আমি নকুবাবু – ১

বয়স হলে এই এক রোগ! চোখ থেকে ঘুম চলে যায়৷ সারা দুনিয়ার চিন্তা যেন মাথায় এসে ভিড় করে৷ লোকে বলে আমার পৃথিবী মানে তো ওই একচিলতে ঘর! যেখানে আমার ‘ওরা’ থাকে৷ ‘ওরা’ বলতে আমার সংগ্রহশালার বন্ধুরা৷ কত দিনের, কত দূরের— সব ঠিকানা আমার স্মৃতির খাঁচায় লিপিবদ্ধ৷ হ্যাঁ, ওদের কথা আমায় ভাবতেই হয়! কারণ, ওরা আমার কাছে নিছক জড়পদার্থ মাত্র নয়৷ ভালোবাসা পেলে জড়পদার্থের মধ্যেও প্রাণ প্রতিষ্ঠিত যে হতে পারে, সে প্রমাণ তো আমি পেয়েছি, এবং প্রতিদিনই পাই৷

 কথাটা পরিষ্কার করে নিই৷ সকালে, যখন আমি তিনতলা থেকে দোতলায় নেমে সংগ্রহশালার ঘরটা খুলি, ঘরে আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা যেন কেমন নড়েচড়ে ওঠে৷ আমি সেটা বুঝতে পারি৷ ‘ওরা’ যেন বলতে চায়, এসো, তোমার জন্যই আমরা অপেক্ষা করে আছি!

তারপর যখন লন্ঠনগুলো, পুরাকালের নানান যন্ত্রপাতিগুলো ঝাড়পোঁছ করি, ওরা খুশিতে যেন ঝলমলিয়ে ওঠে৷ আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, এবং বলেও৷ ওদের শব্দহীন নীরব ভাষা আমি বুঝি৷ এ যেন এক অব্যক্ত জীবনের জ্বলন্ত অভিঘাত৷

 নুড়িপাথরের আকর্ষণে যে কাজটা একদিন শুরু করেছিলাম সেই অবুঝ কৈশোরে, সেদিন বুঝতে পারিনি, ওই নানা আকারের, নানা রঙের নুড়িগুলিই আমাকে একদিন নেশা ধরিয়ে দেবে, নিশির মতো ডেকে নিয়ে যাবে অনেক দূরে, বিশাল এক মাঠের মধ্যে৷ যে মাঠটা পৃথিবীর আকাশকে ছুঁয়ে গিয়েছে৷

 এই অবসরে আরও একটা সংগ্রহশালার কথা বলে রাখি৷ সেটা কোনো ঘর নয়, মাঠ নয়, সেই সংগ্রহশালাটা আমার স্মৃতির কোশে কোশে অবস্থান করে৷ সেটা হল, এই পুরোনো কলকাতার মানুষজন, ঘরবাড়ি, রঙ্গমঞ্চ, সিনেমা হল, রাস্তাঘাট, জিনিসপত্র ইত্যাদি৷ জানি, নতুনকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য পুরোনোকে চলে যেতেই হয়৷ তবু, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ কি সত্যিই ভোলা যায়? ভোলা যে যায় না, সেইজন্যই তো রাত্রির নিদ্রাহীন অন্ধকারে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে৷ এ যেন ঠিক প্রিয়জনকে হারানোর স্মৃতি৷ ‘স্মৃতি’ না বলে একটা গভীর বেদনা বলাটাই বোধহয় ঠিক হবে৷

 যেখান থেকে লেখাটা শুরু করেছিলাম, সেখানেই আবার ফিরে যাওয়া যাক৷

 ঘুম আসে না৷ নিদ্রাহীন দু’টি চোখ দাঁড়িয়ে আছে ‘স্টার থিয়েটার’-এর সামনে৷ কখনও বা ‘রঙমহল’-এর বিপরীত ফুটপাতে, কখনও আবার ‘বিশ্বরূপা’-র লবিতে৷ একদা যেখানে শিশিরকুমার ভাদুড়ির ‘নাট্য নিকেতন’ ছিল৷ কোথাও কোনো সেই চিহ্ন নেই সেইসব পুরাতনের৷ ‘স্টার’ আছে শুধু তার পুরোনো নামটা গায়ে নিয়ে৷ এই ‘স্টার’-এর কথা উঠতেই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল৷ ‘স্টার’ থিয়েটারে তখন মহিলা শিল্পীদের আনার জন্য নিজস্ব ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা ছিল৷ ওই ঘোড়ার গাড়ি টানত দু’টো বিশালদেহী কালো বিদেশি ঘোড়া৷ সেই গাড়িগুলোকে বলা হত ‘ব্রুহাম’৷ গাড়ির পেছনে দু’জন পাগড়ি পরা দারোয়ান থাকত৷ এদের পোশাকের রং ছিল সাদা৷ সামনে বসত চালাক৷ তারও পোশাকের রং সাদা৷ মাথায় পাগড়ি৷ চালকের পায়ের কাছে সাইকেলের বেলের মতো বাজানোর ব্যবস্থা ছিল৷ সেই গাড়ি থিয়েটারের সামনে পৌঁছোলে বেল বাজানো হত৷ বেল বাজালেই থিয়েটারের গেট খুলে যেত৷ আমি একদিন দেখেছিলাম, অভিনেত্রী রানিবালা গাড়ি থেকে নামছেন৷ গ্যাসের আলোয় তাঁর হিরের নাকছাবি জ্বলজ্বল করছে৷ পুরোনো দিনের কথা, পুরোনো মানুষের কথা, পুরোনো কলকাতার কথা চোখের সামনে ঢেউ তুলে তুলে চলে যায়৷ ওরা আমার ঘুম কেড়ে নেয়৷ আমি জেগে থাকি৷ ভোর হয়ে আসে৷ তন্দ্রা এসে দু’চোখ জড়িয়ে ধরে৷ কখন যে ভোর হয়ে আসে, সূর্যের আলো ফোটে— কোনো কোনো দিন তা-ও জানতে পারি না৷ তন্দ্রার ঘোরে সূর্য ওঠার আগেই সূর্যপ্রণাম সেরে নিই …

 ওঁ জবাকুসুম-সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং৷

 ধ্বান্তারিং সবর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরং৷৷

 সে যাই হোক! ব্যক্তিগত ঘুম-নির্ঘুমের কথা তুলে পাঠককে বিরক্ত করতে চাই না! ঘোড়ার গাড়ির কথাটা যখন উঠলই, এই সুযোগে তখনকার দিনের, অর্থাৎ তিনের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা কেমন ছিল সেটা একটু চোখের সামনে ধরা যাক৷ এক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে যখন বেড়াতে যেতাম, আমার কিশোর চোখে পারিপার্শ্বিক চলাচলের দৃশ্যগুলো কেমন গেঁথে যেত৷ মানুষ, রাস্তাঘাট, যানবাহন, দোকানপাট, সিনেমা-থিয়েটার হল, কোনো কিছুই বাদ যেত না৷

 বাগবাজার থেকে যে-খালটা বেরিয়েছে, সেদিনও এই খালটা ছিল৷ আজ যেমন মজা-হাজা, সংকীর্ণ, সেদিন এমনটা ছিল না৷ ছিল আরও চওড়া, আরও গভীর৷ এই খালটা ভাঙড় হয়ে বিদ্যাধরী নদীতে পড়েছে৷ তখনকার দিনে এই খালেই লঞ্চ চলাচল করত৷ এই লঞ্চ ধরেই আনাজপত্র, ভেড়ির মাছ এবং মানুষজন কলকাতায় আসত৷ আমি দেখেছি ডানলপ থেকে বাঁ-দিকে যে রাস্তাটা পশ্চিমদিক বরাবর দক্ষিণেশ্বরে চলে গিয়েছে, সেই রাস্তার দু’পাশে সেদিন ঘন হোগলা বন ছিল৷ রাস্তাটার নাম ছিল পি.ডব্লু.ডি. রোড৷ এখনও হয়তো সেই নামই আছে৷ মায়ের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার সময় আমি দেখেছি, রাস্তায় কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না৷ পরবর্তীকালে মায়ের কাছ থেকে জেনেছি, সময়টা ছিল তখন তিনের দশকের মাঝামাঝি৷ ডানলপ থেকে বাঁ-দিক ধরে দক্ষিণেশ্বর যেতে আজ সেখানে মজে যাওয়া খালটা চোখে পড়ে, একটু দূরে তারই গা-ঘেঁষে যে রেললাইনটা চলে গিয়েছে, সেটারই নাম হয়তো ছিল সি. সি.আর.লিঙ্ক রেল৷ ওই রেললাইনের পাশ দিয়ে একটা খাল বয়ে যেত৷ সেই খালটার নাম ছিল ‘দেতের খাল’৷ শোনা যায়, ওই খাল ধরেই রঘু ডাকাত নাকি ডাকাতি করতে যেত৷

 দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে সে-সময় বৈদ্যুতিক আলোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷ মূল মন্দিরের বাইরে, অর্থাৎ প্রবেশপথে একটা হ্যাজাক জ্বলত৷ মন্দির চত্বরে, ভেতরেও ছিল ওই একই ব্যবস্থা৷ সন্ধের পর সেখানেও একটা হ্যাজাক জ্বলতে দেখা যেত৷ রাত্রি সাড়ে আটটার সময় মন্দির বন্ধ হয়ে যেত৷ মন্দিরের ডানদিকে নহবতখানার পাশে একটা পুকুর ছিল, যেটা এখনও আছে৷ তারপর পঞ্চবটী৷ তারপর ছিল ঝোপঝাড়, জঙ্গল৷ সেই জঙ্গলে শেয়াল ডাকত৷ শুনেছি সেখানে নাকি নানারকম হিংস্র জন্তুর বাস ছিল৷ সেই সময় দক্ষিণেশ্বর মন্দির চত্বরে এখনকার মতো কোনো দোকানপাট ছিল না৷ মন্দিরে যাওয়ার দু’পাশের রাস্তা একেবারে ফাঁকা ছিল৷

 পরবর্তীকালে, আমার বয়স যখন প্রায় তেইশ-চব্বিশ, সেই সময় পি.ডব্লু.ডি. রোডের বাঁ-দিকে সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের মহামিলন মঠ তৈরি হতে আমি দেখেছি৷ মঠ তৈরি হওয়ার আগে, জায়গাটা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা থাকত৷ ঘেরা জায়গার মধ্যেই একটা টালির চালাঘর ছিল৷ সেখানে সারা দিনরাত অখণ্ড হরিনাম সংকীর্তন হত৷

 কথাপ্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল৷ ভাস্কর মিত্র নামে আমার এক বন্ধুস্থানীয় পরিচিতজন ছিলেন৷ এই ভাস্কর মিত্র আমাকে একটা ১০ ইঞ্চি স্পুল দেন৷ এই স্পুলে বহু ভক্তিমূলক গান, ঈশ্বরচিন্তা সম্বন্ধীয় বাণী, এমনকি সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের কণ্ঠস্বরও ধরা ছিল৷ পরবর্তী সময়ে ওই স্পুল থেকে আমি ক্যাসেট তৈরি করি৷ খোঁজ করলে ওই ক্যাসেট এখনও মহামিলন মঠের সংগ্রহশালায় পাওয়া যেতে পারে৷

 আবার সেকালের যানবাহনের কথায় ফিরে যাওয়া যাক৷ তখন বেলগাছিয়া থেকে রাজারহাট পর্যন্ত একটা রেললাইন ছিল৷ ওই লাইনে একটা ন্যারোগেজ ট্রেন যাতায়াত করত৷ কলকাতার রাস্তায় প্রথম দোতলা বাস চলে সলিড চাকায়৷ অর্থাৎ, চাকায় হাওয়া ভরার কোনো বালাই ছিল না৷ চাকায় চেন লাগানো থাকত৷ সেই চেন ইঞ্জিনের সঙ্গে ঘুরত৷ ইঞ্জিনের নাম ছিল ‘থরনিক্রক্ট’৷ তখন উল্টোডাঙায় একটা ময়দা কল ছিল৷ নাম ছিল ‘ইউনাইটেড ফ্লাওয়ার মিল’৷ সেখানে ‘থরনিক্রক্ট’ ইঞ্জিনে টানা দুটো সলিড চাকার লরি ছিল৷

 পুরোনো কলকাতার ট্রামগাড়ি ছিল সবুজ রঙের৷ সামনে ‘রুট বোর্ড’-এর সঙ্গে, মাথার ওপর হলদে আর সবুজ রঙের দুটো আলো থাকত৷ ওই আলো দরকার হত রুট চেঞ্জ করার সময়৷

 কারণ, লাইন্সম্যানরা লেখাপড়া জানত না৷ তারা রঙের চিহ্ন দেখে লাইন বদলে দিত৷

 বেলগাছিয়া থেকে গ্যালিফ স্ট্রিট এবং হাওড়া থেকে শিবপুর পর্যন্ত দু-মুখো ইঞ্জিন লাগানো এক বগির ট্রাম চলত৷

 তখনকার দিনে ট্যাক্সিগুলো ছিল বড়ো বড়ো৷ একটা ট্যাক্সিতে গাদাগাদি করে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ জন মানুষ যেতে পারত৷ ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া ট্যাক্সিগুলো চালাত পাঞ্জাবি ড্রাইভাররা৷ ট্যাক্সিগুলোর নাম ছিল ‘অকল্যান্ড’৷ পরে অবশ্য নানারকম চটকদার ট্যাক্সি কলকাতার রাস্তায় দেখা গিয়েছে৷ এগুলি সবই ছিল আকারে একটু বড়ো বড়ো৷

 ১৯৫৩ সালে কলকাতার রাজপথে দেখা গেল ছোটো ছোটো ট্যাক্সি৷ সেগুলিকে সাধারণত বলা হত— ‘বেবি ট্যাক্সি’৷ এরই কাছাকাছি সময়ে কিংবা এর একটু আগে, আরও এক ধরনের ছোটো ট্যাক্সি কলকাতার পথে চলতে দেখেছি, যেগুলিকে বলা হত ‘সিডনি’ ট্যাক্সি৷

 পুরোনো কলকাতায়, লক্ষ করেছি মোটামুটি চার রকমের রিকশা চালু ছিল৷ যাকে বলে হাতে টানা রিকশা৷ একটা ছিল সাধারণের যাতায়াতের জন্য রিকশা, যাকে বলা হত ‘পাবলিক রিকশা’৷ আর এক ধরনের রিকশা ছিল ডাক্তারবাবুদের জন্য স্পেশাল রিকশা৷ আর এক প্রকার রিকশা, যা কেবল কলকাতা করপোরেশনের ‘লেডি’ ডাক্তারদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল৷ সেই মহিলা ডাক্তারদের সঙ্গে থাকত মাঝারি মাপের একটা বাক্স৷ বাক্সে থাকত নানারকম যন্ত্রপাতি এবং ওষুধপত্র৷ এঁদের ডাক পড়ত সন্তানসম্ভবা মহিলাদের প্রয়োজন হলে৷ আরও এক ধরনের রিকশা ছিল, সেই রিকশাগুলো শুধু ব্যবহার করতেন ‘মিশনারি মহিলা’রা৷ এঁরা সকলেই ছিলেন কোনো না কোনো মিশনারি স্কুলের দিদিমণি৷ এঁদের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপ্রচার৷ বিশেষ করে খ্রিস্টধর্ম৷ এঁরা আসতেন ঠিক দুপুরবেলা, গৃহস্থের বাড়িতে৷ নানা গল্পগাছার মধ্য দিয়ে যিশুখ্রিস্টের জীবনকথা ও বাণী শোনাতেন৷ বাড়ির মহিলাদের মন জয় করবার জন্য কাচের পুতুল ও রকমারি জিনিসপত্র উপহার দিতেন৷ মাঝে মাঝে এঁদের সঙ্গে ইউরোপীয় মেমসাহেবরাও থাকতেন৷ তাঁরা যিশু সম্বন্ধে নানা বইপত্র উপহার দিতেন৷

 আরও একটা কথা এখানে বলে রাখি৷ ডাক্তারবাবুদের জন্য রিকশার চালকরা ছিলেন মাইনে করা৷ আর, ডাক্তারবাবুদের রিকশাগুলো হত একটু চওড়া এবং পাবলিক রিকশার চেয়ে আকারে ছিল একটু বড়ো আর মাথার ঢাকনার রং ছিল কালো এবং কোনোটা বা খাকি রঙের৷

 ট্রামগাড়ির প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করতে ভুল হয়ে গিয়েছিল৷ হাওড়া থেকে শিবপুরে ট্রাম চলাচলের বিষয় বলেছি৷ বলেছি এক বগি ট্রামের কথা৷ এছাড়া অনেকেই হয়তো আজ ভুলে গিয়েছেন, হাওড়া থেকে আরও একটা লাইনে ট্রাম চলাচল করত৷ সেটা হচ্ছে, হাওড়া স্টেশন থেকে সালকিয়া বাঁধাঘাট পর্যন্ত৷ প্রথমে এক বগি, পরবর্তীকালে ডবল বগির ট্রামও চলতে দেখেছি৷ হাওড়া রোড এবং জিটি রোড— দু’দিক দিয়ে দুটো ট্রাম চলাচল করত৷ দুটো ট্রামের নম্বর ছিল ৪১ এবং ৪২৷ এই দু-বগির ট্রাম পরে ডালহৌসি পর্যন্ত প্রসারিত হয়৷ পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যানজটের কারণে শিবপুর এবং সালকিয়া বাঁধাঘাট লাইনের রুট দুটি তুলে দেওয়া হয়৷

 আমরা ছোটোবেলায় দেখেছি, অর্থাৎ তিন, চার ও পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার প্রধান রাস্তাগুলোতে ঘোড়ার গাড়ি চলাচলের রেওয়াজ ছিল বেশি৷ তখন, কলকাতার সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষজন ঘোড়ার গাড়ির সওয়ারি হতেই বেশি পছন্দ করতেন৷

 পরিবহণ, যানবাহন সব সময়ই রাস্তাঘাটের ওপর নির্ভরশীল৷ সেই সময়, আমার ছোটোবেলায় অর্থাৎ ১৯৩৭-৩৮ সালে, কলকাতা শহরের সঙ্গে হাওড়ার যোগাযোগের দুটি সেতু তৈরির কাজ আমি দেখেছি৷ একটি হাওড়া সেতু, অন্যটি বালি ব্রিজ (Opened 1933)৷

 বালি ব্রিজ তৈরির সময় রেলের ইঞ্জিনের মতো স্টিম ক্রেন দিয়ে কাজ হয়েছিল৷ হাওড়া ব্রিজের ডিজাইনার ছিলেন জার্মান টেকনোলজিস্ট৷ এই ব্রিজের কাজ শুরু হয় ১৯৩৭ সাল নাগাদ৷ হাওড়া ব্রিজের মূল পিলার বা পোস্ট ছিল চারটি৷ এপারে দুটি এবং ওপারে দুটি৷ এই পোস্ট বা পিলারগুলি যে পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছিল, বা বলা যায় পাইলিং হয়েছিল, সেগুলো কিন্তু কালো পাথর ছিল না৷ সেগুলো ছিল এক ধরনের বেলে পাথর৷ ইংরেজিতে তখন যাকে বলা হত— Sand Stone Gravel এই পাথর কালো পাথরের চেয়ে অনেক বেশি ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারে৷ এই পাথর আমদানি করা হত ধলভূমগড় থেকে, এই ধলভূমগড়েই আমার বাল্যকাল কেটেছে৷ বাল্যকালের প্রসঙ্গে যখন আসব, ধলভূমগড়ের কথা পাঠককে জানাবার অবকাশ রইল৷

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে৷ ১৯৪১ (২৫.১২.৪১) সালে কলকাতায় জাপানি বোমা পড়ার সময়, হাওড়া ব্রিজকে জাপানি বোমার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে ব্রিজের দু-মাথায় দুটো বড়ো বড়ো বেলুন ওড়ানো থাকত৷ এই বেলুনকে বলা হত Barrage বেলুন৷

 এখন যে হাওড়া ব্রিজ আমরা দেখছি, তার আগে হাওড়া স্টেশনের সঙ্গে কলকাতার সংযোগের জন্য গঙ্গার ওপরে একটা চলমান কাঠের ব্রিজ ছিল৷ একে বলা হত ‘পল্টুন’ ব্রিজ৷ উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে বড়ো বড়ো নৌকা কিংবা জাহাজ যাতায়াতের সময় ব্রিজের মাঝখান বরাবর অংশটা দু-পাশে সরিয়ে নেওয়া হত৷ জাহাজ বা নৌকা চলে যাওয়ার পরে কাঠের ব্রিজ আবার জোড়া লেগে যেত জনসাধারণের যাতায়াত করার জন্য৷ কাঠের ব্রিজ বন্ধ রাখার সময় হাওড়া স্টেশনের যাত্রীসাধারণের জন্য রেল কোম্পানির স্টিমারের ব্যবস্থা ছিল৷ ট্রেনের যাত্রীদের এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য কোনো টিকিট লাগত না৷

 এতক্ষণ যে-কথা নিয়ে বকবক করে গেলাম, সেটা এই লেখার ভূমিকা মাত্র৷ আমার প্রথম জীবন— বাল্যকাল, কৈশোর বা যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে ধলভূমগড়ে৷ ঘাটশিলার আগের স্টেশন ধলভূমগড়৷ এখন এই জায়গাগুলো ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত৷ এই ধলভূমগড়ে আমাদের একটা বাড়ি ছিল৷ আমরা মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে থাকতাম এবং সপরিবারে৷

 মনে পড়ছে, আমার বয়স তখন ন’ কিংবা দশ৷ সালটা মনে আছে, ১৯৩৫৷ দুর্গাপুজোর সময়৷ জায়গাটা ছিল আদিবাসী অধ্যুষিত৷ এখানে কোনো দুর্গাপুজো হত না৷ এখান থেকে আট-দশ মাইল দূরে রাজবাড়ি, অর্থাৎ রাজার কাছারিবাড়িতে দুর্গাপুজো হত৷ এখানকার রাজা ছিলেন জগদীশচন্দ্র দেওধবল দেব৷ এখানকার বাসিন্দারা স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন৷ এঁদের কথায় ওড়িয়া ভাষার একটু টান ছিল৷ বড়োরা বলতেন শুধু টান নয়, ওড়িয়া ভাষার কিছুটা মিশ্রণও লক্ষ করা যেত৷

 আমরা যেখানে থাকতাম, তার আশপাশের কয়েকজন বাঙালি প্রতিবেশী ছিলেন বাবার বন্ধুস্থানীয়৷ ঠিক হল, ৮/১০ মাইল পথ পেরিয়ে, রাজবাড়ির প্রতিমা দর্শনে যাওয়া হবে৷ যেমন চিন্তা, সেইরকম কাজ৷ সঙ্গে সঙ্গে কয়েকখানা গোরুর গাড়ি ঠিক করে ফেলা হল৷

 কাছারিবাড়ি যেতে গেলে, যেতে হবে শালবনের মধ্য দিয়ে৷ সন্ধ্যার মুখে আমাদের যাত্রা শুরু হল৷ মনে আছে, অন্ধকারে পথ দেখবার জন্য সঙ্গে নেওয়া হল কয়েকটা মশাল এবং কেরোসিন তেল৷ সন্ধ্যায় যাত্রা শুরু করে আমরা যখন রাজবাড়িতে পৌঁছোলাম, তখন ঘড়িতে বাজে রাত্রি বারোটা, সাড়ে বারোটার মতো৷ বনের মধ্যে যেতে যেতে আমরা অনেক হিংস্র জন্তুর সম্মুখে পড়েছিলাম৷ সামনে বাঘ দেখে গোরুগুলো থেমে গিয়েছিল৷ সে কী ভয়! মা আমাদের জড়িয়ে ধরে বসে ছিলেন৷ যাই হোক, আমাদের সঙ্গে ছিল মশাল৷ মশালের আলো দেখে বাঘ ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল৷

 দুর্গামণ্ডপের পাশেই যাত্রাপালা হচ্ছিল৷ প্রতিমা দর্শনের পর, আমরা যাত্রাপালা দেখেছিলাম৷ ছোটোবেলার সেই দুর্গাপ্রতিমা দর্শনের কথা আজও আমার চোখের সামনে ভাসছে৷

 এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলে রাখি৷ ছোটোবেলায় আমরা খুব ডানপিটে ছিলাম৷ আমি এবং আমারই সমবয়সি কয়েকজন মিলে কয়েকটা পাখির ডিম সংগ্রহ করেছিলাম৷ যাত্রাপালা তখন চলছে৷ পালার নাম ‘রামলীলা’৷ বিভীষণ রামকে সম্বোধন করে বলছেন ‘কাকাবাবু কাকাবাবু, এ-দেহ রাখিব না৷ খাল-বিল ভ্যাঙ্গে এলাম…৷’ ঠিক এই সময় আমাদের মধ্যে কে একজন বিভীষণের মুখে ডিম ছুড়ে মারল৷ ডিম ফেটে বিভীষণের মুখময় হয়ে গেল৷ বিভীষণ পার্ট ভুলে গিয়ে বলতে শুরু করল,— ‘এ-শালা কৌন মারুতি রে!’

 ধলভূমগড় এবং ছোটোবেলার কথায় সময়ান্তরে আবার ফিরে আসা যাবে৷ এখন সুদূর অতীতের দিকে একটু চেয়ে দেখা যাক!…

 কোথায় ছিলাম, কোথায় এলাম! পূর্বপুরুষ বা পরিবারের আদ্যিকালের মানুষদের কথা ভাবতে গেলে, সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যায়৷ নানা জনের নানা মত৷ তবে, আমাদের কুলপঞ্জি অনুযায়ী যতটুকু জানা যায়, তা থেকে বলা যায়, একাদশ-দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়, তখন নাকি এই গৌড়বঙ্গে ব্রাহ্মণদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না৷ এ-বঙ্গের রাজারা কান্ব্যকুব্জ বা কনৌজ থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের, অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করে আনেন৷ বিনিময়ে প্রচুর ধনদৌলত, জমিদারি এবং তদুপরি এলাকার মাহাত্ম্য অনুযায়ী প্রত্যেককে এক-একটি উপাধি প্রদান করা হয়৷ আমাদের উপাধি যেমন চট্টোপাধ্যায়৷ অবশ্য, এ-সম্বন্ধে আরও অন্য মতবাদ আছে৷ থাকতেই পারে৷ সে-বিতর্কের মধ্যে আমি যেতে চাই না৷

 পিতা-প্রপিতামহদের কাছে শুনেছি আমাদের আদি পুরুষরা কনৌজ থেকে এসে, এ-বঙ্গে হুগলি জেলার হরিপাল এলাকায় বসবাস শুরু করেন৷ বাবারা ছিলেন তিন ভাই৷ বাবা ছিলেন সকলের ছোটো৷ শুনেছি, ঠাকুরদা কৃষ্ণগোবিন্দ চট্টোপাধ্যায় হরিপাল থেকে কলকাতায় গ্রে স্ট্রিট এলাকায় সৃষ্টিধর দত্ত লেনে একটা খোলার বাড়ি কেনেন৷ বাবাদের ছিল টোল, চতুষ্পাঠী৷ এখানে বেদ, পুরাণ এবং নানারকম শাস্ত্র পড়ানো হত৷ ঠাকুরদার বাবার নাম শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়৷ শুনেছি, এই শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় সেকালে হরিপাল থেকে পায়ে হেঁটে কলকাতায় আসতেন৷ হরিপাল থেকে কলকাতা, অর্থাৎ গ্রে স্ট্রিটের দূরত্ব পায়ে হেঁটে প্রায় বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ কিলোমিটার৷ আট-দশ ঘণ্টা পথ শ্যামাচরণ পায়ে হেঁটে কলকাতায় পৌঁছোতেন৷ রাত্রিটা শিষ্যবাড়িতে কাটিয়ে, পরদিন সকালে আবার পায়ে হেঁটেই হরিপালে ফিরতেন৷ সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা!

 বংশের ঠিকুজি-কুলজির কথার মাঝখানে একটা অন্য কথা বলে রাখি৷ আমার নাম সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায়৷ আমার একটা ডাকনামও আছে৷ সবাই আমাকে নকুবাবু বলে ডাকে৷ এই ‘নকুবাবু’ নামেই এলাকায় আমি বেশি পরিচিত৷ এ-প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলে রাখা খুবই প্রয়োজন বলে মনে করছি৷ সবাই আমাকে জানেন, আমি একজন পুরোনো জিনিসপত্রের সংগ্রাহক৷ যাকে বলে Collector of Materials of Vintage Years৷ সংবাদপত্রে এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই পরিচয়ে অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে৷ কিন্তু এটাই আমার জীবনের সবকিছু নয়৷ মূল গবেষণা কিংবা চিন্তার বস্তু তো নয়ই৷ কারণ, শব্দ নিয়ে, প্রকৃতি নিয়ে আমার কিছু নিজস্ব ভাবনাচিন্তা আছে৷ আর আছে, আমার চোখে পুরোনো কলকাতা৷ আজকের যে কলকাতার বিচিত্র রূপবৈচিত্র, সেটার আগে কলকাতার চেহারাটা কী ছিল— সেই বিবর্তনের রূপটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত এক সংগ্রহশালায় সযত্নে রক্ষিত আছে৷ সেই সংগ্রহশালাটির নাম, আমার ‘মস্তিষ্ক’ বা ‘মগজ’৷

 আমার বর্তমান বয়স চুরানব্বই বছর সবে অতিক্রম করে এলাম৷ অর্থাৎ, প্রায় ছ’বছর কম শতবর্ষ৷ জানি না আর কতদিন বাঁচব!

 আবার বংশ এবং পূর্বপুরুষদের কথায় ফিরে আসা যাক৷ আমার ঠাকুরদার দুই বিয়ে৷ প্রথম বিবাহিত স্ত্রীর কোনো সন্তান ছিল না৷ সেই কারণেই আমার ঠাকুরদা দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন৷ আমার বাবা ছিলেন আমার দ্বিতীয় ঠাকুমার সন্তান৷ বড়োঠাকুমা, অর্থাৎ ঠাকুরদার প্রথম স্ত্রী থাকতেন গ্রে স্ট্রিটে৷ ছোটোঠাকুমা চলে যান হরিপালে৷ পরবর্তীকালে, গ্রে স্ট্রিটের সম্পত্তি চলে যায় বড়োজ্যাঠামশায়ের অধিকারে৷ বাবা তখন বাধ্য হয়ে এক নীলকর সাহেব কোম্পানি, সমস্তিপুরে চাকরি নেন৷ আর মেজোজ্যাঠামশাই মগরাহাটে শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি পেয়ে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন৷ বাবার মুখে শুনেছি, সংসার প্রতিপালন করার জন্য বাবা যখন ইংরেজ কোম্পানিতে চাকরি নিতে বাধ্য হলেন, তখন সময়টা ছিল ১৯০২ সাল৷

 বাবার চাকরি প্রসঙ্গ উঠলেই একটা কথা বারবার উল্লেখ করতে হচ্ছে— ‘বাধ্য হয়ে’ শব্দ দু’টি৷ কারণ চিরদিনই বাবার ইচ্ছাটা ছিল—  ব্যাবসামুখী৷ সাময়িক কালের জন্য সংসারের প্রয়োজনে বাবা চাকরি করতে বাধ্য হয়েছিলেন বটে৷ কিন্তু বাবার আসল কাজটা ছিল, কলকাতা শহরে জায়গাজমি কিনে, বাড়ি তৈরি করে অন্যকে বিক্রি করার ব্যাবসা৷ অর্থাৎ, রিয়াল এস্টেটের কারবার৷ আর এই ব্যাবসাতেই বাবার আর্থিক প্রতিপত্তি কিংবা উন্নতি, যাই বলা হোক না কেন! আজকের খান্না সিনেমার পেছনে, ৭-এর বি, শ্যাম মিত্র লেনের যে বাড়িতে এখন আমি বাস করছি, এখানেই আমার জন্ম৷ ১৯২৬ সালের ১৮ নভেম্বর আমার জন্ম৷ আমার জন্মের ঠিক দু’বছর আগে, অর্থাৎ ১৯২৪ সালে এই বাড়িটা তৈরি হয়৷ আমাদের পরিবার গ্রে স্ট্রিট থেকে চলে আসার পর, প্রথমে হোগল কুরিয়া লেন এবং পরে বৃন্দাবন বসাক লেনে কিছুদিন ভাড়াবাড়িতে বসবাস করে৷ মায়ের মুখে শুনেছি, এই বাড়িটা তৈরির সময় কাছেই নলিনী সরকার স্ট্রিটে আরও দু’খানা বাড়ি বাবা তৈরি করেছিলেন৷ সবই বিক্রির উদ্দেশ্যে৷ কিন্তু মায়ের জেদাজেদিতে বাবা এই বাড়িটা আর বিক্রি করতে পারেননি৷ স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য শেষপর্যন্ত আমরা এই বাড়িতেই থেকে গেলাম৷ এবং কী আশ্চর্য, এখনও এই বয়সেও কেমন এই বাড়িতেই বেঁচে আছি! এবং সপরিবারে৷ এ-বাড়িতেই আমার তিন ছেলে এবং এক মেয়ের জন্ম৷ জামাই ডাক্তার৷ মেয়ের ঘরে দুই নাতনি৷ একজন ডাক্তার, অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার৷ কলকাতায় ডাক্তারি করে একজন৷ অন্যজন দিল্লিতে চাকুরিরত৷

 আগেই বলেছি, আমার তিন ছেলে৷ বড়োটির নাম গৌতম৷ মেজো ও ছোটোর নাম যথাক্রমে পার্থ ও বিশ্বজিৎ৷ এরা সকলেই কোনো না কোনো ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত৷

 আমার যখন ১৪ বছর বয়স, অর্থাৎ ১৯৪০ সালে বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়দায়িত্ব এসে বর্তায় মায়ের ওপর৷ আমার বড়দা অন্যত্র চলে যান৷ মেজদা তাঁর শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি পেয়ে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন৷ অর্থাৎ মায়ের সংসার থেকে পৃথক হয়ে যান৷ মা আমাকে এবং দুই দিদিকে নিয়ে এই বাড়িতেই থেকে যান৷ সেই সময়, বাবা মারা যাবার ঠিক আগে ব্যাবসার উদ্দেশ্যে, মানে বিক্রি করার জন্য কলকাতায় বিবেকানন্দ রোডে তিনখানা বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন৷ তিনখানা বাড়িই খালি ছিল৷ মা ওই বাড়িগুলো ভাড়া দিয়ে, সংসার চালানোর জন্য আর্থিক সংস্থানের মোটামুটি একটা সুরাহা করেন৷

 ১৯৪০ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে বাবা মারা গেলেও মা অনেকদিন বেঁচে ছিলেন৷ ১৯৭১ সালে, ১৭ ডিসেম্বর ৮১ বছর বয়সে মা মারা যান৷

 আমরা তিন ভাই ও পাঁচ বোন৷ আমি হচ্ছি আট নম্বর, অর্থাৎ অষ্টমগর্ভের সন্তান৷ সকলের ছোটো৷ আমি স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে সায়েন্স নিয়ে বিদ্যাসাগর কলেজে ভরতি হই৷ এই কলেজ থেকেই আমি সায়েন্সে স্নাতক হই৷ পড়াশুনোর পাট চুকিয়ে দিয়ে আমিও সংসারে মাকে সাহায্য করার জন্য কিছু উপার্জনের চেষ্টা করি৷ বিশেষত, অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যাবসা করে কিছু অর্থ হাতে আসতে থাকে৷ এছাড়া, সিনেমা হলের যন্ত্রপাতি, বিশেষত শব্দযন্ত্র সারাই করে বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করতাম৷

 এই ফাঁকে একান্তভাবে নিজের কিছু ব্যক্তিগত কথা বলে নিই৷ ১৯৫৬ সালে আমার বিয়ে হয়৷ আমার স্ত্রীর নাম নীলিমা চট্টোপাধ্যায়৷ ওঁরা ছিলেন কলকাতার আদি বাসিন্দা৷ বাগবাজারের মেয়ে৷ খানদানি পরিবার৷ আমার স্ত্রী ছিলেন খুব অতিথি-দরদি, পরোপকারী৷ ঠিক আমার মায়ের মতো৷ স্নেহময়ী৷ আমার বাবা পশুপতি চট্টোপাধ্যায়, মা ঊষাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে এই বাড়িতে চলে আসেন গ্রে স্ট্রিটের সৃষ্টিধর দত্ত লেন থেকে৷

 আমার স্ত্রী ছিলেন হৃদরোগের রোগী৷ তাঁর জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেছি৷ বড়ো বড়ো ডাক্তার, কবরেজ দেখিয়েছি৷ মৃত্যুর আগে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যায়৷ প্রায় ৭ বছর শয্যাশায়ী ছিলেন৷ এই যে বাড়িটা, মায়ের স্মৃতি বহন করে চলেছে৷ মায়ের নাম ঊষাঙ্গিনী চট্টোপাধ্যায়৷ ঊষাঙ্গিনী থেকে ‘ঊষালয়’৷ এই নাম রেখেছিলেন আমার বাবা পশুপতি চট্টোপাধ্যায়৷

 এই বাড়িতেই বাবার জীবিতকালেই, আমার ছোটোবেলাতেই আমি দেখেছি অনেক মানুষের যাতায়াত৷ তখন জানতাম না ওঁরা কে! তবে একটা ব্যাপার এখনও আমার মনে আছে৷ ওঁদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সারা বাড়িটাই কেমন পালটে যেত৷ ওঁদের দেখার জন্য পাড়ার মানুষও ছুটে আসতেন৷ পরবর্তীকালে যখন একটু বুঝতে শিখেছি, জ্ঞান হয়েছে, মায়ের মুখে শুনেছি ওঁরা নাকি সব বিখ্যাত মানুষ৷ বাবার কাছে আসতেন বাড়ির খোঁজে৷ বিশেষত সংস্কৃতি জগতের মানুষজনদের আনাগোনাই ছিল বেশি৷ যেমন সংগীত জগতের প্রবাদপুরুষ রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজকুমার মল্লিক প্রমুখ৷ তা ছাড়া উত্তর কলকাতার নাট্য জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের পদধূলিধন্য আমাদের এই ছোট্ট বাড়িটি৷ এ-বিষয়ে পর্বান্তরে সেই আলোচনায় আসা যাবে৷

 আমার বাল্যকালের বেশ কিছুটা সময় কাটে আদিবাসী অঞ্চল অধ্যুষিত ধলভূমগড়ে৷ ঘাটশিলার আগের স্টেশন যে ধলভূমগড় সে-কথা আগেই বলেছি৷ ধলভূমগড়ে আমাদের একটা বাড়ি ছিল৷ সেই সূত্রে সুযোগ পেলেই বাবা-মায়ের সঙ্গে আমরা সেখানে বেড়াতে যেতাম৷ বাল্যকাল, কৈশোর এবং যৌবনের অনেকটা সময় সেখানে কাটাবার সৌভাগ্য হয়৷ ‘সৌভাগ্য’ বলছি এই কারণে যে, এই সুযোগ যদি না পেতাম, তাহলে প্রকৃতিকে চেনবার সুযোগ হত না৷ প্রকৃতি মানে তো শুধু গাছপালা নয়৷ বিস্তীর্ণ বনভূমি, নদীনালা, আকাশ, ধানখেত, চাষের মাঠ এবং সেখানকার মানুষজন এবং মানুষের জীবনযাত্রা৷ সবকিছু মিলিয়েই তো জীবন! প্রকৃতি তো জীবনের বাইরে হতে পারে না৷ গাছেদের যে প্রাণ আছে, এ-কথা প্রমাণ করে দিয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু৷ এটা যে কত বড়ো সত্য, সেটা শহরের মানুষ হাতেকলমে কতটা উপলব্ধি করতে পারেন জানি না, কিন্তু আদিবাসীরা, চাষি সম্প্রদায় যাঁরা নিত্য মাঠে কাজ করেন, তাঁরা বুঝতে পারেন৷ গাছ থেকে ফল তুললে, লতাগুল্ম থেকে ফুলপাতা ছিঁড়লে তাদের যে অভিঘাত, তাদের যে প্রতিক্রিয়া সংশ্লিষ্ট মানুষজন যেভাবে বুঝতে পারেন, অন্যদের পক্ষে বোধহয় সম্ভব হয় না৷

 শুধু বাল্যকাল বলি কেন? পরিণত বয়সে পঁচাত্তর বছর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকৃতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল৷ ধলভূমগড়ে থাকাকালীন বাবার সঙ্গে আমি সুবর্ণরেখা নদীতে স্নান করতে যেতাম৷ সেই নদী থেকে নানারকম পাথর বা নুড়ি সংগ্রহ করতাম৷ নানা আকারের, নানা রঙের সেইসব নুড়ি বা পাথরখণ্ড আমার সংগ্রহশালায় সাজানো আছে৷ যাঁরা আমার সংগ্রহশালা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন৷

 আবার, নদীর স্বচ্ছ জলের মধ্যে নানা আকারের মাছেদের আনন্দে বিচরণ করতে দেখতাম৷ ছোটো ছোটো মাছগুলো কেমন নাচতে নাচতে এসে, অন্য মাছেদের মুখে মুখ রেখে কী কথা বলে যেত বুঝতে পারতাম না৷ কল্পনায় ধরে নিতাম— ওদের মধ্যে কেউ হয়তো প্রেম নিবেদন করছে৷ কেউ হয়তো বলছে, ‘এতদিন কোথায় ছিলে? দেখা পাইনি কেন?’

 কেউ আবার সঙ্গীর কানে মুখ ঠেকিয়ে চলে যাচ্ছে৷ বলে যাচ্ছে অভিমান ছলে, ‘আমি তো এলাম! দরকার হলে তুমি আমার কাছে যেয়ো! নইলে আড়ি৷’

 বড়ো বড়ো মাছগুলো দূরে দূরে ঘাই তুলে জানিয়ে দেয়, ‘আমাদের পৃথিবীতে তোমরা কেন হে বাপু? বুঝতে পেরেছি তোমাদের মতলবটা কী?’ কল্পনা হলেও, ওই বড়ো মাছটির উক্তির সঙ্গে কী সুন্দর, কী সত্য একটা জীবনদর্শনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷ অর্থাৎ, মানবজীবন দর্শন৷ ছোটো ছোটো মাছগুলো কেমন সরল, সুন্দর৷ তাই ওদের মনে কোনো দ্বিধা নেই! নেই কোনো ভয়৷ আর বড়ো মাছগুলোর কথা ভাবুন৷ কাছে আসে না৷ ঘাই মেরে জানান দিয়ে দূরে চলে যায়৷ আমরা যে নিরীহ স্নানার্থী সে-কথা ওরা ভাবতে পারে না৷ কারণ ছোটো মাছগুলোর তুলনায় অনেকটা সময় তারা কাটিয়ে এসেছে৷ সময়ের জ্ঞানবৃক্ষের ফল তারা খেয়েছে৷ তাই তাদের মনে এত প্রশ্ন, এত সন্দেহ৷ তাই হয়তো ওরা আমাদের ভেবেছে— মৎস্যশিকারী৷ শত্রু৷ মানুষও তাই৷ সত্যকে না জেনে মিথ্যের জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে সব কিছু গোলমাল করে ফেলে৷ আসল-নকল গুলিয়ে ফেলে৷

 আরও অনেক উদাহরণ আছে৷ প্রকৃতির মধ্যে ছোটো ছোটো কীটপতঙ্গের মধ্যে এক ধরনের বোধশক্তি কাজ করে৷ মানুষ যদি সেটা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে তাহলেই সে সহজে বুঝতে পারবে৷

 আরও একটা উদাহরণ তুলে ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি৷

 বৃষ্টি পড়লে বাল্যকালে ধলভূমগড়ে দেখতাম, বিশেষত বর্ষাকালে, পিঁপড়ের দল সারিবদ্ধভাবে মুখে খাদ্য নিয়ে বিপদকালে সঞ্চয়ের জন্য নিজেদের বাসার উদ্দেশে চলেছে৷ লক্ষ করলে সকলেই দেখে থাকবেন, সামনে কোনো বিপদের সংকেত পেলে অগ্রগামী সারির মধ্যে থেকে একটি পিঁপড়ে চলা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে, পেছনের সারির কোনো একটি পিঁপড়েকে কোনো জরুরি বার্তা দেওয়ার জন্য৷ হয়তো সম্মুখে কোনো বিপদ৷ কোনো বাধা৷ পথপরিবর্তন করার সংকেত৷ সামান্য এক কীটের মধ্যে যে সহমর্মিতা, যে শৃঙ্খলাবোধ, যা আমাদের মধ্যে, অর্থাৎ মনুষ্যসমাজে খুব কমই দেখা যায়৷ ভালো করে লক্ষ করলে সকলেই বুঝতে পারবেন বাগানের একটি ফুলের গাছ থেকে ফুল তোলার সঙ্গে সঙ্গে গাছটির চেহারাটি কেমন মুহূর্তের মধ্যে পালটে যায়৷ এটা কিন্তু সাধারণের পক্ষে চট করে বোঝা সম্ভব নয়৷ এই ব্যাপারটাই আবার সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন অভিজ্ঞ চাষিরা৷

 আমি দেখেছি জমিতে চাষিরা নানারকম আনাজ ফলাবার জন্য শীতকালে, কী আশ্চর্য মমতায় তাঁরা মাটি তৈরি করেন৷ রাসায়নিক নয়, জৈবিক সার ব্যবহার করে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলো ইত্যাদির বীজ বপন করেন৷ বীজ চারা যখন অঙ্কুরিত হত, এবং নিয়মিত জল সিঞ্চনের কল্যাণে তাদের প্রাত্যহিক বৃদ্ধিটা চাষিরা যেভাবে বুঝতে পারেন, অন্য কারও পক্ষে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না৷ কারণটা কী? আমার মনে হয়, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে৷ সেটা সাধারণ চোখে নয়, সেটা ধরা পড়ে কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট চাষিভাইটির মনের আয়নায়৷ তাঁদের চাহিদা, তাঁদের অভাব-অভিযোগ কেবল তাঁরাই (চাষিভাইরা) বুঝতে পারেন৷

 আমি জানি না, এই ধরনের ঘটনার মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য বা বিশ্লেষণ আছে কিনা!

 মাঝে মাঝে কিছু কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে! কেউ কেউ হঠাৎ হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন, আসলে আপনি কী? একজন সংগ্রাহক, না অতীতচারী? এহেন প্রশ্নের উত্তরে আমি তাঁদের স্পষ্ট জবাবে জানিয়ে দিতে চাই, বলতে চাই, ভেবে দেখুন আমি কীসের সংগ্রাহক? উত্তরটা কী হতে পারে নিশ্চয়ই সেটা আপনারা জানেন৷ আমি পুরোনো দিনের এমন কিছু বস্তুর সংগ্রাহক, যার সঙ্গে সময়, বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের অঙ্গাঙ্গী যোগাযোগ৷ এই সংগৃহীত বস্তুগুলোর গায়ে শুধু সময়ের চিহ্ন লেখা নেই, এরা এক-একটা যুগ এবং বিজ্ঞান ও বিবর্তনের প্রতিভূ৷ আর অতীতচারীর প্রশ্নে বলি, অতীতকে না জানলে বর্তমানকে বুঝবেন কী করে? মানব সভ্যতার অগ্রগতিটা?

 ছোট্ট একটা উদাহরণে ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে চাই৷ ১৯৪৭-’৪৮ সালের কথা৷ আমি নিজে বাজার থেকে, এই কলকাতার বাজার থেকেই ১ টাকায় ৮টা মাদ্রাজি হাঁসের ডিম কিনেছি৷ সাইজেও প্রায় এখনকার পোলট্রির ডিমের চেয়ে ডবল৷ তাহলে ভেবে দেখুন, সেই সময় থেকে আজ প্রায় ৬০-৭০ বছর পেরিয়ে এসে বাজারদরের ঊর্ধ্বগতির লেখচিত্রটা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ যাই হোক, পরবর্তী পর্বে আমার ছোটোবেলায় দেখা বাজারদর সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনায় আসার ইচ্ছা রইল৷ …

 অনেকেরই কৌতূহল, খুবই স্বাভাবিক, কোথা থেকে কীভাবে আমি এইসব মূল্যবান জিনিসগুলো সংগ্রহ করেছি৷

 নানা আকারের, নানা রঙের পাথর-নুড়িগুলো যত্ন করে ঘরে সাজিয়ে রাখার নেশা যারা ধরিয়ে দিয়েছিল, তারাই আমার আজকের এই সংগ্রহশালার পথিকৃৎ৷

 আজকের সংগ্রহশালাটিতে যে-সব বহুমূল্য, দেশি-বিদেশি জিনিসপত্র সাজানো দেখছেন— এরা আমার কাছে সন্তানসম৷ এদের মধ্যে প্রত্যেকটি জিনিসই মূল্যবান— কিন্তু মূল্যহীন হয়ে অধিকাংশই ভাঙাচোরা লোহার গাদায় অবহেলিত ভাবে কালোয়ারের দোকানে মরচে ধরছিল৷ স্বল্পমূল্যে কোনোটা, বা না-মূল্যেই সেখান থেকে সংগ্রহ করা৷ এ যেন ঠিক কুড়িয়ে পাওয়া রাস্তার সন্তানকে ‘হোম’-এ এনে মানুষ করা!

 আমার এই সন্তানদের কুলজি নিয়ে একটু বিস্তারিত হাওয়া যাক৷ আমার সংগ্রহশালা বা ‘হোম’-এর পুরোনো সন্তানটির বয়স প্রায় ১৩৫ বছর৷ এটির নাম – কম্পাস-কাম-সানডায়াল ক্লক (Compass-cum-Sundial Clock)৷ এটি আমাকে দিয়েছিল আমার পুত্রপ্রতিম এক বন্ধু ইংরেজসন্তান জাসন (Jasan)৷ আমি ওকে ডাকি ‘জয়’ বলে৷ ‘জয় আমাকে সম্বোধন করে ‘ফাদার’ নামেই৷ জয় ভারতবর্ষে এলেই আমার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় আসে৷ জয়-এর সঙ্গে এখনও আমার যোগাযোগ আছে৷

 ১৯২৬ সালের তৈরি৷ থমসন হাউস্টন  (Thomston Houston), এক ব্রিটিশ কোম্পানির নির্মিত হেডফোন— এখনও কিছুটা সচল আছে— সব, সব, এই ছোট্ট ঘরখানির মধ্যেই সাজানো৷ আছে কয়েকশো লন্ঠন৷ আলমারির ওপরে সারিবদ্ধ সাজানো৷ প্রত্যেকটি লন্ঠন একটা কাল, একটা সময়কে সূচিত করে৷

 অনেকেই কৌতূহল প্রকাশ করেন৷ জানতে চান, কোথা থেকে সংগ্রহ করেছি? এদের নির্দিষ্ট লিখিত তালিকা নেই৷ সব আমার স্মৃতিলিপিতে মুদ্রিত৷

 বয়স যখন কম ছিল, কয়েকজন বন্ধু মিলে সমগ্র ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করি— যেখানে যখন চমকপ্রদ পুরোনো জিনিস চোখে পড়েছে, সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি৷ সেইরকম নানা আকারের কলিং বেল— শুধু দুর্মূল্য নয়, সবই প্রায় এখন দুষ্প্রাপ্য৷ ১৯১২ সালের তৈরি পকেট মাইক্রোস্কোপ৷ ঝাড়পোঁছ করে রাখলে এখনও ঠিক যেন সেই নতুন চেহারা৷ ভাবতে কেমন অবাক লাগে৷ প্রথম যখন শুরু করেছিলাম তখন বুঝতে পারিনি, আমার এই সংগ্রহশালার জিনিসগুলোর এত কদর হবে৷ টাকাপয়সার হিসাবে নয়, আসলে এর দুষ্প্রাপ্যতা৷ দুর্মূল্যও বলা যাবে না৷ কারণ টাকা দিয়ে এসব বস্তু কেনা যায় না৷ পাওয়াই যাবে না, তো কেনা দূরের কথা!

 অনেক সময় ভাবি, একটা তালিকা তৈরি করে রেখে যাব৷ কিন্তু সেটা আর করা হয় না৷ করা হয় না, তার একমাত্র কারণ আমার ‘করছি’, ‘করব’ গড়িমসি নয়৷ আসলে আমার ভাবনার সঙ্গে ‘ব্যক্তিমানুষ’টির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব৷ দ্বন্দ্বটা হচ্ছে এই— আমিই তো আছি৷ আমিই তো বলে দিতে পারব৷ কিন্তু আমি যে চিরস্থায়ী নই, এ-কথাটা ভাবতেই কেমন ‘আত্ম-ইগো’-তে লাগে৷ এটা যে কত বড়ো ভুল, সেটা আমি বুঝতে পেরেও কেমন অবুঝের মতো আচরণ করে ফেলি৷ এত যে বয়স হয়েছে, বয়সের কথাটা একদম ভুলে যাই৷ চারিদিকে যখন চেয়ে দেখি, নিজেকে বড়ো একা বলে মনে হয়৷ আমার বয়সি তো কাউকে চোখে পড়ে না! এই বছর ১৮ নভেম্বর আমার বয়স হল ৯৬ বছর৷ এখনও আমি চলাফেরা করছি৷ নিজের কিছু কাজ নিজেই করে নিতে পারি৷ প্রয়োজন না থাকলেও, ইচ্ছে হলেই খান্না থেকে হাতিবাগান কিংবা শ্যামবাজারে হেঁটে গিয়ে টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্রও কিনে আনতে পারি৷ বাজার ঘুরে টাটকা শাকপাতা, আনাজপত্র চোখে পড়লে তাও কিনে আনি৷

 কিন্তু বুকটা তখনই মোচড় দিয়ে ওঠে, যখন আমার বয়সি কাউকেই আর চোখে পড়ে না৷ আমার বয়েসি মানুষ যে আর নেই, তা নয়৷ হয়তো আছে৷ কিন্তু তারা হয়তো কেউ ‘আর’ বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না৷ কেউ হয়তো বিছানায় শয্যাশায়ী৷ মনটা খারাপ হয়ে যায়৷ ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরি৷ তখনই মনে হয়— তালিকা করে ফেলা উচিত৷ মৃত্যুভয় নয়৷ জানি, ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’৷ আসলে যে কাজটি আজই করা উচিত, কালকের জন্য সেটা ফেলে রাখা ভুল৷

 এই ভুল-এর যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, তাই স্থির করে ফেললাম— সংগ্রহশালার ‘সন্তান’-গুলোর একটা তালিকা আজই তৈরি করে রাখব৷ সম্ভব হলে থাকবে প্রতিটি সংগৃহীত বস্তুর সঙ্গে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত টীকা৷

 কচ্ছের যাযাবরদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা উটের গলার ঘণ্টা৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নানা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ রিসিভ করার যন্ত্র, যাকে বলা হয়— ‘মেসেজ রিসিভার’৷ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা যন্ত্র৷ অবশ্য যুদ্ধক্ষেত্রের পরিপ্রেক্ষিতে৷ যন্ত্রটি এখনও অনেকাংশে সচল৷ এই যন্ত্রে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন, হিটলার এবং (সম্ভবত) মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কন্ঠস্বর ধরা আছে৷ ‘সম্ভবত’ বলছি এই কারণে যে, রুজভেল্টের কন্ঠস্বরটা স্পষ্ট বোঝা যায় না৷ আপশোস, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নেতাজি যখন ভারতবাসীর উদ্দেশে বলছেন— ‘‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও৷ আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব৷’’

 যুদ্ধক্ষেত্রে নেতাজির এই বাণীধৃত রিসিভার সংগ্রহ করতে না পারলেও, সুভাষচন্দ্র বসুর কণ্ঠস্বর আমার কাছে ধরা আছে৷

 সুভাষচন্দ্র বসু তখনও ‘নেতাজি’ হননি৷ তাঁর ‘মহানিষ্ক্রমণের’ প্রায় বছর দুয়েক আগের ঘটনা৷ আমার বন্ধুর বাবার ছাতুবাবুর বাজারের পেছনে বিডন স্ট্রিটে লাউড স্পিকার-এর এবং নানারকম ইলেকট্রিক্যাল সাজসরঞ্জামের একটা দোকান ছিল৷ আমি আমার বন্ধুটির খোঁজে একদিন ওই দোকানে গিয়ে দেখি— লাউড স্পিকারের বড়ো বড়ো চোংগুলো ঠেলাগাড়িতে বোঝাই করা হচ্ছে৷ ‘ওগুলো কোথায় যাচ্ছে?’ জিজ্ঞেস করাতে বন্ধুর বাবা জানালেন, ‘আজ তোমাদের পাড়ায় সুভাষবাবুর সভা আছে৷ দেশবন্ধু পার্কে৷’ তখন আমার বয়স মাত্র চোদ্দো৷ রাজনীতি সম্বন্ধে সচেতন হওয়ার কথা নয়৷ বড়োদের মুখে সুভাষচন্দ্র বসুর কথা শুনতাম৷ তাই ওঁকে চোখে দেখবার কৌতূহল একটা ছিলই৷

 বন্ধুর বাবা আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি সুভাষবাবুর বক্তৃতা শুনতে যাবে?’

 কারও বক্তৃতা শোনার আগ্রহ তখন আমার মধ্যে তৈরি হয়নি৷ কিন্তু, মানুষটিকে দেখার প্রবল ইচ্ছা সেদিন বিকেলে আমাকে দেশবন্ধু পার্কে টেনে নিয়ে গিয়েছিল৷ সেই প্রথম সুভাষচন্দ্র বসুকে আমার দেখা৷ এবং ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত বাঙালি সাজে৷

 রেডিয়োর প্রথম যুগ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত যাবতীয় ‘ভালভ’ আমার সংগ্রহে এখনও সাজানো৷ এইসব পুরোনো জিনিসের তালিকা-সারণি তৈরি করতে করতে প্রবাদবাক্যের মতো একটা কবিতার ছত্র মনে পড়ে যাচ্ছে— লাইনটা স্মৃতি থেকে বলে যাচ্ছি— ভুল হলেও হতে পারে৷ পাঠক নিজগুণে ক্ষমা করে নেবেন৷

 ‘‘যেখানে দেখিবে ছাই / উড়াইয়া দেখিবে তাই
 পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন৷’’

 আমার এই সংগ্রহের প্রেক্ষিতে কথাটা পরম সত্য৷ কারণ, আমার সংগ্রহশালার অধিকাংশ জিনিস, বলতে গেলে ওই ছাই উড়িয়ে খুঁজে পাওয়া৷

 কলকাতার নানা জায়গা থেকে, বিশেষ করে ওয়েলিংটন স্কোয়ার সংলগ্ন ভাঙাচোরা লোহালক্করের দোকান থেকে অধিকাংশ জিনিস খুঁজে পাওয়া৷ কোনোটা বিনামূল্যে, কোনোটা আবার নামমাত্র পয়সায় কেনা৷ মজার কথাটা হচ্ছে, পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা বলে একটা কথা আছে না! শুধু চোদ্দো আনা নয়, সামান্য একটা কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসও আমার সংগ্রহশালায় এসে ষোলো আনা মূল্যবান হয়ে জাতে উঠে যায়৷ এটা শুধু আমার কথা নয়, অতিথি-দর্শক যাঁরা এই ছোট্ট সংগ্রহশালায় পা রেখেছেন— এটা তাঁদেরই পর্যবেক্ষণের প্রতিক্রিয়া৷

 তালিকা! তালিকা! তালিকা! সব জিনিসের খুঁটিনাটি বিবরণ দেওয়া কি সম্ভব? আবার ভাবি, ‘সম্ভব’ না হলেও এই কাজটা আমাকে করে যেতেই হবে৷ অবশ্য যতদূর আমার পক্ষে সম্ভব৷

 এ-প্রসঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর একটা কলিং বেলের কথা বলতেই হয়৷ ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম যে ইংরেজ দলটি ভারতবর্ষে এসেছিল, তারাই এই ধরনের কলিং বেল ব্যবহার করত৷ ১৯৩০ সালে তৈরি একটা সুইস স্টপওয়াচ৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৯) ব্যবহৃত এখনও সচল একটি মুভি ক্যামেরা৷ দর্শকের অনুরোধে কীভাবে সেটা চালাতে হয়, সেটা আমি দেখাই৷ এই কাজটা করতে কেমন একটা শিহরন আমার সারা দেহে বিদ্যুতের মতো খেলে যায়৷ মনে হয় আমি যেন সেই যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে গিয়েছি৷ যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ছ’বছর পরে আমার জন্ম!

 ‘এখানে-ওখানে ছড়ানো-ছেটানো নয়৷ অপরিসর হলেও সমস্ত জিনিসই সংগ্রহশালায় সাজানো-গোছানো৷ এমনকি আদ্যিকালের ৩৫ মিলিমিটার রিলের প্রোজেক্টরটি পর্যন্ত৷’ কোনো দর্শকের এহেন উক্তি আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়৷ দর্শকবন্ধু ঠিকই বলেছেন৷ জায়গার অকুলান, তবুও পুরোনো প্রোজেক্টরের ওপরেই হেডফোনগুলো বাধ্য হয়েই সাজিয়ে রেখেছি৷ দর্শকদের মধ্যে অনেকেরই সহানুভূতি-মিশ্রিত অনুযোগ— এটা কেন এটার ওপরে রেখেছেন? ওটা কেন ওখানে? একটা সচল পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়নের ওপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত একটা মেসেজ রিসিভার রাখা দেখে একজন বলেন— ‘এটাকে একটু আলাদা করে রাখা যায় না!’ দর্শকদের, বন্ধুদের ভালোবাসার এমন মন্তব্য আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়৷ তবে, আমাকে সাহায্য করবার মানুষের অভাব নেই৷ আমার ছেলেরাই তো আছে! কিন্তু ওরা জানে, আমি নিজের কাজটা নিজের হাতে করতেই পছন্দ করি৷

 যাই হোক, যে-কথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, সেই সংগ্রহের কথায় ফিরে যাওয়া যাক৷ হাজারেরও কিছু বেশি সংগ্রহের বাইরে আছে হাজার তিনেক রেকর্ড৷ সবই গালার তৈরি৷ পুরোনো দিনের কত গান যে সেখানে লুকিয়ে আছে! সেগুলো আলাদা একটা স্থানের দাবি করে৷

 আমি জানি, তালিকার বিবরণ পড়া আর আমার চোখে দেখার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত৷ আমি চাই, আমি থাকি আর না-থাকি, আমার এই সংগ্রহশালা একদিন প্রসারিত হবে৷ যারা থাকবে, তাদের মধ্যে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে৷ এইটুকুই৷ এটাই বলতে পারি৷ এখনও পর্যন্ত কোনো নেতিবাচক চিন্তা আমার মধ্যে আসে না৷ আমি আশাবাদী৷ তবে, একটা কথা পাঠকদের উদ্দেশে বলতে চাই৷ আমি যখন থাকব না, কোনো উত্তরপুরুষ এগিয়ে এসে এই সংগ্রহশালার দায়িত্ব নিজের হাতে যদি তুলে নেন, আমি খুশি হব৷ আমার আত্মা খুশি হবে৷ কারণ, আমি পরজন্মে বিশ্বাসী৷

 আর, সেদিন যদি বিদেশি ডোয়ার্কিন কোম্পানির ছাপমারা পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়নটি হঠাৎ বেজে উঠে দায়িত্বশীল উত্তরপুরুষটিকে প্রশ্ন করে বসে, ‘তুমি কে বাপু! ঝাড়পোঁছ করছ? আমার গায়ে হাত দিচ্ছ?’ এসব কল্পনার সংলাপ মনে হলেও, এর মধ্যে একটা চরম সত্য নিহিত আছে৷ আসল কথা শুধু লোক দেখানো ভালোবাসা নয়৷ সত্যিকারের দরদ থাকা চাই ওদের প্রতি৷ জড়পদার্থ হলেও আমি মনে করি, মানুষের ভালোবাসা ওরা বুঝতে পারে৷ এটা পুরোপুরি মনের ব্যাপার৷ ভক্তির ব্যাপার৷ ভালোবাসার ব্যাপার৷ যেমন, মাটির প্রতিমায় আমরা প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে পুজো করি! নারায়ণ জ্ঞানে শিলাখণ্ড পুজো করি! মোদ্দা কথা হল, যে-ই দায়িত্ব নিক না কেন, ভালোবাসা না থাকলে কিছুই হবে না৷…

 এই পৃথিবীর সব কিছুকে একটা সংসারের সঙ্গে তুলনা করা যায়৷ এটা, এই পৃথিবীটা হচ্ছে মহাবিশ্বের সংসার৷ বলা যেতে পারে মহাকালও৷ মহাকালের সংসারে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এই মহাবিশ্ব তার নিজের খেয়ালে সাজিয়ে রেখেছেন৷ যেমন, সুন্দরবনের ‘ম্যানগ্রোভ অরণ্য’৷ এই অরণ্য নদীর ভাঙন থেকে স্থলভূমিকে রক্ষা করছে৷ আমরা যদি গভীরভাবে নিরীক্ষণ করি, তাহলে বুঝতে পারব যে এই পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সেই অদৃশ্য মহাকাল যেখানে যেমনটি প্রয়োজন, সেখানে তেমনটি করেই সাজিয়ে রেখেছেন৷ আমরা, অর্থাৎ মানুষ কী করছে? বিজ্ঞানের সাহায্যে মহাবিশ্ব-র এই সাজানো সংসার ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে৷ একটা ছোট্ট উদাহরণ, আমাদের সাজানো-গোছানো ঘরখানার জিনিসপত্র যদি কেউ উলটোপালটা করে এদিক-ওদিক অগোছালো করে রাখে, আমরা যেমন বিরক্ত হই, সেই রকমই মহাবিশ্ব বা মহাকালও বিরক্ত হন৷ তার এই সাজানো বিশ্বসংসারের ভারসাম্য নষ্ট হয়৷ তিনি কুপিত হন এবং মানুষের দুষ্কর্মের জন্য প্রতিশোধ নেন৷ ফলে, পৃথিবীতে নানা বিপর্যয় নেমে আসে৷ খরা-বন্যা-মহামারি ইত্যাদিও৷

 এই বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে গেলে, এই প্রকৃতির ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ প্রকৃতির লীলাকে অবলোকন করাই আমাদের কাজ৷

 এইসব প্রকৃতি-বিরোধী কাজ মানেই সমাজবিরোধী কাজ৷ অর্থলোভী ধনী ব্যক্তিরা টাকার জোরে, ক্ষমতার জোরে এই সুন্দর পৃথিবীকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে, পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলবে, এটা মানা যায় না৷ এই পৃথিবী রক্ষা করতে গেলে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকলকে এগিয়ে আসতে হবে৷ গড়ে তুলতে হবে জনজাগরণ৷

 আর একবার গ্রহ-নক্ষত্রের প্রসঙ্গে ফিরে আসি৷ এক-একটা গ্রহের এক-একটা রং থাকে৷ আর এই রঙের মধ্যে থাকে ভিন্ন ভিন্ন শব্দতরঙ্গ৷ জাতক যখন ভূমিষ্ঠ হয়, সেই শব্দতরঙ্গ তার শরীরে প্রবাহিত হয়৷ কারণ রক্তের মধ্যে যে লোহিত কণিকা থাকে সেই লোহিত কণিকা সারা শরীরে একটা প্রভাব বিস্তার করে৷ আবার সারা শরীরে এই রক্ত চলাচলের সময় একটা চুম্বক-তরঙ্গ তৈরি হয়৷ শরীরের এই চুম্বক-তরঙ্গের সঙ্গে পৃথিবীর চুম্বক বলয়ের একটা যোগাযোগ থাকে৷ যে ব্যক্তি কুকর্ম করে, তার সঙ্গে এই যোগাযোগটা, অর্থাৎ এই চুম্বকশক্তির যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ ফলে তাকে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়৷ জানি না, আমার এই ভাবনার সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা! তবে এটা আমার বিশ্বাস৷ কিন্তু এটা তো সবাই মানবেন যে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে প্রকৃতির প্রভাব এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষের ভূমিকা যে কতদূর পর্যন্ত সুদূর প্রসারিত৷ প্রকৃতিগত মহাবিশ্বে চুম্বক-তরঙ্গ সারা বিশ্বকে যোগাযোগ রক্ষায় সহায়তা করে৷ এবং যে আকাশটা আমরা দেখছি, সেটি হচ্ছে সারা বিশ্বের সব কিছু ঘটনার ব্লু-প্রিন্ট৷ বিশ্বের প্রতিদিনের সব কিছু ঘটনা ওখানে সঞ্চারিত হয়৷ এবং আমি মনে করি, ঘটনার পাপপুণ্যের বিচার ওখানেই হয়ে যায়৷

 আমাদের শরীরে রক্ত সংবহন দ্বারা যে চুম্বক-তরঙ্গ নির্গত হয়, মহাবিশ্বের চুম্বক-তরঙ্গের সঙ্গে প্রতিনিয়ত তার যোগাযোগ থাকে৷ এই যোগাযোগ মানুষের কর্মযোগের ওপর নির্ভর করে৷ কুকর্ম এই সংযোগকে বিচ্ছিন্ন করে এবং সুকর্ম এই সংযোগকে ধরে রাখে৷ আমরা প্রতিনিয়ত কু-কর্ম দ্বারা এই চুম্বক-তরঙ্গের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি৷ আর এটাই হচ্ছে আমাদের জীবন ও যাবতীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ৷

 এছাড়া মানুষের প্রয়োজনে, মানুষের স্বার্থে বিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হলেও, সেখানে কার্যকারণের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করা হয়৷

 অন্যত্র, পৃথিবীতে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ, লোভী মানুষ অর্থের জন্য প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে৷ সেটা আমার এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে মনে হয় কিছুটা বোঝাতে পেরেছি৷…

 মহাত্মা গান্ধির ডাকে ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম৷ গান্ধিজি ডাক দিয়েছিলেন অহিংস আন্দোলনের৷ কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই আন্দোলন হয়ে উঠেছিল সহিংস৷ ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট গান্ধিজি যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন, তখন আমি খুবই ছোটো৷ স্কুল-কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে আমি সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা বিল্ডিং-এ আমরা অবস্থান ধর্মঘট পালন করছিলাম৷ আমাদের সঙ্গে ছিল রামেশ্বর ব্যানার্জি নামে একটি ছাত্র৷ সে পুলিশের কর্ডন ভেঙে স্লোগান দিতে উত্তেজিত হয়ে বিপরীত দিকে কলেজ স্কোয়ারে অপেক্ষমান, তখনকার দিনের ইংরেজের গোর্খা রেজিমেন্টের দিকে এগিয়ে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বতন অফিসারের মধ্যে থেকে একেবারে জিরো রেঞ্জে গুলি চালানো হল৷ রামেশ্বর মাটিতে পড়ে গেল৷ সে উঠল না৷ রামেশ্বর চিরদিনের মতো চলে গেল৷ শহিদ হল৷ কে আজ তাঁর কথা মনে রেখেছে!

 এই ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন অবিলম্বে মেদিনীপুরে ছড়িয়ে পড়ে৷ এক মহিলা আন্দোলনকারী মাতঙ্গিনী হাজরা পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন৷ সবাই জানেন, ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে৷ একটা কথা এখানে বলে রাখতে চাই৷ গান্ধিজি এই আন্দোলন অহিংস বলে ঘোষণা করলেও, কোথাও কোথাও এই আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে৷ সরকারি অফিসে আগুন লাগানো হয়৷ রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে পরিবহন ব্যবস্থা বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়৷ আমাদের পেছনেও গোয়েন্দা লাগানো হয়৷ আমরা মেদিনীপুর হয়ে, আজকের ঝাড়খণ্ডে পালিয়ে যাই৷ সে এক জীবনের অভিনব অভিজ্ঞতা!

 যৌবনে আমাদের জীবনটা কেমন ছিল, সে-কথা না বললে আমার মনে হয়, আমার বক্তব্য অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে৷

 যৌবনে আমাদের সব বিষয়েই একটু একটু আগ্রহ ছিল৷ ওই যে ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, সব জিনিস একটু একটু, কিন্তু একটা জিনিসকে ভালোভাবে জানা! তাই সেই সময়ে সব কিছুকে জানার একটা স্বাভাবিক আগ্রহ আমাদের মধ্যে ছিল৷

 আমি ফুটবল খেলেছি৷ এমনকি প্রথম ডিভিশনে খেলারও অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ আমি এরিয়ান্স ক্লাবে কিছুদিন খেলেছিলাম৷ মাছ ধরারও নেশা ছিল৷ সংগীত শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে মাছ ধরার ব্যবস্থা করে দিতাম৷ সেই সঙ্গে আমারও মাছ ধরার নেশা জন্মে গিয়েছিল৷ গান-বাজনাও শিখেছিলাম৷

 সুযোগ পেলেই কারও না কারও সঙ্গে শিকার করতে গিয়েছি৷ সেসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গেলে, আলাদা করে এক-একটা বই হয়ে যায়৷ সারা ভারত মোটর বাইকে পরিভ্রমণ করেছি৷ সেসবও এক অনন্য কাহিনি৷

 একটু অন্য কথায় ফিরে আসি৷ এত গানের রেকর্ড দেখে অনেকে ভাবতে পারেন, আমি কি কোনো দিন গান-বাজনার রেওয়াজ করেছি! বলব, পেশাদার সংগীত শিল্পীর মতো না হলেও গান-বাজনা, যাত্রা-নাটক-থিয়েটারের প্রতি আমার একটা সহজাত আকর্ষণ ছিল৷ দু-একটা যাত্রাপালা, নাটকে অভিনয় করেছিলাম৷ সবই অ্যামেচার৷ একটু-আধটু গানও গাইতে পারতাম৷ তবে, এ-কথা সত্য যে, সংগীত, নাটক তথা সাংস্কৃতিক জগতের অনেক দিকপাল ব্যক্তিত্বের পদধূলিধন্য আমাদের এই বাড়িটা৷ এঁরা সব বাবার কাছে আসতেন বাড়ির খোঁজে৷ আগেই বলেছি, বাড়ি তৈরি করে অন্যকে বিক্রি করে দেওয়াটাই বাবার ব্যাবসা ছিল৷ সেই সূত্রেই ওই বিখ্যাতজনদের আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া৷ এঁরা সবাই বাবার কাছে আসতেন৷ এই কারণে বাবার মৃত্যুর পরও ওঁদের যাতায়াত ছিল আমাদের এই বাড়িতে৷

 বিখ্যাত সংগীত বিশারদ রাইচাঁদ বড়াল আসতেন পঙ্কজকুমার মল্লিককে সঙ্গে নিয়ে৷ বাবার মৃত্যুর পরও ওঁদের মায়ের কাছে আসতে দেখেছি ওই বাড়ির খোঁজে৷ ও-ই একই উদ্দেশ্যে এসেছেন, অভিনেত্রী কঙ্কাবতী দেবীকে সঙ্গে নিয়ে শিশিরকুমার ভাদুড়ি মহাশয়৷ এই গলির মধ্যে বাড়ি৷ দিনের বেলাতেও আলো জ্বালতে হয়৷ এই বাড়িতেই একদা মহাজনদের আনাগোনা ছিল৷ এ-প্রসঙ্গে উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত ছবির একটা গানের কথা মনে পড়ে গেল৷ ছবিটার নাম ‘ইন্দ্রাণী’৷ গানের প্রথম লাইনটা ছিল ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়ো৷’ মনে আছে এখনও, গানটা ছিল ডুয়েট৷ নায়ক-নায়িকার কণ্ঠে৷ পুরুষকণ্ঠটি ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আর নারীকণ্ঠটি ছিল গীতা দত্তের৷ গানটার সঙ্গে এই বাড়িটারও একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷

 এই বাড়িরও ছোটা ছোটো ঘর, কিন্তু এই বাড়ির আকাশটা অনেক বড়ো৷ অর্থাৎ বহু মানুষের, বহু জগতের মানুষের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল এই বাড়িটা একদা৷

 আগেকার দিনের বিখ্যাত গায়িকা ইন্দুবালা এবং আঙুরবালাও আমাদের এই বাড়িতে এসেছিলেন৷ গানও গেয়েছিলেন শুনেছি৷ আমি নিজে একবার ইন্দুবালার বাড়িতে গিয়েছিলাম৷ উনি আমার গলায় পৈতে দেখে বলেছিলেন, ‘তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান৷ বোসো৷ কী খাবে বল?’

 মনে আছে উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘না! আমি কিছু খেতে আসিনি৷ আমি আপনার গলায় গান শুনতে এসেছি৷’

 তবু উনি আমাকে যত্ন করে কিছু মিষ্টি খাইয়েছিলেন এবং একখানি গানও শুনিয়েছিলেন৷ পরে জেনেছি ওই গানটা ইন্দুবালা দেবীর প্রথম রেকর্ডের এক পিঠের একটি গান৷ গানটা ছিল ‘ওরে মাঝি তরী হেথা বাঁধব নাকো৷’ ইন্দুবালা এই গানটির রেকর্ড করেছিলেন ১৯১৬ সালে৷ বলাই বাহুল্য যে, ইন্দুবালা সংগীতজগতে যেমন বিখ্যাত ছিলেন, অনুরূপভাবে নাট্যজগতেও তিনি ছিলেন একজন স্বনামধন্যা অভিনেত্রী৷ ‘স্টার’ থিয়েটারে উনি দানীবাবুর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন৷ ইন্দুবালা দেবীর গান আমি শুনেছিলাম, আমার বয়স যখন খুব ছোট্ট৷ পরবর্তীকালে ওঁর নাট্যাভিনয়ের কথা মায়ের মুখে শুনেছি৷

 আঙুরবালার গানও আমি শুনেছি একেবারে তাঁর সামনে বসে৷ আঙুরবালা তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ে এই উত্তর কলকাতাতেই থাকতেন৷

 ঠিক মনে করতে পারছি না, এই দুই শিল্পীর, ইন্দুবালা ও আঙুরবালার রেকর্ড আমার সংগ্রহে আছে কিনা! তবে, এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত আঙুরবালার প্রথম রেকর্ডের গান আপন খেয়ালে গাইতাম৷ কাউকে শোনাবার জন্য নয়৷ এখনও দু’টি গানেরই দু’টি প্রথম লাইন মনে আছে৷ যেমন, একটি হচ্ছে (১) ‘বাঁধ না তরীখানি আমার এই নদী কূলে৷’ দ্বিতীয়টি (২) ‘কালা তোর তরে কদমতলায় চেয়ে থাকি৷’

 বিখ্যাত মানুষজনের কথা যখন মনে পড়ে, বই-এ পড়া নয়, নিজের চোখে যাঁদের দেখার সুযোগ হয়েছে, তখনই আমার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব খেলা করে যায়— ‘জীবনের এই যে ঘটনাবলি, এর সঙ্গে কি ভাগ্যের কোনো সংযোগ আছে, না এ শুধুই ঘটনাচক্র! এই যে ঘটনাচক্র এবং ভাগ্যের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, কোনোটাকেই অস্বীকার করতে পারি না৷ যে ঘটনাচক্রের অভিঘাতে আমি আজ, মানে আমাদের এই গোটা পরিবারটা একসময় হরিপাল থেকে কলকাতায় এসে ঘর বাঁধল, সেটা যদি ঘটনাচক্রে না ঘটত, যদি আমরা কলকাতায় না এসে অন্য একটা গ্রামে গিয়ে বাস করতাম তাহলে কি আমি এই মুহূর্তে, এখানে বসে এত কথা বলতে পারতাম! আমার মনে হয় ভাগ্য-টাগ্য নয়, ঘটনাচক্রেরই অন্য নাম ভাগ্য বা অদৃষ্ট৷ যা-ই বলা হোক না কেন! আরও একটা কথা আমার মনে হয়৷ মনে হয়-ই বা কেন বলি, আমি বিশ্বাস করি৷ এই যে ব্রহ্মাণ্ড! আর তার গ্রহ-তারকা-নক্ষত্র, চন্দ্রসূর্য, আকাশ-বাতাস-মৃত্তিকা! প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই এদের প্রত্যেকটারই একটা প্রভাব আছে এই পৃথিবীর ওপর৷ পৃথিবীর মানুষজন, এমনকি প্রতিটি কীটপতঙ্গ, পশুপক্ষী সকলের ওপরে৷ সেই প্রভাবজনিত যে অভিঘাত, সেই অভিঘাতই আমাদের, এই পৃথিবীর প্রাণীকুল এবং সকল কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে৷

 আমার আরও কিছু ভাবনা আছে৷ পৃথিবীর যাবতীয় শব্দতরঙ্গ, চুম্বকশক্তি, পৃথিবীর জীবজগতের ওপর এদের প্রভাব আছে৷ আর পরিবেশ এবং প্রকৃতিগত প্রভাবটা তো জলের মতো সত্য৷ যেমন, নদীর ধারে যেসব মানুষের বসবাস, তাদের মধ্যে দেখা যায় মানুষ সন্তরনপটু হয়৷ প্রকৃতির এই প্রভাবকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না৷

 ফিরে যাওয়া যাক আবার পুরোনো দিনের কথায়৷ পুরোনো জিনিসপত্তর এবং আমার সংগ্রহশালার সদস্যদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব কথাই প্রায় বলা শেষ হয়ে গিয়েছে৷ কলকাতা শহরে নানা উপলক্ষ্যে, শোভাযাত্রায় রাজপথে যে আলোকসজ্জা চোখে পড়ে সেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ডে-লাইট, হ্যাজাক ও গ্যাসের আলো চোখে পড়ে৷ আমার সংগ্রহশালায় নানা আকারের সেই ডে-লাইট এবং হ্যাজাক আপনারা দেখেছেন৷ কিন্তু কলকাতার রাজপথে গ্যাসের আলো জ্বলতে আজকের প্রজন্মের কেউ দেখেছেন বলে আমার তো মনে হয় না৷

 এই তো, সেদিন পর্যন্ত, মানে স্বাধীনতার বেশ কিছু পরেও কলকাতার পথে গ্যাসলাইট জ্বলতে দেখা গিয়েছিল৷ এখনকার ছেলেমেয়েরা ছবিতে সেসব আলো দেখেছে৷ আমি পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময়েও কলকাতার রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বলতে দেখেছি৷ সেই আলো জ্বালাবার জন্য এক-একটা এলাকায় এক-একজন নির্দিষ্ট লোক থাকত৷ তাদের কাঁধে থাকত একটা লম্বা মই৷ লোহার স্ট্যান্ডের মাথায় বসানো থাকতো চৌকো একটা কাচের ঘর৷ এবং সেই ঘরটার মধ্যে, ঠিক তার মাঝখানে ওপরের দিকে ডে-লাইট কিংবা হ্যাজাকের মতো একটা ম্যান্টেল লাগানো থাকত৷ সেই লোকটি মই দিয়ে স্ট্যান্ডে উঠে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে ‘ম্যান্টেল’-এ আগুন ধরিয়ে দিত৷ তার আগে অবশ্য চৌকো আলোক-আধারটির চারপাশের কাচ ভালো করে মুছে নিত সে৷ ম্যান্টেল জ্বালাবার সঙ্গে সঙ্গে সেই কাচ ভেদ করে ঝকঝকে আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত৷ মনে পড়ছে, ছোটোবেলায় ‘Lamp Lighter’ নামে একটা কবিতা পড়েছিলাম, কবিতাটি ওই আলো জ্বালাবার মানুষগুলোকে নিয়ে লেখা৷

 কলকাতার বড়ো বড়ো রাস্তাগুলোর দু’পাশে ঘোড়ার জলপানের জন্য লোহার চার কোনা লম্বাটে ছোটো ছোটো জলাধার ফুটপাতের কিনারায় বসানো থাকত৷ তখন কলকাতার রাজপথে ঘোড়ার গাড়ির চলন ছিল বেশি৷

 এবার কলকাতার ফেরিওয়ালাদের কথায় একটু আসা যাক৷ দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফেরিওয়ালার ডাক আমরা শুনতে পেতাম৷

 সকালে, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্র একটা কন্ঠস্বর শুনে আমাদের ঘুম ভেঙে যেত৷ যেমন, চিঁড়ের চাক, ছোলার চাক, মুড়ির চাক৷ ঠিক তার কিছুটা আগে-পরে শোনা যেত, মাখন, সাদা মাখন! কিংবা কখনো কখনো শোনা যেত, মাখন, চিনি মাখন! সাদা মাখনের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে, কলার পাতায় খদ্দেরকে পরিবেশন করা হত৷ বেলা একটু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবির্ভাব ঘটত জয়নগরের মোয়া, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের সন্দেশ, শোনপাপড়ি বিক্রেতার৷ বেলা যত বাড়তে থাকে, ফেরিওয়ালার রকমফের কিংবা বলা যায় বৈচিত্র্যও বৃদ্ধি পায়৷ শীতের সময় দুপুরবেলায় ঝুড়ি মাথায় গলিতে গলিতে হাঁক দিয়ে যায় ট্যাপারি, টোপাকুল, নারকেলের কুল ইত্যাদি৷ আবার ভর দুপুরে না হলেও, পুরুষরা কাজেকর্মে বেরিয়ে যাওয়ার পর, আগরপাড়ার তৈরি সুতো বাঁধা ইজের, জামা, সায়া, ব্লাউজ ইত্যাদি বিক্রির জন্য চেনাজানা বাড়িতে কড়া নড়ে উঠত৷ বাড়ির মহিলারা বেরিয়ে এসে দরদস্তুর করে জিনিসপত্র কিনতেন৷ আর একদল ফেরিওয়ালার আসা-যাওয়াও ছোটোবেলায় লক্ষ করতাম৷ তারা শুধু ধনেখালির শাড়ি, শান্তিপুরের ধুতি নিয়ে আসত৷ আবার দুপুর গড়িয়ে বিকেল৷ কী শীত— কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা— ঘুগনি-আলুর দম৷ আর বিচিত্র কন্ঠস্বরের ডিম সেদ্ধর অব্যাহতি ছিল না৷ গলা শুনেই গৃহস্থের জানালা-দরজা খুলে যেত৷ উভয় পক্ষেরই পরিচিত মুখ, ক্রেতা এবং বিক্রেতার৷ খদ্দেরের কিছু বলার আগেই ঘুগনিওয়ালা কাটা শালপাতায় চামচ করে ঘুগনি সাজাতে শুরু করে৷ তারপর একটা পুরোনো পাউডারের কৌটো থেকে নুনমরিচ গুঁড়ো ছড়িয়ে খদ্দেরের হাতে তুলে দেয়৷ ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে ফেরিওয়ালারও বদল ঘটে৷ গরমকালে অলিতে-গলিতে শুরু হয়ে যায় কুলপি বরফের হাঁকডাক৷ শুধু কি হাঁকডাক? এক-একটা এলাকা যেন এক-এক জনের ইজারা নেওয়া৷ এ-পাড়ায় ক্ষিতীশ বিখ্যাত, তো ও-পাড়ায় অমূল্যর কুলপি৷

 পুরাতনকে জানতে গেলে আমার মনে হয়, শুধু বিজ্ঞানভিত্তিক আবিষ্কারকে জানলেই হবে না৷ পুরোনো ইতিহাসের অনেক কিছু জানার থাকে৷ আমরা সাধারণ মানুষ৷ পণ্ডিত নই, গবেষক নই৷ প্রাত্যহিক জীবনধারণের প্রয়োজন মেটাতে যে নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুসামগ্রীর অনিবার্যতা, সেই চাল-ডাল-তেল-নুন বাজারদরটা কেমন ছিল, সেটা অজানা থেকে গেলে আমার মনে হয় অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়৷ তাই গত শতাব্দীর তিন থেকে পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময়ের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারদরের একটা তালিকা এই লেখার সঙ্গে তুলে ধরতে চাই৷

 অর্থাৎ, একদা কী ছিল আর বর্তমানে কী হয়েছে, এটা না জানা থাকলে অগ্রগতি বা রূপান্তরের ছবিটা স্পষ্ট ধরা পড়ে না৷

 প্রশ্ন উঠতে পারে, এই অগ্রগতি বা রূপান্তরের সঙ্গে আমার সংগ্রহশালার কী সম্পর্ক? উত্তরে বলব, অতীতকে না জানলে, বর্তমানকে জানা যায় না৷ আমার কথা ছেড়ে দিন, আমরা কেউ সবজান্তা নই৷ একটা বিষয়ে পণ্ডিত হওয়াটাই শেষ কথা নয়৷ অন্যথায় সব বিষয়ই কিছু জানাটা একান্ত দরকার৷

 ১ টাকায় ৮টা ডিমের কথা আগে বলেছি৷ সেটা আটচল্লিশ সালের কথা৷ অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের কথা৷ স্বাধীনতার ঠিক পরে পরেই৷ পাঠকদের অবগতির জন্য এখানে আমি গতদিনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের একটা তালিকা তুলে ধরতে চাই৷ ফলে পাঠক সহজেই বুঝতে পারবেন আজ থেকে ৭২-৭৩ বছর আগে ১ টাকায় যেখানে ৮টা ডিম পাওয়া যেত, সে-ই ৮টা ডিমই এখন কিনতে গেলে বিক্রেতাকে গুনে দিতে হবে অন্তত ৫৬ টাকা৷ গুণগত মানের কথাটা না হয় ছেড়েই দিলাম৷ এই সামান্য ঘটনা থেকেই পাঠক বুঝতে পারবেন টাকার দাম আজ কীভাবে কমে গিয়েছে৷

 আরও একটা উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে৷ আমার সংগ্রহশালায় আছে ১৮৯০ সালের ছাপমারা এক ব্যাগ রুপোর টাকা৷ ১০০০ টাকার একটা ব্যাগ৷ এক-একটা টাকার ওজন প্রায় ১ ভরিরও বেশি৷ ভেবে দেখুন, আজ ১ ভরি রুপোর দামই হাজার টাকার ওপরে৷

 ৫ আনায় সব রকম সবজি পাওয়া যেত আর ৮ আনার মাছ কিনলে ঝাঁকা ভরে যেত৷ মুটে ভাড়া ছিল ৪ পয়সা৷ দূরত্ব যাই হোক না কেন৷ হাতিবাগান বাজার থেকে খান্না কিংবা হেদুয়া৷ পয়সার কথাটা একটু পরিষ্কার করে নিই৷ আজকের পাঠকরা জানে না, এ-কথা আমি বলতে চাইছি না৷ তবু সকলে তো সমান নয়৷ সকলের কথা ভেবেই বলছি৷ তখন ১৬ আনায় একটা টাকা ছিল৷ তখন, মানে আমি স্বাধীনতার পরের ঘটনাই বলতে চাইছি৷ অর্থাৎ, ৪ পয়সায় ১ আনা হলে ৬৪ পয়সায় ১ টাকা৷ আগেই বলেছি টাকার দাম কীভাবে কমে গিয়েছে৷ আজকে যেখানে ১ কেজি আলুর দাম ৪২ টাকা থেকে ৪৫ টাকা, স্বাধীনতার আগে-পরে ১ সের নৈনিতাল আলুর দাম ছিল ৫ থেকে বড়ো জোর ৬ আনা৷ তখন তো আর কেজি ছিল না৷ সবই সের দরে বিক্রি হত৷ এখন ১ কেজি পাঁঠার মাংসের দাম ৬৫০ টাকা থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে, তখন আমরা দেখেছি, ’৪২-’৪৩ সালের কথা— ১ সের মাংসের দাম ৬ আনা৷ ৬ আনা, মানে ২৪ পয়সা৷ আর কেজির সঙ্গে সেরের পার্থক্যটা মনে করি সকলেই জানেন৷ ১ কেজির থেকে ১ সের সামান্য একটু কম— ১০০ থেকে ৫০ গ্রামের মতো৷

 চার-এর দশকে ভালো চালের দর ছিল, ৩ টাকা থেকে ৪ টাকা মণ৷ মণ, মানে এখনকার প্রায় ৩৮ কেজি৷ ১৯৪৮ সালে আমি নিজের হাতে কিনেছি, ১০ সের শ্রী ঘি ১১ টাকা চার আনায়৷ সরষের তেল, ছ’ আনায় ১ সের৷ এখন ১ কেজি, মানে ১ সেরের একটু বেশি সরষের তেলের দাম— ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা৷ তখন আজকের এই টাকায় প্রায় ৪০ সের তেল হয়ে যেত৷ সেই সমসাময়িক কালের হিসাব থেকেই বলা যায়, ১ টাকায় ৮ সের আটা৷ কাটা পোনা ৬ আনা থেকে আট আনা সের৷ আর এক সের ওজনের গঙ্গার ইলিশ ১ জোড়ার দাম ছিল মাত্র ১ টাকা আট আনা৷

 পাঠককে আরও একবার মনে করিয়ে দিই, যে জিনিসপত্রের দরের ফিরিস্তি আমি দিচ্ছি, সে-সবই তিন থেকে চার-এর দশকের সময়ভিত্তিক৷ এই প্রসঙ্গে আরও একটা জরুরি কথা বলে রাখি৷ পৃথিবীতে পর পর দুটো বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গিয়েছে৷ মানুষ মানুষকে কী নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তারও আমরা সাক্ষী থেকেছি৷ ‘দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’-এর সময় (১৯৪৬) কলকাতার রাজপথে মনুষ্যত্বের হত্যালীলাও দেখতে হয়েছে৷ নাগাসাকি-হিরোসিমার কথা না হয় বাদই দিলাম৷ মনুষ্যত্বের শুভবুদ্ধির গঙ্গাযাত্রা, তা-ও আমাদের দেখতে হয়েছে৷ কিন্তু, একটা জিনিস আমাকে গভীরভাবে দোলা দিয়ে যায়, জিনিসপত্রে ভেজাল দেওয়াটা তেমন চোখে পড়ত না৷ এটা এসেছে আরও পরে৷

 তাই বলছি, যা কিছু আমরা কিনেছি, যা কিছু আমরা খেয়েছি, সবই খাঁটি৷ ভেজাল কী জিনিস সাধারণ মানুষ তখন বুঝত না৷

 আজকের দিনে কেউ কি ভাবতে পারেন ১ টাকায় ৫ সের দুধের কথা? ৮ আনা সের রাবড়ি? ১ পয়সায়, সাইজ অনুযায়ী ৩টে কী ২টো রসগোল্লা? ১ ঝুড়ি (১১০ টায় ঝুড়ি) ল্যাংড়া আমের দাম মাত্র ১ টাকা ৪ আনা? কিংবা ৫ আনা সের গলদা চিংড়ি? মনে আছে, রুই মাছের দাম সব থেকে বেশি ছিল৷ ১ সের একটা কাটা বড়ো রুই মাছের দাম ছিল মাত্র ছ’আনা৷ শীতকালে যখন বেগুনের মরশুম, ১ সের বেগুন কিনেছি মাত্র ১ পয়সায়৷ অন্য সময়ে দাম বেড়ে হয়েছে ২ পয়সা৷ আজ যেমন বাঁধাকপি, লাউ, কুমড়ো এমনকি পেঁপে কেজি দরে বিক্রি হতে দেখি, আমাদের সময়ে, মানে যে–সময়ের কথা আলোচনা করছি, তখন এমনটা ছিল না৷ বাঁধাকপি, কুমড়োর ফালি, লাউয়ের ফালি সব ঠাউকো দরে বিক্রি হত৷ এক পয়সা, দু-পয়সা ফালি৷ একটা গোটা বড়ো বাঁধাকপির দাম ছিল ১ পয়সা থেকে ২ পয়সা৷ কোনো শাকপাতাই তখন ওজন দরে বিক্রি হত না৷ গ্রামের লোক তো শাকপাতা কিনতই না, শুধু শহরের বাজারেই সেগুলো বিকোত৷ কখনও আঁটি হিসেবে, কখনও ভাগা দেওয়া৷ ২-৩ আঁটি পালং শাক পাওয়া যেত ১ থেকে ২ পয়সায়৷ ১টা বড়ো মাপের ফুলকপির দাম ছিল বড়ো জোর ২ পয়সা৷

 আগেই বলেছি, আমি প্রথম শ্রেণির একজন ফুটবল খেলোয়াড় ছিলাম৷ কলকাতার এরিয়ান্স-এর মতো এক খানদানি ক্লাবে বেশ কিছুদিন খেলেছি৷ সেই কারণেই হয়তো অন্যান্য খেলার প্রতিও আমার একটা স্বাভাবিক আগ্রহ ছিল৷ সেটা যত সামান্য খেলাই হোক না কেন! গলির ক্রিকেট৷ ক্যাম্বিস বল৷ নানা রকম গুলি খেলা৷ এক সময় এই উত্তর কলকাতায় খুব জনপ্রিয় ছিল৷ বিশেষ করে কিশোরদের মধ্যে৷ এছাড়াও একটা খেলার প্রচলন দেখেছি, সেটা হচ্ছে ‘ঘুন্নি’ খেলা৷ এই ‘ঘুন্নি’ হচ্ছে এক রকম গাছের ফল৷ দেখতে ঠিক ছোটো এলাচের মতো৷ কিন্তু ফলটা খুব শক্ত এবং নিটোল৷ এখন আর এসব খেলা চোখে পড়ে না৷

 আমাদের যৌবনকালে আর একটা বিনোদনমূলক, বেশ মজার একটা খেলা খুবই জনপ্রিয় ছিল৷ এই খেলাটা এখনও অবশ্য আছে৷ কিন্তু, সেদিনের মতো নয়৷ সেটা হচ্ছে বাঁদরখেলা৷

 এভাবে কথা বলতে বলতে ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ একটা বিষয় আলোচনা করতে করতে, কথার মধ্যে অন্য কথা এসে যায়৷ অর্থাৎ,ধান চাষের কথা বলতে বলতে গান-বাজনার কথা এসে যায়৷ কিছু করার নেই!

 তিন, চার বা পাঁচের দশকের জিনিসপত্রের বা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ে আলোচনা করেছি৷ এবারও আরও কিছু কথা বাদ পড়ে গিয়েছিল৷ ওই যে আগে বললাম, ধারাবাহিকতার বিচ্ছিন্নতা! মানে, যেখানে যেটা বলার কথা, সেটা একটু আগুপিছু হয়ে যায়৷ এই আর কী!

 যে-কথা বলতে চেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে, প্রসঙ্গ তেলেভাজা৷ অর্থাৎ, তেলেভাজা বলতেই উত্তর কলকাতার কথাই এসে যায়৷ শুধু সেই সময়েই নয়, এখনও সাধারণ ভাবে তেলেভাজার এক নম্বরে দাঁড়িয়ে আছে এই উত্তর কলকাতাই৷

 তবে, অনেকেই হয়তো জানেন, এক সময় কলকাতার তেলেভাজার একাধিপত্য রাজত্ব ছিল উড়িষ্যাবাসীদের৷ এখন অবশ্য চিত্রটা পালটে গিয়েছে৷

 তখন এক পয়সায় দুটো ফুলুরি কিংবা দুটো বড়ো বড়ো বেগুনি পাওয়া যেত৷ ফুলুরির সাইজ ছিল মুঠোভরা৷ অর্থাৎ একটা ফুলুরিতেই একটা মুঠো ভরে যেত৷ আর বেগুনির সাইজ ছিল এক-একটা তিন ইঞ্চি চওড়া এবং লম্বায় প্রায় পাঁচ ইঞ্চি৷ একটা কথা মনে পড়ে গেল৷ লোকে শুনলে হাসবে৷ আমরা দুই বন্ধু মিলে মাঝে মাঝে দু-পয়সায় চারটে ফুলুরি কিনে খেতে খেতে কাশী মিত্তির ঘাটে চান করতে যেতাম৷ ওই ফুলুরির তেলেই আমাদের গায়ে, মাথায় মাখা হয়ে যেত৷ আর সেই বেগুনি-ফুলুরির স্বাদও ছিল চমৎকার৷ আসলে খাঁটি সরষের তেলে ভাজা তো! তখনকার দিনে ভেজাল বলে কিছু ছিল না৷

 ফেরিওয়ালার কথায় আবার একটু ফিরে আসা যাক৷ ঠিক দুপুরবেলায় আসত বাসনওয়ালা বাসন বিক্রি করতে৷ গলার ডাক তো ছিলই, সঙ্গে ছিল কাঁসি বাজানো৷ বিচিত্র সেই বাজনার তাল বা ঢং! বিকেলে হাঁক দিয়ে যেত— কেক-পেস্ট্রি বিক্রেতা৷ তার মাথায় থাকত একটা বাক্স৷ বাক্সের গায়ে লেখা থাকত— মিঃ বেরি৷ অর্থাৎ বেরি কোম্পানির তৈরি কেক, পেস্ট্রি৷ ওই বাক্সের মধ্যে কেক-পেস্ট্রি ছাড়াও থাকত হরেক রকমের বিস্কুট৷ কাঁই বিস্কুট, সুজি বিস্কুট, জিলিপি বিস্কুট, তিন কোনা ঝাল বিস্কুট এবং আরও যে কত রকম! বিচিত্র তাদের স্বাদ, বিচিত্র তাদের আকার৷

 এরই মাঝখানে ঘটত স্বাদ বদলের পালা৷ চিনে ফেরিওয়ালারা আসত চাইনিজ সিল্ক নিয়ে৷ প্রায়ই দেখা যেত এসব অতি নিম্নমানের জিনিস৷ একবার কাচলেই রং উঠে যেত৷

 বাড়ি ভাড়া ছিল জলের দর৷ জাপানি বোমার ভয়ে যখন লোক কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছে, তখন তো বাড়ির মালিকরা লোককে ডেকে ডেকে বিনিপয়সায় থাকতে দিত বাড়িটা পাহারা দেওয়ার জন্য৷ মালিক প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যেত কলকাতা ছেড়ে অন্যত্র৷

 অন্য সময় এই কলকাতা শহরেই, ৮ থেকে ১০ কামরার একটা বাড়ির ভাড়া ছিল মাত্র ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকার মধ্যে৷

 ১৯৪২, ১৯৪৩ সালের কথা বলছি৷ সে-সময় মাংস ছিল প্রতি সের ছ’আনা৷ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে৷ ইংরেজি ১৯৪৩ সালের কথা উঠতে মনে পড়ে গেল বাংলা সালের৷ ১৯৪৩ সাল, অর্থাৎ বাংলা ১২৫০ বঙ্গাব্দ৷ যাকে বলা হয়— পঞ্চাশের মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ৷ অনেকেই বলেন এই দুর্ভিক্ষ, অর্থাৎ পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ ছিল মানুষের তৈরি৷ খাদ্যশস্যের অভাব ছিল না৷ বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত লাভের আশায় শস্য মজুত করে রেখেছিল৷ বাজার থেকে সব ধান, চাল, খাদ্যশস্য তুলে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল৷ একটা কৃত্রিম অভাবের সৃষ্টি করা হয়েছিল এই বঙ্গভূমিতে৷ অনেকেই মনে করে থাকেন বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নাকি অশুভ একটা যোগাযোগ ছিল সরকারের৷ ফলে গ্রাম বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে এই কলকাতা শহরে ধেয়ে আসে৷ ক্ষুধার জ্বালায় তাদের কঙ্কালসার চেহারা৷ একমুঠো ভাতের জন্য চারিদিকে হাহাকার৷ খেতে না পেয়ে, রাস্তাঘাটে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল৷

 আমার বয়স তখন ১৭ বছর৷ আমি নিজের চোখে দেখেছি ক্ষুধার্ত মানুষের কঙ্কালসার চেহারাগুলো৷ শুনেছি নিজের কানে সেই মানুষগুলোর কান্না৷ তারা সবাই ভাতের কথা ভুলে গিয়েছিল৷ এক মুঠো ভাত ভিক্ষে করতে সাহস পেত না৷ তাই তাদের কণ্ঠে করুণ আর্জি ভেসে আসত, ‘মা, একটু ফ্যান দাও মা’! কলকাতার রাজপথে হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল৷ ইতিহাসবিদদের মতে, এই মন্বন্তরে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল৷ ১২৫০-এর এই দুর্ভিক্ষ, যা বলতে গেলে কালো অক্ষরে বঙ্গদেশের ইতিহাসে লেখা আছে— এ আমার দুর্ভাগ্য! না, আমি হতভাগ্য! এই ভয়ংকর বীভৎস ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছিল আমাকে৷ এর আগেও অবশ্য আরও একটা ঐতিহাসিক দুর্ভিক্ষের কথা আমার মতো অনেকেই বইয়ে পড়েছেন৷ সেটা ছিয়াত্তর-এর মন্বন্তর নামে পরিচিত৷ আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে, এই দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর এই বঙ্গদেশেই দেখা গিয়েছিল৷ সময়টা ছিল ইংরেজি ১৭৭০ সাল৷ আর, বঙ্গাব্দ ১১৭৬৷ তাই সেই দুর্ভিক্ষের নাম ‘ছিয়াত্তর-এর মন্বন্তর’৷

 আমাদের সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর লেখাতে এই ছিয়াত্তর-এর মন্বন্তরের কথা উল্লেখ করেছেন৷ শুধু বঙ্কিমচন্দ্রই বা কেন, বহু ঐতিহাসিকের লেখাতেও এ-নিয়ে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ আছে৷

 এরকমই হয়! কী কথা বলতে কী কথা এসে যায়৷ বলছিলাম ১৯৪২-’৪৩ সালের বাজারদর নিয়ে কথা৷ এসে গেল এই বঙ্গদেশের দু-দুটো ঐতিহাসিক মন্বন্তরের কথা৷

 সে যাই হোক৷ এখন যে আমাদের দেশে অতিমারির আবহ চলছে, আমাদের দেশেই বা বলছি কেন, কোভিড-১৯, এই মহামারি তো আজ সারা বিশ্বজুড়ে এক ভয়ংকর আবহাওয়া বা আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে৷ পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগে পড়েছেন, কত তাড়াতাড়ি এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করা যায়৷ আশা করি, শীঘ্রই এই রোগের ওষুধ বেরিয়ে যাবে৷ কিন্তু, ইতিমধ্যেই যে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন— সে দুঃখ আমরা রাখব কোথায়! ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, সেই অচেনা, অজানা, অনাত্মীয় দেশি-বিদেশি মানুষগুলির পরলোকগত আত্মা যেন শান্তি পায়৷

 এই প্রসঙ্গে অনেক কথাই আজ মনে পড়ে যাচ্ছে, বা বলতে ইচ্ছে করছে৷ আমাদের বাংলার এক কবি বলেছেন, আমরা ‘মন্বন্তর আর মারি’ নিয়েই এখানে বাস করি৷ কথাটা খুবই সত্য৷ কারণ, মানুষ যুগে যুগে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মারি নিয়েই বাস করে আসছে৷ এই তো সেদিন পর্যন্ত টিবি-কে বলা হত রাজরোগ৷ অর্থাৎ টিবি, যক্ষ্মা বা ক্ষয়রোগ, যাই বলি না কেন— যতদিন এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে অসহায় ভাবে প্রাণ দিতে বাধ্য হত৷ কেবল ধনী লোকরাই তাদের আত্মীয়-স্বজনদের এই রোগ হলে ভালোমন্দ খাইয়ে, কিছুদিনের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন৷ তা ছাড়া এ-রোগের পরিণতি মৃত্যু ব্যতিরেকে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না৷ ১৯৪৫ সালে এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের পর টিবি এখন তো এই পৃথিবী থেকেই নির্মূল হয়ে গিয়েছে৷ কোভিড-১৯-এর পরিণতিও তাই৷ অর্থাৎ আজ নয়, কাল এই অতিমারিও পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে৷

 তবে কোভিড-এর দিন যে শেষ হয়ে এসেছে, সে-বিষয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই৷ সাম্প্রতিক খবরা-খবর তো সে-কথাই বলছে৷

 কিন্তু, তারপর! এখনও বহু প্রাণঘাতী রোগ মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ যেমন ক্যানসার৷ যেমন হার্ট-অ্যাটাক৷ তবে, পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকলেই প্রতিনিয়তই নতুন নতুন রোগের সম্মুখীন হতে হবে মানুষকে৷ অতএব রোগ এবং তার প্রতিষেধক নিয়ে বিজ্ঞানীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতেই থাকবে৷ এরই সঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে— আজ পৃথিবী প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন যেভাবে দূষিত হয়ে চলেছে— এই মুহূর্তে মানুষের কর্তব্য পৃথিবী যাতে দূষণমুক্ত হয়, তারই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া৷

 আমার এই জীবদ্দশাতেই তো দেখলাম, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, প্লেগ এবং নানা রোগ প্রায় মহামারির মতো দেখা দিত— এই কলকাতা শহরেই দেখেছি— উপযুক্ত ওষুধের অভাবে কত লোককে মরতে৷

 আমি মনে করি, মানুষ থাকলেই পৃথিবীতে নানারকম নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে৷ আবার নতুন নতুন ওষুধের আবিষ্কার ঘটবে প্রতিষেধক হিসেবে৷ এ খেলা চলতেই থাকবে৷

 এই যে নানারকম রোগের কথা উঠতে, একটা বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করতে ইচ্ছে হচ্ছে৷ আমাদের যৌবনকালে দেখতাম পাড়ায় পাড়ায় কত ব্যায়াম সমিতি ছিল৷ ছেলেরা সেইসব সমিতি বা ক্লাবে গিয়ে দেহচর্চা করত৷ শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি তরুণরা অত্যন্ত সচেতন ছিল৷ ওইসব ব্যায়াম সমিতি বা ক্লাবে একজন করে বিখ্যাত ব্যায়ামবিদদের ইন্সট্রাকটর হিসেবে নিয়োগ করা হত৷ তাঁরাই ব্যায়াম শেখাতেন৷ যেমন, মনোতোষ রায়, মনোহর আইচ, কমল ভাণ্ডারী কিংবা বিষ্ণু ঘোষ৷ বলাই বাহুল্য এঁরা প্রত্যেকেই বিশ্ববিখ্যাত ব্যায়ামবিদ৷ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন৷ এঁরা সকলে বেতনভুক ছিলেন তা কিন্তু নয়৷ কেউ কেউ মাস্টারমশাই হিসেবে ওইসব ব্যায়াম সমিতি বা ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন৷ কিন্তু, অনেকেই বিনা পারিশ্রমিকেই, স্বেচ্ছায়, অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে দায়িত্ব নিতেন এবং সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতেন৷ এছাড়া সে-সময় কুস্তি প্রতিযোগিতার একটা চল ছিল৷ জায়গায় জায়গায় কুস্তির আখড়া ছিল৷ সবাই কেমন স্বাস্থ্যচর্চায় ব্যস্ত থাকত৷ বড়োদের বা বয়স্কদেরও দেখেছি বাড়িতেই তারা সকলে মুগুর ভাঁজত, ডন-বৈঠক দিত৷ ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়ামেরও বেশ চল ছিল৷

 এখনও যে নেই তা নয়৷ তুলনায় সেরকম রমরমা ভাবটা আর চোখে পড়ে না৷

 নিজের কথা বলতে গেলে বলতে হয়— এই বয়সে তো আর ব্যায়াম করার প্রশ্ন ওঠে না৷ তবে শরীরের যত্ন আমি নিই৷ সেটা একটু অন্যভাবে৷ যেমন, খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে একটু বাছবিচার করে চলা৷ যেমন, আমি অনেক দিন আগেই মাছ-মাংস খাওয়া ত্যাগ করেছি৷ সেটাও অত্যন্ত পরিমিত ভাবে৷ যেমন সকালে, খুব ভোরবেলায়, একটু অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়৷ ঘুম থেকে উঠে নিজের হাতে তৈরি করা দুধ ছাড়া এক কাপ চায়ের সঙ্গে দুটো বিস্কুট খাই৷ এর পর আর ঘুম নয়৷ সকাল ন’টার সময় প্রাতরাশ৷ প্রাতরাশ কথাটা শুনতে খুব রাশভারী শোনায়৷ আসলে, থাকে সামান্য একটু ছাতু, ছোলার ছাতু৷ একটা কী দুটো কাঁঠালি কলা৷ ইচ্ছা হলে, কখনো-সখনো এর সঙ্গে থাকে দুধ ছাড়া লিকার চা এক কাপ৷

 এরপর আমার টুকটাক কাজ থাকে৷ থাকে কিছু পড়াশোনাও৷ লোকজন আসে, টেলিফোন আসে৷ সেখানে কথাবার্তা বলতে হয়৷ তার জন্যেও অনেকটা সময় কেটে যায়৷ দুপুর ১টার মধ্যে স্নানটান শেষ হয়ে যায়৷ কোনো কোনো দিন একটু আগে-পরেও হয়ে যায়৷ তারপরেই দুপুরের খাওয়া৷ মাছ-মাংসের কথা আগেই বলেছি৷ ওসব ত্যাগ করেছি অনেক দিন আগে৷ দুপুরের খাওয়াও খুব সাদাসিধে৷ আমি স্বল্পাহারী৷ আহারে থাকে সামান্য একটু ভাত, ডাল, শাকভাজা৷ যে-কোনো শাক এবং টাটকা সবজির একটা তরকারি৷ তবে, একটা কথা এখানে বাদ পড়ে গিয়েছে৷ প্রাতরাশের সঙ্গে থাকে একটা সন্দেশ৷

 আমার ঘুম খুব কম৷ দুপুরে প্রায় জেগেই থাকি৷ বইপত্র পড়ি৷ খবরের কাগজ পড়ি৷ কেউ সংগ্রহশালায় এলে তাঁর সঙ্গে কথা বলি৷ এইভাবেই দিনটা কেটে যায়৷ রাত্রেও সেই হালকা একটু খাওয়া৷ রাত্রে ভাত নয়৷ রুটিই বরাবরের পছন্দ৷ ওই এক থেকে দেড়খানা৷ বড়ো জোর দু’খানা৷ এখনও নিজের কাজ যতটা পারি নিজেই করার চেষ্টা করি৷ প্রয়োজন না থাকলেও নিজের কাজটুকু নিজেই করতে ভালোবাসি৷ আসলে বয়স তো হয়েছে! সেই অনুপাতে কাজের পরিমাপ বা পরিমাণ— সবটাই আমাকে দেখে, ভেবেচিন্তে করতে হয়৷

 তবে, একটা কথা বলতে আমার ভালো লাগছে— সংগ্রহশালার দেখভালের কাজটা এখনও নিজের হাতেই করি৷ অর্থাৎ, ঝাড়পোঁছ অথবা সাজানো-গোছানোর কাজটা৷ অনেকে দেখতে আসেন৷ দর্শকদের বোঝাবার সময়, এক জায়গার জিনিস অন্য জায়গায় চলে যায়৷ সেগুলোকে আবার যথাস্থানে রাখার কাজটা আমি নিজের হাতে করতেই পছন্দ করি৷ এক্ষেত্রে অন্যের সাজানোটা আমার ঠিক পছন্দ হয় না৷ এখন, এই করোনার আবহে বাড়ি থেকে বাইরে বেড়াতে যাচ্ছি না৷

 আগে নিয়মিত সকালের দিকে প্রয়োজন না থাকলেও একটু বাড়ির বাইরেটা ঘুরে আসতাম৷ কখনও শ্যামবাজারে, কখনও আবার হাতিবাগান বাজারে৷ খারাপ লাগছে৷ পরিচিত মুখগুলোর মুখোমুখি হওয়া যাচ্ছে না বলে৷ এ-পাড়ার সবাই আমাকে চেনে৷ এ-পাড়ায় বলি কেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যখন হাতিবাগানের দিকে যাওয়ার পথে— সকলেই চেনা মুখ৷ মুখোমুখি হলেই তারা জিজ্ঞেস করত, ‘নকুদা কেমন আছ’!

 এখন আর সেই কথাটা শোনার কোনো অবকাশ নেই৷ এখন সারা দিনরাত্রি ঘরবন্দি৷ ঘরে বসে আছি৷ তবু মুখে মাস্ক নিয়ে৷ মাঝে মাঝে ভাবি, যা হয় হোক, আর ভালো লাগছে না৷ এবার বেরিয়ে পড়ব৷ কিন্তু, কথা যে বলব— সকলেরই তো মুখ বন্ধ! মুখ বাঁধা থাকলে কি প্রাণ খুলে কথা বলা যায়! আশা করি এই অবস্থার অদূরেই অবসান ঘটবে৷ মাস্ক ছাড়া মুখ কথা বলে উঠবে, ‘নকুদা, কোথায় ছিলেন এত দিন? কেমন আছেন’!

 বিশ্ববিধাতার সাজানো-গোছানো প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষ তার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যেভাবে আজ ধ্বংস করে চলেছে, যেভাবে তার ভারসাম্য নষ্ট করে চলেছে এবং এই সুন্দর পৃথিবীকে এক ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, অদূর অতীতেই কিন্তু এমনটা ছিল না৷ দেখি, আজকের যে-কোনো উৎসব-অনুষ্ঠানের মধ্যেই কেমন যেন একটা বিশৃঙ্খলার ভাব৷

 আমাদের ছোটোবেলায় কিন্তু এরকমটা ছিল না৷ সে ছোটো কিংবা বড়ো যে-কোনো উৎসবই হোক না কেন! কালীপুজো, বিশ্বকর্মা পুজো, সরস্বতী পুজোর মতো পুজোপার্বণগুলোকে মনে হত যেন এক-একটা পারিবারিক উৎসব৷

 ছোটোবেলায় দেখেছি আজকের মতো যেখানে-সেখানে একটু জায়গা পেলেই কালীপুজো কিংবা সরস্বতী পুজো হত না৷ বারোয়ারি সরস্বতী পুজো খুব কম দেখেছি৷ স্কুল-কলেজের সরস্বতী পুজোই ছিল৷ এবং কিছু পুজো ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে৷ আজকের মতো যত্রতত্র এইসব পুজোকে কেন্দ্র করে কান ফাটানো শব্দে মাইক বাজানোর চল ছিল না৷

 কলকাতায় বিশ্বকর্মা পুজোর বিশেষ আকর্ষণ ছিল ঘুড়ি ওড়ানো৷ বিশ্বকর্মা পুজোর মাসখানেক আগে থেকেই কলকাতার আকাশে নানান রং-বেরঙের ঘুড়ি উড়তে দেখা যেত৷ অলিতে-গলিতে দেখা যেত সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার ধুম৷ বিশ্বকর্মা পুজোর দিন কলকাতার আকাশ নানা রঙের, নানা নামের ঘুড়িতে ছেয়ে যেত৷ ছাদে ছাদে শুধু ছেলেছোকরারা নয়, গৃহকর্তারাও তাদের সঙ্গে যোগ দিতেন৷ কত রকম সেসব ঘুড়ির নাম৷ পেটকাটা, ঘয়লা, মোমবাতি, ময়ূরপঙ্খি, মুখপোড়া, শতরঞ্চি, চাঁদিয়াল ইত্যাদি ইত্যাদি৷ মাঝে মাঝে এ-বাড়ির ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে কাটা ঘুড়ির সুতো গোটাতে ব্যস্ত! কোনো রেষারেষি নয়, দ্বেষাদ্বেষি নয়, চারিদিকে একটা সম্প্রীতির আবহাওয়া৷

 শুধু বিশ্বকর্মা পুজো নয়৷ সব উৎসবেই এই একই বাতাবরণ৷ সরস্বতী পুজোর দিন সকাল থেকেই দেখতাম, হলুদ রঙে ছাপানো শাড়ি পরে ছোটো ছোটো মেয়েরা দল বেঁধে নিজ নিজ স্কুলের উদ্দেশে যাচ্ছে৷ তখন সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকত৷ এখনও থাকে৷ কিন্তু সেদিনের সেই শৃঙ্খলা, আনন্দের সেই মধুর উত্তাপ আজ মনে হয় আর নেই৷ কারণ, চারিদিকে এত শব্দ (মাইকের আওয়াজ, মানুষের চিৎকার-চ্যাঁচামেচি) কেমন যেন একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে৷ সব আনন্দকে পণ্ড করে দেয়৷ আবার আমিই হয়তো ভুল, আমিই হয়তো সময়ের সঙ্গে, যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছি না৷ কালীপুজোর কথায় আসি৷ আমাদের ছোটোবেলায়, অর্থাৎ তিন, চার, পাঁচ এমনকি ছয়ের দশকেও দেখেছি, পুজোতে আজকের মতো এত আলোকসজ্জার রমরমা ছিল না৷ বাজি পুড়ত ঠিকই৷ কিন্তু শব্দবাজিরও এত রেওয়াজ ছিল না৷ রংমশাল, ফুলঝুরি, সাপবাজি এবং হাউই অবশ্য ছিল৷ আর ছিল, এখন যেটা উঠে গিয়েছে, ছুঁচোবাজি৷ বড়ো বিরক্তিকর! তবে, এটাও ঠিক, বারোয়ারি কালীপুজো সে-সময় খুব একটা ছিল না৷

 আইন করে শব্দবাজি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে৷ কিন্তু শব্দকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি৷ বিশেষ করে, ছোটো-বড়ো যে-কোনো পুজোর বিসর্জনের সময় দেখা যায়, মাইক বাজিয়ে, ডিজে বাজিয়ে শোভাযাত্রা যাচ্ছে৷ কান ফাটানো আওয়াজ৷ মানুষের শরীরের ক্ষতি তো করছেই, এমনকি পরিবেশকেও রীতিমতো দূষিত করে ছাড়ছে৷

 দোল খেলার মধ্যেও সেদিন একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ আবহাওয়া বিরাজ করত৷ আজকের মতো রং মেখে, রাস্তাঘাটে নেশা করে অসুস্থ পরিবেশ কেউ সৃষ্টি করত না৷

 তিন থেকে ছয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার দুর্গাপুজো সম্বন্ধে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রতিমা শিল্পে এই সময়টা ছিল বিপ্লবের যুগ৷ এই সময়ে প্রতিমা-শিল্পে নানা বিবর্তন দেখা যায়৷ পুরোনো শিল্প-ভাবনাকে ভেঙেচুরে তাতে নতুনত্বের ছাপ আনা হয়৷ অজন্তা-ইলোরা, খাজুরাহো, কোনার্ক-এর মূর্তির আদলে দুর্গাপ্রতিমার গড়নে একটা নতুনত্ব আনা হয়৷ তা ছাড়া বিখ্যাত মৃৎশিল্পীরা, নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে দুর্গা প্রতিমার রূপের পরিবর্তন ঘটান৷ অর্থাৎ একটা নতুন শিল্পধারার সৃষ্টি হয়৷ সাধারণভাবে তখন যাকে বলা হত, আর্টের ঠাকুর৷ কলকাতার দুর্গাপ্রতিমা-শিল্পে সেদিন যে বিপ্লব দেখা গিয়েছিল, সেই ধারা এখনও চলছে৷

 টুকরো টুকরো স্মৃতি, টুকরো টুকরো ঘটনার ছবি হঠাৎ হঠাৎ মনের আয়নায়, চোখের সামনে দোলা দিয়ে যায়৷ এই মুহূর্তে যেমন অস্ট্রেলিয়া নিবাসী বন্ধুটির কথা মনে পড়ছে৷ তার BMW মোটর সাইকেলে চেপে অমরকন্টক, খাজুরাহো এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করার স্মৃতি কোনো দিন ভুলব না৷ সেই রকম স্মৃতির কুঠুরিতে বাসা বেঁধে আছে আদিবাসী সাঁওতাল কন্যাদের নাচগানের দৃশ্য, বিবাহ অনুষ্ঠান, তাদের আচার-আচরণ৷ আর সেই সাঁওতাল কন্যাদের খেতে আল ধরে যাওয়ার সময় যে দেহভঙ্গি তা কোনো দিন ভুলতে পারব না৷ নৃত্য নয়, তবু যেন নিঃশব্দে নৃত্যের একটা ছন্দ হৃদয়কে দুলিয়ে দিয়ে যায়৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *