আমি পদ্মজা – ৩৫

৩৫

বাসন্তী গাঢ় করে ঠোঁটে লিপস্টিক দিচ্ছেন। প্রেমা,প্রান্ত বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। তারা দুজন বাসন্তীকে মেনে নিয়েছে। বাসন্তীর কথাবার্তা, চালচলন আলাদা। যা ছোট দুটি মনকে আনন্দ দেয়। আগ্রহভরে বাসন্তীর কথা শুনে তারা। লিপস্টিক লাগানো শেষ হলে বাসন্তী প্রেমাকে বলল, ‘তুমি লাগাইবা?’

প্রেমা হেসে মাথা নাড়ায়। বাসন্তীর আরো কাছে ঘেঁষে বসে। বাসন্তী প্রেমার ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক গাঢ় করে ঘষে দিল। এরপর প্রান্তকে বলল, ‘তুমিও লাগাইবা আব্বা?’

‘জি।’ বলল প্রান্ত। প্রেমাকে লিপস্টিকে সুন্দর লাগছে। তাই তারও ইচ্ছে হচ্ছে।

বাসন্তী প্রান্তর ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার জন্য উঁবু হোন। পূর্ণা বেশ অনেকক্ষণ ধরে এসব নাটক দেখছে। এই মহিলাকে সে একটুও সহ্য করতে পারে না। এক তো সৎ মা। বাপের আরেক বউ। তার উপর এই বয়সে এসে এতো সাজগোজ করে। প্রান্তকে লিপস্টিক দিচ্ছে দেখে তার গা পিত্তি জ্বলে উঠল। ঘর থেকে দপদপ করে পা ফেলে ছুটে আসে। প্রান্তকে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘হিজরা সাজার ইচ্ছে হচ্ছে কেন তোর? কতবার বলছি এই বজ্জাত মহিলার সাথে না ঘেঁষতে?’

বাসন্তী ভয় পান পূর্ণাকে। মেয়েটা খিটখিটে, বদমেজাজি। হেমলতা বলেছেন, সেদিনের দূর্ঘটনার পর থেকে পূর্ণা এমন হয়ে গেছে। হুটহাট রেগে যায়। কথা শুনে না। পদ্মজা যাওয়ার পর থেকে আরো বিগড়ে গেছে। এজন্য যথাসম্ভব পূর্ণাকে এড়িয়ে চলেন। তবুও এসে আক্রমণ করে বসে। গত দুই সপ্তাহে মেয়েটা অতিষ্ঠ করে তুলেছে জীবন। তিনি কাটা কাটা গলায় পূর্ণাকে বললেন, ‘এই ছিক্ষা পাইছো তুমি? গুরুজনদের সাথে এমনে কথা কও।’

‘আপনি চুপ থাকেন। খারাপ মহিলা। বুড়া হয়ে গেছে এখনও রঙ-ঢঙ করে।’

পূর্ণার কথা মাটিতে পড়ার আগে তীব্র থাপ্পড়ে সে মাটিতে উল্টে পড়ল। চোখের দৃষ্টি গরম করে ফিরে তাকায় সে, দেখার জন্য, কে মেরেছে তাকে! দেখল হেমলতাকে। হেমলতা অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছেন। যেন চোখের দৃষ্টি দিয়ে পূর্ণাকে পুড়িয়ে ফেলবেন। পূর্ণার চোখ শিথিল হয়ে আসে। সে চোখ সরিয়ে নেয়। হেমলতা বললেন, ‘নিজেকে সংশোধন কর। এখনও সময় আছে।’

পূর্ণা নতজানু অবস্থায় বলল, ‘আমি এই মহিলাকে সহ্য করতে পারি না আম্মা।’

‘করতে হবে। উনার অধিকার আছে এই বাড়িতে।’

‘আমি খুন করব এই মহিলাকে।’ পূর্ণার রাগে শরীর কাঁপছে।

পূর্ণার অবস্থা দেখে হেমলতার দৃষ্টি গেল থমকে। পূর্ণা কেন এমন হলো? তিনি কী এক মেয়ের শূন্যতার শোক কাটাতে গিয়ে আরেক মেয়েকে সময় দিচ্ছেন না। বুঝিয়ে, শুনিয়ে পূর্ণাকে আবার আগের মতো করতে হবে। তিনি কণ্ঠ খাদে নামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এরপর পূর্ণা যা বলল তিনি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। পূর্ণা বাসন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বেশ্যার মেয়ে বেশ্যাই হয়। আর বেশ্যার সাথে এক বাড়িতে থাকতে ঘৃণা করে আমার।’

হেমলতা ছুটে যান বাইরে। বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ফিরে আসেন। বাসন্তী দ্রুত আগলে ধরেন পূর্ণাকে। হেমলতাকে অনুরোধ করেন, ‘এত বড় ছেড়িডারে মাইরো না। ছোট মানুছ। বুঝে না।’

‘আপা, আপনি সরেন। ও খুব বেড়ে গেছে।’

বাসন্তীর স্পর্শ পূর্ণার ভালো লাগছে না। সে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পূর্ণার পিঠে বারি মারলেন। পূর্ণা আর্তনাদ করে শুয়ে পড়ে। হেমলতা আবার মারার জন্য প্রস্তুত হোন, বাসন্তী পূর্ণাকে আগলে বসেন। অনুরোধ করেন, ‘যুবতি ছেড়িদের এমনে মারতে নাই। আর মাইরো না।’

প্রেমা,প্রান্ত ভয়ে গুটিয়ে গেছে। হেমলতার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। তিনি বাঁশের কঞ্চি ফেলে লাহাড়ি ঘরের দিকে যান। বারান্দায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মনে মনে মোর্শেদের উপর ভীষণভাবে ক্ষেপে যান। মোর্শেদ চিৎকার করে করে বাসন্তীর সম্পর্কে সব বলেছে বলেই তো পূর্ণা জেনেছে। আর তাই এখন পূর্ণা কারো অতীত নিয়ে আঘাত করার সুযোগ পাচ্ছে। মোড়ল বাড়ির ছোট সংসারটা কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। হেমলতা আকাশের দিকে তাকিয়ে হা করে নিঃশ্বাস নেন। সব কষ্ট,যন্ত্রণা যদি উড়ে যেত। সব যদি আগের মতো হয়ে যেত। সব কঠিন মানুষেরাই কী জীবনের এক অংশে এসে এমন দূর্বল হয়ে পড়ে? কোনো দিশা খুঁজে পায় না?

.

আমির বিছানায় বসে উপন্যাসের বই পড়ছে। ছয়দিন পর পদ্মজার মেট্রিকের ফলাফল। এরপরই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হবে। যদিও ফরিনা বেগম রাজি নন। কিন্তু আমির মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সে পদ্মজাকে রাজধানীতে নিবেই। পদ্মজার কথা মনে হতেই আমির বই রেখে গোসলখানার দরজার দিকে তাকাল। তার ঘরের সাথে আগে গোসলখানা ছিল না। পদ্মজার জন্য করা হয়েছে। সে বই রেখে সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তখনি পদ্মজা চিৎকার করে উঠল। তাই দ্রুত দৌড়ে গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। পদ্মজা শাড়ি দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছে। কিছুটা কাঁপছে। আমির দ্রুত কাছে এসে বলল, ‘কী হয়েছে?’

‘ওখানে,ওখানে কে ছিল। আ…আমাকে দেখছিল।’

পদ্মজার ইঙ্গিত অনুসরণ করে আমির সেদিকে তাকাল। গোসলখানার ডান দেয়ালের একটা ইট সরানো। সকালে তো সরানো ছিল না! পদ্মজা কাঁদতে থাকল। কাপড় পাল্টাতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ে দেয়ালে। আর তখনই দুটি চোখ দেখতে পায়। সে তাকাতেই চোখ দুটি দ্রুত সরে যায়। পদ্মজার পিল চমকে উঠে। আমির পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুকনো কাপড় পরে আসো। কেঁদো না।’

কথা শেষ করেই সে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার তাড়া দেখে মনে হলো, অজ্ঞাত আগন্তুককে আমির চিনে। পদ্মজা দ্রুত কাপড় পরে নিল। এরপর আমিরকে খুঁজতে থাকল। আমির সোজা রিদওয়ানের ঘরের দিকে যায়। রিদওয়ান পানি পান করছিল। আমির গিয়ে রিদওয়ানের বুকের শার্ট খামচে ধরে। চিৎকার করে বলল, ‘তোকে সাবধান করেছিলাম। দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিলাম।’

‘শার্ট ছাড়।’

‘ছাড়ব না। কী করবি? তুই আমার বউয়ের দিকে কু-নজর দিবি আর আমি ছেড়ে দেব?’

‘প্রমাণ আছে তোর কাছে?’

‘কুত্তার বাচ্চা,প্রমাণ লাগবে? আমি জানি না?’

‘আমির মুখ সামলা। গালাগালি করবি না।’

‘করব। কী করবি তুই?’

‘আবার বলছি,শার্ট ছাড়।’

আমির ঘুষি মারে রিদওয়ানের নাকে। রিদওয়ান টাল সামলাতে না পেরে পালঙ্কের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চিৎকার, চেঁচামিচি শুনে বাড়ির সবাই রিদওয়ানের ঘরে ছুটে আসে।

৩৬

পদ্মজা ঘরের চৌকাঠে পা দিল মাত্র। আমির রিদওয়ানকে টেনে হিঁচড়ে তুলে বলল, ‘তোকে না করেছিলাম। বার বার না করেছি। তবুও শুনলি না।’

রিদওয়ান শক্ত দুই হাতে আমিরকে ধাক্কা মেরে ছুঁড়ে ফেলে দূরে। আমির আলমারির সাথে ধাক্কা খেয়ে আরো হিংস্র হয়ে উঠে। রিদওয়ানের দিকে তেড়ে আসে। নূরজাহান দৌড়ে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ান। চিৎকার করে বললেন, ‘কী অইছে তোদের? তোরা এমন করতাছস কেন?’

‘দাদু, সরে যাও। মাদা** বাচ্চারে আমি মেরে ফেলবো।’

‘তুই কী ভালা মানুষের বাচ্চা?’ তেজ নিয়ে বলল রিদওয়ান।

আমির নূরজাহানকে ডিঙিয়ে রিদওয়ানকে আঘাত করতে প্রস্তুত হলো। তখন মজিদ হাওলাদারের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘যে যেখানে আছো, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।’

আমির মজিদ হাওলাদারকে এক নজর দেখে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। পরেই জ্বলে উঠে বলল, ‘আব্বা,আপনি জানেন না ও কী করছে? পদ্মজা গোসল করছিল,ও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল।’ আমিরের কণ্ঠ থেকে যেন অগ্নি ঝরছে।

ফরিনা,আমিনা,রানি সহ হাওলাদার বাড়িতে কাজ করা দুজন মহিলা ছিঃ ছিঃ করে উঠল। রিদওয়ান সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘তোর কাছে কী প্রমাণ আছে?’

‘প্রমাণ লাগবে? আমি জানি এটা তুই ছিলি। বিয়ের রাতেও তুই পদ্মজার কাছে গিয়েছিলি।’

‘অপবাদ দিবি না।’

‘তুই ভালো করেই জানিস আমি অপবাদ দিচ্ছি না।’

‘তুমি কী করে শত ভাগ নিশ্চিত হতে পারছো ছেলেটা রিদওয়ানই ছিল?পদ্মজা দেখেছে? নাকি তুমি? ‘ বললেন মজিদ।

‘আব্বা, কেউ দেখেনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত ওই চরিত্রহীনটা রিদু। কারণ, আমার আগে থেকে ও পদ্মজাকে পছন্দ করতো।’

পদ্মজা বিস্ময়ে তাকাল। কী হচ্ছে,কী সব শুনছে? ফরিনার দুই ঠোঁট হা হয়ে গেল। মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। আমিনা বললেন, ‘আপা,আমি আগেই কইছিলাম এই ছেড়ি বিনাশিনী। এই ছেড়ির রূপ আগুনের লাকান। এই ছেড়ির জন্যে এখন বাড়ির ছেড়াদের ভেজাল হইতাছে।’

আমির আমিনার কথা শুনেও না শোনার ভান করল। মজিদকে বলল, ‘আব্বা,আপনি এর বিচার করবেন? না আমি ওরে মেরে ফেলব? আর আম্মা, এরপরও বলবা এই বাড়িতে রেখে যেতে পদ্মজাকে। আমাকে তো ফিরতেই হবে ঢাকা। পদ্মজাকে রেখে আমি কিছুতেই যাব না। মনে রেখো। আব্বা তুমিও কথাটা মনে রেখো, আমি তোমার ব্যবসায় আর নেই। যদি পদ্মজা আমার সাথে ঢাকায় না যায়।’

‘তুমি যেখাবে যাবা তোমার বউতো সেখানেই যাবে। বউ রেখে যাবা কেন? আর রিদওয়ান তুমি আমার সাথে আসো। তোমার সাথে আমার বোঝাপড়া আছে।’

মজিদ হাওলাদার বেরিয়ে যান। আমির পদ্মজার হাতে ধরে পদ্মজাকে বলল, ‘আর কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না।’

খুশিতে পদ্মজার চোখের তারায় অশ্রু জ্বলজ্বল করে উঠে। সে আমিরের এক হাত শক্ত করে ধরে বোঝায়, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিশ্বাস করি।’

.

সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্ত। এমন সময় হাওলাদার বাড়ির রাতের রান্না করা হয়। মগা এক ব্যাগ মাছ দিয়ে গেছে। লতিফা মাছ কাটছে। লতিফা এই বাড়ির কাজের মেয়ে। সবাই ছোট করে লুতু ডাকে। ফরিনা ভাত বসিয়েছেন। আর অনবরত বলে চলেছেন, ‘আমি এই বাড়ির বড় বান্দি। দাসী আমি। বাবুর বাপ দাসী পুষে রাখছে। দাসী পালে। সারাদিন কাম করি। অন্যরা হাওয়া লাগাইয়া ঘুরে। মরণ হয় না আমার। মরণই আমার একমাত্র শান্তি।’

পদ্মজা গুনগুন করে গান গাচ্ছে আর রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরছে। ফরিনার সব কথাই তার কানে আসছে। তার গায়ে লাগছে না। বরং হাসি পাচ্ছে। সে বহুবার রান্নাঘরে গিয়েছে কাজ করার জন্য। ফরিনা তাড়িয়ে দিয়েছেন। কাজ করতে হবে না বলেছেন। আর এখন বলছেন,কেউ সাহায্য করে না। পদ্মজা পা টিপে টিপে রান্না ঘরে ঢুকল। বলল, ‘আম্মা, আমি সাহায্য করি?’

‘এই ছেড়ি তুমি এতো বেয়াদব কেরে? কতবার কইছি তোমার সাহায্য করতে হইব না।’

‘না…মানে আপনি বলছিলেন, কেউ সাহায্য করে না।’

‘তোমারে তো বলি নাই। তোমার গায়ে লাগে কেন?’

‘মেঝে ঝাড়ু দিয়ে দেই?’

‘তোমারে কইছি আমি? তুমি যাও এন থাইকা। যাও কইতাছি।’

পদ্মজা বেরিয়ে আসে। বাসায় লাবণ্য নেই,আমির নেই। কার কাছে যাবে? রানি আছে! রানির কথা মনে হতেই পদ্মজা রানির ঘরের দিকে এগোল। যাওয়ার পথে সন্ধ্যার আযান ভেসে আসে কানে। তাই আর সেদিকে এগুলো না। নিজের ঘরের দিকে হেঁটে গেলো। নামায পড়তে হবে।

নামায পড়ে, সূরা ইয়াসিন একবার পড়ল। এরপর জানালা লাগাতে গিয়ে রানিকে দেখতে পেল। সেদিনের মতো জঙ্গলের ভেতর ঢুকছে। আর কিছু মুহূর্ত পার হলে চারিদিক রাতের গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। এমন সময় কী করতে যাচ্ছে ওখানে? এতো সাহসই কী করে হয়? পদ্মজা হুড়মুড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়। আজ সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। লাবণ্য সবে মাত্র সদর ঘরে ঢুকেছে। পদ্মজাকে তাড়াহুড়ো করে কোথাও যেতে দেখে বলল, ‘কী রে, কই যাস?’

পদ্মজা চমকে উঠল। এরপর বলল, ‘এইতো…এইখানেই। কই ছিলি? আচ্ছা, পরে কথা বলব আসি এখন।’

লাবণ্য ঠোঁট উল্টে পদ্মজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। এরপর মনে মনে ভেবে নিল, দুই তলা থেকে হয়তো দেখেছে দাভাই আসছে। তাই এগিয়ে আনতে যাচ্ছে। সে নিজ ঘরের দিকে চলে গেল। পদ্মজা কখনো বাড়ির পিছনের দিকে যায়নি। এই প্রথম যাচ্ছে। বাড়ির ডান পাশে বিশাল পুকুর। কালো জল। অথচ,বাড়ির সামনের পুকুরের জল স্বচ্ছ।

দুই মিনিট লাগে শাক-সবজির ক্ষেত পার হতে। বাড়ির পিছনে এরকম শাক-সবজির বাগান আছে সে জানতো না। এরপর পৌঁছালো জঙ্গলের সামনে। সেখান থেকে অন্দরমহলের দিকে তাকাল। ওইতো তাদের ঘরের জানালা দেখা যাচ্ছে। আরেকটা জানালাও দেখা যাচ্ছে। পদ্মজা কপাল কুঁচকে খেয়াল করল, সেই জানালার গ্রিল ধরে কেউ তাকিয়ে আছে। পদ্মজা ঠাওর করার চেষ্টা করল এটা কার ঘর। মনে হতে বেশি সময় লাগল না। এটা রূম্পা ভাবির ঘর। তবে কী তিনিই তাকিয়ে আছেন? পদ্মজা আবার তাকাল। রূম্পা জানালার পর্দা সরিয়ে হাত নাড়ায়। পদ্মজা মৃদু হেসে হাত নাড়াল। দূর থেকে রুম্পার মুখটা দেখে মনে হচ্ছে,সে কিছু বলতে চায় পদ্মজাকে। তার ভেতর লুকানো আছে কোনো এক রহস্যময় গল্প।

‘ভাবি এইনে কী করেন রাইতের বেলা?’

ভূমিকম্পে ভূমি যেভাবে কেঁপে উঠে,পদ্মজা ঠিক সেভাবেই কেঁপে উঠল। তাকিয়ে দেখল, মদনকে। সে জঙ্গলের ভেতর থেকেই এসেছে। পদ্মজা আমতাআমতা করে বলল, ‘হা…হাঁটতে এসেছিলাম।’

‘এই রাইতের বেলা?’

‘বিকেল থেকেই। এখন ফিরে যাচ্ছিলাম।’

‘চলেন এক সাথে যাই। জায়গাডা ভালা না ভাবি। আপনি হইছেন সুন্দরী মানুষ। জ্বিন,ভূতের আছর পড়ব।’

‘আপনি যান। আমি আসছি।’

‘আর কী করবেন এইহানে?’

পদ্মজা জঙ্গলের দিকে তাকাল। অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়! সব জঙ্গল অযত্নে বেড়ে উঠলেও এই জঙ্গল যেন যত্নে বেড়ে উঠা। সে অন্ধকারে খোঁজার চেষ্টা করল রানিকে। পেল না। এদিকে মদনের সাথে না গেলে সে বাড়িতে যদি বলে দেয়। তাহলে অনেকের প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হবে। আর একটার পর একটা মিথ্যে বলতে হবে। পদ্মজা মনে মনে পরিকল্পনা করে, মদনের সাথে বাড়ি অবধি গিয়ে আবার চলে আসবে।

৩৭

মদন কিছুতেই যাচ্ছে না। আর পদ্মজা অন্দরমহলের ভেতর ঢুকতে চাইছে না। সে বার বার বলছে, ‘আমি একটু হাঁটব এদিকে। আপনি যান।’

‘রাইতের বেলা একলা থাকবেন। আমার কাম আপনারারে দেইখা রাখা।’

‘এদিকে তো আলো জ্বলছে। উনিও আসবেন এখন। আপনি যান। আর আপনার পা তো কাদামাখা। বেশিক্ষণ এভাবে না থেকে ধুয়ে আসুন।’

মদন পায়ের দিকে তাকাল। লুঙ্গি হাঁটু অবধি তুলে বেঁধে রাখা। সে হেসে বলল, ‘আইচ্ছা তাইলে আমি ধুইয়া আইতাছি। বেশিখন(বেশিক্ষণ) লাগব না।’

‘আচ্ছা,আসুন।’

মদন চলে যেতেই পদ্মজা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। গলার মাঝে যেন কাঁটা বিঁধে ছিল। বাড়ির পিছনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখলে পেল আমিরকে। আমির আলগ ঘর পেরিয়ে এদিকেই আসছে। পদ্মজা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারল না। আলগ ঘরের দিকে চেয়ে রইল। আমির পদ্মজাকে দেখতে পেয়ে লম্বা করে হাসল। বলল, ‘পদ্মবতী কী আমার জন্য অপেক্ষা করছে?’

‘বোধহয় করছি।’

আমির ভ্রুকুটি করে বলল, ‘বোধহয় কেন?’

‘ঘরে একা ভালো লাগছিল না। তাই হাঁটতে বের হয়েছিলাম। আপনি নামায পরেছেন?’

‘এইযে মাথায় টুপি। মসজিদ থেকে আসলাম।’

পদ্মজা আড়চোখে অন্দরমহলের ডান দিকে তাকায়। সেখানে কী সে যেতে পারবে না? পদ্মজা উসখুস করতে থাকল। আমির পদ্মজাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আমিরের কাজে পদ্মজা হতভম্ব হয়ে গেল। দ্রুত এদিকওদিক তাকিয়ে দেখল,কেউ আছে নাকি। এরপর আমিরের হাতের বাঁধন ছুটানোর চেষ্টা করতে লাগল। আর বলল, ‘ছাড়ুন,কেউ দেখবে। ‘

‘কেউ দেখবে না। এদিকে কেউ নেই।’ আমিরের কণ্ঠ মোহময়। সে পদ্মজার ঘাড়ে থুতুনি রাখল। এরপর ঠোঁটের ছোঁয়া লাগাতেই পদ্মজা কেঁপে উঠল। জোর করে আমিরের হাতের বাঁধন ছুটিয়ে সরে গেল। বলল, ‘আপনি ঘরে যান।’

‘আচ্ছা,চলো।’

‘আপনি যান,আমি আসছি।’

‘কেন? তুমি কোথায় যাবে?’

পদ্মজা নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবল। এরপর বলল, ‘আলগ ঘরে যাব। আপনি ঘরে যান। নয়তো আম্মা আমাকে খুঁজবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব। এরপর সব বলব।’

‘আরে, কী করবে বলবে তো।’

‘আপনি যান না।’

পদ্মজা ঠেলে আমিরকে অন্দরমহলের দিকে পাঠাল। আমির অসহায় মুখ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমিও থাকি?’

‘আপনি ঘরে গিয়ে বসবেন আর আমি চলে আসব।’

পদ্মজার অনুরোধ ফেলা যাচ্ছে না। আমির না চাইতেও অন্দরমহলে চলে গেল। পদ্মজা এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে অন্দরমহলের ডান পাশে চলে আসে। সঙ্গে,সঙ্গে রানির মুখোমুখি হয়। রানি ও পদ্মজা একসাথে কেঁপে উঠল। দুজন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। রানিই আগে কথা বলল, ‘রাইতের বেলা এমনে ছুটতাছো কেন?’

পদ্মজার মাথা থেকে ঘুমটা পরে গেছে সেই কখন। দৌড়ে আসাতে চুলের খোঁপাও খুলে গেছে। গাছ-গাছালির বাতাসে তিরতির করে চুল উড়ছে। তবুও সে ঘামছে। আমতাআমতা করে বলল, ‘আ…আমি তো হাঁটতে বের হয়েছি। জোনাকি দেখলাম এদিকে। তাই নিতে এসেছি।’

‘ওহ। কই জোনাকি। নাই তো।’

‘একটু আগেই ছিল।’

‘এহন তো নাই। রাইতের বেলা একলা থাকবা কেন। আসো ঘরে যাই।’

‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে রানি আপা? সন্ধ্যার আযানের আগে তোমার ঘরে গেলাম। পেলাম না। এদিক দিয়ে কোথাও ছিলে? কিন্তু এদিকে তো ঝোপঝাড়,জঙ্গল।’

পদ্মজার প্রশ্নে রানির মুখ রক্তিম হয়ে উঠল। কেমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠে মুখ। সে অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। কী বলবে খুঁজছে যে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পদ্মজা অপেক্ষা করছে,রানি কী বলে শোনার জন্য। পদ্মজা ডাকল, ‘আপা?’

‘আরে আমি ঔষধ খুঁজতে আসছিলাম।’

‘কী ঔষধ?’

‘তুমি চিনবা না। আসো বাড়িত যাই। মেলা রাইত হইয়া গেছে।’

রানি পদ্মজাকে রেখে এগোতে থাকল। এটাকে পালিয়ে যাওয়া বলে। পদ্মজা আর থেকে কী করবে! সেও রানির পিছু পিছু অন্দরমহলে চলে আসে। ঘরে ঢুকতেই আমির হামলা করে, ‘এবার কাহিনি কী বলো তো।’

‘বিশ্বাস করবেন?’

‘তোমার কথা বিশ্বাস করব না, এ হয়?’

‘রানি আপা প্রায় জঙ্গলের ভেতর যায়। আমি জানালা থেকে দেখি। উনি এমন ভাবে যান যেন চুরি করতে যাচ্ছেন।’

আমির শুনে অবাক হলো। সে চাপা স্বরে প্রশ্ন করল, ‘সত্যি! প্রায়ই যায়?’

‘আমি সত্যি বলছি।’

আমির চিন্তিত হয়ে কিছু ভাবে। কপালের চামড়া কুঁচকে গেছে। গভীর ভাবনায় বিভোর সে। পদ্মজা বলল, ‘আমি আজ অনুসরণ করে জঙ্গল অবধি গিয়েছিলাম। মদন ভাইয়ার জন্য ভেতরে ঢুকতে পারিনি। এরপর আপনি এলেন। পরে আবার যেতে চেয়েছি। কিন্তু ততক্ষণে রানি আপা চলে এসেছে। সরাসরি প্রশ্নও করেছি, কেন জঙ্গলে গিয়েছিল। বলল, ঔষধ আনতে। মানে কোনো ঔষধি পাতা। কিন্ত আমার বিশ্বাস হয়নি। প্রায়ই কেন কেউ ঔষধি পাতা আনতে যাবে? আবার ভোরে আর রাতে।’

পদ্মজা এক দমে কথা গুলো বলল। আমির বলল, ‘আব্বাকে বলতে হবে।’

‘আগে শুনুন?’

‘বলো?’

‘এখন কাউকে বলবেন না।’

‘বলা উচিত। ব্যাপারটা জটিল মনে হচ্ছে।’

‘আমরা আগে বের করি কী হয়েছে? কী করতে যায়। এরপর নিজেরা সমাধান করতে পারলে করব। নয়তো বড়দের বলব। যদিও আমরা নিশ্চিত না কোনো সমস্যা আছে।’

‘অবশ্যই সমস্যা আছে। তুমি জানো, ওদিকে কোনো মহিলা ভুলেও যায় না। যেতে চায় না ভয়ে। সেখানে রানি যায়। বড় কোনো কারণ আছে।’

‘আমরা বের করি সেটা?’

‘কীভাবে?’

‘আমার মনে হচ্ছে আবার যাবে। কাল-পরশুর মধ্যে। আমরা পিছুপিছু যাব।’

‘খারাপ বলোনি।’

‘কাউকে বলবেন না এখন, অনুরোধ।’

আমির হাসল। পদ্মজার কোমর পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বলব না।’

‘আপনি কারণে-অকারণে ছোঁয়ার বাহানা খুঁজেন।’

‘এতে পাপ তো নেই।’

‘খাওয়ার সময় হয়েছে। চলুন। ঠিক সময়ে না গেলে আম্মা চিল্লাবেন।’

‘আম্মারা চিল্লায়ই। তোমাকে খয়েরি রঙে বেশি সুন্দর লাগে।’

‘আমি তো খয়েরি শাড়ি পরিনি।’

‘পুরো কথা বলতে দাও।’

‘আচ্ছা,বলুন।’

‘আর, কালো রঙে আবেদনময়ী লাগে। আকর্ষণীয়।’ আমির ফিসফিসিয়ে কথাটা বলল। পদ্মজার কানে,ঘাড়ে আমিরের নিঃশ্বাস ছিটকে পড়ে। সে ঘুরে আমিরের দিকে তাকায়। আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আপনি সবসময় আকর্ষণীয়।’

আমির হইহই করে উঠল, ‘সত্যি? কত,কত দিন পর একটু প্রশংসা করলে। আল্লাহ!’

পদ্মজা মৃদু আওয়াজ করে হাসল। বলল, ‘প্রশংসা শুনতে খুব ভালোবাসেন?’

‘অবশ্যই। তবে বউয়ের প্রশংসা করতে আরো বেশি ভালবাসি।’ আমির আরো শক্ত করে পদ্মজার কোমর আঁকড়ে ধরে। পদ্মজা আমিরের দুই হাতে ধরে বলল, ‘আপনি সবসময় এতো শক্ত করে কেন ধরুন? গায়ের জোর দেখান?’

‘কেন? ভালো লাগে না?’

‘মোটেও না। আদর করে ধরবেন।’

আমির হাতের বাঁধন কোমল করে দিয়ে বলল, ‘লজ্জার ছিটেফোঁটাও গিলে ফেলছো দেখছি।’

‘বিয়ের এতদিন পরও কোন মানুষটা লজ্জা পায় আমাকে দেখাবেন। আমি অতো ভং ধরতে পারব না।’

‘কী ঝাঁঝ কথায়।’

‘এবার ছাড়ুন।’

‘ইচ্ছে হচ্ছে না।’

‘আবার শক্ত করে ধরেছেন।’

‘যদি দৌড়ে পালাও?’

‘পালিয়ে আর যাব কতটুকু?’

আমির পদ্মজাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এক হাতে কোমর চেপে ধরল। তখনই লতিফা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে। পদ্মজা,আমির দুজন দুদিকে ছিটকে যায়। আমির ধমকে উঠল, ‘লুতু,কতবার বলছি না বলে ঘরে ঢুকবি না। আমাদের তো নতুন বিয়ে হয়েছে নাকি?’

পদ্মজা খেয়াল করে আমির কথাগুলো রাগে বলার চেষ্টা করলেও রাগের মতো হয়নি। পদ্মজার হাসি পেল। লতিফার মুখের অবস্থা দরজার চিপায় পড়ার মতো। সে আমিরকে ভীষণ ভয় পায়। কাচুমাচু হয়ে বলল, ‘খালাম্মা খাইতে যাইতে কইছে।’

৩৮

পদ্মজা নূরজাহানের পা টিপে দিচ্ছে। তার মূল উদ্দেশ্য রুম্পার ঘরে যাওয়া। সকাল থেকে বারংবার রুম্পার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করেছে। পারেনি। মদন কিছুতেই ঢুকতে দেয়নি। তার এক কথা, নূরজাহান না বললে ঢুকতে দিবে না। অগত্যা পদ্মজা নিরাশ হয়ে নূরজাহানের ঘরে এসে পা টিপা শুরু করে। যদি একটু পটানো যায়। ঘন্টাখানেক ধরে সে নূরজাহানের পা টিপছে। হাত ব্যাথায় টনটন করছে। নূরজাহান আয়েশ করে ঘুমাচ্ছেন। কখন যে ঘুম ভাঙবে! এভাবে কেটে যায় আরো অনেক সময়। নূরজাহান চোখ মেলে তাকান। পদ্মজাকে বললেন, ‘এহনো আছো?’

পদ্মজা মৃদু হাসলো। নূরজাহান বললেন, ‘অনেকক্ষণ হইছে। যাও, এহন ঘরে যাও।’

পদ্মজার চোখে মুখে আঁধার নেমে আসে। পরক্ষণেই মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘আপনার ভালো ঘুম হয়েছে?’

‘সে হয়েছে।’

‘দাদু একটা প্রশ্ন করি?’

‘করো।’

‘রুম্পা ভাবিকে যেদিন দেখেছিলাম অনেক নোংরা দেখাচ্ছিল। উনাকে পরিষ্কার রাখার জন্য একটা মেয়ে দরকার। কিন্তু সবসময় মদন ভাইয়া পাহারা দেন।’

‘ষাড়ের লাকান শক্তি ওই ছেড়ির। হের লগে ছেড়িরা পারব না। সবাই ডরায়।

‘তাই বলে,এভাবে অপরিষ্কার থাকবে সবসময়।’

‘সবাই ডরায়। কেউ যাইব না সাফ কইরা দিতে। তুমি বেহুদা কথা বলতাছো।’

নূরজাহানের কঠিন কণ্ঠের সামনে পদ্মজার আসল কথাটাই মুখে আসছে না। সে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় আমি পারব। ভাবি আমাকে আঘাত করবে না। আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিতেন যদি।’

‘পাগল হইছো ছেড়ি? কেমনে খামচাইয়া ধরছিল মনে নাই? আর কথা কইয়ো না। যাও এন থাইকা।’

পদ্মজা আর কিছু বলার সাহস পেল না। সে ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দুই তলার বারান্দা থেকে আলগ ঘরের সামনের খালি জায়গা দেখা যাচ্ছে। সেখানে গ্রামের মানুষের ভীড়। মজিদ হাওলাদার তার লোকজন নিয়ে গ্রামের মানুষদের সমস্যা শুনছেন। কাউকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করছেন, কাউকে বা ধান দিয়ে। এই ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটে। পদ্মজার খুব ভালো লাগে। গর্ব হয়।

.

পূর্ণা ঘাটে বসে আছে। মাদিনী নদীর জলের স্রোতে তার দৃষ্টি স্থির। প্রান্ত,প্রেমা স্কুলে গিয়েছে। সে যায়নি। ইদানীং সে স্কুলে যায় না একদমই। ভালো লাগে না। পদ্মজা যাওয়ার পর থেকে সব যেন থমকে গেছে। পদ্মজার শূন্য জায়গাটা কিছুতেই পূর্ণা মানতে পারছে না। বাড়ির প্রতিটি কোণে সে পদ্মজার স্মৃতি খুঁজে পায়। এইতো এই ঘাটে বসে দুজন কত সময় পার করতো। কত গল্প করতো। আজ পদ্মজার জায়গা শূন্য। পূর্ণা অনুভব করে,সে তার মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে পদ্মজাকে। পদ্মজার প্রতিটি কথা কানে বাজে। এতদিন হয়ে গেল,তবুও এই শোক,এই শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না সে। পূর্ণার চোখ দুটি ছলছল করে উঠে। সে নিচের ঠোঁট কামড়ে দুইবার ডাকল, ‘আপা…আপারে।’

বাসন্তী দূর থেকে পূর্ণাকে দেখতে পেলেন। জুতা খুলে পা টিপে হেঁটে আসেন। পূর্ণার পাশে বসেন। পূর্ণা এক ঝলক বাসন্তীকে দেখে দ্রুত চোখের জল মুছল। এরপর বলল, ‘আপনি এখানে এসেছেন কেন?’

প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে পূর্ণা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বাসন্তীর দিকে তাকাল। দেখতে পেল, বাসন্তীকে আজ অন্যরকম লাগছে। আরেকটু খেয়াল করে বুঝতে পারল অন্যরকম কেন লাগছে। আজ বাসন্তীর ঠোঁটে লিপস্টিক নেই,কপালে টিপ নেই,চোখে গাঢ় কাজল নেই। থুতুনির নিচে সবসময় কালো তিনটা ফোঁটা দিতেন সেটাও নেই। পূর্ণা বাসন্তীর হাতের দিকে তাকাল। হাতেও দুই-তিন ডজন চুড়ি নেই। দুই হাতে শুধু দুটো সোনার চিকন চুড়ি। পূর্বের প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করে পূর্ণা পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আপনি আজ সাজেননি?’

‘না ছাজলে ভালো লাগে না?’ বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন বাসন্তী।

পূর্ণা বাসন্তীর চোখেমুখে স্নিগ্ধতা খুঁজে পেল। মায়াবী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। চকচকে গাল। চল্লিশের উপর বয়স মনেই হয় না। কিন্তু মুখে কিছু বলল না পূর্ণা। সে চোখ সরিয়ে নিল। বাসন্তী বললেন, ‘আমার সাথে গপ করবা?’

‘আমার ঠেকা পড়েনি।’ পূর্ণার ঝাঁঝালো স্বর।

বাসন্তী পূর্ণার পাশ ঘেঁষে বসেন। পূর্ণা বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। কিছু কঠিন কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হলো সবেমাত্র। তখন বাসন্তী বললেন, ‘আম্মা, আমি তোমার আব্বারে ভালোবাছছিলাম ছত্যি। তবুও ছেছ বয়ছে আইছছা একটা ভুল করে ফেলি। ভুল যখন বুঝতে পারি তোমার আব্বারে বলি। কিন্তু তোমার আব্বা মুখ ফিরাইয়া নিল। আমার তোমার আব্বা ছাড়া আর গতি ছিল না। তাই গ্রামের মানুছ নিয়া আছছিলাম। আমার এই কাজের জন্যে তোমাদের এতো বড় ক্ষতি হবে জানলে এমন করতাম না। যাক গে ছেছব কথা। তোমার আব্বা আমারে আজও মেনে নেয় নাই। তাতে আমার দুঃখ নাই। তোমার আম্মার মতো একটা ছোট বইন পাইছি। তোমার দুইডা ভাই বইনের মতো ছন্তান পাইছি। আমি নিঃছন্তান। আমার কোনো ছন্তান নেই। কখনো হবেও না। ছন্তানের ছূন্যতা আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। তোমাদের বাড়িতে আছার পর থেকে সেই দুঃখ ঘুচে গেছে। প্রান্ত,প্রেমা যখন আমারে বড় আম্মা কইয়া ডাকে,আমার খুছিতে কান্দন আইছছা পড়ে। ছুধু ভালো লাগে না তোমার গুমট মুখটা। বিছ্বাস করো আম্মা,তোমার মারে আমি তাড়াতে আছি নাই। ছে হইছে গিয়া হীরার টুকরা। তার মতো মানুছ হয় না। আমি যা চেয়েছি তার চেয়েও বেছি পাইছি। ছেটা তোমার আম্মা দিছে। আমি চাই না আমার জন্যে তুমি কছ্ট পাও। আমি তোমারে বলব না আমারে আম্মা ডাকতে। আমি ছুধু চাই তুমি আমাকে মেনে নাও। ভালো থাকো। হাছিখুছি থাকো। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। তোমরা যেমনে বলবা আমি তেমনেই চলব। এইযে দেখো,তোমার ছাজগোজ পছন্দ না বলে আমি আজ ছাজি নাই। আর কোনোদিনও ছাজব না। আমি কী কম ছুন্দর নাকি যে ছাজতেই হবে।’

পূর্ণার মন ছুঁতে পেরেছে বাসন্তীর কথা। পূর্ণা বরাবরই কোমল মনের। তবুও শক্ত কণ্ঠেই বলল, ‘আমি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করব না। আপনি আপনার মতো থাকুন প্রেমা,প্রান্তকে নিয়ে। আমি আমার মতো থাকব আমার মাকে নিয়ে। আমার আর কারোর বন্ধুত্ব্ব দরকার নেই।’

বাসন্তীর চোখ ছলছল করছে। তবুও তিনি হাসতে কার্পণ্য করলেন না। বললেন, ‘তোমার চুল অনেক ছুন্দর আর লম্বা। এখন তো ভরদুপুর। বাইন্ধা রাখো।’

পূর্ণা চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিল। এরপর বলল, ‘আম্মা এখনও ঘুমে?’

‘হ।’

‘আম্মার কী যে হয়েছে। কখনো একদমই ঘুমায় না। আর কখনো ঘুম ছেড়ে উঠতেই পারে না। ‘

‘পদ্মজার জন্যে কান্ধে দেখি। ছরীর দূর্বল হয়ে পড়ছে। এজন্যই ঘুমাচ্ছে।’

পূর্ণা উঠে দাঁড়ায়। বাসন্তী বললেন, ‘আমি রানছি বলে ছকালে খাইলা না। এখন নিয়া আছি ভাত?’

‘পরে খাব।’ বলে পূর্ণা দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল।

হেমলতার ঘরে এসে দেখল,তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চুল ছড়িয়ে আছে বালিশে। কেমন শুকিয়ে গেছেন। এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে তো আরো শুকাবে। ডাকা উচিত। পূর্ণা ডাকল, ‘আম্মা….আম্মা।’

হেমলতা সাড়া দিলেন না। পূর্ণা ঝুঁকে হেমলতার গায়ে হাত দিয়ে ডাকল, ‘ও আম্মা। উঠো এবার। দুপুর হয়ে গেছে। আম্মা…ও আম্মা।’

হেমলতা চোখ খুলেন। চোখের মণি ফ্যাকাসে। তিনি উঠতে চাইলে হুট করে হাত কাঁপতে থাকল। পূর্ণা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে আম্মা?’

হেমলতা কিচ্ছুটি বললেন না। পূর্ণা হেমলতাকে ধরে উঠাল। হেমলতা পূর্ণার দিকে চেয়ে থেকে ক্ষীন স্বরে প্রশ্ন করেন, ‘কে তুমি?’

৩৯

হেমলতার এহেন প্রশ্নে পূর্ণা চমকে উঠল। চাপা স্বরে অবাক হয়ে উচ্চারণ করল, ‘আম্মা!’

সেকেন্ড কয়েক পর পূর্ণার উপর থেকে হেমলতা চোখ সরিয়ে নিলেন। পূর্ণা বলল, ‘আমাকে চিনতে পারছো না?’

হেমলতা বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, ‘ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। তাই এমন হয়েছে। সবার খাওয়াদাওয়া হয়েছে?’

পূর্ণা তখনও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। হেমলতা পূর্ণার দিকে তাকান। জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী রে? কিছু জিজ্ঞাসা করেছি না?’

‘হয়েছে। দুপুরের আযান পড়বে।’

‘এতক্ষণ ঘুমিয়েছি! আরো আগে ডাকতে পারলি না?’

‘ঘুমাচ্ছিলে আরাম করে। তাই ডাকিনি।’

‘ফজরের নামাযটা পড়া হলো না। এখন কাযা পড়তে হবে। তুই নামায পড়েছিলি তো?’

‘পড়েছি।’

‘খেয়েছিস?’

‘না।’

‘এরকম করে আর কতদিন চলবে? যা খেয়ে নে।’

পূর্ণা বাধ্য মেয়ের মতো হেঁটে চলে গেল রান্নাঘরে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। কতক্ষণ না খেয়ে রাগ করে থাকা যায়? হেমলতা খোলা চুল হাত খোঁপা করে নেন। এরপর কলপাড়ের দিকে যান। অযু করে ঘরে ঢোকার সময় দেখেন,পূর্ণা খাচ্ছে। তিনি পূর্ণার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘খাওয়া শেষ করে ঘরে আসিস।’

পূর্ণা খেয়েদেয়ে থালা ধুয়ে গুছিয়ে রাখে। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখে, চারা গাছ লাগানোর জন্য বাসন্তী উঠানের এক কোণে বসে মাটি খুঁড়ছেন। পূর্ণা দৃষ্টি সরিয়ে হেমলতার ঘরে আসে। এসে দেখে হেমলতা জায়নামাজে অসম্ভব উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন। পূর্ণা ডাকল, ‘ আম্মা?’

হেমলতা চমকে তাকান। পূর্ণা দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হয়। চমকানোর কী এমন হলো? হেমলতা স্বাভাবিক হয়ে বসেন। জায়নামাজ ভাঁজ করেন ধীরেসুস্থে। এরপর পূর্ণাকে কাছে এসে বসতে বলেন। পূর্ণা পাশে এসে বসে। হেমলতা ভারী কণ্ঠে বললেন, ‘আপার(বাসন্তী) প্রতি তোর এতো রাগ কেন? আম্মাকে বল?’

‘এখন রাগ নেই।’

‘প্রেমা-প্রান্তের মতো মিলেমিশে থাকতে পারবি না? ওরা বড় আম্মা ডাকে। তুই শুধু খালাম্মা ডাকবি।’

‘মাত্র উঠলে ঘুম থেকে। আগে খাও। এরপর কথা বলব।’

‘আমি এখনই বলব। কথাগুলো বলব বলব করে বলা হয়নি। দেখ পূর্ণা, আপা অন্য পরিবেশে বড় হয়েছে,থেকেছে তাই একটু অন্যরকম। তাই বলে মানুষটা তো খারাপ না। আপা সত্যি একটা সংসার চায়। পরিবারের একজন সদস্য ভাবতে দোষ কোথায়? বাকি জীবনটা কাটাক না আমাদের সাথে। আমার কাজকর্মের একজন সঙ্গীও হলো। বয়স তো হচ্ছে,একা সব সামলানো যায়? আপারও বয়স হচ্ছে। কিন্তু দুজনে মিলে তো কাজ করতে পারব। কয়দিন পর তোর বিয়ে হবে,প্রেমার বিয়ে হবে। শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি। তখন আমার একজন সঙ্গী থাকলো। আর এমন নয় যে,আপার মনে বিষ আছে। আপারও ভালো সঙ্গ দরকার। ভালো পরিবেশ, ভালো সংসার। আমি দেখেছি, আপা কত সুখে আছে এখানে। প্রেমা-প্রান্তর জন্য জান দিয়ে দিতে প্রস্তুত। নিঃসন্তান বলেই হয়তো এমন। আপা কিন্তু এখন আমাদের ছাড়া অসহায়। উনার মা মারা গেছে। বাবা তো নেই। আত্মীয়-স্বজন নেই। এই বয়সে যাবে কই? আমরা একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারি না? সতিন হলেই সে খারাপ হবে,সৎ মা হলেই সে খারাপ হবে এমন কোনো বাণী আছে?’

পূর্ণা বেশ অনেকক্ষণ চুপ রইল। এরপর বলল, ‘কিন্তু উনি অনেক সাজগোজ করেন। যদিও আমাকে কিছুক্ষণ আগে বলেছেন,আর সাজবেন না। তবে,উনার কথার ধরণ আমার ভালো লাগে না। স কে ছ উচ্চারণ করেন। শুদ্ধ-অশুদ্ধ মিলিয়ে জগাখিচুড়ি বানিয়ে কথা বলেন।’

হেমলতা পূর্ণার কথায় হাসলেন। পূর্ণা ওড়নার আঁচল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। হেমলতা পূর্ণার মাথায় হাত রাখেন। বললেন, ‘তোর আপা যদি প্রান্তকে শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করিয়ে দিতে পারে। তুই তোর বাসন্তী খালাকে স উচ্চারণ শিখাতে পারবি না?’

‘উনি শিখবেন?’

‘বললে,অবশ্যই শিখবেন।

‘সত্যি?’

‘বলেই দেখ।’

‘এখন যাব?’

‘যা।’

‘যাচ্ছি।’

পূর্ণা ছুটে বেরিয়ে গেল। হেমলতা মৃদু হেসে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। সেলাই মেশিনের সামনে বসেন। অনেকগুলো কাপড় জমেছে। সব শেষ করতে হবে।

উঠানে বাসন্তীকে পেল না পূর্ণা। এদিকওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকল। বাসন্তী কলপাড় থেকে হাত পা ধুয়ে বেরিয়ে আসেন। পূর্ণা কথা বলতে গিয়ে দেখে জড়তা কাজ করছে। দুই তিনবার ঢোক গিলে ডাকল, ‘শুনুন?’

বাসন্তী দাঁড়ালেন। পূর্ণাকে দেখে হাসলেন। পূর্ণা এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনাকে আমি পড়াব।’

‘কী পড়াইবা?’

‘লাহাড়ি ঘরের বারান্দায় আসেন আগে।’

বাসন্তী কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তবুও পূর্ণার পিছু পিছু গেলেন। বারান্দার চৌকির উপর পূর্ণা বসল। পূর্ণার সামনে বাসন্তী বসেন উৎসুক হয়ে। পূর্ণা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আপনাকে দন্ত-স উচ্চারণ শেখাব আমি।’

‘দন্ত-ছ উচ্চারণ তো আমি পারি।’

‘আপনি দন্ত-স না বলে দন্ত-ছ বলেন। শুনতে ভালো লাগে না। বলুন, দন্ত-স।’

বাসন্তী থতমত খেয়ে যান। চোখ ছোট ছোট করে বললেন, ‘দন্ত-ছ।’

‘হয়নি। বলুন, দন্ত-স।’

‘দন্ত-ছ।’

‘আবারও হয়নি। আচ্ছা বলুন, সংসার।’

‘ছংছার।’

‘স-ং-সা-র।’

‘ছ…সওও-ং-চ.সার।’

সংসার উচ্চারণ করতে করতে পূর্ণার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়েন বাসন্তী। পূর্ণা বলল, ‘উপরে চলে আসছেন কেন? দূরে বসুন।’

বাসন্তী দ্রুত সোজা হয়ে বসেন। পূর্ণা বলল, ‘এবার বলুন, সন্তান।’

‘স.সন্তান।’

‘ফাটাফাটি! হয়ে গেছে। এবার বলুন,আসছে।’

‘আছছে।’

‘আরে,আবার ছ উচ্চারণ করছেন কেন? বলুন, আসছে। আ-স-ছে।’

‘আ-স-ছে।’

‘হয়েছে। এবার বলুন, সাজগোজ।’

‘সাজগোছ।’

.

হাওলাদার বাড়ির পুরুষেরা একসাথে বসেছে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। আলমগীর, খলিল সবাই আজ উপস্থিত আছে। আমির দুই দিন পর শহরে ফিরবে। তাই আলমগীর চলে এসেছে। অতিরিক্ত গরম পড়েছে। বাড়ির চারপাশে এতো গাছপালা তবুও একটু বাতাসের দেখা নেই। আমিনা,লতিফা বাতাস করছে। পদ্মজা,ফরিনা,রিনু খাবার বেড়ে দিচ্ছে। পদ্মজা আমিরের থালায় মাংস দিতেই আমির বলল, ‘তুমি কখন খাবে?’

পদ্মজা চোখ তুলে তাকায়। বলল, ‘আম্মার সাথে।’

‘এখন বসো না।’

‘জেদ ধরবেন না। অনুরোধ। ‘ ফিসফিসিয়ে বলল পদ্মজা।

এরপর মাছের তরকারি আনার জন্য রান্না ঘরে যায়। বাটিতে করে মাছের ঝোল নিয়ে ফিরে আসে। আমিরের দিকে চোখ পড়তেই আমির চোখ টিপল। পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে হাসে। আলমগীরের থালায় মাছের ঝোল দেওয়ার সময় খেয়াল করল, আলমগীর বেশ ফুর্তিতে আছে। বয়স পঁয়ত্রিশ হবে। এসে একবারও রুম্পার কথা জিজ্ঞাসা করল না। কী অদ্ভুত! বউয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া,ভালোবাসা নেই যে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

রানি,লাবণ্য ছুটে এসে বাপ-চাচার মাঝে বসে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সবাই বিভিন্ন রকম আলোচনা করছে। রানির বিয়ে নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে। খুব দ্রুত রানির বিয়ে দিতে চান তারা। আচমকা রানি গড়গড় করে বমি করতে আরম্ভ করল। সবাই বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। প্রতিটি খাবারের থালা নষ্ট হয়ে যায়। আমিনা দ্রুত রানিকে ধরে কলপাড়ে নিয়ে যান। লাবণ্য,পদ্মজা,নূরজাহান, ফরিনা ছুটে যান পিছু পিছু। বাড়ির পুরুষেরা হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। মুহূর্তে একটা হইচই লেগে গেল।

রানি বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে কলপাড়ে বসে পড়ে। আমিনা হায় হুতাশ করে বিলাপ করছেন, ‘আমার ছেড়িডার কী হইলো? কয়দিন ধইরা খালি বমি করতাছে। জ্বীনের আছড় লাগল নাকি। কতবার কইছি যহন তহন ঘর থাইকা বাইর না হইতে। ‘

লাবণ্য তথ্য দিল, ‘আপা রাতেও ছটফট করে। ঘুমাতে পারে না।’

আমিনা কেঁদে কূল পাচ্ছেন না। রানির চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। তিনি রানিকে প্রশ্ন করলেন, ‘আর কী কষ্ট হয় তোর? ও আম্মা কবিরাজ ডাকেন। আমার ছেড়িডার কী হইলো।’

রানি ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘মাথাডা খালি চক্কর মারে।’

নূরজাহান চোখ দু’টি বড় বড় করে প্রশ্ন করলেন, ‘এই ছেড়ি তোর শরীর খারাপ শেষ কবে হইছে?’

‘দুই মাস হবে।’ কথাটা বলে রানি চমকে উঠল। সবাই কী ধারণা করছে? সে চোখ তুলে উপরে তাকায়। সবাই উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। রানির শরীর কাঁপতে থাকে। আমিনা মেয়েকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এমন কিছু হয় নাই আম্মা। আপনি ভুল বুঝতাছেন। আমার ছেড়ি এমন না।’

‘হেইডা কবিরাজ আইলে কওয়া যাইব। এই ছেড়ির জন্যে যদি এই বাড়ির কোনো অসম্মান হয় কাইট্টা গাঙে ভাসায়া দিয়াম। মনে রাইখো বউ।’ নূরজাহান বললেন রাগী স্বরে। রানির গলা শুকিয়ে কাঠ! হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে চলছে। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। একসময় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল আমিনার কাঁধে। আমিনা চিৎকার করে উঠলেন, ‘ও রানি…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *