাহ থেকে আবার ফিরে গিয়েছে। গ্রামবাসী এখন হাওলাদার বাড়িতে যেতে ভয় পায়। সেখানে নাকি আত্মারা ঘুরঘুর করে! প্রেমা রুম্পাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো। কুশল-বিনিময় শেষ করে রুম্পা তুষারকে প্রশ্ন করলো, ‘ উনি ভালা আছে? জেলে খাওনদাওন দেয়? মারে কেউ?’
রুম্পার কণ্ঠে ব্যাকুলতা। তুষার রুম্পাকে আশ্বস্ত করে বললো, ‘আলমগীর সাহেব ভালো আছেন,সুস্থ আছেন। খাবার দেয়া হয়৷ কেউ মারধোর করে না। আপনি চিন্তা করবেন না।’
রুম্পা হাসলো। আলমগীর সুস্থ আছে এই খবরটুকুই রুম্পার বেঁচে থাকার শক্তি!
.
সাত মাস পূর্বে, রবিবার দুপুরে মুমিন নামে একজন ব্যাক্তি মজিদের সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখে ফরিনার কবরের পাশে এক মেয়ে শুয়ে আছে। তার পরনের সাদা শাড়ি রক্তে রাঙা। আর কবরের উপর একটা মাথা! মজিদ হাওলাদার মুমিনকে নতুন দারোয়ান হিসেবে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই ডেকে পাঠিয়েছেন। মুমিন এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে যায়। জান নিয়ে দৌড়ে পালায়। তারপর ঘন্টাখানেকের মধ্যে হাওলাদার বাড়ির গণহত্যার ঘটনা পুরো অলন্দপুরে ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে লোক জড়ো হয়৷ পদ্মজা এতো মানুষকে দেখেও নীরব থাকে। তার রূপ হয় রূপকথার অতৃপ্ত অশরীরীর মতো। কেউ কেউ পাথর ছুঁড়ে মারলো,ডাকলো,কুহকিনী, ডাইনি,রাক্ষসী ! থানা থেকে পুলিশ আসে। পদ্মজাকে শহরে নিয়ে যায়। নৃশংস এই খুনের কথা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। টেলিভিশন, রেডিও সব জায়গায় এক কথা,
‘অলন্দপুরের ছোট গ্রাম আটপাড়ার হাওলাদার বাড়ির বধূ উম্মে পদ্মজা চলচ্চিত্র অভিনেতা লিখন শাহর সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে খুন করেছে স্বামী,শ্বশুর,ভাসুর ও চাচা শ্বশুরকে। সাথে আরেকটি মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। তাকে খুন করার কারণ এখনও শনাক্ত করা যায়নি।’
এক দিনের ব্যবধানে পুরো দেশে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। নৃশংস খুনের বর্ণনা শুনে কেউ কেউ রাতে ঘুমাতে পারেনি। গ্রামবাসী তাদের প্রিয় ও মহান মাতব্বরের মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে। তারা সমস্বরে চিৎকার করে জানায়,তারা পদ্মজার ফাঁসি চায়। মুহূর্তে পুরো দেশের কাছে কলঙ্কিত হয়ে যায় পদ্মজা। আলমগীর গ্রামে এসে শুনে পুলিশ পদ্মজাকে ধরে নিয়ে গেছে! খুন হয়েছে বাড়ির প্রতিটি পুরুষ। সব শুনে ঘাবড়ে যায় আলমগীর। ফিরে যায় রুম্পার কাছে।
মগা গ্রামে প্রবেশ করতেই পুলিশ তাকে পূর্ণার খুনের দায়ে আটক করে। আলমগীর ঘরে ফিরে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। রুম্পা আলমগীর কে অনেক প্রশ্ন করলো,আলমগীর জবাব দিল না। আমিরের দেয়া নীল খামটির দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো। এই খামে একটা চিঠি আর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দলিল রয়েছে। চিঠিতে লেখা এক পরিকল্পনা। আর ঘটেছে অন্য ঘটনা! সবাই যেভাবে পদ্মজার উপর ক্ষিপ্ত হয়েছে,ফাঁসি নিশ্চিত! সে চাইলে পদ্মজার ফাঁসি আটকাতে পারে। তার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। কিন্তু তার জন্য নিজের জীবন ও সংসার ত্যাগ করতে হবে। এতো সাধনার পর পাওয়া নতুন জীবন ভালো করে উপভোগ করার পূর্বে কিছুতেই সে বন্দী হতে চায় না! আলমগীর খাম থেকে চিঠিটি বের করে আরো একবার পড়লো;-
প্রিয় বড় ভাই,
বড় বিপদে পড়ে তোমার সাহায্য চাইছি। এখানে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। পদ্মজা জেনে গিয়েছে সব সত্য৷ তোমার চিঠি পাওয়ার পূর্বেই সব জেনেছে৷ আমি বিস্তারিত কিছু লেখব না। তুমি পরে পদ্মজার কাছে জেনে নিও। আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব। তার আগে আমি চারজনকে হত্যা করতে চাই। তার মাঝে তিন জন পদ্মজার নামে কুৎসা রটিয়েছে। আমি তখন গ্রামে ছিলাম না। ঢাকা গিয়েছিলাম। সেই সুযোগে তারা সুন্দর চাঁদে দাগ ছিটিয়েছে। রবিবারের সকাল আমার দেখা হবে না। আমার বেঁচে থাকা পদ্মজার জন্য হুমকি! সেই সাথে আমার জন্য ভীষণ কষ্টের। আমি তোমাকে কিছু দলিল দিয়েছি। যা প্রমাণ করে আমি একজন নারী পাচারকারী। সেই সাথে এটাও প্রমাণ করে,আমার সাথে কারা কারা ছিল। একটু খুঁজে দেখো দলিলগুলোর মাঝে আরেকটি চিরকুট আছে৷ সেখানে আমি স্পষ্ট করে আমার সাথে কাজ করা সবার নাম লিখে দিয়েছি। যাদের বর্তমান ঠিকানা জানা আছে সেই ঠিকানাও লিখে দিয়েছি। আমি প্রমাণ সহ স্বীকার করেছি,আমার সব অপরাধ। তোমার নাম সেখানে কোথাও নেই। কোথায় মেয়ে পাচার হয়? কীভাবে হয়? কারা এই কাজের সাথে যুক্ত? আমার জানা সব বিস্তারিত লেখা আছে। আমার দেয়া ঠিকানা অনুসারে খোঁজ চালালে উদ্ধার হবে,আড়াইশোরও বেশি মেয়ে! তুমি এই চিরকুট নিজের কাছে রেখে আমার স্বীকারোক্তি চিরকুটটি ও সকল দলিল প্রমাণ হিসেবে সকলের সামনে উন্মোচন করবে। রুম্পা ভাবিকে বাঁচিয়ে রাখার অবদান পুরোটাই আমার ছিল। সেই কৃতজ্ঞতা থেকে হলেও তুমি পদ্মজাকে কলঙ্কমুক্ত করো ভাই। পদ্মজাকে নিজের সাথে নিয়ে যেও। দেখে রেখো। তোমার কাছে আমানত রেখে গেলাম।
ইতি,
আমির হাওলাদার
আলমগীর চিঠি মেঝেতে রেখে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে। সে মগার থেকে চিঠি পাওয়ার পর পরই আমিরকে বাঁচানোর জন্য বেরিয়ে পড়ে। আমিরকে সে ভীষণ ভালোবাসে। আমিরের আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত আলমগীরকে বসে থাকতে দেয়নি। কিন্তু গ্রামে পৌঁছে শুনলো সব শেষ! পদ্মজা খুন করেছে সবাইকে। আর এখন পদ্মজা মিথ্যা অপবাদে জেলে বাস করছে। এই মুহূর্তে সে যদি এই প্রমাণসমূহ নিয়ে সে পুলিশের কাছে যায়। পুলিশ তাকেও আটক করবে। সে পুলিশকে মিথ্যে বলতে পারবে না। সেই সাহস হবে না। সব সত্য জানার পর তার ফাঁসিও হতে পারে। সে নিজেকে উৎসর্গ করার সাহস পায় না।
পদ্মজার মামলার তর্কবিতর্কে যখন পঁচিশ দিন পার হয় তখন রুম্পা নিজ ইচ্ছায় আলমগীরকে অনুরোধ করলো,আলমগীর যেন পদ্মজাকে বাঁচায়। মিথ্যা অপবাদে পদ্মজার ফাঁসি হতে দেখে সে সুখের সংসার করতে পারবে না। পদ্মজা পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে কাউকে খুন করেনি,এই টুকু সত্য যেন আলমগীর সবাইকে জানায়। আলমগীর রাতেই রুম্পাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পদ্মজাও তখন সব স্বীকার করেছে। সব প্রমাণ পাওয়ার পর দেশের পরিবেশ পাল্টে যায়। জনগণের মাথায় পড়ে হাত। আমিরের দেয়া তথ্যানুসারে ধরা পড়ে কয়েকটি চক্রের নেতা! তদন্ত চালিয়ে জানা যায়, স্বয়ং বাণিজ্য মন্ত্রী এই চক্রের সাথে জড়িত৷ উদ্ধার হয় তিনশোরও বেশি অসহায় মেয়ে। কেউ কেউ পলাতক। এই খবর দেশের বাইরেও বেরিয়ে পড়ে। কুয়েত,সৌদি সহ আরো কয়েকটি দেশে তদন্ত শুরু হয়। তারা চিরুনি অভিযান চালিয়ে আমিরের দেয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে মেয়ে সংগ্রহকারীদের খুঁজে চলে। দুজন ধরা পড়ে। বাকিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। উদ্ধারকৃত মেয়েগুলি নতুন জীবন পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। আমিরের চিঠিতে নতুন গোপন তথ্য ছিল, অন্দরমহলের পিছনে বড় নারিকেল গাছটির নিচে একটি বিশাল গর্ত আছে যেখানে ছুরি,রাম দা,চাপাতি,কুড়াল,চাবুক সহ অনেক অস্ত্র রয়েছে। তুষার অস্ত্রসমূহ উদ্ধার করে,সেই সাথে উদ্ধার হয় পদ্মজার জন্য রেখে যাওয়া আমিরের লাল খামটি! পদ্মজা তখন অস্বাভাবিক ছিল। সে নিজের মধ্যে ছিল না। তাকে হাসপাতালে রাখার আদেশ দেয় আদালত। দেড় মাসের চিকিৎসার পর পদ্মজার শারীরিক ও মানসিক ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা সেড়ে উঠে। আদালত থেকে দশ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আলমগীর রাজ স্বাক্ষী হওয়াতে ফাঁসির বদলে আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়। শেষ নিঃশ্বাস অবধি সে কারাগারে কাটাবে। তারপর রুম্পা চলে আসে গ্রামে। গ্রামে আসার এক মাস পর জানতে পারে সে গর্ভবতী। তার শূন্য জীবনে আশার আলো হয়ে আসে সন্তান আগমনের সংবাদ! দেশবাসীর মুখের কথা পাল্টে যায়। তারা পদ্মজার মুক্তি চেয়ে আজও আন্দোলন করে চলেছে!
.
পরদিন সকাল সাতটা। তুষার খাওয়াদাওয়া করে মাত্র উঠেছে। তখন দুই-তিনটে কুকুরের চিৎকার ভেসে আসে। তুষার দ্রুত বারান্দা থেকে নেমে লাহাড়ি ঘরের দিকে তাকালো। সকালের মিষ্টি বাতাসে বিষণ্ণ এক দৃশ্য চোখে পড়ে। অপরিচ্ছন্ন মৃদুল কুকুরগুলোর সাথে কী নিয়ে যেন তর্ক করছে! মাঝেমধ্যে মাটি ছুঁড়ে মারছে। তুষার
দ্রুতপায়ে মৃদুলের দিকে এগিয়ে যায়। তুষারের পিছন পিছন বাসন্তী ও প্রেমাও গেল। গতকাল রাতে তুষার মৃদুলকে দেখতে এসেছিল।তখন মৃদুল পূর্ণার কবরের পাশে ঘুমাচ্ছিল। জুলেখা বানু ডাকতে নিষেধ করেন৷ তাই তুষার ডাকেনি।
গোঁফ-দাড়ির জন্য মৃদুলকে চেনা যাচ্ছে না। গায়ে মাটি লেগে আছে।
প্যান্টের এক পা হাঁটু অবধি ছেঁড়া। তুষারকে দেখে মৃদুল দুই কদম পিছিয়ে গেল। লাহাড়ি ঘর থেকে জুলেখা বানু বেরিয়ে আসেন। তিনি ভীষণ শুকিয়েছেন। চোখেমুখে আগের সৌন্দর্যটুকু নেই। একমাত্র ছেলেকে রেখে তিনি নিজের বাড়িতে ঘুমাতে পারেন না। মৃদুল মোড়ল বাড়ি ছেড়ে এক পাও নড়ে না। সে তার সুস্থ জীবন পূর্ণার সাথে কবর দিয়েছে। মাস তিনেক আগে মৃদুলকে জোর করে বেঁধে শহরের ডাক্তারের কাছে নেয়া হয়েছিল। ডাক্তারের পরামর্শে তাকে পাগলা গারদে রেখে আসা হয়৷ তিন-চার দিন পার হতেই খবর আসে,দারোয়ান ও দুজন নার্সকে আহত করে মৃদুল পালিয়েছে। জুলেখা বানু এই খবর শুনে অজ্ঞান হয়ে যান। মৃদুলের জ্ঞান সুস্থ নয়৷ সে কী করে গ্রামে ফিরবে? দীর্ঘ পনেরো দিন পর মৃদুলকে এক গ্রামে পাওয়া যায়। জুলেখা বানু কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে পড়েন। মৃদুল পাগল থাকুক তাও চোখের সামনে থাকুক সেটাই তিনি চান। তাই মৃদুলকে বাড়ি নিয়ে যান। কিন্তু মৃদুল পূর্ণাকে ছাড়া কিছুতেই খাবে না। তাই বাধ্য হয়ে মৃদুলকে আবার মোড়ল বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। মৃদুল সর্বক্ষণ পূর্ণার কবরের পাশে বসে থাকে। বিড়বিড় করে কিছু বলে। পূর্ণার কবরের চারপাশে গর্ত করে বাঁশ পুঁতেছে তারপর টিনের ছাদ দিয়েছে,যেন পূর্ণা বৃষ্টিতে না ভিজে৷ রাতে পূর্ণার জন্য কিনে আনা লাল বেনারসিটি আঁকড়ে ধরে ঘুমায়। জুলেখা বানু জোর করে দুইবেলা খাইয়ে দেন৷ মাঝেমধ্যে নিজের বাড়িতে যান।
নিজের বিলাসবহুল বাড়ি নিয়ে জুলেখা বানুর অহংকার ছিল। আর আজ ছেলের জন্য তাকে অন্যের বাড়ির লাহাড়ি ঘরে থাকতে হচ্ছে। সন্তানের উপরে যে কিছু নেই! গ্রামের বাচ্চারা মৃদুলকে লাল পাগল ডাকে। লাল পাগল ডাকার কারণ,মৃদুল ফর্সা,সুন্দর! যদিও তার সৌন্দর্য টিকে নেই। গোলাপি ঠোঁট দুটি কালচে হয়েছে। তুষার মৃদুলকে আদুরে স্বরে ডাকলো, ‘ মৃদুল।’
মৃদুল এক নজর তুষারকে দেখলো। তারপর দূরে সরে গেল। তুষার জুলেখা বানুকে প্রশ্ন করলো, ‘মৃদুল খেয়েছে?’
জুলেখা ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘ না। খায় নাই। কাইল থাইকা খাইতাছে না।’
তুষার কপাল ইষৎ কুঁচকে মৃদুলের দিকে তাকালো। জুলেখাকে আবার প্রশ্ন করলো, ‘শুনেছিলাম ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলেন। ওর অবস্থা কেমন? মাথা কতটুকু কাজ করে?’
জুলেখা বানুর চোখের কার্ণিশে জল জমে। তিনি বললেন, ‘ বাচ্চারাও ওর থাইকা বেশি বুঝে। যত দিন যাইতাছে পাগলামি বাড়তাছে। আমি আর ওর বাপে ছাড়া যে যেইডা কয় ওইডাই বিশ্বাস করে।’
‘চাচা কোথায়?’
‘বাড়িত। বাড়িঘর জমিজমা দেহন লাগে না? আর কেলা দেখবো? কেউ আছে?’ জুলেখার কণ্ঠে অসহায়ত্ব স্পষ্ট।
তুষার মৃদুলের পাশে গিয়ে বসলো। বললো, ‘ আমাকে ভয় পাচ্ছো?’
মৃদুল আড়চোখে তুষারকে দেখলো। মাথা ঝাঁকিয়ে জানালো,সে ভয় পাচ্ছে। হাওলাদার বাড়ির খুঁটিনাটি তদন্ত করতে তুষার যখন অলন্দপুরে এসেছিল তখন মৃদুলের সাথে তার দেখা হয়। তখন মৃদুলের এতো খারাপ অবস্থা ছিল না। তুষার বললো, ‘আজ রাজহাঁস জবাই করবো৷ তুমি আমাকে সাহায্য করবে?’
মৃদুল কিছু বললো না। তুষার বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আম্মা,রাজহাঁস আছে না?’
‘আছে আব্বা।’ বললেন বাসন্তী।
তারপর তুষার মৃদুলকে বললো, ‘রাজহাঁস আছে। অর্ধেক আমরা খাব আর অর্ধেক পূর্ণাকে দেব। পূর্ণা রাজহাঁস খেতে পছন্দ করতো। তাই না প্রেমা?’
কোনাকালেই পূর্ণা রাজহাঁস পছন্দ করতো না। তাও প্রেমা তুষারের সাথে তাল মিলালো। তুষার সাবধানে মৃদুলকে বললো, ‘ তুমি যদি আমাকে সাহায্য না করো আর আমার সাথে খেতে না বসো আমি কিন্তু পূর্ণাকে কিছু দেব না। দেখিয়ে দেখিয়ে খাব। তখন পূর্ণা কষ্ট পাবে।’
মৃদুল পূর্ণার কবরে হাত বুলিয়ে দিল। সে চিন্তা করছে কী করবে। অনেকক্ষণ চিন্তা করে সে রাজি হলো। সারাদিন তুষারের সাথে ভালো সময় কাটে। তুষার এমনভাবে কথা বলে,যেন পূর্ণা সত্যি বেঁচে আছে৷ মৃদুল তুষারের সঙ্গ উপভোগ করে। এক ফাঁকে জুলেখাকে তুষার জানালো,মৃদুলকে ঢাকা নিয়ে গেলে ভালো হয়। আরেকটু চেষ্টা করে দেখা যেত। জুলেখা তুষারের দুই হাত ধরে অনুরোধ করেন,মৃদুলের সুস্থতার জন্য তিনি সবরকম খরচ করতে প্রস্তুত। শুধু মৃদুলকে যেন তুষার সামলায়। তুষার জুলেখাকে আশ্বস্ত করলো। তারপর আটপাড়ায় ঘুরাঘুরি করে জানতে পারলো,মগা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ইয়াকুব আলীর বাড়িতে কাজ নিয়েছে। আর ইয়াকুব আলী অলন্দপুরের মাতব্বর হয়েছেন।
দিনের আলো কেটে রাত নামতেই মৃদুল পূর্ণার কবরের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আর তুষার রাতের খাবার খেয়ে ঘরে আসে। প্রেমা মশারি টানাচ্ছে। বাইরে বিরতিহীনভাবে ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে। তাদের ডাকাডাকিতে তুষারের কানে তালা লেগে যাচ্ছে। সে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পছন্দ করে না। অন্যদিকে প্রেমার ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভীষণ পছন্দ। সে মুগ্ধ হয়ে শুনে। তুষার দুই কানে আঙুল ঢুকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘পোকাগুলো কি সারারাত ডাকাডাকি করবে?’
প্রেমা বললো, ‘মাঝরাত অবধি ডাকবে।’
তুষার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘মাঝরাত অবধি জেগে থাকবো?’
‘কানে তুলা দিয়ে রাখুন।’
‘আছে তুলা?’ বললো তুষার।
প্রেমা আলমারি খুলে তুলা বের করে দিল। তুষার প্রেমার কাণ্ডে বিস্মিত! সত্যি সত্যি তুলা দিয়ে দিল! এই মেয়ে নাকি বাকি দুই বোনের চেয়ে লজ্জাবতী আর ভীতু ছিল! অথচ,পদ্মজা আমিরকে লজ্জা পেত। পূর্ণা মৃদুলকে লজ্জা পেত। আর প্রেমা লজ্জা তো দূরের কথা তার চেয়ে এতো বড় মানুষটিকে পরোয়াও করে না। নির্বিকার ভঙ্গিতে থাকে। সময় ও পরিস্থিতি মানুষকে কতোটা পাল্টে দেয়! তুষার তুলা হাতে বসে রইলো। প্রেমা খেয়াল করেও কিছু বললো না।
শোবার সময় প্রেমা প্রশ্ন করলো, ‘আপার কারাদণ্ডর সময় কি কমানো যায় না?’
‘কমতে পারে। মনে হয় না এতদিন জেলে রাখবে। অনেক সময় যতদিন জেল হওয়ার কথা ততদিন হয় না।’
‘এমনও হয়?’
‘হয়। মেয়াদের আগে মুক্তি পেয়ে যায় অনেকে। তাছাড়া লিখন শাহ দৌড়াদৌড়ি করছেন,জনগণও চাইছে সাজা কমানো হউক। কমবে নিশ্চয়ই।’
‘আপা কি জেল থেকে বের হয়ে লিখন ভাইয়াকে বিয়ে করতে রাজি হবে?’
‘আমার যতটুকু ধারণা, রাজি হবে না। লিখন শাহ আশা নিয়ে বসে আছেন। পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। পদ্মজা লিখন শাহকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন ।’
প্রেমা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো, ‘কী লেখা সেখানে?’
তুষার চেয়ার ছেড়ে বিছানায় এসে বসলো। বললো, ‘ আমি পড়িনি। পিন্টুকে দিয়ে পাঠিয়েছি।’
প্রেমা ছোট করে বললো, ‘ওহ।’
তারপর প্রশ্ন করলো, ‘গত কয়েকদিনের মধ্যে আপার সাথে দেখা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ,গতকাল বিকেলেই দেখা হয়েছে। তিনি আমাকে দেখলেই গুটিয়ে যান। পর পুরুষের উপস্থিতি পছন্দ করেন না। তাই না?’
প্রেমা হেসে মাথা ঝাঁকালো। আবার পদ্মজার কথা শুনে প্রেমা হেসেছে! তুষার প্রেমাকে ভালো করে খেয়াল করলো। পদ্মজার মুখের ছাপ প্রেমার মুখে আছে। প্রেমা সবসময় সোজা সিঁথি করে বেণি করে। শাড়ি পরে বলে বয়সের তুলনায় একটু বেশি বড় লাগে। এই যা…হুট করে প্রেমাকে বড় মনে হচ্ছে কেন? এতদিন তো শাড়ি পরাই দেখেছে। বড় তো লাগেনি! এ কোন কেরামতি! তুষার মুচকি হাসলো। প্রেমা তুষারকে তার দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে বললো, ‘ হাসছেন কেন?’
তুষার টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, ‘ আমির হাওলাদার তিনটে বিয়ে করেছেন। আমি হলে চারটে বিয়ে করতাম। চার বিয়ে করা সুন্নত!’
প্রেমা বাঁকা চোখে তুষারের দিকে তাকালো। বললো, ‘ করুন গিয়ে। তবে ভাইয়ার প্রথম দুটো বিয়ের কোনো মূল্য নেই। ভাইয়ার বউ একমাত্র আমার আপা।’
তুষার এক হাতে মাথার ভর দিয়ে প্রেমার দিকে ফিরে বললো, ‘কেন মূল্য নেই?’
‘ইসলামে পালিয়ে বিয়ে করার মূল্য নেই। মেয়ের অভিভাবক লাগে৷ ভাইয়ার দুটো বউ বাসায় কিছু না বলে বিয়ে করেছে। তাই হাশরের ময়দানে আমির ভাইয়ার বউ শুধু আমার আপা!’ কথাটা প্রেমা ভাব নিয়ে বললো।
তুষার আবার হাসলো। সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বুজলো। মাঝে দূরত্ব রেখে প্রেমাও শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর তুষার বললো, ‘প্রেমা? ‘
প্রেমা জেগেই ছিল। সে সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘সাত দিনের কথা তো আজ একদিনে বলে ফেলছেন!’
প্রেমার কণ্ঠে ঝাঁঝ। তার মনে তুষারের জন্য কতো রাগ জমে আছে টের পাওয়া যাচ্ছে। কেন এতো রাগ? সে কি গত চার মাসে তুষারের সঙ্গ পাওয়ার আশা করে বার বার নিরাশ হয়েছে? সত্যি এমন কিছু হয়েছে? তুষার ভাবলো। অদ্ভুত বিষয় প্রেমার মুখের ঝাঁঝালো কথাগুলো তুষারের ভালো লাগছে। সর্বনাশ! তবে কি সেও মরণ প্রেমে পড়তে যাচ্ছে! পরিণতি আমিরের মতো হবে নাকি মৃদুলের মতো? নাকি আরো ভয়ানক?
হঠাৎ নীরবতা ভেঙে তুষার বলে উঠলো, ‘জানো প্রেমা,ভালোবাসার ব্যাখা ও রূপের বাহার পর্যবেক্ষণ করতে গেলে মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায়।’
তুষারের গলার স্বরটা পরিবর্তন হয়েছে৷ কোমল হয়েছে! সে এতো পাল্টে গেল কী করে? প্রেমা বললো, ‘কেন এমন হয়?’
তুষার শূন্যে চোখ রেখে বললো, ‘ভালোবেসে মানুষ পাগল হয়,ভালো হয়,খারাপ হয়, নিঃস্ব হয় এমনকি নিজের জীবনকেও হত্যা করতে দুইবার ভাবে না! কী অদ্ভুত!’
তুষারের কথাগুলো প্রেমার ভালো লাগছে। সে তুষারের দিকে ফিরলো। তুষারও প্রেমার দিকে তাকালো। প্রেমা বললো, ‘যে ফাঁসে সে জানে,ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত!’
কী সুন্দর কথা! কত মোহনীয় তার কণ্ঠ! তুষার ধীর স্বরে বললো, ‘ কাউকে ভালোবেসেছো?’
প্রশ্নটি শুনে প্রেমার ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠে। সে দ্রুত অন্যদিকে ফিরে চোখ বুজলো। কী করে সে বুঝাবে, তুষারের প্রেমে পড়ে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়! তার ব্যথিত হৃদয় তারই অজান্তে তুষারের প্রেমে কবেই পড়েছে! তুষার প্রেমার পিঠের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার কেন যেন মনে হলো,প্রেমা তার চোখের দৃষ্টি আড়াল করেছে!
.
লিখনের মা ফাতিমা ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করছেন। তিনি তৃধার সাথে লিখনের বিয়ে ঠিক করেছেন। কিন্তু লিখন বিয়ে করবে না৷ সে পদ্মজার জন্য অপেক্ষা করছে। পদ্মজা জেল থেকে বের হলে তাকেই বিয়ে করবে৷ ফাতিমা একজন খুনি,বিবাহিত,এক বাচ্চার মাকে কিছুতেই ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে রাজি নন। লিখন যেরকম নাছোড়বান্দা তার মা তেমন নাছোড়বান্দা। ফাতিমা কঠোরভাবে জানিয়েছেন,যদি লিখন পদ্মজাকে বিয়ে করে তিনি আত্মহত্যা করবেন৷ সম্মান নষ্ট হওয়ার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়! এতেও লিখন ভ্রুক্ষেপ করলো না। সে পাগল হয়ে আছে। আমির নেই। এবার সে পদ্মজাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারে। জীবন তাকে একটা সুযোগ দিয়েছে। সে সেই সুযোগ এড়াতে পারবে না। এতদিন দূরে থেকেছে পদ্মজার স্বামী ছিল বলে। এখন পদ্মজা একা। তার স্বামী মৃত। পদ্মজাকে বিয়ে করে তাকে একটা নতুন জীবন উপহার দিবে,সেই সাথে নিজের ক্ষত হৃদয় সাড়িয়ে তুলবে। লিখন বৈঠকখানাতে গিয়ে বসলো। যেদিন জানলো পদ্মজা জেলে। সেদিন থেকে সে দৌড়ের উপর আছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছে। একদিকে পদ্মজার ফাঁসি হওয়ার আশঙ্কা অন্যদিকে মিথ্যা বদনামে তার ক্যারিয়ার নষ্ট হওয়ার পথে! ভাগ্য সহায় ছিল,তাই দুটোর কোনোটিরই ক্ষতি হয়নি। এজন্য খোদার দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া! দ্বিতীয় তলা থেকে ফাতিমার চিৎকার ভেসে আসে, ‘এই মেয়ের জন্য আমার ছেলে জীবনে প্রথমবার আহত হয়ে হাসপাতালে ছিল। এমন অশুভ মেয়েকে আমি আমার ছেলের জীবনে মেনে নেব না। তুমি তোমার ছেলেকে সামলাও।’
ফাতিমাকে তার স্বামী সামলানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না।
দরজায় কলিং বেল বেজে উঠে। আশেপাশে কেউ নেই। লিখন কয়েকবার তাদের বাসার কাজের মেয়েটিকে ডাকলো। তারও খোঁজ নেই। লিখন বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতে গেল। দরজার সামনে তার বাড়ির দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা খাম। লিখন প্রশ্ন করলো, ‘কে দিয়েছে?’
দারোয়ান বললো, ‘তুষার সাহেব পাঠিয়েছেন।’
লিখন খামটি হাতে নিয়ে বললো, ‘আচ্ছা,যাও।’
লিখন দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে আসে। খামটি বিছানায় উপর রেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজেকে দেখার সময় সে তার পাশে পদ্মজাকেও দেখতে পায়। তার জীবনে কিছুর অভাব নেই। শুধু একটাই অভাব, পদ্মজার অভাব! সে তার পরনের শার্ট খুলে গোসলখানায় গেল। গোসল করে কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে তারপর খামটি হাতে নিল। খামের ভেতর চিঠি! লিখন আগ্রহ নিয়ে চিঠির ভাঁজ খুললো:-
সম্মানিত লিখন শাহ,
আমার সালাম নিবেন। আশা করি ভালো আছেন। সর্বপ্রথম বলতে চাই,আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমি আপনাকে এবং আপনার অনুভূতিকে সম্মান করি। বাধ্য হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় আপনাকে চিঠি লিখতে হলো। শুনেছি,আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আপনি আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু কিছু স্বপ্ন নিষিদ্ধ! আপনি এমন এক আশায় নিষ্পাপ একটি মনকে আঘাত করছেন যে আশা পূরণ হওয়ার নয়৷ আপনার সাথে আমার বিয়ে হলে আগেই হতো৷ আমার মনপ্রাণ একজনের প্রেমে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে৷ সেই ছাই কী করে আবার আপনি পুড়াবেন? মানুষ এক জীবনে সবকিছু পায় না। প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু না কিছুর অভাব থাকে। এক-দুটো অভাব নিয়ে বেঁচে থাকা খুব বেশি কঠিন নয়৷ যে আপনাকে ভালোবাসে তাকে আপনি ভালোবাসুন। যে আপনার জন্য মরতে প্রস্তুত তার জন্য বুকের এক টুকরো জায়গা দলিল করে দিন। তৃধা মেয়েটি ভীষণ ভালো। আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। সে আপনাকে খুব ভালোবাসে। তার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হওয়ার। অথচ,সে মেডিকেলের পড়া ছেড়ে মিডিয়ায় যোগ দিয়েছে! কতোটা ভালোবাসা থাকলে মানুষ এরকম করে? আপনি নিজেও স্বীকার করতে বাধ্য তৃধা আপনাকে ভালোবাসে! সে আপনার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। তৃধাই আপনাকে উজাড় করে ভালোবাসতে পারবে। আমাদের জুটি হওয়া সম্ভব নয়৷ এ স্বপ্নকে আর দূরে যেতে দিয়েন না। আমার সর্বত্র জুড়ে একটি নাম। আমি একটি মানুষের জন্যই আকুল। আমি হাজার চেষ্টা করেও আপনাকে এক টুকরো ভালোবাসা দিতে পারবো না। তখন ভালোবাসা অভিশাপে পরিণত হবে। চিন্তা করে দেখুন, আমাদের সত্যি বিয়ে হলে কেউ সুখী হবে না। না আপনি হবেন, না আমি হবো। আর না আপনার পরিবার আর তৃধা সুখী হবে৷ আমি বলছি না আমার কথায় তৃধাকে বিয়ে করতে,ভালোবাসতে। ভালোবাসা জোর করে হয় না৷ তবে বিয়েতে আল্লাহ তায়ালা নিজে রহমত ঢেলে দেন। ভালোবাসা ঢেলে দেন। জীবনকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন৷ আমার আম্মা বলতেন,পৃথিবীতে মানুষ দায়িত্ব নিয়ে আসে৷ সেই দায়িত্ব শেষ হয়ে গেলে তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। হয়তো আমার কোনো দায়িত্ব বাকি! তাই এখনো বেঁচে আছি। যদি সত্যি দশ বছর পর পৃথিবীর বুকে মুক্ত হয়ে হাঁটার সুযোগ পাই,আমি আপনাকে আমার পাশে দেখতে চাই না। আমি আমার স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। এই বাঁচায় সুখ না থাকুক,স্বস্তি আছে৷ আমার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে সেই স্বস্তিটুকু কেড়ে নিবেন না। আপনি আমার জীবনের গল্পটির একটা পৃষ্ঠা মাত্র! আমি আমার শেষ জীবনটুকু নিজের মতো কাটাতে চাই। পাষাণের মতো কথা বলার জন্য আমি দুঃখিত! আপনার জীবন ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠুক। পরিবারকে সময় দিন।
ইতি,
পদ্মজা
লিখনের চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল চিঠির উপর পড়ে! কী নিষ্ঠুর প্রতিটি শব্দ! লিখন চিঠিটি রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালো। ধূলো উড়িয়ে বাতাস ছুটছে। আজ রাতে ঝড় হতে পারে! তার বুকেও ঝড় বইছে। নিজেকে পৃথিবীর উচ্ছিষ্ট মনে হচ্ছে! পদ্মজা তার জন্য চাঁদই রয়ে গেল আর সে গরীব ব্রাহ্মণ!
২০০৯ সাল। দেখতে দেখতে কেটে গেল তেরোটি বছর। পদ্মজা দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি কুয়াশা হাড় কাঁপানো শীত নিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। পদ্মজা দুই হাতে চাদর টেনে ধরলো। যত দূর চোখ যায় কেবল সবুজের হাতছানি। চা বাগানের সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্য! আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি কত সুন্দর! রঙহীন ধূসর কুয়াশাও চা বাগানের সৌন্দর্য আড়াল করতে পারলো না। কুয়াশার জন্য যেন অন্যরকম সুন্দর লাগছে। এই অপরূপ সৌন্দর্য যে কাউকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম । তবে বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ি সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি সুন্দর। পদ্মজা দুই পা তুলে বেতের চেয়ারে বসলো। তার মুখ শুষ্ক। আজ তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় প্রিয়তমর মৃত্যুবার্ষিকী! প্রিয়তম মারা গিয়েও যেন সর্বত্র বিছিয়ে রেখে গেছে ভালোবাসার ডালপালা। পদ্মজা সময়-অসময়ে,কারণে-অকারণে বার বার সেসব ডালপালার বেড়াজালে আটকে পড়ে। নিজেকে বড় নিঃস্ব মনে হয়।
পদ্মজা তার হাতের লাল খামটি থেকে দুটো চিঠি বের করলো। সে প্রতিদিন এই চিঠি দুটো পড়ে দিন শুরু করে। যতক্ষণ পড়ে,মনে হয় যেন আমিরের সাথে কথা বলছে! তার একদম পাশ ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে আমির বলছে, ‘,পদ্মবতী,ভালোবাসি।’
পদ্মজা চিঠি দুটিতে প্রথমে চুমু দিল। তারপর একটি চিঠির ভাঁজ খুললো। শুরুতে কোনো সম্বোধন নেই। অদ্ভুত একখানা চিঠি। চিঠিও বলা যায় না,এক পৃষ্ঠায় লেখা এক রাজা ও রানির গল্প। পদ্মজা পড়া শুরু করলো-
‘এক ছিল দুষ্টু রাজা! নারী আর টাকার প্রতি ছিল তার চরম আসক্তি। যে নারী একবার তার বিছানায় যেত তার পরের দিন সে লাশ হয়ে নদীতে ভেসে যেত। রাজা এক নারীকে দ্বিতীয়বার ছুঁতে পছন্দ করতো না। কিন্তু সমাজে ছিল রাজার বেশ নামডাক! সবার চোখের মণি। খুন করা ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। তার কালো হাতের ছোঁয়ায় বিসর্জন হয়েছে শত শত নারী। প্রতিটি বিসর্জন রাজার জন্য ছিল তৃপ্তিকর। নারী ব্যবসায় লাভবান হয়ে গড়ে তুলে প্রাসাদের পর প্রাসাদ! একদিন চাচাতো ভাইয়ের সাথে বাজি ধরে হেরে গেল রাজা। শর্তমতে,ভাইয়ের জন্য এক রাজকন্যাকে অপহরণ করতে যায়। সেদিন ছিল বৃষ্টি। সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। রাজকন্যার প্রাসাদে সেদিন কেউ ছিল না। রাজা এক কামরায় ওৎ পেতে থাকে। রাজকন্যা আসলেই তাকে তার কালো হাতে অপবিত্র করে দিবে। কামরায় ছিল ইষৎ আলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত আসে। রাজকন্যার পা পড়ে কামরায়। রাজকন্যা রাজাকে দেখে চমকে যায়। ভয় পেয়ে যায়। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে ‘‘কে আপনি? খালি বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?’ সেই কণ্ঠ যেন কোনো কণ্ঠ ছিল না। ধনুকের ছোঁড়া তীর ছিল। রাজার বুক ছিঁড়ে সেই তীর ঢুকে পড়ে। রিনঝিনে গলার রাজকন্যাকে দেখতে রাজা আগুন জ্বালায়। আগুনের হলুদ আলোয় রাজকন্যার অপরূপ মায়াবী সুন্দর মুখশ্রী দেখে রাজা মুগ্ধ হয়ে যায়। তার পা দুটো থমকে যায়। রাজকন্যা যেন এক গোলাপের বাগান। যার সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে রাজার কালো অন্তরে। রাজা নেশাগ্রস্তের মতো উচ্চারণ করলো নিজের নাম। নাম শুনেও রাজকন্যার ভয় কমলো না। পালিয়ে গেল অন্য কামরায়। রাজা কিছুতেই ভুলতে পারছিল না রাজকন্যার মুখ। তার চেনা পৃথিবী চুরমার হয়ে যায়। রাজকন্যার কামরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে মুহূর্তের পর মুহূর্ত৷ সেদিনই ঘটে গেল দূর্ঘটনা। রাজ্যবাসী শূন্য প্রাসাদে দুষ্টু রাজা ও মিষ্টি রাজকন্যাকে এক সঙ্গে দেখে ফেললো। রাজকন্যার গায়ে লেগে গেল কলঙ্ক। কয়েকজন অমানুষ রাজকন্যাকে নোংরা ভাষায় হেনস্তা করলো। সেই দৃশ্য দেখে রাজার বুকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সে নিজ প্রাসাদে ফিরে এক দণ্ডও শান্তি পেল না। তার চাচাতো ভাইকে তাৎক্ষণিক আদেশ করলো যারা রাজকন্যাকে তাদের মুখ দিয়ে অপমান করেছে তাদের যেন জিহবা ছিঁড়ে ফেলা হয়,যে হাত দিয়ে রাজকন্যাকে ছুঁয়েছে সে হাত যেন কেটে দেয়া হয়, যে চোখ দিয়ে রাজকন্যাকে লোলুপ দৃষ্টিতে দেখেছে সে চোখ যেন উপড়ে ফেলা হয়। ভোররাতে দুষ্টু রাজা খবর পেল, রাজকন্যার মাতা সেই অমানুষ দের হত্যা করেছে। এতে রাজা খুশি হলেও রাজকন্যার মাতাকে নিয়ে একটা চাপা ভয় কাজ করে। কিন্তু বেশিক্ষণ রাজকন্যার মাতাকে নিয়ে ভাবলো না। রাজকন্যাকে যে ভোলা যাচ্ছে না। তাকে যে করেই হউক পেতে হবে৷ নয়তো জীবন বৃথা। রাজা তার পিতাকে আদেশ করলো, মায়াবতী রাজকন্যাকে তার চাই ই চাই। নয়তো সে বাঁচবে না। এই পৃথিবী তোলপাড় করে দিবে৷ রাজার পাগলামি দেখে অবাক তার পরিবার। সালিশ বসে। সালিশে সেই দুষ্টু রাজা রাজকন্যার মাতার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে রেহাই পেয়ে,জিতে নিল রাজকন্যাকে। তিনি এক কথায় রাজকন্যাকে দিতে রাজি হলেন। আনন্দে রাজার বুকে উথাল ঢেউ শুরু হয়। কী অসহ্য সুখময় যন্ত্রণা! রাজা এর আগে এতো খুশি হয়েছে নাকি জানা নেই! যথাসময়ে তাদের বিয়ে হলো। রাজকন্যা রাজার রানী হলো। নাম তার পদ্মবতী। ফুলের মতো পবিত্র সে,সদ্যজাত শিশুর মতোই নিষ্পাপ। রাজা ভুলে গেল নারী সঙ্গের কথা,ভুলে গেল তার রাজত্বের কথা। তার ধ্যানজ্ঞান সীমাবদ্ধ হয়ে গেল পদ্মবতীতে। পদ্মবতীর একেকটা কদম রাজার বুকে ঢেউ তুলে,পদ্মবতীর প্রতিটি নিঃশ্বাস থেকে যেন ফুল ঝরে পড়ে। পদ্মবতীর পায়ে চুমু দেয়ার সময় রাজার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘পদ্মবতী…আমার রানী,আমি কাঁটা বিছানো বাগানে শুয়ে থাকি তুমি আমার বুকে হেঁটে বেড়াও।’
ধীরে ধীরে রাজা উপলব্ধি করতে পারলো, তার পদ্মবতী পবিত্র। এতোই পবিত্র যে সে কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করবে না।
এই পবিত্রতা রাজাকে আরো আকৃষ্ট করে ফেললো। সেই সাথে রাজা ভয় পেল,তার কালো অন্তরের খবর যদি পদ্মবতী জেনে যায়
তখন কী হবে? কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ধরে বেঁধে রাখা গেলেও পদ্মবতীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। এই বিচ্ছেদ সহ্য করার ক্ষমতা তার হবে না। নির্ঘাত মরে যাবে। যে ভালোবাসা নিজ ইচ্ছায় তাকে বিমুগ্ধ করে তুলে,সে ভালোবাসা জোর করে সে কখনো নিতে পারবে না। রাজা তার পাপ লুকিয়ে রাখতে মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা অভিনয় করা শুরু করলো। পদ্মবতীর থেকে সহানুভূতি আর বিশ্বাস অর্জন করতে গল্প বানালো৷ তার পাপের মহলে নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিল। প্রয়োজনে সে পৃথিবীর প্রতিটি মানব সন্তানকে খুন করতে প্রস্তুত,তাও তার পাপের জন্য পদ্মবতীকে হারাতে চায় না।
যথাসম্ভব পদ্মবতীকে নিয়ে দুষ্টু রাজা অন্য রাজপ্রাসাদে চলে আসে। সেই প্রাসাদে রাজা আর তার পদ্মবতী ছাড়া কেউ নেই! ভালোবাসার সোহাগ ও খুনসুটিতে ভরে উঠে তাদের ঘর। রাজার দৃষ্টি ডুবে যায় একজনেতে! কোনো নারী আর তাকে টানতে পারলো না। প্রতিটি প্রহর পদ্মবতীকেই নতুন করে অনুভব করে। নারী আসক্তি চিরতরে তাকে ছেড়ে গেল। কিন্তু নারী ব্যবসা রয়েই গেল। সৎ পেশার অজুহাতে অসৎ পেশা জ্বলজ্বল করে তখনো জ্বলছিল। মাঝেমধ্যে রাজার ভয় হতো,পদ্মবতী সব জেনে যাবে না তো? রাজা সব রকম পট্টি বেঁধে দিল পদ্মবতীর চোখে। পদ্মবতী সেই পট্টিসমূহ ভেদ করে পৌঁছাতে পারলো না গভীরে! ভালোবাসার বেড়াজালেই আটকে রইলো।
বছর দেড়েক পর তাদের ঘর আলো করে এলো এক রাজকন্যা। রাজকন্যা ছিল মায়ের মতোই সুন্দর। আকাশে একটা চাঁদ উঠে,কিন্তু রাজার আকাশে উঠেছিল দুটো চাঁদ! ছোট্ট রাজকন্যাকে দেখে রাজার বুক কেঁপে উঠে। তৃতীয়বারের মতো কোনো মেয়ের প্রতি সে ভালোবাসা অনুভব করে। তার প্রথম ভালোবাসা তার মা,দ্বিতীয় ভালোবাসা স্ত্রী, আর তৃতীয় ভালোবাসা তার কন্যা! রাজা যতবার রাজকন্যাকে কোলে নিত, বুকে একটা ব্যথা অনুভব করতো। বার বার মনে হতো, আমার জগৎ-সংসার একটু সাধারণ হতে পারতো না? এই চিন্তা তার অসৎ কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। তার দলবল চিন্তিত হয়ে পড়ে। কাজের প্রতি রাজার উদাসীনতা তাদের ক্ষিপ্ত করে। পূর্ব ক্ষোভের জেদ ধরে তারা রাজার দূর্বলতা লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারে। সেই তীরে ছোট্ট রাজকন্যার প্রাণের আলো নিভে যায়। রাজার বুক থেকে একটা চাঁদ খসে পড়ে! পদ্মবতী ভেঙে গুড়িয়ে যায়। পদ্মবতীর ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা রাজার নেই। শক্ত দুই হাতে আঁকড়ে ধরে পদ্মবতীকে। তার কন্যার খুনিকে সে নিজ হাতে কোপাতে পারলেও,খুনের আদেশ দাতাদের হত্যা করতে পারলো না। জানতে পারলো তার পিতা,চাচা ও চাচাতো ভাইয়ের আদেশে তার রাজকন্যার চোখ দুটি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে! ততদিনে রাজা এটাও বুঝে গেল, যে জগতে সে প্রবেশ করেছে সেই জগতের শেষ পরিণতি মৃত্যু। সে যদি খুনের আদেশ দাতাদের ক্ষতি করে তার ব্যবসা ডুবে যাবে৷ ব্যবসার খুঁটি সে হলেও, আদেশ দাতারা সেই খুঁটি ধরে রেখেছে। আর ব্যবসার পতন মানে পদ্মবতীর সব জেনে যাওয়া। সেই সাথে অন্য রাজাদের ক্ষোভের শিকার হওয়া। যে রাজাদের সাথে মিলে দুষ্টু রাজা পাপ জমায় তারা হিংস্র হয়ে উঠবে। আর তারা দুষ্টু রাজার উপর ক্ষিপ্ত হলে ক্ষতি হবে পদ্মবতীরও। এতোজনকে রুখতে যাওয়ার ক্ষমতা দুষ্টু রাজার নেই। আবার মাথার উপর আছে শাসকের আদালত! একমাত্র রাজার মৃত্যু পারে তার কন্যার খুনীদের ধ্বংস করতে। কিন্তু রাজা নিজেকে উৎসর্গ করতে চায় না। পদ্মবতীর সাথে সারাজীবন বাঁচতে চায়। তাই রাজা ধামাচাপা দিল রাজকন্যার ব্যথা! বাবা হিসেবে হেরে গেল,চুপসে গেল। অভিশাপ সেই রাজাকে। অভিশাপ!
‘
পদ্মজা চিঠির উপর হাত বুলিয়ে দিল। যখন সে প্রথম এই বাস্তব রূপকথা পড়েছিল,সাদা অংশে শুকনো রক্ত লেগে ছিল। তার প্রিয় স্বামীর রক্ত! আমিরের শরীরে পাওয়া গেছে অগণিত কামড়ের দাগ,চাবুক মারার দাগ,ছুরির আঘাতের দাগ। সে নিজেকে শেষ দিনগুলোতে অনেক আঘাত করেছে। নিজেকে রক্তাক্ত করে পাতালঘরে আর্তনাদ করেছে। পদ্মজা হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে দ্বিতীয় চিঠিটি হাতে নিল। ভাঁজ খুললো,
‘
প্রিয়র চেয়েও প্রিয় পদ্মবতী,
আমার পাপের রাজত্বে তোমার আগমন ভূমিকম্পের মতো ছিল। যখনই দেখি তুমি দাঁড়িয়ে আছো,আমার হৃৎপিণ্ড থমকে যায়। চোখের সামনে ছয় বছরে গড়ে তোলা ভারী দেয়াল ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
আমার চোখের মণি পদ্মজা,তোমার ওই দুচোখের অবিশ্বাস্য চাহনি আমাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। আমার কথা হারিয়ে যায়। আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। খারাপের মাঝেও ভালো থাকার মন্ত্র ছিল তোমার দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে যখন ঘৃণা দেখতে পাই,আমার বুক পুড়ে যায়। আমার মস্তিষ্ক ফেটে যায়!
তোমার আহত মুখশ্রী দেখে আমার শরীরের চামড়া ঝলসে যায়। তোমার চোখের জল দেখে সমুদ্র আছড়ে পড়ে মাথার উপর। আমার মিথ্যাচার, আমার প্রতারণা তোমাকে কষ্টের ভুবনে ছুঁড়ে ফেলে। বিষাদের ছায়া ঢেকে যায় তোমার চোখ। সেই বিষাদটুকু মুছে দেয়ার অধিকার আমি হারিয়ে ফেলি। যদি পারতাম আকাশের মেঘ হয়ে তোমার কাজলকালো আঁখি ছুঁয়ে সবটুকু বিষাদ ধুয়েমুছে সাফ করে দিতাম।
আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা, তুমি একটু দূরে সরলেই যে আমি মনে মনে পুরো পৃথিবী ভস্ম করে দেয়ার ইচ্ছে পুষি, সেই আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম,তোমার-আমার পথচলা এখানেই শেষ! আমি শান্ত পাথরের মতো স্থির হয়ে যাই। গন্তব্য হারিয়ে ফেলি। এই ভুবনে তুমি আমার শেষ আশ্রয়স্থল ছিলে। আম্মার সাথে তখন যোজন যোজন দূরত্ব। তোমার ঘৃণাভরা চাহনি আমাকে চোখের পলকে পুড়িয়ে দেয়৷ তোমার আমার বিচ্ছেদ আমাকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়, প্রেমানলে জ্বলতে জ্বলতে আমি অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছি।
সোনালি রোদ্দুরের মতো সুন্দর পদ্মবতী, আমি তোমাকে আঘাত করে নিজে মরে গিয়েছি। যে হাতে আঘাত করেছি সেই হাত পুড়ে যাক,পোকামাকড় খাক! তোমাকে ব্যথা দিয়ে আমি ভালো নেই। ছুরির আঘাতও আমার মনের ব্যথার চেয়ে বেশি হতে পারছে না। যদি পারতাম হয় তোমাকে ভালোবাসতাম,নয় শুধু হাওলাদার বংশে জন্ম নিতাম। দুটো একসাথে গ্রহণ করতাম না। দুই সত্ত্বা মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে আমাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
আমি নিষ্ঠুর,তুমি মায়াবতী
আমি ধ্বংস,তুমি সৃষ্টি
আমি পাপ,তুমি পবিত্র
এতো অমিলে কেন হলো মিলন? কেন কালো অন্তরে ছড়িয়েছিল ফুলের সুবাস? আমাকে ধ্বংস করার কি অন্য কোনো অস্ত্র ছিল না? এমন কঠিন কষ্ট কেন দেয়া হচ্ছে আমাকে? তোমার ব্যথায় আমি দগ্ধ হচ্ছি। তোমার কান্না,তোমার আর্তনাদ আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনকে কাঁপিয়ে তুলে। মনে হয়,মাথার ভেতর পোকারা কিলবিল করছে৷ বিচ্ছেদের বিষাক্ত ছোবলে নীল হয়ে যাচ্ছি আমি। আমাকে বাঁচাও!
শূন্য আকাশে গাঙচিল যেমন একা আমিও তেমন একা। প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে অনুশোচনায় দগ্ধ করে। একাকী নীরবে সহ্য করি। এটাই তো আমার প্রাপ্য। মেয়েগুলোকে বাঁচাতে চেয়েও বাঁচাতে পারিনি। বুকের উপর পাথর চেপে পাঠিয়ে দিয়েছি বহুদূরে। যখন তাদের জাহাজে তুলে দিয়েছি আমার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে ছিল। ব্যথিত হৃদয় প্রথমবারের মতো অনুভব করে, তারাও তো আমার মতো কষ্ট পাচ্ছে! কিন্তু তখন আমার আর সামর্থ্য ছিল না।
আমার জীবনের বসন্তকাল তুমি। তোমার অসহ্য আলিঙ্গন আমার সহ্যের বাইরে ছিল। তোমার আর্তনাদ করে পালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়। সত্যি যদি পারতাম,পালিয়ে যেতে! কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। আমার আকাশ সমান পাপ আমার পিছু ছাড়বে না। আজীবন দৌড়াতে হবে। এক দন্ডও শান্তি মিলবে না।
মেঘলা বরণ অঙ্গের সাম্রাজ্ঞী, তোমার ভালোবাসার সাম্রাজ্যে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম শত জনম। হলো না। তোমার চোখের খাদে পড়ে থাকতে চেয়েছিলাম আজীবন। তাও হলো না। সময় এসেছে আমার বিদায়ের! আমাদের পথচলা এতটুকুই। আমি ছিলাম দূর্গের মতো কঠিন। সেই দূর্গ তুমি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছো। ভালোবাসা আমার হাঁটু ভেঙে দিয়েছে। আমার আর উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। শেষ বারের মতো তোমাকে ছুঁয়ে যেতে চাই। আমার প্রেম তুমি,আমার ভালোবাসা তুমি। সত্যি বলছি,আমার জীবনে আসা প্রতিটি নারী আমাকে নয় আমার হারাম টাকার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাদের আমি কিনে নিয়েছি। শারমিন আর মেহুল দুজনকে বাড়ি উপহার দিয়ে তারপর আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে। তাও আমি অপরাধী। আমি তাদের ঠকিয়েছি, প্রতারণা করেছি,খুন করেছি। আমি অনুতপ্ত। বড্ড আফসোস হচ্ছে,বড্ড আক্ষেপ থেকে গেল৷ ওপারেও আমি তোমাকে পাবো না! আমার মতো ঘৃণিত ব্যাক্তি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারবে না। আমার জায়গা হবে,জাহান্নামের কোনো এক দুর্গন্ধময় জগতে! তোমাকে দেখার তৃষ্ণা, তোমাকে ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার মিটলো না। হয়তো সহস্র বছরেও মিটবে না।
আমার হৃদয়ের রঙহীন বাগানের রঙিন প্রজাপতি, সাদা শাড়িকে তোমার সঙ্গী করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দুঃখিত। তুমি মুক্ত হবে। পাখির মতো উড়বে। শুধু আমি থাকবো না পাশে। আফসোস!
চিঠির শেষ প্রহরে এসে হাত কাঁপছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই পৃথিবীতে আমি আরেকটু থাকতে চাই। এই পৃথিবীর সবুজ বুকে তোমাকে নিয়ে প্রতিটি ভোর হাঁটতে চাই। আমাদের ভালোবাসার জ্যোৎস্না রাতগুলো আরেকটু দীর্ঘ হলে কী এমন হতো? আমাদের প্রেমের পরিণতি এতো নিষ্ঠুর কেন হলো?
তোমার ওই ঘোলা চোখের মায়াজাল ছেড়ে চলে যেতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু যেতে হবেই। আর থাকা যাবে না। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তোমার কোনো ক্ষতি হওয়ার আগে,আমাকে সব কীটদের নিয়ে এই পৃথিবী ছাড়তে হবে।
আমার আঁধার জীবনের জোনাকি, সৃষ্টিকর্তাকে বলো আমাকে যেন আরেকটা সুযোগ দেয়া হয়৷ এই পৃথিবীতে আবার যেন পাঠানো হয়৷
পৃথিবীর বুকে তো জায়গা, সম্পদের অভাব নেই। আরেকটা জীবন কি পেতে পারি না? তখন আমি কঠিন পরীক্ষা দেব৷ তোমাকে পেতে আগুনের উপর দিয়ে হাঁটবো, ভাঙা কাচের ধারে পা ছিন্নভিন্ন করে হলেও তোমাকে জিতে নেব। থাকবে না কোনো অন্ধকার জগতের হাতছানি,তৈরি হবে তোমার আমার প্রেমের উপাখ্যান৷ আমাদের ভালোবাসা দেখে জ্যোৎস্না ও তারকারাজি ঝলমলিয়ে ওঠবে।
আমাদের আবার দেখা হবে। কোনো না কোনো ভাবে আবার দেখা হবে। দেখা হতেই হবে। নিজের খেয়াল রেখো৷ ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করো। পূর্ণা,মা হেমলতার কাছে নিশ্চয়ই ভালো আছে৷ চিন্তা করো না। পারলাম না আরো কয়টা দিন তোমাকে আগলে রাখতে। ক্ষমা করো আমায়। অতৃপ্ত আমি মৃত্যুকে তৃপ্তি হিসেবে গ্রহণ করছি।
ইতি,
আমির হাওলাদার ‘
চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠে,আমিরের শেষ চাহনি। রক্ত বমি করে মাটিতে লুটিয়ে পড়া! ভেসে উঠে সেই শিশি। যে শিশির উপরে বড় বড় করে লেখা ছিল Poison (বিষ)। পদ্মজা দুটো চিঠি বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। তারপর শূন্য আকাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই চিঠি যেদিন প্রথম পড়লো সে,চিৎকার করে কেঁদেছে। সে আমিরকে খুন করে অনুতপ্ত নয়। সে কাঁদে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে!
দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে৷ পদ্মজা দ্রুত চিঠি দুটো ভাঁজ করে খামের ভেতর রেখে দিল। গলার স্বর উঁচু করে বললো, ‘বলো বুবু।’
দরজার ওপাশ থেকে লতিফার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘মাহবুব মাস্টার আইছে?’
পদ্মজা বললো, ‘নাস্তা তৈরি করো। আমি আসছি।’
পদ্মজা চোখের পানি মুছে ঘরে আসলো। আয়নায় দেখলো,সে যে কেঁদেছে বুঝা যাচ্ছে নাকি। না বুঝা যাচ্ছে না। গায়ের শালটি রেখে আলনা থেকে আরেকটি কালো শাল নিয়ে ভালো করে মাথা ঢেকে নিল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। বৈঠকখানার সামনে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালো।
মাহবুব মাস্টার বসে আছেন। তার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তিনি অংকের মাস্টার। পদ্মজা আর তিনি এক স্কুলের শিক্ষক। ভালো পড়ান। তার সামনে বসে আছে তিনটি ছেলেমেয়ে। এই তিনজনকে পড়ানোর জন্যই পদ্মজা মাহবুব মাস্টারকে ডেকেছে। মাহবুব মাস্টার বারো বছরের ছেলেটিকে আগে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নাম কী?’
ছেলেটি প্রবল উৎসাহ নিয়ে বললো, ‘আমার নাম নুহাশ হাওলাদার। আর ওর নাম…’
মাহবুব নুহাশকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘তুমি শুধু তোমার নাম বলো। অন্যজনেরটা বলতে বলিনি। কাঁটা থুতুনি তোমার নাম কী?’
‘আমীরাতুন নিসা নুড়ি।’ নুড়ি অবাক হওয়ার ভান করে নিজের নাম বললো। তার থুতনিতে গর্ত আছে বলে কি তাকে কাঁটা থুতুনি ডাকতে হবে! সে মনে মনে ব্যথা পেয়েছে। নুড়ির পাশে বসে থাকা দশ বছরের মেয়েটি বললো, ‘আমার নাম জিজ্ঞাসা করছেন না কেন? আমি সবার ছোট। আমার নাম খাদিজাতুল আলিয়া।’
মাহবুব মাস্টার চোখের চশমা ঠিক করে বললেন, ‘ভীষণ বেয়াদব তো! এতো অধৈর্য্য কেন তুমি?’
নুহাশ আলিয়ার মাথায় থাপ্পড় দিয়ে বললো, ‘ মা কী বলছে মনে নেই? বেশি কথা বলতে নিষেধ করেনি?’
আলিয়া কটমট করে নুহাশের দিকে তাকালো। নুহাশ বললো, ‘ খেয়ে ফেলবি আমাকে?’
আলিয়া খামচে ধরলো নুহাশের মাথার চুল। নুহাশও আলিয়ার চুল খামচে ধরে। দুজন ধস্তাধস্তি করে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। তারা দুজন কথায় কথায় ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলে। মাহবুব মাস্টার আঁতকে উঠলেন,হইহই করে চিৎকার করে উঠলেন। পদ্মজা পর্দা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে নুহাশ ও আলিয়া থেমে গেল৷ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নুড়ি দুই চোখ খিঁচে চাপাস্বরে নুহাশকে বললো, ‘দিলি তো মা কে রাগিয়ে!’
মাহবুব মাস্টার হতবাক! পদ্মজার মতো নম্রভদ্র শিক্ষিকার এমন উশৃংখল ছেলেমেয়ে! তিনি চশমা ঠিক করতে করতে বললেন, ‘ এত অসভ্য এরা!’
পদ্মজা শীতল চোখে নুহাশ ও আলিয়ার দিকে তাকালো। তারা নতজানু হয়ে আছে। পদ্মজা বললো, ‘ সবাই ভেতরে যাও।’
পদ্মজার কণ্ঠে রাগের আঁচ। তা টের পেয়ে আলিয়ার চোখে জল জমে। প্রায় প্রতিদিন নুহাশ আর তার ঝগড়া হয়। ঝগড়ার জন্য শাস্তি পায় তবুও ভুলে ভুলে আবার ঝগড়া করে ফেলে। তারা চুপচাপ ঘরের ভেতর চলে গেল। পদ্মজা মৃদু হেসে মাহবুব মাস্টারকে বললো, ‘ ওরা একটু ক্ষেপা ধরণের। ভাইবোন একসাথে থাকলে যা হয়!’
‘শয়তানদের মেরুদণ্ড সোজা করতে করতে চুল পেকেছে আমার। এদেরও কয়দিনে সোজা করে ফেলবো।’
‘আগামীকাল থেকে আর দুষ্টুমি করবে না। আপনি একটু ভালো করে পড়াবেন। আমার তিনটা ছেলেমেয়েই অংকে কাঁচা।’
‘আপনি আমাকে বলেছেন, এতেই যথেষ্ট। অংক ওদের প্রিয় সাবজেক্ট না বানাতে পারলে আমি মাহবুব মাস্টার না।’
পদ্মজা জোরপূর্বক হাসলো। মাহবুব মাস্টার একটু বেশি কথা বলেন। যাওয়ার পূর্বে মাহবুব মাস্টার বলে গেলেন, আগামীকাল থেকে প্রতিদিন সকাল সাতটায় অংক পড়াতে আসবেন।
পড়ন্ত বিকেল! আলিয়া ছবি আঁকছে। সে খুব ভালো ছবি আঁকে। বর্ণনা শুনে হুবহু ছবি আঁকতে পারে! গায়ের রং শ্যামলা। তার নাম আমিরের নামের সাথে মিল রেখে আলিয়া রাখা হয়েছে। পদ্মজা পাঁচ বছর জেলে ছিল। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তার নিঃস্ব জীবনে রূম্পার ছেলে নুহাশের আগমন হয়৷ রুম্পা নুহাশকে জন্ম দিয়েই মারা যায়। চার-পাঁচ বছর লতিফা আর বাসন্তী নুহাশকে দেখেছে। তারপর পদ্মজা দায়িত্ব নিলো। নুহাশ আর লতিফাকে নিয়ে চলে আসে চা বাগানের দেশ সিলেটে। তার নামে যত সম্পত্তি আমির লিখে দিয়েছিল সেসব পদ্মজা সরকারের দায়িত্বে দিয়েছে।এবং অন্দরমহল ও অলন্দপুরের জমিজমা বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে এতিমখানা,মসজিদ ও মাদরাসা নির্মাণ করেছে। গরীবদের খাবার,জামা-কাপড় দান করেছে। একটি পয়সাও নিজের জন্য রাখেনি। খালি হাতে সিলেট এসেছে। সিলেটে পদ্মজার রেনু নামে এক বান্ধবী ছিল । তারা একসাথে ঢাকা পড়েছে। রেনুর সহযোগিতায় পদ্মজা একটা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক হয়। মাস তিনেক পার হতেই পদ্মজা অনুভব করলো,তার বেঁচে থাকা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। তাই নুহাশকে নিয়ে ঢাকা ঘুরতে যায়। কথায় কথায় পদ্মজা তুষারকে জানালো,সে একটা মেয়ে বাচ্চা দত্তক নিতে চায়। তুষার এ কথা শুনে বললো,পদ্মজা চাইলে তাদের এলাকার এতিমখানা থেকে বাচ্চা নিতে পারে। তুষারের ভালো পরিচিতি আছে। প্রতি মাসে সে তার বেতনের একাংশ এতিমখানায় দেয়। পদ্মজা কথাটি শুনে খুব খুশি হলো। তুষারের সাহায্যে এতিমখানা থেকে আড়াই বছরের এক শ্যামবর্ণের মেয়েকে দত্তক নিয়ে নিজের মেয়ে মনে করে বুকে জড়িয়ে নেয়। নাম দেয়,খাদিজাতুল আলিয়া। যেদিন আলিয়াকে নিয়ে বাসায় আসে সেদিন রাতে টের পেল,আলিয়ার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। পদ্মজা এরপর দিন সকালে আবার এতিমখানায় গেল। আলিয়ার শ্বাসকষ্ট নিয়ে কথা বলতে। তারা চিকিৎসা করেছে নাকি? ঔষধের নামগুলো কী?
সব জেনে যখন সে এতিমখানা থেকে বের হতে উদ্যত হলো তখন তার পিঠের উপর একটা নুড়ি পাথর এসে পড়ে। পদ্মজা পিছনে ফিরে নুহাশের বয়সী একটা মেয়েকে দেখতে পেল। মেয়েটির থুতনির গর্তটি তার পায়ের তলার মাটি কাঁপিয়ে তুলে। হুবহু আমিরের কাঁটা দাগটির মতো! এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়,তার আর আমিরের সন্তান দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজার বুকের ভেতরটা হাহাকার
করে উঠে। মেয়েটি দৌড়ে পালায়। পদ্মজা মেয়েটিকে খুঁজে বের করে। তারপর এতিমখানার দায়িত্বে থাকা কতৃপক্ষকে অনুরোধ করলো, এই মেয়েটিকেও সে দত্তক নিতে চায়। পদ্মজার দূর্বলতা টের পেয়ে লোকটি,বিরাট অংকের টাকা চেয়ে বসে। পদ্মজা বাধ্য হয়ে আশা ছেড়ে দেয়। তবে যে কয়টাদিন ঢাকা ছিল,নিজের অজান্তে বোরকা পরে বার বার এতিমখানার সামনে গিয়ে ঘুরঘুর করেছে। তারপর ফিরে আসে সিলেট। মাস তিনেক অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চা মেয়েটির মুখ ভুলতে পারলো না। তার বুকের ভেতর ছোট মেয়েটি যেন আলোড়ন সৃষ্টি করে দিয়েছে। পদ্মজা আবার ঢাকা গেল। নিজ থেকে তুষারকে বললো মেয়েটিকে আনার ব্যবস্থা করে দিতে। তুষার ও প্রেমা দুজনই পদ্মজার অস্থিরতা গভীর ভাবে টের পেল। তুষার দ্রুত সম্ভব মেয়েটিকে নিয়ে আসে। মেয়েটিকে হাতের কাছে পেয়ে পদ্মজা কেঁদে দেয়। খুশিতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নুড়ি পাথরের জন্য মেয়েটিকে পাওয়া বলে,তার নাম দিল আমীরাতুন নিসা নুড়ি।
এই হলো পদ্মজার তিন সন্তানের মা হওয়ার গল্প। সিলেটে তাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সব সমস্যা পেরিয়ে আজ সে এক বেসরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষিক। বিশাল চা বাগানের মধ্যিস্থলে এক কোয়ার্টারে তারা থাকে। তাদের বাড়িটি এক তলা।
পদ্মজা রাতের রান্না করছে। আলিয়া ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকে পদ্মজাকে দেখছে। নুহাশ ভয়ে তাকাচ্ছেই না। পদ্মজা যখন রেগে যায়। কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আর পদ্মজা দূরত্বের রেখা টেনে দিলে তার তিন ছেলেমেয়েদের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। নুড়ি আড়চোখে পদ্মজাকে দেখে আলিয়াকে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘মা কষ্ট পেয়েছে।’
আলিয়ার চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। সে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ‘ আমি মা কে কষ্ট দিতে চাইনি।’
নুহাশ ব্যথিত স্বরে তাল মিলালো, ‘আমিও চাইনি।’
আলিয়া চিৎকার করে উঠলো, ‘তোমার জন্য হয়েছে ভাইয়া৷ তুমি আমাকে রাগিয়েছো।’
নুড়ি ঠোঁটে এক আঙুল রেখে ইশারা করে চুপ হতে৷ আলিয়া দ্রুত এক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। সে ভুলে ভুলে আবার চিৎকার করে উঠেছে! নুহাশ ঠোঁট টিপে হাসলো। আলিয়া ভুল করলে তার ভালো লাগে। নুড়ি রান্নাঘরে গিয়ে পদ্মজাকে বললো, ‘ মা,আমি সাহায্য করবো?’
পদ্মজা বললো, ‘ না মা,আমি আর তোমার লুতু খালামনি আছি। বই পড়তে বলেছিলাম পড়া হয়েছে?’
নুড়ি জিহবা কামড়ে বললো, ‘ আল্লাহ! ভুলে গেছি মা।’
‘কতদিন বলেছি,ছুটির দিন পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য বই পড়তে? ভুলে গেলে চলবে? আমাদের ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।’
নুড়ি মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো, ‘আর ভুল হবে না।’
পদ্মজা নুড়ির দিকে তাকালো। সবেমাত্র বয়সসন্ধিকালে পা দিয়েছে মেয়েটা। তার ফর্সা সাধারণ মুখশ্রী থুতুনিতে থাকা খাঁচ কাঁটা দাগটির জন্য অসাধারণ হয়ে উঠেছে। মাথায় চুল কোঁকড়া। হাত-পা চিকন চিকন। নুড়ি পদ্মজাকে এভাবে তাকাতে দেখে বিব্রতবোধ করলো। পদ্মজা চোখের দৃষ্টি সরিয়ে বললো, ‘ বাঁদর দুটোকে গিয়ে বল,যদি আমার হাতে মার খেতে না চায় অযু করে জায়নামাযে যেন বসে। এক্ষুনি মাগরিবের আযান পড়বে।’
নুড়ি মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। পদ্মজা চোখ ছোট করে বললো, ‘ কী হলো?’
‘মা,আমি নামায আদায় করতে পারবো না।’
পদ্মজা রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল,তখনই বুঝতে পারলো নুড়ি কেন নামায আদায় করতে পারবে না। সে আমুদে স্বরে বললো, ‘ ও তাহলে আপনি এজন্যই আজ এতো চুপচাপ?’
নুড়ি দাঁত বের করে হাসলো। নুহাশ,আলিয়ার চেয়েও নুড়ি বেশি দুষ্ট ৷ রাগ,জেদ খুব বেশি। তবে পদ্মজার সামনে ভেজা বিড়াল। সে আর যাই করুক,পদ্মজাকে কখনো কষ্ট দিতে চায় না। নিজের অজান্তেও না।
রাতের খাবার পরিবেশন করার সময় লতিফা বললো, ‘ প্রান্ত কোনদিন আইবো কইছে?’
‘আগামী মাসে আসবে। ভাবছি,এইবার গ্রামে গিয়ে প্রান্তর বিয়ে দেব। জমিজমা নিয়েই সারাক্ষণ পড়ে থাকে। ধরেবেঁধে বিয়ে দিতে হবে।’
‘বউ কোন এলাকার আনবা?’
পদ্মজা হাসলো। বললো, ‘প্রান্ত যা চায়।’
ধপাস করে কিছু একটা পড়ে! নুহাশ আর আলিয়া আবার দুষ্টুমি শুরু করেছে। লতিফা বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘ ওরা দিন দিন খালি শয়তান অইতাছে।’
‘শয়তান বলতে মানা করেছি। আল্লাহর রহমতে আমার ছেলেমেয়েরা আমার গর্ব হবে। আমি টের পাই।’
পদ্মজা এই তিন বাঁদর ছেলেমেয়ের মুখে অলৌকিক কী দেখেছে লতিফার জানা নেই। শুধু এইটুকু জানে,এরা তিনজন যেখানে যায় সে জায়গায় তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। লতিফা জোর গলায় বললো, ‘ দেহো পদ্মজা,আমি কিন্তু হুদাই কইতাছি না। দিন দিন আরো বিগড়ে যাইবো।’
পদ্মজা লতিফার কথা পাত্তা দিল না। সে খাবার পরিবেশন শেষে ঘরে চলে যায়। একদিন নুহাশ ও আলিয়াকে রাগ দেখিয়ে চলতে হবে। নুহাশ খাবার খেতে এসে বললো, ‘ লুতু খালামনি,মা খাবে না?’
লতিফা বললো, ‘না,খাইবো না। তোমরা দুইডায় যেমনে মাস্টারের সামনে পদ্মর মুখ কালা করছো। পদ্ম খাইবো কেন? হে গুসা করছে।’
আলিয়া পদ্মজার ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ তাহলে আমরাও খাব না।’
নুড়ি বললো, ‘ তাহলে আরো বেশি রাগ করবে। আরো বেশি কষ্ট পাবে।’
মনে ব্যথা নিয়ে মুখ গুমট করে তারা দুজন খেল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে তিনজন ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। পদ্মজা প্রতিদিন ঘুমাবার পূর্বে তাদের গল্প বলে। গত এক মাস ধরে পদ্মজা একটা গল্প বলছে। গল্পটা এক দুষ্টু রাজা ও এক মিষ্টি রানির। ভালোবাসা সত্ত্বেও রানি রাজাকে খুন করে। তারপর রানির কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ড হওয়ার পর কখন মুক্তি পেল? পরের জীবনটা কীভাবে কাটলো? বললো না পদ্মজা। সেটা জানার জন্য তিনটি ছেলেমেয়ে উদগ্রীব হয়ে আছে৷ পদ্মজা বলেছিল আজ বলবে, কিন্তু বলার সুযোগই পেল না। নুহাশ ও আলিয়া রাগিয়ে দিল। নুড়ি দরজা লাগিয়ে নুহাশ ও আলিয়াকে ডাকলো। একত্রে বসার পর নুড়ি বললো, ‘আজ বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। তাই কিছু বলার দরকার নেই। কাল সকালে তোরা দুজন মার পায়ে ধরে ফেলবি।’
নুড়ি কথা শেষ করে হাত তালি দিল। যেন সব সমস্যা শেষ! নুহাশ ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘মা,পা ধরে ক্ষমা চাওয়া পছন্দ করে না।’
নুড়ির হাসি মিলিয়ে গেল। আলিয়া বললো, ‘পেয়েছি,আমরা সব বই পড়ে শেষ করে ফেলবো। মা খুশি হবে।’
‘বছর পার হয়ে যাবে। মা এক বছর রেগে থাকবে?’ বললো নুড়ি।
তারা ঘন্টাখানেক আলোচনা করলো। কোনো পরিকল্পনাই চূড়ান্ত হলো না। একজনের পছন্দ হয় তো অন্যজনের হয় না। হুট করে তারা পদ্মজার গলার স্বর শুনতে পেল। পদ্মজা লতিফাকে বলছে, ‘ লুতু বুবু,বাড়ির বড় বিড়ালদের বলে দাও তাদের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে।’
নুহাশ,নুড়ি ও আলিয়া দ্রুত লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। পদ্মজা মাঝ রাতে নিজ ঘর থেকে বের হয়। লতিফা জেগে ছিল। তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করছে। পদ্মজার সংস্পর্শে এসে তার মুখের আঞ্চলিক ভাষা ছাড়া সব পাল্টে গেছে। রিনুকে বিয়ে দিয়েই সে পদ্মজার সঙ্গী হয়েছে। লতিফা জায়নামাজ ছেড়ে উঠতেই পদ্মজা বললো, ‘ আমি বের হচ্ছি। আমাকে না পেয়ে ওরা যেন বের না হয়৷ আশেপাশের অবস্থা ভালো না। পাশের এলাকায় পর পর দুটো লাশ পাওয়া গেছে। এখানে আবার কোন চক্রান্ত চলছে কে জানে! দরজা বন্ধ করে রেখ।’
‘তুমিও যাইয়ো না পদ্ম।’
পদ্মজা শুনলো না। প্রথমে ছেলেমেয়েদের ঘরে গেল। নুড়ি ও আলিয়া এক বিছানায় ঘুমাচ্ছে। আর নুহাশ পাশের বিছানায় ৷ পদ্মজা ঘুমন্ত তিন ছেলেমেয়ের কপালে চুমু দিয়ে আলতো করে মুখ ছুঁয়ে দিল। এই তিনটে ফুটফুটে ছেলেমেয়েকে সে ভীষণ ভালোবাসে। তাদের জন্য পদ্মজা নিজের জীবন কোরবান দিতেও প্রস্তুত। জীবনে যতটুকু আনন্দ আছে তার পুরোটা অবদান নুড়ি,নুহাশ আর আলিয়ার। পদ্মজা অনেকক্ষণ বসে রইলো। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো বাইরে। কোয়ার্টার ছেড়ে বের হতেই নিঃসঙ্গতা কামড়ে ধরে তাকে। আমিরের প্রতিটি মৃত্যুবার্ষিকীর রাত সে খোলা আকাশের নিচে কাটায়। চোখ বন্ধ করে অনুভব করে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো। এই সময়টুকু একান্ত তার আর আমিরের৷
ঘন্টাখানেক হেঁটে এসে এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালো পদ্মজা। এই পাহাড়টি এখানকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। একটা মই হলেই যেন আকাশ ছোঁয়া যাবে। আকাশের গায়ে লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলজ্বল করছে। এর মাঝে কোন তারাগুলো পদ্মজার প্রিয়জন? পদ্মজা এক হাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে ভেজা কণ্ঠে উচ্চারণ করলো, ‘আমার প্রিয়জনেরা!’
তার এই দুটি শব্দে প্রকাশ পায় ভেতরের সব দুঃখ,যন্ত্রণা, অভাববোধ। মা-বাবা,বোন,স্বামী,শ্বাশুড়ি সবাই আকাশটাতে থাকে। শুধু সে জমিনে রয়ে গেছে। পদ্মজা চোখ বুজলো। সাঁইসাঁই করে বাতাস বইছে। বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঠান্ডায় শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। চোখের পাতায় দৃশ্যমান হয়,হেমলতার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,রুক্ষমূর্তি, পূর্ণার আহ্লাদ, হাসি,আমিরের ছোঁয়ার বাহানা,বুকে নিয়ে কান্না থামানো। কত সুন্দর অতীত! কতোটা সুন্দর! পদ্মজা চোখ খুললো। তার ঘোলা দুটি চোখ জলে ভরে উঠেছে। সে শিশির ভেজা ঘাসের উপর বসলো। দিনটা কেটে যায়, রাতটা তার কাটে না। আমির শয়নেস্বপনে রাজত্ব করে। পদ্মজা অসহায় চোখ দুটি মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে যদি তার স্বামীর মুখটা ভেসে উঠতো! কেমন আছে সে? পদ্মজার দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে। নীরবে কাঁদতে থাকে। কী ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে তাকে! দিনের আলোয় দেখা কঠিন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, রাগী পদ্মজা রাতের বেলায় এমন অসহায় হয়ে কাঁদে কেউ বিশ্বাস করবে? করবে না।
পদ্মজা হাঁটুতে মুখ গুঁজে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ সে কারো উপস্থিতি টের পেল। তার দিকে কেউ হেঁটে আসছে। গত দুই সপ্তাহে দুটো খুন হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে পাশের এলাকায়। এলাকাটি খুব কাছে। লাশের ছবি দেখে বুঝা গেছে,কেউ বা কারা দেশে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করছে৷ সেই সাথে লাশের শরীরের ক্ষতস্থান দেখে মনে হয়েছে,হত্যাকারী বা হত্যাকারীরা শয়তানের উপাসনা করে। পদ্মজার মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়। সে তার কোমরের খাঁজে থাকা খাপ থেকে ছুরি বের করলো। তারপর দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। দেখলো নুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে কালো বোরকা। নুড়িকে দেখে পদ্মজা অবাক হয়। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে অবাকের ছাপটা মুখ থেকে সরেও গেল। নুড়ি প্রায় সময় তাকে অনুসরণ করে। সে পদ্মজাকে একা ছাড়তে নারাজ। পদ্মজা ঘাসের উপর বসতে বসতে বললো, ‘ পিছু নিতে না করেছিলাম।’
নুড়ি কিছু বললো না। পদ্মজাও চুপ রইলো। নুড়ি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো। নুহাশ ও আলিয়া দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চেয়েও দূরে দাঁড়িয়ে আছে লতিফা। লতিফা নুড়িদের আটকানোর চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু বাঁদরদের সে আটকে রাখতে পারলো না। পারে তো তারা লতিফার হা-পা বেঁধে ফেলে। নুড়ি সাবধানে ডাকলো, ‘মা?’
পদ্মজা দূরে চোখ রেখে নির্বিকার কণ্ঠে বললো, ‘ বল।’
‘বাবার জন্য কাঁদছিলে?’
পদ্মজা নিরুত্তর। নুড়ি সময় নিয়ে দ্বিধাভরে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ দুষ্টু রাজাটা বাবা আর মিষ্টি রানীটা তুমি তাই না আম্মা?’
পদ্মজা চমকে তাকালো। অপলকভাবে তাকিয়েই রইলো। নুড়ি কী করে জানলো,তাদেরকে বলা গল্পটি তাদেরই মায়ের গল্প! নুড়িকে দেখলে মনে হয় না,সে যে পদ্মজা ও আমির হাওলাদারের নিজের মেয়ে নয়। নুড়ির চোখের দৃষ্টি ঈগলের মতো। যেমন চঞ্চল তেমন সাহস। সে ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আশেপাশে যা কিছুই ঘটুক সর্বপ্রথম তার চোখে ধরা পড়ে। পদ্মজা নুড়ির প্রশ্ন এড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলো। নুড়ি সংকোচ নিয়ে বললো, ‘ মা,তুমি সোয়েটার পরোনি। ঠান্ডা লাগবে।’
পদ্মজা খাপে ছুরি রেখে বললো, ‘ নুহাশ আর আলিয়াও এসেছে?’
নুড়ি মাথা ঝাঁকালো। পদ্মজা নুড়িকে নিয়ে নিচে নেমে আসে। নুহাশ ও আলিয়ার সামনে এসে তিনজনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘সাহসী সঠিক সময়ে হতে বলেছি। এই রাতের বেলা ঝুঁকি নিয়ে মায়ের পিছু নিতে নয়।’
লতিফা এগিয়ে এসে বললো, ‘ তোমারে লইয়া হেরা চিন্তাত আছিলো। খুনটুন যে হইলো গত সপ্তাত এর লাইগগা।’
পদ্মজা ভ্রু উঁচিয়ে বললো, ‘ তাহলে ওরা আমাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে এসেছে?’
নুড়ি,নুহাশ ও আলিয়া ভয়ে একজন আরেকজন চাওয়াচাওয়ি করলো। পদ্মজা হেসে তিনজনকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ আমার সাহসী বাচ্চারা! কিন্তু এতো রাতে আসা একদম ঠিক হয়নি। হ্যাঁ আমারও ঠিক হয়নি। আমরা কেউই আর ভুল করবো না। ঠিক আছে?’
তিনজন সমস্বরে বললো, ‘ঠিক আছে মা।’
পদ্মজা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাহাড় ছেড়ে সমতলে নামে। পথে আলিয়া বললো, ‘মা,একটা কথা বলবো।’
পদ্মজা আদুরে স্বরে বললো, ‘বলো বাবা।’
‘মজনু স্যার রূপকথা দিদিকে কিছু বলেছে মনে হয়।’
পদ্মজার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। মজনু তার স্কুলেরই একজন শিক্ষক। নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রীদের বাংলা পড়ায়। তার নামে অনেক অভিযোগ আছে। ছাত্রীদের হ্যারাস করে। শরীরে বিভিন্ন অজুহাতে হাত দেয়। বিয়ে করেছে দুটি। অনেক মেয়ে মজনুর জন্য স্কুলে আসা ছেড়ে দিয়েছে। তারা কিছু বলতেও পারে না,সইতেও পারে না। মাস ছয়েক আগে স্কুলের এক মেয়ে দাবি করেছে,সে গর্ভবতী। মজনু তাকে ভয় দেখিয়ে অনেকবার শারিরীক সম্পর্ক করেছে। মজনু অস্বীকার করে। উল্টো সমাজে মেয়েটির বদনাম হয়। তাকে আর স্কুলে দেখা যায়নি। পদ্মজা সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য মেয়েটিকে খুঁজেছে। কিন্তু পেল না। তার পরিবারকেও পেল না। মজনু পদ্মজার সাথে ঘেঁষার চেষ্টাও করেছে অনেকবার। চরিত্রহীন,লম্পট পুরুষ সে। পদ্মজা কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পাঠিয়েছিল,লাভ হয়নি। মজনু সিলেটের এমপি সুহিন আলমের শালা। এজন্যই পদ্মজার অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হয়নি। এমনকি সেই মেয়েটির পরিবার নাকি মামলা করেছিল,সেই মামলাও ধামাচাপা পড়ে যায় সুহিন আলমের ক্ষমতার কাছে। তাই মজনুর নাম উঠতেই পদ্মজা বিচলিত হয়ে উঠে। বললো, ‘কেন এমন মনে হলো?’
নুড়ি মাথা নিচু করে বললো, ‘রূপকথা দিদিকে ডেকেছিল মনে হয়। অনেকক্ষণ পর দিদি দ্বিতীয় ভবন থেকে বের হয়। তখন দিদি কাঁদছিল। দিদির চুল ঢোকার সময় খোঁপা ছিল বের হওয়ার সময় এলোমেলো ছিল।’
আলিয়া বললো, ‘আমি আর নুড়ি আপা রূপকথা দিদিকে টিফিন টাইমে জাম গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখেছি মা।’
পদ্মজা তাদের মেয়েদের আশ্বস্ত করলো। বললো,সব ঠিক হয়ে যাবে। সারা রাত পদ্মজা এ নিয়ে ভেবেছে। মজনুকে আর সহ্য করা যায় না। মেয়েগুলোর জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলোকে দূষিত করে ফেলছে! আবর্জনা বেশিদিন রাখা ঠিক হচ্ছে না। চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে! পরদিনই স্কুলে গিয়ে পদ্মজা রূপকথাকে ডেকে পাঠালো। রূপকথা হিন্দু ধর্মালম্বী। খুব সুন্দর মেয়ে। রূপকথার ধর্মের ভাষায় বলা যায়, সে দেবীর মতো সুন্দর! নবম শ্রেণিতে পড়ে। রূপকথা পদ্মজার সামনে এসে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ালো। পদ্মজা রূপকথাকে পরখ করে বললো, ‘তোমাকে ভীষণ হতাশাগ্রস্ত আর ভীতগ্রস্ত দেখাচ্ছে। আমাকে তোমার সমস্যা খুলে বলতে পারো।’
রূপকথা পদ্মজার কথায় অপ্রতিভ হয়ে উঠলো। পদ্মজা চেয়ার ছেড়ে রূপকথার পাশে এসে দাঁড়ায়। রূপকথার মাথায় হাত রেখে বললো, ‘ মনের মাঝে চেপে রেখো না। কষ্ট লুকিয়ে রাখতে নেই। হাতের মুঠোয় এনে চেপে ধরে ধ্বংস করে দিতে হয়।’
রূপকথা পদ্মজার সংস্পর্শে আজ প্রথম এসেছে। পদ্মজাকে প্রতিটি ছাত্রছাত্রী সম্মান করে,ভালোবাসে। তার ব্যবহার এবং সৌন্দর্য দুটোই সবাইকে অভিভূত করে ফেলে। অনেকে বলে পদ্মজার শরীরে তারা নাকি মা মা গন্ধ খুঁজে পায়। রূপকথাও পাচ্ছে। সে কেঁদে ফেললো। পদ্মজা রূপকথার মুখটা উঁচু করে ধরলো। বড়,বড় আঁখি তার। লাল টুকটুকে গাল,জোড়া ভ্রু। এমন সুন্দর মেয়ে কাঁদতে পারে! পদ্মজা বললো, ‘ মজনু স্যার কী বলেছে তোমাকে? আমাকে বলো। ‘
রূপকথা অনেক কষ্টে কান্না আটকে বললো, ‘ আমার মা-বাবা নেই। জ্যাঠা জ্যাঠামির কাছে থাকি। ঠাম্মার কথায় জ্যাঠা আমাকে পড়াচ্ছে৷ দিঘীপাড়ার সতেন্দ্র বাবু আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। জ্যাঠা বলেছে,পরীক্ষায় যদি ফেইল করি আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে।’
পদ্মজা জানতে চাইলো, ‘সতেন্দ্র বাবু মানে দিঘীপাড়ার মোড়ের মধু ব্যবসায়ী ?’
‘হু।’
‘উনি তো তোমার দাদার বয়সী। আর যেহেতু তোমার জ্যাঠা বলেছে, ফেইল করলে বিয়ে দিয়ে দিবে। তাহলে পাস করার চেষ্টা করো।’
রূপকথার কান্না বাড়লো। পদ্মজা বুঝতে পারলো,এখানে আরো ঘটনা আছে। সে কোমল কণ্ঠে বললো, ‘লক্ষী মেয়ে,সবটা বলো আমাকে।’
রূপকথা বললো, ‘ মজনু স্যার বলেছেন,উনার সাথে প্রেম না করলে আমাকে ফেইল করিয়ে দিবেন। উনার সাথে যেন প্রেম করি। আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি জানি না প্রেম কীভাবে করে। উনি যখন আমাকে ডাকেন,আমি যাই। আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। শরীরে হাত দেয়। আমার ভালো লাগে না৷ রাতে ঘুমাতে পারি না। ঠাম্মাকে বলছি,ঠাম্মা বলছে স্যার যা বলে শুনতে। তাহলে বেশি মার্ক পাবো। স্যার গত পরশু আমাকে বলছে,আমি আজ যেন স্যারের সাথে ঘুরতে যাই।’
রূপকথা কাঁপছে। হেঁচকি তুলে কাঁদছে। অনাথ মেয়েটা! মা-বাবার আদর ছাড়া বড় হয়েছে। আপন দাদি সমস্যা শুনে বলেছে,স্যার যা বলে শুনতে। এতে নাকি বেশি মার্ক পাবে! কেমন মানসিকতা! আজ ঘুরতে গিয়ে জানোয়ারটা মেয়েটার কতবড় ক্ষতি করে ফেলবে কে জানে! মজনু সেই অভাগী মেয়েটিকেও কি এভাবে ভয় দেখিয়ে কাছে টেনেছিল? পদ্মজা রূপকথাকে বুকের সাথে চেপে ধরে। পদ্মজার গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণে রূপকথা ডুবে যায়। মনে হচ্ছে,সে তার মাকে জড়িয়ে ধরেছে। তার কান্নার বেগ বাড়ে। পদ্মজা রূপকথার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘ এই ব্যাপারে আর কাউকে কিছু বলো না। আজ বাড়ি চলে যাও।’
স্কুল ছুটির পর পদ্মজা মজনুর পিছু নেয়। মজনু তার বাসায় না গিয়ে সিলেট বোরহান উদ্দিন মাজারের পাশের এলাকায় গেল। পদ্মজাও সেখানে গেল। মজনু বার বার হাতের ঘড়ি দেখছে। বুঝা যাচ্ছে, সে কারোর জন্য অপেক্ষা করছে। পদ্মজা একটা সাদা বিল্ডিংয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর তাদের স্কুলের জামা পরা একটা মেয়ে মজনুর সাথে দেখা করতে আসে। পদ্মজা ঘৃণায় কপাল কুঞ্চিত করলো। মজনু পড়ানোর জন্য নয় সুযোগ ব্যবহার করে মেয়েদের ভোগ করার জন্য শিক্ষক হয়েছে। শিক্ষক কখনো লম্পট হয় না,লম্পটরা শিক্ষকের মুখোশ পরে। পদ্মজা পর পর তিনদিন সাবধানে মজনুকে অনুসরণ করে নিশ্চিত হয়েছে,মজনু রাতে ঘুমাবার পূর্বে বাইরে টং দোকানে চা খেতে যায়। তারপর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাড়ি ফিরে। রাস্তার দুই পাশে ঝোপজঙ্গল।এটা মজনুর প্রিয় অভ্যাস হতে পারে। রূপকথা তিনদিন পদ্মজার কথায় স্কুলে আসেনি। চতুর্থ দিন শেষে রাত আটটায় পদ্মজা একখানা বড় লাগেজে একটি বড় ধানের বস্তা ও রাম দা নিল। খুলে নিল নিজের কানের দুল। শরীরে এমন কিছু রাখলো না,যা প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগতে পারে। কাঁধের ব্যাগে নিল বোরকা ও রুমাল । তারপর নতুন শাল দিয়ে মাথা ঢেকে বেরিয়ে পড়লো।
রাত ঠিক দশটা বাজে তখন। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। ঠান্ডা বাতাস বইছে। মাঝেমধ্যে শেয়ালের ডাকও শোনা যাচ্ছে। মজনু সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে গুনগুন করে গান গেয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে৷ হাঁটছে হেলেদুলে। আশেপাশে গাছপালা বেশি। রাস্তার দুই ধারের ঝোপজঙ্গল গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। দূরে ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। এদিকটায় মানুষজন তেমন আসে না।
পদ্মজা রাম দা নিয়ে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। তার লাগেজ ও কাঁধ ব্যাগটি কিছুটা দূরে রাখা। সে তীক্ষ্ণ চোখ দুটি মেলে অপেক্ষা করছে মজনুর জন্য। চোখ দুটি যেন জ্বলজ্বল করছে। তার নিঃশ্বাসেও যেন ছন্দ রয়েছে। শরীর ঠান্ডা করা ছন্দ! আর সেই ছন্দে আছে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের পূর্বাভাস! মজনুর দেখা মিলতেই পদ্মজা চাপাস্বরে ডাকলো, ‘ স্যার…স্যার।’
যেন অশরীরী ডাকছে। মজনুর একটু ভয় করলেও উৎসুক হয়ে ডানে তাকালো। জঙ্গল থেকে কে ডাকছে! মজনু উঁচু স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘কে?’
‘আমি স্যার…’
কণ্ঠস্বরটা চেনা মনে হচ্ছে। তবে কেমন যেন ভূতুড়ে এবং ভারী! মজনু হাতের সিগারেট ফেলে দুই পা এগিয়ে গেল। বললো, ‘আমিটা কে?’
‘আমি পদ্মজা।’
(সমাপ্ত)
ভয়ংকর সুন্দর
এমন উপন্যাস আগে কখনও পরি নাই,আনেক যায়গায় পড়া আটকে গেছে, মন ভারি হয়ে গেছে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ভেলেছি। কষ্ট নিজে অনুভব করেছি। মনে হয়ছে বই পড়ছি না, কোন কল্পনায় আমি ঘটনাটা দেখছি। ভিষণ ভালে লেগেছে।
-ইতি-
নাঈম