আমি পদ্মজা – ৮০

৮০

পদ্মজা রান্নাঘরে জুলেখা বানুকে দেখে অবাক হলো। অচেনা হলেও সালাম দিল, ‘ আসসালামু আলাইকুম।’

জুলেখা তীক্ষ্ণ চোখে পদ্মজার দিকে তাকালেন। অবহেলার স্বরে বললেন, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’

রিনু ছিল রান্নাঘরে। পদ্মজা রিনুর দিকে তাকিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করলো, অচেনা মহিলাটি কে? রিনু হেসে বললো, ‘মৃদুল ভাইজানের আম্মা।’

পদ্মজার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। জুলেখার দিকে এক পা এগিয়ে এসে বললো, ‘ দুঃখিত! চিনতে পারিনি। আপনি প্লেট ধুচ্ছেন কেন? রাখুন। আমি ধুয়ে দিচ্ছি।’

জুলেখা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি চুপচাপ প্লেট ধুয়ে, চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। মুখের প্রতিক্রিয়াতে পদ্মজার প্রতি ছিল অবজ্ঞা,ঘৃণা। পদ্মজা মনে মনে আহত হয়। জুলেখার দৃষ্টি ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়ার মতো ছিল। পদ্মজা জুলেখার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো। রিনু পদ্মজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। ফিসফিসিয়ে বললো, ‘আমার মনডা কয়,এই বেডির উপর জিনের আছড় আছে!’

পদ্মজা রিনুর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। বললো, ‘উনি আমাদের বাড়ির মেহমান! মুখে লাগাম দাও রিনু। পূর্ণার জন্য খাবার নিতে পারবো?’

লতিফা শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘরে ঢুকলো। পদ্মজার প্রশ্নের জবাবে বললো, ‘হ পদ্ম, নিতে পারবা। খাড়াও আমি দিতাছি। তুমি খাইবা কখন?’

‘পূর্ণা আর আমার খাবার একসাথেই দিয়ে দাও বুবু।’

‘দিতাছি। রিনু জলদি ওই বাডিডা(বাটি) দে।’

রিনুর বদলে পদ্মজা এগিয়ে দিলো। খাবার নিয়ে উপরে যাওয়ার সময় পদ্মজাকে দেখে জুলেখা হাতের গ্লাস শব্দ করে টেবিলে রাখলেন। পদ্মজা বুঝতে পারে,জুলেখার ঘৃণা ও বিরক্তির কারণ! বোধহয় গতকালের অপবাদ তিনি শুনেছেন। পদ্মজার ভয় হয়। পূর্ণার বিয়েটা হবে তো? জুলেখাকে দেখে মনে হচ্ছে,বিয়ের কথা বলার অবস্থাতেও তিনি নেই। জুলেখার কপাল আর ভ্রুযুগলে পদ্মজার চোখ আটকে যায়। যেন হেমলতার কপাল আর ভ্রু দেখছে সে। হুবহু একরকম! পদ্মজার বুকটা হুহু করে উঠে। সে দুই চোখ মেলে জুলেখার কপালের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখের দৃষ্টিতে যেন জন্ম জন্মান্তরের দুঃখ। পদ্মজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুলেখা উঠে চলে যান। পদ্মজার সম্বিৎ ফিরলো। সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় চলে আসে। পূর্ণা দুই হাতে একটা বালিশ জড়িয়ে ধরে পরম আবেশে ঘুমাচ্ছে। জুলেখার কপাল,ভ্রু দেখে জেগে উঠা ব্যথা পূর্ণাকে দেখে আরো বেড়ে যায়। হেমলতার যৌবনকাল পূর্ণার বর্তমান রূপের প্রতিচ্ছবি। সেই মুখ,সেই ঠোঁট,সেই গাল। নাকের পাটা মসৃণ। এতো মিল দুজনের! পদ্মজা পূর্ণার মাথায় হাত রেখে হেমলতার কথা ভাবে।পুরনো স্মৃতিগুলো চোখের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। পদ্মজা পূর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো, ‘আম্মা।’

তার দুই চোখ জলে ভরে উঠে। পূর্ণা কী কখনো জানবে? পদ্মজা পূর্ণার ঘুমন্ত মুখ দেখে বহুবার আম্মা বলে কেঁদেছে! সে মনকে বুঝিয়েছে, এইতো আম্মা আছে! আমার সামনেই আছে! আমি এতিম নই!

পদ্মজা হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছলো। পূর্ণা এতো আরাম করে ঘুমাচ্ছে যে পদ্মজার ঘুম ভাঙাতে মায়া হচ্ছে। কিন্তু বেলা করে খাওয়া তার একদম পছন্দ না। খেয়ে না হয় আরো ঘুমানো যাবে। পদ্মজা পূর্ণার চোখেমুখে স্নেহের পরশ বুলিয়ে ডাকলো, ‘পূর্ণা? পূর্ণা? এই পূর্ণা?’

পূর্ণা ধীরে,ধীরে চোখ খুললো। পদ্মজা বললো, ‘সূর্য কখন উঠেছে খবর আছে? নামাযের তো নামগন্ধও নেই। যা দ্রুত হাত-মুখ ধুয়ে আয়।’

পূর্ণা অন্যদিকে ফিরে চোখ বুজলো। সে ঘুমে বিভোর। পদ্মজা আবার ডাকলো। জোর করে তুলে কলপাড়ে পাঠালো। পূর্ণা ঘুমিয়ে,ঘুমিয়ে কলপাড়ে গেল। ফিরে এলো সতেজ হয়ে। ঘরে প্রবেশ করেই সোজা লেপের ভেতর ঢুকে পড়লো। পদ্মজাকে আহ্লাদী স্বরে বললো, ‘খাইয়ে দাও আপা।’

পদ্মজা বিনাবাক্যে খাইয়ে দিল। পূর্ণা না বললেও খাইয়ে দিত। খাওয়ার মাঝে পূর্ণা কথা বলতে চেয়েছিল। পদ্মজা নিষেধ করে। খাওয়ার মাঝে কথা বলা ভালো না বলে চুপ করিয়ে দেয়। খাওয়া শেষে পদ্মজা বললো, ‘ শেষরাতে কোথা থেকে ফিরছিলি?’

পূর্ণা চোখ বড়বড় করে তাকায়। তার হেঁচকি উঠে যায়। পদ্মজা পানি এগিয়ে দিল। তাকিয়ে রইলো সরু চোখে। পূর্ণা পানি পান করে মিনমিনিয়ে বললো, ‘আর যাব না।’

পদ্মজা গুরুজনদের মতো বললো, ‘বাড়তি কথা না বলে প্রশ্নের উত্তর দেয়া বাধ্যতা।’

পূর্ণা ভয়ে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। সে ঢোক গিলে নতজানু হয়ে বললো, ‘মৃদুল যে…উনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।’

‘সে ডেকেছিল?’

‘হু।’

‘আর তুইও চলে গেলি?’

পূর্ণার মনে হচ্ছে সে ফাঁসির দঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে ঝুলে যাবে। পদ্মজা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘরের দুই দিকে জানালা আছে। পূর্ব দিকের জানালা খোলা। উত্তর দিকেরটা বন্ধ। সে উত্তর দিকের জানালা খুলতে খুলতে বললো, ‘ বিয়ের আগে মাঝরাতে দেখা করা কী ঠিক হলো? মৃদুল এখনো পর-পুরুষ। বিয়েও ঠিক হয়নি। যখন এসে শুয়েছিস তখন টের পেয়েছি। তার আগে টের পেলে কানে ধরে ঘরে নিয়ে আসতাম।’

পূর্ণা অপরাধী কণ্ঠে বললো, ‘আপা,আর যাব না। ক্ষমা করে দাও।’

পদ্মজা পূর্ণার পাশে এসে বসে। পূর্ণার হাতের উপর নিজের এক হাত রেখে বললো, ‘বিয়ের পর আমার বোনের জীবনে হাজার জ্যোৎস্না আসুক।’

পূর্ণা তার অন্য হাত পদ্মজার হাতের উপর রাখলো। তারপর পদ্মজার চোখের দিকে তাকিয়ে ডাকলো, ‘আপা।’

‘কী?’

‘তোমাকে কে মেরেছে? কেন মেরেছে? তুমি রাতে কেন কেঁদেছো?’

পদ্মজা তার হাত সরিয়ে নেয়। চোখমুখে কাঠিন্য ভাব চলে আসে। কণ্ঠে গাম্ভীর্যতা রেখে পদ্মজা বললো, ‘প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছিলাম।’

পূর্ণা চোখ নামিয়ে বললো, ‘আপা,আমি জানতে চাই।’

পদ্মজা দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো, ‘বাড়ি ফিরে যা। মৃদুলের আম্মা-আব্বা আসছে। যখন তোকে প্রয়োজন হবে ডেকে পাঠাব। তার আগে যেন এই বাড়ির আশেপাশেও না দেখি।’

পদ্মজা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। পূর্ণা তার পায়ের উপর থেকে দ্রুত লেপ সরাল। তারপর দৌড়ে পদ্মজার সামনে এসে দাঁড়াল। অনুরোধ করে বললো, ‘আপা,আপা দোহাই লাগে বলো। আমি তোমার সব কথা শুনি। কিন্তু এইটা শোনা সম্ভব হচ্ছে না।’

‘পূর্ণা!’

পূর্ণা আচমকা পদ্মজার দুই পা জড়িয়ে ধরলো। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ‘আপা,পায়ে পড়ছি আমাকে সব বলো। তোমার গালের ক্ষত,গলার দাগ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি শান্তি পাচ্ছি না। কে তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছে? কে এতোবড় দুঃসাহস দেখিয়েছে? আমি তার কলিজা ছিঁড়বো।’

পূর্ণার চোখের জল পদ্মজার পায়ে পড়ে। পদ্মজা পূর্ণাকে টেনে তুললো। পূর্ণার কাজল নয়ন দুটি জলে টুইটুম্বুর। যেন স্বচ্চ কালো জলের পুকুর।

পদ্মজা পূর্ণার চোখের জল মুছে দিয়ে বললো, ‘কাঁদুনি।’

পূর্ণা পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে। পদ্মজার শরীরে সে মা,মা গন্ধ খুঁজে পায়। সেই ছোটবেলা থেকেই পদ্মজা তার জীবন,তার আনন্দ। পদ্মজার গলার কালসিটে দাগটা যেন তারই বুকের আঘাত। রক্তক্ষরণ হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। পদ্মজা পূর্ণাকে অপেক্ষা করতে বলে,নিজের ঘরে যায়। আলমগীরের দেয়া খাম নিয়ে ফিরে আসে। দরজা বন্ধ করে পূর্ণাকে নিয়ে বিছানার উপর বসলো। এরপর বললো, ‘আমি জানি,আমার বোন বড় হয়েছে। সেই সাথে ধৈর্য্য,জ্ঞানও বেড়েছে। আমি একটা কারণেই তোকে সব জানাব,যাতে সাবধান থাকতে পারিস। আমি চাই, সব জানার পর তুই নিজে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নিবি না। আমি যেভাবে বলবো,সেভাবে চলবি। রাজি?’

পূর্ণা বুঝতে পারছে সে ভয়াবহ কিছু জানতে চলেছে। উত্তেজনায় তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়েছে। পূর্ণা বললো, ‘রাজি।’

পদ্মজা হাতের খামটা পূর্ণার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘তিনটে চিঠি আছে। তিনটাই আলমগীর ভাইয়ার লেখা। আমি গতকাল পড়েছি। মন দিয়ে পড়বি। অনেক কিছু জানতে পারবি। আর যতটুকু বাকি আছে আমি বলব।’

পূর্ণা প্রবল আগ্রহ নিয়ে খাম খুলে তিনটে চিঠি বের করলো। পদ্মজার কথামতো প্রথম একটা চিঠির ভাঁজ খুললো।

——

বোন পদ্মজা,

সালাম নিও। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার। সেদিনের রাতে তোমার আগমন আমার জীবনে নিয়ে এসেছে আনন্দ। পৌঁছে দিয়েছে আলোর জগতে। যে জগতে বাঁচার জন্য পিছনের প্রতিটি মুহূর্ত অসহনীয় যন্ত্রণায় কাটিয়েছি। জানি না এতো পাপ করার পরও করুণাময় কেন আমার প্রতি এতো উদার হলেন! তিনি চেয়েছিলেন বলেই, তুমি ফেরেশতার মতো হাজির হয়েছিলে। বাঁচিয়েছিলে আমাকে আর রুম্পাকে। যখন তুমি এই চিঠি পড়ছো,তখন তোমার অবস্থা কী আমি জানি না। হয়তো সব জেনে গিয়েছো নয়তো এখনো অন্ধকারে ডুবে আছো। যদি অন্ধকারে ডুবে থাকো তাহলে আমি তোমাকে আলোর সন্ধান দেব। সব জানার পর সিদ্ধান্ত তোমার। চিঠিটা বোধহয় বড় হয়ে যাবে। এক পৃষ্ঠাতে হবে না। ধৈর্য্য ধরে সবটুকু পড়ো। আমি তোমাকে একটা তিক্ত দীর্ঘ গল্প শোনাবো। গল্পটার কেন্দ্রবিন্দু আমির হলেও জড়িয়ে আছি অনেকেই।

যখন আমিরের জন্ম হয় কাকি আম্মার পর সবচেয়ে বেশি খুশি হই আমি। কাকি আম্মা বড় দুঃখী ছিলেন। কাকা মারধর করতেন খুব। নিজ চোখে কাকি আম্মাকে বিবস্ত্র করে মারতে দেখেছি। আমার ছোট মন লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছিল। লুকিয়ে কেঁদেছিলাম। কিন্তু কাকা বা আব্বা কাউকে একটুও মায়া দেখাতে দেখিনি,লজ্জা পেতে দেখেনি। তাদের চোখেমুখে সর্বক্ষণ হিংস্রতা ছিল। আমি খুব ভয় পেতাম আব্বাকে। ভীতু ছিলাম। আমার কাছে আমার আব্বা,কাকাই ছিল ভূত,রাক্ষস। আমার আম্মা সবসময় পাথরের মতো নিশ্চুপ। তার অনুভূতি অসাড়। কাকি আম্মা ছিলেন আমার মা। তিনি বহুবার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে একটা ছেলের জন্য আক্ষেপ করেছেন। কাকি আম্মা বলতেন,সেই ছেলে এসে নাকি কাকি আম্মার সব দুঃখ ঘুচে দিবে। যখন সেই ছেলেটা এলো আমি অনেক খুশি হই। এবার বুঝি কাকি আম্মার কষ্ট কমবে। কাকি আম্মা বলেছিলেন, আমির হবে পুলিশ। সব অন্যায়কারীকে শাস্তি দিবে আর আমি হবো শিক্ষক। শুধু কাকি আম্মার না আমারও ইচ্ছে ছিল আমি শিক্ষক হবো। ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াবো। সব বাচ্চাদের আদর্শ হবো। সবাই দেখে সালাম দিবে,সম্মান করবে। সারাক্ষণ হাতে একটা বই নিয়ে হাঁটবো। এই স্বপ্ন নিয়েই পড়তে থাকি স্কুলে। এর মাঝে আব্বা একটা বাচ্চাকে নিয়ে আসে। বলে, সে নাকি আমাদের আরেক ভাই। তার নাম রাখে রিদওয়ান। আমরা চার ভাই হয়ে যাই। আমি,জাফর,রিদওয়ান,আমির একসাথে এক স্কুলে পড়েছি। রিদওয়ান,আমির এক শ্রেণির ছিল। ছোট থেকেই আমিরের শরীরে ছিল অবাক করার মতো শক্তি। ওর মেধা ছিল ধারালো। আমরা সবাই ধরেই নিয়েছিলাম,আমির পুলিশ হবে। অনেক বড় পুলিশ হবে। পুরো দেশ চিনবে। ঠিক তখনই আমাকে আর জাফরকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় অভিশপ্ত এক কালো জীবনের সামনে। যে জীবনে টাকা, নারী আর রক্তের খেলা চলে। আমাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়,নারী হচ্ছে ভোগের বস্তু। পাতালঘরে বনেদি ঘরের দুই-তিনজন পুরুষের দেখাও মিলে। তারা দুজন নারীকে আমাদের সামনে কুৎসিত ভাবে আঘাত করে। আব্বা,কাকা উপভোগ করে সেই দৃশ্য। সেই অসহায় দুই নারীর চিৎকারে কলিজা ছিঁড়ে যায় আমার। আব্বা আর কাকার পায়ে পড়েছি যাতে তাদের ছেড়ে দেয়। কিন্তু ছাড়েনি। রক্ত দেখে জাফর জ্ঞান হারায়। ও রক্ত সহ্য করতে পারতো না। রক্তে খুব ভয় ছিল জাফরের। একটা তেরো বছরের মেয়েকে বাঁধা অবস্থায় আমার হাতে তুলে দেয়া হয়। আব্বা আমাকে বুঝায়,মেয়েটার সাথে কী করতে হবে! জানতে পারি, বাড়ির পিছনে জঙ্গলে অবস্থিত এই পাতালঘর অনেক বছরের পুরনো। আমাদের বংশের প্রতিটি পুরুষের একমাত্র পেশা পতিতাবৃত্তি ও নারী ধর্ষণ। আমাদের অঢেল সম্পদ পতিতাবৃত্তির টাকায় করা। নারী বিক্রির টাকায় করা! একরকম বাধ্য হয়েই আমাকে অভ্যস্ত করে দেওয়া হয় এই পথে। ঘৃণায় বমি করেছি অনেকবার। ধর্ষণের পর কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হতো মেয়েগুলোকে। আমার জীবন হয়ে উঠে দূর্বিষহ।

তবে ঘরে ফিরে শান্তি লাগতো। আমির ছিল সেখানে। আমিরের দুষ্টুমি আমাকে খুব হাসাতো। আমিরের একটা দোষ ছিল,ও রিদওয়ানকে খুব অত্যাচার করতো। দুজনের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। সে যাই হোক, আমিরের সঙ্গ ছিল শান্তির! ওর চঞ্চলতা,সাহসিকতা ছিল মুগ্ধ করার মতো। আমার সেই শান্তিও একদিন নষ্ট হয়ে যায়। যেদিন নানাবাড়ি থেকে ফিরে পাতালঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান আর আমিরের উপস্থিতি দেখি! আমির তখন পুরোদমে পনেরো বছরের একটা মেয়েকে পেটাচ্ছিল! আমিরের চোখেমুখের হিংস্রতা আমাকে অবাক করে দেয়। আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না,আমার প্রিয় ভাইয়ের এই রূপ! এই জীবন!

এর পরের কথাগুলো তোমার জন্য খুব কষ্টের হবে পদ্মজা। দয়া করে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার পড়া শুরু করো।

——

পূর্ণা থামে। তার শরীর কাঁপছে। অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। সে ছলছল চোখে পদ্মজার দিকে তাকায়। তার চোখে খুব ভয়,ঘৃণা। সে স্পষ্ট স্বরে উন্মাদের মতো ডাকলো, ‘আপা…এই আপা।’

পদ্মজা পূর্ণার এক হাত শক্ত করে ধরলো। বললো, ‘ভাইয়া আমাকে যা বলেছেন,তাই কর। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নে।’

পূর্ণার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তার মাথা ভনভন করছে। শরীর যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। সে পদ্মজার এক হাত শক্ত করে ধরে জোরে নিঃশ্বাস নিল। বুকে অপ্রতিরোধ্য তুফান বয়ে যাচ্ছে! আমির তার কাছে আপন বড় ভাই। সম্মানীয় বড় ভাই! এই ব্যথা সহ্য করতে পারবে না সে। পুরো শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।

৮১

পদ্মজা পূর্ণার মনের অবস্থা টের পাচ্ছে। তার মতো সহ্যশক্তি নেই পূর্ণার। পদ্মজা পূর্ণার হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বললো, ‘মন এতো দূর্বল হলে কি চলে?’

পূর্ণা পদ্মজার দিকে তাকালো। পদ্মজা চোখের ইশারায় বাকিটুকু পড়তে বলে। পূর্ণা এক হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছে পড়া শুরু করলো-

——

আমাদের দাদুর সঙ্গ পেয়ে আমির ছোট থেকেই নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়েছে। কাকার কথায় দাদু আমিরকে আলাদা করে সময় দিতেন। আমির কাকার বড় শিকার ছিল। আমিরের চাল-চলন ছিল অন্যরকম। তাকে ছোট থেকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে,মেয়েরা ভোগের বস্তু। শিখিয়েছে টাকার ক্ষমতা আর পৈশাচিক আনন্দ কেমন! দাদু শুরু থেকে সব জানেন। তিনি কাকা আর আব্বাকে উৎসাহিত করতেন। আমাদের দাদাকেও সাহায্য করেছেন। দাদুর সোনার অলংকারের প্রতি দূর্বলতা ছিল খুব। এই দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আমার দাদা,আব্বা,কাকা দাদুকে ব্যবহার করেছেন। দাদুর সাথে দাদুর এক বোনও ছিল। দাদুর বোন বলতে আপন নয়,পরিচিত। দুজন নারী মিলে সহযোগিতা করে এসেছে বছরের পর বছর। আমির নারীর শরীর ভোগ করার চেয়ে, আঘাত করতে পছন্দ করতো। প্রথম তিন বছর সে কোনো মেয়ের সাথে জোরপূর্বক মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেনি। সবসময় প্রতিটি মেয়ের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে।

প্রথম প্রথম আমার খারাপ লাগতো। কিন্তু একসময় অভ্যস্ত হওয়ার সাথে উপভোগ করতে থাকি। আমিরের যখন আঠারো বয়স তখন থেকে সে যৌনতার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। পাশের গ্রামের এক মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে। মেয়েটা দেখতে মিষ্টি ছিল। আমিরকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে। বিশ্বাস করে নিজের ইজ্জত সঁপে দিয়েছিল, বিনিময়ে এরপরদিন লাশ হয়ে নদীর ঢেউয়ে ভেসে যেতে হয়েছে! আমিরের নারী আসক্তি তীব্র হয়ে উঠে। কিন্তু জোরপূর্বক কিছু করতে সে নারাজ। বেছে নেয় ছলনার পথ,প্রতারণার পথ। কতগুলো মেয়েকে সে ঠকিয়ে ভোগ করেছে তার হিসেব নেই আমার কাছে। ঢাকায় পড়তে গিয়ে কারো মাধ্যমে নারী পাচারের সাথে যুক্ত হয়। তারপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। টাকার পাহাড় গড়ে উঠে। পদ্মজা,তোমার খারাপ লাগবে। তাও বলতে হচ্ছে, তুমি যেমন আমিরের জীবনের প্রথম মেয়ে নও তেমন বউও নও! শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুন্দরী এক মেয়েকে আমির বিয়ে করেছিল। সেই মেয়েটি নিঃসন্দেহে রূপসী ছিল। সে বিয়ের পূর্বে শারিরীক সম্পর্কে আগ্রহী ছিল না বলে আমির তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মেয়েটি তার পরিবারে না জানিয়ে আমিরকে বিয়ে করে। এক সপ্তাহ পর মেয়েটি যখন আমিরের কাছে তিক্ত হয়ে উঠে, তখন মৃত্যু মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ায়! মেয়েটির পরিবারের কেউ জানতেও পারেনি,তাদের বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়েছিল! আর সে স্বামীর হাতেই মারা গিয়েছে! আমির তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। সে তখনই ঠান্ডা মাথায় পুরো ঘটনার চিহ্ন মুছে দেয়। এটাই কিন্তু ওর একটা বিয়ে নয়। আমির আরেকটা বিয়েও করেছিল। ভিন্ন ধর্মের এক সুন্দরী মেয়েকে। তার বেলায়ও হবুহু ঘটনা ঘটে। সে মেয়ের মৃত্যু আমি নিজচোখে দেখেছি। কিন্তু কিছু বলিনি। বলতে ইচ্ছে হয়নি! মন বলতে কিছু ছিল না তখন। মেয়েটা মৃত্যুর পূর্বে অবাক হয়ে দেখছিল আমিরকে। সে বোধহয় বিশ্বাস করতে পারছিল না,যাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছে সে তাকে খুন করছে! আমির কিন্তু খুন করার ঘন্টাখানেক পরই অন্য মেয়ের সাথে সময় কাটিয়েছে! আমিরের বাড়ি-গাড়ি সব হয়। যেকোনো নারী আমিরকে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিত নির্দ্বিধায়। আমির দেখতে একটু শ্যামলা হলেও ওর কথাবার্তা, চাল-চলন, চাহনি ছিল আকর্ষণ করার মতো। যতগুলো মেয়ে আমিরকে ভালোবেসেছে বেশিরভাগই আমিরের থুতুনির কাটা দাগটা দেখে প্রেমে পড়েছে। আমির সম্পর্কিত আর কিছু বলার নেই। এইটুকুতেই তুমি আমিরের স্থান বুঝে যাবে। তোমার স্বামী একা খারাপ এই কথা বলার মুখ নেই আমার। আমি কিছু কম করিনি!

তবে আমির কাকির ব্যাপারে ছিল দূর্বল। তার সব সাবধানতা ছিল কাকিকে নিয়ে! কাকি যেন কিছু জানতে না পারেন। আমির ঢাকা থাকার কারণে,কাকি কখনো সন্দেহও করেননি। তার আগে সন্দেহ করেছিলেন কিন্তু প্রমাণ পাননি। যেদিন কাকি তোমাকে আর আমিরকে তোমাদের বাড়ি থেকে আনতে গিয়েছিলেন। সেদিন তোমরা আসার পর রাতে কাকি জানতে পারেন আমির অনেক আগে থেকে কাকার সাথে কাজ করছে। এমনকি ঢাকা এই কাজই করে। আমির কাকার সাথে ডিল নিয়ে আলোচনা করছিল। খুব চাপ ছিল মাথার উপর। চিন্তায় আমির অসতর্ক হয়ে যায়। কাকির ঘরেই কাকার সাথে নারী পাচারের বিষয়ক কথা বলছিল। আর কাকিও সব শুনে ফেলেন। তিনি খুব কাঁদেন। রাগে আমিরকে অনেকগুলো থাপ্পড় দেন। আমির কিছু বলেনি। চুপচাপ থাপ্পড় খেয়েছে। কাকি আমিরকে নিষেধ করেন, আমির আর যেন আম্মা না ডাকে। আর যেন দেখা না করে। আমির কাকিকে সামলানোর অনেক চেষ্টা করেছে। পারেনি। কাকির খুব কষ্ট হচ্ছিলো। ঘৃণায় আমিরের শার্ট টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলেছেন। কাকির নখের দাগ আমিরের পেটে-বুকে হয়তো এখনো আছে। কাকির বেঁচে থাকার সুতোটাই ছিঁড়ে যায়। সারা রাত্রি হাউমাউ করে কেঁদেছেন। অনেকবার কাকিকে স্বান্তনা দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সাহস হয়নি। আমি নিজেই তো একটা নিকৃষ্ট মানব! আবার সেদিন রাতে তুমি রুম্পার সাথে ছিলে। রুম্পা যদি সব বলে দেয় তোমাকে সে ভয়ে আমির রিদওয়ানকে পাহারায় রেখেছিল। লতিফাকে দিয়ে খাবারে ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিল। যাতে রুম্পা ঘুমিয়ে পড়ে। আমির অনেক ছলচাতুরী করেছে,তুমি যাতে কিছু না জানতে পারো।

আমার আর রুম্পাকে তুমি নতুন জীবন পেতে সহযোগিতা করেছো তাই তোমাকে আমাদের গল্পটাও বলতে চাই। জানি না আর কতদিন বাঁচব। পালিয়ে এসেছি! আমিরের হাত অনেক লম্বা। ওর আমাকে খুঁজে পেতে সময় লাগবে না। বরং অবাক হচ্ছি,এতদিনেও আমির আমাকে খুঁজে পায়নি কেন?

রুম্পাকে আমার জন্য কাকা পছন্দ করেছিলেন। বিয়ের প্রথম দিনই বুঝতে পারি,রুম্পা সরল সোজা একটা মেয়ে। রুম্পার সঙ্গ ছিল অনেক শান্তির। কখন যে ভালোবেসে ফেলি বুঝিনি। বিয়ের মাস কয়েক পর বৈশাখ মাসে আমি পাতালঘরে ছিলাম। আমার সামনে নগ্ন মেয়ে ছিল। তখন পাতালঘরের চারপাশেএতো নিরাপত্তা ছিল না। হুট করে দেখি রুম্পা চলে এসেছে। তারপরের দিনগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠে। রুম্পাকে রিদওয়ান মারে,আব্বা মারে,কাকা মারে। আমি চুপচাপ মেনে নেই। কিন্তু খুব কষ্ট হতো। নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি। নিজের প্রতি ঘৃণা হতো। স্বামী হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ লাগতো। রিদওয়ান আমার অজান্তে আমার ভালোবাসার বউকে ধর্ষণ করে। এই খবর ধর্ষণের এক সপ্তাহ পর শুনেছি। কিন্তু আমি এমনই কাপুরুষ যে রিদওয়ানকে মারতে গিয়ে উল্টো মার খেয়ে চুপ হয়ে গিয়েছি! রুম্পা তেজি মেয়ে ছিল। ও রাগে বার বার বলেছে,পুলিশের কাছে যাবে। সব বলে দিবে। তাই রুম্পাকে মারার পরিকল্পনা করা হয়। আমি রুম্পার সাথে লুকিয়ে দেখা করি। ওর পায়ে ধরে ক্ষমা চাই। আর বলি,পাগলের ভান ধরে থাকতে। আমি মাঝে মাঝে দেখা করব। রুম্পা তেজি হলেও মৃত্যুকে ভয় পেতো খুব। পাগলের ভান ধরে থাকলে বাঁচতে পারবে এই কথা শুনে খুব কাঁদে। আর তাই করে। সে যে এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচতে চায়! রুম্পার চিৎকার,চেঁচামেচি শুনে আব্বা,কাকা ধরে নেয় রুম্পার মাথা ঠিক নেই। তবে আমিরের দৃষ্টি ঈগলের মতো। প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারে,রুম্পা পাগল নয়। মানসিক ভারসাম্যও হারায়নি। তাও কেন যেন কাউকে কিছু বলেনি! রুম্পা কিন্তু তখনো জানতো না আমির এই কাজে যুক্ত আছে। আমির আর রুম্পার সম্পর্ক ভাইবোনের মতো ছিল। আমির পরিবারের সাথে সবসময় সহজ-সরল থেকেছে। একদম সাধারণ একটা মানুষের মতো। শুরু হয় রুম্পার বন্দী জীবন আর আমার নিঃসঙ্গ রাত। একটা দিনও শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। কাপুরুষ শব্দটা সর্বক্ষণ খুঁড়ে-খুঁড়ে খেয়েছে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে দেখা করেছি। বুঝতে পেরেছি,রুম্পাকে আমি খুব ভালোবাসি। আব্বা,চাচা আর ছোট ভাই আমির এই তিন জনের ভয়ে এক পাও বাড়ানোর সাহস হয়নি। একজন লোক আমাদের দল ছেড়ে পালিয়েছিল। বিনিময়ে তার নির্মম মৃত্যু হয়েছে। সে ভারত চলে গিয়েছিল। তাও আমির ধরে ফেলেছে! বলো তো পদ্মজা,এমন ঘটনা জানার পর আমার মতো কাপুরুষ আর কী ই বা করতো? ধিক্কার আমার নিজের জীবনকে! আমাকে তো কুকুরের খাবার হওয়া উচিত! রুম্পাকে তুমি ঢাকা নিয়ে যেতে চেয়েছিলে তাই আমির বাবলুকে আদেশ করে,রুম্পাকে খুন করতে। আমি এই খবর পেয়ে পালানোর কথা ভাবি। পথে বাবলু আটক করে তখন তুমি ফেরেশতার মতো হাজির হও। এই ঋণ শোধের উপায় আমার জানা নেই।

আর কী বলবো আমি? এখন সিদ্ধান্ত তোমার। তুমি কী করবে! আমিতো সব জানিয়ে দিয়েছি। কিছু কথা না জানালেই নয়। আমির আমার কাছে সবসময় স্বচ্ছ ছিল। কিন্তু তুমি আসার পর আমি তাকে চিনতে পারি না। যখন তোমাদের বিয়ে হয় ভেবেই নিয়েছিলাম কয়দিন পর তোমার লাশও দেখতে হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। উল্টা আমির পাল্টে যায়। চারিদিকে কঠোর নিরাপত্তা দেয়া হয়। গ্রাম থেকে ঢাকা ফিরেই সুন্দরী দুই মেয়েকে সঙ্গ দেয়ার কথা ছিল। এই দুই মেয়েকে হাতের মুঠোর আনতে আমিরের সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে। সুযোগ পেয়েও আমির তাদের কাছে টানতে পারেনি। বছরখানেকে বুঝে যাই, আমির সত্যি তোমাকে ভালোবেসেছে! কোনো মেয়ের শরীর আর টানেনি আমিরকে। এ নিয়ে আব্বা,কাকার মাঝে অনেক কথা হয়েছে। আমির যদি সব ছেড়ে দেয়? আমার মনের কোণে আশা জাগে,আমির এবার আমার মতো অনুভব করবে। এই কালো জগতকে তার কালোই লাগবে। আমি নিজ চোখে দেখেছি,আমিরকে তোমার জন্য ছটফট করতে। তোমার অসুখ হলে সবকিছু ভুলে যেতো। তোমার চিন্তায় এক জায়গায় স্থির থাকতে পারতো না। এমনকি ঢাকার বাড়ি সহ আমাদের বাড়িটাও আমির তোমার নামে করে দিয়েছে। আমিরের যত সম্পদ আছে সব তোমার নামে করা। আমিরের কিন্তু নিজস্ব বলতে কিছু নেই। সে নিঃস্ব। এই খবর রিদওয়ান বা আব্বা,কাকা কেউ জানে না। কোনো কাক-পক্ষীও জানে না। চট্টগ্রাম সমুদ্রের কাছে তোমার জন্য একটা বাংলো বাড়ি বানাচ্ছে। বাড়ি বানানোর টাকা একত্রিশটা মেয়ে পাচার করার বিনিময়ে অগ্রিম নিয়েছিল। এখন সেই চাপ মাথায় নিয়ে ঘুরছে। হাতে সময় কম। কিন্তু মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না! আমার জানামতে, তুমি ধার্মিক ও পবিত্র একটা মেয়ে। তুমি এতকিছু জানার পর আমিরকে মেনে নিতে পারবে না। তোমার বিবেক তোমাকে সঠিক পথ দেখাবে। আমি যা জানি সব বলেছি। আমির তোমাকে ভালোবাসে এই কথাটা কঠিন সত্য। তুমি যদি আমিরের কাছে তার দুই চোখ চাও সে তোমার সামনে ছুরি ধরে হাঁটুগেড়ে বসে বলবে নিয়ে নাও! ছয় বছরে আমিরের যে রূপ,তোমার প্রতি যে টান আমি দেখেছি তা থেকে আমার এটাই মনে হয়। আমির তোমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। এমন মানুষের মনে এতো ভালোবাসা দেয়ার কোনো উদ্দেশ্য হয়তো সৃষ্টিকর্তার আছে। শুনেছি,সৃষ্টিকর্তার সব সৃষ্টি কোনো উদ্দেশ্যে করা। এখন সবটা তোমার সিদ্ধান্ত। আমি এইটুকুও মিথ্যে বলিনি। তুমি বুদ্ধিমতী একটু চোখ কান খোলা রাখলেই বুঝতে পারবে। যে পদক্ষেপই নাও না কেন সাবধান থেকো। আমিরের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটা পক্ষীও উড়ে যেতে পারে না।

রুম্পা তোমাকে ভালোবাসা জানিয়েছে। কখনো সুযোগ মিললে আমাদের আবার দেখা হবে। আমার মৃত্যু যেকোনো সময় হয়ে যেতে পারে। রুম্পাকে যদি আবার ওই বাড়িতে নেয়া হয় তুমি দেখে রেখো। আল্লাহ তোমার সাথে আছেন। আমার জন্য দোয়া করো। আল্লাহ আমার শাস্তি যেন রুম্পাকে না দেন। আমাকেই যেন দেন। আর আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমি অনুতপ্ত। এতো বড় চিঠি লিখে অভ্যেস নেই। ভুল হলে ক্ষমা করো। ভালো থেকো বোন।

ইতি,

আলমগীর।

——-

পূর্ণা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে তার বুক ভিজে গিয়েছে। সে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপা। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।’

পদ্মজা পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরলো। পূর্ণা পদ্মজার বুকে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে থাকলো। পদ্মজা তার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলে। পূর্ণা দুই হাতে শক্ত করে ধরে পদ্মজাকে। তার প্রিয় বোনের এতো কষ্ট! সে সহ্য করতে পারছে না। পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ভাইয়া তোমার আগে আরো দুটো বিয়ে করেছে। এই ব্যথা কীভাবে সহ্য করেছো আপা?’

পদ্মজা কান্না আটকিয়ে রেখেছিল। এই কথা শুনে ভেতর থেকে কান্না আপনা আপনি চলে আসে। পূর্ণাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। একটা মানুষ খুঁজছিল সে,যাকে জড়িয়ে ধরে মনখুলে কাঁদা যাবে। আমির অত্যাচারী, হিংস্র,নারী ব্যবসায়ী এইটুকুর ব্যথাই সে হজম করতে পারেনি। চিঠি পড়ে যখন জানতে পারলো,আমির নারী আসক্ত ছিল। এমনকি বিয়েও করেছে। তখন ইচ্ছে হচ্ছিল,গলায় ফাঁস লাগিয়ে মরে যেতে। ঠান্ডা মেঝেতে বসে হাত-পা ছড়িয়ে কেঁদেছে। বার বার চোখে ভেসে উঠেছে আমিরের সাথে অনেক মেয়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। একজন স্ত্রীর জন্য এটা কতোটা বেদনাদায়ক হতে পারে,তার কোনো পরিমাপ নেই। পদ্মজা চোখের জল মুছলো। পূর্ণাকে সামনাসামনি বসিয়ে বললো, ‘ এখন কাঁদার সময় নয়। তোকে আমি সব জানিয়েছি,যাতে প্রেমাকে দেখে রাখতে পারিস। আর নিজেও সাবধানে থাকিস। আমি একটা ছুরি দেব। নিজের সাথে রাখবি। রিদওয়ানের নজর ভালো না। প্রেমার দায়িত্ব তোর। তোর বিয়ে দিয়ে দেব তিন-চারদিনের মধ্যেই।’

‘আপা?’ পূর্ণার কণ্ঠটা অদ্ভুত শোনায়। পদ্মজা তাকালো। পূর্ণা ঢোক গিলে নতজানু হয়ে কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বললো, ‘ভাইয়ার কোনো ক্ষতি করো না আপা।’

কথা শেষ করেই জোরে কেঁদে উঠলো পূর্ণা। সে বুঝতে পারছে সে অন্যায় আবদার করেছে। পাপীর প্রতি মায়া দেখাচ্ছে। কিন্তু আমিরকে সে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। আমির কখনো বড় ভাইয়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। মাথার উপরের ছাদ হয়ে থেকেছে। সবচেয়ে বড় কথা তার প্রিয় বোনের ভালোবাসার মানুষ আমির। কেউ না জানুক সে জানে,আমির ছাড়া পদ্মজা বেঁচে থেকেও মৃত। পদ্মজা তার মা হেমলতার মতো হয়েছে। সত্যকে,ন্যায়কে বেছে নিবে। ভালোবাসার সিন্দুকটা তালা মেরে রাখবে। তারপর কষ্টে ধুঁকে-ধুঁকে মরবে। পূর্ণার কথা শুনে পদ্মজা অবাক হয়ে উচ্চারণ করলো, ‘পূর্ণা!’

পূর্ণা পদ্মজার কোলের উপর মাথা নত করে বললো, ‘আপা,আমি খুব খারাপ। কিন্তু তোমার সুখ আমার কাছে সবচেয়ে বড়। ভাইয়া তোমাকে ভালো রাখবে। ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে। আগের সব ভুলে যাও। মাফ করে দাও। আমি জানি তুমি ভাইয়াকেও ছাড়বে না। ভাইয়ার কিছু করে ফেলবে। আপা,দোহাই লাগে। তোমার সুখ নষ্ট করো না।’

পদ্মজা আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে অবস্থান করছে। পূর্ণা মাথা তুলে তাকায়। পদ্মজা প্রশ্ন করে, ‘ আর যে মেয়েগুলো অত্যাচারিত হয়েছে? যে মেয়েগুলো ঠকেছে? যে মেয়েগুলো যন্ত্রনায় ছটফট করে জীবন দিয়েছে? তাদের প্রতি অন্যায়ের শাস্তি কে দিবে?’

পূর্ণার সহজ উত্তর, ‘তোমাকে তো কিছু করেনি। তোমাকে তো ভালো রাখবে।’

পদ্মজা নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। সে ভেবেছিল পূর্ণা ঘৃণায় আমিরকে খুন করতে চাইবে। খুন করতে চাইবে রিদওয়ান, খলিল আর মজিদকে। কিন্তু এ তো উল্টা সুর তুলছে! পদ্মজা গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে পূর্ণাকে থাপ্পড় দিল। পূর্ণা আকস্মিক ঘটনায় নিজেকে শক্ত রাখার সুযোগ পায়নি। বিছানা থেকে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে। পদ্মজার নাক লাল হয়ে গেছে। সে রাগে পূর্ণাকে বললো, ‘ ছিঃ! তুই আম্মার মেয়ে!’

৮২

পূর্ণা উত্তরে কিছু বললো না। সে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকলো। নাকের পানি,চোখের পানি মিলেমিশে একাকার। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। পদ্মজার রাগে দুঃখে কান্না পায়। বেসামাল ঘূর্ণিপাকে সে আটকে পড়েছে। প্রতিটি নিঃশ্বাস হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। কেউ নেই পাশে দাঁড়ানোর মতো। কেউ মাথা ছুঁয়ে দিয়ে বলে না, পাশে আছি! মন যা চায় করো। পদ্মজার ভেতরের ঝড়ের তাণ্ডব কেউ টের পাচ্ছে না। সবাই তার বিরুদ্ধে। সবাই!

পদ্মজা চিঠি ও খাম নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পূর্ণা মৃদু আর্তনাদ করলো। সে কিছুতেই চিঠির লেখাগুলো আর পদ্মজার মুখে উচ্চারিত শব্দগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কাছে ভাইয়া নামক শব্দটির মানে আমির। তাৎক্ষণিক চোখের সামনে ভেসে উঠে একটা হাসিখুশি মুখ। আমিরের যে স্নেহ,ভালোবাসা এতদিন তাদের উপর চুইয়ে-চুইয়ে পড়েছে। সেই ভালোবাসায় খাদ থাকতে পারে না! পূর্ণা দেয়ালে হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শরীরটা কেমন করছে! হাজারটা সূচ যেন বুকের ভেতরটা খোঁচাচ্ছে। সে তার আপার চোখেমুখে দেখেছে সীমাহীন কষ্ট! পূর্ণা দুই হাতে কপালের দুই পাশ চেপে ধরে পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করে, ‘তুমি গতকাল রাতে এজন্যে কাঁদছিলে আপা! ভাইয়ার ভালোবাসার অভাব তোমাকে ছাই করে দিচ্ছে। তুমি পুড়ে যাচ্ছো। পুড়ে যাচ্ছো তুমি।’

পূর্ণা বিছানায় বসলো। সে অস্থির হয়ে আছে। জানালায় চোখ পড়তেই সে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় বড় বড় গাছ। তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। না জানি কত মেয়ের কুরবানির সাক্ষী এই গাছেরা! পূর্ণা জানালার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে। গাল বেয়ে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। তার কেন এতো কষ্ট হচ্ছে সে জানে না। বড় ভাইয়ের সমতূল্য আমিরের এমন ভয়ংকর রূপের কথা জেনে নাকি তার বোন আর বোনের ভালোবাসার বিচ্ছেদের আশঙ্কায়! পূর্ণা দুই হাতে চোখের জল মুছে ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকলো। তারপর দ্রুতপায়ে ২য় তলায় পদ্মজার ঘরে যায়। পদ্মজা ঘরে নেই। নিচ তলায় হয়তো! পূর্ণা সোজা নিচ তলায় চলে আসে। সদর ঘরে জুলেখা রিনুর সাথে কথা বলছিল। তিনি ব্যাগও গুছাচ্ছেন। পূর্ণা মৃদুলের কাছে শুনেছে,মৃদুল তার মা-বাবাকে নিয়ে এসেছে। জুলেখা বানুর মুখের সাথে মৃদুলের মুখের মিল রয়েছে। পূর্ণা আন্দাজ করে নিল,তিনি মৃদুলের মা। পূর্ণা নতজানু হয়ে এগিয়ে আসে। জুলেখার পায়ে ছুঁয়ে সালাম করার জন্য ঝুঁকতেই জুলেখা পা সরিয়ে নিলেন। কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘ দূরে যাও।’

পূর্ণা মনে মনে আহত হয়। দূরে সরে দাঁড়ায়। চোখের কার্নিশে জল জমে। সে ঢোক গিলে কান্না আটকিয়ে কাঁপাকণ্ঠে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম।’

জুলেখা বানু জবাব দিলেন না। তিনি কাউকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ কী গো! হয় নাই তোমার? সময় যাইতাছে নাকি আইতাছে?’

গফুর মিয়া বেরিয়ে আসেন। পূর্ণা গফুর মিয়াকে দেখে বুঝতে পারলো, উনি মৃদুলের বাবা। লাল রঙের লম্বা দাঁড়ি,মাথায় সাদা টুপি,পরনে সাদা পাঞ্জাবি। চোখেমুখের নূর যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। গফুর মিয়া পূর্ণাকে দেখে হাসলেন। বললেন, ‘ভালো আছো মা? শরীরটা ভালো লাগছে?’

গফুর মিয়ার প্রশ্ন দুটো পূর্ণা শরীরকে চাঙ্গা করে তুললো। সে মৃদু হেসে বললো, ‘ ভালো আছি। আপনি…আপনি ভালো আছেন?’

‘আছি। বুড়ো মানুষ… ‘

গফুর মিয়া কথা শেষ করতে পারলেন না। জুলেখা বানু বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন, ‘এহন তোমার গপ(গল্প) করার সময় না। ট্রেইন ছাইড়া দিলে বুঝবা।’

পদ্মজা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথার চুল ঢেকে জুলেখা বানুকে বললো, ‘গতকালই আসলেন। আজই চলে যাবেন?’

জুলেখা বানু পদ্মজার দিকে ফিরেও তাকালেন না। তিনি রিনুকে ধমকের স্বরে বললেন, ‘মৃদুইল্লা কই গেছে?’

রিনু বললো, ‘বাইরে গেছে। কলপাড়ে।’

‘গিয়া খবর দেও,হের আম্মায় ডাকতাছে।’

রিনু পদ্মজাকে একবার দেখলো। তারপর বাইরে গেল। লতিফা সদর ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। সে আড়চোখে জুলেখার ব্যবহার দেখছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে, মহিলাকে ভেজা কাপড়ের মতো মুচড়াতে! জুলেখার এমন ব্যবহারের কারণ পদ্মজা বুঝতে পারছে। তাও প্রশ্ন করলো, ‘মনে হচ্ছে আপনি খুব বিরক্ত হয়ে আছেন! আমরা কোনো ভুল করেছি?’

জুলেখা কটাক্ষ করে বললেন, ‘দেখো মা,তোমার সাথে আমি কথা কইতে চাইতাছি না। তুমিও কইয়ো না।’

পদ্মজা পূর্ণার দিকে তাকালো। পূর্ণা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তার চোখে, জলের পুকুর সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়ে যেন ঘর ভাসিয়ে নিবে। লতিফা ঝাড়ু দেওয়ার ভান করে সব বালু জুলেখার ভেজা পায়ের উপর ছিটিয়ে দিল। জুলেখা বানু দুই লাফে দূরে সরে যান। চোখ বড় বড় করে লতিফাকে বললেন, ‘এই ছেড়ি,চোক্ষে দেহো না? কেমনে কামডা বাড়াইছে! এহন আবার পাও ধুইতে হইবো।’

লতিফা অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বললো, ‘মাফ করেন খালাম্মা।’

মৃদুল সদর ঘরে প্রবেশ করে আগে পূর্ণার মুখ দেখলো। পূর্ণাকে দেখেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। সে পূর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘পূর্ণা,এহন কেমন লাগতাছে?’

পূর্ণা গুমট কণ্ঠে জবাব দিল, ‘ভালো।’

মৃদুল বললো, ‘লিখন ভাইয়ের খবর নিয়া আইছি।’

পদ্মজা সঙ্গে-সঙ্গে প্রশ্ন করলো, ‘কেমন আছেন উনি?’

জুলেখা তীক্ষ্ণ চোখে পদ্মজার দিকে তাকান। জুলেখার চাহনি দেখে পদ্মজা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মৃদুল বললো, ‘জানি না ভাবি। খালি জানি, লিখন ভাইরে ঢাকা হাসপাতাল নিয়া গেছে।’

পদ্মজা বিড়বিড় করে বললো, ‘আল্লাহ উনাকে সুস্থ করে দিবেন,ইনশাআল্লাহ। ‘

পূর্ণার চোখেমুখের গুমট ভাবটা স্পষ্ট। মৃদুল দেখতে পাচ্ছে কিন্তু তার কারণ বুঝতে পারছে না। জুলেখা বানু আদেশের স্বরে মৃদুলকে বললেন, ‘তোর যে কাপড়ডি বাইর করছিলি ব্যাগে ঢুকাইছি। এহন এই জুতাডি খুইলা তোর জুতাডি পায়ে লাগা।’

মৃদুলের কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হয়। বললো, ‘আমরা কই যাইতাছি? ‘

‘বাড়িত যাইতাছি।’

মৃদুলের মাথায় যেন বাজ পড়ে। সে পূর্ণার দিকে তাকালো। পূর্ণা অন্যদিকে ফিরে আছে। মৃদুল অবাক হয়ে জুলেখাকে বললো, ‘আমরা যেই কামে আইছি,সেই কাম তো হয় নাই আম্মা।’

জুলেখা পূর্ণার উপর চোখ রেখে বললেন, ‘আমি এমন কালা ছেড়িরে আমার ছেড়ার বউ কইরা ঘরে নিতে রাজি না।’

মৃদুল উঁচু স্বরে উচ্চারণ করলো, ‘আম্মা!’

জুলেখা বানু চেঁচিয়ে বললেন, ‘তুই কী দেইক্ষা এমন ছেড়িরে পছন্দ করছস? তোর লগে এই ছেড়ির যায়? তোর আর এই ছেড়ির গায়ের রঙ আসমান আর জমিন।’

জুলেখা বানুর চিৎকার শুনে খলিল ও আমিনা উপস্থিত হোন। অপমানে,লজ্জায় পূর্ণার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। পূর্ণার চোখের জল পদ্মজা হজম করতে পারছে না। পদ্মজা বললো, ‘ আপনি গায়ের রঙকে মূল্য দিচ্ছেন কেন? ছেলে-মেয়ে দুজন দুজনকে ভালোবাসে। ভালোবাসাটাকে মূল্য দিন।’

জুলেখা বানুর মেজাজ শুধু খারাপের দিকেই যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘আমার ছেড়ার মতো সোনার টুকরা এমন কয়লারে কুনুদিনও পছন্দ করব না। এই ছেড়ি তাবিজ করছে। কালা জাদু করছে আমার ছেড়ার উপর। আমার ছেড়ারে আমি বরহাট্টার হুজুরের কাছে লইয়া যাইয়াম। জাদু দিয়া বেশিদিন ধইরা রাখন যায় না। এইডা তুমি আর তোমার বইনে মনে রাইক্ষো।’

মৃদুল চিৎকার করে উঠলো, ‘আম্মা! কীসব আবোলতাবোল কইতাছেন। আপনি পূর্ণারে কষ্ট দিতাছেন।’

জুলেখা কেঁদে দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার কষ্ট নাই? আমি কত আশা কইরা আছিলাম আমার ছেড়ার বউ আমি পছন্দ কইরা ঘরে আনাম। পরীর মতো বউ আনাম। কিন্তু তুই এমন কালা ছেড়িরে পছন্দ কইরা রাখছস। দশ মাস দশ দিন তোরে পেটে রাখছি। আর এহন তুই এই ছেড়ির লাইগগা গলা উঁচায়া কথাও কইতাছস!’

পদ্মজা জুলেখাকে বুঝাতে চাইলো, ‘আপনি অকারণে কাঁদছেন। দেখুন…’

‘তুমি চুপ থাকো। তোমার বইনের তো গত্রের রঙ কালা। আর তোমার তো চরিত্রই কালা। নষ্টা মাইয়া মানুষের মতো জামাই রাইক্ষা অন্য ছেড়ার লগে সম্পর্ক রাখছো। এমন চরিত্রহীন ছেড়ি মানুষের বইনরে আমার বংশে নিয়া কি ইজ্জতে কালি লাগামু?’

পূর্ণার ত্যাড়া রগটা সক্রিয় হয়ে উঠে। সে জুলেখার সামনে এসে আঙুল শাসিয়ে বললো, ‘আমি সব সহ্য করব কিন্তু আমার আপাকে কিছু বললে আমি সহ্য করব না।’

পূর্ণার আঙুল শাসিয়ে কথা বলাটা জুলেখা হজম করতে পারলেন না। কত বড় সাহস! মিয়া বংশের বড় বউকে শাসিয়ে কথা বলছে! জুলেখা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, ‘কইলজাডা বেশি বড়! এই ছেড়ি কারে আঙুল দেহাইতাছো তুমি? তোমার বইনে যে নষ্টা পুরা গেরামে জানে। সত্য কইতে আমি ডরাই না।’

মৃদুল ক্ষেপে যায়। সে জুলেখার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো আর বললো, ‘আম্মা,আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করতাছেন।’

জুলেখা পিছনে ঘুরেই মৃদুলকে কষে চড় মারলেন। বেশ জোরেই শব্দ হয়। গফুর মিয়া জুলেখাকে ধমকালেন, ‘তুমি কী করতাছো? কী কইতাছো?’

জুলেখা বানু গফুর মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কিয়ামত নাইমা আইলেও এমন নষ্টার কালি বইনরে আমার ঘরের ঝিও করতাম না।’

পূর্ণার শিরায়-শিরায় ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ে। সে টেবিলে এক হাত রেখে কিড়মিড় করে বললো, ‘আরেকবার নষ্টা কথা উচ্চারণ করলে আমি আপনার জিভ পুড়িয়ে দেব।’

উপস্থিত সবাই পূর্ণার দিকে চমকে তাকায়। মৃদলও অবাক হয়। পদ্মজা পূর্ণার এক হাত টেনে ধরে,কিন্তু পূর্ণাকে নাড়ানো যায় না। সে বড় বড় চোখ করে জুলেখার দিকে তাকিয়ে আছে। জুলেখা রাগে,বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। তিনি ক্রোধের ভার নিতে পারছেন না। টেবিলে জোরে জোরে তিনটা থাপ্পড় দিয়ে তিনবার বললেন, ‘ নষ্টার বইন,নষ্টার বইন,নষ্টার বইন!’

কেউ কিছু বুঝে উঠার পূর্বে পূর্ণা টেবিলের উপর থাকা জগ হাতে তুলে নিল। তারপর জগের সবটুকু পানি জুলেখার মুখের উপর ছুঁড়ে মারলো। আকস্মিক ঘটনায় সবার চোখ মারবেলের মতো হয়ে যায়।

সাথে-সাথে পদ্মজা পূর্ণাকে বিরতিহীনভাবে থাপড়ানো শুরু করলো। পূর্ণা দুই হাতে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। রাগে,দুঃখে সে কাঁদছে। পদ্মজার চোখভর্তি জল। সে পূর্ণাকে বললো, ‘এটা কী করলি তুই? তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি? আর কত জ্বালাবি আমাকে?’

লতিফা পূর্ণাকে বাঁচাতে দৌড়ে আসে। জুলেখা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছেন। অপমানে তার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তিনি মৃদুলের দিকে তাকালেন। মৃদুলের চোখেমুখে অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে! তার অনুভূতিগুলো থমকে গেছে। জুলেখার চোখে জল চিকচিক করছে। তিনি চোখের জল মুছে বললেন, ‘থাক এইহানে,বাড়ি ফেইরা আমার কবর দেখবি তুই।’

মৃদুল তার মাকে খুব ভালোবাসে। জুলেখার চোখের জল তার হৃৎপিণ্ডকে জ্বালিয়ে দেয়! জুলেখা ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে যান। পিছন পিছন গফুর মিয়াও গেলেন। মৃদুল পূর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘ভালো করলে না।’

পূর্ণাকে লতিফা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সেই অবস্থায়ই পূর্ণা হুংকার ছাড়ে, ‘ বেশ করেছি। আমার বোন আমার মা! আমার মাকে আপনার মা গালি দিয়েছে। আমি উনাকে ছেড়ে দিলে জাহান্নামেও আমার জায়গা হতো না।’

‘কাজটা ঠিক করো নাই পূর্ণা!’ মৃদুলের কণ্ঠে তেজের আঁচ পাওয়া গেল।

মায়ের প্রতি মৃদুলের সমর্থন দেখে পূর্ণা রাগে বলে উঠলো, ‘ এমন মায়ের ছেলেকে আমি বিয়ে করব না।’

মৃদুল তিরস্কার করে হেসে বললো, ‘আমিও করব না। তুমি না আমার গায়ের রঙের সাথে মানাও, না ব্যবহারের দিক দিয়া মানাও। জুতা মারি বিয়ারে।’

মৃদুল টেবিলে জোরে লাথি মেরে বেরিয়ে গেল। পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসলো। ছোট থেকে শত সমস্যার মুখোমুখি হতে হতে সে ক্লান্ত। বড্ড ক্লান্ত!

৮৩

এখন যে দুপুর তা বুঝার সাধ্যি নেই! ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে। সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। কুয়াশা তার গভীর মায়াজালে সূর্যকে লুকিয়ে রেখেছে। পূর্ণা আলগ ঘরের বারান্দায় বসে কাঁদছে। তার পাশে বসে আছে প্রান্ত। প্রান্ত পূর্ণাকে নিয়ে যেতে এসেছে। কিন্তু পূর্ণার কোনো হুঁশ নেই। সে কেঁদেই চলেছে। মগা আলগ ঘরে ঘুমাচ্ছে। নাক দিয়ে বের হচ্ছে বিদঘুটে শব্দ। সেই শব্দে প্রান্ত বিরক্ত! সে দুই আঙুল কানে ঢুকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। পূর্ণা হাঁটুর উপর থুতুনি রেখে সুপারি গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ বেয়ে টুপটুপ বৃষ্টি বর্ষণ হচ্ছে। বুকের জ্বালাপোড়া সহ্য করতে পারছে না। মৃদুলের শেষ কথাগুলো তার শরীরের প্রতিটি পশমকে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ব্যথা সে কোথায় লুকোবে? মনের মণিকোঠায় যত্নে রাখা ভালোবাসার মুখের তিক্ত কথা কি সহ্য করা যায়! পূর্ণা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। বুকের ভেতর তুফান বয়ে যাচ্ছে। লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে ফুসফুস, কিডনি,মস্তিষ্ক,সর্বাঙ্গ! পূর্ণার হেঁচকি ওঠে। প্রান্ত চেয়ার ছেড়ে পূর্ণার সামনে এসে দাঁড়ালো। উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো, ‘আপা!’

পূর্ণা তার ডাগরডাগর চোখদুটো মেলে প্রান্তর দিকে তাকায়। চোখের দৃষ্টিতে দুঃখের মহাসাগর। পূর্ণা প্রান্তকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো, ‘ভাই,আল্লাহ আমাদের থেকেই কেন সবকিছু ছিনিয়ে নেন?’

প্রান্ত পূর্ণার কথার মানে বুঝলো না। কিন্তু পূর্ণার কান্না তার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সে পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘ আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন আপা। বড় আপা বলে,যা হয় সব ভালোর জন্য হয়।’

পূর্ণার কান্নার দমকে কিশোর প্রান্ত কেঁপে-কেঁপে উঠে। আলগ ঘরের ডান পাশে রিদওয়ান দাঁড়িয়ে আছে। মৃদুল অন্দরমহলে আছে ভেবে সে পাতালঘর থেকে সোজা আলগ ঘরে এসেছে। কিন্তু এসে দেখে,এখানে পূর্ণা হাউমাউ করে কাঁদছে! ব্যাপারটা কী? রিদওয়ান আলগ ঘরে আর গেল না। কলপাড়ে রিনুকে দেখা যায়। রিদওয়ান চারপাশ দেখতে দেখতে কলপাড়ে আসে। রিনু রিদওয়ানকে দেখে ভয়ে জমে যায়। রিদওয়ান নানা অজুহাতে রিনুর গায়ে হাত দেয়। রিনুর ভালো লাগে না। ভয়ে কিছু বলতেও পারে না। সে এতিম! ছোট থেকে এই বাড়িতে বড় হয়েছে। যাওয়ার জায়গা নেই। রিদওয়ান রিনুকে প্রশ্ন করলো, ‘ পূর্ণা কাঁদতেছে দেখলাম। কিছু জানিস?’

রিনু কাচুমাচু হয়ে সকালের ঘটনা খুলে বললো। সব শুনে রিদওয়ান খুব খুশি হয়। গুনগুনিয়ে গান গেয়ে অন্দরমহলের দিকে যায়। আমিনা আলোকে নিয়ে অন্দরমহলের সামনে খেলছেন। রিদওয়ান আলোর দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকলো, ‘মামা,এদিকে আসো।’

রিদওয়ান আলোকে কোলে নেয়। আমিনা ভারী করুণ ভাবে বললো, ‘ আমার রানিরে কি পাওন যাইতো না?’

রিদওয়ান চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, ‘খোঁজা হচ্ছে। পেয়ে যাবো।’

আলোকে আমিনার কোলে দিয়ে রিদওয়ান সদর ঘরে প্রবেশ করে। রান্নাঘর থেকে পদ্মজার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। রিদওয়ান সেদিকে যায়। পদ্মজা রিদওয়ানকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। কাজে মন দিল। রিদওয়ান পদ্মজার উপর চোখ রেখে কপাল কুঁচকায়! এই মেয়ে এতো চুপচাপ আর স্বাভাবিক কেন? সব মেনে নিল নাকি? রিদওয়ান মনের প্রশ্ন মনে রেখেই জায়গা ত্যাগ করে। যাওয়ার পূর্বে লতিফাকে বলে গেল, ‘লুতু,খাবার নিয়ে আয়।’

রিদওয়ান চোখের আড়াল হতেই লতিফা ভেংচি কাটে। মাংস রান্না হচ্ছে। মাংস রান্না হতে দেখলেই পদ্মজার ফরিনার কথা মনে পড়ে। ফরিনার হাতের মাংসের ঝোলের স্বাদ ছিল অন্যরকম। অন্দরমহলের বাম পাশে ফরিনার কবর! আজ তিনদিন তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়েছেন। পদ্মজার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মাথার উপর ভারী বোঝা! বোঝা টানতে কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাসে-নিঃশ্বাসে সে আল্লাহর নাম স্বরণ করছে। প্রার্থনা করছে, এই বোঝার ঘানি যেন সে টানতে পারে। সেই ক্ষমতা আর ধৈর্য্য যেন হয়! লতিফা পদ্মজাকে চাপাস্বরে ডাকলো, ‘পদ্ম?’

পদ্মজা তাকালো। লতিফা বললো, ‘তুমি আমারে না কইছিলা বড় কাকা আর ছোট কাকার সব খবর দিতে।’

পদ্মজা দরজার বাইরে একবার তাকালো। তারপর লতিফার দিকে ঝুঁকে বললো, ‘কী খবর এনেছো?’

‘শনিবার রাইতে ভোজ আসর বসাইবো।’

‘কীসের?’

লতিফা কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। তার দৃষ্টি অস্থির। সে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘মাইয়া পাচার করার কয়কদিনের মাঝে সবাই এক লগে বইয়া খাওয়া-দাওয়া করে। পরের কাম নিয়া কথাবার্তা কয়।’

‘এটাও কী নিয়ম?

‘হ।’

‘কত্ত খারাপ এরা! এতো মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পেরেছে সেই খুশিতে আনন্দ-ফূর্তি করে! কয়জন থাকবে জানো?’

লতিফা বললো, ‘পাঁচ জনে।’

পদ্মজা আর কথা বাড়ালো না। অন্যমনস্ক হয়ে উচ্চারণ করলো, ‘শনিবার রাতে!’

লতিফা কপাল ইষৎ কুঁচকিয়ে বললো, ‘কিতা করবা ভাবছো?’

পদ্মজা তেজপাতা হাতে নিয়ে বললো, ‘জানি না বুবু।’

পদ্মজা কথা বাড়াতে চাইছে না বুঝতে পেরে লতিফা আর কথা বললো না। সে রিদওয়ানের জন্য খাবার প্রস্তুত করে।।পদ্মজা বললো, ‘ জানো,তোমার ভাই আমার আগে দুটো বিয়ে করেছে!’

লতিফার হাত থেকে থালা পড়ে যায়। ঝনঝন শব্দ হয়। ভাত,ঝোল মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।

মৃদুল পুকুরপাড়ে বসে আছে। তার চোখ দুটি লাল। আজ ট্রেন নেই। আগামীকাল ভোরে ট্রেন আসবে। জুলেখার ফুফাতো বোনের শ্বশুর বাড়ি অলন্দপুরে। আটপাড়ার পাশের গ্রাম নয়াপাড়ায়! জুলেখা সোজা তার বোনের বাড়িতে চলে এসেছে। এখানে আসার পর থেকে বাড়ির পাশে পুকুরপাড়ে বসে আছে মৃদুল। তার জিভ ভারী হয়ে আছে। অকপট বলে দেওয়া কথাটা তাকে খুঁড়ে, খুঁড়ে খাচ্ছে। পূর্ণার কান্নামাখা চোখ দুটি বার বার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় দপদপ করছে মাথার রগ। কান্নারা গলায় এসে আটকে আছে। রাগের বশে সে জীবনে অনেক ভুল করেছে। কিন্তু এইবারের ভুলটা আত্মার উপর আঘাত হানছে। নিজের কথা দ্বারা নিজেই কষ্ট পাচ্ছে। জুলেখা বানু মৃদুলকে খুঁজে পুকুরপাড়ে আসেন। তিনি মৃদুলের উপর বেজায় খুশি! মৃদুলকে বললেন, ‘আব্বা,খাইতে আসো।’

মৃদুল দূর্বল গলায় বললো, ‘পরে খামু। যান আপনি।’

জুলেখা মৃদুলের পাশে বসলেন। মৃদুলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার লাইগগা আসমানের পরী আনাম। মন খারাপ কইরো না।’

‘লাগব না আমার আসমানের পরী।’

মৃদুলের কণ্ঠস্বর কঠিন হওয়াতে জুলেখা বানুর হাসি মিলিয়ে যায়। তিনি বললেন, ‘দেহো আব্বা,তুমি চাইছো আর পাও নাই এমন কিছু আছে? ওই ছেড়ি কালা। ছেড়ির বইনেরও চরিত্র ভালা না…’

‘চুপ করেন আম্মা। আল্লাহর দোহাই লাগে,চুপ করেন। আপনি কারে কি কইতাছেন? পদ্মজা ভাবির নখের যোগ্যেরও কোনো নারী নাই। আর আপনি তারে চরিত্রের অপবাদ দিতাছেন।’

মৃদুল চিৎকার করে কথাগুলো বললো। মৃদুলের চিৎকার শুনে জুলেখার বোনের শ্বাশুড়ি পুকুরপাড়ে উঁকি দেন। সেদিকে তাকিয়ে জুলেখার লজ্জা হয়। মাথা হেট হয়ে যায়। তিনি রাগে চাপাস্বরে বললেন, ‘আমি কইতাছি না গেরামের মানুষ কইছে? ওই ছেড়ির শ্বশুরেও কইছে। এরা মিছা কইছে?’

‘হ কইছে। আমি লিখন ভাইরেও চিনি,পদ্মজা ভাবিরেও চিনি। এই দেশের নামীদামী একজন অভিনেতা কেন অন্য বাড়ির বউয়ের সাথে লুকিয়ে সম্পর্ক রাখব আম্মা? তার কী সুন্দর মাইয়ার অভাব? পদ্মজা ভাবিরে লিখন ভাই পছন্দ করে ঠিক। কিন্তু পদ্মজা ভাবির সাথে আমির ভাইয়ের বিয়া হইবার আগে থাইকা। পদ্মজা ভাবি এমনই পবিত্র একজন মানুষ যে,লিখন ভাই এত্ত ভালোবাসে জাইননাও কোনোদিন লিখন ভাইয়ের দিকে ফেইরা তাকাইছে না। জামাইরে ভালোবাসছে। পদ্মজা ভাবি,দিনরাত এবাদত করে। ভাই-বোনের দায়িত্ব নিছে। এমন মানুষ খুঁইজা পাইবেন? পূর্ণার কাছে ওর বইনে ওর মা। তুমি ওর মারে খারাপ কথা কইছো। এজন্যে ও তোমার সাথে খারাপ করছে। আর পূর্ণা তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে তাই আমিও…’

মৃদুল আর কথা বলতে পারলো না। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। জুলেখা পিছনে ফিরে তাকান। বোনের শ্বাশুড়ি তাকিয়ে রয়েছে! জুলেখার মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে যায়। গটগট শব্দ তুলে জায়গা ছাড়লেন। মৃদুল জুলেখার যাওয়ার পানে তাকালো। সে তার মায়ের স্বভাব জানে। এখন খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিবে। উনিশবিশ হলেই নিজের ক্ষতি করে বসেন। এজন্য গফুর মিয়াও কিছু বলেন না,আর না মৃদুল কিছু বলতে পারে! মৃদুল মাথা নত করে কান্নায় ডুবে যায়। শেষ কবে সে কেঁদেছে জানে না!

পূর্ণা পদ্মজাকে না বলে বাড়িতে চলে গেছে। পদ্মজা এক হাতে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে বসে আছে। মস্তিষ্কে ঘুরাঘুরি করছে আমিরের কু-কীর্তি! তার দুটো বিয়ে,নারী আসক্তি,সমাজের চোখে কলঙ্কিত হওয়া আর ফরিনার মৃত্যু! কানে বাজছে ‘নষ্টা’ শব্দটি। কতো ঘৃণা নিয়ে জুলেখা বানু এই শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন! তারপর মৃদুলের বলা কথাগুলো শুনে পূর্ণার অবাক চাহনি! পূর্ণার রক্তাক্ত হৃদয়ের যন্ত্রণা পদ্মজা টের পাচ্ছে! বুকটা ভারি হয়ে আছে। কান্না মন হালকা করে। কিন্তু কান্না আসছে না। আর কত কাঁদা যায়? পদ্মজা নিজেকে বুঝায়, আরো ধৈর্য্যশীল হতে হবে! এক হাতের দুই আঙুলে কপালের দুই পাশ চেপে ধরে।

আমির সদর ঘরে প্রবেশ করে থমকে যায়। তার হাতে কাপড়ের একখানা খালি ব্যাগ। পদ্মজা পা দেখেই চিনে ফেলে,মানুষটা কে! সে মুখ তুলে তাকালো না। সেকেন্ড কয়েক আমির থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর পদ্মজার পাশ কেটে দ্বিতীয় তলায় উঠে গেল। পদ্মজা অনুভব করে,তার অনুভূতিরা পাল্টে যাচ্ছে। চঞ্চল হয়ে উঠছে! আমির ঘরে প্রবেশ করেই দ্রুত আলমারি খুললো। একবার দরজার দিকে তাকালো। তারপর কাগজে মুড়ানো একটা বস্তু দ্রুত ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। যখন আলমারি লাগাতে যাবে একটা খাম মেঝেতে পড়ে। খামের উপরের লেখাটা আমিরের চেনা-চেনা মনে হয়। তাই সে পদ্মজার অনুমতি ছাড়াই খামের ভেতর থেকেচিঠি বের করলো। চিঠির লেখাগুলো দেখে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে যায়, এটা আলমগীরের চিঠি!

আমিরের ভ্রু দুটি বেঁকে গেল। সে উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রতিটি লাইন পড়লো। প্রতিটি শব্দ তার মগজে আঘাত হানে! আতঙ্কে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। নিজের অজান্তে এক কদম পিছিয়ে আসে। আলমগীরের খামের ভেতরের পৃষ্ঠায় কিছু লেখার অভ্যেস রয়েছে। আমির খাম ছিঁড়লো। তার ধারণা ঠিক! সাদা খামের ভেতরের পৃষ্ঠায় আলমগীরের বর্তমান ঠিকানা ও পাতালঘরের সঠিক অবস্থানের কথা লেখা আছে! আমির আলমগীরের ঠিকানাটা মুখস্থ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু মুখস্থ হচ্ছে না। ভেতরটা কাঁপছে। পদ্মজা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমির পদ্মজার উপস্থিতি টের পেয়ে হাতের খাম ও চিঠিগুলো বিছানার উপর রেখে কাপড়ের ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। তারপর পদ্মজার দিকে তাকালো। তার চাহনি যেন মৃত! পদ্মজা কয়েক পা এগিয়ে এলো। আমির অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা রয়ে সয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ আর কিছু জানার আছে?’

আমির নির্বিকার! তার মুখে রা নেই। পদ্মজা বিছানা থেকে একটা চিরকুট হাতে নিল। বললো, ‘আপনার দুই বউয়ের নাম কী ছিল?’

আমির বললো, ‘শারমিন,মেহুল।’

পদ্মজার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠে। আমির পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পলকও পড়ছে না। পদ্মজা ঢোক গিলে বললো, ‘আমরা যে ঘরে একসঙ্গে থেকেছি,তারাও কি সেই ঘরে আপনার সঙ্গে থেকেছে?’

‘না,অন্য বাড়িতে।’

‘তাহলে সব সত্য?’

‘মিথ্যা বলে যদি তোমাকে আরো একবার পাওয়া যেত আমি মিথ্যা বলতাম।’ আমিরের সরল গলা। পদ্মজার নাকের পাটা ফুলে যায়। আমিরের সাথে কথা বললে তার এতো কান্না পায় কেন! আমির বললো, ‘আসি।’

পদ্মজা শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে বললো, ‘কেন?’

আমির থামলো। পদ্মজা কান্না করে দিল। সে কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আমির বললো, ‘আমাকে কান্না দেখাতে দাঁড় করালে?’

পদ্মজা জল ভরা আগুন চোখে আমিরের দিকে তাকায়। কিড়মিড় করে বললো, ‘ নরপশু আপনি! এতগুলি মেয়ের ভালোবাসা নিয়ে খেলেছেন।’

আমির নির্বাক। তার চুপ করে থাকাটা পদ্মজাকে আরো জ্বালা দেয়। তার অবচেতন মন চায় একবার আমির বলুক, সব মিথ্যে। কিন্তু আমির বলে না। কারণ,সব সত্য! সব সত্য! পদ্মজা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার করে বললো, ‘ কথা বলার মুখ নেই? এতো লজ্জা হা? আসলেই লজ্জা আছে?’

পদ্মজা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। আমির চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বুকের ভেতর আগুন ছুটে বেড়াচ্ছে। যেদিকে যাচ্ছে সেদিকটা পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। পদ্মজা এলোমেলো হয়ে গেছে। আমির বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই পদ্মজা বললো, ‘আমাকে তালাক দিন। আমি আপনার বউয়ের পরিচয়ে আর থাকতে চাই না।’

পদ্মজার কথা শোনামাত্র আমিরের বুকটা কেঁপে উঠলো। কোথেকে যেনো একটা উত্তাল ঢেউ এসে মনের সমস্ত কিনার ওলট-পালট করে দিল। আমির কথা বলতে গিয়ে দেখলো কথা আসছে না। পদ্মজা আরো একবার চেঁচিয়ে বললো, ‘আমার তালাক চাই। আপনার বউ হওয়া কলঙ্কের।’

আমির অনেক কষ্টে কয়টা শব্দ উচ্চারণ করলো, ‘থাক না এক-দুটো কলঙ্ক।’

পদ্মজা সেকেন্ড তিনেক ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর মুহূর্তে ভুলে যায় পৃথিবী। ভুলে যায় পাপ-পুণ্য। ঝড়ের গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমিরের বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ছেড়ে দিলে যদি হারিয়ে যায়! আমিরের বুকের সোয়েটার কামড়ে ধরে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ চলুন না, দূরে পালিয়ে যাই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

পদ্মজা জড়িয়ে ধরতেই আমিরের শরীরের রক্ত চলাচল থেমে যায়। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। সেই জল ফুটন্ত পানির মতো গরম। এ যেন দগ্ধ হওয়া হৃদয়ের আঁচ!

৮৪

হৃদয়ের প্রলয়ঙ্করী ঝড় ক্ষণমুহূর্তের জন্য থামিয়ে আমির বললো, ‘ ছাড়ো পদ্মজা।’

পদ্মজার কান্না থেমে যায়! হাত দুটি আমিরের পিঠ থেকে সরে যায়। পদ্মজা তার জলভরা নয়ন দুটি মেলে আমিরের দিকে তাকালো। তার রক্ত জবা ঠোঁট দুটি কাঁপছে। হোঁচট খাওয়া গলায় পদ্মজা বললো, ‘ আমার হৃদয়ের আকুলতা আপনাকে ছুঁতে পারছে না?’

আমির ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। পদ্মজা দূরে সরে দাঁড়ালো। আমিরের কৃষ্ণ মুখে, বিপর্যস্ত পদ্মজার নিষ্কম্প স্থির চোখের দৃষ্টি থমকে আছে। পদ্মজা থেমে থেমে বললো, ‘ তাহলে আমি…আমিও বঞ্চিত ভালোবাসা থেকে!’

পদ্মজার দুই চোখ বেয়ে জল পড়ছে। আমির আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। চোখের পলকে প্রস্থান করলো। পদ্মজা ধাতস্থ হয়ে আচমকা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো চিৎকার করে উঠলো, ‘ ধিক্কার নিজের উপর! জানোয়ারকে মানুষ হওয়ার সুযোগ দিয়েছি! ধিক্কার নিজের ভালোবাসার উপর! প্রতিটি কাজের জন্য আপনি শাস্তি পাবেন। আমি আপনার আজরাইল হবো।’

পদ্মজার গলার হাড় ভেসে উঠে। তার চিৎকার অন্দরমহলকে কাঁপিয়ে তুলে। কাঁদতে-কাঁদতে সে মেঝেতে বসে পড়লো। আমিরের প্রত্যাখ্যান তার ভালোবাসাকে ক্রোধে পরিণত করছে। পদ্মজা রাগে বিছানার চাদর টেনে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো। বুকের ভেতরটা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে! ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ! পানি প্রয়োজন!

ফরিনার কবরের চারপাশে বাঁশের বেড়া দেয়া হয়েছে। আমির ফরিনার কবরের পাশে এসে বসলো। হাতের ব্যাগটা পাশে রেখে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ফরিনার কবরে হাত বুলিয়ে দিল। গাঢ় স্বরে ডাকলো, ‘আম্মা! আমার আম্মা।’

চারিদিকে নিস্তব্ধতা। অন্দরমহল থেকে কোনো শব্দ আসছে না। নিস্তব্ধতা ভেঙে- ভেঙে মাঝেমধ্যে পাতার ফাঁকেফাঁকে পাখ-পাখালির ডানা নাড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমিরের ঠোঁট দুটো কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। অথবা সে কিছু বলছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। আড়ষ্টতা ঘিরে রেখেছে তাকে। সে তার মৃত মা’কে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। আমির অনেকক্ষণ নতজানু হয়ে চুপচাপ বসে রইলো। তারপর উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ হাতে নিয়ে পাতালঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে। লতিফা অন্দরমহল থেকে অস্থির হয়ে বের হয়। তার হাঁটায় তাড়াহুড়ো।

আমির ডাকলো, ‘ লুতু।’

লতিফা দাঁড়াল। আমির বললো, ‘ পদ্মজার খেয়াল রাখবি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক রাখবি। আর, যখন যা বলে করবি।’

লতিফা মাথা নাড়াল। আমির প্রশ্ন করলো, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’

আমিরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লতিফা বললো, ‘ ভাইজান,তোমারে কিছু কইতাম।’

‘বল।’

‘মৃদুল ভাইজানে আর তার আম্মা-আব্বা আইছিলো। মৃদুল ভাইজানের আম্মা মৃদুল ভাইজানরে পূর্ণার লগে বিয়া করাইতে রাজি হয় নাই। ‘

আমির কপাল কুঁচকাল। বললো, ‘কী সমস্যা? কেন রাজি হয়নি?’

রিদওয়ান অন্দরমহল থেকে বের হয়ে ফোড়ন কাটলো, ‘আমির,তোর সাথে কথা আছে।’

আমির পিছনে ফিরে তাকালো না। বললো, ‘পরে শুনব।’

রিদওয়ান বললো, ‘আমি জানি কেন রাজি হয়নি। আয়,ওদিকে যেতে যেতে বলি।’

লতিফা রিদওয়ানের দিকে তাকায়। রিদওয়ান তার চোখের দৃষ্টি দিয়ে লতিফাকে সতর্ক করে। আমির রিদওয়ানের দিকে ফিরে বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘ আরে ভাই,যা তো। লুতু কী কী হয়েছে বলতো?’

রিদওয়ানের সামনে রিদওয়ান সম্পর্কে কিছু বলার সাহস লতিফার হলো না। সে বললো, ‘ মৃদুল ভাইজানের আম্মা পূর্ণার গায়ের রঙ পছন্দ করে নাই। কইছে,কালা ছেড়ি ঘরে নিব না।’

আমির রাগ নিয়ে বললো, ‘ফালতু মহিলা! পূর্ণা জানে? কোথায় পূর্ণা?’

‘হ জানে। এই বাড়িত আছিলো। এহন হেই বাড়িত গেছে।’

‘মৃদুল…মৃদুল কী বললো?’

লতিফা পুরো ঘটনা খুলে বললো। এড়িয়ে গেল পদ্মজার ব্যাপারটা। সে মনে মনে পরিকল্পনা করলো,রাতে যদি রিদওয়ান অন্দরমহলে থাকে সে পাতালঘরে গিয়ে আমিরকে সব বলবে। আমির সব শুনে বললো, ‘ মৃদুল ছাড়া এই পরিস্থিতি ঠিক হবে না। দেখা যাক,ও কী সিদ্ধান্ত নেয়। আর ওই মুখছুটা মহিলাকে আমি একবার পাই শুধু!’

আমির রাগে গজগজ করতে করতে সামনে এগিয়ে যায়। রিদওয়ান লতিফাকে চাপা স্বরে হুমকি দিল, ‘ গতকালের ঘটনা যদি আমিরের কানে যায় তোর খবর আছে। ল্যাং* করে গাছে ঝুলিয়ে রাখবো।’

লতিফা চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। বললো, ‘ বাড়ির বাইরে গেলেই আমির ভাইজানে সব জাইননা যাইব। তহন ?’

লতিফার প্রশ্ন শুনে রিদওয়ান চিন্তায় পড়ে যায়। সে আমিরের পিছনে যেতে যেতে ভাবতে থাকে,এই পরিস্থিতি কী করে সামাল দিবে! আজ না হয় কাল আমির তো সব জানবে! আমির জঙ্গলে প্রবেশ করে রিদওয়ানকে বললো, ‘ কী কথা না বলবি!’

রিদওয়ান বললো, ‘ শনিবার রাতে ভোজ আসর হবে। চাচা সিদ্ধান্ত নিল।’

‘আচ্ছা।’

‘ছাগলের মাংস পুড়ানো হবে।’

‘কয়টা?’

‘দুটো।’

‘বিরাট আয়োজন!’

দুজন কথা বলতে বলতে পাতালঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিদওয়ান ঘাস সরিয়ে দরজা খুললো। এক পা সিঁড়িতে দিতেই আমির রিদওয়ানের কাঁধ চেপে ধরলো। ফিসফিসিয়ে বললো, ‘এখানে কেউ আছে!’

আমিরের কথা শুনে রিদওয়ানের বুক ছ্যাঁত করে উঠলো। এমতাবস্থায় কে দেখে ফেললো! রিদওয়ান চারপাশে চোখ বুলায়। কোথাও কেউ নেই! আমিরের প্রখরতা নিয়ে তাদের কোনো সন্দেহ নেই। আমির যেহেতু বলেছে এখানে কেউ আছে। মানে আছে। রিদওয়ান চাপাস্বরে বললো, ‘এখন কী করব?’

আমির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাক্তি। সে চারপাশে আরো একবার চোখ বুলিয়ে বললো, ‘ কেউ এখানে থাকলে সে ডান দিকে আছে।’

রিদওয়ান ডান দিকে এগিয়ে যায়। তখনই একজন লোক ঝোপঝাড়ের মাঝখান থেকে উঠে দৌড়াতে শুরু করে। রিদওয়ান উল্কার গতিতে তাকে ধরে ফেললো। লোকটার মাথায় চুল নেই। পরনে লুঙ্গি আর ফতুয়া। পাটকাঠির মতো চিকন লোকটা ইয়াকুব আলীর সহকারী পলাশ মিয়া। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি অথবা ত্রিশই। রিদওয়ান পলাশকে ঘাড়ে ধরে আমিরের সামনে নিয়ে আসে। দেখে মনে হচ্ছে,রিদওয়ান জীবিত ইঁদুর ধরেছে। আমির পলাশকে প্রশ্ন করলো, ‘ নির্বাচনের তো অনেক দেরি আছে। এখনই আমাদের পিছনে পড়ার রহস্যটা বুঝলাম না।’

পলাশ পাতালঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ এইডা কিতা? এইহানে কিতা করেন আপনেরা?’

আমির হাসলো। পলাশের মাথায় টোকা মেরে বললো, ‘ এই দৃশ্য দেখা তোর একদম ঠিক হয়নি। আয়ুটা কমে গেল।’

আমির পাতালে নেমে গেল। পলাশ ছটফট করতে থাকে। সে কিছুতেই ভেতরে যাবে না। সে ভয় পাচ্ছে। রিদওয়ান পলাশকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। আমির বিওয়ানের চেয়ারে এসে বসলো। রিদওয়ান পলাশকে বেঁধে মেঝেতে ফেললো। চিৎকার,চেঁচামেচি করার জন্য পলাশ রিদওয়ানের হাতে দুই-তিনটা থাপ্পড় খেল। পলাশ কাঁদো-কাঁদো হয়ে আমিরকে বললো, ‘ আপনেরা এমন করতাছেন কেন আমার লগে? আমারে ছাইড়া দেন।’

রিদওয়ান আমিরকে বললো, ‘তুই সামলা। আমি যাই,চাচার সাথে কথা আছে।’

আমির ইশারা করলো, যেতে। রিদওয়ান চলে গেল। পলাশ চারপাশ দেখে ঢোক গিললো। পাতালঘর মৃদু লাল-হলুদ আলোতে ডুবে আছে। কেমন ভূতুড়ে পরিবেশ! তার মনে হচ্ছে,সে কবরে আছে। আর সামনে ঘাড় বাঁকিয়ে বসে আছে স্বয়ং যমদূত! আমির এক পা চেয়ারে তুলে বললো, ‘ তারপর,পলাশ মিয়ার এখানে কোন দরকারে আসা হয়েছে?’

পলাশ হাতজোড় করে বললো, ‘আমারে ছাইড়া দেন। আমি এমন কবর আর দেহি নাই। আমার কইলজাডা কাঁপতাছে।’

আমির ধমকে বললো, ‘এখানে আসছিলি কেন?’

পলাশ দ্রুত বললো, ‘ ইয়াকুব চাচা পাডাইছে।’

‘কোন দরকারে?’

‘আমারে খালি কইছে,মজিদ মাতব্বরের বাড়িত যা। আমার মনে হইতাছে ওই বাড়িত কিছু একটা গোলমাল আছে। কিছু যদি বাইর করতে পারছ তোরে আরেকটা বিয়া দিয়া দিয়াম।’

আমির চমকাল। বললো, ‘উনার হুট করে কেন মনে হলো এখানে গোলমাল আছে?’

পলাশ কেঁদে বললো, ‘আমি এইডা জানি না ভাই। আমারে ছাইড়া দেন।’

আমিরের মাথায় কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে যায়। কী এমন হলো যে, ইয়াকুব আলী হাওলাদার বাড়ি নিয়ে সন্দেহ করছে! আমির আয়েশি ভঙ্গিতে বসলো। বললো, ‘ শুনেছি,গত বছর তোর বউকে নাকি হিন্দু এক জমিদারের কিনে নিয়েছে । তারপর তোর বউ আত্মহত্যা করলো! সত্যি?’

পলাশ মেঝেতে কপাল ঠেকিয়ে বললো, ‘ভাই,আমারে মাফ কইরা দেন। আমি ভুল করছিলাম। আমারে ছাইড়া দেন। আমি কেউরে কিছু কইতাম না।’

আমির বললো, ‘তুইতো ভাই আমার চাইতেও খারাপ। আচ্ছা,সবসময় তো পাপ কাজ করেছি। আজ একটা ভালো কাজ করার সুযোগ যখন পেয়েছি,করে ফেলি।’

পলাশের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। সে জানে না,এই কবরস্থানের মতো বড় ঘরটায় কী হয়! কিন্তু এখানে যে ভালো কিছু হয় না বুঝা যাচ্ছে। বাঁচতে পারলে পরে এর রহস্য বের করা যাবে। আমির চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পলাশের মুখে জোরে লাথি দিল। পলাশ আর্তনাদ করে শুয়ে পড়ে। আমির চারিদিকে চোখ বুলিয়েও কোনো অস্ত্র পেল না। সে টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা কাঁচি বের করলো। ধারালো কাঁচি। সে কাঁচি দিয়ে পলাশের মুখে আঁচড় কাটে। হাতে-পায়ে,শরীরে আঁচড় কাটে। পলাশের বিদঘুটে চিৎকার পাতালঘরেই চাপা পড়ে যায়। তার চামড়া ছিঁড়ে রক্ত ঝরতে থাকে। আমিরকে আব্বা ডেকে অনুরোধ করে,তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সে জানে না, আমির কখনো তার শিকারের প্রতি মায়া দেখায় না। আমির পলাশের পাশে বসলো। দুই-তিনবার মাথা ঘুরাল। খুব নিঃস্ব লাগছে নিজেকে,মাথাটা ফাঁকা লাগছে। সে কাঁচি দিয়ে নিজের হাতে হেঁচকা টান মারে। সাথে-সাথে হাত থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে। পলাশ আমিরের কাণ্ড দেখে চমকে যায়। আমির কাঁচি রেখে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। শূন্যে চোখ রেখে হাসে। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি করে দেয়ালের পাশে যায়। ভয়ে পলাশের আত্মা কেঁপে উঠে! আমির দেয়ালের পাশ ঘেঁষে বসে। পলাশের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠে। হঠাৎ করে তার কী হয়ে গেল? আমিরের উন্মাদ আচরণ দেখে পলাশের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে। আমির চট করেই উঠে দাঁড়াল। পলাশকে টেনে বসালো। তারপর নিজে গিয়ে চেয়ারে বসলো।

ব্যাগ থেকে কাগজে মুড়ানো বস্তুটি বের করলো। কাগজের ভাঁজ খুলতেই একটা লাল বেনারসি বেরিয়ে আসে। আমির লাল বেনারসি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে পলাশকে বললো, ‘আমার আম্মা ছোটবেলা একটা গল্প বলতেন,এক রাজা প্রতি রাতে বিয়ে করে প্রতি রাতেই বউকে খুন করতেন। তারপর শেষদিকে যে রানিকে বিয়ে করেন সেই রানি রাতজেগে রাজাকে গল্প শোনাতেন। গল্প শেষ হতো না বলে রাজাও রানিকে খুন করতে পারতেন না। রানি এভাবে গল্প বলে-বলে অনেকদিন বেঁচে ছিলেন। এখন আমি তোকে একটা গল্প শোনাব। আমাদের নিয়ম হচ্ছে,যতক্ষণ আমার গল্প চলবে ততক্ষণ তুই বেঁচে থাকবি। গল্প শেষ তোর আয়ুও শেষ।’

পলাশ হাতজোড় করে আকুতি-মিনতি করলো, ‘ ভাই,আমার জীবন ভিক্ষা দেন। আপনেরা তো ভালা মানুষ ভাই। আপনেরার অনেক নাম। আমারে কেন মারতে চাইতাছেন? আমারে ছাইড়া দেন ভাই।’

পলাশের কথায় আমিরের ভাবান্তর হলো না। সে বেনারসি থেকে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করলো। তারপর শূন্যে চোখ রেখে ঘোর লাগা গলায় বললো, ‘ এক ছিল দুষ্টু রাজা! নারী আর টাকার প্রতি ছিল তার চরম আসক্তি। যে নারী একবার তার বিছানায় যেত তার পরের দিন সে লাশ হয়ে নদীতে ভেসে যেত। রাজা এক নারীকে দ্বিতীয়বার ছুঁতে পছন্দ করতো না। কিন্তু সমাজে ছিল রাজার বেশ নামডাক! সবার চোখের মণি। খুন করা ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। তার কালো হাতের ছোঁয়ায় বিসর্জন হয়েছে হাজারো নারী। প্রতিটি বিসর্জন রাজার জন্য ছিল তৃপ্তিকর। তাকে শাস্তি দেয়ার মতো কোনো অস্ত্র ছিল না পৃথিবীতে। ভাইয়ের সাথে বাজি ধরে হেরে যায় রাজা। শর্তমতে,ভাইয়ের জন্য এক রাজকন্যাকে অপহরণ করতে যায়। সেদিন ছিল বৃষ্টি। সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। রাজকন্যার প্রাসাদে সেদিন কেউ ছিল না। রাজা এক কামরায় ওৎ পেতে থাকে। রাজকন্যা আসলেই তাকে তার কালো হাতে অপবিত্র করে দিবে। কামড়ায় ছিল ইষৎ আলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত আসে। রাজকন্যার পা পড়ে কামড়ায়। রাজকন্যা রাজাকে দেখে চমকে যায়। ভয় পেয়ে যায়। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে ‘‘কে আপনি? খালি বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?’ সেই কণ্ঠ যেন কোনো কণ্ঠ ছিল না। ধনুকের ছোঁড়া তীর ছিল। রাজার বুক ছিঁড়ে সেই তীর ঢুকে পড়ে। রিনঝিনে গলার রাজকন্যাকে দেখতে রাজা আগুন জ্বালাল। আগুনের হলুদ আলোয় রাজকন্যার অপরূপ মায়াবী সুন্দর মুখশ্রী দেখে রাজা মুগ্ধ হয়ে যায়। তার পা দুটো থমকে যায়। রাজকন্যা যেন এক গোলাপের বাগান। যার সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে রাজার কালো অন্তরে। রাজা কী আর তখন বুঝেছিল,সৃষ্টিকর্তা তাকে তার পাপের শাস্তি দেয়ার জন্য সেদিন অস্ত্র পাঠিয়েছিল!’

আমির পলাশের দিকে তাকিয়ে হাসলো। কী মায়া সেই হাসিতে! মায়াভরা সেই হাসি প্রমাণ করে দিল,সেদিনটার জন্য সে কতোটা খুশি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *