আমি গাধা বলছি – ২

দুই

আমার দিনগুলো বড় আরামেই কাটছিল। ঘাসের আঁটি বহন করা, এদিক সেদিক চরে ঘাস খাওয়া আর দিনের শেষে খুঁটির কাছে এসে শুয়ে পড়া এই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। এর চেয়ে সাদাসিধে জীবন আর কি হতে পারে? আর এ জগতে বেশির ভাগ লোক এর চেয়ে বেশি আর কিইবা চায়। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের কাছে আমার এ নিরবচ্ছিন্ন ঝঞ্ঝাটহীন জীবন ভালো লাগল না। শোনা গেল সরকার আর এ, কলোনী নাম দিয়ে বিশুদ্ধ দুগ্ধ সরবরাহের জন্যে এক ডায়রী ফার্মের পত্তন করেছে। সকল বিপদগুলো প্রথমত এমনি শুভ উদ্দেশ্যে নিয়েই তো আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করি বোম্বেতে আবার খাঁটি দুধ পান করার দরকার হল কার? বোম্বের সকল বীরপুরুষরাই ইরানীদের চা আর গোয়ালদের আধা দুধ আধা পানি পান করে সব রকম স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। জীবনের সব রকম সংগ্রামের মাঝে এসব দুধ পান করেই আজো তারা বেঁচেবর্তে থাছে। এমতাবস্থায় তাদেরকে খাঁটি দুধ পান করানোর জন্যে নতুন একটা পন্থার উদ্ভব করার কি মানে হতে পারে? লোকদেরকে একটা নতুন বিষয়ের প্রতি নিবিষ্ট করিয়ে একটা বিতর্কের সূত্রপাত করা ছাড়া আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? আমি জানি, সরকারের উদ্দেশ্য এটা নয়। কিন্তু শেষ অবধি তাই হয়ে যায়। লোকদের একটা প্রয়োজন মিটিয়ে দিলে অপর প্রয়োজনের ক্ষুধা বেড়ে যায়। যারা বিজ্ঞলোক তারা বিচক্ষণ জেনে গেছে যে, যেদিন থেকে আর, এ, কলোনীর সূত্রপাত হয়েছে সেদিন থেকে মহারাষ্ট্রের কাহিনীও শুরু হয়েছে। এখন আপনি লোকদেরকে খাঁটি দুধ পান করিয়ে কি আশা করতে পারেন? ইরানীদের চা’র বদৌলতেই তো এতকাল মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটের মধ্যে গলায় গলায় মিল ছিল। কিন্তু দুধ এমন একটা পদার্থ যা সব সময় ভাগাভাগির পক্ষপাতী। পাঞ্জাবীদের কথাই ধরুন না; বেশি বেশি দুধ পান করতো; ফলে তাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেল। আসলে অপরাধ ছিল দুধের।

কিন্তু দোষ দেওয়া হয় ইংরেজদের। আসলে দুধের স্বভাবটাই বিভক্ত হবার। আপনি একটা পাত্রে একটু দুধ রেখে দিন, দেখবেন, একটু পর ভাগাভাগি হয়ে গেছে। মানুষের ইতিহাসে এমন অসংখ্য নজির পাওয়া যায় যে, ছোট ছোট জিনিস থেকে বড় বড় শিক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মনে করুন মোহাম্মদ বিন-কাশিম যদি ভারতের বদলে চীন আক্রমণ করত তাহলে পাকিস্তান এখন চীন দেশে থাকত। আর নেপোলিয়ান যদি পানিপথে জন্মগ্রহণ করত, তাহলে ওয়াটারলুর যুদ্ধে ইংরেজরা কোনদিন জিতে পারত না। কলম্বাসের জাহাজ যদি সমুদ্রে ডুবে যেত, তাহলে আমেরিকা কোন দিনই আবিষ্কৃত হত না। তখন কলম্বাস হয়ত ডুবতে ডুবতে মহাকবি গালিবের ভাষায় বলত,

ডুবুয়া মুজকো হোনে নে

না-হোতা মায় তু কেয়া হোতা?

এ ধরনের যুক্তিতর্কের উপমা দিয়ে টয়েন বি তাঁর সমুদয় ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। এজন্যে আমিও বলি, যদি আর, এ কলোনী না হতো মহারাষ্ট্র প্রদেশও আলাদা হতো না। এ শুধু দুধেরই অপরাধ। বোম্বের বনেদী লোকেরা প্রায় একশ বছর থেকে ইরানীদের ফিকে চা পান করে আসছে। এখন নতুন করে তারা খাঁটি দুধ পান করতে গিয়ে তাদের পাকস্থলীতে দেখা দিল গোলমাল। আর লোকেদের পাকস্থলীতে গোলমাল হলে বদহজমের দরুন তারা নতুন নতুন দাবি-দাওয়া উত্থাপন করে। আমরা মহারাষ্ট্র চাই, কাজ চাই, অন্ন চাই, বস্ত্ৰ চাই, বাড়ি চাই, ছাতা চাই, সিনেমা চাই এবং প্রত্যেক জিনিস এত ভাল চাই, যত ভালো আর, এ, কলোনীর দুধ। “

এজন্য সেকালের রাজা বাদশাহরা জনসাধারণের কোন চাহিদাই পূরণ করতো না। তাতে জনসাধারণের হজম শক্তি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকত। কিন্তু আজকাল লোকদের হজম শক্তি বিগড়ে হা হা এত বেড়ে গেছে যে, ভাল একটা আশা ভরসা না দিলে তাদেরকে নিরস্ত করা কঠিন।

আর, এ, কলোনী হয়ে যাবার পর বহুসংখ্যক গোয়ালারা কারবার বন্ধ হবার উপক্রম হল। তাদের ব্যবসা চালু রাখার জন্য তারা সম্ভাব্য সকল রকম চেষ্টা করল। কখনো দুধের দাম কমিয়ে পানি বেশি মিশাল। কখনো ঘাসের দাম কমিয়ে বিক্রয় দর কমাল। কখনো পানি কম দিয়ে বেশি লোকসান দিল। কিন্তু আর, এ, কলোনীর সামনে তাদের সব প্রয়াস বানচাল হয়ে গেল। প্রাইভেট গোয়ালদেরকে অবশেষে হাত গোটাতে হল। দিন দিন আর, এ, কলোনীর দুধের চাহিদাই বেশি রকম বেড়ে যেতে লাগল। গোয়ালারা যদি খাঁটি দুধ আর, এ, কলোনীর চেয়ে কম দামে বিক্রি করতো তাহলে কিছু সংখ্যক লোকের ব্যবসাটা চালু থাকত ৷ কিন্তু সেটাতো ব্যবসা-নীতির খেলাপ। এক জিনিসে অন্য জিনিস না মিশালে কোনদিনই সেটা ব্যবসা হয় না। উদাহরণ স্বরূপ, দুধে পানি, সাহিত্যে নগ্নতা, আটাতে ভূষি, ঘি’তে তেল, রাজনীতিতে ধর্ম এবং চাকরিতে ঘুষ ইত্যাদি তো ব্যবসা-নীতির পয়লা সবক।

ব্যবসা নীতির দ্বিতীয় ধারা হল, ভেজাল সংমিশ্রণের পরিমাণ এবং উপাদান। যেমন, আপনি যদি দুধে মধু মিশালেন, তাহলে হয়েছে আপনার ব্যবসা। একটা দামী, জিনিসের সাথে একটা দামী জিনিস মেশানো চলে না। দামী জিনিসের সাথে কম দামী জিনিস মিশাতে হবে (যদি ক্ষতিকর হয় তাতেও ক্ষতি নেই)। আজকাল ব্যবসার সব রকম রহস্য এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পানির কিইবা দাম আছে। আমার মত গাধাও বিনে পয়সার পানি পান করে থাকে। কিন্তু এ পানি যখন দুধে মেশানো হয়, চার গুণ দামে বিক্রি হয়। কাঠের ভুষির কিইবা দাম? অথচ আটার সাথে মিশিয়ে দিলে দিব্যি চলে যায়, কারো খেতে অসুবিধা হয় না। ঘৃণা এবং বিসংবাদ এমনিতে কত নিচ কাজ, অথচ তাতে যদি ধর্মের সংমিশ্রণ করা যায়, তাহলে লাখো নিষ্পাপীদের প্রাণ তাতে বিলীন হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। ব্যবসা-নীতির এসব গুরুত্ব দুধের গোয়ালারা শুধু জানে না, ধর্মের ধ্বজাধারী থেকে আরম্ভ করে রাজনীতির জনহিতৈষীদেরও বিলক্ষণ জানা আছে। যখন এভবে গোয়ালাদের ব্যবসা শিকায় উঠতে আরম্ভ করলো, ঘিসুর ঘাস বিক্রিও দিন দিন কমে আসতে লাগল।

ঘিসুর বাড়িতে বাল বাচ্চা উপোষ করতে আরম্ভ করল। ঘিসুর অবস্থা শেষ অবধি এমন হল যে, সে জোসেফ ডি. সুজার বাসায় বসে আমাকে বিক্রি করার কথাবার্তা উত্থাপন করল। বিক্রি করার পরামর্শটা দিয়েছিল তাকে রমজানী কসাই। ঘিসু যখন থেকে বেকার হল তার পানের মাত্রাটা বেড়ে গেল। প্রথম প্রথম ডি, সুজা ধার দিল ৷ কিন্তু ধারের পরিমাণ যখন বেড়ে গেল এবং তা পরিশোধ হবার ব্যাপারে ডি, সুজা সন্দিহান হয়ে পড়ল, তখন সে কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে লাগল—নিঃসন্দেহে সে ঘিসুর বন্ধু। কিন্তু বন্ধুই বা বন্ধুকে কদিন বাকী দিতে পারে।

এমতাবস্থায় রমজানী কসাই ঘিসুকে পরামর্শ দিল আমাকে বিক্রি করে দেবার জন্য। আমি সেসব কথা বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলাম। ‘গাধাটা আমার কাছে বিক্রি কর। পুরো পঁচিশ টাকা দেব।’ রমজানী কসাই বলল। জোসেফ বলল, ‘ঠিকই, রমজানী ঠিকই বলছে। আজকাল তোমার ঘাস কোথাও বিক্রি হচ্ছে না, গাধাটা রেখে আর কি করবে? তাছাড়া আমারও গোটা সাতেক টাকা পাওনা। বিক্রি দিলে আমার টাকাটাও পেয়ে যেতে পারি।’ কর্ণেল সিং বলল, ‘আর বাদ বাকী টাকা দিয়ে দিব্যি আরো দশদিন পান করতে পারবে।’

ঘিসু বলল, ‘বেচারী গাধাটা তো আমার মাথার বোঝা হয়ে রয়নি। নিজেই চারিদিকে চরে খায়। আর সন্ধ্যায় এসে খোঁটার কাছে শুয়ে থাকে। সারাদিন আমার ছেলেপিলেগুলি ওর পিঠে চড়ে বেড়ায়। তাছাড়া এক আধটা ঘাসের আঁটি তো এখনও বিক্রি হয়। রমজানী বলল, ‘এক আধটা ঘাসের আঁটি তো তুমি নিজেও বয়ে নিয়ে যেতে পার। তুমি চিন্তা করে দেখ পুরো পঁচিশটা টাকা দেব। তাও খায়খাতির আছে বলে। নইলে এই গাধা পনের টাকাও বিকায় না।’

ঘিসু বলল, ‘তুমি গাধা দিয়ে কি করবে?’ রমজানী বলল, ‘আজকাল বাঁচা বড় দায়। এখন ছাগল বকরীর যা দাম। তাছাড়া একটা থেকে বড় জোর তিন সের গোস্ত পাওয়াও দুষ্কর। তোমার গাধা তো বেশ মোটাসোটা আছে। গোস্তও মন্দ হবে না?’

‘তুমি গাধার গোস্ত বিক্রি করবে ?’

‘হ্যাঁ, তবে বকরীর গোস্তের সাথে মিশাল দিয়ে ৷’ ‘বকরীর গোস্তের সাথে মিশিয়ে?’ ঘিসু বিস্মিত হয়।

‘এতে আশ্চর্যের কি আছে? তোমাদের গোয়ালারা দুধে পানি দেয় না বুঝি?’ ‘কিন্তু তাই বলে গাধার গোস্ত লোকেরা কি মোটেই টের পাবে না?’

‘এটা তো ভাই যার যার ব্যবসার গোমর, আমি এমন এমন ওস্তাদ কসাইকে দেখেছি যারা বকরীর গোস্তের সাথে কুকুরের গোস্ত পর্যন্ত বেমালুম চালিয়ে দিয়েছেন। আমি তো শুধু গাধার গোস্ত বিক্রি করবো। আর তাও কিমা করে বিক্রি করলে কোন নাম নিশানাও থাকবে না।’ কর্ণেল সিং ড্রাইভার মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এটাতো গোমরের কথাই। আমরা মালিকের পেট্রলের উপর কি কারসাজিটা করি সেটা কেউ জানলে উপায় থাকে? তা না করে আমরা বাঁচবই বা কি করে বল? এজন্যেই-ইয়ার এক আধটু’ ……

‘হ্যাঁ, ইয়ার, তুমি রাজী হয়ে যাও।’ কর্ণেল সিং ঘিসুকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল। এসব কথা শুনে আমার পায়ের নীচের মাটি যেন সরে যাচ্ছিল। মনে হলো কে যেন আমার পায়ের সাথে চার চার মণ লোহা বেঁধে দিয়েছে। আমি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে শুনছিলাম আমার জীবন মৃত্যুর কথা। আমি শেষ অবধি শুনতে চাচ্ছিলাম ঘিসু কি বলে। যে অবলা প্রাণী এত মাস ধরে মন প্রাণ-দিয়ে যার সেবায় নিয়োজিত ছিল, প্রতিদানে একটু ঘাস পর্যন্ত নেয়নি, তার প্রতি ঘিসুর কোন দয়া আছে কিনা সেটাই আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতে চাচ্ছিলাম। ঘিসু বলল, ‘গাধাটি আমার সাথে এবং বাড়ির ছেলেপিলেদের সাথে বেশ মায়া জমিয়ে ফেলেছে। আমি কি করে আজ তার প্রাণ বিনষ্ট করব? দাও আর একটু দাও দেখি।’ ,

‘নাও, পান কর। কিন্তু তুমি তার প্রাণ বিনষ্ট করছ কোথায়? প্রাণ দেবার নেবার মালিক তো হল উপরওয়ালা। তুমি শুধু গাধাটি আমার কাছে বিক্রী করছো বৈ তো নয়। পঁচিশ টাকা দিচ্ছি তাও বন্ধু মানুষ বলে। নইলে অন্য কেউ দশ টাকায়ও নেবে না এটা। ঠিক আছে, তোমার মনে না চাইলে না হবে।’

কর্ণেল সিং কথা কাটিয়ে বলল, ‘কাল কোথায় গিয়েছিলিরে রমজানী? কালকে যে এলি না এখানে।’

‘আর বলিস না ভাই—আকিলা বানুর কাওয়ালী শুনতে গিয়েছিলাম, সে যা গায়

‘আরজে নিয়াজে ইকে কাবেল নেহি রাহা

যিস দিলপে হামে নাজ থা উ দিল নেহি রাহা।’

বলেই রমজানী গুন গুন করতে লাগল। তার গুন গুন শুনে ঘিসু মাথা দোলাতে শুরু করল। আর সেই সাথে কর্ণেল সিং ড্রাইভার টিনের পেটরা পেটাতে শুরু করল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যাক, জীবনটা বেঁচে গেল তাহলে। ঘিসু ভাবাবিষ্ট হয়ে বলল, ‘পঁচিশ কেন কেউ যদি হাজার টাকা দেয়, তবু আমার গাধা কাউকে দেব না।’

‘কে, তোর গাধার কথা বলছে এখন আর? রমজানীর কাওয়ালীটা শুনতে দে।’ জোসেফ বলল। কিন্তু ঘিসুর ততক্ষণে জোস উঠে গেছে সে হাত নেড়ে বলল ‘কেউ যদি পঞ্চাশ লাখ টাকাও দেয়, তবু আমার গাধা কাউকে দেব না। এ গাধা আমার যে সেবা করেছে আমি তা জীবনভর ভুলতে পারব না। আমি কোনদিন গাধা বেচব না। সে যখন কোন কোন সময় করুণ চোখে আমার দিকে চায়, মনে হয় সে কোন গাধা নয়। গাধার খোলসের নীচে এক সাধুর আত্মা লুকিয়ে আছে। কেউ যদি পঞ্চাশ কোটি টাকাও দেয় আমার গাধা হাত ছাড়া করবো না। ঘিসু কোন দিন কারো সাথে বেঈমানী করে নাই আর করবেও না। ঘিসু ধর্মবিরোধী কোন কাজ করতে পারবে না।’

‘নিয়ে এলো ফের ধর্মের কথা মাঝখানে। জোসেফ ওর গ্লাসটা একটু ভরে দে।’ কৰ্ণেল সিং বলল।

‘কোত্থেকে দেব? সাত টাকার আগেই সামাল দিয়ে রেখেছে। কত আর ধার দেয়া যায় বলো।’

‘দে ভাই, ভরে দে, ভগবান দেনেওয়ালা। যেভাবে হোক তোমার ধার পরিশোধ হবেই।’

‘যখন পরিশোধ হবে তখনই দেব। এখন আর এক ফোঁটাও দিতে পারব না।’ ঘিসু তার খালি গেলাস দেখিয়ে রমজানীকে বলল, ‘আমার গেলাসটা যে একেবারে খালিরে রমজানী।’

‘তোমার গ্লাস খালিই থাকবে।’ জোসেফ বলল।

‘একটা টাকা দে রমজানী।’ ঘিসু বলল। রমজানী পকেট থেকে পঁচিশ টাকা বের করে বলল, ‘এক টাকা কেন, এই নাও পুরো পঁচিশ টাকা দিচ্ছি।’

ঘিসু কট্ করে টাকাগুলোর দিকে এগুতে লাগল। ধপকরে টাকাগুলো হাতে নিয়ে সে বলল, ‘চলো গাধা দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। নে জোসেফ, এখন তো আর দিতে বাধা নেই ৷

রমজানী আমার গলায় দড়ি লাগিয়ে নিয়ে চলল এবং নেচে নেচে বলতে লাগল-

আরজে নিয়াজে ইকে কাবেল নেহি রাহা

যিস দিলপে নাজ থা মুঝে উ দিল নেহি রাহা। –

সহসা আমি বললাম,

জাতাহুঁ দাগে হাসরাতে

হাসতি লিয়ে হুয়ে

কুশতায়ে দরখুরে মাহফিলে নেহী রাহা।

রমজানী চমকে তাকাল। তারপর আমার দিকে দেখে রশি টেনে জোরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। সে ঠিক করতে পারছিল না যে ; এ আওয়াজ কোত্থেকে আসছে। ভয়ে তার মুখ সাদা হয়ে গেল। ভয় দূর করার জন্য সে জোরে জোরে গাইতে লাগল। আরজে নিয়াজে …

আমি এবার একটু জোরেই বললাম,

মরণে কি আয় দিল আওর হি

তদবীর কর,

কে ম্যায়,

শায়ানে দস্ত অ বাজুয়ে কাতে নেহি রাহা।

রমজানী ভয়ে রীতিমত কাঁপতে লাগল এবার। রাতও হয়ে এসেছে। সে অন্ধকারে চীৎকার দিয়ে বলল, কে? ‘কে এসব বলছে?’

‘আমি এক হতভাগা গাধা।’

‘তুমি, তুমি?’

রমজানী চোখ ছানাবড়া করে আমার দিকে তাকাল। চমকে উঠে বলল,

‘তুমি এক গাধা হয়ে মানুষের ভাষায় কথা বলছ ৷’

আমি বললাম, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর কখনো মানুষের ভাষায় কথা বলব না। কিন্তু যখন জীবনমরণের প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে এবং মানব জাতির বেঈমানী দেখতে পেলাম তখন বাধ্য হয়ে ইকবালের সে চরণ বলতে হয়,

দিলসে হুয়া আয় কাশতে অফা মিট গেয়ি কে ওয়া

হাসেল সেওয়ায়ে হাসরাতে

হাসেল নেহি রাহা।

লা হাওলা ওলা কুয়াতা…. রমজানী চিৎকার দিয়ে বলল এবং আমার রশি ছেড়ে দিয়ে জোরসে দৌড়াল। আমি পেছন দিকে রমজানীর অপসৃয়মান দৃশ্য দেখতে দেখতে তাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘ও রমজানী ভাই, একটু শোন, যাচ্ছ কেন?’

কিন্তু সে একবারও পিছন ফিরে দেখল না। সে ভয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে থাকল। আমি মাথা নত করে আস্তে আস্তে ফিরে চললাম। চলতে চলতে জোসেফ ডিসুজার ঝুপড়ির কাছে যেয়ে পৌঁছলাম। ততক্ষণে ঘিসু’ এবং কর্ণেল সিং চলে গেছে। শুধু ডি’সুজা বাইরের বেঞ্চিতে বসে গ্লাসের তলানীটুকু পান করছিল। সে আমাকে দেখে লাফ মেরে আমার রশি ধরে ফেলল।

‘রমজানীর হাত থেকে ছুটে পালিয়ে এসেছ বুঝি? পালিয়েই বা কোথা যাবে। কালকেই তোমাকে রমজানীর হাওলা করে দেব। বলেই সে আমাকে নারিকেল গাছের সাথে বেঁধে রাখল। আমি আস্তে আস্তে জোসেফকে বললাম,। ‘জোসেফ।’

‘হায়, একি?’ সে জোরে চিৎকার করে বলল।

আমি বললাম, ‘চিৎকার করার কোন দরকার নেই। তুমি একজন শিক্ষিত · লোক এ জন্য তোমার সাথে মুখ খুললাম। তুমি আশ্চর্যই হচ্ছ, আমি গাধাই বলছি।’

‘একি, আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো।’

‘না, স্বপ্ন দেখবে কেন? এ হতভাগা ঠিকই বলছে। ছোটকালে আমি মানুষের ভাষা শিখে নিয়েছিলাম।’

সে আমার জীবনের আদ্যোপান্ত ঘটনা শুনে বলল, ‘হায় হায় মোটেই বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু আজ তোমাকে সামনে দেখে মনে পড়ছে তুমিই সেই বিখ্যাত গাধা। তুমিতো পণ্ডিত নেহেরুর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলে। হ্যাঁ, বেশ মনে পড়ছে। তোমার বহু খবর আমি পত্রিকায় পড়েছি। বলুন, আমি আপনার কি খেদমত করতে পারি।’

আমি বললাম, ‘শুধু রমজানীর হাত থেকে আমাকে বাঁচাও।’

‘কিন্তু তা কেমন করে? রমজানী তোমাকে পঁচিশ টাকা দিয়ে কিনে ফেলেছে যে।.

‘শুধু পঁচিশ টাকায় আমার জীবনটা বরবাদ হয়ে যেতে বলো?’

‘কেন, বোম্বের দাদারাতো মাত্র দশ টাকার বদলে মানুষের প্রাণ সংহার করে থাকে। তারাতো হলো মানুষ। আর তুমি হলে গাধা। লেখাপড়া জান ঠিকই। কিন্তু তাতে কি আসে যায়। বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি সৈনিক ছিলাম। আমি নিজের চোখে দেখেছি মাত্র কটা ‘টাকার লোভে বহু লোককে নিহত করা হয়েছে। সে তুলনায় তুমিতো এক গাধা।’

‘তারাও গাধা ছিল। যুদ্ধের সময় মানুষের জীবনকে ভেড়া বকরির মত জ্ঞান করা হত। হিরোশিমার বোমা বর্ষণে ৭০ হাজার লোকের প্রাণহানি হয়েছে। হিসেব করলে দেখবে তাদের মাথাপিছু দাম পঁচিশ টাকাও পড়েনি।’

জোসেফ বলল, ‘এতে তো তোমার খুশী হওয়া দরকার। মানুষের জীবনের চেয়ে এক গাধার দাম অনেক বেশি দেয়া হচ্ছে।’ আমি তার কথা না শোনার ভান করে বললাম, ‘সে লোকেরা অযথা লাখো লাখো মানুষকে মেশিনগানের শিকার বানিয়েছে। তারা যদি বরং তাদের মাংস গরুর মাংসের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করতো তাহলে বেশ লাভ হত তাদের। লাভই তো তাদের দরকার।’

‘তুমি কি সব আশ্চর্য কথা বলছ।’

‘শুধু পঁচিশ টাকার বিনিময়ে একজনের হাতের রশি অপরের হাতে তুলে দেওয়ার মত আশ্চর্য কথাতো আর বলছি না।’

‘এখন তুমি কি বাঁচতে চাও?’

‘আমি বাঁচতে চাই।’ আমি ধরা গলায় বলতে লাগলম, ‘আমার মত কোটি কোটি লোক এ জগতে রয়েছে। তাদেরকে গাধা পেয়ে সবাই গলা টিপে মারছে। এখন আমরা সবাই বাঁচতে চাই, আমাদের গলায় কেউ যেন রশি না লাগাতে পারে।’

‘সবার কথা বলে তোমার কি লাভ? তোমার নিজের কথা বল।’ ‘আমি বলি তুমি রমজানীর হাত থেকে আমাকে কিনে নাও।’

‘বাহ্ এক গাধার জীবন বাঁচানোর জন্য রমজানীকে পঁচিশটি টাকা দিয়ে দেব আমি? আমি এত গাধা নই।’

‘আমার কথা আগে শুনেই নাও। এতে তোমারই লাভ। তুমি আমাকে কিনে নিলে আমি পুলিশের চোখ বাঁচিয়ে তোমার মদ মহমক্রাক অবধি পৌছে দেব। এখন পর্যন্ত এ কাজের জন্য তোমরা মানুষের সাহায্য গ্রহণ করছ। মানুষ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে যায়, তাদের সাজা হয়। তোমাদের লোকসান হয়। কিন্তু এ কাজের জন্য যদি তুমি আমার সাহায্য নাও, তাহলে আমি কছম করে বলতে পারি পুলিশ একবারও ধরতে পারবে না।’

‘তা কেমন করে?

‘বেশ সহজ পন্থা আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি। এ কাজের জন্য সর্ব প্রথমে তোমাকে বান্দ্রাতে এবং মহমক্রাকে দুটো ঘাঁটি করতে হবে।’ ‘সেসব চিন্তা করতে হবে না। আগে থাকেই আমাদের একাধিক ঘাঁটি রয়েছে সেখানে।’

‘তবে তো সব কাজ সহজ হয়ে যাচ্ছে। আমি শপথ করে বলতে পারি পৃথিবীর কোন স্মাগলারের মাথায় এ ফন্দি আসবে না।’ জোসেফ অধৈর্য হয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তারপর।’

‌ ‘পন্থাটা একেবারে সহজ। তোমার কাজ হবে শুধু রোজ আমাকে বান্দ্রা থেকে মহমক্রাকে নিয়ে যাওয়া।’

‘আচ্ছা, তারপর।’

‘রোজ সকালে আমাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ মদ পান করিয়ে দাও। আমার পেটে বেশ কয়েক গ্যালন মদই ধরবে, আমাকে মদ পান করিয়ে দিয়ে মহমক্রাকে নিয়ে ছেড়ে দাও। আমি একটা ভবঘুরে গাধার মত ঘুরতে ঘুরতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশের চেকপোস্ট পার হয়ে যাব। পুলিশের বাবার সাধ্য নাই আমাদের কারসাজি বুঝে। তারাতো শুধু মানুষের তল্লাশী করে, গাধার প্রতি তাদের সন্দেহ হবে কেন? ‘তারপর ?’

‘তারপর মহমের ঘাঁটিতে পৌঁছে তুমি গলায় রাবরের নল ঢুকিয়ে সব মদ বের করে নেবে গাধার পেট থেকে।’

‘বের করা মদ লোকেরা পান করবে? গন্ধ আসবে না?’

‘কি বোকার মত কথা বলছ। যারা পঁচা জায়গায় লুকানো বোতল এবং পুরানো টায়ারে ভরা মদ পান করে যাচ্ছে দিব্যি, তারা গাধার পেটের মদ খেতে আপত্তি করবে কেন? সকাল বেলা আমার খালি পেট ময়লা যুক্ত টায়ারের থেকে তো অনেকাংশে পবিত্রই থাকে বলতে হবে।’

‘বুঝলাম, এতে তোমার নেশা হবে না?’

‘পাঁচ মিনিটে আবার নেশা কতটুকু হবে? মহমক্রাক পার হয়ে যেতে পাঁচ মিনিটের বেশি তো আর লাগবে না। আমার পেটকে মনে কর পেট্রোলের একটা বড় ড্রাম। বান্দ্রা হল তোমার ফিলিং স্টেশন। ব্যাস, বান্দ্রা হতে এ ড্রাম ভরে মহমক্রাকে এনে খালি করছ, এরচে বিজ্ঞানসম্মত পন্থা আর কি হতে পারে।’ ‘গড ব্লেস ইউ—’

জোসেফ একটু চিন্তা করে বললো এবং খুশীতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এমন ভাল পন্থা আর হয় না। তুমি এক নম্বর পাকা স্মাগলার গাধা। পুলিশের চোখে ধুলা দেবার এর চেয়ে বড় ফন্দি আর নেই। হলিক্রাইষ্ট ইউ—আমি তো এক বছরেই লাখপতি বনে যাব।’ আনন্দের আতিশয্যে জোসেফ আমার মুখে চুমা দিতে লাগলো। ‘এখন অবশ্যিই বড়লোক হয়ে যাব আমি। এতে আর কোন সন্দেহ নেই। এখন পঁচিশ কেন, দরকার হয় একশ টাকা দিয়ে আমি তোমাকে ছাড়িয়ে নেবো।’

‘এতদিন আমি নেহাত এক গাধা ছিলাম। এখন এক উপকারী জন্তু বলে আখ্যায়িত হচ্ছি। মানুষ যখন লাভের গন্ধ পায়, তখন একটা গাধার গালেও চুমা দিতে পারে।’

‘এসো ভিতরে চলে এসো।’

জোসেফ আমাকে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে গেল এবং বলতে লাগল, ‘আমি তোমাকে বাইরে নারকেল গাছের নীচে থাকতে দিতে পারি না। তোমার যদি ঠাণ্ডা লেগে যায়। কি আশ্চর্য, তোমার গায়েতো একটা কাপড়ও নেই।’ আমি বললাম, ‘পৃথিবীতে অসংখ্য গাধা নগ্ন অবস্থায় গাছের নীচে শুয়ে থাকে।’

‘রাখো সে সব গাধাদের কথা। আজ তো আমি তোমাকে আমার নিজের বেডরুমে শুতে দেব। গরম লাগলে সিলিং ফ্যান খুলে দেব ৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *