দশ
দ্বিতীয় দিন ছক্কা-চৌকা কোনটাই লাগলো না। ছক্কা-চৌকা একেবারে মাঠে মারা গেছে। জুমন, গোলাব সিং আর সেতাব সিং ড্রইংরুমে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে। অবশ্য শেঠকে খুব হাসি-খুশি মনে হচ্ছিল। আজ আবারও নাকি সে দু’লাখ টাকা দাও মেরে দিয়েছে।
‘শেঠ দু’লাখ টাকা পেল কি করে?’ জুমন জিজ্ঞেস করলো। জুমন কেন? আমারও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, সেখানে চৌকা-ছক্কা কিছুই এলো না, শেঠ এত টাকা পেল কি করে? শেঠ মুচকি হেসে বলল,
‘তোমরা তো হৈ-হৈ করে চলে গেলে। তোমরা চলে গেলে আমি বেশ কিছুক্ষণ আরও চিন্তা করলাম। যোগী মহারাজ এত সোজা কথায় কি আর নাম্বার বলে দেয়? নিশ্চয়ই এতে কিছু কিন্তু আছে। অনেক চিন্তা ভাবনার পর গুরুজীর শেষ কথাটাই আমার বেশ মনে ধরল :
‘জু জিতা ইভি হারা
অর্থ একেবারে পরিষ্কার। অর্থাৎ হার-জিত সমান এজন্যে আমি বন্দীতে টিকেট ধরলাম।’
‘সাবাস শেঠ, আমি বললাম, ‘তুমি দেখছি আজকাল আমার সব কথা ধরে নিতে পার।’
‘তা কেন পারব না গুরু। সারা জীবন আপনার পদসেবা করেছি। কিছুই কি পাইনি এখানে?’ জুমন বলল,
‘ঠিক আছে এখন থেকে সাধু বাবার কথা শুনে তুমি যে নাম্বার ঠিক করবে আমিও তাই বলব শেঠ। আমার সাথে দালালী করো না যেন। হাতে বানানো নাম্বার বললে, ভাল হবে না বলছি।’
‘আজকে আমি কিন্তু নাম্বার টাম্বার বলাবলির মধ্যে নেই।’ আমি বললাম।
‘কেন যোগী মহারাজ, আমরা কোন অপরাধ করেছি?’ শেঠ দু’হাত জোড় করে বলল, ‘আসলে ব্যাপারটা হলো রোজ রোজ নাম্বার বলা আমার জন্য নিষেধ আছে। শুধু পূর্ণিমার দিনই আমি নাম্বার বলতে পারব।’
আমি ভেবে নিয়েছিলাম যেভাবে হোক আমাকে এ যাত্রা কোন রকম ইজ্জত রক্ষা করে যেতে হবে। এরপর যদি মদ খেয়ে অন্তর্ধান হয়ে নাম্বার বলতে থাকি, একদিন না একদিন ধরা পড়ে যাবই। এখানে দিব্যি আরামেইতো আছি। এভাবেই পূর্ণিমার ভাওতা দিয়ে আর মাস খানেক যদি নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে পারি দোষ কি? এরপর যা হয় হবে। আগামী পূর্ণিমাতেও যদি আমার অর্থহীন বকাঝকা থেকে ওরা কোন নাম্বার বুঝে নিয়ে কিছু পেয়ে যায় তাহলে তো পোয়া বারো। আর না পেলে মানে মানে কেটে পড়ব। আর নয়তো তখন ওরাই ডাণ্ডা মেরে বের করে দেবে এক সময়।
গোলাব সিং বলল,
‘শেঠ মাসে একবারও যদি আমার নাম্বার ঠিক ধরতে পারি সারা বছরের কোন চিন্তা করতে হবে না। আমি একবার এক পাগলা বাবার চক্করে পড়েছিলাম। গুরুজীতো তবু নাম্বার পষ্ট করে বলেন। কিন্তু তার কাছ থেকে নাম্বার বের করা বড়
ঝক্কির ব্যাপার ছিল। সারাদিন তেল মালিশ করেও কেউ কোন নাম্বার বের করতে পারতো না। সত্যি বলতে কি, তিনি কোন কথাই সোজা বলতেন না। তার আজব ধরনের ইশারা ইঙ্গিত থেকে নাম্বার বুঝে নিতে হতো। একেবার তো তিনি আমার মুখে পানের পিক দিলেন। আমি তক্ষুণি দৌড়ে গিয়ে পাঞ্জা ধরলাম। ধরতেই বাজীমাত—সেদিন তিনি হাতের লাঠি দিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলেন এক ঘা, আমি বুঝলাম এক্কা ধরতে হবে। লাঠি তো একের মতই সোজা কিনা। এবারও বেশ মালপানি পেয়ে বসলাম। বড় কামেল মানুষ ছিলেন। কিন্তু তারপরও হঠাৎ এক সময় তিনি এমন ডুব মারলেন যে কোন দিনই দেখা পেলাম না আর তাঁর। আজ তিনি থাকলে তাঁর জুতা সাফ করেই আমার ভাগ্য ফিরে যেত।’
‘চিন্তা করো না গোলাব সিং। আমাদের সাধু কম কিসে?’ পূর্ণিমার দিনে আমি সরাসরি অস্বীকার করে বললাম,।’
‘আজ আমি নাম্বার বলতে পারব না
‘কেন, মহারাজ আমরা কি অপরাধ করেছি।’
‘আজ হিমালয় থেকে আমার ডাক এসেছে। গুরু শুভ্রনাথ আমার উপর রেগে আছেন। কৈলাস পর্বতে আজ দু’হাজার বছর অবধি তিনি সমাধি আসনে বিরাজমান। আজকেই আমাকে হিমালয় রওনা দিতে হচ্ছে।’
‘কেন মহারাজ, আপনার উপর রেগে আছেন কেন তিনি?’
‘কারণ, আমি বোম্বেতে এসে আমার কর্তব্য ভুলে গেছি। তাঁর চাঁদা তুলবার জন্য তিনি আমাকে বোম্বে আসার আজ্ঞা করেছিলেন। হায় হায়, আমি সব ভুলে গেছি। তার জন্যে যে একুশ লাখ টাকা জমা করতে হবে। কি আশ্চর্য, কোথায় আমার কর্তব্য আর কোথায় তোদের পাঞ্জা-ছক্কা। তোরা আমাকে ডুবিয়েছিস।’
‘গুরু আপনি বলেন তো, কৈলাসের গুরুর জন্যে এক্ষুণি আমি এক লাখ টাকার চেক কাটছি ৷’ শেঠ বলল।
‘এক লাখ টাকায় কি হবে? আমার দরকার একুশ লাখ। আর গুরু বলেছেন একজনের কাছেই সব টাকাগুলো চাইতে। সে যদি দিতে না পারে, তাহলে আর কারো কাছে যেন না চাই।’
‘কিন্তু আমার কাছে তো একুশ লাখ নাই গুরুজী।’
শেঠ ভুসুরীমল অপরাধীর মত হয়ে বলল।
‘আমি কি তোমার কাছে একুশ লাখ চাই নাকি? আমি চাই আমার ধ্যান জ্ঞান থেকে তোমরা যেসব টাকা কড়ি পেয়েছ তার অর্ধেক টাকা আমার নামে ব্যাংকে জমা করতে থাক। জমা করতে করতে যখন একুশ লাখ হবে তখনই না হয় আমি হিমালয় রওনা দেব।’
‘আমার কোন আপত্তি নেই গুরু মহারাজ। আমি তো আপনার চরণের দাস। যা হুকুম করবেন তাই করব।’
নির্দিষ্ট সময়ে আবার মাহফিল বসল। বোতল বোতল হুইস্কি চলল ৷ আজ আমি এমন সব তন্তর মন্তর পড়ব যে, কারো ভাগ্যে যেন কিছু না পড়ে। এরপরও যদি কিছু পেয়ে যায় ওরা, তার অর্ধেক তো আমার জন্য বরাদ্দ রইলোই। তা না হলে ওরা আমার ওপর একটা না একটা অভিযোগ খাড়া করবে। ব্যস, এ যাত্রা কেটে গেলে আরো কিছু কালের জন্য নিশ্চিন্ত হতে পারি। শালার জগৎটাই এ ধারার। সততা এবং ভালমানুষীর অর্থই হলো সারা জীবন তুমি ভুখা থাকো এবং গাধা হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা যাও। এখন থেকে আমি ওদের মতোই ব্যবহার করব। ওদের মাথায় রেখেই কাঁঠাল ভেঙে খাব। নইলে আমার মত গাধার কোন উপায়ান্তর নেই।
নাম্বার বলার সময় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগলো আমার মাথায়ও রক্ত চড়ে যেতে লাগল।
কি রকম আহাম্মক আর মূর্খ এ লোকগুলো। পয়সার জন্যে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। এদের কাছে ধর্ম, রাজনীতি, কৃষ্টি, সভ্যতা এবং মানব জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তার কোন মানেই নেই। অর্থের সীমিত গণ্ডির মধ্যেই এদের আনাগোনা। আত্মার উপর অন্ধত্বের পট্টি বেঁধে বর্তমান, ভবিষ্যৎ, আর অতীতকে ভুলে লোভী কুকুরের মত অর্থের বেদীতে আত্মাহুতি দিচ্ছে। হতভাগাগুলো কেমন করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার মুখ থেকে কোন কথা বের হলে ঝাঁকে ঝাঁকে নোট ঝরতে থাকবে উপর থেকে। আমি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বললাম, শুয়োরের বাচ্চা হারামীগুলো …’
হঠাৎ ওরা চারজন এক পলকের জন্য চমকে উঠল। আবার নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল।
‘হতভাগা চামারগুলো খেটে খেতে চায় না, এক পয়সা দিয়ে দেশের উন্নতি করবে না। শুধু জুয়া, লটারী, রেস, স্মাগলিং, বদমাশী, চুরি, ডাকাতি, ঘুষ, জালিয়াতি, হত্যা সব রকম খারাপ কাজে লেগে আছে। তারপর আবার ন্যাকামী করে বলবে এদেশের উন্নতি হচ্ছে না কেন? এদেশের দারিদ্র্য কেন যায় না? লোকদের এত দুঃখ দুর্দশা কিসের? ব্যাটা চোর, বদমাশ, কুত্তা, কমিনা-কমজাত, শুধু রাতারাতি বড় লোক হবার শখ। শুধু নম্বর আর নম্বর, না, নম্বর আমি বলব না। কেন বলব? আমি পারব না নম্বর বলতে। যাও, যা ইচ্ছে তাই কর গিয়ে।’ রাগে আমার গা থর থর করে কাঁপছিল আর মুখ থেকে গরম ফেনা বের হচ্ছিল। আমি ক্ষোভে ঘৃণায় ওদের লক্ষীছাড়া পিশাচ চেহারাগুলোর দিকে চরম ন্যক্কারজনক কটাক্ষ হেনে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম এবং দাঁড়িয়ে ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগলাম।
সেতাব সিং বলল,
মিষ্টি, ‘গাধাটার হলো কি? আমাদের খেয়ে আমাদের গাল দিচ্ছে। ফলের রস, চা, কত খাবার আয়োজন, শোবার জন্য নরম বিছানা, থাকার জন্য সাজানো কামরা, টেলিফোন, ঝালর আরো কত আরাম আয়েশের উপকরণ ভোগ করছে, অথচ এমনভাবে আমাদেরকে গালি দিচ্ছে। আমি এক্ষুণি পিস্তল মেরে ওর জীবনলীলা সাঙ্গ করে দেব।’
জুমন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘রসো, সেতাব তুমি কিছুই বুঝ না। গুরুজী সাধে কি আর রেগেছে, নিশ্চয়ই আমরা কোন অপরাধ করেছি।’ গোলাব সিং মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল : ‘জুমন ঠিক বলেছে। অবশ্যি আমরা কোন অপরাধ করেছি, নইলে গুরু আমাদের গাল দেবে কেন?’ শেঠ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘আরে থামো না, কি হয়েছে? সাধুর গালিতো আকাশবাণী। তাঁর কথা নিয়ে মন ভার করলে চলে? তোমরা এখনো টের পেলে না সাধু বাবা তো নম্বর বলে ফেলেছেন?’
‘একি, নম্বর বলল আবার কোন সময়? শুধু গালিইতো দিল এতক্ষণ?’
‘গালিইতো দিলো কিন্তু পয়লাতেই কি গালি দিল খেয়াল করেছ কি?’
‘কেন শুয়রের বাচ্চা হারামী থেকে শুরু করে চোর, বদমাস, পাজী, কুত্তা সব গালিই তো দিল। তাহলে হিসাব করে দেখ প্রথমে দু’টি গালি এবং শেষের দিকে ছ’টি গালি।
এখনতো বেশ বুঝতে পারছ আজ ওপেন দুই এবং ক্লোজে হয় আসবে। সাধু বাবা আজ প্রাণভরে আমাদের গালি দিয়েছেন। আর আমরাও ইচ্ছামত দুই আর ছক্কাতে ধরব। সব পয়সা নিঃশেষ করে ধরব। বোম্বের সকল ধন দৌলত লুটে নেব আজ ৷’ শেঠ ভুসুরীমল-এর একথা শুনে সবার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত। একটা কিছু পেয়ে যাওয়ার মতো তারা খুশিতে আটখানা হয়ে উঠল।
আমি তাড়াতাড়ি করে আমার কামরায় চলে এলাম আর লোকগুলোর কাণ্ডকারখানা সম্পর্কে চিন্তা করতে লাগলাম। টাকার জন্য এরা কি না করতে পারে। টাকার জন্যে এরা গালি শুনতে রাজী। আমি মনে মনে বললাম, কালকে যদি এরা নম্বর মাফিক কিছু না পায় নির্ঘাত আমাকে পিস্তল মেরে শেষ করে ফেলবে। আমি এখন পালিয়ে বাঁচার জন্য মনে মনে অনেক ফন্দি আঁটলাম। কিন্তু কড়া পাহারায় থেকে তার কিছুই করা সম্ভব না। তাছাড়া রাত্রিবেলা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে যায়।
ভোরবেলায় যখন তালা খুলল, ভয়ে আমার গা কাঁপছিল। আমি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম, আমার সামনে চারজন ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে। আমি ভয়ে এক পা দুপা করে পিছু হটছিলাম। কিন্তু হঠাৎই ওরা হুমড়ি খেয়ে আমার পায়ের উপর পড়ল। আজকের মত বাজিমাত কোনদিনই হয়নি তাদের। জুমন সত্তর হাজার পেয়েছে। গোলাব সিং ত্রিশ হাজার। সেতাব সিং পঞ্চাশ হাজার আর শেঠ ভুসুরিমল তার সমুদয় পুঁজি দিয়ে টিকেট ধরেছিল, সে পেয়েছে পুরো চৌষট্টি লাখ টাকা।
বাপ্রে! এখন তারা খুশিতে ক্ষণে হাসছে, ক্ষণে কাঁদছে, ক্ষণে আমার পায় চুমু দিচ্ছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওরা পাগলের মত কি করছিল আমি তার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
‘ভগবান মালিক মহর্ষি দেবতা সাধু ফকির দরবেশ’,—আমি জোরসে একটা ধমক দিয়ে বললাম,
‘ভাগো এখান থেকে। আমাকে একা থাকতে দাও।’
হুকুম শুনে একসঙ্গে সবাই আমার পা ছেড়ে দিয়ে পিছে হটে গেল। এবং হাত জোড় করে কাঁপতে কাঁপতে পিছু হটে যাচ্ছিল। আমি ততোধিক গর্জন করে বললাম,
‘শেঠ তুমি যেও না, তোমার সাথে আমার কথা আছে।’ সবাই চলে গেলে আমি শেঠের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললাম, ‘সত্য সত্য বল কত টাকা পেয়েছ আজ?’
শেঠ মাথা নত করে বিনীতভাবে বলল,
চৌষট্টি লাখ টাকা গুরুদেব, মাত্র চৌষট্টি লাখ
‘আমার বত্রিশ লাখ আলাদা করে দাও।’
‘এখনি দিচ্ছি ৷’ বলেই শেঠ তার কামরায় চলে গেল এবং কাঁপা কাঁপা হাতে ট্রেজারী খুলে ৩২টা বাণ্ডিল এনে আমার পদপ্রান্তে জমা করল। সবগুলো হাজার টাকার নোট। এক সাথে এত টাকা দেখে আমার স্বর বদলে গেল। আমি প্রসন্ন হয়ে বললাম,
‘বেটা আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি তোর উপর। এজন্যে আমি তোকে দু’লাখ টাকা বখশিশ দিচ্ছি। এখান থেকে দুটা বাণ্ডিল তুলে নে। বাদ-বাকী টাকাগুলো নিয়ে আমার সাথে ব্যাংকে চল।’