আমি জানি যা হয়েছিল
১
বাইরে প্রবল শব্দে বাজ পড়ল। কোনওরকম অশনি সংকেত ছাড়াই হঠাৎ করে যেন গর্জন করে উঠল গোটা আকাশ। পরক্ষণেই চোখ ঝলসে দিয়ে নীলাভ আগুনের গোলা সশব্দে আছড়ে পড়ল মাটিতে।
জানলার কাচ প্রবল আওয়াজের ধাক্কায় মুহূর্তের জন্য থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। সেই কম্পন বুঝি আস্তে আস্তে এবার ছড়িয়ে পড়ছে দেওয়ালে দেওয়ালে। মসৃণ ক্রিম রঙের দেওয়ালের তলায় যেন ইটগুলোও কাঁপছে। শুক্লার মনে হল, শুধু বাজের আওয়াজ নয়, দেওয়ালে দেওয়ালে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আরও কিছু অস্ফুট শব্দ, যা সঠিকভাবে শ্রুতিগোচর হয় না! অদ্ভুত কিছু ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে তার চতুর্দিকে। তিনি শুনতে পাচ্ছেন, কিন্তু বুঝতে পারছেন না।
.
শুক্লা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন তার স্বামী প্রণবের দিকে। প্রণবকে এই অনুভূতির কথা আগেও অনেকবার জানিয়েছেন। বহুবার মনে হয়েছে, হঠাৎ করে ছুঁয়ে যাওয়া একপশলা হিমেল ঝোড়ো হাওয়া বুঝি ফিসফিস করে কিছু বলে গেল। অথবা ভোররাতের শিশির টুপটাপ করে বলে যায় কোনও এক রহস্যময় কাহিনী। জোনাকির সবুজাভ আলো অদ্ভুত ইঙ্গিতে বলতে চায় কিছু অপ্রকাশিত ইতিহাস যার খোঁজ মেলেনি আজও। কিন্তু সব কিছুই যেন রহস্যের কুয়াশায় মোড়া। ধরা দিয়েও অধরাই থেকে যায়। বড় অস্পষ্ট সে ইঙ্গিত। শুক্লা বুঝে উঠতে পারেন না, কিন্তু অনুভব করতে পারেন সে অলৌকিক উপস্থিতিকে। মনে হয় একজোড়া অদৃশ্য চোখ সবসময়ই নজর রাখছে তার ওপরে! কোনও ছায়া তাকে প্রতি মুহূর্তে নীরবে অনুসরণ করছে!
কিন্তু প্রণবকে বারংবার বলা সত্ত্বেও কোনও লাভ হয়নি। তিনি কিছুতেই কোনওরকম অতিলৌকিকে বিশ্বাস করবেন না, উলটে বলবেন, “সবটাই তোমার মনের ভুল। তুমি ঐ ওষুধগুলো একটু বেশিই খাচ্ছ। বেশিদিন ধরে অ্যান্টিডিপ্রেশান্ট ট্যাবলেট খেলে লোকে এমন উদ্ভট জিনিসই দেখে আর শোনে। আর গত তিনমাসে তো মুড়ি-মুড়কির মতো ওষুধ খেয়ে চলেছ। এসব তারই সাইড এফেক্ট। কতবার বলেছি, এত ওষুধ খেও না। কিন্তু তুমি কিছুতেই শুনবে না!”
বাইরে ততক্ষণে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রেক্ষাপট এখন ঝাপসা। এক লহমায় প্রকৃতি মুছে ফেলেছে সমস্ত রং, সমস্ত সৌন্দর্য। সুবিশাল কালো এক পর্দায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিশ্বচরাচর! কোথাও কিছু নেই। যেন কোনওদিনই ছিল না! শুধু বাইরের বিশালদেহী বটগাছটার সঙ্গে আচমকা ধেয়ে আসা প্রভঞ্জনের অসম লড়াইয়ের আভাসটুকু পাওয়া যায় মাত্ৰ।
ওই ঝড়ের হাওয়ার দাপটে বিধ্বস্ত গাছটার মতো শুক্লারও মনের মধ্যে কিছু আশঙ্কা আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই অশুভ চিন্তায় মনের ভেতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে তার। চার মাস দশ দিন! আজ থেকে ঠিক চার মাস দশ দিন আগে ছেলেটা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল! সেই যে চলে গেল, আর ফিরল না! এমনভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল যেন তার অস্তিত্ব ছিলই না কখনও! কতদিন তার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর শোনেননি তারা! কতদিন সে নাকি স্বরে নতুন কোনও বায়না করেনি। যে দুষ্টুমিভরা খিলখিলে হাসির জলতরঙ্গ বাড়ির প্রতিটা কোণে অনুরণিত হয়ে ফিরত, আজ সে নীরব!
ভাবতে ভাবতেই শুক্লার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। বাড়িটা চার মাস দশ দিন ধরে বড় নীরব হয়ে পড়ে আছে। কেমন যেন বোবা বিমূঢ় মানুষের মত নিরুত্তাপ নৈঃশব্দ গ্রাস করে নিয়েছে তাকে। এত শূন্যতা কেন? কোথায় হারিয়ে গেল পাহাড়ি ঝর্ণার মতো অনাবিল উচ্ছ্বাস! সে কি আর ফিরবে না?
অমঙ্গল আশঙ্কাটা মনে হতেই কোনওমতে নিজেকে সামলে নেন শুক্লা। নাঃ, সন্তানের বিষয়ে অশুভ চিন্তা করতে নেই। কোনওমতে চোখের জল সামলে দেওয়ালের দিকে তাকান তিনি। সেখানে ঘরের আলোয় উদ্ভাসিত এক বালকের ছবি। ঝলমলে কমলা রঙের টি-শার্ট পরে বারো বছরের সৃজন বন্দ্যোপাধ্যায় দুষ্টু হাসি হাসছে। শুক্লা ও প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র সন্তান। শুক্লা পেশায় শিক্ষিকা এবং প্রণব নামজাদা আইনজ্ঞ। প্রণব আজ পর্যন্ত একটি কেসেও হারেননি। তার দৌলতে শাস্তি পেয়েছে অনেকেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রণবের শত্রুর শেষ নেই। সৃজন বাবার বড় আদরের ছেলে! তল্লাটের সবাই জানে, সৃজন প্রণবের প্রাণ!
তাই যখন সে নিখোঁজ হয়ে গেল, তখন বহুবার পুলিশ জিজ্ঞাসা করেছে প্রণবকে, “আপনার বিশেষ কোনও শত্রু আছে যে সৃজনকে কিডন্যাপ করতে পারে?”
প্রণব আর্দ্র, অসহায় চোখে তাকিয়েছিলেন। একজন উকিলের কি আদৌ একজন বিশেষ শত্রু থাকে! তার পেশাটাই যে শত্রু তৈরির কারখানা ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার হয়তো তার নীরবতার মধ্যেই উত্তরটা খুঁজে নিয়েছিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, “আচ্ছা, সেদিন ঠিক কী হয়েছিল বলতে পারেন?”
প্রণবের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। শুক্লা বিমূঢ়ের মতো জানতে চেয়েছিলেন, “মানে?
—“মানে…” প্রশ্নটাকে আরও একটু সরল করে দিয়েছেন অফিসার,
–“ছেলেমানুষ তো! পড়াশোনা বা মার্কস নিয়ে আপনাদের মধ্যে কোনওরকম মনোমালিন্য হয়েছিল? আই মিন, কোনও কারণে বকাঝকা খেয়েছিল কি? কিংবা রাগ করার কোনও কারণ? ইউ নো, টিন এজারস! এই বয়েসটা খুব অভিমানী। এমনও হতে পারে যে হয়তো আপনাদের ওপর রাগ করে নিজেই কোথাও চলে গিয়েছে।”
—“ইম্পসিবল অফিসার!” প্রণব মাথা নেড়ে কোনওমতে বলেন, “বাবি রাগ করে বড়জোর চেঁচাতে পারে, কান্নাকাটি করতে পারে, এমনকি না খেয়েও থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা কিছুতেই ভাববে না।”
অফিসার তখনও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। প্রণব একটু থেমে ফের যোগ করলেন, “ও সারাজীবনে কখনও আমাদের ছাড়া কোথাও থাকেনি। আমার ফিরতে একটু লেট হলেই সে টেনশনে পায়চারি করতে শুরু করে দেয়। যতক্ষণ না আমি ফিরছি, সে খাবে না, শোবেও না। কোনও কেসের কারণে শহরের বাইরে গেলে কেঁদে-কেটে অস্থির হয়। আর মায়ের গায়ে লেপ্টে না থাকলে তার শান্তি হয় না। মায়ের হাতের রান্না ছাড়া সে খেতে পারে না, ও গায়ে হাত বুলিয়ে না দিলে ছেলের ঘুম হয় না। এরপরও আপনার মনে হয় যে বাবি সামান্য রাগ বা জেদ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে?”
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার মৃদু সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন। যে ছেলে মা বাবার প্রাণ, যে একমুহূর্তও নিজের পরিবারকে ছেড়ে থাকতে পারে না, তার চরিত্রে আচমকা রাগ করে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার থিওরি ঠিক বসে না। তদন্ত করে যতটুকু জেনেছেন, তাতে সৃজনকে বাপ-মায়ের অত্যন্ত আদুরে ছেলে বলেই মনে হয়েছে। দুনিয়ায় বোধহয় এমন কিছু নেই যা প্রণব বা শুক্লা সৃজনকে দিতে পারেন না। তবু রুটিনমাফিক জানতে চেয়েছিলেন, “পড়াশোনা বিষয়ক কোনওরকম স্ট্রেস?”
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একসঙ্গে বলে ওঠেন, “না!”
সত্যিই পড়াশোনা নিয়ে কখনও সৃজনকে কোনও কড়া কথা বলেননি ওরা। বলতে হয়নি। সে একটু ছটফটে হলেও অত্যন্ত মেধাবী। আর রেজাল্ট কিংবা মার্কস নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা প্রণবের স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি নিজে পড়াশোনায় সাঙ্ঘাতিক কিছু ভালো ছিলেন না। অথচ ফার্স্ট বেঞ্চারদের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। শুক্লাও শিক্ষিকা হওয়ার দরুন জানেন ও বিশ্বাস করেন, পরীক্ষার নম্বরই মানুষের একমাত্র পরিচয় নয়। তাছাড়া সৃজন ফার্স্ট বয় না হলেও তার রেজাল্ট চিরকালই ভালো। তাই তার মার্কস বা পার্সেন্টেজ নিয়ে দু-জনের কারোরই তেমন মাথাব্যথা ছিল না। অফিসার তাদের উত্তর শুনে একটু চুপ করে থাকেন। তারপর আবার সেই একই প্রশ্ন করেন, “সেদিন এগজ্যাক্টলি কী হয়েছিল তা জানেন?”
কী হয়েছিল! কী হয়েছিল!… সেদিন ঠিক কী হয়েছিল?…
বারবার এই প্রশ্নটাই উদ্ধত জিজ্ঞাসাচিহ্ন নিয়ে শুক্লার মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। সেদিন কী হয়েছিল? কিছুই তো হয়নি! না কোনওরকম মনোমালিন্য, না কোনওরকম রাগারাগি! আর পাঁচটা দিনের মতই স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়েছিল রোদ ঝলমলে দিনটা। সকাল সকাল প্রণব কোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কোভিড নাইন্টিনের তান্ডবে কোর্ট বহুদিন বন্ধ থাকার পরে সেদিন খুলেছিল। প্রণবের বেশ কিছু কেস পেন্ডিং থাকার দরুন তাকে সেদিন কোর্টে যেতেই হয়েছিল। সকাল থেকে শুক্লা ব্যস্ত ছিলেন অনলাইন ক্লাস নিয়ে। সৃজনও নিজের ঘরে বসে নির্বিঘ্নে অনলাইন ক্লাসই করছিল।
দুপুরবেলা মা-ছেলে একসঙ্গে বসে লাঞ্চও করেছে। মা আর ছেলে একসঙ্গে খেতে বসা মানেই দু-জনের সারাদিনের গল্পে ভরে থাকবে পারিবারিক মুহূর্তগুলো। বিশেষ করে সৃজনের অনলাইন ক্লাসের গল্প। তার কোন স্যার ক্লাস শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে অসতর্কভাবে স্যান্ডো-গেঞ্জি পরে বসে হাতপাখায় হাওয়া খাচ্ছিলেন, কিংবা কোন ম্যাডাম পড়াতে পড়াতেই আচমকা চিৎকার করে উঠে কাউকে বলেছেন, “কতবার বলব চিঁড়েভাজার কৌটোটা টেবিলের ওপরে আছে!” এসব মজাদার গল্পই মূল বিষয়বস্তু। শুক্লা শোনেন ও হাসতে হাসতে বিষম খান। সমগ্র শিক্ষকপ্রজাতি এখনও অনলাইন ক্লাসে এক্সপার্ট হয়ে উঠতে পারেনি। আর এই ছোটোখাটো প্রমাদগুলো তারই প্রতিফল। এর মধ্যে বিশুদ্ধ মজা ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই সৃজন যখন অভিনয় করে দেখাচ্ছিল, যে স্যান্ডো-গেঞ্জি পরা স্যার যে মুহূর্তে আবিষ্কার করলেন যে তাঁকে গোটা ক্লাস দেখছে তৎক্ষণাৎ তাঁর মুখভঙ্গি ঠিক কেমন হয়েছিল; তখন হাসতে হাসতে শুক্লার চোখে জল চলে এসেছিল। তখন কে জানত, শেষপর্যন্ত কী হতে চলেছে! কে জানত হাসির ছলে চলে আসা অশ্রুই ভবিতব্য হয়ে দাঁড়াবে!
সারা সকাল অনলাইন ক্লাস নিয়ে ক্লান্ত শুক্লা রোজই দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেন। আর সৃজন সেই ফাঁকে ঠিক ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অতনুদের বাড়িতে খেলতে যায়। না, ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো আউটডোর গেম নয়। কোভিডের জন্য বাচ্চারা আর বাইরে খেলাধুলো করে না। অতনুর বাবা বিরাট বিজনেসম্যান। তিনি নিজের বাড়ির মধ্যেই আস্ত ভিডিয়ো গেম-পার্লার বসিয়ে দিয়েছেন! আছে টেবল টেনিস বা দাবা খেলার ব্যবস্থাও। রোজ দুপুরে খাওয়ার পরে সৃজন সেখানেই বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করে। সে টেবল টেনিস চ্যাম্পিয়ন। ভিডিয়ো গেমেও ওস্তাদ। শুক্লাও বারণ করেন না। করোনা ভাইরাসের জ্বালায় বাচ্চাগুলোর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এখনও পর্যন্ত এ চত্ত্বরে ভাইরাস সংক্রমণ হয়নি। আর খেলাধুলোর সবটাই তো বাড়ির ভেতরে। অতনুর বাবাও অত্যন্ত খুঁতখুঁতে মানুষ। গোটা বাড়িটাকেই ঘন্টায় ঘন্টায় স্যানিটাইজ করেন। তাই আপত্তির বিশেষ জায়গা নেই।
সেদিনও অতনুদের বাড়িতে খেলতে গিয়েছিল সৃজন। আর ফিরে আসেনি! সে-কথা মনে পড়তেই অসম্ভব আত্মগ্লানিতে ভোগেন শুক্লা। সারাদিনের ক্লান্তিতে এমন কালঘুমে পেয়েছিল তাকে যে অন্ধকার নেমে আসার আগে জানতেও পারেননি যে সৃজন বাড়িতে ফেরেনি! এতটাই প্রগাঢ় ঘুমে তলিয়েছিলেন যে বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের লোক ভোলা একরকম হাঁকডাক করেই তার ঘুম ভাঙিয়েছিল। তিনি চোখ মেলে তাকাতেই ভোলা উদ্বিগ্নকণ্ঠে জানায়, “মা, ছোড়দা যে এখনও ফিরল না!”
নিদ্রাজড়িত চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়েই প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলেন তিনি! সে কী! সাতটা বেজে গিয়েছে! এতক্ষণ ঘুমিয়েছেন! আর ভোলাই বা কী বলছে! বাবি এখনও অতনুদের বাড়ি থেকে ফেরেনি! কেন! এতক্ষণে তো তার ফিরে আসার কথা। আর যদি না ফেরে, তার মানে এখনও হয়তো সে খেলাতেই ব্যস্ত। তবে ভোলার কন্ঠস্বরে এমন চাপা উদ্বেগই বা কেন!
শুক্লা একটু বিহ্বলভাবে জানান, “এখনও খেলছে হয়তো। অতনুদের বাড়িতে যা। ওকে ডেকে আন।”
ভোলা ভয়ার্ত স্বরে বলল, “আমি গিয়েছিলাম মা। কিন্তু অতনুদাদাবাবুদের বাড়িতে ছোড়দা নেই!”
—“মানে!”
প্রায় বজ্রাহতের মতো বললেন শুক্লা। অতনুদের বাড়িতে সৃজন নেই! তবে সে গেল কোথায়? বাড়িতেও তো ফেরেনি! পরের কয়েকঘন্টায় তন্ন তন্ন করে সৃজনকে চতুর্দিকে খুঁজলেন শুক্লা ও ভোলা। যেখানে যেখানে তার থাকার সম্ভাবনা আছে, সেই প্রত্যেকটি বাড়িতেই খোঁজ করলেন। কিন্তু নাঃ, সৃজন কোথাও নেই! কোত্থাও নেই! কোনও বন্ধুর বাড়িতে সে যায়নি। কোনও আত্মীয়ের বাড়িতেও নয়।
ভয়ার্ত শুক্লা ফোন করলেন প্রণবকে। তিনি তখন বাড়ির দিকেই রওনা হয়েছেন। শুক্লার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে বললেন, “বাবিকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে! তোমরা এখনও চুপচাপ বসে আছ! আমি এখনই পুলিশকে ফোন করছি।”
এরপর পুলিশ রীতিমত চিরুনি তল্লাশি শুরু করল। অতনু এবং সৃজনের অন্য বন্ধুরা জানাল যে সৃজন নাকি সেদিন একটু আগেই খেলা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। বেচারি টেবল টেনিসে হেরে যাচ্ছিল বলে মুড বেজায় অফ ছিল। রীতিমত বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া করে, হাতের র্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গজগজ করতে করতে চলে গিয়েছিল সে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে, কিংবা কারোর সঙ্গে যাচ্ছে কিনা তা কেউই খেয়াল করেনি। স্বাভাবিকভাবেই সবাই ধরে নিয়েছে যে সোজা বাড়িতেই যাবে সৃজন। কিন্তু ছেলেটা তো বাড়িতে ফেরেইনি! তবে গেল কোথায়?
এ প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। পুলিশ আশপাশের সমস্ত পুকুরে, জলাধারে রীতিমত জাল ফেলে খানা-তল্লাশি করেছে। হিস্ট্রিশিটার ও কিডন্যাপারদের তুলে নিয়ে পিটিয়ে একসাও করেছে। ছেলে অন্ত প্রাণ দম্পতি প্রতি পলে পলে দগ্ধে মরছেন। টিভিতে, খবরের কাগজে সৃজনের ছবিসহ ‘সন্ধান চাই’ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নিজের হাতে সৃজনের পোস্টার লাগিয়েছেন স্বয়ং প্রণব। শুক্লা প্রথমে অন্নজল ত্যাগ করেছিলেন। পরে প্রণবের কাতর অনুরোধে অনশন ভাঙলেও আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছেন ডিপ্রেশনের রোগী! আর সেই ওষুধের মাত্রা যতই দিন যাচ্ছে, ততই বেড়ে চলেছে! শুক্লাকে পাগলের মতো ওষুধ খেতে দেখে প্রণব বহুবার বকাবকি করেছেন। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি! আজ চারমাস দশদিন হয়ে গেল, দু-জন নীরবে ফোনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন অনন্ত প্রতীক্ষায়! যদি পুলিশের ফোন আসে। যদি তারা খুঁজে পায় সৃজনকে! অথবা তার কোনও খবর পাওয়া যায়! কিংবা যদি কিডন্যাপারদের র্যানসম্ কলও আসে!
অন্তত এইটুকু তো বোঝা যায় যে বারো বছরের ছেলেটা কোথায় গেল! যে প্রশ্নটা বারবার পুলিশ করেছে তার উত্তরটাও যদি জানা যেত! আদতে কী হয়েছিল তার সঙ্গে! সৃজনের কী হল! কোথায় আছে সে!
বাইরে ঠিক বটগাছটার মাথায় বিদ্যুতের তরবারি আবার ঝলসে উঠল! পরক্ষণেই সমস্ত চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে দিয়ে দরজায় সজোর করাঘাতের শব্দ! শান্ত নয়, অশান্ত ও মুহূর্মুহু করাঘাত! বুঝি দরজাটা এবার ভেঙেই যাবে!
সেকেন্ডের ভগ্নাংশে প্রায় স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠলেন শুক্লা। যেদিন থেকে সৃজন হারিয়ে গিয়েছে তারপর থেকে প্রায়ই চমকে চমকে ওঠেন তিনি। ডোরবেল বা করাঘাতের শব্দ এলেই প্রাণপণ ছুটে যান সেদিকে। ভোলাকে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে দ্রুতহাতে দরজা খুলে দেন। বুকের ভেতর একটাই প্রত্যাশা। যদি সে ফিরে আসে। যদি সৃজন আবার এসে দাঁড়ায় বন্ধ দরজার সামনে! তাকে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিতে হবে না?
আজও তিনি সবেগে দরজার দিকে ছুটলেন। পিছন পিছন প্রণব ও দ্রুতহাতে মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে ফেলেছেন শুক্লা! বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়া ছায়া অবয়ব! আগন্তুকের সারা দেহ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে জল। ক্ষীণ আলোয় চোখে পড়ল আপাদমস্তক ভেজা খাকী উর্দি!
—“অফিসার!”
প্রণব এবার সাগ্রহে এগিয়ে যান আগন্তুকের দিকে। বাইরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু না হলেও একদম অপরিচিতও নন। তিনি সৃজনের ‘মিসিং’ কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার!
শুক্লার হৃৎপিণ্ড প্রায় লাফিয়ে উঠল। এই ঝড়জলের রাতে আচমকা স্বয়ং ইনভেস্টিগেটিং অফিসার এসে উপস্থিত কেন! তার মুখে যেন কয়েক হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে। তবে কি এতদিনে সৃজনের কোনও খবর পাওয়া গেল? সেই সংবাদই কি শোনাতে এসেছেন অফিসার?
শুক্লার মুখের কথাই প্রায় ছিনিয়ে নিলেন প্রণব, “এত রাতে আপনি? বাবির কোনও খোঁজ পেলেন?”
উর্দিধারী অবনত মুখে একটু রুক্ষস্বরেই জানালেন, “আমি জানি যা হয়েছিল!”
—“কী!
উপস্থিত দু-জনেই চমকে উঠলেন! অফিসার তো কখনও এমন নিরুত্তাপ অথচ খসখসে স্বরে কথা বলেন না! তাছাড়া উনি বলছেনই বা কী! উনি জানেন কী হয়েছিল! এর অর্থ?
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার আস্তে আস্তে এবার মুখ তুলে তাকান। ভদ্রলোকের সারা মুখ বেয়ে তখনও জলবিন্দু ঝরে পড়ছে। কিন্তু তার চোখে চোখ পড়তেই অস্ফুট আর্তনাদ করে কয়েক পা পিছিয়ে এলেন শুক্লা! প্রণব যা দেখলেন তাতে ভয়ে রক্তহিম হয়ে গেল! অফিসারের চোখের মণি দুটো সম্পূর্ণ সাদা! এ কী আদৌ মানুষের চোখ! এবং কী অদ্ভুত তার দৃষ্টি! সে দৃষ্টিতে কোনও প্রাণ নেই। যেন দুটো ভয়াল পাথরের চোখ অনিমেষে তাকিয়ে আছে!
তিনি এবার সজোরে সেই একই বাক্যের পুনরাবৃত্তি করলেন। তার জোরালো কণ্ঠস্বরে কেঁপে উঠল গোটা ঘর। ফের উচ্চারিত হল সেই কথাগুলো!
—“আমি জানি যা হয়েছিল!”
শুক্লা ভয়ে, বিস্ময়ে বাকশক্তিহীন! ততক্ষণে সেখানে এসে পড়েছে ভোলাও। সে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে! প্রণব কোনওমতে বলেন, “কী বলছেন! অফিসার?”
অফিসার তখনও বীভৎস সেই সাদা চোখে মরা মাছের মতো তাকিয়ে আছেন। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে যেন এবার মর্মান্তিক হাহাকার! ক্রন্দন উচ্ছ্বসিত-কণ্ঠে এবার তিনি সজোরে চিৎকার করে উঠলেন, “আ–মি–জা—নি যা হ—য়ে—ছিল!”
উপস্থিত সবাই বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল অফিসার বিদ্যুৎবেগে বের করে আনলেন তার সার্ভিস রিভলবার। কেউ কিছু বোঝার আগেই নিজের কপালেই আগ্নেয়াস্ত্রটি ঠেকিয়েছেন তিনি! প্রণব আর্তচিৎকার করে উঠলেন,
—“এ কী! কী করছেন আপনি!”
কিন্তু কেউ আর কিছু করার আগেই গর্জে উঠল রিভলবার! অফিসারের প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে!
ঠিক সেই মুহূর্তেই বিরাট বটগাছটাও ঝড়ের দাপট সহ্য করতে না পেরে সশব্দে হুড়মুড়িয়ে উলটে পড়ল।
২
—“তোদের চোখের সামনেই ভদ্রলোক সুইসাইড করলেন দিদিভাই!” সুচরিতার কথায় আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন শুক্লা। কাল রাতের ঘটনার পর থেকে তিনি বাকশক্তিরহিত। কথা বলার শক্তিটুকুও বাকি নেই। এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না তার সামনে দাঁড়িয়ে এক পুলিশ অফিসার নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন! চোখের সামনে ভাসছে সেই ভয়ংকর মুহূর্ত! কী ভয়াবহ ছিল সেই সাদা দুটো চোখ! কী ভয়ংকর তার সেই অন্তিম শব্দগুলো! এখনও মস্তিষ্কের ভেতরে ধাক্কা খেয়ে ফিরছে তার বলা বাক্যটা,
—“আমি জানি যা হয়েছিল!” সুচরিতা সেই মারাত্মক শব্দগুলোই আবার উচ্চারণ করল, “এর মানে কী! উনি কী জানতেন? আর কিছু বলেছেন কি?”
