চৌদ্দ
প্রথমদিনের রাশপ্রিন্ট দেখে প্রেমবালা আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কি অপূর্ব অভিনয় করেছ তুমি। দিলীপ কুমারকেও হার মানিয়ে দিয়েছ।’ ‘সত্যি?’ আমি খুশী হয়ে বললাম।
‘আর ওই যে নদীর তীরে, কি ফাইন এক্সপ্রেশন তোমার—মাহিয়াল যখন আমাকে দেখে এগিয়ে আসে, কেমন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে তুমি হাঁটো একেবারে চার্লি চ্যাপলিনের মতো তোমার অভিনয়।’
‘না, কে বলে? আমার অভিনয় মোটেই ভাল হয়নি।’ আসলে আমি মনে মনে ফুলছিলাম।
‘সত্যি বলছি, ওই যে তোমার ক্লোজ আপটা—কুমারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে যখন তুমি আমার কাছে চলে আসো এবং অবলীলাক্রমে আমাকে পিঠে তুলে নাও তোমার ভাবভঙ্গি একেবারে দেবানন্দের মত। আমি জানতাম না এক গাধার মধ্যে এমন সুন্দর অভিনয় প্রতিভা লুকিয়ে আছে।’
সে রসিয়ে রসিয়ে কতক্ষণ হাসল। তারপর বলল,
‘দেখো, শেষে মাহিয়ালকে রেখে তোমাকেই না আবার ভালবেসে ফেলি।’ বলেই সে অট্টহাসি করে উঠল। তারপর কি মনে করে একটু লজ্জিত হয়ে পড়ল। তার হাসির সাথে আমিও হাসছিলাম। যেন একটা চমকপ্রদ কাহিনী শুনে আমরা হাসছি। হঠাৎ তার ছবিটা যেন কেমন হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আমি দৃষ্টিটা নত করে নিলাম। এবং আমার বুক দুরু দুরু কাঁপছিল তখন। সে দিন বিকেলেই সে আমার বাংলোতে এসে হাজির। বিশেষ চিন্তা-ক্লিষ্ট মনে হল। জিজ্ঞেস করলাম, কিছুই বলল না। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা হয়ে ধরলাম। পরে বলল,
‘কি বলব ডার্লিং। ওই যে আমার ইনকাম ট্যাক্সের মামলাটা। হিসেবে গোলমাল হয়ে যাওয়াতে ইনকাম ট্যাক্সওয়ালারা আমার দু’লাখ টাকা জরিমানা, করেছে। কাল সে টাকাটা দিতে হবে। কিন্তু আমার কাছে এখন কুল্লে পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। কিভাবে কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘তাতে কি হয়েছে? আমি দেড় লাখ টাকা দিয়ে দিচ্ছি। এই নাও চেক দিয়ে দিচ্ছি।’
‘না, তোমার থেকে আমি টাকা নেব না। আমি দশদিন কিছু না নিয়ে কাজ করার ওয়াদা করেছি, আমি কিছুতেই তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে পারি না। কি আর হবে? বড়জোর জেল হবে, এইতো? আমি জেলে যেতে রাজী, ওয়াদা খেলাপ করতে পারি না।’ তবু আমি
‘আমরা থাকতে তুমি জেলে যাবে, এ কেমন কথা? এ টাকা তোমাকে গ্রহণ করতেই হবে।’
বারংবার সে অস্বীকার করলো আর আমি তাকে রাজী করার চেষ্টা করছিলাম। অবশেষে সে নিতে রাজী হল। আমি চেক কেটে দিলাম। এরপর আমি একটু হুইস্কি পান করলাম। তাকেও একটু পান করতে দিলাম। তারপর সে আমার রেডিওগ্রাম বাজাতে শুরু করল।
‘তুমি নাচতে পার?’ সে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি তো শুধু লাফাতে জানি।’
‘বাজে কথা রাখ, তোমার গলায় এটা কি ঝুলিয়ে রেখেছ? কোট প্যান্ট পর। টাই লাগাও। এসো তোমাকে ড্যান্স শিখাচ্ছি। হাই সোসাইটিতে মেলামেশা করতে হলে ওয়েস্টার্ন ড্যান্স শিখে নিতে হয়?
একথা বলেই সে ‘স্নোফক্সট্রাট’ এর রেকর্ড জুড়ে দিল। এবং আমাকে টেনে নিয়ে নাচতে শুরু করল। ‘ওয়ান টু থ্রি—’ তালে তালে আমি নাচতে লাগলাম। সময় কিভাবে গত হল বলতে পারব না। আমি আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে ভুলে গেলাম। চরম নাচের সময় মনে হল আমি একজন মানুষ। সাজানো উৎকৃষ্ট কামরা, কার্পেট, গালিচা, রেডিওগ্রাম, নীলাভ হালকা আলো এবং অনিন্দ্যসুন্দরীর সাহচর্য, কত আনন্দের এ জীবন। কোটি কোটি গাধা এমন আনন্দ পায় না। “
হঠাৎই সে হাতঘড়ি দেখে চমকে উঠে বলল,
‘উফ, নটা বেজে গেছে। মা বকবে। এখন আসি। স্টুডিওতে দেখা হবে। টাটা।
বলেই সে ছোঁ মারার মতো আমাকে একটা চুমো দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। প্রথম দশ দিনের সুটিং এর মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটল। কুমারের বস্তির সেট তৈরি করা হয়েছে। কুমার মাটির বাসন-কোসন তৈরি করছে। কুমারের বউঝিরা নানা কাজে দৌড়াদৌড়ি করছে। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা হৈ-হল্লা করছে। কখনো লাইট জ্বালানো হচ্ছে, কখনো নেভানো হচ্ছে এমন জমকালো দৃশ্যের এককোণে একটা কৃত্রিম গাছও তৈরি করা হয়েছে। গাছের নীচে কতকগুলো গাধা চরে বেড়াচ্ছে।
আমি দাদা ধূমলকে বললাম,
‘গাধাগুলো এলো কোত্থেকে?’
‘আমি আনিয়েছি। কুমারের বস্তিতে তো গাধা থাকতেই হবে
‘আমি এসব গাধাদের সাথে কাজ করব না।’
‘শেঠ, এসব তো হল গিয়ে একস্ট্রা গাধা। তাদের সাথে আপনার কি তুলনা? সিনটাকে জমকালো করার জন্যেই এগুলোকে এনেছি। এগুলোকে গাধা বলাও ঠিক হবে না। কারণ, আপনি স্বয়ং গাধা। এগুলোকে বলা যায় বাজারী ভবঘুরে টাট্টি। সুমন তাল মিলিয়ে বলল,
‘কোথায় আপনি, আর কোথায় এরা। কোথায় রাজা ভোজ আর কোথায় গঙ্গা তেলী। আপনি তো কাজ করবেন বড় বড় স্টারদের সাথে।
অশনি, ব্রিজেন্দ্র—প্রেমবালা, সবাই আপনার সমমানের।’
‘হ্যাঁ, তাহলে ঠিক আছে।’ আমি নিজেকে কোন মতে বুঝিয়ে নিলাম। দাদা ধূমল কাছে এসে আমার কানে কানে বলল,
‘এখন তো আমি আগাগোড়া স্ক্রীপ্টটাই এমনভাবে সাজিয়ে নিচ্ছি যে, যেখানে প্রেমবালা থাকবে সেখানে আপনিও থাকবেন।’
‘সাবাস।’ আমি বললাম। কিসের একটা আকর্ষণে আমি একস্ট্রা গাধাগুলোর কাছে যেয়ে হাজির হলাম। কাছে যেতেই দেখলাম, আমার সেই ভূতপূর্ব প্রেমাস্পদও রয়েছে সে দলে। জোসেফ ডি’সুজার ঝুপড়ির কাছে আমি যাকে প্রেম নিবেদন করেছিলাম। কিন্তু এখন সে কেমন যেন শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। দেহের সেই লাবণ্য আর নেই। কান ঝুঁকে পড়েছে। হাড়-গোড় বেরিয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে না জানি বেচারী কতকাল থেকে পেট ভরে ঘাস খেতে পায়নি
‘কেমন আছ মেম সাহেব? একবার চোখ তুলে দেখ দেখি কে এসেছে তোমার কাছে।’
সে চমকে উঠে আমার আপাদমস্তক দেখে নিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমাকে চিনতে পারলো না।
‘কে তুমি?’
‘আমি তোমার ব্যর্থ প্রেমিক। মনে নেই সেদিনের কথা? জোসেফ ডি’সুজার ওখানে আমার প্রেম নিবেদনকে পদদলিত করে দিয়েছিলে।’
মুহূর্তে তার চেহারাটা আরক্ত হয়ে উঠল। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে সে আমার দিকে তাকাতে লাগল।
‘কিন্তু তুমি এখানে কি করে এলে? তুমিও একস্ট্রা হিসাবে এসেছো?’ ‘না। যে ছবির জন্য তোমাদেরকে আনা হয়েছে, আমি তার প্রডিউসার।
‘ফিল্ম প্রডিউসার? গাধা হয়ে?’ সে চোখ কপালে তুলে বলল। ‘কেন, যার কাছে লাখ লাখ টাকা আছে প্রডিউসার হতে বাধা কি তার? সে গাধা হোক, আর যাই হোক। ডাক্তারকে ডাক্তারী পাস করতে হয়, ইঞ্জিনিয়ারকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করতে হয়। কিন্তু প্রডিউসার হবার জন্য কোন কোয়ালিফেকেশনের দরকার হয় না। শুধু টাকা থাকলেই হলো।’
‘তুমি এত টাকা কোথায় পেলে?’
‘লটারী ধরে ৷’
‘কত টাকা?’
‘ত্রিশ লাখ।’
‘ত্রিশ লাখ! বাপরে!’ বলেই সে চোখে ছানাবড়া করে আমার আপাদমস্তক দেখতে লাগল। আমার গায়ে চমৎকার সার্কসিফেনের কোট, পরনে চার পা বিশিষ্ট পাতলুন, গলায় চমৎকার টাই। আমার মসৃণ লোমগুলিতে সুগন্ধি তৈল মাখানো ছিল। সে একটু কাছে এসে আমার দেহের ঘ্রাণ নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘সত্যি, আমি যদি তখন তোমাকে গ্রহণ করতাম কত ভালো হতো।’ আমি কিছুই বললাম না। ‘চল এখন তুমি আমাকে বিয়ে কর।’
‘সেদিন চলে গেছে মেম সাব। সে সময় আমি ছিলাম গরীব অসহায়। আজ আমি মস্তবড় ফিল্মস্টার। ‘ফেন ফেয়ার’ এবং ‘নিউ স্ক্রীনে’ আমার রঙিন ছবি ছাপা হয়। এখন আমি আমার সমমানের গাধাদেরকেই বিয়ে করব। তোমাকে কেন বিয়ে করব?’
‘এতটুকু বলে আর আমি সেখানে দাঁড়ালাম না। ডাইরেক্টরের কাছে এসে বললাম, ‘ওই যে স্বর্ণকেশী মেয়ে গাধাটা, মনে হয় অনেক দিন থেকে ঘাস পায়নি। ওটার জন্য কিছু ঘাসের বন্দোবস্ত করে দাও। একস্ট্রাগুলো যতদিন এখানে থাকবে ততদিন ওটার জন্যে ঘাসের বন্দোবস্ত রাখ।’
দাদা ধূমল মুচকি হেসে বলল,
‘আজ্ঞে কোন পুরনো স্মৃতি
‘মিথ্যে নয়। কিন্তু তা স্তিমিতপ্ৰায় ৷’ সুমন বলল,
‘আগুন নিভে গেলে থাকে ভস্ম আর সৌন্দর্য ফুরিয়ে গেলে থাকে স্মৃতি ৷’ ‘এমন সময় হঠাৎ প্রেমবালা অগ্নিমূর্তি হয়ে এসে আমাকে আক্রমণ করে বলল
‘কার সাথে তুমি এতক্ষণ কথা বলছিলে?’
‘তুমি রাগ করছ কেন ডার্লিং ওটাতো একটা একস্ট্রা গাধা।’
‘হোক না, তুমি তো তার সাথে বেশ রসিয়ে রসিয়ে মজা করে কথ বলছিলে।’
‘ওর সাথে মজা করে কথা বলার কি আছে? একটা একস্ট্রার সাথে আমার কিইবা অন্তরঙ্গতা থাকতে পারে? এমনি ওটাকে খুব ক্ষুধায় কাতর মনে হচ্ছিল, কিছু ঘাসের বন্দোবস্ত করে দেবার কথা বলেছি।’
‘না, ওটাকে ঘাস দিতে পারবে না তুমি। এক্ষুণি যদি ওটাকে সেট থেকে বের করে না দাও, সত্যি করে বলছি, আমি ছবিতে কাজ করব না।’ বলেই সে ক্রোধে হাঁফাতে লাগল। আমি তাকে অনেক করে বুঝালাম। কিন্তু কিছুতেই সে মানল না। বাধ্য হয়ে একস্ট্রাকে সেটের বাইরে তাড়িয়ে দেবার হুকুম দিতে হল। তাড়িয়ে দিতেই প্রেমবালার মুড ফিরে এল। একটা চাপা আনন্দে মনটা ভরে উঠল তার। গুন গুন করে একটা গান ধরল সে।
তখন তাকে এত ভাল লাগছিল আমার ইচ্ছা হচ্ছিল সবকিছু কোরবান করে দেই তার জন্য।