৬০
ঘুম ভাঙতেই পদ্মজা হকচকিয়ে যায়। চোখের সামনে সব কালো। কালো রঙ ব্যাতীত কিছু নেই। ঘোর অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। পদ্মজা চোখ কচলে আবার তাকায়। না,কিছুই পরিবর্তন হয়নি! সবকিছু কালো। বিকেলে সে বৈঠকখানার সোফায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। তারপর নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঘুম ভাঙতেই দেখছে সব অন্ধকার! পদ্মজা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় দেয়ালের সুইচ। তখন সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে একটা আলো। আলোয় ভেসে উঠে আমিরের মুখ। পদ্মজা দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আমির পদ্মজার চেয়ে দুই হাত দূরে এসে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি আবেগপ্রবণ। পদ্মজার হৃদস্পন্দন থমকে যায়। কাচুমাচু হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি সব বাতি নিভিয়েছেন?’
আমির জবাব না দিয়ে হাতে থাকা সুন্দর কাচের হারিকেনটি পাশে রাখল। তারপরই পদ্মজা কিছু বুঝে উঠার আগে পদ্মজাকে কোলে তুলে নিল। পদ্মজা আমতাআমতা করে শুধু বলতে পারল, ‘এ…এ…ই কি…কি?’
আমির তাদের নিজস্ব ঘরে নিয়ে আসে পদ্মজাকে। পদ্মজা ঘর দেখে অবাক হয়। ঘরের চারিদিকে অদ্ভুত সুন্দর কাচের ছোট হারিকেন। আর মাঝে এক ঝুড়ি পদ্মফুল! সময়টা শরৎকাল। দিনের বেলা শরতের সাদা মেঘ নীল আকাশে পাল তুলে, ছবির মতো ঝকঝকে সুন্দর করে তুলে আকাশ। কমে এসেছে যখন তখন বৃষ্টির জ্বালাতন। সময় বিল ঝিল ঝাপিয়ে শাপলা আর পদ্ম ফোটার। এতো পদ্ম ফুল দেখে মনে হচ্ছে বড় এক বিলের সব পদ্ম ফুল তুলে নিয়ে এসেছে আমির। পদ্মজা প্রশ্ন করার পূর্বে আমির পিছন থেকে দুই হাতে পদ্মজার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মনে আছে,প্রথম রাতে বলেছিলাম একদিন পদ্ম ফুল দিয়ে আমার পদ্মাবতীকে সাজাব! সময়টা নিয়ে এসেছি। দেখো তাকিয়ে।’
পদ্মজা ঝুড়ি ভর্তি পদ্ম ফুলগুলোর দিকে তাকায়। তার চোখ দুটি জলে ছলছল করে উঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমিরের দিকে চেয়ে আবেগমাখা কণ্ঠে বলল, ‘সে কথাটাও মনে রেখেছেন!’
উত্তরে আমির হেসেছিল। প্রথম রাতের চেয়ে কোনো অংশে কম সুন্দর ছিল না সেই রাত। পদ্মজা সেজেছিল পদ্ম ফুল দিয়ে। স্বামী যত্ন করে সাজিয়েছিল। সময়টাকে আরো সুন্দর করে তুলতে প্রকৃতি দিয়েছিল মৃদু শীতল বাতাস।
জানালা দিয়ে প্রবেশ করা বাতাসের দাপটে পদ্মজার ঘুম ছুটে যায়। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। হাত বাড়িয়ে আমিরকে খোঁজে। নেই,বিছানা খালি! আবার সে পুরনো দিনের আরেকটি সুন্দর মুহূর্ত স্বপ্নে দেখেছে। তার চোখ দুটি জলে ভরে উঠে। আজ পাঁচ দিন আমির নেই। তার কাছে তার স্বামী নেই। কোনো এক অজানা জায়গায় বন্দি হয়ে আছে। পদ্মজা এক হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। বালিশের উপর থাকা আমিরের শার্টটা হাতে নিয়ে চুমু খেল। তার চোখ দুটি আবার ভিজে উঠে। সেদিন রিদওয়ান, খলিল,মজিদ দ্বারা আহত হওয়ার পর তাকে ওখান থেকে কে এনেছে সে জানে না। চোখ খুলে ফরিনাকে দেখেছিল। তিনি ডুকরে কাঁদছেন আর চোখের জল মুছছেন। লতিফাকে জিজ্ঞাসা করে পদ্মজা জানতে পারে,সময়টা দুপুর । সর্বাঙ্গে তখন বিষধর ব্যথা। উঠার শক্তিটুকু নেই। গলায় ব্যথা একটু বেশি ছিল। প্রথমে তার মাথায় আসে আমিরের কথা। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই বুঝে যায়,এভাবে সে এদের সাথে পারবে না। তাকে তার মায়ের মতো শান্ত হতে হবে। সময়-সুযোগ বুঝে কাজ করতে হবে। ফরিনা আদর করে খাইয়ে দেন। তিনি পদ্মজার উপর করা নির্মম অত্যাচার আটকাতে পারেননি বলে
বারবার ক্ষমাও চেয়েছেন। তিনি নাকি চেষ্টা করেছিলেন। কীরকম চেষ্টা করেছেন সেটা বলেননি। পদ্মজা জিজ্ঞাসাও করেনি। এরপর পদ্মজা কাঁপা হাতে পূর্ণাকে চিঠি লিখে,ফরিনার হাতে দেয়। তিনি যেন মগাকে দিয়ে দেন।
তারপরের দিনগুলো চুপচাপ কাটিয়ে দেয় পদ্মজা। আমিরের শোকে ভেতরে ভেতরে ঝড় বইলেও সামনে সে নিশ্চুপ থেকেছে। সুস্থ হওয়াটা আসল। নয়তো কাজের কাজ কিছুই হবে না। উল্টো নর্দমার কীটগুলোর হাতে মরতে হবে। আমিরের জন্য দোয়ায় দুই হাত তুলে অঝোরে কেঁদেছে,যেন আমির ভালো থাকে। আর তার কাছে ফিরে আসে। খুব মনে পড়ে মানুষটাকে! হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে পদ্মজার। পদ্মজা আমিরের শার্ট বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ফরিনা এসে দাঁড়ান দরজার সামনে। কেউ একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল হতেই,পদ্মজা হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছে তাকাল। ফরিনা ঘরে প্রবেশ করেন। গায়ে সাদা-খয়েরি মিশ্রণের শাল। পদ্মজা আমিরের শার্ট বালিশের উপর রেখে বলল, ‘আছরের আযান পড়েছে আম্মা?’
মৃদুল অন্দরমহলের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। তাকে মদন কিছুতেই অন্দরমহলে ঢুকতে দিচ্ছে না। গত চারদিন ধরে সে চেষ্টা করছে অন্দরমহলে ঢোকার। গত তিন দিন ভুড়িওয়ালা একজন ঢুকতে দিত না। এখন দিচ্ছে না মদন। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে সে মৃদুলের সাথে তর্ক করছে। মৃদুল বলছে, ‘দুলাভাই ঢুকতে দেন কইতাছি। সমস্যাটা কিতা ঢুকলে? সেটাই তো বুঝতাছি না।’
‘দেহো মৃদুল মিয়া এইডা আমার কথা না। মজিদ চাচার কথা। উনি কইছে বাড়ির ভিতরে নতুন কেউরে ঢুকতে না দিতে।’
‘আমি তো আত্মীয় নাকি? আমার সাথে এমন করা হইতাছে কেন? আগে তো ঠিকই ঢুকতে দিত। এহন দেয় না কেন?’
‘হেইডা তো আমি জানি না।’
‘সরেন কইতাছি। নইলে ওইযে গাছের মোড়াডা ওইডা দিয়ে আবার মাথাডা ফাডায়া দিব। একবার মারছে আপাই এহন আমি মারাম।’
‘হেইডাই করো,তবুও আমি চাচার কথা অমান্য করতে পারতাম না।’
‘আমার কিন্তু কইলাম, রাগ উঠতাছে। মাটির তলায় গাইরালামু।’
‘মিয়া ভাই তুমি আমারে যা ইচ্ছা কইরালাও। আমি-
মৃদুলের মাথা বরাবরই চড়া! হুট করে খুন করার মতো রাগ চেপে যায় মাথায়। সে মদনের গলা চেপে ধরে। মদন কাশতে থাকল। আলো কান্না শুরু করে। আলোর কান্না শুনে খলিল বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। সদর দরজার সামনে এমন দৃশ্য দেখে তিনি দৌড়ে আসেন। মৃদুলকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেন। হুংকার ছাড়েন, ‘তোমার এতো সাহস কেমনে হইছে? আমার জামাইয়ের গলা চাইপা ধরো!’
মৃদুলের নাক লাল হয়ে গেছে রাগে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। রাগী মেজাজ নিয়েই দুই হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল, ‘ আপনার জামাই আমারে ভেতরে ঢুকতে দেয় না।’
‘তুমি মেহমান মানুষ, আলগ ঘরে থাকবা। এইহানে কী দরকার?’
‘এই নিয়ম কবে করছেন আপনেরা? আগের বার যখন ছিলাম তহন তো ঠিকই ঢুকতে দিছেন।’
‘এহন আর ঢুহন যাইব না। এইডা অন্দরমহল। বাড়ির বউ-ছেড়িদের জায়গা।’
‘সত্যি কইরা কন তো,বাড়ির ভিতর কী চলে?’
খলিলের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে,অসভ্য ছেলেটার কানের নিচে কয়টা দিয়ে দিতে। তিনি কটাক্ষ করে মৃদুলকে বললেন, ‘নিজের বাড়ি রাইখা এইহানে পইড়া রইছো কেন? মাইনষের অন্ন নষ্ট করতাছো। নিজের বাড়িত যাও।’
অপমানে মৃদুল বাকহীন হয়ে পড়ে! সে ক্ষণকাল কথা বলতে পারে না। তার আপন ফুফা এমন কথা বললো! ক্ষণমুহূর্ত পর সে জ্বলে উঠে বলল, ‘আপনের বাড়ির উপর থুথু মারি। আমি ব্যাঠা মিয়া বংশের ছেড়া। শত বিঘার মালিক আমি একাই। আপনের অন্নের ঠেকা পড়ে নাই আমার। আমার বাড়িত কামলাই আছে দশ-বারো জন। আমি কাইলই চইলা যাইয়াম বাড়িত।’
মৃদুলের আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। সে ঘুরে দাঁড়ায়। কাছেই একটা বিরাট পাতিল ছিল। কোনো কাজে হয়তো বের করা হয়েছে। সে পাতিলে জোরে লাথি মেরে হনহন করে চলে যায়। পূর্ণা তার বোনের খবর নিয়ে দিতে বলেছে বলেই,সে বার বার অন্দরমহলে ঢোকার চেষ্টা করেছে। নয়তো মৃদুলকে কেউ একবার কোনো ব্যপারে না করলে,সে দ্বিতীবারের মতো সেখানে ফিরেও তাকায় না।
পদ্মজার কথার জবাব দিলেন না ফরিনা। তিনি পদ্মজার পাশে গিয়ে বসলেন। পিছনে রিনু আসে। হাতে খাবারের প্লেট। তিনবেলা ফরিনাই খাইয়ে দিচ্ছেন। যত্ন নিচ্ছেন পদ্মজার। মায়ের চেয়ে কোনো অংশে কম করছেন না। তবুও এই মানুষটা কোন কারণে সেদিন তার চিৎকার শুনেও বাঁচাতে যায়নি? ফরিনা প্লেট হাতে নিতেই পদ্মজা বলল, ‘আমি এখন মোটামুটি ভালোই আছি আম্মা। আমি খেয়ে নিতে পারবো। হাঁটতেও তো পারি।’
পদ্মজার এক কথায় খাবারের প্লেট পদ্মজার হাতে তুলে দিলেন ফরিনা। আর রিনুকে চলে যেতে বললেন। পদ্মজা চুপচাপ খেয়ে নেয়। তার খেতে ইচ্ছে করে না একদমই। কিন্তু সামনের যুদ্ধটার জন্য তার খেতেই হবে। তাকে সুস্থ থাকতে হবে। সুস্থতা ছাড়া যুদ্ধে সফল হওয়া সম্ভব নয়। যতক্ষণ পদ্মজা খেল,ততক্ষণ ফরিনা পাশে বসে থাকলেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পর পদ্মজা ফরিনাকে বলল, ‘আব্বাকে খুব ভয় পান আম্মা?’
ফরিনা স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলেন, ‘সব বউরাই স্বামীরে ডরায়।’
‘না,আপনি একটু বেশি ভয় পান। যমের মতো।’
‘কবিরাজের দেওয়া ঔষধডি খাও এহন।’
‘আপনি কথা এড়াচ্ছেন আম্মা। আচ্ছা,ঔষধ দেন আগে।’
ফরিনা আলমারি খুলে ঔষধ বের করলেন। তারপর এগিয়ে দিলেন পদ্মজার কাছে। পদ্মজা ঔষধ খেয়ে বলল, ‘কবিরাজ আনার অনুমতি ওরা দিয়েছিল ভেবে আমি অবাক হয়েছি আম্মা! ওরা কেন চায়? আমি সুস্থ থাকি?’
ফরিনা কিছু বললেন না। পদ্মজা ফরিনার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মানুষটার আয়ু কী শেষের পথে? কেমন যেন মৃত, মৃত ছাপ মুখে। চোখ বুজলে মনে হবে,অনেক দিনের উপোষ করে মারা গিয়েছেন। পদ্মজার মায়া হয় মানুষটার জন্য। কোন দুঃখে তিনি ধুঁকে,ধুঁকে মরছেন! পদ্মজা বিছানা থেকে নেমে এসে ফরিনার সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘আম্মা, আপনি আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে একটা আবদার রাখবেন?’
‘তুমি তো আমার ছেড়িই।’
‘তাহলে আবদার রাখবেন?’
‘রাখাম।’ ফরিনার শুষ্ক চোখ। অথচ গলা ভেজা মনে হলো!
পদ্মজা বলল, ‘তাহলে আপনার সব গোপন কথা আমাকে বলুন। যা ভেবে ভেবে আপনি কষ্ট পান।’
ফরিনা দুই হাতে পদ্মজার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু খান। এক ফোঁটা চোখের জল পড়ে পদ্মজার হাতে। মমতাময়ী স্পর্শ! পদ্মজার শরীরের
লোম খাড়া হয়ে যায়। ফরিনা বললেন, ‘তার আগে কও আমি সব কওয়ার পর তোমারে যা করতে কইয়াম তাই করবা তুমি।’
পদ্মজা অপলক নয়নে ফরিনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি করতে বলবেন তিনি? যদি সে সেটা করতে না পারে! সম্ভব না হয়! পদ্মজা বলল, ‘আপনি যা বলবেন আমাকে তার সাথে যদি যা করতে বলাটা মানানসই হয়,যুক্তিগত হয়। আমি তাই করব আম্মা।’
ফরিনা চোখের জল মুছেন। তারপর বললেন, ‘আমি বাবুর বাপরে দেইখা আইতাছি। তুমি শুইয়া থাকো।’
কথা শেষ করেই ফরিনা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যান। পদ্মজার মাঝে উত্তেজনা কাজ করছে। সে জানে না সে কী শুনতে চলেছে,তবে সেটা কোনো সাধারণ ঘটনা বা কথা হবে না এটা নিশ্চিত। সে ঘরে পায়চারি করতে করতে জানালার ধারে আসে। দেখতে পায় রিদওয়ানকে। হাতে একটা পলিথিন নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে। এই জঙ্গলের মাঝেই তো আছে তালাবন্ধ রহস্যজাল। যার চাবি বোধহয় তার কাছে আছে। আলমগীরের দেয়া চাবিটাকে পদ্মজার কোনো তালাবন্ধ রহস্যজালের চাবি মনে হয়! রিদওয়ান গত দিনগুলোতে তিন-চার বার তাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু কিছু বলেনি। রিদওয়ানের মতিগতি বোঝা যায় না। অদ্ভুত সে। রিদওয়ানকে দেখলে পদ্মজার শরীর রাগে কাঁপে।
বেশ কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ আসে কানে। শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে পুরুষের পায়ের শব্দ। পদ্মজা দ্রুত এসে বিছানার এক কোণে বসে। যে কোণে ছুরি রাখা আছে। ঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান। পদ্মজাকে দেখেই লম্বা করে হেসে বলল, ‘তারপর বলো কেমন আছো?’
পদ্মজার থেকে জবাব না পেয়ে রিদওয়ান আবার প্রশ্ন করল, ‘সুস্থ আছো তো?’
পদ্মজা সাড়া দিল না। রিদওয়ান চেয়ার টেনে বসল। বলল, ‘তোমাকে এত চুপচাপ দেখে অবাক হচ্ছি। কী পরিকল্পনা করছো বলোতো?’
পদ্মজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। বলল, ‘কাপুরুষ বোধহয় আপনার মতো মানুষকেই বলা হয়।’
রিদওয়ানের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তারপর হুট করেই হেসে দিল। বলল, ‘ কাপুরুষের কী করেছি?’
‘স্বামীর অবর্তমানে তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। আবার সেই স্ত্রী অসুস্থ ছিল। এমন তো কাপুরুষরাই করে।’
‘এতো কথা না বলে চুপচাপ যা বলি শুনো। আমির আমাদের ব্যপারে অনেক নাক গলিয়েছে। অনেক সমস্যা করেছে। তবুও আমরা আমিরকে এক শর্তে ফিরিয়ে দেব। যদি তুমি সেই শর্ত মানো।’
‘কী শর্ত?’
‘তুমি আমিরকে নিয়ে ঢাকা চলে যাবে। কখনো অলন্দপুরে ফিরবে না।’
‘যদি না মানি?’
‘অবুঝের মতো প্রশ্ন করতে বলিনি। শর্ত দিয়েছি,মানা না মানা তোমার ব্যপার।’
‘আপনারা আমাকে ভয় পাচ্ছেন কেন?’
রিদওয়ান হাসল। পদ্মজা বলল, ‘সেদিন মেরে আধমরা করেছেন। এবার একদম মেরে দিন। তাহলেই আপনাদের সমস্যা শেষ। বেহুদা, আমাদের মুক্তি দিয়ে ভেজাল কেন বাড়াচ্ছেন? ঢাকা ফিরে গিয়ে পুলিশ নিয়েও তো আসতে পারি।’
রিদওয়ান বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক উচ্চারণ করল। বলল, ‘তোমাকে মারা যাবে না।’
‘আমাকে দিয়ে আপনাদের কী কাজ হবে যে মারা যাবে না?’
‘এতো প্রশ্ন কেন করছো?’
‘মনে আসছে তাই।’
রিদওয়ান রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে, ‘তুমি শর্তে রাজি নাকি না?’
‘আগে বলুন,কার কাজে আমি লাগব? কার খাতিরে আমাকে মারা যাবে না?’
‘তুমি শর্তে রাজি নাকি সেটা বলো। এইযে আমার পাঞ্জাবিতে তাজা লাল দাগটা দেখছো এটা কিন্তু রক্তের। আর রক্তটা আমিরের।’
পদ্মজার চোখ দুটি জ্বলে উঠে। এমনিতেই এই হিংস্র মানুষটার হাসি,কথা তার গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তার উপর তার স্বামীর রক্ত দেখাচ্ছে রিদওয়ান। পদ্মজা উঁচু গলায় প্রশ্ন করল, ‘উনাকে জঙ্গলেই রেখেছেন তাই না?’
‘শর্তে রাজি তুমি?’
‘না।’
‘তোমাকে তো আমি-
রিদওয়ান রেগে তেড়ে আসে। পদ্মজা পাশের টেবিল থেকে ঔষধের কাচের বোতলটা নিয়ে রিদওয়ানের মাথায় আঘাত করে। রিদওয়ান আকস্মিক আক্রমণে বিছানায় পড়ে যায়। পদ্মজা দ্রুততার সাথে ছুরি হাতে নেয়। রিদওয়ান বিছানায় পড়ার দুই সেকেন্ডের মধ্যে তার পিঠে ছুরি দিয়ে হেঁচকা টান মারে। রিদওয়ান আর্তনাদ করে উঠল। পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ছুরির আঘাত শরীরের মাংস অবধি চলে গিয়েছে। সুযোগ পদ্মজার হাতের মুঠোয়। সে এই সুযোগ হারাবে না। এতদিন সে এদের মানুষ ভেবে এসেছে। অথচ,এরা মানুষরূপী শয়তান। আর শয়তানকে বুঝেশুনে নয়, ইচ্ছামত আঘাত করা উচিত। পদ্মজা দ্রুত কাঠের চেয়ার তুলে নেয় হাতে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে বারি মারে রিদওয়ানের মাথায়। রিদওয়ানের কানের পাশ দিয়ে রক্তের ধারা নামে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার শরীর। পদ্মজা হিংস্র বাঘিনীর মতো হাঁপাতে থাকে। মিনিট দুয়েক পর শাড়ির আঁচল মেঝে থেকে তুলে বুকে জরিয়ে নেয়। হুট করেই যেন শান্ত সমুদ্র গর্জন তুলে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে চারপাশ।
৬১
ফরিনা পদ্মজার ঘরে প্রবেশ করে ঘাবড়ে গেলেন। বিছানায় রক্তাক্ত দীর্ঘদেহী একজন পুরুষ সংজ্ঞাহারা হয়ে পড়ে আছে। নাকি মরে গেছে? ফরিনা শিউরে উঠেন। পদ্মজা ফরিনাকে এক নজর দেখে জগ থেকে গ্লাসে জল নিয়ে ঢকঢক করে পান করল। ফরিনার মনে হচ্ছে বিছানায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত পুরুষ মানুষটি রিদওয়ান! যখন শতভাগ নিশ্চিত হলেন এটা রিদওয়ান, মনে তীব্র একটা ভয় জেঁকে বসে। তিনি নিঃশ্বাস আটকে পদ্মজার কাছে ছুটে আসেন। চাপা স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘রিদু কি মইরা গেছে?’
পদ্মজা তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারলো না। সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে বলল, ‘মরেনি বোধহয়। তবে বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে মরে যাবে।’
পদ্মজার তরঙ্গহীন গলার স্বর ফরিনার ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। তিনি পদ্মজাকে আচমকা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। পদ্মজা থতমত খেয়ে গেল। ফরিনার হৃৎপিণ্ডের কাঁপুনি টের পায় সে। ফরিনা অস্থির হয়ে বললেন, ‘ও মা-
পদ্মজা ফরিনার বুক থেকে মাথা তুলে বলল, ‘কী হয়েছে আম্মা?’
ফরিনার চোখের দৃষ্টি অস্থির। তিনি ঢোক গিলে বললেন, ‘তুমি পলাইয়া যাও। আর আইবা না। রুম্পার মতো চইলা যাও।’
‘আম্মা,ওরা আমাকে মারবে না। রিদওয়ান ভাইয়াই বলেছে।’
‘মিছা কথা…মিছা কথা কইছে।’
‘আম্মা,আপনি এমন করছেন কেন?’
ফরিনা দ্রুত সংজ্ঞাহীন রিদওয়ানকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি পলায়া যাও। তোমার আব্বা,ওই শকুনের বাইচ্ছা আমার নিষ্পাপ কলিজার টুকরা বাবুরে মাইরা ফেলছে কিন্তু…’
জুতার ছপছপ আওয়াজ শুনে ফরিনা থমকে যান। এরকম আওয়াজ মজিদের জুতোয় হয়। মনে হয় জুতায় পানি নিয়ে হাঁটছে। তিনি আতঙ্কে চোখ দুটি বড় বড় করে তাকালেন। মজিদ তো ঘরে ছিল না! কখন চলে এলো? আর যতক্ষণ মজিদ ঘরে থাকে ততক্ষণ ফরিনাকেও ঘরে থাকতে হয়। তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত মজিদ এখন পদ্মজার ঘরে আসবে। আর রিদওয়ানকে দেখে ফেলবে! তিনি পদ্মজার আলমারি খুলে তালা-চাবি বের করলেন। একটা ঝড় থামতেই যেন আরেকটা ঝড় শুরু হয়েছে। পদ্মজা ফরিনাকে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আম্মা,কিন্তু কী? বাবু মানে উনাকে মেরে ফেলেছে মানে? আপনি কীভাবে জানেন? আম্মা…’
ফরিনা নিজের এক হাতে পদ্মজার এক হাত শক্ত করে চেপে ধরেন। তারপর দৌড়ে বেরিয়ে যান ঘর থেকে। বারান্দায় পা রাখতেই মজিদের সাথে দেখা হয়। ফরিনা মজিদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে পদ্মজাকে টেনে নিয়ে যান তিন তলায়। মজিদ হতভম্ব হয়ে দেখলেন ঘটনাটা। পদ্মজা বার বার জিজ্ঞাসা করছে ফরিনাকে, ‘আম্মা,আপনি এটা কী বললেন! আমার বুক কাঁপছে। আম্মা কোথায় যাচ্ছেন?’
মজিদ পদ্মজার ঘরে উঁকি দিলেন। তার তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি। বিছানার উপর রিদওয়ানকে দেখতে না পেলেও,রিদওয়ানের পা জোড়া চোখে পড়ে যায়। তিনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। চাদর সরিয়ে রিদওয়ানকে দেখে আঁৎকে উঠলেন। এদিকে,ফরিনা পদ্মজাকে ঠেলে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেন। ঘরের দরজাটি লোহার। পদ্মজা ধাক্কা খেয়ে ঘরের মধ্যিখানে পড়ে। সে মেঝে থেকে উঠতে উঠতে ফরিনা বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। পদ্মজা আচমকার ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। তার মাথায় বার বার বাজছে,তোমার আব্বা,ওই শকুনের বাইচ্ছা আমার নিষ্পাপ কইলজার টুকরা বাবুরে মাইরা ফেলছে!’
পদ্মজা দুই হাতে মুখ চেপে ধরে। মনে হচ্ছে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখুনি মারা যাবে। বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ফরিনা বলেছিলেন,সম্পত্তির জন্য হলেও আমিরকে ওরা জানে মারবে না! এজন্যই পদ্মজা ধৈর্য ধরে পাঁচটি দিন কাটাতে পেরেছে। ভেবেছিল, শরীরে একটু শক্তি জমিয়ে তারপর সে তার স্বামীকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু একটু আগে ফরিনা যা বললেন তাতে পদ্মজার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। রিদওয়ান শর্ত দিয়েছিল, পদ্মজা ঢাকা চলে গেলে আমিরকে ছেড়ে দিবে। পদ্মজা তাই মানতো। শুধু না করে আরেকটু কথা বের করতে চেয়েছিল সে। তার আগেই রিদওয়ান আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। আর পদ্মজাও আঘাত করে বসে। পাঁচ দিনের সব ধৈর্য, পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে গেল ফরিনার এক কথায়। পদ্মজা দরজায় থাপ্পড় দিয়ে ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা কেন আটকালেন আমাকে? দরজা খুলুন। আম্মা আপনার ছেলের কী হয়েছে? কী বললেন? আম্মা…’
ফরিনা হাতের চাবিটা দূরে ছুঁড়ে ফেললেন। সিঁড়িতে শব্দ হচ্ছে দপদপ! তিনি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখেন,অস্বাভাবিকভাবে হাত কাঁপছে। কাঁপছে পা। মজিদ,খলিল একসাথে উঠে আসে। ফরিনার সামনে এসে দাঁড়ায়। ফরিনা ভয়ে জমে গেছেন। মজিদের চেহারা ক্ষুদ্ধ। তিনি রাগে গজগজ করতে করতে প্রশ্ন করলেন, ‘রিদওয়ানকে পদ্মজা আঘাত করেছে?’
ফরিনা কিছু বললেন না। মজিদের গলার স্বর শুনে পদ্মজা চুপ হয়ে যায়। ফরিনা এলোমেলো দৃষ্টি নিয়ে কাঁপছেন। খলিল বললেন, ‘ভাবিরে জিগাও কেন? ওই ছেড়ি ছাড়া আর কার এতো সাহস আছে? এই ছেড়ি এই ঘরের ভিতরে?’
ফরিনা দরজার সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছেন। খলিলের প্রশ্ন শুনে আরো শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। মজিদ ফরিনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন। দরজায় তালা! তখনই পদ্মজা দরজায় থাপ্পড় দিয়ে ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা দরজা খুলুন। কী হচ্ছে ওখানে?’
মজিদের ক্ষুদ্ধ চেহারা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে। তিনি ফরিনার কাছে চাবি চাইলেন, ‘চাবি দাও। কি বলছি,কানে যায় না? চাবি দাও।’
ফরিনা আমতাআমতা করে বললেন, ‘ন…না-ই।’
মজিদ ফরিনার মুখ চেপে ধরেন। তারপর চাপা স্বরে বললেন, ‘চাবি দাও।’
ফরিনা তাও বললেন,চাবি নেই। মজিদ আরো একবার বললেন, ‘চাবি দাও বলছি। শাড়ির কোন ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছো?’
‘চাবি নাই। চাবি নাই আমার কাছে।’ গলা উঁচিয়ে বললেন ফরিনা।
খলিল দরজায় জোরে কয়টা লাথি দিলেন। তালা ভাঙার চেষ্টা করলেন। দুপদাপ শব্দ! সেই সাথে পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে নোংরা গালি। খলিলের মুখের ভাষা শুনে পদ্মজার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে যায়। ফরিনার উঁচুবাক্য শুনে মজিদ হাওলাদার রাগে কাঁপতে থাকলেন। ফরিনার এতো সাহস কবে হলো! তিনি ফরিনার শরীর হাতড়ে চাবি খুঁজতে খুঁজতে বললেন, ‘চাবি কোথায় রাখছো? জলদি বলো। নয়তো এরপর যা হবে,ভালো হবে না।’
ফরিনার শরীর কাঁপছে ভয়ে। তিনি জানেন,এই মুহূর্তে তিনি খুন হয়ে যেতেও পারেন। তবুও চাবি দিবেন না। নয়তো ওরা পদ্মজাকে খুন করে ফেলবে। ওরা পারে না এমন কিছু নেই! মজিদের নিকৃষ্ট অনেক কাজের সাক্ষী তিনি। এই মানুষটা তার জীবনের জাহান্নাম। মজিদ রাগে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ফরিনা কিছুতেই কথা মানছে না বলে, ছোট ভাইয়ের সামনে ফরিনার শাড়ি টেনে খুলে ফেললেন তিনি। আর বললেন, ‘চাবি কোন চিপায় রাখছো? বলো,নয়তো মেরে পুঁতে ফেলবো।’
ফরিনা টু শব্দও করলেন না। খলিলের সামনে যুবতীকালে তাকে বিবস্ত্র করেও মজিদ মেরেছে! সম্মান-ইজ্জত কবেই হারিয়ে গেছে। নতুন করে হারানোর কিছু নেই। বয়সও অনেক হয়েছে! তবে এদের শিকার পদ্মজাকে হতে দিবেন না কিছুতেই। মজিদ কোনোভাবেই ফরিনার কাছ থেকে চাবি উদ্ধার করতে পারেননি। এদিকে রিদওয়ানের অবস্থা খারাপের দিকে। খলিল দ্রুত নিচে চলে গেলেন। মজিদ ফরিনাকে মেঝেতে ফেলে ইচ্ছেমত লাথি,থাপ্পড় দেন,সাথে বিশ্রি গালিগালাজ। চারপাশ ফরিনার কান্নায় ভারী হয়ে উঠে। ফরিনার কান্নার স্বর পদ্মজার কানে আসতেই সে চিৎকার করে বলল, ‘আব্বা,আম্মাকে মারবেন না। আব্বা…দোহাই লাগে। আম্মা লাশের মতো হয়ে গেছে। আব্বা,আম্মাকে মারবেন না। আমাকে মারেন। আব্বা। আম্মা আপনি দরজা খুলুন। আম্মাকে এভাবে কেন মারছেন আব্বা ? আপনি তো অলন্দপুরের ফেরেশতা ছিলেন আব্বা। আপনার এমন রূপ কেন? আম্মা দরজা খুলুন। আব্বা,আম্মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। অনুরোধ করছি,আর মারবেন না।’
বাইরে ফরিনার কান্না,ঘরের ভেতর পদ্মজার কান্না। আর দরজায় এলোপাথাড়ি থাপ্পড়ের আওয়াজ। সব মিলিয়ে চারপাশ যেন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। খলিলের ডাক শুনে মজিদ চলে গেলেন। কিন্তু যাওয়ার পূর্বে ফরিনার পেটে বড় একটা লাথি বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফরিনার মুখ দিয়ে বমি বেরিয়ে আসে। মজিদ চলে যাওয়ার মিনিট দুয়েক পর লতিফা দৌড়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় সে দুইবার হোঁচট খেল। তারপর ফরিনার মাথা নিজের কোলে নিয়ে কেঁদে বলল, ‘খালাম্মা আপনি কেন খালুর বিরুদ্ধে গেলেন। ও খালাম্মা কথা কন। খালাম্মা?’
লতিফার ব্যকুল কণ্ঠস্বর শুনে পদ্মজা আরো জোরে থাপ্পড় দিল দরজায়। বলল, ‘লুতু বুবু আম্মার কী হয়েছে? লুতু বুবু দরজা খুলো। ও লুতু বুবু।’
ফরিনা অস্পষ্ট স্বরে লতিফাকে বললেন, ‘তোর খালু চইলা গেছে?’
‘হ,গেছে।’
‘বাড়ি থেইকা বাইর হইছে?’ ফরিনার কণ্ঠ নিভে আসছে।
লতিফা ফরিনার মাথাটা সাবধানে মেঝেতে রেখে বারান্দা থেকে বাইরে উঁকি দিল। মজিদ,খলিল,মদন আর বাড়ির দারোয়ান মিলে গরু গাড়ি দিয়ে রিদওয়ানকে নিয়ে যাচ্ছে। গেইটের কাছাকাছি চলে গেছে। সে ফরিনাকে এসে বলল, ‘বাইর হইয়া গেছে খাল্লাম্মা।’
পদ্মজা দরজায় এলোপাথাড়ি থাপ্পড় দিচ্ছে। বিকট শব্দ হচ্ছে! ফরিনা আঙ্গুলের ইশারায় ডান দিকটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওইহানে খুঁইজা দেখ,চাবি পাবি একটা। দরজাডা খুইলা দে।’
লতিফা ফরিনার কথামতো চাবি খুঁজল। পেয়েও গেল। তারপর দরজা খুলতেই পদ্মজা হুড়মুড়িয়ে বের হয়। ফরিনাকে দেখে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। গায়ে শাড়ি নেই। পেটিকোট হাঁটু অবধি তোলা। মিষ্টি রঙের ব্লাউজে রক্তের দাগ। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। দুই চোখ ফুলে গেছে। হাতে,পায়ে জখম। বয়স্ক মানুষটাকেও ছাড়েনি! পদ্মজা হাঁটুগেড়ে বসে ফরিনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল, ‘ আম্মা,আপনি কেন চাবিটা দিলেন না? এরা মানুষ? নিজের বউকে কেউ এভাবে মারে? লুতু বুবু আম্মাকে ধরো।’
লতিফা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘পদ্মজা তুমি কিচ্চু জানো না। খালু এমনেই মারে।’
‘এখন ধরো আম্মাকে।’
লতিফা,পদ্মজা দুজন মিলে ফরিনাকে ধরে ধরে তিন তলার আরেকটি ঘরে নিয়ে যায়। যে ঘরটিতে প্রথম রুম্পা ছিল,তারপর রানি। নিচ তলা অবধি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফরিনা মেঝেতে পা সোজা করে ফেলতে পারছেন না। চোখ দুটি বার বার বুজে যাচ্ছে। পদ্মজা একটা অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করছে। যেমনটা তার মায়ের মৃত্যুর আগে অনুভব হয়েছিল। পদ্মজার গা কেঁপে উঠে। চোখ ছাপিয়ে জল নামে। মনে মনে কেঁদে বলল, ‘আল্লাহ! কেন আমার সাথে এমন হচ্ছে! কীসের পরীক্ষা নিচ্ছো তুমি? আমার চারপাশ এতো নির্মম কেন? কোথায় আছো আম্মা। কোথায় আছেন পারিজার আব্বু। আমি ভীষণ একা। ভীষণ।’
পদ্মজার হেঁচকি উঠে গেল। সে ঢোক গিলে নিজেকে সামলায়। ফরিনার যত্ন নিতে হবে তার। ফরিনাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই তিনি থেমে থেমে বললেন, ‘আমার কৈ মাছের জান। আমি মরতাম না। তুমি,তুমি পলায়া যাও।’
‘আম্মা,আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। লুতু বুবু হালকা গরম পানি,আর আমার ঘরের আলমারির ডান পাশের ড্রয়ার থেকে স্যাভলন আর তুলা নিয়ে আসো।’
পদ্মজার আদেশ পাওয়া মাত্র লতিফা বেরিয়ে গেল। ফরিনা করুণ চোখে পদ্মজার দিকে চেয়ে বললেন, ‘কান্দো কেরে? কাইন্দো না।’
পদ্মজার সুন্দর দুটি চোখে জলের পুকুর। বিরতিহীনভাবে পানি গড়িয়ে পড়ছে গলায়,বুকে। সে ফরিনার এক হাতে কপাল ঠেকিয়ে হতাশ হয়ে ব্যর্থ কণ্ঠে বলল, ‘আম্মা,আমি কী করব? যখনই ভাবি এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তখনই ভয়ংকর সব ঘটনার সম্মূখীন হতে হয়। আমি আর পারছি না। এতো খারাপ পরিবেশ আমি আর নিতে পারছি না আম্মা। নিজেকে কিছুক্ষণ আগেও শক্তিমান মনে হয়েছে। মনে হয়েছে,আমি চাইলে সব পারব। কিন্তু এখন খুব দূর্বল মনে হচ্ছে। আমি ওদের বিরুদ্ধে পেরে উঠছি না। আপনি ভালো হয়ে উঠুন আম্মা। আপনার ছেলে কি সত্যি-’
পদ্মজা তাকিয়ে দেখল, ফরিনার চোখ বোজা অবস্থায় আছে। পদ্মজার বুক ছ্যাঁত করে উঠল। সে ফরিনার নাকের কাছে হাত নিয়ে পরীক্ষা করল,নিঃশ্বাস নিচ্ছে নাকি। নিঃশ্বাস নিচ্ছে! সেই সময় লতিফা স্যাভলন,তুলা,আর হালকা গরম পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো।
ফরিনা ঘুমাচ্ছেন। কথা বলার অবস্থায় নেই। পদ্মজার পায়ে ঘা হয়েছে। পাঁচদিনে কি ছেঁড়াকাঁটা ভালো হয়? শীতের কারণে উলটো আরো কষ্ট বাড়ে। পায়ের অবস্থা যা তা! তাতে অবশ্য যায় আসে না পদ্মজার। সে অস্থির হয়ে আছে। বুকে এক ফোঁটাও শান্তি নেই। রিদওয়ান দুপুরে জঙ্গল থেকে ফিরেছিল। পদ্মজার ধারণা,আমির জঙ্গলের কোথাও বন্দি আছে। অথবা লাশটা হলেও আছে! ভাবনাটা পদ্মজার মাথায় আসতেই সে দ্রুত মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করে, ‘ না! আমি কী ভাবছি! কিছু হয়নি। কারো কিছু হয়নি। সবাই ভালো আছে।’
সে লতিফার দায়িত্বে ফরিনাকে রেখে নিচ তলায় নেমে আসে। সাথে ছুরি,রাম দা নিয়েছে। আজ খোঁপা করেনি। বেণী করেছে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই। সব হাসপাতালে। ওরা ফিরলে সে আর আস্তো থাকবে না। তার আগেই আমিরকে বের করতে হবে। সেই সাথে লুকোনো গুপ্ত রহস্য। সদর ঘরে আমিনা ছিলেন। তিনি আলোকে খিচুরি খাওয়াচ্ছেন। নির্বিকার ভঙ্গি! কোনো তাড়া নেই,চিন্তা নেই! রিদওয়ানের অবস্থা কী দেখেনি? এই মানুষটা শুধু রানির জন্যই কাঁদেন। আর কারোর জন্য না! কিন্তু কেন? পরিবারের সবার সাথে দূরত্ব বজায় রাখেন। যদিও কথা বলেন,তা অহংকারী, কটু কথা। পদ্মজা বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার নামায পড়েই বেরিয়েছে। আজ জঙ্গলে মরবে নয়তো আগামীকাল এই বাড়ির পুরুষগুলোর হাতে! সে মনে মনে মৃত্যু মেনে নিয়েছে। ধীর পায়ে হেঁটে জঙ্গলে ঢুকে। বোনদের কথা খুব মনে পড়ছে। সে মারা গেলে, ওদের কী হবে? খুব কী কাঁদবে? কাঁদতে কাঁদতে জ্বর উঠে যাবে বোধহয়! পূর্ণার তো খুব কান্নার পর জ্বর হয়। প্রেমা নিজেকে সামলাতে পারবে। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় পদ্মজা মানুষের উপস্থিতি টের পেলো। ফিসফিসিয়ে কাছে কোথাও কেউ কথা বলছে। পদ্মজা এখনও ভালো করে জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করেনি। সে হিজল গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে দুটি মানুষ চোখের পর্দায় ভেসে উঠে। তারা জঙ্গলের পশ্চিম দিক থেকে এসেছে। অস্পষ্ট তাদের মুখ। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে অন্দরমহলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল তারা। একটা মুখ চিনতে পারে পদ্মজা। মৃদুল! মৃদুলের হাতে টর্চ। সেই টর্চের আলোতে পাশের জনের হাত ভেসে উঠে। এক হাতে লাল তাজা রক্ত, অন্য হাতে রামদা। পদ্মজা শিউরে উঠে। ঘামতে থাকল। উত্তেজনায় তার হৃৎপিণ্ড ফেটে যাওয়ার উপক্রম। গলা শুকিয়ে কাঠ। মৃদুল কিছু একটা বলে। উত্তরে আগন্তুক কিছু একটা বলে। ঝাপসা আলোয় মৃদুলের সাথের লোকটার দেহ আর চুল স্পষ্ট হয়। লম্বা শরীর,মাথায় ঝাকড়া চুল। চারপাশ থমকে যায়। পদ্মজার শরীর বেয়ে যেন মুহূর্তে শীতল কিছু একটা ছুটে যায়। সে বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছে না।
৬২
চন্দ্র তারকাহীন ম্লান আকাশের কারণে চারপাশ অদ্ভুত ভয়ংকর হয়ে আছে। পদ্মজার মুখ ঘেঁষে একটা পাতা মাটিতে পড়লো। সাথে সাথে সে ভয় পেয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, নিজের ভয় পাওয়া দেখে নিজের উপর খুব বিরক্ত হয়। দুই পা এগিয়ে এসে অন্দরমহলের পিছনে তাকায়। আধো অন্ধকারে আবিষ্কার করলো, মৃদুল এবং আগন্তুক নেই! চোখের পলকে যেন মুহূর্তেই ভোঁজবাজির মতো নাই হয়ে গেল! পদ্মজার মস্তিষ্ক সাবধান হয়ে উঠলো। মৃদুলের মধ্যে ঘাপলা আছে ভাবতেই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সে সবকিছু ভাবতে পারে। সবকিছু! পদ্মজা তার পরিকল্পিত পথ ধরে হাঁটা শুরু করলো। মনে মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, মৃদুল জঙ্গলের ভেতরে ঢুকেনি তো? আর দীর্ঘদেহী, ঝাঁকড়া চুলের আগন্তুকও কি সাথে রয়েছে? পদ্মজা এক হাতে ছুরি নিল, অন্য হাতে রাম দা। তার চোখের দৃষ্টি প্রখর। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সাবধানে এক পা,এক পা করে এগোচ্ছে। নিঃশ্বাস যেন আটকে আছে। এই বুঝি কেউ আক্রমণ করে বসল! সেদিন যতটুকু এসেছিল সে,ঠাওর করে করে নিরাপদভাবে ঠিক ততটুকুই চলে আসে পদ্মজা। সামনে বড় বড় গাছপালা ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। ভূতুড়ে পরিবেশ। পদ্মজা কেন জানি নিশ্চিত,আজও কেউ থাকবে এখানে, অজানা রহস্যজাল পাহারা দেয়ার জন্য। আর আশেপাশেই আছে সেই গুপ্ত রহস্যজাল। পদ্মজার শিরায়,শিরায় প্রবল উত্তেজনা বয়ে যায়। কয়েকটা গাছ পেরিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। একটা শব্দ ভেসে আসছে কানে। পদ্মজা দুরু দুরু বুকে শব্দ্যোৎস লক্ষ করে তাকাল। কিছুটা দূরে একজন লোক উবু হয়ে বসে আছে। সম্ভবত প্রস্রাব করছে। পদ্মজা প্রস্তুত হয় লোকটিকে পেছন থেকে আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু অগত্যা কারণে তার হাত কেঁপে উঠলো। সে কাউকে প্রাণে মারতে পারবে না। সেই সাহস হচ্ছে না। একটা খুন করেছে ভাবলেই তার গাঁ কেঁপে উঠে। সেদিনের খুনটা তার নিজের অজান্তেই হয়ে গিয়েছে। সে যেন ছিল অন্য এক পদ্মজা। সেই পদ্মজাকে সে নিজেও চিনতো না।
পদ্মজা অস্থির হয়ে কিছু একটা খোঁজে। লোকটা উঠে দাঁড়ায়। পদ্মজা দ্রুত একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে। লোকটির মুখ অস্পষ্ট। অবয়ব শুধু স্পষ্ট। দুলকি চালে এদিকেই এগিয়ে আসছে। পরনে লুঙ্গি ও সোয়েটার পরা। মাথায় টুপিও রয়েছে। লোকটার হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে না, সে টের পেয়েছে অন্য কারো উপস্থিতি। তবুও পদ্মজার নিঃশ্বাস আটকে যায়। সে রাম দা শক্ত করে ধরলো। লোকটি তার কাছে আসতেই সে শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে মাথায় আঘাত করে। লোহার রাম দার এক পাশের আঘাতে লোকটি লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। গোঙানির শব্দ করে, হাত পা ধাপড়াতে থাকলো। সেকেন্ড কয়েক পরই দেহ নিস্তেজ হয়ে যায়। পদ্মজার বুক ফুঁড়ে নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। তবে লোকটাকে কাঁচা খেলোয়ার মনে হলো! এক আঘাতেই কুপোকাত! পদ্মজা একবার ভাবল,টর্চের আলোয় লোকটার মুখ দেখবে। তারপর মাথায় এলো,টর্চের আলো দেখে যদি ওত পাতা বিপদ তার উপস্থিতি টের পেয়ে এগিয়ে আসে! তাই আর টর্চ জ্বালাল না। সে নিথর দেহটিকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। বাতাসের সাঁ,সাঁ শব্দ,ঝিঁঝিঁপোকার ডাক,আর অশরীরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা, আর রাতের অন্ধকার বার বার পদ্মজার গা হিম করে দিচ্ছে। পদ্মজা প্রমোদ গুণে নিজের মধ্যে সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে। বড় বড় গাছপালা ফেলে সে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল। সামনে কোনো বড় গাছ নেই। জঙ্গলের মাঝে এরকম খোলা জায়গা কেন? এতে কি কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে! একদমই খোলা তাও নয়। জংলি লতাপাতা রয়েছে। তবে একটু অন্যরকম। লতাপাতার মাঝে জোঁক বা কোনো বিষাক্ত জীব থাকতে পারে। বিপদের কথা ভেবেও পদ্মজা ঝুঁকি নিলো। সে পা বাড়াল সামনে। কয়েক কদম এগোতেই জুতা ভেদ করে কাঁটা ফুঁটে পায়ে! আঘাতে আবার আঘাত লেগেছে। ব্যথায় পদ্মজার কলিজা যেন ছিঁড়ে যায়। সে কাঁটা বের করার চেষ্টা করে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল বেরোয়। রক্তজবা ঠোঁট দুটি জলে ভিজে যায়।
মৃদুল এদিকওদিক দেখে বলল, ‘লিখন ভাই, চলো চইলা যাই।’
অসহনীয় যন্ত্রনায় লিখনের কপালে বিন্দু,বিন্দু ঘাম জমেছে। সেসবকে তোয়াক্কা করে সে বলল, ‘পদ্মজার খোঁজ নিতে হবে আগে।’
মৃদুল বুঝতে পারছে না কি করবে সে! লিখনের হাত থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। দুপুরে সে পূর্ণার সাথে দেখা করতে মোড়ল বাড়িতে গিয়েছিল। পূর্ণা চোখমুখ ফুলে যা তা অবস্থা। অনেক কান্নাকাটি করে পদ্মজার জন্য। পূর্ণা আশঙ্কা করছে,তার বোন ভালো নেই। মৃদুলেরও তাই মনে হয়। সে যেতেই পূর্ণা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকল। তখন লিখন শাহ আসে। তার শুটিং শেষের দিকে। সপ্তাহখানেক পর ঢাকা ফিরবে। তাই পূর্ণাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল। পূর্ণাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে লিখন বিচলিত হয়ে পড়ে। তারপর প্রশ্ন করে বিস্তারিত জানতে পারে। লিখন,হাওলাদার বাড়িতে আসতে চাইলে,মৃদুল না করলো। সে বললো,ঢুকতে দিবে না। লিখন মৃদুলের কথা শুনে না। চলে আসে হাওলাদার বাড়িতে। পিছু পিছু আসে মৃদুল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত দারোয়ান গেইটের ভেতরেই ঢুকতে দিল না লিখনকে। তখন মৃদুল, লিখনের সাথে পরিকল্পনা করলো, তারা বাড়ির পিছনের ভাঙা প্রাচীর পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকবে। লিখন প্রথম রাজি না হলেও,পরে রাজি হলো। সে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। পদ্মজার খোঁজ নেই কথাটা সে ভাবতেই পারছে না! এতো বয়সে এসেও সে একটা মেয়ের জন্য এতো ব্যকুল হয়ে পড়ছে! তাও বিবাহিত মেয়ে! এমন মেয়েকে ভালোবেসে ব্যকুল হওয়া তো সমাজের চোখে খারাপ। এই সমাজের জন্যই সে পদ্মজার থেকে নিজের এতো দূরত্ব রাখে। যাতে কোনো খারাপ কথা,কোনো দূর্নাম পদ্মজাকে ছুঁতে না পারে। পদ্মজা যেন অসুখী না হয়। সেই পদ্মজার নাকি চারদিন ধরে খোঁজ নেই! মৃদুল দেখা করতে চাইলে,তাও করতে দেয়া হচ্ছে না! লিখনের মাথার রগরগ দপদপ করতে থাকে। আঁধার নামতেই দুজনে হাওলাদার বাড়ির পিছনের ভাঙা প্রাচীর দিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়ে। বাড়ির পিছনে যে জঙ্গল,সেই জঙ্গলসহ পুরো বাড়ির সীমানা মিলিয়ে চারিদিকে গোল করে প্রাচীর দেয়া। তাই পিছনের প্রাচীর দিয়ে তারা আগে পশ্চিম দিকের জঙ্গলে পা রাখে। মৃদুল একবার মদনের সাথে পশ্চিম দিকে এসেছিল। একটা ঔষধি পাতা নিতে। তাই সে জানতো,এদিকে বড় বড় কাঁটা আছে। যা পথ রোধ করে। এজন্য সে রামদা নিয়ে এসেছে। যা লিখনের হাতে ছিল। লিখন অসাবধানবশত কাঁটার লতাপাতা কাটতে গিয়ে নিজের হাতে আঘাত করে বসে। ফলে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে। গলগল করে বেরিয়ে আসে রক্ত। রক্তাক্ত হাত নিয়ে বেরিয়ে আসে জঙ্গল থেকে। মৃদুল চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘ভাই, রক্ত তো বন্ধই হইতাছে না।’
‘কী করা যায় বলোতো?’
‘আসো চইলা যাই। বাজারে যাইবা। নয়তো ডাক্তারের বাড়িতে নিয়া যাব।’
‘ব্যস্ত হয়ো না মৃদুল।’
লিখন এক জায়গায় বসল। তারা অন্দরমহলের বাম দিকে আছে। মৃদুলের হাত থেকে টর্চ নিয়ে লিখন চারিদিকে কিছু দেখল। তারপর বলল, ‘ওইযে দেখা যাচ্ছে,ওই পাতাটা নিয়ে আসো।’
‘আচ্ছা,ভাই। ‘
মৃদুল লিখনের দেখানো কয়েকটা পাতা নিয়ে আসে। তারপর কচলে নরম করে লিখনের ক্ষতস্থানে লাগায়। লিখন বলল, ‘হয়েছে এবার। রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘আমরা চইলা যাইলেই পারতাম।’
‘পদ্মজার খোঁজ না নিয়ে কীভাবে যাই?’
‘পদ্মজা ভাবিরে এতো ভালোবাসো ভাই,অবাক করে আমারে।’
লিখন মুচকি হেসে বলল, ‘এসব বলো না মৃদুল। এসব বলতে নেই।’
‘সত্যি কথা কইতে ডর কীসের?’
লিখন ঠোঁটে হাসি রেখেই উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘বিবাহিত নারী নিয়ে এসব বলতে নেই। সমাজ ভালো চোখে দেখে না।’
‘সমাজরে আমি জুতা মারি।’
‘তোমার বয়স বেড়েছে ঠিকই,জ্ঞান হয়নি।’ বলতে বলতে লিখন অন্দরমহলের পিছনে এসে দাঁড়াল। গা হিম করা ঠান্ডা বইছে। তার পরনে শীতবস্ত্র নেই। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে সে। মৃদুল বলল, ‘এই কথা আমার আম্মাও বলে।’
‘এসব কথা বাদ দাও এখন। শুনো,আমরা বাড়ির সামনে যাব নাকি পিছন থেকেই কিছু করব?’
লিখনের ভাবগতি বোঝা যাচ্ছে না। মৃদুল লিখনের দৃষ্টি অনুকরণ করে অন্দরমহলের দুই তলায় তাকাল। পদ্মজার ঘরের জানালার দিকে। প্রশ্ন করলো, ‘পিছনে কী করার আছে?’
‘পদ্মজার ঘরের জানালার পাশে রেইনট্রি গাছটা দেখেছো? গাছে উঠে উঁকি দিলেই পদ্মজাকে দেখা যাবে। কথা বলাও যাবে।’
‘উঠতে পারো গাছে?’
‘আরে পুরুষ মানুষ হয়েছি কীজন্যে?’
‘তাইলে গাছে উঠমু আমরা?’
‘একবার সামনে দিয়ে চেষ্টা করা উচিত। তুমি যাও,গিয়ে দেখো ঢুকতে দেয় নাকি।’
মৃদুল মুখ কালো করে বললো, ‘দিবে না। আবার অপমান হতে ইচ্ছা করতাছে না।’
‘তাহলে চলো গাছে উঠি।’
মৃদুল চুল ঠিক করতে করতে গুরুতর ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি যহন কইছো, আমি যাবো।’
লিখন হাসলো। পূর্ণার মতোই মৃদুলের স্বভাব। পূর্ণাকে যে কারণে ভালো লাগে,ঠিক একই কারণে মৃদুলকেও ভালো লাগে। মৃদুল চলে যায়। লিখনের মাথাটা ব্যথা করছে। সে দু হাতে কপালের দু পাশ চেপে ধরে পদ্মজার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবে, একজন জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে এভাবে প্রাচীর ডিঙিয়ে,লুকিয়ে এক পাক্ষিক ভালোবাসার মানুষের খোঁজ নিতে আসাটাকে হয়তো কারো চোখে পাগলামি মনে হবে। কিন্তু তার চোখে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব! নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব! পদ্মজা ভালো আছে ভেবেই সে মানসিকভাবে ভালো থাকে। এ কথা ঠিক, পদ্মজার সাথে আমিরের এতো সুখ দেখে তার বুকে চিনচিন ব্যথা হয়। তবে এটাও ঠিক পদ্মজার সুখ দেখে সে শান্তিও পায়! বেঁচে থাকার মানসিক মনোবল পায়। আশা থাকে মনে, আছে! বেঁচে আছে পদ্মফুল! চাইলেই দূর থেকে দেখা যাবে। চাইলে কথা বলাও যাবে। কিন্তু যদি নাই বা থাকে? তবে-
মৃদুল এসে জানালো, ‘শালার ব্যাঠা দুলাভাই নাই। কেউই নাই দরজার সামনে।’
লিখন বলল, ‘তাহলে চলো। সামনে দিয়েই যাই। আমারও কেমন লাগছিল,এভাবে লুকিয়ে বাড়ির পিছন দিয়ে… ‘ লিখন হাসলো। ম্লান হাসি। সে এগিয়ে গেল। সাথে মৃদুল। দুজন অন্দরমহলে প্রবেশ করলো নির্বিঘ্নে। কোনো বাধা আসেনি। আমিনা সদর ঘরে বসে ছিলেন। তিনি লিখনকে দেখে বললেন, ‘তুমি এইহানে কেরে আইছো?’
মৃদুল ঘরে ঢুকে বলল, ‘ফুফুআম্মা,পদ্মজা ভাবি কই?’
আমিনা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুলের কাছে এসে আদুরে গলায় বললেন, ‘কই আছিলি বাপ? তোর ফুপায় বকছে বইলা চইলা যাবি কেন? আমি তোর ফুফুআম্মা আছি না? তুই এইহানেই থাকবি। যতদিন ইচ্ছা থাকবি।’
মৃদুল কপালে ভাঁজ সৃষ্টি করে বলল, ‘ধুর! বাদ দেও এসব কথা। তোমার জামাই একটা ইবলিশ। ইবলিশের ধারেকাছে মানুষদের থাকতে নাই।’
আমিনা মৃদুলের মুখ ছুঁয়ে বললেন, ‘এমন কয় না বাপ।’
‘আদর পরে কইরো। এখন কও তো পদ্মজা ভাবি কই?’
‘ঘরেই আছে।’
‘ভাবির কি শরীর ভালা আছে?’
আমিনা ক্ষণমুহূর্ত সময় নিয়ে লিখনকে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘হ ভালা।’
‘আচ্ছা,ফুফুআম্মা আমরা উপরে যাইতাছি।’
আমিনা লিখনের দিকে আঙ্গুল তাক করে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, ‘এই ছেড়াও যাইবো?’
লিখন চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। পরপুরুষ হয়ে পদ্মজার মতো মেয়েকে দেখতে যাওয়া ঠিক হবে না বোধহয়। মৃদুল তো এই বাড়ির আত্মীয়। সে গেলে সমস্যা নেই। মৃদুল কিছু বলার পূর্বে লিখন বলল, ‘আমি এখানে বসি। তুমি যাও।’
‘না ভাই,তুমি আইয়ো।’
‘আরেএ,মৃদুল যাও তো।’
মৃদুল সিঁড়িতে পা রাখলো। আমিনা ভাবছেন,পদ্মজা তো ঘরেই আছে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই। এরকম সময়ে যদি পদ্মজার নিচে নেমে আসে? লিখনের সাথে কথা বলে! আর এ খবর কোনোভাবে খলিল হাওলাদারের কানে যায়। তবে তার রক্ষে নেই। তিনি উঁচুকণ্ঠে ডাকলেন, ‘ মৃদুলরে?’
মৃদুল তাকালো। আমিনা জানেন না,পদ্মজা সত্যি যে ঘরে নেই। তিনি মিথ্যে ভেবে বললেন, ‘পদ্মজায় তো ঘরে নাই।’
লিখন উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কেন? কোথায় গিয়েছে?’
আমিনা নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, ‘আমি কিতা কইতাম? গেছে কোনো কামে।’
মৃদুল সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসলো, ‘ভাবি একলা গেছে?’
আমিনা আরেকটা মিথ্যা বললেন, ‘না,একলা যায় নাই। আমিরের লগে গেছে?’
মৃদুল উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো, ‘আমির ভাই বাড়িত আছিলো? আমি যে দেহি নাই। ভাবছি,জরুরি কোনো কামে ঢাকাত গেছে।আচ্ছা,ফুফুআম্মা অন্দরমহল নজরবন্দিতে আছিলো কেন? আমারে ঢুকতে দিতো না।’
আমিনা তৃতীয়বারের মতো মিথ্যে বললেন, ‘আমির তো ঢাকাতই গেছিলো। কাইল রাইতে আইছে। আমির নাই এজন্যে পদ্মজার-‘
লিখন কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। সিকিউরিটি মানে নিরাপত্তা দিয়ে গিয়েছিল। আমি আছিতো গ্রামে! আমির হাওলাদার খুব ভালোবাসেন পদ্মজাকে!’ শেষ শব্দ তিনটি লিখন জোরপূর্বক হেসে বলল। তার চোখের মণি চিকচিক করছে। মৃদুল আফসোস করে বললো, ‘ধুর,দেখা হইলো না।’
‘আসি চাচি।’ বললো লিখন।
মৃদুল,লিখন বেরিয়ে আসে। মৃদুল বললো, ‘পদ্মজা ভাবির চিঠি দেখে তো মনে হয় নাই এতো সহজ ব্যপার।’
‘হু। পদ্মজা একটা রহস্যময়ী,মায়াময়ী। তাই বোধহয় রহস্য রেখে চিঠি লিখেছে। আর,মিস্টার আমির যেহেতু এখন সাথে আছে নিশ্চয় পদ্মজা ভালো আছে।’
মৃদুল গভীর মগ্ন হয়ে কিছু ভাবছে। সে লিখনের কথার জবাবে বললো, ‘ উমম।’
‘তবুও, আগামীকাল পদ্মজা পূর্ণার সাথে যোগাযোগ না করলে আমরা আবার আসব না হয়।’
মৃদুল লাফিয়ে উঠে বলল, ‘এটাই ভাবছিলাম।’
লিখনের হাতের রক্তপড়া বন্ধ হলেও খুব ব্যথা হচ্ছে। তা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মৃদুল বললো, ‘ভাই,সাইকেল নিয়া আসি। এ অবস্থায় হেঁটে যাওয়া ঠিক হইব না।’
লিখনও সায় দিল। মৃদুল আলগ ঘর থেকে সাইকেল নিয়ে আসে। মৃদুল সামনে, লিখন পিছনে বসলো। তাদেরকে দারোয়ান দেখে অবাক হয়। তবে বেশিকিছু বলতে পারেনি,মৃদুল হুমকি-ধামকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাসে লিখন অনুভব করলো,তার বুকের সূক্ষ্ম ব্যথাটা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। সে একবার ঘুরে তাকাল হাওলাদার বাড়ির গেইটের দিকে! খ্যাতিমান, সুদর্শন, ধনী লিখন শাহ, যে সবসময় ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে রাখে তাকে দেখে সবার কত সুখী মনে হয়! কত যুবক স্বপ্ন দেখে লিখন শাহর অবস্থানে আসার! কিন্তু তারা কী কখনো জানবে, লিখন শাহ সর্বক্ষণ বুকের ভেতর বিষাক্ত সূচ নিয়ে হাসে। যে সূচের তীব্রতা তাকে এক মুহূর্তও শান্তি দেয় না।
পদ্মজা চারিদিকে হাঁটছে। কিন্তু চোখে পড়ার মতো কিছু পাচ্ছে না। কী এমন আছে এখানে? যা পাহারা দেয়ার জন্য কেউ না কেউ থাকে। কিছুই তো নজরে আসছে না। পদ্মজা জংলি লতাপাতার উপর হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে আসে। শিশিরের জলে পায়ের তালু থেকে হাঁটু অবধি ভিজে গিয়েছে। পা জোড়া ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম। থেকে থেকে কাছে কোথাও শেয়াল ডাকছে। পদ্মজার বুক ধুকপুক,ধুকপুক করছে।
মনে হচ্ছে,কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ করে বসবে। ছিঁড়ে খাবে দেহ! ভাবতেই,পদ্মজার গা শিউরে উঠলো। সে ঢোক গিলল। তারপর আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিল। আয়তুল কুরসি যতবার সে পড়ে,ততবার নিজের মধ্যে একটা শক্তি অনুভব করে। ভরসা পায়। এই মুহূর্তেও তার ব্যক্তিক্রম হয়নি। সে সামনে এগোতে এগোতে একসময় আবিষ্কার করলো,তার পায়ের নিচে মাটির বদলে অন্যকিছু আছে! চকিতে পদ্মজার মস্তিষ্ক চারগুণ গতিতে সচল হয়ে উঠলো। সে পায়ের নিচের লতাপাতা সরাতে গিয়ে দেখল, এই লতাপাতাগুলোর শেকড় নেই! পদ্মজা দ্রুতগতিতে সব লতাপাতা সরালো। তখনই আবছা আলোয় চোখে ভেসে উঠলো,লোহার মেঝে! পদ্মজার মুখে একটি গাঢ় বিস্ময়ের ছাপ প্রতীয়মান হয়ে উঠলো। তার উত্তেজনা বেড়ে যায়। শীতল শরীর উত্তেজনায় ঘামতে শুরু করলো। লোহার মেঝেটা খুব একটা বড় নয়। পদ্মজা টর্চ জ্বালায়। খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দেখে। এক পাশে ছিদ্র রয়েছে। মনে হচ্ছে,এখানে চাবি ব্যবহৃত হয়! চকিতে পদ্মজার মাথায় এলো,আলমগীরের দেয়া চাবিটার কথা। সে দ্রুত পেটিকোটের দুই ভাঁজ থেকে চাবিটি বের করলো। প্রবল উত্তেজনায় তার হাত মৃদু কাঁপছে। বিসমিল্লাহ বলে,চাবি ছিদ্রে প্রবেশ করালো। এবং কাজও করে! পদ্মজা বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে পড়ে! কী হতে চলেছে? সে লোহার এই অংশটি দুই হাতে তোলার চেষ্টা করলো। যতটা ভারী ভেবেছিল,ততটা নয়! পদ্মজা লোহার ভাবলেও,এটা বোধহয় লোহার নয়। ধীরে ধীরে পদ্মজা আবিষ্কার করলো,এটি একটা দরজা,গুপ্ত কোনো ঘরের দরজা। সে আতঙ্কে হিম হয়ে যায়। নিচের দিকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। পদ্মজা তার কাঁপতে থাকা পা এগিয়ে দেয় ভেতরে। সে ভয় পাচ্ছে না তা নয়! খুব ভয় হচ্ছে। এমন আচানক ঘটনার সম্মূখীন তো আগে হয়নি। সিঁড়ি ভেঙ্গে সে অনেক দূর অবধি নেমে আসে। ভীষণ ঠান্ডা এদিকে। মনে হচ্ছে সব স্বপ্ন! কোনো রূপকথার গল্পের রাক্ষসপুরীতে চলে এসেছে! চোখের সামনে ভেসে উঠে আরেকটি দরজা। এই দরজাটি অদ্ভুত ধরণের। তাদের ঢাকার বাড়িতে হুবুহু একইরকম দরজা আছে! এই দরজার আড়ালে যাই হয়ে যাক বাইরে শব্দ আসে না! পদ্মজা অস্পষ্ট একটা সন্দেহে বিভোর হয়ে উঠে। এই দরজাটি খুলতে আলমগীরের দেয়া চাবিটাই কাজ করে! পদ্মজা চাবিতে চুমু খায়। এতো গুরুত্বপূর্ণ চাবি আলমগীর তাকে দিল কেন? এসব ভাবার সময় এখন নয়। বাকিটুকু তাকে দেখতে হবে। দরজা খুলে অন্য একটি অংশে প্রবেশ করতেই মুখে তীব্র আলো ধাক্কা খেল। পদ্মজা কপাল কুঁচকে দুই হাত সামনে বাড়িয়ে আলোর গতিবেগ রোধ করে মুখে অস্ফুট বিরক্তিসূচক শব্দ করলো। তারপর ধীরে ধীরে পিটপিট করে তাকালো। চারিদিকে রঙ-বেরঙের বাতি জ্বলছে। এই বাতিগুলোও তার চেনা। তাদের বাড়িতে আছে। যখন বিদ্যুত থাকে না,ব্যাটারিচালিত এই বাতিগুলো পুরো বাড়ি আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলে! দুইদিকে আরো দুটো দরজা। প্রথম দরজাটিতে লেখা ‘স্বাগতম’। দ্বিতীয়টিতে লেখা ‘ধ-রক্ত।’ রুম্পা তো এমন কিছুই বলেছিল! পদ্মজা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দ্বিতীয় দরজাটির দিকে হেঁটে আসে। এটার কোনো তালা নেই। তাহলে খুলবে কী করে? পদ্মজা ধাক্কা দিল। সাথে সাথে খুলেও গেল। পদ্মজার মুখ হা হয়ে যায়। তার ঠোঁট বার বার শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কোথায় এসেছে সে! আর কি ফিরতে পারবে নিজের ঘরে? আচমকা পদ্মজার কানে ভেসে আসে মেয়েদের কান্নার চিৎকার! পদ্মজার রক্ত হিম হয়ে যায়। এরকম একটা জায়গায় এতোগুলো মেয়ে কেন কাঁদছে? কত কষ্ট,যন্ত্রণা সেই কান্নায়! কান্নার বেগ বাড়ছে। যেন কেউ বিরতিহীনভাবে আঘাত করছে। পদ্মজা দুই হাতে ছুরি ও রাম দা শক্ত করে ধরলো। তারপর সেই কান্না অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো সামনে। যত এগুচ্ছে কান্নাগুলো তীব্র ধাক্কা দিচ্ছে বুকে। পদ্মজার নিঃশ্বাস আটকে আছে। সে চলে এসেছে খুব কাছে। চোখের সামনে আরেকটা ঘরের দরজা। দরজাটি একটু খোলা। সে সাবধানে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর তাকালো। আর ঠিক তখনই তার পায়ের পাতা থেকে মাথার তালু অবধি শিরশির করে উঠলো। চোখের সামনে দেখা দৃশ্যটা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হতে লাগলো। মনে হচ্ছে জায়গায় জমে গেছে সে। বিবস্ত্র অবস্থায় পাঁচ-ছয়টি মেয়ে হাতজোড় করে কাঁপছে,কাঁদছে। তাদের শরীর রক্তাক্ত। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা লম্বা শ্যামবর্ণের দেহ। গায়ে শার্ট নেই। প্যান্ট নেমে এসেছে নাভির অনেক নিচ অবধি। তার হাতে বেল্ট! সম্ভবত বেল্ট দিয়েই,মেয়েগুলোকে আঘাত করছিল! প্রশস্ত ও তুষ্টপুষ্ট শরীরের গড়নের মানুষটিকে চিনতে পেরে পদ্মজার বুকের পাঁজর টনটন করে উঠল। তার হাত থেকে পড়ে যায় ছুরি ও রাম দা। বিকট শব্দ হয়। সেই শব্দ অনুসরণ করে উপস্থিতি মানুষগুলোর চোখ পড়ে দরজার দিকে। পদ্মজা ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে। শরীরের সবটুকু শক্তি নিমিষেই কে যেন চুষে নিয়েছে! পদ্মজাকে দেখে মানুষটির চোখ হিংস্র জন্তুর মতো জ্বলজ্বল করে উঠে। কপালের শিরা ভেসে উঠে,হিংস্র চাহনি আরো ভয়ঙ্কর হয়ে যায়। সে ভাবতেই পারছে না, পদ্মজা এত দূর চলে এসেছে! পদ্মজা বিস্ময়ভরা ছলছল চোখ দুটি সেই মানুষটার দিকে তাক করে অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘ ছিঃ!’
৬৩
বিছানার উপর কাঁথা মোড়ানো ফরিনার দূর্বল দেহটা শুয়ে আছে। বিদ্যুত নেই। ঘরের এক কোণে লণ্ঠন জ্বলছে। ফরিনার চোখ বোজা। লতিফা পায়ে পায়ে হেঁটে এসে নিঃশব্দে ফরিনার শিয়রে দাঁড়াল। ক্ষীণস্বরে ডাকলো, ‘খালাম্মা ঘুমাইছেন?’
ফরিনা ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। চোখের দৃষ্টি ঘোলা। কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে বয়সের তুলনায় একটু বেশিই যেন বয়স্ক দেখাচ্ছে। ফরিনা কিছু একটা বললেন। লতিফা বুঝলো না। সে নত হয়ে ফরিনার মুখের কাছে নিজের মুখ এনে বললো, ‘কী কইছেন খালাম্মা?’
ফরিনা দূর্বল গলায় নিম্নস্বরে বললেন, ‘পদ্মজা কই?’
‘আপনের ঘরে না আইলো দেখলাম।’
‘ঘুম থাইকা উইঠা তো দেহি নাই।’ ফরিনা থামলেন। তারপর বললেন, ‘এহন কই?’
‘মনে কয় ঘরে আছে। ডাইকা দিমু?’
‘না, থাকুক।’
‘খাইবেন কিছু?’
‘না। আরেকটা কেঁথা দে।’
লতিফা আলমারি থেকে লেপ বের করলো। তারপর ফরিনার গায়ের উপর দিল। আর বললো, ‘অনেক ঠান্ডা পড়ছে খালাম্মা। কাঁথা দিয়া হইবো না।’
ফরিনা লতিফার সাথে আর কথা বাড়ালেন না। তিনি জানালার বাইরে চোখ রাখেন। রাতের আকাশ দেখা যাচ্ছে। আর শীতল হাওয়া সাঁ,সাঁ করে ঘরের ভেতর ঢুকছে। তিনি আকাশের গায়ে বাবুর ছোটবেলার মুখটা দেখতে পেলেন। যখন বাবুর জন্ম হলো, আমিনা কপাল কুঁচকে বলেছিলেন, ‘তোমার ছেড়ায় তো সত্যি কালা হইছে। আমি ঠিকই কইছিলাম।’
আমিনার কথা শুনে ফরিনার বিন্দুমাত্র রাগ হয়নি। বাবুর নিষ্পাপ মুখটা দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। সারা মুখে গুচ্ছ গুচ্ছ মায়া। এই মায়াময় শ্যামবর্ণের মুখ দেখে তিনি যেন পিছনের সব কষ্ট ধামাচাপা দিয়ে দিতে পেরেছিলেন। আদর করে কোলে নিয়ে ডেকেছিলেন, ‘আমার বাবু।’
মায়াময় এক রত্তি বাবুর নামকরণ হয় আমির হাওলাদার। ধীরে ধীরে বড় হয় আমির। মায়ের চুলের বেণি করে দেয়া ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যাস। মায়ের হাতে তিন বেলা না খেলে পেটই ভরতো না। কতশত আবদার ছিল তার! আম্মা,আম্মা করে বাড়ি মাথায় তুলে রাখতো। যতবার আম্মা ডাকতো ততবার বোধহয় নিঃশ্বাসও নিতো না। ছোট থেকেই আমির স্বাস্থ্যবান,তেজি। বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র ছেলে ছিল। যখন আমিরের বয়স চৌদ্ধ,তখন সে ফরিনাকে কোলে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরেছে! ফরিনা সেদিন আবেগে আপ্লুত হয়ে ছেলেকে বকেছেন,উচ্চস্বরে হেসেছেন। জীবনে স্বর্গীয় সুখ নিয়ে এসেছিল আমির। পিছনের কথা ভেবে, ফরিনার ঠোঁট দুটি থরথর করে কেঁপে উঠলো। চোখ দুটি ভিজে উঠে জলে। এই বয়সে এসে স্মৃতির নরকীয় যন্ত্রণা হজম করা খুব কষ্টের। কম তো বয়স হলো না। পঞ্চাশের ঘরে পড়েছেন। ফরিনার চোখের দেয়াল টপকে উপচে পড়ছে নোনা জল। সেই জল দেখে লতিফা বিচলিত হয়ে উঠলো, ‘খালাম্মা,ও খালাম্মা। কান্দেন কেন?’
ফরিনা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালেন। ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘তুই যা লুতু।’
লতিফা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর বললো, ‘পদ্মরে কিছু কইয়েন না খালাম্মা। কষ্টে মইরা যাইব। ছেড়িডা ভালা আছে। ভালাই থাহক। মা-বাপ নাই।’
ফরিনা লতিফার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুই সব জানতি লুতু?’
লতিফা মাথা নত করে বলল, ‘হ।’
ফরিনা হিংস্র সিংহীর মতো গর্জে উঠে বললেন, ‘আমারে আগে কইলি না কেন তুই? আমার বাবু কেমনে আমার হাত থাইকা ছুইটা গেলো? বাপের রক্ত কেমনে পাইলো?’
ফরিনা কাশতে থাকলেন। উত্তেজিত হওয়াতে শরীরের হাড়ে,হাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব হচ্ছে। কেউ যেন কাঁটাচামচ দিয়ে একটার পর একটা ঘা দিচ্ছে। লতিফা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফরিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘খালাম্মা,আপনি চিল্লাইয়েন না। আপনের ক্ষতি হইবো।’
ফরিনা শ্বাসকষ্ট রোগীর মতো ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে বললেন, ‘আমার ক্ষতি হওনের আর কী আছেরে লুতু!’
লতিফা ভয় পেয়ে যায়। ফরিনা বিরতিহীন ভাবে কাশছেন। যেন শ্বাস নিতে পারছেন না। সে দৌড়ে দুই তলায় ছুটে যায় পদ্মজাকে আনতে। ফরিনা ছাদের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে হা করে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিলেন। মনে হচ্ছে দম গলায় এসে আটকে গেছে। তিনি শূন্য! একেবারে ফাঁকা কোল! মজিদ হাওলাদার নামক নরপিশাচ তার নিষ্পাপ বাবুকে খুন করে,নিষ্পাপ বাবুর মনকে খুন করে বাঁচিয়ে রেখেছে হিংস্র আমিরকে! হাওলাদার বাড়ির রক্ত থেকে তিনি তার বাবুকে পরিষ্কার রাখতে পারেননি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলে আসা পাপের পাহাড় আমির যেন কয়েক বছরে কয়েকগুণ বড় করে তুলেছে! একজন দুঃখী মায়ের শেষ সম্বল হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ভালোবাসারা,চলছে শুধু অভিনয়! যার কাছেই সেই অভিনয় ধরা পড়বে,তার জায়গা বন্দি ঘরে নয়তো কবরে।
বাতাসটাতে বোধহয় প্রকৃতি বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। পদ্মজার বুক জ্বলছে। বুকের ভেতরটা তীব্র দহনে পুড়ে যাচ্ছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তারই ভালোবাসার স্বামী! আমির হাওলাদার! আমিরের হিংস্র চোখ দুটি শিথিল হয়ে ভয়ে, আতঙ্কে জমে যায়। মস্তিষ্ক মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যায়। হুট করে পদ্মজাকে দেখে তার চোখ দুটি স্বভাবসুলভ কারণে জ্বলজ্বল করে উঠে। যা হিংস্র দেখায়। কিন্তু এই মুহূর্তে তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে! হাত থেকে বেল্ট পড়ে যায়। আড়চোখে বিবস্ত্র মেয়েগুলোকে একবার দেখে,তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। এ কোন সময়ে পদ্মজার উপস্থিতি! পদ্মজার গাল বেয়ে জল মেঝেতে পড়ে। আমির দ্রুত পায়ে পদ্মজার কাছে আসে। পদ্মজাকে ছুঁতেই পদ্মজা ছ্যাঁত করে উঠল। ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় আমিরের দিকে। আমির জোর করে পদ্মজাকে তুললো। পদ্মজা জোরে জোরে কাঁদতে থাকলো। সে দুই হাতে ধাক্কা দেয় আমিরকে। কিন্তু এক চুলও দূরে সরাতে পারেনি। আমির পদ্মজা দুই হাত পিঠের দিকে নিয়ে নিজের এক হাতে চেপে ধরে। অন্য হাতে পদ্মজার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, ‘কিছু দেখোনি তুমি।’
তারপর উচ্চস্বরে কাউকে ডাকলো, ‘আরভিদ,আরভিদ! দ্রুত মেয়েগুলোকে ঢেকে দাও।’
আমিরের ডাক শুনে সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে একজন দৌড়ে আসে। দেখতে শ্বেতাঙ্গদের মতো। লাল চুল। তার হাতে কাপড়। সে দরজা পেরিয়ে মেয়েগুলোকে ঢেকে দিতে যায়। পদ্মজা কপাল দিয়ে আমিরের বুকে আঘাত করে আর্তনাদ করে বললো, ‘ছাড়ুন আমাকে। আমার ঘেন্না হচ্ছে আপনাকে। কত নিকৃষ্ট আপনি!’
আমির বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। আচমকা ঘটনায় সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। পদ্মজা ধ্বস্তাধস্তি শুরু করে। তার সারা শরীরে যেন পোকারা কিলবিল করছে। মেয়েগুলোর মধ্য থেকে একজন মেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো, ‘আপা আমরারে বাঁচান। এই লোকটা আমারারে মাইরা ফেলব।’
আরভিদ নামের শ্বেতাঙ্গ লোকটি চোখের পলকে মেয়েটির গালে থাপ্পড় বসালো। মেয়েটি আম্মা বলে কেঁদে উঠে। পদ্মজার বুকের হাড়ে,হাড়ে কাঁপন ধরে। এসব কী হচ্ছে! কেন হচ্ছে! সব দুঃস্বপ্ন হয়ে যাক! হয়ে যাক! পদ্মজা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘ছাড়ুন আমাকে।’
আরভিদের থেকে পাওয়া কাপড়ের একটু অংশ বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে, একটা মেয়ে পদ্মজাকে দেখছে। পদ্মজাকে দেখে মেয়েটার মনে হচ্ছে এই মানুষটা ভালো। এখানের সবার মতো খারাপ না। তাই সে অনুরোধ করে বললো, ‘আমাদের বাঁচান আপা। আমাদের অনেক মারে ওরা।’
আমির কিছুতেই পদ্মজাকে হটাতে পারছে না। যেন জায়গায় জমে আছে। মেয়েটির কথা শুনে আমিরের মাথার রক্ত টগবগ করে উঠে। সে তার রক্তচক্ষু দিয়ে ভয় দেখালো। আরভিদ মেয়েটির পেট বরাবর লাথি মারে। মেয়েটি কুঁকিয়ে উঠে কাপড়ের অংশ থেকে দূরে সরে গিয়ে দেয়ালের সাথে গিয়ে ধাক্কা খেলো। নগ্ন দেহটি দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়েই মেঝেতে পড়ে গুটিয়ে যায়। সেই গুটিয়ে যাওয়া দেহটির উপরই আরভিদ আরেকটা লাথি বসায়। মেয়েটা চিৎকার অবধি করতে পারলো না! নির্মম,পাশবিক অত্যাচার পদ্মজাকে হিংস্র করে তুললো। সে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে আমিরকে দূরে সরিয়ে দিল। আমিরের খেয়াল ছিল মেয়েগুলোর দিকে, তাই সহজেই ছিটকে যায়। পদ্মজা মেঝে থেকে তুলে নিলো ছুরি। আরভিদ কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই পদ্মজা তেড়ে এসে মুখ দিয়ে অদ্ভুত উচ্চারণ করে আরভিদকে আঘাত করলো। আরভিদের পরনে ঘন জ্যাকেট ছিল। তাই তার বেশি আঘাত লাগেনি।তবে সে আকস্মিক আক্রমণে ঘাবড়ে যায়। পদ্মজাকে আঘাত করতে চায়,আমির চেঁচিয়ে উঠলো, ‘আরভিদ, থামো।’
আরভিদ থামলেও পদ্মজা থামলো না। সে আবার আঘাত করতে উদ্যত হয়, ধরে ফেললো আমির। পদ্মজা হিংস্র বাঘিনীর মতো ফোঁস,ফোঁস করতে থাকে। তার শরীর কাঁপছে ক্রোধে। পদ্মজার রাগ দেখে আমির প্রচণ্ড অবাক হয়। পদ্মজার রাগ সে কোনোদিন দেখেনি! ফ্রান্স থেকে তারা অনেক যন্ত্রপাতি আনে। তার মধ্যে একটি পদ্মজার হাতের ছুরি। যে ছুরির ধার বিষের চেয়েও ধারালো। সে ছুরি পদ্মজার হাতে! আমির জোরদবস্তি করে পদ্মজার হাত থেকে ছুরি ফেলে দিলো। মেয়েগুলো ভয়ে কাঁপছে। তারা এখন পদ্মজাকেও ভয় পাচ্ছে। এতো সুন্দর মেয়ের তেজি রূপ দেখে মনে হচ্ছে, হাজার বছর ধরে যুবতিদের রক্ত দিয়ে গোসল করে সৌন্দর্য রক্ষা করা এক ভয়ংকর সুন্দরী ডাইনি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমির পদ্মজাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে। পদ্মজা হাত পা ছুটাছুটি করছে। চিৎকার করছে। দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল আরেকজন লোক। তার চুলগুলো মেয়েদের মতোন অনেক লম্বা,তবে ফর্সা। এতো চেঁচামিচি শুনেও ভেতরে যায়নি। কারণ, আমির না বললে তারা এক পাও নড়ে না। আমির পদ্মজার সাথে ধ্বস্তাধস্তি করতে করতে বললো, ‘মেয়েগুলোকে সামলাও,দ্রুত যাও। আরভিদকে সাহায্য করো।’
লোকটি আমিরের আদেশমতো চলে গেলো। পদ্মজা নিজের কান দুটি বিশ্বাস করতে পারে না। তার স্বামীর কণ্ঠে এ কি শুনছে সে! বুকের জ্বালাপোড়া বেড়ে চলেছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার! আমির পদ্মজাকে একটা ঘরে নিয়ে আসে। পদ্মজা নিজের মধ্যে নেই। সে কিড়মিড় করছে,কাঁদছে। আমির পদ্মজাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দ্রুত চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেললো। তখন পদ্মজার সুযোগ ছিলো আমিরকে ধাক্কা মেরে পালানোর চেষ্টা করার। কিন্তু সে পারেনি! সে কার থেকে পালাবে? নিজের স্বামীর থেকে? যাকে সে ভালোবাসে। যে মানুষটা তাকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ায়। খাইয়ে দেয়। শতশত আবদার পূরণ করে! পদ্মজা ডুকরে কেঁদে উঠলো। এক হাতের উপর কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আমি মেনে নিতে পারছি না।’
আমির পদ্মজার চেয়ে কিছুটা দূরে চেয়ার নিয়ে বসলো। তার চোখেমুখে আতঙ্ক! সে চেয়ে রইলো পদ্মজার দিকে। পদ্মজা চোখ তুলে তাকায়। আমিরের চোখে চোখ পড়ে। সে ঠোঁট দুটি ভেঙে কেঁদে বললো, ‘আপনি আমাকে বাঁধতে পারলেন?’
আমির কিছু বললো না। পদ্মজা বললো, ‘আপনি ওভাবে মেয়েগুলোকে মারতেও পারলেন?’
আমির আগের অবস্থানেই রইলো। পদ্মজা নাক টেনে বললো, ‘এতো খারাপ আপনি? এতো বেশি! মেয়েগুলোকে কেন মারছিলেন?’
আমির শুধু চেয়েই আছে। পদ্মজা বললো, ‘এতো নিষ্ঠুর আপনি? সব দুঃস্বপ্ন হতে পারে না?’
আমির পদ্মজার প্রশ্ন উপেক্ষা করে বললো, ‘রিদওয়ান কোথায়?’
পদ্মজা কান্না থামিয়ে হাসলো। ধারালো সেই হাসি। ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো, ‘আমাকে পাহারা দিতে রেখেছিলেন? মারতেও কি বলেছিলেন?’
‘যা বলছি উত্তর দাও।’
পদ্মজা সেকেন্ড কয়েক আমিরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর বললো, ‘মেরে দিয়েছি।’
আমির চমকে উঠলো, ‘কি!’
‘মরেনি। হাসপাতাল আছে।’
আবারও পিনপতন নীরবতা। পদ্মজা আমিরকে দেখছে। যে মুখে মায়া ছাড়া কিছু দেখতো না সে,আজ সে মুখটাই চিনছে না। বুকের ভেতরটা কেমন করছে! আল্লাহ যেন বুকের ভেতর জাহান্নামের আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পদ্মজার মস্তিষ্কের সব প্রশ্ন উধাও হয়ে গিয়েছে। শুধু দেখছে আমিরকে, ভাবছে আমিরকে নিয়ে। পদ্মজা ম্লান হেসে জানতে চাইলো, ‘এখন কী করবেন আমাকে নিয়ে? বুকে ছুরি চালাবেন? নাকি রাম দা? মারার জন্য আর কিছু কি আছে?’
আমির নিশ্চুপ। সে নিজেও জানে না সে কী করবে! পদ্মজা বললো, ‘ পশুরা কাউকে ভালোবাসে?’
আমির মুখ খুললো, ‘বাসে বোধহয়।’
পদ্মজা হাসলো। হাসতে হাসতে চেয়ারে হেলান দিল। তারপর আবার সোজা হয়ে বসলো। গুরুতর ভঙ্গিতে বললো, ‘মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন।’
‘অসম্ভব।’
‘আমি ঠিক ছাড়িয়ে নেব।’
‘আর কিছু করো না।’
‘কী করবেন? খুনই তো।’
‘একটু ভয়ডর ঢুকাও মনে।’
‘বিশ্বাস করুন,আপনার বুকে ছুরি চালাতে আমার খুব কষ্ট হবে।’
আমির চকিতে তাকালো। পদ্মজা কথাটা বলে কাঁপতে থাকলো। নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! কী বলাচ্ছে! এই কথাটা সে মন থেকে বলেনি। সে কিছুতেই এমন কথা বলেনি! আমির নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘ভালোই তো ছিলাম আমরা!’
‘মুখোশধারীর সাথে আবার ভালো থাকা!’
‘একদম মায়ের মতো হয়েছো।’
‘নিঁখুত অভিনেতা!’
‘বাধ্য হয়ে।’
‘কে করেছে বাধ্য আপনাকে?’
‘তোমার আদর্শ। তোমার পবিত্রতা।’
‘আপনি কলুষিত করেছেন।’
‘বিয়ে করেছি।’
‘কেন করেছেন? ভোগ করে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতেন। তাহলে ভালোবেসে আজকের নরকীয় যন্ত্রণাটা সহ্য করতে হতো না।’
‘সব ভুলে যাও। রানির হালে থাকবে।’ আমিরের কণ্ঠে জোর নেই। সে পদ্মজাকে চিনে। পদ্মজাকে সে এতদিন অন্ধকারে রাখলেও,পদ্মজা তাকে আলোতে রেখেছিল। সেই আলো দিয়ে আমির চিনতে পেরেছে পদ্মজাকে। পদ্মজা অন্যায় মেনে নেয়ার মেয়ে নয়। কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে। আজও পদ্মজা জানতে পারতো না কিছু,যদি সে ঝড়ের কবলে না পড়তো! গুটি ওলটপালট হয়ে গেছে! এরেই বোধহয় বলে চোরের দশদিন,গৃহস্থের একদিন।
পদ্মজা ছলছল চোখে আমিরকে দেখে। সে চোখের সামনে সবকিছু দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সর্বাঙ্গে যে কষ্টটা হচ্ছে,শরীর থেকে রুহ বের হয়ে যাওয়ার সময়ও বোধহয় তেমন কষ্ট হয় না। পদ্মজা ঝরঝর করে কেঁদে দিল। এ কেমন নিয়তি তার! যতক্ষণ সে সামনে থাকে ততক্ষণ প্রেমের কথা বলা মানুষটা তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে ঠান্ডা মাথায় ভাবছে,তাকে নিয়ে এখন কী করা যায়! পদ্মজা তার হাতের চুড়িগুলো দিকে তাকালো। চুড়ি দুটো তার মায়ের। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে! এই পৃথিবীতে তার একমাত্র ছায়া,একমাত্র ভরসার স্থান ছিল তার মা! মা মারা গেল। তারপর সেই স্থানটা পরিবর্তন হলো আমিরের নামে। সেই মানুষটার রূপ এভাবে গিরগিটির মতো পাল্টে গেল! না,পাল্টে যায়নি। এমনই ছিল। শুধু মুখোশ পরে ছিল। ছদ্মবেশী!
মেয়েগুলোর চিৎকার ভেসে আসে। তাদের অত্যাচার করা হচ্ছে খুব। কিছু একটা দিয়ে পিটাচ্ছে,ফ্যাচফ্যাচ শব্দ হচ্ছে। কোন বাবা-মায়ের চোখের মণিদের এভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে! পদ্মজা চিৎকারগুলোকে ইঙ্গিত করে বললো, ‘আপনার কষ্ট হয় না? একটুও হয় না?
আমিরের ভাবান্তর হলো না। সে চিন্তায় মগ্ন। তার ছক উল্টে গেছে। এমন এক জায়গা এসে ছক উল্টেছে যে আর ঠিক করার উপায় নেই। নতুন করে সাজালে সেখান থেকে হয় পদ্মজা নয় এতো বছরের পাপের সাম্রাজ্য ত্যাগ করতে হবে! তুখোড় আমির মনে মনে পরিকল্পনা করলো, আপাতত,যে কাজের জন্য তার ছুটে আসতে হয়েছে অলন্দপুরে সে কাজটা সম্পন্ন করতে হবে। এই চাপটা মাথার উপর থেকে গেলে তারপর অন্যকিছু। কয়টা দিন পদ্মজাকে নজরে রাখতে হবে। কিন্তু যদি,সেই কাজ করার পথেই পদ্মজা দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়!
পদ্মজা চেয়ার থেকে ছুটতে চাইছে। ছটফট করছে। সে আমিরকে অনুরোধ করলো, ‘শুনছেন আপনি, ওদের মারতে নিষেধ করুন। আপনার বুক কাঁপছে না? ওদের কান্না অনুভব করুন। ওদের কষ্ট হচ্ছে অনেক। পুরো…পুরো শরীরে রক্ত ছিল। তার উপর আবার মারছে। আমি সহ্য করতে পারছি না।’
আমির চুপ করে তাকিয়ে আছে পদ্মজার দিকে। তার চোখের পলক পড়ছে না। চাইলেও আর অজুহাত দেয়া সম্ভব নয়। অজুহাত দেয়ার মতো কিছু নেই। এবার যা হবে সরাসরি হবে। পদ্মজার কান্না বেড়ে যায়। পদ্মজা কি মেয়েগুলোর জন্য কাঁদছে নাকি নিজের স্বামীর সমর্থনে মেয়েগুলো অত্যাচারিত হচ্ছে বলে কাঁদছে? কে জানে।
৬৪
সময় নিজের গতিতে ছুটতে,ছুটতে মাঝরাত অবধি চলে এসেছে। সেই তখন থেকে আমির পাথরের মতো বসে আছে। কথাও বলছে না,যাচ্ছেও না। পদ্মজা হাজারটা প্রশ্ন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
তার গলা শুকিয়ে গেছে। আমির মাঝে শুধু একটা অনুরোধ রেখেছে পদ্মজার। পদ্মজা বলেছিল, সে যে আমিরের কাছে আছে সেটা যেন ফরিনাকে জানানো হয়। তিনি খুব অসুস্থ। চিন্তা করবেন। আমির পদ্মজার এই অনুরোধ রাখে। তবে ফরিনা এতো অসুস্থ শুনেও তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। ঘন্টা দুয়েক পূর্বে আচমকা মেয়েগুলোর কান্না,আর্তনাদ বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েগুলোকে কেন এভাবে মারা হচ্ছে তাও আন্দাজ করতে পারছে না পদ্মজা। একবার মনে উঁকি দিয়েছিল, নারী পাচারের কথা। কিন্তু সেই সন্দেহ ধরে রাখতে পারলো না। কারণ, পাচার করার উদ্দেশ্যে থাকলে এভাবে মারতো না। পাশবিক নির্যাতন করতো না। এছাড়া সে এটাও আন্দাজ করতে পারছে না এতো রহস্যের উদ্দেশ্য কী? শুধু এতটুকু বুঝতে পারছে, তার দেখা সব খারাপের গুরু তার স্বামী! পদ্মজা তার ক্লান্ত ঘোলা চোখ দুটি আমিরের দিকে তাক করে দূর্বল কণ্ঠে বললো, ‘এভাবেই বেঁধে রাখবেন? মেরে ফেলার পরিকল্পনা থাকলে মেরে ফেলুন না।’
পদ্মজা ভেবেছিল আমির বোধহয় উত্তর দিবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আমির বললো, ‘তোমার কেন মনে হচ্ছে তোমাকে মেরে ফেলা হবে?’
‘কেন? কখনো কাউকে খুন করেননি? অভিজ্ঞতা নেই?’ তাচ্ছিল্যের সাথে বললো পদ্মজা।
আমির শান্ত স্বরে বললো, ‘অন্যরা আর তোমার মধ্যে পার্থক্য আছে।’
পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘মানে,অন্যদের খুন করেছেন?’
আমির জবাব দিল না। পদ্মজা উত্তেজিত হয়ে পড়লো, ‘কাকে করেছেন? কয়জনকে করেছেন? আবদুল ভাইকে কি আপনি মেরেছিলেন?’
আমির চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললো, ‘না।’
‘তাহলে কাকে?’
‘এতো কথা কেন বলছো?’
‘মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন। কী লাভ ওদের মেরে,আটকে রেখে?’
আমির চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে চলে গেল। পদ্মজার বুকের ভেতর হাহাকার লেগে যায়। বুকের আগুনটাকে চেপে ধরে ভাবে, তাকে স্বাভাবিক হতে হবে। মেয়েগুলোকে নিয়ে কী হচ্ছে,কেন হচ্ছে,কী কাজ চলে এখানে সেটা জানতে হবে। তারপর তার স্বামীর সাথে বোঝাপড়া হবে। কথাগুলো ভেবে পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তখন একটা হুল্লোড় কানে আসে। অনেকগুলো মেয়ের আকুতি! আবার মারছে! না মারছে না। মেয়েগুলোর কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে তারা বাম দিকে আছে। আর দশ-বারো জন একসাথে আছে! তবে কি এরা অন্য দল? এখানে আরো মেয়ে আছে? পদ্মজা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো। আমিরের কণ্ঠ ভেসে আসছে। সে মেয়েগুলোকে খাওয়ার জন্য বলছে। তারপর একজনকে আদেশস্বরে বললো, ‘রাফেদ,দেখো এরা যেন ঠিক করে খায়। আর সবার বাঁধন একসাথে খুলে দিবে না। একজন একজন করে খুলবে। আর চেঁচামিচি যেন না করে। খাওয়া শেষ হতেই হাত,মুখ বেঁধে ফেলবে। আমি আরভিদকে পাঠাচ্ছি। আরভিদ কোথায়?’
উত্তরে আরেকটি পুরুষ কণ্ঠ কি বললো,পদ্মজা বুঝতে পারলো না। সেই পুরুষ কণ্ঠটি ছাপিয়ে একটি মেয়ের কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘ভাই আমারে ছাইড়া দেন। আমার কয়দিন পর বিয়া। অনেক কষ্টে আমার বাপে আমার বিয়া ঠিক করছে।’
তারপর আর কোনো সাড়াশব্দ আসেনি! ঘৃণায় পদ্মজার চোখ বুজে আসে। চোখ ছাপিয়ে জল নামে। তার কিছুক্ষণ পর আমির আসলো। পদ্মজা কান্না থামিয়ে চোখমুখ শক্ত করে অন্যদিকে চেয়ে রইলো। আমির বললো, ‘খাবার আসছে। খেয়ে নাও।’
‘খাবো না।’পদ্মজার তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ।
‘বিষ দিইনি। লতিফার রান্না। খেতে পারবে।’
পদ্মজা চমকে তাকাল। আবার চোখ সরিয়ে নিল। লতিফা যে এই বাড়ির রহস্যের সাথে যুক্ত সেটা পদ্মজা আন্দাজ করতে পেরেছিল। এবার বুঝেছে লতিফার কাজ কি! আমির বললো, ‘কি হলো?’
পদ্মজা বললো, ‘আমার একটা উত্তর দিন।’
‘তোমার তো প্রশ্নের অভাব নেই। ‘
‘এখানে আরো মেয়ে আছে? আপনার কি নারী ব্যবসা আছে?’
শেষ প্রশ্নটা করার সময় পদ্মজার কণ্ঠ কাঁপে। আমির শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো, ‘খাবে নাকি সেটা বলো?’
‘আপনি আমাকে হারাম টাকায় রানি করেছিলেন?’
‘টাকা টাকাই হয়। হারাম,হালাল নেই।’
‘মুসলিম তো আপনি,নাকি?’
‘আমাদের কোনো ধর্ম নেই।’
‘কিসব বলছেন আপনি হ্যাঁ? মাথা ঠিক আছে?’ উত্তেজিত হয়ে পড়লো পদ্মজা।
‘এরকম ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদার স্বভাব তো তোমার ছিল না।’
‘মন আছে আপনার? পৃথিবীর বুকে এমন কোন নারী আছে যে ছয় বছর সংসার করার পর তার স্বামী নারী ব্যবসায়ী,খুনি,অত্যাচারী,নিকৃষ্ট জেনেও কষ্ট পাবে না,কাঁদবে না?’
‘এজন্যই তো জানাতে চাইনি। জানতে গেলে কেন?’
‘আপনি আপনার নষ্ট জীবনের সাথে আমাকে জড়ালেন কেন?’
‘নষ্ট জীবন চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম। তোমাকে তো ভালোটাই দেখিয়েছি। তুমি চাদর তুলতে গেলে কেন?’
‘এখন সব দোষ আমার তাই না? আপনি খোলস কেন পরলেন? শয়তান শয়তানের মতোই থাকতেন।’
‘নিজের জীবনকেও নরক বানালে,সাথে আমারও।’
‘মেয়েগুলোকে মেরে কী শান্তি পান? কেন মারেন? এসব করে কী লাভ? ছেড়ে দিন সবকিছু। আমরা একটা ছোট ঘরে সুখে থাকবো। আমাদের ভালোবাসাগুলো তো মিথ্যে না। আমরা তো আমাদের ভালোবাসা নিয়ে ভালো ছিলাম।’
‘মন থেকে এটা মানছো?’
‘কোনটা?’
‘আমাদের ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না।’
পদ্মজা কি বলবে ভেবে পায় না! যে মানুষটার মনে অন্যদের জন্য মায়াদয়া নেই। পশুর মতো যার আচরণ সে কী করে কাউকে ভালোবাসতে পারে? এই সমীকরণটা কিছুতেই মানাতে পারছে না সে।
পদ্মজা ভেজাকণ্ঠে বললো, ‘আপনাকে ক্ষমা করা ঠিক না। আপনাকে কোনো ভালো মানুষ ক্ষমা করবে না। কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসি। আপনি সবকিছু ছেড়ে দিন। মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন। তওবা করুন। আমরা দূরে চলে যাব। সুখে-শান্তিতে থাকবো।’
অনেক আশা নিয়ে উন্মাদের মতো কথাগুলো বললো পদ্মজা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া পদ্মজার মুখে এহেন কথা আশা করেনি আমির। তবুও সে পদ্মজার মনের মতো উত্তর দিতে পারলো না। সে পদ্মজার আশায় বালি ঢেলে দিয়ে বললো, ‘তুমি সব ভুলে যাও।’
পদ্মজার বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এই মানুষটার সর্বস্ব জুড়ে সে নেই। যদি থাকতো,সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে তাকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতো। পদ্মজার বুকের ক্লান্ত সূক্ষ্ম ব্যথাটা আবার বড় আকার ধারণ করে। আমির পদ্মজার বাঁধন খুলে দিলো। পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘খুলে দিলেন যে?’
‘খাবে,চলো।’.
‘যদি এখন পালিয়ে যাই?’
‘কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে?’
‘জানেনই যখন আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই। আপনিই আমার শেষ আশ্রয়। তাহলে ফিরে আসুন না আমার কাছে!’
‘আবার কাঁদছো।’
পদ্মজা লম্বায় আমিরের কাঁধ অবধি। সে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে আমিরের দিকে। রক্ত জবা ঠোঁট দুটি চোখের জলে ভিজে ছপছপ করছে। আমিরের চোখের দৃষ্টিতে যেন প্রাণ নেই,নিষ্প্রাণ। শীতল। পদ্মজা আচমকা আমিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আমির দুই পা পিছিয়ে যায়। পদ্মজা জোরে,জোরে কাঁদতে, কাঁদতে বললো, ‘আপনি এভাবে অচেনা হয়ে যাবেন না। আমি বেঁচে থেকেও মরে যাবো। আমার ভালোবাসাকে এভাবে পর করে দিবেন না। আপনার মনে আছে, একবার আমি রাগ করে দুই দিন কথা বলিনি। তখন আপনি বলেছিলেন, আমাকে এভাবে অচেনা হতে দেখে আপনার কষ্ট হচ্ছে। ভালোবাসার মানুষের অচেনা রূপের মতো ভয়ানক কষ্ট দুটো নেই। এখন আমার সেই ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। আপনি আমাকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন? আমি সব ভুলে যাবো। আপনি ভালো হয়ে যান। মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন। ধ্বংস করে দিন আপনার সব পাপের চিহ্ন।’
আমির এক হাত রাখে পদ্মজার মাথার উপর। পদ্মজা অশ্রুভরা চোখে তাকায়। আমির পদ্মজার চোখের জল মুছে দিয়ে বললো, ‘গালে ব্যথা পেয়েছো কী করে?’
‘এতক্ষণে দেখেছেন?’
‘না।’
‘সেদিন জঙ্গলে এসেছিলাম। কাঁটা লেগেছিল। তারপর…’
‘রিদওয়ান মেরেছিল?’
‘হু।’
‘কেন আসতে গেলে? সাধারণ দুনিয়ার বাইরেও মানুষের বানানো আরেক জগত থাকে। সেই জগতে পবিত্র মানুষদের ঢুকতে নেই।’
‘ভেঙে ফেলুন সব।’
‘নিজের হাতে যত্ন করে করা সাম্রাজ্য ভাঙা যায় না।’
‘পাপের সাম্রাজ্য ধরে রেখে কেন পাপ বাড়াবেন? আমাদের ভালোবাসাকে কেন বলি দিবেন?’
‘আমার রক্ত ভালো না। কেউ আমাকে পশু বললে,আমার আনন্দ হয়।’
‘তাহলে আপনি ছাড়বেন না কিছু?’
‘না।’
পদ্মজা নিরাশ হয়ে বসে পড়ে চেয়ারে। আমির বললো, ‘খাবে নাকি খাবে না?’
‘আমি এখানে খেতে আসিনি!’
‘তাহলে না খেয়েই থাকো।’
পদ্মজা চুপ থাকে। নিজের মস্তিষ্ককে শান্ত করার চেষ্টা করে। খেয়েদেয়ে সুস্থ থাকতে হবে। মেয়েগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। এখন নিজেকে এভাবে ভেঙে যেতে দেওয়া যাবে না। সে লম্বা করে বার কয়েকবার নিঃশ্বাস নিল। তারপর বললো, ‘খাবো।’
আমির বের হয়ে যায় সেদিন রাতে আর ফিরে আসেনি। মেয়েদের মতো সিল্কি লম্বা চুলের লোকটি খাবার নিয়ে আসে। তার নাম রাফেদ। পদ্মজা যতক্ষণ খায়,দাঁড়িয়ে থাকে। পদ্মজার খাওয়া শেষ হতেই রাফেদ পদ্মজাকে বাঁধতে চাইলো,তখন পদ্মজা প্রশ্ন করলো, ‘উনি কোথায়? আপনি কেন বাঁধছেন?’
‘বাইরে গিয়েছেন। আমাকে বলেছেন,আপনার খাওয়া শেষ হলে বেঁধে রাখতে। ‘
‘কী করতে গিয়েছে?’
‘এতসব বলতে পারব না। স্যার অনেক রাগী। স্যারকে রাগাবেন না। যা বলবে মেনে নিবেন।’
‘আপনার স্যার তো আমাকে ভয় পায়। আমার কথায় সারাক্ষণ এই ঘরে ছিল। ভয়ে কেঁপেছেনও। বিশ্বাস করুন।’
রাফেদ হাসলো। এই হাসিকেই বোধহয় বলে শয়তানের মতো হাসা।
‘মজা করছেন?’
‘আচ্ছা, ওই সাদা খরগোশটা কোথায়?’
‘খরগোশ?’
‘ওইযে,সাদা দেখতে। আরদিদ বা এরকম কোনো নাম।’
‘তা জেনে আপনি কী করবেন? ‘ রাফেদ এগিয়ে আসে বাঁধার জন্য। পদ্মজা আড়চোখে কিছু একটা খুঁজে। কিন্তু রাফেদকে আক্রমণ করার মতো কিছু পেল না। ঘরে কিছু বলতে দুটো চেয়ারই আছে। চেয়ার গুলো কি খুব ভারী? একবার চেষ্টা করে দেখা উচিত। পদ্মজা দুই পা পিছিয়ে যেয়ে বললো, ‘আপনাদের বাড়িটা অনেক সুন্দর। পাতালে বাড়ি আমি কখনো দেখিনি। একটু ঘুরে দেখি? আমার উনি বানিয়েছেন তাই না?’
‘এটা স্যারের বানানো না।’
‘তাহলে কার?’
রাফেদ পদ্মজার ন্যাকামি বুঝে যায়। সে তেড়ে আসে। পর পুরুষের সাথে ধস্তাধস্তিতে পদ্মজার মন সায় দিচ্ছে না। এখান থেকে পালালেও বাইরে আরেক শয়তান আছে। পালিয়েও লাভ নেই। তার চেয়ে এখানে থেকেই পরিস্থিতি বোঝা উচিত। পদ্মজা দ্রুত চেয়ারে বসে পড়ে বললো, ‘ধস্তাধস্তি করবেন না। আমি বসে পড়েছি। আপনি বাঁধুন।’
রাফেদ পদ্মজাকে চেয়ারের সাথে শক্ত করে বেঁধে চলে যায়। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে। ঘরের ছাদ অনেক উঁচুতে! মনে মনে আন্দাজ করার চেষ্টা করে মাটির কতোটা নিচে আছে সে। বেশ অনেকক্ষণ পার হওয়ার পর পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। পদ্মজা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমির প্রবেশ করে। তার হাতে মলম জাতীয় কিছু। পদ্মজা কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকে। আমির পদ্মজার দিকে মলম এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘ঔষধপত্র নিয়ে আসা উচিত ছিল।’
‘আমি কি জানতাম নাকি, এখানে আমার বর শয়তানের রাজত্ব নিয়ে বসে আছে?’
‘খুব কথা বলছো।’
‘মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন।’
‘এক কথা বার বার বলো না।’
‘আমাকে ভালোবাসেন না?’
পদ্মজা তার মায়াময় দৃষ্টি দিয়ে আবিষ্কার করে আমিরের চোখে প্রাণ এসেছে! সঙ্গে,সঙ্গে পদ্মজার মনের জানালার পাল্লা খুলে গিয়ে মুঠো,মুঠো বাতাস প্রবেশ করে। অশান্তিতে অবশ হয়ে যাওয়া মন,মুহূর্তে চাঙ্গা হয়ে উঠে। আমির পদ্মজার প্রশ্নের জবাবে কিছু বললো না। হাতের বস্তুটি পদ্মজার পায়ের কাছে রাখলো। তারপর পদ্মজার বাঁধন খুলে দিয়ে বললো, ‘গালে,পায়ে লাগিয়ে নিও। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করো না।’
বলেই সে বেরিয়ে যায়। দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়। পদ্মজার চাঙ্গা হয়ে যাওয়া মনে আবার মেঘ জমে। সে মেঝেতে ‘দ’ ভঙ্গিতে বসে পড়ে।
.
বর্তমান।
পদ্মজার কান্না যেন থেমে থেমে চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তুষার কথা বলতে গেল, কিন্তু ফুটল না। পদ্মজার বিষাদভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। পদ্মজা দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলো। মেয়েটার কান্না রোগ বোধহয় সেদিন থেকেই হয়! যেদিন জানলো তার স্বামীর আসল পরিচয়। তুষার থামতে বললো না। পদ্মজাকে কাঁদতে দিল। অনেকক্ষণ কাঁদার পর পদ্মজা পানি খেতে চাইলো। তাকে পানি দেওয়া হলো। তারপর চুপ হয়ে যায়। নেমে আসে পিনপতন নিরবতা। যতক্ষণ না তুষার আর প্রশ্ন করবে পদ্মজা কিছু বলবে না। তাই তুষার নিরবতা ভেঙে বললো, ‘তার অন্যায় জেনেও তাকে মাফ করতে চেয়েছিলেন। রাতের এইটুকু শুনে তো মনে হচ্ছে না, আপনি আমির হাওলাদারকে কখনো খুন করতে পারেন। পাগলের মতো ভালোবেসেও তার বুকে ছুরি চালানোর সাহস হলো কী করে?’
পদ্মজা তুষারের উৎসুক মুখটার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। ফিসফিসিয়ে বললো, ‘মুক্তি দিয়েছি,মুক্তি!’
‘আপনার বর্ণনা অনুযায়ী আপনার প্রতি আমির হাওলাদারের ব্যবহার নরম ছিল। তিনি আপনার প্রতি দূর্বল ছিলেন।’
পদ্মজা উদাসীন হয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর বললো, ‘দূর্বল ছিল নাকি!’
‘আমার তো তাই মনে হচ্ছে।’
‘আমি উনাকে খুব ভালোবাসি স্যার।’ পদ্মজার কণ্ঠটা কেমন শোনায়! সে তার স্বামীকে খুন করে এসে জেলে বসে তার জন্যই কাঁদছে। কি অবাক কাণ্ড! তুষার বললো, ‘আপনার ভাষ্যমতে তিনি একজন শয়তান ছিলেন। শয়তানকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজেকে পাপী মনে হয়নি?’
‘হয়েছে।’
‘তাহলে সেটা কী করে ভালোবাসা হলো?’
পদ্মজা কাঁদতে থাকলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘যখন কাউকে ভালোবাসবেন তখন বুঝবেন। ভালবাসায় দোষ-গুণের স্থান নেই। ভালবাসা শুধুই ভালবাসা। ভালোবাসা গুণী-খুনী,পাপ-পুণ্যের ভেদাভেদ করে না।’
তুষারের মনে হচ্ছে তার বুকে যেন একটা বড়সড় পাথর। আমিরের প্রতি পদ্মজার ভালোবাসার তীব্রতা তাকে কাতর করে তুলেছে। বার বার মনে হচ্ছে, সেই মানুষটাও বোধহয় পদ্মজাকে ভালোবাসতো। কিন্তু পাপ তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। সে কি কখনো পাপ থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেছিল? প্রশ্নটা তুষারের মনে আসতেই তার উত্তেজনা বেড়ে যায়। পদ্মজাকে প্রশ্ন করে, ‘তিনি কি পাপ থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেছিলেন? তারপর আর ভালোবেসেছিলেন আপনাকে?’
তুষারের প্রশ্নে পদ্মজা থম মেরে গেল। শূন্যে দৃষ্টি রেখে আওড়াল, ‘চেষ্টা কি করেছিলেন? করেছিলেন কি?’