সাত
সমুদ্রের তীরে পৌঁছে খেমজি আমাকে দাঁড় করিয়ে রক্তচক্ষু পাকিয়ে বলল, ‘জানো আমি তোমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছি?’
‘জানি, আমাকে খুন করার জন্য এখানে নিয়ে এসেছ।’ জীবন সম্পর্কে একেবারে বেপরোয়া হয়ে আমি বললাম। ‘বেশতো আগেই জেনে ফেলেছ দেখছি। ঠিক আছে, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।’ বলেই খেমজি পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করল।
‘আমার আর বাঁচবার সাধ নেই। আমি যে কোন মুহূর্তে মরতে প্রস্তুত। তবে আমার একটা অন্তিম অনুরোধ। মৃত্যুর পূর্বে আমার একটা মনোবাঞ্ছা।’ ‘কি তোমার অনুরোধ?’
‘অনুরোধ আর কিছুই নয়। রেসের সময় যে আমার পিঠে আরোহণ করেছিল এবং যার পরিচালনায় আমি ঘোড়াদের হারিয়ে দিয়ে গাধাদের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছি, মরার আগে সেই মহাত্মনের পূণ্য হস্ত চুম্বন করতে চাই।’
‘ও এই কথা?’ খেমজি ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে ঝটপট চুমো দিয়ে নাও।’
বলেই খেমজী হাতটা এগিয়ে দিল। খেমজি হাত এগিয়ে দিতেই আমি পেছন ফিরে এমন জোরে লাথি মারলাম যে, সে ক’হাত দূরে পাথরের ওপর যেয়ে ছিটকে পড়ল। হাত থেকে পিস্তল পড়ে গেল। এই সুযোগে আমি উঠে পড়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। খেমজি কাতরাতে কাতরাতে উঠে দাঁড়াল এবং আমার চৌদ্দ পুরুষ একত্র করে গালি দিল। কিন্তু আমি পেছনে একট ও না তাকিয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে থাকলাম। রেসকোর্সের মাঠের চেয়েও দ্বিগুণ রেসে দৌড়াতে লাগলাম। হঠাৎ দেখলাম, খেমজি গুলী ছুড়ছে। ক’টা গুলীই আমার গা ঘেঁষে ছম ছম করে চলে গেল।
শেষ অবধি একটা গুলী এসে আমার পেছনের ডান দিকের পা ভেদ করে চলে গেল। আমি ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কোন্মতে নিজেকে সামলে নিয়ে তবু দৌড়াতেই থাকলাম। পথঘাট, বাজার-গলি, খেলার মাঠ কোন কিছুই আমার মনে নেই। আমি প্রাণের দায়ে উঠে পড়ে দৌড়াচ্ছিলাম।
অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর পেছনে ফিরে যখন দেখলাম, যতদূর দৃষ্টি যায় আর কোন লোকজন নেই, পথঘাট নীরব নিস্তব্ধ, আশপাশের বাংলোগুলো নিঃসাড়ে ঘুমুচ্ছে, হঠাৎ আমার হাত পা ভেঙে এল। একটি বাংলোর বারান্দায় নারকেল গাছের তলায় আমি এক রকম হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম।
সকালে যখন বাংলোর মালী এসে ডাণ্ডা মেরে আমাকে তাড়ানোর চেষ্টা করছিল, কোন মতেই আমি উঠতে পারছিলাম না। আমার পা ফুলে গেছে ক্ষতস্থানের রক্ত শুকিয়ে গেছে। মালীর মার খেয়ে আমি কাঁদতে লাগলাম।
আমার চিৎকার শুনে বাংলোর মালিক বেরিয়ে এলেন। বেঁটে দোহারা চেহারার
একজন লোক, মাথায় টাক। চোখগুলো চকচকে। লোকটি থেমে থেমে কথা বলে। ‘আলী—এখানে কিসের হল্লা? এ কি?
‘গাধা স্যার ৷’ বলেই আলী আবার এক ঘা বসিয়ে দিল আমার উপর। লোকটি আমার আপাদমস্তক ভালভাবে নিরীক্ষণ করল। টেকো মাথায় একটু চুলকালো। তারপর কিছু একটা পেয়ে যাবার মত উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। মালীকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘হু—এটার পায়ে জখম। এটাকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে আসো।’
মালী অনেকটা বিস্ময় ও বিরক্তির সাথে মালিকের দিকে তাকাল। হঠাৎ গাধার প্রতি তার এত দরদ হল কেন সে বুঝে উঠতে পারল না। কতক্ষণ কি বক বক করে দড়ি আনবার জন্যে সে ভেতরে চলে গেল। সে চলে যেতেই মালিকও ভেতরে গেল।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর মালিক ঔষধপত্র এবং ব্যান্ডেজের সরঞ্জাম নিয়ে আমার কাছে এল। সাথে একটা চাকর ছেলেও এসেছে। মালিক আমার ক্ষতস্থান ধুয়ে অপারেশন করে ভেতর থেকে খুঁজে গুলী বের করল। তারপর ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে ইনজেকশন দিতে লাগল।
এমন সময় ভেতর থেকে একজন স্বর্ণকেশীর আবির্ভাব হল। সে মালিক থেকে কম হলেও দেড় ফুট লম্বা হবে। তার পরনে সাঁতারের পোশাক। অর্থাৎ বুকে এবং কোমরে এক চিলতে রঙিন কাপড়। তার দেহ দেখে মনে হলো, সূর্য্য কিরণ দিয়ে তাকে তৈরী করা হয়েছে।
‘মাস্টার, এ জানোয়ার কোত্থেকে এসেছে?
সে ইংরেজিতে বলছিল। কিন্তু তার ইংরেজি বলার ধরন দেখে আমার ধারণা পাল্টে গেল। আমি ভেবেছিলাম মেয়েটি সাগর পারের হবে। ‘এ তুমি কি করছ?’
‘গাধাটা—জখম হয়েছে ইনজেকশন দিচ্ছি।’ পরে আমি জানতে পারলাম মালিকের নাম—এইচ বি মাস্টার। একজন খ্যাতিমান ডাক্তার এবং বৈজ্ঞানিক।
মাস্টার আমাকে ইনজেকশন দিচ্ছিল আর মেয়েটি আমার গায়ে হাত বুলাচ্ছিল। তার নরম হাতের পরশ লেগে আমার গা শির শির করছিল। ‘এখান থেকে যাও বলছি লোলা—’
মাস্টার হুকুমের স্বরে বলল। লোলা একটু পিছিয়ে গিয়ে আমাকে দেখতে লাগল। মাস্টার কোন দিকে না তাকিয়ে নিবিষ্ট মনে আমাকে এক সাথে দুটো
ইনজেকশন দিল। তারপর সিরিঞ্জ ইত্যাদি চাকরের হাতে দিয়ে লোলাকে বলল, ‘তুমি এ ড্রেস পরে বাইরে এসেছ? লজ্জা করে না?’।
‘কিসের লজ্জা, এ তো গাধা।’
‘না এসব চলবে না, জলদি ভেতরে গিয়ে এসব বদল করে এসো।’
‘কিন্তু আমি তো সুইমিংপুল যাচ্ছিলাম ডার্লিং ; নো সুইমিং, আমার হুকুম, ড্রেস বদল করো।’
মাস্টার রেগে গিয়ে বলল। তার রাগ দেখে লোলা অনেকটা ভয় পেয়ে গেল। তার টকটকে লাল দেহ আরো আরক্ত হয়ে উঠল। চোখগুলো আরো নীল হয়ে গেল। সে ইচ্ছা করলে বেঁটে মাস্টারটিকে দুহাতে ধরে এক পলকের মধ্যে কাবু করে ফেলতে পারে। কিন্তু তবু সে তার হুকুম মেনে নিয়ে বাংলার ভেতরে চলে গেল। মাস্টার একটু বিজয়ীর হাসি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি মাস্টার আমার কথা শুনবে না এতই বুকের পাটা?’
কিন্তু তার কথায় কিইবা সম্মতি জানাতে পারি আমি। কিছুক্ষণ পর মাস্টার কি মনে করে ভেতরে চলে গেল।
লনে রোদ এসে পড়েছে। আমার গা গরম হয়ে উঠেছে। ঔষধ এবং ইনজেকশন দেওয়াতে আমার বেশ ভাল বোধ হচ্ছিল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আমার খুব ক্ষুধা পেল। অপ্রত্যাশিতভাবে মালীর ছেলে দু’টি আমার জন্য দু’আঁটি ঘাস নিয়ে এল। আমি পরমানন্দে চিবিয়ে চিবিয়ে তা খেতে লাগলাম।
আমি ঘাস খাচ্ছিলাম আর অপর দিকের লনে একটা রঙিন ছাতার নিচে গালিচা বিছানোর আয়োজন হচ্ছিল। গালিচা বিছানোর কাজ সারা হলে মাস্টার এবং লোলা এসে বসলো সেখানে। লোলার পরনে চমৎকার পাশ্চাত্য ফ্রক। মাথায় তোয়ালের তৈরী টুপির মত, আসলে সেটা তোয়ালেই ছিল। হাতে দুটো মালিশের শিশি। মাস্টারের পরনে কালো লেংটিটুকু ছাড়া আর কিছুই ছিল না। রোদের মধ্যে তার শ্যামলা দেহ দেখে মনে হলো, আসলে সে মানুষ নয় একটা জ্বল জ্যান্ত গরিলার বাচ্চা।
মাস্টার গালিচার উপর সটান উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল, আর লোলা তার দেহ মালিশ করতে শুরু করল।
মালির ছেলের দুটো দূরে দাঁড়িয়ে তাদেরকে চুপি চুপি দেখছিল আর ফিস্ ফিস্ করে আপ্সে বলাবলি করেছিল,
‘যখনই বিবি সাব দেশে যান, এ হারামজাদী লোলাটা এসে জেঁকে বসে।’ ‘আমার তো রীতিমত হাসি পায়, এত লম্বা চওড়া মেমটার এই বেঁটে দেড়হাত মানুষের সাথে কেমন খাতির আবার?’
‘ ও বুঝবে না ভাই, পয়সা।’
‘পয়সা! পয়সা তো সে যেখানে যাবে সেখানেই পাবে।
‘শুধু পয়সাও নয়। বাড়ি গাড়ি। চাকরদের ওপর কেমন হুকুম চালায় দেখেছ? মনে হয় বাড়ির মালিক বনে বসেছেন আর কি। জানো পাজিটা ইংরেজিতে গালি দেয়। একবার যদি ফাঁক মত পাই ….।’
বলেই সে একটা চমকপ্রদ খেয়ালে ডুবে গেল।
‘দেখতো মাস্টারের গা টা। একেবারে গণ্ডারের চামড়ার
‘মেয়ে জাত কি চামড়া দেখে, তাদের পয়সা পেলেই হল।’
তারপর দুভাই একটা চাপা নিঃশ্বাস টেনে চুপসে গেল। এদিকে আমার ঘাসও শেষ হয়ে এসেছে। ছেলে দুটি এক সময় কেটে পড়লো সেখান থেকে। আমি খাবার শেষ করে রঙিন ছাতার দিকে কান খাড়া করে ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগলাম। লোলা জিজ্ঞেস করল-
‘এ গাধাটা দিয়ে করবে কি তুমি?’
মত।’
‘গবেষণা করব।
‘গবেষণা? কিসের গবেষণা?’
‘সিরাম, তৈরির গবেষণা।
‘সিরাম?’
‘হ্যাঁ সিরাম, এ সিরাম ব্যবহারে পুরনো ক্ষত দু’দিনেই শুকিয়ে যাবে।’ ‘কিন্তু ওয়েস্টার্ন কানট্রিতে তো ঘোড়া নিয়ে গবেষণা করে সিরাম তৈরি করে বলে আমি শুনেছি।
‘ঘোড়া কোথায় পাব? ঘোড়ার খুব দাম। গাধাতেই চলে যাবে। বিনে পয়সায় পেয়ে গেলাম।’
‘কিন্তু…’
‘কোন কিন্তু নেই। আমি মাস্টার, আমি সাইন্টিস্ট—ইউ শাট-আপ ৷’