আমি পদ্মজা – ৫০

৫০

সুনসান নিরবতা চারিদিকে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। পদ্মজা

তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছে কখন রুম্পা চোখ খুলবে। বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। দরজায় কেউ টোকা দিতেই পদ্মজা সাবধান হয়ে গেল। রুম্পার নিরাপত্তা নিয়ে তার মন অস্থির হয়ে আছে। সে গম্ভীরকণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কে কে ওখানে?’

‘আমি।’

আমিরের কণ্ঠ শুনে পদ্মজা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর দরজা খুলল। আমিরের চুল এলোমেলো। ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সে পদ্মজাকে দেখে বলল, ‘ঘুম ভেঙে গেল। তোমাকে মনে পড়ছে।’

‘আমি তো এখন যেতে পারব না।’

‘আমি থাকি তাহলে।’ আমিরের নির্বিকার কণ্ঠ।

পদ্মজা চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘শীতের রাতে মাটিতে থাকবেন? রুম্পা ভাবি বিছানায় ঘুমাচ্ছে। এই ঘরে থাকলে মাটিতেই থাকতে হবে। ঘরে যান।’

‘মাটিতেই থাকব।’

‘ধুর! আপনি সবসময় ঘাড়ত্যাড়ামি করেন। আপনাকে তো আমি বলে এসেছি কতোটা দরকার রুম্পা ভাবির সাথে থাকা।’

‘গত দিনও বোনদের সাথে ছিলে। আজ রুম্পা ভাবির সাথে।’

‘কয়টা দিনই তো। আজীবন একসাথেই থাকব।’

‘আচ্ছা যাচ্ছি,এখনও ঘুমাওনি কেন?’

পদ্মজা একবার রুম্পাকে দেখে নিয়ে বলল, ‘এইতো ঘুমাব।’

আমির চারপাশ দেখে বলল, ‘আর,সাবধানে থাকবে। রিদওয়ান দোতলায় ঘুরঘুর করছে। ভয় পাবে না। আমি আছি।’

পদ্মজা চিন্তিত আমিরের চোখের দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনি আমার সাথে থাকতে নয়,দেখতে আসছেন আমি ঠিক আছি নাকি তাই না? ভয় পাবেন না তো একদম।’

আমির দুই হাতে পদ্মজার দুই গাল ধরল, ‘আমি তো জানি আমার পদ্মবতী কতোটা সাহসী! এজন্যই এই বাড়িতে আসার সাহস করতে পেরেছি।’

‘আহ্লাদ হয়েছে? এবার যান।’

আমির হেসে চলে গেল। পদ্মজা অনেকক্ষণ অন্ধকার বারান্দায় তাকিয়ে রইল। এরপর দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমিরকে সে কতোটা ভালোবাসে সে নিজেও জানে না! আমিরের প্রতিটি স্পর্শ,কথায় ছন্দে হৃদয় স্পন্দিত হয়। আমিরের পাগলামি,খেয়াল রাখা,দায়িত্ববোধ সবকিছু পদ্মজাকে মুগ্ধ করে। একজন আদর্শ স্বামী বোধহয় একেই বলে। আমিরের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন সে ঘুমিয়ে পড়ল। ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে ভাবা সময়টা জাদুর মতো। চোখের পলকে নির্ঘুম রাত কেটে যায় নয়তো নিজের অজান্তে আবেশে ঘুম চলে আসে।

সকালে উঠেই পূর্ণাকে গিয়ে ডেকে তুলল পদ্মজা। এরপর রুম্পার ঘরে এসে নামায পড়ল। কোরঅান পড়ল। রুম্পার ঘুম আরো কিছুক্ষণ পর ভাঙে। রুম্পাকে ধরে ধরে টয়লেটে নিয়ে যায় পদ্মজা। এরপর রুম্পাকে রেখে রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে যায়। ফরিনা মাত্র চুলা থেকে খিচুড়ি নামিয়েছেন।

‘আম্মা,ভাবির জন্য খিচুড়ি নিয়ে যাই?’ বলল পদ্মজা।

ফরিনা হেসে বললেন, ‘এইডা আবার কওন লাগে। লইয়া যাও। তুমি খাইবা কুনসময়?’

‘ভাবিকে খাইয়ে এসে তারপর উনাকে নিয়ে খাব। আম্মা,রাতের হাঁসের মাংস আছে না?’

‘হ আছে তো। ওইযে ওই পাতিলডায়।’

পদ্মজা গরম গরম খিচুড়ি হাঁসের মাংসের ভুনা দিয়ে নিয়ে আসে। ঘরে ঢুকে দেখল,রুম্পা মেঝেতে পড়ে আছে। পদ্মজা থালা বিছানার উপর রেখে রুম্পাকে তোলার চেষ্টা করে। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘ভাবি মেঝেতে পড়লেন কীভাবে?’

রুম্পা কিছু বলছে না। সে উদ্ভ্রাটের মতো ছটফট করছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। পদ্মজাকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। পদ্মজা খুব বিস্মিত। রুম্পা এমন করছে কেন? সে রুম্পাকে প্রশ্ন করেই চলেছে, ‘কেউ এসেছিল ঘরে? কে এসেছিল? ভয় দেখিয়েছে? ভাবি…ভাবি বলো আমাকে। ভাবি…ধাক্কাচ্ছো কেন? আমি তোমার জন্য খাবার এনেছি।’

খাবারের কথা শুনে রুম্পা থমকে গেল। পদ্মজার দিকে এক নজর তাকিয়ে বিছানার দিকে তাকাল। ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের উপর। এতো গরম খাবার গাপুসগুপুস করে খেতে থাকল। পদ্মজা বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। এমনভাবে রুম্পা খাচ্ছে যেন আর কোনোদিন খাওয়া হবে না। সুযোগ আসবে না। পদ্মজা পানি এগিয়ে দিল। রুম্পা অল্প সময়ের ব্যবধানে পুরো থালার খিচুড়ি এবং এক বাটি হাঁসের মাংস ভুনা খেল।

খাওয়া শেষে পদ্মজা নমনীয় কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘ভাবি আমার সাথে একটু কথা বলবেন?’

রুম্পা দূরে সরে যায়। দেয়াল ঘেঁষে বসে। মাথা দুইদিকে নাড়িয়ে ইশারা করে,সে কথা বলবে না। পদ্মজা তবুও আশা ছাড়ল না। সে রুম্পার পাশে গিয়ে বসল। রুম্পার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে আমার সাথে ঢাকা নিয়ে যাব। যাবে?’

রুম্পা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল। পদ্মজাকে ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে বলল, ‘বাইর হ আমার ঘর থাইকা। বাইর হ তুই।’

রুম্পার ব্যবহারে পদ্মজা আহত হলো, ‘ভাবিই! আমি তোমার ভালো চাই।’

‘বাইর হ কইতাছি। বাইর হ।’

শীতের ঠান্ডা হিম বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকছে। শীতের দাপট বেড়েছে। এবারের শীত বোধহয় মানুষ মারার জন্য এসেছে! এতো ঠান্ডা! রুম্পার পরনে শাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। ঠান্ডায় তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। পদ্মজা রুম্পার চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করল। রুম্পার চোখ বার বার দরজার দিকে যাচ্ছে। পদ্মজা উঠে স্থির হয়ে দাঁড়াল না অবধি, ছুটে আসে দরজার কাছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুক ছুটে পালাতে চায়। পদ্মজা জোরালো কণ্ঠে ডেকে উঠল, ‘লতিফা বুবু।’

লতিফা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পদ্মজাকে দেখল। এরপর সিঁড়িভেঙে নিচে নেমে যায়। তার চোখে ভয় ছিল। একটা ঝনঝন শব্দ হয়। পদ্মজা চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। রুম্পা পাগলামি শুরু করেছে। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ঘরের জিনিসপত্র ছুঁড়ছে। পদ্মজা রুম্পাকে থামানোর চেষ্টা করে। অনেক বোঝায়। কিছুতেই রুম্পা থামে না। রুম্পার হাত থেকে স্টিলের গ্লাস পদ্মজার কপালে এসে পড়ে। পদ্মজা ‘আহ’ বলে বসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে রুম্পা পাগলামি থামিয়ে দিল। ছুটে এসে পদ্মজার আহত স্থানে হাত রাখে, উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে, ‘আমি তোমারে ইচ্ছা কইরা দুঃখ দেই নাই বইন। বেশি বেদনা করতাছে?’

আঞ্চলিক ভাষায় রিনঝিনে কণ্ঠ! পদ্মজা দুই চোখ মেলে তাকায়। রুম্পা পদ্মজার কপালের ফোলা অংশে ফু দিচ্ছে। সে ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে,পদ্মজাকে অনেক পছন্দ করে রুম্পা। মুখোশ খুলে বেরিয়ে এসেছে আসল রূপে। সে কঠিন নয়,পাগল নয়। বরং বড্ড নরম,কোমল। পদ্মজা শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কেন পাগলের অভিনয় কর ভাবি?’

রুম্পার হাত থেমে যায়। সে ধরা পড়ে গেছে।

.

কুয়াশার স্তর ভেদ করে একটা নৌকা খালে ঢুকে। নৌকা চালাচ্ছে মৃদুল। গতকাল যে ছেলেটাকে মৃদুল আন্ডা ডেকেছিল সেই ছেলেটাও নৌকায় আছে। তার ভালো নাম,জাকির। মৃদুলের সাথে বাচ্চাকাচ্চাদের অনেক খাতির। পূর্ণা খালের ঘাটে বসে ছিল। সে ফজরের নামায পড়ে,খিচুরি খেয়ে এখানে চলে এসেছে। মন খারাপের সময় ঘাটে বসে থাকতে তার ভালো লাগে। গতকাল রাতে খাওয়ার সময় মৃদুল কম হলেও বিশ বার তাকে কালি ডেকেছে। অন্ধকারে নাকি দেখাই যায় না। এমন অনেক কথা বলেছে। কালো রঙের মেয়ে হওয়া বোধহয় পাপ! আবার পদ্মজাও রাতে তার সাথে থাকেনি। পুরো রাত সে কেঁদেছে। কেউ কেন তাকে কালি বলবে! আবার তার আপাও তাকে সময় দিল না। শ্বশুরবাড়ির অন্য বউকে নিয়ে ব্যস্ত। পূর্ণার খুব অভিমান হয়েছে। বয়স বিশ পার হলেও রয়ে গেছে সেই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটি। মৃদুল নৌকা থামিয়ে পূর্ণাকে ডাকল, ‘কালি বেয়াইন।’

পূর্ণা তাকাল না। মৃদুল আবার ডাকল, ‘বেয়াইন গো।’

তাও পূর্ণা সাড়া দিল না। মৃদুল জাকিরকে বলল, ‘কী রে ব্যাঠা, বুঝছিস কিছু? এই ছেড়িরে ভূতে ধরল নাকি?’

জাকির দাঁত বের করে শুধু হাসল। মৃদুল জোরে বলল, ‘আরে বেয়াইন কী কানে শুনে না? কাল তো ঠিকই শুনছিল। ঠান্ডা কী কানের ভেতরে ঢুইকা গেছে? ও কালি বেয়াইন। বেয়াইন…’

পূর্ণা হুট করে উঠে দাঁড়াল। আঙুল শাসিয়ে মৃদুলকে বলল, ‘আপনার কী মা বাপ নাই? থাকলেও শিক্ষা দেয়নি যারে তারে যা ইচ্ছে ডাকা উচিত না। অসভ্যতা অন্য জায়গায় করবেন আমার সামনে না। আমি কালো আমি জানি। আপনাকে কালি বলে সেটা মনে করিয়ে দিতে হবে না। আমি আপনাকে অনুমতি দেইনি আমাকে কালি ডাকতে বা বেয়াইন ডাকতে। আমি আপনার বেয়াইনও না। আমার ধুলাভাইয়ের আপন ভাই না আপনি। কোথাকার কে আপনি? এই ফর্সা চামড়ার দেমাগ দেখান? আরেকবার আমাকে কালি বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।’

কথা শেষ করেই পূর্ণা কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যায়। রেখে যায় অপমানে থমথম করা একটা মুখ। মৃদুল ঘোর থেকে বেরোতে পারছে না। তাকে একটা মেয়ে এভাবে বলেছে? তার মতো সুন্দর ছেলের জন্য গ্রামের সবকটি মেয়ে পাগল। আর এই কালো মেয়েটা তাকে এভাবে অপমান করলো! মৃদুল রাগে বৈঠা ছুঁড়ে ফেলে খালে। নৌকা থেকে রাগে নামতে গেলে তার এক পায়ে নৌকা ধাক্কা খেল। ফলে নিমিষে দূরে চলে যায় নৌকাটি। নৌকায় থাকা ছেলেটি চিৎকার করল, ‘ মৃদুল ভাই। আমি আইয়াম কেমনে? বৈডাডাও ফালায়া দিছো।’

মৃদুল বিরক্তি নিয়ে ফিরে তাকাল। সত্যি নৌকা অনেক দূরে চলে গিয়েছে। এই ঠান্ডার মধ্যে ছোট বাচ্চাটা সাঁতরে পাড়ে আসবে কীভাবে!

মৃদুল রাগ এক পাশে রেখে বরফের মতো ঠান্ডা জলে ঝাঁপ দিল।

.

রুম্পা থেমে থেমে কাঁদছে। পদ্মজা অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে। সে ভীষণ অস্থির। একজোড়া পায়ের শব্দ ভেসে আসতেই রুম্পার কান্না থেমে গেলে। যেন এই পায়ের শব্দগুলো সে চিনে। রুম্পা কাঁপতে থাকল। রুম্পার অবস্থা দেখে পদ্মজার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত গড়িয়ে যায়। রুম্পা পদ্মজার এক হাত ধরে চাপাস্বরে দ্রুত বলল, ‘এহান থাইকা চইলা যাও বইন। আর আগাইয়ো না। ওরা পিশাচের মতো। ছিঁইড়া খাইয়া ফেলব। ওদের দয়ামায়া নাই। তুমি অনেক ভালা। তোমারে কোনোদিন ভুলতাম না আমি। তুমি এইহানে থাইকো না। তুমি এই বাড়ির কেউয়ের লগে যোগাযোগ রাইখো না।’

‘ওরা কী করেছে? ভাবি, অনুরোধ করছি আমাকে বলুন। ভাবি অনুরোধ করছি।’

রুম্পা সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঢোক গিলছে। পায়ের শব্দটা যত কাছে আসছে তার কাঁপুনি তত বাড়ছে। সে ছলছল চোখে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বলল, ‘পিছনে…উত্তরে…ধ রক্ত।’

পরমুহূর্তেই দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে খলিল হাওলাদার। এতো জোরে দরজা ধাক্কা দিয়েছেন যে, বিকট শব্দ হয়। হুংকার ছেড়ে পদ্মজাকে বললেন, ‘তুমি এই ঘর থাইকা বাইর হও। অনেক অবাধ্যতা দেখাইছো আর না।’

খলিলের চোখ দুটি দেখে পদ্মজার রক্ত ছলকে উঠে। গাঢ় লাল। সে দুই হাতে রুম্পাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি রুম্পা ভাবির সাথে থাকব।’

‘থাকবা না তুমি।’

‘কেন জানতে পারি?’

‘একটা পাগলের সাথে কীসের থাকন?’

‘রুম্পা ভাবি পা…’ পদ্মজা কথা শেষ করতে পারল না। বুকে মুখ লুকিয়ে রাখা রুম্পা পিঠে চিমটি দিয়ে ভেজাকণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কইও না। আমি পাগল না কইও না। দোহাই লাগে।’

পদ্মজা থেমে গেল। খলিল বললেন, ‘বাড়ায়া যাও বউ।’

পদ্মজা নাছোড়বান্দা হয়ে বলল, ‘যাব না আমি। রুম্পা ভাবির সাথে থাকব আমি।’

রুম্পা পদ্মজাকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে আবার পাগলামি শুরু করে। খলিল রুম্পাকে আঘাত করার জন্য উদ্যত হতেই পদ্মজা বাধা হয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘নিজের মেয়েকে অমানুষের মারতে পারেন বলে সবার মেয়েকে মারার অধিকার পাবেন না।’

পদ্মজার কথা মাটিতে পড়ার আগে খলিলের শক্ত হাতের থাপ্পড় পদ্মজার গালে পড়ে। পদ্মজা ব্যথায় ‘মা’ বলে আর্তনাদ করে উঠল।

৫১

ভোর হয়েছে আর কতক্ষণই হলো! দু ঘন্টার মতো। এর মধ্যেই মেঘলা আকাশ বেয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে। পূর্ণা আলগ ঘরের সামনে থাকা বারান্দার চেয়ারে মুখ ভার করে বসে আছে। তার গায়ে সোয়েটার,সোয়েটারের উপরে তিন তিনটে কাঁথা। তবুও পাতলা ঠোঁট জোড়া ঠান্ডায় কাঁপছে। বসে থাকতে থাকতে একসময় বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। কোথাও যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। তার চেয়ে বরং আপার সাথে আড্ডা দেয়া যাক। চৌকাঠে পা রাখতেই মৃদুলের কণ্ঠস্বর কানে এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মৃদুল কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে আসছে। শরীর ভেজা। রানি আপা,রানি আপা বলে ডাকছে। কিন্তু এখানে তো রানি নেই। মৃদুল বারান্দায় পা রেখেই পূর্ণার মুখটা দেখতে পেল। তার দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে, সঙ্গে মৃদুলের কপালে ভাঁজ পড়ে। এই মেয়ের জন্যই তো এমন ঘটনা ঘটলো। এখন ঠান্ডায় কাঁপতে হচ্ছে। সে দৃষ্টি সরিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। শার্ট খুলে দড়িতে মেলে দিয়ে ডাকল, ‘কইরে রানি আপা। শীতে মইরা যাইতেছি। কাপড় নিয়ে আয়। ভেজা শরীর নিয়া ঘরে কেমনে ঢুকব?’

পূর্ণা কাঠখোট্টা গলায় বলল, ‘রানি আপা এইখানে নাই। হুদাই চেঁচাচ্ছেন।’

মৃদুল পূর্ণার স্বরেই পাল্টা জবাব দিল, ‘তোমারে কইছি আমার উত্তর দিতে? আমার ইচ্ছে হইলে আমি চেঁচাব। তোমার ভালা না লাগলে কানে ফাত্তর ঢুকায়া রাখো।’

পূর্ণা দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে তাকিয়ে থাকে। মৃদুল আড়চোখে পূর্ণাকে দেখে। আবার চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বাতাস বেড়েছে। খালি গায়ে কাঁপুনি শুরু হয়। মৃদুলকে এভাবে কাঁপতে দেখে পূর্ণার মায়া হচ্ছে। সে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘আমি আপনার কাপড় নিয়ে আসব?’

মৃদুল চোয়াল শক্ত রেখেই আবারও আড়চোখে তাকাল। কিন্তু উত্তর দিল না। সে সম্পূর্ণভাবে পূর্ণাকে উপেক্ষা করছে। পূর্ণা জবাবের আশায় কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর চলে যায়। পূর্ণা চলে যেতেই মৃদুল শীতের তীব্রতায় মুখ দিয়ে ‘ উউউউউউ’ জাতীয় শব্দ করে কাঁপতে থাকল। যতক্ষণ না প্যান্ট শুকাবে ঘরের ভেতর ঢুকতে পারবে না। তার ঘরে যাওয়ার পথে ধান ছড়ানো আছে। এদিক দিয়ে গেলে ধান ভিজে নষ্ট হবে। সহ্য করা ছাড়া আর উপায় নেই। কেউ যদি কাপড় দিয়ে যেত! পূর্ণা আলগ ঘরের পিছনে উত্তর দিকে যে বারান্দা আছে সেখানে মগাকে পেল। মগা ঝিমুচ্ছে।

‘মগা ভাইয়া?’

মগা তাকাল। পূর্ণা বলল, ‘ মৃদুল ভাইয়ের ঘর কোনটা?’

মগা আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দিল। পূর্ণা মৃদুলের ঘরে গিয়ে একটা লুঙ্গি আর শার্ট নিয়ে বেরিয়ে আসে। মৃদুল পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা শীতের কাতরতা বন্ধ করে দিল। পূর্ণা মৃদুলের চেয়ে এক হাত দূরে এসে দাঁড়ায়। লুঙ্গি,শার্ট এগিয়ে দেয়। মৃদুল ঘুরে তাকায়। আর রাগ দেখানো সম্ভব নয়। রগে, রগে ঠান্ডার তীব্রতা ঢুকে গেছে। রক্ত শীতল হয়ে এসেছে। সে পূর্ণার হাত থেকে নিজের কাপড় নিতে নিতে হৃদয় থমকে দেয়ার মতো একটা মায়াবী মুখশ্রী আবিষ্কার করলো। টানা টানা চোখ,চোখের পাঁপড়িগুলো এতো ঘন যে মনে হচ্ছে কোনো বিশাল বটবৃক্ষ ছায়া ফেলে রেখেছে,পাতলা ফিনফিনে ঠোঁট,ত্বকে তেলতেলে ভাব। চকচক করছে। লম্বা এলো চুল বাতাসে উড়ছে। শ্যামবর্ণের মুখ এতো আকর্ষণীয় হয়? কিছু সৌন্দর্য বোধহয় এভাবেই খুব কাছে থেকে চিনে নিতে হয়। মৃদুলের দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে। সে আগে লুঙ্গি নিল। পূর্ণা অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বলে, ‘আমি দেখছি না। আপনি পাল্টে ফেলুন।’

মৃদুল মোহময় কোনো টানে আবার ফিরে তাকায়। তবে মুখটা আর দেখতে পেল না। মায়াবী মুখটা অন্যদিকে ফিরে আছে। সে লুঙ্গি পাল্টে মিনমিনিয়ে বলল, ‘শার্টটা?’

পূর্ণা হেসে শার্ট এগিয়ে দিল। মৃদুলের এলোমেলো দৃষ্টি। হুট করেই বুকে ঝড়ো বাতাস বইছে। কী আশ্চর্য! পূর্ণা গর্বের সাথে বলল, ‘আমাকে কালি বলে কষ্ট দিলেও আমি আপনার কষ্ট দেখতে পারিনি। আমি এমনই মহৎ।’

অন্যসময় হলে হয়তো মৃদুলও পাল্টা জবাব দিত। কিন্তু এখন ইচ্ছে হচ্ছে না। মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না। পূর্ণা কিছু না বলে আলগ ঘরে ঢুকে যায়। মৃদুল দ্রুত পায়ে দুই পা এগিয়ে আসে। আবার পিছিয়ে যায়। আজকের দিনটা অন্যরকম লাগছে। আচ্ছা,দিনটা অন্যরকম নাকি অনুভূতি অন্যরকম?

.

পদ্মজা নিজেকে ধাতস্থ করার আগেই খলিল পদ্মজাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দেন। এরপর দ্রুত দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। পদ্মজা গালে হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখের জল বিসর্জন হচ্ছে আঘাতের কষ্টে? নাকি কারো হাতে থাপ্পড় খাওয়ার অপমানে? কে জানে! খলিল কপাল কুঁচকে আরো কী কী যেন বলে চলে যান। পদ্মজা ঠায় সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সে আকস্মিক ঘটনাটি হজম করতে পারছে না। দিকদিশা যেন হারিয়ে ফেলেছে। ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ পেয়ে পদ্মজা সম্বিৎ ফিরে পেল। সে বন্ধ দরজার দিকে একবার তাকাল। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি কীভাবে সামলানো উচিত তার মাথায় আসছে না। একটু দূরে চোখ পড়তেই দেখতে পেল,লতিফাকে। পদ্মজাকে তাকাতে দেখেই লতিফা আড়াল হয়ে যায়। পদ্মজা সে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে। তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। এই তীব্র শীতে আবার বৃষ্টি হবে নাকি! ভাবতে ভাবতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামে। পদ্মজার গা কেঁপে উঠে ঠান্ডার তীব্রতায়।

সাঁ সাঁ করে বাতাস বইছে। সুপারি গাছগুলো একবার ডানে দুলে পড়ছে তো আরেকবার বামে। আলগ ঘরের পিছনের বারান্দায় মগা গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। পদ্মজা শাড়ির আঁচল ভালো করে টেনে ধরে শীত থেকে বাঁচতে। আবহাওয়ার অবস্থা ভালো না তার মধ্যে বৃষ্টি আর বাতাস! সামান্য শাড়ির আঁচলে কী ঠান্ডার তীব্রতা আটকানো যায়!

ইচ্ছেও করছে না ঘরে যেতে। সে এদিকওদিক চেয়ে দেখল। শেষ কর্ণারে একটা চেয়ার দেখতে পেল। চেয়ারটা আনার জন্য এগোয়। তখন নাকে একটা বিশ্রি বোটকা গন্ধ আসে। পদ্মজার স্নায়ু সজাগ হয়ে উঠে। যত এগোচ্ছে গন্ধটা তীব্র হচ্ছে! সে সাবধানে এক পা এক পা করে ফেলছে।

এরিমধ্যে আমিরের চেঁচামেচি কানে আসে। পদ্মজা থমকে যায়। উলটো ঘুরে বাইরে উঁকি দেয়। বাইরে ধস্তাধস্তি শুরু হয়েছে। সবার আগে চোখে পড়ে আমিরকে। পদ্মজা সবকিছু ভুলে ছুটে নেমে আসে নিচ তলায়। এরপর বাইরে আসে। আমির তার চাচাকে মারছে! যেভাবে পারে কিল,ঘুষি দিচ্ছে। আমির এতোটাই রেগে গিয়েছে যে,নিজের আপন চাচাকে মারছে! মজিদ হাওলাদার, রিদওয়ান, আমিনা,রানি, সবাই আটকানোর চেষ্টা করছে। কেউ পারছে না। আমির খলিলকে ছেড়ে রিদওয়ানকে ধাক্কা মেরে কাঁদায় ফেলে দিল। আমিরের আচরণ উন্মাদের মতো। সে বিশ্রি গালিগালাজ করতে করতে রিদওয়ানের পেটে লাথি বসায়। রিদওয়ান কুঁকিয়ে উঠল। আমিনা আমিরকে কিল,থাপ্পড় দিয়ে আঘাত করছেন। তাতেও কাজ হচ্ছে না। এমন বেয়াদব তো আমির না! পদ্মজা দৌড়ে আসে। আমিরকে চিৎকার করে বলে, ‘কী করছেন আপনি? পাগল হয়ে গেছেন? ছাড়ুন।’

আমির পদ্মজার জবাব দেয় না। খলিলকে থাবা মেরে ধরে। খলিলের নাক বেয়ে রক্ত ঝরছে। সেই অবস্থায়ই মুখে আরেকটা ঘুষি মারে। রানি, আমিনা হাউমাউ করে কাঁদছে। মৃদুল,পূর্ণা,মগা,মদন সবাই ছুটে আসে। মৃদুল,পদ্মজা দুই হাতে আমিরকে টেনে সরাতে চায়। কিন্তু পারল না। আমিরের শরীরে যেন কয়েকটা বাঘের শক্তি ঢুকেছে। সে কিছুতেই ক্লান্ত হচ্ছে না। মৃদুল দুই হাতে জাপটে ধরে আমিরকে দূরে সরিয়ে আনে। আমির হিংস্র বাঘের মতো হাত পা ছুড়তে ছুড়তে বলে, ‘কুত্তার বাচ্চারা অনেক কিছু করছস করতে দিছি। আমার বউয়ের গায়ে হাত দেস কোন সাহসে। মৃদুল ছাড়। আমি ওদের আজরাইলের মুখ দেখিয়ে ছাড়ব।’

মৃদুলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আমির। ছুটে এসে রিদওয়ানকে ধরে। পদ্মজা হতভম্ব হয়ে পড়েছে! রিদওয়ান গতকাল তার কাঁধে হাত দিয়েছিল, আর আজ খলিল থাপ্পড়ে মেরেছে। এসব কে বলেছে আমিরকে? থাপ্পড়টা লতিফা দেখেছিল। তাহলে কী লতিফা বলেছে?

আমিনা পদ্মজার পায়ে লুটিয়ে পড়েন। পদ্মজা দ্রুত সরে যায়, ‘চাচি কী করছেন!’

আমিনা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘থামাও এই কামড়াকামড়ি। আল্লাহর দোহাই লাগে।’

পদ্মজা কী করবে বুঝতে পারছে না। আমির তার কথা শুনছেই না। আর আমিরের এমন রাগ সে দেখেনি! গুরুজনদের গায়ে হাত তোলার মতো রাগ আমিরের হতে পারে এটাও ধারণার বাইরে। পদ্মজা আমিরের সোয়েটার খামচে ধরে কণ্ঠ কঠিন করে বলল, ‘ছাড়ুন বলছি। ছাড়ুন।’

আমির তাও শুনলো না। সে ধাক্কা মেরে পদ্মজাকে সরিয়ে দিল। দুই হাত দূরেই নারিকেল গাছ ছিল। সেখানে পড়লে নিশ্চিত কোনো অঘটন ঘটে যেত,অঘটন ঘটার পূর্বেই দুটো হাত পদ্মজাকে আঁকড়ে ধরে। পদ্মজা কৃতজ্ঞতা নজরে তাকায়। ফরিনাকে দেখতে পেল। পদ্মজা অবাক হয়। ফরিনা এরকম ধস্তাধস্তি দেখেও চুপ করে আছেন। থামানোর চেষ্টা অবধি করছেন না। পদ্মজা আবার আমিরকে থামানোর চেষ্টা করল। মৃদুল চেষ্টা করল। কিছুতেই কিছু হয় না। আমির খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে,অনেক বছরের রাগ একসাথে মিটিয়ে নিচ্ছে। পদ্মজা আমিরকে অনুরোধ করে সরে আসতে। সেই অনুরোধ আমিরের কর্ণকুহর অবধি পৌঁছেছে কিনা সন্দেহ! পদ্মজা অসহায় মুখ করে সরে যাবে তখনই দুটি শক্তপোক্ত হাত আমিরকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে। সেই হাতে খুব দামী ঘড়ি। হাতের মালিককে দেখার জন্য পদ্মজা চোখ তুলে তাকায়। মুখ দেখে চমকে উঠে! দীর্ঘ সময় পর আবার সেই মানুষটির সাথে দেখা। যে মানুষটি তার প্রথম ভালোবাসা না হলেও প্রথম আবেগমাখা অনুভূতি ছিল। সে লিখন শাহ! পদ্মজা দূরে সরে দাঁড়ায়। মৃদুল,লিখন মিলে আমিরকে তুলে অনেকটা দূরে নিয়ে আসে। আমির ছটফট করছে ছোটার জন্য। অথচ ছুটতে পারছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে লিখনকে দেখে সে স্থির হয়ে যায়। লিখন হেসে বলল, ‘এবার থামুন। অনেক শক্তি ফুরিয়েছেন।’

আমির কিছু বলতে চাইল তখনই রিদওয়ান সবার অগোচরে ইট দিয়ে আমিরের ঘাড়ে বারি মারে। আমির আর্তনাদ করে বসে পড়ে। লিখন রিদওয়ানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। পদ্মজা উৎকর্ণ হয়ে দৌড়ে আসে। আমিনা,রানি খলিল এবং রিদওয়ানকে নিয়ে দ্রুত আলগ ঘরে চলে যায়। দরজা বন্ধ করে দেয়। মজিদ মগাকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি যা গঞ্জে। বিপুল ডাক্তাররে নিয়ে আয়। আমার বাড়িতে এসব কী হচ্ছে!’

ফরিনা তখনও দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। এই ঘটনা তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি! যেন এই ঘটনার জন্য তিনি খুশি। কী চলছে তার মনে?

৫২

ফরিনা তাড়াহুড়ো করে খোশমেজাজে রান্না করছেন। সাহায্য করার মতো পাশে কেউ নেই। একাই দৌড়ে দৌড়ে সব করছেন। হাওলাদার বাড়িতে অতিথি এসে একদিন না থেকে যেতে পারে না। এতে নাকি গৃহস্থ বাড়ির অমঙ্গল হয়। তাই মজিদ লিখনকে থেকে যেতে জোর করেছেন। পদ্মজা নিজের ঘরে স্বামী সেবায় ব্যস্ত। আমিরের ঘাড়ের চামড়া ফুলে গেছে। হাড়ে বিষের মতো যন্ত্রণা। বিপুল ডাক্তার ঔষধপত্র দিয়েছেন। পদ্মজা অশ্রুসজল নয়নে আমিরের মুখের দিকে চেয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ স্বামীর যন্ত্রণা দেখেছে। সহ্য করতে হয়েছে। মাত্রই আমির চোখ বুজেছে। সে মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করছে,দ্রুত যেন আমিরের ব্যথাটা সেড়ে যায়। নয়তো তাকে যেন দিয়ে দেয়। ঘাড়ের আহত অংশে পদ্মজা আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। নীল হয়ে আছে। লতিফা নিরবে পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল। পদ্মজা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে জলদি চোখের জল মুছল। তারপর লতিফাকে দেখে বলল, ‘লুতু বুবু!’

লতিফা বলল, ‘খাইবা না? খালাম্মা খাইতে ডাকতাছে।’

পদ্মজা গম্ভীরকণ্ঠে বলল, ‘আম্মা নিজের ছেলেকে কেন দেখতে আসেননি?’

‘খালাম্মায় লিখন ভাইজানের লাইগে রাঁনতাছিল।’

পদ্মজা ক্ষিপ্ত হয়, ‘নিজের ছেলেকে না দেখে উনি কীভাবে অতিথির জন্য ভোজ আয়োজন করছেন? আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।’

লতিফা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পদ্মজা অনেকক্ষণ ক্ষিপ্ত নয়নে মেঝেতে চোখ নিবদ্ধ করে রাখল। এরপর আমিরকে এক ঝলক দেখে, লতিফাকে বলল, ‘তুমি যাও,আমি আসছি।’

লতিফা দুই পা এগোতেই পদ্মজা ডেকে উঠল, ‘লুতু বুবু।’

লুতু দাঁড়াল। পদ্মজা বলল, ‘তুমি আমার উপর নজর রাখছিলে কেন? আর আমাকে না জিজ্ঞাসা করে থাপ্পড়ের কথাই বা কেন বলেছো উনাকে?’

লতিফার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে নত হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা আরো দুই বার প্রশ্ন করেও কোনো জবাব পেল না। তাই বলল, ‘নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?’

এইবার লতিফা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সে কিছু একটা ভাবল। এরপর মুখ তুলে দেখল পদ্মজা তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। লতিফা অপ্রতিভ হয়ে উঠে। বলে, ‘আমি যাই। নইলে খালাম্মায় চেতব।’

পদ্মজার উত্তরের আশায় থাকেনি লতিফা। তড়িঘড়ি করে চলে যায়। পদ্মজা ভ্রুকুটি করে দরজার বাইরে তাকিয়ে থাকে। প্রতিটি প্রশ্ন যেন আলাদা আলাদা। অথচ তার মনে হয় সব প্রশ্নের এক উত্তর,এক যোগসূত্র। এখন সেসব ভাবার সময় না। আমিরের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। পদ্মজা আমিরের কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রা অনুমান করে। ভীষণ গরম। জ্বর উঠছে নাকি!

লিখন,মৃদুলের আড্ডা জমে উঠেছে। দুজন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। লিখনের নায়িকা তিন দিন আগে ঘাট থেকে পিছলে নদীতে পরে গেছে। সাঁতার জানে না তাই প্রচুর পানি খেয়েছে। সেই সাথে পা মচকে গেছে। কোমরেও ব্যথা পেয়েছে। এই কথা শুনে মৃদুল হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিল। পূর্ণা দূর থেকে কটমট করে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে আছে। কত অসভ্য এই লোক! মানুষের আঘাতের কথা শুনে হাসে! তার গা জ্বলে যাচ্ছে মৃদুলের হা হা করে হাসা দেখে। লিখন আরো জানাল,সে এবং তার দল গত তিনদিন নায়িকা ছাড়া দৃশ্যগুলোর শুটিং করেছে। বাকি যা দৃশ্য আছে সবকিছুতে নায়িকার উপস্থিতি থাকতেই হবে। তাই আপাতত শুটিং স্থগিত আছে। আশা করা যাচ্ছে, তিন-চার দিনের মধ্যে নায়িকা সুস্থ হয়ে যাবে। পূর্ণাকে দূরে বসে থাকতে দেখে লিখন ডাকল। পূর্ণা খুশিতে গদগদ হয়ে দৌড়ে আসে। ঘন্টা দুয়েক আগে একটু কথা হয়েছিল। আর হয়নি। লিখন প্রশ্ন করল, ‘ভেতরের অবস্থা কেমন? আমির হাওলাদার আগের চেয়ে কিছুটা ভালো অনুভব করছেন?’

‘হু,ঘুমাচ্ছে দেখে এলাম। আপা আছে পাশে।’

‘তোমার আপা পাশে থাকলে আর কী লাগে!’ লিখনের কণ্ঠটা করুণ শোনায়। পূর্ণা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘ভাইয়া,আপনি কিন্তু আমাদের বাড়িতে যাবেন। তখন বললাম, কিছুই বললেন না।’

‘আচ্ছা,যাব।’

‘প্রান্ত অনেক খুশি হবে।’

‘প্রান্ত যেন কে?’

‘আমার ভাই। ওইযে খুন-

‘মনে পড়ছে। কী যেন নাম ছিল… মুন্না বা এরকম কিছু নাম ছিল না?’

‘জি ভাইয়া।’

‘সবাই কত বড় হয়ে গেছে। পড়াশোনা আর করোনি কেন?’

পূর্ণা বাম হাত চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘মেট্রিক ফেইল করাতে আর পড়তে ইচ্ছে করেনি।’

মৃদুল ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, ‘তুমিও মেট্রিক ফেইল?’

পূর্ণা আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল, ‘কেন? আরো কেউ আছে এখানে?’

মৃদুল মুচকি হেসে চুল ঠিক করতে করতে চমৎকার করে বলল, ‘আমিও মেট্রিক ফেইল।’

মৃদুলের কথা শুনে লিখন সশব্দে হেসে উঠল। পূর্ণা সরু চোখে তাকিয়ে আছে মৃদুলের দিকে। মজা করলো নাকি সত্য বলল? লিখন ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলল, ‘মৃদুল মজা করছো নাকি সত্যি?’

মৃদুল গুরুতর ভঙ্গিতে বলল, ‘আচ্ছা,মিথ্যা কইতে যামু কেন? এতে আমার লাভডা কী?’

মৃদুলের ভঙ্গি দেখে লিখন চারপাশ কাঁপিয়ে হাসল। সাথে তাল মিলাল পূর্ণা ও মৃদুল। লিখন আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে। দেখতে কত ভালো দেখাচ্ছে। কী অপূর্ব মুখ। বলিষ্ঠ শরীর। পূর্ণা কেন জানি আজও মনে হচ্ছে,লিখনের পাশেই পদ্মজাকে মানায় বেশি। পরক্ষণেই পূর্ণা নিজেকে শাসাল, ‘চুপ থাক পূর্ণা! আমির ভাইয়ার মতো ভালো মানুষ দুটি নেই। আপার জন্য উনি সেরা।’

তবুও মন বুঝে না। হয়তো সৌন্দর্যের মিলটার জন্যই লিখন,পদ্মজা দুটি নাম তার ভাবনায় একসাথে জোড়া লেগে যায়। অথচ,বিবেক দিয়ে ভাবলে মনে হয় আমিরের জায়গা কেউ নিতে পারবে না। কেউ না। সে অনন্য।

হাসিখুশি মুহূর্ত উবে যায় খলিলের কর্কশ কণ্ঠে, ‘বেহায়া,বেলাজা ছেড়ি। পর পুরুষের সামনে কেমনে দাঁত মেলায়া হাসতাছে। ঘরে বাপ মা না থাকলে এমনই হয়। এই ছেড়ি ঘরে যাও।’

লিখন,মৃদুলের সামনে এভাবে কটু কথা শুনে পূর্ণা বুক ফেটে কান্না আসে। সে এক পলকে লিখন,মৃদুলকে দেখে আলগ ঘরের ভেতর চলে যায়। লিখন,মৃদুল হতভম্ব। খলিলের মাথায়,হাতে ব্যান্ডেজ। নাকের নিচে চামড়া উঠে গেছে,মাংস দেখা যাচ্ছে। তবুও তেজ কমে না। তিনি পূর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘মা ডা মইরা যাওয়ার পর থেকে এই ছেড়ি দস্যি হইয়া গেছে। এত বড় ছেড়ি,বুড়া হইতাছে। বড় বইনে বিয়া দেয় না। কোনদিন কোন কাম ঘটায় আল্লায় জানে। তা লিখন দুপুরের খাবার খাইছো?’

লিখনের ইচ্ছে হচ্ছে না এই কুৎসিত ভাবনার লোকটার জবাব দিতে। যেহেতু সে এই বাড়ির অতিথি। তাই মনের কথা শুনতে পারল না। বলল, ‘জি না।’

মৃদুল খলিলকে উপেক্ষা করে আলগ ঘরে ঢুকে পড়ে। পূর্ণা আলগ ঘরের পিছনের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। মৃদুল পিছনে এসে দাঁড়াল। কোমল স্বরে বলল, ‘খালুর কথায় কষ্ট পাইছো?’

পূর্ণা মৃদুলের দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল, ‘আপনি কারো কষ্টের কথা ভাবেন দেখে ভালো লাগলো।’

‘সবসময় ত্যাড়া কথা কেন কও? আমি যদি আগে জানতাম,তোমারে কালি কইলে তোমার এত্ত কষ্ট হয়। আমি কইতাম না।’

পূর্ণা তাকাল। পূর্ণার দৃষ্টি দেখে মৃদুলের মন কেমন করে উঠল। এ দৃষ্টির নাম বোধহয় ‘মন কেমন করা দৃষ্টি’। পূর্ণা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘মাফ চাইছেন?’

মৃদুলের জোড়া ভ্রু কুঁচকে আসে। দুই পা পিছিয়ে যেয়ে বলে, ‘জীবনেও না।’

পদ্মজা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো রান্নাঘরে ঢুকে ফরিনাকে বলল, ‘আম্মা,কী হয়েছে আপনার?’

ফরিনা প্রবল বিস্ময়ে জানতে চাইলেন, ‘কেন? কী হইব আমার?’

ফরিনার ব্যবহারে পদ্মজা খুব অবাক। সে কিঞ্চিৎ হা হয়ে তাকিয়ে রইল। ফরিনা নিশ্চিন্ত মনে চুলা থেকে পাতিল নামালেন। তারপর বললেন, ‘ও পদ্মজা,মগারে একটু কইবা লিখন,মৃদুলরে ডাইকা আনতে। লিখন ছেড়াডা কহন আইছে। এহনও খায় নাই।’

পদ্মজা আর ঘাঁটল না ফরিনাকে। সে বুঝে গেছে কোনো জবাব পাবে না। সদর ঘরে পার হতেই সদর দরজায় মৃদুল এবং লিখনের দেখা পেল। পদ্মজা চট করে আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে নিল। তারপর বলল, ‘আপনারা এখানে এসে বসুন। আম্মা,আপনাদেরই খোঁজ করছিলেন।’

কথা শেষ হতেই পদ্মজা সদর ঘর ছেড়ে রান্নাঘরে চলে গেল। লিখন আবিষ্ট হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। সেই পুরনো দিনের মতোই তার স্বপ্নের প্রেয়সী এক ছুটে পালিয়ে বেড়ায়। পার্থক্য শুধু এটাই,আগে লজ্জায় পালাত,এখন অস্বস্তিতে। লিখন গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পদ্মজাকে এক ঝলক দেখার জন্য এই বাড়িতে সে পা দিয়েছে। যাকে ভালোবাসে তার স্বামীর বাড়িতে আসা কতটা কষ্টের তা শুধু তার মতো অভাগারাই জানে। মৃদুল লিখনের দৃষ্টি খেয়াল করে কিছু একটা আন্দাজ করে বলল, ‘পদ্মজা ভাবিকে চিনেন?’

‘চিনব না কেন-

লিখন থেমে গেল। সে নিজের অজান্তেই কী বলে দিচ্ছিল! হেসে বলল, ‘ এতসব জেনে কী হবে? আসো গিয়ে বসি। তারপর বলো,কখনো প্রেমে পড়েছো?’

‘না মনে হয়।’ উদাসীন হয়ে বলল মৃদুল।

‘নিশ্চিত হয়ে বলো।’

মৃদুল ভাবল। কোন নারীর প্রতি তার আকর্ষণ বেশি কাজ করেছে। উত্তর পেয়েও গেল। সকালেই সে পূর্ণার মধ্যে অদ্ভুত কিছু পেয়েছে। অজানা অনুভূতি অনুভব করেছে। এটা কী প্রেম? মৃদুল নিশ্চিত নয়। তাই সে বলল, ‘না,পড়ি নাই।’

‘আচ্ছা,সেসব বাদ। বিয়ে করছো কবে সেটা বলো।’

‘উমম,হুট করে একদিন। আমার ইচ্ছে,আমি হুট করে একদিন বিয়ে করে আম্মারে চমকে দেব।’

লিখন সশব্দে হাসল। বলল, ‘জানো মৃদুল,মানুষের সব চাওয়া পূরণ হয় না। প্রতিটি মানুষের জীবনের কোনো না কোনো পাশে অপূর্ণতা থাকে।’

‘তাহলে বলছেন,আমার এই ইচ্ছে পূরণ হইব না?’

‘না তা বলছি না। হুট করে বিয়ে করে ফেলা আর কেমন অসম্ভব কাজ? মেয়ে রাজি থাকলেই হলো। মেয়ে বেঁকে গেলে কিন্তু কিচ্ছা খতম।’

লিখন আবার সশব্দে হাসল। মৃদুলও অকারণে তাল মিলিয়ে হাসে আর ভাবে,একটা মানুষ এতো হাসতে পারে কীভাবে? এতো সুখী লিখন শাহ?

সে তো আর জানে না দুঃখীরা পাহাড় সমান কষ্ট লুকোয় হাসির আড়ালে।

আস্তে আস্তে বাড়ির সবাই আসে। আমির ছাড়া। রিদওয়ান, খলিল এত শান্তভাবে আছে যে মনেই হচ্ছে না সকালে এতো বড় ঘটনা ঘটে গেছে। বাড়ির মহিলারা দৌড়ে দৌড়ে খাবার পরিবেশন করছে। পদ্মজা খুব অবাক হয়ে প্রতিটি মানুষকে পর্যবেক্ষণ করছে। লিখনও এতে কম অবাক হয়নি। কত শান্ত পরিবেশ! ঝগড়ার পর মান-অভিমান,তর্ক-বিতর্ক থাকে। সেসব কিছুই নেই। পদ্মজা সবার সামনে আলাদা প্লেটে খাবার নিয়ে ফরিনাকে বলল, ‘আম্মা,আমি উনার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি। ঘুম ভেঙেছে হয়তো।’

পদ্মজা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। লিখন সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকে। পদ্মজার হাঁটার ছন্দ দৃপ্ত ও সাবলীল। মাথায় শাড়ির আঁচলে ঘোমটা টানা। স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে। এই স্বামীটা কী সে হতে পারত না? এতোটাই অযোগ্য ছিল! অযোগ্য নাকি নিয়তির খেলা? কেন ভোলা যায় না এই নারীকে?

লিখনের বোন লিলি আর পদ্মজা একই ক্যাম্পাসের হওয়া সত্ত্বেও লিখন কখনো পদ্মজার সামনে এসে দাঁড়ায়নি। পদ্মজার অস্বস্তি হবে ভেবে। সে পদ্মজার চোখে ভালোবাসা দেখতে চায়,বিব্রতভাব বা অস্বস্তি দেখতে চায় না। এ যে বড় যন্ত্রণার। এতোদিনেও বুকের ভেতর কীভাবে পুষে আছে এক পাক্ষিক ভালোবাসা? কোনোভাবে কী এই ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে! আসবে কী সেই সুদিন? লিখনের শুষ্ক চক্ষু সজল হয়ে উঠে। সে ভাবতে পারে না, পদ্মজা বিবাহিত! লিখনের সম্মূখ বরাবর মৃদুল ছিল। মৃদুল লিখনের প্রতিক্রিয়া দেখে অনেক কিছুই বুঝে নিল। নিশ্চিত হওয়া যাবে পূর্ণাকে জিজ্ঞাসা করলে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে পূর্ণার সাথে কথা বলতে হবে। মৃদুল চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পূর্ণাকে খোঁজে।

পদ্মজা আমিরকে ধরে ধরে বসাল। ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথা। টিকে থাকা যাচ্ছে না। রাগে কিড়মিড় করছে এখনও। পদ্মজা শান্ত করে। তারপর খাইয়ে দিল। খাওয়া শেষে আমির ম্লান হেসে বলল, ‘লিখনের সাথে কথা হয়েছে?’

পদ্মজা নিষকম্প স্থির চোখে তাকাল, ‘উনার সাথে কেন কথা হতে যাবে আমার?’

‘উনি তো তোমার জন্যই এসেছেন।’

‘আপনাকে বলেছে? অন্য দরকারেও আসতে পারে।’

আমির হাসল। বলল, ‘সে আজও তোমাকে পছন্দ করে। আশা করে তুমি তার কাছে যাবে।’

‘অসম্ভব। যা তা বলছেন। আপনি এসব বললে আমার খারাপ লাগে।’

পদ্মজা থামল। আমির মৃদু হাসছে। পদ্মজা আমিরের কোলে মাথা রেখে আদুরে কণ্ঠে বলল, ‘আপনি জানেন না আপনাকে কত ভালোবাসি আমি। আমি আপনাকে ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবতে পারি না।’

‘তাহলে বাচ্চার জন্য বিয়ে করতে বলো কেন?’

‘বন্ধ্যা নারীর কত যন্ত্রণা বুঝবেন না।’

‘আমাদের একটা মেয়ে হয়েছিল।’

‘আর হবে না,তাই বলি।’

‘হবে,আল্লাহ চাইলে হবে। তাছাড়া আমার কাছে তো ফুটফুটে একটা বউই আছে। আর কী লাগে?’

পদ্মজা আমিরের কোল থেকে মাথা তুলে বসে। তারপর চিরুনি দিয়ে আমিরের চুল আঁচড়ে দিয়ে বলল, ‘চুলগুলো বড় হয়েছে অনেক।’

‘হু,আচ্ছা এদিকে আসো।’

আমির পদ্মজাকে এক হাতে টান দিতে গিয়ে ঘাড়ে চাপ খেয়ে ‘আহ’ করে উঠল। পদ্মজা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ‘খুব লেগেছে? আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। কেন এমন করেন আপনি!’

চারপাশ অনেকটা ফর্সা হয়েছে। দুপুরের সূর্যটা একটু দেখা যাচ্ছে। তাও তেজ নেই। কিছুক্ষণ পর আবার ডুবেও যাবে। পূর্ণা লবণ দিয়ে টক বড়ই খাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে,অমৃত খাচ্ছে। মৃদুল পূর্ণার পাশে এসে বসল।পূর্ণা চমকে উঠে। মৃদুলকে দেখে বুকে থুথু দেয়। তারপর বাজখাঁই কণ্ঠে বলল, ‘হুট করে এভাবে কেউ আসে?’

‘আর কথা কইও না। তোমারে সারা দুনিয়া খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি। মাত্র মগা কইল,তুমি নাকি ছাদে।’

‘কেন? আমাকে খুঁজছেন কেন?’

‘এমনে খ্যাঁট খ্যাঁট কইরা কথা কইতাছ কেন? একটু ভালো কথা আহে না মুখ দিয়ে?’

পূর্ণা একটু নড়েচড়ে বসল। তারপর হেসে বলল, ‘দুঃখিত। এবার বলুন কী দরকার।’

‘ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতাম আর কী!’

‘আমার ব্যক্তিগত কোনো তথ্য নেই।’

‘তোমার না,তোমার বড় বইনের। পদ্মজা ভাবির।’

পূর্ণা উৎসুক হয়ে তাকাল। মৃদুল উশখুশ করতে করতে বলল, ‘পদ্মজা ভাবি আর লিখন ভাইয়ের মধ্যে কী কোনো সম্পর্ক ছিল?’

পূর্ণা জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে,মৃদুল কোনো ফালতু প্রশ্ন করেছে। এরপর নির্বিকার কণ্ঠে বলল, ‘না। তবে,লিখন ভাই আপারে পছন্দ করতো। আপার সাথে ভাইয়ার বিয়েটা কেমনে হইছে জানেন?’

‘আমির ভাইয়ের কথা বলছো?’

‘আমার আপার কী আর কোথাও বিয়ে হয়েছে?’

‘সোজা উত্তর দিতে পারো না? তারপর বলো।’

‘ওই ঘটনাটা না হলে হয়তো লিখন ভাইয়ের সাথেই আপার বিয়েটা হতো। কিন্তু হয়নি। এতটুকুই।’

‘লিখন ভাইরে দেখলে মনে হয়,তাদের মধ্যে কোনো গভীর সম্পর্ক ছিল। তারপর বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। ভাই অনেক ভালোবাসতে পারে।’

‘হু।’ পূর্ণা বড়ই খাচ্ছে তৃপ্তি করে।

মৃদুল বিরক্তি নিয়ে অনেকক্ষণ পূর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর উঠে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশ দেখে। পূর্ণা বাঁকা চোখে মৃদুলকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে নেয়। মৃদুলের উপস্থিতি তার হৃদ স্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করে। কিন্তু তা প্রকাশ করার সাহস হয় না। পূর্ণা আরেকটা বড়ই হাতে নিল। তখন মৃদুল ডাকল, ‘বেয়াইন।’

পূর্ণা তাকায়। মৃদুল ঝুঁকে ছাদের মেঝেতে কিছু দেখছে। পূর্ণা উৎসুক হয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। মৃদুল আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘রক্ত না?’

পূর্ণা মৃদুলের মতো ঝুঁকে ভালো করে খেয়াল করল। তারপর বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলল, ‘তাই তো।’

‘মানুষের রক্ত না পশুর রক্ত নিশ্চিত হইতাম কেমনে?’

‘পশুর রক্ত এইখানে আসবে কেন?’

‘মানুষের রক্তই কেন আসবে?’

‘তাই তো।’

দুইজন চিন্তিত হয়ে ভাবতে থাকল। পূর্ণা বলল, ‘মনে হয় কোনো পাখি শিকার হয়েছে। আর রক্তাক্ত অবস্থায় এখানে এসে পড়েছে।’

‘তাহলে মরা পাখিটা কই?’

‘ধরুন,আহত হয়েছে কিন্তু মরেনি। এরপর চলে গেছে।’

সন্ধ্যারাত। জোনাকিপোকারা ছুটে বেড়াচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস। সেই বাতাসে পাতলা শার্ট পরে লিখন নারিকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। জোনাকি পোকা দেখছে। মাঝেমধ্যে অন্দরমহলের দিকে তাকিয়ে কাউকে চোখ দুটি খুঁজছে। সেদিন হেমলতা ফিরিয়ে দেয়ার পর সারা রাত বাড়ি ফেরেনি সে। ক্ষেতে বসেছিল। আকাশ কাঁপিয়ে কেঁদেছে। কেউ শুনেনি। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার মতো কষ্ট দুটো নেই। স্বপ্নে সাজানো সংসার ভেঙে চুরমার হওয়ার দিন ছিল সেদিন। এক সময় ইচ্ছে হয়েছিল পদ্মজাকে তুলে নিয়ে পালাতে। কিন্তু বিবেক সাড়া দেয়নি। পরদিন সকালে উঠেই মা-বাবাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। প্রতিটা মুহূর্তে আফসোস হয়,শুরুতে কেন হেমলতার কাছে প্রস্তাব দিতে পারল না সে! পরবর্তী কয়েকটা মাস ঘোরের মধ্যে কেটেছে। সিনেমা জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। এরপর জীবনের গতিটা স্বাভাবিক হয়েছে ঠিকই কিন্তু মন…মন তো ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। আজও জোড়া লাগেনি। পদ্মজা কী কখনো জানবে,ঢাকায় কতবার পদ্মজার পিছু নিয়েছে সে। জানবে কী তার ভালোবাসার গভীরতা?

লিখন আনমনে হেসে উঠল। চোখে জল ঠোঁটে হাসি! এ হাসি সুখের নয়,যন্ত্রণার।

পূর্ণা অন্দরমহলে আসেনি। পদ্মজা ভীষণ রেগে আছে। আলগ ঘরের বারান্দায় সারাক্ষণ কী করে এই মেয়ে? এর আগেও যখন পারিজা তার পেটে ছিল। পূর্ণা এই বাড়িতে অনেকদিন ছিল। তখনও মাঝ রাত অবধি আলগ ঘরের বারান্দায় বসে থাকত। পদ্মজা শাল গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে আসে অন্দরমহল থেকে। সারাদিন পূর্ণার খোঁজ নেয়া হয়নি। এখন ধরে ঘরে নিয়ে যাবে। নির্জন,থমথমে পরিবেশ। তখন লিখনের কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘পদ্মজা?’

পদ্মজা কণ্ঠটি শোনামাত্র ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠে। অপ্রতিভ হয়ে উঠে। একটা মানুষ কেন তাকে এত বছর মনে রাখবে? কেন অনুচিত আশা করে বসে থাকবে! পদ্মজার রাগ হয়,অস্বস্তি হয়। কষ্টও হয়। প্রার্থনা করে, এই মানুষটার জীবনে কেউ আসুক। এসে তার জীবনটা কানায় কানায় পূর্ণ করে দিক। ভুলিয়ে দিক অতীত। পদ্মজা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘এভাবে রাতের বেলা ডাকবেন না।’

পদ্মজা লিখনকে উপেক্ষা করে দুই পা এগিয়ে যায়।

‘জীবন থেকে তো সরেই গিয়েছো। আমি তোমাকে বিব্রত করতে চাই না। তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সামনে আসিনি। আজ যখন এসেই পড়েছি কয়েক হাত দূরে থেকেই একটু কথা বললে কী খুব বড় দোষ হয়ে যাবে?’

লিখনের করুণ কণ্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে পদ্মজা। লিখন হাসল। সুরগুলি যেন ফিরে এসে প্রাণে মৃদুগুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে। পদ্মজার উপস্থিতি এভাবে কাঁপন ধরাচ্ছে কেন! আজকের এই সময়টা সুন্দর, ভারি সুন্দর!

৫৩

কোনো সাড়া নেই। পদ্মজা পিছনে ফিরে তাকাল। লিখন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে তার দিকে চেয়ে কী দেখছে! পদ্মজা আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল। কাটা কাটা গলায় বলল, ‘কিছু বলার যখন নেই,আসি আমি।’

‘ভুলে গেছো আমায়? মনে পড়ে না?’ লিখনের কণ্ঠে ব্যাকুলতা।

পদ্মজার তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ, ‘না ভুলবার মতো কোনো সম্পর্ক কী আমাদের ছিল? ছিল না। আর এভাবে নির্জনে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। আপনি বুঝদার মানুষ,জ্ঞানী মানুষ। এতটুকু নিশ্চয়ই বুঝবেন।’

লিখন ম্লান হেসে বলল, ‘আচ্ছা,আজ আসো।’

‘একটা অনুরোধ ছিল।’

‘কী?’

পদ্মজা ফের আবার তাকাল। সরাসরি লিখনের চোখের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে লিখনের বুক কেঁপে উঠে। সে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। পদ্মজা বলল, ‘নিজেকে এবার গুছিয়ে নিন। মরীচিকার পিছনে অনেক দৌড়েছেন,আর না। এবার নিজের জীবনটা নতুন করে সাজান। আপনার মনের জোর বাড়ান। মানুষ দ্বিতীয় প্রেমেও পড়ে। দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসে। মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে। আপনি চেষ্টা করুন। আপনিও পারবেন। কেউ না কেউ আপনার জন্য অবশ্যই আছে।’

‘পদ্ম ফুল।’

পদ্মজা একটু সময়ের জন্য হলেও থমকায়। লিখন বলল, ‘এভাবেই ভালো আছি আমি। তুমিও এভাবেই সারাজীবন ভালো থেকো।’

পদ্মজা কী প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই লিখন শাহ তো এক ধ্যানেই পড়ে আছে। সে আর কথা বাড়াল না। যে বুঝেও বুঝতে চায় না,তাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। সে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘শুভ রাত্রি।’

লিখন পদ্মজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। তার অশ্রুসজল চাহনি। তবে বুকে প্রশান্তি। জীবনের খরতাপ দহনে মায়াময় পদ্মজার কণ্ঠ,একটু দেওয়া সময় তার বুকে প্রশান্তির ঢেউ তুলেছে। এই…এইটুকু সময়ের স্মৃতি নিয়েই কয়েকটা রাত আরামে ঘুমানো যাবে। সে বিড়বিড় করল, ‘আমি মানতে পারি না তুমি অন্য কারো। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

শেষের শব্দ তিনটে ঘোর লাগা কণ্ঠে ভেঙে ভেঙে বলল।

পূর্ণাকে ঘরে এনে পদ্মজা ধমকে বলল, ‘এই ঠান্ডার মধ্যে সোয়েটার না পরে কীভাবে থাকিস? বাইরে বাতাসও হচ্ছে। আমার কোনো কথাবার্তাই কী শুনবি না?’

পূর্ণা অপরাধী স্বরে বলল, ‘আর হবে না আপা। আগামীকাল সন্ধ্যার আযানের সাথে সাথে ঘরে চলে আসব।’

‘জি, না। বিকেল থেকেই ঘরে থাকবেন। এমনিতেই এই বাড়ির অবস্থা ভালো না। তুই দুই দিন পর বাড়িতে চলে যাবি।’

‘তুমি যাবে না?’

পদ্মজা আনমনে কিছু ভাবল। তারপর বলল, ‘যাব। কয়দিন পর। আচ্ছা,শোন রাতে টয়লেটে যেতে ভয় পেলে আমাকে ডাকবি। চেপে রাখবি না।’

‘আচ্ছা।’

পূর্ণা খুক খুক করে কাশতে থাকল। পদ্মজা বিচলিত হয়ে বলল, ‘কাশিও হয়ে গেছে! কত ঠান্ডা বাঁধিয়েছিস। জ্বরও আছে নাকি দেখি।’

পদ্মজা পূর্ণার কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রা অনুমান করে বলল, ‘আছেই তো। তুই কী নিজের যত্ন নেয়া শিখবি না? সারাদিন নতুন শাড়ি পরে, সাজগোজ করে ঘুরে বেড়ালেই নিজের যত্ন নেয়া হয়ে যায়? স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে তো।’

পূর্ণা বাধ্য মেয়ের মতো বলল, ‘আচ্ছা,নেব।’

‘তা তো সবসময় বলিস। তুই বস, আমি কুসুম গরম পানি নিয়ে আসছি। গড়গড়া কুলি করে এরপর ঘুমাবি।’

‘আপা-

‘তুই চুপ থাক। চুপচাপ লেপের ভেতর শুয়ে থাক। আমি আসছি।’

পদ্মজা রান্নাঘরে এসে দেখে বালতিতে পানি নেই। বাড়ির সবাই যার যার ঘরে আছে। হয়তো ঘুমিয়েও গেছে। আমির তো সেই কখন ঘুমিয়েছে। পদ্মজা ছোট বালতি হাতে নিয়ে কলপাড়ে আসে। চারিদিক নির্জন,থমথমে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। পদ্মজা আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিল। ঝাপসা আলোয় পুরো বাড়িটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। যদিও এই বাড়িতে সবসময়ই রহস্য বিদ্যমান! পদ্মজা বালতি রেখে,কল চাপতে যাবে তখনই কানে একটা ঝনঝন শব্দ আসে। স্টিলের কিছু কাছে কোথাও পড়েছে। পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। কান খাড়া করে বুঝতে পারল শব্দটা রানির ঘর থেকে আসছে। রানি আপার কোনো বিপদ হলো না তো? পদ্মজা ছুটে আসে রানির ঘরের সামনে। কানে ক্রোধ মেশানো চাপা কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘তোমার লগে কয়বার হুতছি বইললা ভাইবো না সবসময় হুইতে দিয়াম। মাডিতে যেভাবে এতদিন ছিলা,আজও থাকবা। বিছানাত উঠার জন্য গাঁইগুঁই করবা না।’

‘মাডিত অনেক ঠান্ডা লাগে। আমারে এক কোণাত জায়গা দেও।’

‘তুমি মাডিত থাকবা মানে মাডিত থাকবা। কামলা হইয়া মালিকের ছেড়ির লগে হুইবার সাহস আর করবা না।’

‘আমি বিছানাত ঘুমাইয়াম। তুমি আমার বউ লাগো।’

‘তুমি মাডিত ঘুমাইবা। আমি তোমারে জামাই মানি না।’

‘দেহো রানি-

এরপরই একটা আর্তচিৎকার ভেসে আসে। রানি-মদন তর্ক করছে। নিশ্চয় রানি মদনকে ধাক্কা দিয়েছে। আর মদন ব্যথা পেয়েছে। পদ্মজা একবার ভাবল,দরজায় কড়া নাড়বে। এরপর ভাবল,স্বামী-স্ত্রীর অনেক কথা সে শুনে ফেলেছে। আর না শোনাই ভালো। যেহেতু তারা কারো সামনে ঝগড়া করে না,রাতে নিজ ঘরে সবার অগোচরে ঝগড়া করে। তাহলে ব্যপারটা ব্যক্তিগত। পদ্মজা সরে আসে। তবে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। এই দাম্পত্য সংসারে কী ভালোবাসা, সুখ আসবে না? মদন তো দেখতে খারাপ না। শুধু এতিম আর এই বাড়ির একজন বাধ্য ভৃত্য। এ ছাড়া তো ভীষণ সহজ-সরল। সবার সাথে হেসেখেলে কথা বলে। ঠোঁটে হাসি সবসময় থাকে।

লিখন, মৃদুল একই ঘরে একই বিছানায় শুয়েছে। লিখনের জন্য আলাদা ঘর ছিল। কিন্তু সে মৃদুলের সাথেই শুয়েছে। ছেলেটাকে খুব ভালো লেগেছে তার। সোজাসুজি কথা বলে। মনে কিছু চেপে রাখতে পারে না। এতক্ষণ বকবক করেছে। সবেমাত্র অন্যপাশে ফিরে চোখ বুজেছে। বোধহয় ঘুম পেয়েছে। লিখনের মনটা আনচান আনচান করছে। ইচ্ছে হচ্ছে,পদ্মজাকে দেখতে। একসাথে বসে গল্প করতে। কিন্তু এ তো সম্ভব নয়। এই বাড়িতে আর আসা যাবে না। পদ্মজার সামনে এলেই মন বেপরোয়া হয়ে যায়। কত-শত ইচ্ছে জেগে উঠে। লিখনের ব্যাক্তিত্ব ভীষণ শক্ত। শুধু এই একটা জায়গাতেই সে দূর্বল। এভাবে চলতে পারে না। নিজের জায়গায় নিজেকে শক্ত থাকতে হবে। লিখন জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মৃদুল ফিরে তাকাল। বলল, ‘ভাইয়ের ঘুম পাইতাছে না?’

‘হু। তুমি ঘুমাও।’

মৃদুল মেরুদণ্ড সোজা করে শুয়ে বলল, ‘আপনি –

‘আপনি না তুমি। একটু আগেই না আমাদের কথা হলো। তুমি আমাকে তুমি বলবে।’

মৃদুল হাসল। বলল, ‘তুমি যে মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করছো,সে মেয়েটা পদ্মজা ভাবি। তাই না?’

লিখন অপ্রস্তুত হয়ে উঠল। পদ্মজা যে বাড়ির বউ সে বাড়ির আত্মীয়র সাথে এসব নিয়ে কথা বলাটা নিশ্চয় অনুচিত! এতে পদ্মজার অসম্মান হবে। সে তো চায় না,পদ্মজা কষ্ট পাক। তাকে নিয়ে কেউ দুই লাইন বেশি ভাবুক। পদ্মজা সবসময় ভালো থাকুক। লিখন জোরপূর্বক হাসল। তারপর বলল, ‘কী বলছো! তেমন কিছুই না। ঘুমাও এখন। আমারও অনেক ঘুম পাচ্ছে।’

লিখন অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়ে। মৃদুল হতাশ হয়ে চোখ বুজে।

পদ্মজা অন্ধকারে ধীরে ধীরে হাঁটছে। হাতে কাঁচের গ্লাস। তাতে কুসুম গরম পানি। সিঁড়িতে পা রাখতেই কারো পায়ের আওয়াজ কানে আসে। পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে,আলমগীর চোরের মতো চারপাশ দেখে দেখে সদর দরজার দিকে যাচ্ছে। পদ্মজা দ্রুত সিঁড়ি থেকে নেমে চেয়ারের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। গ্লাস রেখে দেয় এক পাশে। তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। চোখ দুটি তীক্ষ্ণ হয়ে আলমগীরকে পরখ করছে। আলমগীরের পরনে পাঞ্জাবি। বাড়িতে ভদ্রলোকের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। শান্তশিষ্ট,চুপচাপ। মাঝেমধ্যে ঢাকা যায়। দেখা হয়,তবে কথা হয় না। কিছু প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। নিজ ইচ্ছায় কথা বলে না। আলমগীর সদর দরজা পেরিয়ে যায়। পদ্মজা সাবধানে আলমগীরের পিছু নেয়। পায়ের জুতাগুলো হাঁটার তালে মৃদু শব্দ তুলছে। তাই পদ্মজা জুতাজোড়া খুলে দরজার পাশে রেখে দিল। আলমগীর অন্দরমহলের ডান দিকে এগোচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক চারিদিকে। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছে। গা ছমছমে পরিবেশ। এদিকওদিক কোনো মৃদু শব্দ হতেই পদ্মজা উৎকর্ণ হয়ে উঠছে। কেমন গা কাটা দিচ্ছে। এতো রাতে দীর্ঘদেহী এই লোক যাচ্ছে কোথায়? হাঁটতে হাঁটতে তারা বাড়ির পিছনে চলে আসে। আলমগীর অন্দরমহলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে এটাই তার গন্তব্য। পদ্মজা কলাগাছের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। বাতাসে গা কাঁপুনি দিচ্ছে। আলমগীর টর্চ জ্বালিয়ে চারপাশ দেখে নিল। তারপর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করল। মনে হচ্ছে,কাউকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। পদ্মজার রগে রগে দামামা শুরু হয়। কী হতে চলেছে? আজ সে কী দেখবে?

পূর্ণা বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। এতক্ষণ হয়ে গেল তার আপা আসছে না কেন? সে জুতা পরে বেরিয়ে আসে। নেমে আসে নিচ তলায়। রান্নাঘরে যাওয়ার পথে পায়ে কাঁচের গ্লাস লেগে পড়ে যায়। পূর্ণা ভয় পেয়ে যায়। এখানে গ্লাস কে রাখল! আংশিক পানি তার পায়ে লাগে। মনে হচ্ছে, পানিটা গরম। এই রাতের বেলা গরম পানি এখানে…কীভাবে? পূর্ণা ভাবে, তার আপার পানি গরম করার কথা ছিল। কিন্তু গরম করে এখানে কেন রাখবে? ঘরে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। পূর্ণা রান্নাঘরে এসে দেখে পদ্মজা নেই। সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। দরজার পাশে পদ্মজার জুতা দেখে ভয়টা আরো বেড়ে যায়। সে দৌড়ে আমিরের ঘরে গেল। গিয়ে দেখল,আমির ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা নেই। পূর্ণা এবার ঘামতে থাকল। সে শুনেছে,এই বাড়িতে ভূত-জ্বীন আছে। এরা মানুষের ক্ষতি করে। বিশেষ করে সুন্দর মানুষদের। তার মানে তার আপার গুরুতর বিপদ! পূর্ণা এক দৌড়ে রান্নাঘরে আসে। লণ্ঠন জ্বালিয়ে নেয়। অন্যসময় হলে ভয় কাজ করত। আজ করছে না। সে তার আপাকে জান দিয়ে হলেও বাঁচাবে। মনে হয়,কোনো শয়তান জ্বীন তার বোনকে ধরেছে এবং পুকুরপাড়ে নিয়ে গেছে। পূর্ণা ঝটপট বেরিয়ে পড়ে। কাউকে ডাকার বুদ্ধি অবধি মাথায় আসেনি। সে আতঙ্কে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। আয়তুল কুরসি পড়তে পড়তে পুকুরপাড়ের পথ ধরে।

পদ্মজাকে চমকে দিয়ে তৃতীয় তলার একটা জানালা হাট করে খুলে যায়। সেখান থেকে একটা মোটা দড়ি আলমগীরের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। পদ্মজার ওষ্ঠদ্বয় নিজেদের শক্তিতে আলাদা হয়ে যায়। দুই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। আলমগীর সেই দড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠে যায়। দড়ি বেয়ে উপরে উঠার দ্রুততা দেখে মনে হলো,এর আগে বহুবার আলমগীর দড়ি বেয়ে উপরে উঠেছে। পদ্মজার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে। জানালা দিয়ে আলমগীর কার ঘরে গিয়েছে? তৃতীয় তলায় সে একবার গিয়েছে তাই জানেও না কোন ঘরে কী আছে। পায়ের গোড়ালিতে ঠান্ডা শিরশিরে অনুভব হচ্ছে। পদ্মজা এক হাত দিয়ে ছুঁতেই বুঝতে পারে জোঁকে ধরেছে। জোঁকে তার খুব ভয় আছে। কিন্তু এখন ভয় করছে না। এখন তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে আছে অন্যকাজে। সে জোঁক ছাড়িয়ে নিল। অনেকক্ষণ পার হয়ে যায় আলমগীরের দেখা নেই। দড়ি তো ঝুলছে। মানে নামবে আবার। পদ্মজা কোমরে এক হাত রেখে তাকিয়ে রইল। আচমকা মনে পড়ে,তৃতীয় তলায় রুম্পা আছে। ডান দিকের কোনো এক ঘরে। আর আলমগীর ডান দিকের কোনো ঘরের জানালা দিয়েই ঢুকেছে। মানে কী রুম্পার কাছে গিয়েছে? পদ্মজা বারংবার শুধু চমকাচ্ছে। আলমগীর দড়ি বেয়ে নেমে পড়ে। তারপর ইশারায় অন্য কাউকে নামতে বলে। কাঙ্ক্ষিত সেই মুখটি দেখে পদ্মজার পিল চমকে উঠে। রূম্পা! শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে দড়ি বেয়ে নামছে। বার বার দড়ি থেকে হাত ছুটে যাচ্ছে। আলমগীর দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছেন যাতে রুম্পা পড়ে গেলে তিনি ধরতে পারেন। পদ্মজার বুক দুরুদুরু করছে,যদি রুম্পা পড়ে যায়! এতো ঝুঁকি কেন নিয়েছে?

রুম্পার পা মাটিতে পড়তেই আলমগীর শক্ত করে রুম্পাকে জড়িয়ে ধরে। রুম্পার কান্নার সুর ভেসে আসে। তাৎক্ষণিক আলমগীর রুম্পার মুখ চেপে ধরে কিছু বলল। তারপর টর্চের আলো দিয়ে চারপাশ দেখে, রুম্পাকে এক হাতে শক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করল। তখন কোথেকে উদয় হয় একজন অদ্ভুত লোকের। লোকটা কালো,মোটা,লম্বা চুল। এক হাতে রাম দা, অন্য হাতে লাঠি। অজানা বিপদের আশঙ্কা পেয়ে পদ্মজার ভয় হলো। পা থেকে কিছুটা দূরে থাকা কয়েকটা পাথরের মধ্যে বড়সড় দেখে একটা পাথর হাতে নিল। যেন বিপদে কাজে লাগানো যায়। আলমগীর আর অজ্ঞাত লোকটির মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। একসময় তা হাতাহাতিতে চলে যায়। রুম্পা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেছে। অজ্ঞাত লোকটি রুম্পাকে ধরতে চাইছে। কিন্তু আলমগীর তা হতে দিচ্ছে না। পদ্মজার মনে হচ্ছে,এখন তার সামনে যাওয়া উচিত। আল্লাহর নাম নিয়ে সে কলাগাছের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটির হাত থেকে রামদা নিয়ে দূরে ফেলে দিল। তখনই সে পদ্মজাকে দেখতে পেল। চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘বোন,সাহায্য করো।’

অজ্ঞাত লোকটি পদ্মজাকে দেখে আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠল। সে ছুটে এসে ছোঁ মেরে রুম্পাকে ধরতে চাইল। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটির ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুই হাতে ঝাপটে ধরে রেখে রুম্পাকে বলে, ‘তুমি যাও রুম্পা।’

রুম্পা দৌড়ে পদ্মজার কাছে আসে। সে হাঁপড়ের মতো হাঁপাচ্ছে। ভয়ে ঘামছে। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটিকে আটকে রাখতে পারছে না। সে অনেক কষ্টে অনুরোধ করে, ‘আমার রুম্পারে ওরা মেরে ফেলবে। তুমি ওরে খালপাড়ে নিয়ে যাও বোন। আমি আজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকব।’

পদ্মজা দুই হাতে আঁকড়ে ধরে রুম্পাকে। আলমগীরের হাত থেকে পড়ে যাওয়া টর্চের আলো অজ্ঞাত লোকটির মুখে পড়তেই পদ্মজার খুব চেনা মনে হয়। আবার পারিজার খুনির বর্ণনাও ঠিক এমনই। ভাবতেই, পদ্মজার রক্ত ছলকে উঠে। সেই মুহূর্তে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে পূর্ণার। সে পুকুরপাড়ে যাচ্ছিল। টর্চের আলো পেয়ে সে এদিকে ছুটে এসেছে। অজ্ঞাত লোকটি রুম্পার উদ্দেশ্যে হাতের লাঠি ছুঁড়ে মারে। পদ্মজা দ্রুত রুম্পাকে নিয়ে সরে যায়। লাঠি গিয়ে সোজা পূর্ণার কাঁধে পড়ে। সে আপা বলে আর্তনাদ করে বসে পড়ে। পদ্মজা দিকদিশা হারিয়ে ফেলে। কী করবে সে? মনে হচ্ছে রুম্পাকে কেউ খুন করতে চাইছে তাই আলমগীর তাকে নিয়ে পালাচ্ছে। আর এই নাম না জানা লোক,রুম্পাকে আঘাত করতে চাইছে। আবার পূর্ণাও আঘাত পেয়েছে। কী করবে পদ্মজা? রুম্পাকে নিয়ে খালের দিকে যাবে? পূর্ণাকে এই ভয়ংকর পরিবেশ থেকে নিরাপদে নিয়ে যাবে? নাকি পারিজার খুনিকে ধরবে?

৫৪

থেকে থেকে দূরে হুতুম প্যাঁচা ডাকছে। যা ভুতুড়ে শোনাচ্ছে। গা কাঁপুনি ঠান্ডা। সময়টা যেন থমকে দাঁড়িয়ে চড়ছে দণ্ড শূলে। পদ্মজা ছুটে আসে পূর্ণার কাছে। পূর্ণা উবু হয়ে শুয়ে পড়েছে। কাঁদছে মা,মা করে। পদ্মজা এক হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে রুম্পাকে। আরেক হাতে পূর্ণার কাঁধে ছুঁয়ে দেখল কোথায় আঘাত পেয়েছে। ঠান্ডায় তার ঠোঁট কাঁপছে। কানে ভেসে আসছে দুজন পুরুষের ধস্তাধস্তির দুপদাপ শব্দ। পদ্মজার ঠান্ডা হাতে পূর্ণার আহত স্থানের রক্ত লাগতেই সে আঁতকে উঠল। রুম্পাকে ছেড়ে পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরল। পাশে তাকিয়ে দেখল,যে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সে লাঠির আগায় কাঁচি বাঁধা। পূর্ণার ঘাড়ের চামড়া ছিঁড়ে গেছে। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পূর্ণার পুরো শরীর। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটির সাথে আর পারছে না। সে আকুতি, মিনতি করে পদ্মজাকে বলছে, ‘পদ্মজা,পদ্মজা, বোন সহায় হও।’

টানাপোড়নে পদ্মজার হাত পা কাঁপতে থাকল। সে পূর্ণাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। পূর্ণা কিছুতেই উঠতে পারছে না। যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে সে। পূর্ণার কান্না দেখে পদ্মজার বুক ব্যথায় বিষে যাচ্ছে। এই রাত, রাতের আঁধার এতো পাষাণ কেন হলো! আলমগীরের আর্তনাদ ভেসে আসে। পদ্মজা চমকে ফিরে তাকাল। অজ্ঞাত লোকটি আলমগীরের স্পর্শকাতর স্থানে অস্বাভাবিকভাবে আঘাত করেছে। ফলে সে দূর্বল হয়ে আর্তনাদ করে উবু হয়ে ছটফট করছে। অজ্ঞাত লোকটি দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে ছুটে এসে রুম্পাকে ধরতে চাইল। পদ্মজা বাধা হয়ে দাঁড়াল। অজ্ঞাত লোকটি কর্কশ কণ্ঠে পদ্মজাকে হুংকার দিল, ‘আমার কাম আমারে করতে দে।’

একটা মানুষের কণ্ঠস্বর এতো ভয়ংকর কী করে হয়! এই কণ্ঠস্বর যে কাউকে কাঁপিয়ে তুলবে। পদ্মজা কিঞ্চিৎ চমকালেও থেমে থাকল না। উত্তরে হাওয়ায় তার চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সে অজ্ঞাত লোকটির মতোই হুংকার দিয়ে বলল, ‘নিজের ভালো চান তো আত্মসমর্পণ করুন।।

পদ্মজার কথা শুনে লোকটি ব্যঙ্গ করে হাসল। খুব কাছ থেকে অজ্ঞাত লোকটির মুখ দেখে পদ্মজা কপাল কুঁচকে ফেলল। লোকটির মুখ থেকে বিশ্রি একটা দূর্গন্ধ আসছে। স্বাস্থ্যবান দেহ,গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। সাদা দাঁতকপাটি আর লাল ভয়ংকর চোখ দুটিই আগে নজর কাড়ছে। পদ্মজা কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই অজ্ঞাত লোকটি পদ্মজাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। এরপর লাঠি হাতে তুলে নিল। রুম্পা ছুটে পালাতে চাইল। কিন্তু পারল না। অজ্ঞাত লোকটি তার গলা চেপে ধরল।

পদ্মজা দৌড়ে এসে অজ্ঞাত লোকটির পিঠে কিল ঘুষি দিল। তাও কাজ হলো না। পদ্মজার গায়ের শক্তি লোকটিকে এক চুলও নাড়াতে পারেনি। রুম্পা গোঙাচ্ছে। পূর্ণা যন্ত্রনায় কাঁদছে,ভয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। নিশাচর পাখিরা আজ যেন অদ্ভুত স্বরে ডাকাডাকি করছে। কেমন গা কাঁপিয়ে তোলা! ঝিঁঝিঁপোকাদের ডাক বেড়েছে,কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বাতাসের বেগ।

অজ্ঞাত লোকটির হিংস্র থাবা রুম্পাকে গ্রাস করে নিয়েছে। লোকটি পা দিয়ে মাটি থেকে লাঠি তুলল। তারপর লাঠির আগা থেকে কাঁচি হাতে নিল।

আর একটু ক্ষণ তাহলেই সেই ধারালো কাঁচি রুম্পার গলার রগ টেনে নিবে। উড়ে যাবে রুম্পার রুহ। আলমগীর নিজের যন্ত্রণা ভুলে ছুটে আসে তার সহধর্মিণীর প্রাণ বাঁচাতে। তার আগেই ঘটে যায় ভয়ংকর এক দৃশ্য। পদ্মজা অজ্ঞাত লোকটির পড়ে থাকা রামদা তুলে তার পিঠেই কোপ বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাত লোকটি লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ফলে রাম দা আরো গভীরে প্রবেশ করে। গরু জবাইয়ের পর গরু যেভাবে কাতরায় অজ্ঞাত লোকটি সেভাবে কাতরাতে থাকল। রক্ত ছিটকে পড়ে পদ্মজার শাড়িতে,মুখমণ্ডলে। কাতরাতে থাকা দেহটি ডিঙিয়ে আলমগীর রুম্পার কাছে যায়। তারপর পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজার বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে। চোখে যেন ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায় দেহটি। নিস্তেজ হয়ে পড়ে পদ্মজাও। সে এলোমেলো পায়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। তার শরীর কিঞ্চিৎ কাঁপছে। এটা সে কী করেছে! এ যে অচিন্তনীয় কাজ! সব এলোমেলো লাগছে। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। গা গুলিয়ে উঠছে।

পূর্ণা এই দৃশ্য দেখে নিজের রক্তক্ষরণ ভুলে যায়। ভয়ে কাঁপতে থাকে। নাভি উল্টে বমি বেরিয়ে আসে। আলমগীর তাড়াহুড়ো করে পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল। পদ্মজার বুকে বইছে অপ্রতিরোধ্য তুফান! সে নিষকম্প চোখে তাকিয়ে আছে নিথর দেহটির দিকে। আলমগীর একটা চাবি পদ্মজার হাতে গুঁজে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলল, ‘ভয় পেয়ো না। এই বাড়িতে দিন দুপুরে খুন হলেও তা বাইরের কেউ জানবে না। সকালে উঠে দেখবে এখানে বাবলুর লাশও নেই রক্তও নেই। কেউ না কেউ সরিয়ে দিবে। সব দুঃস্বপ্ন মনে হবে। দ্রুত ঘরে ফিরে যাও। আমার অনেক কথা বলার আছে। আমি চিঠি লিখব। তোমার বাপের বাড়ির ঠিকানায়। আসছি।’

রুম্পা দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরল। তার বুকটা হাহাকার করছে। পদ্মজার কথা খুব মনে পড়বে। আলমগীর অস্থির হয়ে চারিদিক দেখছে। আতঙ্কে সে কাঁপছে। এই বুঝি কেউ এসে গেলো। আর রুম্পাকে আবার বন্দি করে দিল। এমন অশান্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। আতঙ্কে যেকোনো মুহূর্তে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রুম্পা পদ্মজাকে কিছু বলতে চেয়েছিল,আলমগীর বলতে দিল না। তার আগেই টেনে নিয়ে দৌড়াতে থাকল। পদ্মজা তাদের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকল। ঝিঁঝিঁপোকাদের আলোর ভীড়ে দুজন হারিয়ে যাচ্ছে। তারা বাঁচার আশায় দৌড়াচ্ছে। না হওয়া সংসার পাতার স্বপ পূরণ করতে দৌড়াচ্ছে। দুজন আড়াল হয়ে যেতেই পদ্মজা দুই হাতে নিজের মুখ ছুঁলো। এরপর দুই হাত সামনে এনে দেখল,টকটকে লাল রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে সে বমি করতে থাকল। তারপরপরই সম্বিৎ ফিরল। সে পূর্ণাকে খুঁজতে থাকল। একটু দূরে পূর্ণা ঘাসের উপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। পদ্মজা দৌড়ে আসে। পূর্ণা পিটপিট করে তাকায়। পূর্ণাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। একুশ বছর বয়সী একটা মেয়ের শরীর তো কম ভারি নয়। পদ্মজার শক্তিতে কুলোচ্ছে না। সে পূর্ণাকে আকুতি করে বলল, ‘উঠার চেষ্টা কর বোন।’

পূর্ণার শরীরে ভূমিকম্প বয়ে যাচ্ছে। সে পুরো ভর পদ্মজার উপর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। পদ্মজা শরীরের পুরোটা শক্তি দিয়ে পূর্ণাকে আগলে ধরে সামনে হাঁটা শুরু করে। পদ্মজার পা জোড়া ঠকঠক করে কাঁপছে। সে জানে না এটা শীতের কাঁপুনি নাকি ভয়ংকর কোনো কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার উত্তেজনা। মনে হচ্ছে যেন ভয়ংকর একটা ঝড় হুট করে শুরু হয়ে হুট করে থেমে গেছে। আর রেখে গেছে নিঃশ্বাস থামিয়ে দেওয়া নিস্তব্ধতা। পদ্মজা ঘামছে, কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছে,এই বুঝি মৃত বাবলু উঠে দাঁড়াল। অনেক অনেক প্রেতাত্মা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দুই বোনের উপর!

জঙ্গলের গাছপালা থেকে প্যাঁচাদের দল তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে,সদ্য খুন হওয়া একটা মৃত দেহ পড়ে আছে ঘাসের উপর। আরেকটু দূরে ছিমছাম গঠনের শাড়ি পরা একটা মেয়ে চুল খোলা রেখে এলোমেলো পায়ে আরেকটা দূর্বল দেহকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির ভেতর! দুজনের গায়ে তাজা লাল রক্ত। এই দৃশ্য তো রাতের আঁধারের চেয়েও ভয়ংকর! যার স্বাক্ষী হয়ে রইল রাতের আঁধার আর নিশাচর পাখিরা।

প্রতিদিনের মতোই ভোরের আলো নিকষকালো রাতকে ঠেলে দূরে সরিয়ে পৃথিবীটাকে আলোকিত করে তুলেছে। পাখিরা কিচিরমিচির করে ডাকছে। নতুন করে শুরু হয়েছে আরেকটা দিন। শুধু পদ্মজার সময়টা থমকে গেছে। সে তার গোসলখানায় বসে আছে। কনকনে ঠান্ডায় গোসল করেছে। এরপর থেকেই উদাসীন হয়ে ভেজাকাপড়ে বসে আছে। পূর্ণা অন্য ঘরে ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা রাতে ধীরেসুস্থে পূর্ণার ক্ষত সামলেছে। বুঝতে দেয়নি,সে মনে মনে কতোটা ভেঙে পড়েছে। যখন রাতে তারা দুই বোন দুই তলায় উঠছিল,তখন পিছনে কেউ যেন ছিল! এতো চিৎকার, চেঁচামিচি হয়েছে আর কেউ শুনেনি? অন্দরমহলের রিদওয়ান এবং মজিদের ঘরের মানুষদের তো শোনার কথা ছিল। কারণ তাদের ঘর ডান দিকে,আর ডান দিকেই এতো বড় ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে। পূর্ণা জোরে জোরে কেঁদেছে,আলমগীর চেঁচিয়েছে। বাবলু নামের সেই লোকটি খুন হওয়ার সময় আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করেছিল। দুপদাপ শব্দ তুলে কাতরেছিল। তবুও কেউ আসেনি! কেন? তার কেন মনে হচ্ছে,সবাই শুনেছে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। পদ্মজার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে। সবকিছু কেমন ওলটপালট লাগছে। কাউকে খুন করার মতো সাহস কী করে হলো? এ কী মা হেমলতার গুণ! পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখ পড়ে আলমগীরের দেয়া চাবিটার দিকে। চাবিটা দেখতে অনেক বড়। সে অপলক চোখে চাবির দিকে তাকিয়ে থাকল।

আমির ঘুম থেকে উঠে পদ্মজাকে দেখতে না পেয়ে গোসলখানায় উঁকি দিয়ে পদ্মজাকে দেখে সে চমকে উঠল। পদ্মজার শাড়ি হাঁটু অবধি তোলা। আঁচল বুকে নেই। চুল এলোমেলো। গায়ের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। থেমে থেমে কাঁপছে। তাতেও পদ্মজার ভ্রুক্ষেপ নেই। আমির হন্তদন্ত হয়ে গোসলখানায় প্রবেশ করল। পদ্মজার দুই বাহু দুই হাতে চেপে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল, ‘পদ্মবতী, কী হয়েছে? এ কী অবস্থা তোমার।’

পদ্মজা কিছু বলল না। সে আমিরের চোখের দিকে নিজের চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখল। আমির দ্বিগুণ বিচলিত হয়ে বলল, ‘এই পদ্ম, তুমি কাঁপছো তো। কী হয়েছে?’

পদ্মজার ঠোঁট দুটি ভেঙ্গে আসে। আর চোখ ছাপিয়ে জল। আমির অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা আচমকা আমিরকে জড়িয়ে ধরল। আমিরের পুরো শরীর মুহূর্তে ঠান্ডা বরফ হয়ে যায়। পদ্মজা বাঁধভাঙা নদীর মতো হু হু করে কাঁদতে থাকল। আমির শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বলো না কী হয়েছে? আমার চিন্তা হচ্ছে।’

পদ্মজা আরো শক্ত করে আমিরকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি…আমি খ.খুন করেছি।’

‘কী…কী বলছো! এই পদ্মজা।’

পদ্মজা আমিরের পিঠ খামচে ধরে বলল, ‘আ…আমি.এটা কেমনে করলাম!’

আমির পদ্মজাকে নিজের সামনাসামনি বসিয়ে বলল, ‘আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। সব বলো না আমাকে! কান্না থামাও।’

পদ্মজা মেঝেতে দৃষ্টি রেখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে পুরো ঘটনাটা বলল। সে নিজের কাজে নিজে অবাক। আমির পদ্মজাকে শান্ত করার জন্য বুকের সাথে চেপে ধরে বলল, ‘কিছু হয়নি। শান্ত হও। কান্না থামাও।’

পদ্মজার কান্না থামে। সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। মস্তিষ্ক শূন্যের কোঠায়। আমির তা বেশ বুঝতে পেরেছে। আলমারি থেকে শাড়ি,ব্লাউজ নিয়ে আসল। নিজে পদ্মজাকে পরিয়ে দিল। পদ্মজার পুরো শরীর যেন শরীর না, বরফ। এতোই ঠান্ডা! আমির পদ্মজার চুল মুছে দিয়ে বলল, ‘ঘরে চলো। না, থাক। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

পদ্মজা তরঙ্গহীন স্বরে বলল, ‘তোমার ঘাড়ে টান পড়বে। আমি যেতে পারব।’

আমির পদ্মজাকে ধরে ধরে নিয়ে আসে। পদ্মজাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে লেপ জড়িয়ে দিল গায়ে। তারপর বলল, ‘আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না। ডান দিকে তো?’

পদ্মজা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আমির সোয়েটার পরে বেরিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে বলল, ‘কই কোথাও তো কিছু পাইনি।’

পদ্মজা চমকে গেল। দ্রুত উঠে বসল। তারপর চোখ বড়বড় করে জানতে চাইল, ‘লাশ বা রক্ত কিছুই নেই?’

আমির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘না তো। তুমি রাতে স্বপ্ন দেখেছো বোধহয়।’

পদ্মজা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। অস্থির হয়ে পড়ে। এটা কী করে সম্ভব! এই কাকডাকা ভোরে লাশ থাকবে না কেন! আলমগীরের বলা কথাগুলো মনে পড়তেই পদ্মজা সব বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে আবার শুয়ে পড়ে। চোখ বুজে। তার ঠোঁট দুটি তিরতির করে কাঁপছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *