আমি নকুবাবু – ২

ধলভূমগড় আদিবাসী অঞ্চলে যখন ছিলাম, সেখানে মাঠে-ময়দানে কোনো উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে নানা ধরনের হাট কিংবা মেলা বসত৷ সেইসব মেলায় বা জমায়েতে মুরগির লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই দেখেছি৷ তা ছাড়া, এক সময় তো এই কলকাতা শহরে কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে পয়সা ওড়ানো এবং বুলবুলির লড়াইয়ের প্রচলন ছিল৷ সেখানে প্রতিযোগিতা ছিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, কিন্তু অশোভন কিছু চোখে পড়ত না৷

 সেসব দিন আর নেই, পরিবেশ আজ হারিয়ে গিয়েছে৷ বিনোদনের হরেক কিসিম এখন মানুষের হাতে৷ জনসংখ্যা বেড়েছে, মানুষের জীবনধারণের চিত্রটিও পালটে গিয়েছে৷ চিরাচরিত উৎসব-অনুষ্ঠানের চেহারায়ও বিরাট রূপান্তর ঘটে গিয়েছে৷ আগে যেমন বিশ্বকর্মা পুজোকে কেন্দ্র করে কলকাতা শহরে ঘুড়ি ওড়ানোর যে জাঁকজমক দেখা যেত, ইদানীং আর সে দৃশ্য চোখে পড়ে না৷ এখন তো অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন৷ এটা খুবই প্রয়োজনীয় বস্তু৷ কিন্তু, এই বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত বস্তুটি যতটা না প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার চেয়ে বহুগুণ ব্যবহৃত হচ্ছে বিনোদন হিসেবে৷ ফলে, পারিবারিক জীবনে, সমাজে নানা বিপত্তি দেখা যাচ্ছে৷

 অর্থাৎ, আবার সেই পুরোনো কথায় ফিরে যেতে হচ্ছে৷ বিজ্ঞান মানুষের জীবনে আশীর্বাদ না অভিশাপ সেটা নির্ভর করছে মানুষের ওপরে৷

 সেই জন্যই দেখা যায়, সমাজে— শহরে কিংবা গ্রামেগঞ্জে, কী ঘুড়ি ওড়ানো, কী পাড়ায় পাড়ায় খেলাধুলোয় আমাদের মতো এখন আর সেই আগ্রহ বা আকর্ষণ চোখে পড়ে না৷ সকলেই যেন আজ অন্য বিনোদনে মগ্ন৷

 কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, কলকাতার ফুটবলের আকর্ষণ তো কমেনি! সেই আগের মতোই আছে৷ ঠিক কথা৷ কিন্তু, বড়ো বড়ো দলগুলোর মধ্যে ক’জন আমাদের দেশের খেলোয়াড়? হৃদয় খুঁড়ে এসব বেদনার কথা আর উল্লেখ করতে চাই না৷

 আবার একটু অন্য কথায় ফিরে আসি৷ মানবজীবনে বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে আগেও কিছু আলোচনা করেছি৷ হয়তো সেটা বিস্তারিত নয়৷ এই পর্যায়ে আরও কিছু সংযোজন এখানে তুলে ধরছি৷ পুরাকালের একটা প্রবাদের ওপর একটু আলোকপাত করতে চাই৷ এর সঙ্গে বিজ্ঞানের সত্য কতটা নিহিত সেটা আমার জানা নেই৷ সেই প্রবাদটা হচ্ছে, কোনো অচেনা মানুষের পাশে না শুয়ে, কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে শয়ন করা উচিত৷ আমরা যে নিশ্বাস-প্রশ্বাস ত্যাগ এবং গ্রহণ করি, নিশ্বাসের মাধ্যমে আমাদের শরীরের দূষিত বায়ু পরিত্যাগ করি এবং প্রশ্বাসের মাধ্যমে বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণ করি৷ অর্থাৎ অক্সিজেন গ্রহণ করি৷ এই দেহের এই নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াকলাপ, এর দ্বারা দেহের ভেতরে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে৷ নিশ্বাসের মাধ্যমে যে দূষিত বায়ু দেহ থেকে নির্গত হয়, এটা যখন কোনো অসৎ ও নিকৃষ্ট ব্যক্তির দেহ থেকে নির্গত হয়, আমি মনে করি সেটা যদি কোনো সৎ ব্যক্তির ওপর পড়ে, সেই প্রভাব সেই সৎ ব্যক্তিকেও কলুষিত করে তোলে এবং তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে৷

 সেই কারণেই আমাদের সচেতন থাকা উচিত, যেন কোনো দুষ্টু লোকের প্রভাব থেকে আমরা একটু দূরে থাকি৷ তাদের প্রভাবে যেন কোনো ভাবেই প্রভাবিত না হয়ে পড়ি৷ প্রকৃত ভালোবাসা, স্নেহ, সৌহার্দ্য, সব কিছুর বিনিময়ে আমরা যদি পৃথিবীর সকল জীবজন্তু, মানুষের জন্য সমর্পণ করতে পারি, তাহলে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশে বসবাসের অধিকারী হয়ে উঠতে পারব৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এসবের পরিবর্তে প্রতিনিয়ত আমরা ভোগ-লালসা, কুকর্ম, অন্যকে বঞ্চনা করার উদ্দেশ্যে ব্যস্ত থাকি৷ অথচ, আমরা বিন্দুমাত্র চিন্তা করি না যে, আমরা যেভাবে জীবনযাপন করি, তাতে আমাদের ঘরের পরিবেশ, বিশেষ করে নিজেদের পরিবেশকে নষ্ট করছি৷ অথচ আমরা ভুলে যাই যে, কোনো কিছুই কেউ আমরা সঙ্গে করে নিয়ে যাব না৷ একদিন সব কিছুকে ফেলে রেখে চলে যেতে হবে৷ এ-কথা মনে রেখে, আমরা যদি সুন্দর মন ও সুন্দর ব্যবহারের দ্বারা প্রকৃতিকে ভালোবাসি এবং যত্ন করি, এমনকি শ্রদ্ধা করি, তাহলে আমাদের জীবন সুন্দর ও মঙ্গলময় হয়ে উঠতে পারে৷

 আগেই এ-বিষয়ে আলোচনা করেছি যে, বিজ্ঞান মানবজীবনে আশীর্বাদ কিংবা অভিশাপ হবে কিনা, সেটা নির্ভর করছে মানুষের ওপর৷ অর্থাৎ মানুষের শুভ এবং অশুভ বুদ্ধির ওপর৷ তাই বিজ্ঞানের অশুভ ব্যবহার, অন্যায় ব্যবহারে পৃথিবী তার ভারসাম্য হারাচ্ছে৷ আর এই ভারসাম্য হারানোর ফলে পৃথিবীতে নানা বিপর্যয় নেমে আসছে৷ প্রাকৃতিক বিপর্যয়— যেমন, ঝড়, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদি ইত্যাদি৷

 আমরা, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যদি সৎ হতে পারি, আমরা যদি কেউ কাউকে হিংসা না করি, নিজেরা মিলেমিশে, সুস্থভাবে বসবাস করার চেষ্টা করি, অন্যের জায়গা দখল করার আগ্রাসী মনোভাব ত্যাগ করি, তাহলেই মানুষের পক্ষে সুন্দরভাবে, সুস্থভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব হবে৷ আমরা সকলে মিলে একটা সুন্দর পৃথিবী তৈরি করতে পারব৷

 এই প্রসঙ্গে, দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের কথায় একটু আলোকপাত করতে চাই৷ ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায়, অন্য দেশ আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে৷ এর পেছনে আছে অশুভ বুদ্ধির প্রভাব৷ এই অশুভ বুদ্ধিই অনিষ্টের কারণ হয়ে ওঠে৷ ফলে, নানারকম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে৷ যুদ্ধ দেখা দিতে পারে৷ আর যুদ্ধ মানেই জীবনহানি৷ নানারূপ যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার৷ ফলে, প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ক্ষতি৷ প্রকৃতির ওপর অত্যাচার হলেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারায়৷ ফলে, নানা বিপর্যয়ের মুখে মানুষকে ঠেলে দেয়৷ তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, প্রকৃতি কিন্তু নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকে না৷ একদিন না একদিন সে ঠিক প্রতিশোধ নেবেই নেবে৷ আমরা যদি সচেতন হয়ে, সদিচ্ছার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, আমাদের মধ্যে যতটুকু ক্ষমতা সেটুকু মাত্র অবলম্বন করে, পরিবেশকে সুন্দর করে গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করি, দূষণমুক্ত একটা সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আসুন, প্রথমে ১০ জন প্রতিবেশী নিয়ে আমরা কাজটা শুরু করে দিই৷ আমরা যদি এই বিষয়ে আন্তরিক হতে পারি, তাহলে আমাদের দেখাদেখি আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন৷ এইভাবে এক-এক করে ১০০ জন৷ এই ভাবেই বিন্দু বিন্দু করে এক সময় আমাদের এই উদ্যোগ বহুত্বে পরিণত হবে৷ বিন্দু বিন্দু করে যেমন সিন্ধুর সৃষ্টি হয়৷ সেই রকমটাই আমি আশা করি৷

 এই পরিবেশ দূষণের ফলে সমাজের কী ক্ষতি হতে পারে, সে-কথা মনে হয় কাউকে বিস্তারিত ভাবে বোঝানোর প্রয়োজন নেই৷ এই পরিবেশ দূষণের ফলে কলকাতার আকাশে একবার চোখ মেলে চেয়ে দেখুন, কাক কিংবা চড়ুইপাখির সংখ্যা কী ভয়ংকর ভাবে কমে গিয়েছে৷ এর কারণ কী? প্রতিনিয়ত শহরে বায়ু দূষিত হচ্ছে৷ একটু লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, পাড়ায় পাড়ায় মোবাইল টাওয়ার বসানো হয়েছে৷ অভিজ্ঞরা বলছেন, এই মোবাইল টাওয়ার থেকে এক ধরনের বিষাক্ত রশ্মি নির্গত হয়৷ এই রশ্মি বাতাসকে দূষিত করে তুলছে৷ ফলে চড়ুইপাখি, কাক, পায়রা শহর ছেড়ে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে৷ তা ছাড়া এই কলকাতা শহরেই আমরা দেখেছি কত গাছপালা৷ এখন সে-সব নেই৷ ঝড়ে পড়ে যাওয়ার পর এখন আর নতুন করে শহরের রাজপথে গাছ লাগানো হয় না৷ প্রাকৃতিক ভারসাম্য তাহলে কীভাবে রক্ষিত হবে? এর ওপর শহরের আকাশে ধুলো-ধোঁয়া তো আছেই৷ বারবার প্রকৃতির কথায় আমাকে আসতে হয়৷ কারণ আমি জানি, প্রকৃতির কিন্তু প্রাণ আছে৷ একটা কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল৷ আমার অস্ট্রেলিয়ান বন্ধুর সঙ্গে মোটর সাইকেলে অমরকণ্টক, খাজুরাহো ভ্রমণের কথা আগেই বলেছি৷ প্রকৃতি প্রসঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে হঠাৎ একটা জরুরি কথা মনে পড়ে গেল৷ যে মোটর সাইকেলে করে একদা ভারত ভ্রমণ করেছিলাম, সেই গাড়িটা ছিল আমার এক বন্ধুর৷ বন্ধুটির নাম ছিল তারাপদ সাহা৷ মোটর সাইকেলটার নাম ছিল BMW, মডেলটা ছিল— R60৷ তখন সময়টা ছিল ১৯৬১ সাল৷ সেই সময় এই সাইকেলেই বন্ধুর সঙ্গে সারা ভারত পরিভ্রমণ করেছি৷ বিশেষ করে মন্দিরময় ভারত৷

 তখন আমরা, আমি ও আমার বন্ধু বীরভূমে ঘুরে বেড়াচ্ছি৷ বীরভূমের কাছে রাজনগর বলে একটা জায়গা৷ সেখান থেকে মাইল তিনেক ভেতরে একটা নির্জন জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে একটা দৃশ্য চোখে পড়ল৷ একজন লোক, পোশাক-আশাক দেখে গ্রাম্য কৃষক বলেই মনে হয়েছিল৷ সেই মানুষটি একটা গাছের গোড়ায় কান লাগিয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন সে কান পেতে কিছু শোনবার চেষ্টা করছে৷ কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এখানে কী করছ?’

 লোকটা উত্তর দিল, ‘আমি গাছটার কথা শুনছি৷’

 মনে আছে সে আরও বলেছিল, ‘বাবু, গাছেরা কথা বলতে না পারলেও, মানুষদের কথা ওরা বুঝতে পারে৷’

 লোকটির কথা শুনে প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম৷ ‘কিন্তু গাছেদেরও প্রাণ আছে’, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর কথাটা মনে পড়ায় বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম, ‘হলেও হতে পারে!’ কাজেই প্রকৃতিকে অসাড় মনে করার কোনো কারণ নেই৷ প্রকৃতি সব বোঝে৷ তার অমর্যাদা হলে সে এক সময় রুখে দাঁড়াবে৷ এবং প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবেই নেবে৷…

 আমি দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বহু দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করেছি৷ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে৷ এটা আমার জীবনে সম্পদ হয়ে আছে৷ বলতে গেলে, সেইসব দুর্লভ অভিজ্ঞতা আমার সুস্থ ও আনন্দময় জীবনের চাবিকাঠি৷

 হিমালয় ভ্রমণকালে, বিভিন্ন সময়ে হিমালয়ের অন্তর্গত বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য স্থান দর্শন করেছি৷ যেমন, অমরনাথ, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, হর-কী-দুন, ওসলা, চন্দনবাড়ি প্রভৃতি অসংখ্য স্থান ভ্রমণ করে কৃতার্থ হয়েছি৷

 অমরনাথ যাত্রা করেছিলাম ১৯৭৮ সালে, ‘ব্যানার্জি স্পেশাল’ নামে এক ট্যুরিস্ট সংস্থার উদ্যোগে৷ ওই সংস্থা আমাদের ভ্রমণের সমস্ত ব্যবস্থা করে দেয়৷ মনে আছে, মাথা পিছু খরচ হয়েছিল মাত্র ১৪০০ টাকা৷

 তখনকার রেলওয়ে সময়সূচি অনুযায়ী শিয়ালদহ স্টেশন থেকে জম্মু এক্সপ্রেস ছাড়ে সকাল ১১ টা নাগাদ৷ দু-দিন, দু-রাত্রি পর, সকাল ৮টার সময় আমরা জম্মু স্টেশনে পৌঁছোলাম৷ জম্মু থেকে বাসে আমরা পহেলগাঁও পৌঁছোলাম সন্ধে ৭টা নাগাদ৷ আমাদের দলে পুরুষ-মহিলা মিলে ১০ জন যাত্রী ছিলাম৷ পহেলগাঁও-এ আগে থেকেই আমাদের জন্য হোটেল ঠিক করাই ছিল৷ রাত্রিটা সেই হোটেলে কাটিয়ে, পরের দিন সকালবেলায় আমরা চন্দনবাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করলাম৷ আমি ও আমার এক সহযাত্রী পহেলগাঁও থেকে পায়ে হেঁটেই চন্দনবাড়ি গিয়েছিলাম৷ বাকি সকলের জন্য ব্যবস্থা ছিল ঘোড়া৷ অর্থাৎ, ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা৷ আমরা দুজন সকাল ৮ টায় যাত্রা করে সন্ধে ৬টা নাগাদ চন্দনবাড়ি পৌঁছোলাম৷ বলাই বাহুল্য, আমাদের যাত্রাপথটি ছিল খুব কষ্টকর৷ সবটাই চড়াই৷ চড়াই বেয়ে উঠতে খুবই কষ্ট হয়েছিল৷ পহেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ির দূরত্ব প্রায় ১৩ মাইলের মতো৷ সমস্ত পথটাই বরফে ঢাকা ছিল৷ প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা সময় লেগেছিল৷ ক্লান্তিকর যাত্রাপথ সন্দেহ নেই৷ কিন্তু যাত্রাপথের দু’ধারে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের সকল কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল৷

 তখন আমার বয়স প্রায় বাহান্ন বছর৷ চন্দনবাড়ি পৌঁছে মনে আছে, সেই রাতটা আমরা একটা তাঁবুতে কাটিয়েছিলাম এবং খিচুড়ি খেয়েই কাটিয়েছিলাম৷ প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য রাস্তার ধারের দোকান থেকে ঘন ঘন চা কিনে খেতাম৷

 পরের দিন চন্দনবাড়ি থেকে রওনা দিয়ে পৌঁছোলাম পঞ্চতরণী৷ সেখানে বিশ্রামের জন্য রাত কাটিয়েছিলাম৷ উল্লেখ্য যে, যাত্রাপথে শেষনাগে একটা হ্রদ দেখেছিলাম৷ সেই হ্রদটির জল ছিল সবুজ রং-এর৷ আর জল ছিল মারাত্মক ঠান্ডা৷

 শেষনাগ থেকে মহাগুণেশ্বর, এই পথটি ছিল প্রায় ১৪৫০ ফুট উঁচুতে৷ দুপুর ১২টার মধ্যে এই পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল৷ কারণ এর পর ওই পথে বরফপাত ও ধস নামার সম্ভাবনা থাকে৷

 দূর থেকে পাহাড়গুলো বড়ো বড়ো কয়লার চাঙড়ের মতো দেখতে৷ সেখানে কোনো গাছপালার চিহ্ন মাত্র ছিল না৷ মহাগুণেশ্বর থেকে সন্ধের পর পঞ্চতরণী পৌঁছেছিলাম৷ ওখানে কিছু মুসলমান সম্প্রদায় থাকেন ঘোড়া নিয়ে, ভাড়া খাটাবার জন্য৷ প্রচণ্ড শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওদের কাছে থাকে আগুনের ব্যবস্থা৷ বেতের এক প্রকার ঝুড়িতে ঘেরা পাত্রের মধ্যে থাকে সেই আগুনের পাত্র৷ সেগুলো শরীর গরম রাখার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়৷ রাতে আমরা পঞ্চতরণী-তে থাকলাম৷ থাকার ব্যবস্থা ওই তাঁবুর মধ্যে৷ খাওয়া গরম গরম খিচুড়ি৷ আর শোওয়া, খাটিয়ার বিছানায়৷ পরের দিন পঞ্চতরণী হয়ে ভৈরবঘাট এবং অবশেষে অমরনাথ গুহা৷ রাস্তার দু-ধারে পাহাড়ের ঢালে ফুলের সে কী বাহার! সেই ফুল মুসলমানরা তুলে দেয় মন্দিরে দেবদেবীর পুজোর জন্য৷ এখানে জাতপাতের কোনো বালাই নেই৷ গুহাতে প্রায় ২০০টা ধাপ বা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হয়৷ পাহাড়ের দুদিক থেকে জল চুঁইয়ে পড়ে শিবলিঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে৷ নীচে অমরগঙ্গা প্রবাহিত৷ আমি অমরগঙ্গা থেকে কিছু পাথর সংগ্রহ করে, স্মারকচিহ্ন হিসেবে রেখে দিই৷

 অমরনাথ দর্শন করে মুগ্ধচিত্তে ফিরে এলাম৷ আমরা এমন একটা সময়ে অমরনাথ যাত্রা শুরু করেছিলাম, যাতে ভিড় এড়ানো যায়৷ অর্থাৎ শ্রাবণী পূর্ণিমার আগে আগে৷

 ফেরার সময় পঞ্চতরণী থেকে চন্দনবাড়ি৷ চন্দনবাড়িতে রাত কাটিয়ে পরের দিন জিপে করে পহেলগাঁও, সেখানে রাতটুকু কাটিয়ে পরের দিন পৌঁছে গিয়েছিলাম শ্রীনগর৷ শ্রীনগরে আমরা দুদিন ছিলাম৷ সেখানে ডাল হ্রদ, মোগল গার্ডেন ইত্যাদি দর্শন করে এবং জিনিসপত্র কেনাকাটা করার পর, শ্রীনগর থেকে জম্মু পৌঁছোলাম৷ সেখান থেকে ২ দিন, ২ রাত্রি ট্রেন যাত্রার পর শিয়ালদহ৷ অর্থাৎ, আমরা আবার কলকাতায় ফিরে এলাম৷

 এখানেই শেষ না৷ ১৯৭৯ সালে আবার আমরা কয়েকজন মিলে তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়ি৷ প্রায় একই মন্দির, একই তীর্থক্ষেত্র৷ একই গঙ্গা, একই গঙ্গোত্রী, বদ্রীনারায়ণ ইত্যাদি ইত্যাদি৷ কিন্তু কোনো কিছুই পুরোনো বলে মনে হয় না৷ এ যেন চিরনতুন, অ-পুরাতন, অনবদ্য!

 এই যাত্রাপথে নাবা, ওসলা প্রভৃতি জায়গায় ঘুরেছি৷ ওসলা-তে দুর্যোধনের মন্দির দর্শন করেছি৷ ওসলা-তে কিছু সামাজিক প্রথা সম্বন্ধে আমাদের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল৷ এখানে এখনও বহুবিবাহ প্রথা চালু আছে৷ যেমন, একটি পরিবারে একটি মাত্র স্ত্রী থাকে৷ আর তার পাঁচ-ছ’জন স্বামী থাকে৷ একটা কথা এখানে বলে রাখি, ১৯৭৩ সালে হিমালয় ভ্রমণের সময় যে-সকল দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করেছিলাম, সেই স্থানও পুনরায় দর্শন করতে হয়েছিল, কিন্তু আশ্চর্যের কথা, দেখা স্থান, দেখা মন্দির হলেও কোনো কিছুই পুরোনো বলে মনে হয়নি৷ হিমালয়ের নানান স্থান আমরা দু-জন কী তিনজন মিলেও ভ্রমণ করেছি৷ নির্জন পথ৷ তবুও যেন মনে হয়েছে আমাদের সঙ্গে আরও কেউ একজন আছেন, তিনিই যেন আমাদের গাইড হিসেবে পথ দেখিয়ে চলেছেন৷ মনের ভুল হতে পারে, কিন্তু এটাই ছিল বাস্তব ঘটনা৷

 আমাদের যাত্রাপথের দু’ধারে ফুটে ছিল এক ধরনের গোলাপ ফুল৷ এই ফুলের শোভা আছে, কিন্তু গন্ধ ছিল না৷ গোলাপ ছাড়াও দেখেছি অসংখ্য রডোড্রেনডন ফুলের গাছ৷ এসব ফুল, গাছের শোভা দেখে চক্ষু জুড়িয়ে যায়৷ পথের দু’পাশে এক ধরনের ফলের গাছও আমরা দেখেছিলাম৷ আমাদের সঙ্গে স্থানীয় লোকরা সেই ফল খেয়ে তৃষ্ণা মেটায়৷

 এখানে আমি একটা অলৌকিক ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না৷

 অমরনাথ গুহাকেন্দ্রে আমি আমার মা-কে স্পষ্ট দেখেছিলাম৷ মা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আমাকে আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে৷ প্রথমে একটু হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম৷ মনে হয়েছিল এ আমার চোখের ভুল, বিভ্রম! কিন্তু পুনরায় দেখার চেষ্টা করতে ওই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয়েছিল৷ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, রক্ত-মাংসের জীবন্ত আমার মাতৃমূর্তি৷ যদিও আমার মা বহু বছর আগে দেহত্যাগ করেছিলেন৷ এটার মধ্যে, অর্থাৎ এই ঘটনার মধ্যে আমার একটা ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ আছে৷ উচ্চতাবিশিষ্ট পরিবেশে মানুষের চেতনা এমনভাবে ঘুরে যায় যে, তখন নাকি দিব্যচক্ষে পরলোকগত পূর্বপুরুষদের দেখা পাওয়া যায়৷ এইভাবে অনেকে অনেক কিছুর দর্শন পেয়ে থাকেন বলে শুনেছি৷ এই হিমালয় ভ্রমণের পথে পথে, নানা স্থানে, নানা ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে৷ সেসব ঘটনার নিখুঁত বিবরণ দেওয়া এক্ষেত্রে অনাবশ্যক বলে মনে হতে পারে৷

 আমাদের হিমালয় ভ্রমণের যাত্রাপথে মাঝে মাঝে তাঁবু খাটিয়ে বাস করতে বাধ্য হই৷ কারণ, সেসব জায়গায় থাকার কোনো চটি কিংবা হোটেল ছিল না৷ আমরা ওসলায় একটা বাংলো বাড়িতে একটা রাত কাটিয়েছিলাম৷ সেখানে গভীর রাতে বাংলোটি কাঁপতে লাগল৷ তারপর বিকট এক শব্দ কানে এল৷ কান ফাটানো শব্দ৷ মনে হল যেন, মহাপ্রলয় ঘটে গেল৷ পরদিন সকালে উঠে শুনতে পেলাম ‘বন্দরপুছ’ পাহাড়ের একটা অংশ ‘হিমানিসম্প্রাত’ হয়ে পড়েছে৷ মনে আছে, আমরা সেই পাহাড়টা দেখতে গিয়েছিলাম৷

 হিমালয়ের অনেক অঞ্চলে আমরা ঘুরেছি, কিছু কিছু এমন স্থান চোখে পড়েছে, জনমানবশূন্য৷ ক্কচিৎ-কখনও দু-একজন সাধুসন্ত চোখে পড়েছে৷ আশপাশের মাইলের পর মাইল জনহীন৷ কোথাও কোনো জনপদ, দোকানপাট কিংবা বসতির চিহ্ন নেই৷ ভেবে অবাক হতে হয়েছে, তাঁরা কী খান! কোথা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করেন? এই আত্মকৌতূহলের কোনো জবাব খুঁজে পাইনি৷ হিমালয় ভ্রমণকালে নানারকম বিস্ময়কর ঘটনা নিজের চোখে দেখেছি৷ অন্যের মুখ থেকেও শুনেছি৷ অবাক হয়েছি, ভেবেছি৷ কিন্তু, কোনো কূলকিনারা পাইনি৷…

আবার বাস্তব জীবনে, প্রাত্যহিক সংসারে ফিরে এসে যখন দেখি বা শুনি আজকের দিনে শিক্ষক এবং ছাত্রদের সম্পর্কের কথা, তখন বেদনায় বুকটা ভেঙে পড়ে৷ চোখে জল এসে যায়৷

 এ-প্রসঙ্গে একটা উদাহরণের কথা তুলে ধরছি৷ একটা উদাহরণই বা কেন বলছি! আমাদের স্কুল কলেজ-জীবনে তখন সেটাই চল ছিল৷ শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক বিরাজ করত৷

 আমি দেখেছি, আমার স্কুল কিংবা কলেজ-জীবনে ক্লাসের ছাত্ররা পড়া না করতে পারলে শিক্ষকরা বকাবকি করতেন৷ দুষ্টুমি করলে মারতেনও৷ কিন্তু ছুটির পর সেই ছেলেটিকে, অর্থাৎ যে ছেলেটিকে বকেছিলেন কিংবা মেরেছিলেন, তাকে কাছে টেনে নিয়ে বোঝাতেন৷ আদর করতেন৷ ভালো করে পড়াশোনা করতে বলতেন৷ মারার জন্য, বকার জন্য, এ যেন ছাত্রের কাছে দুঃখপ্রকাশ করা৷ যেন ক্ষমা চেয়ে নেওয়ারই একটা বিকল্প ইঙ্গিত৷

 আজকে চারিদিকে কত কোচিং ক্লাস, টিউটোরিয়াল হোম চোখে পড়ে৷ এর বাইরে গৃহশিক্ষকরা তো আছেনই৷ আমাদের সময়ে দেখেছি, স্কুল ছুটির পর শিক্ষকরা বিনা বেতনে আগ্রহী ছাত্রদের যত্ন করে পড়াতেন৷

 তা ছাড়া, কোনো শিক্ষকের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে, ফেয়ারওয়েলের দিন, ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকরাও চোখের জল ফেলতেন৷ শিক্ষকরা অবসর নেওয়ার পরও, ছাত্ররা শিক্ষকদের বাড়ি গিয়ে খোঁজ-খবর নিত৷ স্যার কেমন আছেন, বাড়ি গিয়ে ছাত্ররা দেখা করে আসত৷ এটা তো স্কুলের ঘটনা৷ আমাদের কলেজ-জীবনের দিনগুলোতে অধ্যাপক এবং ছাত্রদের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল অত্যন্ত মধুর৷ কলেজে তো বটেই, কলেজের বাইরে, রাস্তাঘাটে, কোথাও যদি অধ্যাপকদের সঙ্গে দেখা হত, ছাত্ররা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মাস্টারমশাইয়ের কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করত৷ তারপর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা তো ছিলই৷

প্রসঙ্গ: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

 আমার উপলব্ধ নীতিকথার সারণিতে বিভূতিভূষণের কথা প্রথমেই এসেছে৷

 ১৯৫০ সালের কথা৷ বিভূতিভূষণ তখন ঘাটশিলায় থাকতেন৷ আমি যখন ধলভূমগড়ে যেতাম বিভূতিভূষণের সঙ্গে দেখা করতাম৷ তিনি ঘাটশিলায় যেখানে থাকতেন, সে জায়গাটার নাম ছিল, ‘দাহিগোড়া’৷ তাঁর বাড়িটা ছিল এক ধরনের টালি দিয়ে ছাওয়া৷ এই টালিগুলোকে বলা হত ‘খাপরি টালি’৷ দেয়াল ছিল পাকা ইটের৷ মনে আছে, বাড়িটা ছিল দক্ষিণমুখী৷ দক্ষিণ দিকে একটা রোয়াক ছিল৷ বাড়ির উঠোনে ছিল একটা ‘তুলসী মঞ্চ’৷

 ঘাটশিলাতে অনেক গণ্যমান্য মানুষ ছিলেন বিভূতিভূষণের বন্ধু৷ বিভূতিভূষণ ঘাটশিলাতে এলেই তাঁরা বিভূতিবাবুর বাড়িতে আসতেন৷ সেখানে সাহিত্যের আসর বসত৷ মাঝে মাঝে দেখেছি, কলকাতা থেকেও অনেক নামকরা সাহিত্যিক বিভূতিবাবুর বাড়িতে আসতেন৷ সাহিত্যবাসর বসত৷ সাহিত্য সম্বন্ধে নানা আলোচনা চলত৷ আমরাও মাঝে মাঝে সেইসব অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি৷ দেখেছি, মাঝে মাঝে বিভূতিবাবুর বাড়িতে পিকনিকের আয়োজনও হত৷ বিভূতিভূষণ খুব ভোজনরসিক ছিলেন৷

 আমি যখন ধলভূমগড়ে যেতাম, সেই সময় যদি বিভূতিভূষণ ঘাটশিলায় থাকতেন, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম৷ সেই সময় ঘাটশিলা এবং ধলভূমগড়ে অনেক বিশিষ্ট বঙ্গজনের বসবাস ছিল৷ তা ছাড়া, এখানকার জলবায়ু ভালো বলে, অনেকেই কলকাতা থেকে হাওয়া বদল করতে এখানে বেড়াতে আসতেন৷ বিভূতিভূষণের ছোটোভাইয়ের নাম ছিল নুটুবাবু৷ অর্থাৎ নুটুবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়৷ নুটুবাবুর সঙ্গেও আমার বেশ আলাপ ছিল৷ তিনি ছিলেন বেশ ভালোমানুষ এবং খাঁটি মানুষ৷

 ঘাটশিলা স্টেশন থেকে সোজা হরিণধুবড়ি হয়ে রাজবাড়ির ম্যানেজার বঙ্কিমবাবুর বাড়ির সামনে দিয়ে, রেললাইন পেরিয়ে যে রাস্তা ছিল, সেটা ধলভূমগড় যাওয়ার রাস্তায় গিয়ে মিশত৷ তখন বোম্বে রোড হয়নি৷ রাস্তাগুলো ছিল লাল মোরামে বাঁধানো৷ ওই রাস্তার ধারে, ধলভূমগড়ে কুয়োতলায় একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় টেবিল পেতে নুটুবাবু হোমিয়োপ্যাথি ডিসপেনসারি খুলে আদিবাসীদের চিকিৎসা করতেন৷ তিনি ঘাটশিলা থেকে সাইকেলে এখানে আসতেন৷ নুটুবাবুর মাথায় থাকত খাকি রঙের শোলার টুপি৷ নুটুবাবু আসতেন ঠিক ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে৷ আবার ১২টা-১টার মধ্যে ফিরে যেতেন৷ শুনেছি, নুটুবাবু অনেককে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন৷

 কুয়োতলার গায়েতে একটা প্রাচীন বটগাছ ছিল৷ স্থানীয় প্রবীণ মানুষদের মুখে শুনতাম, গাছটার বয়স নাকি দুশো বছর৷ সেই গাছটাকে আমি ২০০২ সালেও দেখেছি৷ এই গাছটার পাশেই যে গ্রামটা ছিল তার নাম চারচাকা৷ তারপর, আরও গ্রাম৷ বিচিত্র সব নাম৷ যেমন, বাঘাশোল, করকটা শোল, পট্টনায়ক শোল ইত্যাদি৷ ‘শোল’ কথাটার স্থানীয় ভাষায় মানে, ‘মৌজা’৷

 সুবর্ণরেখা নদীর দুটো ঘাটের নাম ছিল গোকলো, দ্যাড়াং৷ ধলভূমগড় স্টেশন থেকে ওই ঘাট দুটির দূরত্ব ছিল প্রায় মাইল তিনেক৷ আগেই বলেছি, বিভূতিবাবু যখন ঘাটশিলায় থাকতেন, তাঁর বাড়িতে প্রায়ই সাহিত্যের আসর বসত৷ নানা বিদ্বজ্জনের আনাগোনা ছিল সেখানে৷ দেখেছি, উনি গোরুর গাড়িতে চেপে স্থানীয় জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন৷ কখনও বা মোটর গাড়ি চেপেও তাঁকে ঘুরতে দেখেছি৷ তবে, গোরুর গাড়ি বা মোটর গাড়ি যাই হোক না কেন, আমি দেখেছি রাস্তার ধারে গাড়ি বেঁধে রেখে বিভূতিবাবু পায়ে হেঁটে ঘুরতেই ভালোবাসতেন বেশি৷

 বিভূতিভূষণের ঘাটশিলার বাড়ির কাছেই সুবর্ণরেখা নদী৷ নদীতে যাওয়ার পথে, বিরাট একটা পাথরের চাঁই পড়ে থাকতে দেখতাম৷ বিভূতিবাবু মাঝে মাঝে ওই পাথরটার ওপর প্রায় ধ্যানস্থ হয়ে বসে থাকতেন৷ মনে হয় এক মনে প্রকৃতিকে গভীরভাবে অবলোকন করতেন৷ সেই কারণেই ওই শিলাখণ্ডটির নামই হয়ে গিয়েছিল ‘বিভূতি শিলা’৷ সুযোগ পেলেই তিনি দিন রাত ওই শিলায় বসে প্রকৃতি দেখতেন৷ মনে হত উনি যেন প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলছেন৷ দুঃখের কথা, আমি যখন ২০০২ সালে ঘাটশিলায় যাই, তখন কিন্তু ওই শিলাখণ্ডটিকে না দেখতে পেয়ে অবাক হয়েছিলাম৷ দেখলাম, সেই পাথরটির জায়গায় একটা বাড়ি তৈরি হয়েছে৷

 আমাদের ধলভূমগড়ের বাড়ির কথা বিস্তারিতভাবে কিছু বলা হয়নি৷ বাড়ির চারদিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল৷ বাড়ির সদর দরজাটা ছিল স্টেশনের দিকে৷ বাড়ির পেছন দিকে একটা খিড়কি দরজাও ছিল৷ বাড়ির পেছনে কিছুটা ফাঁকা জায়গার পরেই শুরু হয় বিস্তীর্ণ জঙ্গল৷ গভীর জঙ্গল৷ সুবর্ণরেখা নদীর ওপারে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বহু হিংস্র পশু এপারের জঙ্গলে এসে লুকিয়ে থাকত৷ এইসব হিংস্র জন্তুদের মধ্যে প্রধানত দেখা যেত চিতাবাঘ, ভাল্লুক, বুনো শুয়োর এবং বন্য কুকুর৷ একবার একটা ঘটনা ঘটে৷ বাড়ির পেছনের খিড়কির দরজাটা ভুল করে বন্ধ করা হয়নি৷ দরজাটা খোলা ছিল৷ বাড়ির উঠোনে গরমকালে খাট পেতে আমরা সবাই শুয়ে ছিলাম৷ কেউ কেউ আবার গল্পে মেতেছিল৷ রাত্রিকাল৷ আমাদের একটা পোষা দেশি কুকুর ছিল৷ কুকুরটা দেখতে খুব লম্বা-চওড়া৷ হঠাৎ দেখি কুকুরটা খিড়কি দরজা থেকে ছুটে সদর দরজার দিকে পালিয়ে গেল৷ কুকুরটার পেছনে একটা লম্বাটে জন্তু তাড়া করেছে৷ বাবার বন্ধু সুবোধবাবু সেদিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন৷ সন্ধেবেলায় বাবার সঙ্গে গল্প করতে এসেছিলেন৷ তিনিই বাবাকে বলেন, ‘দেখলেন, কুকুরটাকে কে তাড়া করেছিল?’

 বাবা তো অবাক! কিছুই জানেন না৷ সুবোধবাবু এবার বিস্তারিত হলেন৷ এবং বললেন, ‘ওটা একটা চিতাবাঘ৷ সময় সময় ওরা ভয়ংকর হিংস্র হয়ে ওঠে৷

 রাজ-কাছারি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ৮ মাইল দূরে৷ যেতে আসতে ১৬ মাইল রাস্তা৷ ওই রাজ-কাছারিতে গিয়ে খাজনা দিয়ে আসতে হত৷ একবার হল কী, মা আমাকে রাজ-কাছারিতে খাজনা দিতে পাঠালেন৷ এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো৷ এক বছরের আমাদের বাড়ির খাজনা ছিল ১ টাকা ৪ আনা৷ একবার সকাল ১০টার সময় ভাত-টাত খেয়ে আমি কাছারিবাড়ি রওনা দিলাম খাজনা দেওয়ার জন্য৷ দুপুরে কাছারিতে খাজনা জমা দিয়ে রসিদ নিলাম৷ কাছারিবাড়িতে দূর-দূরান্ত থেকে যারা খাজনা দিতে যেত, তাদের সকলকে আখের গুড় আর ছোলা ভিজে খেতে দেওয়া হত৷ তাই খেয়ে ইঁদারার জল খেয়ে দুপুরের দিকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই৷ পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছের নীচে বিশ্রাম নিতে নিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই৷ ঘুম ভাঙতেই দেখলাম প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে৷ বনের রাস্তার মধ্যে দিয়ে ফিরতে হবে৷ তাই ফেরার কথা আর মাথায় এল না৷ বন্যপশুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য একটা গাছে উঠে পড়লাম৷ গায়ের চাদর দিয়ে একটা গাছের ডালের সঙ্গে নিজেকে ভালো করে বেঁধে নিলাম যাতে পড়ে না যাই৷ সন্ধে তখন হব-হব৷ এমন সময় হয়তো মানুষের গন্ধ পেয়ে একটা বন্য কুকুর গাছতলায় এসে ওপরের দিকে চাইতে লাগল এবং মাঝে মাঝে গাছের গোড়ায় আঁচড় কাটতে লাগল৷ দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যে আরও চার-পাঁচটা বন্য কুকুর গাছটির নীচে এসে জমা হল এবং গাছের গোড়ায় ক্রমাগত আঁচড় কাটতে লাগল৷ নিজেকে চাদর দিয়ে ভাগ্যিস গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলাম৷ একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল৷ হঠাৎ একটা ক্যাঁচর-ক্যাঁচর শব্দে তন্দ্রা কেটে গিয়ে দেখলাম, ভোর হয়ে আসছে৷ গোটা চারেক গোরুর গাড়ির চাকার শব্দে বন্য কুকুরগুলো ভয়ে পালিয়ে গিয়েছে৷ আমি গায়ের চাদরের বাঁধন খুলে গাছের নীচে নেমে পড়লাম এবং গাড়োয়ানদের সব কথা খুলে বলাতে তারাই আমাকে গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে ধলভূমগড়ে পৌঁছে দেয়৷ বাড়ি পৌঁছে দেখলাম মা সারারাত আমার চিন্তায় কান্নাকাটি করেছেন৷ মায়ের চোখ লাল৷ ফোলা ফোলা৷ মাথার চুল এলোমেলো৷ আমি মাকে দেখে, মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম৷ সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি৷ সময়টা ছিল ১৯৪১ সাল৷ অর্থাৎ যে-বছর কলকাতায় জাপানি বোমা পড়ে৷ তখন মা আর আর আমি ধলভূমগড়ে এসেছিলাম৷

 আরও একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল আমার জীবনে৷ সেটা ছিল ১৯৪৫ সালের কথা৷ তখন আমার বয়স ছিল উনিশ-কুড়ি৷ আমার সমবয়সি ৮/১০ জন বন্ধুকে নিয়ে ধলভূমগড়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম৷ ওখানে আমাদের বাড়িঘর দেখাশোনা করার জন্য একজন কেয়ারটেকার ছিলেন৷ তাঁকে আমরা শর্মাজি বলে ডাকতাম৷ আদিবাসীরা সারাদিন নদীতে মাছ ধরে, সন্ধের দিকে বাড়িতে বাড়িতে বিক্রি করতে আসত৷ আমরা সেই আদিবাসী একজনের কাছ থেকে এক সের-দেড় সের ওজনের একটা মাছ কিনে ফেললাম৷ কিন্তু আমরা জানতাম না যে ওই মাছ রান্না করার জন্য মালমশলা নেই৷ কী আর করা যায়! ওই রাত্রেই মুদির দোকানের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম৷ আমাদের বাড়ি থেকে মুদির দোকান ছিল অনেকটা দূরে৷ দেড় মাইল দূরে হাট অঞ্চলে৷ কারণ, কাছাকাছি কোনো মুদির দোকান ছিল না৷ কিন্তু মাছটা রান্না করতে গেলে তেল-মশলা তো আনতেই হবে৷ রাত্রে খাওয়ার প্রয়োজনে এই মাছটা ছিল একমাত্র পদ৷ তা ছাড়া আমাদের সকলের মধ্যে একটা পিকনিকের মেজাজ তৈরি হয়েই ছিল৷ অন্য সুযোগ, মা নেই আমাদের সঙ্গে৷ অর্থাৎ কী করছি, কোথায় যাচ্ছি বলার কেউ নেই৷ আমাদের মনে তখন অনন্ত স্বাধীনতা৷ তাই সেই রাত্রিতেই, অর্থাৎ গ্রামগঞ্জের পরিবেশে রাত্রি ৮টা-৯টা মানে দেশ-পাড়াগাঁয়ে অনেক রাত্রি৷ শর্মাজিকে সঙ্গে নিয়ে তেল-মশলা কিনতে হাটের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম৷ যাই হোক, তেল-মশলা কিনে শর্মাজিকে বললাম, শর্মাজি রেললাইন ধরে চলুন৷ তাহলে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে৷ শর্মাজি রাজি হলেন না৷ বললেন, রেললাইনের পাশ বরাবর ঘন জঙ্গল চলে গিয়েছে৷ জঙ্গল থেকে প্রায়ই হিংস্র বাঘ-ভাল্লুক, চিতাবাঘ বেরিয়ে পথ চলতি মানুষকে আক্রমণ করে৷

 শর্মাজির সতর্কবাণীকে অগ্রাহ্য করে আমি বললাম, ‘না, ও কিছুই হবে না৷ আমরা রেললাইন ধরেই ফিরব৷ তাহলে অর্ধেকটা দূরত্ব কম হয়ে যাবে৷’

 সেটা ছিল চাঁদনি রাত৷ চারিদিকে ফুটফুটে আলো৷ রেললাইনটা সিঙ্গল লাইনের৷ কয়লার ইঞ্জিনে গাড়ি চলত৷ আমরা রেললাইন ধরে চলতে চলতে হঠাৎ কীসের একটা খসখস শব্দ কানে এল৷ শর্মাজি বললেন, ‘শুনছ, কিছু যেন একটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে! নিশ্চয়ই ওটা কোনো একটা জন্তু-টন্তু হবে৷’

 বলতে বলতেই দেখতে পেলাম, ওটা একটা চিতাবাঘ৷ আমরা জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম৷ বাঘটাও ঠিক আমাদের সমান্তরালে হাঁটছিল৷ জঙ্গল থেকে রেললাইনটা ছিল পনেরো-কুড়ি ফুট উঁচুতে৷ বুঝতে পারছি, বাঘটা আমাদের লক্ষ করতে করতে লাইনের পথ ধরে, প্রায় একই সমান্তরালে চলেছে৷ মনে হচ্ছে, আমাদের দুজনের মধ্যে একজনকে বাঘটা ওই গভীর জঙ্গলে টেনে নিয়ে যাবে৷ এমন সময় দেখতে পেলাম স্টেশনের দিকে, মানে যেদিকে আমরা দুজন এগিয়ে চলেছি, সেই স্টেশনের দিক থেকে একটা মালগাড়ি এগিয়ে আসছে৷ সেই গাড়ির ইঞ্জিনের হেডলাইটের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে৷ মালগাড়িতে আশি-নব্বইটা বগি ছিল৷ আমরা ছুটে গিয়ে সামনের সিগন্যাল কেবিনে উঠে পড়লাম৷ ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করাতে সিগন্যাল-ম্যানকে সমস্ত বললাম৷ যা-ই হোক, এ-যাত্রায় সাংঘাতিক একটা বিপদ থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম৷

 বাঘ-ভাল্লুকের কথা আলোচনা করতে করতে আসল শিকার করার কাহিনিটাই ভুলে গিয়েছিলাম৷

 সময়টা ছিল ১৯৫০ সাল৷ মাসটাও মনে আছে৷ ফেব্রুয়ারি৷ অর্থাৎ, আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগের কথা৷ আমরা ক’জন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম সুন্দরবনে শিকারে যাব৷ যেমন কথা তেমনি কাজ৷ অর্থাৎ, দু-এক দিনের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সব আয়োজন, অর্থাৎ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিলাম৷ সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা বড়ো বাক্স জোগাড় করা হল৷ বিরাট বড়ো বাক্স৷ বাক্সের মধ্যে অনেকগুলো খোপ ছিল৷ মনে আছে প্রায় এক মাসের মতো জিনিসপত্র, মানে নানা রসদ, খাদ্যসামগ্রী, অর্থাৎ নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু৷ চাল, ডাল, জ্বালানি তেল এবং আরও কত টুকিটাকি৷

 তখনকার দিনে সুন্দরবনে যেতে হলে মথুরাপুর খাল ধরে সুন্দরবনে যেতে হত৷ আমরা এক মাসের জন্য একটা নৌকো ভাড়া করেছিলাম৷ নৌকোর ভাড়া ছিল, প্রতিদিন মাত্র তিরিশ টাকা৷ আর সঙ্গের যে দুজন মাঝি থাকত, তাদেরও মজুরি ছিল প্রতিদিন তিরিশ টাকা করে৷ আমরা নৌকোতে সব জিনিসপত্র সাজিয়ে নিয়েছিলাম৷ আমাদের সঙ্গে ছিল দুটো পেট্রোম্যাক্স এবং দুটো হ্যারিকেন৷ আর ছিল কেরোসিন তেলের দুটো লোহার পাত্র৷

 এই লোহার পাত্র বা জ্যারিকেন, যা-ই বলা হোক না কেন, যুদ্ধের সময় এইরকম জ্যারিকেন বা পাত্র আমরা দেখেছি৷ এক-একটা জ্যারিকেনে প্রায় পঁচিশ লিটার মতো কেরোসিন ধরত৷ বিকেলের দিকে আমরা নৌকোয় উঠে গেলাম৷ মাঝিরা বলল, ‘আপনারা নৌকোতে বিশ্রাম নিন৷ ভালো করে গুছিয়ে, শুয়ে-বসে থাকুন৷ নদীতে জোয়ার এলে আমরা নৌকো ছাড়ব৷’

 রাত্রি প্রায় ন’টা নাগাদ মাঝিরা হাঁক ছাড়ল, ‘এবার নৌকো ছাড়ব৷ নদীতে জোয়ার এসে গিয়েছে৷’ অন্ধকার ভেদ করে নৌকা চলতে শুরু করল৷ ভোরবেলায় আমাদের নৌকা রায়দিঘিতে পৌঁছোল৷ এ-অঞ্চলে, তখনকার দিনে এটাই ছিল বলতে গেলে কিছুটা শহর৷ কারণ এই রায়দিঘিতেই তখন নলকূপের ব্যবস্থা ছিল৷ পানীয় জলের একমাত্র উৎস৷

 এখান থেকেই আমরা তিনটে জ্যারিকেনে পানীয় জল ভরতি করে নিলাম৷ রায়দিঘি থেকে আবার যাত্রা শুরু করলাম৷ মানে, রায়দিঘিতে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম৷

 আবার আমাদের নৌকা চলতে শুরু করল৷ ক্রমে নলগোড়া নামের একটা জায়গা হয়ে আমরা পঞ্চখণ্ড নামে একটা জায়গায় এসে পৌঁছোলাম৷ এখানে আমাদের নৌকা নোঙর করা হল৷ এখানে কিছু মানুষের বসবাসের স্থান৷ দু-একটা দোকানপাট এবং হাটবাজারও এখানে বসে৷ এখান থেকে কিছু আনাজপত্র আমরা কিনলাম৷ পরের দিন ভোরবেলায় আবার আমাদের নৌকা চলতে শুরু করল৷ আমরা সন্ধ্যা নাগাদ মোল্লাখালি এসে পৌঁছোলাম৷ এখানে নদী অনেক চওড়া হয়ে গিয়েছে৷ মাঝিরা আমাদের নৌকাটা একটা খালের মধ্যে বেঁধে রাখল৷ খালটা ছিল প্রায় ১০০ ফুট মতো চওড়া৷ মাঝিরা বলল, ‘এখানেই নোঙর করে থাকব৷ নদীতে জোয়ার না এলে নৌকো ছাড়া যাবে না৷’

 সে যাই হোক, নৌকাতে বাঁশের মাথায় একটা পেট্রোম্যাক্স জ্বালিয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ চারিদিকের গভীর কালো অন্ধকারের মধ্যে এই আলো যেন বিভীষিকার মতো লাগছিল৷ গা-ছমছম করা একটা ভয় আমরা অনুভব করছিলাম৷ গভীর রাত্রে আমরা বাঘের ডাকও শুনতে পেয়েছিলাম৷ রাতে ঘুম আসত না৷ মাঝিদের সঙ্গে গল্প করতাম৷ দিনের বেলা নদীর ধারে হরিণ দেখতে পেতাম৷ তারা নদীতে জল পান করতে আসত৷ মাঝে মাঝে নদীর ধারে কুমিরও দেখতে পেতাম৷ তারা রোদ পোহাতে আসত৷

 আমাদের সঙ্গে শিকারের জন্য বন্দুক ছিল ঠিকই৷ কিন্তু এই বন্দুক থেকে একটা গুলিও আমাদের খরচ করতে হয়নি৷ মুখে আমরা বলতাম, সুন্দরবনে শিকারে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু এটা ছিল আমাদের জীবনে একটা অ্যাডভেঞ্চার৷ শুনেছিলাম, মোল্লাখালি-তে জঙ্গলের মধ্যে যেতে একটা দুর্গ ছিল৷ সেখানে যাওয়ার সময় একটা গ্রাম আমাদের চোখে পড়ে৷ সেই গ্রামের মানুষরা বাংলায় কথা বললেও ধর্মের দিক থেকে তারা খ্রিস্ট-ধর্মাবলম্বী৷ বাঘের জন্যই সুন্দরবনে আসা৷ বাঘ শুধু দেখার জন্য৷ মারার জন্য নয়৷ আমাদের নৌকা যখন জোয়ারের অপেক্ষায় নোঙর করা ছিল, সেই সময়ের এক রাতের ঘটনার কথা বলি৷ নৌকায় যথারীতি আলো জ্বলছিল৷ আমরা যেখানে ছিলাম, তার অদূরেই জঙ্গল৷ রাতে, হয়তো মানুষের গন্ধ পেয়ে সাঁতার কেটে একটা বাঘ আমাদের নৌকার দিকে এগিয়ে আসে৷ বাঘটা নৌকার একেবারে কাছে এসে গেলে মাঝি লগি দিয়ে খোঁচা মেরে তাড়িয়ে দেয়৷ বাঘটা বনে ফিরে যায়৷ কিছুক্ষণ পর দেখা যায় সেই বাঘটাই আমাদের আক্রমণ করতে আসছে৷ এবারও আমাদের নৌকার মাঝি অদ্ভুত তৎপরতায় লগি মেরে খুঁচিয়ে বাঘটাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল৷

এছাড়া আমার এক সহপাঠী, কর্ণের কাকা, নাম কার্তিক দাস, তাঁর খুব শিকারের শখ ছিল৷ তাঁর শিকার করার জন্য লাইসেন্স করা অনেকগুলো বন্দুক ছিল৷ সেই কার্তিককাকার সঙ্গে হাজারিবাগ জঙ্গলে শিকারে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথাও কোনোদিন ভোলার নয়৷

 এইসব কথা বলতে বলতে আমার কিছু নিজস্ব ভাবনা চিন্তা, একান্ত উপলব্ধির কথা আর বলা হয়ে ওঠে না৷ এসব কথা শুনে অনেকেই হয়তো আমাকে পাগল ভাবতে পারেন৷ তাতে আমি কিছু মনে করি না৷ প্রত্যেকটি মানুষের যেমন একটা জীবনদর্শন থাকে— কেমন করে সংসার প্রতিপালন করব, কীভাবে সন্তানকে মানুষ করব ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এগুলো সব ব্যক্তিজীবনের ভাবনাচিন্তা৷ একান্তভাবে ব্যক্তিগত ব্যাপার-স্যাপার৷ কিন্তু আমার ভাবনাচিন্তা ব্যক্তিগত নয়৷ ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে মানুষের জীবনচর্যা৷ বলা যেতে পারে এটাই দর্শন৷ অর্থাৎ জীবনদর্শন৷

 আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেক দিন সংসারের যে কাজকর্মে ব্যস্ত থাকি, সেটাও এই জাগতিক নিয়মের দ্বারা প্রভাবিত৷ এই কর্ম আবার দুটি ধারায় বিভক্ত৷ ব্যক্তিগত প্রয়োজন এবং বৃহত্তর মানবসমাজের কল্যাণে৷ যে কাজ বৃহত্তর সমাজের কল্যাণে নিবেদিত, সেই কাজটি মহাবিশ্বের একটা অদৃশ্য শক্তি আমাদের দিয়ে করিয়ে নেয়৷ সকলের পক্ষে সেটা উপলব্ধি করা, জানি সম্ভব হয় না৷ অর্থাৎ অদৃশ্য একটা নিয়ন্ত্রণশক্তি সেই মঙ্গল কাজগুলি করিয়ে নেয়৷ এই কর্মের সঙ্গে একটা চুম্বক-শক্তি যেন ঠিক দড়ির মতো টেনে রাখে৷ যেটাকে বলা যায় নিয়ন্ত্রণশক্তি৷ আরও সহজ করে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে৷ মহাবিশ্বের যিনি নিয়ন্ত্রক, তিনি যেন এক ঘোড়সওয়ার৷ ঘোড়া কোন দিকে ছুটবে, কোথায় যাবে, সেটা যেমন নিয়ন্ত্রণ করে ঘোড়সওয়ারের হাতের চাবুকটি, বলা যেতে পারে, ঘোড়সওয়ারটি যদি মহাবিশ্ব হয়, চাবুকটি হচ্ছে তার চুম্বক-শক্তি৷

 আমি মনে করি, কার্যসিদ্ধির জন্য কাজ শুরু করার আগে পরিকল্পনা বা প্রস্তুতিটি যদি নিখুঁত না হয়, তাহলে কিন্তু নির্দিষ্ট কাজটি সফল হতে পারে না৷ তার মানে, সব কিছু নির্ভর করছে সেই অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের হাতে৷ একটা উপমা তুলে ধরে এই ব্যাপারটা আমি প্রমাণ করতে চাই৷ ধরা যাক, একজন নিমন্ত্রিত অতিথির সামনেই তাঁকে খেতে দেওয়ার জন্য নানা রকম সুস্বাদু খাবার সাজানো হচ্ছে৷ অতিথি দেখছেন এবং অপেক্ষা করে আছেন কখন খাদ্য সাজানো শেষ হবে! কখন তাঁকে খাওয়ার জন্য ডাকা হবে! যত দেরি হচ্ছে, অতিথির খিদের ইচ্ছেটা ততই বাড়ছে এবং তাঁর পাকস্থলীতে ততই পাচকরসের ক্ষরণ হচ্ছে৷ তারপর এক সময় তৃপ্তি সহকারে অতিথি খাদ্য গ্রহণ করলেন এবং দেখা গেল সহজেই সেই অতিথি খাদ্য গ্রহণ করলেন এবং দেখা গেল সহজেই সেই অতিথির খাবার হজম হয়ে গেল৷ আমি মনে করি ধর্মীয় ক্ষেত্রে এটাকেই বলা হয় নিবেদন৷ এই নিবেদনটা যদি আন্তরিক অর্থাৎ সঠিক না হয়, তাহলে কোনো কাজই সফল হয় না৷ অর্থাৎ, জীবনে এবং সমাজকল্যাণে যে কাজই করা হোক না কেন, সুচারু চিন্তা-ভাবনা এবং সঠিক পরিকল্পনার প্রয়োজন! অতিথি তথা নিমন্ত্রিত মানুষটির খাদ্য পরিবেশনের আগে এই যে খাদ্য সাজানোর প্রস্তুতি, এটাকেই আমি বলতে চাই নিবেদন৷ আর, এই নিবেদনের নামে বিলম্ব— এটাই হচ্ছে আসল কথা৷ এই প্রস্তুতি বা বিলম্বের ফলে অতিথির পাকস্থলীতে তৈরি হল পাচকরস এবং সহজেই সেই খাদ্য হজম হয়ে গেল৷ যেটা শারীরিক সুস্থতার একটা চরম লক্ষণ৷ এই যে ব্যাপারটা, এটা শুধু বলা কথা নয়৷ এর সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সত্যের একটা যোগ আছে৷

 আমি অনেক বার একটা কথা বলেছি৷ একই কথা বার বার বলে এসেছি৷ আমার সংগ্রহশালায় যারা আছে— সবই জড়বস্তু৷ আমি যে তাদের ভালোবাসি, যত্ন করি, সেটা কিন্তু ‘ওরা’ বুঝতে পারে৷ তাই আমি মনে করি, ভালোবাসার জোরে ‘জড়বস্তু’-র মধ্যেও প্রাণের প্রতিষ্ঠা হতে পারে৷

 প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা ব্যক্তিসত্তা আছে৷ সেই সত্তাটা সচরাচর প্রকাশ পায় না৷ সেটা যেন অন্তরের অন্তস্তলে ঘুমিয়ে থাকে৷ তাকে জ্ঞান, বিবেক, ধৈর্য দিয়ে জাগাতে হয়৷ সেই সত্তাটা যখন উন্মোচিত হয়, তখনই আসল মানুষটিকে আমরা দেখতে পাই৷ বুঝতে পারি৷ এই সত্তার উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু একাকার হয়ে যায়৷ জাত-পাত বিভেদ ভুলে আসল মানুষটি বেরিয়ে আসে৷

 আবার অন্য একটা উপমায় ফিরে আসি৷ হাত দিয়ে একটা দেয়ালে যদি আঘাত করা হয় তাহলে সেই আঘাত কিন্তু ফিরে আসে৷ অর্থাৎ, আঘাত করলে প্রতিঘাতটা অনিবার্য হয়ে ওঠে৷ সেই রকমই ভালো-মন্দের মধ্যে আমরা বাস করি৷ আঘাতের যেমন প্রত্যাঘাত আছে, সেই রকম স্নেহ-ভালোবাসারও প্রতিদান আছে৷ মনে রাখতে হবে, স্নেহ-ভালোবাসা এমনই একটা বস্তু, সেটা কিন্তু অপরকে দান করলে বৃথা যায় না৷ প্রতিদান হিসেবে ফিরে আসে৷

 এইসব খুবই সহজ কথা৷ সকলেই বোঝেন৷ কিন্তু আসলে ব্যাপারটা আমরা যতটা সহজ বলে মনে করি ততটা সহজ নয়৷

 বিখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটা লেখায় বলে গিয়েছেন—

 ভগবানের সৃষ্টির মধ্যে যে কত সৌন্দর্য তা দেখবার সুযোগ ও সুবিধা কি সকলেই পায়? চৈতন্যকে প্রসারিত করে দেওয়া চাই, নতুবা শুধু শুধু চোখ ফিরে দেখলে কিছুই হয় না৷ উষ্ণতার অনুভূতির জন্য আকুতি সর্বাগ্রে প্রয়োজন৷ আকুতি থেকে ইচ্ছা— ইচ্ছা থেকে কর্মপ্রবৃত্তি৷

 আমার কথা, আমার কিছু একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধির কথা জানাবার আগে প্রণাম জানাই সেই মহাবিশ্বকে৷

 যে মহাবিশ্বকে অবলম্বন করে জীবনযাপন করছি, সেই মহাবিশ্বের অনন্ত বিস্ময়ের কাছে প্রণাম৷

 আমার অন্তর দিয়ে উপলব্ধ যে সত্য, যেগুলি পাঠকালে পাঠক হয়তো বিরক্তি প্রকাশ করতে পারেন৷ এতে আমি বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হব না৷ তার কারণ, পাঠক মাত্রই প্রবীণ নয়৷ লেখক যখন লেখেন, তার প্রত্যাশা থাকে বয়স ভেদে সর্বশ্রেণির পাঠকই তার লেখাটি পড়ুক৷ পড়ে ভালোলাগা বা উপকৃত হওয়ার ব্যাপারটা অন্য কথা৷

 এক্ষেত্রে যাঁরা তরুণ পাঠক তাঁরা নিশ্চয়ই আমার উপলব্ধ বাণীর প্রতি খুব একটা আকৃষ্ট হবেন বলে মনে হয় না৷ কারণ, তাঁরা চান লেখার মধ্যে গতি বা অ্যাডভেঞ্চার৷ তাঁরা আমার এইসব বাণীর কচকচানি নিয়ে মাথা ঘামাবেন না৷

 তার অনেকগুলো কারণও আছে৷ আমি রামকৃষ্ণ কিংবা বিবেকানন্দের মতো কোনো ধর্মগুরু নই৷ আমি একজন অতি সাধারণ সংসারী মানুষ৷ অতএব, আমার জীবনে যা সত্য বলে মনে হয়েছে, অন্যের কাছে যা বাণীর মতো শোনাচ্ছে, সবরকম পাঠকের কাছে সেটা উপভোগ্য না-হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ তবে আমি প্রবীণ পাঠকদের ভরসা রাখি, আমার এই উপলব্ধি থেকে কিছু সত্য, অর্থাৎ জীবনসত্য খুঁজে পাবেন৷

 আমার চেয়েও যাঁরা বয়সে অনেক ছোটো, আমি যেমন এখন ছিয়ানব্বই, যাঁরা ৬০-৭০-এ পা দিয়েই বলতে শুরু করেন, আর ভালো লাগছে না৷ কবে যে যাব! সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না৷ আমি কিন্তু তাঁদের সঙ্গে একমত নই৷ আমি মনে করি তাঁরা জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দটাই খুঁজে পাননি৷ আসলে বেঁচে থাকার যে মজা, সেই মজাটা থেকেই তাঁরা বঞ্চিত৷

 এই ‘মজা’-টা যে কী, এটা বোঝাতে গেলে একটু বিশ্লেষণের প্রয়োজন৷ এই ‘মজা’-টা উপলব্ধি করতে গেলে বেশিদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি৷

 মনে রাখতে হবে, প্রতিদিনই আমাদের নতুনভাবে জন্ম হচ্ছে৷ যতদিন পৃথিবীতে আপনি বেঁচে আছেন, ততদিনই আপনি নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন৷ আর, এই ঘটনা-অভিঘাত-জাত অভিজ্ঞতাই মানুষের জীবনে নতুন নতুন পথের দিশা হয়ে ওঠে৷ ব্যক্তিজীবনে এই অভিজ্ঞতাই এক-একটি বাণী রূপে প্রতিভাত হয়৷

 এটাও আমি খুব ভালো ভাবেই বুঝি যে, সংসারের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন৷ তবে বেঁচে থাকার আরও একটা অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীকে আরও একটু ভালো করে দেখার সুযোগ পাওয়া৷ আর এই দেখা মানেই, যত দেখা ততই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা৷ আর সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা খুঁজে পাই চরম সত্যটি৷ যা বাণী রূপে পরিগণিত৷

 এমনই কয়েক শত সত্যের উপলব্ধি ঘটেছে আমার জীবনে৷ যেগুলিকে আলাদা করে সাজালে বাণীর মতোই শোনাবে৷ আগেই বলেছি,এখনও বলছি, আমি কোনো মহাপুরুষ নই৷ তাই আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধ সত্যগুলো অন্যের কাছে বাণী-র মতোই শোনাবে৷ যদি তা-ই শোনায় আর সেটাকে পাঠক সত্য বলে মনে করে, তাহলে সেটাকে ‘বাণী’ বলে ধরে নিতে বাধা কোথায়? এ প্রশ্ন আমার পাঠকের কাছে নয়৷ আমার নিজের কাছেই এই প্রশ্ন!

 যদি সময় পাই, আমার ‘সত্য’, যা অন্যের কাছে ‘বাণী’ বলে মনে হয়, সেগুলিকে একত্র করে দুই মলাটের মধ্যে যদি স্থান করে দিতে পারি তবেই আমার শান্তি৷ মনে করব, একটা কাজের মতো কাজ করতে পেরেছি৷

 আমি এই ভারতবর্ষের নানা স্থানে ভ্রমণ করেছি৷ নানা জাতির, নানা সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছি৷ তাদের আচার-আচরণ এবং প্রাত্যহিক ব্যবহার, বা জীবনযাপনের মধ্যে থেকে নানা সত্যের সন্ধান খুঁজে পেয়েছি৷ এই সত্যটা কী? এখানে একটু বিশ্লেষণের প্রয়োজন৷ আমরা যখন বীরভূম জেলার নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, সেই সময় একজন চাষিভাই আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি দিনের বেলায় ঘুমোই, রাত্রে জেগে থাকি৷’

 প্রশ্ন করেছিলাম, ‘কেন?’ চাষিভাইটি উত্তর দিয়েছিল, ‘কারণ, আমি রাত্রিবেলা চাষের জমি পাহারা দিই৷’ এই পর্যন্তই৷ এই ঘটনার মধ্য থেকেই আমি একটা চরম সত্য খুঁজে পেলাম৷ সেটা হচ্ছে, কে কখন ঘুমুচ্ছে, কে কখন জেগে আছে সেটা বড়ো কথা নয়৷ আসলে দেখতে হবে, সে তাঁর কর্তব্যকর্মটি ঠিক ভাবে করছে কি না৷

 পুরোনো, পুরোনো বলে আঁকড়ে ধরে বসে আছি৷ কিন্তু আসা-যাওয়া নিয়েই তো এই পৃথিবী৷ এক দল যাবে, এক দল আসবে৷ অর্থাৎ নতুনদের জায়গা করে দিতেই হবেই৷ মজাটা হচ্ছে, আজ যে নতুন, কালের নিয়মে সে-ও একদিন পুরোনো হয়ে যাবে৷ পৃথিবী যে পরিবর্তনশীল, সেটা ধরা পড়ে এই আসা-যাওয়ার মধ্যে থেকেই৷ এ-প্রসঙ্গে ভারতের ঋষিদের কথা টেনে আনা যায়৷ তাঁরা শুধু দার্শনিক ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন সত্যদ্রষ্টা৷ তাই, কোনটা পুরোনো, কোনটা নতুন, তাঁদের হৃদয়ে আঁচড় কাটতে পারত না৷ কারণ, তাঁরা চরম সত্যটা উপলব্ধি করতে পারতেন৷ তাঁরা জানতেন আজ যে নতুন, কালের নিয়মে কালই সে পুরোনো হয়ে যাবে! আর এই পুরোনো দেখতে দেখতে, এর প্রতি আমাদের একটা ভালোবাসা জন্মায় এবং এগুলো চলে গেলেই মনটা কেমন হুহু করে ওঠে৷ আবার নতুন কিছু এসে, নতুন কেউ এসে শূন্যস্থানটা পূরণ করে দেয়৷ আমাদের সকল দুঃখ ভুলিয়ে দেয়৷ যাওয়া-আসা-র এই দোলাটাকেই আমি বলছিলাম ‘মজা’৷

 অনেকে মনে করেন, ঈশ্বর যা দিয়েছেন, সেটা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত৷ এটাও যেমন সত্য, আবার এর বিপরীতে অন্য একটা সত্যও ঈশ্বর আমাদের জন্য পরিবর্ত হিসেবে রেখেছেন৷ সেটা হচ্ছে, প্রত্যেক মানুষের জীবনেরই একটা লক্ষ্য থাকে৷ সে চায়, সেই লক্ষ্যে পৌঁছোতে৷ আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছোতে গেলে চাই সাধনা৷ এটা মানুষের একটা সাধারণ ধর্ম৷ প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই এটা থাকা বাঞ্ছনীয়৷ এই জিনিসটা যদি আমাদের জীবন থেকে উধাও হয়ে যায়, তাহলে মানবজীবন হয়ে ওঠে আনন্দহীন৷

 যে-কোনো শিল্পের মাধ্যমেই মানুষ তার লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারে৷ আর তার জন্যে চাই সাধনা৷ এবং যিনি এই সাধনায় সফল হতে পারেন, তিনিই তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারেন৷ এটাকেই অন্যভাবে বিশ্লেষণ করে বলা যায়, এটাই সাধনার দ্বারা ঈশ্বরকে পাওয়া৷ তাই বলা যেতে পারে, একজন শিল্পীর মধ্যে আমৃত্যু তৃষ্ণা থেকে যায়৷ এই তৃষ্ণার অন্য নাম ভালোবাসা৷ এই ভালোবাসা না থাকলে তৃষ্ণা মেটানো যায় না৷ অতএব, এই ভালোবাসাই সব৷ ভালোবাসাই মনুষ্যজীবনের মহান ব্রত এবং এই ভালোবাসার কোনো বিচ্যুতি ঘটলে, নানা বিপত্তি ঘটে যেতে পারে৷

 জীবনের পরিণতি কী? এ-কথা না ভেবে, তোমার কাজটা তুমি ভালোভাবে করার চেষ্টা কর৷ এটুকুই তোমার ডিউটি৷ এটাই তোমার কর্তব্য৷ এই কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হলেও চাই সাধনা৷ কঠোর সাধনা৷

 আমরা যে-গৃহে বাস করি, সেই ঘরের প্রতিটি বস্তু আমাদের আকৃষ্ট করে৷ সেই কারণেই আমাদের গৃহের প্রতি একটা আকর্ষণ জন্মায় এবং গৃহকে আমাদের আশ্রয়দাতা বলে মনে করি৷

 আমরা অতি সাধারণ মানুষ৷ আমাদের মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার একটা ব্যাপার থাকে৷ আর সেটাকে পেতে গেলে আকুলতার প্রয়োজন৷ এই আকুলতা থাকলেই বাঞ্ছিত বস্তুটি তোমার সামনে এসে নিজেকে প্রকাশ করবে৷

 সব মানুষের রুচি এক হতে পারে না৷ ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রুচি৷ যেমন দ্রষ্টব্য এক, কিন্তু দর্শক অনেক৷ সকলের দৃষ্টি কিন্তু সমান নয়৷ একজনের যা ভালো লাগে, অন্যের তা না-ও লাগতে পারে৷

 দারিদ্র্যের মধ্য দিয়েই জীবনকে চেনা যায়৷ আর মানুষের সত্যিকারের ইতিহাস দরিদ্রদের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়৷

 আমরা এই বিশ্বদেবতার জয়গান করি৷ কারণ তিনিই তো আমাদের এই বিশ্বে এনেছেন৷ এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর এই লীলা আমরা যাতে প্রত্যক্ষ করতে পারি৷ এই বিশ্বদেবতাকেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘জীবনদেবতা’৷ আমার মনে হয়, এই ‘জীবনদেবতা’ এবং ‘বিশ্বদেবতা’-র মধ্যে একটু পার্থক্য আছে৷ রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা ‘গতিশীল’, অনন্তের অনুসন্ধানী৷ বলা যেতে পারে অনন্তের অভিযাত্রী৷ আমি যাকে বিশ্বদেবতা বলতে চাইছি, তিনিই তো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা৷ আর রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’ হচ্ছে এই সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে যে অনন্তের রহস্য, সেই রহস্যকে উন্মোচন করার অক্লান্ত প্রয়াস৷ সম্মুখ পানে ছুটে চলা৷ শুধু ছুটে চলা৷

 বৈজ্ঞানিকের কথায়, এই পৃথিবী মৃত্যুহীন নয়৷ অমর নয়৷ স্বাভাবিক ভাবেই এই পৃথিবীরও একদিন মৃত্যু হবে৷ কিন্তু, যতদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকবে, পৃথিবীতে জীবজন্তু থাকবে, মনে রাখতে হবে এই পৃথিবী বিবর্তনশীল৷ হয়তো সেই সুদূর ভবিষ্যতে আরও উন্নত বুদ্ধিসম্পন্ন মানবজাতির আবির্ভাব ঘটবে৷ আরও উন্নত মানবসভ্যতা দেখা দেবে৷ জানি না, সেই উন্নত মানবসভ্যতার যারা ধারক-বাহক হবে, তারা পৃথিবীর এই অনিবার্য তথা স্বাভাবিক মৃত্যুকে রোধ করতে পারবে কিনা৷ এটা ভবিষ্যতের কথা৷ কোটি কোটি বছর পরের কথা হয়তো৷ কিন্তু সুন্দর জীবনের জন্য মানুষকে চেষ্টা করে যেতে হবে৷ এই চেষ্টার দ্বারাই সৃষ্টি হতে পারে সুন্দর পৃথিবী এবং ‘সুন্দর’-ই মানবজীবনে এনে দিতে পারে আনন্দ৷ এই আনন্দই বাঁচাতে পারে আমাদের সকল রকম দুঃখ-যন্ত্রণার হাত থেকে৷ তাই, জীবনের আনন্দই প্রধান বস্তু৷ বলা যেতে পারে আকাঙ্ক্ষিত এই সুন্দর জীবনের চাবিকাঠিই হল আনন্দ৷

 বেঁচে থাকতে গেলে জীবনে সংঘাত আসবে, সংকট আসবে৷ কিন্তু সকলেরই চেষ্টা করা উচিত সেই সংকট বা সংঘাত থেকে নিজেকে দূরে রাখা৷ এটা মুখে বলা যতটা সহজ, কার্যক্ষেত্রে ততটা নয়৷ সংসারী মানুষের পক্ষে এই কাজটা করা খুবই কঠিন৷ তবে, এটা যারা করতে পারে তাদের চেতনা নষ্ট হওয়ার কোনো অবকাশ থাকে না৷ প্রতিদিন কিছুটা সময় নির্জনতায় কাটাতে পারলে, তাঁর স্বরূপকে উপলব্ধি করা যায়৷ তাঁর স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারলে তাঁর অবস্থান অনুভূত হয়৷ তাঁর অবস্থান অনুভূত হলে, জীবনের দুঃসময়ে আনন্দ এনে দেয়৷

 কামের বহির্মুখী প্রকাশ বন্ধ করে, অন্তর্মুখী প্রকাশের চেষ্টা যারা করে, তারাই আনন্দদায়ক ভালোবাসার স্বাদ পেয়ে থাকে৷ আর সেই ভালোবাসার মৃত্যু নেই৷

 জীবনে ভালো কিংবা মন্দ যে কাজটাই আমরা করি না কেন, জীবনের শেষ অধ্যায়ে তার প্রতিফলন উপলব্ধি করা যায়৷ এই প্রসঙ্গেই জীবনে আনন্দের কথাটা এসে পড়ে৷ আধ্যাত্মিক জগতে যাকে বলা হয় নির্মল আনন্দ৷ শিশু যেমন একটা খেলনা পেলে ভীষণ আনন্দ পায়, আনন্দে নেচে ওঠে, এ আনন্দ সেরকম নয়৷ অর্থাৎ, কিছু পাওয়ার বিনিময়ে আনন্দ, এটা তা নয়৷ সমাজের প্রতি, ব্যক্তিমানুষের জন্য ভালো কাজ করে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেই আনন্দ কোনো বিনিময় বোঝে না৷ ভালো কাজ করে অপরের সেবা করে যে আনন্দ হৃদয়ে বা মনে উপলব্ধি করা যায়, তাকেই বলে নির্মল আনন্দ৷ এই যে উপলব্ধিগত আনন্দ, এই আনন্দ কোনো বিনিময় বোঝে না৷ তাই এই আনন্দ অফুরন্ত৷ তাই এই আনন্দ অপরকে বিলিয়ে দেওয়া যায়৷ এই আনন্দ বিলিয়ে দিলে ফুরোয় না৷

 আরও একটা উপমা৷ বীজ বপন করলে চারা অঙ্কুরিত হয়৷ আর অঙ্কুরিত গাছটি যখন ফুলে-ফলে বড়ো হয়ে ওঠে, তাকে আমরা যত্ন করি, ভালোবাসি, ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখি৷ কারণটা কী? কারণটা হচ্ছে, এই গাছটির জন্মরহস্য আমাদের জানা হয়ে গিয়েছে৷ সেইরকম কামকে নিবৃত্তি করার একমাত্র উপায় হচ্ছে, মানুষের জন্মরহস্যকে জানা!

 আরও কত অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত উপলব্ধি, যা নিছক নীতিকথার মতো শোনাবে৷ কিন্তু, আমি মনে করি এর মধ্যে জীবন এবং জীবনের চরম কিছু সত্য নিহিত৷ এসব নতুন কিছু নয়৷ সবই চিরন্তন সত্য৷ শুধু নতুন করে তুলে ধরা, নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করা৷ ভেবেছি বারান্তরে, এখন নয়, অন্য ভাবে, অন্য সময় এসব কথা আলাদা ভাবে সারণিভুক্ত করব৷

 জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমাদের জীবনে একই সঙ্গে পাশাপাশি ‘সু’ এবং ‘কু’ কাজ করে যায়, অর্থাৎ ‘সুবুদ্ধি’ আর ‘কুবুদ্ধি’ জীবনে সমান্তরাল ভাবে অবস্থান করে৷ কিন্তু ভয়টা হচ্ছে, এই ‘কুবুদ্ধি’ ‘সুবুদ্ধি’-কে ছাপিয়ে গেলেই জীবনে নানা রকম বিপত্তির সৃষ্টি হয়৷ অতএব, জীবন থেকে এই কুবুদ্ধিটাকে কীভাবে ত্যাগ করা যায়, সেটা অভ্যাস করতে হবে৷ এই অভ্যাসটা যদি জোরদার হয়ে ওঠে, তাহলে ‘কুবুদ্ধি’ শেষপর্যন্ত মানুষের মন থেকে দূর হয়ে যায়৷ আর ‘সুবুদ্ধি’ নির্বিঘ্নে ভালো কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারে৷ আর এই ভালো কাজগুলো করবার জন্য আত্মপ্রত্যয়ও ধীরে ধীরে বাড়বে৷

 এটা তো সকলেই স্বীকার করবেন, আমরা যা কিছু করছি, অর্থাৎ আমাদের যা কিছু ভাবনাচিন্তা, সেটা কিন্তু সমাজকে নিয়ে৷ আর সমাজ মানেই তো মানুষ৷ মানুষকে বাদ দিয়ে তো আর সমাজের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না!

 শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গরিব-বড়োলোক, সবাইকে নিয়েই এই সমাজ৷ চিন্তা করে যদি কেউ একটু দেখে, তাহলে সবাই বুঝতে পারবে, একটা সুস্থ সমাজ, সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাধা৷ এই বাধাটির নাম, সংস্কার৷ একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে গেলে, সমাজের সকল মানুষকে সংস্কার থেকে মুক্ত হতে হবে৷ মানুষ যদি সংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারে, তবেই সুন্দর একটা সমাজ গড়ে ওঠে৷

 এই সংস্কারের কথা যখন উঠল, তখন এ নিয়ে আমার কিছু ব্যক্তিগত উপলব্ধির কথা বলে নিই৷ আমরা সংসারী মানুষ৷ সাধু-সন্ন্যাসী কেউ নই৷ তাই আমাদের কাছে, অর্থাৎ এই সংসারী মানুষের কাছে সংস্কার দু-প্রকার৷ সকলের মধ্যেই এই সংস্কার কমবেশি কিছু পরিমাণে থাকেই৷ সমাজে এমন কতকগুলো সংস্কার আছে, যা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না৷ এ-বিষয়ে অনেক উদাহরণ তুলে ধরা যায়৷ যেমন, আমরা যখন কাজেকর্মে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বাইরে যাই, তখন বাড়ির গৃহদেবতা কিংবা অন্যান্য ঠাকুরদেবতার ছবিতে কিংবা পরলোকগত মা-বাবার ছবিতে প্রণাম করি৷ যুক্তিনিষ্ঠ মানুষ হয়তো বলবেন, এসবই তো মনের ব্যাপার, এই ভক্তিটা তো মনে মনে রাখাই ভালো! দেখনদারির প্রয়োজনটা কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, গুরুজনদের বা ঠাকুর-দেবতার প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা, এটা একটা অভ্যাসের ব্যাপার এবং সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত বিষয়৷ তবে এটা ঠিক যে, এটাও এক ধরনের সংস্কার৷ কিন্তু, এই ধরনের সংস্কার সমাজে কিংবা ব্যক্তিজীবনে কারও কাছে ক্ষতিকর নয়৷

 কিন্তু, যে সংস্কার সমাজের ক্ষতি করে, মানুষকে ছোটো করে, জাতপাতের বিচার করে, সেটাই হচ্ছে কুসংস্কার৷

 এই কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে না পারলে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না৷ আর, যখনই আমরা সমষ্টিগত ভাবে এই কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারব, তখনই সমাজ সুন্দর হবে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *