আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো

আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো 

এক.

 জানিস দোস্ত, কাল না কঠিন একটা পাপ করে ফেলেছি। রুমে কেউ ছিল না, দরজাটা বন্ধ করে, অনলাইনে গিয়ে… ভাই থামুন! আর কথা বাড়াবেন না। আপনার যে পাপের কথা আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো কাকপক্ষীও টের পায়নি, আপনার যে পাপ মানুষের কাছ থেকে আল্লাহ গোপন রেখেছিলেন, সেটা আপনি নিজে সকলের সামনে প্রকাশ করে দিয়ে নিজের কী সর্বনাশ করছেন জানলে, আক্ষেপে মাথার চুল একটা একটা করে ছিঁড়ে চান্দু হয়ে যেতেন তবুও আক্ষেপ ফুরাত না। রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

“আমার সকল উম্মত মাফ পাবে, তবে প্রকাশকারী ব্যতীত। আর নিশ্চয় এ বড়ই ধৃষ্টতা যে, কোনো ব্যক্তি রাতে অপরাধ করল যা আল্লাহ্ গোপন রাখলেন। কিন্তু সে ভোর হলে বলে বেড়াতে লাগল, হে অমুক! আমি আজ রাতে এমন এমন কর্ম করেছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত অতিবাহিত করল যে, আল্লাহ্ তার কর্ম গোপন রেখেছিলেন, আর সে ভোরে উঠে তার ওপর আল্লাহর পর্দা খুলে ফেলল।” 

(সহিহ বুখারি :৫৭২১) 

আরেকটি বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহ্ হাশরের ময়দানে ফেরেশতাদের বলবেন যাও আমার অমুক অমুক বান্দাকে ডেকে নিয়ে এসো। ফেরেশতাগণ বান্দাদের নিয়ে এসে আল্লাহ সামনে দাঁড় করিয়ে দেবেন। আল্লাহ্ বান্দাদের বলবেন, হে আমার বান্দা! আমার কাছে এসো। বান্দা আল্লাহর কাছে এসে দাঁড়াবে, আল্লাহ্ বান্দাকে আরও কাছে ডাকবেন। বান্দা আল্লাহর আরও কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। এভাবে বান্দা আল্লাহর এত কাছে চলে যাবে যে, সে নুর দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে যাবে। আল্লাহ্ এবং তার মাঝে শুধু একটা পর্দা থাকবে। কোনো ফেরেশতা তাকে আর দেখতেও পাবে না, শুনতেও পাবে না আল্লাহ্ এবং বান্দার কথোপকথন। শুধু আল্লাহ্ আর তাঁর বান্দা। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে বলবেন, “ইয়া আবদি, দেখো তোমার আমলনামা, তুমি নিজেই দেখে পৃথিবীতে কী করে এসেছ তুমি।” বান্দা তার আমলনামায় চোখ বুলাবে–শুধু পাপ আর পপি, রাশি রাশি পপি। আল্লাহ্ বলবেন, ইয়া আবদি, তুমি কি জানতে না, তুমি গোপনে যে কাজ করো আমি সেটাও দেখতে পাই? তুমি কি জানতে না, একদিন তোমাকে আমার সামনে দাঁড়াতে হবে? তুমি কি জানতে না, একদিন আমি তোমার সব কাজের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করব? বান্দা উত্তর দেবে, “ইয়া রব্ব! আমি জানতাম, জানতাম… আমি জানতাম। আল্লাহ্ বলবেন, তাহলে কেন তুমি এ কাজগুলো করেছিলে? বান্দা উত্তর দেবে, ইয়া রব্ব! আপনার সামনে এ পাপের বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে আমার বিচার করার চেয়ে আমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা আপনার জন্য অনেক সহজ। 

আল্লাহ্ বলবেন, পাতা উল্টাও, পরের পৃষ্ঠায় যাও। বান্দা পরের পাতায় গিয়ে দেখবে পুরোটাই আগের চেয়েও জঘন্য গুনাহ দ্বারা পরিপূর্ণ। এভাবে সে পুরো আমলনামার পাতায় চোখ বুলোবে। প্রত্যেক পাতাতেই আগের পাতার চেয়ে আরও বেশি, আরও জঘন্য গুনাহ দেখতে পাবে সে। বান্দা প্রচণ্ড মন খারাপ করে ফেলবে। প্রচণ্ড হতাশ হয়ে সে ভাববে, আমাকে আল্লাহ্ নিশ্চয়ই এখন জাহান্নামের আগুনের গর্তে ফেলে দেবেন। আমি তো ভালো আমলও করেছিলাম, কিন্তু সেগুলো আমার কাজে এল কই? আমার পাপই আমাকে ধ্বংস করে ছাড়ল! আল্লাহ্ বান্দাকে বলবেন, ইয়া আবদি! তুমি কেন তোমার পাপগুলো গোপন করে রেখেছিলে দুনিয়ার জীবনে? বান্দী জবাব দেবে, ইয়া রব্ব! আমি আমার পাপগুলো নিয়ে লজ্জিত ছিলাম। 

আল্লাহ্ বলবেন, তুমি কি দেখোনি পৃথিবীতে আমি তোমার পাপগুলো মানুষের কাছ থেকে গোপন রেখেছিলাম। এটা ছিল তোমার প্রতি আমার রাহমাহ। আজকেও আমি তোমার পাপগুলো মানুষের কাছ থেকে গোপন করে রাখব। (অন্য একটা বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ্ বলবেন, “দুনিয়াতে তুমি তোমার মুসলিম ভাইয়ের দোষ গোপন করে রাখতে, তাই আজকে আমিও তোমার দোষ গোপন করে রাখব।” আল্লাহ বন্দীকে বলবেন, এবার আমলনামার পাতা উল্টাও। 

আমলনামা খুলতেই বান্দার চোখ কপালে উঠে যাবে। পুরো আমলনামা জুড়েই শুধু ভালো কাজ। পাপকাজগুলোর কোনো চিহ্ন নেই। ফেরেশতারাও জানবে না যে, আল্লাহ্ বান্দার সমস্ত পাপ আমলনামা থেকে মুছে ফেলে ভালো কাজ দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছেন। অতঃপর বান্দাকে মাফ করে দেয়া হবে। ভাই আমার, পর্ন ভিডিও দেখা বা হস্তমৈথুন করা ছাড়তে না পারলেও চেষ্টা করুন এগুলো সবার কাছ থেকে গোপন করে রাখতে, আল্লাহ্ ছাড়া পাপের কোনো সাক্ষী না রাখতে। আল্লাহর দয়া হলে তিনি হয়তো আপনার এ গোপন পাপগুলো দুনিয়াতেও গোপন রাখবেন এবং হাশরের ময়দানেও গোপন রেখে আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন। অযথী সবাইকে বলে বেড়িয়ে কেন ক্ষমা পাবার এ সুযোগটা হারাবেন? বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে বসে পর্ন দেখে, মেয়েদের ফিগার বিশ্লেষণ করে বা কোনো কারণ ছাড়াই স্রেফ মজা করার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে কে কত পর্ন দেখে, কার কত গিগাবাইট কালেকশীন, কে কতবার হস্তমৈথুন করে এগুলো নিয়ে আলোচনা করে নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারবেন না, ভাই। একদিন আফসোস করতে হবে এসব “ফান” করার জন্য। কিন্তু তখন কিছুই করার থাকবে না। 

.

দুই.

কয়েক বছর আগে আমাদের দেশে একটা মাল্টিলেভেল বিযনেস কোম্পানি “ডেসটিনি” বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছিল, এরা যদিও চোর-বাটপার ছিল তবে এদের মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের কন্সেপ্টটা অসাধারণ ছিল। আপনি তাদের কোম্পানিতে যতজন লোক ঢুকাবেন তাদের প্রত্যেকের ইনকাম থেকে আপনি কিছু কমিশন পাবেন। আপনার মাধ্যমে যদি খুব বেশি লোক তাদের কোম্পানিতে জয়েন করে, তাহলে একসময় এমন অবস্থা হবে, কিছু না করেই আপনি মাসে আরামসে লাখ দুয়েক টাকা কামিয়ে ফেলবেন। বসে বসে পায়ের ওপর পা তুলে শুধু খাবেন আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবেন। 

সুবহানাল্লাহ, আল্লাহর সাথে বান্দার জান্নাত কেনাবেচার ব্যবসাতেও বান্দার পাপ পুণ্যের হিসাব অনেকটা এভাবেই করা হয়। মনে করুন, আপনার মাধ্যমে আল্লাহ্ কাউকে হেদায়াত দান করলেন। তারপর সেই ব্যক্তি যা যা নেক আমল করবেন সেখান থেকে আপনার সওয়াবের অ্যাকাউন্টে বেশ কিছু সওয়াব যোগ হয়ে যাবে (আমলকারী ব্যক্তিও তার আমলের পূর্ণ সওয়াব পাবেন। তার। ভাগের সওয়াব বিন্দুমাত্র কমবে না)। আবার আপনার কারণে কোনো ব্যক্তি যদি পাপ কাজে লিপ্ত হয়, আল্লাহর অবাধ্যতা করে, তাহলে সেই পাপ কাজের জন্য সে ব্যক্তি তো শাস্তি পাবেই সেই সাথে আপনাকেও তার সাথে শাস্তি ভাগাভাগি। করে নিতে হবে। হাদীসে এ রকম বর্ণনাই এসেছে।

“…যদি কোনো ব্যক্তি কোনো ভালো পথে আহ্বান করে, তবে যত মানুষ তার অনুসরণ করবে তাদের সকলের পুরস্কারের সমপরিমাণ পুরস্কার সে ব্যক্তি লাভ করবে, তবে এতে অনুসরণকারীদের পুরস্কারের কোনো ঘাটতি হবে না। আর যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিভ্রান্তির দিকে আহ্বান করে, তবে যত মানুষ তার অনুসরণ করবে তাদের সকলের পাপের সমপরিমাণ পাপ সে ব্যক্তি লাভ করবে, তবে এতে অনুসরণকারীদের পাপের কোনো ঘাটতি হবে না।” 

(সহিহ মুসলিম : ৬৯৮০)

আল্লাহ কুরআনে আমাদের স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করে দিয়েছেন আমরা যেন। পাপ কাজে একে অন্যকে সাহায্য না করি। আল্লাহ বলেছেন : 

“…তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অনেকে সাহায্য করবে। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করবে না।” 

(সূরা মাইদাহ; ৫:৫)

ভাই আমার, আপনার নিজের লাইফ স্টাইল সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখুন কীভাবে পদে পদে আল্লাহর এ আদেশ অমান্য করে চলছেন। জেনে অথবা না-জেনে বন্ধুদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বন্ধুদের হার্ডডিস্ক পর্ন ভিডিও দিয়ে বোঝাই করে দিচ্ছেন, তাদের সঙ্গে পর্ন ভিডিওর লিংক শেয়ার করছেন, আইটেম গার্লদের নিয়ে, ক্লাসের মেয়েদের নিয়ে রসালো আলোচনা করে তাদের মন বিষাক্ত করে দিচ্ছেন। বুকে হাত রেখে আজ একটা প্রশ্ন করুন তো নিজেকে। আপনি যে বন্ধুদের মাঝে এভাবে অশ্লীল জিনিসপত্র ছড়িয়ে দিচ্ছেন এতে আপনার কী লাভ হচ্ছে? সিরিয়াসলি, কী লাভ হচ্ছে আপনার? আপনি নিজে যখন ওইসব নিষিদ্ধ জিনিস দেখছেন তখন নিজে খুব বড় ধরনের পাপ করছেন কিন্তু “আদিম” মজাটাও পাচ্ছেন। কিন্তু আপনার সাপ্লাই করা পর্ন ভিডিও দেখে আপনার বন্ধুবান্ধবরা যখন তাদের লালসা মেটাচ্ছে তখন আপনার কী লাভ হচ্ছে? কোনো লাভই হচ্ছে না। 

কিন্তু আপনাকে কাঁধে নিতে হচ্ছে আপনার বন্ধুর করা পাপের ভারও। আপনার বন্ধুদের কাছ থেকে যতজনের কাছে আপনার দেয়া পর্ন ভিডিও বা আইটেম সং ছড়িয়ে পড়বে এবং যতজন যতবার তা দেখে “মজা” নেবে, আপনার অ্যাকাউন্টে তাদের করা পাপের ভাগ যোগ হতেই থাকবে। আপনি মজা-টজা কিছুই পেলেন না, কিন্তু শেষ বিচারের দিন দেখা যাবে পাহাড়-পরিমাণ পাপের মালিক হয়ে বসে আছেন। কেমন লাগবে তখন? এটা কি পাগলামি না? নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা না? একবার চিন্তা করুন তো, পৃথিবীতে শত শত গিগাবাইট পর্ন ছড়িয়ে দিয়ে দুম করে একদিন মারা গেলেন। তখন কী হবে আপনার? কবরে গিয়েও পাপ কামাতে থাকবেন। এ রকম পাগলামি করার কোনো মানে আছে? দুনিয়ার জীবন তো একটাই, তাই না? একে নিয়ে জুয়া খেলার কোনো মানে হয়? আপনি নিজে পর্ন ভিডিও দেখা ছাড়তে পারছেন না, চোখের হেফাযত করতে পারছেন না ভালো কথা। নিজে নিজে দেখুন, মজা নিন আর পাপ কামাতে থাকুন নিজ দায়িত্বে। কিন্তু ভুলেও এমন কোনো কাজ করবেন না, যাতে আপনার বন্ধুবান্ধব, আপনার চারপাশের সমাজের মানুষগুলোর মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে। খুব সাবধান! ফেইসবুকের কোনো একটা পোস্টে আপনার করা একটা ক্লিক বা কমেন্ট অথবা আপনার কোনো শেয়ার দেয়া লিংকের মাধ্যমে হয়তো আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা মানুষগুলোর মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে অশ্লীলতা। এ ব্যাপারগুলো নিয়েও সাবধান। হওয়া দরকার। 

অনেক মেয়েরাই ফেইসবুকে নিজেদের ছবি দেন। আপনারা হয়তো তেমন কিছু না ভেবেই এসব ছবি আপলোড দেন, অথচ আপনাদের এসব ছবি এক একটা ছোট অঙ্গীর, যেটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে একসময় পুড়িয়ে দিতে পারে কোনো বিশাল বন। আপনার ছবি দেখে যতজন ফিতনায় পড়বে, যতজন পাপে জড়াবে ততজনের পীপের ভাগীদার আপনাকেও হতে হবে। কী দরকার ফেসবুকে ছবি দিয়ে? কী দরকার বোন? “স্মরণ রেখ যারা কামনা করে মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার হোক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো 

{সূরা আন-নূর; ২৪:১৯)