তের
মহরতের পর কাহিনী সম্পর্কে আলোচনা উঠল। ছবির কাহিনী কি হবে? ‘কাহিনী?’ দাদা ধূমল অনেকটা অপ্রস্তুতের মত হল। সুমন বলল, ‘ছবিতে কাহিনী হয় না শেঠ।’ ‘তবু একটা কিছু কাহিনীতো থাকতে হবে।’
‘মনে করুন এক ছিল মশা।’ ‘না, ওসব রাখ, কাহিনী বল ৷’ ‘কাহিনী?’ ‘হ্যাঁ, এইমাত্র মনে পড়ল একেবারে ফার্স্টক্লাস …’ ধূমল বলল। ‘আচ্ছা বল।’ ‘সোহনী মাহিয়াল।’ ‘সোহনী মাহিয়ালের ছবিতো হয়েছে।’ ‘হয়েছে। তিনবার হয়েছে। দুইবার সিলভার জুবিলী লাভ করেছে। কিন্তু দাদা সেটাকে এবার এমনভাবে সাজিয়ে নেবেন যে, সবগুলোর মাথা কাটা যাবে।’
সুমন বলল।
‘আর তাও টেকনিকালারে হবে।’ দাদা ধূমল বলল।
‘আর তাও চওড়া স্ক্রিনে হবে।’ সুমন বলল ৷
‘আমি এ কাহিনীর আগাগোড়া এক নূতন ধাঁচে ঢেলে তৈরি
করব।
এটাতে এমন একটা একশন কাজে লাগাব যে, এ ছবি গোল্ডেন এমন কি ডায়মন্ড জুবিলী লাভ করার পরও যেন হল থেকে না বের হয়। অবশেষে পুলিশের লোকেরা এসে ছবিকে হল থেকে বের করবে।’
‘আচ্ছা কি ভাবে সাজাতে চাও ওটাকে?’
‘অশনি হবে কুমার। প্রেমবালা তার মেয়ে, যার নাম সোহনী। সোহনী বিজেন্দ্রনাথকে ভালবাসে, যার নাম মাহিয়াল।’
‘আচ্ছা তারপর?’
‘তারপর আমি একটা আইডিয়া লাগাচ্ছি।’
‘কি আইডিয়া?’
‘কুমারের ছিল এক গাধা।
‘গাধা?’ সুমন অবাক হলো।
‘কেন, কেন কুমারদের গাধা হয় না? সোহিনী-মাহিয়ালের কাহিনীর কুমারেরও এক গাধা ছিল। কিন্তু এ কালের লেখকরা সে গাধাকে কাজে লাগায়নি। আমি সে গাধাকে দিয়ে এমন অ্যাকশন লাগব যে, লোকেরা সোহনী-মাহিয়ালকে পর্যন্ত বেমালুম ভুলে যাবে।’
‘তা কেমন করে?
‘মনে কর সোহনী যখন মাহিয়ালকে ভালবেসে ফেলে, সোহনী আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে গাধার গলা জড়িয়ে মনের দুঃখ জানাতে থাকে। গাধা অবলা জীব, সোহনীর
মনের কথা সব বুঝতে পারে কিন্তু ব্যক্ত করতে পারে না। নীরব অভিব্যক্তি দিয়ে সে সোহনীর প্রেমাবেগের স্বীকৃতি দেয়। মাহিয়ালের জন্য প্রেম-কাতর সোহনী যখন করুণকণ্ঠে গান গাইতে থাকে, তার চোখ থেকে টপ টপ করে অশ্রু গড়াতে থাকে।’
‘কার চোখ থেকে?’
‘প্রেমবালার?’
‘না, গাধার। সোহনীর প্রেমের ব্যথায় গাধার মত অবলা জীবের চোখ থেকে যখন দরদর করে পানি পড়তে থাকবে, তখন হলের লোকেদের কি অবস্থা হবে? কোন লোক না কেঁদে পারবে?’ শুনে সুমনের চোখ ছলছল করে উঠল।
‘আরেকটা আইডিয়া লাগাচ্ছি।’
‘আচ্ছা বল দেখি।’
‘প্রেমকাতর সোহনীর ব্যথায় ব্যথিত হয়ে গাধা আর টিকতে পারে না। একদিন সে সোহনীকে পিঠে করেই নিয়ে চলল মাহিয়ালের কাছে। পথে যেতে একটা বিরাট পরিখা পড়ল। এক লাফে তা পার হয়ে গেল। তারপর একটা দেয়াল সামনে পড়ল, তা এক লাফে টপকে গেল। তারপর দৌড়াতে দৌড়াতে চেনাব-এর তীরে দাঁড়াল। এপারে সোহনী ওপারে মাহিয়াল মাঝখানে উত্তাল তরঙ্গ নদী। গাধা একটুখানি থেমে নিয়ে বিপজ্জনক নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। স্রোতস্বিনী চেনাবের তরঙ্গাভিঘাত উপেক্ষা করে সাঁতার কেটে গাধা ওপারে যেয়ে উঠতে সক্ষম হলো। তারপর উভয়ের মিলন। কেমন লাগলো? এমন কোন লোক থাকবে না যে হাততালি না দেবে ওখানটায়?’
‘আলবৎ, তারপর?
আমার বেশ মজা লাগছিল।
‘তারপর আর কি, রোজ ওভাবে সোহনীকে পিঠে করে মাহিয়ালের কাছে নিয়ে যায় সে। কিন্তু একদিন কুমার টের পেয়ে যায়। সোহনীকে এক কামরায় বন্ধ করে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। আর গাধাকে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলল। সিনটা একবার খেয়াল করে দেখো। ভেতরে সোহনী কাঁদছে বাইরে গাধা মার খাচ্ছে। মার খেতে খেতে গাধা বেহুঁশ হয়ে যায়।
আমার আইডিয়া দেখ। গভীর রাত। গাধা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে, সোহনী দরজা খুলবার জন্যে অনর্গল দরজা পিটাচ্ছে। সে শব্দে গাধার সংজ্ঞা ফিরে আসে। হঠাৎ সবকিছু মনে পড়ে যায় গাধার। কিন্তু অবলা জীব। কি করতে পারে সে? তবু ক্ষত-বিক্ষত দেহ নিয়ে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোল এবং থুতনি দিয়ে ঠেলে ঠেলে দরজার অর্গলটা খুলে ফেলল। সোহনী বেরিয়ে এসে গাধার পিঠে চড়ে বসল। গাধার সারাদেহে এত ব্যথা যে, সে নড়তেও পারছিল না। কিন্তু সোহনীর মিলনাকাঙ্ক্ষার কথা চিন্তা করে গাধা এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু ভুলে গেল এবং মরিয়া হয়ে চেনাবের দিকে দৌড়াল। আবারও সে উত্তাল তরঙ্গ ভেঙে ওপারে গিয়ে মাহিয়ালের সাথে মিলিয়ে দিল তাকে। আবার করতালি!
এবারে কুমার রেগে গিয়ে গাধাকে অন্যত্র বিক্রি করে ফেলল। কিন্তু সোহনী জানতে পারল না। রাতের বেলা গাধাকে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে সে চেনাবের তীরে চলে এল। ওপারে মাহিয়াল সোহনীর প্রতীক্ষা করে বিলম্বিত লয় নিয়ে গাইছে,
‘আজা মেরি সোহনী আজা।’ আর এপারে সোহনী গাধাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গাইছে,
‘আজা মেরি গাধে আজা।’
ডুয়েট শেষ হবার পর গাধা দ্বিতীয় মালিকের বাড়ি থেকে দড়ি ছিঁড়ে যথা সময়ে চেনাবের তীরে এসে হাজির হল। আবার করতালি।
‘কিন্তু সোহনী মাহিয়ালের কাহিনীতো ট্রাজেডী।’ আমি বললাম। ‘হ্যা ট্রাজেডীইতো ৷’ শেষে হলো কি, এবারে মালিক গাধাকে এক ঘরে বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিল। আজ সোহনী কেমন করে চেনাব পার হবে? অনেক ভেবে চিন্তে সোহনী একটা মাটির ঘড়া নিয়ে নদীতে নেমে পড়ল। ওদিকে গাধা যথাসময়ে নদী তীরে আসার জন্যে দেয়ালে মাথা কুটতে লাগল। মাথা কুটতে কুটতে হঠাৎ দেয়াল ভেঙে গেল (গ্রামাঞ্চলের বাড়ি ঘরের দেয়াল মাটির হয়ে থাকে)। গাধা কেমন করে জানতে পারল সোহনী মাটির কলসী নিয়ে চেনাব পাড়ি দিয়েছে। চেনাবে ভীষণ ঝড় তুফান। মাঝপথে কলসী যদি ভেঙে যায় সোহনীতো ওপারে পৌঁছতে পারবে না। এসব ভেবে গাধা প্রাণপণে নদী-তীরের দিকে দৌড়ে আসছিল। মালিক টের পেয়ে গেল যে, গাধা ছাড়া পেয়েছে। সে বন্দুক নিয়ে গাধার পিছনে দৌড়াল। দু’বার গুলী করল। গুলী খেয়েও গাধা সোহনীর বিপদের কথা ভুলতে পারল না। মাটির কলসী ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে যাবার আগে যদি সে নদীতে, ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে কতো ভাল হয়। জখমী পা নিয়ে সে প্রাণপণে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ চেনাবের দিকে দৌড়ে আসছিল। চেনাবে ভীষণ ঝড় তুফান। ওপার থেকে মাহিয়াল আকুল কণ্ঠে বলছে,
‘হায় সোহনী তুমি আমাকে ভুলে গেলে
তার জবাবে সোহনী চিৎকার করে বলল, ‘ম্যয় ক্যায়সে বেওফাই করুঙ্গী? ‘মেরা রেশতায়ে উলফত তো পাক্কা হ্যায়।’
ততক্ষণে গাধা একেবারে তীরে এসে পড়েছে। গাধা বলল, ‘মগার ঘড়াতো কাচ্চা হ্যায়।’
বলেই সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং শেষ শক্তিটুকু নিঃশেষ করে দিয়ে সামনের দিকে এগোবার চেষ্টা করে। কিন্তু গুলিবিদ্ধ পা নিয়ে সে এগোতে পারে না। ওদিকে মাঝপথে সোহনীর মাটির ঘড়া ভেঙে যায় এবং পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে সে। সোহনীকে বাঁচাবার জন্যে মাহিয়াল নদীতে লাফিয়ে পড়ে। তারপর পানি আর পানি। দু’জনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে তরঙ্গের মধ্যে ঢাকা পড়ে যায়। ওদিকে আহত গাধাও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে স্রোতের টানে টানে ভেসে যায়।
কাহিনী শেষ করে দাদা ধূমল রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। শেঠ ভুসুরীমল বলল,
‘কিন্তু এ কাহিনীতে সোহনী মাহিয়ালের চেয়ে গাধার কাহিনীই বেশি মনে হয়।
‘তা যাই হোক, কাহিনী কিন্তু বেশ জমজমাট। আমার রীতিমত গা কাঁটা দিয়ে উঠেছে।’
আমি বললাম।
‘কিন্তু কথা হচ্ছে, গাধা কোথায় পাওয়া যাবে? এমন চরিত্রের জন্য যেমন তেমন গাধা হলে তো চলবে না।’ সুমন বলল
দাদা বলল,
‘গাধার জন্যে আমরা আবার কোথায় যাব? গাধাতো আমাদের সামনেই।’ ‘আমি’’ আমি আঁৎকে উঠলাম।
‘হ্যা শেঠ, তুমি নিজেই যদি ছবিতে কাজ করতে রাজী হও আমাদের আর চাই কি?’
‘কিন্তু আমি যে গাধা। বড় বড় ফিল্মস্টাররা আমার সাথে কাজ করতে রাজী হবে?
‘আলবৎ হবে। কেন হবে না?’
‘কিন্তু আমি তো কোনদিন অভিনয় করিনি। তাছাড়া এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। বলতে গেলে এ ছবিতে আমিই হিরো।’
‘প্রথমত সব হিরোই গাধা থাকে। দু’চারটা ছবি নস্যাৎ করার পর তবে গিয়ে তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হয়। কিন্তু আপনি তো আর ওরকম হবেন না। বেশ পড়ালেখা জানেন, বুদ্ধি জ্ঞানও কম নেই। আপনি ভালই অভিনয় করতে পারবেন। আরে সাহেব, অভিনয় এক জিনিস, একবার নেমেই দেখুন না। দু’চার দিনেই বড় বড় হিরোদের নাক কান কেটে দিতে পারবেন। শেষে এমন হবে ছবি শেষ হবার আগে গণ্ডায় গায় লাখো টাকার কন্ট্রাক্ট আপনার পকেটে জমা হতে থাকবে।’
‘তা কি করে হয়? আমি কি আর কোন ফিল্মস্টার?’
‘আরে জনাব, ভাল মতো পাবলিসিটি পেলে গাধারও ফিল্মস্টার হতে কদ্দিন? আজকাল তো পাবলিসিটিই সব। আপনি মন দিয়ে কাজ করুন, আর দু’লাখ টাকা ব্যয় করে পাবলিসিটি করুন দেখবেন কি অবস্থা দাঁড়ায়। ‘ঠিক আছে, আমি অভিনয় করব।’ আমি বললাম।