ছয়
রেস শুরু হবার ক’দিন আগে থেকেই পত্র-পত্রিকায় গোল্ডেন স্টারকে নিয়ে বেশ বাক-বিতণ্ডা শুরু হল। গোল্ডেন স্টারের বংশ পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, স্পেনিশ এবং সাউথ আমেরিকার ইণ্ডিয়ান গাধার ক্রুশ ব্রিডিং-এ এর জন্ম হয়েছে। বেশির ভাগ সাংবাদিক এ ঘোড়াটি সম্পর্কে কোনরূপ সুস্পষ্ট মতামত দিলেন না, পাঠকদেরকে তারা হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললেন, তারা যেন অযথা এই বুনো অনভিজ্ঞ ঘোড়ার পেছনে টাকা না ঢালেন।
মারিয়া খবরের কাগজ থেকে এসব পড়ে পড়ে আমাকে শোনাতো আর তা শুনে শুনে আমার রক্ত টগবগ করতে থাকত। আমি মনে মনে ঠিক করলাম, রেসের দিনে আমি এমন করে দৌড়াব, মনে করব আমার পেছনে বোম্বের সকল পুলিশরা জীপ নিয়ে তাড়া করে আসছে। আমি এসব সাংবাদিকদেরকে দেখিয়ে দেব, দৌড় কাকে বলে? গাধারাও যে ভালো জাতের ঘোড়াকে দৌড়ে হারিয়ে দিতে পারে আমি তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেব।
রেসের দিনে আমাকে মহালক্ষ্মী রেসকোর্সের আস্তাবলে স্থানান্তরিত করা হল। কিন্তু নিরাপত্তার জন্যে কোন ঘোড়ার সাথে আমাকে মিশতে দেওয়া হল না। কোন ফটোগ্রাফারকেও আমার কাছে আসতে দেওয়া হল না।
রেসের ঘণ্টা খানেক আগে মারিয়া যথেষ্ট পরিমাণে মদ পান করিয়ে গেল আমাকে। তার কিছুক্ষণ পর এক ডাক্তার এসে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে গেল। ইঞ্জেকশন দিতেই আমার সারাদেহে একটা দুর্দান্ত তেজ টগবগ করে উঠল।
রেসকোর্সের ময়দানে অসংখ্য দর্শকের সমাগম হয়েছে। আমাকে দেখেই দর্শকরা খিলখিল করে হেসে উঠল। লজ্জায় ঘৃণায় আমার গা থরথর করে কাঁপছিল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলাম। উইনার্স গ্যালারীতে মারিয়া শেঠ রুস্তমের পাশে দাঁড়িয়ে একটা গোলাপী রুমাল দেখাচ্ছিল। লোকদের হাসিঠাট্টা দেখে আমি একেবারে ঘাবড়ে গিয়ছিলাম। কিন্তু মারিয়াকে দেখে সাহসে আমার বুক ভরে উঠল। রেসের ঘোড়াগুলোর একেবারে শেষের দিকে আমি দাঁড়ালাম। যখন আমরা এক চক্কর ঘুরে এলাম তখনও আমি সবার পিছনে। আমার দৌড় দেখে লোকরা হেসে বলল, ‘আরে এ যে গাধার চেয়েও অধম। এই বুঝি পেরুর ঘোড়া। গাধাও তো এর চেয়ে ভাল দৌড়াতে পারে।’।
কোন লোকই আমার নামে কোন টিকেট ধরল না, তা দেখে শেঠ রুস্তমের চেহারা অনেকটা পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করল। মারিয়াও কেমন যেন চিন্তিত হয়ে পড়ল।
মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে এমন জোরে এক দৌড় দিলাম যে, আধা ফার্লং এর মধ্যেই তিনটা ঘোড়াকে পিছনে ফেলে দিলাম। এরপর চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, এমন কি সপ্তম ঘোড়াটাকেও অতিক্রম করে চললাম আমি।
‘হারিআপ গোল্ডেন স্টার, মারিয়া রুমাল নেড়ে খুশিতে চিৎকার করে উঠল। সর্বত্র শুধু মারিয়ার চিৎকারই যেন গুঞ্জন করতে লাগল। এখন উইনিং পোস্ট মাত্র—
আর এক ফার্লং দূরে রয়েছে। আমার আগে মাত্র—দুটো ঘোড়া রয়েছে। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে ধীর আগ্রহে ফলাফলের প্রতীক্ষা করছিল।
‘বাকআপ’ ‘সোনাকা তারা।’ হাজারো দর্শক চিৎকার করে উঠল। অসংখ্য লোক ‘সোনাকা তারার’ উপর টিকেট ধরছে এবং সেটা এখনো আগে রয়েছে। ‘বাক আপ মাহপারা—’।
মাহপারা ছিল আমার আগে। তার উপরও অনেকে বাজি লাগিয়েছে। ‘হারিআপ মাই ডার্লিং গোল্ডেন স্টার।’
মারিয়া তীব্র চিৎকার করে বলল। আমি এবার শেষ শক্তিটুকু নিঃশেষ করে জীবন মরণপণ করে দৌড়ালাম। মুহূর্তে আমি ঘোড়া দুটোকে পঞ্চাশ গজ পেছনে ফেলে উইনিং পোস্ট অতিক্রম করে গেলাম।
বোম্বাইর রেসকোর্সের ইতিহাসে এমন রেস কোনদিন হয়নি। গোল্ডেন স্টার শতকরা নম্বই ভাগ দাও মেরে দিয়েছে। গোল্ডেন স্টারের নামে মাত্র সাতটা টিকেট ধরা হয়েছিল। সাতটা টিকেটই রুস্তম শেঠের লোকেরা ধরেছিল।
মারিয়া আমার উপর দুশ টাকা ধরেছিল। সে পেয়েছে আঠার হাজার টাকা। শেঠজির দুটো টিকেট বেকার গেছে। সে দুটো অন্য ঘোড়ার নামে ধরেছিল। তা সত্ত্বেও শেঠজি এ রেসে সর্বমোট আড়াই লাখ টাকা উপার্জন করেছে।
গোল্ডেন স্টার…।
রেস শেষ হবার সাথে সাথেই আমাকে মহালক্ষ্মীর আস্তাবল থেকে শেঠজির আস্তাবলে নিয়ে আসা হল। শেঠ আমার পিঠে চাপড় দিয়ে আদর করল। মারিয়া ভালবাসা জানাল। আমার অনুরোধক্রমে রুস্তম শেঠ ডাক্তার রাম অবতারের বিলটা পাঠিয়ে দিল। প্রথমবার রাম অবতার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল, তার কাছে আমি দুই হাজার টাকা ঋণী ছিলাম।
রাতে গোলাপ জল ছিটানো তাজা তাজা ঘাস এনে দেয়া হলো আমাকে। এরপর আমাকে আসল হুইস্কি দেয়া হল। আমি নিমিষে দুবোতল শেষ করে ফেললাম। পানাহার শেষ করে আমি মশারীর নীচে পা ছড়িয়ে সটান শুয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমার আস্তাবলের বাইরে কারা যেন ফিস্ ফিস্ করে কথা বলছিল। আমি দেওয়ালের সাথে কান লাগিয়ে শুনতে লাগলাম, ‘এ সম্পর্কে খুব তদন্ত হবে। আর অন্য কোন রেসের রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না।’
‘খেমজি বলল, ‘কিন্তু শেঠ, গোল্ডেন স্টারতো আজ একেবারে বাজিমাত করে দিয়েছে।’
‘তুমি বোঝ না, আমি রিস্ক নিতে পারি না, যখন তদন্ত শুরু হবে একথা গোপন রাখা যাবে না যে, আমি একটা গাধা দিয়ে ঘোড় দৌড়ে জয়লাভ করেছি। ফলে আমার জেলও হয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমি রিস্ক নিতে পারি না। গোল্ডেন স্টারকে খতম করে দেয়া দরকার।’
‘সেটা কি করে সম্ভব?’ খেমজি বলল।
‘তুমি গাধাটাকে কোন ছুতা করে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে যাও। গাধাটা কিন্তু ভারী হুঁশিয়ার। কোন কিছু টের না পায় যেন। বলবে এখানে তোমার প্রাণের ভয় আছে। এ কথা বলে সমুদ্রের তীরে নিয়ে পিস্তল দিয়ে সুট করে লাশটা সমুদ্রে ফেলে দেবে। কি বল মারিয়া।’
‘হাঁ, এটাই ঠিক হবে। সমুদ্রে ফেলে দিলে পুলিশের লোকেরা মোটেই টের পাবে না।’
প্রথমদিকে তো আমি ভয়ে কাঁপছিলাম। তারপর যখন মারিয়ার কথা শুনলাম, আমার কান্না পেল। একেই তাহলে আমি ভালবাসতাম। ভালবাসার এই প্রতিদান 1 খেমজি বলল, ‘আসলে কেমন যেন লাগছে শেঠজি। যে গাধা আমাদের একই রেসে লাখো টাকার ভাগ্য ফিরিয়ে দিল, কি করে তাকে শেষ করে দেবো। কিছুই ভাল লাগছে না শেঠজি।’
‘বোকার মত কথা বলো না। যে গাধা দিয়ে আমাদের আর কোন কাজ হচ্ছে না, তাকে রেখে কি করব? তাকে শেষ করে দেয়াই ভাল। তাকে রেখে বিপদের ঝুঁকি নিতে যাবে কে?’
এরপর তাদের আর কোন কথা শোনা গেল না। এরপর দীর্ঘ নীরবতা। রাতের অন্ধকারের মধ্যে আমার গলার কাছে একটা খড়গ ঝুলছিল যেন। আমার এখনই পালিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? আস্তাবলের দরজা বাইরে থেকে আটকানো, তাছাড়া ইচ্ছা করলেই কি কোন গাধা পালিয়ে যেতে পারে?
‘না না এমন হতে পারে না। আমি নিজেকে মরতে দিতে পারি না।’ আমি আবেগ জড়িত কণ্ঠে মরিয়া হয়ে বললাম। এরপর অতি সতর্কতার সাথে কে যেন দরজাটা খুলল। এবং একটা কালো ছায়া ভেতরে প্রবেশ করলো।
আমি চমকে উঠে বললাম ‘কে?’
হঠাৎ ছায়াটা দরজার কাছের সুইস টিপে দিল। প্লাবিত আলোর মাঝে দেখলাম খেমজি দাঁড়িয়ে।
‘কি জন্যে এত রাতে?’
‘উঠ,—চলো—বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’
‘বাইরে কোথায়?’
‘সমুদ্রের তীরে। একটু হাওয়া খেয়ে আসি আর তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে ৷’
‘সে কথা এখানে বললেই তো হয়।’
‘এখানে বড্ড গরম। তাছাড়া কেউ শুনে ফেলতে পারে। জানতো দেয়ালেরও কান আছে। এক রেসে তো আমরা জিতলাম। আগামী রেস সম্পর্কে কি করা যায় তা নিয়ে অনেক কথা আছে তোমার সাথে।’
আমি মনে মনে বললাম, আগামী রেস সম্পর্কে আর কি বলবে। তার আগেই তো আমার মৃত্যু হচ্ছে।
খেমজি আমার গলায় দড়ি লাগিয়ে সমুদ্রের তীরের দিকে নিয়ে চলল। রাস্তায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। নারকেল গাছগুলোকে মার্শাল ল’র সিপাইর মতো মনে হল। সমুদ্রের তরঙ্গ তীরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তরঙ্গর ঝুপঝাপের তীব্র আওয়াজে কানে তালা দেবার জো। চারিদিকে কোন জনপ্রাণী নেই। দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র আর তার তীরে একজন মানুষ ও একটি গাধা।