আমি পদ্মজা – ৮৫

৮৫

মঙ্গলবার দুপুর বারোটা। হাওলাদার বাড়িতে কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। আলগ ঘরের বারান্দায় মজিদ বসে আছেন। তার সামনে খলিল এবং রিদওয়ান। রিদওয়ান চারপাশ দেখে মজিদের দিকে ঝুঁকে বললো, ‘ কাকা,পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। তার আগে আমাদের কিছু করতে হবে।’

মজিদ পান চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘ কোন পরিস্থিতি?’

‘আমিরের হাব-ভাব ভালো না। ও কখন আমাদের উপর চড়া হয়ে যায় জানি না। আপনি আমি আব্বা সবাই জানি আমির কী কী করতে পারে! আমির আমাকে আর আব্বাকে কখনোই পছন্দ করেনি। আপনাকেও সেদিন মারলো। তাছাড়া আমাদের উপর আমিরের পুরনো একটা ক্ষোভ আছে।’

মজিদ পান চিবানো বন্ধ করে বললেন, ‘ বাবু আমাদের খুন করবে?’

রিদওয়ান সোজা হয়ে বসলো। লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, ‘ কাকা, আমির পদ্মজার জন্য পাগল। পদ্মজার জন্য অনেক কিছু করতে পারে। আমাদের খুন করে পদ্মজাকে নিয়ে ভালো থাকতে চাইতেই পারে।’

মজিদ হাসলেন। যেন রিদওয়ান কোনো কৌতুক বলেছে। রিদওয়ান অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। বললো, ‘কাকা,বিশ্বাস করুন আমি আমিরর চোখেমুখে কিছু একটা দেখেছি। ও কিছু একটা করতে যাচ্ছে। আর পদ্মজা তো আছেই। পদ্মজা এতো শান্ত-স্বাভাবিক,মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। এসব লক্ষণ কিন্তু ভালো না কাকা। আমির যেমন ভয়ংকর পদ্মজাও তেমন ভয়ংকর। যেকোনো মুহূর্তে আমাদের ক্ষতি করতে পারে।’

মজিদ হাওলাদার মেরুদণ্ড সোজা করে বসলেন। গুরুতর ভঙ্গিতে বললেন, ‘ পদ্মজাকে নিয়ে আমারও চিন্তা আছে। এই মেয়ের চোখের দিকে তাকানো যায় না।’

মজিদ হাওলাদারের কল্পনায় পদ্মজার চোখ দুটি ভেসে উঠে। সবসময় তিনি পদ্মজার চোখের ভেতর আগ্নেয়গিরি দেখতে পান। তিনি দ্রুত মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, ‘খলিল, পদ্মজার কিছু একটা করতে হবে। এই মেয়ে ক্ষতিকর। ধরে-বেঁধে রাখার মেয়ে না। ‘

খলিল বললেন, ‘এই ছেড়ি এতোকিছু দেইক্ষাও ডরায় নাই। আর কেমনে ডরাইবো?’

মজিদ থুথু ফেলে বললেন, ‘ পদ্মজাকে রাখাই যাবে না। এই দায়িত্ব রিদুর।’

রিদওয়ানের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠলো। পরপরই সেই আলো নিভে গেল। সে প্রশ্ন করলো, ‘ আর আমির? আমির পদ্মজার ক্ষতি মানবে না।’

মজিদ চিন্তায় পড়ে যান। কিছু বলতে পারলেন না। রিদওয়ান উত্তেজিত। সে চেয়ার ছেড়ে মজিদের পায়ের কাছে বসলো। বললো, ‘ কাকা, গত পরশু যা হলো,আমির জানতে পারলে আপনাকে, আমাকে আর আব্বাকে কাউকে ছাড়বে না। আমির গ্রামের সবাইকে ডেকে সবকিছু বলে দিতে পারে।’

মজিদ ধমকে উঠলেন, ‘ বাবু এটা কখনো করবে না। নিজের ক্ষতি করবে না।’

‘করবে কাকা,করবে। ওর মাথা ঠিক নাই। আমাদের ক্ষতি করতে ওর হাত কাঁপবে না। মাথাও কাজ করবে না। আর নিজের ক্ষতি তো এখনই করতেছে। পরেও করতে পারবে।’

মজিদ হাওলাদারের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে। রিদওয়ানের কথায় যুক্তি আছে। রিদওয়ান বললো, ‘ কাকা,আমির এখন আমাদের জন্যও হুমকি।’

মজিদ হাওলাদার রিদওয়ানের দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘আমির ছাড়া আমরা অচল রিদু। এখনের মানুষ সচেতন,বুদ্ধিমান,আইন শক্তিশালী এমন অবস্থায় আমির ছাড়া কী করে চলবে? আমিরের মাথা পরিষ্কার। একবার-দুইবার না বার বার পুলিশ সন্দেহ করেও সন্দেহ ধরে রাখতে পারেনি। আমির সামলিয়েছে।’

রিদওয়ান আশ্বাস দিল, ‘কাকা,আমরা সাবধান থাকব। আপনাদের পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা আছে আর আমার বিশ বছরের অভিজ্ঞতা। আমরা চাইলে সামলাতে পারবো।’

মজিদ হাওলাদার রিদওয়ানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। বললেন, ‘ বাবুর জায়গা নেয়ার জন্য এসব বলছিস?’

রিদওয়ানের চোখেমুখে হতাশার ছাপ পড়লো। সে চেয়ারে উঠে বসলো। বললো, ‘ আমার একার কোনো স্বার্থসিদ্ধি নাই কাকা। আব্বা আর আপনাকেও বাঁচাতে চাইছি। আমির আগের আমির নাই। আপনার বড় ভুল পদ্মজার সাথে আমিরের বিয়ে দেয়া।’

মজিদ হাওলাদার উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘ আমার ছেলের সাথে আমি কথা বলবো। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।’

মজিদ হাওলাদার চলে যান। তিনি চোখের আড়াল হতেই রিদওয়ান মজিদের চেয়ার লাথি দিয়ে ফেলে দিল। রাগে গজগজ করতে করতে বললো, ‘ শু*** বাচ্চা।’

খলিল রিদওয়ানের উরুতে এক হাত রেখে বললেন, ‘ মাথাডা ঠান্ডা করো আব্বা।’

রিদওয়ান চোখ বড়-বড় করে বললো, ‘ আর কতদিন ওদের বাপ-ব্যাঠার কামলা খাটব? আদেশ মানব? মার খাব? বলতে পারেন? আমার বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে,আপনি অকর্মার ঢেকি আব্বা। কাকা সবকিছু আমিরের নামে করে দিল আপনি টু শব্দও করেননি। ‘

খলিল হাওলাদার দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলেন। তিনি ছোট থেকেই মনে মনে মজিদের উপর ক্ষিপ্ত। গোপনে অনেক পরিকল্পনাই করেছেন কখনো তা বাস্তবে রূপ নেয়নি!

লতিফা পদ্মজার ঘরে প্রবেশ করে দেখলো,পদ্মজা নেই। সে হাতের বস্তা পালঙ্কের নিচে রাখলো। বস্তার ভেতর পদ্মজার চাওয়া কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। লতিফা ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হয়। তখন গোসলখানা থেকে পদ্মজা বের হলো। পদ্মজাকে দেখে লতিফার শরীর কেঁপে উঠে। পদ্মজার পরনে একদম সাদা শাড়ি! ভেজা চুল থেকে টুপটুপ করে জল পড়ছে। এই সন্ধ্যাবেলা সে গোসল করেছে! বাঁকানো কোমর,ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ,ঘন কালো লম্বা চুল,রক্তজবা ঠোঁট,মসৃণ ত্বক থাকা সত্ত্বেও তাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। পদ্মজা তো বিবাহিত সে কেন সাদা শাড়ি পরলো? লতিফার অনুভব হয়,তার পায়ের তলার মেঝে কেঁপে উঠেছে। পদ্মজা চুল মুছতে মুছতে বললো, ‘ যা আনতে বলছিলাম এনেছো?’

লতিফা নিরুত্তর। পদ্মজা লতিফার দিকে তাকালো। লতিফা হা করে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা ডাকলো, ‘লুতু বুবু?’

লতিফা এগিয়ে আসে। তার বিস্ময়কর চাহনি। পদ্মজা লতিফার বিস্ময়ের কারণ বুঝতে পেরেছে। লতিফা বললো, ‘ তুমি সাদা কাপড় পিনছো কেরে?’

পদ্মজা হেসে বললো, ‘বলা যাবে না।’

লতিফা বলার মতো কথা খুঁজে পেল না। পদ্মজা আলমারি থেকে ছাই রঙা ব্লাউজ বের করলো। বিছানার উপর বসে বললো, ‘ লুতু বুবু, ব্লাউজের এ পাশটা সেলাই করে দাও। তোমার হাতের সেলাই খুব সুন্দর হয়।’

লতিফার ধীর পায়ে পদ্মজা সামনে এসে দাঁড়ালো। পদ্মজার হাত থেকে ব্লাউজ নিয়ে বিছানায় বসলো। পদ্মজা একটা ছোট বাক্স থেকে সুই-সুতা বের করে লতিফাকে দিল। লতিফা রয়ে সয়ে বললো, ‘ শাড়িডা কি বুড়ির?’

পদ্মজা ছোট করে জবাব দিল ‘হু।’

লতিফা বললো, ‘ হ,কাপড়ডা দেইক্ষাই চিনছি।’

পদ্মজা বললো,’দাদুর অবস্থা খুব বাজে। শরীরে মাছি বসে,বাজে গন্ধ বের হয়। যন্ত্রণায় ছটফট করে।’

লতিফা হঠাৎ করেই হইহই করে উঠলো, ‘ আল্লাহর শাস্তি আল্লাহই দেয় বইন। বুড়ির সাথে উচিত অইতাছে। বুড়ি কানলে আমার যে কি শান্তি লাগে পদ্ম। মরুক বুড়ি,মরুক! ‘

পদ্মজা নরম স্বরে বললো, ‘ এভাবে বলো না বুবু। এভাবে বলতে নেই।’

লতিফা পদ্মজার চোখের দিকে তাকালো। হাতের ব্লাউজটা বিছানায় রেখে পদ্মজার এক হাত চেপে ধরে বললো, ‘ তুমি সাদা কাপড় কেরে পিনছো পদ্ম? আমারে কও।’

লতিফার চোখেমুখে জানার প্রবল আগ্রহ। পদ্মজা ধীরেসুস্থে বললো, ‘ আমি ধরে নিয়েছি আমার স্বামী মৃত।’

‘কিন্তু এইডা তো মিছা।’

পদ্মজা গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘এটা সত্য হবে বুবু।’

‘পদ্মজা…’

‘কিছু বলো না বুবু। এই সাদা রঙ আমার আত্মবিশ্বাস আর সাহসকে দ্বিগুণ করে দিয়েছে। সারাজীবন ভয়ে চুপ থেকেছো,অন্যায়কে-পাপকে সমর্থন করেছো। এবার অন্তত থেকো না। মরতে হবে তো তাই না? কবরে কী জবাব দিবে?’

লতিফা মাথা নিচু করলো। ক্ষণমুহূর্ত পর বললো, ‘ আমিতো কইছি তোমার সব কথা মাইননা চলাম। এখনো কইতাছি,সব মাইননা চলাম।’

‘এবার বলো,যা আনতে বলেছিলাম এনেছো?’

‘হ আনছি। পালঙ্কের নিচে রাখছি।’

পদ্মজা পালঙ্কের নিচে থেকে বস্তা বের করে মেঝেতে বসলো। লতিফা ব্লাউজ সেলাই করা শুরু করে। পদ্মজা বস্তার ভেতর থেকে দুটো রাম দা, একটা চাপাতি বের করলো। লতিফা বললো, ‘ পদ্ম, আমার অনেক ডর লাগতাছে। ‘

পদ্মজা রাম দায়ের আগা দেখতে দেখতে বললো, ‘ কী জন্য?’

‘তুমি যদি না পারো তুমারে ওরা মাইরা ফেলব।’ লতিফার কণ্ঠে ভয়।

পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে লতিফার দিকে তাকালো। তার চোখ-মুখের রঙ পাল্টে গেছে। পদ্মজা বললো, ‘ আজ অনুশীলন করব। দেখা যাক,আমার হাত কতোটা সাহসী।’

কথা শেষ করে পদ্মজা হাসলো। লতিফার অশান্তি হচ্ছে। সামনে কী হবে সে জানে না! কিন্তু যা ই হোক, খুব খারাপ হবে! পদ্মজা চাপাতি হাতে নিয়ে লতিফাকে ডাকলো, ‘ বুবু?’

‘কও পদ্ম।’

‘জসিম গতকাল থেকে তোমার পিছনে ঘুরঘুর করছে দেখলাম।’

লতিফার মনোযোগ সেলাইয়ে। সে সেলাই করতে করতে বললো, ‘জসিম আমারে খারাপ প্রস্তাব দিছে। ডর দেহাইছে,রাজি না হইলে জোর কইরা নাকি খারাপ কাম করব।’

‘ধর্ষণের হুমকি দিল?’

‘হ।’

‘জসিম,হাবু কতদিন ধরে কাজ করে এখানে?’

‘অনেক বছর। দশ-বারো বছর তো হইবই।’

পদ্মজা চাপাতি দিয়ে রামদায় মৃদু আঘাত করে বললো, ‘হাবু তো এখন নাই। তাহলে শুরুটা জসিমকে দিয়েই হউক!’

লতিফা চুপ রইলো। তার কাছে খুন স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক খুন সে নিজের চোখে দেখেছে। তাই খুনখারাপিতে তার ভয় নেই। কিন্তু এইবার ভয় হচ্ছে। খুব ভয় হচ্ছে। পদ্মজা সরাসরি কিছু বলেনি। তবে বুঝা যাচ্ছে সে কী করতে চলেছে। যদি পদ্মজা ধরা পড়ে যায়? তখন কী হবে! লতিফা ঢোক গিলল। সেলাইয়ে মন দেয়ার চেষ্টা করলো। পদ্মজা প্রশ্ন করলো, ‘মগা কি এসবের সাথে জড়িত?’

‘মগা অনেক ভালা পদ্ম। বাড়ির টুকটাক কাম করে। বেক্কলের মতো। আর খালি ঘুমায়। ওর ভিতরে প্যাচঁগোচ নাই।’

‘বাড়ির ভেতর কখনো মেয়ে নিয়ে আসা হয়নি?’

‘বাঁইচা আছে এমন আনে নাই। মরা আনছে।’

পদ্মজা চমকে তাকাল। প্রশ্ন করলো, ‘মৃত মেয়ে দিয়ে কী করে?’

লতিফা দরজার দিকে তাকালো। পদ্মজা দ্রুত উঠে যায় দরজা বন্ধ করতে। তারপর লতিফার সামনে এসে বসলো। লতিফা বললো, ‘ যে ছেড়ি বেশি সুন্দর থাকে, জানে মারার পরেও রিদওয়ান ভাইজানে তারে ছাড়ে না। মরা মানুষের শরীরের উপর টান খলিল কাকার আছিলো। রিদওয়ান ভাইজানেও এই স্বভাব পাইছে।’

পদ্মজার গা গুলিয়ে উঠে। বমি গলায় চলে আসে। সে এক হাতে মুখ চেপে ধরলো। ঘৃণায় তার চোখে জলে ছলছল করে উঠে। লতিফা বললো, ‘রিদু ভাইজানে কয়দিন আগেও বস্তাত ভইরা এক ছেড়িরে বাড়ির ছাদে আনছিলো। তিন তলা ঘরের দরজায় তালা আছিলো। তাই ছাদে গেছিল। পরে আমি চাবি লইয়া গেছি। বস্তা থাইকা রক্ত পড়ছিল। শীতের মাঝে কাঁইপা-কাঁইপা আমি রক্ত ধুইছি।’

পদ্মজা কোনোমতে বললো, ‘ তখন আমি এখানে ছিলাম?’

‘হ। পূর্ণা আর মৃদুল ভাইজানেও আছিলো।’

পদ্মজা এক হাত কপালে ঠেকিয়ে বললো, ‘আল্লাহ! তাও আমার চোখে পড়েনি!’

পদ্মজা সেকেন্ড দুয়েকের জন্য থামলো তারপর বললো, ‘ এমনকি আমি তিন তলার এক ঘর থেকে বোটকা গন্ধ পেয়েছিলাম তবুও ভাবিনি এই বাড়িতে এতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটে!’

লতিফার সেলাই শেষ। সে ব্লাউজটি পদ্মজার উরুর উপর রেখে বললো, ‘ লও তোমার বেলাউজ(ব্লাউজ)।’

পদ্মজা রাগে কিড়মিড় করে লতিফাকে বললো, ‘দেখো,রিদওয়ানের শরীর টুকরো,টুকরো করে কুকুরের সামনে ছুঁড়ে দেব আমি।’

লতিফা এতক্ষণে হাসলো। বললো, ‘ আল্লাহ তোমারে শক্তি দেউক।’

পদ্মজার ডান হাত কাঁপছে। সে তার ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছে না। এই মুহূর্তে সে যা শুনেছে, তারপর শান্ত থাকা সম্ভব নয়। লতিফা পদ্মজার মস্তিষ্ক অন্য প্রসঙ্গে নেয়ার জন্য বললো, ‘ পারিজারে কেলা মারছে জানো পদ্ম?’

পদ্মজা লতিফার দিকে তাকালো। পারিজার কথা মনে পড়লেই তার বুকের ব্যথা বেড়ে যায়। সে ম্লান হেসে বললো, ‘ না। কিন্তু আন্দাজ করতে পেরেছি।’

‘আমির ভাইজানে জানে।’

‘সেটাও এখন বুঝতে পারছি। শুনেছি,তার আড়ালে একটা পাখিও উড়ে যেতে পারে না। সেখানে আমার মেয়ের খুনিকে সে চিনবে না? অবশ্যই চিনবে। কিন্তু কিছু করেনি কারণ এতে তার লোক কমে যাবে। ব্যবসার ক্ষতি হবে।’

‘কিছু যে করে নাই এইডাও ঠিক না। এক মাস পরে আমির ভাইজানে জানছে,রিদু ভাইজানে হাবলু মিয়ারে দিয়া পারিজারে খুন করাইছে। সব জাইননা হাবলু মিয়ারে আমির ভাইজানে কুড়াল দিয়া কুপাইছে। রিদু ভাইজানরে আমির ভাইজানে খুন করতে চাইছিলো কিন্তু বড় কাকার লাইগগা পারে নাই। তয় মাসখানেক হাসপাতালে আছিলো। বছরখানেক রিদু ভাইজানে আমির ভাইজানের সামনে যায় নাই।’

পদ্মজা দুই হাতে চাদর খামচে ধরলো। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। সে কান্নামাখা স্বরে বললো, ‘ কী নিষ্ঠুর ওরা! আমার ছোট বাচ্চা!’

লতিফার পদ্মজার জন্য খুব মায়া হয়। মেয়েটা বড় বড় আঘাত সহ্য করেছে,করে যাচ্ছে! পদ্মজা বললো, ‘ আমির হাওলাদার তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিত বলে সে আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে তাই না?’

লতিফা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। পদ্মজা কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললো, ‘প্রতিশোধ নিয়েছে সে! আমিও নেব। করুণ মৃত্যু হবে তার। এতো বড় সাহস কী করে পেলো সে? আমির হাওলাদারের মেয়েকে খুন করার সাহস রিদওয়ানের থাকার কথা না। তার পিছনে মজিদ হাওলাদার আর তার ভাই ছিল। তাদের সমর্থন ছিল। সে জানতো,তাকে বাঁচানোর জন্য ঢাল হবে তারা।’

লতিফা বিচলিত হয়ে বললো, ‘ কাইন্দো না পদ্ম। আর কাইন্দো না।’

পদ্মজা দুই হাতে চোখের জল মুছে বললো, ‘ কাঁদব না আমি। আমার ছোট মেয়ে জান্নাতে তার নানুর সাথে আছে। সে সুখে আছে। এই জগতে তার না থাকাটাই ভালো হয়েছে বুবু।’

পদ্মজাকে যত দেখে তত অবাক হয় লতিফা। এই নারী কীসের তৈরি? এতো যন্ত্রণা, এতো দুঃখ নিয়েও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামবাসীর ছিঃ চিৎকার তাকে দূর্বল করতে পারেনি। যতবার ভেঙে যায় ততবার চোখের জল মুছে নতুন উদ্যমে বেঁচে উঠে। লতিফা দ্বিধাভরা কণ্ঠে বললো, ‘আমি তোমারে একবার জড়ায়া ধরি পদ্ম?’

লতিফা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এশার নামায আদায় করে

পদ্মজা ঘর থেকে বের হলো। দরজার পাশে জসিম নেই। একটু আগেই সে জসিমের কাশি শুনেছে। কোথায় গেল? অন্দরমহল অন্ধকারে ছেয়ে আছে। সন্ধ্যার পরপর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ব্যাপারটা বিরক্তিকর। বাড়িতে সাড়াশব্দও নেই। কখনোই থাকে না। সন্ধ্যা হলেই আলো ঘুমিয়ে পড়ে। রিনু তার ঘরে শুয়ে থাকে। লতিফা রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করে,সবার আদেশ শুনে। আর এখন সবার খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার সময়। আর এই মুহূর্তেই জসিম উধাও! পদ্মজার স্নায়ু সাবধান হয়ে উঠলো।

লতিফা রান্নাঘরে থালাবাসন ধুচ্ছে। থালাবাসন ধোয়া শেষে পানি গরম করার জন্য চুলায় আগুন ধরালো। রান্নাঘরে আর আলো নেই। জসিম লতিফার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। লতিফা জসিমের উপস্থিতি টের পেয়ে কপাল কুঞ্চিত করলো। পিছনে ফিরে বললো, ‘ আপনে আমার পিছনে ঘুরতাছেন কেরে?’

‘তোরে আমার পছন্দ অইছে। আমার লগে আয়।’

‘আমি যাইতাম না।’

‘আরে আয়,আয়।’

জসিম হাসলো। তার বিদঘুটে হাসি। সে অনেক চিকন হলেও তালগাছের মতো লম্বা। লতিফার মাথা উঁচু করে তাকাতে হয়। লতিফা জসিমের আক্রমণের জন্য মনে মনে প্রস্তুত ছিল। সে সজোরে প্রবল কণ্ঠে বললো, ‘ এন থাইকা বাইর হইয়া যা কুত্তার বাচ্চা! নাইলে তোরে আমি দা দিয়া কুপাইয়াম।’

জসিম লতিফার ব্লাউজ টেনে ধরে। লতিফা চিৎকার করে দা হাতে নিতে নেয় জসিম লাথি দিয়ে দা সরিয়ে দেয়। লতিফা জসিমকে তার কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করে। দুজনের মাঝে ধ্বস্তাধস্তি শুরু হয়। জসিম গায়ের জোরে লতিফার স্পর্শকাতর স্থানে ছুঁতেই লতিফা চিৎকার করে মজিদ আর আমিনাকে ডাকলো। জসিম টেনেহিঁচড়ে লতিফার শাড়ি খুলে ফেললো। লতিফার গায়ে হাত দেয়ার অনুমতি সে খলিলের কাছে পেয়েছে। যদিও খলিল বলেছিল,বাড়িতে কিছু না করতে। কিন্তু জসিম সে কথা শুনেনি। ফলে,তার পরিণতি ভয়ংকর হয়। সাদা শাড়ির আবরণে আচ্ছাদিত পদ্মজা রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে রাম দা। লতিফা পদ্মজাকে দেখে জসিমকে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। পদ্মজা শক্ত করে রাম দা ধরলো। তারপর ‘জারজের বাচ্চা, মর’ বলে পিছন থেকে জসিমের গলায় কোপ বসাল। জসিমের গলা অর্ধেক কেটে যায়। রক্ত ছিটকে পড়ে পদ্মজার গায়ে। লতিফার নাকমুখ রক্তে ভেসে যায়। কিছু রক্ত ছিটকে আগুনে পড়ে। রক্তে রান্নাঘরের থালাবাসন,পাতিল রাঙা হয়ে উঠে। দেহটি সজোরে শব্দ তুলে মেঝেতে পড়ে গেল। লতিফার মুখ দিয়ে রক্ত প্রবেশ করায় সে বমি করতে থাকে। পদ্মজার বুক হাঁপড়ের মতো উঠানামা করছে। সে চোখ বুজে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে স্থির হলো। তারপর লতিফার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো, ‘ এটা কিন্তু আমার দ্বিতীয় শিকার ছিল।’

৮৬

পদ্মজা রাম দা হাতে নিয়ে অন্দরমহল থেকে বের হলো। রাম দা থেকে চুইয়ে-চুইয়ে রক্ত পড়ছে। তার গায়ের সাদা শাড়িতে ছোপ-ছোপ রক্তের দাগ। লতিফা আড়চোখে পদ্মজাকে দেখছে। পদ্মজার শান্ত থাকা দেখে লতিফা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! পদ্মজার হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে মানুষ খুন করাটাই তার কাজ! লতিফা নিজের কপালের ঘাম মুছে মিনমিনিয়ে বললো, ‘ জসিমের লাশটা কিতা করাম?’

পদ্মজা কলপাড়ে পা রেখে শান্ত স্বরে বললো, ‘ এতো বড় দেহ দুজন মিলে কিছুই করতে পারবো না। রিদওয়ান কুকুরটা ঘরে আছে না?’

লতিফার খুব ঘাম হচ্ছে। সে বিড়বিড় করে বললো, ‘ তোমারে দেইখা আমার ডর লাগতাছে পদ্ম।’

লতিফার কথা পদ্মজার কানে আসতেই পদ্মজা হাসলো। বললো, ‘ তুমি কখনো খুন করোনি?’

পদ্মজা শীতল চোখে তাকায়। লতিফা মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘না,করি নাই।’

‘শুধু দেখেছো?’

‘হ।’

‘রিদওয়ানকে গিয়ে বলো,পদ্মজা জসিমরে খুন করছে।’

কলপাড়ের এক পাশে সাদা রঙের বালতি ভর্তি পানি রয়েছে। পদ্মজা বালতির পাশে বসলো। পদ্মজার কথা শুনে লতিফার বুক ছ্যাঁত করে উঠে। সে দুই কদম এগিয়ে এসে চাপাস্বরে বললো, ‘ এইতা কিতা কও পদ্ম! রিদু ভাইজানে জানলে…’

লতিফাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে পদ্মজা বললো, ‘কিছুই হবে না। বরং লাশটা সরিয়ে ফেলতে সাহায্য করবে।’

পদ্মজা রাম দা বালতির ভেতর রাখলো। সঙ্গে-সঙ্গে সাদা পানি লাল হয়ে উঠে। লতিফা কথা বলছে না,চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্বিধাগ্রস্ত। পদ্মজা লতিফার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ যা বলেছি করো বুবু।’

লতিফা জবাবে কিছু বললো না। সে উল্টোদিকে ঘুরে অন্দরমহলে চলে গেল। চারিদিকে অন্ধকার। তবে আকাশে চাঁদ আছে। জোনাকি পোকারা অনর্থক গল্প করে যাচ্ছে। তাদেরও কী পদ্মজার মতো শীত অনুভব হয় না? শিশির পড়ছে। মৃদু বাতাসও রয়েছে। তীব্র ঠান্ডায় মাটিও যেন কাঁপছে। শুধু কাঁপছে না পদ্মজা। শীতের দানব তার শরীর ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারছে না। পদ্মজার বুকের ভেতর একটা উষ্ণ অনুভূতি ছুটে বেড়াচ্ছে। সেই উষ্ণ অনুভূতি শীতের দানবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।

রাম দা-এ লেগে থাকা জানোয়ারের রক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয় পদ্মজা। তারপর অন্দরমহলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। অন্দরমহলের সদর দরজার দিকে ফিরে তাকাতেই রিদওয়ানের দেখা মিলল। রিদওয়ান তার দিকে ছুটে আসছে। চোখেমুখে ক্রোধ স্পষ্ট।

পদ্মজা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে রিদওয়ানকে স্বাগত জানালো। রিদওয়ান নিঃশ্বাসের গতিতে এক হাতে পদ্মজার গলা চেপে ধরে বললো, ‘বেশ্যা মা* মরার ইচ্ছে জাগছে তোর?’

পদ্মজা রিদওয়ানকে বাঁধা দিল না। সে ঠোঁটে হাসি ধরে রাখলো। রিদওয়ান পদ্মজার হাসি দেখে ভড়কে যায়। পরক্ষণেই রেগে গিয়ে আরো জোরে চেপে ধরে পদ্মজার গলা। কিড়মিড় করে বললো, ‘ জন্মের মতো হাসি বন্ধ করে দেব!’

পদ্মজার চোখ উল্টে আসতেই রিদওয়ান পদ্মজার গলা ছেড়ে দিল। পদ্মজা দুই-তিনবার কাশলো। তারপর রিদওয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শব্দ করে হেসে দিল! রিদওয়ানের শরীর রাগে কাঁপছে। সে পদ্মজার ব্যবহারে হতভম্ব! পদ্মজার চোখেমুখে ভয়ের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই! রিদওয়ান দ্রুতগতিতে অন্দরমহলে ভেতর চলে গেল। লতিফা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। রিদওয়ান চলে যেতেই লতিফা দৌড়ে আসে পদ্মজার কাছে। লতিফাকে দেখে পদ্মজা কোনো কারণ ছাড়াই বললো, ‘ শিকার তাকে বলে যাকে আমরা হত্যা করার উদ্দেশ্যে আঘাত করি।’

লতিফা শুধু ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো।

খলিল টয়লেটে যাচ্ছিলেন,রিদওয়ানকে অস্থির হয়ে মজিদ হাওলাদারের ঘরের দিকে যেতে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। রিদওয়ান মজিদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় জোরে শব্দ করলো।

সে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। অস্থির হয়ে আছে। মজিদ হাওলাদার সবেমাত্র শুয়েছেন। দরজায় এতো জোরে শব্দ হওয়াতে খুব বিরক্ত হলেন। তিনি চোখে চশমা পরে দরজা খুললেন। ততক্ষনে খলিল হাওলাদারও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি রিদওয়ানকে ডাকলেন, ‘ রিদু আব্বা?’

রিদওয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে খলিলকে একবার দেখলো। দরজা খোলার শব্দ হতেই সে সামনে তাকায়। মজিদ কিছু বলার পূর্বে রিদওয়ান দুই হাত ঝাঁকিয়ে মজিদকে বললো, ‘আমার কথা তো কোনোদিন শুনেন না।পদ্মজা কী করছে খবর রাখছেন?’

খলিল দুই তলায় উঠার সিঁড়িতে তাকিয়ে বললেন, ‘ এই ছেড়ি আবার কোন কাম করলো?’

মজিদ উৎসুক হয়ে রিদওয়ানের দিকে তাকালেন। রিদওয়ান এক হাত দিয়ে অন্যে হাতের তালুতে থাপ্পড় দিয়ে বললো, ‘ খুন করছে…খুন। জসিমের গলা কেটে রান্নাঘরে ফেলে রাখছে।’

মজিদ ও খলিল চমকালেন! রিদওয়ান গলায় জোর বাড়িয়ে বললো, ‘ খুন করেও একদম স্বাভাবিক আছে। মনে ভয়ডর নাই। রাম দা হাতে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কতোটা ভয়ংকর হয়ে গেছে বুঝতে পারছেন কাকা? আপনার অনুমতি নাই বলে ওই মা** আমার সহ্য করতে হলো। নয়তো ওরে আমি কলপাড়েই গেঁথে আসতাম।’

মজিদ হাওলাদার কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। আচমকা এমন একটা খবর পেয়ে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। রিদওয়ান গলার জোর আরো বাড়ালো, ‘পদ্মজার হাতে অস্ত্র উঠে গেছে কাকা! অস্ত্র! ওদিকে আমিরের খবর নাই। পাতালঘরের দরজায় নতুন তালা দিয়ে চাবি নিয়ে ভেতরে বসে আছে। খাবারও কেউ নিয়ে যায় না,নিতেও আসে না। ভেতরে ও কী করতেছে তাও জানি না। ও নিজে মরবে আমাদেরও মারবে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমির-পদ্মজা দুজনই আমাদের জন্য হুমকি কাকা। বুঝতেছেন না কেন? আজকের ঘটনার পরও কি বুঝবেন না? সময় থাকতে আপনি দুজনের কবর খোঁড়ার অনুমতি দেন।’

বৃহস্পতিবার, দুপুর ১:৪০ মিনিট। পূর্ণা দুপুরের নামায আদায় করে লাহাড়ি ঘরের চেয়ে কিছুটা দূরে অবস্থিত গোলাপ গাছটির পাশে বসে রয়েছে। গোলাপ গাছটি তার ভীষণ প্রিয়। এই গাছটি তার মন খারাপের সঙ্গী,একাকীত্বের সঙ্গী! প্রেমা পূর্ণার পিছনে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু পূর্ণা টের পেল না। সে অন্যমনস্ক। তার ঠোঁটে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। প্রেমা পূর্ণার কাঁধে হাত রাখে। পূর্ণা চমকে উঠে। প্রেমাকে দেখে বুকে তিনবার থুথু দিল। তারপর বললো, ‘ ভয় দেখালি কেন?’

‘কখন ভয় দেখালাম?’

‘কখন ভয় দেখালাম হা?’

প্রেমা ভ্রুকুঞ্চন করলো। পূর্ণা বললো, ‘ কী দরকার বল?’

পূর্ণার ব্যবহার দেখে বিরক্তি ধরে গেছে প্রেমার। সে তীব্র বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘বড় আম্মা খেতে ডাকছে।’

‘যা,আমি আসছি।’

‘আমার সাথে আসো।’

পূর্ণা রাগ নিয়ে বললো, ‘যেতে বলছি,যা তো।’

‘তুমি কী ভাবছিলে? মুচকি-মুচকি হাসছিলে কেন?’

‘তোকে বলতে হবে?’

প্রেমা দৃঢ়কণ্ঠে বললো, ‘হ্যাঁ,বলতে হবে।’

পূর্ণা মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো, ‘তর্ক করবি না। থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব।’

‘সবসময় ঝগড়া করো কেন?’

‘আমি করি? নাকি তুই বেয়াদবি করে আমাকে রাগাস!’

প্রেমা গাল ফুলিয়ে চলে যেতে নিল,তখনই পূর্ণা চট করে প্রেমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। প্রেমা পূর্ণাকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে বললো, ‘ছাড়ো। লাগবে না আমার আদর।’

পূর্ণা প্রেমাকে শক্ত করে ধরে রাখে। প্রেমার কাঁধে থুতুনি রেখে আহ্লাদী স্বরে বললো, ‘ কালতো সারাজীবনের জন্য চলেই যাব। রাগ করে না লক্ষী বোন।’

পূর্ণার কথা শুনে প্রেমা চুপ হয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পূর্ণার দিকে তাকালো। অবাক হয়ে প্রশ্ন বললো, ‘কোথায় যাবা?’

পূর্ণা ঠোঁট কামড়ে হাসলো। প্রেমা জোর করে পূর্ণার থেকে ছুটে যায়। একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। পূর্ণা সারাজীবনের জন্য চলে যাবে শুনে প্রেমা বিচলিত হয়ে পড়েছে। সে প্রশ্ন করলো, ‘বলো, কোথায় যাবা?’

পূর্ণা হাত দিয়ে ঢেউয়ের মতো করে বললো, ‘অনেক দূরে!’

‘জায়গার নাম নেই?’

পূর্ণা হাসলো। তার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। প্রেমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙার পথে! পূর্ণা বললো, ‘বিকেলে জানতে পারবি।’

‘এখন বললে কী সমস্যা? ‘

পূর্ণা হঠাৎ চোখমুখ কঠিন করে বললো, ‘বেশি কথা বলিস! আম্মা ডাকতেছে না খেতে? চল।’

‘কিন্তু…’

পূর্ণা প্রেমাকে ধাক্কা দিয়ে তাড়া দিল, ‘চল,চল।’

বারান্দায় পা রাখার পূর্বে পূর্ণা ঘাড় ঘুরিয়ে গেইটের দিকে তাকালো। তার ভেতরে-বাহিরে বসন্তের কোকিল কুহু কুহু করে ডাকছে। মনের বাগানে ফুটেছে শত রঙের ফুল। সেই ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণে তলিয়ে যাচ্ছে সে। হারিয়ে যাচ্ছে বারংবার ফেলে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত মধুর ক্ষণে। সেদিন পূর্ণা হাওলাদার বাড়ি থেকে ফিরেই মোড়ল বাড়ির উঠানে বসে পড়ে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দেয় মুহূর্তের পর মুহূর্ত! বাসন্তী অনেক বুঝিয়েছেন, যেন পূর্ণা ঘরে যায়। চারিদিক ছিল কুয়াশায় ঢাকা। কুয়াশার জন্য কয়েক হাত দূরের বস্তুও চোখে পড়ছিল না। এমতাবস্থায় পূর্ণা উঠানে, শিশিরভেজা মাটিতে বসেছিল। প্রেমা-প্রান্ত কেউ বুঝাতে পারেনি। বাসন্তী কেঁদে বলেছেন, ‘ আমি তোর আপন মা না এজন্যে আমার কথা শুনস না?’

তাতেও পূর্ণার ভাবান্তর হলো না। সে যে বসে আছে তো আছেই। পাথর হয়ে গেছে। না শীত,না বাসন্তীর কান্না কিছুই ছুঁতে পারেনি। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। মা সমতূল্য বড় বোনের সাথে মনমালিন্য, ভালোবাসার পুরুষের সাথে বিচ্ছেদ কী করে সহ্য করবে? কী করে?…বুকের ভেতরটায় আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। সে কী করে তা বাসন্তীকে দেখাবে? সন্ধ্যার আযান পড়ার পরও যখন পূর্ণা ঘরে গেল না তখন বাসন্তী ও প্রেমা উঠানে পাটি এনে বিছালো। তারপর পূর্ণাকে প্রেমা বললো, ‘মাটিতে বসে থেকো না। পাটিতে বসো। কেন এমন করছো? বড় আপার সাথে কত খারাপ হলো! তার উপর তুমি এমন করছো!’

পূর্ণা আগের অবস্থানেই রইলো। ‘বড় আপার সাথে কত খারাপ হলো’ কথাটি শুনে তার দুই গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। বাসন্তী এবং প্রান্ত পূর্ণাকে টেনে পাটিতে নিতে চাইলে পূর্ণা চিৎকার করে কেঁদে বললো, ‘কী সমস্যা তোমাদের? আল্লাহর দোহাই লাগে,একটু শান্তিতে থাকতে দাও। নয়তো আমি কিছু একটা করে ফেলবো। আমি আত্মহত্যা করবো। আমার আর সহ্য হচ্ছে না!’

পূর্ণার রুদ্রমূর্তির সামনে বেশিক্ষণ টিকে থাকার সাহস কারো হলো না। পূর্ণা যে ধাঁচের মেয়ে সে নিজের ক্ষতি করতে দুইবার ভাববে না। বাসন্তী ঘরে এসে চাপাস্বরে কাঁদতে থাকলেন। তিনি আত্মগ্লানিতে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছেন। না পেরেছেন পদ্মজাকে অপবাদ থেকে বাঁচাতে,আর না পারছেন পূর্ণার কষ্ট কমাতে! সব ঘটনার জন্য তিনি নিজেকে দোষারোপ করছেন। বার বার মনে হচ্ছে, হেমলতা থাকলে এসব কিছুই হতো না। বাসন্তী মা হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে করছেন! প্রেমা বাসন্তীকে কাঁদতে দেখেও দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। তার নিজেরও বুক ভারী হয়ে আছে। গ্রামবাসী ছিঃ চিৎকার করছে। বাড়ি বয়ে এসে যা তা বলে যাচ্ছে। বড় বোন পদ্মজার সাথে মৃত মা হেমলতাকেও তারা ছাড়ছে না। সাথে মৃদুল-পূর্ণার নাম তো আছেই। কিশোরী এই ছোট মনে আর কতক্ষণ সহ্য ক্ষমতা ধরে রাখা যায়! প্রেমার চোখ দুটি ছলছল করে উঠে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ার আগে দ্রুত মুছে ফেললো সে।

চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেছে। পূর্ণা উঠান ছেড়ে তার প্রিয় গোলাপ গাছটির পাশে এসে বসলো। গাছের পাতা আলতো করে ছুঁয়ে দিতেই দুই ফোঁটা শিশির ঝরে পড়ে মাটিতে। প্রেমা পূর্ণার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বারান্দার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসন্তী বারান্দার মুখে মোড়া নিয়ে বসে আছেন। পূর্ণাকে বাইরে রেখে তিনি ঘরে থাকতে পারবেন না! নিজের অজান্তে একসময় চোখ লেগে যায়। প্রান্ত টয়লেটে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। লাহাড়ি ঘরের চারপাশ অন্ধকারে তলিয়ে আছে দেখে সে এগিয়ে আসে। অন্ধকারের জন্য পূর্ণাকে তার চোখেই পড়ছে না। তাই সে রান্নাঘর গিয়ে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে আসে। তারপর পূর্ণার পাশে এসে বললো, ‘ আপা, ঘরে চলো।’

পূর্ণা রুক্ষ চোখে তাকায়। কাঠ-কাঠ কণ্ঠে বললো, ‘,যা এখান থেকে।’

তাও প্রান্ত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর পূর্ণার চেয়ে কিছুটা দূরে থাকা মুরগির খুপির উপর হারিকেন রেখে সে চলে যায়।

রাত গভীর থেকে গভীরত হয়। পূর্ণা গোলাপ গাছটি ছেড়ে লাহাড়ি ঘরের বারান্দায় যায়। সেখান থেকে আবার গোলাপ গাছের সামনে আসে। রাত বাড়ার সাথে কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আক্ষেপের ভারে শরীর ভার হয়ে আসছে! লাল বেনারসি পরার স্বপ্ন কী স্বপ্নই রয়ে যাবে? পায়ে আলতা দেয়া হবে না? হবে না একটা সংসার? যে সংসারে মৃদুল হবে কর্তা সে হবে কর্তী! মৃদুল কেন তাকে বুঝলো না? মৃদুল কি তাকে ভালোবাসেনি? কখনো মুখফুটে কেন বলেনি ভালোবাসার কথা? অসহ্য যন্ত্রণায় তার ইচ্ছে হচ্ছে নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলতে!

গা ছমছমে পরিবেশ। নিস্তব্ধতায় ঘিরে আছে চারপাশ। বৃষ্টির ফোঁটার মতো শিশির পড়ছে। লাহাড়ি ঘরের টিনের ছাদে টুপটুপ শব্দ হচ্ছে! পূর্ণার শরীর মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। মৃদু কাঁপছেও। তবুও তার ইচ্ছে হচ্ছে না,ঘরে যেতে। হঠাৎ এক জোড়া পায়ের শব্দ কানে এসে ধাক্কা দেয়। পূর্ণা থমকে যায়। সে টের পায় কেউ একজন তার চেয়ে কয়েক হাত দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। পূর্ণা চট করে উঠে দাঁড়ালো। ঘাড় ঘুরিয়ে আগন্তুককে দেখে তার চোখেমুখে কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। সে অন্যদিকে ফিরে তাকালো। তারপর আবার আগন্তুকের দিকে তাকালো। না সে সত্যি দেখছে! মৃদুল এসেছে! এই কুয়াশাজড়ানো রাত, টুপটুপ শিশির আর হারিকেনের হলুদ আলো স্বাক্ষী বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত মৃদুল ঘায়েল করা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে ছিল পূর্ণার দিকে! সেই চাহনির তীরবিদ্ধে পূর্ণার বুকের স্পন্দন থেমে গিয়েছিল। থেমে গিয়েছিল শ্বাস-প্রশ্বাস! চোখের পলক পড়েনি দীর্ঘক্ষণ!

মৃদুল যখন অস্পষ্ট স্বরে ডাকলো, ‘পূর্ণা।’

তখন পূর্ণার সম্বিৎ ফিরলো। সে আবিষ্কার করলো, মৃদুলের উপস্থিতি, মৃদুলের চাহনি তার মনের রাগ-ক্ষোভ পানি করে দিয়েছে! এ কেমন শক্তি! তবে মৃদুলের কণ্ঠ শুনে অভিমানের পাহাড়টা যেন মজবুত হয়ে দাঁড়িয়েছে! অভিমানের ভারে পূর্ণা বাজখাঁই কণ্ঠে বললো, ‘ কী চাই?’

মৃদুল মাথা নত করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে কোনো জবাব দিতে পারলো না। পূর্ণা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যখন উত্তর পেল না। তখন মৃদুলের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায়,মৃদুল পথ আটকে দাঁড়ায়। তার মাথা নত।

পূর্ণা বললো, ‘ কী চান আপনি? এতো রাতে আমার বাড়িতে এসেছেন কেন? আপনার তো এতক্ষণে নিজের বাড়িতে থাকার কথা ছিল!’

মৃদুল কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না, গলা আটকে আসছে। সে পূর্ণার চোখের দিকে তাকালো। তার চোখেমুখে অসহায়ত্ব স্পষ্ট! পূর্ণার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। ফর্সা মানুষের এই এক সমস্যা, তারা কাঁদলে চোখমুখ লাল হয়ে যায়। তখন দেখে খুব মায়া হয়। পূর্ণা গলার স্বর নরম হয়, ‘ কী বলবেন বলুন। বলে বিদায় হোন।’

কত নির্দয়ভাবে পূর্ণা বিদায় হতে বললো! মৃদুলের মনে হলো,এমন নিষ্ঠুর কথা সে আগে কখনো শুনেনি! সঙ্গে -সঙ্গে মৃদুলের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। সে তার ভুলের ক্ষমা কী করে চাইবে বুঝতে পারছে না। সারাদিন সে অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছে! হারে হারে টের পেয়েছে পূর্ণাকে শুধু মন নয়,তার সুখের চাবিও দিয়ে বসে আছে! কখন, কী করে তার এতোবড় ক্ষতি হয়ে গেল সে বুঝতেও পারেনি! ভেবেছিল,পূর্ণাকে এই মুখ আর দেখাবে না। কিন্তু রাতের আঁধার পাহাড়সম যন্ত্রণার সূচ নিয়ে যখন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে আর স্থির থাকতে পারলো না। উল্কার গতিতে হাওলাদার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে গিয়ে দারোয়ানের কাছে জানতে পারলো, পূর্ণা নিজের বাড়ি চলে গিয়েছে। মৃদুল আর দেরি করেনি। কুয়াশার স্তর ভেদ করে ছুটে আসে প্রিয়তমার বাড়ি! কিন্তু এই মুহূর্তে মনের মণিকোঠায় জড়িয়ে রাখা প্রিয়তমাকে দেখে তার কথা হারিয়ে গেছে,হারিয়ে গেছে সত্ত্বা। নিজ সত্ত্বা হারিয়ে কাউকে ভালোবাসতে নেই! এ ক্ষতি কখনো পূরণ হয় না। কিন্তু প্রেমিক মন কি আর এতকিছু বুঝে! মৃদুলের চোখে পানি দেখে পূর্ণার গলা জড়িয়ে আসে। সে গোপনে ঢোক গিললো। মৃদুল তার কান্না আটকিয়ে বললো, ‘ আমি তোমারে ছাড়া থাকতে পারবো না পূর্ণা।’

পূর্ণা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে। তখন মৃদুল তাকে অবজ্ঞা করে চলে গিয়েছিল,এখন সেও এর প্রতিশোধ নিবে! পূর্ণা বললো, ‘ কিন্তু আমি আপনাকে চাই না। আমার সাথে যাকে মানায় না আমি তার ধারেকাছেও থাকতে চাই না।’

পূর্ণার উচ্চারিত একেকটা শব্দ মৃদুলের বুক ছিঁড়ে ফুটো করে দেয়। সে পূর্ণার দিকে এক পা বাড়িয়ে বললো, ‘আমি তহন বুঝি নাই। আমি…আমি আমার রাগ সামলাইতে পারি নাই।’

মৃদুলের কথার ধরণ এলোমেলো! সে ভীষণ অস্থির। সে যেন নিজের মধ্যে নেই! পূর্ণা এত সহজে নরম হওয়ার পাত্রী নয়। সে তার তেজ উর্ধ্বে রেখে বললো, ‘কৈফিয়ত দেয়ার জন্য কষ্ট করে কালো মেয়ের কাছে আসতে গেলেন কেন? রাতের কালো আঁধারে কালো মেয়েটাকে কি দেখা যাচ্ছে?’

মৃদুল কী বলবে,কী করবে বুঝতে পারছে না। আচমকা সে পূর্ণার কোমর জড়িয়ে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। হঠাৎ যেন পাহাড়ের শক্ত মাটির দেয়াল ভেঙে ঝর্ণধারার বাঁধ ভেঙে গেল। পূর্ণার পায়ের তলার মাটি শিরশির করে উঠে। মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। সর্বাঙ্গে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। যেন মাথার উপর বরফের পাহাড় ধ্বসে পড়েছে। মৃদুল কান্নামাখা স্বরে বললো, ‘ আমি কখন এমন হইয়া গেলাম পূর্ণা! তুমি আমারে কোন নদীতে নিয়া ঝাঁপ দিলা। নদীর একূলও পাই না,ওকূলও পাই না। তুমি হাত ছাইড়া দিলেই মরণ! ধইরা রাখো আমারে!’

মৃদুলের আকুল আবেদন শুনে পূর্ণার বুকের পাঁজর ব্যথায় টনটন করে উঠে। তার অভিমানের পাহাড় মুহূর্তে ধ্বসে যায়। মৃদুল কখন তাকে এতো ভালোবেসে ফেললো? এই জাদু কখন হলো! এভাবে কোনো প্রেমিক কাঁদতে পারে! পূর্ণা মৃদুলের সামনে বসলো। তার চোখ দুটি আবারও জলে পূর্ণ হয়ে উঠে। সে মৃদুলের এক হাতে শক্ত করে ধরে। মৃদুল বললো,, ‘পূর্ণা আমি আর কুনুদিন এমন করতাম না। কুনুদিন না! এইবারের মতো মাফ কইরা দেও। যদি আর এমন করি তুমি আমারে আমার লুঙ্গি দিয়া শ্বাস আটকায়া খুন কইরো!’

মৃদুলের কথা শুনে পূর্ণার মনের আকাশের মেঘ কেটে যায়। সে মৃদুলের হাতের উপর কপাল ঠেকিয়ে হাসতে হাসতে কান্না করে দিল। বিচ্ছেদের পরের পূর্ণমিলন এতো মধুর হয় কেন? পূর্ণার ইচ্ছে হচ্ছে,মৃদুলকে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে!

শেষরাতের বাতাস সাঁ সাঁ করে উড়ছে। লাহাড়ি ঘরের বারান্দার চৌকিতে বসে আছে মৃদুল-পূর্ণা। দুজনের মাঝে এক হাত দূরত্ব। হাড় কাঁপানো শীত! পূর্ণা ঠকঠক করে কাঁপছে। মৃদুল মৃদু ধমকের স্বরে বললো, ‘কখন থাইকা কইতাছি,ঘরে যাও।’

পূর্ণা কাঁপছে ঠিকই তবে তার মুখে হাসি। সে ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বললো, ‘ কাঁপতে ভালো লাগে আমার!’

‘অসুস্থ হইয়া যাইবা তো। শরীর মরা মানুষের মতো ঠান্ডা হইয়া গেছে।’

‘কিছু হবে না।’

মৃদুল পূর্ণাকে দেখে অবাক হচ্ছে। একটা মানুষ এমন তীব্র ঠান্ডা কী করে সহ্য করতে পারে! ফজরের আযান পড়ার খুব বেশি সময় নেই। ফজরের আযানের পূর্বে মৃদুলকে তার আত্মীয়র বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। ফজরের নামাযের পরই ট্রেন আসবে। মৃদল চৌকি থেকে নেমে বললো, ‘ আমি যাই এহন?’

মৃদুলের কণ্ঠে জড়তা। সে যেতে চাইছে না। পূর্ণা চৌকি থেকে নেমে মৃদুলের পাশে এসে দাঁড়ালো। মৃদুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আসবেন তো?’

মৃদুল পূর্ণার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। পূর্ণার দুই গালে হাত রেখে বিভ্রম নিয়ে বললো, ‘ বৃহস্পতিবার বিকালের মধ্যেই আইসসা পড়ুম। আর শুক্রবার আমার এই রানির সাথে আমার নিকাহ হইবো।’

মৃদুল নিকাহ শব্দটা খুশিতে বাকবাকম হয়ে উচ্চারণ করে। পূর্ণা বললো, ‘আপনার আম্মা রাজি না হলে?’

‘পুরা দুইন্নারে এক পাশে রাইখা শুক্রবার আমি তোমারে বিয়া করাম। বিয়ার শাড়ি,গয়না সব নিয়া আসুম। তুমি খালি প্রহর গুণতে থাহো।’

পূর্ণার খুশিতে কান্না পাচ্ছে। তিনদিন পর সেও বউ সাজবে! মৃদুলের বউ হবে! সুদর্শন, বাউন্ডুলে,রাগী ছেলেটার বউ! ভাবতেই বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। মৃদুল আমুদে গলায় বললো, ‘ এহন যাও, লেপের তলে ঢুইকা ঘুম দেও। তোমারে ধরছি না সাপরে ধরছি বুঝা যাইতাছে না। এত্ত ঠান্ডা! যাও ঘরে যাও।’

‘টর্চ নিয়ে আসেননি? অন্ধকারে যাবেন কী করে?’

মৃদুল চুল ঝাঁকি দিয়ে ভাব নিয়ে বললো, ‘ আমি মিয়া বংশের ছেড়া! দুইন্নাত এমন কিছু নাই যে আমার পথ আটকাইবো! যেমনে আইছি ওমনেই যামু।’

পূর্ণা ফিক করে হেসে দিল।

গেইটের কাছাকাছি এসে পূর্ণা বললো, ‘ তাড়াতাড়ি আসবেন কিন্তু! আমি অপেক্ষা করব।’

মৃদুল হেসে মাথা নাড়াল। ইশারায় আশ্বস্ত করলো, সে তাড়াতাড়ি আসবে! গেইটের কাছে গিয়ে ফিরে তাকালো মৃদুল। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে! মনে হচ্ছে কিছু একটা বলা হয়নি। সে কথাটি না বললে,বড় ভুল হয়ে যবে। মৃদুল পূর্ণার সামনে এসে দাঁড়ালো। খুব কাছাকাছি! পূর্ণাও উৎসুক হয়ে আছে। সেও কি যেন শুনতে চাইছে! মৃদুল তার শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভেজাল। তারপর ডাকলো, ‘পূর্ণা?’

মৃদুলের কথার সাথে মুখ থেকে ধোঁয়া বের হয়। পূর্ণা স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। মৃদুল পূর্ণাকে একবার দেখলো তারপর লাহাড়ি ঘরের দিকে তাকালো। তারপর আবার পূর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি ছাড়া এই পৃথিবীর সুখ আমার জন্যে হারাম হইয়া যাক পূর্ণা!’

মৃদুলের প্রতিটা কথা এতো মধুর কেন মনে হচ্ছে পূর্ণার! তারা যেন নতুন কোনো জগতে চলে এসেছে। যেখানে শুধু সে,মৃদুল, প্রেম,প্রেম আর প্রেম! পরক্ষণেই মৃদুল বললো, ‘ভালোবাসি না কইলে হয় না? কইতেই হয়?’

পূর্ণা চোখে জল নিয়ে হেসে উঠে। তার রেশমি কালো চুল মৃদু বাতাসে উড়ছে। কুয়াশার আবছা আলোয় শ্যামবর্ণের পূর্ণাকে আবেদনময়ী মনে হচ্ছে৷ রাতের অন্ধকারের নিজস্ব ক্ষমতা আছে। রাত মানুষের মনের অনুভূতিকে সযত্নে জাগ্রত করে তুলে। মৃদলের উপর রাত তার নিজস্ব ক্ষমতা ফলায়! ফলস্বরূপ, মৃদুলের মনের জানালায় উঁকি দেয় নিষিদ্ধ সব আবদার! যখন মৃদুলের নিজের মনের চাওয়া বুঝতে পারলো সে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে হঠাৎ বলে উঠলো, ‘শয়তান,শয়তান!’

পূর্ণা হতভম্ব হয়ে যায়। সে চোখমুখ বিকৃত করে বললো, ‘শয়তান কে? আমি?’

মৃদুল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে বললো, ‘ না,না! তুমি হইবা কেন?’

মৃদুল চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে আবার বললো, ‘দেখো,আমার চারপাশে শয়তান ঘুরতাছে।

পূর্ণা মৃদুলের চারপাশ দেখে বললো, ‘কোথায়? কীভাবে দেখলেন?’

মৃদুল অসহায় চোখে তাকায়। অনেকক্ষণ তাকিয়েই থাকে। তারপর বললো, ‘আমার তোমারে চুমু খাইতে ইচ্ছা করতাছে। এইটা তো শয়তানের কাম!’

মৃদলের সহজ/সরল স্বীকারোক্তি। পূর্ণার কান গরম হয়ে যায়। লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। মৃদুল অস্থির হয়ে বললো, ‘আমি যাইতাছি।’

কথা শেষ করেই মৃদুল ঘুরে দাঁড়ায়। গেইটের বাইরে যেতে যেতে দুইগালে থাপ্পড় দিয়ে কয়েকবার উচ্চারণ করলো, ‘ আসতাগফিরুল্লাহ,আসতাগফিরুল্লাহ!’

মৃদুল চোখের আড়াল হতেই পূর্ণা একা একা হেসে কুটি-কুটি হয়ে যায়।

পূর্ণা পায়ে আলতা দিয়ে প্রেমাকে বললো, ‘ভালো দেখাচ্ছে না?’

প্রেমা পূর্ণার উপর ভীষণ রেগে আছে। সে তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো, ‘ কথা বলব না তোমার সাথে।’

‘ওমা! আমি আবার কী করলাম?’

‘আম্মা এতো রান্নাবান্না করছে। আর তুমি পুরো বাড়ি নতুন করে গুছালে এখন আবার সাজতে বসেছো। কেন এসব হচ্ছে সেটা বলছো না! কেন?’

পূর্ণা ঠোঁট টিপে হাসলো। দুই ডজন লাল কাচের চুড়ি দুই হাতে পরে বললো, ‘আমি কি আর কখনো সাজিনি?’

‘এবার আলাদা মনে হচ্ছে।’

‘সেটা তোর দোষ।’

‘আপা,বলো না।’

‘বিরক্ত করবি না তো।’

প্রেমা রাগে পায়ে গটগট শব্দ তুলে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। এখন সে বাসন্তীকে চাপ দিয়ে সব জেনে নিবে! প্রেমাকে রাগাতে পূর্ণার বেশ লাগে। সে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। মৃদুল পূর্ণার আলতা দেয়া পা খুব পছন্দ করে! যতবার পূর্ণা আলতা দিয়েছে মৃদুল ততবার প্রশংসা করেছে। পূর্ণার নিজেকে প্রজাপতি মনে হচ্ছে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে যত্রতত্র। চোখ বুঁজলেই সেদিনের রাতটা ধরা দেয় ছবির মতন! মৃদুল চলে যাওয়ার পরদিন সকালে উঠেই পূর্ণা পদ্মজার কাছে গিয়েছিল। দুই বোনের মন-মালিন্য শেষ হয়েছে। পূর্ণার মুখে সব শুনে পদ্মজা ভীষণ খুশি হয়েছে। মাঝে একদিনের বেশি সময় চলে গেল,পদ্মজার সাথে পূর্ণার দেখা হয়নি। তাই পূর্ণা সিদ্ধান্ত নেয় সে এখন হাওলাদার বাড়িতে যাবে। মৃদুলের জন্য অপেক্ষা করা সময়টা খুব বেশি দীর্ঘ মনে হচ্ছে। ওই বাড়িতে গেলে সময়টা কেটে যাবে, আর ফিরেই দেখবে মৃদুল চলে এসেছে! তাছাড়া আমিরের সাথে পূর্ণা সাক্ষাৎ করতে চায়। পদ্মজার অনিশ্চিত জীবনটা গুছিয়ে দেয়ার কোনো পথ আছে নাকি খুঁজতে হবে! পূর্ণা মাথায় ঘোমটা টেনে নিল। তারপর চিৎকার করে বাসন্তীকে বললো, ‘বড় আম্মা,আপার কাছে যাচ্ছি।’

রান্নাঘর থেকে বাসন্তীর জবাব আসে, ‘যাস না এখন।’

কিন্তু চঞ্চল পূর্ণা কী কারো কথা শুনার মেয়ে! সে দৌড়ে পালাতে চায়। গেইটের কাছে এসেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। বড়ই কাঁটা পড়ে ছিল,সেই কাঁটা তেড়চাভাবে পূর্ণার হাতে প্রবেশ করে। কিঞ্চিৎ রক্ত বেরিয়ে আসে। তাতেও দমবার পাত্রী নয় সে। কাঁটা বের করে দ্রুত মোড়ল বাড়ি ছাড়লো! বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর পূর্ণার মনটা হঠাৎ করেই বিতৃষ্ণায় ভরে উঠে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে মোড়ল বাড়ির দিকে তাকালো। গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে তাদের ঘরের ছাদ দেখা যাচ্ছে!

৮৭

পদ্মজা দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফরিনার কবরের পাশে গেল। সাথে নিয়ে এসেছে গোলাপ, জারবেরা,গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকা গাছের চারা। ফরিনার কবরের চেয়ে একটু দূরে গর্ত খুঁড়লো। প্রথমে গোলাপ গাছের চারা রোপণ করে। রিদওয়ান অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে পদ্মজাকে দেখে সেকেন্ড তিনেকের জন্য দাঁড়ালো। তার চোখেমুখে আনন্দের ছাপ! তারা গত দুইদিন পদ্মজার উপর কোনো রকম চাপ প্রয়োগ করেনি এবং বাজে আচরণও করেনি! পদ্মজা প্রথম যখন ব্যাপারটা ধরতে পারলো অবাক হয়েছিল। পরে আন্দাজ করে নিয়েছে, আড়ালে নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র চলছে! পদ্মজা স্বাভাবিক আচরণ করলেও ভেতরে ভেতরে সর্বক্ষণ ওঁৎ পেতে থেকেছে। সাবধান থেকেছে।কিন্তু কোনো আক্রমণ এখনো আসেনি। রিদওয়ান পদ্মজার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও সেদিকে গেল না। পদ্মজার উদ্দেশ্যে শিস বাজিয়ে যেখানে চাচ্ছিল সেদিকে চলে যায়। পদ্মজা শিস শুনেও তাকালো না। সে বুঝতে পেরেছে শিসটা কে দিয়েছে! পদ্মজা আরেকটা গর্ত খুঁড়লো চন্দ্রমল্লিকার জন্য।

আমির জানালা খুলে বাইরে তাকালো। সঙ্গে-সঙ্গে চোখেমুখে এক মুঠো বাতাস আর তীব্র আলো ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমির চোখ ছোট ছোট করে ফেললো। তারপর চারপাশে চোখ বুলাল। অন্দরমহলের কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। কারো সাড়া শব্দও নেই। বাড়িটা মৃত হয়ে গেছে! একসময় কত শোরগোল ছিল! শাহানা,শিরিন,রানি,লাবণ্য,ফরিনার মতো ভালোমনের সহজ-সরল মানুষগুলো ছিল। এখন কেউ নেই! লাবণ্যর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল,হয়েছে কী? লাবণ্য নিজের ভাইকে ছাড়া কী করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল! আর রানি? রানি ভাগ্যের সাথে অভিমান করে কোথায় হারিয়ে গেল? আদৌ বেঁচে আছে ? নাকি অভিমানের পাল্লাটা এতোই ভারী যে সইতে না পেরে নিজেকে উৎসর্গ করেছে? আমিরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে ফরিনার কবরের দিকে তাকালো। পদ্মজা বাঁশের কঞ্চি নেয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে মাত্র। তার সাদা শাড়ির আঁচল মাটি ছুঁইছুঁই। শাড়ির একপাশে কাদা মাখানো। সাদা শাড়ি পরা অবস্থায় পদ্মজাকে দেখে আমিরের আত্মা স্তব্ধ হয়ে যায়! সে চেয়ার খামচে ধরে। বুকের ভেতর সূচের মতো তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণা শুরু হয়। ক্ষণ মুহূর্তের পার্থক্যে সেই যন্ত্রণা বুক ছাপিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাখ্যাতীত যন্ত্রণার অনুভতিতে তার ভেতরটা গাঁট হয়ে যায়।

সে তিনরাত, দুইদিন পাতালঘরে থেকে আজ সকালে বেরিয়ে এসেছে। অন্দরমহলে না গিয়ে সোজা আলগ ঘরে চলে আসে। মগার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। মগা আমিরকে তার পাশে শুতে দেখে চমকায়। তবে উদ্ভ্রান্ত আমিরের সাথে কথা বলার সাহস হয় না। সে মেরুদণ্ড সোজা করে চুপচাপ শুয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর আমির ঘুম ঘুম চোখে বললো, ‘আমি যে এখানে আছি কেউ যেন জানতে না পারে।’

মগা সোজা থেকেই চোখ ঘুরিয়ে আমিরের পিঠের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আইচ্ছা।’

আমির ঘুমিয়ে পড়ে। এইতো কিছুক্ষণ আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। শরীরে এক ফোঁটাও শক্তি ছিল না। দুইদিন শুকনো খাবার আর দুই বোতল পানি খেয়ে কাটিয়েছে। মগা আমিরের মুখ দেখে বুঝতে পারে, আমির ক্ষুধার্ত! সে অন্দরমহল থেকে পিঠা এনে দেয়। লতিফা গতকাল বিকেলে পিঠা বানিয়েছিল। আমির বিনাবাক্যে পিঠা খেল। তারপর জানালা খুলে পদ্মজার পরনে সাদা শাড়ি দেখে থমকে গেল,স্তব্ধ হয়ে গেল। আমিরের বুকের ভেতর থেকে কেউ একজন বললো, ‘এই চোখ গলে যাক। দৃষ্টি কমে যাক। সাদা রঙ এতো বিচ্ছিরি কেন?’

আমির অযত্নে বড় হওয়া মাথার চুলগুলো এক হাতে টেনে ধরে হা করে শ্বাস নিল। জানালা দিয়ে আসা আলোয় মগা আবিষ্কার করলো,আমিরের হাতে অগণিত কামড়ের দাগ! তাও সে চুপ থাকলো। আগ্রহ চাপা দিল। আমির হাতে কামড় দেয়ার জন্য হা করে তখন মগার উপস্থিতি টের পায় আর থেমে যায়। তার চোখ দুটি অস্বাভাবিক রকমের লাল! মগা চোখের দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে। আমির পানি পান করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে।

পূর্ণা হাওলাদার বাড়িতে ঢুকেই আলগ ঘরের সামনে আমিরকে দেখতে পায়। আমিরকে দেখে অজানা,বোবা একটা অনুভূতি কুন্ডলী পাকিয়ে পূর্ণার বুকের ভেতর ঢুকে পড়ে। সে দৌড়ে আসে। পূর্ণাকে আসতে দেখে,আমির তার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে, হাসি হাসি মুখ করার চেষ্টা করলো। পূর্ণা আমিরের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে অবাক চোখে আমিরকে দেখে৷ আমিরের মাথার চুল লম্বা হয়েছে। চুলগুলো আগে চিকচিক করতো এখন কেমন ময়লা দেখাচ্ছে! দাঁড়ি-গোঁফের জন্য গাল দেখা যাচ্ছে না। শুকিয়েছে অনেক। আমিরকে দেখে পূর্ণার চোখেমুখে যে আনন্দটা আগে ফুটে উঠতো সেটা আজ নেই। বরং বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে! আমিরকে দেখেই পূর্ণার চোখ দুটি বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে।

পূর্ণার আমিরের জন্য মায়া হয়। আমির কখনো তার বোনের জামাই ছিল না,বড় ভাই ছিল! তাই অনুভূতিটা ছোট বোনের মতোই রক্তাক্ত।

পূর্ণা পাংশুটে স্বরে বললো, ‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না ভাইয়া।’

পূর্ণার কথা শুনে আমির অবাক হলো না। সে শুনেছে, পূর্ণা একরাত এখানে ছিল। তাহলে পদ্মজা নিশ্চয়ই কিছু বলেছে। পূর্ণা আবার বললো, ‘ এতো নিখুঁত অভিনয় কেউ করতে পারে না। তোমার ধমক,উপদেশ, ভালোবাসা কিছু অভিনয় ছিল না। এতটুকু আমি বুঝতে শিখেছি। তুমি চাইলে সব খারাপ কাজ ছেড়ে দিতে পারবে। ভাইয়া দয়া করে তুমি আমার ভালো ভাই-ই থাকো!’

পূর্ণা কেঁদে দিল। সে কান্না ছাড়া অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। আমির সবসময় পূর্ণার মাথায় হাত রেখে উপদেশ দেয়,স্বান্তনা দেয়। অভ্যাসমতো আজও পূর্ণার মাথায় হাত রাখতে গেল,কিন্তু রাখলো না। থেমে গেল। যদি পূর্ণা এই ছোঁয়াকে অপবিত্র মনে করে! আমির নিজের হাত গুটিয়ে নিল। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো, ‘ মৃদুল নাকি আজেবাজে কথা বলেছে?’

পূর্ণার বুকের ভেতরে থাকা টনটনে অভিমানটা কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো, ‘কথা ঘোরাচ্ছ কেন ভাইয়া?’

আমির নিরুত্তর। পূর্ণা বললো, ‘ তোমার নাকি মন নেই? মায়াদয়া নেই? তুমি নাকি পাষাণ, নিষ্ঠুর!’

এতো করুণ কারো কণ্ঠ হয়? বোন বলছে, তুমি নাকি পাষাণ,নিষ্ঠুর! উত্তরে কী বলবে আমির? হ্যাঁ আমি পাষান বলবে? নাকি চুপ থাকবে? আমির বুঝতে পারলো না। পূর্ণা আমিরের নিশ্চুপ থাকাটা পছন্দ করছে না। শ্যামবর্ণের আমির হাওলাদারকে একসময় পূর্ণা পছন্দ না করলেও এখন আত্মার সাথে মিশে গিয়েছে। আমির বাচাল প্রকৃতির মানুষ। সারাক্ষণ কথা বলে। কিন্তু আজ তার মুখে কথা নেই। সে নির্জীব, নিষ্ক্রিয়। পূর্ণা সাবধানে ভেজা কণ্ঠে বললো, ‘ আমিও কি তোমাকে ঘৃণা করব ভাইয়া?’

আমির ছটফট করতে থাকে। তার পা দুটি অস্থির,চোখের দৃষ্টি অস্থির। কপালে ছড়িয়ে থাকা কয়টা চুল টেনে ধরে। পূর্ণা গাঢ় স্বরে বললো, ‘আপা খুব কষ্টে আছে ভাইয়া। আপা ছোট থেকে কষ্ট পেয়ে আসছে। এখনো পাচ্ছে। আর কতদিন কষ্ট পাবে?কবে সবকিছু ঠিক হবে?’

আমির চটজলদি উত্তর দিল, ‘,দুইদিন!’

পূর্ণা ভ্রু কুঁচকাল। বললো, ‘ দুইদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে?’

আমির কথা বললো না। তবে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। পূর্ণার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। তবে কি,আমির সবকিছু ছেড়ে দিতে যাচ্ছে! পূর্নার ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হয়। সে খুশিতে বাকবাকুম হয়ে যায়। বললো, ‘সত্যি?’

আমির ধীরসুস্থে বললো, ‘আমাদের কী কথা হয়েছে পদ্মজাকে বলো না এখন।’

‘বলব না,ভাইয়া। ভুলেও বলব না।’

আমিরের সাথে পূর্ণার বেশিক্ষণ কথা হলো না। আমির চুপচাপ,বিষণ্ণ। পূর্ণা অনুমতি নিয়ে পদ্মজার কাছে চলে যায়। আমির বারান্দা থেকে চেয়ার নিয়ে বাইরে এসে বসলো। লতিফা মগাকে বাজারে পাঠানোর জন্য আলগ ঘরে আসে। ঘর থেকে বাইরে তাকিয়ে আমিরকে দেখতে পেল। আমিরকে দেখে সে প্রাণ ফিরে পায়! উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ঘর থেকে চিৎকার করে ডাকলো, ‘ভাইজান।’

আমির তাকালো। লতিফা ছুটে বাইরে আসে। সে গত দুইদিন পাতালঘরের আশেপাশে গিয়ে ঘুরঘুর করেছে কিন্তু আমিরের দেখা পায়নি। পদ্মজার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা না বলা অবধি সে কিছুতেই শান্তি পাবে না!

পদ্মজা চারা লাগানোর পর আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে গোড়ার মাটি শক্ত করে দিল। এরপর গোড়ায় পানি দিল। তারপর গাছকে খাড়া রাখার জন্য বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করে। কাজ শেষ করে হাত ধুয়ে উঠতেই পূর্ণার গলা ভেসে আসে, ‘আপা?’

পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। পূর্ণার চোখ দুটি মারবেলের মতো গোল গোল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্মজার বুঝতে পারলো,তার পরনের সাদা শাড়ি দেখে পূর্ণা অবাক হয়েছে! পূর্ণা এগিয়ে এসে রাগী স্বরে বললো, ‘সাদা শাড়ি পরছো কেন আপা? তুমি কি বিধবা?’

পদ্মজা বালতি হাতে নিয়ে বললো, ‘বিধবা হলেই মানুষ সাদা শাড়ি পরে? এমনি পরা যায় না?’

‘বিবাহিতারা সাদা শাড়ি পরতে পারে না। আবার এমন শাড়ি! অন্য কোনো রঙই নাই।’

‘বলছিলাম না,এই বাড়িতে না আসতে? আমিতো আগামীকাল সকালেই যেতাম।’

‘তুমি শাড়ি পাল্টাও।’

পদ্মজা ভ্রুকুটি করে বললো, ‘তুই তো ক্যাটকেটে হয়ে গেছিস। সংসার করবি কী করে?’

‘আপা তুমি এই সাদা শাড়ি এক্ষুনি পাল্টাবে।’

পূর্ণাকে বাচ্চাদের মতো জেদ করা দেখে পদ্মজা হাসলো। বললো, ‘কেন ভালো দেখাচ্ছে না?’

পূর্ণা চোখ ছোট ছোট করে বললো, ‘না,দেখাচ্ছে না। ভূতের মতো দেখাচ্ছে।’

পূর্ণার দৃঢ়কণ্ঠ! তাকে এখন যাই বলা হউক সে শুনবে না। আগামীকাল বিয়েটা হয়েই গেলে পদ্মজার শান্তি। পদ্মজা অন্দরমহলের দিকে যেতে যেতে বললো, ‘ঘরে আয়।’

‘আগে বলো,শাড়ি পাল্টাবা?’

পদ্মজার পূর্ণার দিকে তাকালো। পূর্ণা রাগী রাগী ভাব আনার চেষ্টা করে। পদ্মজা হাসলো। বললো, ‘ঘরে চল। পাল্টাব।’

পূর্ণা পদ্মজাকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আজকের দিনটা আসলেই সুন্দর! যা চাচ্ছে তাই হচ্ছে! সে উল্লাসিত। পদ্মজা বললো, ‘ বাড়ি ছেড়ে এলি কেন? মৃদুল এসে তোকে না দেখলে মন খারাপ করবে।’

‘করলে করুক!’

ঘরে এসে পূর্ণা জোর করে পদ্মজাকে কালো শাড়ি পরিয়ে দিল। পদ্মজাও মেনে নিল। যদি মৃদুল আজ আসে আগামীকাল আল্লাহ চাইলে পূর্ণার বিয়ে হবে। তারপর চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি। এরপর আর কোনোদিন দেখা হবে নাকি পদ্মজা জানে না! সজ্ঞানে,পরিকল্পিতভাবে সে যা করতে যাচ্ছে,তাতে আবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই

আজ আর কালকের দিনটা শুধু পূর্ণার মতোই হউক! পূর্ণা পদ্মজাকে শাড়ি পরানো শেষে বললো, ‘কত সুন্দর লাগছে! আর তখন কী একটা মরা রঙের শাড়ি পরেছিলে। দেখতে খুব খারাপ লাগছিল।’

‘আসলেই দেখতে খারাপ লাগছিল?’

পূর্ণা অসহায় চোখে তাকায়। সে কী করে বলবে, তার আপাকে সবকিছুতেই ভালো দেখায়। কিন্তু সাদা রঙটা যে অশুভ ইঙ্গিত দেয়!

পূর্ণার মনের অবস্থা পদ্মজা যেন উপলব্ধি করতে পারে। সে পূর্ণাকে বিছানায় বসিয়ে বললো, ‘ আজ আমার বোনকে খুব বেশি সুন্দর লাগছে।’

পূর্ণা লজ্জা পেল। পদ্মজা বললো, ‘ কী খাবি?’

পূর্ণা আয়েশ করে বসে বললো, ‘

‘খাব না। খেয়ে আসছি।’

‘ভাপা পিঠা খাবি? লুতু বুবু বানিয়েছে।’

‘না আপা কিছুই খাবো না। আপা?’

পূর্ণা চাপাস্বরে ‘আপা’ ডাকলো। পদ্মজা উৎসুক হয়ে তাকালো। পূর্ণা বললো, ‘ বাড়ির মানুষদের কী অবস্থা?’

‘জানি না। খাওয়ার সময় শুধু দেখা হয়। তারাও কিছু বলে না আমিও না।’

পূর্ণা প্রবল উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলো, ‘ওদের নিয়ে কী পরিকল্পনা করেছো?’

পদ্মজা তার পরিকল্পনা চেপে গেল, ‘এখনো ভাবিনি। তুই তোর বিয়েতে মন দে। নামায-রোজা কিন্তু কখনো ছাড়বি না। ভদ্রভাবে থাকবি। মাথা ঢেকে রাখবি সবসময়। আর অন্যায় করবি না আর কখনো সহ্য করবি না। ঠিক আছে?’

পূর্ণা গর্ব করে বললো, ‘আমি গত দুইদিন এক ওয়াক্ত নামাযও ছাড়িনি। এখনো দুপুরের নামায পড়ে আসছি।’

‘এইতো,ভালো মেয়ে। ভালো বউও হবে।’

পূর্ণার চোখভর্তি কাজল। ডাগরডোগর চোখ দুটি কাজলের ছোঁয়াতে ফুটে আছে। সোজা সিঁথি করে লম্বা চুল বেণী করা। কানে সাত রঙের গোল আকৃতির দুল। গায়ের ওড়নায় পাথরের কাজ। হাতে ঝনঝন করছে কাচের চুড়ি। সত্যি খুব সুন্দর লাগছে। পদ্মজা মুগ্ধ হয়। সে পূর্ণার এক হাতের উল্টোপাশে চুমু দিয়ে বললো, ‘ সত্যি আজ খুব বেশি সুন্দর লাগছে! নজর না লাগুক। মাশা-আল্লাহ।’

পূর্ণা মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। গড়গড় করে উগড়ে দেয় ভেতরের সব কথা,স্বপ্ন,আশা। তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে,সে যেন বহু বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। বা একটা রঙিন ফড়িং বোতল থেকে মুক্ত হয়ে আকাশে উড়ছে। পূর্ণাকে এতো খুশি দেখে পদ্মজার মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। তার কোমল হৃদয়টা পূর্ণার মনখোলা হাসি দেখে খুশিতে কেঁদে উঠে।

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে পূর্ণা অন্দরমহল থেকে বের হয়। পদ্মজা মগাকে ডেকে বললো,পূর্ণাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে। পূর্ণা জেদ ধরে, ‘আমি একা যেতে পারবো আপা। সন্ধ্যা তো হয়নি।’

পূর্ণার জেদকে পদ্মজা পাত্তা দিল না। তাই পূর্ণা মগার সাথে যেতে রাজি হয়৷ পূর্ণা যাওয়ার আগে শক্ত করে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরলো। পদ্মজা পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘সকালেই আসব।’

পূর্ণা পদ্মজার দিকে মুখ তুলে তাকায়। বললো, ‘তোমার সুখই আমার সুখ আপা। তুমি আমার মা,তুমিই আমার ভালোবাসা।’

পূর্ণা কেন এতো ভালোবাসে? পদ্মজার বুক ভরে যায়। সে পূর্ণার গাল ছুঁয়ে বললো, ‘আম্মাকে তোর মাঝে খুঁজে পাই আমি। যখন শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি আমার মাও চলে যাবে।’

পূর্ণার কান্না পায়। সে আবার পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে। দুই বোনের বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। পদ্মজা বেলা দেখে তাড়া দিল, ‘ বাড়ি যা। সন্ধ্যা হয়ে যাবে।’

‘আরেকটু জড়িয়ে রাখি।’

পূর্ণার মায়াময় আবদার! পদ্মজা কী বলবে খুঁজে পায় না। পূর্ণাকে বুকের সাথে শুধু চেপে ধরে রাখে। আকাশপানে চেয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে,তার বোনটা যেন সুখী হয়। মৃদুলের ভালোবাসায় পূর্ণার জীবনটা যেন পূর্ণ হয়ে উঠে।

হাওলাদার বাড়ি থেকে দুই মিনিট দুরত্বে গিয়ে পূর্ণার মনে পড়ে,সে মৃদুলের কথা আমিরকে বলেনি। এমনকি বিয়ের কথাও বলেনি! পদ্মজা আমিরকে কিছু বলবে না পূর্ণা জানে। এখন যদি সেও না বলে,কাল যদি আমির তাদের বাড়িতে না যায়? পূর্ণা হাঁটা থামিয়ে মগাকে বললো, ‘এখন বাড়ি যাব না। আমাকে আবার ও বাড়িতে যেতে হবে।’

‘রাইত হইয়া যাইব।’

‘তুমি যাও। আমি আমির ভাইয়ার সাথে দেখা করব।’

মগা কান চুলকাতে চুলকাতে বললো, ‘পরে আমি তোমারে দিয়া আইতে পারতাম না। বাজারে যামু।’

‘তুমি বাজারে যাও। আমাকে ভাইয়া দিয়ে আসবে।’

‘আইচ্ছা,তাইলে আমি যাই।’

মগা বাজারের দিকে চলে যায়। পূর্ণা আবার হাওলাদার বাড়িতে আসে। হাওলাদার বাড়ির সুপারি গাছগুলো মৃদু বাতাসে দুলছে। বাতাস শীত বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পূর্ণা তার ওড়না ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল। আলগ ঘরের আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সন্ধ্যার আযানের সুর ভেসে আসে কানে। দিনের আলো বিদায় নিচ্ছে,ফিরে আসছে গাঢ় অন্ধকার। আলগ ঘরের সবকটা ঘরে পূর্ণা আমিরকে খুঁজলো। ধান রাখার ঘরে গিয়ে সে একটু ভয় পেয়েছিল বৈকি! সেই ঘরে জানালা নেই। তাই ঘরটি অন্ধকারে ডুবে ছিল। ঘরে প্রবেশ করতেই একটা কালো বিড়াল ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটিতে। পূর্ণার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বুকে থুথু দিয়ে দ্রুত সে ঘর থেকে বের হয় আসে। প্রতিটি ঘরে আমিরকে খোঁজে। কিন্তু কোথাও আমিরকে পেল না। অন্দরমহলে গেল নাকি?

পূর্ণা যখন আলগ ঘর থেকে বের হতে যাবে তখন দেখলো, খলিল হাওলাদারের সাথে বোরকা পরা একটি মেয়ে। তারা দ্রুত হাঁটছে। মেয়েটির হাতে চাপাতি! পূর্ণার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। শিরশির করে উঠে বুকের ভেতরটা। খলিল চোরের মতো চারপাশ দেখছে আর হাঁটছে। পূর্ণা নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। খলিল মেয়েটিকে নিয়ে অন্দরমহলে না গিয়ে অন্দরমহলের পিছনে যাচ্ছে।

পূর্ণার মনে প্রশ্ন জাগে,তারা কি পাতালঘরে যাচ্ছে? সাথে মেয়েটি কে? খলিলের মতো খারাপ লোকের সাথে একটা মেয়ে জঙ্গলের দিকে কেন যাবে? মেয়েটির হাতে চাপাতি-ই বা কেন? পূর্ণার মাথায় প্রশ্নগুলো আসতেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। শিরদাঁড়া উঁচিয়ে আলগ ঘর থেকে বের হলো। একবার ভাবলো,পদ্মজাকে গিয়ে বলবে। কিন্তু তারপর ভাবলো, ততক্ষণে যদি মেয়েটি হারিয়ে যায়। মেয়েটির সম্পর্কে বোধহয় পদ্মজা জানে না। তাই তাকে বলেনি! মেয়েটি যদি পদ্মজার কোনো ক্ষতি করে বসে! কিছু করার আগে জানতে হবে মেয়েটি কে? এই বাড়ির সাথে তার কী সম্পর্ক! পূর্ণা বুকে থুথু দিয়ে খলিলের পিছু নিল। সে ঠোঁট টিপে সাবধানে এগিয়ে যায়৷ উত্তেজনায় তার হাত-পা কাঁপছে। কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বার বার ঢোক গিলছে। ততক্ষণে আকাশ তার ঝাঁপি থেকে অন্ধকার নামিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো পৃথিবী গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। পূর্ণা যত এগুচ্ছে তত কাঁপুনি বাড়ছে৷ নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঘনঘন। একবার ভাবলো,চলে যাবে। কিন্তু কৌতূহল তাকে জাপটে ধরে রেখেছে। তাই পিছু হটতে পারলো না। চারপাশ নির্জন,ছমছমে! খলিল মেয়েটিকে নিয়ে অন্দরমহলের পিছনে চলে যেতেই পূর্ণা দৌড়ে শেষ মাথায় আসে। অন্দরমহলের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সাবধানে জঙ্গলের দিকে উঁকি দেয়। খলিল বোরকা পরাহিত মেয়েটিকে নিয়ে জঙ্গলের মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চারপাশে চোখ বুলিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চাবি বের করে মেয়েটির হাতে দিলেন। তারপর চাপাস্বরে কিছু বললেন। মেয়েটিও যেন কিছু বললো! পূর্ণা রাতের জঙ্গল ভয় পায়। একটু পর গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে যাবে চারপাশ। তার ভীতু মন কিছুতেই খলিলের পিছু পিছু জঙ্গলের ভেতর যেতে সায় দিবে না! তাই পূর্ণার বোকা মস্তিষ্ক বুদ্ধি করলো,সে দূর থেকে খলিলের উপর পাথর ছুঁড়ে মারবে। পাথর কে মেরেছে সেটা দেখার জন্য খলিলের সাথে মেয়েটিও তাকাবে। আর তখনই পূর্ণা মেয়েটির মুখ দেখে নিবে আর দৌড়ে পালাবে। যে ভাবনা সে কাজ! পূর্ণা চারপাশে চোখ বুলিয়ে ছোট একটা পাথর কুড়িয়ে নিল। তারপর খলিলের উপর ছুঁড়ে মারলো। পাথরটি সোজা খলিলের ঘাড়ের উপর পড়লো। খলিল চমকে তাকালেও মেয়েটি তাকায়নি। মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চুপচাপ থাকাটা বলে দেয়,সে সাবধানী মানুষ! শত্রুর উদেশ্য বুঝার ক্ষমতা আছে! পূর্ণার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। খলিল পূর্ণার দিকে তেড়ে আসার আগে পূর্ণা ছুটে পালাতে উল্টোদিকে দৌড় দেয়। কিন্তু শেষ রক্ষে হলো না। আচমকা সেখানে রিদওয়ান উপস্থিত হয়। জাপটে ধরে পূর্ণাকে।

পূর্ণা চিৎকার দেয়ার পূর্বে রিদওয়ান মুখ চেপে ধরলো। মেয়েটি রিদওয়ানকে দেখে জঙ্গলের ভেতরে চলে যায়। খলিল রিদওয়ানের দিকে এগিয়ে আসেন।

পূর্ণা ছটফট করছে ছোটার জন্য। কিন্তু রিদওয়ানের বিশাল দেহের সাথে সে পারছে না। রিদওয়ান খলিলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘ ওরে নিয়ে বাড়ির সামনে দিয়ে আসতে না করছিলাম না? বাড়িতে মানুষ নাই বলে এমন অসাবধান হবেন?’

খলিল কৈফিয়তের স্বরে বললেন, ‘ না পাইরা আইছি।’

রিদওয়ান আগুন চোখে জঙ্গলের দিকে তাকালো। তারপর নিজের গলার মাফলার দিয়ে পূর্ণার মুখ বেঁধে দিল। আর খলিলের গলার মাফলার দিয়ে পা বাঁধলো। পূর্ণার দুই হাত পিছনে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। তারপর জোর করে পূর্ণাকে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যায়।

ভয়ে পূর্ণার বুক কাঁপছে। শরীর অবশ হয়ে আসছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে ছোটার জন্য। রিদওয়ান টেনে হিঁচড়ে পূর্ণাকে পাতালঘরের সামনে নিয়ে আসে। পূর্ণা চোখ ঘুরিয়ে দানবের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় গাছ দেখে শিউরে উঠে। মুখ দিয়ে ‘উউউউ’ ধরণের শব্দ করতে থাকে। তখন একটা গর্ত থেকে মেয়েলি স্বর ভেসে আসে, ‘ চাবি কাজ করতাছে না।’

কণ্ঠ স্বরটি পূর্ণার খুব বেশি পরিচিত মনে হয়! পূর্ণা উৎসুক হয়ে সেখানে তাকালো৷ খলিলের হাতের টর্চের আলোয় পাতালে যাওয়ার সিঁড়ি চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়। সেই দৃশ্য দেখে পূর্ণার পা থেকে মাথার তালু অবধি কেঁপে উঠে। সে পদ্মজার কাছে পাতালঘরের বর্ণনা শুনেছে কিন্তু এখন সরাসরি দেখছে! অনুভূতি ব্যাখ্যা করার মতো না! তার বুকের ভেতরে দামামা বেজে চলেছে! রিদওয়ান পূর্ণাকে টেনেহিঁচড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামিয়ে আনে। পাতালঘরে প্রধান দরজায় সামনে এসে দাঁড়ায়।

মেয়েটির হাত থেকে চাবি নিয়ে খলিল দরজা খোলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনিও পারলেন না। টর্চের আলো মেয়েটির পায়ের কাছে পড়ে আছে। পূর্ণা চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে মেয়েটির মুখ দেখার জন্য। মেয়েটির মুখ অন্ধকারে তলিয়ে আছে। খলিল হাত নাড়াচাড়া করাতে টর্চের আলো অস্থির হয়ে এদিকসেদিক ছুটছে। একসময় আলো মেয়েটির মুখের উপর পড়লো আবার তাৎক্ষণিক সরেও গেল। চোখের পলকের গতিতে আলো সরে গেলেও পূর্ণা দেখে ফেললো মেয়েটির মুখ!

পূর্ণার মনে হলো,আশেপাশে কোনো বজ্রপাত পড়লো মাত্র! তার চোখ দুটি বড় বড় হয়ে যায়। সে জোরে জোরে লাফাতে থাকলো। রিদওয়ান পূর্ণাকে ঠেসে ধরে। পূর্ণা গোঙাতে শুরু করে। সে মেয়েটির উদ্দেশ্যে কিছু বলছে। কিন্তু মুখ বেঁধে রাখার জন্য কথাগুলো গোঙানোর মতো মনে হচ্ছে। রিদওয়ান পূর্ণাকে বিশ্রী কয়েকটা গালি দিয়ে খলিলকে রাগী স্বরে বললো, ‘এখনো খোলা হয়নি?’

খলিল হাওলাদার বললেন, ‘চাবিডা কাম করে না।’

‘আপনি এই মা** হাত ধরেন। আমি দেখতাছি।’

খলিল পূর্ণার হাত ধরলেন। রিদওয়ান চাবি দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে। পূর্ণা মেয়েটির দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে। খলিল মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ তোর ওড়না দে। এই ছেড়ির হাত বান্ধা লাগবো।’

মেয়েটি তার মাথার ওড়না খুলে পূর্ণার হাত বাঁধার জন্য আসতেই খলিল পূর্ণার হাত ছেড়ে দিলেন। পূর্ণা সাথে সাথে তার দুই হাতে খামচে ধরলো মেয়েটির দুই গাল। একটা গালিও দিল। কিন্তু সেই গালি স্পষ্ট উচ্চারণ হলো না। খলিক পূর্ণাকে জোরে লাথি দিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললেন। শুকনো পাটকাঠির মতো পূর্ণা এক লাথিতে মিইয়ে গেল। শরীরের শক্তি কমে গেল। তারপর খলিল আর মেয়েটি মিলে পূর্ণার হাত শক্ত করে বাঁধলো। পূর্ণার কোমর ব্যথায় টনটন করে উঠে৷ গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

রিদওয়ান চেষ্টা করেও চাবি কাজে লাগাতে পারলো না। তীব্র রাগ নিয়ে সে বললো, ‘ দরজার চাবি এটা না।’

‘আমির তো এইডাই দিল।’ বললেন খলিল।

রিদওয়ানের মাথা গরম হয়ে যায়। সে ছুঁড়ে ফেলে চাবি। পা দিয়ে মেঝেতে লাথি দেয় কয়েকবার। তারপর দুই হাত তুলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কয়েকবার শ্বাস নিল। তারপর পূর্ণার সামনে বসে খলিলের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ এই মেয়ের কোনো ব্যবস্থা করতে হবে আব্বা।’

খলিল বললেন, ‘কী করবি?’

রিদওয়ান কিছু একটা চিন্তা করলো। তারপর পূর্ণার মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে পূর্ণাকে প্রশ্ন করলো, ‘আব্বার পিছু নিয়েছিলে কেন? কতটুকু জানো তুমি?’

পূর্ণা সর্বপ্রথমে মেয়েটির উদ্দেশ্যে থুথু ফেললো। তারপর রাগে কিড়মিড় করে রিদওয়ানকে বললো, ‘ জারজের বাচ্চা থুথু দেই তোর মুখে আর তোর বাপের মুখে।’

রিদওয়ান হাসলো। দ্রুতগতিতে মেঝেতে পা ভাঁজ করে বসলো। তারপর পূর্ণার মুখর উপর ঝুঁকে তুই-তুকারি করে বললো, ‘ আমিরের মুখেও দিবি?’

পূর্ণা চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। রিদওয়ান হাসি হাসি মুখ রেখে খলিলের দিকে তাকালো। বললো, ‘কুমারী মেয়ের থুথুও মজা কী বলেন আব্বা?’

খলিলের উত্তরের আশায় না থেকে রিদওয়ান পূর্ণার মুখের একদম কাছে এসে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো। রিদওয়ান উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে পূর্ণা শরীর ঘৃণার রি রি করে উঠলো। রিদওয়ান এক হাতে ঠেসে ধরে পূর্ণার মুখ। তারপর পূর্ণার ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে পূর্ণার গায়ের গন্ধ শুঁকে। তাকে উন্মাদের মতো দেখাচ্ছে। পূর্ণার জান বেরিয়ে যাওয়ার যোগাড়! রিদওয়ানের ভারী দেহের ভরে তার শরীরের হাড্ডি বিষিয়ে উঠছে। একটুও নড়তে পারছে না। চোখ ফেটে জল পড়ছে৷ রিদওয়ান পূর্ণার জামার পিঠের চেইন খুলে পূর্ণার ঘাড়ে চুমু দিল৷ সাথে সাথে ঘৃণায় পূর্ণা চোখ বন্ধ করে ফেললো। তখন চোখের সামনে ছবির মতোন ধরা দেয় মৃদুলের মুখটা। কোথায় সে? সে কি এসেছে? সে কি অনুভব করছে,তার প্রিয়তমা এক হায়েনার শিকার হয়েছে? পূর্ণার মনটা হুহু করে কেঁদে উঠে। ভেতরে ভেতরে সে আর্তনাদ করে ডাকলো, তার দ্বিতীয় মাকে! যাকে সে আপা বলে ডাকে!

রিদওয়ান পূর্ণার মুখ ছেড়ে চট করে উঠে দাঁড়ালো। গায়ের কাপড় খুলতে খুলতে খলিলকে বললো, ‘ দেখবেন? নাকি যাবেন?’

‘কোনো ভেজাল হইবো না তো?’ খলিলের গলার স্বর পাংশুটে।

‘কীসের ভেজাল?’

‘আমির যদি জানে।’

‘কী বলবে ও? বউয়ের প্রতি মায়া দেখায় না হয় বুঝলাম। শালিরে দিয়ে কী দরকার ওর? আর যা নিয়ম তাই হচ্ছে আব্বা। পূর্ণা যখন সব জেনে গেছে ওর বাঁচার অধিকার নাই।’ রিদওয়ান উত্তেজিত। সে কথা শেষ করে পূর্ণার দিকে ঝুঁকলো। পূর্ণা জোরে কেঁদে উঠলো। চিৎকার করে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললো, ‘ ভাবি,বাঁচাও। দোহাই লাগে,কিছু করো।’

রিদওয়ান ফিক করে হেসে ফেললো। পূর্ণা আরো ঘাবড়ে যায়। সে আকুতি করে মেয়েটিকে বললো, ‘ভাবি,এভাবে চুপ থেকো না। আল্লাহ সইবে না।’

রিদওয়ান পূর্ণার দুই গাল টিপে ধরে জিহ্বা দিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে গাঢ় স্বরে বললো, ‘ তোদের মা* বললে তোদের ঘেন্না হয়। আর আসমানিরে মা* বললে ও খুশি হয়৷ সাহায্য চাওয়ারও মানুষ পাইলি না।’

খলিল ব্যাপারটা উপভোগ করছেন। তিনি হেসে আসমানিকে বললেন, ‘ যখন ছেড়া আছিলাম রিদুর মতো আছিলাম। যে ছেড়ি একবার আমার হাতে পড়ছে কাইন্দা বাপ ডাকছে। ডরায়া মুইত্তা দিছে।’

খলিল কথা শেষ করে হাসলেন। তার হাসির শব্দ ফ্যাচফ্যাচে! খুবই বিশ্রী। আসমানি মৃদু হেসে আবার চুপসে গেল। পাতালঘরের দরজা না খোলাতে সে চিন্তিত। আবার রিদওয়ান এতোটাই উত্তেজিত যে,দরজার সামনে ফাঁকা জায়গায় তার খেল দেখানো শুরু করেছে! দরজা খোলার নামগন্ধ নেই,চিন্তাও নেই! খলিল এক হাতে আসমানিকে জড়িয়ে ধরে একটু দূরে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালেন।তারপর আমুদে গলায় বললেন, ‘ আমার রাজকন্যের মন খারাপ কেরে?

রিদওয়ান পূর্ণার বুকের উপর থাবা দিতেই পূর্ণা আর্তনাদ করে উঠলো, ‘আম্মা…আপা….’

রিদওয়ান পূর্ণার বুকের উপর বসে পূর্ণার মুখ চেপে ধরে কিড়মিড় করে চাপাস্বরে বললো, ‘চুপ,একদম চুপ!’

পূর্ণা স্পষ্ট টের পাচ্ছে তার পৃথিবী বিকট শব্দ তুলে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ওইতো…ওইতো মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে লাল বেনারসি। পূর্ণা চিৎকার করে মৃদুলকে ডাকলো। কিন্তু মৃদুল আসলো না। সে কেন বাঁচাতে আসছে না? কেন আসছে না? মৃদুল হঠাৎ করেই কাঁদতে থাকলো। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লো। তারপর চোখের পলকে সে উধাও হয়ে যায়!

পূর্ণার শরীর কেঁপে উঠে। যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। নিজেকে বুঝায়,তার আপা আসবে, আসবেই! পূর্ণার চোখের পর্দায় পদ্মজার আগমন ঘটে।

পদ্মজা আসছে। হ্যাঁ আসছে, হাতে রাম দা নিয়ে দৌড়ে আসছে। তার চোখের দৃষ্টিতে আগুন। শক্তিশালী বাতাস তাকে আটকানোর চেষ্টা করছে। তার চুলগুলোকে উড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।

সব কিছু ছাড়িয়ে সে ছুটে আসছে। এক কোপে সব জানোয়ারের মাথা শরীর থেকে আলাদা করে দিতে সে আসছে! কিন্তু দেরি করছে আসতে! ভীষণ দেরি করছে! পূর্ণা শব্দ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে, চোখ বুজলো। নিষ্ঠুর মাটি নীরব থেকে দেখে পূর্ণার সতীত্ব হরণ! সময়ের ব্যবধানে বেঁহুশ হয়ে যায় পূর্ণা।

বাপ-বেটা মিলে পর পর দুইবার ধর্ষণ করে। পূর্ণার গলা তৃষ্ণায় চৌচির। প্রাণ ভ্রমর যাই যাই! চোখ দুটি নিভু নিভু। রিদওয়ান দূরে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। খলিল ও আসমানি মিলে পূর্ণার গলায় রশি টেনে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। হত্যার সময় পূর্ণা হাত-পা দাপিয়ে কাতরায়! আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় নিস্তব্ধ প্রগাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতে!

৮৮

মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যেতেই গাছের পাতাগুলো নড়েচড়ে উঠে। রিদওয়ান চমকে সেদিকে তাকালো। আকাশের অর্ধবৃত্ত চাঁদটি দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোতে রিদওয়ান আবিষ্কার করলো,সে প্রচণ্ড শীতেও ঘামছে। তার পায়ের কাছে পড়ে আছে পূর্ণার লাশ। অন্ধকার, ছমছমে পরিবেশ। শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। রিদওয়ান প্যান্টের পকেট খুঁজে বিড়ি আর দিয়াশলাই বের করলো।

পূর্ণাকে হত্যার পর যখন ভাবলো অন্য মেয়েগুলোর মতো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে পূর্ণার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিবে তখন খলিল উপর থেকে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এসে চাপাস্বরে বললেন, ‘ কে জানি আইতাছে। মনে কয়,আমির। হুন রিদু,এইবার আমির তোর উপরে চ্যাতলে আমি কিছু করতে পারতাম না। ভাইজানেও করব না। ভাইজানে আমারে আগেই কইছে।’

খলিল হাওলাদার অন্দরমহলে যাচ্ছিলেন। পাতাল ছেড়ে একটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ে কে যেন টর্চ নিয়ে এদিকে আসছে। তিনি আন্দাজ করেছেন, অজ্ঞাত লোকটি আমির। তারপরই দৌড়ে আসেন। খলিলের মুখে আমির নামটা শুনতেই রিদওয়ান বুকের ভেতর ভয় জেঁকে বসে।

রিদওয়ান আমিরকে ভয় পেতে চায় না। তবুও ভয় তাকে ছাড়ে না। ভয় পাওয়ার কিছু কারণও রয়েছে। প্রথমত, পারিজার হত্যার ব্যাপারে আমির সব জানে। রিদওয়ান টের পায় আমিরের মনে এই হত্যা নিয়ে ক্ষোভ রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, এই পাপের জগতের জন্য পদ্মজার সাথে তার বিচ্ছেদ হয়েছে। সে এখন বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ছে। জ্বলন্ত কয়লা হয়ে আছে। এখন যদি শুনে,পূর্ণাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে

জ্বলন্ত কয়লা নিজ শক্তিকে আগুন তৈরি করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

রিদওয়ান পূর্ণাকে ধর্ষণের আগে যদিও বলেছিল, আমির শালীর জন্য কিছুই করবে না। কিন্তু রিদওয়ান এখন বুঝতে পারছে, সে তখন উত্তেজিত হয়ে ভুল কথা বলেছে। শালীর জন্য কিছু না করুক, শালীর মৃত্যু আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ নিশ্চয়ই করবে! পূর্ণা পদ্মজার জীবন! আর পদ্মজা আমিরের প্রাণভোমরা! সংযোগ তো আছেই। কিছুতেই ঝুঁকি নেয়া যাবে না। আবার খলিল হাওলাদার বলছেন,এবার আর ছেলের পক্ষ নিবেন না! রিদওয়ান এতো চেষ্টা করেও খলিল-মজিদকে নিজের বশে আনতে পারেনি। সব মিলিয়ে বিপদের আশঙ্কা শতভাগ! রিদওয়ান ভাবলো, আপাতত আমিরকে রাগানো ঠিক হবে না৷ আমিরকে হত্যা করার ব্যাপারে মজিদ,খলিল দুজনকে রিদওয়ান বাগে আনতে পেরেছে। একটা মৃত লাশের জন্য পরিকল্পনা নষ্ট করা উচিত হবে না। আর দুটো দিন সহ্য করতেই হবে আমিরকে।

রিদওয়ান খলিল ও আসমানিকে নিঃশ্বাসের গতিতে বললো, ‘ তোমরা এখানে থাকো। দড়িটা ওই চিপায় লুকিয়ে রাখো। আমি যে এখানে ছিলাম আমির যেন জানতে না পারে।’

রিদওয়ান পূর্ণার লাশ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তারপর দ্রুত ঘন ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। ঝোপঝাড়ে কেউ থাকলে সেটাও টের পেয়ে যায় আমির। এই ক্ষমতা সে কোথায় পেয়েছে,রিদওয়ানের জানা নেই। তবে আমিরের কাছে শুনেছে,আমির লুকিয়ে থাকা মানুষটির নিঃশ্বাস ও তাকিয়ে থাকাটা অনুভব করতে পারে! তাই রিদওয়ান চোখ বুজে,নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঘাপটি মেরে বসে থাকে।

আমির পাতালে ঢুকলো। খলিল সিঁড়ির দিকে টর্চ ধরলেন। মুখে টর্চের তীব্র আলো পড়তেই আমির কপাল কুঁচকে দুই হাত সামনে বাড়িয়ে আলোর গতিবেগ রোধ করে মুখে অস্ফুট বিরক্তিসূচক শব্দ করল।

খলিল হেসে আমুদে কণ্ঠে বললেন, ‘ বাবু আইছস নাকি!’

আমির চোখ ছোট ছোট করে ধমকের স্বরে বললো, ‘আরে এভাবে মুখের উপর টর্চ ধরে রাখছেন কেন?’

খলিল টর্চের আলো দ্রুত অন্যদিকে সরিয়ে নিলেন। আমির তার হাতের চাবি খলিলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘এইযে চাবি।’

খলিল চাবি হাতে নিয়ে বললেন, ‘ কুন সময় থাইকা খাড়ায়া আছি। চাবি লইয়া আইয়া ভালা করছো আব্বা।’

‘আনতে গেলেন না কেন?আমি অন্দরমহলেই ছিলাম।’

‘এইতো অহন যাইতে চাইছিলাম।’

আমির টর্চ আসমানির মুখের উপর ধরে বললো, ‘ তোর এই সময় এখানে কী?’

আসমানি তার বোরকা খুলতে খুলতে বললো, ‘ রিদওয়ানে ডাকছে।’

‘রিদওয়ান কোথায়?’

‘জানি না। আমারে আইতে কইয়া নিজের আওয়ার নাম নাই। না আইলেও সমস্যা নাই। তুমি আইছো চলবো।’ আসমানি লম্বা করে হাসলো। খলিল বা আসমানি কারো চোখেমুখে একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। আমির আসমানির নোংরা অঙ্গভঙ্গি দেখে হাসলো। আসমানির সামনে সে যতবার আসে ততবার আসমানি বিভিন্নভাবে তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। গত চার বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে,কিন্তু ফল এখনো পায়নি। আমির আসমানির খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। চাপাস্বরে বললো, ‘খোদার কসম,তোর মতো বে** দুটো দেখিনি।’

আমিরের অপমানজনক কথা আসমানি গায়ে লাগা তো দূরের কথা, কানেই ঢোকায়নি। খলিল দরজা খুললেন৷ তিনজন একসাথে ভেতরে প্রবেশ করলো। দরজা লাগানোর সময় আমির তার টর্চের আলোতে মেঝেতে একটা নুপুর দেখতে পেলো। সে ভ্রুকুটি করে এগিয়ে আসে। হাতে নুপুরটি তুলে নেয়। আসমানি পিছন থেকে বললো, ‘ আমার নুপুর।’

এই মুহূর্তে রিদওয়ান ঝোপঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে, লাশটার কী করা যায়? পাতালে তো এখন ঢোকা যাবে না। সেখানে আমির আছে। অন্দরমহল থেকে রাম দা আর বস্তা নিয়ে আসতে অন্দরমহলে যাওয়া যায়। তারপর জঙ্গলের পিছনের ভাঙা দেয়াল টপকে ঘাটে চলে গেলেই নিশ্চিত। ঘাটে তাদের ট্রলার আছে। একবার ট্রলারে উঠতে পারলে পূর্ণার লাশ আর কেউ পাবে না। রিদওয়ান হাতের বিড়ি ফেলে পূর্ণার লাশ রেখে দ্রুত অন্দরমহলে যায়। পূর্ণার ফ্যাকাসে মুখের উপর একটা জোনাকিপোকা বসে। জোনাকিপোকার জ্বলে জ্বলে আবার নিভে যাওয়া আলোয় পূর্ণার মুখটা আরো ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে! বুক মোচড় দিয়ে উঠার মতো। পূর্ণার দুই হাত নিস্তেজ হয়ে ঘাসে পড়ে আছে। সারা জনমের জন্য সে ঘুমিয়ে পড়েছে। এই পৃথিবীর বুকে তার একুশ বছরেরই জীবন ছিল। কী হতো যদি আরো কয়টা দিন সে বাঁচতে পারতো?

রিদওয়ান ভীষণ উত্তেজিত। শত-শত খুন করার পর এই প্রথম কোনো মৃত দেহ নিয়ে সে বিপাকে পড়েছে। অন্দরমহলের সামনে এসে দেখে,পদ্মজা দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজার সাথে কথা বলছে প্রান্ত! প্রান্ত কি পূর্ণার খোঁজে এসেছে? রিদওয়ান এক হাতে নিজের ঘাড় ম্যাসাজ করলো। অন্দরমহল থেকে বস্তা বা রাম দা আনা এখন বিপদজনক। পদ্মজা বুদ্ধিমতী, তার রিদওয়ানকে সন্দেহ করার সম্ভাবনা শতভাগ। সন্দেহ না এই মেয়ে নিশ্চিত হয়ে যাবে৷ লতিফাকে দেখা যাচ্ছে না, তাহলে ওকে দিয়ে সাহায্য নেয়া যেত। এখন কী করবে সে? রিদওয়ানের মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। পরক্ষণেই মন বলে উঠলো, সামান্য নারীকে সে কেন ভয় পাবে? তারপর আবার ভাবলো, না এখন আমির বা পদ্মজার মুখোমুখি হওয়া যাবে না,এতে বহু কাঙ্ক্ষিত সাজানো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। রিদওয়ান উল্টো ঘুরে জঙ্গলে ছুটে আসে। পূর্ণার লাশের পাশে এসে দাঁড়ায়। আরেকটা বিড়ির জন্য পকেটে হাত দেয়। বিড়ি নেই৷ সে পায়চারি করতে করতে ভাবতে থাকলো। কী করা যায়? হুট করে তার মাথা কাজ করে। ট্রলারে করে পূর্ণার লাশ নিয়ে দূরে চলে যাবে। পথে কোনো না কোনো ব্যবস্থা হবে৷ ভাবতে দেরি হলেও কাজে দেরি করলো না। সে পূর্ণার লাশ কাঁধে তুলে নিল। জঙ্গল পেরিয়ে ভাঙা ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাঙা অংশ কম। পূর্ণার লাশ নিয়ে একসাথে বের হওয়া সম্ভব নয়৷ আগে রিদওয়ানকে বের হতে হবে তারপর পূর্ণার লাশ টেনে বের করতে হবে। রিদওয়ান পূর্ণার লাশ রেখে নিজে আগে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো। বাইরের দৃশ্য দেখে সঙ্গে – সঙ্গে সে চমকে গেল! বাইরে চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। একজন ইয়াকুব আলী। যিনি গত চার বছর ধরে মজিদ হাওলাদারের মাতব্বর পদের প্রতিদ্বন্ধী। সাথে উনার বিএ পাশ ছেলে ইউসুফ আর রয়েছে চামচা দুজন। তারা এই রাতের বেলা গাঢ় অন্ধকারে এখানে কী করছে? একইদিনে এতো বিপদ! রিদওয়ান তার ঠোঁট ভেজাল। নিজেদের গোলকধাঁধায় আটকে রাখা এলাকা যেন এখন নিজেদের জন্যই গোলকধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে!

কয়দিন আগে ইয়াকুব আলীর এক লোক এখানে এসেছিল। তারপর আমিরের হাতে খুন হলো। আর এখন ইয়াকুব আলী নিজে তার ছেলেকে নিয়ে এসেছেন! কী চাচ্ছে এরা? কিছু কি সন্দেহ করেছে?

যদি নারী পাচার সম্পর্কিত কিছু জেনে থাকে! ভাবতেই রিদওয়ানের হৃৎপিণ্ড ছ্যাঁৎ করে উঠলো। কেউ যেন তার হৃৎপিণ্ডে গরম খুন্তি ছুঁইয়ে দিয়েছে। রিদওয়ান নিজেকে আড়াল করে নেয়। ইয়াকুব আলী চলে যান। রয়ে যায় বাকি তিনজন। তারা চারপাশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখছে। এই খবর দ্রুত মজিদ এবং খলিলকে দিতে হবে। রিদওয়ান দ্রুত সরে আসে। পূর্ণার লাশ দেখে সে থমকে দাঁড়ায়। এক মুহূর্তের জন্য সে পূর্ণার কথা ভুলে গিয়েছিল। আগে এই লাশের ব্যবস্থা করতে হবে। এই মুহূর্তে সে একা হয়ে পড়েছে। মজিদ হাওলাদার বাড়িতে নেই। খলিল হাওলাদার আমিরের সাথে পাতালে রয়েছেন। দলের কেউও আপাতত কাছে নেই! সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থা! রিদওয়ান পূর্ণার লাশ আবার কাঁধে তুলে নিল৷ একটা মৃত,নিস্তেজ দেহ নিয়ে টানাহেঁচড়া করে দম বেরিয়ে যাচ্ছে। মাথার রগ দপদপ করছে। এতদিনের অভিজ্ঞতা আজ রিদওয়ানের কোনো কাজেই লাগছে না৷ কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না৷ আচ্ছা,আমির তার জায়গায় থাকলে কী করতো? কিছুতো করতোই৷ রিদওয়ান নিজের উপর বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো, ‘আব্বা,কাকা ঠিকই বলে। আমিরের মাথার এক ফোঁটা বুদ্ধি আমার মাথায় নাই।’

অনেক ভাবাভাবির পর রিদওয়ান পূর্ণার লাশ একটি গাছের পাশে রাখলো। তারপর শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালো৷ বার কয়েক নিঃশ্বাস নিল এবং ছাড়লো। এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে অন্দরমহলে গেল। সদর ঘরে পদ্মজা বসে আছে। পদ্মজার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রিদওয়ান অবাক হওয়ার ভান ধরে প্রশ্ন করলো, ‘ এই রাতের বেলা সবাই এমন তব্ধা লেগে বসে আছে কেন?’

পদ্মজা রিদওয়ানের দিকে ঘুরেও তাকালো না। প্রান্ত বললো, ‘মেজো আপাকে খুঁজে পাচ্ছি ন।’

রিদওয়ান এক গ্লাস পানি খেয়ে হেসে বললো, ‘ এই মেয়ে বাঁদরের মতো। দেখো,কার বাড়িতে আছে।’

‘আপার আজ কোথাও যাওয়ার কথা না।’

‘যেতেও পারে।’

কথা শেষ করে রিদওয়ান নিজ ঘরে চলে গেল। ঘরে এসেই সে অস্থির হয়ে উঠে। দ্রুত তোষকের নিচ থেকে বড় একটা বস্তা নিয়ে, ছোট করে ভাঁজ করে। তারপর ভাঁজকরা বস্তা শার্টের ভেতর বগলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রাম দা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু রাম দা লুকানোর মতো জায়গা তার শরীরে নেই! সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে সাবধানে আবার জঙ্গলে আসে। পূর্ণার লাশ বস্তার ভেতর ভরে কাঁধে তুলে নেয়। অন্দরমহলের চারপাশ সুপারি গাছে আচ্ছাদিত। সুপারি গাছ আর রাতের অন্ধকারকে কাজে লাগিয়ে রিদওয়ান গেইটের কাছে খুব সহজেই চলে আসে।

গেইটের দারোয়ান মুত্তালিব ঝিমুচ্ছেন। মুত্তালিব মজিদের বিশ্বস্ত দারোয়ান। সে এই বাড়ি সম্পর্কিত সবকিছু জানে। কিন্তু কখনো খুন হতে দেখেনি বা খুন হওয়া লাশও দেখেনি। এমন দায়িত্ব সে কখনো পায়নি। এই বাড়ির গোপনীয়তা গোপন রাখাই তার কাজ। রিদওয়ান বাধ্য হয়ে মুত্তালিবকে নতুন দায়িত্ব দেয়ার জন্য ডাকলো, ‘ মুত্তালিব কাকা?’

মুত্তালিব পিটপিট করে তাকালেন। রিদওয়ানের মুখটা স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসতেই তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন। রিদওয়ান ইশারায় শান্ত হতে বললো। মুত্তালিব উৎসুক হয়ে তাকালেন। রিদওয়ান তার কাঁধের বস্তা মুত্তালিবের পায়ের কাছে রাখে। মুত্তালিব প্রশ্ন করলেন, ‘বস্তার ভিতরে কিতা?’

রিদওয়ান শান্তস্বরে জানালো, ‘ লাশ।’

রিদওয়ান শান্তস্বরে বললেও মুত্তালিবের জন্য এই শব্দটি ভয়ানক ছিল। তিনি চমকে উঠলেন। রিদওয়ান চারপাশ দেখে বললো, ‘ আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। বিনিময়ে বেতনের চেয়ে তিনগুন পাবেন।’

মুত্তালিবের বেতন সাধারণ বেতনের চেয়ে এমনিতেই তিনগুণ। তার উপর আরো তিনগুণ মানে রাজপ্রাসাদ জেতার মতো! লোভনীয় প্রস্তাব! মুত্তালিবের চোখ দুটি চকচক করে উঠে। অর্থের লোভে মনের ভয় চাপা পড়ে। তিনি অভিজ্ঞ স্বরে সাহস নিয়ে বললেন, ‘ তুমি খালি কও,বাকি কাম আমার।’

রিদওয়ান আরেকটু এগিয়ে আসে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ ভ্যানগাড়িটা নিয়ে আসেন। ছন নিবেন বেশি৷ তারপর এই বস্তাটা আজমপুরের হাওড়ে ফেলে আসবেন।’

মুত্তালিব মনে মনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। ভয়টা আবার জেগে উঠে। কিন্তু অর্থের জন্য তিনি জোর করে ভয়কে চাপা দেয়ার চেষ্টা করলেন।এতগুলো টাকা জলে ভাসিয়ে দেয়া যায় না! তার চেয়ে একটা দেহ জলে ভাসিয়ে দেয়াই উত্তম! তিনি ভ্যানগাড়ি নিয়ে আসেন। ভ্যানগাড়িটি হাওলাদার বাড়ির। সাথে অনেক ছনও নিলেন। দুজনের তাড়াহুড়ো করে ছনের ভেতর বস্তা রাখলো। রিদওয়ান বললো, ‘সাবধানে কাজ করবেন। এমন জায়গায় ফেলবেন যাতে কেউ লাশ খুঁজে না পায়।’

মুত্তালিব চারপাশ দেখে ঢোক গিললেন। তার চোরাচাহনি! তিনি আতঙ্কিত। কিন্তু তা রিদওয়ানের সামনে প্রকাশ করতে নারাজ। তিনি রিদওয়ানকে আশ্বস্ত করলেন, ‘কোনো ভুল হইবো না। কাম সাইরাই আমি আইতাছি।’

‘সকালেই আপনি আপনার টাকা পেয়ে যাবেন। ‘ বললো রিদওয়ান।

মুত্তালিব হাসি বিনিময় করলেন। তারপর মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে অন্ধকার পথে বেরিয়ে পড়েন।

মুত্তালিবের পা বার বার ফসকে যাচ্ছে। তিনি ভয় পাচ্ছেন। যদি কেউ টের পেয়ে যায় তখন কী হবে? তিনি ঘামছেন,হাতও কাঁপছে। পথে এক দুজন লোকের সাক্ষাৎ পেয়ে তিনি নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি জানেন না,কার লাশ নিয়ে তিনি পথ পাড়ি দিচ্ছেন৷ বার বার মনে হচ্ছে, বস্তার ভেতর থেকে লাশটি বেরিয়ে এসে তার গলা চেপে ধরবে। রক্ত চুষে খাবে! চিরচেনা পথঘাটকে তার পরিত্যাক্ত মনে হচ্ছে। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দে নিজেই উৎকর্ণ হয়ে উঠছেন বার বার। আটপাড়া ছেড়ে নোয়াপাড়ায় আসেন। রাস্তার দুই ধারে গাছ-গাছালি। তারপর যতদূর চোখ যার বিস্তীর্ণ ক্ষেত। তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। ভয়ে বুকে চাপ অনুভব করছেন। আজমপুর যেতে পথে থানা পড়ে। থানার সামনে দিয়ে তিনি কী করে যাবেন? যদি কেউ বুঝে যায়! এই চিন্তায় রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ভয়ে রক্ত হিম হয়ে গেছে। তিনি ক্লান্ত হয়ে গাড়ি থামালেন। মিনিট ছয়েক পথের ধারে বসে বিড়ি ফুঁকলেন। ভয় কিছুতেই কাটছে না। বুকের ভেতর একটা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। টাকার লোভে এতোবড় ঝুঁকি নেয়া ঠিক হয়নি। তিনি ভাবলেন, ও বাড়িতে তো এই কাজ করার অনেক মানুষ আছে। তাকেই কেন এই কাজ দেয়া হলো? এই লাশের সাথে কি কোনো বড় বিপদ জড়িত? মুত্তালিবের লাশের মুখ দেখার কৌতূহল জাগলো। তিনি চারদিক দেখে বস্তার মুখ খুললেন। বেরিয়ে আসে চেনা শ্যামবর্ণের মুখখানা। গলায় গাঢ় দাগ! চোখেমুখে আঁচড়। মুত্তালিব ভয়ে কান্না করে দিলেন। এই মেয়েটাকে তিনি সন্ধ্যাবেলায় দেখেছেন জলজ্যান্ত! এখন মৃত! তিনি বুকে হাত দিয়ে বসে পড়েন। বাতাস ও পাতার ঘর্ষণে সৃষ্ট শব্দে তিনি চমকে উঠেন। প্রস্রাবের বেগ বেড়ে যায়। চোখের পলকে লুঙ্গি ভিজে যায়। তিনি নিজের কাজে নিজে লজ্জিত হোন। লজ্জা,ভয় সব মিলিয়ে মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে। আজমপুর যেতে আরো দুই ঘন্টা লাগবে। এতক্ষণ তিনি এই লাশ নিয়ে কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারবেন না। মুত্তালিব দ্রুত বস্তার মুখ বেঁধে ফেলেন। আরেকটু এগিয়ে নোয়াপাড়ার শেষ মাথায় পৌঁছালেন। সেখানে ক্ষেতের পাশে ঘন ঝোঁপঝাড় রয়েছে। এখানে সহজে কারোর আসার কথা নয়। ঝোঁপঝাড়ের ভেতর ছন বিছিয়ে সেখানে বস্তাটি রাখলেন। তারপর বস্তার উপর আরো ছন দিয়ে দ্রুত জায়গা ছাড়লেন।

.

সকাল নয়টা বাজে। পূর্ণার হদিস মিলেনি। পূর্ণা লাপাত্তা,এই খবর পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রেমা ঘরে বসে কান্নাকাটি করছে। মৃদুলও আসেনি। বাসন্তী ও প্রান্ত এদিকওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তাদের সাথে আরো কয়েকজন রয়েছে৷ সবাই মিলে পূর্ণাকে খুঁজছে। পদ্মজার নানাবাড়ির মানুষজন বলতে, পদ্মজার নানু আর প্রতিবন্ধী হিমেল বেঁচে আছে। তারা দুজনই অনেকদিন ধরে পদ্মজার খালার বাড়ি ঢাকাতে আছে। গ্রামে কাছের আত্মীয় বলতে আর কেউ নেই। হাওলাদার বাড়িতে তো পূর্ণা নেই। পদ্মজা মগার কাছে যখন শুনলো,পূর্ণা আমিরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তাৎক্ষণিক পদ্মজা আমিরকে খোঁজে। সে পাতালঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু চাবি না থাকার কারণে যেতে পারেনি। চিন্তায় তার মাথা ব্যথা উঠে গেছে। মজিদ গ্রামের বাইরে ছিলেন। তিনি ভোররাতে ফিরেন। রিদওয়ান ঘরে বেঘোরে ঘুমিয়েছে। দুজনের মধ্যে কারো বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ নেই। তবে পদ্মজা সন্দেহের তালিকায় দুজনকেই রেখেছে৷ বাকি রইলো খলিল আর আমির হাওলাদার। তারা দুজন রাত থেকে চোখের বাইরে আছে। দুজনের সাথে মুখোমুখি হতে হবে। পদ্মজার ধারণা,পূর্ণা বন্দী হয়েছে। তাকে ভয় দেখানোর জন্য এরা পূর্ণাকে বন্দি করেছে। পদ্মজা সরাসরি মজিদ এবং রিদওয়ানকে সকালে প্রশ্ন করেছে। দুজনই উত্তর দিয়েছে,তারা জানে না। আমিরের সাথে সাক্ষাৎ হলেই,নিশ্চিত হওয়া যাবে।

বেলা সাড়ে নয়টায় আমিরের দেখা মিলে। তার পরনে ঢিলা সাদা রঙের পায়জামা আর ফতুয়া। অনেক পুরনো কাপড়! হাঁটার তালে ফতুয়া দুলছে। সে সোজা আলগঘরে আসে। মগার হাতে একটা নীল খাম আরেকটা ছোট কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘ এই কাগজে আলমগীর ভাইয়ার ঠিকানা আছে। ঠিকানায় এই খাম পৌঁছে দিবি।’

মগা বাধ্যর মতো মাথা নাড়ালো। যে ঠিকানা লেখা আছে সে ঠিকানায় পৌঁছাতে মগার ষোল ঘন্টা লাগবে। আমির চারপাশ দেখে বললো, ‘মরে গেলেও এই খাম অন্য কারো হাতে দিবি না। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে রওনা হবি।’

‘আইচ্ছা।’

আমির ঘুরে দাঁড়ায় চলে যেতে। মগা ডাকলো, ‘ ভাই?’

আমির তাকালো। মগা বললো, ‘পূর্ণায় রাইতে তোমার লগে দেখা করতে আইছিল না?’

আমির চোখ ছোট ছোট করে ফেললো। বললো, ‘ না তো। কেন?’

মগা উসখুস করে বললো, ‘পূর্ণারে খুঁইজা পাইতাছে না কাইল থাইকা।’

আমির সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সে মগাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন সেখানে উপস্থিত হয় পদ্মজা। পদ্মজা আমিরের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ আমাকে নিজের দাসী বানাতে আমার বোনকে পথ করেছেন আপনি? পূর্ণা কোথায়?’

পদ্মজার কণ্ঠে তেজের আঁচ পাওয়া যায়। সে রাগান্বিত। আমির আশ্চর্য হয়ে গেল। সে পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘ আমি কী করে জানবো? পূর্ণা তোমার কাছে গিয়েছিল না?’

মগা বললো, ‘ ভাই,পূর্ণারে নিয়া বাড়িত যাইতাছিলাম। তখন পূর্ণায় পথে থাইমা কইলো তোমার লগে দেখা করবো। পরে নাকি তুমি হেরে বাড়িত দিয়া আইবা।’

আমির একবার পদ্মজাকে দেখলো তারপর মগার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ তারপর এই বাড়িতে আসছিল?’

‘আইছিল মনে কয়।’

‘তুই কোথায় ছিলি?’

মগা মাথা নত করে বললো, ‘ বাজারে।’

আমির চিন্তায় পড়ে যায়। সে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আমার সাথে তো পূর্ণার দেখা হয়নি। মগা,তুই পূর্ণাকে নিজ চোখে দেখেছিস এই বাড়িতে ঢুকতে?’

মগা না সূচক মাথা নাড়াল। আমির দ্রুত গেইটের দারোয়ান মুত্তালিবের কাছে যায়। মুত্তালিব পদ্মজাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়। আমির মুত্তালিবকে প্রশ্ন করলো, ‘ পূর্ণা গতকাল বেরিয়ে যাওয়ার পর আবার বাড়িতে আসছিল?’

মুত্তালিব কোনো রকম দ্বিধা ছাড়া মিথ্যা বললেন, ‘ না আহে নাই তো।’

পদ্মজা থমকায়। এতক্ষণ ভেবেছিল,পূর্ণা বোধহয় আমিরের হাতে বন্দি আছে। কিন্তু পূর্ণা নাকি আসেইনি! আমির বাইরে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা মিনিটের পর মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। পূর্ণার পরিয়ে দেয়া কালো শাড়িটা এখনো তার গায়ে জড়িয়ে আছে। লতিফা ও রিনু পদ্মজার পিছনে এসে দাঁড়ায়। তখন গেইটের ভেতর এসে প্রবেশ করে বিপর্যস্ত প্রান্ত। সে সঙ্গে নিয়ে এসেছে পদ্মজার জন্য মৃত্যুর সংবাদ।

হেমলতার হাতে বানানো শীতল পাটির উপর শুয়ে আছে পূর্ণা। পা থেকে গলা অবধি চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা। পদ্মজা মোড়ল বাড়িতে পা রাখতেই সবাই তার দিকে তাকালো৷ মানুষের ভীড় জমেছে। নোয়াপাড়ার গরীব ঘরের এক ছোট মেয়ে প্রতিদিন ভোরে রান্নার জন্য শুকনো পাতা কুড়ায়। বস্তা ভরে শুকনো পাতা নিয়ে বাড়ি ফেরে৷ সঙ্গে থাকে তার ছোট ভাই। দুজন মিলে নিত্যদিনের মতো আজও পাতা কুড়াতে বের হয়েছিল। ঝোপঝাড়ে ছনের স্তূপ দেখে তারা খুব অবাক হয়। রান্নার কাজে ছন খুব ভালো কাজ করে। তারা ছন সংগ্রহ করতে গিয়ে একটা ভারী বস্তা আবিষ্কার করে। বস্তার মুখ খুলে দুজনই ভয় পেয়ে যায়। দৌড়ে পালিয়ে যায়। এই ঘটনা গ্রামে ছড়িয়ে দেয়। গ্রামের কয়েকজন পূর্ণাকে চিহ্নিত করে। তারপর নিয়ে আসে আটপাড়ায়। পূর্ণার লাশ মোড়ল বাড়িতে নিয়ে আসতে আসতে পুরো গ্রাম পূর্ণার মৃত্যুর খবর জেনে যায়।

মোড়ল বাড়িতে কত রকম মানুষ উপস্থিত হয়েছে। তাও পদ্মজার কাছে চারপাশ জনমানবহীন লাগছে৷ তার চোখ শুষ্ক। প্রেমা বুক ফাটিয়ে কাঁদছে। কাঁদছে বাসন্তী ও প্রান্ত। তারা পারলে জোর করে পূর্ণাকে জাগিয়ে তুলে। পদ্মজা ধীরপায়ে পূর্ণার মাথার কাছে এসে বসলো। পূর্ণার আঁচড় কাটা মুখটা জুড়ে গুচ্ছ,গুচ্ছ মায়া। পদ্মজা এক হাতে ছুঁয়ে দেয় পূর্ণার মুখ। তারপর মৃদুস্বরে ডাকলো, ‘ পূর্ণা? পূর্ণারে….

পূর্ণা সাড়া দেয় না। সে এখন মৃত একটি লাশ মাত্র। যে কিছুক্ষণের মধ্যে মাটির নিচে চিরজীবনের জন্য চলে যাবে। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখলো। তাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। পদ্মজা চারিদিকে তাকিয়েও কোনো মানুষ দেখতে পেল না! অথচ তার চারপাশে মানুষজনের মেলা বসেছে! পদ্মজা পূর্ণার এক হাত মুঠোর নিয়ে চুমু দিল। পূর্ণার আঙুলে চুল প্যাঁচানো। পদ্মজা সময় নিয়ে চুল থেকে পূর্ণার আঙুল মুক্ত করলো। অনেক লম্বা একটা চুল! মেয়ে মানুষের চুল। পূর্ণা মৃত্যুর পূর্বে কোনো মেয়ের চুল টেনে ধরেছিল তা স্পষ্ট! পদ্মজা পূর্ণার কপালে চুমু দিল। তারপর আবার আদুরে স্বরে ডাকলো, ‘ পূর্ণা?বোন আমার। তোর আপা ডাকছে…তোর পদ্মজা আপা।’

পূর্ণা আর সাড়া দিবে না…কোনোদিন দিবে না! তার দুরন্তপনা জীবনের জন্য থেমে গেছে। পদ্মজা বিশ্বাস করতে পারছে না! সে অস্থির হয়ে উঠে। একটু দূরে সরে বসে। তার নিঃশ্বাস এলোমেলো এবং ভারী। বুকের ভেতর তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে৷ তার মস্তিষ্কের স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। সে হামাগুড়ি দিয়ে আরেকটু দূরে সরে যায়। মাথায় হাত দিয়ে বসে। তারপর আরেকটু দূরে সরে যায়! এভাবে যেতে যেতে অনেক দূরে চলে যায়। মানুষ তাকে হা করে দেখছে। কিছুক্ষণ দূরে বসে থেকে চট করে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুতপায়ে পূর্ণার কাছে আসে। পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চারপাশ দেখলো। কী অদ্ভুত! সে এখনো কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। শুধু বাসন্তী, প্রেমা ও প্রান্তকে দেখছে। আর দেখছে ঘুমন্ত পূর্ণাকে। পদ্মজা পূর্ণার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ আমার সুন্দর চাঁদ,আজ তোর বিয়ে। মৃদুল…মৃদুল ভাই কোথায়? সে কি আসেনি?’

পদ্মজা চারপাশে চোখ বুলিয়ে মৃদুলকে খুঁজলো। যখন সে মৃদুলকে খুঁজতে লাগলো তখন তার চোখে পড়লো,অনেক অনেক মানুষ এসেছে। এতো মানুষ কখন এলো? মৃদুল কোথায়? পদ্মজা মৃদুলকে খুঁজতে উঠে দাঁড়ায়। মানুষের ভীড়ে ঢুকে সে মৃদুলকে খুঁজতে থাকে। আমির দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুক ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সে এলোমেলো হয়ে যাওয়া পদ্মজাকে দেখছে। পদ্মজা বুকের ভেতর যে সহ্য ক্ষমতা পুষে রেখেছিল, আজ সেটা ধ্বংস হয়ে গেছে৷ এই মুহূর্তে পদ্মজা নিজের মধ্যে নেই৷ একটুও কাঁদছে না। আমিরের ইচ্ছে হচ্ছে,পদ্মজাকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে। যেন সে হাউমাউ করে কাঁদতে পারে। কিন্তু সেই ইচ্ছে প্রকাশের দুঃসাহস আমিরের নেই। সে এগিয়ে এসে পূর্ণার মুখের দিকে তাকালো। পূর্ণা খুন হয়েছে শুনে,আমির রিদওয়ান,খলিল আর মজিদকে সন্দেহ করেছিল। কিন্তু আমিরের জানামতে, এরা এতো বড় ভুল করবে না। তারা কখনো ঝোপঝাড়ে লাশ ফেলবে না। তারা নদীতে ভাসিয়ে দেয়,যাতে প্রমাণ মুছে যায়। কিন্তু পূর্ণার শরীরে এখন অগণিত প্রমাণ পাওয়া যাবে। একজন কুখ্যাত অপরাধী হিসেবে আমির নিশ্চিত, এমন বোকামি একমাত্র প্রথম খুন করা কেউই করবে। অথবা যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে লাশ গুম করার,সে বোকা! অলন্দপুরে তারা ছাড়া আর কে হতে পারে? বাসন্তীর হাতের নাড়াচাড়ায় পূর্ণার পায়ের চাদর সরে যায়। তার এক পায়ের নুপুর দেখে আমিরের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে! সঙ্গে সঙ্গে সে রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো। তার চোখের রং পাল্টে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। এবার সে নিশ্চিত এই কাজ কারা করেছে! আমির দ্রুতপায়ে সবার অগোচরে মোড়ল বাড়ি ছাড়লো। তার গন্তব্য আজিদের বাড়ি।

মৃদুল! সে আজ বেজায় খুশি। ট্রলার নিয়ে এসেছে বউ নিতে। সাথে এসেছে মা-বাবাসহ আত্মীয়স্বজন। গতকাল তার আসার কথা ছিল। কিন্তু আসতে পারেনি। জুলেখা প্রথম রাজি হোননি। যখন দেখলেন মৃদুল সত্যি তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন তিনি হার মানলেন। বললেন,তিনি এই বিয়েতে রাজি। তিনি ছেলের বিয়েতে থাকতে চান। আর কাছের কয়েজনকে নিয়ে তারপর বউ আনতে যেতে চান। আত্মীয়দের নিয়ে তৈরি হতে হতে রাত হয়ে যায়। তারপর নিজেদের ট্রলার নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বিয়ের উদ্দেশ্যে। জুলেখা এখনো গাল ফুলিয়ে বসে আছেন। তিনি মন থেকে এই বিয়েতে রাজি নন। মৃদুলের তাতে যায় আসে না,তার মা-বাবা বিয়েতে থাকছে এটাই অনেক। আটপাড়ার খালে এসে ট্রলার থামে। খাল থেকে পূর্ণাদের বাড়ি যেতে মিনিট পাঁচেক লাগে। উত্তেজনায় মৃদুলের বুক কাঁপছে। তার ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। যেকোনো কথায় সে হাসছে। ট্রলার থেকে নামার সময় একটা কালো ব্যাগ হাতে তুলে নেয়। মৃদুলকে ব্যাগ নিতে দেখে তার এক ভাই বললো, ‘ আরে ব্যাঠা, ব্যাগ আমার কাছে দে। তুই জামাই মানুষ।’

মৃদুল দিতে রাজি হলো না। এই ব্যাগে থাকা প্রতিটি জিনিস লাল। সে নিজে পূর্ণার জন্য পছন্দ করে কিনেছে। ব্যাগের সবকিছু দিয়ে আজ পূর্ণা সাজবে। সে নিজের হাতে এই ব্যাগ পূর্ণার হাতে দিতে চায়। মৃদুল নাছোড়বান্দা। তার ভাই তার সাথে তর্ক করে পারলো না। মৃদুল খুশির জোয়ারে ভাসছে। সে সবার আগে আগে হেঁটে যায়। মিনিট দুয়েক হাঁটার পর মোড়ল বাড়ির সামনে সে ভীড় দেখতে পেল। মৃদুল অবাক হলো। গ্রামবাসীকে দাওয়াত দেয়া হলো নাকি? নিজে নিজে উত্তর খুঁজে নিল। দাওয়াতই হবে। পূর্ণা কতো পাগল! মৃদুল হাসলো। কিন্তু সেই হাসি মিলিয়ে গেল বাড়ির কাছাকাছি এসে। বাড়ি থেকে কান্নার স্বর ভেসে আসছে। জুলেখা বললেন, ‘ বাড়ির ভিতরে কান্দাকাটি হইতাছে না?’

মৃদুল চুপসে গেল। মনে মনে প্রশ্ন করলো, পদ্মজা ভাবির সাথে আবার কিছু হলো নাকি? সে দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে। মানুষজনকে ঠেলেঠুলে পূর্ণার লাশের সামনে এসে দাঁড়ায়। পূর্ণার লাশ দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। খুশিতে মাথা নষ্ট হয়ে গেল নাকি? চোখ কীসব দেখছে! মৃদুল আবার চোখ খুললো। পূর্ণাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখলো। পূর্ণার পায়ে এখনো আলতা লেগে আছে। কাদামাখা লাল টুকটুকে দুটো পা। এই পায়ে হেঁটে দৌড়ে তার কাছে আসার কথা ছিল না? অথচ কেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে পূর্ণা! মৃদুল তার হাতের ব্যাগটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। পূর্ণার মাথার কাছে চলে আসে। পূর্ণার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে ছলছল চোখে সবার দিকে তাকায়। বাসন্তী মৃদুলকে দেখে আরো জোরে কাঁদতে থাকলেন। ঘটনাটা বুঝতে মৃদুলের অনেক সময় লাগে। সে পূর্ণার গালে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে পূর্ণাকে ডাকলো। ভালোবাসার মানুষের সাথে সংসার করার আশায় পবিত্র মিলনের আকাঙ্ক্ষায় সে ছুটে এসেছে। কিন্তু সে মানুষটি নাকি মৃত! মৃদুল অবাক চোখে তার মা-বাবার দিকে তাকায়। কেমন স্বপ্ন লাগছে সব! পুলিশ এসে ভীড় কমিয়ে দেয়। লাশের আশপাশ থেকে সবাইকে সরে যেতে বলে। মৃদুল বোকা বোকা চোখে পুলিশদের দিকে তাকায়। একজন পুলিশ তার বাহু ধরে সরে যেতে বললে,মৃদুল পূর্ণাকে অনুরোধ করে বললো, ‘ পূর্ণা,এই পূর্ণা। উঠো। আমার শেষ কথাটা রাখো। উঠো তুমি। আমি তোমারে নিয়া যাইতে আইছি।’

মৃদুল দ্রুত ব্যাগের চেইন খুললো। তার হাত কাঁপছে। এসব কী হলো? কেন হলো? পৃথিবীটা এরকম করে ভেঙে যাচ্ছে কেন? বুকের ভেতর কীসের এতো শব্দ? সে ব্যাগ থেকে লাল টুকটুকে বেনারসি বের করলো। তারপর সেই বেনারসি পূর্ণার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে পূর্ণাকে বললো, ‘আমরা যে ঘরে সংসার পাতাম সেই ঘর আমি সাজায়া আইছি পূর্ণা। সুন্দর কইরা সাজায়া আইছি।’

পুলিশ তাড়া দিচ্ছে। কেউ ছোঁয়ার আগে লাশ তারা নিয়ে যাবে পরীক্ষার জন্য৷ খুন হওয়া লাশ ছোঁয়ার অনুমতি নেই। কিন্তু মৃদুল জাপটে ধরে রেখেছে পূর্ণাকে। পদ্মজা দূরে বসে আছে। হাঁটুতে থুতুনি ঠেকিয়ে মৃদুলকে দেখছে। তার ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। যেন সত্যি মৃদুল বিয়ে করতে এসেছে! আর বিয়ে হচ্ছে। মানুষগুলো একবার পদ্মজাকে দেখছে আরেকবার মৃদুলকে! মৃদুলের বাবা মৃদুলকে বলে পূর্ণাকে ছেড়ে দিতে। মৃদুল আরো শক্ত করে ধরে। সে বিড়বিড় করছে। পূর্ণাকে কানে কানে কিছু বলছে।যখন দুজন লোক মৃদুলকে টেনে তুলতে নিল,মৃদুল চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, ‘ পূর্ণা…আমার পূর্ণা। তুমি উঠো না কেন? আম্মা…আম্মা তুমি কই? আম্মা চুড়ি বাইর করো,আলতা বাইর করো আরো কি কি আছে না? সব বাইর করো আম্মা। পূর্ণারে সাজাইবা সবাই। আমি বিয়া করব আম্মা। আম্মা…আম্মা পূর্ণারে উঠতে কও। আম্মা ওরে কারা মারছে? আম্মা. ‘

মৃদুলের পাগলামি দেখে ভড়কে যান জুলেখা। এতোবড় ছেলে কেমন হাউমাউ করে কাঁদছে! তিনি দৌড়ে মৃদুলের পাশে আসেন। মৃদুল জুলেখার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আম্মা মরা মানুষরে বিয়া করা যায় না? আমারে বিয়া দেও আম্মা। তারপর একলগে কবর দেও। আমি ওরে ছাড়া কেমনে থাকুম আম্মা?’

মৃদুল পূর্ণাকে বেনারসি দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলে। তাকে মানুষজন খামচে ধরেও আটকাতে পারছে না। সে পূর্ণাকে শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে। তার দুই হাত টেনে ছোটাতে চেষ্টা করে সবাই। কিন্তু পারছে না। মৃদুল কিছুতেই পূর্ণাকে ছাড়বে না। আকাশের মালিক যেন নিজ দায়িত্বে মৃদুলের উপর শক্তির ভান্ডারের সব শক্তি ঢেলে দিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে,লাশ পঁচে যাবে। তদন্তও ঠিকঠাক হবে না। একজন পুলিশ হাতের লাঠি দিয়ে মৃদুলের পিঠে আঘাত করলো। মৃদুল তাও তার কাজে অটল থাকে। সে হাউমাউ করে কাঁদছে। পূর্ণাকে চিৎকার করে ডাকছে। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। সে পূর্ণার মাথায় চুমু দিয়ে পূর্ণাকে বললো, ‘ কবুল,কবুল,কবুল। আমি কবুল কইছি পূর্ণা। তুমি কও। সবাই হুনছে আমি কইছি। সবাই হুনছেন না? এহন তুমি কও। পূর্ণা…আমারে এতো বড় শাস্তি দিও না পূর্ণা৷ আমারেও সাথে নিয়া যাও।’

মৃদুল মানুষজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আমারেও সবাই কবর দেন। পূর্ণার লগে কবর দেন। দিবেন আপনেরা? আমি কবুল কইছি না? অর্ধেক বিয়াতো হইয়া গেছে। হইছে না?’

মৃদুল কাঁদতে কাঁদতে হাসলো। জুলেখা কান্না শুরু করেছেন। মৃদুলের এমন পাগলামি তিনি সহ্য করতে পারছেন না। ছেলেটা পাগল হয়ে গেল নাকি? তার কলিজার টুকরা এমন করে কাঁদছে কেন! কীসের অভাব তার! নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তিনি মৃদুলকে সুখী দেখতে চান। তিনি মনে মনে চাইছেন,অলৌকিক কিছু হউক,মেয়েটা জেগে উঠুক। মৃদুল হাসুক! মৃদুলের পিঠ ছিঁড়ে যাচ্ছে আঘাতে-আঘাতে। তারা সবাই উন্মাদ এক প্রেমিককে আঘাত করছে যেন পূর্ণাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু মৃদুল তো ছাড়বে না। সে কিছুতেই ছাড়বে না। মৃদুল পূর্ণার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো ‘এই কালি? কালি কইছি তো। গুসা করো…গুসা করো আমার সাথে। গালি দেও আমারে। ও পূর্ণা…ও ভ্রমর। চাইয়া দেহো একবার। আসমানের পরী তুমি…সবচেয়ে সুন্দর মুখ তোমার। হাসো পূর্ণা। হাসো।’

বেশ অনেকক্ষণ ধ্বস্তাধস্তির পর মৃদুলের থেকে পূর্ণাকে সরানো যায়। মৃদুল বন্দী পাখির মতো ছটফট করছে। সে পায়ে মাটি খুঁড়ছে। সবাইকে অনুরোধ করছে তাকে ছেড়ে দিতে। চিৎকার করার কারণে মৃদুলের গলার রগ ফুলে লাল হয়ে গেছে। মানুষের টানাহেঁচড়ায় তার পরনের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গেছে। নিজের অজান্তে এক শ্যামকন্যার প্রেমে উন্মাদ হয়ে ত্যাগ করে সে সর্বসুখ! ত্যাগ করে সকল প্রকার চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন-আশা! এমনও হয়?

৮৯

আকস্মিক থাপ্পড়ে রিদওয়ানের ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠে প্রচণ্ড আক্রোশে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষোভ আড়াল করে। মজিদ হাওলাদার টেবিলে থাপ্পড় দিয়ে চাপাস্বরে বললেন, ‘ এমন বোকামি কী করে করলি? এখন কে বাঁচাবে?’

রিদওয়ান মাথা নত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। পূর্ণার খবরটা শোনার পর থেকে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে গেছে। পূর্ণার শরীরে অগণিত প্রমাণ রয়েছে যা রিদওয়ানের জন্য বিপদজনক। মুত্তালিব যেখানে সেখানে ফেলে চলে আসবে জানলে সে এই দায়িত্ব দিত না। কিন্তু যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। এখন তাকে একমাত্র মজিদ বাঁচাতে পারেন। খলিল মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো, ‘ ভাইজান,ও বুঝে নাই। না বুইঝা কইরা ফেলছে।’

মজিদ চেয়ারে বসলেন। জগ থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে বললেন, ‘ যা করেছে করেছেই! কিন্তু শেষে কী বোকামিটা করলো! লাশ কেউ ঝোপে ফেলে আসে?’

রিদওয়ান মুখ খুললো, ‘ আমি মুত্তালিব কাকারে বলছিলাম,লাশটা আজমপুর হাওড়ে ফেলে আসতে।’

রিদওয়ানের কথা যেন আগুনে ঘি ঢাললো। মজিদ উঠে দাঁড়ান। রিদওয়ানের পিঠে একনাগাড়ে কয়টা থাপ্পড় বসিয়ে খিটখিট করে বললেন, ‘ তুই চুপ থাক হারামজাদা!’

রিদওয়ানের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। মজিদ খলিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখন এখানে বসে থাকবি? নাকি আমার সাথে যাবি?’

খলিল চট করে উঠে দাঁড়ালেন। মজিদ মাথার টুপিটা ঠিক করে রিদওয়ানকে বললেন, ‘ তুইও আয় সাথে।’

রিদওয়ান পথ আটকে বললো, ‘ কাকা,একটা কথা ছিল।’

‘আবার কী বলবি তুই?’

‘গতকাল রাতে ভাঙা ফটকের বাইরে ইয়াকুব আলী আর তার ছেলেকে দেখছি।’

মজিদের চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ইয়াকুব আলী শিক্ষিত মার্জিত একজন ব্যক্তি। যিনি ইসলামের আদর্শে চলাফেরা করেন। নিজের সর্বত্র বিলিয়ে দেন গরীব-দুঃখীদের। কিন্তু মজিদকে টেক্কা দিয়ে মাতব্বরি পদটা ছিনিয়ে নিতে পারেননি। তবে তিনি ক্ষমতাবান ব্যক্তি। মজিদের সামনে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা তার আছে। গত চার বছর ধরে এই মহান ব্যক্তির মুখোমুখি মজিদকে হতে হচ্ছে। চার বছর আগে ইয়াকুব আলী সৌদিতে ছিলেন। সৌদি থেকে এসেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জনসেবা করবেন। এই লোক তার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে মানে তো,বিপদজনক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ মজিদ আন্দাজ করে নিলেন,সেদিনের সমাবেশের ঘটনা থেকে ইয়াকুব আলীর কিছু সন্দেহ হয়েছে। তিনি রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললেন, ‘ বিপদের জাল চারিদিকে, তার মধ্যে তুই আবার আরেক অঘটন ঘটালি!’

রিদওয়ান প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, ‘ আপনি পূর্ণার ব্যাপারটা সামলান। আমি বাকিগুলো সামলে নেব।’

রিদওয়ানের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ মজিদের গায়ে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি কটাক্ষ করে বললেন, ‘তুই আমার বা* করবি!’

অপমানে রিদওয়ানের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। সে খলিলের দিকে তাকায়। খলিল চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। মজিদ রাগে ফুঁসছেন। তিনি মেঝেতে থুথু ফেলে বেরিয়ে পড়লেন। মজিদের সাথে খলিলও বেরিয়ে গেলেন। রিদওয়ান অনেকক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর জগের পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়ল। রিনু আলগ ঘর ছেড়ে দৌড়ে অন্দরমহলে চলে আসে। সে আলগ ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়েছিল। তারপরই মজিদ,খলিল ও রিদওয়ানের কথা শুনেছে। বাড়িতে আমিনা আর আলো আছে। লতিফা পদ্মজার সাথে গিয়েছে। রিনু রান্নাঘরে এসে চার-পাঁচ গ্লাস পানি খেল। তার বুক কাঁপছে। সে বাকহারা! পূর্ণাকে রিদওয়ান আর খলিল খুন করেছে! এটা শুনে তার মাথা ভনভন করছে।

আজিদের বাড়ির আঙিনা শূন্য! কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আমির চারপাশে চোখ বুলিয়ে সোজা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। আসমানি হঠাৎ আমিরকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সে নিজেকে ধাতস্থ করার পূর্বে আমির তার গলা চেপে ধরলো। আসমানি আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব। সে দ্রুত আমিরের হাত চেপে ধরে। আমির দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘ একটা মিথ্যা বললে,সোজা নরকে পাঠিয়ে দেব মা* ঝি।’

আসমানির নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। এক্ষুনি বুঝি দম বেরিয়ে যাবে! তার মুখ দিয়ে ঘ্যারঘ্যার জাতীয় শব্দ বেরিয়ে আসে৷ আমির আসমানির হাঁটুতে লাথি দিয়ে আসমানিকে মাটিতে ফেলে দেয়,তারপর চুলের মুঠি ধরে শক্ত করে। আসমানি কাশতে থাকে। হৃৎপিণ্ড আরেকটু হলে ফেটে যেত৷ শ্বাসনালী ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে আসতো! তার মনে হচ্ছে,সে নতুন জীবন পেয়েছে। আসমানি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। রাগে আমিরের কপালের রগ ভেসে উঠেছে। পারলে সে আসমানিকে পিষে ফেলে! আমির গলার আওয়াজ নীচু করে বললো, ‘ পূর্ণার সাথে কী হয়েছিল?’

আসমানির চোখ দুটি বড় বড় হয়ে যায়৷ সে আমিরকে যতটুকু চিনে গতকালই আন্দাজ করতে পেরেছিল,আমির দ্রুত সব ধরে ফেলবে। কিন্তু এতো দ্রুত ধরে ফেলবে ভাবেনি। আসমানি কথা বলার জন্য উদ্যত হলো তখন আমির হুমকি দিল, ‘ একটা অক্ষর মিথ্যে বললে এখানেই পুঁতে যাবো। সত্য বলার সুযোগ দেব না।’

আমিরের কথা শুনে ভয় পেয়ে যায় আসমানি। দুই বছর আগের কথা, তাদের দলের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। আমির সেই বিশ্বাসঘাতককে যেখানে ধরেছিল সেখানেই মাটি খুঁড়ে পুঁতে এসেছিল! আসমানি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ‘ চুল ছাড়ো। কইতাছি।’

আমির আরো শক্ত করে ধরে। আসমানি আর্তনাদ করে উঠলো। সে যত সময় নিবে তত বেশি অত্যাচারিত হবে। তাই দ্রুত সব বলে দিল। আমির আসমানিকে ছেড়ে দেয়। ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ান মালেহা বানু। তিনি আজিদের মা এবং আসমানির শ্বাশুড়ি। আমির চলে যেতে উঠে দাঁড়ায়। আসমানি তড়িৎ গতিতে বলে উঠলো, ‘ কিছু খাইয়া যাও।’

আমির শুনেও না শোনার ভান করে মালেহা বানুর পাশ কাটিয়ে চলে গেল৷ মালেহা বানু অবাক চোখে আসমানিকে দেখছেন।মাতব্বরের ছেলে তার ছেলের বউকে মারলো কেন? তিনি প্রশ্ন করতে গিয়েও করলেন না। তীব্র কৌতূহল চাপা দিয়ে দরজা ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। শফিক আমিরের হাতে খুন হওয়ার পর মালেহা বানু অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি জানেন শফিক নিখোঁজ। আসমানি এবং আজিদ শফিকের পরিণতি জানে। তারা কেউ শফিককে হারিয়ে একটুও ব্যথিত নয়। পাপের রাজত্বে প্রয়োজনে সহযোগী পাওয়া যায়, আপনজন নয়! মালেহা বানু এ সম্পর্কিত কিছুই জানেন না। তিনি সবসময় নীরব। পাড়া ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। দুই ছেলে অর্থ উপার্জন করছে এইতো অনেক! তিনি রানীর মতো আছেন। আর কী লাগে? তার রাগটা আসমানির উপর। আসমানির সাথে শফিকের দৃষ্টিকটু ঘেষাঘেষি তিনি অনেকবার দেখেছেন! এ নিয়ে কথা শুনাতে গেলে,শফিক ও আজিদ দুজনই ক্রুদ্ধ হতো! তাই তিনি অনেকদিন হলো আসমানির সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছেন।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আজিদের সাথে দেখা হয়। আজিদ আমিরকে দেখে বললো, ‘হুনলাম,পূর্ণা নাকি খুন অইছে?’

আমির উত্তর দিল না। সে আজিদকে এড়িয়ে যায়। আজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে আমিরের উপর কটমট করে তাকায়। সে তার বড় ভাই শফিকের কথা শুনে এদের সাথে যুক্ত হয়েছিল। সেখানে দেখা হয় আসমানির সাথে। আসমানি সুন্দরী। রূপের ঝলকে পুরুষ মানুষকে কাত করার ক্ষমতা তার আছে। আজিদ মাঝেমধ্যে পাতালে যেত তাও আসমানির সাথে সময় কাটানোর জন্য৷ আসমানি একাধারে পাতালের প্রতিটি পুরুষের সাথে রাত কাটাত। আজিদ প্রথম অবাক হয়েছিল,একটা মেয়ে কী করে এতোটা খারাপ হতে পারে? তারপর অবশ্য জেনেছে,আসমানি তার জন্মদাত্রীর মতো হয়েছে। আমিরের দাদি নূরজাহানের সঙ্গী হিসেবে তার একজন বান্ধবী ছিল৷ সেই বান্দবীর মেয়ে আসমানি। মায়ের পেশা মেয়ে পেয়েছে! আসমানি ষোল বছর বয়স থেকেই তার গ্রামে কু-কীর্তি করে বেরিয়েছে। গ্রামের সালিশে যখন তাকে গ্রাম থেকে বের করে দিল,তখন মজিদ হাওলাদার আর আমির হাওলাদার আসমানিকে আজিদের গলায় ঝুলিয়ে দিল। আজিদ এমন একটা মেয়েকে বউ হিসেবে গ্রহণ করতে সংকোচ করেছিল৷ কিন্তু তার বড় ভাই বিয়েটা সমর্থন করে। এখানে আজিদের আর কিছু বলার ছিল না। সে আসমানিকে বিয়ে করে। তবে ইদানীং একটা বাচ্চার জন্য আজিদের মন কাঁদে। আসমানির কখনো বাচ্চা হলে সে মানতে পারবে না,এই বাচ্চা তার। এ নিয়ে সে যন্ত্রণায় আছে। মনে মনে হাওলাদার বাড়ি আর মৃত শফিকের উপর ক্ষিপ্ত সে। গত কয়দিন ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে,মজিদের অনুমতি নিয়ে সে আরেকটা বিয়ে করবে। আজিদ সোজা কলপাড়ে চলে আসে। আজ বিকেলে তাকে রওনা হতে হবে। মালেহা বানুর অসুস্থতা বেড়েছে। শহরের ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

——

তখন সময় বোধহয় রাত নয়টা৷ আমির অন্দরমহলে না গিয়ে সোজা আলগ ঘরে প্রবেশ করলো। গাঢ় অন্ধকারে আলগ ঘর ডুবে আছে। চারিদিক এতটাই নির্জন যে,মনে হচ্ছে মৃত্যু নেমে এসেছে চারিদিকে। খলিল-মজিদ বাড়িতে নেই। তারা লোক দেখানো ভালোমানুষিতে ব্যস্ত৷ দুজনে মোড়ল বাড়ির অভিভাবক হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমির জানে,তারা প্রমাণ লুটপাটে ব্যস্ত। প্রমাণ নষ্ট করা তাদের বাঁ হাতের কাজ! আমির বিছানা হাতড়ে বালিশের নিচ থেকে দিয়াশলাই বের করে হারিকেন জ্বালাল। মগা বিকেলে বেরিয়ে গেছে। তাই আলগ ঘরে সুনসান নীরবতা। নয়তো অন্যবার মগার নাক ডাকার শব্দে আলগ ঘরে টেকা যায় না।

আমির তার খয়েরী শার্টের পকেট থেকে একটা লাল ছোট খাম বের করলো। তারপর হারিকেনের সামনে বসলো। পাশের ঘরে ধপ করে শব্দ হয়। আমির সে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো,বিড়াল ছোটাছুটি করছে। নিশ্চয়ই ইদুর দেখেছে! সে হারিকেন নিভিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। লাল খামটি পায়জামার পকেটে রাখে। অন্দরমহলের চারপাশ ঘিরে জোনাকি পোকারা অনর্থক গল্প করে যাচ্ছে। আমির জোনাকিপোকাদের ভীড়ে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। আজকের দিনটা অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল! কিছুটা সুন্দর কিছুটা দুঃখের! অথচ সবটাই শব্দহীন। আমির কিছু একটা ভেবে অন্দরমহলে প্রবেশ করে। লতিফা আমিরকে দেখে দৌড়ে এসে পথ আটকে বললো, ‘ ভাইজান,পদ্মর কী হইলো বুঝতাছি না। কথাবাতা কয় না।’

লতিফা চিন্তিত। আমির প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, ‘ আমি থাকব এখানে। তুই রান্না বসা।’

কথা শেষ করে উপরে উঠে গেল আমির। লতিফা রান্নাঘরে চলে যায়। আমির আজ পদ্মজার সাথে থাকবে শুনে সে কেন জানি খুব খুশি হলো! পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল,আমির সারাক্ষণ ঘরের ভেতর আঠার মতো লেগে থাকতো। না নিজে বের হতো আর না পদ্মজাকে বের হতে দিতো! এ নিয়ে ফরিনা,রানি,নূরজাহান ও আমিনার কত কথা ছিল! লতিফার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। অতীত এতো সুন্দর কেন হয়?

দ্বিতীয় তলায় উঠতেই আমিরের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে। বারান্দা জুড়ে উত্তুরে হাওয়া বইছে। আকাশের তারা ও অর্ধচন্দ্রের আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। এমন একটা পরিবেশে মিনমিনিয়ে কেউ কাঁদছে । বড্ড অচেনা এই কান্না! যেন কোনো অশরীরী শত জনমের দুঃখ একসাথে মনে করে কাঁদছে! আমির দ্রুত পায়ে পদ্মজার ঘরে আসে। ঘরের প্রতিটি কোণা অন্ধকারে তলিয়ে আছে। বাতাসে একটা ভারী কান্না ভেসে বেড়াচ্ছে। আমির আন্দাজে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো। বিছানার পাশে একটা টেবিল আছে। সে টেবিলে হারিকেন থাকে আর ড্রয়ারে থাকে দিয়াশলাই। আমির দিয়াশলাই বের করে হারিকেন জ্বালাল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো,দেয়াল ঘেঁষে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে পদ্মজা। সে কাঁদছে! কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার করুণ কান্না এসে আমিরের বুক ভিজিয়ে দেয়। ও বাড়ির অবস্থা ভালো নেই। প্রেমার গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। বাসন্তী পড়েছেন বড় কষ্টে! একদিকে পূর্ণার সমাপ্তি অন্যদিকে প্রেমার গা কাঁপানো জ্বর! মৃদুলের গলা ভেঙে গেছে,বড্ড এলোমেলো হয়ে গেছে সে। বাবা-মায়ের বড় আদরের একমাত্র ছেলে। কখনো মায়ের হাতে মার খেয়েছে কিনা সন্দেহ! তার প্রাপ্তির খাতা সবসময় পরিপূর্ণ ছিল। সে কখনো কষ্টে কাঁদেনি,বাস্তবতা দেখেনি। সোনার চামচে খেয়ে বড় হওয়া আহ্লাদী আদুরে ছেলে! তার জন্য এই ধাক্কাটা মৃত্যুর মতো! সে স্বাভাবিক হতে কত সময় নিবে কে জানে! অথচ সবকিছু ছেড়ে পদ্মজা অন্দরমহলে চলে এসেছে। তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এক জায়গায় সারাক্ষণ বসে ছিল। তারপর হুট করেই অন্দরমহলে চলে আসে। সাথে খন্ড খন্ড মেঘ আষাঢ়ী দুই চোখে জড়ো করে নিয়ে আসে।

আমির কথা বলার জন্য যখন উদ্যত হলো সে টের পেলো তার হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়ছে! এমন কেন হয়? পদ্মজা কোন আসমানের চাঁদ যে তাকে ছোঁয়ার কথা ভাবলেই আমিরের গলা শুকিয়ে আসে! কয়দিনের দূরত্বে, মানুষটার চোখের দিকে তাকাতেও সংকোচ হচ্ছে! অথচ,ফেলে আসা দীর্ঘ ছয় বছরের প্রতিটি রাত দুজন দুজনের বুকের সাথে লেপ্টে কাটিয়েছে। কত উছলে পড়া জ্যোৎস্না রাতে তারা ভালোবাসার গল্প রচনা করেছে! আমির রয়ে সয়ে বললো, ‘ চলে এলে কেন?’

পদ্মজা মাথা তুলে তাকালো। পদ্মজার চোখের দৃষ্টিতে আমির এলোমেলো হয়ে গেল। বুক প্রবলভাবে কাঁপতে থাকলো। পদ্মজার দৃষ্টির জাল আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে তাকে। সে বিছানার উপর বসলো। বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অথচ পদ্মজা নির্লিপ্ত। পদ্মজার নাকের নাকফুলটা জ্বলজ্বল করছে। নাকফুলটি বিয়ের পর আমির পরিয়ে দিয়েছিল। নাকফুলে গেঁথে দিয়েছিল জনম জনমের ভালোবাসা। অথচ,এখন সেই ভালোবাসা বিষের দাঁনার মতো রূপ নিয়েছে! পদ্মজা এক হাতে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ‘ আমি কিছু পেলাম না জীবনে। আব্বার অবহেলা আর নোংরা কথা শুনে কাটিয়েছি ষোলটা বছর। তারপর আমার মা,আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। সে হচ্ছে আরেক বিশ্বাসঘাতক।’

শেষ লাইনটায় ক্ষোভ-অভিমান প্রকাশ পায়। পদ্মজা গলার জোর বাড়িয়ে ‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটি উচ্চারণ করলো। আমির চট করে বললো, ‘ উনি বিশ্বাসঘাতক নন।’

পদ্মজা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো দুই হাতে খামচে ধরে মেঝে। আমিরের দিকে রক্তচোখে তাকায়। তার বুক থেকে আঁচল মেঝেতে পড়ে। সে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে আমিরকে বললো, ‘ করেছে,করেছে। সবকিছুর জন্য আমার মা দায়ী। সব ভুল আমার মায়ের। সে আমাকে জন্ম দিয়েছে। আমাকে আগুনে ঠেলে দিয়ে নিজে চলে গেছে। ছোট থেকে আমাকে বলে এসেছে, সারাজীবন আমার সাথে থাকবে। আমাকে আগলে রাখবেন। যাই হয়ে যাক,সব আমাকে বলবে৷ কিন্তু আম্মা,একটা কথাও রাখেনি। রাখেনি কোনো কথা। প্রতারক,বিশ্বাসঘাতক। সব দোষ আমার মায়ের। সব দোষ…’

পদ্মজা অস্থির হয়ে পড়েছে। তার নিঃশ্বাস এলোমেলো। সে বিপর্যস্ত। কাঁদতে কাঁদতে হুট করে আমিরের দিকে তাকিয়ে সে হাসলো। বললো, ‘ সবাই কী ভেবেছে? আমাকে কষ্ট দিয়ে কাঁদাবে? আমি কাঁদব না। কিছুতেই কাঁদব না।’

কাঁদব না বলেও আবার কাঁদতে শুরু করলো। কষ্টের মাত্রা পেরিয়ে গেলে,মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সে তার জীবনের ছোট ঘটনাগুলোকে বড় করে ভাবতে থাকে।সারাক্ষণ বিলাপ করে আর কাঁদে। পদ্মজার অবস্থা এখন ওরকম! সে তার চেনা সত্ত্বা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। পদ্মজার কান্না শুনে আমিরের মাথা ফেটে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে বলতে চাইছে, পদ্মবতী, কান্না থামাও। কান্না থামাও তুমি। আমি সহ্য করতে পারছি না৷ এতো কেন কষ্ট তোমার? তুমি পদ্মবতী নাকি কষ্টবতী?

মনের কথা মনে রয়ে গেল। আমির পারলো না কিছু বলতে। সে বিছানার মাঝে গিয়ে বসলো। দুই হাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে৷ ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেয়। আত্মগ্লানি তাকে গ্রাস করে ফেলেছে৷ সে যেন অদৃশ্য কোনো শেকলে বন্দী। পদ্মজার আর্তনাদ, বিলাপ গুমরে গুমরে কেঁদে ঘরের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমির টের পাচ্ছে! আর টের পাচ্ছে বলেই,মনে হচ্ছে তার মস্তিষ্কে কেউ যেন রড দিয়ে পিটাচ্ছে। সে জানালার বাইরে তাকায়৷ রাতের লক্ষ তারাতেও যেন বেদনার গুঞ্জন। হৃদয়ের শহর খাঁখাঁ করছে। ইচ্ছে হচ্ছে,অন্যবারের মতো পালিয়ে যেতে। কিন্তু আজ সে পালাবে না। সে পালাতে চায় না। তার ভেতরটা তিরতির করে কাঁপছে। মোলায়েম বাতাসের ঝংকারে রগে রগে শিরশির অনুভুতি হচ্ছে। আমির পদ্মজার দিকে তাকায়। নিজের মাথার চুল আরো জোরে টেনে ধরে। পদ্মজা পা ছড়িয়ে বসলো। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজলো। আমির পদ্মজার উপর চোখ রেখে নিজের হাত কামড়ে ধরে। সে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, সে কি নিজের সিদ্ধান্তে অটল? হ্যাঁ/না,/হ্যাঁ/না একটা সিদ্ধান্তের ব্যবধান মাত্র। তাহলেই মনের যুদ্ধের সমাপ্তি! খুব দ্রুত উত্তর আসে হ্যাঁ! মুহূর্তে অদৃশ্য ভারী দেয়াল ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পৃথিবীর সব ফুল জেগে উঠে। শান্ত সমুদ্রের ঢেউ যেন বিকট শব্দ তুলে আছড়ে পড়ে তীরে। আমির বিছানা থেকে নেমে পদ্মজার দুই বাহু চেপে ধরে দাঁড় করায়। পদ্মজা দরজার বাইরে তাকিয়ে আছে। তার বার বার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। একবার পূর্ণাকে দেখছে তো অন্যবার পারিজাকে। দুজনই রক্তাক্ত অবস্থায় তার সামনে আসে। পদ্মজা খামচে ধরে আমিরের চোখমুখ। নখের আঁচড়ে গাল ছিঁড়ে নেয়। আমির তার দুই হাতে পদ্মজাকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। পদ্মজা আবার কান্না শুরু করে।

আমির পদ্মজাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘একটু শান্ত হও…একটু!’

পদ্মজা এতক্ষণ আমিরকে টের পায়নি। এখন টের পাচ্ছে। সে এক ঝটকায় আমিরের হাত দূরে সরিয়ে দেয়। তারপর বিছানার মাঝে গিয়ে বসলো। আমির পদ্মজার সামনে এসে বসে৷ আমিরের মুখটা দেখে মনে পড়ে যায় প্রথম দিনের কথা। যেদিন পাতালে আমিরের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। আমির নগ্ন মেয়েগুলোকে বেল্ট দিয়ে পিটাচ্ছিল! পদ্মজার রক্ত ছলকে উঠে। তার বোনের সাথেও কি এমন হয়েছে? কিছু বুঝে উঠার পূর্বে পদ্মজা আমিরের গলা চেপে ধরলো। আমির হকচকিয়ে গেলেও বাঁধা দিল না। পদ্মজা আমিরের মুখের উপর ঝুঁকে কিছু একটা বিড়বিড় করে। যা অস্পষ্ট। বিড়বিড় করতে করতে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে দুই হাতে আমিরের গলা চেপে ধরে রাখে। আমির গলায় প্রচণ্ড চাপ অনুভব করে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। চোখ বুজতেই যন্ত্রণায় চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। পদ্মজা আমিরের গলা ছেড়ে দিল। দূরে সরে বসলো। আমিরের শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে ফিক করে হেসে দিল। তারপর আবার নীরব হয়ে গেল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে,হেমলতার মৃত মুখ,পারিজারর মৃত মুখ,পূর্ণার মৃত মুখ! পূর্ণা একটা গাছের সামনে বসে কাঁদছে। এইতো তার চেয়ে মাত্র কয়েক দূরেই সেই গাছটা। পারিজা একটা বাড়ির ছাদে বসে আছে। তার গলা থেকে রক্ত ছুঁইয়ে- ছুঁইয়ে পড়ছে! পদ্মজা থম মেরে সেখানে তাকিয়ে রইলো। অদ্ভুত স্বরে কেঁদে উঠলো। আমির নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিল। পদ্মজা কান্না থামিয়ে অবাক চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু দেখছে! আমির পদ্মজার কাছে এসে বসে। পদ্মজার এক হাত মুঠোয় নিয়ে আঙুলগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। পদ্মজার মুখের উপর কয়টা চুল উড়ে বেড়াচ্ছে৷ আমির অবাধ্য চুলগুলোকে পদ্মজার কানে গুঁজে দিল৷ পদ্মজার চোখ,নাক,গাল,ঠোঁট পর্যবেক্ষণ করে আমির উঁকি দিল অতীতে। গল্পটা ভীষণ ব্যক্তিগত। পদ্মজা একবার বিরক্ত হয়ে রাগী স্বরে বলেছিল, ‘আরেকটা চুমু দিলে আমি বাড়ি ছেড়ে কিন্তু চলে যাব।’

আমির পদ্মজার কথায় থমকে যায়। তখন ঢাকায় নতুন নতুন তাদের সংসার। পদ্মজা ভার্সিটিতে পড়ছে। আগামীকাল তার পরীক্ষা তাই সে পড়ছিল। কিন্তু আমির সেদিন বাড়িতে ছিল। আর সারাক্ষণ পদ্মজাকে বিরক্ত করে যাচ্ছিল। পদ্মজার মুখের সামনে গিয়ে একবার নাকে চুমু দেয় তো আরেকবার গালে। বারংবার পদ্মজা পড়ার খেই হারিয়ে ফেলছিল। সে ভীষণ রেগে যায়। আর কথাটা বলে ফেলে। আমিরতো বরাবরই রাগী। সে তাৎক্ষনিক রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা সময় বাড়ি ফেরে তাও পদ্মজার সাথে কোনো কথা বললো না। পদ্মজা তো অবাক। সে কথা বলতে গেলে, হু হ্যাঁ ছাড়া আমির কিছু বলে না। পদ্মজা মুখে কিছু বলতে লজ্জা পায়৷ তাই সে বিভিন্নভাবে আমিরের আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করেছে। আমির প্রথম পদক্ষেপে নরম হয়ে গেলেও প্রকাশ করলো না। সে গম্ভীর হয়ে থাকে। চুপচাপ খেয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। অথচ অন্যবার পদ্মজাকে টেনে নিয়ে যায়,তারপর একসাথে ঘুমায়। আমিরের আচরণে পদ্মজা মনে ব্যথা পায়। একটা কথার জন্য এরকম কেউ করে? পদ্মজা অভিমানে বৈঠকখানায় বসে থাকে। আমির এদিকে চিন্তিত৷ রাত বাড়ছে,পদ্মজা আসে না কেন? সে ভাবলো,পদ্মজা এসে ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলে তার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করবে। তখন সে কিছু একটা চেয়ে বসবে। কিন্তু তার অর্ধাঙ্গিনী তো ঘরেই আসছে না! আমির বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় দেখে পদ্মজা সোফায় গাল ফুলিয়ে থম মেরে বসে আছে! রাগ ভাঙানোর বদলে উল্টো রাগ করে বসে আছে। কি অদ্ভুত! আমির খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বললো, ‘ রাত কয়টা বাজে কারো খবর আছে? কেউ কি ঘরে যাবে না?’

পদ্মজা অভিমানী স্বরে বললো, ‘ কেউ তাকে পাত্তা না দিলে সে কেন ঘরে যাবে?’

আমির হেসে ফেললো। সে পদ্মজার সামনে এসে বসে। পদ্মজার চোখে জল চিকচিক করছে। আমির পদ্মজার হাতে চুমু দিয়ে বললো, ‘ কী বাচ্চাকাচ্চা বিয়ে করলাম রে। একটুতে কেঁদে দেয়।’

‘তো ছেড়ে দিন না।’

আমিরের চোখ দুটি বড় বড় হয়ে যায়! পদ্মজা এতো কথা কবে শিখলো। কী অভিমান তার! আমির হাসি দীর্ঘ করলো। পদ্মজার মুখের উপর ঝুঁকে বললো, ‘ মৃত্যুর আগে ছাড়ছি না। পরপারে যদি আবার দেখা হয় তখনও তোমার পিছু নেব।’

আমিরকে মুখের উপর ঝুঁকতে দেখে পদ্মজা লজ্জা পেয়ে গেল।

ও বাড়ির প্রতিটি ইট তাদের ভালোবাসার স্বাক্ষী। সবখানে ভালোবাসা লেপ্টে লেপ্টে আছে। আমির বর্তমানে ফিরে আসে। সে রান্নাঘরে যায়। লতিফাকে বলে গরম পানি আর ছোট তোয়ালে নিয়ে আসে। পদ্মজার মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। তার চোখ দুটির উপর যেন ভারী পর্দা টানানো। এই জগতের কিছু দেখছে না। সে চোখ বুজলো। তার হাঁটু থেকে পা অবধি কাঁদা লেগে আছে। আমির ভেজা তোয়ালে দিয়ে পদ্মজার হাত-পা মুছে দিল। তারপর লতিফাকে ডেকে আনে। লতিফা পদ্মজাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। সে পদ্মজাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমির লতিফাকে বললো, ‘ কয়দিনে ঠিক হয়ে যাবে। শোন তোর সাথে কিছু কথা আছে।’

লতিফা উৎসুক হয়ে তাকায়। আমির বললো, ‘ পদ্মজার যত্ন নিবি। রাধাপুরের রঞ্জন মিয়ারে চিনিস না?’

লতিফা বললো, ‘ চিনি।’

‘উনি নিজের হাতে বাদামের তেল বানান। খাঁটি বাদামের তেল। পদ্মজা চুলে বাদামের তেল দেয়। উনার কাছ থেকে সবসময় বাদামের তেল আনবি। আর, ওর পিঠের হাড়ে মাঝে মাঝে ব্যথা হয়। ছোটবেলা কোথাও আঘাত পেয়েছে। যখন ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটবে বুঝবি,পিঠের হাড়ে যন্ত্রণা হচ্ছে। তখন ধরে নিয়ে সরিষা তেল ডলে দিবি আর গরম সেঁক দিবি। তিনবেলা নিজ দায়িত্বে জোর করে খাওয়াবি। আর পিঠের দিকে কিন্তু খেয়াল অবশ্যই রাখবি।’

লতিফা জানে না তাকে কেন এই দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে৷ সে প্রশ্নও করলো না। বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। পদ্মজা আবার মিনমিনিয়ে কাঁদছে। অস্পষ্ট স্বরে পূর্ণাকে ডাকছে। লতিফা পদ্মজার শাড়ি ও বিছানার চাদর পাল্টে দিল৷ শাড়ি পাল্টানোর সময় যখন পদ্মজা অর্ধনগ্ন তখন সে লতিফাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘পূর্ণা.পূর্ণা…বোন আমার।’

লতিফা চমকে গেল। তাকে পদ্মজা পূর্ণা বলছে কেন? পদ্মজার কান্না শুনে আমির ছুটে ঘরে আসে। পদ্মজা আমিরকে দেখেই,টেবিল থেকে হারিকেন নিয়ে তার উপর ছুঁড়ে মারে। তারপর চিৎকার করে বললো, ‘ খুনী,ধর্ষক, জানোয়ার…জানোয়ার….।’

পদ্মজার চিৎকারে অন্দরমহল কেঁপে উঠে। হারিকেনের কাচের উপর ব্যবহৃত প্লাস্টিক আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তাই পদ্মজা চিকন তার দিয়ে সেটি জোড়া দেয়। তারের একাংশ খাড়া হয়ে ছিল। সেই খাড়া অংশ আমিরের চোখের পাশে ঢুকে পড়ে। আরেকটু হলে চোখ গলে যেত। সঙ্গে সঙ্গে আমির মেঝেতে বসে পড়লো। দুই-তিন ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসে। লতিফা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। পদ্মজা রাগে কিড়মিড় করতে করতে চাদর ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে। আমির লতিফাকে বললো, ‘ পদ্মজাকে দেখ তুই।’

তারপর সে অন্য চোখে পথ দেখে সোজা কলপাড়ে চলে যায়। চোখের পাশে আঘাত পেলেও চোখের ভেতর ভীষণ ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। খলিল-রিদওয়ান সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছে। এসেই পদ্মজার চিৎকার শুনে। পদ্মজার চিৎকার কোনো স্বাভাবিক মানুষের মতো না। তাছাড়া তারা দুজনই পদ্মজাকে ও বাড়িতে কাঁদতে দেখেনি। অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখেছে। খলিল রিদওয়ানকে বললো, ‘ এই ছেড়ি পাগল হইয়া গেল নাকি?’

রিদওয়ান হেসে বললো, ‘ আরো আগে হওয়ার কথা ছিল আব্বা।’

আমিরকে কলপাড়ে দৌড়ে যেতে দেখে রিনুও পিছনে যায়। সে কল চাপে। আমির উন্মাদের মতো চোখে পানি দিতে থাকে। তার চোখ জ্বলে যাচ্ছে। যাক, সে তো এটাই চায়! হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃত সব ছারখার হয়ে যাক!

পদ্মজা লতিফার হাত খামচে ধরে। তার চোখমুখ অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে চাপা স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘আমার বোনকে কে খুন করেছে? কার আদেশে হয়েছে?’

পদ্মজার চাহনি দেখে মনে হচ্ছে,লতিফা যদি প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারে তাহলে পদ্মজা তাকেও খুন করে ফেলবে। লতিফা পদ্মজার সাথে বাড়ি ফেরার পর রিনু লতিফার কাছে ছুটে আসে। সে যা যা শুনেছে সব লতিফাকে বলে। লতিফা এখন সব জানা সত্ত্বেও বলতে চাইছে না। সে বললো, ‘ শাড়িডা আগে পিন্দো। ঠান্ডা লাগব।’

পদ্মজা লতিফার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। সে লতিফার হাত খামচে ধরে রাখা অবস্থায় বললো, ‘ কী জানো তুমি? বলো আমাকে।’

যতক্ষণ লতিফার মুখ থেকে কিছু না শুনবে ততক্ষণ লতিফার হাত পদ্মজা ছাড়বে না। তার নখ লতিফার হাতের চামড়া ভেদ করেছে। লতিফা সংক্ষেপে দ্রুত সব বললো। সব শুনে পদ্মজা লতিফার হাত ছেড়ে নিজের হাত নিজে খামচে ধরে। মুখ দিয়ে ‘ইইইই’ জাতীয় শব্দ করে রাগে কাঁপতে থাকে। লতিফা ভয় পেয়ে যায়। সে পদ্মজার মাথায় হাত রাখে,পদ্মজা সেই হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। লতিফা দূরে সরে আসে। পদ্মজা শূন্যে তাকিয়ে নিজেকে স্থির করলো। তারপর চুপচাপ শাড়ি পড়ে শুয়ে পড়ে। লতিফা ধীর পায়ে পদ্মজার পায়ের কাছে এসে বসলো।

ঘন্টাখানেক পার হওয়ার পর আমির ঘরে আসে। আমিরকে দেখে লতিফা বেরিয়ে যায়। আমির এক চোখে ঝাপসা দেখছে। সে ধীরপায়ে পদ্মজার পায়ের কাছে এসে বসলো। চোখ ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশ দেখে আবিষ্কার করলো, পুরো ঘর জুড়ে গাঢ় বিষাদের ছায়া। এ ঘরে আনন্দরা আসে না অনেকদিন! আমির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পদ্মজার পায়ের আঙুল ফুটিয়ে দিল। কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মৃদুলের মতো হাউমাউ করে যদি কান্না করা যেত! আমির ঠোঁট কামড়ে ধরে। দুই গাল বেয়ে আষাঢ়ের বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টিতে পদ্মজার দুই পা স্নান করে। তাদের জীবনের সব সুর,ছন্দ এক থাবায় কে ছিনিয়ে নিল? কেন হলো না দীর্ঘ সংসার! তবে কেন হয়েছিল,পাপ-পবিত্রের মিলন? শূন্যে অভিযোগ তুলেও উত্তর মিলে না। আমির তার চোখের জল মুছে ফেললো। তারপর পদ্মজার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। একবার ভাবলো,পদ্মজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। তারপর আবার ভাবলো, যদি পদ্মজার ঘুম ভেঙে যায়। পাশেও শুয়ে থাকতে পারবে না। তাই চুপচাপ দূরত্ব রেখে শুয়ে থাকে। শেষ রাতে পদ্মজা ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠে। সে স্বপ্নে শুধু রক্ত দেখছে। রক্তের সাগর,রক্তের নদী,রক্তের পুকুর! পদ্মজা ভয়ে চট করে চোখ খুলে। সে ঘুমাচ্ছে না বরং বার বার পূর্ণার সাথে সাক্ষাৎ করছে! পাশ ফিরে দেখে আমির শুয়ে আছে। তার চোখ দুটি বোজা। গত দিনগুলোতে সে ঘুমায়নি। পদ্মজার সংস্পর্শে আসতেই তাকে ঘুম জেঁকে ধরেছে। পদ্মজা আমিরকে দেখে থমকায়। আমিরের এক চোখ ফুলে গেছে। পদ্মজা আলতো করে আহতস্থান ছুঁয়ে দেয়। কী যেন মনে পড়তেই অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়ে। আমির চোখ খুললো। সে পদ্মজার পিঠের উপর নির্বিকারভাবে চেয়ে রইলো।

ফজরের আযানের সুর ভেসে আসে কানে। বিষাদ রাঙা ভোরের আলো ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরের ভেতর। আমির উঠে বসে। পদ্মজা আবার ঘুমিয়েছে। ঘুমের মাঝে বিড়বিড় করছে। আমির কান পেতে শুনে,পদ্মজা পূর্ণাকে কিছু বলছে! সে তার পায়জামার পকেট থেকে লাল খামটি বের করে বালিশের কভারের ভেতর রেখে দিল। তারপর বিছানা থেকে নেমে পদ্মজার মুখের সামনে চেয়ার নিয়ে বসলো। ভোরের মায়াবী আলোয় পদ্মজার বিষণ্ণ মুখটা আরো বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। আমির সাবধানে পদ্মজার কপালে চুমু দিল,হাতে চুমু দিল। তারপর মিষ্টি করে হেসে বললো, ‘ তুমি চাও বা না চাও,পরপারে দেখা হলে আবার তোমার পিছু নেব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *