আমি গাধা বলছি – ৫

পাঁচ

আমার সারাদেহ কামানোর পর গরম পানি এবং সাবান দিয়ে কয়েকবার গোসল করানো হলো। কয়েকবার শুকনো তোয়ালে দিয়ে সারা গা মুছে সাফ-সাফাই করে জয়তুনের তৈল মালিশ করা চলল। অবশেষে একদিন একটা দামী-পালিশ লাগানো হলো আমার গায়ে। পালিশ লাগানোর পর আমার চেহারাটাই পালটে গেল। সারা জীবনে আমার এতরূপ কোনদিন দেখিনি। আমার রূপে মুগ্ধ হয়ে মারিয়া আজকাল চুপি চুপি দেখতে লাগলো আমাকে। আমি মারিয়াকে বললাম,

‘আসলে রুস্তম শেঠ একটা ফেরেশতা। এমন নিঃস্বার্থ সহানুভূতিশীল ও দেবতাতুল্য মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। আপন ভাইও ভাইর সাথে এমন ব্যবহার করে না। একমাত্র রুস্তম শেঠকে দেখেই আমার মত গাধাও মানবতা বলে যে জগতে একটা বস্তু আছে, সে কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে।’ মারিয়া বলল,

‘সত্যি তার ঋণ আমরা শোধ করতে পারব না।’

পরদিন ঘন মোচওয়ালা দোহারা চেহারার অর্ধ বয়েসী একজন লোক আমার আস্তাবলে এলো। তার শ্যেনদৃষ্টি আমার পালিশ করা দেহকে যেন বিদ্ধ করছিল। লোকটির সাথে একজন ডাক্তার রয়েছে। তাদের পেছনে শেঠজী এবং খেমজী রয়েছেন। ডাক্তার আমার আপাদমস্তক দেখে বললেন, ‘এটাকে গাধার মত মনে হচ্ছে যে।’ রুস্তম শেঠ বলেন, “জ্বি না, এটা পেরুর ঘোড়া। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে এ ঘোড়ার জন্ম। সেখানকার ঘোড়া ঠিক এ আদলেরই হয়ে থাকে।’

‘জ্বি হ্যাঁ, ওখানকার ঘোড়াগুলো অনেকটা দেখতে গাধার মত। শেঠ বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে পেরু থেকে এ ঘোড়া আনিয়েছেন। এদেশে এ জাতের ঘোড়া আর কোথাও নেই। এটার মা স্পেনিশ এবং বাপ সাউথ আমেরিকার ইণ্ডিয়ান। উভয়ের ক্রস ব্রিডিং-এ এটার জন্ম। বেশ দৌড়াতে পারে।’ খেমজি বলল।

‘রাখো, হয়েছে—হুহ্ গোঁফধারী লোকটি একটা ন্যক্কারজনক অভিব্যক্তি করে বলল। ‘এটার নাম কি?’ ‘গোল্ডেন স্টার।’ ‘গোল্ডেন স্টার? নামের কত বাহার।’ এবার ডাক্তারও কেমন যেন সন্দেহের ভাব দেখাল। তাদের এ ভাব সাব দেখে শেঠজী তাদেরকে নিয়ে একটু আড়ালে গেল। অনেকক্ষণ ধরে তাদের মধ্যে কি নিয়ে যেন কানাঘুষা চলল। অতঃপর তারা দু’জন চলে গেল। শেঠজী এবং খেমজী হাসতে হাসতে এসে আমাকে বলল,

‘সব ঠিক হয়ে গেল। কালকে তোমাকে মহালক্ষ্মী রেসকোর্সের আস্তাবলে নেয়া হবে।’

‘মহালক্ষী রেসকোর্সে কেন?’

‘সেখানে একমাস পর ক্রিসমাস কাপের যে রেস হবে, তাতে তুমি অংশগ্রহণ করবে।’

আমি গাধা হয়ে ঘোড়ার সাথে দৌড়াব? আপনাদের বুদ্ধিসুদ্ধির মাথা খেয়েছেন নাকি? গাধারা কোনদিন ঘোড়ার সাথে দৌড়ে পারে?’

‘তুমি যে কত দ্রুত দৌড়াতে পার, সেটা আমাদের সেদিনই জানা হয়ে গেছে, যেদিন পুলিশ তোমার পিছু ধাওয়া করছিল। পুলিশের জীপ এবং সব রকম দ্রুতগামী যানবাহন পিছে ফেলে কি করে যে তুমি দেয়াল টপকে অরলির দিকে চলে এসেছিলে, আমরা সবই দেখেছি। খেমজী তার ছোট সবুজ কার নিয়ে তোমাকে অনুসরণ করছিল। সেদিন যত দ্রুত দৌড়েছিলে, তার চার ভাগের এক ভাগও যদি রেসে দৌড়াতে পার, তবেই আমাদের কেল্লাফতে। আমি হলফ করে বলতে পারি, কোন ঘোড়াই তোমার সাথে এঁটে উঠতে পারবে না।’

‘শেঠ, এ জন্যই কি তুমি আমাকে এত দয়া দেখিয়েছ?’

‘আলবৎ। তুমি বেশ দৌড়াতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস এবং সে জন্যই তোমার এত যত্ন আত্তি।’

‘আচ্ছা তাহলে এজন্যেই কি শেঠ আমার জীবন বাঁচিয়েছিলো? কি আশ্চৰ্য্য, আজকাল গাধাকেও ঘোড়ার দলে স্মাগেল করা হচ্ছে। মারিয়া, চিন্তা করে দেখ দেখি স্মাগলিং দুনিয়ার কোথায় না আছে? না মারিয়া, রেসে দৌড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।’

‘তা কি করে হয়? তুমি এতোদিনে মরে ভূত হয়ে থাকতে। সেই মরণ থেকে যে তোমাকে বাঁচাল এবং তোমার চিকিৎসার জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করল, তার জন্যে তোমার কোন কৃতজ্ঞতা নেই?’

‘তাতো বুঝলাম মারিয়া, কিন্তু রেসে যে আমি জিততে পারব তার কোন নিশ্চয়তা আছে? শেঠ যে অবস্থায় আমাকে দৌড়াতে দেখেছে, সে সময়ের কথা আলাদা, তখন ছিল আমার জীবন মরণের প্রশ্ন। না—মারিয়া আমি দৌড়াতে পারব না।’

‘আরো চিন্তা করে দেখ। ইতিহাসে এমন কোন নজির নেই যে এক গাধা ঘোড়ার সাথে দৌড়ের পাল্লা দিয়েছে। তুমিই হবে প্রথম গাধা, যে ঘোড়ার সাথে দৌড়াবে। তুমিই গাধা কুলের প্রথম প্রতিনিধি হবে।’

‘আর যারা রেসের অন্তরালের এসব দুর্নীতি এবং স্মাগলিং সম্পর্কে কিছুই না জেনে রেসে লাখো লাখো টাকা ঢেলে দেবে তাদেরকে তুমি কি বলবে?’

‘শেঠ আমাকে বলেছেন, এটাকেই বিজনেস বলে। একজন অপরজনকে যত বেশি গাধা বানাতে পারবে ততই সে বিজনেসে লাভবান হবে।’

‘আমি এমন কাজ কেন করতে যাব, যেখানে সাধারণ লোকেরা না জেনে লাখো লাখো টাকা পানিতে ঢালবে। আমি সাধারণ লোকদের ক্ষতি করতে পারি না।’

‘তবে এটা জেনো তুমি এতে অংশগ্রহণ না করলেও রেসের খেলা যেমন চলত, তেমনই চলবে। রেস বন্ধ হবে না। তবে বেচারি মারিয়ার চাকুরিটা হয়ত থাকবে না।’

‘কি, তোমার চাকুরি যাবে কেন?’

‘চাকুরি যাবে না বসে থাকবে? তুমি বোঝ না শেঠ আমাকে কি জন্যে নিয়োগ করেছেন। সে উদ্দেশ্যই যদি বানচাল হয়ে যায়, ডিয়ার ডাংকিং, তুমি অন্ততঃ আমার খাতিরেও কি এ রেসে যোগ দিতে পার না—শুধু আমার জন্যে—’

‘কি যে বলো মারিয়া, তোমার জন্যে আমার প্রাণও দিয়ে দিতে পারি।’ আমি দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বললাম, ‘তুমি কোন চিন্তা করো না। তোমার খাতিরে যদি দৌড়াতে হয় তবে এ গাধা অবশ্যই দৌড়বে। শুধু দৌড়াবেই না—ঘোড়ার কুলের নাকে মুখে কালি মেখে দেবে। মনে রেখো, এ গাধা মহালক্ষ্মী রেসকোর্সের সকল ঘোড়াকে বেকুব বানিয়ে ছাড়বে।’

‘ডার্লিং’ মারিয়া আমাকে চুমু দিয়ে বলল, ‘আমি তোমার কাছে এরকম আশাই করি।’

‘আমি জানতাম না, তুমি আমাকে এত ভালবাস। আসলে আমি এক গাধা বইতো নই ৷’

‘প্রেম করতে হলে কিছুটা গাধা হওয়া দরকার।’ বলেই মারিয়া একটা লাস্যভঙ্গি করে আঁচল দোলাতে দোলাতে আস্তাবল থেকে বেরিয়ে গেল। মারিয়া চলে গেলে—আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। আমি হাত পা টানা দিয়ে গলাটা আস্তাবলের বাইরে গলিয়ে দিলাম এবং মরহুম ওস্তাদ তানসেনের একটা সুরের তান ধরলাম।

সে সুরে সারা আস্তাবল গুঞ্জরিত হয়ে উঠল।

মারিয়া আস্তাবল থেকে বেরিয়ে লনের মাঝখানে দিয়ে শেঠজির বাংলোর দিকে এগোচ্ছিলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *