আমি পদ্মজা – ৬৫

৬৫

তুষার হাঁসফাঁস করা অস্বস্তিকর ভ্যাপসা গরমে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। পদ্মজা তখনও শূন্যে দৃষ্টি রেখে বিড়বিড় করছে। মেয়েটা যেদিকে তাকায় সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। তুষার রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ডাকলো, ‘মিস পদ্মজা?’

পদ্মজা তাকাল। তার চোখ দুটি ফোলা। আর ঠোঁট দুটি সবসময় তিরতির করে কাঁপে। তুষারের তীক্ষ্ণ চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে পদ্মজা বললো, ‘আমার ফাঁসি কবে হবে? এত দেরি হচ্ছে কেন?’

পদ্মজার কণ্ঠে ফাঁসির জন্য আকুতি! একটা মানুষ কতোটা নিঃস্ব হলে পৃথিবী থেকে মুক্তি চায়? তুষারের ধারণা নেই। সে তার ভেতরের মায়া লুকিয়ে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো, ‘আপনাকে যা প্রশ্ন করা হয়েছে তার উত্তর দিলেন না তো?’

পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কোন প্রশ্ন?’

মুহূর্তে ভুলে গিয়েছে! তুষার অবশ্য এতে রাগলো না। সে আবার প্রশ্ন করলো, ‘তিনি কি পাপ থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেছিলেন? তারপর আর ভালোবেসেছিলেন আপনাকে?’

‘আগে বলুন,পিশাচের মতো যাদের আচরণ তারা কাউকে ভালোবাসতে পারে?’

তুষার তার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবলো। ভেবে বললো, ‘পারে। তারা কম মানুষকে ভালোবাসে। কিন্তু যাকে ভালোবাসে তার সাথে সব ভালো করে। আর যার সাথে খারাপ তার সাথে খারাপই। তবে এদের পিশাচসিদ্ধে বাঁধা পড়লে তখন ভালোবাসা থাকে কি না আমার জানা নেই।’

পদ্মজা উদাস হয়ে বললো, ‘আমি সব জেনে যাওয়ার পর,কখনো মনে হতো তিনি ব্যাকুল আমার জন্য। আর কখনো মনে হতো আমার সামনে স্বয়ং শয়তান দাঁড়িয়ে আছে। এই ভালো,এই খারাপ! উনি উন্মাদের মতো হয়ে যেতেন। কি করছেন না করছেন তা যেন নিজেও বুঝতেন না।’

‘আই থিংক, তিনি দুটো জীবন নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিলেন। তারপর সময় চলে আসে একটা বেছে নেয়ার তখন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।’

পদ্মজা চকিতে তাকাল। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো, ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত!’

.

অতীত।

শিশির ভেজা ঘাসে পা দিতেই সর্বাঙ্গ শীতল হয়ে উঠছে। ব্যাপারটা পূর্ণার বেশ ভালো লাগছে। সে ভোরের নামায পড়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে এসেছে তার বোনের খবর যেন পাওয়া যায়। এখন সে উত্তরের হাওড়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে মৃদুলের জন্য। ভোরের দমকা বাতাস ও কুয়াশায় তীব্র শীতে সে কাঁপছে। তবুও ভালো লাগছে। পূর্ণার শীতে কাঁপতে খুব ভালো লাগে! কি আশ্চর্য ভালো লাগা! মৃদুল কুয়াশা ভেদ করে পূর্ণার সামনে এসে দাঁড়াল। পূর্ণার পরনে বেগুনি রঙের সোয়েটার। তার কাঁপুনি চোখে পড়ার মতো। মৃদুল তার গায়ের শাল দিয়ে পূর্ণার মাথা ঢেকে দিল। বললো, ‘এই ঠান্ডার মধ্যে টুপি ছাড়া ঘর থাইকা বাইর হইছো কেন? আর জুতা খুলছো কেন? পরো।’

‘পরো’ শব্দটি ধমকে উচ্চারণ করলো। পূর্ণা দ্রুত জুতা পরে নিল। বললো, ‘শাল দিয়ে দিলেন যে,আপনার ঠান্ডা লাগবে না?’

‘আমারে দেইখা লাগে আমার ঠান্ডা লাগতাছে? গেঞ্জি পরছি,তার উপর শার্ট, তার উপর সোয়েটার। এইযে গলায় মাফলার, মাথায় টুপি। হাত,পায়েও মোজা আছে। এরপরেও আমার ঠান্ডা লাগবো?’

পূর্ণা হেসে বললো, ‘না।’

তারপর পরই বললো, ‘আজ দুপুরে না আবার যাবেন বলছিলেন।’

‘হু,যাব তো। লিখন ভাইরে নিয়া যাবো। পদ্মজা ভাবি আমির ভাইয়ের সাথে যখন আছে ভালোই আছে। তবুও খোঁজ নিমু আমি। এতো চিন্তা কইরো না।’

পূর্ণা অন্যমনস্ক হয়ে বললো, ‘আচ্ছা।’

‘খাইয়া আইছো?’

মৃদুলের ফর্সা গাল,সহজ-সরল দুটি চোখ,জোড়া-ভ্রু আর গোলাপি ঠোঁটগুলো এক নজর দেখে পূর্ণা বললো, ‘হুম। আপনি খেয়েছেন?’

‘আর খাওয়া।’

‘কেন? খাননি?’

‘জাকিররে চিনো না? জাকিরের বাড়িত উঠছি। ওর আম্মা গেছে বাপের বাড়ি। ওর আব্বা আর আমি একসাথে আছিলাম। রাঁধবো কে?’

‘জাকিরের দাদি কোথায়?’

‘বুড়ির অসুখ। আইচ্ছা বাদ দেও।’

‘বাদ দেব কেন? ফুপা কয়টা কথা বলেছে বলে এভাবে বাড়ি ছেড়ে দিবেন? নিজেরই তো ফুপা।’

‘আত্মসম্মান বলে তো একটা কথা আছে। পদ্মজা ভাবির খোঁজটা তোমারে দেওনের লাইগগাই আছি। নইলে রাইতেই যাইতামগা। আমার এতো বড় বাড়ি রাইখা আমি এইহানে কথা শুনে পইড়া থাকুম কেন?’

পূর্ণা রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে জানতে চাইলো, ‘তাহলে আজ চলে যাবেন?’

মৃদুল পূর্ণার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আড়চোখে পূর্ণার দিকে তাকাল। পূর্ণা চোখ বড় বড় করে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। মৃদুল মুচকি হাসলো। মৃদুলের হাসি দেখে পূর্ণা উশখুশ করে বললো, ‘হাসার কি বললাম?’

‘তুমিও চলো।’

‘কোথায়?’

‘আমার বাড়িতে।’

‘ধুর! এ হয় নাকি!’

মৃদুল কপালে ভাঁজ সৃষ্টি করে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, ‘সব পুরুষরা তো বিয়ে করে বউ নিয়ে নিজের বাড়িতেই যায়। তাহলে আমার বেলা এ হয় না ক্যান?’

মৃদুলের কথায় পূর্ণা বাকরুদ্ধ! মৃদুল তাকে বিয়ের কথা বলেছে! পূর্ণার শ্যামবর্ণের মায়াবী মুখটায় লজ্জারা জমে বসে। ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠে। সে উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করলো। মৃদুল বললো, ‘চলে যাইতাছো ক্যান?’

‘আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন।’

‘আরে যাইয়ো না।’

‘যাচ্ছি।’

‘কথা হুনো।’

পূর্ণা থামে না। তাই মৃদুল দৌড়ে আসে পূর্ণার পাশে। হাঁপাতে, হাঁপাতে বললো, ‘এতো শরম পাও ক্যান?’

পূর্ণা লজ্জাশরম আর নিতে পারছে না। মৃদুলের কথায় সে লজ্জায় ঝিমিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো, ‘আমাদের বাড়িতে চলুন। খেয়ে যাবেন।’

‘উম,খাওন যায়। বাসন্তী খালার রান্না কিন্তু এক্কেরে খাঁটি।’

‘আপনি তো বড় আম্মার সব রান্না খেয়ে দেখেননি। খেলে বুঝতেন কত মজা!’

‘তাহলে তো এই বাড়িতে জামাই হতেই হবে।’

পূর্ণা হেসে দিল। বেশি লজ্জা পেলে মানুষ হাসি আটকে রাখতে পারে না। পূর্ণার বেলাও তাই হলো। তারা দুজন গল্প করতে করতে মোড়ল বাড়িতে আসে। পথেঘাটে অনেকের সাথে দেখা হয়। সবাই জহুরি চোখে তাদের দেখে। তাতে অবশ্য মৃদুল-পূর্ণার যায় আসে না। দুজন একই রকম।তারা সমাজকে উপেক্ষা করে নিজেদের আনন্দ নিজেরা বুঝে নিয়েছে। কিন্তু সমাজকে উপেক্ষা করতে চাইলেও কি উপেক্ষা করা যায়? এই সমাজ নিয়েই বাঁচতে হয়।

দুপুরে মৃদুল লিখনের খোঁজে গেওয়া পাড়ার বড় ধানক্ষেতে আসলো। ধানক্ষেতের মাঝে শুটিং চলছে। একটা সুন্দর গ্রাম্য গানের তালে,লিখন নাচছে। মাথায় গামছা বাঁধা। পরনে লুঙ্গি,শার্ট। সব বেশভূষাতেই তাকে সুন্দর লাগে। আকর্ষণীয়! দূরের পথের বট গাছের আড়ালে কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা তাদের স্বপ্নের পুরুষকে দেখছে। যার সামনে দাঁড়ানোর সাহস এবং ক্ষমতা কোনোটাই তাদের নেই। লিখনের সাক্ষাৎ তাদের ঘুম কেড়ে নেয়। মৃদুল দাঁড়িয়ে থেকে শুটিং দেখে। লিখনের খেয়ালে মৃদুল পড়তেই সে হাত নাড়ায়। মৃদুলও হাত নাড়ালো। শুটিং শেষ হতেই লিখন আসে। মাথা থেকে গামছা সরাতেই ঝাঁকড়া চুলগুলো সূর্যের আলোয় ঝলমল করে উঠে। সে মৃদুলের সাথে করমর্দন করে বললো, ‘দুঃখিত, তোমাকে অপেক্ষা করতে হলো।’

‘আমার ভালোই লাগতেছিল।’

একজন দুটো চেয়ার নিয়ে আসে। লিখন বললো, ‘বসো।’

দুজন বসলো। মৃদুল বললো, ‘ও বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি যাবা তো?’

‘হু যাবো। তবে,আমি বাড়ির চেয়ে দূরে থাকবো। বাড়ির ভেতর বা কাছে যাব না। এটা ভালো দেখাবে না।’

‘খারাপ দেখাইবো কেন?’

‘আর বলো না, একজন মজার ছলে আজ আমাকে বলেছে, আমাকে হাওলাদার বাড়িতে দেখা যায় সবসময়। কার জন্য যাই? পদ্মজার জন্য নাকি? আমাদের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল নাকি। এমন অদ্ভুত কথা। কিন্তু গিয়েছি মাত্র দুই দিন। একজনের মুখ থেকে আরেকজনের মুখে এভাবে ছড়িয়ে গেলে পদ্মজার জন্য খুব খারাপ হবে। সম্মানহানি হবে।’

‘মানুষ মিথ্যা কইলেই হইবো?’

‘তোমাকে আমি আগেও বলেছি,পদ্মজা একবার অসম্মানিত হয়েছে। এজন্য আমার খুব ভয় করে। আমার এই একটাই ভয়। মিথ্যে হউক অথবা সত্য,পদ্মজা দুর্নামি হউক সেটা চাই না।’

‘তাইলে যাওনের কি দরকার?’

লিখন হাসলো। হেসে বললো, ‘রাগ করো না মৃদুল। ছয় বছর আগ থেকেই আমার নামের সাথে পদ্মজার নাম জড়িয়ে একটু কানাঘুষা আছে। এখন যদি বার বার ওই বাড়িতে যাই মানুষ অনেক কথা বানাবে।’

‘বুঝছি ভাই। রাগ করি নাই।’

‘তাহলে চলো। আমি কাপড় পাল্টে নিই। তারপর যাবো।’

দুজন চলে আসে হাওলাদার বাড়িতে। লিখন হাওলাদার বাড়ির চেয়ে দূরে একটা মাঠে অপেক্ষা করে। দারোয়ান মৃদুলকে ঢুকতে দিল। মৃদুল দারোয়ানের পেটে থাপ্পড় দিয়ে বললো, ‘শালার পেটলা! এখন ঢুকতে দিলি ক্যান?’

‘বড় চাচায় কইছে।’

মৃদুল আলগ ঘরের বারান্দায় দেখলো মজিদকে। সে দারোয়ানের মাথায় একটা টোকা দিয়ে আলগ ঘরে চলে আসে। মজিদ হাওলাদার চেয়ারে বসে বই পড়ছেন। এই মানুষটা মৃদুলের খুব পছন্দের। এমন সৎ,উদার মানুষ সে দুটো দেখেনি। দেখলেই ভক্তি চলে আসে। অলন্দপুরের মানুষ সুখী এই মানুষটার জন্যেই। সবসময় বাইরে থাকেন। হুটহাট বাড়িতে পাওয়া যায়। মৃদুল মজিদের সামনে এসে দাঁড়াল।সালাম দিল, ‘আসসালামু আলাইকুম মামা।’

মজিদ হাওলাদার বই থেকে চোখ তুলে উত্তর দিলেন, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। মৃদুল নাকি?’

‘জি,মামা।’

‘তুমি বাড়ি ছেড়ে কোথায় গিয়েছো? রাতে দেখলাম না।’

মৃদুল মাথা নত করে বললো, ‘আলম ভাইয়ের বাড়িতে। জাকিরের আব্বা।’

‘তুমি আমার বাড়ি রেখে অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকছো,এটা ঠিক না মৃদুল। আমি অসন্তুষ্ট হয়েছি।’

‘কেউ অপমান করলে কি আর থাকা যায়?’

‘শুনছি আমি, এটা খলিলের বাড়ি নাকি আমার বাড়ি? তুমি এখানেই থাকবে।’

‘আইজ চইলা যামু বাড়িত।’

‘এ তো তোমার রাগের কথা। রাগের সিদ্ধান্ত। আর কয়টা দিন থেকে যাও। ফুপার কথা রাখো। তোমার আব্বা শুনলে কি বলবেন?’

‘আব্বারে কইতাম না।’

‘যা বলছি শুনো।’

‘আচ্ছা,মামা।’

‘যাও ঘরে যাও। দুপুরের খেয়েছো? না খেলে খেয়ে নাও।’

‘যাইতাছি। আচ্ছা,মামা আমির ভাই কই?’

‘আমিরতো ঢাকা গেছে।’

‘কয়দিন ধরে?’

‘গতকাল বিকেলেই গেল।’

‘পদ্মজা ভাবিরে নিয়ে গেছে?’

‘হুম। দুজনই গিয়েছে। চলে আসবে দুই-তিনদিনের মধ্যে।’

‘আচ্ছা মামা,গত কয়দিন আমির ভাই কই আছিল?’

‘ঢাকা ছিল। তারপর এসে পদ্মজাকেও নিয়ে গেছে। পদ্মজার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ব্যাপার বোধহয়। এত কি আর আমাদের বলে? তুমি এতো ভেবো না। যাও খেতে যাও।’

মৃদুল মজিদের কথা বিশ্বাস করে নিল। অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না। মৃদুল ভাবলো। তাহলে দাঁড়াল যে, ‘আমির ভাই এতদিন ঢাকা ছিল তাই পদ্মজা ভাবিকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। এজন্য কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আমির ভাই পদ্মজা ভাবির জন্য কেমন পাগল সবাই জানে! তাই এই পাগলামি মানা যায়। তারপর কোনো জরুরী কাজে পদ্মজা ভাবিকেও নিয়ে যাওয়া হয়। মজিদ মামার কথামতো সেই জরুরি কাজ পদ্মজা ভাবির বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ব্যপার হতে পারে। পরীক্ষা বা অন্য কিছু।’

মৃদুল মনে মনে খুশি হয়। সে মজিদকে বললো, ‘মামা আমি আইতাছি।’

তারপর বেরিয়ে আসলো। লিখনকে সব বললো। তার ভাবনাও জানালো। লিখনও মেনে নিল। মৃদুল চলে যেতেই মজিদ হাওলাদার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমিনার কাছ থেকে তিনি শুনেছেন,মৃদুল,লিখন এসেছিল। আর কী কথা হয়েছিল তাও জেনেছেন। তাই গুছিয়ে ব্যাপারটাকে সামলাতে পেরেছেন।

.

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে পদ্মজা। তাকে স্বাগতম দরজা দিয়ে এওয়ান( A1) নামে একটা ঘরে রাখা হয়েছে। দুপুর অবধি সে ঘরে বন্দি ছিল। হাত-পা বাঁধা ছিল না। তারপর যখন কতগুলো মেয়ের বুকফাটা আর্তনাদ তাকে কাঁপিয়ে তুলে, বাতাস ভারি হয়ে ওঠে তখন দরজায় জোরে,জোরে শব্দ করেছে। ফলস্বরুপ তার হাত-পা বেঁধে তাকে অন্য দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। রাফেদ নিয়ে এসেছে। গত রাতের পর আমিরের সাক্ষাৎ আর মিলেনি। মানুষটা এখানেই আছে,সে কণ্ঠ শুনেছিল। শুধু তার কাছে আসেনি।

আমির পাতালঘরের দরজার সামনে বসে আছে। এক পাশে ধ-রক্ত লেখা দরজা,অন্য পাশে স্বাগতম দরজা। ধ-রক্তের ভেতর চারটি ঘর। স্বাগতমের ভেতর পাঁচটি ঘর। এ নিয়েই পাতালঘর। সে হাতের উপর কপাল ঠেকিয়ে কিছু চিন্তা করছে। কপালের রগগুলো দপদপ করছে। সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। রিদওয়ান,খলিলের এখানে আসার কথা ছিল। সকালে মজিদ ও খলিলের সাথে তার কথা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ আহত হলে হাসপাতালে রাখা হয় না। নিজেদের দেখাশোনা নিজেদের করতে হয়। রিদওয়ানের জ্ঞান ফিরেছে। তবে অবস্থা ভালো নয়। এতে আমিরের যায় আসে না। বেঁচে আছে তো তাকে হাসপাতালে আর থাকতে দিবে না। অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য্য হয়ে আমির উঠে পড়ে। তখন ফট করে পাতাল দরজা খুলে যায়। প্রবেশ করে মজিদ,খলিল আর রিদওয়ান। রিদওয়ানের মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। মাথায় ব্যান্ডেজ। চোখ নিভু,নিভু। খলিলের হাতে বিভিন্ন ঔষধপত্র, স্যালাইন। মজিদ প্রবেশ করেই বললেন, ‘তোর বউ কোথায়?’

আমির উত্তর দিল না। সে পদ্মজার ব্যাপারে কথা বলতে আগ্রহী নয়। খলিল বললেন, ‘এই ছেড়ির কইলজাডা বেশি বড়। এইহানে আইয়া পড়ছে। আমি কইতাছি ভাই, এই ছেড়িরে সময় থাকতে সরায়া না দিলে এই ছেড়ি একদিন আমরারে সরায়া দিব। বাবলুর মতো জাত খুনিরে মাইরা ফেলছে। আর আমরারে পারব না?’

আমির কারো সাথে কোনোরকম কথা না বলে, ‘রিদওয়ানের শার্টের কলার চেপে ধরলো। কিড়মিড় করে চাপাস্বরে বললো, ‘পদ্মজার গলায় দাগ হলো কী করে? ‘

রিদওয়ানের অবস্থা শোচনীয়। তাকে আরো কয়টা ঘন্টা সময় দিলে সে কিছুটা শক্ত হয়ে যেত। আমির এভাবে চেপে ধরাতে তার জান বেরিয়ে আসতে চাইছে। মজিদ আমিরকে টেনে সরিয়ে আনে। বলে, ‘মারিস না,মরে যাবে।’

আমির তার ভয়ংকর চোখ দুটি রিদওয়ানের মুখের উপর রেখে বললো, ‘কুত্তার বাচ্চারে আমি জবাই দেব।’

‘আমির আব্বা, এখন বউয়ের প্রতি মায়া দেখানোর সময় না। মাত্র আট দিন বাকি। রিদওয়ানকে সুস্থ হতে হবে। আমাদের সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। একুশজন মেয়ে আটদিনের মধ্যে যোগাড় করতে হবে।’

মজিদের কথা আমিরের উপর কাজ করে। সে খলিলকে বলে, এটু( A2) ঘরে রিদওয়ানকে রাখতে। খলিল রিদওয়ানকে নিয়ে যান। মজিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমিরকে দেখে বললেন, ‘আমরা কিন্তু এখন বিপদের উপরে আছি। কিছুতেই মন অন্য জায়গায় দেয়া যাবে না। বিপদ থেকে রক্ষা না পেলে এতদিনের কষ্টে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য জলে যাবে। তোর হাতে সব দিয়েছি। কারণ, আমি জানি আমার ছেলে বাঘের বাচ্চা। সে সব কিছু পারে। থাবা দিয়ে সব ধ্বংস করে দিতে পারে। অর্থের উপরে কিছু নেই। অর্থ দিয়ে সব কেনা যায়।’

মজিদের কথাগুলো আমিরের উপর বিষাক্ত বিষের মতো প্রভাব ফেলে। মুহূর্তে মধ্যেই তার পূর্বের ধ্যান-জ্ঞান মস্তিষ্ক জুড়ে বসে। পদ্মজার সাথে দেখা হওয়ার পর সে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এমন তো হওয়া যাবে না। কিছুতেই না। নারীর আকুতি-মিনতি আর অর্থের চেয়ে সুন্দর পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আমির অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘাড় বাঁকাল। তারপর মজিদকে নিয়ে ধ-রক্তে প্রবেশ করলো। ধ-রক্তের বিওয়ান(B1) ঘরে প্রবেশ করতেই মজিদের মনটা ভরে যায়। নগ্ন কতগুলো দেহ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে এক-দুটো নড়ছে। গোঙাচ্ছে! যা তাদের জন্য চক্ষু শীতল দৃশ্য। আরভিদ এসে জানালো, ‘ দুটো মেয়ে মারা গেছে।’

আমির ভ্রুকুটি করে জানতে চাইলো, ‘কোন দুটি মেয়ে?’

আরভিদ লাঠি দিয়ে ঠেলে দুটি নিস্তেজ দেহ দেখালো। আমির বললো, ‘ দুটোকে আলাদা করো। আর একটা বস্তা আর ছুরি,রাম দা নিয়ে আসো। চাচারে বলবা আসতে।’

আরভিদ চলে গেল। মজিদ বললেন, ‘আজ ট্রলার লাগবে?’

‘লাগবে। লাশ রেখে দিলে দূর্গন্ধ ছড়াবে। আর মন্তুরে বলে দিও, বড় নদীতে ফেলতে। মাদিনীতে যেন না ফেলে। শফিক বলছে, কয়দিন পর পর একই নদীতে লাশ পায় যা সন্দেহবাতিক। ওদের থানায় তদন্ত চলছে।’

মজিদ মহা বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘মন্তুরে মনে চায় জুতা দিয়ে পিটাই। বার বার বলার পরও একই ভুল করে।’

‘কয়টা ঘা দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’

রাফেদ পদ্মজার জন্য খাবার নিয়ে আসে। প্লেট বিছানার এক পাশে রেখে পদ্মজার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েই রাফেদ কিছু বুঝে উঠার পূর্বে রাফেদকে জোরে ধাক্কা মারলো পদ্মজা। রাফেদ এমন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। দুশো বছরের পুরনো পাতালঘরের দেয়ালে বারি খেতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। ততক্ষণে পদ্মজা বেরিয়ে যায়। পদ্মজা নিশ্চিত হয়ে গেছে,তাকে কেউ আক্রমণ করবে না। আমির আক্রমণ করতে নিষেধ করেছে। তাই সে নির্ভয়ে রাফেদকে আঘাত করে বেরিয়ে আসে। এক ছুটে প্রবেশ করে ধ-রক্তে। আমিরের সাথে তার কথা আছে। সে কি চায়? জানতে চায়। এভাবে সময়টাকে থামিয়ে রাখলে চলবে না। বিওয়ান(B1) ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল পদ্মজা। গতকাল দেখেনি দরজার বিওয়ান লেখাটি। আজ দেখেছে। তার বুক কাঁপছে দুরুদুরু! মজিদ হাওলাদারের হাসি শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে গোঙানির শব্দ। পদ্মজার লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ে। সে দরজা ঠেলে উঁকি দেয়। গতকাল দৃশ্যের চেয়েও ভয়ংকর এক দৃশ্য ভেসে উঠে। মেঝেতে রক্তের বন্যা। প্রতিটি মেয়ে অচেতনের মতো পড়ে আছে। তারা চিৎকার করছে না। যেন প্রাণ যাওয়ার অপেক্ষাতেই আছে তারা। মজিদ হাওলাদার লাঠি দিয়ে মেয়েগুলোর স্পর্শকাতর স্থানে পাশবিক উল্লাসে আঘাত করছে। তার চেয়ে কিছুটা দূরে দামী একখানা চেয়ারে বসে আমির কিছু কাগজ দেখছে। পাশেই খলিল হাওলাদার বসে আছেন। একটা মেয়ের দেহ ছুরি দিয়ে কেটে বস্তায় ভরছেন। যাতে কেউ দেহ শনাক্ত না করতে পারে। সামনে রয়েছে রাম দা তিনটে। বীভৎস দৃশ্যটি যে কাউকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তুলবে। পদ্মজার বেলাও তা হয়। বমি গলায় এসে আটকে যায়। শরীর বেয়ে একটা আগুন ছুটে এসে মাথায় থেমে যায়। সঙ্গে,সঙ্গে পদ্মজার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। সে ঝড়ের গতিতে তেড়ে এসে বয়স্ক শয়তান মজিদকে এক ধাক্কায় ছুঁড়ে ফেলে দূরে। মজিদ হাওলাদার উঁবু হয়ে পড়ে যান। নাক ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। মজিদ মেঝেতে উঁবু হয়ে পড়তেই খলিল উঠে দাঁড়ায়। পদ্মজার চুলের মুঠি টেনে ধরে। সেকেন্ড খানিক পার হতে পারেনি তার আগেই আমির খলিলকে থাবা দিয়ে সরিয়ে দেয়। এক হাতে জড়িয়ে ধরে পদ্মজাকে। আমিরের ছোঁয়া গায়ে লাগতেই পদ্মজা ছ্যাঁত করে উঠলো। এই ঘৃণ্য মানুষটিকে সে এখন সহ্য করতে পারছে না। আমিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মেঝে থেকে রাম দা তুলে নিল। আমিরের দিকে রাম দা তাক করে সাপের মতো হিশহিশ করতে করতে বললো, ‘আমি কিন্তু মেরে দেব। একদম…একদম মেরে দেব।’

পদ্মজার গলা কাঁপছে,শরীর কাঁপছে। চারপাশে রক্তাক্ত দেহ ছড়িয়ে আছে। এক পাশে মানুষের দেহের টুকরো! সে ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। এই পরিবেশ সে নিতে পারছে না। এমন নির্দয়,বর্বর মানুষ ছিল পাক সেনারা। এই কথা সে শুনেছে তার মায়ের কাছে। সে যেন পাক সেনাদের বাঙালি রূপে দেখছে। পদ্মজা অস্থির হয়ে চারপাশ দেখে। মেয়েগুলো কীভাবে বাঁচানো যায়? জানা নেই। কোনো পথ নেই। খলিল পদ্মজার দিকে ছুরি ছুঁড়ে মারার জন্য উদ্যত হয়,তখন আমির হুংকার দিয়ে উঠলো, ‘শুয়ো** বাচ্চা,হাত নামা।’

কি জঘন্য আমিরের ভাষা,চোখের দৃষ্টি,হুংকার! পদ্মজার গা রি রি করে উঠে। সে আমিরের দিকে রাম দা উঁচু করে বললো, ‘যারা যারা আছে সবাইকে ছেড়ে দিন। নয়তো…নয়তো আমি…আমি আপনাকে মেরে ফেলবো।’

পদ্মজা ঘামছে। তার কথা এলোমেলো। তার শরীরে অস্থিরতা। একবার এদিকে তাকাচ্ছে,আরেকবার ওদিকে। দিকদিশা হারিয়ে ফেলেছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার মাথা কাজ করছে না। বমি ঠেলেঠুলে উপরের দিকে আসছে। আরভিদ দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়। রাফেদ তার পিছনে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই পদ্মজা ফিরে তাকালো। সুযোগ পেয়ে আমির পিছন থেকে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরলো। পদ্মজার হাত থেকে রাম দা ছিনিয়ে নিল। পদ্মজা কিড়মিড় করতে থাকে। মুখ দিয়ে ক্রোধে বের হতে থাকে অদ্ভুত কিছু শব্দ! আমির পদ্মজাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ধমকে বললো, ‘এইবার বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। থামো।’

পদ্মজা অগ্নি চোখে আমিরের দিকে তাকালো। সে আমিরের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে। নিজের অজান্তে খামচে আমিরের হাত থেকে রক্ত নিয়ে আসে। ছটফট করতে থাকে। পদ্মজার গা থেকে শাড়ি পরে যায়। ভেসে উঠে শরীরের অনেকাংশ! সম্পর্কে মজিদ,খলিল যাই হোক না কেন আমির জানে তারা কতোটা নিকৃষ্ট। তাদের চরিত্র,চাহনি সব নিয়েই তার ধারণা আছে। তাই সে দ্রুত পদ্মজাকে শাড়ি দিয়ে ঢেকে দিল। শক্ত করে চেপে ধরলো। আচমকা পদ্মজা বমি করতে শুরু করে। যা ছিটকে পড়ে আমিরের চোখেমুখে। সে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। পদ্মজার শরীর নেতিয়ে পড়ে। আমির পদ্মজাকে নিয়ে এওয়ানে(A1) চলে আসে। দূর্বল শরীরেও পদ্মজার তেজ কমে না। আমিরও হারার পাত্র নয়। তার পুরুষালি শক্তির সাথে পদ্মজা পেরে উঠেনি। একসময় পদ্মজা থেমে গেল,ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমির দূরে সরে দাঁড়ায়। এ কি শুরু হয়েছে! তার এই রাজত্বে এমন বিশৃঙ্খলা কখনো হয়নি। পদ্মজার জন্য বার বার কাজে বিঘ্ন ঘটছে। পদ্মজাকে অন্দরমহলে পাঠানোও সম্ভব না। পদ্মজা যেভাবে রিদওয়ানকে আঘাত করেছে,তাতে আর ভরসা নেই পদ্মজার উপর। যেকোনো মুহূর্তের পদ্মজা হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। একমাত্র সে পারে পদ্মজাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আর এই মুহূর্তে তার অন্দরমহলে ফেরা যাবে না। দুই-তিনদিন লাগবে ফিরতে। আমির মনে মনে ভেবে নেয়, বাকি যেকয়টি দিন সে এখানে আছে পদ্মজাকে এক ঘরে বেঁধে রাখবে। কিছুতেই বাঁধন খোলা যাবে না। আমির পদ্মজার দিকে এগোয়। পদ্মজা চিৎকার করে উঠলো, ‘খারাপ লোক! ঘেন্না হচ্ছে আমার! ঘেন্না হচ্ছে।’

পদ্মজা প্রবল আক্রোশে আমিরের পায়ের কাছে থুথু ফেললো। আমির পদ্মজার দুই হাত পিঠের দিকে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। বেঁধে ফেললো দড়ি দিয়ে। তারপর বিছানায় ফেলে পা বাঁধতে বাঁধতে বললো, ‘ভুল করলে এখানে এসে। এতো নাক না গলালে ভালো থাকতে। সুখে থাকতে।’

পদ্মজা ক্রোধে-আক্রোশে ঘোরে আছে। হাত-পা বেঁধে ফেললেও মুখ তো আছে। পদ্মজা মুখের থুথু দিয়ে বুঝিয়ে দিল,সে আমিরকে সহ্য করতে পারছে না। আমিরের মুখে থুথু পড়তেই তার মাথা চড়ে যায়, ‘পদ্মজা!’

‘আমাকে ডাকবেন না আপনি। পিশাচ একটা।’

‘আমি কিন্তু তোমার গায়ে হাত তুলবো।’

‘আমি আশা করি না যে,আপনি আমাকে মারবেন না।’

মজিদ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছেন। তিনি পদ্মজাকে নিয়ে আতঙ্কে আছেন। মনে মনে তিনি পদ্মজাকে কয়েকবার খুন করেছেন,কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়তো সম্ভব না,যতদিন পদ্মজার উপর আমিরের আকর্ষণ আছে। তিনি খলিলকে গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, ‘আমিররে পদ্মজার কাছ থেকে নিয়ে আয়। ওই মা* ঝি মায়াবিনী। রূপ দিয়ে আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে বশ করে নিবে।’

খলিলের কানে মজিদের কথা গেল না। তিনি রাগে ফুলে আছেন। আমির সবসময় তার সাথে এবং রিদওয়ানের সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার করে। দুই বাপ-ব্যাঠা মিলে অনেকবার পরিকল্পনা করেছে,আমিরকে খুন করার। কিন্তু আমিরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, প্রখর শ্রবণশক্তি,নিজেকে রক্ষা করার মতো কৌশল ডিঙিয়ে তাকে আক্রমণ করার সাহস কখনো হয়ে উঠেনি। এছাড়া,আমিরের একেকটা চামচা তার মতোই জাত খুনি! তবে খলিল দমেও যাননি। একদিন সুযোগ হবে। সেদিন এক কোপে আলাদা করে দিবেন আমিরের মাথা। তাছাড়া মজিদকেও খলিলের পছন্দ নয়। সব সম্পত্তি আমিরের নামে করে দিয়েছে! মনের ক্রোধ মনেই রয়ে যায়। কাজ করতে হয় আমিরের হয়ে। নিজেরা আর দখল নিতে পারে না। মজিদ হাওলাদার পা দিয়ে খলিলের পিঠে ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন, ‘খলিল?’

খলিল সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো, ‘কও ভাই।’

‘যা,আমিররে গিয়ে বল,রায়পুর যেতে। ওদিকে মেলা হচ্ছে।’

‘মেলায় ধরা পইড়া যাইবো না?’

‘এখন ঝুঁকি নিতেই হবে। সময় নেই। আর আমির পারবে।’

খলিল এওয়ানে আসে। আমিরকে বলে রায়পুরের কথা। আমির দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। আর মজিদকে হুমকি দিয়ে বলে গেল, পদ্মজার গায়ে কোনো টোকা যেন না লাগে!

তারপর সাথে নিয়ে যায় রাফেদকে। ট্রলারে আছে মন্তু আর শ্রীভব। পদ্মজা পড়ে থাকে ঘরে। তার চোখ বেয়ে জল নেমে আসে। মাথা ঘুরাচ্ছে খুব। চোখ দুটি বার বার বন্ধ হয়ে আসছে। মন এবং শরীর দুটোর উপর দিয়েই ধকল যাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে। চোখের পর্দায় ভেসে উঠে পূর্ণা ও প্রেমার মুখ। এই পাপের কবলে যদি পূর্ণা,প্রেমা পড়ে! পদ্মজা চট করে চোখ খুলে। তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। চিন্তায় মাথা ব্যথা বেড়ে যায়।

দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ক্লান্ত চোখদুটি খুললো পদ্মজা। ঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান। তার ঠোঁটে হাসি। পদ্মজার পাশে এসে বসে। পদ্মজা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। রিদওয়ান হেসে বললো, ‘এই দিনটার অপেক্ষা করছিলাম অনেকদিন ধরে।’

পদ্মজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। রিদওয়ান বললো, ‘আমির কি ঠকানোটাই না ঠকালো তোমাকে।’

রিদওয়ান দাঁত বের করে হাসলো। হাসি দেখে মনে হচ্ছে সত্যি আজ তার সুখের দিন। সে তো এটাই চেয়েছে। পদ্মজা জেনে যাক সব। রিদওয়ান বললো, ‘তোমাকে অনেক সংকেত দিয়েছিলাম। যাতে আমিরকে চিনে ফেলতে পারো। কিন্তু তোমার আগে সেই সংকেত আমিরের চোখে পড়ে যেত। কি কপাল আমিরের! দুনিয়ায় সব সুখ নিয়েই ও জন্মেছে।’

পদ্মজা প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কেন চাইতেন? আপনি তো এই দলেরই।’

‘দলের তো বাধ্য হয়ে। দেখো,আমি তোমাকে আগে পছন্দ করেছি সেই হিসেবে আমার তোমাকে পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কে পেয়েছে? আমির! যে একজন নারী অত্যাচারী, নারী ব্যবসায়ী,খুনি,শয়তান।’

‘শয়তান তো আপনিও।’

‘আমি শয়তান হলে তোমার কী যায় আসে? তোমার স্বামী হলে-

‘এখানে কেন এসেছেন?’

‘গল্প করতে।’

‘মেয়েগুলোকে মারা হচ্ছে কেন?’

রিদওয়ান মুচকি হেসে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে সব বলার জন্যই এখানে এসেছে। পদ্মজা ও আমির প্রতিদ্বন্দ্বী হলে তার যে আনন্দ হবে সেই আনন্দ বোধহয় বেহেশতেও নেই। এটা রিদওয়ানের ভাবনা। তাই তো সে যখনই শুনলো,আমিরের উপস্থিতি এখন নেই। সঙ্গে,সঙ্গে অসুস্থ শরীর নিয়েই পদ্মজার কাছে চলে এসেছে। রিদওয়ান ধীরেসুস্থে জানালো এই পাতালঘরের ইতিহাস। দুশো বছর পুরনো এই পাতাল ঘর। আগে মন্দির ছিল। মন্দিরের নিচে পাতালঘর বানানো হয়েছিল। সেখানে সোনার মূর্তি ছিল। মূর্তির গায়ে ছিল হীরা,পান্না। তখনকার আমলের রাজার দায়িত্বে ছিল এই পাতালঘর। তারপর সেটা কোনোভাবে হাওলাদার বাড়ির হয়ে যায়। সোনার মূর্তিও নাই হয়ে যায়। তার খোঁজ কেউ জানে না। তখনের প্রজন্মে হাওলাদার বংশের একজন পুরুষ ছিলেন নারী আসক্ত। তিনি যখন বাড়ির পিছনে এমন একটা পাতাল ঘরের সন্ধান পেলেন,মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নারী আসক্তি। তারপর থেকেই মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণ করে, খুন করা হয়ে উঠে প্রতি দিনকার অভ্যাস। আস্তে আস্তে এই পাপ ছড়িয়ে পড়ে বংশের সব ছেলেদের মধ্যে। পাতালঘর তাদের মনে নিষিদ্ধ, মহাপাপের বাসনা জাগিয়ে তুলে। আস্তে আস্তে ধর্ষণের সাথে সাথে নারী বিক্রি শুরু হয়। শুরু হয় পতিতাবৃত্তি। লম্পট ক্ষমতাশালীরা অর্থ দিয়ে নারী ভোগ করতে আসতো পাতালঘরে। এই পাপ মজিদ হাওলাদার অবধি একই ভাবে চলে আসে। আমির হাওলাদার সেটাকে বিদেশ অবধি নিয়ে যায়। টাকার পাহাড় গড়ে তুলে। পাতালঘরকে করে তুলে আধুনিক। বানায় আরো কয়েকটি ঘর। চারিদিকের নিরাপত্তা শক্ত করে। প্রতি বছরের শীতে এবং বর্ষাকালে কয়েকটি মেয়েকে ধরে এনে হাওলাদার বাড়ির পুরুষেরা নিজেদের পুরুষত্বের ক্ষমতা প্রমাণ করে। তারপর চৌদ্দ দিন ধরে একটানা তাদের করা হয় নির্মম অত্যাচার। চৌদ্দ দিনের মধ্যে অনেকে মারা যায়। আবার অনেকে বেঁচে থাকে। যারা বেঁচে থাকে তাদের কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তারপর লাশের গায়ে,পাথর বেঁধে ট্রলারে করে ডুবিয়ে দেয়া হয় সব বড়,বড় নদীতে। আর বছরে চারবার নারী পাচার করা হয় বিদেশে। পুরো বছর জুড়ে খোঁজ চলে নারী শিকারের। এ পাপ হাওলাদার বাড়ির রক্তে মিশে গিয়েছে। বয়স পনেরো হতেই বাড়ির ছেলেদের জড়িয়ে দেয়া হয় এই চক্রের সাথে। এ যেন হাওলাদার বংশের রীতি! ছেলে হয়ে জন্মালে এই রীতি অনুযায়ী চলতেই হবে! সব শুনে পদ্মজা পায়ের তালু থেকে মাথার চুল অবধি কেঁপে উঠে! দুশো বছর ধরে চলছে এই পাপ! কেউ বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি! অথচ,এই হাওলাদার বাড়ির সুনাম সব জায়গায়। হিন্দুরা হাওলাদার বাড়ির পুরুষদের দেবতার সাথে তুলনা করে,আর মুসলিমরা ফেরেশতার সাথে! অথচ এদের রক্তেই শয়তানের বসবাস। এই তবে এই বাড়ির রহস্য! এজন্যই কি মেয়ে হওয়ার পর সৃষ্টিকর্তা তাকে বন্ধ্যা করে দেয়! আমির…আমিরও কী নারী আসক্ত! এটাই তো স্বাভাবিক! হাওলাদার বংশের ছেলে হয়ে নারী ভোগ করেনি এমন ভাবনা মানায় না! পদ্মজার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করতে থাকে। বার কয়েক ঢোক গিলে। রিদওয়ান পদ্মজার অস্থিরতা টের পেয়েছে। তার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। সে খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বললো, ‘এবার চলো ছয় বছর পূর্বে ফিরে যাই। সেই ঝড়ের সন্ধ্যেতে। যেদিন আমির আর তোমার প্রথম দেখা হয়েছিল।’

৬৬

‘সেই ঝড়ের সন্ধ্যেতে। যেদিন আমির আর তোমার প্রথম দেখা হয়েছিল’ বাক্য দুটি পদ্মজার নিঃশ্বাস থামিয়ে দিল। রিদওয়ান বিছানা ছেড়ে চেয়ার টেনে বসলো। বললো, ‘ আমির সারাবছরই ঢাকা থাকে। শুধু বর্ষাকাল আর শীতকালে গ্রামে আসে। সেসময় বর্ষাকাল ছিল। মেয়ে যোগাড় হয়ে গেছে। সেই আনন্দে আমির আমার সাথে তাস খেলে। বলে, যদি ওকে আমি হারাতে পারি আমি যা চাইবো তাই দিবে। একটু প্রশংসা করি,আমির শয়তান হলেও কথা দিয়ে কথা রাখার অভ্যাসটা ভালোই ছিল। আমার সৌভাগ্য, আমির সেদিন হেরে যায়। আমাদের আটপাড়া গ্রামের মেয়েদের আমরা কখনো শিকার করি না। এটা আমাদের নিয়ম। নিজের গ্রামের মেয়ে হারালে দূর্নাম হবে বড় চাচার। কারণ তিনি মাতব্বর। আটপাড়ার কোনো মেয়ে আজও আমাদের হাতে পড়েনি। তোমাকে আমি স্কুলে যাওয়ার সময় দেখি। বিশ্বাস করো,আমি তোমাকে যেদিন দেখি সেদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। আব্বাকে বলছি,তোমাকে এনে দিতে। তিনি দিলেন না। আটপাড়ার মেয়ে তুলে আনা যাবে না! কড়া নিষেধ। তারপর অনুরোধ করেছি, যাতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। তখন বড় চাচা বললেন, তোমার মায়ের কথা। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। গ্রামের অনেকের কাছে শুনেছেন, তোমার মা নাকি মেয়ে বিয়ে দিবেন না। দূর-দূরান্ত থেকে বনেদি ঘরের ছেলেরাও নাকি এসেছে বিয়ের জন্য তাও তিনি বিয়ে দিতে রাজি হননি। কিন্তু আমারতো তোমাকে লাগবেই। তোমার রূপ এমনই যে,সারাজীবন ভোগ করলেও পানসে লাগবে না।’

শেষ কথাটি শুনে রাগে পদ্মজার কপালের চামড়া কুঁচকে যায়। তবে টু শব্দ করলো না। রিদওয়ান বলছে, ‘আমার এই বাড়ির প্রতি,এই পাতালঘরের প্রতি লোভ অনেক আগে থেকে। তবুও আমি সেসবের কিছু না চেয়ে আমিরের কাছে তোমাকে চেয়েছি। কতোটা পছন্দ করেছি ভাবো একবার? ভাবো পদ্মজা। একটু ভাবো।’

রিদওয়ান পদ্মজার দিকে কাতর চোখে তাকালো। তারপর চোখেমুখে ক্রোধ এনে বললো, ‘কিন্তু হলো কী? নিজে পছন্দ করে ফেললো। আমির আমার জন্য তোমাকে তুলে আনতে গিয়েছিল। আমি জানতাম,তোমার আম্মা বাড়িতে নেই। তাই এরপরদিনই আমির তোমাদের বাড়িতে যায়। কথা দিয়েছিল,এশার আযানের আগেই আমার কাছে তোমাকে পৌঁছে দিবে। ধ-রক্তের বি-থ্রি ঘরে আমি অপেক্ষায় ছিলাম। মাঝরাত অবধি অপেক্ষা করেছি। তারপর অন্দরমহলে চলে যাই। গিয়ে শুনি,আমির বড় চাচাকে হুমকি দিচ্ছে,তোমার সাথে বিয়ে না দিলে নাকি কাজ ছেড়ে দিবে। যদিও সবাই জানি,আমির কোনোদিন তার পেশা ছাড়বে না। তাও বড় চাচা আমিরকে অসন্তুষ্ট রাখতে চান না। তাই কথা দিলেন তোমার সাথেই বিয়ে হবে। যেভাবেই হউক। আমিরের সাথে আমার তর্ক হয়। আমাকে তখনই আদেশ দেয়া হয়, ছইদকে খুন করতে হবে। ছইদ আমিরের সাথে বেয়াদবি করেছে। যা আমিরের গায়ে লেগেছে। ও চায় না ছইদ আর বেঁচে থাকুক। আমিরের আদেশ পালন করতেই হয়। কিন্তু সেদিন আমি শুনিনি। তখন বড় চাচা বললো, ‘পদ্মজা সমাজের কাছে আমিরের বউ হলেও,ঘরে তোর বউও হবে। আমি তার ব্যবস্থা করব,আমিরের সাথে কথা বলব। ‘

আমাকে আশা দেওয়া হয়। তাই ছইদকে সরিয়ে দেই। সব কিন্তু তোমাকে পাওয়ার জন্য। কিন্তু অবাক কান্ড কি জানো? তোমার মাও সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মহিলা এতো ভয়ংকর আগে বুঝিনি! মেয়ে মানুষ হয়ে কীরকম ভাবে যে নেশাগ্রস্থ দুটি মানুষকে জবাই করেছে তুমি ভাবতেও পারবে না!’

রিদওয়ান থামলো। সে অবাকচোখে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্মজার কোনো ভাবান্তর হলো না। সে জানে এই ঘটনা। চিঠিতে পড়েছে। রিদওয়ান বললো, ‘তারপরদিন সালিশে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হলো। তোমার আম্মাও রাজি হয়ে গেলেন। বলেছি না? আমির দুনিয়ার সব সুখ নিয়ে জন্মেছে। তোমার আম্মা আমাকে চিনতেন না। কখনো দেখলেও বা নাম শুনলেও মুখ মনে নেই। তাই তিনি নিশ্চিন্তে বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিলেন। বড় চাচা সমাজের চোখে কতোটা মহান সেটা তুমিও জানো। দুই মাস অন্তর,অন্তর দান করেন। সবার অভাব দূর করেন,চিকিৎসা করান। উনার ছেলের বউ মানে অনেক কিছু! তোমার আম্মাতো আর ভেতরের খবর জানতেন না। সে যাই হোক পরের কথা বলি। আমির যখন শুনলো, তোমার আম্মা দুটো খুন করেছে, ও চিন্তায় পড়ে যায়। আমির ধূর্তবাজ, চালাক। ও মানুষ চিনে। ও তাৎক্ষণিক বুঝে গেল, তোমার আম্মা জটিল মানুষ। তাই আমাকে নিষেধ করলো,বিয়ে বাড়িতে আমার মুখ না দেখাতে। চিনে গেলে সমস্যা হবে। আমিরের সাথে তাল মিলিয়ে বড় চাচাও নিষেধ করলো। আমি তো-

পদ্মজা মাঝপথে প্রশ্ন করলো, ‘আপনি এই গ্রামের ছেলে! আর আম্মাও এই গ্রামের মেয়ে,বউ। তারপরও আপনাকে চিনতেন না?’

‘ওইযে বললাম,কখনো হাওলাদার বাড়ির ছেলে হিসেবে দেখলেও মনে নেই। নয়তো নাম জানতেন মুখ চিনতেন না। তাছাড়া,আমাকে সত্যি অনেকেই চিনে না। নাম জানলে মুখ চিনে না। মুখ চিনলেও,হুট করে দেখে ধরতে পারে না। সবসময় এখানে থাকি। অন্দরমহলে থাকি। রাতে বের হই। ট্রলারে থাকি। এটা খুব সহজ ব্যাপার। তোমার আম্মা চিনতেন না বললে বেমানান লাগবে না। আর শুনেছি, তোমার আম্মা নাকি সমাজের দিকে চোখ দিতেন না তেমন। নিজের সংসার আর তিন মেয়েকে নিয়েই থাকতেন।’

কথাগুলো অবহেলার স্বরে বলে রিদওয়ান থামলো। পদ্মজা কিছু বললো না। রিদওয়ান ভ্রুকুঞ্চন করে বললো, ‘কোথায় যেন ছিলাম?’

পদ্মজা জবাব দিল না। রিদওয়ান মনে করার চেষ্টা করলো। মনে পড়তেই আবার বলা শুরু করলো। আমিরের কথামতো সে হেমলতাকে মুখ দেখায়নি। যায়নি ও বাড়িতে। বিয়ের দুইদিন আগে মেয়েগুলোকে ঢাকা চালান করে দেয়া হয়। সেখান থেকে আলমগীর আমিরের কথামতো পাচার করে দেয় বিদেশে। মৃত মেয়েগুলোকে ফেলে দেওয়া হয় বড়-বড় নদীতে। একটা মেয়ে রয়ে যায়। সে মেয়েটিকে পদ্মজা আর আমিরের বিয়ের আগের দিন রাতে হত্যা করা হয়। তারপর আমিরের কথামতো, হাবলু আর রিদওয়ান চলে আসে হাওড়ে। অন্দরমহলে তখন আমিরের গায়ে হলুদের উৎসব চলছিল। হাওড়ে তখন তীব্র স্রোত। বাড়ি ফেরার তাড়াও ছিল। আবার মেয়েটি অনেক দূরের। তাই হাবলু মেয়েটিকে নদীর শেষ মাথায় ও হাওড়ের শুরুতে ফেলে দেয়। তখনই খেয়ালে পড়ে,আরেকটি নৌকা। যেখানে মোড়ল বাড়ির পরিবার ছিল। রিদওয়ান ট্রলারের ভেতর ছিল। সে হাবলুকে তাড়া দেয় দ্রুত ট্রলার ঘুরাতে। তারপরের কাহিনি পদ্মজার জানা। পুরোটা শুনে পদ্মজা অবাক হয়ে যায়। সে হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আর…আর হানিফ মামার ব্যাপারটা?’

রিদওয়ান খুব বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘এসব ছোটখাটো ব্যাপার। ওই শালা আমাদের সাথেরই লোক ছিল। তারপর আধিপত্য দেখানো শুরু করে। টাকা চায় অনেক। আমিরের উপর কথাবলা শুরু করে। হুমকি দেয়। তার চাহিদা বেড়ে যায়। অনেকদিন সহ্য করার পর একদম উপরে পাঠিয়ে দেই।’ রিদওয়ান হাসলো। যেন খুব মহৎ একখানা কাজ করেছে। তারপর আবার বললো, ‘প্রান্তর আব্বা আর আবদুল এদের নিয়েও প্রশ্ন করবে নাকি? এদের কথা জেনে তোমার লাভ নেই। দুইজনই সব জেনে ফেলার কারণে মরেছে। সহজ হিসাব। প্রান্তর বাপ আমিরের হাতে,আবদুল আমার হাতে। এসব বাদ দেও। আমরা আমিরের কথাতে যাই। তোমাকে শুধু আমিরের গল্প শোনাব।’

রিদওয়ান কাছে কথাগুলো যেন কত স্বাভাবিক! যেন মশা মারার গল্প বলছে! পদ্মজা ভীষণ অবাক হচ্ছে। এই হাওলাদার বাড়ির আঁচ তার গায়ে এতো আগে থেকেই লেগেছিল! হানিফকে খুন করতে গিয়ে তার মা খালি হাতে ফিরে আসে। তারপরদিন হানিফের লাশ পাওয়া যায়। অথচ,তার মা খুন করেনি। প্রান্তর বাপ খুন হয়। প্রান্ত মুন্না থেকে প্রান্ত হয়ে উঠে,তাদের ভাই হয়ে উঠে। আমির শিকার করতে এসে তার প্রেমে পড়ে যায়। বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের আগেরদিন রাতে নদীতে লাশ পাওয়া যায়। তারপর অবশেষে বিয়ে হয়! সবকিছু এক সুতোয় গাঁথা! এ কেমন যোগসূত্র! পদ্মজার মাথা ভনভন করতে থাকে। এতদিন একটা চক্র তার আশেপাশে শব্দ তুলে ঘুরঘুর করছিল । সে শব্দ ঠিকই শুনেছে তবে তার উপস্থিতি ধরতে পারেনি। রিদওয়ান বললো, ‘বিয়ের দিন রাতে বড় চাচার কথায় ভরসা রেখে তোমাকে ছুঁয়েছিলাম। ভেবেছিলাম,আমির কিছু বলবে না। কিন্তু হলো কি? সে তো তোমার রূপে একেবারে কুপোকাত।

তারপরের ঘটনাও বোধহয় জানো। আমির আষ্টেপৃষ্ঠে তোমাকে আগলে রাখা শুরু করে। একসময় বিভিন্ন কার্যকলাপে তোমার সন্দেহ হতে থাকে। এই ব্যাপারটা আমিরকে চিন্তায় ফেলে দেয়। পাহারাদার বাড়িয়ে দেয়। তোমার উপর নজর রাখার জন্য রেখে দেওয়া হয় লতিফাকে। তাই আমিরের সাজানো দেয়াল ভেঙে পৌঁছাতে পারোনি পাতালঘরে। তোমার আম্মা নাকি চোখের দৃষ্টি দেখে,মানুষ চিনতে পারেন? কার মুখ থেকে জানি আমির শুনেছিল। ব্যাপারটাকে গুরুতর ভাবে নিয়ে নেয় আমির। সে কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। তোমার আম্মাকে নিয়ে একটু ভয়েও ছিল। মহিলার চাহনি,কথাবার্তা খুব বেশি ধারালো আর সজাগ। আমির পরিকল্পনা করে,তোমার আম্মার গলাটা আলাদা করে দিবে। মাঝপথে কাঁটা রাখা ভালো না। এটা কিন্তু আমার কথা না। আমিরের কথা।’

রিদওয়ান পদ্মজার মুখের ভঙ্গি দেখার জন্য তাকালো। পদ্মজার চোখ দুটি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। আমির হাওলাদার তার মাকে খুন করতে চেয়েছিল! রিদওয়ান পদ্মজার মেজাজ আঁচ করতে পেরে বললো, ‘ এমনকি খুন করতেও গিয়েছিল।’

পদ্মজা চকিতে তাকাল। তার চোখে জল টলমল করছে সেই সাথে লাল হয়ে উঠেছে। রিদওয়ান বললো, ‘ঘটনাটা তোমার বিয়ের কয়দিন পরের। সেখানে গিয়ে জানতে পারলো,তোমার আম্মার কি এক রোগ হয়েছে। মরে যাবে,সব ভুলে যাবে। সম্ভবত তোমার আম্মা তোমার আব্বার সাথে কথা বলছিল। আমার ঠিক মনে নেই। অনেক আগের ঘটনাটা তো। তাই আমির তার পরিকল্পনা বাদ দিল। কয়দিন পর তোমাকে নিয়ে ঢাকা চলে যাবে । এখন আর এসব করে লাভ নেই। কয়দিন পর এমনিতেই মরে যাবে। তবে যদি না মরতো তাহলে কিন্তু আমিরই খুন করতো। এই হলো তোমার সোহাগের স্বামী।’

রিদওয়ানের ঠোঁটে তিরস্কারের হাসি। কি যে আনন্দ হচ্ছে তার! শুধু পদ্মজা জানে তার কী পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে। আমিরের প্রতি রাগ,ঘৃণা নিঃশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এই মুহূর্তে যদি তার হাত,পায়ের বাঁধন খোলা থাকতো তবে সে রিদওয়ানের এই গা জ্বালা হাসি চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে,আমিরকে শেষ করে দিত। রিদওয়ান হইহই করে উঠলো, ‘ আরে আরো বাকি আছেতো। থেমে গেলেতো চলবে না। যেদিন তোমার মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল দিল,সেদিন তোমার আম্মা প্রথম আমাদের বাড়িতে আসেন। আর আমাকে দেখে চিনে ফেলেন। বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী মহিলার মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে উঠে। তিনি তোমাকে নিয়ে ভয় পান বোধহয়। আমি রাতে দ্বিতীয় তলায় হাঁটছিলাম রুম্পা ভাবির ঘরটা নজরে রাখার জন্য। ধীরে,ধীরে হাঁটছিলাম তাও সেই শব্দ তোমার মায়ের কানে চলে যায়। তিনি বেরিয়ে আসেন। আমাদের কথা হয়। উনি তোমার ভবিষ্যত নিয়ে ভেঙে পড়েন। মা হিসেবে এমনটাই হওয়ার কথা। শেষ রাতে আমি আর আমির ছাদে ছিলাম। আচমকা দেখি, তোমার আম্মা জঙ্গলের ভেতর ঢুকছেন। কত সাহস! মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রথমবার এসেই সন্দেহ করে পুরো বাড়ি ঘুরা শুরু করেছেন! বিন্দুমাত্র ভয়ডর নেই। জঙ্গলের ভেতরই আমাদের সব। তখন এতো নিরাপত্তা ছিল না। তাই আমির ছুরি নিয়ে তোমার মায়ের পিছু ধাওয়া করে। লক্ষ্য ছিল,যখনই তোমার আম্মা টের পাবে কিছু। তখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু তোমার আম্মা পুরো জঙ্গল ঘুরেও কিছু ধরতে পারেননি। এটা তোমার আম্মার ভাগ্য! নয়তো ওখানেই মরতে হতো। এখানেই কিন্তু সব শেষ নয়। তোমরা ঢাকা যাওয়ার পর উনি আরো দু-দুবার লুকিয়ে এই বাড়িতে ঢুকেছিলেন। দুইবারই হাবলু উনার পিছু নিয়েছে। আমি আমিরকে চিঠি লিখি। তখন আমির জানালো,আরেকবার তোমার আম্মা যদি এখানে আসে সঙ্গে সঙ্গে যেন মৃত্যু উপহার দিয়ে দেই। কিন্তু তিনি আর আসেননি। কিছু না পেয়ে বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন,এখানে কিছু নেই। এই বাড়িতে গোপন কিছু নেই। নয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিছু একটা হবে জানি না অতো। তোমার মায়েরও ভাগ্য ভালো! দুইবার মেয়ের জামাইয়ের হাতে খুন হতে গিয়েও হয়নি,দুইবার হাবলুর মতো জাত খুনির হাতে খুন হতে গিয়েও হয়নি। উনার মৃত্যুটাই লেখা ছিল রোগে। সে যাই হোক। দেখো, আমির জানতো তোমার মা তোমার কতোটা প্রিয়। তবুও কিন্তু নিজের স্বার্থ দেখেছে। তোমার মাকে খুন করতে চেয়েছে। এমন মানুষকে তুমি ভালোবেসেছো! রাগ হচ্ছে না ভেবে?’

পদ্মজা নির্বাক,বাকহারা। তার ভেতরে বিন্দুমাত্র ভালোবাসার অনুভূতি যেন নেই। রিদওয়ান আবার বলতে শুরু করলো, ‘আমির তোমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী আর বোনের বিয়ের জন্য এখানে আসেনি। তুমি ভেবেছো, সব কাজকর্ম ফেলে শুধু তোমার মন রাখতে এসেছে। এটা মিথ্যা। ও এখানে এসেছে বিপদে পড়ে। কুয়েত থেকে বড় অংকের টাকা অগ্রীম নিয়েছে ছয় মাস আগে। বিনিময়ে ত্রিশটা মেয়ে দিতে হবে। মেয়েগুলোর গায়ে একটু দাগও থাকতে পারবে না। মেয়ে দেয়ার কথা ছিল এক মাস আগেই। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি,পারিনি। সব মানুষ চালাক হয়ে গেছে। এমন কখনো হয়নি। এইবার সব ওলটপালট হয়ে গেছে। আমির এর উপর চাপ আসতে থাকে। ও টাকাগুলোও খরচ করে ফেলছে। কী করছে কে জানে। কুয়েত থেকে হুমকি এসেছে,আরো এক মাসের মধ্যে ত্রিশটা মেয়ে দিতে না পারলে আমাদের সম্পর্কে সব প্রমাণ বাংলাদেশ পুলিশ ঐক্যতে পাঠাবে। যেভাবেই হউক আমাদের ধ্বংস করবে। ওরা খুব ক্ষমতাশালী। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের সাথে তাদের চক্র শামিল আছে। আমরা সবাই এখন একটা ঝড়ে আছি। বিশেষ করে আমির আর ওর বাপ। তাই আমির এখানে এসেছে। এক মাস শেষ হওয়ার আর বারোদিন বাকি। মেয়ে পাচার করতে হবে আটদিন পরই। মেয়ে যোগাড় হয়েছে নয় জন। যেভাবেই হউক আমাদের একুশটা মেয়ে লাগবেই। তাই এখন খুব চাপ। আর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে উপস্থিত তুমি!’

রিদওয়ান শব্দ করে হাসলো। তার হাসি যেন থামছে না। পদ্মজা তীক্ষ্ণ স্বরে বললো, ‘ধ্বংসের লক্ষণ শুরু হয়েছে। দুশো বছর চলেছে আর কত চলবে!’

‘কিন্তু আমরা সেটা হতে দেব না। আমিতো দেবই না। আমার জীবনে কিছু বলতে শুধু এই অংশটাই আছে। বেঁচে থাকার একটাই অংশ।’

‘যে মেয়েগুলোকে মেরেছেন তাদের না মেরে পাচার করেই দিতে পারতেন। সেটা কেন করেননি?’ পদ্মজার ভেতরে অপ্রতিরোধ্য তুফান চললেও। কণ্ঠ শান্ত। রিদওয়ান স্বাভাবিক স্বরেই জানালো,কেন তারা এই মেয়েগুলোকে পাচার করতে পারছে না। মেয়েগুলো দুই মাস ধরে এখানে আছে। প্রথম পনেরো দিন বীভৎস ধর্ষণে এদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে,শরীরে বিভিন্ন দাগ বসে গেছে। তখন তারা জানতো না,তাদের মেয়ের অভাব পড়ে যাবে। তারপরও এক মাস ঔষধপত্র দিয়ে মেয়েগুলোর ক্ষতি পূরণের চেষ্টা করেছে। হয়নি। তাই বিগত পাঁচদিন ধরে তারা তাদের রীতি অনুসারে মেয়েগুলিকে পিটাচ্ছে। আজ দুটো মেয়ে মারা গেছে। আগে লাশই ফেলে দেয়া হতো। পাঁচ বছর ধরে টুকরো,টুকরো করা হয়। এটাও আমিরের বুদ্ধি। যাতে কোনো মানুষের চোখে না পড়ে,আর পুলিশও শনাক্ত করতে না পারে। পুলিশরাও এখন চালাক হয়ে গেছে।

পদ্মজা বললো, ‘আমি মেয়ে পাচার করতে দেব না।’

‘কী করবে?’

পদ্মজা নিশ্চুপ।

‘কিছুই পারবে না। আমির তোমাকে ছেড়ে দিলেও আমরা ছাড়ব না। আর আমিরও তোমাকে ছাড়বে না। ও তোমার শরীরে আকৃষ্ট। ভালোবাসে না। যেদিন তুমি রুম্পার ঘরে রাতে ছিলে সেদিন আমির তোমার খেয়াল রাখার জন্য না,তোমার উপর নজর রাখার জন্য রাতে ঘুমায়নি। রুম্পা কখন কী বলে দেয় সেই ভয়ে। রুম্পাকে খুন করার পরিকল্পনাও আমিরের। ও বাবলুকে পাঠায়। হাবলুর ভাই বাবলু। দুজনই বংশগত জাত খুনি। কিন্তু গিয়ে দেখে আলমগীর ভাইয়া তার বউকে নিয়ে পালাচ্ছে। তবুও বাবলুর সাথে ওরা পারতো না। সেখানে তুমি বাগড়া দাও। বাবলুকে খুন করে ফেলো! কী আশ্চর্য! একদম মায়ের রূপ পেয়েছো। পুরোটা দৃশ্য কিন্তু আমির দেখেছে। ও জঙ্গলে ছিল। এতো,এতো চিন্তার মাঝে তোমার এই রূপ! তুমি যখন পূর্ণাকে নিয়ে অন্দরমহলে চলে যাও,তখন লাশ সরিয়ে দেয়া হয়। তুমি পূর্ণাকে নিয়ে ঘরে যাও তখন আমির তোমাদের ঘরে চলে যায়। এমনকি আমিরের জ্বরও হয়েছিল,মেয়ে যোগাড়ের চিন্তায়। এমন অবস্থায় তোমার খুনাখুনির কাজকর্ম আমিরকে পাগল করে তুলে। অস্থির হয়ে পড়ে। রানিকে খোঁজার নাম করে এখানে এসে পরিকল্পনা করে,তোমাকে ভয় দেখানোর। যাতে তুমি ঢাকা চলে যাও আমিরকে নিয়ে। ওর বিশ্বাস আটদিনে মেয়ে যোগাড় করে ফেলবে। কিন্তু এটা বিশ্বাস নেই যে, তুমি আট দিন পর ঢাকা যেতে রাজি হবে। তাই আগে থেকে কাজ এগিয়ে রাখার পরিকল্পনা করে। এমনকি তোমাকে মারতেও বলেছে। যাতে ভয় পাও। মারার পরও যখন ভয় পাওনি। তারপর বললো,তোমাকে রক্ত দেখাতে। যদিও একটা মেয়ের রক্ত দেখিয়েছিলাম তোমাকে। ওর বিশ্বাস ছিল,স্বামীর জানের মায়ায় হলেও ছেড়ে দিবে এই গ্রাম। কিন্তু তুমিতো মুখের উপর বলে দিলে,ঢাকা ফেরত যেতে রাজি না তুমি। এই সত্যি তুমি আমিরকে ভালোবাসো? ভালোবাসা কী?’

পদ্মজা দাঁতে দাঁত চেপে চোখের জল ফেলছে। রিদওয়ান দুই হাত নাড়িয়ে বললো, ‘আচ্ছা,এসব ভালোবাসা-টালোবাসার কথা বাদ দেও। আমির তোমাকে ভালোবাসে না। সব ওর নাটক। ও তোমার রূপকেই ভালোবেসেছে। এখনও যে রূপের শরীর তোমার! আমিই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সেখানে তো ও হালালভাবে ভোগ করার সনদ পেয়েছে। সবশেষে, ভালোভাবে বলছি পদ্মজা। কোনো বাগড়া দিও না আর। সব মেনে নাও। নয়তো তোমাকে মরতে হবে। আমির না মারলেও বড় চাচা,আব্বা আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেব না।’

‘তিনি কেন আমাকে মারবেন না? তিনিতো আমাকে ভালোবাসেন না।’

‘ভালো না বাসলেও টাকার প্রতি যেমন টান ওর তেমন সুন্দরের প্রতি টান আছে। ধরে রাখতে চাইতেও পারে। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, অনেক করেছো আর কিছু করো না।’

‘কী পান এসব করে?’

‘অর্থ পাই। শান্তি পাই।’

‘মেয়েদের কষ্ট দিয়ে কীসের শান্তি? হাওলাদার বংশে ভালো ছেলে নেই? সবই খারাপ?’

‘যারা ভালো হয়েছে তারা মরেছে। তবে জাফর ভাই,আলমগীর এরা তো ভালো। এদের অনেক পিটিয়েও বড় চাচা,আব্বা এই পথে আনতে পারেনি। জাফর ভাইতো এই সম্পর্কে কিছুই জানে না। জাফর ভাই একটু বোকা ধরণের। অনেক স্পর্শকাতর মন। মুরগির রক্ত দেখলেই অজ্ঞান হয়ে যায়। তাই তাকে আর এই জগতে আনা হয়নি। আব্বার প্রথম ছেলে ছিল বলে মারেনি। রাজধানীতে পাঠিয়ে দেয় পড়ার জন্য। তারপর বিয়ে করে বাইরেই চলে গেল। আর আলমগীর ভাইয়া বাধ্য হয়ে এই দলে কাজ করেছে। সুযোগ পেয়ে পালিয়েও গেছে। আমিরতো ছোট থেকেই তেজি। বড় চাচার কাছে আমির হচ্ছে সোনার টুকরা। এসব গল্প করতে ভালো লাগছে না। ঘাড়টা খুব ব্যথা করছে। এতো শক্ত আঘাত দিয়েছো। ডাইনি নাকি তুমি?’

রিদওয়ান আলতো করে ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘আচ্ছা,আসল কথা বলি, আমিরকে ছেড়ে পালিয়ে যাও। এই রাজত্বে থাবা দেয়ার কথা ভেবো না। জীবনে কিছু পাইনি। মা জন্ম দিয়ে মারা গেল। বাপের অবৈধ সন্তান আমি। ছোট থেকে আমি অত্যাচারিত। আজও আমির আমার উপর অত্যাচার করে। অনেক দূর্বল ছিলাম। পানিতে চুবিয়ে রেখেছে,শীতের রাতে উলঙ্গ করে বেঁধে রেখেছে। পিটিয়েছে। আমির মানুষকে আঘাত করতে পছন্দ করে। মানুষের আকুতি-মিনতি ওর কাছে পরম শান্তির। তুমি ওর কাছে থেকো না। পালিয়ে যাও। পুলিশের কাছে যেও না। অন্য কোথাও গিয়ে থাকো। ও এখন মায়া দেখাচ্ছে। যখন স্বার্থে বেশি টান পড়বে ঠিকই হাত তুলবে। খুন করে ফেলবে তোমাকে।’

পদ্মজা শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে বললো, ‘ কি বলছেন! তাহলে উনি আপনার কাহিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন!’

রিদওয়ান পদ্মজার কথা বুঝতে পারলো না। সে একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করলো, ‘কিছু বললে?’

পদ্মজা কিছু বলতে পারলো না। তার চোখ থেকে জল পড়ছে। পিছনের ছয় বছর মিথ্যের জাল দিয়ে প্যাঁচানো! কিছু সত্য নয়। সব মিথ্যে। সব!

আমির মাত্রই এসেছে। এখন শেষরাত। সে পানি খেয়ে রাফেদকে বললো, ‘নতুন মেয়ে তিনটাকে খেতে দিও। চিৎকার, চেঁচামেচি করলে ভুলেও মেরো না।’

রাফেদ বললো, ‘আপনি ভাববেন না। সব সামলে নেব।’

আমির বিটু(B2) ঘরে বসে রয়েছে। মজিদ বললো, ‘আমরা যাই তাহলে। সকালে কাজ আছে আমার।’

আমির কিছু বললো না। কপাল কুঁচকে রেখেছে। সিগারেট ধরালো। খলিল বললো, ‘ওই ছেড়িরে এহন কী করবি?’

আমির বললো, ‘এটা আমার ব্যাপার। আরভিদ?’ উঁচু স্বরে ডাকলো।

আরভিদ সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে আসলো। আমির বললো, ‘বাড়ির পিছনে যাও। লতিফা থাকবে। যা দিবে নিয়ে আসবে।’

আরভিদ চলে গেলো। আমির চেয়ারে বসে মজিদকে বললো, ‘গেলে যাও। দাঁড়িয়ে আছো কেন? শফিক না আসছিল,কোথায় গেল?’

‘রিদুর কাছে গেছে।’ বললেন খলিল। তারপর মজিদরে বললেন, ‘আইয়ো ভাই। বাড়িত যাই।’

পদ্মজা ক্লান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো, ‘ঢাকার অফিস আর গোডাউনে আমি তো অনেকবার গিয়েছি। সেখানে পণ্য দেখেছি। মেনু দেখেছি। কিছুতো মিথ্যে মনে হয়নি।’

‘আমিরের সত্যি পণ্যের ইমপোর্ট ব্যবসা আছে। ও কাঁচা কাজ করে না।’

‘আর আমার মেয়ে? আমার নিষ্পাপ তিন মাসের মেয়েটাকে কে খুন করেছে? বাবলু করেছে?’

রিদওয়ান এই প্রশ্নে থমকায়। পদ্মজা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে এই প্রশ্নের জবাবের জন্য। দরজায় টোকা পড়ে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে প্রবেশ করলো একটা চেনা মুখ। রিদওয়ান হেসে বললো, ‘আরে শফিক। শেষরাতে এখানে?’

শফিক পদ্মজাকে জহুরি চোখে দেখলো। শফিকের এলোমেলো চুল,নোংরা চাহনি। সে রিদওয়ানকে বললো, ‘হু,আসছি। আগে বল,আমিরের বউ এখানে কেন? এই মেয়েরেও চালান করে দিবে নাকি?’

‘নিজে নিজেই চলে এসেছে। কোনো বিপদ? থানার কী অবস্থা?’

‘তোরা কি আজমপুর থেকে কোনো মেয়ে এনেছিস? আজমপুরের মাতব্বর মামলা করেছে। তার মেয়ে হারিয়ে গেছে। বিশাল বড়লোক। বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপার তো জানিসই। আশেপাশের সব এলাকাতেই খোঁজ চলছে। আগামীকাল অলন্দপুরেও পুলিশ আসবে। তাই তোদের জানাতে এসেছি। সাবধানে থাকিস।’

‘দুনিয়ার সব ভেজাল একসাথে এইবারই আসতেছে।’ ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললো রিদওয়ান।

শফিক তার গোঁফে হাত বুলাতে বুলাতে পদ্মজাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখলো। তারপর পদ্মজার পায়ের কাছে বসলো। পদ্মজার ফর্সা পা দুটিতে তার নজর পড়ে। পায়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললো, ‘খুব সুন্দরী। কাছ থেকে প্রথম দেখলাম। মেরেই তো দিবে নাকি?’

শফিকের ছোঁয়া যেন পদ্মজার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল। সে হুংকার ছাড়লো, ‘ একদম ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না। দূরে সরুন।’

শফিক অবাক হয়ে রিদওয়ানকে বললো, ‘আরে এর তো তেজ অনেক। আমির সামলায় কেমনে?’

রিদওয়ান ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকিয়ে রেখেছে। তার সাহস হচ্ছে না পদ্মজাকে ছোঁয়ার। কিন্তু অন্য কেউ আমিরের দূর্বলতায় হাত দিচ্ছে দেখে তার খুব আনন্দ হচ্ছে। সে শুধু দৃশ্যটা উপভোগ করছে। শফিক শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো, ‘এতো সুন্দর মেয়ে হাতছাড়া করা যায় না। মেরেই যখন দেয়া হবে একটু উপভোগ করে দেখি কী বলিস?’

পদ্মজার বুক ধুকপুক করছে। শেষমেশ তার ইজ্জতেও হাত পড়ছে। সে ছটফট করতে থাকে ছোটার জন্য। পদ্মজা বাঁধা অবস্থায় উল্টা হয়ে ছিল। শফিক সোজা করে। সঙ্গে,সঙ্গে পদ্মজার মসৃণ,পাতলা পেট উন্মুক্ত হয়ে উঠে। শফিকের লোলুপ দৃষ্টি দেখে পদ্মজার শরীর রি রি করে উঠে। সে প্রাণপণে ছোটার চেষ্টা করছে। শফিক উল্লাসে বললো, ‘ আরে ভাই, এমন সুন্দর মেয়েমানুষ তো দুটো দেখেনি। আমিরের উচিত ছিল আমাদের সাথে ভাগ করে নেয়া। একাই ছয় বছর – আচ্ছা যাক। তুই এখানে বসে থেকে দেখবি? দেখলে দেখতে পারিস।’

শফিক আরো অশ্লীল মন্তব্য করে। যা শুনে পদ্মজার ঘৃণায় বুক ফেটে কান্না আসে। শফিক পদ্মজার উপর ঝুঁকতেই পদ্মজা চেঁচাতে থাকে। এক দলা থুথু ছুঁড়ে দেয় শফিকের মুখের উপর। শফিকের চোখ দুটি বড় বড় হয়ে যায়। প্রবল আক্রোশে পদ্মজার আহত গালে থাপ্পড় বসায়। পুরনো ক্ষতস্থানের পুরো চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। ব্যথায় পদ্মজার সারা শরীর টনটন করে উঠে। আর্তনাদ করে উঠে ‘আম্মা’ বলে। তখনই দুটি পায়ের শব্দ ভেসে আসে। কেউ একজন দৌড়ে এদিকে আসছে। রিদওয়ান আমিরের উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত ভয়ে চেয়ার থেকে উঠে, দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। ঘরে এসে প্রবেশ করলো আমির। রিদওয়ানের ধারণাই সত্যি। আমির পদ্মজার চিৎকার শুনেই চলে এসেছে। আমির এখানে আছে জানলে রিদওয়ান শফিককে নিষেধ করতো। শফিকও তো বলেনি! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়!

শফিক আমিরকে দেখে হাসলো। বললো, ‘আমির এই বউ তো-

চোখের পলকে সেই হাসি মিলিয়ে যায়। কথা বলাও থেমে যায়। আমির থাবা মেরে ধরে শফিককে। রিদওয়ান দ্রুত বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। এটু(A2) ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। শফিক কিছু বুঝে উঠার পূর্বে আমির ছুরি দিয়ে শফিকের গলার রগ কেটে ফেলে। রক্ত ছিটকে পড়ে পদ্মজার উপর। আমির নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে ছুরি দিয়ে শফিকের দুই চোখে আঘাত করে। পেটে,বুকে আঘাত করে। শফিকের মাথা দুই হাতে ধরে দেয়ালে শব্দ তুলে আঘাত করে। শফিকের মুখ থেকে গ্যার-গ্যার ধরণের একটা শব্দ বেরিয়ে আসে। সেই শব্দ আর আমিরের বিশ্রি গালিগালাজে পদ্মজা ভীত হয়ে পড়ে। রক্তে সারা ঘর রক্তপুরী হয়ে উঠেছে। পদ্মজার শরীর কাঁপতে থাকে। সে কখনো আমিরকে খুন করতে দেখেনি। আজই প্রথম দেখছে। কী নির্মম তার খুন করার ধরণ। কী হিংস্র তার চাহনি,তার আক্রমণ! চোখের পলকে মানুষ খুন করে ফেলেছে! পদ্মজা চোখ বুজে জোরে জোরে কাঁদতে থাকলো।আমিরের সারামুখে রক্ত। চোখ দুটি ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। হাপাচ্ছে না। দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো মজিদ,খলিল,রাফেদ,আরভিদ।

মুহূর্তে চারিদিক থমকে যায়। থেমে যায় সব শব্দ। শফিকের রক্তাক্ত দেহটি মেঝেতে পড়ে আছে। চোখ দুটি যেন বেরিয়ে এসেছে। গলার রগ থেকে ছিটকে রক্ত বের হচ্ছে। যেকোনো সাধারণ মানুষের কাছে এই দৃশ্য দেখা মানে ওই মুহূর্তে মৃত্যুবরণ করা। গড়গড় করে বমি করা। পদ্মজার সারা শরীর কাঁপছে। এমন মানুষের সাথে সে কিছুতেই পারবে না। মুহূর্তের ঘটনায় সে হার মেনে নিয়েছে। মনেপ্রাণে নিজের মৃত্যু চাইছে। এই মুহূর্তে মনে ভয় ছাড়া আর কিছু নেই।ভালোবাসা,রাগ,ঘৃণা,ক্রোধ কিছু নেই। সে শুধু ভয় পাচ্ছে।

৬৭

আমির হাতের ছুরি চেয়ারের উপর রাখলো। তারপর রক্তমাখা জ্যাকেট খুলে মেঝেতে ফেললো। পদ্মজা ভয়ে মিইয়ে গেছে। অস্বাভাবিকভাবে ফোঁপাচ্ছে। খলিল যত দ্রুত সম্ভব জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন। মজিদ তীব্র বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে বিকৃত রূপ ধারণ করলেন। শফিক তাদের কতো কাজে লাগতো,সেটাও শেষ! পদ্মজাকে তার শুরু থেকেই অপছন্দ। মেয়েটার রূপের আড়ালে তিনি আগুন দেখতে পান। যে আগুন আমিরকে ঘায়েল করে তাদের নিঃশেষ করে দিবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমিরকে কিছু বলে লাভ নেই। পরে সময় করে বোঝাতে হবে। মাথায় অনেক চিন্তা নিয়ে তিনিও জায়গা ত্যাগ করলেন। আমির তার গায়ের শার্ট খুলে হাত-মুখের রক্ত মুছে,পদ্মজার দিকে এগিয়ে আসলো।

পদ্মজা আমিরের দিকে তাকানোর সাহস অবধি পাচ্ছে না। সে খুনের দৃশ্যটি বার বার দেখছে। মনে হচ্ছে,এই বুঝি আমির তার চোখ দুটি… না ভাবা যাচ্ছে না! পদ্মজা নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলো। আমির ছুঁতেই দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমির দুই সেকেন্ডের জন্য থামে। তারপর জোর করে পদ্মজাকে বসালো। পদ্মজার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। সঙ্গে,সঙ্গে পদ্মজা বিছানার এক কোণে চলে গেল। সে স্থির হতে পারছে না। তার মন,শরীর ভীষণভাবে অস্থির হয়ে আছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আমির অনেকক্ষণ পদ্মজার ভয় পাওয়া দেখলো। তারপর ডাকলো, ‘পদ্মজা।’

পদ্মজা হাঁটুতে মুখ গুঁজে রেখেছে। সে আমিরের ডাকে সাড়া দিল না। আমির উঁচু কণ্ঠে বললো, ‘তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তোমাকে কিছু করবো না।’

তাও পদ্মজা তাকায় না। তার শরীর বিরতিহীনভাবে কাঁপছে। আমির বিছানায় উঠে আসে। জোর জবরদস্তি করে পদ্মজাকে নামিয়ে আনে বিছানা থেকে। ধমক দেয়। পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসে এফোর(A4) ঘরে। এ ঘরটা অন্যরকম। সাধারণ ঘরের মতো। পদ্মজাকে বিছানায় রাখতেই, পদ্মজা আমিরকে জোরে ধাক্কা দিল। কিন্তু অদ্ভুত! তার ধাক্কায় আমির এক আঙ্গুলও নড়েনি। আমিরকে পদ্মজার আর স্বামী মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে দানব। একটা দানব দাঁড়িয়ে আছে সামনে। সে মুক্তির জন্য ছটফট করছে আর কাঁদছে। আমির পদ্মজাকে স্থির করার চেষ্টা করে। পদ্মজা কিছুতেই স্থির হয় না। সে তার মাকে খুঁজছে। মুক্তি চাইছে। ভয়ে তার শরীর শীতল হয়ে গেছে। বাঁধ ভাঙ্গা নদীর মতো হু হু করে কাঁদছে। আমিরের ধৈর্য্য ভেঙে যায়, জোরে ধমকে উঠে, ‘কান্না থামাও। থামাও বলছি।’

পদ্মজা কান্না থামানোর চেষ্টা করে। ভয়ার্ত চোখে আমিরের দিকে তাকায়। আমির আসার সময় আরভিদকে দেখেছে। আরভিদের হাতে একটা ব্যাগ ছিল। সে পদ্মজাকে রেখে দরজার কাছে এসে আরভিদকে ডেকে ব্যাগ নিল। ব্যাগে পদ্মজার ঔষধপত্র,শাড়ি,ব্লাউজ,সোয়েটার,শাল রয়েছে। যখন বের হয়েছিল তখন বাইরে লতিফা দাঁড়িয়ে ছিল। ফরিনা পাঠিয়েছেন পদ্মজার খোঁজ নিতে। নয়তো তিনি খাবেন না। তাই লতিফা বাধ্য হয়ে এসেছিল। আমির লতিফাকে দেখে রেগে যায়। লতিফাও ভয় পেয়ে যায়। তবে আমির রেগে কিছু বললো না। শুধু প্রশ্ন করলো কেন এসেছে? তারপর উত্তর দিয়ে দিল,পদ্মজা ভালো আছে। একটা ব্যাগে যেন পদ্মজার দরকারি জিনিসপত্র দিয়ে দেয়া হয়। শেষ রাতে যেন বাড়ির পিছনে অপেক্ষা করে। আর দুইদিন থাকা হবে এখানে। দুটো দিন পদ্মজাকে চোখের আড়াল করা যাবে না। লতিফা শেষ রাতে ব্যাগ নিয়ে আসে। আমির লতিফার কথা ভুলে যায়। তারপর যখন মনে পড়ে,আরভিদকে পাঠায়। আমির ব্যাগ থেকে শাড়ি,ব্লাউজ বের করে বিছানার এক পাশে রাখলো। পদ্মজাকে বললো, ‘তখন বমি করেছো,এখন আবার রক্তও লেগেছে। পাল্টে নাও।’

আমিরের কণ্ঠ শান্ত,স্বাভাবিক। কিছু মুহূর্ত আগের ঘটনার কোনো ছাপ নেই তার মুখে। সে পদ্মজার জবাবের জন্য অপেক্ষা করে। পদ্মজা জবাব দেয় না। তার ফোঁপানো ধীরে ধীরে কমে আসে। ফিরে আসে তার স্থির স্বভাবে। পদ্মজার গাল থেকে রক্ত ঝরছে। আমির তুলা এনে কিছুটা বিছানায় রাখলো,আর কিছুটা দিয়ে পদ্মজার গালের রক্ত মুছার জন্য পদ্মজার এক হাত ধরে তার দিকে ফেরানোর চেষ্টা করতে চাইলো, তখনই পদ্মজা ছ্যাৎ করে উঠে দূরে সরে যায়,চোখ বড় বড় করে বললো, ‘দূরে থাকুন।’

‘রক্ত ঝরছে তো।’

‘আমারটা আমি দেখে নিতে পারবো।’

পদ্মজা বাকি তুলাটুকু নিজের গালে চেপে ধরলো। আমিরের আর কি বলার! সে পদ্মজার সাথে কথা বাড়ানোর সাহস পায় না। বিছানার চেয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে কাঠের চেয়ারে বসলো। দুজন দুইদিকে বসে থাকে চুপচাপ। নিস্তব্ধ,শান্ত পরিবেশের জন্য পদ্মজার নিঃশব্দে কান্না করাটা শুনতে পাচ্ছে আমির। সে কথা বলতে গিয়ে দেখলো,তার কথা ফুটছে না। আরো দুইবার চেষ্টা করার পর কথা ফুটল, ‘কী করবে ভেবে পাচ্ছো না? অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে?’

পদ্মজা আগুন দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। কটাক্ষ করে বললো, ‘আনন্দ হচ্ছে আপনার?’

‘আনন্দ হওয়ার কী আছে?’

‘কিছু নেই?’

‘না।’

‘ওই লোকটিকে খুন করে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন?’

‘নিজেকে ভালো প্রমাণ করার চেষ্টা করলে তোমার কাছে ভালো হতে পারবো?’

পদ্মজা থমকাল। সময় নিয়ে বললো, ‘আপনি আমার মাকে খুন করতে চেয়েছেন। আপনি আমাকে একটার পর একটা মিথ্যা বলেছেন। আর অন্যদের সাথে নৃশংসতার কথা না হয় বাদই দিলাম। তারপরও আমি আপনাকে ভালো মনে করব?’

‘সেটাই তো বললাম।’

তীব্র ঘৃণায় পদ্মজা মুখ ফিরিয়ে নিল। আমির বললো, ‘এসব কে বলেছে?’

‘মিথ্যে তো বলেনি।’

‘রিদওয়ান?’

‘সত্য তো?’

আমির উত্তর দিল না। পদ্মজা বললো, ‘আমার নিজেকে নর্দমার কীট মনে হচ্ছে। আপনার মতো একটা মানুষের সাথে এতদিন বসবাস করেছি আমি।’

‘গোসল করে পরিষ্কার হয়ে যাও।’

‘মজা করছেন?’

‘না।’

‘তারপর তো ঠিকই ছুঁবেন। জোর করে অপবিত্র করে দিবেন। পুরুষ তো আপনি। পেরে উঠবে না কোনো নারী। নারী তো ভোগের জিনিস। ভোগ করে করে ফেলে দেওয়ার জিনিস।’

আমিরের কপালে ভাঁজ পড়ে। বললো, ‘কবে তোমাকে জোর করেছি?’

‘আপনাকে ভালোমানুষ ভেবে,স্বামী ভেবে কখনো জোর করার সুযোগ দেইনি।’

‘ভালোবেসে না?’

‘দয়া করে,ভালোবাসার নাম মুখে নিয়েন না। আমার রূপে পাগল আপনি। আমার মতো সুন্দর মেয়ে আপনি দুটো দেখেননি এজন্য রেখে দিয়েছেন। বিয়ে করেছেন। হালাল সনদের অধিকারে ভোগ করেছেন। আমার এই সৌন্দর্য যদি না থাকতো, কবেই ছুঁড়ে দিতেন আবর্জনায়।’

‘রূপ নিয়ে অহংকার করছো? পাগল হয়ে গেছো তুমি।’

‘তাই করছি। আপনার ভাই রিদওয়ানের মনোরঞ্জনের জন্য আমাকে তুলে আনতে গিয়েছিলেন। নিজের বউকে অন্যজনের ভোগের জন্য আনতে গিয়েছিলেন।’

আমির হাসলো। হেসে বললো, ‘তখন তুমি আমার বউ ছিলে? দেখার পর হয়েছো।’

আমিরের হাসি পদ্মজার রাগ আরো কয়েনগুণ বাড়িয়ে তুললো, ‘আমার এই সুন্দর মুখ না থাকলে আমার জায়গা কি আপনার বিলাসবহুল বাড়িতে হতো? স্থায়ী রক্ষিতা হিসেবে?’

‘তোমার মনে হচ্ছে না,তুমি বাড়াবাড়ি করছো? তোমার সাথে এমন কথাবার্তা যায় না।’

‘আপনি তো আমাকে আমার জায়গায় থাকতে দিলেন না। আমাকে আপনার স্তরেই নামতে হবে এখন। নয়তো বাঁচবো কী করে? কয়দিন পরতো আমার বোনদের উপরও আপনার হাত পড়বে। ব্যবসায় বিপদে পড়েছেন তো।’

‘আটপাড়ার মেয়েদের-

পদ্মজা আমিরের কথা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘জানি আমি। কিন্তু সেই নিয়ম ভেঙে আপনি আমাকে ঠিকই তুলে আনতে গিয়েছিলেন। মেয়ের প্রয়োজনে আমার বোনদের উপর হাত দিবেন না তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? যেখানে আপনি আমার মাকে খুন করতে চেয়েছিলেন।’

‘তোমার বোনদের উপর কখনো কোনো আক্রমণ আসবে না। তুমি খুব বেশি কথা বলছো।

‘শরীরের শক্তির সাথে তো পেরে উঠি না।’

‘তাই কথা বলে মাথা খাচ্ছো?’

‘আপনার মরে যেতে ইচ্ছে করে না? এতো খারাপ কাজ করার পরও নিজেকে ক্লান্ত মনে হয় না? মনে হয় না,এইবার থামা উচিত?’

আমির মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো। বললো, ‘অনেক কথা বলেছো। এইবার গোসল করে, খাওয়াদাওয়া করে আমাকে সুযোগ দাও।’

‘কীসের সুযোগ?’

‘তোমাকে বাঁধার। আমাকে বের হতে হবে আবার।’

পদ্মজা অন্যদিকে ফিরে বসে। যার অর্থ সে গোসল করবে না। তার অসহ্য লাগছে আমিরকে। আমিরের খুন করার অভিজ্ঞতা দেখে হাতাহাতি করার সাহস মরে গেছে। এখন থেকে যা করতে হবে,পরিকল্পনা মাফিক করতে হবে। নয়তো সে কিছুতেই পারবে না। মেয়েগুলোর মুক্তির আকুতি করে যে লাভ নেই সেটাও বুঝে গেছে। আমির চেয়ার ছেড়ে উঠে আসলো।। খপ করে পদ্মজার হাতে ধরলো। বললো, ‘যাও গোসলে।’

‘ছাড়ুন!’ কিড়মিড় করে বললো পদ্মজা।

‘গোসলে যাও। গোসল করে খাওয়াদাওয়া করে,ওষুধপত্র খেয়ে আমাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করো।’

‘নাটক করছেন কেন?’

‘নাটক তো তুমিও করছো। যেভাবে কথা বলছো এটা তো তুমি না।’

‘উফফ! ছাড়ুন।’

‘আমাকে বাধ্য করো না,তোমাকে গোসল করিয়ে দিতে।’

পদ্মজা বিস্ফোরিত হয়ে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘তখনই আমি মরে যাবো।’

‘সেজন্যই বলছি,নিজে যাও।’

‘আমি আপনার কথা শুনবো না।’

‘আমার হাতের মার কিন্তু খুব শক্ত। নরম আছি নরম থাকতে দাও।’

‘অন্যজনকে দিয়ে মার দিয়েছেন,এবার নিজে মারাটা বাকি। মেরে দিন না, এখুনি মেরে দিন।’

‘আমি কাউকে মারতে বলিনি। কিন্তু এরকম চলতে থাকলে,তুমি আমার হাতে শক্ত আঘাত পাবে।’

পদ্মজার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। সে ভেজাকণ্ঠে বললো, ‘সেদিনটাও যে আমাকে দেখতে হবে আমি জানি। তাহলে এখন কেন দরদ দেখাচ্ছেন? নাটক করছেন কেন?’

‘পদ্মজা আমার দেরি হয়ে যাবে। সময়টা আমার কাছে খুব মূল্যবান। দুই দিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। মাথা চড়ে আছে,কথা শুনো।’

পদ্মজা কিছু বলার মতো খুঁজে না পেয়ে,থুথু ছুঁড়ে মারলো। আকস্মিক ঘটনায় আমির হতভম্ব। পদ্মজা কথায়,কথায় থুথু ছুঁড়ে দিচ্ছে। যা অপমানজনক। কিন্তু আমির কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে পদ্মজাকে জোর করে টেনে নামালো। বললো, ‘গোসলে যাও।’

‘গায়ের জোর দেখাচ্ছেন?’

‘দেখাচ্ছি।’

‘ছয় বছর তো জোরই দেখিয়েছেন।’

‘তোমার সম্মতিতে।’

পদ্মজা আমিরের চোখের দিকে তাকালো। শান্ত,গভীর ক্লান্ত দুটি চোখ। হিংস্রতার বিন্দুমাত্র রেশ নেই। খাড়া নাক,পাতলা ঠোঁটে হালকা গোলাপি ছাপ। থুথুনিতে কাটা দাগ। এলোমেলো চুল,কপালে দারুণ দুটো ভাঁজ। উত্তপ্ত চেনা নিঃশ্বাস মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় প্রাণের স্বামীর কথা। কত কত আদর,সোহাগ,ভালোবাসার ছন্দ এই মানুষটিকে ঘিরে। ঘৃণার মোটা দেয়াল ভেঙে ভালোবাসার অনুভূতিটা কী অদ্ভুতভাবেই ছুঁয়ে ফেললো পদ্মজাকে। তখনই কানে ভেসে আসে রিদওয়ানের কথাগুলো,ভেসে আসে মেয়েদের চিৎকার। চোখের সামনের রঙিন পর্দাটা সরে গিয়ে হয়ে উঠে ক্রোধী। পদ্মজা চাপাস্বরে আমিরকে জানায়, ‘শেষ অবধি আমি পদ্মজাই থাকবো।’

আমির পদ্মজার স্বরেই বললো, ‘পারবে না। আমার সাথে তুমি পারবে না। বিশ্বাস করো,গায়ের জোরে,বুদ্ধির খেলায় আমার সাথে পারবে এমন মানুষ জন্মিয়েছে সেটা আমি বিশ্বাস করি না। তবে কোনো অনুভূতি জন্মালেও জন্মাতে পারে।’

আমিরের শেষ কথাটা দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে। কোনো অনুভূতি কি তলোয়ারের চেয়েও ধারালো হয়? সত্যি কি অনুভূতি কারো ধ্বংসের কারণ হতে পারে? তাহলে সেই অনুভূতি পদ্মজা কোথায় পাবে? যে অনুভূতি দিয়ে আমিরকে নিঃস্ব করে মৃত্যুর দুয়ারে পাঠানো যাবে। শেষ হবে দুশো বছরের পাপ। আমিরের পদ্মবতী হয়ে উঠবে শুধুমাত্র পদ্মজা।

৬৮

পদ্মজার শরীর ঘামে ভিজে একাকার। প্রচণ্ড গরম লাগছে। সকালে খুব ঠান্ডা ছিল। সোয়েটার পরার পরও তার শরীর কাঁপছিল। তাই আমির পদ্মজার গায়ে শাল পেঁচিয়ে দিয়েছিল। তারপর তো আমির বেরিয়েই গেল। এখন পদ্মজা গরমে ঘামছে। সময়টা দুপুরবেলা। সূর্য আজ অনেক তেজ নিয়ে আকাশে উঠেছে। পদ্মজার হাসঁফাঁস লাগছে। গরমে মাথা ব্যথা হয়ে গেছে। বসে থাকতে থাকতে কোমরও যেন অবশ হয়ে গেছে। আশেপাশে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভোরের দিকে মেয়েদের চিৎকার কানে এসেছিল। পদ্মজার কিছু করার ছিল না। সে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে। খট করে দরজা খুলে যায়। পদ্মজা চোখ তুলে তাকালো। আমির এসেছে! পরনে ফুলহাতা সাদা গেঞ্জি। পদ্মজা চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিল। আমির পদ্মজার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। তারপর শাল সরাতে চাইলে,পদ্মজা বাঁধা দিয়ে বললো, ‘ আমি পারবো।’

আমির সরে দাঁড়ালো। পদ্মজা গা থেকে শাল বিছানায় রেখে সোয়েটার খুললো। তারপর কাঠ কাঠ গলায় বললো, ‘দয়া করে আমাকে আর বাঁধবেন না।’

‘নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার স্বভাব আমার নেই।’

‘বসে থাকতে,থাকতে আমার কোমরের হাড় ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।’

‘দুই-তিনদিন বসে থাকলে হাড় ক্ষয় হয় না।’

পদ্মজা হতাশ হয়ে বললো,’আমার যন্ত্রণা হয়। ঝিমঝিম করে পা।’

আমির ঘরের এক কোণে থাকা কাঠের বক্সের দিকে এগোতে এগোতে বললো, ‘মামার বাড়িতে আসোনি যে,যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে।’

‘একুশটা মেয়ে কি জোগাড় হয়ে গেছে?’ আচমকা পদ্মজার এমন প্রশ্ন,তাও শান্ত কণ্ঠ।

আমির বক্সের তালা খুলে একটা ছুরি বের করলো। পদ্মজার জবাব দিল স্বাভাবিককণ্ঠে, ‘এতো সহজ নাকি! এতসব রিদওয়ান কেন যে তোমাকে বললো!’

‘আপনি আমার মাকে কীভাবে মারতে চেয়েছিলেন?’

‘পথের কাঁটা রাখতে নেই।’

পদ্মজা চমকে গেল,আহত হলো। আমির কত সহজভাবে তার মাকে উদেশ্য করে বললো ‘পথের কাঁটা রাখতে নেই।’ পদ্মজা কথা বলার মতো আর মন পাচ্ছে না। কষ্টও যেন সয়ে গেছে। শুধু তীক্ষ্ণ চোখে আমিরের পিঠের উপর তাকিয়ে রইলো। আমির উঁবু হয়ে কী যেন খুঁজছে। দরজা খোলা। পদ্মজা পরিকল্পনা করলো,সে এখন এক দৌড়ে ধ রক্তে চলে যাবে। যে ভাবনা সেই কাজ, এক পা এক পা করে পিছিয়ে যায়। আমির না দেখেই পদ্মজার উদ্দেশ্যে বললো, ‘ পালাতে পারবে না।’

পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। বললো, ‘পালাচ্ছি না।’

আমির উঠে দাঁড়াল। পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তো কোথায় যাচ্ছো?’

পদ্মজা বিছানায় এসে বসলো। তার মাথা কোনো কাজই করছে না। এখানে কোনো পথই নেই। সব পথ যেন বন্ধ করা। সে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘ আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করছি না। করবও না। আমাকে বাঁধবেন না অনুরোধ।’

‘ছলনার পথ নিতে চাইছো?’

‘ছলনা করবো কেন? টয়লেটে যেতে পারি না,শুতে পারি না। স্বামীর নতুন বাড়িতে এসেছি তো নাকি? একটু শান্তি তো দিবেন।’

‘অভিনয়ে খুব কাঁচা তুমি। হচ্ছে না। ভালো করে অভিনয় করো নয়তো যা বলার সোজাসুজি বলো।’

পদ্মজা থতমত খেয়ে গেল। সে সোজাসুজি আর কিছুই বললো না। এক রাত চলে গেছে। মানে আর সাতদিন বাকি। কিছু করতে পারবে তো! আমির বক্স থেকে একটা বস্তু হাতে নিল। পদ্মজার দিকে ফিরে বললো, ‘যদি এটা ধরতে পারো তোমার বসা,শোয়া সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়ে যাব।’

কথা শেষ করেই বস্তুটি পদ্মজার দিকে ছুঁড়ে মারলো। পদ্মজা ধরে ফেললো। আমির আবার বক্সের দিকে ফিরলো। বললো, ‘দারুণ। আমি আমার কথা রাখবো।’

পদ্মজা বস্তুটির এক মাথা ধরে টান দিতেই একটা ছুরি বেরিয়ে আসে। সে অবাক হয়ে আমিরের দিকে তাকালো। আমির মনোযোগ দিয়ে কি যেন খুঁজেই চলেছে। পদ্মজা তাৎক্ষণিক ভাবলো,ছুরি দিয়ে সে আমিরকে ভয় দেখাবে। ভয় দেখিয়ে সবগুলো মেয়েকে বাঁচিয়ে ফেলবে। তার উত্তেজিত মস্তিষ্ক গভীরভাবে কিছু আর ভাবলো না। পরিস্থিতিকে পানির মতো সহজ ভেবে,সে ধীরে,ধীরে এগিয়ে গেল। আমির আড়চোখে খেয়াল করলো, পদ্মজা আসছে। আর তার হাতে ছুরি। তাও আমির নড়লো না। ওইভাবেই রইলো। আমির যখন একটু দূরে তখন পদ্মজা হাঁটা থামিয়ে দৌড়ে এসে আমিরের গলায় ছুরি ধরে বললো, ‘সবগুলো মেয়েকে ছেড়ে দিন নয়তো আমি আপনাকে মেরে ফেলবো।’

আমির হাসলো। বললো, ‘পদ্মজা,এখানে শুটিং হচ্ছে না।’

পদ্মজা অপ্রস্তুত হয়ে আছে। তবুও সে ভাঙা গলায় হুংকার ছেড়ে বললো, ‘ যা বলছি করুন।’

আমির নাছোড়বান্দা স্বরে বললো, ‘করব না।’

পদ্মজার আশার পাহাড় দুই ভাগ হয়ে যায়। তবুও সে হার মানার মেয়ে নয়। বললো, ‘আমাকে সহজ ভাববেন না। আমি কিন্তু স্বামী বলে ছেড়ে দেব না।’

‘এতো লম্বা হয়ে লাভ কী হলো? স্বামীর গলায় ছুরি ধরতে পায়ের আঙুলের উপর ভর দিতে হচ্ছে তোমার। এবার পায়ের পাতা মাটিতে ফেলো নয়তো আঙুল ভেঙে যাবে।’

পদ্মজা দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বললো, ‘গতকাল থেকে আপনি আমার সাথে মশকরা করে যাচ্ছেন।’

আমির চমৎকার কৌশলে তার জায়গায় পদ্মজাকে নিয়ে আসে আর পদ্মজার জায়গায় সে চলে আসে। শুধু ছুরিটা আলাদা। আমির বললো, ‘তোমার হাতের ছুরি দিয়ে সুতাও কাটা যাবে না। ভোঁতা ছুরি। খেয়াল না করেই আমাকে আক্রমণ করতে চলে এসেছো। মশকরা আমি করছি নাকি তুমি? বাচ্চাদের মতো আচরণ করছো। বুদ্ধি হাঁটুতে চলে এসেছে। গতকালের শফিকের মৃত্যুটা তোমাকে তোমার জায়গা থেকে নড়বড়ে করে দিল, সেখানে আমার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করছো! বোকা মেয়ে। এখন আমি যদি তোমার গলার শিরাটা কেটে ফেলি? আমার হাতের ছুরি কিন্তু ভোঁতা না।’

পদ্মজার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে যায়। আমির এমনভাবে চেপে ধরে ছুরি ধরেছে যে, মনে হচ্ছে এখুনি আমির তার প্রাণ নিয়ে নিবে। কিন্তু আমির সেটা করলো না। পদ্মজাকে আলগা করে দিল। পদ্মজা ছাড়া পেয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। আমির বললো, ‘আগে ঘোর কাটিয়ে নিজের অবস্থানে ফিরে আসো।’

কথা শেষ করে যখনই আমির বের হবে তখন পদ্মজা প্রশ্ন করলো, ‘এতো মন্দ ভাগ্য কেন হলো আমার?’

আমির জবাব না দিয়েই চলে গেল। পদ্মজা মেঝেতে বসে,ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে কোনদিকে যাবে,কী করবে? দিকদিশা পাচ্ছে না। এতো ভেবেও কোনো কূলকিনারা পেল না। আমির যদি তাকে বেঁধে না যায় তবে সে কিছু করার চেষ্টা করতো। কিন্তু সেটা কখনোই হবে না। আমির বোকা না। সে খুব সতর্ক এবং চালাক। পদ্মজা কান্না করা ছাড়া করার মতো আর কিছু পাচ্ছে না। নিজের কপাল চাপড়ে শুধু কান্না করারই সুযোগ আছে এখানে। আমির হ্যান্ডকাপ নিয়ে আসলো। পদ্মজার হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দিল। পদ্মজা কিছু বললো না,আমিরও বললো না। হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আমির তার মতো চলে গেল। বের হওয়ার পূর্বে আরভিদকে বললো, ‘পদ্মজার হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো আছে। যদি এখানে হাঁটাহাটি করে কিছু বলো না। আমি বড় দরজায় নতুন তালা দিয়েছি। চাবি একটা আর সেটা আমার কাছে। যা ই করুক,বের হতে পারবে না।’

আরভিদ বললো, ‘যদি আমাকে আক্রমণ করে?’

‘ও হাত ছাড়া কাউকে আক্রমণও করতে পারে না। তাই নির্ভয়ে থাকবে। যা ইচ্ছে করুক পাত্তা দিবে না। মনে করবে,পিঁপড়া ঘোরাঘুরি করছে।’

আরভিদ বললো, ‘জি,স্যার।’

‘মেয়েগুলোকে খাবার দিবে। আমার আসতে অনেক রাত হবে।’

‘জি,স্যার।’

আমির রাফেদকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার পূর্বে ভালো করে সবকিছু দেখে নিলো। পদ্মজা দ্বারা তার ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো পথ আছে নাকি! নেই! আমির নিশ্চিন্তে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। আচমকা তার খেয়াল হলো,তার হাত বন্দি কিন্তু পা বন্দি না। দরজাও খোলা। সে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে আসলো বাইরে। চারিদিক নির্জন,থমথমে। সে আগে প্রতিটি ঘর দেখলো। এটুতে(A2) রিদওয়ান ঘুমাচ্ছে। বাকি ঘরগুলো খালি। সে পা টিপে,টিপে স্বাগতম দরজা পেরিয়ে ধ-রক্ত দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। ধ-রক্তের মানে সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে,ধর্ষণ এবং ধ্বংস থেকে নেয়া ধ। রক্তটা বোধহয় এদের মনের আনন্দ। তাই নামকরণ হয়েছে,ধ-রক্ত। পদ্মজা দরজা ধাক্কা দিতেই আরভিদ সামনে এসে দাঁড়ালো।

.

মৃদুল সাইকেল নিয়ে বড় সড়কে পূর্ণার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা রায়পুর মেলায় যাবে। আজ শেষ দিন। পূর্ণার নাকি অনেকদিনের ইচ্ছে রায়পুর মেলায় যাওয়ার। কিন্তু হেমলতা কখনো মেলায় যেতে দেননি। তিনি সবসময় ভীড় থেকে মেয়েদের দূরে রেখেছেন। পূর্ণা তার বন্ধুদের কাছে শুধু শুনেছেই কখনো যায়নি। কথায় কথায় যখন মৃদুলকে সে বললো তার ইচ্ছের কথা। মৃদুল তাৎক্ষণিক পূর্ণাকে জানালো, ‘আমি তোমারে নিয়া যামু। কাইল দুপুরে বড় সড়কে আইসা পড়বা। বোরকা পইরা আসবা। ‘

মৃদুল অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে উঠে। তখন দূরের ক্ষেতে দেখা যায় পূর্ণাকে। কালো বোরকা পরা। আপাদমস্তক ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা। মাথার উপর তুলে রেখেছে নিকাব। সড়কের দুই পাশে বিস্তীর্ণ ক্ষেত। ক্ষেতের আইল ধরে ছুটে আসছে পূর্ণা। ওড়নার আংশিক অংশ বাতাসে উড়ছে। মৃদুল মনোমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণা মৃদুলের কাছে এসে হাঁপাতে থাকলো। হাঁপাতে,হাঁপাতে বললো, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে তাই না? বড় আম্মা আসতেই দিচ্ছিল না।’

মৃদুল পূর্ণার পাতলা ত্বকের মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললো, ‘কী বইলা আইছো?’

‘কিছুই না। বলেছিলাম,সুরুজ চাচার বাড়িতে যাব। তখন বললো,কোথাও যাওয়া-যাওয়ি নাই। আপা জানতে পারলে নাকি বড় আম্মার উপর রাগবে। তাই না বলেই চলে এসেছি।’

‘চিন্তা করব তো।’

‘না বলে কতবার বের হয়েছি। কিছু হবে না।’

মৃদুল তাড়া দিয়ে বললো, ‘তাইলে তো হইলোই। তাড়াতাড়ি উঠো। যাইতে সময় লাগব।’

পূর্ণা এতক্ষণে সাইকেল খেয়াল করলো। সে বললো, ‘ সাইকেলে করে যাব?’

মৃদুল ফিরে তাকাল। বললো, ‘তাইলে কী দিয়া যাইবা? হাঁইটা গেলে বাড়ি আইতে আইতে আজকে সারা রাইত লাগব।’

মৃদুলের পিছনে থাকা খালি জায়গাটায় পূর্ণা তাকাল। মৃদুলের খুব কাছে। আর এখানে বসলে মৃদুলের পেট জড়িয়ে ধরতে হবে। ভাবতেই পূর্ণার হাড় হিম হয়ে আসে। এতদিনের পরিচয়ে একজন আরেকজনের হাতও ধরেনি। আর আজ এতো কাছে বসে পেট জড়িয়ে ধরতে হবে! পূর্ণা ঢোক গিলে মিনমিনিয়ে বললো, ‘সাইকেল দিয়ে যাব না আমি।’

মৃদুলের ভ্রুযুগল বেঁকে যায়। সে ধমকে উঠে, ‘নাটক করতাছো কেন? তাড়াতাড়ি উঠো। আর মুখটা ঘুরো। মানুষ দেখব।’

সূর্যের কিরণ এসে পড়ে মৃদুলের চোখেমুখে। স্নিগ্ধ, চকচকে ফর্সা মুখের সাথে বেঁকে যাওয়া দুটি ভ্রু কী সুন্দর করেই না মানিয়েছে! পূর্ণা সেদিকে চেয়ে থেকে কিছু বলতে পারলো না। নিকাব দিয়ে মুখ ঢেকে মৃদুলের পিছনে বসলো। মৃদুল মৃদু হাসলো, যা চোখে পড়লো না পূর্ণার। মৃদুল সাইকেলের চাকায় পা দিতেই পূর্ণা খামচে ধরে মৃদুলের শার্ট। মৃদুলের সর্বাঙ্গে একটা অজানা,অচেনা সুন্দর অনুভূতির উথালপাতাল ঢেউ উঠে। পূর্ণার বুকে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে! নিঃশ্বাস এত বেশি এলোমেলো হয়ে পড়ে যে,পূর্ণার মনে হচ্ছে এখুনি সে মারা যাবে। মৃদুল আটপাড়া পার হয়ে, পূর্ণার উদ্দেশ্যে বললো, ‘কাঁপতাছো কেন?’

পূর্ণা কিছু বলতে পারলো না। কী লজ্জা! সে কাঁপছে সেটাও মৃদুল টের পাচ্ছে। পথের দুই দিকে যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ মাঠ। কোথাও কোনো মানুষ দেখা যাচ্ছে না। পূর্ণা দূরে চোখ রেখে চুপ করে রয়েছে। মৃদুল বললো, ‘পূর্ণা?’

এ কেমন মায়াময় ডাক! পূর্ণার হৃদয়ে উঠা অপ্রতিরোধ্য তুফান বেড়ে যায়। বুকে এতো জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে কেন? যদি মৃদুল শুনে ফেলে! সে তো লজ্জায় মরেই যাবে। মৃদুল আবার ডাকলো, ‘পূর্ণা?’

পূর্ণা জুবুথুবু হয়ে উত্তর দিল, ‘কী?’

‘আমার হাত পা অবশ হইয়া যাইতাছে কেন?’

‘আমারও।’

সাইকেল থেমে গেল। মৃদুল পূর্ণাকে বললো, ‘নামো।’

পূর্ণা নামলো। মৃদুল বললো, ‘সাইকেল দিয়া আর যাওয়া যাইবো না। দূরে থাকা ভালা। তোমার ছোঁয়া বিজলির মতোন বাইরিতাছে আমারে।’

মৃদুলের কথা শুনে পূর্ণার খুব হাসি পেলো। সে হাসি আটকে রাখলো না। হেসে ফেললো। যদিও হাসি দেখা যায়নি। তবে মৃদুল বুঝতে পারলো,পূর্ণা হেসেছে। সে মুখ ভার করে বললো, ‘হাসো,হাসো। হাসবাই তো। আরেকটু হলে মরেই যেতাম।’

পূর্ণা সশব্দে হেসে উঠলো। মৃদুল বললো, ‘ হইছে আর হাসা লাগব না। হাঁটো। মাঠের মাঝখান দিয়া যাই কী বলো? তাইলে তাড়াতাড়ি যেতে পারব।’

পূর্ণা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। বললো, ‘সাইকেল কী করবেন?’

‘হাত দিয়া ঠেলে নিয়া যাব।’

দুজন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে রায়পুর চলে আসে। মেলায় ঢুকতেই আছরের আযান পড়ে যায়! পূর্ণার মাথায় যেন বাজ পড়ে। সে ভীত কণ্ঠে বললো, ‘আছরের আযান পড়ে গেছে। বাড়ি কখন যাব? একটু পর তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আসুন,চলে যাই।’

‘মাত্র তো আইলাম। কিছু কিইনা এরপর যামুনে।’

‘দেরি হয়ে যাবে।’

‘খালি চুড়ি আর লিপস্টিক হইলেও নিয়া যাবা। আসো।’

মৃদুল শক্ত করে পূর্ণার হাত ধরলো। এই প্রথম মৃদুল হাত ধরেছে! সঙ্গে,সঙ্গে পূর্ণার মনে হয়,চারিদিকের সব ভীড়,কোলাহল থমকে গেছে। থমকে গেছে নাগরদোলার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ! পূর্ণার মনের আঙিনা জুড়ে নৃত্য শুরু হয়। সে ভুলে যায়, তার বাড়ি ফেরার তাড়া! মৃদুল যেদিকে নিয়ে যায়,সেদিকে ছুটে যায়। চারিদিকে কত শব্দ,কত মানুষ,রঙ-বেরঙের কত শাড়ি,গহনা,চুড়ি। কিছুই পূর্ণার চোখে পড়ছে না। শুধু অনুভব করছে,একটা পুরুষালি শক্ত হাত তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মনে মনে এই মানুষটাকে সে ভালোবাসে! রঙিন,রঙিন স্বপ্ন দেখে। এই সমাজ বিয়ের বাজারে সাদা-কালোর ভেদাভেদ করবে জেনেও সে ভালোবাসে। গায়ের রঙ মেনে কী আর ভালোবাসা হয়! মৃদুল একটা চুড়ির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আট ডজন চুড়ি কিনলো। পূর্ণা মানা করেছে,মৃদুল শুনেনি। চুড়ি কেনার পর মৃদুল বললো, ‘ অন্যকিছু দেখো। নূপুর নিবা না?’

পূর্ণা মাথা নাড়াল। সে নূপুর নিবে। সে একটা,একটা করে নূপুর দেখা শুরু করলো। মৃদুল এক ডজন সুতার চুড়ি হাতে নিল। চুড়িগুলো নিজের চোখের সামনে ধরলো। চুড়ির গোল ফাঁকা অংশে পূর্ণার মুখটা ভেসে উঠে। নিকাব মাথার উপর তুলে রাখা। চিকন নাকে নাকফুলটা জ্বলজ্বল করছে। পূর্ণা একজোড়া নূপুর হাতে নিয়ে মৃদুলের দিকে তাকালো। মৃদুল দ্রুত চুড়ি সরিয়ে নিল। অন্যদিকে তাকালো। পূর্ণার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে।

কথা ছিল শুধু চুড়ি,লিপস্টিক কিনে চলে যাবে অথচ মৃদুল পারলে পূর্ণার জন্য পুরো মেলাটাই কিনে ফেলে। পূর্ণা মৃদুলের পাগলামি দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে। এতকিছু নিচ্ছে! সব জিনিস রাখার জন্য বড় ব্যাগও কিনেছে! পূর্ণা মৃদুলকে চাপা স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘এত কিছু কেন নিচ্ছেন?’

মৃদুল বললো, ‘জীবনে প্রথম আম্মার জন্য শাড়ি,জুতা কিনছিলাম। আজ যখন আবার সুযোগ পাইছি মেয়ে মানুষের জন্য কেনাকাটা করার,কিনতে দেও।’

সন্ধ্যার আযান কানে আসতেই পূর্ণার গলা শুকিয়ে যায়। সে খপ করে মৃদুলের হাতের বাহু খামচে ধরে, কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ‘আমার আর কিছু লাগবে না। জীবনে আর মেলায়ও আসব না। বাড়ি নিয়ে চলুন।’

‘কাঁদতাছো কেন? আইচ্ছা আর কিছু কিনব না। বাজারে যাই। এরপরে বাড়িত যামু।’

মেলায় প্রবেশ করার পূর্বে,রায়পুরের বাজারের এক দোকানে মৃদুল তার সাইকেলটা রেখে এসেছে। যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে। দোকানদার মজিদ হাওলাদারের নাম শুনে,মৃদুলকে বাসায় যেতে বলেছিল। মৃদুল বলেছে,আরেকদিন যাবে। তারা মেলা থেকে বের হতে প্রস্তুত হয় তখন একজন লোক মৃদুলের পিঠ চাপড়ে বললো, ‘মৃদুল না?’

মৃদুল পরিচিত কারো কণ্ঠ পেয়ে উৎসুক হয়ে ফিরে তাকালো। লোকটিকে দেখে চিনতে পারলো। বললো, ‘আরে গফুর ভাই। কেমন আছেন?’

‘এইতো ভালাই আছি।’

‘রায়পুরে কী? মেলায় আইছেন?’

‘ছোট বইনডার জামাইর বাড়ি এইহানে। তোমার সাথে কেলা এইডে? বউ নাকি? বিয়া করলা কবে?’

পূর্ণা আড়ষ্ট হয়ে চোখ নামিয়ে নিল। মৃদুল আড়চোখে পূর্ণাকে দেখলো। তারপর বললো ‘জি ভাই,বউ। মাস খানেক হইলো।’

তখনই পূর্ণা মৃদুলের পিঠে চিমটি কাটলো। মৃদুল ‘আউ’ করে উঠে। গফুর উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তাই সে জোরপূর্বক হেসে বললো, ‘আজকে অনেক শীত! শীতে চিমটি মারে! আইচ্ছা,ভাই আজ আসি।’

‘রায়পুর কার বাড়িত আইছো কইলা না তো?’

‘অলন্দপুরে আইছি,ফুফুর বাড়িত। এহন যাই ভাই।’

‘মজিদ হাওলাদার তোমার ফুফুর ভাসুর না?’

‘জি।’

‘মানুষটারে দেখার অনেক ইচ্ছা আছিলো। অনেক ভালা কথা হুনি।’

মৃদুলের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো, ‘চইলা আইয়েন। আমিতো আছিই। আমারে এখন যাইতে দেন।’

‘যাও মিয়া।’

মেলার বাইরে এসে পূর্ণা বললো, ‘বউ বললেন কেন?’

মৃদুল বললো, ‘তে কী কইতাম? গ্রামে তোমারে আমারে মানুষ এক লগে কথা কইতে দেখে,হাঁটতে দেখে। এতেই নিন্দা করে। এখন যদি কেউ জানে সন্ধ্যা বেলা আমার সাথে এতো দূরে মেলায় আইছো কী হইবো জানো?’

‘এইজন্য বউ বলছেন?’ পূর্ণার কণ্ঠে অভিমান টের পাওয়া গেল। মৃদুল মুচকি হাসলো। বললো, ‘আর কী জন্যে বলব?’

পূর্ণা কিছু বললো না। শীতে তার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে,এখানে অনেক বাতাস। হাঁটতে হাঁটতে মৃদুল বললো, ‘ভয় হইতাছে না?’

পূর্ণা অবাক হয়ে জানতে চাইলো, ‘কীসের ভয়?’

‘পর পুরুষের সাথে রাতের বেলা এতো দূরে আছো। যদি কিছু হয়ে যায়?’

মৃদুলের কথা শুনে সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যায় পূর্ণা। সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে মৃদুলের দিকে। মৃদুল পূর্ণার তাকানো দেখে হেসে উঠলো।

পূর্ণা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমতাআমতা করে বললো, ‘হা…হাসছেন কেন?’

‘তোমার ভয় পাওয়া দেইখা।’ মৃদুল হো হো করে হাসতে থাকলো। পূর্ণার খুব রাগ হয়। সে মৃদুলকে ফেলে সামনে হাঁটতে থাকে। মৃদুল পিছনে ডাকে, ‘আরে খাড়াও।’

বাজারে অনেক ভীড়। চিৎকার,চেঁচামেচি। মারামারি লেগেছে বোধহয়। মৃদুল,পূর্ণা রায়পুরের ছোট বাজারের ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত ভেজাল দেখে মৃদুল পূর্ণাকে বললো, ‘তুমি এইখানে খাড়াও। এইদিকে কেউ নাই। আমি যাইতাছি আর আইতাছি।’

পূর্ণা চারপাশ দেখলো। ঘাটে অনেক নৌকা,ট্রলার বাঁধা। কেউ নেই,সবাই বোধহয় বাজারে। মানুষ ঝগড়া করতে আর সময় পেল না! মৃদুল চলে গেল। পূর্ণা কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দূর থেকে ইঞ্জিনের শব্দ আসছে। কোনো ট্রলার এদিকেই আসছে। গা হিম করা ঠান্ডা! পূর্ণা ব্যাগ থেকে নতুন কেনা শাল বের করে গায়ে জড়িয়ে নিল। এবার ঠান্ডা কম লাগছে!

ট্রলারের ছাদে বসে আমির সিগারেট ফুঁকছে। তার এক পা ঝুলছে। শীতের তীব্রতায় আমিরের রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তবুও উঠে গিয়ে শীতবস্ত্র ব্যবহার করছে না। সহ্য করছে। নদীর জলে চেয়ে থেকে কিছু ভাবছে। তার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। তিন-চার দিন ধরে সারাক্ষণ কপালের রগগুলো দপদপ করছে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করেছে। খুব ঝুঁকি নিয়ে এইবার তারা মেয়ে শিকার করছে। কখন কোন ভুল হয়ে যায় কে জানে! সারাক্ষণ একটা আতঙ্ক কাজ করে। আমির যে ট্রলারে বসে আছে,সে ট্রলারটি ঘাটে বাঁধা। তাদের আরো চারটা ট্রলারও পাশে আছে। আমিরের ডানপাশে একটা ইঞ্জিনের ছোট নৌকা এসে থামলো। নৌকায় রয়েছে মজিদ,খলিল সাথে আরো দুজন লোক। তাদেরকে দেখে আমির দ্রুত সিগারেট ফেলে দিল। ছাদ থেকে নামলো। মজিদকে ভক্তির সাথে সালাম দিল। মজিদ গম্ভীরস্বরে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ‘ এইখানে কী করছো?’

আমির বাধ্য ছেলের মতো বললো, ‘মেলায় এসেছি। আম্মা পাঠিয়েছেন।’

‘তাড়াতাড়ি ফিরো।’

‘জি,আব্বা।’

মজিদের সাথে থাকা দুজন লোক মজিদের সাথে বুকে বুক মিলিয়ে বললো, ‘তাইলে এহন আসি ভাই?’

মজিদ বললেন, ‘ জি,আসুন। শুক্রবার কিন্তু আসবেন।’

‘আরে,আসব,আসব। আপনি দাওয়াত করবেন আর আমরা আসতাম না?’

মজিদ হেসে বললেন, ‘সাবধানে যাবেন।’

লোক দুটি চলে যেতেই আমির ছাদে উঠে বসে আরেকটা সিগারেট ধরাল। তীক্ষ্ণ চোখে মজিদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সব চাপ কি আমার উপরেই? অন্যদের নাকে সরষে তেল দিয়ে আরাম করা হচ্ছে?’

মজিদ বললেন, ‘আরে আব্বা আমার! আমরাও তো আছি।’

খলিল বাঁকা স্বরে বললেন, ‘সারাবছর তো আমরাই এইহানে দৌড়াই। এই কয়দিনে তোর…’

খলিল পুরো কথা শেষ করতে পারলেন না। আমির বাঁধা দিয়ে খুব বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘তুই চুপ থাক। তোর ছেড়ারে বলবি,কাল বিছানা ছাড়তে। নয়তো ওর ইঞ্জিনে এমন আঘাত করব, সামনে না বিয়ে করাতে যাচ্ছো সেই বিয়ে ভেস্তে যাবে।’

‘আহ আমির! চাচাকে তুই-তুকারি করতে নিষেধ করেছি না অনেকবার? মানুষ শুনলে কী বলবে?’

‘মানুষের জন্যই ওরে চাচা ডাকি। আর তোমার জন্যই ও বেঁচে আছে। নয়তো ওর দেহ এতদিনে পঁচে মাটির সাথে মিশে যেত।’

খলিলের মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে যায়। প্রতিদিন আমিরের অপমান, দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হচ্ছে। বিন্দুমাত্র সম্মান করে না। খলিল মজিদের পাশ থেকে দূরে গিয়ে বসেন। মজিদ মুখ দিয়ে ‘চ’ কারান্ত শব্দ করে বললেন, ‘কেন যে তোরা নিজেদের মধ্যে ভেজাল করিস। এতে তো আমাদের দলই দূর্বল হয়ে যাবে।’

আমির নির্বিকার কণ্ঠে বললো, ‘কাউকে লাগবে না। আমি একাই যথেষ্ট।’

‘বললেই তো হবে না। একা চলা যায় না।’

‘আরে যাও তো।’

আমিরের মেজাজ তুঙ্গে। মজিদ সময় নিয়ে বললেন, ‘এতো রেগে আছিস কেন?’

আমির চোখ বড় বড় করে তাকালো। তার চোখ দুটি লাল। ভয়ংকর রেগে আছে সে। মজিদ আর কথা বাড়ালেন না। নৌকা ছেড়ে দেয়া হয়। চোখের পলকে দূরে হারিয়ে যায় নৌকাটি। ট্রলারের ভেতর থেকে মন্তু বেরিয়ে আসে। আমিরকে বলে, ‘ভাই,ছেড়িডারে সামলানি যায়তাছে না।’

‘যেভাবে সামলানো যায়,সেভাবে সামলা। চুলের মুঠি ধরে মা-বাপ তুলে গালি দিবি। মেয়েরা ছেলেদের মুখে নোংরা গালাগাল শুনলে দূর্বল হয়ে যায়। ভয় পায়। এ কথাটা কতবার বলব?’

মন্তু ভেতরে চলে যায়। আমির সিগারেটের ধোঁয়া শূন্যে উড়িয়ে ঘাটের উপরের ভিটায় তাকালো। একটা বোরকা পরা মেয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রখর দৃষ্টি মেয়েটিকে নিশানা করে। রাফেদ বাজার থেকে রঙ চা নিয়ে আসে। আমির রাফেদকে বললো, ‘ঘাটের মুখে মানুষ আছে?’

‘না স্যার। বাজারে এক দোকানদার আরেক দোকানদারের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে রক্তারক্তি অবস্থা। সবাই ওখানে।’

আমির চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। কেউ নেই। রাফেদকে বললো, ‘ওইযে মেয়েটিকে দেখছো? নিয়ে আসো।’

রাফেদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! এতো ঝুঁকি নিয়ে খোলা জায়গায় শিকার! সে ঢোক গিলে বললো, ‘কী বলেন স্যার! এভাবে…’

‘তো? সময় আছে হাতে? এখন ঝুঁকি নিতেই হবে। পারলে,মানুষের মাঝ থেকেও তুলে আনতে হবে। মন্তুরে নিয়ে যাও। কোনোরকম বিপদ ছাড়া মেয়েটিকে নিয়ে আসবে।’

‘স্যা.’

আমির জায়গা ছেড়ে দূরে চলে যায়। রাফেদের কথা সে শুনলো না। তার বার বার মনে হচ্ছে,পদ্মজাকে মায়া দেখিয়ে এভাবে ছেড়ে এসে সে ভুল করে ফেলেছে। কেন ভুল মনে হচ্ছে জানে না! পদ্মজা একবার খুন করেছে এছাড়া সে খুব সাহসী,বুদ্ধিমতী। সে চাইলে বুদ্ধি দিয়েও অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু কী করবে? বের হতে তো কোনোভাবেই পারবে না। মেয়েগুলোর ঘরে ঢুকতে পারবে,কথা বলতে পারবে। এর বেশি কিছু না! তবুও মনটা কু গাইছে। ভুল হয়েছে মনে হচ্ছে। সে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, ‘আমি কি কোনো বোকামি করে ফেললাম? ওদিকে সব ঠিক আছে তো!’

রাফেদ হা করে আমিরের যাওয়া দেখলো। তারপর একটা কাচের বোতল থেকে তরল কিছু ঢেলে নিল রুমালে। মন্তুকে নিয়ে ট্রলার থেকে নামলো। তাদের লক্ষ্য অপেক্ষারত কালো বোরকা পরা মেয়েটি।

৬৯

অনেক্ষণ হলো তবুও মৃদুল আসছে না। পূর্ণা বিরক্ত হয়ে নিকাব মাথার উপর তুললো। ব্যাগ থেকে টর্চ বের করলো। টর্চটির আলাদা বিশেষত্ব, এটি তিন রঙের আলো দেয়। তাই মৃদুল এটি প্রান্তের জন্য কিনেছে । পূর্ণা টর্চের সুইচে চাপ দেয় কিন্তু কাজ হয় না। সে ভ্রুযুগল কুঁচকে আরো দুইবার চাপ দিল। তাও হলো না। সুইচে আঙুল রেখে টর্চের মুখটা সে নিজের দিকে তাক করলো। মনে প্রশ্ন আসে,দোকানদার নষ্ট টর্চ দিয়ে ঠকালো নাকি?

তখনই টর্চের আলো জ্বলে উঠে। তীব্র তিন রঙের আলো ঝাঁপিয়ে পড়ে পূর্ণার চোখেমুখে। সাথে সাথে পূর্ণা চোখ বন্ধ করে ফেললো। ওদিকে আমির হাতের সিগারেট নদীর জলে ফেলে পিছনে ফিরে তাকালো। রাফেদ কী করছে দেখার জন্য! রাফেদের বদলে পূর্ণার মুখটা ভেসে উঠে। তিন রঙের আলোয় পূর্ণার মুখটা স্পষ্ট। আমিরের চোখের দৃষ্টি থমকে যায়। রাফেদ,মন্তু পূর্ণার একদম কাছাকাছি চলে গিয়েছে। আমির তাৎক্ষণিক কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। কিন্তু রাফেদ,মন্তুকে আটকাতে তো হবেই। আমির ছাদ থেকে জোরে চেঁচিয়ে ডাকলো, ‘রাফেদ।’

আমিরের কণ্ঠস্বর শুনে রাফেদ,মন্তু পিছনে তাকায়। পূর্ণাও তাকালো। সে আমিরের কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হয়েছে। মৃদুল মাত্র ঘাটে প্রবেশ করেছে। তার কানেও আমিরের গলা এসেছে। চারটি চোখ হা করে আমিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমির দ্রুত ট্রলার থেকে নেমে আসে। পূর্ণা অস্পষ্ট স্বরে ডাকলো, ‘ভাইয়া!’

আমির রাফেদের পাশ কেটে যাওয়ার সময় চাপাস্বরে বললো, ‘ট্রলারে যাও।’

তারপর পূর্ণার দিকে এগিয়ে আসলো। বললো, ‘পূর্ণা এখানে কী করছো?’

মৃদুল আমিরের পিছনে এসে দাঁড়াল। পূর্ণার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমির পিছনে তাকালো। মৃদুলকে দেখতে পেল। আমির অবাক হয়ে উচ্চারণ করলো, ‘মৃদুল?’

তারপর আবার পূর্ণার দিকে তাকালো। পূর্ণার দৃষ্টি নত। আমির দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘দুজনে একসাথে এসেছিস?’

মৃদুল মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো, ‘জি, ভাই। মেলায় আইছিলাম।’

আমির দুই পা পিছিয়ে গেল। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে পূর্ণা আর মৃদুলকে দেখলো। পূর্ণা আতঙ্কে বার বার মৃদুলের দিকে তাকাচ্ছে। মৃদুল ইশারায় তাকে ভরসা করতে বলছে। আমিরের কেন জানি হাসি পাচ্ছে। কিন্তু চোখেমুখে গাম্ভীর্য রেখে বললো, ‘একদম ঠিক করোনি পূর্ণা। এভাবে রাতের বেলা এত দূরে চলে এসেছো। আবার অজানা,অচেনা একজন ছেলের সাথে।’

আমিরের কথা শুনে মৃদুল আহত হয়। পূর্ণার বুক ধুকপুক, ধুকপুক করছে। আমির যেহেতু জেনেছে পদ্মজাও জানবে। আর তারপর কী হবে, পূর্ণা ভাবতে পারছে না। মৃদুল পূর্ণার অবস্থা বুঝতে পেরে আমিরকে বললো, ‘ ভাই,ও আসতে চায় নাই। আমি জোর করছিলাম…’

আমির মৃদুলকে বাঁধা দিয়ে বললো,’পূর্ণাকে তোর চেয়ে আমি বেশি ভালো চিনি। নিজের ইচ্ছায় এসেছে নাকি কারো কথায় সেটা বুঝতে পারছি।’

ভয়ে,লজ্জায় পূর্ণার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। আমির গাম্ভীর্যতার সাথে রাগ মিশিয়ে বললো, ‘এর একটা বিহিত করতেই হবে। নালিশ বসাব আমি।’

‘ভাই…’

‘তুই থাম মৃদুল! পূর্ণা আমার বোন। আমার বোন নিয়ে আমি কী করব সেটা আমার ব্যপার।’

আমিরের প্রতিটি কথায় পূর্ণা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে ভয়ে ভ্যাঁ,ভ্যাঁ করে কান্না করে দিল। মৃদুলের সাথে আমিরও থতমত খেয়ে গেল। পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আমি আর আসবো না ভাইয়া।’

পূর্ণার মুখের প্রতিক্রিয়া দেখে আমির সশব্দে হেসে উঠলো। পেট চেপে ধরে হাসতে থাকলো। কতদিন পর এভাবে মন খুলে হেসেছে কে জানে! আমিরের হাসি দেখে পূর্ণার কান্না থেমে যায়। মৃদুল শুধু অবাক হয়ে দেখছেই। প্রথম পূর্ণা হুট করে কান্না শুরু করে দিল,এখন আমির হুট করে পাগলের মতো হাসছে! হাসতে হাসতে আমিরের চোখে জল চলে আসে। সে অনেক কষ্টে হাসি চেপে বললো, ‘কাঁদতে হবে না। আমি কিছুই করব না। প্রেম করা যায় আর ধরা পড়লেই কাঁপাকাঁপি?’

পূর্ণা আড়চোখে মৃদুলকে দেখে মিনমিনিয়ে বললো, ‘আমাদের মধ্যে প্রেমট্রেম নেই ভাইয়া।’

আমিরের মুখটা হা হয়ে গেল। সে বিস্ময় নিয়ে বললো, ‘সেকী! কী যুগ আসলো! প্রেম,ভালোবাসা ছাড়াই ছেলেমেয়ে একসাথে রাতের বেলা মেলায় চলে এসেছে।’

মৃদুল বললো, ‘বন্ধু…বন্ধু হই।’

আমির ভ্রু উঁচিয়ে বললো, ‘তাই না? তোরা বন্ধু? আচ্ছা,হতেই পারে বন্ধুত্ব। শোন, পদ্মজা পূর্ণার বিয়ে ঠিক করেছে। মৃদুল,তুই কিন্তু পূর্ণার বিয়েতে আমার সাথে নাচবি।’

মৃদুলের চোখ দুটি সজল হয়ে উঠে। পূর্ণা চকিতে তাকাল। গুরুতর ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো, ‘ কবে? কোথায় ঠিক করেছে?’

‘সে আমি কী বলব? তোমার বোন জানে।’

পূর্ণার কান্না পাচ্ছে। সে মৃদুলকে এক নজর দেখে আমিরকে প্রশ্ন করলো, ‘তোমরা ঢাকা থেকে কবে আসছো?’

আমির প্রশ্নটা শুনে তখনই জবাব দিল না। ভাবলো,পূর্ণা বোধহয় পদ্মজার খোঁজে তাদের বাড়িতে গিয়েছিল। আর তখন বাড়ির কেউ হয়তো বলেছে ঢাকার কথা। আমির হেসে জবাব দিল, ‘বিকেলে। কাল যেও বাড়িতে। বোনের সাথে দেখা করে আসবে।’

পূর্ণা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আমির খেয়াল করলো,মৃদুল,পূর্ণা দুজনের মুখে কালো ছায়া নেমে এসেছে। তাই সে মিথ্যের পর্দা সরিয়ে বললো, ‘বিয়ে ঠিক করেনি। মজা করেছি। তারপর মেলা থেকে কী কী কেনা হয়েছে?’

আমিরের কথা শুনে মৃদুল-পূর্ণার বুকে এক পশলা বৃষ্টি নেমে আসে। বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়। পূর্ণা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো, ‘অনেক কিছু কেনা হয়েছে। সব উনি কিনে দিয়েছেন।’

‘তাই নাকি! আমি কিছু কিনে দেব না? মৃদুল,মেলা ভেঙে গেছে?’

‘না ভাই,ভেঙে যাবে।’

‘তাহলে চল,যাই।’

পূর্ণা আটকাল, ‘না ভাইয়া,আর কিছু লাগবে না। অনেক কিছু হয়ে গেছে।’

‘এসব তো বন্ধু দিয়েছে। ভাইয়ের উপহার আলাদা। নাকি এখন শুধু পূর্ণা বন্ধুর উপহারই নিবে। বাকি সব বাদ!’

আমিরের মশকরা বুঝতে পেরে পূর্ণা বললো, ‘ধুর,ভাইয়া।’

আমির হাসলো। বললো, ‘কোনো কথা না। আমরা এখন মেলায় যাব। মৃদুল তোর সাইকেলটা ওইযে ছোট ট্রলারটা ওখানে রেখে আয়। পূর্ণার হাতের ব্যাগটাও নিয়ে যা। যাওয়ার সময় ট্রলার দিয়ে চলে যাবি। রাতের বেলা হাওড়ের ক্ষেত দিয়ে না যাওয়াই ভালো। সাথে যখন পূর্ণা আছে।’

‘তুমি ফিরবে না ভাইয়া?’ বললো পূর্ণা।

আমির বললো, ‘একটু দেরি হবে। একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে। মৃদুল যা।’

মৃদুল সাইকেল আর ব্যাগ রেখে আসে। তারপর তিন জন একসাথে মেলায় প্রবেশ করে। পূর্ণার শাড়ি বেশি পছন্দ। তাই আমির শাড়ি কিনলো বেশি। একটা শাড়িতে তার চোখ আটকে যায়। কালো রঙের রেশমি সুতার শাড়িটা চোখে পড়তেই পদ্মজার মুখটা ভেসে উঠে। পদ্মজার কালো রঙ ভীষণ পছন্দের। ফর্সা,ছিমছাম আদুরে শরীরে যখন কালো রঙের শাড়ি লেপ্টে থাকে কী অপূর্বই না দেখায়! আমিরের তো মাঝে মাঝে মনে হয়,কালো রঙের সৃষ্টি হয়েছে শুধুমাত্র পদ্মজার রূপের ঝলকানি বুঝাতে! চোখের পর্দায় ভেসে উঠে পদ্মজার ঠোঁটের নিচের সূক্ষ্ম স্থির কালো তিলটা। হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। তিলটা থেকেও যেন অদ্ভুত কোনো আলো বের হচ্ছে! আমির মুচকি হেসে শাড়িটা কিনে নিল। আর কিছু কিনলো না। পদ্মজা গয়নাগাটি পছন্দ করে না। তারপর চলে এলো ঘাটে। পূর্ণা খুশিতে আটখানা। এত কিছু পেয়েছে আজ! ট্রলারে করে চলে গেল মৃদুল-পূর্ণা। সাথে গেল মন্তু। মন্তু পূর্ণাকে বাড়িতে অবধি পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে। আমির তার আগের জায়গায় এসে বসে। মৃদুল-পূর্ণার ব্যাপারটা অদ্ভুত শান্তি নিয়ে এসেছে বুকে! কত সুন্দর তাদের জীবন। কোনো জটিলতা নেই,কোনো দূরত্ব নেই!

আমিরের মস্তিষ্কে একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়, সে তো কথায় কথায় পূর্ণাকে আগামীকাল তাদের বাড়িতে যেতে বলেছে! কিন্তু পদ্মজা তো সেখানে নেই! তাছাড়া বেশ কিছুক্ষণ আগেও সে পদ্মজার ব্যাপারে চিন্তিত ছিল। একটু ওদিকে যাওয়া দরকার। আমির রাফেদকে ডেকে বললো, ‘আমি ফিরছি। মন্তু এখুনি চলে আসবে। যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল মনে রাখবে। দুজন চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করবে। চাচাও আসবে বোধহয়। একটু দেরি হলেও, আমি আসবই।’

‘জি,স্যার।’

.

পদ্মজা ভেবেছিল আরভিদ তার উপর আক্রমণ করবে। কিন্তু করেনি। পদ্মজা বিওয়ান(B1) ঘরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দরজায় তালা দেয়া। ভেতরেও কোনো সাড়াশব্দ নেই! মেয়েগুলো বেঁচে আছে তো? যে ঘরে পাচার করার উদ্দেশ্যে কতগুলো মেয়েকে বেঁধে রাখা হয়েছে সে ঘরের দরজাটা আবার খোলা। দরজার উপর লেখা বিথ্রি(B3)। পদ্মজা বিথ্রির সামনে সন্ধ্যা অবধি ঘুরঘুর করেছে। প্রবেশ করার সাহস হয়নি। তার হাত বন্দি,আবার আরভিদ সবসময় তার উপর চোখ রাখছে। কখন না ইজ্জতে হাত দিয়ে দেয়। সে ভয়ে পদ্মজা এগোয়নি। সন্ধ্যায় রিদওয়ানের সাথে দেখা হয়েছিল। সে বের হচ্ছিল। পদ্মজাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে, সে অবাক হয়েছিল। আরভিদকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী ব্যপার?’

আরভিদ বললো, ‘স্যার যা বলেছেন,তাই হচ্ছে।’

রিদওয়ান পদ্মজার দিকে চোখ রেখে বললো, ‘আমির এই মেয়ের রূপে ডুবে আছে। কবে যে ঘোর কাটবে! দেখে রেখো। কখন কী করে বসে!’

রিদওয়ান দরজা খুলতে চেষ্টা করলো। খুলল না। আরভিদ বললো, ‘ চাবি স্যারের কাছে।’

রিদওয়ানের খুব বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘ধ্যাত!’

তারপর চলে এলো বিটুতে। শরীরে অনেক ক্লান্তি। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।।ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ আগেই খাবার খেয়েছে। আজকের রাতটা এক ঘুমে কাটাতে পারলে শরীরটা প্রায় সুস্থ হয়ে যেত। রিদওয়ান অনেক ভেবেচিন্তে দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেল। তারপর শুয়ে পড়লো। বেশিক্ষণ লাগেনি ঘুমাতে। পদ্মজা রিদওয়ানকে দূর থেকে দেখেছে। কথা বলতে আসেনি। সন্ধ্যার পর হতাশ হয়ে নিজ ঘরে চলে আসে। ঘরে অনেকক্ষণ পায়চারি করে। শুয়ে থাকে। এশারের দিকে আবার বেরিয়ে আসে। ভালো লাগছে না কিছু। স্বাগতম ও ধ-রক্ত দরজার মধ্যখানে থাকা সোফায় আরভিদ ঘুমাচ্ছে! আরভিদকে ঘুমাতে দেখে পদ্মজা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। পা টিপে,টিপে সাবধানে ধ-রক্তে প্রবেশ করে। তারপর দ্রুত হেঁটে বিথ্রিতে চলে আসে। মেঝেতে পড়ে আছে অনেকগুলো মেয়ে। তাদের হাত,পা,মুখ বাঁধা। দুই-তিন জন ঘুমাচ্ছে। বাকিরা পদ্মজার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে গেল। চাপা স্বরে বললো, ‘আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না। ভয় পেও না।’

সবার সামনে একটা স্বাস্থ্যবান মেয়ে বসেছিল। পদ্মজা মেয়েটির পিছনে গিয়ে বসলো। মেয়েটির মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। পদ্মজার হাত পিছন থেকে হ্যান্ডকাপ পরানো। তাই সে কাপড়ের গিট্টুটি নিজের দাঁত দিয়ে খোলার চেষ্টা করলো। খুব দ্রুতই সে সফল হয়। প্রতিটি মেয়ে অবাক হয়ে পদ্মজাকে দেখছে। অসম্ভব সুন্দর পদ্মজার উপর থেকে তারা চোখ সরাতে পারছে না। মনে হচ্ছে,বিধাতা কোনো দূত পাঠিয়েছেন। আসার পথে গালে ব্যথা পেয়েছে! স্বাস্থ্যবান মেয়েটির মুখ মুক্ত হতেই পদ্মজাকে বললো, ‘আপনি কেলা?’

পদ্মজা ভয়ার্ত চোখে দরজার দিকে তাকালো। তারপর ফিসফিসিয়ে বললো, ‘আমি পদ্মজা। চিনবে না আমাকে। আমি তোমাদের সাহায্য করতে চাই।’

মেয়েগুলো একজন আরেকজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। পদ্মজা স্বাস্থ্যবান মেয়েটির হাতের বাধঁন খোলার জন্য তার পিছনে গিয়ে পিঠ করে বসলো। হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা করলো,পারলো না। হ্যান্ডকাপের মাঝের দূরত্ব খুব কম। পদ্মজা শুধু আঙুল নাড়াতে পারছে। তাই দাঁত দিয়ে দঁড়ির গিট্টু খোলার জন্য সে শুয়ে পড়লো। গালের ক্ষতস্থানে ঠান্ডা মেঝে লাগতেই শিরশির করে উঠে। যে দঁড়ি দিয়ে মেয়েটির হাত বাঁধা হয়েছে সে দঁড়িতে অনেক ময়লা ছিল। পদ্মজার মুখের ভেতর ময়লা প্রবেশ করে। পদ্মজার কষ্ট হয় তবুও সে থামেনি। ঠিক নয় মিনিট পর মেয়েটি হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়। খুশিতে মেয়েটির বুকে আনন্দের স্রোত বয়ে যায়। নিজের হাত দিয়ে পায়ের বাঁধন খুলে। পদ্মজা অনুরোধ স্বরে বলে, ‘এবার তুমি বাকিদের মুক্ত করো।’

মেয়েটি তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। আরো দুটো মেয়েকে বাঁধন থেকে মুক্ত করে। তারপর তিনজন মিলে বাকিদের সাহায্য করে। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। পদ্মজা সবাইকে কথা বলতে নিষেধ করেছে। সে মনে মনে প্রার্থনা করছে, কেউ যেন না আসে। আর তারা সবাই যেন বেরিয়ে যেতে পারে। আমিরের বোকামি,সে পদ্মজাকে ছেড়ে গিয়েছে। এই বোকামি আর কখনো আমির করবে না। আজ কাজে না লাগাতে পারলে সব শেষ! মেয়েগুলোর মধ্যে কেউ কেউ উত্তেজনায় কাঁপছে। পদ্মজা সবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘সামনে একজন লোক বসে আছে। সে ঘুমে আছে। যদি সজাগ হয়ে যায়, সবাই আক্রমণ করবে। ভয় পাবে না।।নিজেদের ইজ্জতের উপরে কিছু নেই। ইজ্জত রক্ষার জন্য কাউকে আঘাত করার সাহস বুকে রাখতে হয়। একদম ভয় পাবে না। লড়াই করবে। এইযে তুমি আর তুমি আমার সাথে একটু আসো। বাকিরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।’

দুটো মেয়ে পদ্মজার সাথে সাথে যায়। পদ্মজা বিফাইভে চলে আসে। বিকেলে যখন এদিকে হাঁটছিল এই ঘরের এক কোণে সে লাঠি আর পাথর দেখেছিল। মেয়ে দুজনকে বললো, ‘লাঠিগুলো নাও,আর পাথর তিনটাই নিয়ে নাও।’

তিনজন আবার বিথ্রিতে চলে আসে। পদ্মজা সবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘ কাদের সাহস বেশি? কাউকে আঘাত করার মতো সাহস কার কার আছে?’

ছয়টা মেয়ে হাত তুলে। তারা হাতে লাঠি আর পাথর তুলে নেয়। পদ্মজা বলে, ‘যখনই আক্রমণ করতে বলবো,আক্রমণ করবে। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে যেভাবে পারো আঘাত করবে। যদি তোমরা না পারো,তবে বিদেশ পাচার হয়ে যাবে। সেখানে তোমাদের অনেক খারাপ কাজ করতে হবে। যাদের হাতে অস্ত্র নেই তারা দাঁত আর নখ কাজে লাগাবে।’

মেয়েগুলো বাধ্যর মতো মাথা নাড়ায়। তারা ঘোরের মধ্যে আছে। প্রাণের মায়া চলে গিয়েছিল। পদ্মজার হঠাৎ আগমনে মনে বাঁচার আশা জেগেছে। সবাই সাবধানে বিথ্রি থেকে বেরিয়ে আসে। সামনে পদ্মজা। ধ-রক্ত দরজা পেরোবার সময় মেয়েগুলো ধাক্কাধাক্কি করে। ধাক্কা খেয়ে একটা মেয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। আর্তনাদ করে উঠে। আরভিদ চোখ খুলে সামনে এতগুলো মেয়েকে দেখে হকচকিয়ে যায়। সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না! পদ্মজা উঁচুকণ্ঠে চিৎকার করে উঠে, ‘সবাই এই লোকটাকে আক্রমণ করো।’

স্বাস্থ্যবান মেয়েটি সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাঠি দিয়ে আরভিদের পিঠে আঘাত করে। আরভিদ পড়ে যায়। সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরভিদ মেয়েগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পনেরোটা যুবতী মেয়ে তো কম কথা নয়! সে কিছুতেই পেরে উঠেনি। মার খেতে খেতে উঁবু হয়ে যায়। যাদের হাতে অস্ত্র নেই তারা লাথি দিতে থাকে অনবরত। একটা মেয়ে পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা তাকে উৎসাহ দিতে জোরে বললো, ‘লোকটার মাথায় আঘাত করো। দ্রুত করো। চাইলে সব পারা যায়। তুমি ভয় পেও না।’

মেয়েটি পদ্মজার কথামতো বড়সড় পাথরটি দিয়ে আরভিদের মাথায় আঘাত করে। আরভিদের মরণ আর্তনাদ আর মেয়েগুলির ক্রোধ মেশানো নিঃশ্বাসে চারপাশ কেঁপে উঠে। পদ্মজার সত্তা বিজয়ের আগমনে হেসে উঠে। রক্তাক্ত আরভিদ নিস্তেজ হয়ে যায়। মেয়েগুলো থামে,হাঁপাতে থাকে। পদ্মজা দরজার সামনে এসে চাবি খুঁজতে থাকে। চাবি নেই! দ্রুত আরভিদের কাছে আসে। তার প্যান্ট আর শার্টের পকেটে চাবি খুঁজে। নেই! পদ্মজার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আর এক ধাপের জন্য তারা আবার আটকে যাবে! পদ্মজা দুটো মেয়েকে নিয়ে পুরো পাতালঘর তন্ন,তন্ন করে চাবি খুঁজে। যেসব চাবি পেয়েছে একটাতেও দরজা খোলা যায়নি। মেয়েগুলোর মধ্যে যে আনন্দ এসেছিল তা হারিয়ে যায়। পদ্মজাও ভেঙে পড়ে। সে মেয়েগুলোকে আশ্বাস দেয়, ‘কিছু হবে না। আমরা পারব।’

দরজায় সবাই মিলে ধাক্কাধাক্কি করে,তাতেও কোনো ফল পাওয়া গেল না। এই দরজা কী ধাক্কা দিয়ে ভাঙার মতো! পদ্মজা বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, ‘শুনো সবাই,আমরা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকব। যখনই কেউ দরজা খুলবে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। এই লোকটার মতো অবস্থা করে সবাই পালাব। এখন যেভাবে সবাই একসাথে কাজ করেছো তখনও করবে। ঠিক আছে?’

মেয়েগুলো মাথা নাড়াল। তারা প্রস্তুত। দশ মিনিট…বিশ মিনিট…ত্রিশ মিনিট পর দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। সবার হৃদস্পন্দন থেমে যায়। পদ্মজার সবার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় আক্রমণ করতে বলে। দরজা খুলতেই সবগুলো মেয়ে হইহই করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খলিল দুই হাতে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। আমির পিছনে ছিল। সে এসে দেখে বাইরে খলিল,মজিদ দাঁড়িয়ে আছে। চাবি তাদের কাছে নেই। আমির খলিলের হাতে চাবি দেয়। খলিল দরজা খুলতেই এতগুলো মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দৃশ্যটি দেখে আমিরের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে মজিদকে বললো, ‘আব্বা সামনের দরজা বন্ধ করো।’

মজিদ সামনের দরজা বন্ধ করতে চলে যান। আমির এগিয়ে আসে। দীর্ঘদেহী,তুষ্টপুষ্ট আমির দুই হাতে মেয়েগুলোকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। দুজন মেয়ে লাঠি দিয়ে আমিরকে আঘাত করতে চায়,আমির দুই হাতে দুটো লাঠি ধরে ফেলে। লাঠিসহ মেয়ে দুটোকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। বাকি মেয়েগুলোকে চোখের পলকে চড়-থাপ্পড় দিতে শুরু করে। তার চোখ দুটি থেকে রাগ,ক্রোধ-আক্রোশ ঝরছে। একটা মেয়ে আমিরের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারে। পাথরটি আমিরের ঘাড়ে পড়ে। রিদওয়ান ঘাড়ে আঘাত করার বোধহয় তিন সপ্তাহও কাটেনি। আবার পাথরের আঘাত পেয়ে ঘাড়ের কালো আস্তরণ সরে গিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে। পদ্মজার জন্য কেনা শাড়িটা আমির গলায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। আসার পথে ট্রলারের ছাদে বসে শাড়িটা দেখছিল,শাড়ির ব্যাগ পাশে রেখেছিল। কখন যে ব্যাগটি উড়ে যায়,টের পায়নি আমির। যখন টের পেল কিছু করার ছিল না। তাই গলায় মাফলারের মতো পেঁচিয়ে রেখে দেয়। তার পদ্মবতীই তো পরবে! আমিরের রক্তে শাড়িটি ভিজে যায়। সে ঝড়ের গতিতে ঘূর্ণিপাকের মতো প্রতি মেয়েকে আঘাত করে দূর্বল করে দেয়। পদ্মজা বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। আমির তার রক্তচক্ষু দিয়ে পদ্মজার দিকে তাকায়। পদ্মজার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠে। সে কিছু বুঝে উঠার পূর্বে,আমির পদ্মজার দিকে তেড়ে আসে। শাড়িটি দিয়ে পদ্মজার গলা পেঁচিয়ে জোরে টেনে ধরে। তারপর কিড়মিড় করে বলে, ‘ছলনাময়ী!’

আমিরের নিঃশ্বাস থেকে যেন বিষ বের হচ্ছে। আজরাইলের রূপ ধারণ করেছে। পদ্মজার দুই হাত বন্দি। নিজেকে রক্ষার কোনো পথ নেই। সে ছটফট করতে থাকে। একবার আমিরের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার পূর্বেই চোখ দুটি উলটো হয়ে আসে। বুকে ব্যথা শুরু হয়। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। নিঃশ্বাস আটকে যায়। মৃত্যু তার খুব কাছে। আর একটু সময়…পদ্মজা কালিমা পড়ার চেষ্টা করে। মৃত্যুর আগে সে কালিমা পড়ে যেতে চায়। অস্ফুটভাবে তার মুখে ‘ইল্লাল্লাহু’ উচ্চারণ হয়। আমিরের কানে শব্দটি আসতেই তার হাত দুটি কেঁপে উঠে। ছেড়ে দেয় পদ্মজার গলা। পদ্মজা লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। চোখ আধবোজা! ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। হাঁপড়ের মতো বুক ওঠানামা করছে। কষ্টে পুরো শরীর মুচড়ে যাচ্ছে! গলা নীল হয়ে গেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *