“আমি দেখব”
শোন, আমি যা বলছি, ভাল করে শোন। রাতে রাখালকে দেবে ছখানা রুটি, লাটুকে পাঁচখানা, বুড়ো গোপাল আর বাবুরামকে চারখানা করে। এই যা বললুম, এর যেন অন্যথা না হয়। চাইলেও দেবে না।
কড়া নিয়ম! দুপুরে বারুদঠাসা, রাতে সামান্য। ভরপেট খেলে জপধ্যান করবে কি করে, বসে বসে ঢুলবে!
ঠাকুর নহবতের সামনে দাঁড়িয়ে মাকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আর মা আটা ঠেসতে ঠেসতে শুনে যাচ্ছেন। সাধক, আত্মভোলা, ভাবমুখী শ্রীরামকৃষ্ণ এখন ভয়ঙ্কর এক গুরু। আধ্যাত্মিক জগতের অনমনীয় এক অধ্যক্ষ। নিজের একটি ব্রিগেড তৈরি করছেন অভিজ্ঞ মেজর জেনারেলের দক্ষতায়। আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নির্দোষ একটি জমায়েত। সাধন হয়, তাও বড় রকমের কিছু নয়। ঢাক নেই, ঢোল নেই, হোম নেই, আহুতি নেই, মন্ত্রোচ্চারণের রাজকীয়তা নেই। ছোট্ট ঘরখানির এক কোণে কয়েকজন, কয়েকজন পঞ্চবটীতে। অনর্গল ধর্মপ্রসঙ্গ, অবিরল গান, কখনো-সখনো নৃত্য। ধর্ম কোন একটি বিশেষ ধর্ম নয়, সর্বধর্মের সারতত্ত্বের সরল আলোচনা। পণ্ডিতে পণ্ডিতে জ্ঞানের অসিযুদ্ধ নয়। উপলব্ধিই ধর্ম। বোঝানো যায় না, বোঝা যায়। উপমার রাজা উপমাটি কেমন দিলেন— স্বামীর সোহাগ কেমন, সে কি বলে বোঝানো যায়! বিয়ে হোক তখন বুঝবে!
ছোট্ট ঐ ঘরখানি একটি ল্যাবরেটরি। বৈজ্ঞানিক শ্রীরামকৃষ্ণ ওখানে ভবরোগের একটি টিকা তৈরির কাজে ব্যস্ত। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করে মানুষের পরমায়ু বাড়িয়ে দিয়েছেন, ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ আবিষ্কার করলেন ধর্ম। সে আবার কি কথা! ধর্ম আবিষ্কার করলেন মানে? আগে ধর্ম ছিল না? অবশ্যই ছিল, ঠাকুর আমাদের জীবনে ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। স্বামীজী বললেন : “স্থাপকায় চ ধর্মস্য”–ধর্মকে স্থাপন করলেন। আরেকটু সাহস করলে বলা যায়, ধর্মের শেষ জীবনের শুরু। ধর্মজীবন আর গার্হস্থ্যজীবনের যে বিরাট ব্যবধান ছিল, এই অবাক করা অবতার তা ঘুচিয়ে দিলেন। সংসার ত্যাগ করে গুহাবাসী হতে হবে না। নির্জলা উপবাসের প্রয়োজন নেই। শিখা, তিলক ধারণ করে, গলায় আড়াই মণ রুদ্রাক্ষ, তুলসী, স্ফটিকের মালা ঝুলিয়ে বাঘছালে বসার প্রয়োজন নেই। সাধন হবে মনে, বনে, কোণে। গেরুয়া ভিতরে ধারণ, বৈরাগ্য অন্তরে সাধন। ইষ্টের প্রতিষ্ঠা হৃদয়মন্দিরে-’ভক্তের হৃদয় ভগবানের বৈঠকখানা’। কোন ভড়ং, পাঁজি-পুঁথির প্রয়োজন নেই; বেদ-বেদান্ত, গীতা, উপনিষদ্–তাও না। শুধু একটু বিশ্বাস, একটু সত্যের ওপর আঁট, একটু ব্যাকুলতা, একটু জ্ঞান—ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। পুরোমাত্রায় সংসারী, কেবল মাঝে মাঝে নির্জনে সরে গিয়ে দেখে নেওয়া—বিশ্বাস ধরা আছে কিনা। নিক্তির নিচের কাঁটা আর ওপরের কাঁটা এক হয়ে আছে কিনা! তাহলেই হবে। কারণ, “চাঁদামামা সকলের মামা।” যে যা আছ তাই থাক, যেখানে আছ সেখানেই থাক। যেটাকে চুরমার করতে হবে সেটা হলো অহঙ্কার। ‘কাঁচা আমি’কে ‘পাকা আমি’ করতে হবে। “নাহং নাহং তুঁহু তুঁহু।”
শুধু জীবন নয়, ধর্মজীবন। সংসার নয়, সংসারধর্ম। ধর্মকে ধারণ করে সংসারী হওয়া যায়, সন্ন্যাসীও হওয়া যায়। সন্ন্যাসীর ধর্ম হলো বহুজনহিতায়। স্বামীজী তীব্র ভাষায় বললেন : “ধর্মের রহস্য তত্ত্বকথায় নয়-আচরণে। সৎ হওয়া এবং সৎ কাজ করা—তার মধ্যেই সমস্ত ধর্ম। যে শুধু ‘প্রভু প্রভু’ বলে চিৎকার করে সে নয়, যে ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করে সে-ই ঠিক ঠিক ধার্মিক।” এইবার ধার্মিকের চরিত্র বলছেন স্বামীজী : “পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ। শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম। দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ। স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ। অপরকে ভালবাসাই ধর্ম, অপরকে ঘৃণা করাই পাপ। ঈশ্বরে ও নিজ আত্মাতে বিশ্বাসই ধর্ম, সন্দেহই পাপ। অভেদ- দর্শনই ধর্ম, ভেদ-দৰ্শনই পাপ।”
এই পরিবর্তন আসবে কিভাবে? আয় বললেই তো আসবে না! ঠাকুর বলছেন, আগে অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বাঁধ, তারপরে নামো সংসারে। তোমার ‘গেল গেল, মলুম মলুম’ আর্তনাদ থেমে যাবে। তোমার বোধ হবে——এই সংসার মজার কুঠি’। ঠাকুর তাঁর ছোট্ট পরীক্ষাগারে তৈরি করছিলেন ভবরোগের পেনিসিলিন—বিবেক-হলদি, আর ট্রেনিং দিচ্ছিলেন তাঁর বাছাই করা যুবকদের, যাঁরা বেয়ারফুট ডকটসদের মতো জনজীবনে ছড়িয়ে পড়বেন শুধু ধর্ম নয়—জীবনধর্ম, সংসারধর্ম শেখাতে। সন্ন্যাসী আর গৃহী উভয়েরই প্রয়োজন আছে। তা নাহলে কোথায় আসবেন ব্যাস, বাল্মীকি, গৌতম বুদ্ধ, চৈতন্য, শঙ্কর, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ, নরেন্দ্রনাথ? সৎ পিতা-মাতা ছাড়া মহা মহা সন্ন্যাসীরা কোথায় অবতীর্ণ হবেন?
ঠাকুরের বিবেক-হলদি এক মহামলম। সংসার-জলধিতে হাঙর-কুমির অনেক, সেখানে ক্ষতবিক্ষত না হতে চাইলে সাঁতরাতে হবে বিবেক-হলদি গায়ে মেখে। অন্তরে বিবেকের প্রতিষ্ঠাই হলো ইষ্ট প্রতিষ্ঠা। বিবেকই গুরু। তিনি লণ্ঠনধারী গার্ডসাহেব। সকলের ওপর আলো ফেলেন, সেই আলোতে সব দেখা যায়, চেনা যায়, কিন্তু গার্ডসাহেবের মুখ দেখা যায় না। তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানতে মানতে একসময় মন থেকে ভেদবুদ্ধিটা চলে যায়, তখন তুমি আর আমি এক। এরই নাম অদ্বৈতজ্ঞান। হনুমানের সেই দর্শন, রামচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন : “তুমি আমাকে কি চোখে দেখ?” হনুমান বললেন : “যখন আমার দেহবোধ থাকে তখন দেখি তুমি প্রভু আর আমি দাস, আর যখন জীববুদ্ধি থাকে তখন দেখি তুমি পূর্ণ আর আমি অংশ, আর যখন আমার আত্মাবোধ থাকে, তখন দেখি তুমি আর আমি এক।” এই একত্বের বোধ দেহধারী মানুষে সহজে আসবে না, তাই ঠাকুর বলছেন : “থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে।”
ঠাকুর বলছেন, সন্ন্যাসীকে যেভাবেই হোক যো-সো করে উপলব্ধিতে যেতেই হবে। ব্রহ্মানুভূতি। চাপরাশ তাকে পেতেই হবে, তা নাহলে সে শিক্ষা দেবে কেমন করে? ঠাকুরের মুখে কিছু আটকাত না! উপলব্ধি না হয়েই শিক্ষাদান! বললেন, সে কেমন? না, ‘হেগো গুরুর পেদো শিষ্য। ‘ শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরানা অতি কঠোর। কৃচ্ছ্রসাধন নয়, মননে, ধ্যানে এবং ধারণায়। এই হলো ‘মডার্ন রিলিজন’-এর সূত্রপাত। দক্ষিণেশ্বরের সেই ছোট্ট ঘরখানি। উনবিংশ শতক। ভোগবাদ এবং নাস্তিকতার ঢেউ। প্রচ্ছন্ন, একক, অজ্ঞাত এক মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তৈরি করলেন ধর্মের আধুনিক রূপ। সনাতন ধর্মই থাকবে, তবে শ্রীরামকৃষ্ণের পথে সাধনটা হবে অন্যরকম। কেউ জানবে না, ধীরে ধীরে ন্যাবা, জন্ডিস, বি হেপাটাইটিস ভেতরে ভেতরে চারিয়ে যাবে। ১ জানুয়ারি বলতেই তো পারতেন—তোমাদের ইষ্টলাভ হোক। তোমাদের ধর্ম হোক। বললেন : “তোমাদের চৈতন্য হোক।” অন্তরের আলোয় নিজেকে আগে চেন। দেবতা হতে না পার, নরপশু হয়ে যেয়ো না। সে-সম্ভাবনা কিন্তু অতি প্রবল! কাম আর কাঞ্চন কলির মায়া। সাবধান! যাওয়ার নয়, ‘মোড় ঘুরিয়ে দাও’।
ঠাকুর রুটির কোটা বেঁধে দিলেন। এইবার আমাদের মা কি করলেন? তিনি যে অবতারের শক্তি, তিনি তো কারো পরোয়া করেন না, তিনি যে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের জননী হবেন! ঠাকুরের শাসন যতটা কড়া, মায়ের মাতৃত্ব ঠিক ততটাই কোমল। ছখানা, চারখানার হিসেব ভেসে গেল! যার যেমন খিদে সে সেইরকমই খেতে লাগল। ঠাকুর হলেন উত্তম বৈদ্য। আদেশ পালিত হচ্ছে, না হচ্ছে না—খোঁজ নিলেন কয়েকদিন পরেই। বাবুরামকে ধরলেন : রাতে কখানা? চারখানা? -আজ্ঞে না, বেশি। সে কি, বেশি কেন?—মা বলেছেন, ভরপেট। খিদে না মেটা পর্যন্ত গরম গরম
ঠাকুর চটি গলিয়ে ছুটলেন মায়ের দরবারে-কি ব্যাপার, তুমি যে বড় আমার কথা শুনলে না, তোমার স্নেহের চোটে আমার ছেলেদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে বসেছে!
ঘোমটার আড়াল থেকে মায়ের স্পষ্ট উত্তর : “ও দুখানা বেশি রুটি খেয়েছে বলে তুমি অত ভাবছ কেন? তাদের ভবিষ্যৎ আমি দেখব। তুমি ওদের খাওয়া নিয়ে কোন গালাগালি করো না।”
ঠাকুরের মুখে কোন কথা নেই। থতমত খেয়ে গেলেন। সারদা-শক্তি উদিত হচ্ছে।ঠাকুর তুমি গোখরো সাপ হতে পার, সেই সাপকে খেলাবার মন্ত্র কিন্তু আমার মায়ের হাতে! নরেন্দ্রনাথ সেটি জানতেন।