শুক্লা কেঁপে উঠলেন। এখন এই বাক্যটা শুনলেই তার ভয় করছে। কিছুই তো নয়! নিতান্তই কয়েকটা নিরীহ শব্দ মাত্র! কিন্তু প্রত্যেকটা শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আতঙ্ক! সেই আতঙ্ককে প্রকাশ করা যায় না, বর্ণনা করা যায় না। মানুষটা কি সত্যিই আত্মহত্যা করল? নাকি গোটাটাই একটা ভয়াল দুঃস্বপ্ন?
—“বারবার একই কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন সুচরিতা!” প্রণব বিরক্ত হয়ে বলেন, “তোমাকে তো আমি আগেই সব বলেছি। অফিসার তিন বার একটাই কথা বলেছেন। তার বেশি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি! আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে দিদিকে দিয়ে করোবরেট করাচ্ছ? কেন? আমরা কি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি?”
সুচরিতা সম্পর্কে শুক্লার পিসতুতো বোন ও প্রণবের জুনিয়র। জামাইবাবুর ধমক খেয়ে আমতা আমতা করে বলল, “তা নয় প্রণবদা। আমি জাস্ট এমনিই….”
—“এমনি এমনি কী!” আবার ধমকে ওঠেন প্রণব, “তোমার দিদির অবস্থা দ্যাখো! কাল সারারাত ঘুমোয়নি। ভয়ে কাঁপছে। জড়োসড়ো হয়ে আছে। পুলিশ ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করে বা এসে আমাদের জেরা করছে। তোমাকে ডাকলাম ওকে মেন্টাল সাপোর্ট দিতে, আর তুমি উলটে ভয় দেখাচ্ছ!”
জামাইবাবু কাম সিনিয়রের ভর্ৎসনায় সুচরিতা একটু বিব্রত হয়েই চুপ করে যায়। কী বলবে বুঝে পায় না। এই মুহূর্তে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ওপর দিয়ে রীতিমতো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একে তো তাদের একমাত্র সন্তান সৃজন নিখোঁজ, তার ওপর খোদ ‘মিসিং’ কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসারও মারা গেলেন! তাও আবার এইভাবে। পুলিশের জেরায় জেরায় বিধ্বস্ত প্রণব। কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল; সব পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে হচ্ছে। পুলিশ মানতেই চাইছে না যে অফিসার আত্মহত্যা করেছেন! এমনকি তার বলা শেষ কথাটাও বিশ্বাস করছে না তারা। বলছে “আমি জানি যা হয়েছিল। এর অর্থ কী!”
প্রণব অতিকষ্টে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে জানিয়েছেন, “এর অর্থ আমিও জানি না। যিনি জানতেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করার উপায়ও নেই। কিন্তু আমরা তিনজনেই যা দেখেছি ও শুনেছি, তাই বলছি। উনি রিপিটেডলি একটা কথাই বলে গিয়েছেন। কোট-আনকোট, আমি জানি যা হয়েছিল”।
—“কী হয়েছিল? ঠিক কীসের কথা বলছিলেন তিনি?”
—“আমি জানি না।”
ওসির চোখ সন্দেহে সরু হয়ে যায়, “মিঃ ব্যানার্জী, আপনিও একজন ল অফিসার। অনেক সন্দিগ্ধ ব্যক্তিকে জেরা করেছেন কোর্টে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনাদের বক্তব্য রীতিমতো অবিশ্বাস্য! অফিসার এলেন, আপনাদের সঙ্গে কথা বললেন এবং কথা নেই বার্তা নেই, নিজের মাথাতেই আরামসে গুলি মেরে আত্মহত্যা করলেন! মরার আগে কী বলে গেলেন? আমি জানি যা হয়েছিল! সম্পূর্ণ অর্থহীন কথাবার্তা! এ বয়ান যে ধোপে টিকছে না!” প্রণব ও শুক্লা পরস্পর দৃষ্টিবিনিময় করেন। প্রণব নিজেও জানেন, তিনি যা বলছেন তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কোর্টে এ স্টেটমেন্ট দিলে তাকে রীতিমতো মানসিক রোগী বলে সন্দেহ করা হবে। কিন্তু বলবেন টা কী? তাদের তিনজনের চোখের সামনে যা ঘটেছে, তাকে কোনওমতেই বিশ্বাসযোগ্য গল্পের আকার দেওয়া যাবে না! তা ও ভাগ্যিস, সাদা চোখের ব্যাপারটা বলেননি। ওটা বললে হয়তো গোটা পুলিশ সম্প্রদায় অট্টহাস্য করে উঠত ও তাদের সবাইকে ধরে মেন্টাল অ্যাসাইলামে পুরে দিত!
—“আপনি কি আমাদের সন্দেহ করছেন?”
তার কণ্ঠস্বর একটু রুক্ষ। ওসি মৃদু হাসলেন, “দেখুন স্যার, সন্দেহ করাই স্বাভাবিক। যদি মেনেও নিই যে অফিসারের মরার শখ হয়েছিল ও কোনও কারণে তাঁর মাথায় আত্মহত্যার ভূত চেপেছিল, সেক্ষেত্রেও তিনি বেছে বেছে আপনার বাড়িতে এসে, আপনাদের তিন জনকে সাক্ষী রেখে মরবেন কেন? সুইসাইড তো মানুষ দেখিয়ে দেখিয়ে করে না। আদৌ কোনও লজিক পাচ্ছেন এ ঘটনার?”
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, “আই মাস্ট অ্যাডমিট, নাঃ!”
—“আপনি কিছু চেপে যাচ্ছেন না তো স্যার?” ওসি খুব শান্ত ভঙ্গিতেই বলেন, “আপনি নিজেও জানেন পুলিশের কাছে কিছু গোপন করে যাওয়ার ফল কী হতে পারে।”
তার চেয়েও শান্ত ও কিছুটা ক্লান্ত ভঙ্গিতে জানালেন প্রণব, “জানি। আমরা কিছুই গোপন করছি না।”
—“আপনার ছেলের মিসিং কেসটার কোনও ডেভলেপমেন্ট হয়েছিল? তদন্তকারী অফিসার কি সে বিষয়ে কিছু বলেছেন?”
—“না। উনি শুধু একটা কথাই বলেছেন। আর সেটা অলরেডি আমি আপনাদের জানিয়েছি।”
—“আমি জানি যা হয়েছিল!” এবার ওসির ভুরুতে সামান্য ভাঁজ পড়ল। দৃষ্টিও সংশয়ান্বিত। তারপরেই বললেন, “আপনার নিজের কোনও লাইসেন্সড গান আছে?”
ইঙ্গিত স্পষ্ট। প্রণব আর কথা না বাড়িয়ে নিজের লাইসেন্সড রিভলবারটি ওসির হাতে তুলে দেন। আপাতত সেটাই বাজেয়াপ্ত করে সাময়িক বিরতি দিয়েছে পুলিশ।
—“পুলিস আমাদেরই সন্দেহ করছে তাই না?”
দীর্ঘ নীরবতার পরে শুক্লা অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠে এই প্রথম কথা বললেন। ঘরে উপস্থিত দুই উকিলের মধ্যে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি-বিনিময় হল। প্রণব সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, “পুলিশের কাজই হল সন্দেহ করা। ওরা নিজের বাড়ির লোকদেরও সন্দেহ করে।”
—“ওদের কাজ কি শেষ হয়েছে?”
— “নাঃ!” দুদে উকিল অভিজ্ঞ কণ্ঠেই জানান, “যতদূর আমি পুলিশকে চিনি, তাতে বলতে পারি ওরা আমাদের বয়ানে আদৌ বিশ্বাসই করেনি। আবার আসবে। আবার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একই প্রশ্ন করবে।”
তিনি আস্তে আস্তে বলেন, “ওরা ভাবছে আমরা অফিসারকে খুন করেছি, তাই না? নয়তো তোমার রিভলবারটা চাইল কেন?”
প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। হয়তো বা প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যেতেই চাইছিলেন। কিন্তু শুক্লা তার দিকে নাছোড়বান্দা ভঙ্গিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন দেখে একরকম বাধ্য হয়েই বলেন, “ভাবলেই তো হল না। কোর্টে প্রমাণ করতে হবে তো! ওদের কাছে আমাদের বিরুদ্ধে কোনওরকম প্রমাণ নেই। ইভেন ফরেনসিকও বলবে যে গুলিটা ওঁর সার্ভিস রিভলবার থেকেই একদম পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে চলেছিল, আমার রিভলবার থেকে নয়।”
—“কিন্তু তাহলেও তো প্রমাণ হয় না যে আমরা ওঁকে মারিনি।” প্রণব এবার একটু বিরক্ত, “না হয় না। কিন্তু এটাও প্রমাণ হয় না যে ওঁকে আমরা মেরেছি। তুমি অনেকক্ষণ ধরে রেস্টলেস হয়ে আছ। এবার একটু রেস্ট নাও। সু, প্লিজ্ দ্যাখো!”
সুচরিতা বুঝে গিয়েছে তাকে কী করতে হবে। সে তার দিদির হাত ধরে টান মারে, “আয় দিদিভাই, কিছু খেয়ে নে। তারপর একটু বিশ্রাম…”
শুক্লা অন্যমনস্কভাবে ফের বাইরের দিকে তাকান। ঝড়ে ভূ-পাতিত বটগাছটার দিকে তাকিয়েই গা শিরশির করে উঠল তার! বটগাছটা অবিকল অফিসারের প্রাণহীন দেহটার মতই পড়ে আছে! এক পলকের জন্য মনে হল, ওটা গাছ নয়, বরং কোনও মানুষেরই মৃতদেহ!
তিনি আলতো করে মাথা ঝাঁকান। নাঃ, গোটাটাই তার দৃষ্টিভ্রম। কিন্তু বটগাছটাকে এমন জীবন্ত মনে হচ্ছে কেন?
৩
শহরের ইট-কাঠ-পাথরের পাঁজরে এক চিলতে সবুজ মরুদ্যান এই চিলড্রেন্স পার্ক। মখমলি সবুজে ঘেরা এই ছোট্ট পার্কের নাম চিলড্রেন্স পার্ক হলেও অনেক বয়স্ক মানুষ সকালে বিকালে এখানে হাঁটতে আসেন। মাঝখানে একটুকরো স্বচ্ছ নীল জলের জলাশয়কে কেন্দ্র করে চতুর্দিকে গড়ে উঠেছে এক মনোরম সবুজ উদ্যান। ছোটোদের জন্য দোলনা, সি-স, স্লাইড ছাড়াও রয়েছে ছোটো ছোটো বেঞ্চ। সেখানে অনেক প্রকৃতি-প্রেমিকই এসে বসেন। ভোরবেলা জগিং করতে আসে অনেকেই। বৃদ্ধরা একপাশে আবার লাফিং ক্লাব খুলেছেন। সকাল বিকেল শিশু ও বৃদ্ধদের হাসির আওয়াজে ভরে থাকে গোটা উদ্যান।
এখন অবশ্য গোটা পার্কই শুনশান। করোনা ভাইরাসের দৌলতে শিশুরা এখন আর মুক্ত প্রকৃতির বুকে খেলে বেড়াতে পারে না। বৃদ্ধরাও সংক্রমণের ভয়ে বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন না। তাই পার্কে মানুষজনের চিহ্ন নেই। তবে প্রচুর পাখির কলকাকলিতে ভরপুর! পাখিদের তো আর রোগের ভয় নেই। সকাল ও সন্ধেবেলায় প্রচুর পাখির ভিড় জমে। তাদের বিচিত্র কলরবে ভরে থাকে চিলড্রেন্স পার্ক।
সারি সারি গুলমোহরের গাছ কিছুদিন আগেও লালে লাল ছিল। দেখলেই মনে হত, আগুন জ্বলছে। কিন্তু এখন ফুলের সিজন নয়। তাই সবুজ পাতা মেলেই চিরহরিৎ গাছগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঝাঁকড়াচুলো অমলতাস কিন্তু এখনও হলদে সোনালি রঙ ছড়িয়ে চলেছে। সেদিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
পার্কের চতুর্দিকে ইটের পাঁচিল। সেখানে অনেক পোস্টার লাগানো। তবে খুঁজলে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে সৃজনের ছবির পোস্টার। রোজ বিকেলে প্রণব ও শুক্লা একগাদা পোস্টার নিজেদের হাতে সর্বত্র লাগাতে থাকেন। সবাই আশা ছেড়েছে! পুলিশও আস্তে আস্তে নিশ্চেষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারা হাল ছাড়েননি। কে বলতে পারে, হয়তো বা এই পোস্টার দেখেই কেউ চিনে ফেলল সৃজনকে! হয়তো এই ছবির মাধ্যমেই চলে আসতে পারে কোনও খবর। সেই আশাতেই বুক বেঁধে রোজ এই দম্পতি পোস্টারে পোস্টারে ভরিয়ে ফেলেন গোটা এলাকা। যেখানেই পুরনো পোস্টার বিবর্ণ হয়ে যায় বা খসে যায়, সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে নতুন পোস্টার লাগিয়ে দেন! এই নিয়মের ব্যতিক্রম কখনও হয় না।
আজ বিকেলেও প্রাত্যহিক নিয়মমতই গাড়ির ডিকিতে সৃজনের একগাদা পোস্টার নিয়ে বেরিয়েছিলেন প্রণব। তবে আজ তার সঙ্গে শুক্লা আসেননি। কালকের বিভীষিকাময় রাতটা তার দুর্বল মনের ওপর অসম্ভব চাপ ফেলেছে। অনেক কষ্টে তাকে সামান্য খাবার খাইয়ে, ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে সুচরিতা। শুক্লা মানসিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত! এই মুহূর্তে তার বিশ্রাম প্রয়োজন। বিশ্বস্ত ভৃত্য ভোলা আপাতত তার কাছে রয়েছে। আর প্রণবকে সাহায্য করতে এসেছে সুচরিতা।
পার্কের পাঁচিলের গায়ে ছেলের পোস্টার লাগাতে লাগাতেই আচমকা থমকে গেলেন প্রণব। সুচরিতা দেখল, তিনি আলতো করে ছবির গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। যেন নিজের ছেলেকেই পরম স্নেহে আদর করছেন। সমবেদনায় সুচরিতার চোখ জলে ভরে আসে। শুক্লার সামনে নিজের দুর্বলতা প্ৰকাশ করার সুযোগ প্রণব কখনও পাননা। স্ত্রী-র যা মানসিক অবস্থা, তাতে তার সামনে যদি স্বামীও ভেঙে পড়েন তবে শুক্লার পক্ষে তা অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। সুচরিতা জানে, কতখানি শক্তিতে নিজের বুকে পাথর রেখে স্থির হয়ে আছেন প্রণব। কিন্তু যতই যা হোক, মানুষ তো! কতক্ষণ আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারবেন!
—“আমার জন্য…” সৃজনের ছবির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে প্রচণ্ড আফসোসে এবার ভেঙে পড়েন তিনি, “সব আমার জন্য হল। সব আমার জন্য!”
সুচরিতা সহানুভূতি-মাখা কণ্ঠে বলে। “কীসব বলছ প্রণবদা! তোমার জন্য কী হবে!”
—“আমার পেশাটাই কাল হয়েছে। এত শত্রু বাড়িয়েছি, এত লোককে শাস্তি দিয়েছি…” বিকেলের পড়ন্ত রোদের বিষণ্ণতা মুখে মেখে প্রণব ফুঁপিয়ে ওঠেন, “ঈশ্বর জানেন, কোন্ পাপের শাস্তি পাচ্ছি এখন! কারোর যদি বদলা নেওয়ারই থাকত তবে আমাকেই কেন মেরে ফেলল না! বাবি কেন! হোয়াই! …. হোয়াই!”
তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তথাকথিত অপরাধীদের আতঙ্ক প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়। কান্না-জড়ানো কন্ঠে বললেন, “বাবার অপরাধের শাস্তি ছেলেকে কেন দিচ্ছে! ছেলেটা হারিয়ে গেল, শুক্লা ড্রাগের ওভারডোসেজ নিতে নিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আমার যে সব শেষ। তার চেয়ে আমিই কেন মরে যাই না….”
সুচরিতা পরম স্নেহে তার হাত ধরে ফেলল, “তুমি এসব ভেবে মিথ্যেই কষ্ট পাচ্ছ প্রণবদা। তোমার জন্য কিচ্ছু হয়নি। বাবিকে ঠিক পাওয়া যাবে।”
—“কবে?” অশান্ত ক্ষতবিক্ষত পিতৃহৃদয় হাহাকার করে ওঠে, “আর কতদিন? চোখের সামনে নিজের স্ত্রীকে একটু একটু করে পাগল হয়ে যেতে দেখছি। তুমি জানো, ও আজকাল অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায়? ওর মনে হয় কেউ ওকে ফলো করছে। মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ খায়, তারপরও রাতে ঘুমোতে পারে না। সবসময় ভয়ে থাকি, গোটা ফয়েলটাই না কোনওদিন খেয়ে ফেলে! আর কতদিন এ যন্ত্রণা সইতে হবে বলতে পারো? আর যে পারছি না!”
সুচরিতা ভাষা খুঁজে পায় না। ব্যথা-জর্জরিত পিতৃহৃদয়কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কোনও কথাই যথেষ্ট নয়। সামনের এই পুত্রশোকার্ত, ব্যথাসন্তপ্ত মানুষটিকে কী বললে তিনি একটু শান্ত হবেন তা তার জানা নেই। সে খুব কোমলস্বরে বলল, “তুমিও ভেঙে পড়লে চলবে কী করে? সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো।”
—“কী ঠিক হবে!” প্রণবের চোখ এবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। টপটপ করে কয়েকফোঁটা অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ল তার চোখ থেকে। কোনওমতে শুধু বললেন, “ওকালতি ছেড়ে দেব আমি! দরকার পড়লে বাড়ি, গাড়ি, আর যা যা আছে সব বিক্রি করে দেব। যদি নিজেকেও বিক্রি করতে হয়, তবে তাই সই। যত টাকা লাগে দেব, কিন্তু ওরা শুধু আমার বাবিকে ফিরিয়ে দিক!”
এবার সমবেদনায় নয়, একটু সবিস্ময়ে বলল সে, “ওরা কারা? কাদের কথা বলছ?”
—“জানি না!”
হাতের পোস্টার সরিয়ে রেখে এবার ক্লান্ত-ভঙ্গিতে পার্কের বেঞ্চে বসে পড়েছেন প্রণব। দু-হাতে মুখ ঢেকে বললেন, “শুধু জানি সব আমার জন্য হয়েছে। সব আমার জন্য।”
এ কাতরোক্তির কোনও ব্যাখ্যা হয় না। এ অনুতাপও অর্থহীন। তবু সুচরিতার মনে ছাপ ফেলে যায় এক গভীর সন্দেহ। প্রণবের কথা অনুযায়ী এই ‘ওরা’ কারা? তবে কি তিনি সত্যিই কিছু চেপে যাচ্ছেন! এমন নয়তো যে কিডন্যাপারদের ফোন পেয়েছেন উনি? কিন্তু তাদের হুমকির ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছেন না? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে কিডন্যাপারদের প্রথম কথাটাই হয়, “কাউকে কিছু বললে ছেলেকে আর দেখতে পাবি না. … “
চিলড্রেন্স পার্কের নির্জন পরিবেশে ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল সুচরিতার। প্রণব দু-হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদছেন। কিন্তু তার কথাগুলো ভুলতে পারছে না সে। ক্রমাগত মস্তিষ্কের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে। ঠিক কী বলতে চাইলেন প্রণব? এই ‘ওরা’ কারা? সত্যিই কি তিনি কিছু জানেন না? পুরোটাই অনুতপ্ত হৃদয়ের বিলাপ! নাকি এই কথাগুলোর অন্য কোনও মানেও আছে? নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে দেওয়ার কথা উঠছে কোথা থেকে!
—“প্রণবদা!” সন্দিগ্ধ স্বরে বলল সে, “তুমি কি কিছু জানো?” কথাটা শোনামাত্রই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো মুখ তুলে তাকালেন প্রণব। পড়ন্ত আলোয় তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেল সুচরিতা। যদিও মুহূর্তের ভগ্নাংশে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। স্খলিত গলায় বললেন, জানব?”
—“আমি জানি যা হয়েছিল!”
পার্কে এতক্ষণ ঘরে ফেরা পাখির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যায়নি। সুচরিতা ও প্রণব ছাড়া তৃতীয় কোনও মানুষের অস্তিত্বও ছিল না। কিন্তু দু-জনে এতটাই শোকার্ত ও বিভ্রান্ত যে খেয়ালই করেনি ওদের কথোপকথনের মধ্যেই একজন অপরিচিত মানুষ হাঁটতে হাঁটতে এইদিকেই আসছিল। এবার সে এসে দাঁড়িয়েছে প্রণবের ঠিক পেছনেই। কিছু বোঝার আগেই দ্বিতীয়বার উচ্চারিত হল সেই অমোঘ শব্দগুলো,
—“আমি জানি যা হয়েছিল!”
তড়িৎগতিতে পিছন দিকে ঘুরলেন প্রণব। সুচরিতাও ঘাবড়ে গিয়ে তাকাল বক্তার দিকে। পুরোপুরি অন্ধকার এখনও নেমে আসেনি। সূর্যাস্তের নরম আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল আগন্তুককে। বয়েস চল্লিশের মধ্যেই, গাঁট্টাগোট্টা গড়ন, পরনে সাধারণ ডোরাকাটা শার্ট আর ট্রাউজার। মুখে গোঁফ-দাড়ির জঙ্গল। শত বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও মুখে মাস্ক নেই। একদমই সাধারণ ও বিশেষত্বহীন চেহারা। কিন্তু… এ কী!
তার চোখ দুটো! তার চোখ দুটো যে সম্পূর্ণ সাদা! ওর চোখে কি মণি নামক বস্তুটিই নেই! সুচরিতা টের পেল, ভয়ে সে রীতিমতো ঘামছে। এই মারাত্মক বাক্যটা আগেই শুনেছিল। সাদা চোখের বর্ণনাও তার অজ্ঞাত নয়। কিন্তু এ কী অদ্ভুত অমানুষিক চোখ! কোনও মানুষের এমন চোখ হয় না, হতে পারে না! আর কেমন যেন অপলক দৃষ্টি। কোনও জীবন্ত মানুষ এভাবে তাকাতে পারে না। এ কে? তার থেকেও বড় কথা, এ আসলে ঠিক কী! মানুষ না শয়তান!
—“কী?” প্রণব প্রায় উন্মত্তের মতো লাফিয়ে ওঠেন, “কী বললেন?” লোকটার মুখ এবার খানিকটা বিকৃত হয়ে যায়। যেন হৃদয়ের অতল থেকে উঠে আসা কান্নাকে অতি-কষ্টে দমন করতে চাইছে। কিন্তু আশ্চর্য! তার সাদা চোখের পলক পড়ছে না! সে পার্কের নির্জনতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, “আ-মি জা-নি যা হ-য়ে-ছি-ল!”
পাখিগুলোও বুঝি আসন্ন বিপদের সংকেত পেয়ে পরিত্রাহি চিৎকার করে উঠেছে। তাদের ডাকে এখন মাধুর্য নেই। বরং স্পষ্ট অশুভ ইঙ্গিত! সুচরিতার বুকের ভেতরটা ধ্বক্ করে ওঠে। পাখিগুলো এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন! এতক্ষণ দিব্যি ডালে বসে ডাকাডাকি করছিল। এবার চিল চিৎকার করে উন্মত্তের মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে। মনে হয়, হয়তো কোনও অজানা বিভীষিকার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছে!
লোকটার পাথরের মতো দৃষ্টি তখনও ওদের দু-জনের ওপর নিবদ্ধ! প্রণব পাগলের মতো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। উত্তেজনার চোটে বোধহয় শিষ্টাচারও ভুলে গিয়েছেন। আগন্তুকের কলার চেপে ধরে বলেন, “কী জানিস! কী জানিস তুই!”
লোকটা একটুও উত্তেজিত না হয়ে এবার রহস্যময় মুচকি হাসল। পরক্ষণেই প্রণবকে সজোরে ধাক্কা মেরে দৌড়!
প্রণব ভাবতেও পারেননি লোকটা এভাবে হাত ফস্কে পালাবে। ধাক্কা খেয়ে কিছুটা বেসামাল হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ততক্ষণে তারও রোখ চেপে গিয়েছে। অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে তিনিও দৌড়োলেন আগন্তুকের পিছন পিছন। সুচরিতা স্তম্ভিতের মতো দেখল, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা লোকের পিছনে বিষম জেদে দাঁতে দাঁত পিষে দৌড়োচ্ছেন প্রণব! সে প্রমাদ গুণল। কে জানে, এটা কোনওরকম ট্র্যাপ কিনা! সে চেঁচিয়ে ওঠে, “প্রণবদা, দাঁ-ড়া-ও! যে-ও-না-আ-আ!”
সুচরিতার কণ্ঠস্বর প্রণবের কান অবধি পৌঁছোল কিনা কে জানে। কিন্তু তিনি থামলেন না। সামনের ব্যক্তি দুরন্ত গতিতে দৌড়চ্ছে। তার স্পিড দেখে ক্রমাগতই বিস্মিত হচ্ছিলেন। কোনও মানুষের পক্ষে কি আদৌ এত জোরে দৌড়োনো সম্ভব! এ তো দৌড়োচ্ছে না, উড়ছে!
তবু তিনি হাল ছাড়লেন না। লোকটা দৌড়োতে দৌড়োতে পার্ক ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মেইন রোডের দিকে। প্রণবের কেমন যেন ধাঁধা লেগে যায়। কখনও মনে হচ্ছে ওকে দেখতে পাচ্ছেন, কখনও মনে হচ্ছে বুঝি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে! ও কি আদৌ কোনও জাগতিক প্রাণীর মত দৌড়চ্ছে! নাকি ওর দুই পায়ে আলোর গতিবেগ ভর করল! আর এমন আচমকা হঠাৎ হঠাৎ মিলিয়েই বা যাচ্ছে কোথায়! সত্যিই কি মিলিয়ে যাচ্ছে, না গোটাটাই তার চোখের ভুল!
প্রণব কোনওদিনই অতিলৌকিকে বিশ্বাসী নন। কিন্তু আজ একটা শিরশিরে শীতল ভয় তার মনের মধ্যে কামড় বসাচ্ছে। এসব কী হচ্ছে! পুলিশ অফিসারটির মৃত্যুর পর চব্বিশ ঘন্টাও কাটেনি, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি লোক এসে আবার সেই একই কথা বলল! অবিকল সেই একই টোন! হুবহু এক যান্ত্রিক ভঙ্গি। সর্বোপরি সাদা বীভৎস দুটো চোখ! এমনকী বাক্যটাও একই!
আমি জানি যা হয়েছিল!
কী হয়েছিল? কারই বা হয়েছিল! এই বাক্যটার পেছনে আসলে কোন্ রহস্য লুকিয়ে আছে? এর পিছনে কি কোনও মানুষের চক্রান্ত উপস্থিত, না কোনও…!
অবিশ্বাস্য সম্ভাবনাটার কথা মনে আসতেই চিন্তাটা মন থেকে উড়িয়ে দিলেন প্রণব। তিনিও কি তবে শুক্লার মতই আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাচ্ছেন! দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় তার চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে। মানুষ হোক কী শয়তান, ছেড়ে দেওয়া যাবে না। লোকটাকে যে করেই হোক ধরতেই হবে! এর শেষ দেখেই ছাড়বেন।
দৌড়োতে দৌড়োতে প্রণবের হাঁফ ধরে যাচ্ছে। তিনি পেশায় উকিল, পুলিশ নন যে দৌড়ে আসামীকে ধরার অভ্যাস থাকবে। তার ওপর এই ব্যক্তিকে ধরার ক্ষমতা পুলিশ কেন, সম্ভবত কোনও দৌড়বীরেরও নেই! কী অসম্ভব বেগে দৌড়োচ্ছে লোকটা! তবু তিনি হাল ছাড়েন না! চিৎকার করে ডেকে ওঠেন,
—“এ-ই! থা-ম্!”
আগন্তুক ক্ষণিকের জন্য যেন থমকে দাঁড়ায়। প্রণব সবিস্ময়ে দেখলেন, সে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেইন রোডে এখন তেমন গাড়ির ভিড় নেই। শুধু দু-একটা গাড়ি, কখনও বা কিছু ট্রাক হুশহাস করে চলে যাচ্ছে।
লোকটা প্রণবের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন, প্রবল গতিতে উলটোদিক থেকেই ধেয়ে আসছে এক মহাকায় মালবাহী ট্রাক। মানুষটা সম্মোহিতের মতো সেদিকেই তাকিয়ে আছে। এর পরবর্তী ঘটনা কী ঘটতে পারে আন্দাজ করেই প্রণবের হাত-পা অবশ হয়ে আসে। পুলিশ অফিসারও ধরা দেননি। এ লোকটাকেও ধরা যাবে না। ঠিক গুণে গুণে তিন বার ওই বাক্যটা বলাই সম্ভবত ওদের জীবনের অন্তিম লক্ষ! আর ওরা একটি শব্দও খরচ করবে না!
ট্রাকটা দুরন্ত বেগে ক্রমাগতই এগিয়ে আসছে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই…
— “না! দাঁ-ড়া-ও!”
প্রণবের অসহায় শেষ চেষ্টা দেখে সে যেন অর্থপূর্ণ হাসল। ট্র্যাকটা দুর্নিবার গতিতে আসছে! এলো…এলো! এসেই পড়ল!
—“না!”
প্রণবের কথাকে বিন্দুমাত্রও পাত্তা না দিয়ে মানুষটা সবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাস্তায়। ট্রাকের ড্রাইভার এমন ঘটনার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না! তার করারও বিশেষ কিছু নেই। প্রণবের চোখের সামনে একটা জগদ্দল ট্রাক গোটা মানবদেহকে সম্পূর্ণ পিষে দিয়ে চলে গেল, অথচ কারোর কিচ্ছু করার ছিল না!
সুচরিতা ততক্ষণে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে পৌঁছেছে অকুস্থলে। একটু আগেই দেখা জলজ্যান্ত মানুষটার তালগোল পাকানো রক্তাক্ত বীভৎস মৃতদেহটা দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারল না
সে রাস্তার ওপরেই হড়হড়িয়ে বমি করে ফেলল।
৪
চোখের সামনে গভীর অন্ধকার। খাতার সাদা পাতার ওপর কালো কালির দোয়াত উলটে পড়লে যেমন গোটা পাতাটাই কালো হয়ে যায়, ঠিক তেমনই নিকষ কালো রং ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে। এমন বেদনাময় অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসে। নির্জীব আঁধারে প্রাণের কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। বরং যে কোনও মানবমন এই তমিস্রার হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়।
ঠিক তেমনই শ্বাসরোধকারী অন্ধকারে ছটফট করছিলেন শুক্লা। এক করাল অন্ধকূপ তাঁকে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। তিনি অনুভব করছিলেন সুনিবিড় এক নিরাপত্তাহীনতা আস্তে আস্তে জড়িয়ে ধরছে তাঁকে। খুঁজছিলেন এক বিন্দু আলোর রশ্মি! কোথাও কি একটু আলো নেই?
শুক্লার শীত করছিল। এই গুমোট গরমের দিনে এত ঠান্ডা লাগছে কেন! তার হাত, মুখ আস্তে আস্তে হয়ে উঠছে বরফশীতল। অবিকল মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছেন তিনি। উষ্ণতা!…একটু উষ্ণতা বড় প্রয়োজন! কিন্তু তিনি আছেন কোথায়? সত্যিই কি কোনও পার্থিব জগৎ তাকে ঘিরে রেখেছে, না কোনও অলৌকিক জগতে আছেন! যেখানেই থাকুন, এখান থেকে বেরোবার রাস্তা তাকে খুঁজে নিতেই হবে।
অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে আসতেই শুক্লার মনে হল, তিনি একা নন আরও কেউ আছে এখানে! সেই অজ্ঞাত মানুষটির নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছেন! কেউ একটা জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে।
—“কে?”
শুক্লা টের পেলেন তার গলা সামান্য কাঁপল। শীতলতার মাত্রা ক্রমশই বাড়ছে। এসি তো আজ দুপুরে অন করেননি! তবে এই হিমেল অনুভূতির উৎস কোথায়!
এবার শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ নয়, আবছা একটা ছায়ামূর্তিও চোখে পড়ল। ছায়া ছায়া এক মানুষের দেহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। তিনি আবার বললেন, “কে! কে ওখানে!”
আর কিছু বলার আগেই একজোড়া সবল হাত চেপে ধরেছে তার গলা! দুটো লৌহকঠিন হাত সজোরে পিষছে কণ্ঠনালী! তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না! হাতদুটোর মালিককে ঠিকমতো দ্যাখা যায় না। মানুষ নয়, হয়তো বা অন্ধকারই করাল থাবায় চেপে ধরেছে তার টুটি। শুক্লার মনে হল, তিনি এবার মরেই যাবেন! দমবন্ধ হয়ে আসছে… ফুসফুসে একফোঁটাও অক্সিজেন নেই। আপ্রাণ যুদ্ধ করছেন অজ্ঞাত প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে, কিন্তু এই নিষ্ঠুর হাতের নিষ্পেষণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার শক্তিও তার নেই। প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে যাচ্ছেন! অন্ধকার… বড়ো অন্ধকার …
প্রায় ঘর্মাক্ত কলেবরে ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসেন শুক্লা! স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় তার হাত দুটো স্পর্শ করল নিজের গলা। নাঃ, সেখানে সেই দুর্বৃত্ত হাতের কোনও চিহ্ন নেই। হাঁফাতে হাঁফাতে সজোরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। ওঃ, ঈশ্বর! নিতান্তই দুঃস্বপ্ন! অথচ ক্ষণিকের জন্য হলেও মৃত্যুর স্বাদ পেয়েছিলেন! একবারের জন্যও মনে হয়নি গোটাটাই স্বপ্ন! স্বপ্ন এমন বাস্তব কী করে হয়ে উঠতে পারে!
শুক্লা বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে কপালের ঘাম মোছেন। হৃৎপিণ্ডটা এখনও ধড়ফড় করছে। ভয়ের ধাক্কায় কাঁপছে চোখ মুখের পেশীও। আশেপাশে এক ঝলক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। তার ঘরে হালকা আলো জ্বলছে। সম্ভবত ভোলাই এসে জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে। বাইরের আবছা অন্ধকারে আরও কালো হয়ে এখনও পড়ে আছে বটগাছটা। ওর দিকে তাকালেই কেমন যেন গা শিরশির করে। বড় বিষণ্ণতা নির্জীব গাছটার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে! এক বিরাট মহীরুহের কী ট্র্যাজিক পরিণতি!
বাবি যখন ছোটো ছিল, তখন ঐ গাছটায় একটা দোলনা বেঁধে দিয়েছিলেন প্রণব। সে মহানন্দে গাছটায় বসে দোল খেত। সঙ্গে সঙ্গে বটগাছটার ঝুরিও যেন মহানন্দে দুলত। পাতায় পাতায় ছোট্ট শিশুর উচ্ছ্বাস খেলা করে বেড়াত। বটগাছটা বাবির অনেকদিনের সঙ্গী।
দোলনাটা অনেকদিন আগেই ছিঁড়ে গিয়েছে। গাছটাও শেষ হয়ে গেল। বাবি কোথায় কে জানে! ভাবতেই ভীষণ কান্না পেয়ে গেল শুক্লার। বুকের ভেতরে এক প্রচণ্ড ভার! নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। অজ্ঞাত কোনও এক মর্মবেদনায় আপনমনেই কান্না-জড়ানো গলায় বললেন, “সব দোষ আমার! সব দোষ আমার… আমারই!”
— ‘ধপ্…ধপ…ধপ্…’
আচমকা অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুনে সচকিত হয়ে উঠলেন শুক্লা। দোতলার ঘরে ও কীসের শব্দ! একটা জোরালো আওয়াজ ধাক্কা মারছে কর্ণেন্দ্রিয়ে। উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা শুনছেন তিনি। আওয়াজটা একবার এদিকে আসছে। পরক্ষণেই যেন অন্যদিকে যাচ্ছে। তীক্ষ্ণ নয়, একটানা ভোঁতা আওয়াজ, ‘ধপ্…ধপ…ধপ…!’
দোতলায়, এই ঘরের ঠিক ওপরেই একটা পরিত্যক্ত স্টোররুম। এ বাড়ির সমস্ত প্রাচীন ও অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ওখানেই রাখা হয়। আশ্চর্য! এখন
তো ও-ঘরে কোনওরকম শব্দ হওয়ার কথা নয়! বহু বছর হয়ে গেল স্টোররুমটায় কেউ কোনও প্রয়োজনেই ঢোকে না। মাঝেমধ্যে অবশ্য ইঁদুরের উৎপাত হয়। তখন ভোলা দায়িত্ব নিয়ে নেমে পড়ে সাফাই অভিযানে। কিন্তু এ কোনও মানুষের স্বাভাবিক পায়ের আওয়াজ বলে মনে হয় না। হাঁটার বা দৌড়োনোর আওয়াজ তো নয়ই। বরং এক পায়ে লাফালে খানিকটা এমনই শব্দ হয় বটে! স্টোররুমে কে এক পায়ে লাফাবে!
আওয়াজটা ক্রমাগতই বাড়ছে। শুক্লা বিস্মিত হলেন। স্টোররুমে এখন আবার কে গেল? প্রণব বা সুচরিতা ও ঘরে ঢুকবেন বলে মনে হয় না। তবে কি ভোলা!
তিনি বিছানা থেকে নেমে আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে এলেন। তার ঘরে আলো জ্বলছে ঠিকই, কিন্তু হলঘর অন্ধকার। শুধু হলঘর নয়, গোটা বাড়িটাই অন্ধকার। শুক্লা বিস্মিত হলেন! ভোলা এখনও বাড়ির আলোগুলো জ্বেলে দেয় নি? রোজই তো সন্ধে নেমে আসার পর সব ঘরের আলো জ্বেলে দেওয়া তার রুটিন। কারণ বাড়ির কর্ত্রী মনে করেন যে সন্ধেবেলায় বাড়ি অন্ধকার করে রাখা অমঙ্গলসূচক। তাই বহুবছর ধরেই এই কাজটা করে আসছে ভোলা। আজ কি তবে ভুলে গেল! নাকি ফিউজ উড়ে গেল কোথাও!
এদিক-ওদিক, কোনও দিকেই কারোর চিহ্নমাত্র নেই! প্রণব বা সুচরিতাকে দ্যাখা যাচ্ছে না। এমনকি শোনা যাচ্ছে না তাদের কণ্ঠস্বর বা কথোপকথনও শ্মশানের মতো নিস্তব্ধ হয়ে আছে গোটা বাড়ি। ভোলারও কোনও সাড়াশব্দ নেই। সবাই গেল কোথায়!
মাথার ওপরের আওয়াজটা সাময়িক বিরতি দিয়েছিল। এবার দ্বিগুন জোরে শুরু হল। সেই একটানা ধপ্ ধপ্! কীসের শব্দ! কে-ই বা পরিত্যক্ত স্টোররুমে অসময়ে ঢুকল! দেখতেই হচ্ছে!
শুক্লা হাত বাড়িয়ে হলঘরের আলোটা জ্বেলে দিলেন। ফিউজের কোনও সমস্যা নেই, মুহূর্তের মধ্যে আলোকিত হল গোটা ঘর। হলঘরের একপাশে টেবিলে রাখা ছিল টর্চ। সেটাই তুলে নিয়ে অদম্য কৌতূহলে তিনি এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে। ঘরের আলোর খানিকটা উপছে পড়ে আলোকিত করেছে সিঁড়ি। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কোণে কোণে, বাঁকে বাঁকে ওঁত পেতে আছে অন্ধকার। আর অন্ধকার দেখলেই আজকাল বুক কাঁপে তার। তবু সাহসে বুক বেঁধে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলেন শুক্লা! হাতের টর্চটাও জ্বেলে দিলেন।
দোতলাতেও এই মুহূর্তে কোনও আলো নেই! কী আশ্চর্য! ভোলা তার নামের সার্থকতা রেখে সত্যিই ভুলে গেল? না সে বাড়িতেই নেই? এরকম ঘটনা আজ পর্যন্ত এ বাড়িতে হয়নি। বিস্মিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা বিরক্তও হলেন তিনি। তাকে ঘরে একা রেখে সবাই কোন রাজ-কার্যে গিয়েছে! আর দোতলায় এমন শোরগোলই বা করছে কে!
শুক্লা সাবধানে সিঁড়ি পেরিয়ে এসে দোতলার সুসজ্জিত ড্রয়িংরুম ক্রস করলেন। টর্চের আলো সরলরেখায় ধীরে ধীরে ছুঁয়ে যাচ্ছে দেওয়াল, সোফা, আসবাবপত্র। তারপরই লম্বা করিডোর। দু-পাশের দেওয়ালে সাজানো নানাধরনের অয়েল পেইন্টিং। প্রণবের শখ। মাঝেমধ্যেই নানারকম দামি দামি অয়েল পেইন্টিং কিনে এনে ঘর সাজান। এখন ঘরের দেওয়াল কম পড়েছে বলে করিডোরও সাজিয়েছেন।
চতুর্দিক ডুবে আছে অন্ধকারে। তার মাঝখান দিয়ে এক নিঃসঙ্গ ছায়ামূর্তি হাতে টর্চ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কিছু নেই, অথচ প্রত্যেকটি পদক্ষেপের সঙ্গে বাড়ছে শব্দের জোর! আগে দুটো আওয়াজের মধ্যে কয়েক সেকেন্ডের বিরতি ছিল। কিন্তু আওয়াজটাও এখন যেন উত্তেজিত হয়ে একদম বিরতিহীন দ্রুত লয়ে চলছে। শুক্লার মনে হল, তার হৃৎপিণ্ডও বুঝি ঐ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে! টের পেলেন দরদর করে ঘামছেন! অসম্ভব ভয় করছে তার। টর্চ ধরা হাতটা সামান্য কাঁপছেও বটে। তা সত্ত্বেও এগিয়ে গেলেন স্টোররুমের দিকে।
শুক্লা টর্চের আলোয় ভালোভাবে দেখতে পাননি। যখন তিনি আস্তে আস্তে এগোচ্ছিলেন, তখন প্রত্যেকটা ছবির সামনে দিয়ে চলে যাওয়া মাত্রই সেগুলো একটা একটা করে নিঃশব্দে সম্পূর্ণ নীচের দিকে ঘুরে যাচ্ছিল। ঠিক যেন অদৃশ্য কেউ রসিকতা করে অয়েল পেইন্টিংগুলোকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে! আর সেই বাঁধানো পেইন্টিং এর কাচে শুধু শুক্লা নয়, তার পিছন পিছন আরেকটা মানবমূর্তির প্রতিফলনও পড়ল! অথচ সেই মানব-মূর্তি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ! যেন রক্তমাংস নয়, বায়বীয় পদার্থে গড়া এক মানুষ চুপিসাড়ে পিছু নিয়েছে তার!
কে সে!
৫
পরিত্যক্ত স্টোররুম তখন ডুবেছিল বিস্মৃতির অতলে।
একরাশ ধুলো বালি ও মাকড়সার জালে আচ্ছন্ন ঘরটাকে দেখলেই বোঝা যায় যে, বহুদিন কেউ পা রাখেনি এখানে। শেষ কবে ভোলা এখানে এসেছিল তা ভগবানই জানেন। চতুর্দিকে শুধু বাতিল জিনিসপত্রের স্তূপ। তিন বছর আগে প্রণব গোটা বাড়িটাকেই রি-ইনোভেট করিয়েছিলেন। পুরোনো আসবাবপত্র তার পছন্দ হচ্ছিল না। এই বাড়িটা প্রণবের বাবার। স্বাভাবিকভাবেই সব ফার্ণিচারই মান্ধাতার আমলের ছিল! আজকাল বাড়িতে কেউ অত ভারি ভারি ফার্ণিচার রাখে না। আবার প্রাণে ধরে ফেলেও দেওয়া যায় না কারণ ওই আসবাবগুলোর সঙ্গে বহুদিনের স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। তাই সেগুলোর স্থান হয়েছে এই ঘরে।
শুক্লা সুইচবোর্ডে হাত রাখতেই দপ্ করে বাল্ব জ্বলে উঠল। বাল্বটার চতুর্দিকে মাকড়সার জাল তার সোনালি আলোকে কিছুটা ম্লান করেছে। তা সত্ত্বেও ঘর আলোকিত হল।
কী নেই এই স্টোররুমে! বহু পুরনো পালঙ্ক, আকবরী আমলের ড্রেসিং টেবিল, ভাঙা চোরা অযত্নলালিত টিভি, গুচ্ছের ভাঙা শো-পিস, অপ্রয়োজনীয় আসবাব, জং ধরা করাত, মাথা ভাঙা হাতুড়ি, বিবর্ণ পর্দা থেকে শুরু করে সৃজনের শৈশবের কাঠের রকিং হর্স, পুতুল অবধি সবই রয়েছে। কিছু জিনিস সাদা কাপড়ের তলায় মূক হয়ে আছে, কিছু ধুলোর আস্তরণে ধূসর।
শুক্লা এ ঘরে পা রাখতে না রাখতেই ধপ্ ধপ্ আওয়াজটা থেমে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে আর কোনও শব্দ নেই। গোটা ঘরটাই নীরবতায় আচ্ছন্ন। তিনি সবিস্ময়ে একবার চতুর্দিকটা জরিপ করলেন। আওয়াজটা তো এখান থেকেই আসছিল! অথচ কোথাও কিছুই নেই! তবে কী হল? তিনিই কি ভুল শুনলেন? এত বড় ভুল তো কখনও হয় না। যখন এদিকে আসছিলেন তখনও আওয়াজটা শোনা যাচ্ছিল। এখন কোথায় গেল!
চিন্তাটা মাথায় আসতেই যতটুকু সময় লেগেছে! শুক্লা একটু বিভ্রান্ত হয়ে স্টোররুমের আলো নিভিয়েই দিতে যাচ্ছিলেন। আচমকা তার পেছন দিক দিয়ে ফের জাগ্রত হল সেই ধ্বনি! ‘ধপ্…ধপ্…ধপ…!
বিদ্যুৎবেগে পিছনে ফিরলেন শুক্লা। সঙ্গে সঙ্গেই আবিষ্কৃত হল শব্দের উৎস! সৃজনের বহু পুরোনো একটা ফুটবল! বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখলেন, পুরনো ফুটবলটা নিজে থেকেই মেঝের ওপরে লাফাচ্ছে! অর্থাৎ বাউন্স করছে। যেন কেউ তাকে সজোরে আছড়ে ফেলছে স্টোররুমের মেঝেতে। পরক্ষণেই বলটা বাউন্স ব্যাক করে লাফিয়ে উঠছে শূন্যে! আবার কোনও অদৃশ্য শক্তি খেলাচ্ছলে তাকে থাবড়ে ফেলছে মাটিতে। বলটা আবার লাফিয়ে উঠছে!
এই অদ্ভুত খেলারই আওয়াজ হচ্ছে, ধপ্ ধপ্! অথচ সেখানে কেউ নেই! কেউ বলটাকে নিয়ে খেলছে না! ওটা নিজে থেকেই একবার লাফিয়ে উঠছে, পরক্ষণেই পড়ছে! আবার লাফাচ্ছে, আবার আছড়ে পড়ছে। আবার!
ভয়ার্ত শুক্লা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ফুটবল কখনও নিজে নিজে এভাবে লাফাতে পারে! তিনি কিছু করার আগেই সাঁই করে তার দিকেই ছুটে এল বলটা! কেউ বুঝি সকৌতুকে বল ছুঁড়ে দিয়েছে তাকে লক্ষ করে।
শুক্লা খপ্ করে বলটাকে ধরে ফেললেন। সৃজনের শৈশবের বড় প্রিয় খেলা ছিল বল ছোঁড়াছুঁড়ি। যেমন দুষ্টুমি করে সে ফুটবলটাকে মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিত, অবিকল তেমনভাবেই যেন কেউ ছুঁড়ে দিল বলটা! তিনি স্তম্ভিত! হৃৎপিণ্ডটা এবার যেন কয়েক হর্সপাওয়ারের মেশিনের মতো চলতে শুরু করেছে। দরদর করে ঘামছেন শুক্লা। এ কী! যা দেখছেন তা কি বাস্তব! না এটাও দুঃস্বপ্ন!
মুহূর্তের নীরবতা! পরক্ষণেই সমস্ত নৈঃশব্দকে ভেঙে দিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠল কে যেন! শুক্লা প্রায় আঁতকে উঠে সামান্য পিছিয়ে গেলেন! তার গোটা দেহই এবার শিউরে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে কে এমন পাগলের মত খলখলিয়ে হাসছে! এ কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাসি নয়। বরং কোনও দুষ্টু শিশু ভারি মজা পেয়ে খটখট্ করে হেসে উঠলে এরকম শোনায়। তিনি উদভ্রান্তের মত এদিক ওদিক দেখছেন। কে হাসছে! কে! কোথায়? কেন!
খুঁজতে খুঁজতেই ঘরের এককোণে দৃষ্টি গেল তার। সৃজনের লাফিং ডল! সচরাচর এই জাতীয় লাফিং ডলকে কেউ স্পর্শ করলে পুতুলটা পাগলের মত হাত-পা ছুঁড়ে হাসতে থাকে। তার হাসির আওয়াজ অবিকল একটি শিশুর মত। এখনও পুতুলটা ভারি মজা পেয়ে হাত-পা ছুঁড়ে খিল্ খিল্ করে হাসছে! অথচ আদৌ তার হাসার কথাই নয়! কারণ কেউ তাকে স্পর্শ করেনি। এখানে শুক্লা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও মানুষ নেই।
হাসতে হাসতেই পুতুলটা খন্ড মুহূর্তের জন্য থামল। তারপরই আবার হাসতে শুরু করল! বোধহয় কেউ বারবার পুতুলটাকে সবার অগোচরে ছুঁয়ে যাচ্ছে। যখনই সে হাসতে হাসতে থামছে, তখনই আবার টুক করে তাকে স্পর্শ করছে। ফলস্বরূপ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে পুতুলটা! সে হাসি অদ্ভুত নিষ্ঠুর! শিশুর হাসির মতো সুন্দর জিনিস খুব কমই আছে। কিন্তু শুক্লার মনে হল, শিশুর হাসির মতো ভয়ংকর জিনিসও খুব কম! ভয় পাচ্ছেন তিনি। ভীষণ ভয় পাচ্ছেন!
তার কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘামের ফোঁটা চুঁইয়ে পড়ে। এসব কী হচ্ছে! যা ঘটছে তা বাস্তব নয়! হতে পারে না! ফুটবল নিজে থেকেই ড্রপ করতে পারে না। লাফিং ডল নিজে থেকেই হাসতে পারে না। অসম্ভব!
পুতুলটা হাসি থামাতে না থামাতেই ফের একটা কড়কড়ে আওয়াজ! এবার আর দিক চিহ্নিত করতে ভুল হয়নি। শুক্লা সটান তাকালেন ঠিক তার ডান দিকে। সেখানে ধূলি-ধূসরিত আদ্যিকালের রেডিয়ো পড়ে ছিল। তিনি সভয়ে আবিষ্কার করলেন, এখন রেডিয়োটাই এই অদ্ভুত যান্ত্রিক আওয়াজ করছে। কেউ যেন অন করে দিয়েছে ওটাকে! বহু পুরনো রেডিয়ো! অনেকদিন আগেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আর মেরামত করা যায়নি। প্রায় একযুগ ধরে নীরব হয়েছিল রেডিওটা। আজ, বহুবছরের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বলে উঠল, “নমস্কার,” রেডিয়োর ভেতর থেকে ভেসে এল ঘোষকের গমগমে কণ্ঠস্বর, “আপনারা শুনছেন কলকাতা ক। আর আমি…”
এবার যা হল তা অবিশ্বাস্য! সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেডিয়োর ঘোষকও বলে উঠলেন, “আমি জানি যা হয়েছিল।”
ভয়, বিস্ময়ের সীমা সহ্যশক্তির অন্তিম পর্যায় পেরিয়ে গেল। শুক্লার মনে হল, তিনি এখনই হার্টফেল করবেন! যে রেডিয়ো অচল, আজ তার ভেতর থেকেই গম্ভীর আওয়াজ আসছে, “আমি জানি যা হয়েছিল!…আমি জানি যা হয়েছিল….আ-মি জা-নি যা হ-য়ে-ছি-ল!”
তীব্র আওয়াজে কানের পর্দা প্রায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম! বদ্ধ ঘরের মধ্যে প্রতিটা ইট-কাঠ-পাথর ফুঁড়ে, প্রতিটা প্রাচীন আসবাবের মধ্য দিয়ে ভেসে আসছে চিৎকার! না, ঠিক চিৎকার নয়; আর্তনাদ! একটাই বাক্য! একটাই বক্তব্য, “আ-মি জা-নি যা হ-য়ে-ছি-ল!”
আর সহ্য হচ্ছে না! আর সহ্য করা সম্ভব নয়! এবার বোধহয় মাথাটাই ফেটে যাবে! মস্তিষ্কের শিরা উপশিরা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম! দু-হাতে নিজের কান চেপে ধরেছেন শুক্লা। হাত থেকে টর্চটা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। অসম্ভব ভয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ভয়তাড়িত মানুষটি অন্ধকারের তোয়াক্কা না করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োলেন। অন্ধকার করিডোরের আলো কারোর ইশারায় দপদপিয়ে জ্বলে উঠল। আশপাশের যত ঘর অন্ধকারে ডুবেছিল, সর্বত্র এবার আলো জ্বলছে। শুধু জ্বলছে না, আবার নিভছেও। কে-যেন খামখেয়ালি আঙুলে লাইটগুলোকে সুইচ অন, সুইচ অফ করছে! জ্বলছে… নিবছে… জ্বলছে… নিবছে… জ্বলছে!
কোনওমতে হুড়মুড়িয়ে দোতলা থেকে নেমে এলেন শুক্লা! প্রায় প্রাণ হাতে করে পড়ি-কী-মরি ছুটছেন। পালাতে হবে। যে করেই হোক, এখান থেকে পালাতেই হবে তাকে! হাঁফাতে হাঁফাতে নীচের হলঘরে নেমে এলেন। তিনি কি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছেন! যা দেখছেন, যা ঘটছে; সবটাই কি তার কল্পনা হতে পারে? চূড়ান্ত ভয়ের সঙ্গে একটা অসহায় কান্নাও তাকে গ্রাস করছে। দু-একবার শাড়িতে পা বেজে সপাটে আছড়ে পড়লেন মাটিতে। হাতে, পায়ে ব্যথা পেলেন! কিন্তু তবু থামলেন না। পালাতেই হবে! আর উপায় নেই।
পাগলের মতো দৌড়োতে দৌড়োতেই তিনি সজোরে ধাক্কা খেয়েছেন কারোর সঙ্গে। ভয়ার্ত, বিধ্বস্ত মানুষটি দেখলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অতি পরিচিত একটা মুখ। দীর্ঘকালের বিশ্বস্ত ভৃত্য ভোলা! সে ঐ সুপ্রাচীন বটগাছটার মত একটা নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উঃ! অবশেষে একজন আপন মানুষ! একটু উষ্ণতা… একটু স্বস্তি!
—“ভো-লা!” এতক্ষণ আতঙ্কে, প্রবল নিরাপত্তাহীনতায় বোধহয় সমস্ত অনুভূতিই মুছে গিয়েছিল। এবার ভোলাকে ছেলেমানুষের মত দু-হাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন শুক্লা। কোনওমতে বলললেন, “ভোলা!… ও-ওই ঘরে ওই ঘরে কেউ আছে। কিছু আছে! ভোলা, আমায় বাঁচা!… প্লিজ বাঁ-চা!”
ভোলা মুখ নীচু করে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকাল কর্ত্রীর দিকে। শুক্লা তার মুখের দিকে তাকিয়েই তড়িদাহতের মত কেঁপে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন! এ কী! ভোলার চোখ দুটো যে সম্পূর্ণ সাদা! অবিকল সেই অফিসারের পাথরের চোখ দুটো কেউ বসিয়ে দিয়েছে তার চোখে! একদম ফকফকে সাদা চোখে তাকিয়ে আছে সে।
যন্ত্রচালিতের মতো বলল ভোলা, “আমি জানি যা হয়েছিল!”
ভোলার ঠিক পেছন থেকেই আরও একটি কণ্ঠ বলে উঠল সেই একই কথা! একই বাক্য! ভয়বিহ্বল দৃষ্টিতে শুক্লা দেখলেন, এক জন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে হলঘরে। তার পরনে ডাক্তারের অ্যাপ্ৰণ। হাতে সার্জিক্যাল নাইফ! চোখ দুটো সাদা। ভোলার হাতেও একটা ছুরি! কিচেন নাইফ!
দু-জনেই হাতের দুটো ছুরি সামান্য তুলে ধরে তোতাপাখির মতো সমবেতস্বরে বলল, “আ-মি জা-নি যা হ-য়ে-ছি-ল…”
৬
ঠিক রাত তিনটে।
গোটা বাড়িটা এখন নিঝুম। ঘণ্টা চারেক আগেও এখানে পুলিশের দাপাদাপি চলছিল। অ্যাম্বুলেন্সের গগনবিদারী চিৎকার, পুলিশদের জোরালো বুটের খটখট, উচ্চস্বরের জেরায় উচ্চকিত হয়েছিল গোটা পরিবেশ। দু-দুটো লাশ পাওয়া গিয়েছে এ বাড়িতে। একটা দেহ ভোলার। অন্যটা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অপরিচিত হলেও পুলিশ তাকে শহরের নামকরা ডাক্তার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ডাক্তারবাবুর সম্পূর্ণ নাম ডঃ পূর্ণেন্দু সেন। পাওয়া গিয়েছে চিলড্রেন্স পার্কের সেই অজ্ঞাতপরিচয় লোকটির হদিশও। সে নামকরা হিস্ট্রিশিটার। শহরের অন্যতম দাগী সুপারি-কিলার রাশিদ মন্ডল। কিন্তু হঠাৎ করে সে আত্মহত্যা করল কেন তা এখনও অজ্ঞাত। যেমন অপরিচিত ডাক্তার ও ভোলার আত্মহত্যার পিছনেও কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি!
হ্যাঁ, ভোলা এবং আগন্তুক দু-জনেই আত্মহত্যা করেছে। দু-জনেই হাতের ছুরিটা নিজের বুকেই গেঁথে দিয়েছিল। কেন, কী জন্য কেউ জানে না! যখন সুচরিতা ও প্রণব বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন, তখনই আবিষ্কার করেছিলেন ব্যাপারটা। হলঘরে দু-দুটো মৃতদেহের মাঝখানে নির্বাক পুতুলের মতো জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলেন শুক্লা! কিন্তু কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল; কিছুই বলতে পারছেন না। পুলিশও তার মুখ থেকে কোনও কথা বের করতে পারেনি। তিনি শুধু মেঝেতে গুটিশুটি বসে হী হী করে কাঁপছেন আর একটা কথাই বিড়বিড় করে বলছেন।
—“আমি জানি যা হয়েছিল!”
চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি একের পর এক লাগাতার মৃত্যু। শুরু হয়েছিল ইনভেস্টিগেটিং অফিসারকে দিয়ে। কিন্তু আদৌ শেষ হয়েছে কিনা বলা দায় চব্বিশ ঘন্টায় চার জন! তা ও অদ্ভুত পদ্ধতিতে আত্মহত্যা! যদিও এখন পুলিশ আত্মহত্যার থিওরিতে বিশ্বাস করছে না। তবু এক অসহায়, মানসিকভাবে পর্যুদস্ত ও ক্ষীণকায় শিক্ষিকা ছুরি দিয়ে নিজেরই বাড়ির চাকর ও এক জন অজ্ঞাত-পরিচয় ব্যক্তিকে মারবেন. তা-ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর সুপারি-কিলার রাশিদ যে নিজেই ট্রাকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। ট্রাক ড্রাইভার তাৎক্ষণিকভাবে পালিয়ে গেলেও পরে তাকে ধরতে পেরেছে পুলিশ। তার বয়ান প্রণব ও সুচরিতার সঙ্গে হুবহু মিলে গিয়েছে। ট্র্যাফিক সিগন্যালের সিসিটিভি ফুটেজেও যতটুকু দেখা গেল তাতেই স্পষ্ট, লোকটা নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ট্রাকের সামনে। সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
তবু তারা একের পর এক প্রশ্ন করে গিয়েছে শুক্লাকে। ঘটনাটা কখন ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে, এর পিছনের কারণ সম্পর্কে শুক্লার কোনওরকম ধারণা আছে কিনা ইত্যাদি রুটিন প্রশ্ন। আর প্রত্যেকবারই বিড়বিড় করে একই কথা বলে গিয়েছেন শুক্লা।
—“আমি জানি যা হয়েছিল, আমি জানি যা হয়েছিল, আমি জানি…!” অবশেষে কিছুই বুঝতে না পেরে ওদের সাময়িক নিষ্কৃতি দিয়েছে পুলিশ। শুক্লাকে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান এসে দেখেও গেছেন। তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দেখে কিছু ওষুধ ও সেডেটিভ প্রেসক্রাইব করে দিয়েছেন। আপাতত সেই সেডেটিভের কল্যাণেই গভীর ঘুমে হয়তো বা প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছেন তিনি। তার অবস্থা দেখে সুচরিতাও আপাতত এ বাড়িতেই থেকে গিয়েছে।
এক তলার গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ঢং ঢং করে ঠিক তিনটে ঘন্টা পড়ল। চতুর্দিক জনহীন। শুধু দু-একটা বেওয়ারিশ কুকুর মাঝেমধ্যে কেঁদে উঠছে। কুকুরের কান্না অশুভ। তার ওপর এত রাতে দূর থেকে ভেসে আসা করুণ ডাক কেমন যেন অলৌকিক লাগছে! আকাশে আজও মেঘ জমে আছে। কালো রঙের থরে থরে জমাট বাঁধা অন্ধ মেঘগুলোকে দেখলে ভয় করে। মেঘ নয়, প্রকৃতির ভ্রূকুটি।
—“উঁ…ঊ…উঁ…উঁ!”
দূর থেকেই আবার কুকুরের কান্না ভেসে এল। অসহ্য কাঁদুনি! শুনলেই অস্বস্তি লাগে! এমনভাবে কাঁদছে যেন জাগতিক প্রাণী নয়, কোনও অতৃপ্ত প্রেতাত্মা গুমরে গুমরে কেঁদে মরছে! তার সঙ্গেই একটা খস্থস্ শব্দ! অন্ধকারের মধ্যেই প্রকট হল এক আবছায়া মূর্তি। কিছুক্ষণের প্রতীক্ষা তারপরেই দপ্ করে আলো জ্বলে উঠেছে। ছায়াটার বাঁ হাতে একটা টর্চ। ডান হাতেও ধাতব কিছু একটা চকচক করে উঠল। তবে এখনও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না যে ওটা কী!
ছায়ামূর্তি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ভূপতিত মহীরুহের দিকে। কাঠের গায়ে একটা ধাতব ধারালো জিনিসের কোপ পড়ার শব্দ! কুড়ুল! ছায়াদেহ ভীষণ উত্তেজিত! বটগাছটার শাখা-প্রশাখায় এক হাতেই কুড়ুল ধরে কোপের পর কোপ মারছে। এই গাছটাই যত নষ্টের গোড়া! এটাকে এখনই ঝড়ের আঘাতে উলটে পড়তে হল! তা-ও এমনভাবে পড়েছে যে নির্দিষ্ট জায়গাটা খুঁজে বের করাই প্রায় অসম্ভব! লোকজন ডেকে সাফ করানোও বিপজ্জনক। কে জানে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যদি কেউটে বেরিয়ে আসে! এখনই যা করার করে ফেলতে হবে। গাছটা সরানো যাবে না, তবু যদি কোনওভাবে একটু ডালপালা সরিয়ে দিয়ে জিনিসটা বের করে আনা যায়…
—“পারবে না!”
ছায়ামূর্তির ঠিক পিছন থেকেই ভেসে এল একটি বালকের তীব্র স্বর! তার হাতের টর্চটা হঠাৎ করে কেমন যেন পাগলামি শুরু করল! টর্চের আলো হঠাৎই প্রচণ্ড তীব্র হয়ে জ্বলে উঠে পরমুহূর্তেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে শুরু করেছে। ক্ষীণ হতে হতেই আবার দপ্ করে উজ্জ্বল হয়ে উঠল! আলোটা রীতিমতো নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে।
ছায়ামূর্তি একটু ঘাবড়ে গিয়েই ঘুরে দাঁড়ায়। টর্চের আলোর আওতার বাইরে সুস্পষ্ট একটি ছোট্ট মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন দেহ-রেখা। বোঝা যায়, যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে এক বালক! ছোট্ট মূর্তিটা নড়ল না ঠিকই, তবে আবার শোনা গেল তার শান্ত কণ্ঠস্বর!
—“বাবা, আমি জানি সেদিন যা হয়েছিল!”
—“বাবি!”
অন্ধকারের মধ্যেই স্পষ্ট শোনা যায় প্রণবের গলা, “বাবি, তুই!”
—“তুমি পারবে না বাবা!” বালকের গলায় অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী,
–“সেদিনও তুমি পারো নি! এখনও পারবে না।”
প্রণব স্নেহাদ্র কণ্ঠে বলে, “কী বলছিস বাবা!”
— “আমি জানি সেদিন যা হয়েছিল!” বালকের কণ্ঠস্বর কয়েক পর্দা চড়ল,
— “সেদিনও হয়নি! আজও হবে না।”
প্রণব কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন সেই বালকের আবছায়া মূর্তির দিকে। তারপর আস্তে আস্তে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। অসম্ভব অনুতাপ, প্রচণ্ড যন্ত্রণা-মাখা কণ্ঠে বললেন, “বাবি, আমার ভুল হয়ে গিয়েছে! বিশ্বাস কর! ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট!”
আবার ভেসে এল সেই একই বাক্য, “আমি জানি সেদিন যা হয়েছিল!”
—“আমি তোকে মারতে চাইনি!” এবার কান্না-বিকৃত শব্দগুলো কোনওমতে উচ্চারণ করলেন তিনি, “ওটা শুধু একটা অ্যাক্সিডেন্ট।”
—“মা-কে মারতে চেয়েছিলে। সেটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়, মার্ডার ছিল!” মুহূর্তের মধ্যে প্রণবের চোখের সামনে ভেসে উঠল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দৃশ্য! মনে পড়ল সেই সুপারি-কিলার রাশিদের কথা! লোকটা খুব মৃদুস্বরেই বলেছিল,
—“এত মগজমারির কী আছে উকিলসাহেব? এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার তো লিগ্যাল! সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পারমিশন দিয়ে দিয়েছে। আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন। এরকম মারাত্মক কাজ করছেন কেন? ম্যাডামকে বলে দিন-না!”
—“ম্যাডামকে কী বলব?” ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলেন প্রণব, “বলব, যে তোমার বোন সুচরিতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে? বলব, যে পিল নেওয়া সত্ত্বেও সে প্রেগন্যান্ট হয়েছে! এখন বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু কয়েক মাস পরেই বোঝা যাবে! ওর পেটের বাচ্চাটা আমার! এইসব বলব ম্যাডামকে!”
—“আরে তা-লে ডিভোর্স দিন না! খামোকা কিচাইনের কোনও মানে হয়?” সুপারি-কিলার ব্যঙ্গ-বঙ্কিম হাসে, “শালিকে বিয়ে করতে হলে বৌ-কে খুন করতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিল!”
—“আর ইউ ইনসেন রাশিদ?” প্রণব বিরক্ত, “শুক্লাকে ডিভোর্স দেব কোন্ গ্রাউন্ডে? তার দিক দিয়ে কোনও ত্রুটি নেই। তাছাড়া ডিভোর্স দিলেও তাকে খোরপোশ দিতেই হবে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার ছেলে বাবি। সে এখন সব কিছু বোঝে। ডিভোর্স হলে ছেলের কাস্টডি শুক্লা পাবে। বাবি আমাকে ভালোবাসলেও মা-কে ছেড়ে থাকতে পারবে না। আর এসব জানার পর তো আমার সঙ্গে আরও থাকবে না! বাবিকে ছাড়া আমিও থাকতে পারব না।”
—“লেঃ হালুয়া!” রাশিদ হাসতে হাসতে মাথা চুলকোয়, “আপনাদের বড়ো মানুষদের ব্যাপার স্যাপার শ্লা বহুত গড়বড়ের! বউয়ের কোনও খুঁত নেই, ছেলেকে ছাড়া থাকতে পারবেন না! তবে শালির সঙ্গে ইন্টুপিন্টু করতে গেলেন কেন? আমরা অশিক্ষিত পাব্লিকরা তো বউয়ের খুঁত থাকলে তবেই অন্য মেয়েছেলে-মুখো হই। আপনারা শা, এমনি এমনিই! কোনও অশান্তি নেই, কিচ্ছু নেই… অথচ…! মজায় আছেন!”
রাশিদের কথাগুলো যেন সপাটে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছিল প্রণবের মুখে! একটা সুপারি কিলার তাকে ধর্মের পাঠ পড়াচ্ছে! সত্যিই তো! বহু বছরের দাম্পত্য জীবনে শুক্লার দিক থেকে কোনও অভিযোগ করার সুযোগ পাননি তিনি। শুক্লা পারফেক্ট ঘরণী, পারফেক্ট স্ত্রী এবং অবশ্যই এক জন পারফেক্ট মা ও বটে। কিন্তু পারফেক্ট প্রেমিকা নন! সুচরিতার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কারণ ওই একটাই। সে দামাল, শুক্লার মতো লাজুক নয়। সুচরিতা অনেক বেশি সাহসী এবং বুদ্ধিমতী। কোর্টে সিংহের উপযুক্ত সিংহীর মতো লড়তেও জানে। বহু বছর একঘেয়ে উত্থান-পতনহীন দাম্পত্য জীবনে অভ্যস্ত প্রণব তার মধ্যে রোমাঞ্চ খুঁজে পেয়েছিলেন! আর সুচরিতা খুঁজছিল সম্পর্কের পরিচয়। বারবার বলছিল, “অনেক হয়েছে। আর কত দিন এমন লুকিয়ে লুকিয়ে চলবে সব? এবার তুমি দিদিভাইকে ডিভোর্স দিয়ে আমায় বিয়ে করো।”
কিন্তু সেটাই তো পেরে উঠছিলেন না প্রণব। শুক্লার শান্ত, আনন্দিত মুখ, ছেলের সঙ্গে মায়ের নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক তাকে কিছুতেই ভাঙনের কথা বলতে দিচ্ছিল না। দিনের পর দিন বাধ্য হয়েই এক পারফেক্ট স্বামীর অভিনয় করে চলেছিলেন। ওদিকে সুচরিতা ঘোষণা করল, “আমি প্রেগন্যান্ট প্রণবদা!”
প্রণব একদিকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আদর্শ স্বামীর অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এবার দুনিয়ার সব রাগ গিয়ে পড়ল শুক্লার ওপরে! এই নারীর জন্য কিছুতেই তিনি সুচরিতাকে বিয়ে করতে পারবেন না! এই নারীর জন্য তাকে হয়তো সন্তান-সুখ থেকেও বঞ্চিত হতে হবে! এই নারী নিজেকে আদর্শ স্ত্রী প্রমাণ করে প্রণবকে লম্পট প্রমাণ করে দেবে। বাবি তাকে ঘেন্না করবে, সমাজ তাকে ঘেন্না করবে! সবাই বলবে, –“বৌ-টা বড় ভালো ছিল, লোকটাই…!” বাবি বলবে, “আমার বাবা চরিত্রহীন!”
আর সহ্য করতে পারছিলেন না প্রণব। সন্তান, সমাজ, সুনাম; সবকিছু বাঁচানোর একটাই উপায়। শুক্লাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া! আইনি পথে নয়, বেআইনি পথে!
বহুদিনের পুরোনো ভৃত্য ভোলাকে নরমে-গরমে পথে এনেছিলেন তিনি। ভোলা সেদিন শুক্লার খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। তিনি নিজে চলে গিয়েছিলেন কোর্টে। কারণ খোদ আদালতে উপস্থিত থাকার চেয়ে বড়ো অ্যালিবাই আর নেই। রাশিদকে প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন। প্রণব জানতেন, লাঞ্চের পর শুক্লা নিজের ঘরে বিশ্রাম নেবেন। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার দরুন তার ঘুম ভাঙবে না। বাবি নিজের রুটিন অনুযায়ী অতনুদের বাড়িতে খেলায় ব্যস্ত থাকবে। ভোলাকে তো আগেই হাত করেছিলেন। পুরো ফাঁকা মাঠ! সুপারি-কিলার রাশিদ ঠিক নিজের কাজটা করে দেবে। এক দুর্বল নারীর গলা টিপে মারতে তার হাতও কাঁপবে না। তার কেস-ফাইল থেকে জেনেছিলেন, খুনের কোনও প্রমাণ রাখে না রাশিদ। এমনকি, গলায় হাতের ছাপও থাকবে না। তারপর স্বাভাবিক মৃত্যুর সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য ডঃ পূর্ণেন্দু সেন তো আছেনই!
একদম পারফেক্ট প্ল্যানিং করেছিলেন প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানতেন, এটাই সোশ্যাল ইমেজ রক্ষা করে, ছেলের কাছে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে শুক্লার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায়। কিন্তু এটা জানতেন না, যে ঠিক সেদিনই সৃজন টেবল টেনিসে হারবে! সেদিনই মুড অফ হবে তার!
এবং সেদিনই সে বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া করে সময়ের অনেক আগেই বাড়িতে ফিরে আসবে! আর ফিরেই যে সটান মায়ের ঘরে হানা দেবে, তাই বা কে জানতো!
আজ ছোট্ট ছায়াটার সামনে হাঁটু-গেড়ে বসে অনুতাপে কাঁদছিলেন তিনি। কী করে জানবেন যে শুক্লাকে খুন করতে আসা রাশিদকে সৃজন দেখে ফেলবে! কী করে বুঝবেন, যে ছেলের জন্য এতকিছু সেই ছেলেকেই নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে খুন করে ফেলবে নিষ্ঠুর সুপারি কিলার! রাশিদ প্ল্যানমাফিক শুক্লার ঘরে ঢুকেছিল। তাকে সাহায্য করেছিল ভোলা! কিন্তু শিকারকে মারার আগেই সে ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল সৃজন! আর নিষ্ঠুর খুনী প্রত্যক্ষদর্শী ছেলেটিকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বারো বছরের বালককেই গলা টিপে মেরে ফেলল!
—“সব শেষ হয়ে গেল!… সব শেষ! আমি তোকে মারতে চাইনি বাবি!” বালকের ছায়ামূর্তি নীরব। ভূ-লুণ্ঠিত বটগাছটা যেন একটু নড়ে উঠল। এই গাছটার তলায় নিজের হাতে সন্তানের নিথর দেহটা পুঁতে দিয়েছিলেন প্রণব। বাবির হস্তক্ষেপে সেদিনের পুরো পরিকল্পনাই ভেস্তে গিয়েছিল। শয়তান খুনীটা বাবিকে খুন করে পালিয়েছে দেখে ভয়ার্ত ভোলা ফোন করেছিল প্রণবকে তিনি প্রথমে অসম্ভব শোকে কী করবেন, কী বলবেন বুঝতে পারেননি। ভোলা উপায়ান্তর না দেখে সৃজনের মৃতদেহটাকে গভীর রাত অবধি লুকিয়ে রেখেছিল স্টোররুমে! বাতিল, বৃদ্ধ ফার্ণিচারের তলায় সযত্নে রাখা ছিল তার লাশ! পুলিশ যখন বাইরে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তখন নিজের বাড়ির স্টোররুমেই শুয়ে ছিল প্রাণহীন সৃজন। গভীর রাতে সুযোগ বুঝে প্ৰণব ও ভোলা তাকে ঠিক বটগাছটার তলাতেই সমাহিত করেন!
—“তুমি আর পারবে না বাবা! মা-কে মারতে তুমি আর কখনই পারবে না! আমাকেও সরাতে পারবে না। আমি সবসময় এখানেই থাকব।” স্পষ্ট কাটা কাটা উচ্চারণে বলল বালক, “মায়ের কাছে।”
প্রণব বুঝলেন, তার বিদেহী সন্তান সত্যিই সব জানে! ওর কাছ থেকে আর কিছু লুকোনো যাবে না। যেমন লুকোনো যায়নি ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের শ্যেনদৃষ্টি থেকে। অফিসার জানতে পেরেছিলেন সবই। প্রচুর টাকা খাইয়ে তার মুখ বন্ধ করতে হয়েছিল প্রণবকে। সুচরিতাকেও অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভ্রূণ নষ্ট করতে রাজি করিয়েছিলেন। সুচরিতা এই সব প্ল্যানের কথা জানত না। তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, শুক্লাকে ডিভোর্স দিয়ে ওকেই বিয়ে করবেন। কিন্তু শুক্লাকে আর সহ্য হচ্ছিল না! মনে হচ্ছিল, রাশিদ নয়, এই নারীই তার সর্বনাশ করেছে! ওর জন্যই সৃজনকে হারিয়েছেন তিনি। এমনিতেই মানসিকভাবে শুক্লা চরম বিপর্যস্ত ছিলেন! কী হবে, যদি ড্রাগের ওভার ডোজে তিনি মারা যান? অথবা অবসাদ সহ্য করতে না পেরে প্রচুর স্লিপিং পিল খেয়ে আত্মহত্যা করেন? সন্তানকে তো প্রণব হারিয়েছেনই! তবে এই নারীর বেঁচে থাকার অর্থ কী!
ভোলার দায়িত্ব ছিল শুক্লার খাবারে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তার আগেই একের পর এক আত্মহত্যা! চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে চার চারটে মানুষ শেষ…!
—“আমি জানি কী হয়েছিল!” বিদেহী ছায়া হিসহিসিয়ে বলল, “একজন এখনও বাকি আছে। মাস্টারমাইন্ড! তুমি আর কোনওদিন আমার মায়ের দিকে হাত বাড়াতে পারবে না!”
—“বা-বি!”
প্রণব কিছু বলে উঠতে গেলেন! কিন্তু তার আগেই তার নিজের হাতের কুড়ুলটাই যেন জীবন্ত হয়ে লাফিয়ে উঠল! সেকেন্ডের ভগ্নাংশে অমানুষিক জোরে শানানো ফলাটা বসে গেল প্রণবেরই কন্ঠনালীতে! তিনি একটা আর্তনাদ করে ওঠারও সময় পেলেন না। বিস্ফারিত চোখ দুটোয় আস্তে আস্তে নেমে এল মৃত্যুর অন্ধকার। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মহামহিম বটগাছটার মতই তিনিও লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে! শরীরটা থরথর করে শেষবারের মত কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই সব শেষ!
শুক্লা তখন নিজের ঘরে গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। নাঃ, কোনও দুঃস্বপ্ন নয়। দেখছিলেন, বটগাছটার নীচে দাঁড়িয়ে আছে সৃজন খিলখিল করে হাসছে আর চিৎকার করে আবৃত্তি করছে তার প্রিয় কবিতা,
—“রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা
এমন কেন সত্যি হয় না, আহা।
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,
শুনত যারা অবাক হত সবে,
দাদা বলত ‘কেমন করে হবে,
খোকার গায়ে এত কি জোর আছে?’
পাড়ার লোকে সবাই বলত শুনে,
‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।”
ঘুমের মধ্যেই শুক্লা মিষ্টি হাসলেন। বটগাছটার পাতা শিরশিরিয়ে একঝলক আর্দ্র হাওয়া বয়ে গেল।
***