“আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
এই পৃথিবীতে মানুষের জীবনদর্শন অতি সরল। বিশেষ কোন জটিলতা নেই, জীবন হলো দুঃখ-সুখের অসম বিভাজন। সুখের পৃথিবী, দুঃখের পৃথিবী। জ্ঞানী বলবেন, নির্ভেজাল সুখ বা নির্ভেজাল দুঃখ বলে কিছু নেই। একটা আবর্তন। একটা চাকা যেন! এই সুখে, তো এই দুঃখে। এই আলোয়, তো এই অন্ধকারে। সুখ-দুঃখের অতীত যে সমতট, সেটির প্রাপ্তি সাধন-সাপেক্ষ—যার কথা গীতায় (৭।১৩) শ্রীভগবান বলেছেন :
“ত্রিভির্গুণময়ৈভাবৈরেভিঃ সর্বমিদং জগৎ।
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্।।”
—ত্রিগুণজাত ভাব হলো—সুখ, দুঃখ, মোহ। এই গুণত্রয়ই সকল ভ্রান্তির উৎস। ঈশ্বর অথবা স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টির নিরূপাধিক স্বরূপ আবৃত করে রাখে। এরই নাম ‘মায়া’। আর এই মায়া দুরতিক্রমণীয়। “দৈবী হোষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।” (গীতা, ৭।১৪) শ্রীরামকৃষ্ণ মায়ার এই আবরণী-জগতে প্রবেশ করে প্রধান দুটি গেঁড় তুলে এনেছিলেন, যা এই গুল্ম-জগতের স্রষ্টা, সেই দুটি হলো—কাম আর কাঞ্চন।
মানবজীবন যেন একটি তরঙ্গধারণকারী গ্রাহক-যন্ত্র-’রিসিভার’। আবার চিত্রটি এমনও হতে পারে—একটা মানুষ ফাঁকা মাঠে বৃষ্টিতে অবিরাম ভিজছে। সেই বৃষ্টি কখনো মুষল, কখনো ঝিরিঝিরি। দুঃখ আর সুখের উপমা। মুষলে দুঃখ, ঝিরিঝিরিতে ফুরফুরে আনন্দ। তবে প্রকৃতি সেই এক—বৃষ্টি। বৃষ্টিতেই নিহিত প্লাবনের দুঃখ, ফসলের আনন্দ। আলাদা কিছু নেই। ধারাপাতেরই তারতম্য। তাহলে আছেটা কি? দুঃখ এক, সুখ এক? না! আছে, ইন্দ্রিয় আর প্রাপ্তি। কখনো সুখ হচ্ছে দুঃখেরই নামান্তর, আবার কখনো সুখ নয়, দুঃখই হচ্ছে সুখের নামান্তর। তাহলে এই দুটির জননী কে? তিনি হলেন মায়াদেবী। আর সব মানুষেরই অপর নাম স্বভাব। ঠাকুর বলছেন, উট কাঁটাগাছই খাবে, রক্তক্ষরণ হলেও খাবে। ঠাকুর এই উপমায় উটের স্বভাবযুক্ত মানুষকেই খুঁজে পেয়েছেন। আরো খুঁজলে পাওয়া যাবে সেই অমোঘ সত্য—সংসার দুঃখের আগার। ইন্দ্রিয় মানুষকে কোনভাবেই নির্ভেজাল সুখের আস্বাদন দিতে পারবে না। অসম্ভব। তার জন্য অন্য কোন ‘অ্যান্টেনা’র প্রয়োজন! সেটাই হলো ‘চৈতন্য’। চৈতন্য হলো সেই ‘স্পার্ক’, যা ‘পরাজ্ঞান’-এর উদ্দীপক। আলো জ্বেলে রাতের পর রাত বই পড়ে মানুষ ‘ইঞ্জিনিয়ার’ হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানলাভের জন্য প্রয়োজন চৈতন্যের আলো। এই আলোয় অধীত হবে কি? অধ্যয়নের নেই কিছু। পাঁজিতে বিশ আড়া জল, নিঙড়ালে কিছু নেই! জ্ঞানী শকুনি, দৃষ্টি ভাগাড়ে। চৈতন্যের আলোতে বিচার, সেই বিচারের চাবিতে দরজা খোলা এবং দেখা—বসে আছেন তিনি। বলছেন—”মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।” (গীতা, ৭।১৪) ঠাকুর বলছেন : “ঈশ্বরকে জানলে সব জানা হয়ে যায়।
আবার এক সংশয়—’সব জানা’ তাহলে কি? অনেক রকমের জানা আছে! রকম রকম জানা! না। ঠাকুর বলছেন : “ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। এইটাই হলো জানা। তারপর আরো একটু এগিয়ে জানালেন সেই শ্রেষ্ঠ মন্ত্ৰঃ “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন।” আমার নিজস্ব কোন অনুসন্ধান নেই। তার অর্থ অতি ভয়ঙ্কর—’আমি থাকি’। এই ‘থাকা’ শব্দটা এক্ষেত্রে পর্বতের চেয়েও ভারী, আবার শোলার চেয়েও হালকা। মা যদি আমার স্থল হন, তাহলে আমি পর্বতের মতো, মহীরুহের মতো স্থাপিত। মা যদি আমার জল হন, তাহলে শোলার মতো আমি ভাসমান। মা যদি আমার বাতাস হন, তাহলে আমি ত্রসরেণু। যখন পর্বত তখন আমি অচল, অটল, সংশয়হীন বিশ্বাস। আমি যখন শোলা তখন আমার নাম সমর্পণ—’টোটাল স্যারেন্ডার’। আমার মা সব জানেন। তখন আমি বিড়ালের ছানা। মা যেখানে রাখেন! মিউমিউ ডাক ছাড়া আমার দ্বিতীয় আর কর্ম নেই। আমার নিজের কোন ‘চয়েস’ নেই, পছন্দ-অপছন্দ নেই। ‘ইগো সেল্ফ’, ‘কাঁচা আমি’টা পেকে ‘পাকা আমি’ হয়ে আছে। সে এক অভাবনীয় ভয়ঙ্কর মৃত্যু। আমার ‘আমি’ ‘তুমি’ হয়ে গেছে। বলদটার মৃত্যু—”নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু”। এটি সমাধির চেয়েও কঠিন এক অবস্থিতি। “যা করেন কালী সেই সে জানে।” এর মধ্যে আনন্দ নেই, আছে ‘পরমানন্দ’। বাঙলায় ‘পরম’ আর ‘পরা’ যুক্ত যে-কয়টি শব্দ-ধারণা আছে, তার দাতা এই পৃথিবীর কেউ হতে পারেন না, একমাত্র সেই ঈশ্বরীই পারেন দিতে। পরমানন্দেই দেবেন পরম আনন্দ, অক্ষয় ধন পরম ধন, পরম জ্ঞান পরাজ্ঞান।
আর আমি যখন ভাসমান ত্রসরেণু, তখন আমি চৈতন্যের কিরণে এক পরম ভক্ত। আমি ভাসতে ভাসতে দিশাহারা হয়ে ছিটকে যাচ্ছি না, আমি চৈতন্যের বৃত্তে নৃত্যপর সাক্ষাৎ শ্রীচৈতন্য।
আমরা সবাই আছি, মরার জন্যই আছি। ঠাকুরের এই ‘থাকা’-র নামই ‘যোগ’। আমি যোগে থাকি। সামান্য মানুষের মতোই খাই-দাই, তবে যোগে থেকে খাই। সে-খাওয়াটা তখন ‘অর্পণ’। “আহার কর মনে কর আহুতি দিই শ্যামা মাকে।” “ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবিব্রহ্মাণৌ ব্রহ্মণা হুতম্”। (গীতা, ৪।২৪ )
“আমি খাই-দাই আর থাকি”–এ যে কত বড় অর্থবহ এবং উপলব্ধির অতি সরল প্রকাশ, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। পৃথিবী ছেড়ে পালাচ্ছি না, গেরুয়া বা কৌপীন পরে পর্বত-কন্দরে কুম্ভক সহায়ে সমাধিমার্গের অন্বেষণ করছি না। আমি এই সুখ-দুঃখের গলিত, রক্তাক্ত পৃথিবীতে কোটি মানুষেরই একজন— ‘সাফারার’। আমি ‘ক্রাইস্ট’–ক্রুশবিদ্ধ হব জানি। আমার ব্যাধি আছে, এমনকি ক্যান্সারও হবে। মানুষের আঘাত, চক্রান্ত, দেওয়া দুঃখের বৃত্তে আমার অবস্থান। আমি পালাই না, আমি থাকি। যথেষ্ট ভার নিয়েই থাকি—আমি আবার ‘ভারী’ও। অন্যের দুঃখ বহন করি, দর্শন করি, নীরবে অশ্রু বিসর্জন করি। জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধির এই নীরব, নিভৃত নদীর ধারেই আমার কুটির। আমার জীব- অনুভূতিতে সবই আমি অনুভব করি। কিন্তু আমি পালাই না বুদ্ধদেবের মতো। মহাপ্রভুর মতো মহাভাবে আমি আমার ভাবজগতে অচৈতন্য হয়ে থাকি না। আমি সাধারণের চেয়েও সাধারণ, তাই কি তোমরা আমাকে অসাধারণ বলবে! না! এই ‘থাকা’টাই আমাকে দান করছে সেই দেবদুর্লভ ধন, যার নাম ‘প্রেম’। জীবন-নদীর দুই পারের মাঝে, ধরে নাও, আমি এক সেতু। প্রেমের সেতু। তলায় প্রবহমান মহাকাল। সেতুর ওপারে লেখা-প্রেম নিয়ে যাও ঐ জীবনতটে। প্রেমসে বেঁচে ফিরে এস মৃত্যুর তটে। আমি এক প্রেমিক মাঝি। আমি পারাপার করাই। জীবন-নদীর ধারে এক জেলে। মাছ-গুলোকে ধরার চেষ্টা করি। ধরতে পারলে মুছে পরিষ্কার করে আবার ঐ প্রবাহেই ছেড়ে দিই।
মায়াকে চিনে মায়ায় থাকা। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙা। শ্রীরামকৃষ্ণ ‘টেকনোলজিস্ট’। ধর্মের সারকথা নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্ম। সংসারের বাইরে থেকে সংসারী। “রমণীর সঙ্গে থাকে, না করে রমণ।”
শ্রীরামকৃষ্ণ বলবেন, সংসার তার শতসহস্র থাবায় আমাকে ধরতে চায়। আমি পাঁকাল মাছ—পিছলে যাই। আমার মন পড়ে আছে নিজ নিকেতনে, আমি থাকি সংসার-বিদেশে। মুক্তি? সে আমার মা জানেন। বরং যে-জিনিসটি দিতে তিনি বড়ই কাতর, সেই ভক্তির সাধন করি। কলিতে নারদীয় ভক্তি। তুমি ভগবান, আমি তোমার ভক্ত। ‘কাঁচা আমি’কে ‘পাকা আমি’ করা যদি শক্ত হয়, থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে। ভূতকে চিনতে পারলে ভূতের ভয় আর থাকে না। সংসারকে চিনতে পারলে সংসার-ভীতি আর থাকবে না। সংসার হলো আমড়া—আঁটি আর চামড়া, সারবস্তু কিছু নেই।
এই চেনার মধ্যে দুটি চেনা আছে—নিত্যকে চেনা আর অনিত্যকে চেনা। অনিত্য হলো সংসার, যার কিছুই থাকে না, সঙ্গে যায় না। আর নিত্য হলেন ঈশ্বর, যাঁর এই সৃষ্টি, যে-মায়াপ্রপঞ্চের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনি বসে আছেন। যিনি একাধারে লয়, বিলয় ও নিলয়। মাকড়সা ও তার জাল। মাকড়সা বসে আছে সেই জালে। জালের মাকড়সা নয়, মাকড়সার জাল। মায়ার ব্রহ্ম নয়, ব্রহ্মের মায়া। বুদবুদের জল নয়, জলের বুদবুদ। তিনি সাকার, তিনি নিরাকার, তিনি বহুরূপী।
আচ্ছা! এসব যদি নিতান্তই কেতাবি ও কঠিন লাগে, যদি এমন প্রশ্ন জাগে— যাদের কিছু আছে তারাই এইসব ‘ফ্যাশনেবল’ ব্যাপার নিয়ে চোখ উলটে, গদগদভাবে বসে থাকতে পারে। এই উপদেশ শিক্ষিত কিছু বড়লোকের জন্য। যাদের কাল কি করে হাঁড়ি চড়বে জানা নেই, তাদের কি হবে? অন্নচিন্তা চমৎকারা, কালিদাস হয় বুদ্ধিহারা!
শ্রীরামকৃষ্ণ বলবেন, ঠিক! এইটাই প্রকৃত প্রশ্ন। দারিদ্র্যের মতো দগদগে দুঃখ পৃথিবীতে আর কি আছে? এইটাই তো জীবের ‘ক্যাপটিভিটি’। মৃত্যু একটা ‘প্রসেস’। ‘ছিল’ ‘নেই’ হয়েছে। মিটে গেছে মামলা। কিন্তু দারিদ্র্য হলো ‘সাফারিং’। সমস্ত ‘নেগেটিভ থটস’-এর উৎস। ধর্মে পাপী-পুণ্যাত্মার বিভাজন নেই। তিলক ধারণ করে তুলসীর মালা পরলেই ধার্মিক—আমি তা বিশ্বাস করি না; বরং আমি গান গেয়ে বলব—”মনে বাসনা থাকিতে কি হবে বল না জপিলে তুলসীমালা!” বরং সেই মানুষটি দেখনদার ধার্মিকের চেয়ে সহস্র গুণ বেশি ধার্মিক, যে খায়-দায় আর থাকে। কুৎসিত, ক্ষতিকারক চিন্তা যার মনে কখনো আসে না। তবে ‘বোধ’। বোধকে তো অস্বীকার করা যায় না। ‘আমি’ বোধ থাকলে ‘তুমি’ বোধও থাকবে। যেমন যার আলো-জ্ঞান আছে, তার অন্ধকার- জ্ঞানও আছে; যার পাপ-জ্ঞান আছে তার পুণ্য-জ্ঞানও আছে; যার ভাল-বোধ আছে তার মন্দ-বোধও আছে। কথাটা পাপ-পুণ্যের নয়। সমস্ত সমস্যার উৎস ‘আসক্তি’। ‘প্রবৃত্তি’ আর ‘নিবৃত্তি’। বিষয়াসক্ত মানুষ তার যাবতীয় বিষয় আসয় নিয়ে অন্ধকারে পোকার মতো কিলবিল করছে। আবার বিষয়-আসক্তিশূন্য হতদরিদ্র বসে আছে ঈশ্বরের কোলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলবেন, আমি উচ্চকণ্ঠে বলছি তো—খালি পেটে ধর্ম হয় না। ভাত, কাপড়, আশ্রয়, পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ—প্রাথমিক কর্তব্য। সেই অর্থে সংসার অবশ্যই আগে। তবে সেখানে একটাই কথা—একালে যেমন আত্মরক্ষার জন্য বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে, সেখানেও একটা জ্যাকেট পরতে হবে। অবশ্য এখানে ‘আত্মা’র অর্থ দেহ। ইংরেজী ‘সেল্ফ’ ‘সোল’ নয়, সেইরকম মনটিকে ঘাতসহ, উদ্যমী করার জন্য ‘বিশ্বাস’-এর জ্যাকেট ধারণ করতে হবে। ‘ফেথ’।
এইবার আকাঙ্ক্ষাটা কি হবে? যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই, তার অধিক নয়। অধিকের আকাঙ্ক্ষাই আবার দুঃখের। সেই অর্থে, যার অনেক আছে সে, যার কিছুই নেই তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখী। একালের ভাষায় অনেক বেশি ‘ফ্রাসট্রেটেড’–জ্বলন্ত অঙ্গার। ছাই হয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না। বিচারই মানুষকে জ্ঞানী করে। আর সেই জ্ঞানই ঈশ্বরের দৌবারিক। গোটাকতক ঘরে— সে যত বিশালই হোক, গোটাকতক ব্যাঙ্কে, হে মানব, তুমি পৃথিবীর অফুরন্ত, অসীম ঐশ্বর্যের কতটুকুই বা সঞ্চিত করতে পারবে! আকাঙ্ক্ষা তো তোমার মনে! সেখানে অনবরত, অবিরত বিষয়ের অদৃশ্য পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধেই চলেছ! পায়রার ছানার গলায় হাত দিলে যেমন মটর গজগজ করে, সেইরকম বদ্ধজীবের সঙ্গে কথা কইলে টের পাওয়া যায়, বিষয়-বাসনা তাদের ভিতর গজগজ করছে। দারিদ্র্য দুঃখের, তার চেয়েও দুঃখের এই আকাঙ্ক্ষা আকাঙ্ক্ষাশূন্য বিশ্বাসী মানুষের দারিদ্র্য-দুঃখ কেন, কোন দুঃখই থাকে না। নিজের কোন অবস্থাই নিজে ফেরানো যায় না। তিনি যা করেন তাই হয়। আর সেটা হাসি মুখে মেনে নিতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলবেন, একালে বলবে—আপনি আমাকে ভাগ্যবিশ্বাসী হতে বলছেন? একেবারেই না। আমি কেবলই বলছি—’বিশ্বাসে’ বিশ্বাসী হও। সেই থেকে আসবে একটি আধ্যাত্মিক অমূল্য সম্পদ—’রোক’। আমি পাবই। আমি মায়ের সন্তান। তবে কোদাল ধরতেই হবে, আলস্য নামক তামসিকতার আল কেটে জল আনতে হবে খেতে। কাটতে হবে, খুঁড়তে হবে। ভেটকে বসে ‘গেলুম’, ‘গেলুম’, ‘মলুম’, ‘মলুম’ করলে সর্ব অর্থেই তামসিক মৃত্যু তোমাকে ঘিরে আসবে। তোমার বিশ্বাসই তোমার ইষ্ট, দেহই তোমার মন্দির, পবিত্রতাই তোমার আদর্শ। দানের চেয়ে দাতা বড়। সেই দাতাকেই চাইতে হবে। লোভ নয়, নির্লোভ। পূজা, আরতি, ত্যাগ, বৈরাগ্য সব ভিতরে। ‘গীতা’ ‘গীতা’ বারেবারে বললেই বেরিয়ে আসবে গীতার সার’তাগী’ ‘তাগী’। ত্যাগীর মনোবৃত্তি নিয়ে আমার অবস্থান। মনে রাখতে হবে—সংসারে থাকতে গেলেই সুখ-দুঃখ আছে, একটু-আধটু অশান্তি আছে। কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে একটু কালি লাগবেই।
ঠাকুর বলবেন, এইবার আমার কথা নয়—আমার জীবন দেখ। গুরু, কর্তা, বাবা—এই তিন কথায় আমার গায়ে কাঁটা বেঁধে। আমি এক সর্বত্যাগী ধার্মিকের সন্তান। নির্ভীক, সত্যবাদী এক পিতা, ধনীর শত্রুতায় ভিটেছাড়া। মানুষ রামকৃষ্ণ গোলাপ-বিছানো পথে পরমহংস হননি। যিনি পাঠিয়েছিলেন তিনিই তা চাননি। এমনকি একালের সবচেয়ে উৎকট ব্যাধি বসিয়ে দিয়েছিলেন গলায়। কেন? উদাহরণ। মানুষ চাইবে মেহনতি সাধু। যিনি মরতে মরতে বলবেন—ঈশ্বরই সব। বলবেন—সন্ন্যাস! সে তো আছেই, গৃহীরা কেন বঞ্চিত হবে পরমানন্দ থেকে।
ঠাকুর বলবেন, “না গো! তোমাদের সব ত্যাগ করতে হবে কেন? তোমরা রসেবশে বেশ আছ। সা-রে-মা-তে। তোমরা বেশ আছ।”
অতএব কেবল জপে যাও সেই রামকৃষ্ণ-মন্ত্র—”আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন।”