আমি গাধা বলছি – ৮

আট

গবেষণার নামে মাস্টার আমার উপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে শুরু করল। একাধিকবার আমার দেহ থেকে রক্ত বের করল এবং প্রবেশ করাল। এরপর বার কয়েক বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশন দেওয়ার ফলে আমার সারা গায়ে অসংখ্য ফোঁড়া ফুটে উঠল এবং তা থেকে পুঁজ বের হতে লাগল। একটা অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ রেখে মাস্টার আমাকে নিয়ে গবেষণা করত। একটা লোহার শিকল দিয়ে সারাক্ষণ আমাকে বেঁধে রাখা হত।

একদিন আমার গা’টা বড্ড ব্যথা করছিল। ফোঁড়াগুলো থেকে রক্ত এবং পুঁজ গলতে লাগল। জ্বরে সারা গা পুড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এ যাত্রা আমি আর বাঁচব না। এতদিন আমি ঢুঁ শব্দটি করি নাই। কিন্তু মরতে বসে আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। কামরাতে আর কেউ ছিল না। মাস্টার আমাকে একটা ইনজেকশন দিচ্ছিল। ইনকেজশন দেওয়া শেষ হলে আমি আস্তে আস্তে বললাম,

‘ভাল ডাক্তারের হাতেই পড়লাম দেখছি।’ সে আমার কথায় চমকে উঠে বলল,

‘তুমি গাধা, অথচ কথা বলছ?’ বলতে গিয়ে হাত থেকে সিরিঞ্জটা পড়ে গেল তার।

‘হ্যাঁ মাস্টার, আমি গাধা বটে কিন্তু সামান্য লেখাপড়া জানি এবং বেশ বলতে কইতে পারি। তুমি আমার সম্পর্কে খবরের কাগজে অবিশ্যিই অনেক কিছু পড়েছ।’ সে একেবারে হতবাক হয়ে হা করে আমাকে দেখতে লাগলো। আমি আবার বললাম,

‘তুমি কেন আমার জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি শুরু করেছ মাস্টার?’ ‘গবেষণার জন্য।

‘আমি শিক্ষিত গাধা। আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি করতে দেবো না তোমাকে।’

‘দোষ কি, তুমি যদি বেঁচে যাও আর তাতে যদি আমার সিরাম তৈরী হয়ে যায় ক্ষতি কি? আর যদি মরে যাও সে তো তোমার জোর কপাল। বিজ্ঞানের জন্য কে শহীদ হতে পারে?

‘আমি শহীদ হতে চাই না, আমি বেঁচে থাকতে চাই।’

‘গাধারা তো শহীদই হয়ে থাকে বরাবর।

বলেই সে কুটিল হাসি হাসল। আমি মিনতি করে বললাম,

‘দোহাই তোমার, আমার শিকলটা খুলে দাও। আমাকে ছেড়ে দাও।’ আমি ব্যথায় বেদনায় প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম। ‘শাট-আপ।’ বলেই মাস্টার বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে গট গট করে চলে গেল।

আমার কপাল ভাল ছিল। কারণ, ঘটনার পর থেকেই আমার ফোঁড়াগুলো আপনিতেই শুকিয়ে আসতে লাগল। এবং এক মাসের মধ্যে আমি রীতিমত সুস্থ হয়ে উঠলাম। কিন্তু এরপরও নিষ্ঠুরটা আমাকে একটু বের হতে দিল না বরং আরো দু’সপ্তাহ ধরে নানাভাবে আমাকে নিয়ে গবেষণা করল। তারপর যখন দেখল আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি একটা ঔষধের প্যাকেট হাতে নিয়ে হাসি খুশি আমার কামরায় ঢুকল।

‘এন্টিনাসুর সিরাম রেডি ফর সেল। একেবারে পেটেন্ট গবেষণা সাক্সেস ফুল।’ বলেই সে প্যাকেট খুলে বারটি সিরাম বের করলো।

‘একটি লাল, অপরটি সাদা। সে বলল একদিন লাল ইনজেকশন, অপরদিন সাদা ইনকেজশন, বার দিনে কোর্স শেষ

‘আমি বললাম,

‘লাল রংটা কি?’

‘এন্টিনাসুর সিরাম।’

‘সাদাটি?’

‘শুধু পানি ৷’

‘শুধু পানি? পানি দিয়ে কি হবে?’

‘সাদা পানিও ইনজেকশনের নাম করে দিতে হবে যে।’

‘শুধু পানি ইনজেকশন করে কি লাভ? আসলে বারটার ছ’টাই তোমার ঔষধ। ছ’দিনের ছ’টা দিলে তো ছ’দিন আগেই তোমার কোর্স শেষ হয়। আবার পানি কেন ইনজেকশন করতে যাবে?

‘পানি ইনজেকশন না করলে খাব কি? ওটাই তো আমার লাভ।’

‘তোমার এত লাভ কি দরকার? তোমার এত নাম-কাম। ঔষধের ফ্যাক্টরী রয়েছে তোমার, বছরে তিন চার লাখ টাকা পাও সেখান থেকে। এরপরেও তোমার লাভের দরকার?

‘আলবৎ। এক ছেলে প্যারিসে পড়ে। এক ছেলে লণ্ডনে পড়ে।

‘সোমত্ত মেয়ে আছে দুটো। বিয়ে দিতে হবে। এক বউ, এক মেম—বড় খরচ—পানি না বেচে কি করব?

‘এতকাল জানতাম শুধু গাধাদের জীবন নিয়েই তোমরা ছিনিমিনি খেল। এখন দেখছি মানুষদের জীবন নিয়েও খেলা চলছে। চার পয়সার জন্যে দুধে পানি, মদে পানি এবং এখন ঔষধেও পানি।’ ,

‘এদিকে আমি পানি বিক্রি করছি। ওদিকে আমার বড় ভাই এটম বোমা বানাচ্ছে। সেও বৈজ্ঞানিক, আমিও বৈজ্ঞানিক ‘

‘আসলে তোমরা দু’জনই চোর। তোমরা দু’জনই গাধাদের দুশমন।’ আমি অধৈর্য হয়ে বললাম। আমি অনেক ভেবে দেখলাম এইচ, বি মাস্টারের সাথে গলাবাজি করে কোন লাভ নেই। এখান থেকে ছাড়া পাবার জন্য বরং অন্যভাবে চেষ্টা করা দরকার। একদিন আমি তাকে বললাম,

‘আমাকে নিয়ে নতুন গবেষণা তো সাকসেসফুল হয়েছে। এখন আমাকে মুক্তি দাও না।’ সে কঠিনভাবে মাথা নেড়ে বলল,

‘তোমাকে নিয়ে নতুন গবেষণা হবে আমার, তোমাকে ভুখা রাখব এবার।’ আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,

‘আমাকে ভুখা রাখবে কেন আবার?’

‘নূতন ইনজেকশন আবিষ্কার করব। ক্ষুধার ইনজেশন।’

‘ক্ষুধার ইনজেকশন আবার কিসের? মাস্টার ক্ষুধার ইনজেকশন সম্পর্কে আমাকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝাল। তার মর্মার্থ হল,

বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার হাহাকার বড় বিপজ্জনক। এ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধাকে নিবারণ করার জন্য লোকদেরকে দু’ দুবেলা খাবার সংস্থান করতে হয়। সাধ্যাতীত পয়সা খরচ করতে হয় তাতে। সুতরাং এমন একটা ইনজেকশন সে তৈরি করবে যা দিলে নিমেষে মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়ে যাবে। অবশ্য ক্ষুধাকে একেবারে সমূলে বিনাশ করা সম্ভব হবে না তাতে। এক ইনজেকশন দিলে আট দশ দিন আর ক্ষুধা লাগবে না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, ইনজেকশন খাদ্যের কাজ দেবে। ইনজেকশন শুধু ক্ষুধাটা দাবিয়ে রাখবে। এ আট দশ দিনে মানুষ অবশ্য দুর্বল হয়ে যাবে, কিন্তু ক্ষুধা লাগবে না। চিন্তা করে দেখ তো আমি যদি ইনজেকশন তৈরিতে সফলকাম হই, বিশেষ করে কারখানার মালিকদের কত উপকার হবে। কারখানায় হাজার হাজার মজুরকে শুধু একটি করে ইনজেকশন দিয়ে দশ দিন পর্যন্ত দিব্যি খাটিয়ে নিতে পারবে। তোমার রক্ত দিয়ে ক্ষুধার এন্টিসিরাম তৈরি হবে আর তা সারা বিশ্বে পেটেন্ট হয়ে বিক্রি হবে, তখন আমার নাগাল আর পায় কে?

আমি মনে মনে বললাম, এতদিন ছিলাম বন্দী আর এবারে শালার দানা পানিও উঠে গেল কপাল থেকে। এমন পাগলা বৈজ্ঞানিকের পাল্লাতে পড়লাম। আমি তাকে অনেক কাকুতি মিনতি করে বললাম, আমাকে ছেড়ে দাও। অনেক কাঁদাকাটি করে দেওয়ালে মাথা ঠুকলাম, কিন্তু কিছুতেই তার মন গললো না। এরপর থেকে রোজ সকালে এসে সে আমাকে একটা ইনজেকশন দিয়ে যেত এবং সারাদিন কিছুই খেতে দিত না। সন্ধ্যায় এসে জিজ্ঞেস করত ক্ষুধা পেয়েছে?’

‘হ্যাঁ খুব ক্ষুধা পেয়েছে।’ পরদিন আবার নতুন একটা ইনজেকশন দিয়ে সারাদিন উপবাস রেখে সন্ধ্যায় এসে জিজ্ঞেস করল,

‘আজও ক্ষুধা লাগছে?’

‘খুব লেগেছে। ক্ষুধায় আর বাঁচি না মাস্টার। আমাকে কিছু খেতে দাও।’ কিন্তু আমার কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে সে চলে গেল। চতুর্থ সকালে আবার একটা ইনজেকশন দিল। সন্ধ্যায় এসে বলল,

‘এখন অবশ্যি আর ক্ষুধা লাগছে না তোমার, তাই না??

‘কে বলে ক্ষুধা লাগেনি? আজ আমার এত ক্ষুধা পেয়েছে যে যদি ছাড়া পেতাম, তোমাকেই কাঁচা খেয়ে ফেলতাম।’ আমি দাঁতে দাঁত পিষে বললাম। নিষ্ঠুরটা সত্যি সত্যি দশদিন আমাকে ভুখা রাখল। দশদিনে আমার হাড়গোড় বেরিয়ে গেল, আমার গা থর থর করে কাঁপছিল। আমি কেঁদে কেঁদে বললাম,

‘মাস্টার আমাকে সামান্য ঘাস খেতে দাও। আমাকে প্রাণে মেরো না তুমি। এত দীর্ঘদিন আমি কোন কালেই উপোস করিনি। এমন ঔষধ কোনদিন আবিষ্কার করা সম্ভব নয় মাস্টার। ক্ষুধা হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। জীবন যদ্দিন আছে ক্ষুধাও আছে। মানুষ না মরলে কোনদিনই ক্ষুধা নিবৃত্তি হবে না। তাছাড়া ক্ষুধার বিরুদ্ধে এই অভিযানের দরকারই বা কি? আজও পৃথিবীতে এত পরিমাণে ঘাস রয়েছে যে, দুবেলা খেয়ে গাধাদের দিব্যি চলে যাবে। কিন্তু তুমি নিজের লালসা চরিতার্থ করার জন্য গাধাদেরকে উপোস রাখার অপচেষ্টা চালাচ্ছ। এটা মোটেই সম্ভব নয়।’

‘শাট আপ।’ বলেই সে আমার পিছন দিকে একটা লাথি মেরে রাগে গরগর করতে করতে চলে গেল।

আমি এবার ছাড়া পাবার জন্য মরিয়া হয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। যেভাবেই হোক, এ পাগলা বৈজ্ঞানিকের হাত থেকে ছাড়া পেতেই হবে আমাকে। তার গবেষণা কোনদিনই শেষ হবে না। আর আমিও শেষ অবধি প্রাণে বাঁচি কিনা সন্দেহ আছে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। ফন্দিটা মাথায় আসতেই আমার খুব রাগ ধরল এবং খুশিও হলাম। খুশি হলাম এজন্যে যে, যাক্ জীবনটা বেঁচে যাবে দেখছি। আর রাগ হলে এজন্যে যে, এতদিন কেন ফন্দিটা মাথায় আসেনি? আমার মত আস্ত গাধা আর নেই।

দ্বিতীয় দিন বরাবরের মত মাস্টার এসে যখন জিজ্ঞেস করল,

‘এখন ক্ষুধা লাগছে তোমার?’ আমি হেসে উঠে বললাম,

‘ক্ষুধা? ক্ষুধা আবার কি জিনিস?’ আমার তো মনে হয় খানাপিনা ছাড়াই আমি একশ বছর বেঁচে থাকতে পারব। আমি অত্যন্ত কৌশলে ক্ষুধার কথা লুকিয়ে গেলাম। মাস্টার খুশিতে উৎফুল্লা হয়ে বলল,

‘ও গড় এখন তো আমি লাখোপতি—কোটিপতি, ব্যাস—–—সিরাম তৈরি।’ ‘হা-হা-হা’ আমি অট্ট হাসি হেসে বললাম,

‘তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার সামনে ঘাস এনে দাও দেখি, আমি এক পাতাও খাই কিনা দেখে নাও।’ মাস্টার সত্যি সত্যি আমার সামনে কতগুলো ঘাস এনে রাখল। আমার তো ইচ্ছে হচ্ছিল ঘাসের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি। কিন্তু বড় কষ্টে সে ইচ্ছে দমন করে পা দিয়ে ঠেলে ঘাসগুলো একপাশে সরিয়ে দিয়ে বললাম,

‘আরে এতো সামান্য ঘাস, এখন আমার সামনে কেউ বিরিয়ানী এনে দিলেওতো আমি খাব না।’

‘সাবাস—ডাংকি দি গ্রেট।’ বলেই মাস্টার আমার গলা জড়িয়ে ধরল। আর আমি একটা গানের কলি ভাজতে ভাজতে বললাম,

‘জানি না মাস্টার তুমি আমাকে কি খাইয়েছ। ক্ষুধা তো লাগছেই না উপরন্তু আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছে।

‘ভুখাকে আগে জাহা

আওর ভি হ্যায়

আভি ইশ্ক্-কে ইমতেহান

আওর ভি হ্যায়।’

‘হুররে।’ বলেই মাস্টার শিকলটা খুলে তার হাতে নিয়ে খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলল, ‘লোলা কাম হিয়ার, দেখো ভুখা ডাংকি গান গাচ্ছে।’ বলতে বলতে মাস্টার লনে বেরিয়ে গেল। আরো জোরে জোরে লোলাকে ডেকে বলল, দেখো লোলা, ওয়ার্ল্ড প্রবলেম খতম। দশদিন থেকে উপোস, তারপরও গাধা গান গাচ্ছে।’ একথা শুনে আমি আরো নেচে নেচে গাইতে লাগলাম—

‘জিস্ খেত সে মেলে কেসি গাধে কো রুটি উস্ খেত কে হার খোসায়ে গন্ধম কো জ্বালা দো।’

শুনে মাস্টার এবং লোলা দু’জনেই হাততালি দিয়ে নাচতে নাচতে মাস্টার লোলার কোমরে হাত দিয়ে বলল, ‘যাক, এবারে আমরা বেড়াতে বের হতে পারি। সহসা আমি সুযোগ বুঝে একটা লাফ মেরে এক টানে মাষ্টারের হাত থেকে শিকলটা ছাড়িয়ে নিলাম এবং দৌড়ে বাংলোর বাইরে চলে গেলাম।

‘একি কোথা যাচ্ছ?’ মাস্টার চিৎকার করে বলল, ‘আমিও বেড়াতে যাচ্ছি। গুড বাই।’ আমি বললাম।

‘যেয়ো না বলছি, দাঁড়াও।’ মাস্টার হাত নেড়ে নেড়ে আমাকে বাধা দিচ্ছিল। আমি সেসব না শুনে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলাম। ওদিকে মাস্টার লোলাকে নিয়ে গ্যারেজের দিকে দৌড়ালো এবং ত্বরিৎ গাড়িতে বসে হুকুম করল,

‘জলদি চলো গাধার পেছনে।’ আমি জীবন মরণ পণ করে দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু অন্যান্য বারের মত দৌড়াতে পারছিলাম না। কারণ, দশদিনের উপবাসী। শরীরে এক ফোঁটাও বল ছিল না। দৌড়াতে দৌড়াতে পাশ কেটে এক বাজারে ঢুকে পড়লাম আমি। বাজার ছেড়ে এক লেনে ঢুকে একটা অন্ধকার গলির মধ্যে এসে পড়লাম। গলির ভেতর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে গলির প্রান্তসীমায়

এসে পড়লাম আমি। সামনে পাঁচতলা একটা বাড়ি। এখানে এসে আমার পা আর চলছিল না। বাধ্য হয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। পেছন ফিরে দেখলাম মাষ্টারের গাড়ি দ্রুত এগিয়ে আসছে। এখন আগেও যেতে পারছি না, পেছনে যেতেও পারছি না। 1

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *